“এই বিশ্বের বিপুল বিষয় বৈচিত্রকে মানুষের মনের ক্ষুদ্র বিস্তার কিছুতেই অনুধাবন করতে পারে না, আর তাই আমার বিশ্বাস, জগতের সবচেয়ে অনুকম্পার বিষয় হলো মানবমনের চিন্তার এই সীমাবদ্ধতা ।” ‘কল অফ খথুলু’ রচনায় এটিই লাভক্র্যাফটের প্রথম বানী বলা চলে। এর থেকে তিনি আমাদের একটা স্পষ্ট ইঙ্গিত দেন, যে তিনি এমন কিছুর একটা সন্ধান দিতে চলেছেন, যার রহস্য অনুধাবন করতে গেলে সাধারণ চিন্তাশক্তিতে কুল পাওয়া যাবে না – কারণ এই সৃষ্টি হবে তাঁর নিজের মতোই রহস্যময়, নিবিড় তমিস্রাচ্ছন্ন এবং রোমাঞ্চকর।
লাভক্র্যাফটের লেখা যাঁরা পড়েছেন বা পড়ে চলেছেন বিপুল আগ্রহে, তাঁদের জন্য এই অনন্য সাই-ফাই এবং হরর ফ্যান্টাসির স্রষ্টার পরিচয় আলাদা করে দেওয়ার কিছু নেই। এটা বললে ভুল হবে, লাভক্র্যাফট যে ধরণের লেখা লিখে গেছেন, সেই জঁরে তিনিই পথিকৃৎ। তবে তিনি তাঁর পূর্ববর্তী কিছু লেখকদের থেকে অনুপ্রানিত হলেও, একটা নিজস্ব স্টাইল যে সৃষ্টি করেছিলেন সেটা অনস্বীকার্য। তাঁর লেখাকে না পুরোপুরি ফ্যান্টাসির পর্যায়ে ফেলা চলে, না পুরোপুরি হরর – তাই বলা যায়, সমকালীন বা সামান্য পূর্বের লেখকদের মধ্যে, পো এর ডার্ক ফ্যান্টাসি, এডোয়ার্ড প্লাঙ্কেট এর কিম্ভূত গল্প বা ব্ল্যাকউডের ভুতের গল্পের জনপ্রিয়তার থেকে বেরিয়ে লাভক্র্যাফটিয়ান হরর এক স্বতন্ত্রতা লাভ করেছিল।
লাভক্র্যাফটের সাহিত্য সম্পর্কে ধারণা করতে গেলে তাঁর জীবন নিয়ে একটু আলোচনা করা দরকার। সাধারনত, যে কোন প্রবাদপ্রতিম লেখকের রচনা, তাঁর জীবনের ঘটনাবলীর দ্বারা ভীষনভাবে অনুপ্রানিত হয়ে থাকে। লাভক্র্যাফটও এতে ব্যতিক্রম ছিলেন না। তাঁর রচনার মধ্যেকার অবিমিশ্র নৈরাশ্যবাদ, ভয়াল ভয়ংকর সব কল্পনা এবং সর্বোপরি তাঁর সৃষ্ট গল্পের নায়কের মানবসমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন এবং উদাসীন থাকার প্রবণতা বুঝতে গেলে, তাঁর সংবিগ্ন শিশুকাল সম্বন্ধে প্রাথমিক ধারনা থাকা জরুরি। পরবর্তী জীবনে, তাঁর ব্যবহারে, অ-মিশুকে স্বভাবে কিছু পরিবর্তন এলেও, মূল লাভক্র্যাফট একই রকম থেকে গেছিলেন চিরকাল। তবে, তাঁর জীবনে চলার পথের নানা বাঁকে যে সব ছোটখাট ঘটনাস্রোত তাঁর রচনাকে প্রভাবিত করেছিল, সেগুলি পাশাপাশি নিয়ে না চললে, লাভক্র্যাফটিয়ান সাহিত্য আলোচনা অসম্পূর্ণ থেকে যেতে বাধ্য।
হাওয়ার্ড ফিলিপস লাভক্র্যাফট, ২০শে অগষ্ট, ১৮৯০ সালে, আমেরিকার নিউ ইংল্যান্ড প্রদেশের এক ছোট শহর প্রভিডেন্সে জন্মগ্রহন করেন। ছোটবেলা থেকেই তিনি ছিলেন একটু অন্য ধরনের – বিশেষ মিশুকে বলে তিনি বন্ধুমহলে খ্যাত ছিলেন না। বরং বাড়িতে বসে, মুখচোরা ছেলেটি একা একা গল্পের বইতে ডুবে থাকতেই বেশী ভালোবাসত। তার কারণ অবশ্য ছোটবেলা থেকেই বিভিন্ন অসুখে ভোগা, যার জন্য তিনি বেশিদিন স্কুলে থাকতে অবধি পারেননি। তাঁর বয়স যখন মাত্র তিন, তখন তাঁর বাবা, উইনফিল্ড স্কট লাভক্র্যাফট হঠাত মানসিক রোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। হাসপাতালে শুয়েও তিনি নানারকম অদ্ভুত দৃশ্য দেখতেন আর ছটফট করতেন। এই মানসিক অসুখ থেকে তিনি কোনদিন বেরিয়ে আসতে আর সক্ষম হননি – উলটে নিউরোসিফিলিসে আক্রান্ত হয়ে তাঁর মৃত্যু হয়। বাবার মৃত্যু লাভক্র্যাফটের জীবনে এক বড়সড় পরিবর্তন আনে – তাঁকে ভীষনভাবে বিষাদগ্রস্থ করে তোলে। বাবাকে হারিয়ে লাভক্র্যাফট মা এবং দাদুর কাছে পালিত হতে থাকেন। মা সুজান, তাঁর একমাত্র সন্তানকে ভালোবাসতেন না একথাও যেমন ঠিক নয়, আবার শিশু হাওয়ার্ড মায়ের কাছ থেকে শুধু দূরত্বই পেয়েছেন এটাও বড় রূঢ় বাস্তব। তাঁর স্বামীর এরকম অসময় মৃত্যু সুজান মেনে নিতে পারেননি মন থেকে। কারুর কাছে প্রকাশও করতে পারতেন না তাঁর মনের যন্ত্রনা। আর এই নিঃশব্দ বেদনা ভেতর ভেতর তাঁর ভালোলাগা বা ভালোবাসার গ্রন্থিগুলিকে করে তোলে বিশুষ্ক। তাই রোগাভোগা, চুপচাপ ছেলেটিকে খুব একটা কাছেও টেনে নিতে পারেননি মন থেকে। শিশু বয়সের এই পারিবারিক অবহেলা এবং বঞ্চনার বিপুল প্রভাব পরবর্তীকালে পরিলক্ষিত হয় লাভক্র্যাফটের সৃষ্টির মধ্যে, তাঁর চরিত্রকে করে তোলে বিশ্বস্রষ্টার প্রতি প্রতিহিংসাময়।
সেই রুগ্ন ছেলেটির কিন্তু পড়াশোনার ওপর আগ্রহ কম ছিল না, লেখালাখির হাত তখন থেকেই তাঁর পাকা। বাপ-হারা ছেলেটির প্রতিভাকে সমর্থন করতে এগিয়ে আসেন তাঁর দাদু – উইপিল ফিলিস্পস। তিনি নিজে ছিলেন বড় ব্যবসায়ী এবং পর্যাপ্ত ধনী। এই দাদুর বাড়ির চিলেকোঠার ঘরের লাইব্রেরী ছিলো ছোট্ট হাওয়ার্ডের লীলাভূমি। সারা দুনিয়ার থেকে আলাদা হয়ে কয়েকটি মোমবাতি সম্বল করে দিনের পর দিন লাভক্রাফট কাটিয়েছেন এই লাইব্রেরীতে, ডুবে থেকেছেন বিভিন্ন ধরনের ফ্যান্টাসি সাহিত্যে। কিন্তু দাদুর ব্যবসায় কিছুদিন পর থেকে ধস নামে -কি এক প্রকল্পে টাকা ঢেলে তিনি প্রায় স্বর্বস্বান্ত হয়ে পড়েন। এভাবে চলতে চলতেই কিছুদিন পর দাদুর মৃত্যু হওয়াতে, লাভক্র্যাফটের পরিবার ভীষন অর্থকষ্টে পড়েন যা বজায় ছিলো তাঁর জীবদ্দশার বাকি দিনগুলিতেও।
কেমিষ্ট্রি এবং জ্যোতির্বিদ্যা নিয়ে পড়তে চাইতেন লাভক্র্যাফট। কিন্তু অংকে ভালো না হওয়াতে তিনি জ্যোতির্বিদ্য নিয়ে পড়ার আশা ত্যাগ করেন। হাওয়ার্ড লাভক্র্যাফটের জীবনে চলার পথে বার বার বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে তাঁর শারীরিক রুগ্নতা – কিন্তু প্রতিভার স্ফুরণ তো মননে, তার সাথে বাহ্যিক শরীরের কি সম্পর্ক? তাই শত বাধা সত্ত্বেও জীবনের প্রতিটি না পাওয়ার খামতি লাভক্র্যাফট পুষিয়ে নিয়েছিলেন তাঁর শক্তিশালী কলমের মাধ্যমে আর তাতে সমৃদ্ধ হয়েছিল কল্পবিজ্ঞান এবং হরর সাহিত্য। তবে মুখচোরা হওয়াতে, জীবিতাবস্থায় তাঁর প্রতিভার নিরীখে তুল্যমূল্য সম্মান লাভ থেকে তিনি বঞ্চিত হয়েছিলেন বটে, কিন্তু মহাকাল তাঁকে ভোলেনি আর ভোলেনি কল্পবিজ্ঞান প্রেমী মানুষ। তাঁর লেখা, তাঁর চিন্তাধারাকে আশ্রয় করে গড়ে উঠেছে একের পর এক সিনেমা, টিভি সিরিজ, কমিকস- এবং কল্পবিজ্ঞানের এক স্বতন্ত্র্য ধারার –যা নিয়ে আমরা আলোচনা করব পরবর্তী পর্বে।
নিজের জন্মস্থান প্রথিডেন্সকে লাভক্র্যাফট সারাজীবন নিজের একমাত্র কর্মভূমি এবং নর্মভূমি হিসাবে মেনে এসেছিলেন। বিবাহ পরবর্তী জীবনে তিনি নিউ ইয়র্কে কিছুদিন ছিলেন বটে, কিন্তু এত মানুষের উপস্থিতি, ভিড়, সারাক্ষন জমাটি পরিবেশ তাঁর ভালো লাগত না। তাঁর লেখায়, নানা গল্পে (কল অফ খথুলু, দ্য কেস ওফ চার্লস ডেক্সটার ওয়ার্ড) বার বার ফিরে ফিরে এসেছে এই প্রভিডেন্স শহর। তবে তাঁর স্বতস্ফুর্ত অনুরাগের প্রতিদান দিতেও এই শহর ভোলেনি। এখনও তাঁর সম্মানে প্রভিডেন্স শহরে আয়োজন করা হয় লাভক্র্যাফটের নামে প্রদর্শনী এবং ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল। এই শহর তাঁর জীবনের সেরা সৃষ্টির সময় তাঁর সাথে ছিল, আর তিনিও এই উষ্ণ আলিঙ্গন উপভোগ করে গেছেন জীবনের শেষ দিন অবধি। গর্ব করে তিনি বলতেন, “আমি-ই প্রভিডেন্স (I am Providence) যে কথাটি এখন খোদিত আছে তাঁর কবরের উপর।
অন্য পথের যাত্রী
“মানুষের সবচেয়ে পুরাতন এবং শক্তিশালী আবেগ হলো ভয় ।
আর, সবচেয়ে প্রাচীন এবং অদম্য ভয় হলো, অজানা-র থেকে আতঙ্ক।“
ভয় – হ্যাঁ, অতুগ্র ভীতি, গায়ে কাঁটা দেওয়া ভয়, অন্ধকারে কারুর পদশব্দের ভয়, দুনিয়া পদতলে নিতে আসা অদ্ভুত সব জীবের থেকে ভয় – এই ভয়ই হলো লাভক্র্যাফট সাহিত্যের প্রধান উপজীব্য। লেখার মধ্যে পরতে পরতে শুধু এই বিভীষিকার নানারূপের প্রদর্শনী ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে লাভক্র্যাফট এর গল্পে এবং উপন্যাসে। লাভক্র্যাফটের আগে যাঁরা ভুতের গল্প বা বিভীষিকাময় গল্প লিখে নাম কিনেছিলেন, তাঁদের মধ্যে প্রথম সারিতে অবশ্যই এডগার অ্যালেন পো স্বনামধন্য –এবং বলাই বাহুল্য লাভক্র্যাফটের প্রথম দিকের লেখার মধ্যে পো এর প্রচন্ড প্রভাব বর্তমান। লাভক্র্যাফটের “দ্য মিউজিক অফ এরিক য্যান” কে তো মোটামুটি “দ্য টেল টেল হার্ট” এর অনুপ্রাণিত বলা চলে। যদিও পো এর অনুকরনে লেখা অনেক গল্প লাভক্র্যাফট নিজেই নষ্ট করে ফেলেন। এস টি যোশীর মত লাভক্র্যাফট গবেষকদের মতে, “দ্য টেল টেল হার্ট” গল্পটি লাভক্র্যাফট ও লিখতে পারতেন – কারণ তাঁর মধ্যে সেই প্রতিভা এবং সৃষ্টিসুখ ছিল। তাছাড়া “অ্যাট দ্য মাউন্টেনস অফ ম্যাডনেস” এও পো এর “দ্য ন্যারেটিভ অফ আর্থার গর্ডন পিম অফ নানটাকি” এর স্টাইল বজায় রেখেছেন লাভক্র্যাফট। কিন্তু এত প্রভাব সত্ত্বেও পো তে লাভক্র্যাফট বিলীন হয়ে যাননি – দূর থেকেই তাঁকে গুরু মেনে, অন্যরকম সৃষ্টিতে মেতেছেন, যা লাভক্র্যাফটের সমসাময়িকতাকে তো বটেই, বহু-পরবর্তী প্রজন্মকেও তাঁকে হরর সম্রাট বলে মেনে নিতে বাধ্য করেছে।
লাভক্র্যাফট হররের প্রধান এবং মূল বৈশিষ্ট্য হলো, এক অদম্য ভীতি, যার থেকে কোনো মুক্তি নেই। সাধারনত ভুতের গল্পে, বা রাক্ষস, দানবের গল্পে আমরা পাই, ভালোর জয়। অন্তত শেষ পর্যন্ত ঈশ্বর এসে, সেই শয়তানের হাত থেকে গল্পের নায়ক/নায়িকা কে মায় সারা দুনিয়াকে রক্ষা করেন। কিন্তু লাভক্র্যাফটের গল্পে সেই মহামহিমের কোনো স্থান নেই। সাধারণ ভুতের গল্প বা গথিক হরর থেকে লাভক্র্যাফট এগিয়ে গেলেন আরও অনেকটা আগে –সৃষ্টি করলেন এমন এক দুনিয়া যেখানে অশুভ, বিকটদর্শন, ভয়ানক সব জীবেরা ঘোরাফেরা করে, অবহেলাভরে কৃমিকীটের মতো “উপেক্ষার আবিল দৃষ্টিতে” চেয়ে থাকে মানুষের মতো নগন্য জীবদের প্রতি। আর মানুষ সেখানে অসহায় – পালিয়ে পালিয়ে বেড়ানোই তার কাজ, এইসব অতি ভয়ানক বিভীষিকাকে এড়িয়ে কিভাবে বাঁচা যায়, সেই আতঙ্কেই সে আধখানা হয়ে আছে!!
