গল্পঃ রুলপুই – অদিতি সরকার: উত্তরাধিকারঃ ওয়েবসাহিত্য পুরস্কার ২০১৭
রুলপুই
অদিতি সরকার
।।এক।।
গোগ্রাসে খাচ্ছিল লোকটা।
ভারতের উত্তরপূর্ব সীমান্তের এই না শহর না গ্রামে সন্ধে নেমেছে অনেকক্ষণ। আলো একেবারে কমে না আসা পর্যন্ত মেজর মাথুর অবশ্য ছবি তুলে গেছেন মনের আনন্দে। তারপর বাধ্য হয়েই ক্যামেরা ব্যাগবন্দি করতে হয়েছে।
এত তাড়াতাড়ি আস্তানায় ফেরার কোনও ইচ্ছেই ছিল না মাথুরের। আস্তানা বলতে হোম-স্টে। স্থানীয় এক বয়স্ক ভদ্রলোকের বাড়িতে পয়সা দিয়ে থাকা খাওয়া। ভদ্রলোকটি মাথুরের পূর্বপরিচিত। তিনিও প্রাক্তন সৈনিক। কর্নেল সাইলো। এক্স ইন্ডিয়ান আর্মি। বলতে গেলে একরকম ওঁর আমন্ত্রণেই আসা। মেজর মাথুর পাহাড়ি পশুপাখির ছবি তুলতে ভালোবাসেন জেনেই ডেকেছিলেন সাইলো। ‘একবার ঘুরে যাও। গ্যারান্টি দিচ্ছি আফসোস করবে না।’
উনি অবশ্য নিমন্ত্রণই করেছিলেন, মাথুরই বিনা পয়সায় থাকতে রাজি হননি। যার যেটা রুজিরোজগার, সেখানে বন্ধুত্বের অজুহাতে লোকসান করানোতে মেজর বিশ্বাসী নন।
যদিও ওঁর ওখানে মাথুরের কোনওরকম অসুবিধেই নেই, গল্পও ভালোই জমে, তবুও সে বাড়িতে একবার ঢুকে পড়লে একটু টুকটাক আড্ডা, আর তারপর খেয়েদেয়ে ঘুমিয়ে পড়া ছাড়া আর কিছুই করার থাকবে না কাল সকাল হওয়া পর্যন্ত। খানিকটা সময় কাটানোর জন্য তাই সেরকম খিদে না থাকলেও একবাটি পর্ক স্টু নিয়ে ছোটোখাটো দোকানটার এককোণে বসে ছিলেন মাথুর। লোকটাকে লক্ষ করছিলেন।
মঙ্গোলয়েড মুখের আদল দেখে লোকটাকে স্থানীয়ই মনে হচ্ছিল। মানে, এই উত্তরপূর্বাঞ্চলেরই কোনও জাতি। অবশ্য সেটা মিজো না অন্য কোনও উপজাতি তা ধরার মতো জ্ঞান মেজর মাথুরের ছিল না। লোকটার পরনে হদ্দ নোংরা জিনসের প্যান্ট, গায়ে একখানা ভারী খাকি জ্যাকেট। জ্যাকেটের জিপার খোলা থাকায় তলার কালো টি-শার্টটা দেখা যাচ্ছিল।
তড়বড় করে খাচ্ছিল লোকটা। চোখেমুখে কেমন একটা তাড়া খাওয়া সন্ত্রস্ত ভাব। মাঝে মাঝেই পাত থেকে চোখ তুলে রাস্তার দিকে তাকাচ্ছিল। কাউকে না দেখতে পেয়ে যে স্বস্তির ভাবটা ওর মুখে ফুটে উঠছিল সেটা এই আলোআঁধারিতেও মাথুর স্পষ্ট বুঝতে পারছিলেন।
কেন যেন মাথুরের মন বলছিল কিছু একটা সাংঘাতিক কান্ড ঘটতে চলেছে আর কিছুক্ষণের মধ্যেই। আজ পর্যন্ত এইসব ব্যাপারে তাঁর মন কখনও তাঁকে ভুল সংকেত দেয়নি। চুপচাপ তাই অপেক্ষায় বসে রইলেন মেজরমাথুর। তীব্র কৌতূহল নিয়ে।
সৈনিকের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় ভুল করে না। রাস্তা দিয়ে এদিকে আসতে থাকা লোকটিকে দেখেই মাথুর সতর্ক হয়ে বসেছিলেন। লোকটির সন্ধানী দু’চোখ শিকারি জন্তুর মতো কিছু খুঁজছিল।
এক লহমার মধ্যে ছোট্ট দোকানটার ভেতরে একটা দক্ষযজ্ঞ বেধে গেল। শেষমুহূর্তে একটা মরণপণ ঝাঁপ না দিলে আগন্তুকের ছোঁড়া ধারালো ছুরিটা লোকটার বুকেই এসে বিঁধত। বাঁশের নড়বড়ে বেঞ্চ এক লাফে উল্টে ফেলে লোকটা এখন মাথুরের টেবিলের তলায় শরীরটা গুঁজে থরথর করে কাঁপছে। ভয়ার্ত কুঁইকুঁই আওয়াজ বেরোচ্ছে তার গলা দিয়ে। লক্ষ্যভ্রষ্ট ছুরিটা তার বাঁ বাহুর ওপরদিকের মাংসে অনেকখানি গেঁথে গেছে।
দোকানে দু-চারজন যারা বসে খাচ্ছিল এই কান্ড দেখে তারা উঠে দাঁড়িয়ে চ্যাঁচামেচি জুড়ে দিয়েছে ততক্ষণে। মালকিনও ছুটে বেরিয়ে এসেছে পেছনের রান্নার ছাউনি থেকে। তুমুল হইচই হট্টগোলের মধ্যে অচেনা আততায়ী কখন যে অন্ধকারের আড়াল নিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল কেউই খেয়াল করেনি।
গোলমালে কেউ মাথুরের দিকে তাকাচ্ছিল না। টেবিলের নিচের লোকটা ততক্ষণে নেতিয়ে পড়েছে। একটা টানা কাতরানির আওয়াজ বেরোচ্ছে তার নীলচে হয়ে আসা দু’ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে। রক্তে বাঁদিকটা মাখামাখি।
