কৌস্তূভ – শেষ অংশ
কৌস্তূভ – শেষ অংশ
সুমিত বর্ধন
(২১)
রাইফেলের স্কোপে চোখ রাখে সুরিন্দার। দুভাগে ভাগ হয়ে মাটিতে বুক ঘষে এগিয়ে আসছে পলিমারের বর্ম আঁটা জনা ছয়েকের একটা দল।
খানিকটা এগিয়ে এসে হাঁটু গেড়ে রাইফেল তোলে ছজন। কড়-কড় আওয়াজে ছিটকে আসে প্লাজমার ছটা রেখা।
ব্যারিকেডের পেছনে ঝুঁকে পড়ে সুরিন্দার। জবাবী ফায়ারিঙে বাজের আওয়াজ তোলে তার সঙ্গীদের রাইফেলগুলো। কিছুক্ষণ দুপক্ষের প্লাজমা বিনিময়ের পর থেমে যায় ব্যারিকেডের অন্যপাশে রাইফেলের শব্দ। মাথা তুলে সুরিন্দার দেখতে পায়, ফের বুকে ভর দিয়ে শুয়ে পড়েছে পৃথিবীর থেকে আসা হানাদারেরা।
পেছনদিকে একবার তাকায় সুরিন্দার। সন্তোষগঞ্জের উত্তর-পশ্চিমে আকাশে মাথা তুলেছে আগুনের শিখা, কালো ধোঁয়া উড়ছে বাতাসে।
আবার রাইফেল গর্জাতে আরম্ভ করে দুপক্ষেই। ফের চলে প্লাজমা বিনিময়।
হানাদারদের দল থেকে একজন কি একটা ছুঁড়ে দেয় হাওয়ায়। যান্ত্রিক গুঞ্জন তুলে হাওয়ায় উড়ে আসে একটা ধাতব বল।
—হাওয়া গ্রেনেড! হাওয়া গ্রেনেড!
কে চিৎকার করে ব্যারিকেডের পেছন থেকে।
স্কোপে চোখে রাখে সুরিন্দার। উড়ন্ত বলটা নিশানায় এনে চাপ দেয় ট্রিগারে। ব্যারিকেডের অনেকে আগেই একটা বিস্ফোরণে উড়ে যায় বলটা।
রাইফেল নামিয়ে ব্যারিকেডের পেছনে বসে পড়ে সুরিন্দার।
সন্তোষগঞ্জের আকাশে একটা ভয়ঙ্কর বিস্ফোরণ হয়। প্রখর আলোয় ঝলসে যায় চোখ, শব্দে তালা লেগে যায় কানে। কিছুক্ষণের জন্যে দৃষ্টিশক্তি আর শ্রবণশক্তি দুইই হারিয়ে ফেলে সুরিন্দার আর তার সঙ্গীরা।
কিছুক্ষণ বাদে যখন সুরিন্দার নজর দেয় ব্যারিকেডের অন্য দিকে ততক্ষণে তাদের বিহ্বলতার সুযোগ নিয়ে শ্ত্রুরা এগিয়ে এসেছে অনেক কাছে।
(২২)
সরযূ পাস থেকে শ্যামলাঝোরার ওপরে উঠে আসে তিনজনে। পেছনে ধাতুর পায়ে সাবধানী পদক্ষেপে উঠে আসে নেট টার্বাইনের বাক্স। আনন্দী এখানে হাওয়ায় জলকণা উড়িয়ে ঝাঁপ দিয়েছে পাহাড়ের নিচে, তার প্রবল গর্জনে কান পাতা দায়।
মিহিরে রোদ মেখে আনন্দী ছুটে যায় প্রপাতের দিকে, তার ঝকঝকে জলের বুকে উঁচিয়ে থাকা ছোট বড় পাথরের মাঝে চোখে পড়ে কৌস্তূভের অভিনব জীবজগতের প্রাণচাঞ্চল্য। কোথাও পাথরের গায়ে লেপ্টে রোদ পোয়ায় ফিতা কুমীর, কোথাও লম্বা সরু ঠোঁট জলে ডুবিয়ে চুপ করে বসে থাকে সারস বেড়াল, আবার কোথাও তিন পায়ে ভর দিয়ে পাথর থেকে পাথরে লাফিয়ে যায় ক্যাঙারু ভোঁদড়।
নদীর পাশে গিয়ে চোখে মুখে জল ছেটায় সুচেতা। একটু আগেই ফেলে আসা মৃত্যু আর হানাহানির স্মৃতি যেন অনেক দূরের দুঃস্বপ্নের মতন লাগে তার।
—জলের বেশি কাছে যেও না। তোমাকে দেখে কোনও জন্তু আবার তেড়ে আসবে বলা যায় না।
প্রপাতের গর্জনের আওয়াজ ছাপিয়ে ভেসে আসে নিতাইয়ের সাবধান বাণী।
নদীর বুকের প্রাণীগুলোর দিকে একবার তাকিয়ে অনিচ্ছাসত্ত্বেও পেছনে সরে আসে সুচেতা। নিতাই আর শতদল তখন নেট টার্বাইনের বাক্সটা নিয়ে ব্যস্ত।
বাক্সের কোথাও একটা হাত ছোঁয়ায় শতদল, বাক্সের চারটে পা ছোট হতে থাকে, বাক্সটা নিচু হয়ে নেমে আসতে থাকে মাটির কাছাকাছি।
বাক্সটা যখন মাটি থেকে প্রায় হাত-দুয়েক উঁচুতে, শতদল আর নিতাই দুপাশ থেকে ধরে বাক্সটা নিয়ে তার সরু দিকিটা নদীর দিকে একেবারে কিনারায়।
নদীর বুকে উঁচিয়ে থাকা পাথরগুলোর দিকে তাকায় শতদল।
—কোনটাতে লাগাবে?
মাঝনদীতে একটা বড় পাথর আঙুল তুলে দেখায় নিতাই।
—ওটাতেই লাগাও।
বাক্সের গায়ে হাত ছোঁয়ায় শতদল, বাক্সের সরু দিকটা থেকে একটা লাল আলোর রেখা বেরিয়ে এসে নদীর জলকে ছোঁয়। বাক্সটাকে এদিক-ওদিক ঘোরাতে থাকে নিতাই, যতক্ষণ না বাক্স থেকে বেরোনো লাল আলোর রেখা গিয়ে পড়ে নদীর বুকের পাথরের গায়।
আবার বাক্সটাকে ছোঁয় শতদল। খুলে যায় বাক্সের সরু দিকটার ঢাকনা, ছিটকে বেরিয়ে আসে একটা ধাতুর গজাল, পেছনে তার ধাতুর কাছি বাঁধা। সশব্দে আছড়ে পড়ে গজাল পাথরের ওপর, তারপরে একটা বিস্ফোরণের শব্দে আমূল গেঁথে যায় তার ভেতর। কর্কশ চিৎকারে প্রতিবাদ জানিয়ে পাথর থেকে ছিটকে পালায় সারস বেড়াল আর ক্যাঙারু ভোঁদড়, জলে ঝাঁপ দেয় দু-একটা ফিতে কুমীর।
ফের বাক্সের গায়ে হাত ছোঁয়ায় শতদল। প্রথমে কোনাকুনি বেঁকে যায় চারটে পা। পরপর চারটে বিস্ফোরণের শব্দ ওঠে, মাটি থেকে ওড়ে ধুলো আর পাথরের কুঁচি, মাটিতে ঢুকে গেঁথে যায় চারটে পায়া।
বাক্স আর পাথরে পোঁতা গজালের মধ্যের ধাতুর মোটা কাছিটা হাত দিয়ে পরখ করে নিতাই।
—টানটান আছে। চালাও।
বাক্সর গায়ে শেষ বারের মতন হাত ছোঁয়ায় শতদল। বাক্সের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে একটা লাটিম, তার মাঝের ফুটো দিয়ে চলে গেছে বাক্স থেকে বেরনো কাছি।
কাছি বরাবর এবার সামনের দিকে ছিটকে যায় লাটিম, গিয়ে থামে নদীর জলের ওপরে।
এরপর পাক খেতে আরম্ভ করে লাটিম তার গায়ে জড়ানো লম্বা জাল নদীর জলে ভেসে পড়তে থাকে সামনের প্রপাত বেয়ে।
গায়ে জড়ানো সমস্ত জালটুকু জলে ভাসিয়ে দিয়ে পাক খাওয়া বন্ধ করে লাটিম।
জালটার দিকে বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখে সুচেতা।
—এই দিয়ে বিদ্যুৎ তৈরি হবে?
মাথা নাড়ে শতদল।
—হবে। ওই জালটার প্রত্যেকটা গাঁটে বসানো আছে একটা ন্যানো-ট্যারবাইন। ওগুলোর সম্মিলিত শক্তি কম নয়।
—এইবার খালি এইটার সঙ্গে জুড়ে দেওয়া।
মাটি থেকে ড্রোনটা দুহাতে তুলে ধরে নিতাই। বাক্সের পেছন থেকে একটা তার টেনে নিয়ে ড্রোনের সঙ্গে জুড়ে দেয় শতদল।
—এইবার অগ্নি পরীক্ষা। আমাদের কাজ সফল হল কি না এইবার বোঝা যাবে।
ড্রোনের গায়ে একটা বোতামে হাত ছোঁয়ায় নিতাই। ড্রোনের গায়ে একটা লাল আলো জ্বলে ওঠে। দু-একবার দপদপ করে আলোটা, তারপর লাল থেকে হলুদ, হলুদ থেকে সবুজ হয়ে যায়।
—যাক হয়ে গেছে! আমাদের কাজ শেষ।
সন্তুষ্টির ছোঁয়া লাগে নিতাইয়ের কন্ঠস্বরে।
ড্রোনের দিকে তাকায় সুচেতা।
—কাজ শেষ হয়ে গেল?
ড্রোনের হায়ে জ্বলতে থাকা লাল আলোটার দিকে ইঙ্গিত করে নিতাই।
—আলোটা সবুজ হয়ে গেছে দেখছ না? মানে ড্রোনের দায়িত্ব নিয়েছে আমাদের স্যাটেলাইটের ‘এআই’—ওই কৃত্রিম ধী এবার ড্রোনকে চালিয়ে নিয়ে যাবে সন্তোষগঞ্জ অবধি।
নদীর জলে হালকা করে ড্রোনটাকে ভাসিয়ে দেয় নিতাই। স্রোতের টানে সামনে ভেসে যায় ড্রোন। পেছনে কেবল তারের সংযোগটুকু রেখে প্রপাতে ঝাঁপ দিয়ে হারিয়ে যায় জলকণার আড়ালে।
নদীর দিকে থেকে চোখ ফেরায় সুচেতা।
—এবারে আমরা কী করব? সন্তোষগঞ্জ ফেরৎ যাবো?
আকাশের দিকে তাকায় শতদল। মিহির পার করে গেছে মধ্য গগন।
—না। যতক্ষণে আমরা সন্তোষগঞ্জ পৌঁছবো ততক্ষণে আমাদের আর কিছু করার থাকবে না। বরঞ্চ এদের ল্যান্ডারটা খোঁজার চেষ্টা করতে পারি। ল্যান্ডারের দখল নিলে যদি এদের দলের দু-একজন আমাদের হাতে পড়ে যায়, তাহলে আমাদের জমি কিছুটা শক্ত হবে।
সন্তোষগঞ্জ থেকে নিয়ে আসা ছবিটা ব্যাগ থেকে বের করে সুচেতা।
—ল্যান্ডার ওরা রামগিরির ভেতর দিকে কোথাও নামিয়েছে। কিন্তু সঠিক অবস্থানটা এই ছবি থেকে বোঝা যাবে কি?
ছবিটা সুচেতার হাত থেকে নেয় শতদল।
—পুরোটা না হলেও কিছুটা বোঝা যাবে। আমাদের ওপর যেখানে আক্রমণ হল, ল্যান্ডার তার থেকে খুব দূরে থাকবে না।
ছবিটা উঁচু করে তুলে ধরে শতদল। ছবির পাহাড়ের সঙ্গে মেলায় দিগন্তের পাহাড়ের চূড়োগুলোকে। তারপর আঙুল তুলে দেখায় একদিকে।
—ওইখানে। ল্যান্ডার খুব সম্ভব ওখানেই নেমেছে।
—যাবে তো বটে। কিন্তু নেমন্তন্ন খেতে তো আর খালি হাতে যাওয়া যায় না। ধরো এইটা।
খানিক আগের লড়াইয়ের পর তুলে নিয়ে আসা হানাদারদের একটা রাইফেল শতদলের দিকে বাড়িয়ে ধরে নিতাই।
মাথা নাড়ে শতদল।
—না নিতাইদা। ওটা আর ধরব না। ও জীবন পেছনে ফেলে এসেছি।
একটা বিরক্তির আওয়াজ করে নিতাই।
—মরণ বাঁচন সমস্যা, আর তুমি কি না চললে খালি হাতে যুদ্ধু করতে। তোমার সমস্যাটা কি বলতো? তুমি কি একা? এক একটা জীবন তো আমরা সবাই ফেলে এসেছি।
মিহিরের আলো পড়ে রূপোর মতন চকচক করে আনন্দীর জল। তার দিকে কিছুক্ষণ নীরবে তাকিয়ে থাকে শতদল।
—নিতাইদা, আমার অতীতটা জানলে তোমরা হয়তো এই মুহূর্তে আমাকে ফেলে চলে যাবে। যে সব ভাড়াটে হানাদাররা আজ কৌস্তূভে আমাদের আক্রমণ করতে এসেছে, এককালে আমি তাদের চাইতে খুব একটা আলাদা কিছু ছিলাম না।
ভাঁজ পড়ে নিতাইয়ের কপালে। বিস্ময়ে চোখ বিষ্ফারিত হয়ে ওঠে সুচেতার। আনন্দীর জলের দিকে তাকিয়ে থাকে শতদল।
পৃথিবীর কর্পোরেটরা নিজেদের মধ্যে কার্টেল বানিয়ে সাধারণ মানুষকে যে তাদের জুতোর তলায় রাখে তা তোমরা জানো। কিন্তু একটা বিষয় সাধারণ মানুষ জানে না। কর্পোরেটদের নিজেদের মধ্যেও একে অপরকে টেক্কা দেবার একটা নিরন্তর প্রতিযোগিতা চলে। আর এই ক্ষমতা আর মুনাফার প্রতিদ্বন্দীতায় তারা আইনি, বেআইনি কোনও পন্থাই ব্যববহার করতে পিছপা হয় না।
আরও গভীর হয় নিতাইয়ের কপালের ভাঁজ।
—মানে তুমি বলতে চাইছ এই ধরণের বেআইনি কাজে তুমিও জড়িত থাকতে?