লাভক্র্যাফট সাধারণ ছিলেন না – সাদা চোখে দেখতে গেলে তাঁকে কিছুটা উৎকেন্দ্রিক বা বিকারগ্রস্ত বলা চলে। পৃথিবীতে থেকে, যে সব অসামান্য কল্প-জীবের বর্ণনা তিনি দিয়ে গেছেন, এত বিবমিষাময় হরর তিনি সৃষ্টি করে গেছেন, তাতে তাঁকে মাঝে মাঝেই এই গ্রহের বাইরের বলে ভ্রম হতে পারে। কল্পনা কতদূর বিস্তৃত না থাকলে তিনি এত অন্ধকার অসহায়তার নিঁখুত বয়ান তুলে ধরতে পারেন। লাভক্র্যাফটের গল্প পড়ার একটা বিশেষ ধরন আছে। দুম করে কেউ লাভক্র্যাফট পড়তে পারবেন না –একটা বিয়ারের গ্লাস হাতে নিয়ে, রোদে বসে বসে হাল্কা চালে পড়ার বই লাভক্র্যাফট নয়। ওঁর গল্পকে সঠিক উপলব্ধি করা যায় – মনযোগী পাঠক হলে। লাভক্র্যাফট যে ভাবে গল্পগুলি কালানুক্রমিক ভাবে লিখে গেছেন, সেরকম ভাবে পড়লে তবেই তাঁর রচনার রস সঠিক ভাবে অনুধাবন করা যায়। এক একটি গল্পে তিনি পুরাতন কিছু চরিত্রকে হঠাৎ করে তুলে এনেছেন, যা আগের গল্প পড়া না থাকলে পাঠকের খেই হারিয়ে ফেলার সম্ভাবনা প্রচুর। তাছাড়া, লেখার মধ্যে এক দম বন্ধ করার পরিবেশ সৃষ্টি করে গেছেন তিনি, এবং সেই গুমোট পরিবেশের জলছবির মধ্যে দিয়ে তিনি দাঁড় টেনে নিয়ে যেতে থাকেন পাঠককে, ঘন কুয়াশাচ্ছন্ন কোনও এক দ্বীপে, বা আতঙ্কিত করে রাখতে পারেন কোনও বিজ্ঞানীর ব্ল্যাক ম্যাজিকে, বা অভিযানে নিয়ে যেতে পারেন আণ্টার্কটিকাতে – যেখানে পাঠক অসহায় – নিবিড় তমিস্রাতে অজানা ভয়ে শিউরে উঠে সে আত্মসমর্পন করে বসে আছে কোনো এক নাম না জানা, ক্লেদাক্ত বিভীষিকার কাছে।
ছোটবেলা থেকেই দাদুর লাইব্রেরীতে ফ্যান্টাসি পড়ে, দাদুর কাছে ভুতের গল্প শুনে এবং বান্ধবহীন অবস্থায় একা একা নিজের মধ্যে গুটিয়ে থেকে হাওয়ার্ডের শিশু মন কল্পনার জাল বুনতে শুরু করেছিল অনেক আগে থেকেই। এর সাথে জ্যোতির্বিদ্যা এবং রসায়নে আগ্রহ, তাঁর মনকে কল্প-বিজ্ঞান চাষের উপযুক্ত উর্বর জমিতে পরিণত করেছিল। লাভক্র্যাফট স্বীকার করেছিলেন, যে জ্যোতির্বিজ্ঞান পড়তে গিয়েই এই সীমাহীন মহাবিশ্বের ব্যাপারে তাঁর ধারনা এবং কল্পনা আরও বর্ধিত হয়, তিনি ক্রমে উপলব্ধি করতে পারেন যে এই মহাবিশ্বে মানুষ কতটা অকিঞ্চিৎকর। যা একসময় ছিল নিছক ফ্যান্টাসি, তা ক্রমে হয়ে ওঠে তাঁর বিশ্বাস, এবং সেই বিশ্বাসকে তাঁর লেখনীর মাধ্যমে পাঠকের মননে সঞ্চারিত করে তোলেন তিনি।
লাভক্র্যাফট নিজের লেখা নিয়ে নিজে কখনো সন্তুষ্ট ছিলেন না। তাঁর নিজের লেখাকে তিনি কখনও উচ্চমানের বলে মনে করেননি। অনেকে মনে করেন, সেই সময়ে, লাভক্র্যাফট একটু নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছিলেন – যদিও লেখক বৃত্তিকে কখনো তিনি টাকা রোজগারের ফিকির হিসাবে ভাবেন নি – নিজের মনের আনন্দে লেখাই ছিল তাঁর মূল উদ্দেশ্য। এই উদ্দেশ্যেই, কিছু অপেশাদার লেখকদের নিয়ে ১৯১৯ সালে তিনি শুরু করলেন তাঁর সম্পাদনায় প্রথম পত্রিকা ‘দ্য কনসারভেটিভ’। এটা করতে গিয়েই তাঁর আলাপ হলো কিছু তরুণ তুর্কির সাথে, যাঁরা তাঁরই মতো অদ্ভুত, ভয়ানক এক কল্পনার জগত সৃষ্টিতে সহকর্মী হলেন এবং যাঁদের সাথে এর পর থেকে তৈরী হলো, তাঁর দীর্ঘদিনের সখ্যতা। এঁদের মধ্যে লিনহার্ড ক্লেইনার, এডিথ মিনিটার, স্যামুয়েল লাভম্যান, ক্লার্ক অ্যাস্টন স্মিথ প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। নিজের মনের খাদ্যের সাথে সাথে এক নিবিড় আশ্রয় খুঁজে পেলেন লাভক্র্যাফট যা শিশুকাল থেকে তাঁর অধরাই থেকে গেছিল এতদিন।
সৃষ্টিসুখের উল্লাসে
লেখার সমঝদার, কিছু মনোযোগী পাঠক এবং বেশকিছু গুণগ্রাহী পেয়ে গতিময় হলো লাভক্র্যাফটের কলম। তিনি চিঠি লেখা শুরু করলেন তাঁর নতুন পাওয়া বন্ধুদের –পাতার পর পাতা সে সব চিঠি –দিস্তা দিস্তা চিঠির তাড়ায় তাঁর অনুরাগীদের ব্যতিব্যস্ত করে তুললেন তিনি। এতদিন বাইরের দুনিয়ার থেকে মুখ লুকিয়ে থাকা ছেলেটির মনের অর্গল যেন খুলে গেল। জীবদ্দশায় প্রায় লাখ খানেক এর ওপর চিঠি লিখেছিলেন লাভক্র্যাফট। সেসবে থাকত প্রচুর ইলাস্ট্রেশন, আর কিভাবে একটি লেখাকে মনোগ্রাহী করে তুলতে হয়, তার পদ্ধতি বর্ণন। এই সময় নিজের কিছু পুরানো লেখাকে লাভক্র্যাফট নিয়ে এলেন অন্ধকার থেকে আলোতে। এর মধ্যে যে ছোটগল্পটি সবথেকে প্রথমে ছাপাখানার আলো দেখল, তার নাম ‘ডেগন’। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে একজন বন্দী নাবিক, জার্মানদের নজর এড়িয়ে পালিয়ে আসে। সমুদ্রপথে একটি প্রায় ডুবন্ত দ্বীপে অদ্ভুত, গা শিরশিরানি প্রস্তরনির্মিত এক মূর্তি দেখতে পায় –মূর্তির গায়ে মাছের মত আঁশ, চোখদুটো ড্যাবড্যাবে এবং কিরকম একটা বিবমিষা উদ্রেককারী সেই ভয়াল মনোলিথ। সেটি চাক্ষুষ করার পর থেকে সে সাময়িকভাবে মানসিক স্থিরতা হারিয়ে ফেলে – এবং অদ্ভুত দৃশ্যাবলী দেখতে থাকে – যার থেকে সে কোনদিনই মুক্তি পায় না।
লাভক্র্যাফটের লেখার একটি অদ্ভুত স্টাইল হলো, মাত্রাতিরিক্ত বিশেষনের যত্র তত্র ব্যবহার। একটি সাধারণ লাইন বোঝাতে লাভক্র্যাফট এমন কিছু বিশেষণের আশ্রয় নেবেন, যাতে পাঠককে আবার ফিরে আসতে হয় সেখানে, থেমে থেমে বুঝে নিতে হয় – ঠিক কীসের বর্ণনা দিতে চাইছেন লেখক। লাভক্র্যাফটের এই সময়ের রচনা খুব একটা ঝরঝরে নয়, আধুনিক তো নয়ই, আর খুব একটা স্মার্টও নয় – উনি এক একটি বিশাল শব্দকে পছন্দ করে ফেলেন আর সেগুলো তাঁর রচনার মধ্যে বারিধারার মত ঝরাতে থাকেন বারংবার। যেমন “ডেগন” এই গিবাস (Gibbous) শব্দটি বার বার ঘুরে ফিরে এসেছে। এছাড়াও নানা ভারী ভারী বিশেষন, যেমন Eldritch, Squalid, Portent এসব শব্দও বহুল ব্যবহৃত হয়েছে, যা লাভক্র্যাফটিয়ান সিগনেচার বলা যেতে পারে।
এছাড়াও, লাভক্র্যাফটের লেখার মধ্যে আছে বিপুল ন্যারেটিভের ছড়াছড়ি। লেখক কখনও নিজেই গল্পের কথক, বা গল্পের নায়ক ঘটনা পরম্পরার বর্ণনা দিয়ে চলেছেন একই গতিতে – গল্পচ্ছলে গল্প না বলে, বলা ভালো এ যেন ঘটনার ডকুমেন্টরী। সাহিত্যে একে বলা হয় পার্পল স্টাইল লেখা – অর্থাৎ, নানা বিশেষ্য, বিশেষণ, উপমা ব্যবহার করে ভারাক্রান্ত এক রচনা।কিন্তু লাভক্র্যাফটের গল্পের বিষয় এমনই অদ্ভুত, এতই টান টান তার বুনোট, যে একদমে পড়ে ফেলা ছাড়াও উপায় থাকে না পাঠকের। এদিকে লেখা শেষও হয়ে যাচ্ছে এমন এক জায়গায় এসে, যেখান থেকে পাঠক হতবাক হয়ে পড়েন!! “শেষ হইয়াও হইল না শেষ।” এর পর কি? কি হতে পারে? অন্ধকার সিঁড়ি দিয়ে উঠে আসা ভয়াল শুঁড়বিশিষ্ট জীবটির পদশব্দে (ডেগন), বা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের অবয়বকে স্পর্শ করার জন্য উত্তলিত, উদ্বেলিত হাতের আঙুলগুলো যখন ছড়িয়ে যায় (দ্য আউটসাইডার্স), সেই দমবন্ধ করা ক্লাইম্যাক্সে – অদ্ভুতভাবে লেখা শেষ হয়ে যায়! এ এক অনন্য স্টাইল – এবং আজও যখন কেউ এভাবেই লিখতে চান বা চেষ্টা করেন, তখন সেটাকে লাভক্র্যাফটিয়ান লেখনভঙ্গিমা বলে দেগে দেওয়া হয় – আর এখানেই লাভক্র্যাফটের অনন্য রচনাশৈলির জয় বলা যেতে পারে।
