অর্থতৃষ্ণা – শেষ অংশ
অর্থতৃষ্ণা উপন্যাসের প্রথম অংশ
পরের দিন সকালে একটু বেলা বাড়তেই খবর আসে, ইন্সপেক্টর শিউলাল দ্বিবেদী এসেছেন, দেখা করতে চান।
– চলো।
টেবিল থেকে একটা খাম তুলে নিয়ে পা বাড়ায় ধূর্জটি।
পেছনে দুহাত রেখে উঠোনে দাঁড়িয়েছিলেন শিউলাল দ্বিবেদী।
– নমস্কার ধূর্জটিবাবু।
– নমস্কার শিউলালজী। একেবারে সকালবেলাই!
– হ্যাঁ। জবানবন্দী নেওয়ার ছিল কয়েকজনের। তাছাড়া মামলার নিষ্পত্তি না হওয়া অবধি গিরিজাপ্রসাদের ঘরটাও সীল করে দিলাম।
চারপাশে একবার তাকিয়ে নিয়ে হাতের খামটা ইন্সপেক্টর শিউলালের দিকে বাড়িয়ে ধরে ধূর্জটি।
– শিউলালজী, আমার কয়েকটা খবর দরকার। কি দরকার আমি লিখে দিয়েছি। আপনি যদি এই খবরগুলো আমাকে যোগাড় করে দিতে পারেন, আমার তদন্তের সুবিধে হয়।
খাম খুলে কাগজটাতে একবার চোখ বোলান ইন্সপেক্টর শিউলাল।
– এগুলো যোগাড় করতে কিন্তু দিন কয়েক সময় লাগবে। বুঝতেই পারছেন শহর থেকে আমরা অনেক দুরে।
– বুঝতে পারছি। তবে যতটা তাড়াতাড়ি পারেন করুন। কারণ এই কাহিনীর মূল চরিত্রটিকে পাকড়াও করতে যত দেরি হবে, তত হয়ত প্রাণহানি হবে।
নমস্কার করে বিদায় নেন ইন্সপেক্টর শিউলাল।
এর পরের দুটো দিন কাটে মন্থর গতিতে। বাড়ির ফটক বন্ধ। স্বয়ং সৌমেন্দ্রনানারায়ণের হুকুম ছাড়া কারোর বাইরে বেরোনোর বা ভেতরে ঢোকার অনুমতি নেই, গোটা বাড়িটা যেন একটা দুর্গের চেহারা নিয়েছে। কোন আসন্ন বিপদের আশঙ্কায় সবাই উদ্বিগ্ন, তাদের সবার ভীতি আর দুশ্চিন্তা যেন জমাট বেঁধে ভারী করে তুলেছে বাতাসকে।
এই গৃহবন্দী জীবন যখন প্রায় অসহ্য হয়ে এসেছে, তখন তৃতীয় দিনের সকালবেলা একজন পুলিস কন্সটেবল এসে ধূর্জটিকে সেলাম করল। তার হাতে একটা বড় খাম।
– শিউলালজী নে ভেজা হ্যায়।
খামটা হাতে করে সটান ঘরে ঢুকে পড়ে ধূর্জটি।
-যতীন, দরজাটা বন্ধ করে দাও।
আমি দরজা বন্ধ করে দিলে সন্তর্পণে খামটা খোলে ধূর্জটি, ভেতরে থেকে টেনে বের করে আনে এক গোছা টাইপ করা কাগজ।
একটার পর একটা পাতায় চোখ বুলোতে থাকে ধূর্জটি আর তার মুখে ধীরে ধীরে পরিস্ফুট হতে থাকে সেই অদ্ভূত হাসিটা।
শেষ পাতাটায় চোখ বুলিয়ে কাগজের তাড়াটা আবার খামে পুরে ফেলে ধূর্জটি। তার মুখের সেই অদ্ভূত হাসিটা তখনো অটুট।
– কিছু বুঝতে পারলে?
প্রশ্ন করি উদ্বিগ্ন কণ্ঠে।
– বুঝেছি বই কি! পাক্কা বুঝেছি! সব একেবারে যাকে বলে জলবৎ তরলং।
– তবে –
খামটার দিকে হাত বাড়াই আমি।
– উঁহুঃ! আরো কয়েকটা জিনিষ মিলিয়ে নিতে হবে আগে।
খামটা সুটকেসে ভরে তালা বন্ধ করে ফেলে ধূর্জটি।
– কিন্তু তার আগে বলো তুমি ‘গম’ কথাটার কিছু মানে খুঁজে পেলে?
সত্যি কথা বলতে কি কয়েকদিন ভেবে সুগম, দুর্গম পার করে বেগম, নিগম, পয়গম অবধি দু-একটা শব্দ মাথায় এলেও সাম্প্রতিক ঘটনাক্রমের সঙ্গে তাদের কোন তাৎপর্য্য খুঁজে পাই নি। কিন্তু ধূর্জটির সামনে এই মুহূর্তে হেরে যেতেও মন চাইছিল না, সুতরাং বললাম,
– অর্থাগম! শব্দটা অর্থাগম হবে। খুব সম্ভব বণিক গিরিজাপ্রসাদকে অর্থাগমের টোপ দিয়ে ডেকে পাঠানো হয়।
ভ্রু কুঁচকে আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে ধূর্জটি।
– কি আশ্চর্য! কল্পনাও যে অনেক সময়ে যুক্তির কাছাকাছি আসতে পারে এটা তোমার সাহচর্য্য না করলে জানতেই পারতাম না।
– তাহলে শব্দটা অর্থাগমই?
– ঠিক তা নয়, তবে কাছাকাছি গেছো! যাক চলো!
– কোথায়?
– লাইব্রেরীতে। উপেনের সঙ্গে একটু গল্প করে আসি।
– উপেন? উপেন কেন?
– দরকার আছে। আরে চলোই না!
লাইব্রেরীতে ঢোকার মুখে একজন ঝাড়পোঁছ করছিল, তাকে উপেন কোথায় জিজ্ঞেস করতে সে হেসে লাইব্রেরীর শেষ প্রান্তের দিকে দেখাল।
– ওই যে ওইখানে। রঘুকে বল খেলা শেখাচ্ছেন।
কলগোলামকে বল খেলা শেখানো! মনের ভেতরে খানিকটা কৌতূহল নিয়ে লাইব্রেরীতে পা রাখলাম।
লাইব্রেরীর শেষ প্রান্তে একটা উঁচু গরাদবিহীন জানলা। তার পেছেন সবুজ বনানীর ওপর ঝকঝক করে নীল আকাশ। জানলার একপশে দাঁড়িয়ে কলগোলাম রঘু, অন্যপাশে দাঁড়িয়ে উপেন, তার হাতে একটা বল।
আমি উপেনের দিকে এগোতে যাচ্ছিলাম ঠোঁটে আঙুল রেখে আমাকে বাধা দিল ধূর্জটি।
– কথা বলো না। দেখে যাও।
দেখলাম উপেন বলটা কলগোলামের দিকে ছুঁড়ল। কলগোলাম বলটা ধরার চেষ্টা করেও ধরতে পারল না, ফস্কে গেল।
আগে লক্ষ করিনি, এখন খেয়াল করলাম, এক পাশে একটা টুলের ওপর একগোছে হলেরিথ কার্ড রাখা। একটা হলেরিথ কার্ড তুলে নিল উপেন, কামিজের পকেট থেকে বের করল একটা মোটা ছুঁচ। দ্রুত হাতে হলেরিথ কার্ডে কয়েকটা পরপর ফুটো করে ভরে দিল কলগোলামের বুকের চেরা ফুটোয়। তারপর বলটা কুড়িয়ে নিয়ে চলে গেল নিজের জায়গায়।
ফের বল ছুঁড়ল উপেন, এবার কোনরকমে বলটা ধরতে সক্ষম হল কলগোলাম। আবার নতুন একটা হলেরিথ কার্ড ফুটো করে কলগোলামের বুকে পুরে দিল উপেন। এবং আবার ছুঁড়ল বল।
এবার কলগোলাম বলটা ধরে ফেলল অনেকটা অনায়াসেই।
চলতে থাকে উপেনের কলগোলামকে বল ধরা শেখানোর পালা। আমরা দাঁড়িয়ে দেখতে থাকি মন্ত্রমুগ্ধের মত।
মিনিট পনেরো পর মুখ দিয়ে একটা আনন্দের আওয়াজ করে উপেন। কলগোলাম প্রত্যেকবারই লুফে নিচ্ছে বল, একবারও ফস্কাচ্ছে না।
হাততালি দেয় ধূর্জটি। আমাদের দিকে তাকিয়ে লাজুক হাসি হাসে উপেন।
উপেনের দিকে এগিয়ে যায় ধূর্জটি
– উপেন, রঘু তোমার খুব বন্ধু?
ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানায় উপেন।
– উপেন, যখন রঘু বিগড়ে যায় তখন পীতাম্বর বলে যে রঘুকে সারাতে এসেছিল তাকে তুমি চিনতে?
আবার মাথা নেড়ে সম্মতি জানায় উপেন।
– তোমাকে পীতাম্বর বলেছিল রঘুর কি হয়েছিল?
ফের মাথা নেড়ে সম্মতি জানায় উপেন। তারপর একটা হলেরিথ কার্ডে দ্রুতগতিতে কয়েকটা ছিদ্র করে পুরে দেয় কলগোলামের বুকের ফোকরে।
শরীরের অভ্যন্তরে যান্ত্রিক আওয়াজ তুলে কলগোলাম বুকের ফোকর থেকে উগরে দেয় একটুকরো ছাপানো কাগজ।
হাতে তুলে নিই কাগজটা। দেখি ইংরেজী অক্ষরে লেখা রয়েছে ‘লাইট’।
– লাইট! মানে আলো? আলোর সঙ্গে কলগোলাম বিগড়োনোর সম্পর্ক কি?
ধূর্জটির মুখে ফুটে ওঠে আবার সেই অদ্ভূত হাসিটা।
– সম্পর্ক? সম্পর্ক আছে বৈকি! বুঝ জন যে জান সন্ধান!