একটা লম্বা নিঃশ্বাস উঠে আসে শতদলের বুকের ভেতর থেকে।
—হ্যাঁ। আমি ছিলাম দক্ষ নিশানাবাজ—শার্প শুটার। যে কর্পোরেট হাউসের হয়ে আমি কাজ করতাম তাদের প্রতিদ্বন্দীদের বাগে রাখতে আড়িপাতা, গোয়েন্দাগিরি, গুপ্তহত্যা সব কাজই আমায় করতে হত।
গর্জন করে নিজের মনে বয়ে চলে আনন্দী। তার বুকে বয়ে চলে কৌস্তূভের নিরবচ্ছিন্ন প্রাণ চাঞ্চল্য। আকাশ দিয়ে শিসের শব্দ তুলে উড়ে যায় জবা পাখির ঝাঁক। দুটো মানুষ নীরবে তাকিয়ে থাকে শতদলের দিকে।
—আমার কাজ ছিল অত্যন্ত গোপন, কর্পোরেট হাউসের মাথার ওপরের দিকের দু-একজন ছাড়া আমার অস্তিত্বের খবর পর্যন্ত জানত না। কিন্তু একবার আমাদের এক প্রতিদ্বন্দী কোম্পানী জেনে গেল আমার সঠিক পরিচয়। অতীতের বদলা নিতে কন্ট্রাক্ট দিল তাদের ভাড়াটে গুন্ডাদের।
পকেট থেকে একটা ছবি বের করে নিতাইয়ের দিকে বাড়িয়ে ধরে শতদল।
—আমার স্ত্রী আর কন্যা। শপিং করতে বেরিয়েছিল। রাইফেলের প্লাজমাতে ঝাঁঝরা হয়ে যায়। হাতিয়ারকে পেশা করা আমার গোপন জীবনের মাসুল দিল দুটো নিরপরাধ প্রাণ।
ছবিটা হাত বাড়িয়ে নেয় নিতাই। মায়ের কোলে বছর ছয়েকের মেয়ে। মেয়ের মুখে হাসি। মায়ের দৃষ্টি মেয়ের হাসির ওপর।
ছবিটা ঝুঁকে দেখে সুচেতা।
—তোমার পরিচয় জানাজানি হল কি করে?
শূন্য দৃষ্টিতে সুচেতার দিকে তাকায় শতদল।
—একবার ফ্রিডম ইনিশিয়েটিভ আমাদের কোম্পানীর সার্ভার হ্যাক করে যা কিছু গোপন খবর সব অনলাইনে তুলে দেয়। তার মধ্যে আমার সব নাড়িনক্ষত্রের খবরও ছিল।
একটা অদ্ভুত হিক্কার মতন শব্দ বেরিয়ে আসে সুচেতার গলা থেকে। মুখে হাত চাপা দিয়ে সে বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে থাকে শতদলের দিকে।
শতদলের চোখে চোখ রাখে নিতাই।
—আমাদেরই সবারই কিছু না কিছু ইতিহাস আছে। কিন্তু সে ইতিহাস ভুলে নতুন জীবন গড়ার জন্যেই আমাদের কৌস্তূভে আসা। এখানে আর তুমি জীবন নিতে হাতিয়ার ধরছো না। হাতিয়ার ধরছো মানুষের জীবন বাঁচাতে।
কৌস্তূভের নীল আকাশের দিকে তাকিয়ে একটা লম্বা নিঃশ্বাস নেয় সুচেতা। মিহিরের আলো পড়ে চিকচিক করে তার চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়া জল।
—শতদল, একটা কথা তোমার জানা দরকার। আমাকে যখন পরেশের লোক আটকে রেখেছিল, তখন একবার তার দলের দু-একজন নিজেদের মধ্যে একবার বলাবলি করছিল তারা একটা কন্ট্রাক্ট পেয়েছে—কোনও এক কর্পোরেট হাউসের শার্প শুটারকে শিক্ষা দিতে তার পুরো পরিবারকে শেষ করে দিতে হবে।
সুচেতার দিকে এক ঝটকায় ফেরে শতদল। এবার বিস্ময়ে বিস্ফারিত হয়ে ওঠে তার চোখ।
পৃথিবীতে আমি আমার পরিবারের খুনিদের খুঁজে বের করার অনেক চেষ্টা করেছি, কিন্তু কিছুতেই তাদের খোঁজ পাইনি।
এবার কৌস্তূভে পেলে। চলো হিসেবটা মিটিয়ে দিয়ে আসি। নাও ধরো এটা।
শতদলের হাতে রাইফেলটা তুলে দেয় নিতাই।
এবার আর আপত্তি করে না শতদল।
(২৩)
সন্তোষগঞ্জের দক্ষিণে লড়াইটা এগিয়ে এসেছে আরও কাছে। সুরিন্দারের টিমের লড়াইয়ের ক্ষমতাটা কিছুক্ষণের মধ্য বুঝে নিয়ে এবার আক্রমণের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছে হানাদারেরা। একের পর উড়ে আসছে হাওয়া গ্রেনেড, তাদের সবকটাকে সময় মতো ঠেকানো যাচ্ছে না। একটা একটু আগে ফেটেছে ব্যারিকেডের খুব কাছেই, তার থেকে উড়ে আসা টুকরোয় জখম হয়েছে দু-তিনজন।
এবার পেছন থেকে আক্রমণকারীরা টেনে এনেছে একটা মর্টার। একটা প্লাজমার গোলা এসে আছড়ে পড়ে ব্যারিকেডের বাইরে। এবার আর স্কোপের দরকার হয় না। খালি চোখেই সুরিন্দার দেখতে পায় ওপর নিচ করে মর্টারের নিশানা ঠিক করার চেষ্টা করছে হানাদারেরা। পরের গোলাটা আর লক্ষ্যভ্রষ্ট হবে না।
—গো ব্যাক! গো ব্যাক! পিছোও! পিছোও!
সুরিন্দারের নির্দেশে রাইফেল চালাতে চালাতেই ব্যারিকেড থেকে পিছু হটে আসে সুরিন্দারের টিম।
পরমূহূর্তেই একটা প্লাজমার গোলা এসে পড়ে ব্যারিকেডের ওপর। সশব্দ বিস্ফোরণে উড়ে যায় ব্যারিকেড, মাথার ওপর থেকে বৃষ্টির মতন ঝরে পড়ে মাটি আর ধাতুর তপ্ত টুকরো।
সব সাবধানতা শিকেয় তুলে দেয় হানাদারেরা, একটা বিজয় উল্লাস তুলে রাইফেল চালাতে চালাতে সন্তোষগঞ্জের দিকে ছুটে আসতে থাকে তারা।
—পিছোও! পিছোও! ব্যাক! ব্যাক!
সঙ্গীদের নিয়ে সন্তোষগঞ্জের কিনারা ছেড়ে ভেতরের কাঠের বাড়িগুলোর ফাঁকে ঢুকে আসে সুরিন্দার।
রাইফেল চালাতেই চালাতেই পিছু হটে সুরিন্দার আর তার সঙ্গীরা, সরে আসে একটা গলিপথের মুখে। গলির একদিকে একটা বাড়ির কাঠের দেওয়াল, অন্যদিকে দুমানুষ সমান উঁচু করে সাজানো ধাতুর ক্রেট। গলি থেকে বেরোনোর কোনও রাস্তা নেই, পেছনের মুখও বন্ধ স্তূপ করা ক্রেট দিয়ে।
—প্ল্যান রেড! প্ল্যান রেড!
চাপা গলায় নির্দেশ দেয় সুরিন্দার।
আগে থাকতে ঠিক করা প্ল্যান মাফিক পালটে যায় লড়াইয়ের কায়দা। সুরিন্দারের টিমের বেশিরভাগ লোক মিলিয়ে যায় সন্তোষগঞ্জের কাঠের বাড়িঘরের আনাচে কানাচে, নীরব হয়ে পড়ে তাদের রাইফেল। বাকিরা গলির মুখে দাঁড়িয়ে রাইফেল চালাতে থাকে হানাদারাদের উদ্দেশ্যে।
আরও পেছনে হটে আসে সুরিন্দার আর তার সঙ্গীরা, সরে আসে গলির একদম শেষ প্রান্তে। হানাদাররা এগিয়ে আসে আরও কাছে, গলির মুখে।
গলির একপাশের কাঠের দেওয়ালের গায়ে একটা পাল্লা বিহীন দরজা। হানাদারদের প্লজমা থেকে বাঁচতে সুরিন্দারের দল এবার দরজা দিয়ে ঢুকে পড়ে বাড়ির ভেতর।
উল্লাসে চিৎকার করে গলির ভেতরে ঢুকে আসে হানাদারের দল, বিরামহীন ভাবে গর্জাতে থাকে তাদের হাতের রাইফেল।
বাড়ির ভেতরে ঢুকে রাইফেল নামিয়ে ফেল সুরিন্দাররা, উর্ধশ্বাসে দৌড়তে আরম্ভ করে বাড়ির অন্যদিকে।
বাড়ির উল্টোদিকে আর একটা দরজা। দরজার অন্যপাশে দুদিকে কাঠের দেওয়াল দেওয়া একটা সরু গলি। গলির পর আর একটা দরজা। এ দরজাটা অন্য আর একটা বাড়ির।
এ দরজাটাও পার হয়ে যায় সুরিন্দার, কাঠের দেওয়াল দেওয়া গলিপথ দিয়ে এসে পড়ে আর একটা বাড়িতে।
আগের দিন রাতে সুরিন্দার আর তার সঙ্গীরা এইভাবে কাঠের গলিপথ দিয়ে জুড়ে দিয়েছে গোটা পাঁচেক বাড়ি। সেইসঙ্গে কেবল দুটো দরজা বাদে তক্তা মেরে বন্ধ করে দিয়েছে বাড়িরগুলোর সমস্ত জানলা আর অন্য প্রবেশদ্বার।
শেষ বাড়িটার দরজা দিয়ে সুরিন্দার আর তার সাথীরা যখন শেষ বাড়িটার দরজা দিয়ে খোলা আকাশের নিচে বেরিয়ে আসে হানাদাররা তখন মাঝের কোনও একটা বাড়িতে।
সুরিন্দাররা বেরিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গেই এগিয়ে আসে তার বাকি সঙ্গীদের কয়েকজন, যারা একটু আগেই লুকিয়ে পড়েছিল অন্য কোথাও। দরজার দুপাশে জড় করে রাখা কাঠের আঁটি টেনে স্তূপ করে দেয় দরজার মুখে।
ঠিক সেই সময় যে দরজা দিয়ে ঢুকেছিল সুরিন্দাররা আর তার পেছনে হানাদারেরা, তার মুখেও কাঠের পাঁজা স্তূপ করে দেয় আর এক দল।
কয়েক পা পিছিয়ে যায় সুরিন্দার। একের পর এক জোড়া বাড়িগুলোর আশপাসে এগিয়ে আসে আরও দু-তিনজন, হাতে তাদের জেট ফুয়েল ভরা বোতল। বোতলের মুখে বসানো ন্যাকড়ার সলতেয় আগুন লাগিয়ে তারা এবার বোতল ছুঁড়ে মারে বাড়িগুলোর দেওয়ালে আর চালে।
কৌস্তূভের অক্সিজেন ঘন বাতাসে এক লহমায় দাউদাউ করে জ্বলে ওঠে কাঠের বাড়ি, ভেতর থেকে ভেসে আসে ভয়ার্ত চিৎকার আর দিশাহীন ছোটাছুটির পদশব্দ।
কয়েক সেকেণ্ডের মধ্যে আগুনের শিখার আড়ালে হারিয়ে যায় বাড়িগুলো, ভয়ের চিৎকার পালটে যায় মরণ আর্তনাদে, আগুনের আঁচ এড়াতে দলবল নিয়ে অনেকটা পেছনে হটে যেতে বাধ্য হয় সুরিন্দার।
হঠাৎ হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ে একটা কাঠের দেওয়াল, আগুনের ভেতর থেকে পাগলের মতো ছুটে বেরিয়ে আসে গোটা তিনেক মানুষ, তাদের সর্বাঙ্গ মোড়া আগুনের শিখায়।
জ্বলন্ত জতুগৃহ থেকে তারা কয়েক পা এগোতেই না এগোতেই বাজের আওয়াজে ডেকে ওঠে কয়েকটা প্লাজমা রাইফেল।
মাটিতে মুখ থুবড়ে পরে যায় জ্বলন্ত দেহগুলো, আর ওঠে না।
রাইফেল নামিমে নেয় সুরিন্দার।
সন্তোষগঞ্জের দক্ষিণের লড়াই শেষ।
আকাশে মিহির তখন সরে এসেছে মধ্য গগন থেকে।
(২৪)
শ্যামলাঝোরা ছাড়িয়ে আরও খানিকটা ভেতরে এগিয়ে এসে অক্সিজেন টক্সিসিটি ওষুধ খাওয়ার জন্যে কয়েক সেকেণ্ড থামে তিনজনে। রামগিরির এখানটা গাছ প্রায় নেই বললেও চলে, রুক্ষ পাথর এখানে ওখানে ঢেকেছে ঝোপঝাড়ে।
হাতের পাতায় ওষুধটা নিয়ে একটা নিঃশ্বাস ফেলে নিতাই।
—বিকেলের মধ্যে যদি ড্রাগ প্রিন্টার চালু না হয় তাহলে ক্যাম্পের সবাই বিনা ওষুধে অসুস্থ হয়ে পড়বে।
নিতাইয়ের দিকে তাকায় শতদল।
—ক্যাম্প ডক্টর ম্যাডাম আর সুরিন্দারের জিম্মায় আছে। তারা সামলে নেবে। আমরা দেখি কি করে তাদের এখান থেকে সাহায্য করা যায়।
সুচেতার দেওয়া ছবিটা আর একবার বের করে দেখে শতদল।
—আমরা ল্যান্ডারের কাছাকাছিই কোথাও আছি। একটু হুঁশিয়ার থাকো সবাই।
আকাশের দিকে তাকায় সুচেতা।
—ওরা ল্যান্ডারে করে নামলো কেন?