এই পার্পল স্টাইলের লেখার জন্য সমালোচকেরা দাবী করেন অনেকাংশে লর্ড ডান্সিনি-র প্রভাবকে। এডয়োর্ড প্লাঙ্কেট, আয়ারল্যান্ডের ডান্সিনি রাজ্যের আঠারোতম ব্যারন, (অন্যভাবে লর্ড ডান্সিনি নামে পরিচিত) –লাভক্র্যাফটের অব্যবহিত আগে রচনা করেছিলেন নানারকম ফ্যান্টাসি, রূপকথা এবং ভুতের গল্পের। দাদুর লাইব্রেরীতে বসে বসে হাওয়ার্ড যে সব গল্প গোগ্রাসে গিলতেন, তার মধ্যে এঁনার গল্পও ছিল। পো কে অনুসরণ করলেও, ডান্সিনির রচনাশৈলীকেই এক অন্যধাঁচে গড়ে নেন লাভক্র্যাফট। মূলত ডান্সিনির রূপকথায় থাকা ভগবান এবং শয়তানের রূপকেই ফ্যান্টাসির জগত থেকে পৃথিবীর কঠিন বাস্তব জীবনে নামিয়ে এনে লাভক্র্যাফট তাদের ভয়াল এবং বীভৎস করে তোলেন।
এইসব লেখালেখির যখন পুরোদমে চলছে, তাঁর বন্ধুরা তাঁকে পরামর্শ দেন – লিখে কিছু টাকা রোজগার করার। নিজের খেয়ালে সৃষ্টির আনন্দে মেতে থাকা লাভক্র্যাফটের কাছে অর্থের দাবী বা মূল্য ছিল খুবই কম। তবুও, বাস্তবকে মেনে নিয়ে তিনি বিভিন্ন পত্রিকাতে হরর গল্প জমা দিতে থাকেন অর্থের বিনিময়ে, যা তখনকার তুল্যমূল্য বাজার দরের থেকে অনেক নীচে ছিল। ১৯২১ সালে লাভক্র্যাফট প্রায় সতেরটি গল্প লেখেন, এদের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য গল্পটি ছিলো, ‘দ্য আউটসাইডার্স’। গল্পটির প্রাথমিক পর্যায়টি যেন লাভক্র্যাফটের আত্মজীবনীর ঢঙে লেখা। একজন মানুষ নিজের মধ্যে অন্তর্লীন অবস্থায়, এক প্রাসাদের মধ্যে গুটিপোকার মত বাস করছিল। একদিন, যখন সে তার নিজের জাল কেটে প্রজাপতির মতো বাইরের পৃথিবীতে বেরিয়ে আসে, সে দেখতে পায়, চারপাশের মানুষ বিষম আতঙ্কে ছোটাছুটি করছে – আর তাদের চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে কিছু অপরিচিত দানবীয় জিনিস, যারা যেমন ভয়ঙ্কর, তেমনি মায়াদয়াহীন মূর্তিমান বিভীষিকা। গল্পের মধ্যেকার সবচেয়ে শিরিশিরানি জাগানো লাইন হলো এর শেষ বাক্যটি। যা পাঠককে শুধু এক ধাক্কা দেয় না, তাঁকে বাধ্য করে গল্পটি আবার করে পড়তে, ঠিক করে বুঝতে, যে এই সূত্রধার আসলে কে? ইনি কি মানুষ?
অনেকে মনে করেন এই গল্পের নায়ক যেন লাভক্রাফটের দ্বিতীয় সত্ত্বা। নিজের জীবনেও একা একা গুটিয়ে থাকা অবস্থায় ছোট্ট হাওয়ার্ড নিজেকে অন্য মানুষের থেকে আলাদা করে ভাবতে শিখে গেছিল। রুগ্ন চেহারা, বড় বড় স্ফীত চোখ এবং লম্বাটে মুখ যে বাইরের পৃথিবীর কাছে খুব একটা সুশ্রী নয় সেটা বুঝেই নিজেকে বড়ই বিচ্ছিন্ন মনে করতেন তিনি। তাই তাঁর দ্বৈত সত্ত্বাকে এক ভিনগ্রহী করে তুলতে তাঁকে বিশেষ কষ্ট পেতে হয়নি।
১৯২১ -১৯২৩ (বিবাহ এবং উইয়ার্ড টেলস-এ আত্মপ্রকাশ)
১৯২১ সালে লাভক্র্যাফটের মা সুজান মারা গেলেন গলব্লাডার অপারেশনের সময় শিরা ছিঁড়ে। একে তো দাদু প্রায় কপর্দকশূন্য অবস্থায় মারা যাবার পরে, মা এবং ছেলের অতিকষ্টে দিনযাপন হতো। তারপর শেষদিকে সুজান নিজেও হয়ে পড়েছিলেন প্রায় উন্মাদিনী। ছোটখাটো ব্যাপারে ছেলের সাথে বচসা লেগে যেত তাঁর। অদ্ভুত সংযোগে, তাঁর মা নিজেও মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত হয়ে সেই বাটলার হাসপাতালেই ভর্তি হলেন, যেখানে একসময় তাঁর স্বামী ভর্তি ছিলেন। মায়ের মৃত্যু লাভক্র্যাফটকে এক বিশাল ধাক্কা দিয়ে গেল, বলতে গেলে প্রায় পথে বসিয়ে গেল তাঁকে। যদিও জীবনধারনের জন্য কেবল গ্রাসাচ্ছাদন ছাড়া লাভক্র্যাফটের জীবনে বিলাসিতা বলে কিছু ছিল না, তবু এবার তিনি সামান্য হলেও ভেঙে পড়লেন। সপ্তদশ শতকের সাহিত্য পড়ে পড়ে হাওয়ার্ড লাভক্র্যাফট নিজেই নিজের মনে এক আদর্শ তৈরী করে নিয়েছিলেন – এক ভদ্রলোকের আদর্শ, আর সেই আদর্শের গভীরে ছিল এক প্রখর আত্মমর্যাদা বোধ। না, তিনি সাধারণ চাকুরে হবেন না, কোনোদিনই না। তিনি একজন লেখক, আর লেখকরা চাকুরে বৃত্তি করেননা – এই ইগো তাঁকে কোনোদিন বাইরে কোথাও কাজ করতে দেয়নি। এমনকি বিয়ের পর যখন তিনি নিউ ইয়র্কে কয়েক বছর কাটিয়েছিলেন, তখনও স্ত্রী এর অনুরোধেও তিনি চাকরি খুঁজতে বেরোননি, এমনই ছিল তাঁর লেখার ওপর ভালোবাসা এবং নিজের আদর্শের প্রতি অনমনীয় থাকার এক অদম্য জেদ।
যাইহোক, লাভক্র্যাফটের গল্প লেখা তখন পুরোদমে চলেছে। এমন সময়, তাঁর এক বন্ধু, জর্জ হুটেন একটি কৌতুক পত্রিকার জন্য তাঁকে লিখতে বলেন। পত্রিকার নাম ছিল, “হোম ব্রিউ” এবং তা প্রকাশিত হতো ব্রুকলিন থেকে। ফেব্রুয়ারী, ১৯২২ থেকে এই পত্রিকায় প্রকাশিত হতে থাকে তাঁর উদ্ভট সব কাল্পনিক লেখা। দ্য প্লেগ ডেমন, সিক্স শটস বাই মুনলাইট, দ্য স্ক্রীম অফ দ্য ডেড, দ্য হরর ফ্রম দ্য শ্যাডোস, এরকম একের পর এক গল্প ছাপা হতে থাকে পত্রিকাতে –এই গল্পগুলির বিভাগের একটা গালভরা নাম ছিল, “গ্রুসাম টেলস”। পরবর্তীকালে এই বিভাগের নাম বদলে হয়ে যায় “দ্য হার্বাট ওয়েষ্ট – রি-অ্যানিমেটর” সিরিজ। এই গল্পগুলির মধ্যে অনেকে ফ্রাঙ্কেন্সটাইনের ছায়া খুঁজে পেলেও, সেটা কিন্তু ঠিক নয়। কারণ ফ্রাঙ্কেনস্টাইন, বিভিন্ন শবদেহের অঙ্গ, প্রত্যঙ্গ জোগাড় করে সেগুলি একত্র করে এক দানবীয় রূপ দেন, কিন্তু হার্বাট ওয়েষ্ট, এক মৃত মানুষকে জীবিত করার চেষ্টা করেন। তাই লাভক্র্যাফটের কনসেপ্ট এক্ষেত্রে সম্পূর্ন আলাদা বলা যেতে পারে। যদিও অনেকে মনে করেন, হার্বাট ওয়েস্ট ঠিক লাভক্র্যাফট-টাইপ নয়, লাভক্র্যাফটের লেখা বলতে আমরা যা বুঝি, ওয়েস্ট অনেকটা অন্যরকম। তবে, লাভক্র্যাফটের মধ্যে যে এক পেশাদারী লেখক মাথাচাড়া দিয়ে উঠছেন, তার মকশোটি এই লেখা পড়লে বেশ অনুভব করা যায়।