আমি ফের ধূর্জটিকে বলতে যাচ্ছিলাম হেঁয়ালী ছেড়ে সোজা কথায় আমাকে বোঝাতে, কিন্তু তার আর সুযোগ পেলাম না। সাইরেনের তীক্ষ্ণ আওয়াজ তুলে কলগোলাম হঠাৎ একপাশে সরে এসে তার বিশাল শরীরটা দিয়ে আড়াল করে দাঁড়াল ধূর্জটিকে, তার মাথার আলো দুটো তখন দানবিক চোখের মতন দপদপ করে জ্বলছে। আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই জানলা দিয়ে বর্শার আকারের কোন একটা অস্ত্র একটা ধাতব আওয়াজ তুলে আঘাত করল তার বুকে।
সেই ভয়ঙ্কর আঘাতের ধাক্কায় কলগোলাম এক পা হটে গেল, কিন্তু পড়ল না। টাল সামলেই দুহাতে আঁকড়ে বুকের ওপর থেকে তুলে ফেলল বর্শাটাকে। হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে খেয়াল করলাম কলগোলামের চোখের আলোর দপদপানির সঙ্গে তাল রেখে ওঠা পড়া করছে সাইরেনের আওয়াজ আর দুইহাত মুঠো করে তাকিয়ে রয়েছে উপেন, তার চোখ দিয়ে যেন আগুন ঝরে পড়ছে।
আর তার মধ্যেই বর্শাটা ধীরে ধীরে পাল্টে যাচ্ছে একটা কুণ্ডলী পাকানো সাপে। তবে সাপ হলেও তার পিঠে বসানো একজোড়া বাদুড়ের মতন ডানা।
হাত থেকে সাপের কুণ্ডলীগুলোকে ছাড়িয়ে সাপটাকে মাটিতে আছড়ে ফেলে কলগোলাম। তার একটা ধাতব পা হাতুড়ির মতন নেমে আসে সাপের মাথায়।
ছিটকে আসে সামান্য রক্ত, একবার দুবার ছটফট করে নিথর হয়ে পড়ে সাপের প্রাণহীন দেহ।
অগ্নিঝরা দৃষ্টি নিয়ে তখনও সাপটার তাকিয়ে উপেন।
থামে সাইরেনের আওয়াজ। নিভে যায় কলগোলামের চোখের আলো।
প্রায় ছুটতে ছুটতেই এসে পৌঁছন সৌম্যেন্দ্রনারায়ণ।
– কি হয়েছে? সাইরেনের আওয়াজ পেয়ে দৌড়ে এলাম। কেঊ চোট পাননি তো?
মেঝেয় পড়ে থাকা সাপটার দিকে ইঙ্গিত করে ধূর্জটি।
– আপনার ভাইয়ের কলগোলামের জন্য আজ প্রাণে বেঁচে গেছি। আন্দাজ করতে পারি, এটা আমার উদ্দেশ্যেই ছোঁড়া হয়েছিল।
জুতো দিয়ে ডানাওয়ালা সাপটাকে উল্টে দেন সৌম্যেন্দ্রনারায়ণ।
– কি এটা?
খুঁটিয়ে দেখে সাপটাকে ধূর্জটি।
– জ্যাকুলাস! জ্যাভেলিনের মতন এক ছোঁড়া যায় বলে ওই নাম হয়েছে। পুরাকালের গ্রীক আর রোমান মন্ত্রঘাতকদের প্রিয় অস্ত্র। মন্ত্রপাঠ করে শিকারের উদ্দেশ্যে ছুঁড়ে দিলে, নিজেই তার মর্মস্থলে খুঁজে নিয়ে আঘাত করে। লুকানের ফার্সালিয়া কেতাবে এর প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায়।
– কি ভয়ঙ্কর! এ জিনিষ দুলমিগড়ে এল কোথা থেকে?
– আপনার গোপন শত্রুটির তূণীরে ছিল। তার যে হাত অনেক লম্বা বোঝাই যাচ্ছে।
উপেনের দিকে ফেরে ধূর্জটি।
– উপেন, রঘু অমন লাফিয়ে পড়ে আমাকে বাঁচাতে গেল কেন? তুমি কি রঘুকে ট্রেনিং দিয়েছিলে?
মৃদু হেসে মাথা নাড়ে উপেন। তারপর এগিয়ে গিয়ে কলগোলামের বুকে পুরে দেয় একটা হলেরিথ কার্ড। ঘড়ঘড় আওয়াজ তুলে কলগোলামের বুকের ফোকর থেকে বেরিয়ে আসে একটা ছাপা কাগজ।
কাগজে ইংরেজী অক্ষরে লেখা ‘প্রোটেক্ট’।
সপ্রশংস দৃষ্টিতে ভাইয়ের দিকে তাকান সৌমেন্দ্রনানারায়ণ।
– হ্যাঁ আমাদের উপেন বীরপুরুষ। উপেন আমাদের সবাইকে রক্ষা করবে।
একজন কর্মচারী এসে উপেনের হাত ধরে।
– চলো দাদাবাবু। মা ঠাকরুণ ডাকছেন।
আমাদের দিকে হাত নেড়ে কলগোলাম সঙ্গে করে বিদায় নেয় উপেন।
সৌমেন্দ্রনানারায়ণের দিকে ফেরে ধূর্জটি।
– কুমারবাহাদুর, আপনার শত্রুর দুঃসাহস দিনের পর দিনে বেড়ে চলছে। আর অপেক্ষা করা ঠিক হবে না। এই ষড়যন্ত্রের মূল পাণ্ডাটিকে যদি খুব তাড়াতাড়ি তার চারপাশের গোপন অন্ধকার থেকে আলোয় টেনে আনতে না পারি তাহলে আবার হয়ত প্রাণহানি হবে। আমার একটা অনুরোধ আপনাকে রাখতে হবে।
– বলুন।
– আমি চিত্তকে দু-একদিনের জন্যে কলকাতা পাঠাতে চাই। আমার হয়ে কয়েকটা খবর জোগাড় করে আনবে। এই মুহূর্তে আমি অন্য কারোর ওপরে ভরসা করতে পারছি না।
– অবশ্যই। আমি চিত্তকে আপনার কাছে পাঠিয়ে দিচ্ছি, আপনি যা বোঝার ওকে বুঝিয়ে দিন।
– আর একটা অনুরোধ ছিল। আপনার উইঞ্চেস্টার রিপিটার রাইফেলটা কয়েকদিনের জন্যে ধার নিতে চাই। আর একটা টোটা সমেত কার্ত্তুজের বেল্ট।
কপাল কোঁচকান সৌম্যেন্দ্রনারায়ণ।
– আপনি কি টিপ প্র্যাক্টিস করবেন? তাহলে –
মৃদু হাসে ধূর্জটি।
– আপনার চিন্তা নেই। আমি বাড়ির মধ্যে বন্দুক দাগব না। কয়েকটা জিনিষ পরীক্ষা করতে চাই কেবল।
– বেশ। আমি বন্দুক চিত্তর হাত দিয়েই পাঠিয়ে দিচ্ছি।
দুপুরের খাওয়ার পর চিত্ত আমাদের ঘরে এসে হাজির হল।
– এই নিন রাইফেল আর কার্ত্তুজ। আর কলকাতায় কখন যেতে হবে যদি বলেন।
– কাজটা খুব জরুরী চিত্ত। আজ রাতেই তোমায় রওনা দিতে হবে। পারবে তো।
– নিশ্চই। কলকাতায় আমায় কি করতে হবে?
– বলছি। চলো।
ঘাড়ে বন্দুক আর আর কার্ত্তুজের বেল্ট ফেলে চিত্তর সঙ্গে সেই যে ধূর্জটি বেরিয়ে গেল, তারপর থেকে তার টিকিটি আর দেখতে পেলাম না।
বিকেলের দিকে ধূর্জটির খোঁজে নিচে নেমেছি, দেখি সুকুমারবাবু খবরের কাগজ হাতে করে কোথায় যাচ্ছেন। আমাকে দেখে ব্যস্ত হয়ে এগিয়ে এলেন।
– দেখুন দিকি কি অবস্থা! কার নজর লেগেছে এ বাড়িতে। আপনারা অতিথি মানুষ দুদিনের জন্যে এসেছেন, আপনাদের ওপরেও হামলা! তা আপনাকে দেখছি, ধূর্জটিবাবু কই।
প্রায় বলতেই যাচ্ছিলাম যে তাকে আমিও খুঁজছি, কিন্তু তার আগেই দরজার কাছ থেকে তার গলার আওয়াজ এল।
– এই যে এখানে। একটু বাগানে বেড়াচ্ছিলাম।
বেড়ানোর সখ ধূর্জটির কস্মিনকালেও আছে বলে জানতাম না। কিন্ত তবু চুপ করে রইলাম।
আমাদের কাছে এগিয়ে আসে ধূর্জটি।
– নমস্কার সুকুমার বাবু। ভালো তো?
– আমি তো ভালোই। কিন্তু আপনার ওপর যে শুনলাম হামলা হয়েছে?
তাচ্ছিল্যের ভঙ্গীতে হাত নাড়ে ধূর্জট।
– ও ছেড়ে দিন। এই পেশায় থাকলে মাঝে মধ্যে এইরকম ঝামেলা একটু-আধটু সইতে হয়।
– তা হলেও। আপনারা অতিথি। আপনাদের ওপর এই রকম আক্রমণ কাম্য নয়।
উঠোনের অন্যপ্রান্ত থেকে জুতোর আওয়াজ আসে। ভারী পায়ে এগিয়ে আসেন সৌম্যেন্দ্রনারায়ণ। মুখে চিন্তার ছাপ।
– আবার কিছু হল না কি সৌমেন?
সৌম্যেন্দ্রনারায়ণের মুখের চেহারা দেখে উদ্বিগ্ন কণ্ঠে প্রশ্ন করেন সুকুমারবাবু।
– আর বলবেন না। এইসব গণ্ডগোল, তার মধ্যে আবার রামসহায় চলে গেছে।
– কে রামসহায়? তোমার ফৌজী গরুড়?