অত ভারী মহাকাশ যান অভিকর্ষের খপ্পরে পড়লে তাকে জমি থেকে মহাকাশে ফেরৎ নিয়ে যাওয়াটা কঠিন। আমরা পৃথিবীতে আর ফিরব না, তাই শিপ নামিয়ে এনেছিলাম কৌস্তূভের জমিতে। কিন্তু ওরা ফের ফিরে যাবে পৃথিবীতে, তাই নেমেছে ল্যান্ডারে।
—মানে ওদের শিপ কক্ষপথেই কোথাও আছে।
—একদম!
মাথা ঝুঁকিয়ে সায় দেয় শতদল।
—শুধু কক্ষপথেই নেই, আছে হয়তো একদম আমাদের মাথার ওপর। যেখান থেকে শিপের ক্যামেরা সন্তোষগঞ্জের ওপর নজর রাখতে পারে। আর কাজ শেষ হয়ে গেলে সময় নষ্ট না করে ল্যান্ডার নিয়ে যানে উড়ে যাওয়া যায়।
কপালে হাত রেখে আকাশের দিকে তাকায় নিতাই।
—শিপে কি এরা কাউকে রেখে এসেছে?
একটা মৃদু হাসি ফোটে শতদলের ঠোঁটে।
—সে চান্স কম। এরা কেউ কাউকে বিশ্বাস করে না। শিপ কারোর দায়িত্বে দিলে সে যদি এদের বিপদের মুখে ফেলে পালায়? এরা ফিরবে কি করে? না, শিপে কেউ নেই। যারা এসেছে, তারা সবাই নেমে এসেছে কৌস্তূভের জমিতেই। সবাই ফিরে গেলে তখন এদের কম্যাণ্ডার নিজেই চালু করবে শিপে।
শতদলের ছবিটা ঝুঁকে পড়ে দেখে নিতাই। আঙুল দিয়ে দেখায় পাহাড়ের গায়ে একটা উঁচু চড়াই।
—ওর পেছনেই নেমেছিল না ল্যান্ডার?
রাইফেলের সেফটি নামায় শতদল।
—হ্যাঁ। দেখে তাই মনে হচ্ছে। হুঁশিয়ার থেকো।
পাহাড়ের রুক্ষ্ম ঢাল বেয়ে ওপর ওঠে তিনজনে। চারপাশে ছড়ানো বড় বড় পাথর, তার একটা থেকে আর একটায় চামড়ার ডানায় ভেসে উড়ে যায় কাছি বাদুড়, গলার নিচে ঝোলে দড়ির মতো লম্বা তন্তু।
চোখ তুলে ইঙ্গিত করে নিতাই।
—এই দেখ আর অদ্ভূত জীব। এদের গলার দড়িটা কি কাজে লাগে বলো দিকি?
—কে জানে। বোধহয় পাথরের ফাঁকফোকর থেকে পোকামাকড় ধরে ওই দিয়ে।
খানিক অন্যমনস্ক ভাবেই উত্তর দেয় শতদল, তার সতর্ক দৃষ্টি তখন নজর রাখে চারপাশে।
একটু দূরের একটা বড় পাথর লক্ষ করে একটা কাছি বাদুড় উড়ে যায় মাথার ওপর দিয়ে। কিন্তু বসার ঠিক আগের মূহূর্তে হঠাৎ ছিটকে যায় পাথর থেকে, একটা তীক্ষ্ণ স্বরে প্রতিবাদ জানিয়ে ফের ভাসতে থাকে বাতাসে।
এক টানে সুচেতাকে মাটিতে শুইয়ে দেয় শতদল, সঙ্গে সঙ্গে নিজেও ঝাঁপ দেয় তার পাশে।
শতদলের এই ক্ষণিকের জন্যে একটা হতভম্ব ভাব ফুটে ওঠে নিতাইয়ের মুখে, কিন্তু তাও শতদলের দেখাদেখি সেও ঝাঁপ দেয় মাটিতে।
একটা মূহূর্তও যায় না, বড় পাথরটার আড়াল থেকে সশব্দে ছিটকে আসে প্লাজমার লালচে রেখা।
বাঁদিকে আর একটা উঁচু পাথরের দিকে চোখ তুলে ইঙ্গিত করে শতদল।
—ওটার পেছনে! ওটার পেছনে! এই খোলা জায়গায় এখুনি আমাদের ওরা ঝাঁঝরা করে দেবে।
শতদলের কথায় সায় দিয়ে পাহাড়ের ওপরে আরও দু-তিন জায়গা থেকে ছিটকে আসা প্লাজমার রেখা আঘাত করে তার আশেপাসে। হাওয়ায় ছিটকোয় ধূলো আর পাথরের টুকরো।
বুক ঘষে পাথরের পেছনে সরে আসে তিনজনে। চারপাশে আঘাত করতে থাকে প্লাজমার রেখা।
—নিতাইদা, দুদিকটা একটু নজরে রেখো, আমাদের পাশ থেকে আক্রমণ করার চেষ্টা করতে পারে।
শতদলের কথা শেষ হয় না, পাহাড়ের ওপর থেকে কোনাকুনি তাদের দিকে ছুটে আসে কেউ, বিরামহীন গর্জন করে তার হাতের রাইফেল।
আধশোয়া অবস্থাতে রাইফেল চালায় নিতাই, প্লাজমার রেখা সোজা গিয়ে লাগে আক্রমণকারীর বুকে। হাতদুটো মাথার ওপর ছড়িয়ে দিয়ে চিৎ হয়ে আছড়ে পড়ে সে।
শতদলের দিকে তাকায় নিতাই।
—এইখানে এদের আটকে রাখা মুস্কিল। আমরা কি আস্তে আস্তে পাহাড়ের নিচের দিকে নামার চেষ্টা করবো?
উত্তর দেওয়ার সুযোগ পায় না শতদল। একটা ছোট কৌটোর মতন জিনিস পাথর টপকে এসে পড়ে তাদের মাঝখানে।
জিনিসটা চিনতে অসুবিধে হয় না না নিতাইয়ের। আতংকে বিষ্ফারিত হয়ে ওঠে তার দুই চোখ।
—টেসলা গ্রেনেড!
কিন্তু ততক্ষণে কারোর আর কিছু করার নেই।
একটা মৃদু খুট শব্দে খুলে যায় কৌটের দুপাশ। দুদিকে থেকে বেরিয়ে আসে শিরা-উপশিরার মতন নীল বিদ্যুতের অজস্র রেখা, স্পর্শ করে পাথরের পেছনে আশ্রয় নেওয়া তিনটে শরীরকে।
যন্ত্রণার চিৎকার তুলে অজ্ঞান হয়ে যায় তিনজনেই।
(২৫)
সারা শরীরে অশ্য যন্ত্রনা বোধ করে সুচেতা, চোখটুকু খুলতে কষ্ট হয়। পাঁজরে কিসের খোঁচা লাগে তার, গড়িয়ে সরে যেতে চেষ্টা করে সে।
আর একবার খোঁচা লাগে তার পাঁজরে, সঙ্গে কানে আসে একটা কণ্ঠস্বর।
—কি খুকুমণি, আগের বারের আপ্যায়নের সখ মেটেনি? আর একবারের আশায় এতদূর ছুটে এসেছ?
কণ্ঠস্বর চেনা সুচেতার। মনের কোনের এক গোপন প্রকোষ্ঠে বন্ধ করে রাখা অনেক দুঃস্বপ্নের স্মৃতির সাক্ষী ওই কণ্ঠস্বর। শরীর নিংড়ে নেওয়া অকথ্য অত্যাচার, বন্দী জীবনের অসহায় একাকীত্ব, কাছের মানুষকে কে চিরতরে হারানোর অসহায় শূন্যতা, এ সমস্ত যন্ত্রনার সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে আছে ওই কণ্ঠস্বর।
এক ঝটকায় চোখ খুলে যায় সুচেতার। সামনে যে দাঁড়িয়ে তার মাথায় ছোট ছোট করে ছাঁটা চুল। বলের মতো গোল মাথাটা যেন ঘাড় ছাড়াই বসানো চওড়া কাঁধের ওপর। বাহুমূলে উল্কির আঁকিবুঁকি।
মেজর পরেশ।
গলা দিয়ে গোঙানীর মতো একটা আওয়াজ বেরিয়ে আসে সুচেতার। উঠে বসে হাতে ভর দিয়ে পেছনে সরে যাওয়ার চেষ্টা করে সে।
তার পাঁজরে বুটের ঠোক্কর মারে পরেশ।
—ঘুম ভাঙলো খুকুমণি?
পাশ থেকে নিতাইয়ের কন্ঠস্বর ভেসে আসে।
—আরে মাথামোটা পরেশ, সাধে কি আর ইউনিটের লোক তোকে বলদ বলতো! যত বাজে সওয়াল করছিস!
সুচেতা দেখে তার থেকে একটু দুরেই মাটিতে বসে আছে নিতাই আর শতদল। রক্ত গড়িয়ে পড়ছে তাদের নাকমুখ দিয়ে। তার জ্ঞানে ফেরার আগেই একপ্রস্থ অভ্যর্থনা হয়ে গেছে তাদের ওপর দিয়ে।
আগুন জ্বলে ওঠে পরেশের চোখে। লম্বা পায়ে নিতাইয়ের দিকে এগিয়ে গিয়ে সজোরে একটা লাথি কষায় সে নিতাইয়ের শরীরে।
যন্ত্রণার কোনও আওয়াজ আসে না নিতাইয়ের গলা থেকে। বরং হাসতে হাসতে সামনে ঝুঁকে পড়ে সে।
—তা কৌস্তুভে কি করতে এলিরে বলদ? তোর ওই মোটা মাথার জন্যে পৃথিবীর অক্সিজেনে পোষচ্ছিল না?
ফের একটা লাথি মারে পরেশ নিতাইকে। সুচেতা বুঝতে পারে তার থেকে পরেশের নজর সরিয়ে নেওয়ার জন্যে নিতাই ইচ্ছে করে পরেশকে অপমান করে আঘাতগুলো টেনে নিচ্ছে শরীরে। চোখের জল জোর করে চেপে নিতাইয়ের দিকে তাকিয়ে থাকে সে।
রক্তমাখা দাঁত বের করে হাসে নিতাই।
—তা বাবা পরেশ, তোর কপাল ভালো বলতে হবে। ওই কুতকুতে চোখে তো দেখতে পাস না। তাও দেখ, কেমন কপালজোরে আমরা তোর হাতে পড়ে গেলাম।
নিচু হয়ে নিতাইকে সপাটে একটা চড় কষায় পরেশ
—কপাল নয় রে গাড়ল, ক্যামেরা! আমাদের শিপের ক্যামেরায় তোদের দেখতে পেয়েছিলাম এই পাহাড়ে পা রাখার সঙ্গে সঙ্গেই। বলদ তো তুই রে। আমার পাতা ফাঁদে কেমন পা দিলি।
নিতাইয়ের দিকে এবার তাকায় শতদলও। তার বুঝতে অসুবিধে হয় না নিজের দিকে পরেশের নজরটুকু আটকে রেখে শতদলকে পালানোর সুযোগগুলো খোঁজার সুবিধে করে দিচ্ছে নিতাই।
চারপাশটা একবার তাকিয়ে দেখে নেয় শতদল। তাদের সামনে রাইফেল উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে জনা ছয়েক হানাদার। পরণে তাদের পলিমারের বর্ম ছাড়াও পিঠে বাঁধা রয়েছে গ্লাইডার প্যাক। কোমরের বেল্টে ছোরার খাপ।
আড়চোখে অন্যদিকে তাকায় শতদল। ঢালের নিচের দিকে একটা ছোট ঝোপ। লম্বা ডঁটির মাথায় গোল থালার মতন পাতা। পাতার সামনে ঝোলে আঙুরের মতন গোল গোল ফলের থোকা।
গাছের ফল আর পাতার উদ্দেশ্যটা বুঝতে পারে। ফল পাকলে ফেটে আওয়াজ করে, আর ওই থালার মতো পাতায় সে আওয়াজ প্রতিধ্বনিত হয়ে ছড়িয়ে যাত চারপাশে।
ঝোপটার অবস্থান মনের মধ্যে একেবারে গেঁথে নেয় শতদল, পাহারাদারদের অলক্ষ্যে হাতের মুঠোয় কুড়িয়ে নেয় একটা ছোট পাথর, তারপরে অপেক্ষা করে সুযোগের।
—কমাণ্ডার! কমাণ্ডার!