মেজর মাথুর খুব সাবধানে মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসলেন। লোকটা নেতিয়ে পড়েছিল একেবারে। মাথার নিচে হাতের ভর দিয়ে আস্তে আস্তে আধবসা করলেন তাকে। সন্তর্পণে, যাতে আরও চোট না লাগে এমনভাবে রক্তমাখা শরীরটাকে বার করে নিয়ে এলেন টেবিলের নিচ থেকে। লোকটার পুরো ওজনই প্রায় তখন মাথুরের দু’হাতের ওপর।
“কেউ চেনেন একে?” সামান্য আওয়াজ চড়িয়ে হিন্দিতে প্রশ্ন করেন মাথুর।
দোকানের ভেতরে চলতে থাকা চ্যাঁচামেচিটা হঠাৎ থেমে গেল। পায়ে পায়ে জটলাটা এগিয়ে এসে এবার মেজর মাথুরকে ঘিরে দাঁড়াল। দুর্বোধ্য ভাষা ও ভাঙা হিন্দির মিশেলে যেটুকু বোঝা গেল সেটা হচ্ছে কেউই এই হতভাগ্যকে চেনে না; আগে কখনও দেখেনি।
“ধারে কাছে কোনও হেলথ সেন্টার আছে, কিংবা দাওয়াখানা?”
সম্মিলিত মাথা নাড়ায় যা বোঝার বুঝে গেলেন মাথুর।
“তাহলে পুলিশ চৌকি? এরকমভাবে একটা লোক এসে সবার চোখের সামনে আরেকজনকে জখম করে চলে গেল, এ তো পুলিশকে জানানো দরকার।”
এবার দোকানজুড়ে যে প্রবল শোরগোলটা ওঠে সেটার মানে ভাষা না জানলেও বুঝতে কোনও অসুবিধেই হয় না। পুলিশের নামেই সকলের ঘোর আপত্তি। সবথেকে বেশি আপত্তি হোটেলের মালকিনের।
কিন্তু কিছু একটা তো করা দরকার। চোখের সামনে একটা লোক এভাবে বিনা চিকিৎসায় মরে যাবে? রক্ত তো থামছেই না। মেজর মাথুর দ্রুত একটা সিদ্ধান্ত নেন।
“একটা খাটিয়া বা ওই ধরনের কিছু পাওয়া যাবে? আমিই না হয় নিয়ে যাব একে আমার সঙ্গে।”
কথাটা বলতে বলতেই কর্নেল সাইলোর মুখটা একবার ভেসে ওঠে মেজর মাথুরের মনে। বিনা নোটিশে ভদ্রলোককে এইরকম একটা বিচিত্র অবস্থায় ফেলার জন্য একটা অপরাধবোধ মাথা তোলার চেষ্টা করে। জোর করে সেটাকে চাপা দিয়ে জড়ো হওয়া লোকজনের দিকে তাকান মেজর।
“খাটিয়া? মাচা? মাদুর? যা হোক কিছু একটা?”
।।দুই।।
শেষপর্যন্ত চারজন মিলে রীতিমতো চ্যাংদোলা করেই আনতে হয়েছিল লোকটাকে কর্নেল সাইলোর বাড়ি পর্যন্ত। বয়ে আনার মতো কিছুই জোগাড় করা যায়নি। ওই অবস্থায় এতখানি পাহাড়ি রাস্তা ওইভাবে আনতে আনতেই জ্ঞান হারিয়েছিল লোকটা।
তবে কর্নেল সাইলোর জবাব নেই। বাড়ির দরজায় অসময়ে ওরকম একটা বিচিত্র শোভাযাত্রা দেখেও কিন্তু একটুও বিরক্ত বা বিব্রত হননি। কোনও প্রশ্ন না করে আগে গেস্ট-রুম খুলে রক্তাক্ত জ্ঞানহীন লোকটাকে বিছানায় শোয়ানোর ব্যবস্থা করেছেন। একবার শুধু ডান ভুরুটা প্রশ্নচিহ্ন হয়ে মেজর মাথুরের দিকে চেয়ে একটু কপালের দিকে উঠেছিল।
লোকটার ভাগ্য একদিক দিয়ে ভালোই বলতে হবে। কর্নেল সাইলোর দিদি নাকি এককালে নার্স ছিলেন। আইজলের হাসপাতালে অনেকদিন চাকরি করেছেন। এটা মেজর মাথুরের আদৌ জানা ছিল না। এই কান্ড না হলে হয়তো কোনওদিন জানতেও পারতেন না। মনে মনে ভগবানকে একটা আন্তরিক ধন্যবাদ দিয়েছিলেন সেদিন মাথুর।
ক্ষত পরিষ্কার করে ভালো করে ওষুধ-টোষুধ দিয়ে ব্যান্ডেজ বেঁধে দিয়েছেন দিদি। ছুরিটা টেনে বার করার সময় আবার গলগল করে রক্ত বেরোতে আরম্ভ করেছিল। অনেক কষ্টে থামানো গেছে। তারপর থেকে এই দু’দিন দিদিই ঘড়ি ধরে দেখাশোনা করছেন। গা মুছিয়ে দেওয়া, ব্যান্ডেজ পালটানো, ওষুধপত্র দেওয়া, গরম সুপ চামচে করে খাইয়ে দেওয়া, সবকিছুই দিদির নিপুণ হাতে ঠিকঠাক হয়ে চলেছে।
এখনও ভালোভাবে জ্ঞান আসেনি লোকটার। দিদি মুখ, গলা পরিষ্কার করে মুছে দিয়েছেন। অসহায় চোখ বোজা মুখটা দেখে বোঝা যাচ্ছিল লোকটার বয়েস খুব বেশি নয়। ছেলেটা বলাই বেশি মানানসই। বড়জোর ছাব্বিশ কি সাতাশ হবে হয়তো। ঘোরের মধ্যে মাঝে মাঝেই জড়িয়ে জড়িয়ে কী যেন বিড়বিড় করছে। কানটা মুখের কাছে নিয়ে গিয়ে শোনার চেষ্টা করেন কর্নেল সাইলো।
“কিছু বুঝতে পারছেন নাকি, কর্নেল সাইলো?”