– হ্যাঁ। পরিবারের কে মারা গেছে সেই মর্মে তার পেয়ে প্রায় এক কাপড়েই বেরিয়ে গেছে। যাওয়ার সময়ে আমার সঙ্গেও দেখা করে যায় নি।
– সে কি। ভারী মুস্কিল তো।
– হ্যাঁ আজ তো আর হবে না, কাল আবার ছাদে পাহারা দেওয়ার জন্যে অন্য কাউকে লাগাতে হবে।
ধূর্জটির দিকে ফেরেন সৌম্যেন্দ্রনারায়ণ।
– চিত্ত চলে গেছে আপনার কাজ নিয়ে? বুঝিয়ে দিয়েছেন সব।
– হ্যাঁ। দু-একদিনের মধ্যে চিত্ত খবর নিয়ে ফিরলেই আশা করছি এই রহস্যের একটা নিষ্পত্তি করতে পারব
– এই হত্যালীলার পেছনে কে আছে আপনি বুঝতে পেরেছেন নাকি?
বিস্মিত কণ্ঠে প্রশ্ন করেন সৌম্যেন্দ্রনারায়ণ।
– ঠিক জানতে পেরেছি বলব না। তবে একটা আঁচ করতে পেরেছি। চিত্ত বাকি খবরটুকু জোগাড় করে আনলেই বোধহয় একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারব।
– কি আঁচ করতে পেরেছেন জানতে পারি কি? অবশ্য যদি বলতে বাধা না থাকে!
সুকুমারবাবুর কণ্ঠে উৎসুকতার ছোঁয়া।
মৃদু হাসে ধূর্জটি
– আরে না না। আপনাদের বলতে আর বাধা কি? তবে এখনো কয়েকটা যুক্তি সাজানো বাকি আছে, কাল অবধি আমায় সময় দিন। কালকে বিকেলে আশা করছি আপনাদের সব পরিষ্কার করে বলতে পারব। কুমারবাহাদুর, আগের দিনের মতন একটা চায়ের বৈঠক বসানো যায় কি? তাহলে খানিক গল্পগাছা করা যায়।
– অবশ্যই। চায়ের বৈঠক আর এমন কি বড় ব্যাপার। কালকের বৈঠকেই না হয় সব শুনব আপনার থেকে।
ফিরে যাওয়ার জন্যে পা বাড়িয়েছেন সৌম্যেন্দ্রনারায়ণ, আর একবার ডাক দিল ধূর্জটি।
– কুমারবাহাদুর, আপনাদের সেরেস্তায় কাগজ কালি যোগান দেয় যে গোপাল, তাকে কাল বিকেলে একবার ডেকে পাঠাতে পারবেন? আমারও কিছু লেখার কাগজ আর কলমের দরকার ছিল।
– নিশ্চই। আমি খবর পাঠিয়ে দেব।
পরের দিন নিচে যখন নামলাম তখন টেবিলে চায়ের সরঞ্জাম সাজানো। চেয়ারে বসে একটা ম্যাগাজিনের পাতা ওল্টাচ্ছেন সৌম্যেন্দ্রনারায়ণ।
সুকুমারবাবু এসে পৌঁছন একটু বাদে। হাতে খবরের কাগজ, কাঁধে একটা ঝোলা ব্যাগ।
ব্যাগটার দিকে ইঙ্গিত করে ধূর্জটি
– সব তল্পিতল্পা গোটানোর পালা না কি?
রুমাল বের করে মুখ মোছেন সুকুমারবাবু।
– হ্যাঁ! আর বলবেন না। যন্ত্রপাতি সব এদিকসেদিক ছড়িয়ে ছিটিরে রয়েছে, যাবার আগে সব এক জায়গায় জড়ো করছি।
ম্যাগাজিনটা নামিয়ে রাখেন সৌম্যেন্দ্রনারায়ণ,
– এইবার বলুন এই রহস্যের আপনি কি সমাধান সূত্র পেলেন।
কাপে চা ঢালে ধূর্জটি।
– বলছি। তবে তার আগে একটা কাজ সেরে নিই। যতীন, কুমারবাহাদুরের বন্দুক আর কার্ত্তুজের বেল্টটা আমি সিঁড়ির পাশে রেখে এসেছি। ওটা নিয়ে এসো তো।
হুকুম তামিল করি।
বন্দুক আর বেল্ট সৌম্যেন্দ্রনারায়ণের হাতে তুলে দেয় ধূর্জটি।
– এই নিন কুমারবাহাদুর, আপনার বন্দুক। এইবার শুরু করি।
কিন্তু ধূর্জটির শুরু করা হয় না। তার আগেই সুটকেশ হাতে গোপাল এসে নমস্কার করে দাঁড়ায়।
– বাবু, আপনার কি কাগজ কলমের দরকার ছিল?
অপ্রসন্ন দৃষ্টিতে গোপালের দিকে তাকান সুকুমারবাবু।
– তুমি বাপু বড্ড অসময়ে এসে পড়েছ। আমাদের দরকারী কথাবার্তা সেরে নিই, ততক্ষন তুমি ঘুরে এসে না হয়।
– আরে না-না থাক থাক।
বাধা দেয় ধূর্জটি।
– আমাদের কতক্ষণই বা লাগবে। এইখানেই অপেক্ষা করুক না।
চুপ করে যান সুকুমারবাবু, কিন্তু তাঁর মুখ দেখে মনে হয় না যে ব্যাপারটা তাঁর খুব একটা মনঃপূত হয়েছে।
চায়ে চুমুক দেয় ধূর্জটি।
– আসলে ব্যাপারটা বেশ জটিল। আর এর শিকড় রয়েছে আমাদের দেশের বিজ্ঞানচর্চার ইতিহসে।
ভুরু কোঁচকান সুকুমারবাবু।
– বিজ্ঞানচর্চার সঙ্গে এই সব খুনের কি সম্পর্ক?
– সম্পর্ক আছে।
চায়ের কাপ নামিয়ে রাখে ধূর্জটি
– আমাদের দেশে বিজ্ঞানচর্চার প্রধান অন্তরায় হল অর্থ। সরকার বাহাদুর কলেজ ইউনিভার্সিটি বসিয়েছেন বটে, কিন্তু সেখান বিজ্ঞান সাধনার জন্যে উপযুক্ত যন্ত্রপাতি বা গবেষণাগার কিছুই নেই। এইবার ধরুন একজন বিত্তবান মানুষ, বিজ্ঞানের উপাসক, মেধাবী, নিজের খরচে যন্ত্রপাতি কিনে গবেষণা চালিয়ে ফেললেন, এবং বিজ্ঞানী মহলে যথেষ্ঠ প্রতিষ্ঠা পেলেন। আর একজন, তিনিও যথেষ্ট মেধাবী, বিজ্ঞানে তিনিও সমান রকমের উৎসাহী, কিন্তু তাঁর কাছে পর্যাপ্ত অর্থ নেই। অতএব তাঁর উচ্চ গবেষণার পথ রুদ্ধ হয়ে রইল। প্রশ্ন হল এই অবস্থায় দ্বিতীয় ব্যক্তি কি করবেন?
– আপনি কি আমার আর নৃপেনের তুলনা টানছেন?
রাগত স্বরে প্রশ্ন করেন সুকুমারবাবু।
মৃদু হাসে ধূর্জটি,
– আমি কারোরই তুলনা টানছি না সুকুমারবাবু। আমি একটা থিওরী খাড়া করছি কেবল। সমস্তটা শুনেই নিন না।
প্লেট থেকে একটা পেস্ট্রি তুলে নেয় ধূর্জটি।
– এবার আমাদের এই কল্পিত দ্বিতীয় ব্যক্তি হঠাৎ আবিষ্কার করলেন, প্রাকৃত বিজ্ঞান সাধনায় অর্থ অন্তরায় হলেও, অতিপ্রাকৃত বিজ্ঞানের সাধকদের কিন্তু অর্থোপার্জনের প্রভূত সুযোগ রয়েছে। জ্ঞানকে আমরা আলোর সঙ্গে তুলনা করি বটে, কিন্তু এই অতিপ্রাকৃত জ্ঞানের ফলিত ব্যবহারের কয়েকটা অন্ধকারাচ্ছন্ন দিকও আছে। সরকার বাহাদুর সে সব ব্যবহারকে খুব একটা সুনজরেও না দেখলেও এক শ্রেণীর লোক কিন্তু সেই সব কাজের জন্যে দুহাতে পয়সা খরচ করতে সর্বদাই প্রস্তুত থাকে।
পড়ন্ত বেলার রোদ এসে পড়েছে চকমিলান উঠোনে। মাথার ওপরের আকাশের নীল রঙটুকু খানিকটা গাঢ় হয়ে এসেছে। ওপরের বারন্দায় একটা পাখি দু-একবার ডাকাডাকি করে উড়ে যায় আকাশে।
একটা সিগ্রেট ধরায় ধূর্জটি। উড়ে যাওয়া পাখির সন্ধানে বাতাসে ভেসে যায় ধোঁয়া।
– আমাদের এই দ্বিতীয় বৈজ্ঞানিক তাঁর অধ্যয়নের অভিমুখই পাল্টে ফেললেন। ল্যাভোসিয়ার আর ক্যাভেন্ডিশকে ছেড়ে পড়লেন বেচার আর স্টাহ্লকে নিয়ে। ফ্লজিস্টন থিওরী এতদিন হাতুড়েদের পাল্লায় আটকে অর্ধমৃত হয়ে ছিল, তিনি তাকে পুনর্জীবন দিলেন। নামকরা পত্রিকায় হয়ত তাঁর গবেষণা ছাপা হল না, কিন্তু সমাজের প্রদীপের নিচে যে অন্ধকার জগৎ সেখানে তিনি দৈত্যাচার্য্য শুক্রের মতনই প্রসিদ্ধ হয়ে উঠলেন।
জোরে টেবিলে একটা চাপড় মারেন সুকুমারবাবু। লাফিয়ে ওঠে কাপ প্লেটগুলো।
– খুনের কিনারা না করে আপনি কি সব আষাঢ়ে গল্প ফাঁদছেন বলুন তো ধূর্জটিবাবু? আর আমার নামে যে অভিযোগগুলো তুলছেন সেটার একটাও প্রমাণ করতে পারবেন?