পাহাড়ের ওপর থেকে হন্তদন্ত হয়ে নেমে আসে একজন। মাথায় তার পাইলটের সকেট আর চশমা বসানো হেলমেট, অন্য হাতে ধরা একটা ছোট প্রজেক্টর।
—কম্যাণ্ডার। শিপ থেকে রিপোর্ট।
নিতাইকে ছেড়ে এগিয়ে আসে মেজর পরেশ।
প্রজেক্টর চালু করে পাইলট।
হাওয়ায় ভেসে ওঠে সন্তোষগঞ্জের ত্রিমাত্রিক ছবি, যেন অনেক ওপর থেকে তোলা।
একটা বাঁকা হাসি নিয়ে ছবি দেখতে শুরু করে পরেশ। পরের পর ছবি পাল্টাতে থাকে, চওড়া হতে থাকে পরেশের হাসি।
হঠাৎ সন্তোষগঞ্জের দক্ষিণে ক্যামেরা জুম করে। দেখা যায় কৌস্তূভের বাসিন্দাদের তাড়া করে একটা বাড়িতে ঢুকছে পরেশের দল। তার একটু পরেই দাউদাউ করে আগুন ধরে ওঠে পাশাপাশি দাঁড়ানো গোটা তিনেক বাড়ি।
হাসিটা শুকিয়ে আসে মেজর পরেশের। আরও খানিকটা জুম করে ক্যামেরা। এবারের ছবিতে দেখা যায় একটা জ্বলন্ত বাড়ি থেকে ছিটকে বেরিয়ে আসছে পরেশের দলের দু-তিনজন, তাদের সর্বাঙ্গে আগুন ধরে গেছে। বেরোনোর সঙ্গে সঙ্গে তাদের ওপর প্লাজমা বর্ষণ করে সন্তোষগঞ্জের বাসিন্দাদের রাইফেল।
একটা ক্রুদ্ধ গর্জন বেরিয়ে আসে পরশের গলা দিয়ে। অন্যদিকে তখন হেসে গড়িয়ে পড়ে নিতাই।
—হাঃ হাঃ! তোর অর্ধেক টিম তো সাবাড় হয়ে গেল রে বলদ। এবার দিন ফুরনোর আগে বাকি অর্ধেকেরও ওই দশা হবে।
ফের গর্জন করে নিতাইয়ের দিকে এগোতে গিয়েও থেমে যায় পরেশ। কোনও একটা চিন্তায় কপালে ভাঁজ পড়ে তার।
হঠাৎ একটা গালাগালি বেরিয়ে আসে পরেশের গলা দিয়ে।
—শিপ্রা! এসব শিপ্রার প্ল্যান!
দলের লোকেদের দিকে আঙুল তুলে একজনের দিকে ইঙ্গিত করে পরেশ।
—তুমি ক্যাম্পের উত্তরে যারা আছে, তাদেরকে বলো পজিশন না ছাড়তে। পাহাড়ের ওপর থেকে যেন ফায়ারিং জারি রাখে।
যাকে নির্দেশ দেওয়া হল সে পিছিয়ে যায় কয়েক পা, তারপর হাত রাখে বুকের ওপর আড়াআড়ি করে বাঁধা গ্লাইডার প্যাকের বেল্টে।
হানাদারের পিঠে বাঁধা চৌকো জেট প্যাক পাটে পাটে ভাঁজ খুলে দুপাশে ছড়িয়ে যায় লম্বা ডানার মতো, প্যাকের মাঝখান থেকে নেমে আসে জেটের নীলাভ অগ্নি রেখা।
পাহাড়ের গা বেয়ে খানিকটা দৌড়য় পরেশের অনুচর, তারপর একটা লাফ দিয়ে উড়ে যায় আকাশে। কয়েক মিনিটের মধ্যে তার দুপাশে ডানা ছড়ানো চেহারটা মিলিয়ে যায় আকাশের বুকে।
হাতের মুঠোয় পাথরটা আরও শক্ত করে চেপে ধরে শতদল।
বেল্ট থেকে একটা হাওয়া গ্রেনেড বের করে নিতাইকে দেখায় পরেশ।
—কি ভেবেছিস? শিপ্রা আমার প্ল্যান বানচাল করে দেবে? হারামাজাদা, তোদের রিঅ্যাক্টর আমি নিজের হাতে উড়িয়ে দেব এইটা দিয়ে।
হেসে গড়িয়ে যায় নিতাই।
—সাধে কি আর লোকে তোকে আড়ালে বলদ বলে! ওরে মাথা মোটা, হাওয়া গ্রেনেড দিয়ে রিঅ্যাক্টর ওড়ানো যায় না।
বাঁকা হাসিটা ফের ফেরত আসে পরেশের ঠোঁটে।
—তুই কি মনে করেছিস তুই সব বুঝিস? এটা সাধারণ গ্রেনেড নয়। এর ভেতরে এক্সপ্লোসিভ নেই, আছে একটা হ্যাকিং যন্ত্র।
গ্রেনেডটা ফের বেল্টে লটকে দেয় পরেশ।
—এটা রিঅ্যাক্টরের কাছে ছেড়ে দিলে রিঅ্যাক্টরের কন্ট্রোল প্যানেলগুলোকে কয়েক সেকেণ্ডে হ্যাক করে সেগুলোকেই দিয়েই উড়িয়ে দেবে রিঅ্যাক্টর। এ গ্রহে তোদের আয়ু বেশীক্ষণ নয়।
দলের লোকেদের দিকে তাকায় পরেশ,
—তোমরা তিনজন আমার সঙ্গে এসো।
—আর তোমরা দুজন—
নিতাইয়ের দিকে তাকায় মেজর পরেশ। বাঁকা হাসিটা তখনও লেগে রয়েছে তার মুখে।
তোমরা এ তিনটেকে মেরে লাসগুলো পাহাড়ের নিচে ফেলে দাও। এই জঘন্য গ্রহের জন্তুজানোয়ারের পেট ভরাক এদের দেহগুলো।
পিঠের প্যাকের গ্লাইডারের ডানা মেলে দেয় পরেশ। জেটের নীল রেখা টেনে লাফিয়ে ওঠে আকাশে, তাকে অনুসরণ করে তার বাকি দুই অনুচর। কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনটে চেহারা হারিয়ে যায় আকাশের কোণে।
জুতোয় পাথর মাড়ানোর শব্দ ওঠে। কাঁধে রাইফেল রেখে সামনে এগিয়ে আসে পরেশের বাকি দুই শাগরেদ। নির্লিপ্ত চোখে তাকিয়ে থাকে ল্যান্ডারের পাইলট।
মাথায় ঘোরায় না শতদল। দৃষ্টি তার থাকে সামনের দিকে। মনের মধ্য একবার ছকে নেয় পেছনের ঝোপের অবস্থানটা।
তারপর হাতে ধরা পাথরটা ছুঁড়ে দেয় পেছনদিকে।
ঝোপের মধ্যে পাথর পড়তেই দুলে ওঠে ঝোপ, পটকার মতন আওয়াজে পটপট করে ফাটতে থাকে আঙুরের মতন ফলগুলো।
পেছনে ডিশের মতন পাতায় প্রতিধ্বনিত হয়ে সে আওয়াজ ছড়িয়ে যায় পাহাড়ের ঢালে, আওয়াজ শুনে চামড়ার পাখা ঝাপটিয়ে উড়ে আসে কাছি বাদুড়ের দল।
কয়েক সেকেণ্ডের জন্যে মনঃসংযোগ হারায় দুই হানাদার।
আর সেই কয়েক সেকেণ্ডের সুযোগ নেয় শতদল।
স্প্রিঙের মতন লাফিয়ে ওঠে শতদল মাটি থেকে, তার মাথা নিচু করা শরীরটা ছিটকে যায় একজন হানাদারের দেহ লক্ষ করে।
শতদলের বাঁ হাতটা আলগোছে চাপড় মারে হানাদারের রাইফেলের নলের তলায়। আঘাতে ওপর দিকে উঠে যায় রাইফেলের নল, বাজের আওয়াজ তুলে ব্যর্থ প্লাজমা ছিটকে যায় আকাশের দিকে।
শতদলের ডানহাত ততক্ষণে হানাদারের কোমরের খাপ থেকে টেনে নিয়েছে ছোরা, হানাদার দ্বিতীয়বার ট্রিগার টেপার আগেই সে ছোরা শতদল আমূল বিঁধিয়ে দেয় তার কানের গোড়ায়।
শতদলের এবার বাঁহাতের মুঠোয় চেপে ধরে হানাদারের রাইফেল, ডানহাতের ধাক্কায় তার প্রাণহীন দেহটাকে ঠেলে দেয় দ্বিতীয় হানাদারের দিকে।
গর্জে ওঠে দ্বিতীয় হানাদারের রাইফেল, কিন্তু রাইফেলের প্লাজমা আঘাত করে কেবল তার সঙ্গীর প্রাণহীন দেহে।
তার মধ্যেই প্রথম হানাদারের থেকে কেড়ে নেওয়া রাইফেল শতদল বসিয়ে নিয়েছে নিজের কাঁধে। এবার সেই রাইফেলের গর্জে ওঠা প্লাজমা আঘাত করে দ্বিতীয় হানাদারের মাথায়।
মাথা থেকে রক্ত ছিটকে যায় হানাদারের, তার দেহটা আছড়ে পড়ে মাটিতে।
হঠাৎ যেন সম্বিৎ ফিরে পায় স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ল্যান্ডার পাইলট, মাটিতে লাফ দিয়ে গড়িয়ে যায় সে একপাশে। ফের গর্জায় বটে শতদলের রাইফেল, কিন্তু প্লাজমার রেখা বেরিয়ে যায় পাইলটের অনেক ওপর দিয়ে।
মাটিতে শুয়েই কোমরের হোলস্টার থেকে স্প্রিং পিস্তল টেনে বের আনে পাইলট, কিন্তু শতদলের মোকাবিলা করার চেষ্টাও করে না। লাফ মেরে ছিটকে যায় সুচেতার কাছে, তার মাথায় চেপে ধরে স্প্রিং পিস্তলের নল।
একদম কেউ নড়বে না! নড়লেই এর মাথা উড়িয়ে দেব।
স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে যায় শতদল। মাটি থেকে উঠতে গিয়েও যেন জমে যায় নিতাই।
সুচেতার মাথায় পিস্তল ঠেকিয়েই তাকে টেনে হিঁচড়ে দাঁড় করায় ল্যান্ডার পাইলট।
—কেউ নড়বে না!
মাথায় পিস্তল ঠেকানো সুচেতার শরীরের পেছনে আড়াল নিয়ে পিছু হটে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে ওপর দিকে উঠতে থাকে পাইলট।
তার সঙ্গে তাল রেখে শতদল এক পা এগোতেই, কয়েকটা গালাগালির সঙ্গে পাইলটের গলা দিয়ে ফের বেরিয়ে আসে শাসানি।
—বলছি না নড়বি না! কেউ এক পা নড়লেই এর মাথা উড়িয়ে দেব।
ঢালের একদম ওপরে উঠে কয়েক সেকেণ্ড সুচেতাকে নিয়ে দাঁড়ায় পাইলট। তারপর পেছন ফিরেই নামতে শুরু করে ঢালের অন্য পাশ দিয়ে।
ধীরে ধীরে সুচেতা আর পাইলটের চেহারা হারিয়ে যেতে থাকে পাহাড়ের আড়ালে।
শুধু যখন ঢালের আড়ালে কেবল দুজনের মাথাটুকু দেখা যাচ্ছে, তখন সুচেতার একটা আর্ত চিৎকার ভেসে আসে।
—শতদল! নিতাইদা!