ঘরের অন্যদিকে চেয়ারে বসা মাথুর জিজ্ঞাসা করেন। এই দু’দিন ধরে তাঁর ফটো তুলতে বেরোনো বন্ধ। একটু আক্ষেপ হচ্ছে ঠিকই। ছুটিটা নষ্ট হল। যে কারণে এখানে আসা সেটাই ভেস্তে গেল। তবে রহস্যের গন্ধ ছেড়ে নড়তে পারছেন না, সেটাও সত্যি।
লোকটার বাহু থেকে বার করা ছুরিটাই বসে বসে খুঁটিয়ে দেখছিলেন মাথুর। ঝকঝকে ধারালো ছুরিটার তীক্ষ্ণ হিংস্র ফলা, দেখলেই ভয় করে। যদিও তার গা থেকে এখন রক্ত মুছে ফেলা হয়েছে, তবু একটা কীরকম গা শিরশিরে আতঙ্ক যেন ছুরিটার দিকে তাকালেই মনকে ছেয়ে ফেলে। ছুরির বাঁটে একটা অদ্ভুত নকশা। একটা বিশাল ময়াল সাপ পাকে পাকে জড়িয়ে রেখেছে মনে হচ্ছে ছুরিটাকে।
“একটা কথাই বার বার বলছে, যতদূর ধরতে পারলাম।” সাইলো জবাব দেন।
“কী কথা, বলুন তো?”
“রুলপুই।”
“মানে?” হাঁ করে সাইলোর দিকে তাকান মাথুর।
“কী জানি। খুব চেনা চেনা লাগছে কথাটা, কিন্তু ঠিক মনে করতে পারছি না। ওর ভাষাটা মিজো হলেও এই বিশেষ ডায়লেক্টটা আমার ভালো করে জানা নেই।” সাইলোর কপালে ভাঁজ গাঢ় হয়।
“একটা জিনিস দেখেছেন সাইলো সাহেব?” মাথুর হাতে ধরা ছুরিটার দিকে আবার চোখ ফিরিয়ে প্রশ্ন করেন।
“কী?”
“ওর ডানহাতের উল্কিটা। কবজি থেকে কাঁধ পর্যন্ত। ছুরির বাঁটের নকশার সঙ্গে হুবহু মিল। এর মানে কিছু বুঝতে পারছেন?”
“নাহ্। ওর জ্ঞান না ফেরা অবধি কিছুই বোঝা যাবে না।” হতাশ হাত ওলটান সাইলো।
“তাহলে সেই অপেক্ষাই করি।”
খুব বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না অবশ্য। দুপুরের খাবার খাইয়ে এসে দিদি খবর দিলেন রোগীর জ্ঞান ফিরেছে। নামও জানা গেছে তার।
“কী নাম, দিদি?” সাইলো জানতে চান।
“রিকি। রিকি দার্নেই। তাই তো বলল।” দিদি হাতের বাসনগুলো নামাতে নামাতে জবাব দেন।
“কথা বলা যাবে এখন ওর সঙ্গে?” মাথুর জিজ্ঞাসা করলেন।
“হ্যাঁ, কিন্তু বেশিক্ষণ নয়। খুব দুর্বল এখনও। সেটা খেয়াল রাখতে হবে।” দিদিকে দেখতে নরমসরম ছোট্টখাট্টো হলে কী হবে, যা বলেন স্পষ্ট করে বলেন। কারও সাহস হয় না দিদির অবাধ্য হতে।
রিকি দরজার দিকেই তাকিয়ে শুয়ে ছিল। ফ্যাকাশে চেহারা। চোখের নিচে গভীর কালি। সাইলো আর মাথুরকে ঘরে ঢুকতে দেখে সে চেষ্টা করছিল উঠে বসার। মাথুর তাড়াতাড়ি থামালেন।
“উঠতে হবে না, উঠতে হবে না। ওভাবেই থাকো। এখনও ঘা শুকোয়নি তোমার।”
“আপনারা? আপনাদের চিনতে পারলাম না তো?” ভাঙা ইংরেজিতে ক্লান্ত স্বরে প্রশ্ন করে রিকি।
“আমার নাম ডেভিড সাইলো। এই বাড়িটা আমারই। আর ইনি আমার বন্ধু, সুনীল মাথুর।”
সাইলো নিজেদের ফৌজি পরিচয়টা সম্পূর্ণ এড়িয়ে গেলেন। মাথুরও চুপ করেই ছিলেন। রিকির পুরো ব্যাপার না জেনে মুখ খোলা ঠিক হবে না।
“আপনাকে আমার মনে আছে।” মাথুরের দিকে চোখ ঘোরায় রিকি। “আপনিই আমাকে বাঁচাতে চেষ্টা করছিলেন, তাই না? আপনারা কয়েকজন মিলেই তো আমাকে তুললেন ওই হোটেলের মেঝে থেকে। এই পর্যন্ত মনে করতে পারছি, কিন্তু তারপর আর কিছু মনে পড়ছে না।”
“তুমি অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলে। আড়াইদিন পর আজ তোমার জ্ঞান এল।” সাইলো বলেন।
মাথুরের কৌতূহল বাধা মানছিল না। তিনি নিজের চেয়ারটা টেনে রিকির খাটের পাশে নিয়ে আসেন।
“ঘটনাটা কী হয়েছিল একটু খুলে বলবে? ওই লোকটি কে, যে তোমাকে আক্রমণ করতে এসেছিল? হঠাৎ ওভাবে আক্রমণ করলই বা কেন?”