সামনে ঝুঁকে পড়ে বাধা দেন সৌম্যেন্দ্রনারায়ণ।
– আহা। ওনাকে বলতেই দিন না। আপনাকে তো সরাসরি কিছু বলেন নি।
হাতের সিগ্রেটটা ছাইদানে গুঁজে দেয় ধূর্জটি।
– যোগ্য গুরু হলে উপযুক্ত শিষ্যও জুটে যায়। আমাদের এই বৈজ্ঞানিকও তাঁর উপযুক্ত একটি ছাত্র পেয়ে গেলেন। ছাত্রটি মেধাবী, কিন্তু অতিপ্রাকৃত জ্ঞানের সন্ধান করতে গিয়ে সে ভিক্টর ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের থিওরীর প্রতি একটু বেশী মাত্রায় আকৃষ্ট হয়ে পড়ে। একবার কলেজের গবেষণাগারে সবার অজান্তে মৃতদেহের ওপর বজ্রবহ্নি প্রয়োগ করতে গেলে বিধ্বংসী আগুনে গবেষণাগার পুড়ে যায়। নিষিদ্ধ গবেষণার দায়ে কলেজ কর্তৃপক্ষ তাকে বিতাড়ন করেন। কিন্ত রতনে রতনে চেনে। আমাদের বিজ্ঞানীটি পিতৃস্নেহে তাকে নিজের কাছে স্থান দেন। কি গোপাল ঠিক বলছি কি না?
কয়েকজোড়া চোখের বিস্মিত দৃষ্টি গিয়ে পড়ে গোপালের ওপর। হকচকিয়ে সে সবার মুখের দিকে তাকায় হতভম্ব ভঙ্গীতে।
– বাবু! কি বলছেন আমি কিছুই বুঝতে পারছি না!
হেসে ঘাড় নাড়ে ধূর্জটি।
– অত ভণিতা না করলেও চলবে। হারকোর্ট বাটলার কলেজ থেকে যে ছাত্রটি বিতাড়িত হয়, তার নাম নবগোপাল শিকদার। নিজের ছদ্মনামটা গোপাল সমাদ্দার না রেখে অন্য কিছু রাখলে পারতেন। কলেজের পাঠানো ছাত্রদের লিস্টটা পড়ার পর আমার কাজটা সহজ হয়ে গেল যে!
গোপালের মুখে ফুটে উঠল একটা হাল্কা ক্রূর হাসি। ঝুঁকে পড়া কাঁধদুটো সোজা হয়ে এল। মাথাটা যেন আরো খানিকটা উঁচু হয়ে উঠল। মনে হতে লাগল যেন পূর্বপরিচিত সেই দীনহীন দোকানী নয়, আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছে অন্য কেউ।
পাশ থেকে ভেসে এল সুকুমারবাবু শীতল কণ্ঠস্বর।
– যদি ধরেও নিই আপনার এইসব কথা সত্যি, তাহলেও একটা প্রশ্ন থেকে যায়। এইসব খুনজখমের পেছনে আমার স্বার্থ কোথায়?
– স্বার্থ! হ্যাঁ স্বার্থ। স্বার্থ ছাড়া এ পৃথিবীতে কিই বা ঘটে।
সিগ্রটের টিনে টক্টক্ আওয়াজ তোলে ধূর্জটির আঙুল।
– স্বার্থ লুকিয়ে আছে পিংলা পাহাড়ের নিচে। যেখানে আপনি বাড়ি বানাতে চেয়েছিলেন।
– পিংলা পাহাড়। পিংলা পাহাড়ের নিচে কি আছে ধূর্জটি বাবু?
বিস্মিত প্রশ্ন সৌম্যেন্দ্রনারায়ণের।
সুকুমারবাবুর চোখে চোখ রাখে ধূর্জটি,
– পিংলা পাহাড়ের নিচে অ্যাডামান্টাইন আছে কুমার বাহাদুর। ইস্পাতের চাইতে মজবুত, অত্যন্ত হাল্কা, যুদ্ধাস্ত্র বানানোর আদর্শ ধাতু। য়ুরোপে একটা যুদ্ধে ক্ষমতার ফয়সালা হয় নি। তলে তলে সব দেশ ফের যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে। অ্যাডামান্টাইনের চাহিদা এখন আকাশ ছোঁয়া। সোনার চাইতেও তার দাম বেশী।
লক্ষ করি দুচোখ জ্বলছে সৌম্যেন্দ্রনারায়ণের। দুহাতে আঁকড়ে ধরেছেন বন্দুকটাকে।
– এ সব কি সত্যি সুকুমারবাবু?
গোপালের দিকে চোখ রাখে ধূর্জটি।
– সত্যিটা নবগোপাল শিকদারের জামাটা তুললেই জানা যাবে। রাণীসাহেবার ছোঁড়া গুলির ক্ষত চিহ্নটা ওনার পেটের ওপর আছে কিনা দেখে নিলেই হল।
– আমার পেটে কারখানায় শিক পড়ে গিয়েছিল। তার একটা দাগ আছে।
জোরে হেসে ওঠে ধূর্জটি,
– নবগোপালবাবু, ওই গল্প দিয়ে আমাকে হলেও কুমার বাহাদুরকে ফাঁকি দিতে পারবেন না। উনি ফ্রন্টে লড়াই করেছেন, শিকের আঘাত আর গুলির ক্ষতচিহ্নের ফারাক উনি ভালই ধরতে পারবেন।
সুকুমারবাবু কি বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু বাধা দেয় গোপাল।
– স্যার! কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। এটার এখনই ফয়সালা হয়ে যাক।
গোপালের দিকে ফেরে ধূর্জটি।
– ফয়সালা করবেন নবগোপালবাবু। তা করুন। কিন্তু আগাম জানিয়ে রাখি, কিছু ফয়সালা আপনাদের হাত থেকে বেরিয়ে গেছে। এতক্ষণে আপনার দোকান আর সুকুমারবাবুর ক্যাম্পে পুলিস পৌঁছে গেছে। আপনারা জঙ্গলে লুকিয়ে ত্রাসপশুর চোরাকারবারের যে ব্যবসা ফেঁদেছিলেন, তার সবটাই এখন পুলিসের কব্জায়।
আচমকাই উঠে দাঁড়ান সুকুমারবাবু। তাঁর পেছনে সশব্দে আছড়ে পড়ে চেয়ারটা।
বন্দুক আঁকড়ে উঠে দাঁড়ান সৌম্যেন্দ্রনারায়ণও। টেবিল ছেড়ে পিছিয়ে আসেন কয়েক পা।
আমিও দেরি করি না। ধূর্জটির কাঁধটা ধরে টেনে আনি পেছনে।
টেবিলের দুপাশ থেকে সৌম্যেন্দ্রনারায়ণ আর সুকুমার ঘোষাল জ্বলন্ত চোখে দেখতে থাকেন পরস্পরকে।
ধূর্জটির চোখে চোখ রাখেন সুকুমারবাবু।
– এর মধ্যে তুমি মাথা না গলালেই ভাল করতে ধূর্জটিবাবু। সুকুমার ঘোষালকে অমান্য করে কেউ ইহলোকে বেশিদিন থাকে না। নৃপেন যেদিন আমায় পিংলা পাহাড়টা দিতে অস্বীকার করে, পরিবার সমেত তার মৃত্যু পরোয়ানা সেইদিনই লেখা হয়ে গিয়েছিল। অপেক্ষা ছিল কেবল সময় আর সুযোগের। কিন্তু তার মধ্য ঢুকে তুমি খামোখা নিজের প্রাণটা হারাতে বসেছ।
কাঁধে বন্দুক তোলেন সৌম্যেন্দ্রনারায়ণ। ট্রিগারে আঙুল রেখে বন্দুকের নল তাক করেন সুকুমারবাবুর দিকে।
– প্রাণ কার যাবে আর থাকবে, তার হিসেব এক্ষুণি হয়ে যাবে।
নাক দিয়ে একটা তাচ্ছিল্যের আওয়াজ তোলেন সুকুমার বাবু।
– হুঃ! গোপাল–
কয়েক পা এগিয়ে এসে সুটকেসটা খুলে উপুড় করে দেয় নিতাই।
সুটকেস থেকে কিলবিল করে মাটিতে ছড়িয়ে পড়ে একরাশ অদ্ভূতদর্শন প্রাণী। লম্বায় তারা বিঘৎখানেক হবে, চেহারায় মোটা জোঁকের মত হলেও মাথাটা সাপের মতন। তেলতেলে গায়ে সাপের মতন নক্সা কাটা।
– এগুলো কি জানো ধূর্জটিবাবু ?
সুকুমারবাবুর মুখে ব্যঙ্গের হাসি।
– ৎসুচিনোকো।
উত্তর দেয় ধূর্জটি।
– হ্যাঁ ৎসুচিনোকো। খাস জাপান থেকে আমদানী করা। একটা কামড়ে সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যু।
সুকুমারবাবুর কথা শেষ হতে না হতেই একটা প্রাণী লাফ দেয় আমাদের লক্ষ করে।
গর্জে ওঠে সৌম্যেন্দ্রনারায়ণের বন্দুক, রক্তের ফিনকি ছড়িয়ে প্রাণীটা আছড়ে পড়ে মাটিতে।
ব্যঙ্গের হাসি হাসেন সুকুমারবাবু।
– কটাকে মারবে কু-মা-র বাহাদুর? কত গুলি আছে তোমার বন্দুকে। সুটকেশ বোঝাই করে ৎসুচিনোকো নিয়ে এসেছি। মেরে শেষ করতে পারবে না। এই বাড়িশুদ্ধ লোকের ভবিতব্য আজ এদের কামড়েই মৃত্যু বরণ করা।
আবার লাফ দেয় গোটা দুয়েক ৎসুচিনোকো, আবার গর্জে ওঠে সৌম্যেন্দ্রনারায়ণের বন্দুক। ফের সুকুমারবাবুর অট্টহাস্য ছড়িয়ে যায় সরকার বাড়ির চকমিলান উঠোনে।
দুপা পিছিয়ে আসেন সৌম্যেন্দ্রনারায়ণ। সঙ্গে আমরাও। লক্ষ করি এবারে ঝাঁপ দেবার জন্যে তৈরি হচ্ছে একসাথে অন্ততঃ গোটা দশেক ৎসুচিনোকো। বুঝতে পারি লড়াইটা অসম। একসঙ্গে অতগুলো ৎসুচিনোকো ঝাঁপ দিলে, সৌম্যেন্দ্রনারায়ণের পক্ষে তাদের পেড়ে ফেলা সম্ভব হবে না।
হঠাৎ পেছেন থেকে কানে আসে আগ্নেয়াস্ত্রের গর্জন। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাই।
দুহাট হয়ে খুলে গেছে একটা অতিথি কামরার দরজা, আর সেই ঘরের ভেতরে থেকে লম্বা পায়ে দৌড়ে আসছে চিত্ত, তার দুহাতের মুঠোয় ধরা দু-দুটো ওয়েব্লি রিভলভার অগ্নিবর্ষণ করে চলেছে অনবরত।
লাফ দেওয়ার আগেই ভবলীলা সাঙ্গ হয় দশ-বারোটা ৎসুচিনোকোর।
আঙুল দিয়ে টেবিলে টকটক আওয়াজ তোলেন সুকুমারবাবু।
– চিত্ত দেখছি। এত তাড়াতাড়ি ফিরে এলে কলকাতা থেকে?