এর মধ্যে লাভক্র্যাফটের জীবনে কিছু অন্যরকম ঘটনা ঘটে, যেটা তাঁর এযাবৎ কাটিয়ে আসা দিনগুলির থেকে আলাদা তো বটেই। জেনোফোবিক লাভক্র্যাফট টুকটাক বেরোতে থাকেন এদিক সেদিক – তাঁর শহর প্রভিডেন্স ছাড়িয়ে যেতে থাকেন বস্টনে – তাঁর সহ লেখকদের সাথে আলাপ করতে এবং, এর কিছুদিন পর তিনি বিবাহ করেন। মেয়েটির নাম, মিস সোনিয়া গ্রিন। বলাই বাহুল্য সোনিয়া লাভক্রাফটের থেকে পার্থিব ব্যাপারে অনেক বেশী দক্ষ ছিলেন। কেবলমাত্র, সাহিত্যের প্রতি প্রবল অনুরাগ এই দুই মানুষকে কাছাকাছি এনেছিল। মাঝে মাঝেই চন্দ্রালোকিত রাতে তাঁরা একে অপরের সান্নিধ্যে হাঁটতে বেরোতেন নদীর ধার ধরে। এরকমই এক রাতে দুজনেই এক অদ্ভুত আওয়াজ শোনেন নদীর ধারে, চারপাশের অসীম নিস্তব্ধতার মাঝে। নিশ্চিত ভাবেই লাভক্র্যাফটের মনে কোনো উদ্ভট প্লটের উদয় হয়ে থাকবে এই ঘটনা থেকে, কিন্তু এক্ষেত্রে, তিনি নিজে না লিখে সোনিয়াকে এই নিয়ে একটি গল্প লিখতে উৎসাহিত করেন। তার ফলশ্রুতি হিসাবে ১৯২৩ সালে সোনিয়া গ্রিনের হরর গল্প প্রকাশিত হয়, “হরর অ্যাট মার্টিন’স বিচ” এই নামে।
সোনিয়া, মাঝে মাঝেই হাওয়ার্ডকে পিড়াপীড়ি করতে থাকেন নিউ ইয়র্ক-এ এসে বসবাস করার জন্য। তিনি দুটো জিনিস বুঝেছিলেন, এক –যদি লাভক্র্যাফটের ছন্নছাড়া জীবন-কে ভালোবাসায় সিক্ত করতে হয়, তাহলে তাঁকে প্রভিডেন্স থেকে বের করে আনতে হবে। আর দুই, সোনিয়া উপলব্ধি করেছিলেন, লাভক্র্যাফটের মধ্যকার সুপ্ত প্রতিভাকে। আর নিউ ইয়র্ক থেকেই যেহেতু সব নামীদামি পত্রিকাগুলি প্রকাশিত হয়, তাই লাভক্র্যাফট এখানে এলে কিছু করতে পারবেন এই আশা সোনিয়া রেখেছিলেন। কিন্তু ভিনদেশি, বাস্তুহারাদের চাপে দিশেহারা ভিড়ে ভিড়াক্কার নিউ ইয়র্ক শহরে তীব্র জেনোফোবিক লাভক্র্যাফটের দমবন্ধ হয়ে আসতে লাগল। তবুও সোনিয়ার মুখের দিকে চেয়ে তিনি সবই মেনে নিলেন। আর ঠিক এই সময়, মার্চ, ১৯২৩ সালে আত্মপ্রকাশ করল, এক যুগান্তকারী পাল্প পত্রিকা, “উইয়ার্ড টেলস”।
সময়টা এক সন্ধিক্ষন বলা যেতে পারে। আজকের দিনে সাই-ফাই, হরর, ফ্যান্টাসি যতটা না পৃথক জঁর হিসাবে পরিচিত, তার থেকে প্রবলভাবে এদের পৃথক উপস্থিতি ছিল ১৯২০-৩০ সালের মধ্যেকার সময়ে। আর উইয়ার্ড টেলস সেই সময়ের সাই-ফাই, হরর লেখকদের কাছে এক অভয়ারন্য বিশেষ, যেখানে লিখে পরিচিতি এবং অর্থ সবদিক থেকেই লাভবান হতে পারতেন এই জঁর এর লেখকরা। বহু নামি লেখকের (তখনও নামী হননি) প্রচুর বিখ্যাত লেখা ছেপেছে এই উইয়ার্ড টেলস, যেমন ছেপেছে এডমন্ড হ্যামিলটনের লেখা, সেরকমই, রে ব্র্যাডবেরী, রবার্ট হাওয়ার্ড, রবার্ট ব্লক, টেনেসি উইলিয়ামস এনাদের লেখা সমৃদ্ধ ও মুগ্ধ করেছে এই পত্রিকার পাঠকদের।
সোনিয়া এবং বন্ধুদের অনেক অনুরোধ উপরোধের পর, লাভক্র্যাফট শেষ পর্যন্ত তাঁর পাঁচটি বাছাই করা গল্প পাঠালেন “উইয়ার্ড টেলস” এ এবং বলা বাহুল্য সবকটিই নির্বাচিত হলো। ক্লার্ক অ্যাস্টন স্মিথ এবং এডমন্ড হ্যামিল্টনের পাশে শোভা পেতে লাগল, লাভক্র্যাফটের অদ্ভুত ফ্যান্টাসি। সূচনা হলো এক নতুন সম্পর্কের।
এই নিউ ইয়র্কে থাকাকালীনই, ১৯২২ থেকে ১৯২৪ সাল পর্যন্ত লাভক্র্যাফটের কল্পনা উদ্ভাবন করল এমন তিনটি নতুন উপাদান, যা এরপর থেকে তাঁর প্রায় প্রতিটি লেখায় ঘুরে ফিরে আসবে। মিসকোটোনিক ইউনিভার্সিটি (প্রভিডেন্সের ব্রাউন ইউনিভার্সিটি), রহস্যময় শহর আর্কহ্যাম (ম্যাসাচুসেটস) এবং কিশোর বয়সে পড়া আরব্য রজনীর গল্পের ফ্যান্টাসিকে নিজের উর্বর কল্পনায় জারিত করে – নেক্রোনমিকন, যার প্রবক্তা এক উন্মাদ আরব আবদুল আল-হাজারেত। এই আল হাজারেতের উল্লেখ যদিও লাভক্র্যাফটের ১৯২১ সালে লেখা একটি গল্প (দ্য নেমলেস সিটি) থেকে পাওয়া যায়, তবে ১৯২৪ এ লেখা “দ্য হাউন্ড” গল্পেই প্রথম এরকম একটা বই এর কল্পনা করা হয়, যা শুধু অশুভ নয় –অত্যন্ত মারাত্মক। এই বইয়ের ভেতরে শুধু সেই সব মন্ত্র, স্তোত্র এবং পদ্ধতির উল্লেখ আছে, যা দিয়ে অন্য গ্রহের, অন্য মাত্রার, এবং অন্য লোকের নাম না জানা, জীব, বিদেহী এবং কালান্তক সব শয়তানের দল পৃথিবীতে আসতে পারে। এরকম এক মৃত্যুর ছায়াময় ভয়ানক পুস্তকের কল্পনাকে অগষ্ট ডেলেরিথ এবং ক্লার্ক স্মিথের মতো নামি কল্পবিজ্ঞান লেখকরা আবার সমর্থন জানিয়ে টিপ্পনী দেন (ক্লার্ক স্মিথের লেখায় ঠিক এরকমই একটি বইয়ের নাম পাওয়া যায়, “বুক অফ ইবন”)– এর ফলে মোটামুটি একদল ধরেই নেন যে এরকম বই এর অস্তিত্ব থাকার ব্যাপারটা পুরোটাই কষ্ট-কল্পনা নাও হতে পারে। লাভক্র্যাফট যদিও পরে ঘোষনা করেন যে এসবই তাঁর কল্পনা, এই বই বা ম্যাড আরব আল –হাজারেথ এর বাস্তবে কোন অস্তিত্ব নেই কিন্তু ততদিনে তাঁর কাছে এই বইয়ের সন্ধান চেয়ে চিঠি আসা শুরু হয়ে গেছে। এই কাল্পনিক বইটি নিয়ে একদল মানুষ এখনও এই ধারনা পোষন করে চলেছেন যে এই বই নিশ্চই কোথাও না কোথাও আছে! পাগলামি এতদূর গড়িয়েছে, যে কেউ ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরী কার্ডে দুষ্প্রাপ্য বইয়ের স্থানে “নেক্রোনোমিকন” এর উল্লেখ রেখে দেওয়াতে এক ছাত্র লাইব্রেরীর কার্ড চুরি করে সেটি বাগানোর ছক পর্যন্ত কষেছিলো ।
এক ভক্তের বানানো লাভক্র্যাফটিয়ান মেমে
তবে এই “নেমলস সিটি” এবং তাতে আল হাজারেথের উল্লেখ থেকে লাভক্র্যাফট গল্পের কিছু সূত্র প্রকাশ পেতে থাকে। অনেকে মনে করেন, “দ্য নেমলেস সিটি” থেকেই আসলে খথুলুর পটভূমিকা তৈরী হয়। “দ্য হাউন্ড” এ এসে, যখন ম্যাড আরব এই নেক্রোনমিক্রনের মাধ্যমে এক মহা দুষ্ট শক্তির আরাধনা করছেন, তখন মোটামুটি খথুলুর আসার সময় হয়ে এসেছে – আর কিছুদিন পরেই, ১৯২৬ সালে রচিত হবে লাভক্র্যাফটের সেই অমর সৃষ্টি।
এর মাঝে একটু ছোট করে বলে নেওয়া যাক লাভক্র্যাফটের একটি গল্পের কথা। গল্পের নাম, “দ্য র্যাটস ইন দ্য ওয়ালস”। লাভক্র্যাফট গবেষকদের মতে, এটি লেখকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ হরর ছোটগল্প। গল্পের গতির থেকেও বড় কথা, এখানে শব্দকে দিয়ে কথা বলিয়েছেন লাভক্র্যাফট। ঘরের দেওয়ালের মধ্যে ইঁদুরের ঘুরে বেড়ানোর আওয়াজ, টয়লেটের মধ্যে দিয়ে সেইসব ভয়ানকদর্শী ইঁদুরের দলের দিকে তাকিয়ে ন্যারেটারের মনের অবস্থা বর্ণনা এবং সেই সাথে একটা গথিক হরর কে আবছা ভাবে জুড়ে দেওয়া – সব মিলিয়ে এই গল্পটি নিশ্চিত ভাবেই পাঠকের রাতের ঘুম কেড়ে নেবে। পড়তে পড়তে শরীরের মধ্যে কেমন একটা শিরশিরানি জাগানোর মতো গল্প এটি।
নিউ ইয়র্কে থাকতে থাকতে লাভক্র্যাফট দিন দিন আরও গুটিয়ে যেতে লাগলেন। দিনের পর দিন ইউরোপ, এশিয়া থেকে ভিড় করে আসা মানুষদের ভীড়ে তাঁর জেনোফোবিয়া যেন বিশাল আকার ধারন করল। মাঝে তিনি প্রায় সুইসাইডাল হয়ে পড়াতে, বন্ধুবান্ধবদের পরামর্শে নিউ ইয়র্ক-কে চিরকালের জন্য বিদায় জানিয়ে, একা লাভক্র্যাফট আবার ফিরে গেলেন তাঁর প্রিয় শহর প্রভিডেন্সে। তখন ১৯২৬ সালের মার্চ মাস।
খথুলু এবং পরবর্তী লাভক্রাফটিয়ান হররের জন্ম
শুধু মরদেহ কেন চিরকাল রবে শুয়ে?