পাইলটের হেলমেটে একবার ঝলসে ওঠে মিহিরের নীল আলো, তারপর পাইলট আর সুচেতা দুজনেই হারিয়ে যায় পাহাড়ের ঢালের আড়ালে।
রাইফেলের ব্যাটারী ক্লিপ একবার চেক করে নিয়ে তাদের পিছু নেওয়ার জন্য দৌড়তে যায় শতদল।
কিন্তু হঠাৎ তার কাঁধে নিতাইয়ের হাত পড়ে।
—না শতদল! ওদিকে নয়! তোমাকে সন্তোষগঞ্জ যেতে হবে।
বিস্মিত মুখে নিতাইয়ের দিকে তাকায় শতদল।
আঙুল তুলে আকাশের দিকে দেখায় নিতাই। শতদল দেখতে পায় মিহির মাঝ আকাশ থেকে সরে গেছে অনেকখানি।
—বিকেলের আগে ওষুধ না পেলে সন্তোষগঞ্জে সবাই অসুস্থ হয়ে পড়বে। পরেশকে আর অযোধ্যা পাহাড়ের ওপরে পজিশনকে না সরালে বিদ্যুৎ চালু করা যাবে না।
তবু পাহাড়ের ওপরের দিকে তাকায় শতদল।
শতদলের কাঁধে হাল্কা চাপ দেয় নিতাই।
—দেরি করো না, যাও! চিন্তা করো না, সুচেতাকে আমি ছাড়িয়ে আনবো। তোমার কাজ সন্তোষগঞ্জে।
একটু ইতস্ততঃ করে শতদল মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি জানায় নিতাইয়ের কথায়। তারপর নিচু হয়ে গ্লাইডার প্যাক খুলে নেয় মাটিতে পড়ে থাকা এক হানাদারের শরীর থেকে।
কয়েক মিনিট লাগে শতদলের পিঠে গ্লাইডার প্যাক বেঁধে নিতে। তারপর জেটের নীলচে রেখা টেনে লাফ দিয়ে সে হারিয়ে যায় আকাশের বুকে।
(২৬)
কয়েক মিনিটের জন্যে দম নেয় অযোধ্যা পাহাড়ের ওপরের ফোটন কামান। তার ফাঁকে ব্যারিকেডের ওপর দিয়ে কয়েক রাউণ্ড ফায়ারিং করে ফের বসে পড়ে সুরিন্দার।
বেশ কিছুক্ষণ হয়ে গেল উত্তর দিকে লড়াইটা সামলাচ্ছে সুরিন্দার। তাকে চার্জে রেখে ডক্টর শিপ্রা চলে গেছেন সন্তোষগঞ্জের ভেতর দিকে, আহতদের চিকিৎসা করতে।
যেমনটা ডক্টর শিপ্রা আশা করেছিলেন তেমনটা হয়নি। অযোধ্যা পাহাড় থেকে নেমে আসেনি আক্রমণকারীরা। পাহাড়ের ওপরের পজিশন থেকেই তারা অবিরাম আক্রমণ নামিয়ে আনছে সন্তোষগঞ্জের ওপর।
আবার এক রাউণ্ড ফায়ারিং করে বসে পড়ে সুরিন্দার। অক্সিজেন টক্সিসিটি ওষুধের অভাবে মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করে তার।
আকাশের দিকে তাকায় সুরিন্দার। মিহির অনেকটা সরে এসেছে পশ্চিম দিকে। আর কিছুক্ষণের মধ্যে ওষুধ না খেলে ধীরে ধীরে অসুস্থ হয় পড়বে ক্যাম্পের সবাই।
অযোধ্যা পাহাড় থেকে আকাশ বেয়ে ছুটে আসে মিসাইলের ধূসর রেখা। জবাবে টর্পেডোর রেখা লাফিয়ে ওঠে সন্তোষগঞ্জের ভেতর থেকে।
প্রলয়ঙ্কর বিস্ফোরণে আর একবার পৃথিবীর সভ্যতা স্বাক্ষর করে কৌস্তূভের আদিম বাতাসে।
বিপবিপ শব্দে ফের জেগে ওঠে দূর পাহাড়ের ফোটন কামান। উজ্জ্বল শক্তিপুঞ্জ বৃষ্টির ধারার মতন আছড়ে পড়ে সন্তোষগঞ্জের ওপর।
মাথা নিচু করে ব্যারিকেডের পেছনে দৌড়ে আসেন সুজয় বোস, হাতে ধরা কমিউনিকেটর।
—সুরিন্দার! কমিউনিকেটরে একটা পিং পেলাম। ড্রোন আনন্দী দিয়ে সন্তোষগঞ্জের কাছে চলে এসেছে। বিদ্যুৎ সংযোগ করা গেলে আমরা ড্রাগ প্রিন্টার চালু করতে পারি।
অযোধ্যা পাহাড় থেকে ছিটকে আসা ফোটন কামানের শক্তিবিন্দুর দিকে ইঙ্গিত করে সুরিন্দার।
—অসম্ভব। নদী অবধি ওদের পাহাড়ের পজিশনের আওতায়। পাহাড় থেকে ওদের হটানো না গেলে ড্রোন অবধি যাওয়ার আগেই আমরা ঝাঁঝরা হয়ে যাবো।
ব্যারিকেডের পেছনে আচমকাই ঢলে পড়ে একজন। তাকে পরীক্ষা করে একটা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে সুরিন্দার।
—কি হল? চোট লাগলো নাকি?
সুরিন্দারের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করেন সুজয় বোস।
মাথা নাড়ায় সুরিন্দার।
—না। খুব সম্ভব অক্সিজেন টক্সিসিটি থেকে অজ্ঞান হয়ে গেছে।
রাইফেল হাতে কেউ একজন মাথা নিচু করে দৌড়ে এসে ঠেস দিয়ে বসে পড়ে ব্যারিকেডে।
নীলেশ পাঠক।
কপালে চোখ তোলেন সুজয় বোস।
—কি হল? পজিশন ছেড়ে চলে এলে?
মাথা ঝাঁকান নীলেশ পাঠক।
—ওখানে আর থেকে লাভ নেই! সব টর্পেডো শেষ। এখানে তবু হয়তো কিছু কাজে লাগতে পারি।
ব্যারিকেডের পেছনে অজ্ঞান হয়ে ঢলে পড়ে আরও একজন।
(২৭)
শতদলের চেহারা আকাশে মিলিয়ে যেতেই দৌড়ে ঢাল বেয়ে ওপরে ওঠে নিতাই। গুঁড়ি মেরে উঁকি মারে ঢালের ওপর দিয়ে।
অন্যপাশে তখনও সুচেতার মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে পিছু হটে নিচে নামছে পাইলট। নিতাইয়ের মাথাটুকু নজর পড়তেই ফের শাসাতে আরম্ভ করে সে।
—পেছনে যা! পেছনে যা! বলছি না সামনে আসবি না! সামনে এলেই মাথা উড়িয়ে দেব এর!
মাথা নামিয়ে নেয় নিতাই। কিন্তু ততক্ষণে তার নজরে পড়েছে পাইলটের পেছনে, আরও খানিকটা নিচে একটা বিশাল কদাকার চারপেয়ে জন্তুর মতন দাঁড়িয়ে আছে ল্যান্ডারটা।
খানিকটা পিছু হটে প্রায় ছুটতে ছুটতে নিচে নেমে এসে পড়ে থাকা হানাদারাদের কোমরের বেল্ট হাঁটকায় নিতাই।
তার হাতে বেশী সময় নেই। সুচেতাকে নিয়ে পাইলট যদি একবার ল্যান্ডারে ঢুকে দরজা আটকে দেয়, তাহলে তার পক্ষে আর সুচেতাকে ছাড়ানো সম্ভব হবে না।
(২৮)
আনন্দী পাসের আকাশে হানাদারররা উড়ে যায় গ্লাইডারে ভরে করে। কিছুটা পেছনে শতদলের উপস্থিতি তারা তখনও টের পায়নি।
প্রথম লড়াইটা তাই সহজেই জেতে শতদল। রাইফেলের ট্রিগারের একটা হাল্কা চাপে ছিটকে যায় প্লাজমা, ধোঁয়া ওঠে সামনের এক হানাদারের গ্লাইডার থেকে। ডিগবাজী খেয়ে সে পড়তে থাকে মাটির দিকে।
সতর্ক হয়ে যায় বাকিরা। একজন তার দিকে ফিরে শুরু করে প্লাজমা বর্ষণ, বাকি দুজন কোনাকুনি আরও ওপরে উঠে যায় ডান দিকে আর বাঁদিকে।
চতুর্থজন কিন্তু থামে না, উড়ে যেতে থাকে নিজের গন্তব্যের দিকে।
রাইফেলের স্কোপে চোখ রেখে চতুর্থজনকে দেখে শতদল। পরেশ। লড়াই ছেড়ে পরেশ উড়ে যাচ্ছে সন্তোষগঞ্জের দিকে।
পরেশের প্ল্যানটা বুঝতে অসুবিধে হয় না শতদলের। সে তার নিজের লোকেদের নির্দেশ দিয়েছে শতদলকে আটকে রাখার। যতক্ষণ শতদল আর তার অনুচরদের মধ্যে প্লাজমা বিনিময় চলবে ততক্ষণে পরেশ পৌঁছে যাবে সন্তোষগঞ্জ, রিঅ্যাক্টর লক্ষ্য করে ছুঁড়ে দেবে তার সাইবার গ্রেনেড।
এ লড়াইটা তাকে তাড়াতাড়ি জিততে হবে।
শরীর বেঁকিয়ে একটা প্লাজমার রেখা এড়ায় শতদল, তারপর বুঝতে চেষ্টা করে আক্রমণকারীদের উদ্দেশ্য।
তার দিকে সামনে থেকে প্লাজমা বর্ষণ করে চলেছে একজন, বাকি দুজন উঠে গেছে আরও ওপরে।
প্ল্যানটা বুঝতে পারে শতদল। ওপরে ওঠা দুজন অনেকটা উপরে উঠে মাথা নিচু করে চলে আসবে তার পেছনে, তারপর তিনজনে মিলে তাকে আক্রমণ করবে তিনদিক থেকে।
মাথার ওপরে দেখে শতদল, মিহির সরে এসেছে অনেকটা পশ্চিমদিকে, কিন্তু তার ঔজ্জ্বল্য কমেনি একচুলও।
ইকেরাসের মতন মিহিরের চোখ ধাঁধানো আলোর দিকে সটান উড়ে যায় শতদল।
শতদলের হঠাৎ দিক পরিবর্তনে হকচকিয়ে যায় হানাদারেরা। তাকে তিনদিক থেকে ফাঁদে ফেলার প্ল্যান ভুলে একসঙ্গে তাড়া করে আসে তিনজনে।
বেশ খানিকটা ওপরে ওঠার পর মিহিরকে পিঠের দিকে রেখে হানাদারদের দিকে ফেরে শতদল। সে জানে মিহিরের আলোয় চোখ ধাঁধিয়ে যাবে হানাদারদের। তাকে নিশানায় আনা দূর, চোখে পর্যন্ত তারা ভালো করে দেখতে পাবে না।
রাইফেলের স্কোপে চোখ রাখে শতদল, ধীরে সুস্থে ট্রিগার টেপে তিনবার।
তিনটে দেহ পাক খেয়ে পড়তে থাকে নিচের দিকে।
মাথা নিচু করে নিচের দিকে ঝাঁপ দেয় শতদল, দিক পরিবর্তন করে উড়ে যায় দক্ষিণে সন্তোষগঞ্জের দিকে।
পরেশকে না আটকাতে পারলে উড়ে যাবে পুরো কলোনীটাই।
(২৯)
রাইফেল হাতে ঢালের মাথায় ফের উঠে আসে নিতাই। পকেট থেকে বের করে মাটিতে রাখে হানাদারদের বেল্ট থেকে খুলে আনা দুটো হাওয়া গ্রেনেড। ঠিক বুকের নিচে রাখে রাইফেলটাকে।
খুব সন্তর্পণে মাথা উঁচু করে নিচে তাকায় নিতাই। সুচেতাকে নিয়ে পাইলট প্রায় পৌঁছে গেছে ল্যান্ডারের কাছে—সময় আর বেশি নেই।
একটা গ্রেনেড তুলে নেয় নিতাই। তার মাথার ছোট ফুটোতে চোখ রেখে টার্গেট সেট করে ঠিক ল্যান্ডারের মাথায়। দ্বিতীয় গ্রেনেডটা তুলে নিয়ে একইভাবে তার টার্গেট সেট করে প্রথমটার টার্গেট থেকে একটু দূরে।
দুটো গ্রেনেডকেই চালু করে হাওয়ায় ছুঁড়ে দেয় নিতাই। তারপর দুহাতে রাইফেল চেপে ধরে অপেক্ষা করে সঠিক মূহূর্তের।
যান্ত্রিক গুঞ্জন তুলে ল্যান্ডারের দিকে উড়ে যায় পরপর দুটো গ্রেনেড।
প্রথমটা ফাটে ঠিক ল্যান্ডারের ওপরে। সামনে থেকে নজর সরিয়ে চমকে উঠে ঘাড় ঘুরিয়ে বিস্ফোরণের দিকে তাকায় পাইলট।
ঠিক সেই সুযোগে ঢালের মাথায় লাফিয়ে উঠে বসে নিতাই। কাঁধে রাইফেল তুলে চোখ রাখে স্কোপে।
কয়েক সেকেণ্ডের মধ্যে ল্যান্ডারের মাথায় সশব্দে ফেটে যায় দ্বিতীয় গ্রেনেডটা।
স্কোপ জুম করে নিতাই। স্কোপের গোল পটভূমিতে ফুটে ওঠে কেবল পাইলটের হেলমেট পরা মাথাটা, দৃষ্টি তার আটকে মাথার ওপরের বিস্ফোরণে।
স্কোপের লাল ফুটকিটা পাইলটের কপালে বসিয়ে খুব হাল্কা আঙুলে দু-দুবার ট্রিগার টেপে নিতাই।
স্কোপের মধ্যে দিয়ে দেখা যায়, পাইলটের কপালের মাঝখানে ফুটে উঠছে একটা লাল রঙের ফুল।
রাইফেল নামিয়ে যখন লাফিয়ে উঠে দাঁড়ায় নিতাই, তখনও পাইলটের প্রাণহীন দেহটা মাটি স্পর্শ করেনি।
(৩০)
ল্যান্ডারে কম্পিউটারের স্ক্রীনের দিকে তাকিয়ে থাকে সুচেতা। দ্রুতগতিতে আঙুল চলে তার আলোয় গড়া কী বোর্ডের ওপর।
হাত থেকে পাইলটের রক্তমাখা বুড়ো আঙুলটা ছুঁড়ে ফেলে নিতাই। ওটা ব্যবহার করে একটু আগে ল্যান্ডারের বায়োমেট্রিক সিস্টেম টপকে কম্পিউটার চালু করেছে নিতাই আর সুচেতা। এখন পাসওয়ার্ডের বেড়া ভেঙে কক্ষপথে হানাদারদের শিপের ক্যামেরার দখল নিতে চেষ্টা করে সুচেতা।
—পারবে? ক্যামেরটা আমাদের কব্জায় আসবে?