– কলকাতা যায়নি তো ফিরবে কোথা থেকে? কলকাতা যাওয়ার গল্প তো টোপ, না হলে কি আপনি আমাদের দুর্বল ভেবে ফাঁদে পা দিতেন?
উত্তর দেয় ধূর্জটি।
– তা বেশ! এক যাত্রায় পৃথক ফল হয় কেন? চিত্তও না হয় ৎসুচিনোকোর বিষের একবার আস্বাদ নিক। গোপাল -!
সামনের দিকে দু-হাত তুলে দুর্বোধ্য উচ্চারণে কি মন্ত্রপাঠ করে গোপাল। ৎসুচিনোকোর কিলবিলে তৈলাক্ত স্তূপটা ধীরে ধীরে মাটি ছেড়ে উঠে ভাসতে থাকে হাওয়ায়।
ফের মন্ত্রোচ্চারণ করে গোপাল। বৃত্তাকারে পাক খেতে থাকে ৎসুচিনোকোর ঝাঁক।
ভয়ে হাড় হিম যায় আমার। বুঝতে পারি গোপাল সবকটা ৎসুচিনোকোকে একসঙ্গে আমাদের দিকে ছুঁড়ে দেওয়ার ছক কষছে। অতসংখ্যক ৎসুচিনোকো সৌম্যেন্দ্রনারায়ণের বন্দুক আর চিত্তর দুটো পিস্তল মিলেও ঠেকাতে পারবে না।
হঠাৎ ভারী ধাতব কিছু পড়ার শব্দে কেঁপে ওঠে চকমিলান উঠোন। চমকে তাকিয়ে দেখি দোতলার বারন্দা থেকে লাফিয়ে নেমেছে কলগোলাম। তার মুখের জাফরি থেকে শব্দ উঠছে সাইরেনের। দুচোখের আলো জ্বলছে দপদপ করে।
দু-হাত দুপাশে ছড়িয়ে আমাদের আড়াল করে দাঁড়ায় কলগোলাম।
তাচ্ছিল্যের হাসি ফোটে সুকুমারবাবুর ঠোঁটে।
– ওই পেতলের পিপেটাকে দিয়ে আমাদের আটকাতে পারবে ভেবেছ?
সুকুমার বাবুর কথা শেষ হতে না হতেই কানে আসে একোটা ডানা ঝাপটানোর আওয়াজ। অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখি দুহাতে একটা জাম্বুরক ধরে পাখায় ভর করে উঠোনে নেমে আসছে গরুড় রামসহায়।
জম্বুরকটা মাটিতে নামিয়ে রেখে আমাদের আড়াল করে দুপাশে তার পাখা দুটো ছড়িয়ে দেয় রামসহায়।
– মেরে পিছে আ যাইয়ে হুজুর।
উচ্চ উচ্চ গ্রামে উঠতে থাকে গোপালের মন্ত্রপাঠ।
চকমকি ঠুকে জাম্বুরকের সলতেয় আগুন দেয় রামসহায়।
চিৎকার করে সামনের দিকে দুহাত ছুঁড়ে দেয় গোপাল।
তৈলাক্ত মেঘের মত আমাদের দিকে ছিটেকে আসে একরাশ ৎসুচিনোকো।
কান ফাটানো আওয়াজে গর্জন করে ওঠে জাম্বুরক।
ছররার আঘাতে ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে ছিটকে পড়ে বেশিরভাগ ৎসুচিনোকো। বাকিগুলো আটকে যায় কলগোলাম আর গরুড়ের দূর্ভেদ্য প্রাচীরে।
কলগোলামের গায়ে পড়া ৎসুচিনোকোগুলো নিষ্ফল আক্রোশে বিষ ঢালে, সবুজ বিষ গড়িয়ে পরে তার পেতলের গাত্রবর্মে। নির্বিকার ভাবে শরীর থেকে তুলে কলগোলাম সেগুলো হাতের মুঠোয় আর পায়ের নিচে পিষে মারতে থাকে সেগুলোকে।
রামসহায়ের শরীরে যে কটা ৎসুচিনোকো পড়ে, তাদের কামড় বৃথাই যায়। বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়ে রামসহায় তাদের কোপাতে থাকে একটা বিশাল ছোরা দিয়ে।
আর এদের দুজনের পেছন থেকে গর্জন করতে থাকে সৌম্যেন্দ্রনারায়ণের বন্দুক আর চিত্তর পিস্তল।
কতক্ষণ সময় কেটে যায় জানি না। কিন্তু এক সময় খেয়াল করি থেমে গেছে বন্দুকের গর্জন। রক্ত আর ৎসুচিনোকোর দেহাবশেষ মাখামাখি ক্লেদাক্ত উঠোনে আমাদের দিকে বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন সুকুমার বাবু।
কলগোলাম আর রামসহায়ের আড়াল থেকে সামনে এগিয়ে যায় ধূর্জটি।
– আপনার আমদানী করা ৎসুচিনোকোর ভাঁড়ার তো শেষ। আর কিছু আছে নাকি আপনার সংগ্রহে?
মুচকি হাসেন সুকুমারবাবু
– ভাঁড়ার তো তোমাদের গুলিরও শেষ। কি বলো সৌমেন। কি বলো চিত্ত!
সৌম্যেন্দ্রনারায়ণ আর চিত্তর দিকে তাকাই। উত্তর আসে না দুজনের কাছ থেকেই। বুঝতে পারি বানিয়ে বলছেন না সুকুমারবাবু। ৎসুচিনোকোর সঙ্গে শেষ হয়েছে আমাদের পক্ষের গুলিও।
ফের হাসেন সুকুমারবাবু।
– আমার সংগ্রহে তোমার ক্ষুদ্র বুদ্ধি দিয়ে বোঝা যায় না এমন অনেক জিনিষই আছে ধূর্জটিবাবু। যেমন ধরো এইটা –
ঝোলা থেকে দস্তানার মত একটা ধাতব বস্তু বের করেন সুকুমার বাবু। তবে দস্তানার মত দেখতে হলেও আকারে সেটা মানুষের হাতের পাঞ্জার চাইতে চার পাঁচগুণ বড়।
দস্তানার মধ্যে হাত ঢোকান সুকুমারবাবু। দস্তানার প্রতিটি গ্রন্থি উজ্জ্বল হয়ে ওঠে নীলাভ দ্যুতিতে।
– এটা আমার আবিষ্কার। নাম দিয়েছি বজ্রমুষ্টি। চলে এল্ড্রিচ শক্তিতে। খনিতে পাথর ভাঙতে কাজে লাগে। তবে অন্য ব্যবহারও আছে।
দস্তানাটা মুঠো করে সজোরে চায়ের টেবিলের ওপর নামিয়ে আনেন সুকুমারবাবু। সশব্দে চুরমার হয়ে যায় টেবিলটা। তার কাঠের টুকরোগুলো ছড়িয়ে পড়ে চারপাশে। মাটিতে আছড়ে টুকরো টুকরো হয়ে যায় চিনেমাটির তৈর চায়ের বাসন।
মাথা নাড়ে ধূর্জটি।
– এটা দিয়েই বোধহয় আপনি বলাই, পীতাম্বর আর গিরিজাপ্রসাদের মাথাটা থেঁতলে দিয়েছিলেন?
গর্বের হাসি হাসেন সুকুমারবাবু।
– বললাম না, পাথর ভাঙা ছাড়া এর আরো ব্যবহার আছে! তবে এটাও ছাড়াও তোমাদের জন্যে আর একটা উপহার আছে। পাশের জঙ্গলে অপেক্ষা করছে। গোপাল-!
মাথার ওপর দুহাত তুলে মন্ত্রপাঠ শুরু করে গোপাল।
মাথার ওপরে বজ্রমুষ্টি তুলে ধূর্জটির দিকে এগিয়ে আসেন সুকুমারবাবু,
– এসো ধূর্জটিবাবু। তোমাকেও গিরিজাপ্রসাদের কাছে পাঠিয়ে দিই।
সুকুমারবাবুর পথ আটকে এসে দাঁড়ায় কলগোলাম।
তাচ্ছিল্যের হাসি হাসেন সুকুমারবাবু।
– ওফ! ফের এই পেতলের পিপেটা।
হাত চালান সুকুমারবাবু। বজ্রমুষ্টি আছরে পড়ে কলগোলামের বুকে। আঘাতের তীব্রতায় দুপা পিছিয়ে যায় কলগোলাম।
একটা ডানা ঝাপটানোর আওয়াজ ওঠে। মাথা তুলে দেখি পাক খেতে খেতে আকাশ থেকে নিচে নেমে আসছে একটা সরীসৃপের আকারের প্রাণী। পিঠে তার বাদুড়ের মতন ডানা, চাবুকের মত ল্যাজের শেষ প্রান্তটুকু তীরের ফলার মতন।
– ওয়াইভার্ন! খুব সাবধান। এটা নাক থেকে বিষাক্ত বাষ্প ছোঁড়ে।
ওপরের দিকে তাকিয়ে চেঁচিয়ে ওঠে ধূর্জটি।
– রামসহায়! রামসহায়!