“বলছি। একটু জল।”
সাইলো তাড়াতাড়ি টেবিল থেকে জলের গ্লাস নিয়ে রিকির মুখে ধরেন। দু’ঢোঁক খেয়ে গ্লাস সরিয়ে দেয় রিকি।
“আমার নাম রিকি দার্নেই। বিয়াতে জাতির মানুষ আমি। নাম শুনেছেন? আপনি তো এদেশেরই মানুষ। নিশ্চয়ই জানবেন।” সাইলোর দিকে চেয়ে বলে রিকি।
মাথুরও সাইলোর দিকে তাকান। এদিকের জাতিগুলো সম্বন্ধে তাঁর বিশেষ কিছু জানা নেই।
“হ্যাঁ, শুনেছি।” বলেই হঠাৎ লাফিয়ে ওঠেন সাইলো। “আহা। বিয়াতে। তাই বল। রুলপুই। এতক্ষণে মনে পড়েছে।”
“রুলপুই? এ নাম আপনি জানলেন কী করে?” রিকির শিউরে ওঠাটা কারোরই চোখ এড়ায় না।
“তুমিই জ্বরের ঘোরে বিড়বিড় করছিলে।”
“আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।” মাথুর বলতে বাধ্য হলেন।
“আমি বোঝাচ্ছি তোমায়।” গুছিয়ে বসেন সাইলো। “এই যে বিয়াতে জাতি, এরা এই লুসাই পাহাড়ের আদিমতম বাসিন্দা। বহুকাল আগে চিনদেশ থেকে এদের পূর্বপুরুষরা এসেছিলেন এদেশে। আস্তে আস্তে ছড়িয়ে পড়েছিলেন পুরো উপত্যকায়। এঁরা ঈশ্বরজ্ঞানে পুজো করতেন এক অতিকায় ময়ালকে। আর সেই ভয়ানক ঈশ্বরকে তুষ্ট রাখার জন্য বলি দিতেন নিজেদেরই শিশুদের। সেই মহাসর্পেরই নাম রুলপুই। কী রিকি, ঠিক বলছি তো?”
“হ্যাঁ, ঠিক।”
“আমার যতদূর মনে পড়ছে, শেষপর্যন্ত বোধহয় তাকে ওই গ্রামেরই কেউ কৌশলে হত্যা করেছিল।” সাইলো মনে করার চেষ্টা করছিলেন, বোঝা যাচ্ছিল।
“আমরাও সেইরকমই শুনেছি। কিন্তু কেউ কেউ আজও বিশ্বাস করে সেদিন যে মরেছিল সে রুলপুইয়ের দেহ মাত্র। আসল রুলপুই মরেনি। রুলপুই অমর।”
“কিন্তু তার সঙ্গে এই ছুরি মারার কী সম্পর্ক? ছুরির বাঁটে এই সাপ খোদাই, তোমার হাতে সাপের উল্কি, এগুলোরই বা মানে কী? ওই লোকটা কে? কেন মারতে চায় তোমাকে? রুলপুইয়ের নাম শুনে তুমি অমন ভয় পেলে কেন?” মাথুর অনেকগুলো প্রশ্ন এক সঙ্গে করে ফেলেন।
“আপনারা আমার প্রাণ বাঁচিয়েছেন, আপনাদের কাছে কিছু লুকোলে আমার অপরাধ হবে। সব বলছি, তারপর আপনারা যা ডিসিশন নেবেন মেনে নেব।” বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর ধরা গলায় বলে রিকি।
।।তিন।।
“রুলপুইয়ের উপাসনা এখন আর আমাদের জাতির কেউই করে না। যেখানে তার গুহা ছিল সেখানে এখন বাড়িঘর উঠে গেছে। সবাই ভুলে গেছে রুলপুইকে। শুনেছি, তার বিশাল গুহার মুখও আবর্জনায় জঞ্জালে বন্ধ প্রায়। আজ শুধু হাতে গোনা কয়েকজনই জানে রুলপুইয়ের আসল মন্দিরের ঠিকানা।
“সেই যারা প্রথম রুলপুইয়ের পুজো শুরু করেছিল, তাদের মধ্যে কয়েকজন সংকেতে লুকিয়ে রেখেছিল সেই আদি মন্দিরের সন্ধান। তারপর পুরুষের পর পুরুষ ধরে সেই বংশের সন্তানরা নিজেদের কাছে রেখেছে সেই সাংকেতিক ম্যাপ। একসময় নিজেরাই ভুলে গেছে কী করে পড়তে হয় ওই সংকেত, কিন্তু তবুও রেখেছে।”
“কিন্তু কেন? কী আছে ওই মন্দিরে?” মাথুর জানতে চান।
“শুনেছি, সে মন্দিরে আছে এমন সব ধনরত্ন, টাকা দিয়ে যার দাম মাপা যায় না। রুলপুই পাহারা দিয়ে রেখেছেন সেই রত্নের ভান্ডার, যুগ যুগ ধরে।”
“কোথায় সে মন্দির? কোনওদিনও শুনিনি তো। এমন একটা জিনিসের খবর কেউ জানে না, এ হতে পারে?” সাইলোর মুখে-চোখে স্পষ্ট অবিশ্বাস খেলা করে।
“সে মন্দিরের পথ খুব দুর্গম, গভীর জঙ্গলের ভেতরে। রুলপুইয়ের আদি উপাসকদের পরিবারের সন্তানরা ছাড়া কেউ জানে না তার হদিশ।”
“বেশ, তারপর? এর সঙ্গে তোমার ওই উল্কি আর ছোরার কী সম্বন্ধ? তুমি কি তাহলে ওই নাগদেবতার পুরোহিত পরিবারেরই কেউ?”