সুচেতার পাশ থেজে স্ক্রীনের ওপর ঝুঁকে পড়ে প্রশ্ন করে নিতাই।
নাক দিয়ে কেবল একটা তাচ্ছিল্যের আওয়াজ তোলে সুচেতা, আর কোনও উত্তর দেয় না। দ্রতবেগে তার আঙুল চলতে থাকে কী-বোর্ডে।
হঠাৎ একটা হাসি ফুটে ওঠে সুচেতার মুখে।
—হয়ে গেছে! শিপের ক্যামেরা এবার আমার দখলে!
হাওয়ায় ভেসে ওঠে সন্তোষগঞ্জের ত্রিমাত্রিক ছবি।
ক্যামেরা জুম করে সন্তোষগঞ্জের মাঝখানে ফোকাস করে সুচেতা।
প্রায় সঙ্গে সঙ্গে মিলিয়ে যায় তার মুখের হাসিটুকু।
সন্তোষগঞ্জের ভেতরে এখানে ছিটিয়ে ছড়িয়ে শুয়ে বসে আছে লোকজন। কেউ কেউ হাঁটছে টলতে টলতে।
একটা লম্বা নিঃশ্বাস টানে সুচেতা।
—ওষুধের অভাব। অক্সিজেন টক্সিসিটি ওষুধ না খাওয়ার ফলে অজ্ঞান হয়ে পড়ছে লোকজন।
নিতাইয়ের চোখ অন্য কোথাও আটকে যায়।
—ওইটা কি? ওই যে ওটা? সরাও, সরাও ক্যামেরা সরাও!
নিতাইয়ের কথামত ক্যামেরা সন্তোষগঞ্জের ভেতরে একটা নাগরদোলার মতন দেখতে যন্ত্রের ওপর ফোকাস করে সুচেতা।
এবার লম্বা নিঃশ্বাস টানার পালা নিতাইয়ের।
—এটা তো শিপের টর্পেডো ম্যাগাজিন! এটা দিয়ে এরা কি আটাকাচ্ছিল? মিসাইল? আর একটু জুম করো, আর একটু!
ক্যামেরা জুম করে স্ক্রীনে টর্পেডো ম্যাগাজিনিটাকে বড় করে ফুটিয়ে তোলে সুচেতা।
—খালি! টর্পেডো ম্যাগাজিন খালি! যে উদ্দেশ্যেই টর্পেডো ব্যবহার করে থাকুক, এখন ওদের ভাঁড়ার খালি। বিপদ এলে আর টর্পেডো দিয়ে ঠেকাতে পারবে না। অযোধ্যা পাহাড়ে দুশমন পজিশন দেখাও। জলদি! জলদি!
ক্যামেরা সরিয়ে অযোধ্যা পাহাড়ের ওপর ঘোরাতে থাকে সুচেতা। নিতাইয়ের উৎকন্ঠা যেন স্পর্শ করে তাকেও।
অযোধ্যা পাহাড়ে হানাদারদের পজিশন খুঁজে পেতে বেশিক্ষণ লাগে না। ক্যামেরা জুম করে স্ক্রীনে ছবিটা বড় করে তোলে সুচেতা।
মাথা ঝাঁকায় নিতাই।
এই পজিশন থেকে আনন্দী অবধি এদের হাতিয়ারের এক্তিয়ারে। এদেরকে এখান থেকে সরাতে না পারলে সন্তোষগঞ্জের কেউ আনন্দীতে ড্রোন অবধি গিয়ে বিদ্যুৎ সংযোগ করতে পারবে না।
আঙুল তুলে স্ক্রীনের আর অংশের দিকে ইঙ্গিত করে নিতাই।
—আর এটা দেখ। মিনি মিসাইল লঞ্চার। টর্পেডো দিয়ে বোধহয় এখান থেকে ছোঁড়া মিসাইলই আটকাচ্ছিল সন্তোষগঞ্জ।
—কিন্তু সন্তোষগঞ্জের টর্পেডো তো শেষ!
সুচেতার গলায় উৎকণ্ঠার ছোঁয়া।
সুচেতার দিকে তাকায় নিতাই।
—হ্যাঁ। একে ওষুধের অভাবে লোকজন বেহঁশ হয়ে পড়ছে, তারপর আবার টর্পেডোর ভাঁড়ারও শেষ। এদেরকে হটাতে না পারলে সন্তোষগঞ্জের সামনে দু-দুটো সমূহ বিপদ।
—কিন্তু এতদূর থেকে কি করতে পারি আমরা?
ল্যান্ডারের অভ্যন্তরটা মাথা ঘুরিয়ে দেখে নিতাই।
—এটাকে উড়িয়ে নিয়ে যাওয়া যায় না?
মাথা নাড়ে সুচেতা।
—না নিতাইদা। আমি এর কম্পিউটার হ্যাক করেছি কেবল। কিন্তু এর চালানোর কন্ট্রোল খুব সম্ভব পরেশের বায়োমেট্রিকের সঙ্গে লক করা আছে। এখানে আসার সময় শতদল কি বলছিল মনে নেই? একে ওড়ানো সম্ভব নয়।
কপালের ঘাম মোছে নিতাই।
—কি করা যায় তাহলে বলতো?
—এর ভেতর কোনও দুরপাল্লার অস্ত্রশস্ত্র নেই? তাহলে সেগুলো হ্যাক করে ফায়ার করা যায় কি না চেষ্টা করে দেখতে পারি।
এবার মাথা নাড়ে নিতাই।
—এটা অল্প পাল্লার উড়ান যান। শিপ থেকে গ্রহের মাটিতে আর গ্রহ থেকে শিপে মানুষ নিয়ে যাওয়া আসার কাজে ব্যবহার করা হয়। এতে দূরপাল্লার কোনও কোনও অস্ত্র থাকার সম্ভাবনা নেই।
—তাও নিতাইদা! চলো একবার খুঁজে দেখি যদি কাজের কিছু পাওয়া যায় কি না।
ল্যান্ডারের ভেতরটা অনেকটা বাসের মতন। বসার সিট আর মালপত্র রাখার লকার ছাড়া সেখানে বিশেষ কিছুই নেই। ল্যান্ডার তন্নতন্ন করে খুঁজেও তেমন কিছু পায় না নিতাই আর সুচেতা।
কেবল একটা জিনিস ছাড়া।
একটা লকার থেকে একটা ছোটখাট কপ্টারের মতন জিনিস বের করে দুহাতে তুলে ধরে নিতাই,
—এই দেখো! দুরপাল্লার বলতে কেবল এটা পেলাম। নজরদারি ড্রোন। কিন্তু এ তো কোনও কাজে লাগবে না। এতে তো ক্যামেরা ছাড়া কিছু নেই!
নিতাইয়ের হাতের ড্রোনটার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে খানিক্ষণ তাকিয়ে থাকে সুচেতা। স্পষ্টই বোঝা যায় সে কিছু চিন্তা করছে।
—কি হল সুচেতা?
অবাক কন্ঠে প্রশ্ন করে নিতাই।
উত্তর দেয় না সুচেতা, এক দৌড়ে চলে যায় ল্যান্ডারের কম্পিউটার কনসোলের কাছে। ক্যামেরা সরিয়ে কি যেন দেখে স্ক্রীনে।
সুচেতার কাছে এগিয়ে যায় নিতাই।
—কি হল হঠাৎ সুচেতা।
কীবোর্ডে কি একটা করে সুচেতা, ম্যাপের পাশে ভেসে ওঠে আলোয় গড়া একটা জয়স্টিক।
জয়স্টিকের দিকে চোখ তুলে ইঙ্গিত করে সুচেতা।
—এইটা দিয়ে ড্রোনটাকে কন্ট্রোল করা যায়।
কপাল কুঁচকোয় নিতাই।
—সে তো বুঝলাম। কিন্তু এ ড্রোন কি কাজে লাগবে? বললাম না এতে ক্যামেরা ছাড়া কিছু নেই!
—বলছি নিতাইদা। কিন্তু তার আগে দেখতো কোনও টুল-কিট খুঁজে পাও কি না? আমার দু-একটা স্ক্রু ড্রাইভার লাগবে।
(৩১)
খানিক বাদেই কৌস্তূভের আকাশে নজরে আসে সন্তোষগঞ্জের উদ্দেশ্যে উড়ে যাওয়া মেজর পরেশের চেহারাটা।
যে করেই হোক শতদলের উপস্থিতি টের পায় পরেশ, সোজা না উড়ে উড়তে থাকে বেঁকেচুরে। দু-দুবার রাইফেল চালায় শতদল কিন্তু লক্ষ্যভ্রষ্ট হয় দু-দুবারই। শতদলের দিকে ফিরে একবার রাইফেল চালায় পরেশ, তারপর আবার বেঁকেচুরে উড়তে থাকে সামনের দিকে।
আবার রাইফেল চালায় শতদল। ফের তার দিকে ফিরে এক রাউণ্ড ফায়ারিং করেই আবার সামনের দিকে উড়তে থাকে পরেশ।
শতদল বুঝতে পারে পরেশ থামবে না। তার প্রথম উদ্দেশ্য কৌস্তূভের কলোনি ধ্বংস করা। শতদল এই মূহূর্তে তার কাছে অতটা জরুরী নয়।
কিন্তু কোনও রকমে যদি পরেশ সন্তোষগঞ্জ পৌঁছে তার ওই সাইবার গ্রেনেড ছুঁড়ে দেয় রিঅ্যাক্টরের দিকে, তাহলে শতদলের আর কিছু করার থাকবে না। পরেশকে সন্তোষগঞ্জের আগেই থামাতে হবে।
সে নিজে যেটুকু দেখেছে আর নিতাইয়ের মুখে যা শুনেছে তার ওপর ভিত্তি করে পরেশের চরিত্রটা বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করে শতদল। পরেশ গোঁয়ার, বদরাগী, মাথামোটা। মানুষের ওপর অত্যাচার করে আনন্দ পায়।
শতদলের সঙ্গে লড়াই করার জন্যে পরেশ থামবে না।
কিন্তু সে যদি বোঝে শতদল অসহায়, নিরস্ত্র, তাহলে তাকে খতম করার সুযোগও পরেশ সহজে ছেড়ে দেবে না।
ঝুঁকি নিতে হবে একটা। তার নিজের জীবনের দাম সন্তোষগঞ্জের মানুষের থেকে বেশি নয়।
আবার রাইফেল চালায় শতদল। উত্তরে শতদলের দিকে ফিরে ফায়ারিং করে পরেশ।
গায়ে প্লাজমা লাগার অভিনয় করে হাত থেকে রাইফেল ফেলে দেয় শতদল।
এবার থেমে যায় পরেশ, এলোপাথাড়ি প্লাজমা বর্ষণ করতে থাকে শতদলকে উদ্দেশ্য করে।
শরীর বেঁকিয়ে চুরিয়ে প্লাজমার রেখাগুলো এড়াতে থাকে শতদল, সবেগে উড়তে থাকে পরেশকে লক্ষ করে।
পরেশের সবকটা প্লাজমা ব্যর্থ হয় না। একটা ছুঁয়ে যায় শতদলের পাঁজর, হাওয়ায় উড়তে থাকে তার শরীরের রক্তবিন্দু। আর একটা উড়িয়ে দেয় তার গ্লাইডারের বাঁদিকের আগাটা, ব্যালেন্স নষ্ট হয়ে তার শরীরটা পড়তে শুরু করে মাটির দিকে।
কিন্তু ততক্ষণে সে এসে গেছে পরেশের অনেক কাছাকাছি, দুজাত বাড়িয়ে সর্বশক্তি দিয়ে সে আঁকড়ে ধরে পরেশের কোমর।
দু-দুটো শরীরের ভার নিতে পারে না পরেশের গ্লাইডার, কোনওমতে তাল বাঁচিয়ে শতদলকে নিয়ে পরেশ পড়তে থাকে মাটির দিকে
(৩২)
—স্ক্রু ড্রাইভার!