খোলা অতিথি কামরার দিকে আঙুল তুলে চিৎকার করে চিত্ত।
চিত্তর দিকে একবার তাকিয়েই খোলা ঘরের দিকে দৌড়য় রামসহায়।
মাথা নিচু করে তীরের বেগে উঠোনের দিকে পড়তে থাকে ওয়াইভার্ন। যে যেদিকে পারি ছিটকে যাই আমরা।
ধাতব আওয়াজ তুলে আর একবার কলগোলামের বুকে আছড়ে পড়ে সুকুমারবাবুর বজ্রমুষ্টি। টলমল করে হটে যায় কলগোলাম।
উঠোনের কাছাকাছি এসে নাক থেকে একরাশ সবুজ বাষ্প ছড়িয়ে ফের আকাশে উঠে যায় ওয়াইভার্ন। সে বাষ্প লাগামাত্র জ্বলে বিবর্ণ হয়ে যায় উঠোনের চকমিলান নক্সা। তার নিচের পাথর গলে চারপাশে ছড়িয়ে যায় বুদবুদ হয়ে।
ঘর থেকে দৌড়ে বেরোয় রামসহায়। তার দুহাতে ধরা একটা জাজেল।
মাথা নিচু করে আবার নিচের দিকে পড়তে থাকে ওয়াইভার্ন! আকাশের দিকে উঁচু করে তুলে ধরে রামসহায় জাজেলের সুদীর্ঘ নলটা।
আবার ধাতব আওয়াজ ওঠে। বজ্রমুষ্টির আঘাতে আবার পিছু হটে কলগোলাম।
গর্জন করে ওঠে রামসহায়ের জাজেল। দুবার ডিগবাজী খেয়ে আকাশে ছিটকে যায় ওয়াইভার্ন!
হাত থেকে জজেল মাটিতে ফেলে দেয় রামসহায়। দুপাশে তার বিশাল ডানা ছড়িয়ে উঠে যায় আকাশে। কোমরবন্ধ থেকে টেনে বের করে হাওদা পিস্তল।
নিজেকে সামলে নিয়ে রামসহায়ের দিকে তেড়ে আসে ওয়াইভার্ন!
পরের পর বজ্রমুষ্টি আছড়ে পড়ে কলগোলামের বুকে। পিছু হটতে থাকে কলগোলাম।
অদ্ভূত কায়দায় শরীরটাকে বাঁকিয়ে ওয়াইভার্নের পথ থেকে সরে যায় রামসহায়। বাঁহাতে চেপে ধরে তার লম্বা গলাটাকে।
তারপর তার পিঠের মধ্য হাওদা পিস্তল ঠেকিয়ে পরপর দেগে দেয় দুটো নলই।
একটা মরণ চিৎকার করে আকাশ থেকে পড়তে শুরু করে ওয়াইভার্ন! মন্ত্রপাঠ ভুলে বিস্মিত দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে থাকে গোপাল।
হাওদা পিস্তল কোমরে গোঁজে রামসহায়। খাপ থেকে বিশাল তলোয়ারটা টেনে বের করে একপাশে বাড়িয়ে দেয় হাতটা।
আবার একটা ধাতব আওয়াজ ওঠে। কিন্তু এবারে সুকুমারবাবুর বজ্রমুষ্টি কলগোলামের বুকে পড়েনি। হাত দিয়ে আঘাত আটকে দিয়েছে সে।
মাথা নিচু করে আকাশ থেকে নেমে আসে রামসহায়। তার বাড়ানো হাতের তলোয়ারের ধার নির্মম বিদ্যুতের মতন নেমে আসে গোপালের ঘাড়ের ওপর।
কোন আওয়াজ হয় না। গোপালের মুণ্ডটা শরীর থেকে আলাদা হয়ে গড়িয়ে পড়ে উঠোনে।
রক্তের ফোয়ারা ছড়িয়ে তার কবন্ধ লাসটাও ঢলে পড়ে একপাশে।
আর তার পরপরই ওয়াইভার্নের দেহটা সশব্দে আছড়ে পড়ে মাটিতে।
– গোপাল!!
একটা হাহাকার ভেসে আসে সুকুমারবাবুর গলা থেকে।
এক পা এগিয়ে যায় কলগোলাম। সুকুমারবাবুর বজ্রমুষ্টিকে এড়িয়ে দুহাতের মুঠোয় ধরে ফেলে তাঁর কনুই দুটোকে। চোখের আলো দুটো দপদপ করে জ্বলে ওঠে তার। তারপর মড়মড় শব্দে তার হাতের নিষ্পেষণে গুঁড়িয়ে যায় সুকুমারবাবুর কনুই দুটো।
উঠোনের রণক্ষেত্রের ক্লেদ রক্ত ছাড়িয়ে আকাশের দিকে উঠে যায় সুকুমারবাবুর আর্ত চিৎকার।
এগিয়ে এসে বন্দুকের নলটা সুকুমারবাবুর মাথায় ঠেকান সৌম্যেন্দ্রনারায়ণ।
– ওপর থেকে কার্ত্তুজ আনিয়ে তোমাকে এখনই গুলি করে মেরে ফেলতে পারতাম। কিন্তু গুলিতে মৃত্যু সে সাহসী সৈনিকের জন্যে। তোমার মত বিশ্বাসঘাতক হত্যাকারীর শাস্তি পঙ্গু হয়ে বন্দীজীবন ভোগ করা।
লাইব্রেরী ঘরে জড় হয়েছি আমরা আর সৌম্যেন্দ্রনারায়ণ। বই আর বৈজ্ঞানিক সংগ্রহের মাঝে বসে গত কয়েকদিনের স্মৃতিকে দুঃস্বপ্নের মতনই লাগাছে। একদিকে আপন মনে কলগোলামের সঙ্গে বল খেলে চলেছে উপেন। তার একটু দুরেই গোটাকতক বন্দুক নিয়ে পরিষ্কার করতে বসেছে চিত্ত আর রামসহায়।
খোলা জানলা দিয়ে বাইরের নীল আকাশের দিকে একবার তাকায় ধূর্জটি।
– নৃপেন্দ্রনারায়ণের সঙ্গে সুকুমারবাবু সখ্য বোধহয় বহুকাল আগেই ঈর্ষায় পরিণত হয়েছিল। কিন্তু ধূর্ত সুকুমারবাবু সেটা বন্ধুকে কখনো বুঝতে দেননি। তাও একরকম ভাবে চলছিল। কিন্তু সুকুমারবাবু যেদিন জানতে পারলেন পিংলা পাহাড়ের নিচে অ্যাডামান্টাইন আছে সেদিন আগুনে ঘৃতাহুতি পড়ল। প্রথমে ভালমানুষ সেজে সুকুমারবাবু বাড়ি বানানোর অছিলায় জায়গাটা চাইলেন। কিন্তু নৃপেন্দ্রনারায়ণ যখন রাজী হলেন না, তখন গোপালের সাহায্যে সুকুমারবাবু আপনার বাড়িতে পিশাচের আক্রমণ করালেন। আপনি তখন যুদ্ধে। তাঁর হয়ত পরিকল্পনা ছিল সবাই খুন হয়ে গেলে আপনি ফেরার আগেই পাহাড়ের তলা থেকে তিনি সবটুকু অ্যাডামান্টাইন তুলে নেবেন।
উপেনের ছোঁড়া বলটা সৌম্যেন্দ্রনারায়ণের পায়ের কাছে এসে পড়ে। বলটা তুলে নিয়ে উপেনের দিকে বাড়িয়ে ধরেন সৌম্যেন্দ্রনারায়ণ।
– কিন্তু চিন্ময়ীর গুলিতে সুকুমারবাবুর প্ল্যান ভেস্তে গেল।
– হ্যাঁ। খুব সম্ভব গোপালের চিকিৎসার ব্যবস্থা করে, সুকুমারবাবু গোলকুণ্ডায় আস্তানা গাড়লেন। গোলকুণ্ডার খনি নিজামের এক্তিয়ারে। ইংরেজের শাসনের বাইরে। জল কোনদিকে গড়ায় সেটা দেখার জন্যে নিজামের রাজত্ব থেকে তিনি আপনার গতিবিধির ওপর নজর রাখতে শুরু করলেন। ততদিনে তিনি অপরাধের জগতে অনেকদুর পা রেখে ফেলেছেন, সুতরাং তাঁকে এ কাজে সাহায্য করবার লোকের অভাব হয় নি।
– ততদিনে আমিও ফিরে এসেছি।
– হ্যাঁ আপনি ফিরে এসেছেন। এবং ফিরে কেবল আসেননি, ফৌজ থেকে লোক নিয়ে এসেছেন, এবং তাদের সাহায্যে বাড়িটিকে একটি দুর্ভেদ্য দুর্গ বানিয়ে তুলেছেন। আপনাকে সরাসরি আক্রমণ করা অসম্ভব দেখে সুকুমারবাবু অন্য মতলব আঁটলেন।
উপেনের সঙ্গে বল খেলতে থাকা কলগোলামের দিকে তাকালেন সৌম্যেন্দ্রনারায়ণ।
– কলগোলামকে কাজে লাগানো!