সাইলোই জেরা চালু রেখেছেন। মাথুর মাঝে মাঝে একটা দুটো মন্তব্য ছাড়া বিশেষ কথাবার্তা বলছিলেন না। তাঁর তীক্ষ্ণদৃ্ষ্টি অবশ্য রিকির ওপর থেকে নড়ছিল না।
আবার অনেকক্ষণ চুপ করে থাকে রিকি। মাথা নিচু। তারপর আস্তে আস্তে মুখ তোলে।
“আমাকে যে মারতে এসেছিল, ওর নাম জেজে। আমারই জাতের। অসম্ভব নিষ্ঠুর, অসম্ভব লোভী। হেন খারাপ কাজ নেই যা ও করেনি, যা ও করতে পারে না। একটা আস্ত দলই আছে জেজের। যতরকম কুকাজ এই নর্থ-ইস্টে হয় তার অর্ধেকেরও বেশিতে জড়িত জেজের দল। সেই দলের নামও রুলপুই।”
“তোমাদের দেবতার নামে নাম?” মাথুর চমকে ওঠেন।
“হ্যাঁ। এই সাপের উল্কি ওই দলের সদস্যদের পরিচয়। আমি আপনাদের মুখে রুলপুই শুনে ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম, আপনারা ওই গ্যাংয়ের কথাই বলছেন। ওই সাপের মতোই নির্মমভাবে শিকারকে গিলে খায় জেজে; পাকে পাকে জড়িয়ে প্রাণ কেড়ে নেয়। ওই ছোরাটা জেজের নিজের ছোরা। বাঁটে অনেক শখ করে রুলপুইয়ের ছবি খোদাই করিয়েছিল ও।”
“তা তোমার ওপরে তার এত রাগ কেন? তোমার হাতে ওই উল্কি মানে তুমিও ছিলে ওর দলে, বোঝাই যাচ্ছে। লিডার হঠাৎ একেবারে ছুরি নিয়ে মারতে এল তোমায়, ব্যাপারটা কী? টাকাপয়সার বখরা নিয়ে চোরে চোরে গোলমাল?” সাইলোর গলায় অসন্তোষ স্পষ্ট। রিকির পরিচয়টা বুঝে অবধি তাঁর মুখটা বেশ গম্ভীর হয়ে গেছে।
“বয়েস কম ছিল স্যর, রক্ত গরম ছিল। গ্যাং মেম্বার হওয়ার সময় জানতামও না জেজে কী করে। দামি বাইক, দারুণ দারুণ ড্রেস, এসবই দেখেছিলাম। তারপর তো আর বেরোনোর উপায়ই রইল না। জেজের দলে জ্যান্ত ঢোকা যায়, বেরোনো যায় না।”
“মন্দিরের কথা শেষ করলে না তো।” সাইলো সামান্য নরম হয়েছেন।
“আপনি ঠিকই ধরেছেন স্যর, আমি ওই পরিবারেই জন্মেছিলাম। ওই সাংকেতিক চিহ্ন আঁকা ম্যাপ আমার কাছেও আছে। যদিও তা পড়ার বিদ্যে আমার নেই। আমার বাপঠাকুরদারও ছিল না।”
“কোথায় সে ম্যাপ?” মাথুর কৌতূহল না চাপতে পেরে রিকির দিকে ঝুঁকে আসেন।
সাইলো এবং মাথুর অবাক হয়ে দেখলেন রিকি চাদরের মধ্যে থেকে তার ডানহাতটা বার করে নিজের গলায় ঝোলানো একটা ধাতুর চাকতির দিকে ইঙ্গিত করছে।
“এই সেই ম্যাপ।”
“মানে? ওর মধ্যে ম্যাপ লুকোনো আছে?” মাথুর হতভম্ব হয়ে যান কেমন। রিকির কথাগুলো তাঁর কীরকম অবিশ্বাস্য লাগছিল।
“না স্যার। এটাই ম্যাপ। এর গায়েই নকশা আঁকা আছে। এটাই চেয়েছিল জেজে। একদিন, ইয়ে মানে, একটু বেশি নেশা করে বলে ফেলেছিলাম ওকে রুলপুইয়ের মন্দিরের কথা। আমাদের পরিবারের ইতিহাসের কথা। সেদিন থেকে ওর মাথায় শুধু একটাই চিন্তা। কী করে খুঁজে পাবে ওই মন্দির। ওই মহানাগের মূর্তি। লোভ খেয়ে ফেলছিল ওকে স্যার। আমার কাছে লকেটটা চেয়েছিল, প্রথমে ভালো কথায়, তারপর ভয় দেখিয়ে। আমি বুঝে গেছিলাম, যে কোনওদিন ও আমাকে মেরে এটা কেড়ে নেবে। তাই পালিয়েছিলাম। বুঝিনি, জেজের হাত থেকে অত সহজে পালানো যায় না।”
“নিশ্চিন্ত থাকো, এখানে তোমার জেজে কিছু করতে পারবে না।” সাইলো আশ্বাস দেন।
রিকির মুখে অদ্ভুত একটা হাসি খেলে যায়।
“জেজেকে আপনারা চেনেন না স্যর, আমি চিনি। ওর হাত থেকে আমার মুক্তি নেই, জানি আমি। তার চেয়ে বরং আপনারা আমাকে পুলিশের হাতেই দিয়ে দিন, স্যর।”
“আগে সেরে ওঠো, তারপর ভাবব কী করা যায় তোমায় নিয়ে।” ঘর ছেড়ে বেরোতে বেরোতে গম্ভীর স্বরে কথাক’টা বলে যান কর্নেল সাইলো।
।।চার।।
দিন সাতেক পরে একদিন মাঝরাতে বিরাট হট্টগোলে সবার ঘুম ভেঙে গেল। সাইলোর কুকুর টিমি প্রচন্ড চিৎকার করতে করতে সারা বাড়ি দৌড়ে বেড়াচ্ছিল। সাইলো আর মাথুর দু’জনেই যার যার ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে এলেন। দু’জনের মাথাতেই একই কথা ঝিলিক দিয়েছিল – রিকি!