অবাক কন্ঠে সুচেতার কথার পুনরাবৃত্তি করে নিতাই। কিন্তু তারপর আর কথা না বাড়িয়ে কোথা থেকে গোটাকতক বিভিন্ন সাইজের স্ক্রু ড্রাইভার খুঁজে এনে বাড়িয়ে ধরে সুচেতার দিকে।
স্ক্রু ড্রাইভার দিয়ে ড্রোনের ওপরের দিকটা খুলে ভেতরে কি সব কারিকুরি করে সুচেতা, তারপর ফের বন্ধ করে লাগিয়ে দেয় আগের মতন।
—কি করলে ড্রোনে?
অবাক চোখে তাকিয়ে প্রশ্ন করে নিতাই।
তেমন কিছু নয়। খালি একটু বিগড়ে দিলাম।
—বিগড়ে দিলে!
গলার স্বরের বিস্ময় গোপন করতে পারে না নিতাই।
মুচকি হাসে সুচেতা।
—চিন্তা কোরো না। বেশি বিগড়োই নিই। এটা উড়বে কোনওরকম সমস্যা ছাড়াই, কিন্তু আওয়াজ করবে খুব। এর ভেতরের সাইলেন্সারটা খারাপ করে দিয়েছি।
—কিন্তু তাতে কি হবে?
হতভম্ব দেখায় নিতাইকে।
এখুনি দেখতে পাবে।
ল্যান্ডারের বাইরের মাটিতে ড্রোনটাকে রেখে এসে কনসোলের চেয়ারে বসে সুচেতা, হাত রাখে আলোয় গড়া জয়-স্টিকে।
শিপের ক্যামেরায় সুচেতা ট্র্যাক করে ড্রোনের গতিবিধি। স্ক্রীনে দেখা যায় আকাশের বুক চিরে উড়ে যাচ্ছে ড্রোন।
রামগিরি, আনন্দী পাস পার করে সুচেতা ড্রোনকে উড়িয়ে নিয়ে যায় অযোধ্যা পাহাড়ের দিকে।
—তুমি কি দুশমনের পজিশনের দিকে ড্রোন নিয়ে যাচ্ছ?
প্রশ্ন করে নিতাই।
—হ্যাঁ ওখানেই শেষে যেতে হবে, কিন্তু তার আগে অন্য একটা জায়গা ঘুরে যেতে হবে।
অযোধ্যা পাহাড়ের অন্য আর একদিকে একটা টিলার ওপর ড্রোন নিয়ে যায় সুচেতা, জুম করে ক্যামেরা।
ঝুঁকে জায়গাটা স্ক্রীনে দেখে নিতাই। তার মনে পড়ে যায় দিনকতক আগে এই জায়গাটার ছবি সে দেখেছিল ক্যান্টিনে বসে।
আচমকাই সুচেতার প্ল্যানটা দিনের আলোর মতোই পরিষ্কার হয়ে যায় নিতাইয়ের কাছে। একটা চওড়া হাসি ফোটে তার মুখে।
চিল ফড়িঙের বাসা।
ক্যামেরায় দেখা যায় টিলার গায়ের ফোকর দিয়ে ঢুকছে বেরোচ্ছে অজস্র চিল ফড়িং।
টিলার কাছে গিয়ে ড্রোনটাকে পাক খাওয়ায় সুচেতা।
ক্যামেরার পাঠানো ছবিতে শব্দ পাওয়া যায় না বটে, কিন্তু নিতাইয়ের আন্দাজ করতে অসুবিধে হয় না সাইলেন্সার বিগড়নো ড্রোন আওয়াজ করে খেপিয়ে তুলছে চিল ফড়িঙের ঝাঁককে।
চেষ্টা ব্যর্থ হয় না সুচেতার, চিল ফড়িঙের দল তাড়া করে আসে ড্রোনটাকে।
ড্রোনের স্পীড বাড়িয়ে দেয় সুচেতা। দ্রতবেগে উড়িয়ে নিয়ে যায় অযোধ্যা পাহাড়ের আর এক দিকে, যেখানে পজিশন নিয়েছে পৃথিবীর হানাদাররা।
অযোধ্যা পাহাড়ের ওপর দিয়ে উড়ে যায় ড্রোন, তার পেছনে তাদের ফুটখানেক লম্বা কালো গাঁট পাকানো শরীর আর হুকের মতন দাঁত নিয়ে ধাওয়া করে আসে চিল ফড়িঙের ঝাঁক।
একটা টিলার ওপর পৃথিবীর হানাদারেরা তখন সন্তোষগঞ্জের ওপর আক্রমণ নামিয়ে আনতে ব্যস্ত। যতক্ষণে চিল ফড়িঙের ঝাঁক তাদের নজরে পড়ে ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে।
ড্রোনটাকে টিলার মাথায় আছড়ে ফেলে সুচেতা।
আর তার কয়েক মূহূর্ত বাদেই টিলার মাথার মানুষগুলোর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে কৌস্তূভের অতি-কীটের ঝাঁক।
কনসোল ছেড়ে উঠে আসে সুচেতা, নিতাইকে সঙ্গে নিয়ে এসে দাঁড়ায় ল্যান্ডারের বাইরে।
কৌস্টূভের বলয়ে তখন হালকা রং ধরেছে, মিহির এগিয়ে এসেছে দিগন্তের কাছে।
(৩৩)
থেমে যায় ফোটন কামানের বিপবিপ শব্দ। বন্ধ হয়ে যায় অযোধ্যা পাহাড়ের ওপর থেকে ছিটকে আসা শক্তিপুঞ্জের স্রোত।
ব্যারিকেডের ওপর দিয়ে নিয়মমাফিক কয়েকবার ফায়ারিং করে কাহিল শরীরে বসে পড়ে সুরিন্দার। ওষুধের অভাবে শরীরটা যেন আর বাগে আসতে চায় না তার।
কতক্ষণ সে একভাবে বসেছিল সুরিন্দার জানে না, কিন্তু তার সম্বিৎ ফেরে সুজয় বোসের কথায়।
—সুরিন্দার! সুরিন্দার! ফায়ারিং বন্ধ হয়ে গেছে।
মাথা ঝাঁকিয়ে শরীরের ক্লান্তিটা কাটানোর চেষ্টা করে সুরিন্দার, উঁকি দেয় ব্যারিকেডের ওপর।
সত্যি অযোধ্যা পাহাড়ে বন্ধ হয়ে গেছে সব রকম অস্ত্রের আওয়াজ। ফোটন কামানের বিপবিপ শব্দ তো বটেই, কানে আসেনা মামুলী প্লাজমা রাইফেলের কড়-কড় শব্দও।
—কোনও চালাকি নয়তো? সন্দেহ কাটেনা সুরিন্দারের। নিশ্চিত হতে রাইফেল সমেত হাতটা ব্যারিকেডের ওপরে উঁচু করে তুলে ধরে সে।
না। কোনও প্লাজমার রেখা ছুটে আসে না তার হাত লক্ষ করে।
ব্যারিকেডে ভর দিয়ে এবার উঠে দাঁড়ায় সুরিন্দার।
না। তার ওপর নেমে আসে না কোনও অস্ত্রের আক্রমণ। কোনও অজানা কারণে নীরব হয়ে পড়েছে অযোধ্যা পাহাড়ের ওপরের হানাদার পজিশন।
কপালে ভ্রূ তুলে প্রশ্নের দৃষ্টি নিয়ে সুজয় বোসের দিকে তাকায় সুরিন্দার।
মাথা ঝাঁকান সুজয় বোস।
—জানি না। শতদল বা নিতাই কোনও ভাবে থামিয়েছে। কিন্তু সে প্রশ্নের উত্তর পারে। দেখ বিদ্যুৎ চালু করতে পারো কি না। ওষুধ না হলে আমরা বেশিক্ষণ টিকবো না।
রাইফেলে ভর দিয়ে সুরিন্দার শরীরটাকে টেনে নিয়ে যেতে আরম্ভ করে আনন্দীর দিকে।
(৩৪)
সরযূ পাসের পাহাড়ের গায়ে আছড়ে পড়ে শতদল আর পরেশ। ধাক্কায় টুকরো টুকরো হয়ে যায় পরেশের পিঠের গ্লাইডার, হাত থেকে ছিটকে যায় রাইফেল।
শতদলের শরীরের ওপর দুহাতে ঘুষির বৃষ্টি নামিয়ে আনে পরেশ। নাক ফেটে রক্ত পড়ে শতদলের, ব্যাথায় আড়ষ্ট হয়ে যায় পাঁজর, কিন্তু তবু পরেশেকে আঁকড়ে ধরেও থাকে সে।
পাহাড়ের ঢাল বেয়ে জড়াজড়ি করে গড়াতে থাকে পরেশ আর শতদল, ঝোপঝাড় আর গাহের গুঁড়িতে লেগে ক্ষতবিক্ষত হয় তাদের শরীর।
তবু তারই মধ্যে শরীরের আঘাতের তোয়াক্কা না করে পরেশের বেল্টের ক্লিপ থেকে এক হ্যাঁচকায় খুলে নেয় সাইবার গ্রেনেড, কব্জির মোচড়ে ছুঁড়ে ফেলে দূরে।
গড়াতে গড়াতে দুট শরীর এসে পড়ে পাহাড়ের নিচে সরযূর ঘাসে ঢাকা পাড়ে।
আহত শরীরে উঠে দাঁড়ায় শতদল। পিঠে বাঁধা গ্লাইডারের টুকরো খুলে ফেলে দেয় নিচে।
রক্তাত্ত শরীর নিয়ে উঠে দাঁড়ায় পরেশও।
একটা দমকা হাসি বেরিয়ে আসে শতদলের গলা দিয়ে।
তোমার প্ল্যান ফেল পরেশ। এযাত্রা আর তোর সাইবার গ্রেনেড দিয়ে সন্তোষগঞ্জের রিঅ্যাক্টর ওড়ানো হল না।
হিংস্র জন্তুর মতন রক্তমাখা দাঁত বের করে পরেশ। কোমরের বেল্ট থেকে টেনে বের করে একটা একহাত লম্বা ছোরা।
সন্তোষগঞ্জের জন্যে প্ল্যান আরও অনেক আছে। কিন্তু আমার এখন প্ল্যান তোর বুক পেটে ফেড়ে তোকে এই নদীর পাশে ফেলে দিয়ে যাওয়া।
চারপাশে তাকিয়ে দেখে শতদল। কিন্তু পরেশের ছোরার বিরুদ্ধে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার মতন তার চোখে পড়ে না কিছুই।
হঠাৎ শতদলের মনে পড়ে যায় কারাটের দোজোতে সেন্সেই ফুজিমোরির দেওয়া উপদেশ। যখন কোনও অস্ত্র থাকবে না, তখন তোমার শরীরটাই অস্ত্র মনে করবে।
একটা লম্বা শ্বাস বুকের গভীরের টেনে নেয় শতদল। আকাশ, পাহাড়, নদী জল সব যেন অস্তিত্ব হারায় তার কাছে। থাকে শুধু তার আর পরেশের শরীরদুটো। এক পা পিছনে রেখে কোকুৎসু দাচি ভঙ্গীতে দাঁড়িয়ে পড়ে শতদল, নিঃশ্বাস প্রশ্বাসকে নিয়ে আসে নিয়ন্ত্রিত লয়ে। তারপর অপেক্ষা করে পরেশের।
একটা জান্তব চিৎকার তুলে তেড়ে আসে পরেশ, তার হাতের ছোরা নিশানা করে পরেশের পেট।
ধীর ছন্দে এক পা সামনে নিয়ে আসে শতদল, তার কোকুৎসু দাচি ভঙ্গী পালটে যায় কিবা দাচিতে। বাঁ হাতটা কাঁধের ওপর থেকে কোমেরর কাছে নেমে ঘুরে যায় পরেশের ছোরা ধরা হাতের তলা দিয়ে, তারপর তলা থেকে সে হাতটাকে সজোরে ছিটকে দেয় ওপরের দিকে।
এক পা এগিয়ে যায় শতদল, তার ডান হাতের কনুইটা কোমরের কাছে থেকে উঠে এসে পরেশের নাকে আঘাত করে উঠে যায় আরও ওপরে।
সরযূর জলের শব্দে মেশে পরেশের আর্ত চিৎকার। তার হাত থেকে ছিটকে যায় ছোরা, নাক থেকে নেমে আসে রক্তের ধারা, সে টলতে টলতে হটে যায় পেছনে।
স্বচ্ছন্দ লয়ে শতদলের লড়াইয়ের ভঙ্গিমা ফের পালটে যায় কোকুৎসু দাচিতে।
মাথা ঝাঁকায় পরেশ, তার নাকের রক্ত ছিটকোয় হাওয়াতে। ক্রুদ্ধ গর্জন তুলে ছুটে এসে শতদলের মুখের দিকে একটা ঘুষি চালিয়ে দেয় সে।
বাঁ হাতের হালকা চাপড়ে পরেশের মুঠো পাকানো হাতটাকে তলা থেকে ওপরের দিকে ঠেলে দেয় শতদল। তার ডান হাতের কব্জির ভেতরের দিকটা আঘাত করে পরেশের নাকে।
এক পা হটে গিয়ে টাল সামলাতে চেষ্টা করে পরেশ। কিন্তু তার আগেই দুহাতে তার মাথাটাকে ধরে নামিয়ে আনে নিচের দিকে, আর একই সঙ্গে ওপরের দিকে তুলে আনে নিজের হাঁটুটাকে।
শতদলের হাঁটুর ওপর পরেশের চোয়ালের আঘাতের ভয়ানক শব্দটা ছড়িয়ে যায় কৌস্তূভের গোধূলিতে।
পরেশকে ঠেলে ঘাসের ওপর ফেলে দেয় শতদল।