ওই অদ্ভুত প্রানশক্তি আবেশে,
দেখো মৃত্যুও পড়ে নুয়ে।
(That is not dead which can eternal lie
And with strange aeons, even death may die)
“The Nameless City”
১৯২৬ থেকে ১৯৩৬ সাল লাভক্র্যাফটের লেখনীর সবচেয়ে উর্বরা সময়কাল। এই সময়ের মধ্যে লাভক্র্যাফট রচনা করেন এমন কিছু গল্প এবং উপন্যাসের, যা বিশ্বের কল্প-বিজ্ঞান এবং হরর সাহিত্যে এক নবযুগ সৃষ্টি করে গেছে।
ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর এমেরিটাস জর্জ গ্যামোয়েল এঞ্জেল, প্রভিডেন্সের এক রাস্তায় রহস্যজনক ভাবে মৃত্যুবরন করেন। মৃত্যুর আগে, তিনি এমন একটি ভাষ্কর্য পেয়েছিলেন, যাতে এক অদ্ভুত ধরণের বীভৎস প্রানীর ছবি খোদাই করা ছিল। সেই মনুষ্যাকৃতি প্রানীটার মুখে লম্বা লম্বা শুঁড় অনেকটা অক্টোপাসের মতো। সারা শরীর তার আঁশে ভর্তি এবং সেই শরীরের দুপাশে আবার যেন দুটি ডানার মতো দেখা যাচ্ছে। আপাতত এভাবেই তিনি বর্ননা দিয়েছেন, তাঁর সৃষ্ট আদি-দেবতা খথুলুর চরিত্রকে।
লাভক্র্যাফটের আঁকা – খথুলু স্কেচ
লাভক্র্যাফটের আঁকা – অদ্ভুত দর্শন প্রানীর স্কেচ
লাভক্র্যাফটের সৃষ্ট সব অদ্ভুত চরিত্র গুলির মতো এই চরিত্রটিও পড়তে যতটা ভালো লাগবে, ইলাষ্ট্রেশনে ততটা লাগবে না। কারণ, লাভক্র্যাফট কথার যাদুতে ছবি আঁকার শিল্পী – তাই তাঁর লেখা পড়ার সাথে সাথে পাঠকের কল্পনা ঘোড়দৌড় শুরু করে দেয়, আর মনের ক্যানভাসে ছবি ফুটে উঠতে থাকে সেই সৃষ্টিছাড়া দানবের ভয়াল অবয়বের।
যাইহোক, উপরের ছবিটি, সেই অদ্ভুত প্রানীর –যার নাম খথুলু। এখানে ছোট করে বলে রাখি, এই নামটি লাভক্র্যাফটের দেওয়া এবং তিনি এরকম অদ্ভুত নাম রাখার কারণ হিসাবে বলেছিলেন, যে খথুলু, অ্যাজাথথ (খথুলুর জগতের দেবতা), ইয়গ-সোথথ (খথুলুর অন্যমাত্রার সাম্রাজ্যে ঢোকার একমাত্র অন্ধকার পথ বা মহাজাগতিক দেবতা), এরা এ পৃথিবীর নয়। বহুযুগের এবং অন্যমাত্রার ওপার থেকে এই সমস্ত প্রাচীন দেবতারা সৃষ্টির আদিকালে এই পৃথিবীতে রাজত্ব করত। তারপর কোনো এক অজ্ঞাত কারনে, তারা এক অজানা নগরে (সমুদ্রের তলার শহর র্যালেহা) কালনিদ্রায় মগ্ন হয়ে আছে। এই নিদ্রা যেদিন ভাঙবে, সেদিন মানুষের তথা এই পৃথিবীর ঘোর দুর্দিন ঘনিয়ে আসবে। ভিনমাত্রিক হবার কারনে, এদের নাম এবং ভাষাও আলাদা আলাদা। সুতরাং এই নাম, মানুষের জিভে ঠিকঠাক উচ্চারিত হবার কথা নয় – তাই লাভক্র্যাফট নিজে কিছু ক্ষেত্রে উচ্চারন শুধরে দিতে চেয়েছিলেন, তার মধ্যে, খ্ললু (জিভ কে একদম উপরের তালুতে ঠেকিয়ে শব্দটা ছুঁড়ে দিন), খুল-হু, থুলু এবং সবচেয়ে বহুল ব্যবহৃত যে উচ্চারন, সেটিই এখানে ব্যবহার করছি – খথুলু (Cthulhu) । ভিনমাত্রিক প্রাচীন দেবতাগন তো আপাতত উচ্চারন শুধরে দিতে আসছেন না, তাই নিজের মতো করে উচ্চারন করলেও অসুবিধা নেই।
“কল অফ খথুলু” রচনায় লাভক্র্যাফট, কসমোলজি, অ্যানথ্রোপোলজি এবং হররের একটা দুর্দান্ত মিশ্রন ঘটিয়েছেন। গল্পের রচনাশৈলী কিন্তু অদ্ভুত রকমের খাপছাড়া গোছের – মানে এখানে একটু বিবরণ, ওখানে কিছু খবরের কাগজের কাটিং, এখানে কিছু সাংবাদিকতা – সেরকম প্লট বলে কিছু যে আছে সেটা মনেই হবে না। আর এটাই এই গল্পের সবথেকে আকর্ষক জায়গা। ভিন্ন ভিন্ন খাপছাড়া কিছু ঘটনাকে জুড়ে একটা প্লট বানানো হয়েছে এবং সেটাই যেন কখন বিবরণের ঢঙে একটা গল্প হয়ে গেছে। ‘কল অফ খথুলু’ লেখার সময়ে লাভক্র্যাফট তাঁর স্বভাবসিদ্ধ একটানা বিবরণী থেকে বেরিয়ে একটা নতুন রচনাশৈলী বানালেন আর পাঠককে চমকে দিলেন।
মজাদার ব্যাপার হলো, লাভক্র্যাফটের এই যুগান্তকারী সৃষ্টি খথুলুর গল্প কিন্তু ‘উইয়ার্ড টেলস’ প্রথমে ছাপতে চায়নি। তারা লেখাটা ফেরত পাঠিয়ে দেয়। কিন্তু লাভক্র্যাফট লেখাটি কয়েকদিন নিজের কাছে রেখে আবার ‘উইয়ার্ড টেলস’ দপ্তরে পাঠিয়ে দিয়ে লেখেন, “দরকারী পরিবর্তনগুলো করে দিয়ে আবার পাঠালাম।” শেষ পর্যন্ত, ফেব্রুয়ারী, ১৯২৮ এর সংখ্যায় ছাপা হয়ে বেরোলো এই গল্প – সঙ্গে খথুলু লেখার পারিশ্রমিক, ১৬৫ ডলার।
যদিও লাভক্র্যাফট খথুলুকে নিয়ে সরাসরি আর কোনো গল্প লেখেননি, কিন্তু সেই “দ্য নেমলেস সিটি” থেকে যে যে গল্পে খথুলু, বা অ্যাজাথথ, বা ইয়গ-সোথথ, বা নেক্রোনমিকনের উল্লেখ রয়েছে, বা এদের আসার পটভুমিকা তৈরী হয়েছে, সেই সব গল্প একত্রিত ভাবে খথুলু মিথোস বা খথুলু পুরান নামে পরিচিত। খথুলু-র অনুকরনে পরবর্তী কালে অনেক লেখক গল্প লিখেছেন, সেগুলোকেও একসাথে খথুলু মিথোসের মধ্যে রাখা হয়েছে।
প্রভিডেন্সে আসার পর লাভক্র্যাফটের স্বভাবের কিছু পরিবর্তন ঘটে। বন্ধুবান্ধবদের সাথে প্রভিডেন্সের আনাচে কানাচে ঘুরে আসা থেকে শুরু করে, তিনি তাঁর চারপাশে ক্রমশ গড়ে ওঠা কলোনীর লোকজনদের সাথেও মেলামেশা শুরু করেন। এই সময়ে, তিনি লেখেন তাঁর প্রথম এবং সম্ভবত শেষ উপন্যাস, ‘দ্য কেস অফ চার্লস ডেক্সটার ওয়ার্ড’। লেখাটি তাঁর জীবদ্দশায় ছাপা হয়নি – তাঁর মৃত্যুর পর, ১৯৪১ সালে ‘উইয়ার্ড টেলস’ এটি ছেপে বের করে। লেখাটি লিখে লাভক্র্যাফট মোটেই সন্তুষ্ট ছিলেন না বরং লেখাটির কড়া সমালোচনা করে ফেলে রেখেছিলেন তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত। পরবর্তীকালে লেখাটি ছাপা হতে সমালোচকরা একে লাভক্র্যাফটের সিগনেচার কল্প-বিজ্ঞান সৃষ্টি হিসাবে আখ্যা দিতে না চাইলেও, লেখাটি যে উচ্চমানের সে ব্যাপারে কোনো দ্বিমত রাখেননি। গল্পে চার্লস ডেক্সটার ওয়ার্ড তার পূর্বপূরুষ জোশেফ কারউইনের পূর্ববর্তী কার্যকলাপে ভীষন ভাবে আকৃষ্ট হয়ে পড়েন। ধীরে ধীরে কারউইনের নানা বই ঘেঁটে তিনি ব্ল্যাক ম্যাজিক, অপরসায়ন এসবের সাহায্য নিয়ে কারউইনকে পুনুরুজ্জীবিত করার চেষ্টা করেন।
এই গল্পেই ইয়গ – সোথথ এর নাম এবং উপস্থিতি প্রথম উল্লিখিত হয়। কারউইনের কাছে নেক্রোনমিকনের একটি কপি ছিল – আর সেই দিয়েই এই মহাজাগতিক শয়তানি শক্তিকে জাগ্রত করে তিনি নিজের অভীষ্ট সিদ্ধ করতেন।
লাভক্র্যাফটের আরও একটি কালজয়ী কল্পবিজ্ঞান গল্প ‘দ্য কালার আউট অফ স্পেস’ গল্পে, বস্টনের এক সার্ভেয়ার খবর পান যে ম্যাসাচুসেটস এর কাছে আর্কহ্যাম শহরে এক অদ্ভুত ব্যাপার ঘটে চলেছে। সেখানে খোঁজ খবর করতে গিয়ে তিনি জানতে পারেন যে ১৮৮২ সালে সেখানে এক উল্কাপাত ঘটে এবং তারপর থেকেই সেই জায়গাটি মৃত্যু উপত্যকায় পরিণত হয়। উল্কাটি ঠান্ডা না হয়ে সংকুচিত হতে থাকে এবং কিছু বুদবুদের মত অদ্ভুত উজ্জ্বল রঙের জিনিস নির্গত হতে থাকে। তখন থেকেই সেখানকার অধিবাসী মানুষ মায় পশুরা অবধি এক অদ্ভুত রোগের শিকার হয়ে চলেছে। শস্যেরা এক বিকট আকার ধারন করছে, পশুদের শরীরে বীভৎস ক্ষত দেখা দিচ্ছে এবং তারা পাগল হয়ে এদিক ওদিক ছোটাছুটি করে বেড়াচ্ছে। মানুষের অবস্থাও তথৈবচ – এমতাবস্থায় কিভাবে এই অদ্ভুত এবং ভয়ানক অবস্থা থেকে মুক্তি লাভ করা যায়, সেই নিয়েই এই গল্প।
লাভক্র্যাফটের অনেক গল্পের মধ্যে এটিকে সমালোচকেরা অন্যতম সেরা বলেছেন। এই প্রথম লাভক্র্যাফটের গল্পের মধ্যে, সাই-ফাই এবং হরর মিলেমিশে এক হয়ে গিয়ে একটি চমৎকার মিশ্রন তৈরী করেছে, যেটি একধারে যেমন সুখপাঠ্য, তেমনি ভীতিপ্রদ। এই গল্পটি লাভক্র্যাফট ছাপাতে দিয়েছিলেন একটা অন্য পত্রিকাতে, যার নাম ‘অ্যামেজিং স্টোরিজ’ – হয়ত একটু মুখ বদল করার জন্যই। কিন্তু সম্পাদক মশাই গল্পটি শুধু ছাপাতে দেরী করলেন তাই নয়, তিনি লাভক্র্যাফটকে মাত্র পঁচিশ ডলার সাম্মানিক দিতেও কার্পন্য করলেন। যুগে যুগে এরকম সম্পাদকের অভাব কখনোই লক্ষ্য করা যায়না!! বিরক্ত, হতোদ্যম লাভক্র্যাফট ঠিক করলেন, অনেক হয়েছে। আর না! এবার থেকে গল্প ছাপাবেন তো শুধুই ‘উইয়ার্ড টেলস’- এই।
‘দ্য কালার আউট অফ স্পেস’ কে কেন্দ্র করে হলিউডে সিনেমাও হয়েছে, ১৯৬৫ তে, (ডাই মন্সটার ডাই), ১৯৮৭ তে, (দ্য কার্স) এবং সাম্প্রতিক কালের মধ্যে, ২০১০ এ (ডাই ফারবে) – যার মধ্যে শেষেরটি-ই সমালোচকদের মতে লাভক্র্যাফটের রচনার সাথে সবচেয়ে সঙ্গতিপূর্ন।