দিদি নিজের ঘরের দরজা খুলে উঁকি দিচ্ছিলেন। মাথুরের ইশারায় তাড়াতাড়ি আবার ভেতরে ঢুকে ছিটকিনি লাগিয়ে দিলেন।
রিকির ঘরের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ ছিল। কিন্তু সাইলো এবং মাথুর দু’জনেই শুনতে পাচ্ছিলেন ভেতরে ঝটাপটির আওয়াজ। মাথুর আর দু’বার চিন্তা না করে দরজায় কাঁধ দিয়ে সজোরে ধাক্কা দিতে শুরু করলেন। পরপর কয়েকবার তাঁর বিশাল সবল দেহের জোরালো আঘাতের পরেই ভেতরের ছিটকিনি ঢিলে হয়ে গিয়ে দরজা ফাঁক হয়ে গেল।
রিকির ঘরে শোয়ার সময়ে একটা মৃদু আলো রোজই জ্বলে। এখন কিন্তু ঘর পুরো অন্ধকার। তার মধ্যেই মাথুর ও সাইলো দু’জনেই দেখতে পেলেন একটা ছায়াশরীর বাইরের দেওয়ালের জানালার দিকে যাচ্ছে। সাইলোও লাফিয়ে ওদিকে গেলেন লোকটাকে আটকাতে। মুহূর্তের মধ্যে একটা সাংঘাতিক ধাক্কায় ব্যালেন্স না রাখতে পেরে সপাটে পড়লেন মেঝেতে।
ততক্ষণে গরাদহীন জানালা দিয়ে মাথুর প্রায় বুক পর্যন্ত ঝুঁকিয়ে দিয়েছেন বাইরে। অন্ধকারে স্পষ্ট কাউকেই দেখা গেল না, শুধু রাস্তায় একটা শক্তিশালী বাইকের ইঞ্জিন গর্জন করে উঠল।
“কর্নেল, উঠেছেন? চোট-টোট লাগল নাকি?” মাথাটা ভেতরে টেনে নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন মেজর মাথুর।
“নাহ্। আয়্যাম ওকে। বেকায়দায় ধাক্কাটা দিল, তাই। হাতে পেয়েও রাখতে পারলাম না। আলোটা জ্বালাও দেখি। রিকি ঠিক আছে কি না বুঝতে পারছি না।”
আলো জ্বেলে দু’জনেই চমকে উঠলেন। বিছানাটা তোলপাড় হয়ে আছে, কিন্তু রিকি বিছানায় নেই।
চিন্তিত মুখে সাইলো ঘরের এদিক ওদিক তাকাচ্ছিলেন। তখনই মাথুর আওয়াজ দিলেন, “এই যে, এখানে।”
খাটের নিচে চাদরে-কম্বলে জড়ামড়ি হয়ে পড়ে আছে রিকি। চোখ বন্ধ। খুব সাবধানে তাকে টেনে বার করে মাথুর দেখলেন, রিকির গলায় পরিষ্কার কারও আঙুলের চেপে বসা দাগ। নিঃশ্বাস পড়ছে অবশ্য। তবে বেশ কষ্ট করে।
টিমি এতক্ষণে তার তর্জন গর্জন থামিয়েছে। সম্ভবত বুঝেছে, শত্রু এখন নাগালের বাইরে। তার চিৎকার বন্ধ হওয়াতেই বোধহয় দিদিও সাহস পেয়ে ঘর থেকে বেরিয়েছিলেন। কখন এ ঘরে এসে দাঁড়িয়েছেন কেউ খেয়াল করেনি। এখন তাঁর আতঙ্কিত শ্বাস টানার আওয়াজে ওঁরা দু’জনেই চমকে উঠে মুখ ফেরালেন।
“কী হয়েছে রিকির?”