– হ্যাঁ। কলগোলামকে হলেরিথ কার্ড দিয়েই নির্দেশ দেওয়া হয়ে থাকে। কিন্তু সে ক্ষেত্রে কলগোলামের একদম কাছে কাউকে যেতে হয়। যুদ্ধের প্রায় শেষের দিকে একটা পরীক্ষা শুরু হয়েছিল। ধরুন কলগোলামকে কোন বিপজ্জনক জায়গায় নিয়োগ করা হয়েছে। এবার তাকে দূর থেকে নির্দেশ দিতে হবে, কাছে যাওয়া যাবে না। এখানে হলেরিথ কার্ডের ব্যবহার অচল। তখন চেষ্টা শুরু হল যদি আলোর ঝলকানি দিয়ে সঙ্কেতে কলগোলামকে নির্দেশ দেওয়া যায়।
চমকে উঠলেন সৌম্যেন্দ্রনারায়ণ
– আলোর ঝলকানি! মানে সুকুমারবাবুর হেলিওগ্রাফ! সুকুমারবাবুর হেলিওগ্রাফ তাহলে ওই কাজের জন্যে ব্যবহার হত।
হাসল ধূর্জটি।
– ঠিকই ধরেছেন। তবে হেলিওগ্রাফের মূল উদ্দেশ্য ছিল নিজের দলের লোকেদের সঙ্গে সংবাদ আদানপ্রদান করা। কারণ ততদিনে সুকুমারবাবু আর গোপালের ত্রাসপশুর চোরাকারবারের ব্যবসা বেশ ফুলে ফেঁপে উঠেছে। কলগোলামকে নির্দেশ দেওয়ার চিন্তাটা হয়ত তাঁর মাথায় পরে আসে।
দুজন কাজের লোক এসে টেবিলের ওপর চায়ের পট আর পেয়ালা রেখে যায়।
কাপে চা ঢালেন সৌম্যেন্দ্রনারায়ণ। এগিয়ে দেন ধূর্জটির দিকে,
– কিন্তু কলগোলামকে আলোর সঙ্কেতের সাহায্যে নিয়ন্ত্রণ করতে গেলে তো সেই সাঙ্কেতিক নিয়মাবলীগুলো জানা প্রয়োজন।
– অবশ্যই এবং এই সঙ্কেতের নির্দেশ-পঞ্জিকা যোগাড় করতেই সুকুমারবাবুর দরকার হয়ে পড়ল ইন্ডো ব্রিটিশ ক্লকওয়ার্কসে চুরি করার। বলাই হালদার তখন হায়দ্রাবাদে গা ঢাকা দিয়ে আছে। সুকুমারবাবুর অপরাধ জগতে যোগাযোগ কম নয়। তিনি পয়সার লোভ দেখিয়ে বলাইকে দিয়ে নিজামের কিমিয়াখানা থেকে ক্যালরিক চুরি করালেন, এবং তারই মাধ্যমে নিতাই হালদারের সঙ্গে জোট বাঁধলেন। নিতাই তখন সবে জেল থেকে বেরিয়েছে, তারও পয়সার দরকার। এয়ারশিপে করে সুকুমারবাবু নিতাইকে নিয়ে ইন্ডো ব্রিটিশ ক্লকওয়ার্কসে চুরি করতে ঢুকলেন। দোতলায় যখন নিতাই সিন্দুক থেকে নগদ টাকা চুরি করছে, সুকুমারবাবু তখন একতলা থেকে সাঙ্কেতিক নির্দেশ-পঞ্জিকা সরালেন। কিন্তু ওই সামান্য টাকাতে সুকুমারবাবুর কোন আগ্রহ ছিল না। তিনি তখন কুবেরের সম্পদের লোভে পাগল। চুরির শেষে সুকুমারবাবু নিতাইকে ধাক্কা দিয়ে নিচে ফেলে দিলেন, আর এয়ারশিপের কাপড়টা দিলেন ফাঁসিয়ে, যাতে লোকে মনে করে এয়ারশিপ দুর্ঘটনায় নিতাইয়ের মৃত্যু হয়েছে, এবং বলাই ফের পালিয়েছে।
স্ট্র্যাণ্ড রোডের মালগুদামে পড়ে থাকা এয়ারশিপের ছবিটা ফের ভেসে উঠল মনের মধ্যে।
– সুকুমারবাবু ভেবেছিলেন টাকাটা ফেরৎ পাওয়া গেলে মামলাটা চাপা পড়ে যাবে। তাঁর চুরির আসল উদ্দেশ্যটাও লোকে ধরতে পারবে না।
– ঠিক বলেছ যতীন। কিন্তু বলাই এদিকে হায়দ্রাবাদে বসে খবরের কাগজ থেকে জানতে পারল তার ভাই মারা গেছে, আর পুলিস চুরির মামলায় তাকেই খুঁজছে। সে নিজামের কিমিয়াখানায় চুরির খবর আর ইন্ডো ব্রিটিশ ক্লকওয়ার্কসে চুরির খবরদুটোর কাটিং পকেটে করে সুকুমারবাবুর খোঁজে দুলমিগড় হাজির হল।
– কিন্তু কেন? তোমাকে আগেও জিজ্ঞেস করেছিলাম। বলাই পকেটে করে কাটিং দুটো নিয়ে এসেছিল কেন?
– খুব সম্ভব সুকুমারবাবুকে ভয় দেখিয়ে টাকা আদায় করবে বলে।
– কিন্তু সুকুমারবাবু বোধহয় ভয় পাননি।
হাসল ধূর্জটি।
– সুকুমারবাবুর মতন রাঘবোয়ালের সঙ্গে টক্কর নিতে যাওয়াটা বলাইয়ের মতন চুনোপুঁটির উচিত হয় নি। সুকুমারবাবু তাকে খুন করে জঙ্গলের একদম ভেতরে ফেলে দিলেন। মনে করলেন শেয়াল কুকুরে তার লাস খেয়ে যাবে। কেউ টের পাবে না।
একটা লম্বা নিশ্বাস ফেললেন সৌম্যেন্দ্রনারায়ণ,
– কিন্তু ধর্মের কল বাতাসে নড়ে। বলাইয়ের লাস একজন গ্রামবাসীর চোখে পড়ে গেল।
– হ্যাঁ। পুলিস বলাইকে সনাক্ত করে ফেলল। সুকুমারবাবুর মনে হল হয়ত দেরী করাটা আর সমীচীন হবে না, পুলিসের তদন্ত কোন দিকে এগোয় তার ঠিক নেই, শেষে হয়ত তাঁর কাজই ভেস্তে গেল। তিনি হেলিওগ্রাফ দিয়ে কলগোলামকে সাঙ্কেতিক নির্দেশ পাঠালেন।
মাথার রগদুটো চেপে ধরলেন সৌম্যেন্দ্রনারায়ণ।
– আন্দাজ করতে পারছি সুকুমারবাবু কলগোলামকে দিয়ে কি করাতে চেয়েছিলেন। তবু আপনার মুখ থেকেই শুনি।
ফের হাসে ধূর্জটি।
– সুকুমারবাবু যে কলগোলামকে দিয়ে আপনার বাড়িশুদ্ধ সবাইকে হত্যা করাতে চেয়েছিলেন এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু তাঁর এ ব্যাপারে তাঁর সফল হওয়ার কোন সম্ভাবনাই ছিল না।
– কেন? এ কথা বলছেন কেন?
বিস্মিত কণ্ঠে প্রশ্ন করেন সৌম্যেন্দ্রনারায়ণ।
– আমি এখান আসার আগে ইম্পিরিয়াল লাইব্রেরীতে সাম্প্রতিককালের খবর ঘেঁটে যা পেয়েছি তাতে মনে হয়েছে এই আলোর মাধ্যমে কলগোলামকে নির্দেশ দেওয়ার প্রতিটি পরীক্ষাই ব্যর্থ হয়েছে। প্রত্যেকবারই কলগোলাম বিগড়ে গেছে।
উপেনের বলখেলার সঙ্গী একজন বেড়ে গেছে। কলগোলামের সঙ্গে এবার চিত্তও যোগ দিয়েছে। কিছুক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে খেলা দেখেন সৌম্যেন্দ্রনারায়ণ।
– এরপর কলগোলাম মেরামত করতে কলকাতা থেকে পীতাম্বর এসে হাজির হল।
– হ্যাঁ পীতাম্বর কেবল কলগোলাম সারিয়েই তুলল না। কলগোলাম কেন বিগড়েছিল তাও চট করে আন্দাজ করে ফেলল।
– আমাকে জানালো না কেন?
– হয়ত আপনি বিশ্বাস করতে চাইবেন না মনে করে। কিম্বা হয়ত তার মনে হয়েছিল অফিসকে আগে জানানো দরকার।
কলগোলামের বুক থেকে আগের দিন ইংরিজীতে ‘লাইট’ শব্দটা বেরোনোর কথা মনে পড়ে গেল আমার।
– কিন্তু উপেনকে জানিয়েছিল।
-হ্যাঁ উপেনকে পীতাম্বর জানিয়েছিল যে আলোর ঝলকানিতে তার কলগোলাম বিগড়ে গেছে।
মৃদু হাসেন সৌম্যেন্দ্রনারায়ণ,
– ওটা হয়ত পীতাম্বরের দোষ না। মাঝে মধ্যে উপেন এমন নাছোড়বান্দার মত করে যে তাকে না বলাটা মুস্কিল হয়ে পড়ে।
– সুকুমারবাবু বোধহয় পীতাম্বরের ওপর নজর রাখছিলেন। তাকে পোস্ট-অফিসের পথে একলা পেয়ে স্রেফ সন্দেহের বশেই হোক, কিম্বা ভুলিয়ে-ভালিয়ে তার পেট থেকে কথা বের করে নিয়েই হোক, তাকে খুন করলেন।
সৌম্যেন্দ্রনারায়ণের দিকে বল ছোঁড়ে উপেন। বলটা লুফে নিয়ে ফের ছুঁড়ে দেন সৌম্যেন্দ্রনারায়ণ, মাঝপথে লুফে নেয় কলগোলাম। আনন্দে চিৎকার করে ওঠে উপেন।
– পীতাম্বর মারা যেতে আমি কলকাতায় গেলাম।
– হ্যাঁ। এবার সুকুমারবাবু সোজা আপনার ওপর আক্রমণ করালেন। ঘরে বিষাক্ত কীট ছেড়ে দিলেন। আপনার মনে ধারণা পোক্ত হল যে আপনার পরিবারকে ঘিরে ফের কোন ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে। আপনি হেমের সঙ্গে আমার কাছে পৌঁছলেন। এর পরের ঘটনাগুলো আপনি জানেন।
উপেনের আনন্দের চিৎকারে গমগম করেছে লাইব্রেরী ঘরখানা। দুহাতে হাঁটু জড়িয়ে ধরে রামসহায়ও উপভোগ করছে উপেনের চিত্ত আর কলগোলামের বলখেলা।
– কিন্তু সুকুমারবাবুর ওপর তোমার সন্দেহ হল কি করে?