এর পরপরই আরও একটি ভয়ানক গা ছমছমে রহস্য গল্প রচনা করেন লাভক্র্যাফট – ‘দ্য ডানউইচ হরর’। ম্যাসাচুসেটস এর কাছে ডানউইচ নামে একটি প্রায় জনশূন্য, জীর্ন গ্রামে এই ঘটনার উদ্ঘাটন হয়। সেখানে লাভিনিয়া হুইটলির এক বিকটাকৃতি ছেলে ছিল, তার নাম উইলবার হুইটলি। ছেলেটির অস্বাভাবিকত্ব বোঝা যায় যখন যে মাত্র বারো বছর বয়েসেই পূর্ণবয়স্ক মানুষের রূপ নেয় – আর শুধু তাই নয় তার চেহারার বিবরন রীতিমতো ভয় জাগানো। আট ফুটের কাছাকাছি লম্বা এই দানবাকৃতি মানুষটির নীচের ঠোঁট অস্বাভাবিক ভাবে ঝুলে নীচে নেমে এসেছে। চোখে ক্রুর দৃষ্টি। এই ভয়ানক ছেলেকে দেখে গ্রামবাসীরা পুরো পরিবারটিকে একঘরে করে। উইলবারের গায়ের এক আশ্চর্য গন্ধের জন্য জন্তু জানোয়াররাও তাকে এড়িয়ে চলে। কিন্তু উইলবারের তান্ত্রিক দাদু, তাকে সঙ্গে নিয়ে নানা ধরনের তন্ত্রসাধনা করেন। এদিকে উইলবারের পরিবার প্রচুর গরু মোষ কিনে থাকে, কিন্তু তাদের খোঁয়াড় কখনও পূর্ন হয় না। প্রতিদিন সকালে সেই সব গরু মোষদের শরীরে এক অদ্ভুত ক্ষত দেখতে পাওয়া যায়। কেন? কি হয় এখানে? কে এই উইলবার? – এসব নিয়েই এক ভয়াল, আতঙ্কে ভরপুর গল্প হলো এই ‘ডানউইচ হরর’।
‘উইয়ার্ড টেলস’ এ গল্পটি যাবার পরে সম্পাদক মশায় শিহরিত হয়েছিলেন এর পৈশাচিকতা দেখে। ছাপতে গিয়ে দোনামোনা করেছিলেন ঠিকই, কিন্তু এ গল্প না ছেপে পারা যায়? আর এই গল্প লিখে লাভক্রাফট পেলেন তাঁর এখনও অবধি সর্বাধিক সাম্মানিক – প্রায় ২৪০ ডলার।
গল্পের মধ্যে আবার এসেছে ইয়োগ – সোথথ এর রেফারেন্স এবং এখানেই প্রথম দেখানো হয়েছে – ইয়োগ-সোথথ আর কেউ না, এক মহাজাগতিক ঈশ্বর। নেক্রোনোমিকনের উল্লেখ এর থেকে বেশী কোথাও নেই – সেই কাল্পনিক অভিশপ্ত পুস্তক থেকে লাভক্র্যাফট লাইনের পর লাইন উদ্ধৃতি দিয়ে গেছেন এই গল্পে। তবে গল্পটির ব্যাপারে সবথেকে ভালো আলোচনা করেছেন এস টি যোশী। লাভক্র্যাফটের লেখার যে দিকটি নিয়ে আমরা আলোচনা শুরু করেছিলাম, যে তাঁর লেখায় ডুবে গিয়ে পাঠক অন্ধকারেই বাস করেন। আলোর রূপোলী রেখা দেখার যতই চেষ্টা করেন না কেন, সেই পিচঢালা তমিস্রা থেকে বার করে নিয়ে আসার জন্য, কোন উদ্ধারকর্তা এগিয়ে আসেন না – কোন ভগবানের স্থান নেই সেই আঁধারে। ঈশ্বর নামে যিনি আছেন, সে ঈশ্বর মহাজাগতিক, অন্য গ্রহের এবং সে আসলে নিজেই এক বিভীষিকা। বলতে গেলে লাভক্র্যাফটের লেখায় কিছুই সাদা নেই, সবই কালো, নিবিড় কালো। কিন্তু এই গল্পে এসে সেই মিথটা তিনি ভেঙে ফেললেন – ভালোর জয় দেখিয়ে দিয়ে। গল্প যতই বীভৎস হোক না কেন, নিজের জঁর এর বাইরে গিয়ে প্রধানত এটাই তাঁর প্রথম ও শেষ লেখা।
ইতিমধ্যে লাভক্র্যাফটের লেখার মধ্যে অনেক পরিবর্তন এসেছে। বিভিন্ন মানুষের সাথে মিশে, প্রভিডেন্স ছাড়িয়ে এদিক সেদিক ঘুরে তাঁর চিন্তা ভাবনার মধ্যে অনেক স্বচ্ছতা এবং পরিশীলিত ভাব প্রকট হয়ে উঠছে। লেখার মধ্যে দিয়েও ডান্সিনির পার্পল স্টাইল ত্যাগ করে তাঁর নিজের আনকোরা স্টাইল ফুটে বেরুচ্ছে – লেখার মধ্যে এই দমবন্ধ করা ভাব ছেড়ে এখন তাঁর লেখা অনেক বেশী ঝরঝরে, বর্ননা অনেক উন্নত এবং সাহিত্যপদবাচ্য হয়ে এসেছে। কিন্তু এসব সত্ত্বেও নিজের বিবাহ তিনি আর টিকিয়ে রাখতে পারলেন না। প্রভিডেন্সে আসা ইস্তক, স্ত্রী সোনিয়ার সাথে অনেক কম দেখা হতো – প্রায় হতোই না বলতে গেলে। এখন একদম বিচ্ছেদ হয়ে গেল। সোনিয়া, নিউ ইয়র্ক ছেড়ে চলে গেলেন ইউরোপে – সেখানে গিয়ে আবার বিবাহ করে বাকি জীবনটা তিনি অতিবাহিত করেন স্বাচ্ছল্যে। আর ভগ্নহৃদয় লাভক্র্যাফট হাতে তুলে নেন কলম – লিখতে থাকেন তাঁর নতুন গল্প –এক অত্যদ্ভুদ সাই-ফাই হরর ‘দ্য হুইসপারার ইন দ্য ডার্কনেস’।
যখন লাভক্র্যাফট গল্পটি লেখার খসড়া করছেন, তখন প্লুটো সবে সবে নবম গ্রহ হিসাবে আবিষ্কার হয়েছে। এই তথ্যটিকে এই গল্পে একটু অন্যরকম ভাবে দেখিয়েছে লাভক্র্যাফট। এটি খথুলু মাইথসের সাথে খুব দুর্বল ভাবে সংগতিপূর্ন – শুধু কিছু নামোল্লেখ ছাড়া আর সবই মোটমাট নতুন। গল্পটির একটি চমৎকার মর্মানুবাদ “কল্পবিশ্ব” এর এই সংখ্যায় সংযোজিত থাকাতে প্লটের বিষয়ে কিছু বলে দেওয়াটা ঠিক হবে না। তবে একটা কথা অবশ্যই বলতে হয় – যে যুগে বসে লাভক্র্যাফট গল্পটি লিখছেন, তখন ভুত, পিশাচ, ভ্যাম্পায়ার এই সব দিয়ে হরর জঁর তৈরী করা হচ্ছিল। সেদিক থেকে দেখতে গেলে মস্তিষ্ক আলাদা করে সংরক্ষন এবং তা জীবন্ত রাখার ব্যাপারে এই গল্পে যা বলা হয়েছে, তা তখকার দিনে নতুন তো বটেই।
***
লাভক্র্যাফটের ভ্রমণ পিপাসা যতই বাড়তে থাকল, ততই তিনি তাঁর চারপাশে বদলাতে থাকা, উন্নত হতে থাকা দুনিয়ার থেকে সমৃদ্ধ হতে থাকলেন ক্রমাগত। তাঁর হরর গল্প লেখা চলছিল নিজের গতিতে কিন্তু তাতে তিনি সেরকম অন্তরের সাড়া পাচ্ছিলেন না। তাই ১৯৩১ সালে, তিনি আবার একটি নতুন এবং মৌলিক গল্পে হাত দিলেন। আন্টার্কটিকার পটভূমিকায় রচিত হলো এক অনন্য সাই-ফাই হরর, “অ্যাট দ্য মাউন্টেন অফ ম্যাডনেস”।
আন্টার্কটিকায় এক বৈজ্ঞানিক অভিযান নিয়ে গল্পের সূচনা। লাভক্র্যাফট সারাজীবন ধরে আণ্টার্কটিকাকে নিয়ে রহস্যের জাল বুনে এসেছেন। ১৮৮৭ সালে লেখা ক্লার্ক রাসেলের বই “দ্য ফ্রোজেন পাইরেট” যখন পড়ছেন তখন তাঁর নয় বছর বয়স। কিন্তু সেই সময় থেকেই এই বিপুল রহস্যময় মহাদেশ নিয়ে লেখার সুপ্ত বাসনা তাঁর মনে লালিত হয়ে চলেছিল, আর তা এতদিন পরে পরিপূর্নতা লাভ করল এই গল্পের মধ্যে দিয়ে।
এ গল্পের সূত্রধার, মিস্কাটোনিক ইউনিভার্সিটির ডঃ উইলিয়াম ডায়ের সেই আন্টার্কটিকাতে গিয়ে কিছু অদ্ভুতদর্শন জীবের ফসিল আবিষ্কার করেন যার সাথে পৃথিবীর জানা জীবজগতের কোনো প্রানীর মিল নেই। কিন্তু সেই ফসিল আবিষ্কারের পর আরও কি বিভীষিকার সম্মুখীন হন তাঁরা, তারই বিশদ বিবরণী লেখা রয়েছে ডায়ের -এর ন্যারেটিভে –তার মাধ্যমে তিনি সতর্ক করেছেন পরবর্তী কালে আসা অভিযাত্রীদের।
গল্পের নাম অবশ্য এডোয়ার্ড প্লাঙ্কেট বা লর্ড ডান্সিনির “দ্য হাসিস ম্যান” নামক গল্পের এক লাইন থেকে নেওয়া, “And we came at last to those ivory hills that are named the Mountain of Madness” – ডানসিনির প্রতি লাভক্র্যাফটের শ্রদ্ধার এটি একটি নিদর্শন বলা যেতে পারে।
“অ্যাট দ্য মাউন্টেন অফ ম্যাডনেস” রচনার ব্যাপারে লাভক্র্যাফট অনেক বই থেকে অনুপ্রানীত হয়েছিলেন। সবার আগে নাম করতে হয়, পো এর সেই বিখ্যাত গল্প, “দ্য ন্যারেটিভ অফ আরথার গর্ডন পিম অফ নানটাকি” -এখানে পো এর গল্পের নায়ক শেষ অবধি আন্টার্ক্টিকার সামনে এসে, বরফের সাদা চাদরের মধ্যে হারিয়ে যান। এই গল্পটি থেকে লাভক্রাফট এতদূর অনুপ্রানীত হয়েছিলেন, যে তিনি পো এর সৃষ্ট নাম না জানা আতঙ্ক টেকেলি-লি কে অবধি ধার করেন গল্পে ওই হাড় হিম করা এফেক্ট আনার জন্য।
লাভক্র্যাফটের এই গল্পটি খথুলু মিথোস এর গল্পের ভিড়ে একটি উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক স্বরূপ বলা যেতে পারে। এখানে নেক্রোনমিকন থেকে শুরু করে সোগথ পর্যন্ত সব কিছুরই সুন্দর একটি যুক্তিপূর্ন সংযোগ বর্তমান। কিন্তু দুঃখের বিষয়, লাভক্র্যাফটের এই গল্পটি “উইয়ার্ড টেলস” খারিজ করে দেয়। ভগ্নহৃদয় লাভক্র্যাফট গল্পটিকে টেবিলের একদিকে সরিয়ে রেখে দেন। এতদিন ধরে পাল্পপ্রেমীদের অসাধারণ সব গল্প উপহার দেবার পরে, এই ব্যবহার তিনি আশা করেননি “উইয়ার্ড টেলস” এর থেকে। এর পর অবশ্য, ১৯৩৫ সালে, জুলিয়াস সোয়ার্জ এর উদ্যোগে গল্পটি “অ্যাস্টাউন্ডিং স্টোরিজ” নামে আর একটি পাল্প পত্রিকাতে ছাপা হয়ে বেরোয় আর সেই প্রত্যাখ্যাত গল্পটি প্রায় তিনশ পনেরো ডলারে বিক্রি হয় যা সারাজীবনে লাভক্র্যাফটের পাওয়া কোন একটি গল্পের পারিশ্রমিক হিসাবে সবচাইতে বেশী।
উইয়ার্ড টেলস থেকে প্রত্যাখ্যান লাভক্র্যাফট ভালো চোখে নেননি। তাঁর মনে হয় যে তিনি হয়ত একটু বেশীই নরম হয়ে গেছেন –চারপাশের আলোকজ্জ্বল জগতের সংস্পর্শে এসে তাঁর মনের কালো ফিকে হয়ে আসছে যার প্রভাব তাঁর লেখনীতে পড়ে চলেছে। তাই, তিনি মনকে বেঁধে নিলেন –আর ফিরে চললেন সেই পুরানো লাভক্র্যাফটে, সেই অন্ধকারের ঠিকানায়। এখন আলো নয়, অন্ধকারই তাঁর সৃষ্টিকে বাঁচিয়ে রাখতে পারবে।