“কিচ্ছু হয়নি দিদি, শান্ত হও। দেখছি।”
“সর দেখি, আমাকে দেখতে দে। এত খেটেখুটে যাও বা সারিয়ে তুলছিলাম ছেলেটাকে, আবার কী যে হল।”
দিদি অভ্যস্ত হাতে রিকির পালস দেখতে থাকেন। মাথুর ততক্ষণে রুমাল ভিজিয়ে এনেছেন। ঘাড় কপাল মোছাতে থাকেন তাই দিয়ে। আস্তে আস্তে রিকির চোখের পাতা নড়ে। শ্বাস স্বাভাবিক ছন্দে ফেরে।
“আবার আমাকে আজ বাঁচালেন আপনারা। এ ঋণ যে আমি কীভাবে শোধ করব।” রিকির গলা ধরা ধরা।
“সেসব পরে হবে। কী হয়েছিল ব্যাপারটা বল তো।”
“আর কী। আমি তো বলেইছিলাম জেজে আমাকে ছাড়বে না। আজ নিয়ে দু’দিন আমাকে হাতের মধ্যে পেয়েও ফসকেছে, তিনবারের বার আমাকে মেরেই ফেলবে।”
“গলা টিপে ধরেছিল কেন?”
“আমি ঘুমোচ্ছিলাম স্যর, কখন ও ঘরে ঢুকেছে, কীভাবে ঢুকেছে টের পাইনি। ঘুম ভাঙল একেবারে যখন আমার গলাটা ওর দু’হাতের মধ্যে।” বলতে বলতে উঠে বসে রিকি।
মেজর মাথুর হঠাৎ চমকে ওঠেন। “রিকি, তোমার লকেটটা তো গলায় দেখছি না। জেজে কি নিয়ে গেল ওটা?”
সাইলোও উৎকণ্ঠিত মুখ নিয়ে এগিয়ে আসেন। “সত্যিই তো। লকেট তো নেই। তাহলে কি শেষপর্যন্ত ওটা ওই শয়তানের হাতেই পড়ল?”
“না। লকেট আমার কাছেই আছে। গলায় ঝুলতে না দেখেই তো গলা টিপে ধরেছিল।”
“আছে? কোথায়?” এবার দিদি জানতে চান।
“আসলে ক’দিন ধরেই আমার মনটা কেমন কু-ডাক ডাকছিল। তাই গত তিনদিন ধরে রাতে শোওয়ার আগে লকেটটাকে গলা থেকে খুলে লুকিয়ে রাখছিলাম। ভাগ্যিস রেখেছিলাম।”
“কোথায় রেখেছ সেটা বলবে তো।”
রিকির মুখে এবার একটু অপরাধী ভাব দেখা দেয়। সাইলোর দিকে আড়চোখে একবার তাকিয়ে মাথাটা নামিয়ে নেয় সে।
“আপনার একটা জিনিস একটু নষ্ট করেছি, স্যর।”
“আমার জিনিস নষ্ট করেছ? কী জিনিস, শুনি?” সাইলোর গলার ভেতরে গুরগুরিয়ে বাঘ ডেকে ওঠে।
“ওই দেওয়ালে টাঙানো আপনার বড়ো ছবিটা, স্যর।” রিকি গলায় হাত বুলোতে বুলোতে মিনমিন করে জবাব দেয়।
ঘরের বাকি তিনজনের ঘাড় এক সঙ্গে ছবিটার দিকে ঘুরে যায়। যুবক সাইলো পুরো ফৌজি সাজসজ্জায় দাঁড়িয়ে আছেন রাজকীয় ঠাটে।
“আরেঃ, এ ছবিটা এ ঘরে ছিল নাকি!”
সাইলো একটু অপ্রতিভ হয়ে মেজর মাথুরের দিকে তাকান। তাঁর অস্বস্তির কারণ বুঝতে মাথুরের একটুও অসুবিধে হয় না। রিকির কাছে সাইলোর আসল পরিচয় প্রথমদিন থেকেই জানা ছিল। এত স্যর স্যর করার রহস্য তার মানে এই। মাথুর একটু মুচকি হাসেন।
“কিন্তু কিছু নষ্ট হয়েছে বলে তো মনে হচ্ছে না।” অনেকক্ষণ ধরে ভাইয়ের ছবি খুঁটিয়ে দেখে দিদি বলেন।
“সামনের দিকে কিছু করিনি তো। পেছনের দিকে।”
মাথুর দেওয়াল থেকে সাবধানে ছবিটা নামিয়ে আনেন। খুব মন দিয়ে সেটাকে পরীক্ষা করতে থাকেন তারপর। বেশিক্ষণ দেখতে হল না। একটু পরেই বুঝতে পারলেন যে ভালো করে লক্ষ করলে দেখা যাচ্ছে ছবিটার পেছনদিকে ফ্রেমের পাশে ব্যাকিং বোর্ডের একটা জায়গা একটু ছেঁড়া। ফ্রেমের গায়ে ছোটো ছোটো ফুটো দেখেও বোঝা যাচ্ছে যে অন্তত চারটে পিন তুলে ফেলা হয়েছে ওই জায়গাটা থেকে।
হাত দিয়ে অনুভব করতে থাকেন মাথুর। বোঝা যাচ্ছে কিছু একটা আছে ওই ব্যাকিং বোর্ড আর ছবির মাঝখানে। শক্ত গোল একটা জিনিস হাতে লাগছিল তাঁর। খুব সাবধানে ছেঁড়া জায়গাটার মধ্যে দিয়ে দুটো আঙুল গলিয়ে দেন মেজর মাথুর। আঙুল দুটো আবার যখন বেরিয়ে এল তখন তাদের ফাঁকে ধরা রয়েছে তামার একটা চাকতি, যার দু’পিঠেই কিছু অবোধ্য চিহ্ন খোদাই করা।
সাইলো রাগ করবেন, না খুশি হবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না। হাঁ করে একবার ছবির দিকে, একবার রিকির দিকে তাকাচ্ছিলেন।
“এটাই তো?”