—আমি পৃথিবীর শতদল হলে এতক্ষণে তোমার ঘাড়টা ভেঙে দিতাম। কিন্তু ও জীবন আমি পেছনে ফেলে এসেছি।
পেছনে দুহাত রেখে ঘাসের ওপর বসে নিষ্ফল আক্রোশে ফুঁসতে থাকে পরেশ।
পেছন ফিরে হাঁটা দেয় শতদল।
—যাও পৃথিবীতে ফেরৎ যাও। আমাদের এখানে আমাদের মতন থাকতে দাও।
শতদল পেছন ফেরা মাত্র লাফিয়ে ওঠে পরেশ। মাটিতে পড়ে থাকা ছোরাটা কুড়িয়ে নিয়ে দৌড়ে গিয়ে বসিয়ে দেবার চেষ্টা করে শতদলের পিঠে।
এক পা ওপরে তুলে লাট্টুর মতন ঘুরে যায় শতদল, তার ওঠানো পা আঘাত করে পরেশের মুখে। পেছনের দিকে কয়েক পা হটে যায় পরেশ।
সামনের দিকে লাফিয়ে উঠে শতদল আবার লাথি মারে পরেশের বুকে।
এবার আর টাল সামলাতে পারে না পরেশ, ছিটকে পড়ে নদীতে।
ক্রুদ্ধ গর্জন করে নদীর জল থেকে উঠে আসতে চেষ্টা করে পরেশ, কিন্তু তার আর সুযোগ পায় না।
নদী থেকে পরেশের ওপর লাফিয়ে ওঠে শতদলের আগের দিন দেখা একটা প্রাণী। হাত খানেক লম্বা, গায়ে চিংড়ির মতন কঠিন বর্ম, সামনের দিক লম্বা শুঁড়। শুঁড় দিয়ে পরেশের হাতটা জড়িয়ে ধরেই কৌস্তূভের সেই অদ্ভূত জীব সামনের একটা হুকের মতন দাঁত বিঁধিয়ে দেয় তার শরীরে।
চিৎকার করে পরেশ চেষ্টা করে সেটাকে শরীর থেকে ছাড়াতে, কিন্তু তার আগেই জল থেকে তার গায়ে লাফিয়ে ওঠে আর একইরকম আর একটা প্রাণী।
তারপর আর একটা। আরও একটা।
জল থেকে একের পর এক পরেশের শরীরের ওপর লাফিয়ে উঠতে থাকে চিংড়ির মতন অদ্ভূত প্রাণীগুলো।
পরেশের মরণ চিৎকার ছাপিয়ে যায় সরযূর জলের শব্দ।
সে চিৎকার পেছনে রেখে শতদল দ্রুত হাঁটা দেয় সন্তোষগঞ্জের উদ্দেশ্যে।
(৩৫)
উঠে দাঁড়ান সুজয় বোস। টলতে টলতে গিয়ে পা রাখেন সন্তোষগঞ্জের ভেতরে ড্রাগ প্রিন্টারের ঘরে।
কোনওরকমে দাঁড়িয়ে থাকেন ট্যাটু করা দুই হাত ড্রাগ প্রিন্টারের টেবিলে ভর দিয়ে। ঢুলে আসতে চাওয়া মাথাটাকে সোজা করে রাখেন অনেক কষ্টে।
হঠাৎ টুপ টাপ আওয়াজে জ্বলে ওঠে প্রিন্টারের গায়ের কয়েকটা আলো।
হৃৎপিণ্ডটা লাফিয়ে ওঠে সুজয় বোসের। চালু করে দিয়েছে! সুরিন্দার বিদ্যুৎ চালু করে দিয়েছে।
যান্ত্রিক আওয়াজ তুলে দু-তিন মিনিট চলে প্রিন্টার। তারপর তার সামনের প্লাস্টিক কন্টেনারে হাল্কা আওয়াজ করে ঝরে একটা ক্যাপসুল।
ছোঁ মেরে ক্যাপসুলটা তুলে নিয়েই মুখে পুরে দেন সুজয় বোস। কয়েক মিনিটের মধ্যেই টের পান স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসছে তাঁর, কেটে যাচ্ছে গা গোলানি আর ঘোর লাগা ভাবটা।
ততক্ষণে আর একটা ক্যাপসুল ঝরে পড়েছে কন্টেনারে।
ক্যাপসুলটা তুলে নিয়ে বাইরে দৌড়োন সুজয় বোস, কাউকে সেটা দিয়ে ফের ফেরৎ আসেন আর একটা ক্যাপসুল নিতে।
এইভাবে অনেক, অনেকক্ষণ ধরে চলতে থাকে সুজয় বোসের ক্যাপসুল নিয়ে আসা যাওয়ার পালা।
(৩৬)
কন্ট্রোল রুমে আজ কোনও আলোর অভাব নেই। গোল বাটির মতন ছাদে লাগানো সবকটা রোশনি স্ট্রিপ আলো দিচ্ছে আগের মতনই। টেবিল ঘিরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে সবাই, নজর সবার কম্পিউটার টেবিলের ওপর ভাসতে থাকা আলোয় গড়া ভার্চুয়াল স্ক্রীনের দিকে।
পা দুটো আরাম করে সামনের দিকে ছড়িয়ে দেন সুজয় বোস।
—তা নীলেশ, হঠাৎ এমন জরুরী তলব কেন? ক্যাম্পে আর কর্পোরেট কার্টেলের চরেরা নেই, পরেশের টিমও পুরো সাবাড় হয়ে গেছে বলেই জানতাম। হঠাৎ আবার কি সমস্যা হল?
কন্ট্রোল রুমের দরজা খোলা, কানে আসে মানুষের কর্মব্যস্ত কথোপকথন। সন্তোষগঞ্জেকে ফের নতুন করে গড়ে তোলার কর্মচাঞ্চল্য যেন ভেসে আসে বাতাসে।
স্ক্রীনের দিকে তাকান নীলেশ পাঠক।
—জানি সবার কাজ আছে। কিন্তু এই কয়দিনে এমন দু-একটা জিনিস নজরে এসেছে যা সবার বোধহয় জানা উচিত। সুচেতা।
উঠে দাঁড়ায় সুচেতা। শতদল লক্ষ করে তার কপালে পড়েছে চিন্তার ভাঁজ।
—পরেশ মারা যাওয়ার পর তার বায়োমেট্রিক ব্যবহার করে আমরা পরেশের শিপের দখল নিই। তারপর আমি শিপের পুরানো রেকর্ড এক এক করে দেখতে থাকি।
সবার মুখের দিকে একবার তাকায় সুচেতা।
—এটা দু-দিন আগে অবধি আমিও জানতাম না, কিন্তু পরশের আস্তিনে আর একটা ব্যাক-আপ প্লনা ছিল।
—ব্যাক-আপ প্ল্যান! কি প্ল্যান?
নিতাইয়ের কন্ঠস্বরে বিস্ময় চাপা থাকে না।
কেমন শিউরে ওঠে সুচেতা।
ল্যান্ডারে পরেশ একটা টাইমার সেট করে রেখেছিল। এর খবর জানতো কেবল পরেশ নিজে। একটা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে টাইমার অফ না করলে টাইমারের দায়িত্ব ছিল শিপকে একটা সিগন্যাল পাঠানো।
—এরকম করার কারণ?
ফের বিস্মিত কণ্ঠে প্রশ্ন করে নিতাই।
উত্তর আসে শতদলের কাছে ঘেকে।
—পরেশ যদি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ফিরে না আসে, অর্থাৎ সে যদি মারা পড়ে বা বন্দী হয়, তাহলে তার শত্রুরাও ছাড় পাবে না।
সুচেতার দিকে ফেরে শতদল।
—কিন্তু সিগন্যাল পেলে শিপের কাজ কী ছিল?
ফের শিউরে ওঠে সুচেতা।
—কক্ষপথ থেকে সন্তোষগঞ্জের ওপর একটা টেকটনিক টর্পেডো ফায়ার করা।
বিস্ময়ে চোখ বিষ্ফারিত হয়ে ওঠে নিতাইয়ের।
—কিন্তু পরেশ তো মারা গিয়েছিল। মানে সে আর ল্যান্ডারে ফিরে টাইমার বন্ধ করার সুযোগ পায়নি। সুতরাং শিপের তো সিগন্যাল পেয়ে—
—সিগন্যাল পেয়ে আমাদের ওপর একটা টর্পেডো দাগার কথা ছিল।
নিতাইয়ের কথাটা সম্পূর্ণ করেন নীলেশ পাঠক।
কেমন পাংশু লাগে নীলেশ পাঠকের চেহারা।
—কথা ছিল, এবং শিপ সে কথা রেখেছিল। সিগন্যাল পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শিপ কৌস্তূভের উদ্দেশ্যে একটা মহাদেশ বিধ্বংসী টেকটনিক টর্পেডো লঞ্চ করে।
উত্তেজনায় চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে পড়েন ডক্টর শিপ্রা।
—তোমার কথা বুঝতে পারছি না নীলেশ। পরেশের শিপ থেকে যদি টর্পেডো লঞ্চ হয়েই থাকে, তাহলে সে টর্পেডো গেল কোথায়। ও টর্পেডো কৌস্তূভে পড়লে শুরু হয়ে যেত পরের পর ভূমিকম্প আর অগ্ন্যুৎপাত।
কন্ট্রোল রুমের দরজা দিয়ে আসা মিহিরের আলোর দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থাকেন নীলেশ পাঠক। উত্তর দেন অত্যন্ত নিচু স্বরে, যেন কিছুর ভয়েতে হঠাৎ পেয়ে বসেছে তাঁকে।
—টর্পেডো লঞ্চ হবার সঙ্গে সঙ্গেই কৌস্তূভ থেকে উঠে মহাকাশে টর্পেডোকে উড়িয়ে দেয় একটা অত্যন্ত শক্তিশালী লেজার রশ্মি। এই তার ছবি—শিপের ক্যামেরায় তোলা।
স্ক্রীনে ফুটে ওঠে মহাকাশের প্রেক্ষাপটের দিগন্তে একটা বিস্ফোরণের ছবি। অল্প দূরে কৌস্তূভের নীলচে সবুজ দিগন্ত থেকে উঠে এসে সে বিস্ফোরণকে স্পর্শ করেছে কোনও এনার্জি রশ্মির সরল রেখা।
হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকেন ডক্টর শিপ্রা।
—নীলেশ, ও টর্পেডো আমরা ওড়াইনি। আনাদের কাছে অত শক্তিশালী কোনও অস্ত্র নেই।
ডক্টর শিপ্রার দিকে তাকান নীলেশ পাঠক।
—জানি। সেইজন্যে আমি সুচেতাকে বলেছিলাম শিপের রেকর্ডগুলো আর একবার ভালো করে খুঁটিয়ে দেখতে।
উঠে দাঁড়ায় সুচেতা।
—সন্তোষগঞ্জের ওপর আসার আগে পরেশের শিপ কৌস্তূভকে বার দুয়েক প্রদক্ষিণ করে। খুব সম্ভব পরেশকে এই গ্রহটার সার্ভে করার একটা বাড়তি দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। সেই সময় শিপ থেকে কৌস্তূভের যে সব ছবি তোলা হয় তার মধ্যে এইটা ছিল।
সুচেতার হাতের ইশারায় পালটে যায় স্ক্রীনের ছবি।
—একটা পাথুরে প্রান্তর। গাছপালা নেই, খালি চারপাশে ছড়ানো বড় বড় পাথরের চাঁই। আর খানিকটা ছিটকে যাওয়া রঙের মতন সেই সব পাথরের ফাঁকে দাঁড়িয়ে রয়েছে পাঁচিল ঘেরা এক অদ্ভূত দর্শন ইমারত।
নির্বাক হয়ে তাকিয়ে থাকে সবাই স্ক্রীনের ছবির দিকে।
সবার মুখের দিকে পালা করে তাকান ডক্টর শিপ্রা। স্ক্রীনের নীলচে আলো পড়ে তাঁর মুখে।
—কৌস্তূভে আমরা একা নই!
একটা দমকা হাওয়ায় বন্ধ হয়ে যায় কন্ট্রোল রুমের দরজা।
——————————————————————————
কৌস্তূভের তথ্যপঞ্জী
Radius | .8 x Earth |
Mass | .8 x Earth |
Diameter | 10,190 km |
Surface Area | 326.4 Million sq. Km |
Roche Limit | 1300 km |
Surface Gravity | 1.26 x Earth |
To orbit velocity | 7.93 km/s |
Escape velocity | 11.2 km/s |
Geosynchronous orbit distance | 34,160 km |
Geosynchronous orbital velocity | 2.85 km/s |
Orbital period | 442 days |
Semi Major axis | 1.3 AU |
Density | 1.56 x Earth |
Day | 24 Hours |
Atmospheric oxygen | 30% |
Associated bodies | Planetary ring. Two shepherd moons |