১৯৩২ সাল নাগাদ তিনি রচনা করলেন, “দ্য শ্যাডো ওভার ইনস্মাউথ”।
ম্যাসাচুসেটস এর আর্কহ্যাম নগর থেকে কিছু দুরেই অবস্থিত এই ইনস্মাউথ। এক ছাত্র সেখানে প্রত্নতাত্ত্বিক অভিযানে গিয়ে এক অদ্ভুত ধরনের গহনা দেখতে পায়। এর সন্ধানে সে এই জনশূন্য ইনস্মাউথ এসে উপস্থিত হয় যেখানে সে এমন কিছু মানুষের সাক্ষাৎ পায় আর কিছু ঘটনার প্রতক্ষ্যদর্শী হয় – যা কেবল অসাধারণই নয় – ভয়ঙ্করও।
এটিই হলো প্রথম গল্প যা লাভক্র্যাফটের জীবদ্দশায় পুস্তক আকারে প্রকাশ পেয়েছিল। অদ্ভুতভাবে এরকম একটা দুর্দান্ত গল্প লাভক্র্যাফট ছাপাতে দিতে উতসাহী ছিলেন না। বরং গল্পের মধ্যে “একঘেয়ে কচকচি” র ধুয়ো তুলে তিনি রচনাটিকে বাতিলের খাতায় ফেলে রাখেন।
লাভক্র্যাফটের শুভানুধ্যায়ী অগষ্ট ডেলরেথ গোপনে গল্পটি জমা দেন “উইয়ার্ড টেলস” পত্রিকায়। এবারও লেখাটি প্রত্যাখ্যাত হয় –কিন্তু এবার কারণ অন্য। পত্রিকা সম্পাদক মিঃ রাইট বলেছিলেন, “এরকম একটা গল্পকে দু খণ্ডে ভাঙা যাবে না –আর এত বড় গল্প একসাথে প্রকাশ করাও মুশকিল” – তাই পরে ঠিক হয় গল্পটিকে বইয়ের আকারে বের করা হবে। মাত্র দুশোটি বই ছাপা হয়েছিল, আর কষ্টেসৃষ্টে মাত্র শ খানেক কপি বিক্রি হয়েছিল। যে লেখকের বই কিনতে পরবর্তী প্রজন্ম হামলে পড়বে, যে লেখকের লেখার প্রভাব কত কত বেষ্টসেলার বইয়ের লেখকের মনের মধ্যে অবচেতনে খেলা করে বেড়াবে- তাঁর লেখার বিক্রি নেই। লাভক্র্যাফট যতই দুরছাই করুন না কেন, সমালোচকেরা বলে থাকেন এটি লাভক্র্যাফটের সেরা সৃষ্টিগুলির মধ্যে অন্যতম। এই গল্পে যদিও তিনি সেই ডেগন নামের চরিত্রটিকে ফিরিয়ে এনেছিলেন কিছুক্ষণের জন্য, তবুও এখানেও তাঁর অনন্য সাই-ফাই এর মৌতাত ছত্রে ছত্রে পাওয়া যায় – আর বলতে গেলে এটিও তাঁর একটি কথুলু মিথোস এর অন্তর্গত রচনা। এস টি যোশী সন্দেহাতীত এভাবে এই লেখাটিকে লাভক্রাফটের সেরা দুই গল্পের মধ্যে স্থান দিয়েছেন।
শ্যাডো ওভার ইনস্মাউথ এর প্রথম সংস্করণ
মৃত্যু এবং অন্যান্য শিল্পে লাভক্র্যাফট প্রভাব
“মাঝে মাঝে আমার মনে হয়, আমরা যত কম বস্তুকেন্দ্রিক হব, ততই জীবনের সত্য মহিমা আমাদের উপলব্ধিতে আসবে – কারণ এই উভচর জগতে আমাদের দাম্ভিক উপস্থিতি কিন্তু আসলে বড়ই গৌণ এবং অকিঞ্চিতকর ঘটনা।” (বিয়ন্ড দ্য ওয়াল অফ স্লিপ)
লাভক্র্যাফটের কথাগুলি তাঁর জীবনের দিকে তাকালে, অত্যন্ত প্রনিধানযোগ্য। নিজের জীবনে বস্তুময় জগতকে হেলায় সরিয়ে রেখে তিনি বিচরণ করে গেছেন কল্পনার জগতে, স্ফুরণ ঘটিয়েছেন একের পর এক অসাধারণ সব কল্পবিজ্ঞানের। জীবনকে এতটাই অবহেলাভরে দেখেছিলেন বলে, জীবনও যেন বড় করুন প্রতিশোধ নিল তাঁর উপর। যখন তাঁর লেখনী প্রতিভার মধ্যগগনে, তখনই থেমে গেল তাঁর কলম। চূড়ান্ত দারিদ্র, শরীরের প্রতি চরম অবহেলা – বাহ্যিক জগতের প্রতি তাঁর তাচ্ছিল্য, তাঁকে ভীষণ অসুস্থ করে ফেলল। শরীরে ভেঙে পড়তে লাগল তাঁর। তখন ১৯৩৬ সালের শেষের দিক। পেটের অসুখে মাঝে মাঝেই ভুগতে থাকা লাভক্র্যাফট বাধ্য হলেন ডাক্তারের কাছে যেতে। আর তারপরই ধরা পড়ল যে মারন রোগ ক্যান্সার অনেক আগেই বাসা বেঁধেছে তাঁর অন্ত্রে।
শেষ পর্যন্ত ১৯৩৭ সালের ১৫-ই মার্চ, মাত্র সাড়ে ছেচল্লিশ বছর বয়সে, হাওয়ার্ড ফিলিপস লাভক্র্যাফট, এক মহান সাহিত্য স্রষ্টা, হরর-সম্রাট, আধুনিক কল্পবিজ্ঞানের এর অন্যতম সফল দ্রষ্টা এবং জনকের জীবনাবসান হল। কে জানে, যে সব জগতের স্বপ্ন তিনি দেখতেন, যাদের নিয়েই ছিল তাঁর কল্পনার খেলাঘর, তাদের সাথেই অনন্তের পথে যাত্রা করলেন কিনা।
লাভক্রফট যদি তাঁর শরীরের প্রতি আরও একটু যত্নবান হতেন, বাহ্যিক আচার আচরনে আরও একটু সুসংবদ্ধ হতেন তাহলে এভাবে হারাতে হতো না তাঁকে। তবে অদ্ভুত ব্যাপার, দারিদ্র নিয়ে, প্রায় প্রতিদিন একাহারী, জগতের থেকে অবহেলিত লাভক্র্যাফট কখনও কোন অভিযোগ করেননি। দারিদ্রের প্রতি তাঁর এই চরম ঔদাসিন্য বিস্ময়কর। আক্ষেপ হয়, আর কিছুদিন বেঁচে থাকলে, জীবিতাবস্থাতেই তিনি তাঁর প্রাপ্য সম্মানটুকু পেতে পারতেন – অকালে চলে দিয়ে যেটা থেকে তিনি বঞ্চিত হলেন চিরকালের জন্য।
লাভক্র্যাফটের মৃত্যুর অব্যবহিত পরেই, ১৯৩৯ সালে অগষ্ট ডেলেরেথ এর সাথে ডোনাল্ড ওয়ান্ড্রাই (ইনি নিজেও পাল্প পত্রিকাতে লেখালেখি করতেন, উইয়ার্ড টেলস” এ এনার প্রায় ষোলোটি গল্প প্রকাশিত হয় – লাভক্র্যাফটের বিশেষ বন্ধু এবং শুভানুধ্যায়ী) “আর্কহ্যাম হাউস পাবলিকেশন” এর স্থাপনা করেন এবং লাভক্র্যাফটের সমস্ত গল্প সংকলন প্রকাশ করতে থাকেন। বলতে গেলে, লাভক্র্যাফটকে পৃথিবীর সমস্ত সাই-ফাই প্রেমীদের কাছে পৌঁছানোর ভার এই “আর্কহ্যাম হাউস” পাবলিকেশন নিজেদের চওড়া কাঁধে তুলে নেয়। এতদিনে জগত চিনতে পারে, উপলব্ধি করতে পারে লাভক্র্যাফটের প্রতিভাকে, সম্মান দেয় তাঁর সৃষ্টির। সার্থক হয় লাভক্র্যাফটের লেখনী।
“আর্কহ্যাম হাউস” এর সাফল্যে উৎসাহিত হয়ে অনেক সাই-ফাই লেখক এগিয়ে আসত থাকেন এবং লাভক্র্যাফটের চরিত্র গুলির ওপর কাজ শুরু করেন। বিশেষ করে খথুলু কে কেন্দ্র করে কয়েক’শ গল্প রচিত হয় এবং এখনও হয়ে চলেছে –আর এখানেই লাভক্র্যাফটের সৃষ্টির বিশেষত্ব পরিষ্কার বোঝা যায়। এমন কিছু সৃষ্টি করে গেছেন তিনি, যার প্রভাব থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব হচ্ছে না সাই-ফাই লেখকদের। ১৯৪০-১৯৫০ সাল লাভক্র্যাফটে মজে থাকে কল্পবিজ্ঞান বিশ্ব।
বিভিন্ন নামী দামী লেখক, চেতনে বা অবচেতনে লাভক্র্যাফটের রচনাধারাকে অনুসরণ করে ফেলেছেন – তাঁদের গল্পে লাভক্র্যাফটের প্রভাব চলে এসেছে। স্টিফেন কিং এর “দ্য মিস্ট” উপন্যাসকেই ধরা যাক না। একদিন অন্য মাত্রা থেকেম্বেরিয়ে আসা শুঁড় বিশিষ্ট প্রানীগুলি যারা অকারনে মানুষ হত্যা করে চলেছে চরম নৃশংসতায় – সেখানে তো সম্পূর্ন লাভক্র্যাফটের উপস্থিতি। বর্তমান সাই-ফাই লেখক নিল গায়মান সত্যই বলেছেন –“ আমরা সেই সব জিনিসই অনুকরন করি, যার মধ্যে জীবন আছে, যার একটা অস্তিত্ব আছে, তাতপর্য আছে। মৃত জিনিসকে কেউ অনুকরন করতে চায় না। আর তাই, লাভক্র্যাফটের মৃত্যুর প্রায় একশ বছর পরেও, মানুষটা সমান ভাবে চিরন্তন।“
সারা পৃথিবীতে লাভক্র্যাফটের বই এর প্রায় পঁচিশটি ভাষায় অনুবাদ আছে। অগুনতি সিনেমা হয়েছে তাঁর গল্প থেকে, সরাসরি বা তাঁর গল্পের ছায়া অবলম্বনে। এদের মধ্যে উল্লেখ্য – দ্য ইভিল ডেড, হেল-বয়, দ্য রেসারেক্টেড, দ্য প্রমিথিউস। কেউ যদি পাইরেটস্ অফ দ্য ক্যারিবিয়ান দেখে থাকেন, বুঝতে পারবেন সেখানে ডেভি জোনস্ চরিত্রটি খথুলুর আদলে তৈরী –সেই একই রকম আকৃতি –প্রকৃতি – এবং র্যালেহার মত, তাঁর বাসও সমুদ্রের গহীনে কোনও এক গোপন স্থানে। সিনেমা ছাড়াও অগনিত কমিক্সে, ভিডিও গেমে, টিভি সিরিজে, এমনকি মিউজিক ব্যান্ডেও (HP Lovecraft Rock Band, 1967-69) লাভক্র্যাফট এবং তাঁর সৃষ্ট চরিত্রের উজ্জ্বল উপস্থিতি বিশ্বকে প্রতিনিয়ত বুঝিয়ে চলেছে, অন্ধকার থেকে আলোর দিকে যেতে চাইলেও, মানুষের মনের কল্পনাতে যে অন্ধকারের নেশা লাভক্র্যাফট লাগিয়ে দিয়ে গেছিলেন, তার থেকে বেরিয়ে আসার কোন উপায় নেই।
প্রতিবেদকের কৈফিয়তঃ
লেখাটা লেখার আগে আমাকে লাভক্র্যাফট নিয়ে বেশ চর্চা করতে হয়েছে ঠিকই – কিন্তু এতে আমার মনের কিছু অচলায়তন খুলে গেছে। এতদিন যে সমস্ত সাই-ফাই গল্প, উপন্যাস পড়ে এসেছি, লাভক্র্যাফটের মাধ্যমে তাদের শিকড় গুলকে সম্যক উপলব্ধি করতে পারলাম, সেটা কি কম পাওয়া? লাভক্র্যাফটের লেখায় বার বার ফিরে এসেছে একধরনের ভিনগ্রহী বা ভিমাত্রিক জীব যারা সমুদ্রের নীচে থাকে, অক্টোপাসের মত তাদের শুঁড়, গায়ে মাছের মত আঁশ ইত্যাদি। পড়তে পড়তে মনে হয়েছে, লাভক্র্যাফটের কি সামুদ্রিক জীবদের প্রতি একটা ভীতি কাজ করত? নাহলে সামুদ্রিক প্রানীদের ধাঁচে এইসব দানব বা পিশাচ কল্পনা করার মানেটা কি?