প্রশ্ন করি ধূর্জটিকে।
– দেখ, প্রথমটায় সুকুমারবাবুই যে আসল হোতা সে কথা মনে হয় নি। কিন্ত ঝোপের ভেতর থেকে যখন কাটিং দুটো কুড়িয়ে পেলাম, বুঝলাম যে বলাই বোড়ে মাত্র। এই দাবার রাজা মন্ত্রী দুলমিগড়েই কোথাও লুকিয়ে আছে।
– কেন?
– ইম্পিরিয়াল লাইব্রেরীতে গিয়ে নিয়মিত সংবাদপত্র হাঁটকানো যে আমার অভ্যেস তুমি জানো। এইটা করতে করতে আলাদা আলাদা সংবাদপত্রের ছাপা আর কাগাজের মান সমন্ধে আমার একটা মোটামুটি ধারণা হয়ে গেছে। ঝোপে পাওয়া কাটিং এর চেহারা দেখে মনে হল সে দুটো হায়দ্রাবাদের কোন একটা বিশেষ সংবাদপত্র থেকে নেওয়া। তুমি জানো দ্বিতীয় কাটিংটা ছিল ইন্ডো ব্রিটিশ ক্লকওয়ার্কসে চুরির খবর। কিন্তু বলাই যদি এ খবর হায়দ্রাবাদে বসে পেয়ে থাকে তাহলে আমাদের থিওরীটাই পাল্টে যায়। সেক্ষত্রে ধরে নিয়ে বলাই এই চুরিতে অংশ নেয়নি, চুরির খবর পেয়ে দুলমিগড়ে কারোর সঙ্গে মোলাকাত করতে এসেছিল।
– সুকুমারবাবুর ওপর তোমার সন্দেহ হল কেন।
– প্রথমদিন যখন সুকুমারবাবুর সঙ্গে আলাপ হয় তখন উনি যখন খবরের কাগজের পাতা ওল্টাচ্ছিলেন। কোন পাতায় উনি মনযোগ দিয়ে নজর রাখছিলেন সেটা খেয়াল রাখছিলাম। উনি চলে যেতে সেই পাতাটা দেখতে চোখে পড়ল সেখানে অ্যাডামান্টাইন কিনতে চাওয়ার বিজ্ঞাপন বেরিয়েছে। তখনই মনে খটকা লেগেছিল। সুকুমারবাবু কাছে অ্যাডামান্টাইন কোথায়, যে তিনি সে বস্তুটি কিনতে চাওয়ার বিজ্ঞাপন দেখছেন?
– তার পরের দিন গিরিজাপ্রসাদ খুন হল।
-হ্যাঁ। বুঝতে পারলাম তাকে কিছুর টোপ দিয়ে ডেকে নিয়ে গিয়ে খুন করা হয়েছে।
চিঠির পোড়া অংশের কথা মনে পড়ে গেল।
-কিসের টোপ? ‘অর্থাগম’ হবার?
হেসে ফেলল ধূর্জটি।
-হয়ত অনেকটা তাই। তবে ‘গম’ শব্দটা সম্ভবতঃ নাগমণি শব্দের অংশ। জহুরী গিরিজাপ্রসাদকে নাগমণি বিক্রির লোভ দিয়ে খুন করা হয়।
-কিন্তু কেন?
-ওই কেনর মানে খুঁজতে গিয়েই সুকুমারবাবুর ওপর সব সন্দেহটুকু গিয়ে পড়ল। দেখ, এই রহস্যের সবচাইতে জটিল গ্রন্থিটুকু ছিল মোটিভ। কিসের স্বার্থে এই নাটকের হোতা মেতেছে এই হত্যালীলায়? কি তার উদ্দেশ্য? এটা কিছুতেই আমার কাছে পরিষ্কার হচ্ছিল না। তোমার হয়ত মনে আছে সেদিন কথাচ্ছলে গিরিজাপ্রসাদ বলেছিল যে যক্ষরা মাটির নিচে অনেক কিছু দেখতে পায়। সে সত্যি কিছু জানত, না কি এমনিই কথার কথা বলেছিল জানা নেই, কিন্তু একথার পরপরই যখন সে খুন হল তখন বুঝলাম এই রহস্যের মোটিভ লুকিয়ে আছে মাটির তলায়। তার এই কথাটুকু বলার সময়ে সেখানে আমরা আর কুমারবাহাদুর ছাড়া উপস্থিত ছিলেন কেবল সুকুমারবাবু। এছাড়া সেদিন তাঁর অ্যাডামান্টাইনের বিজ্ঞাপনের প্রতি আকর্ষণটাও চোখ এড়ায়নি। অতএব দুইয়ে দুইয়ে চার করতে সময় লাগল না। তবু খুনের ধরনটা দেখে মনের মধ্যে একটু খুঁতখুঁতানি ছিল –
-খুঁতখুঁতানি? কেন?
প্রশ্ন করি বিস্ময়ের সঙ্গে
-ওই যে বললাম খুনের ধরনটা দেখে। মনে হলে অত জোর আঘাত তো কেবল কলগোলামের শক্তিতেই সম্ভব। কিন্তু তারপর খোঁজ নিয়ে জানলাম সারাদিন উপেন আর কলগোলাম লাইব্রেরী ছেড়ে নড়ে নি। সমস্ত সন্দেহটা তখন সুকুমারবাবুর ওপরে গিয়ে পড়ল।
জানলার বাইরের নীল আকশের বুকে সাদা রেখা টেনে উড়ে যায় কয়েকটা হাঁস। সেদিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে সৌম্যেন্দ্রনারায়ণ বললেন,
-এই জন্যেই কি আপনি শিউলালকে কিছু তদন্ত করতে নির্দেশ দিয়েছিলেন?
-হ্যাঁ। আর তার জন্যে খানিকটা সুকুমারবাবু নিজেই দায়ী। নিজকে অতিচালাক ভেবে আমার চোখের সামনে স্টাহ্লের বইখানা না ফেললেই পারতেন। তার আগেই গোপালের দোকানে বেচারের বই দেখে এসেছি। এইটুকু জায়গায় দু-দুটো লোকের কাছে ফ্লজিস্টন থিওরীর বই! কাকতালীয়? না এরা দুজন পরস্পরকে চেনে? শিউলালকে তাই খোঁজ নিতে বললাম
-আপনি শিউলালকে দিয়ে তদন্ত শুরু করাতেই আপনার ওপর আক্রমণ হল।
-হ্যাঁ। আমরা আসার সময়ে দোকানের বসানোর অছিলায় গোপাল খুব সম্ভব আমার ঘ্রাণ তার জ্যাকুলিসকে শুঁকিয়ে রেখেছিল। প্রয়োজনে সেটাই কাজে লাগায়।
-কিন্তু আপনার এগুলো সবই অনুমান। কঠিন প্রমাণ কিছু নেই।
মাথা নাড়ে ধূর্জটি
-জানি। সেইজন্যেই চিত্ত আর রামসহায়কে সরিয়ে দিয়ে সুকুমারবাবুকে একটা আক্রমণের সু্যোগ করে দিলাম। আর উপেনকেও বলে এলাম আমরা বিপদে পড়লে রঘুকে পাঠিয়ে দিতে। প্রমাণের অপেক্ষায় থেকে আবার কারো প্রাণ যাক সে ঝুঁকি আমি আর নিতে চাই নি।
-আমার বাবার এতদিনের বন্ধু। তাঁর এইরকম আচরণ—
মাঝ পথে থেমে যান সৌম্যেন্দ্রনারায়ণ। খেয়াল করি তাঁর চোখের কোন চিকচিক করছে।
নীল আকাশের বুকে ফের উড়ে যায় একসারি হাঁস। সেদিকে তাকিয়ে থাকে ধূর্জটি।
-অর্থতৃষ্ণা। অর্থতৃষ্ণায় সুকুমারবাবু সব ভুলেছিলেন। মানুষ থেকে নির্দয় নরপশু হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন।
#########
পরিভাষাকোষ
আইকর : ichor; দানব রক্ত
ক্যালরিক : The substance of heat, as proposed by Lavosier
ত্রাসপশু : অতিপ্রাকৃত পশু; monster
থ্যাকার্স ডিরেক্টরি : থ্যাকার্স ইণ্ডিয়ান ডিরেক্টরি কলকাতা থেকে প্রকাশিত ভারতে ব্রিটীশ রাজত্বের তথ্য সমণ্বিত ডিরেক্টরি।
কলগোলাম : clockwork robot
বেচার : Johan Joachim Becher
স্টাহ্ল : Georg Ernst Stahl
জাম্বুরক: ঘোড়া বা উটের পিঠে বইবার উপযুক্ত ক্ষুদ্রাকার তোপ।
জাজেল : দুর্গ প্রাকারে ব্যবহৃত সুদীর্ঘ নলের বন্দুক
তোড়া : flintlock / matchlock
তোড়াদার জাজেল : জাজেল ও তোড়া দ্রষ্টব্য
বহুরূপ নক্ষত্র : variable star
যুগল নক্ষত্র : binary star
নব নক্ষত্র : nova
জ্যোতিষ যন্ত্র : orrery
করিমুণ্ড রাশি : Coma Berenices
ফ্লজিস্টন : Phlogiston; a substance supposed by 18th-century chemists to exist in all combustible bodies, and to be released in combustion.
কিমিয়া : alchemistry
কিমিয়াখানা : alchemistry lab.
অলস্টার: ulster; ওভারকোট জাতীয় শীতপোষাক
ফাদার লাফঁ : Father Eugene Lafont; সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের অধক্ষ্য; ইণ্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশান অফ কাল্টিভেশন অফ সায়েন্সের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা।
মাছি : bead, sight; বন্দুকের নিশানা কল
হাওদা পিস্তল : হাতির হাওদার পাশে বেঁধে রাখার উপযুক্ত অতিকায় গাদা পিস্তল।
হেলিওগ্রাফ : Heliograph; সূর্যকিরণের সাহায্যে সঙ্কেত পাঠানোর যন্ত্র
বজ্রবহ্নি : বজ্রের প্রাকৃতিক বিদ্যুৎ; (ঋণ : রবীন্দ্রনাথ)
এল্ড্রিচ : eldritch; অতিপ্রাকৃত
ৎসুচিনোকো : Tsuchinoko; জাপানের সর্পশ্রেণীর বিষাক্ত জীব।
অ্যাডামান্টাইন : বিরল ধাতু।