কদিন আগেই বিখ্যাত “নেচার” পত্রিকায় অবশ্য এক বিজ্ঞানীর দল বলেছেন, যে অক্টোপাস জীবটি ভিনগ্রহী হলেও হতে পারে। তার জিনের-এর জটিল গঠন, ক্ষণে ক্ষণে রং বদলে পরিবেশের সাথে মিশে যাওয়ার ক্ষমতা, প্রখর বুদ্ধিমত্তা, পৃথিবীর আর কোনো প্রানীর মধ্যে দেখা যায় না। এই বিশেষ ক্ষমতা লাভক্র্যাফট অনুধাবন করেই এইসব অদ্ভুত জীবে অক্টোপাসের আদল দিয়েছিলেন কিনা, সেটা জানার এখন কোনো উপায় নেই।
এসব সত্ত্বেও আরও একটা জিনিস ভাবিয়ে তুলেছিলো, যে লাভক্র্যাফটের লেখায় এত অন্ধকার কেন? প্রতিবেদকের অনুসন্ধিৎসু মন, তৎক্ষণাৎ ইন্টারনেটে পাতার পর পাতা, ব্লগের পর ব্লগ ঘেঁটে গেছে এর উত্তরের আশায়। কিছুই যে পাইনি তেমন নয় – তবে সেই পাওয়ার সাথে আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে আমি এত তত্ত্ব খাড়া করেছি।
জীবনী পড়লেই বিলক্ষন বোঝা যায়, লাভক্র্যাফটের জীবনে ভালোবাসা নামক বস্তুটার অনুপস্থিতি বড়ই প্রকট। তাঁর বাবা মারা যান যখন তিনি একদম ছোট। মার কাছ থেকে অপত্যস্নেহে বঞ্চিত লাভক্র্যাফট স্ত্রী সোনিয়ার কাছে আশ্রয় নিয়েছিলেন এক বুভুক্ষু মন নিয়ে। কিন্তু শেষ অবধি তাঁকেও রাখতে পারলেন না। ছোটবেলায় দাদুর লাইব্রেরীতে বসে পড়াশোনায় মগ্ন হাওয়ার্ড বড় হয়ে আলেকডান্ডার পোপের মত কবি হতে চেয়েছিলেন –যে শুধু নিজের মনের ইচ্ছেতেই কবিতা লিখবে, কারুর উপরোধে পড়ে, টাকা রোজগারের আশায় নয়। কিন্তু বিধি বাম – কবি হতে চেয়ে, লাভক্র্যাফট শেষ অবধি লিখতে শুরু করলেন গল্প –আর যে সে গল্প নয়। একদম অন্যরকম এক হরর কল্প বিজ্ঞান সাহিত্য।
আপনি কি অন্ধকারের সাথে কথা বলতে চান, ভয়ঙ্করের সাথে সহাবস্থান করতে চান? তাহলে লাভক্র্যাফট পড়ুন। নিবিড় আতঙ্কেরও যে একটা রোমান্টিকতা আছে, একটা সাহিত্যিক ভাবধারা আছে, সেটা লাভক্র্যাফটই আপনাকে সম্যক ধারনা করাবে। বাহ্যিক ভালোবাসা শূন্য হয়ে লাভক্র্যাফট এইসব কাল্পনিক চরিত্র চিত্রনে নিজের মনপ্রান ঢেলে দিয়েছিলেন। শয়নে, স্বপনে, জাগরণে, এই চরিত্ররা তাঁর সাথে কথা বলত – এবং তাঁদের মধ্যে তিনি বিলীন হয়ে গিয়ে তিনি তূরীয়াবস্থা প্রাপ্ত হতেন। ধ্যনমগ্ন যোগির মত কল্পনার উচ্চৈশ্রবার বল্গা ছেড়ে দিয়েছিলেন তিনি। একটা কথা আছে – লেখককে প্রথমে নিজের সৃষ্ট চরিত্রকে বিশ্বাস করতে হয় – তবেই সেই চরিত্ররা পাঠকের হৃদয়ে প্রবেশ করে পাঠকের মনের সাথে লেখকের মনের তারে বেজে ওঠা সুরকে এক তন্ত্রীতে বাঁধতে পারে। লাভক্র্যাফট তাঁর সৃজিত চরিত্রগুলির মধ্যে বাস করতেন, তাই তাঁর খথুলু, সোগথ, ডেগন, উইলবার, ডেক্সটার ওয়ার্ড এত জীবন্ত।
লাভক্র্যাফট যখন সাই-ফাই লিখছেন, তখন এই এলিয়েন-ধারনা মানুষের মনের মধ্যে এরকম ভাবে বাসা বাঁধেনি। এখন যেমন একশটির মধ্যে শতকরা পঁচানব্বইটি কল্প-বিজ্ঞান গল্পের বিষয়বস্তু হলো ভিনগ্রহী বা অন্য মাত্রা থেকে আসা প্রাণীর দল, লাভক্র্যাফটের আমলে এই ধারনাটাই ছিল নতুন। আর তাই, মানুষের কল্পনায় বা বলা ভালো কল্পনার অভাবে, লাভক্র্যাফটের কল্পবিজ্ঞান হয়ে পড়ে আসলে হরর।
ছোটবেলায় জ্যোতির্বিজ্ঞান পড়ার বাসনা থেকেই লাভক্র্যাফট ধারনা করতে পারেন, এই মহাবিশ্বে মানুষ কত ক্ষুদ্র, কত অকিঞ্চিতকর। আর তাই, তাঁর লেখায় মানুষের সেই অসহায়তা, ভিনগ্রহীদের কাছে মানুষের নতজানু হওয়াকে তিনি এত নৃশংসতায় মাখিয়ে ফেলতে পেরেছেন। অসম্ভব নয় যে এর পেছনে তাঁর দীর্ঘদিনের জেনফোবিয়া কাজ করেছিল, অন্য জাতের মানুষের প্রতি ঘৃনা বা আরও ভালোভাবে বলতে গেলে নিজের জীবনে পাওয়া উদাসীনতা, অবহেলা যেন তিনি উজাড় করে দিয়েছিলেন তাঁর গল্পের মধ্যে। এসব তো গেল তাঁর মনন চিন্তনের আলোচনা, কিন্তু কিভাবে আর কোন কল্পনার জাদুবলে তিনি এসব পুরানো দেবতাদের নিয়ে এসেছিলেন তাঁর সাহিত্যে, সেটা এখনও আমাদের কাছে রহস্যময়। আর সেইজন্যেই লাভক্র্যাফট থেকে গেছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে, এক অনন্য স্রষ্টা হয়ে।
আজ লাভক্র্যাফট নেই – কিন্তু কল্পবিজ্ঞানের মধ্যে দিয়ে তিনি ভীষনভাবে জীবন্ত হয়ে আছেন আমাদের মাঝে। আজও যদি কেউ, কোনো বিজাতীয় ধর্মের দেবতার মধ্যে, বা নিছক অ্যাকাডেমিক কৌতূহলে, বা বিজ্ঞানের কোনো অনাবিষ্কৃত অধ্যায়ের ভেতর থেকে কোনো এক অদ্ভুত, অশ্রুতপূর্ব নতুন কিছু সৃষ্টি করে তাকে সুললিত কল্পনার ছন্দে সাহিত্যের আঙ্গিকে বেঁধে ফেলতে পারেন – হয়ত দেখবেন লাভক্র্যাফট দাঁড়িয়ে আছেন – অনতিদূরেই – আতঙ্কের অন্ধকারের রাজ্যে আপনাকে স্বাগত জানাবার জন্য।
I never can be tied to raw new things,
For I first saw the light in an old town,
Where from my window huddled roofs sloped down
To a quaint harbour rich with visionings.
Streets with carved doorways where the sunset beams
Flooded old fanlights and small window-panes,
And Georgian steeples topped with gilded vanes—
These are the sights that shaped my childhood dreams.
HP Lovecraft (from Fungi from Yuggoth)
অক্ষম অনুবাদে বলা যায় –
নব নব বিষয়ে মোরে বাঁধ কেন আর?
প্রথম আলোর তরে জেগেছে সংসার।
ভাঙাচোরা গবাক্ষ পথে ফুটিয়াছে আলো,
ছাদখানি ঝুঁকে আসে, করে আসমান কালো।
দূরে ওই বন্দরখানি মনোরাম ভারী –
সুন্দর দৃশ্য দেখে যায় বক্ষ জুড়ি।
আঁকা বাঁকা পথপাশে, কত গৃহ ‘পরে
রোদের পরশ চুমে খিলান প্রান্তরে।
জানলার ফাঁক দিয়ে, পশে শয্যাপাশে –
গির্জার চুড়াখানি তাই দেখে হাসে।
সোনালি রোদে ভরা এ শহর ক্রোড়ে,
কেটেছিল ছেলেবেলা, স্বপ্নের ঘোরে।
তথ্যপঞ্জির উৎস সন্ধান –
১। লাভক্র্যাফটের সমস্ত কিছুর সন্ধান জানার জন্য – www.hplovecraft.com – এ শুধু একটি ক্লিক এর অপেক্ষা। লাভক্র্যাফটের মতোই নিরালংকার এই ওয়েবসাইট, আদপে কিন্তু সোনার খনি। লাভক্র্যাফট বিষয়ে সব কিছু এখানেই পাবেন – এবং বিনামূল্যে।
২। ইউটিউব – এখানে অনেক ভিডিওতে লাভক্র্যাফট এবং লাভক্র্যাফটের সৃষ্ট বিভিন্ন ব্যাপারে গভীর আলোচনা আছে। লাভক্র্যাফটের ওপর ডক্যুমেন্টরিও পাবেন এখান থেকে।
৩। অবশ্যই উইকিপিডিয়া – অনেক বেশী গভীরে আলোচনা পড়ার জন্য।
৪। গুগুল বুকস – লাভক্র্যাফটের সমস্ত গা-ছমছমে গল্পের কালেকশান পাবেন।
ছবিগুলির জন্য একান্ত ভাবে আন্তর্জালের কাছে ঋণী।
তাহলে আর অপেক্ষা নয়, বসে পড়ুন এই স্রষ্টার অদ্ভুত গল্প পড়তে আর অন্ধকারের রাজ্যে অবগাহন করুন।
অলঙ্করণ : দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য্য