“হ্যাঁ স্যর, এটাই।”
“আমরা একটু ভালো করে জিনিসটাকে দেখলে তোমার আপত্তি আছে?”
“না স্যর, আপত্তি কীসের?”
“তোরা এত রাতে এসব নিয়ে বসলি আবার।” দিদি গজগজ করে ওঠেন।
“হ্যাঁ দিদি, ঘুম যখন চটেই গেছে তখন নাহয় একটু রহস্যভেদই করি। তুমি শুয়ে পড় বরং। কী মেজরসাব, কফি চলবে নাকি এক কাপ? তার পরে না হয় বসা যাবে সংকেত উদ্ধারে।”
মেজর মাথুর গোঁফের আড়ালে হাসি লুকিয়ে নেন। সাইলো আর কোনও লুকোছাপা করবেন না, বোঝাই যাচ্ছে।
।।পাঁচ।।
বাকি রাতটা ওই চাকতি নিয়েই কেটে গেল। তামার চাকতি একটা, পুরনো হয়ে তেলতেলে হয়ে গেছে। গায়ে খোদাই নকশাগুলোও কিছুটা আবছা, মোছামোছা হয়ে এসেছে। কর্নেল সাইলো একটা মোটা আতসকাচ আর কাগজ পেনসিল নিয়ে বসেছিলেন। চাকতিটার একদিকে অপটু হাতে খোদাই করা একটা বিশাল চেহারার ময়াল সাপ আর অন্যদিকে কিছু চিহ্ন। চিহ্নগুলোকে কাগজে আঁকার পর দেখতে হল অনেকটা এইরকমঃ
“কিছু বুঝলেন, কর্নেল? আপনার তো এইসব নিয়েই কাজ ছিল, যতদূর জানি।”
“খুব একটা কঠিন কোড কিছু নয়, যতটুকু প্রথম দেখায় আন্দাজ করছি। এটা একটা পথনির্দেশ, অ্যাকর্ডিং টু রিকি, তাই তো? তাহলে ধর পথের শেষে যে রিকির সেই মহানাগকে পাওয়া যাবে, সেটা ওই সাপের ছবিটা দেখেই বোঝা যাচ্ছে। তিরচিহ্নগুলোও সেদিকেই ইন্ডিকেট করছে। মুশকিল করছে অন্য ছবিগুলো।”
“যেমন?”
“যেমন ওই চোখ। তারপর ওই ফুলের মতো জিনিসগুলো। ওগুলো যদি গাছ হয়, তাহলে একটা অর্থ হতে পারে যে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে চার চাঁদ হাঁটলে কোথাও একটা পৌঁছনো যাবে। অবশ্য ওটা চার না চল্লিশ না জাস্ট একটা অ্যাবস্ট্রাক্ট আইডিয়া সেটা বোঝার কোনও উপায় এখনও পাইনি। কিন্তু তখন যেখানে জঙ্গল ছিল ন্যচারেলি আজ সেখানে জঙ্গল থাকবে না। কাজেই তাহলে অন্য ক্লু খুঁজতে হবে।”
“অন্য ক্লু বলতে?”
“আমার মনে হচ্ছে ওই ঢেউ খেলানো রেখাদুটো নদী হতে পারে। আর ওই পিরামিডের মতো ব্যাপারটা যদি পাহাড় হয়, তাহলে জায়গাটা প্লেস করা অনেক ইজি হয়ে যায়। কিংবা ধর একটা গুহা। এখানে তো পুরোটাই পাহাড়ি এলাকা। পাহাড় কি আর ছবি এঁকে বোঝাবে? বরং গুহার মধ্যে মন্দির, এইগোছের একটা কিছু হতে পারে।”
“কীভাবে?”
“ভাবো মেজর মাথুর, ভাবো।”
“ওকে। ম্যাপ লাগবে। নদী পার হয়েই একটা পাহাড় কিংবা গুহা কিংবা মন্দির আছে, এরকম একটা জায়গা বের করতে হবে। ঠিক তো?” চেয়ারে পিঠ এলিয়ে দেন মাথুর।
“ঠিক।”
“ভেরি ইজি।” হাসতে থাকেন মেজর মাথুর। “গোটা মিজোরামটাই তো বর্ণনা করে ফেললেন কর্নেল। নদী, পাহাড়, গুহা।”
“সেই তো। স্টার্টিং পয়েন্টটা কোথায় হবে সেটাই আসল প্রশ্ন। আর সেখান থেকে কোনদিকে যেতে হবে। শুরুর ওই চোখটা কী বোঝাচ্ছে সেটা বুঝতে পারলেই…” কথা বলতে বলতে হঠাৎ থেমে যান সাইলো। মেজর মাথুরের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকেন কিছুক্ষণ।
“কী হল?”
“তোমার ছুটি কতদিনের, মাথুর?”
“দু’মাসের ছুটির দিন পনেরোই তো মাত্র খরচ হয়েছে। দেড় মাস মতন এখনও বাকি। কেন বলুন তো?”
“না, ভাবছিলাম।”
“কী?”
“যাবে,মাথুর? একটা অ্যাডভেঞ্চারে? বাড়ি বসে বসে হাঁপিয়ে যাচ্ছি। শরীরে মনে যেন জং ধরে যাচ্ছে। যাও যদি তো একটা দারুণ ব্যাপার হয় কিন্তু। যদি ধর খুঁজেই পাওয়া যায় একটা হারানো কিংবদন্তীর মন্দির, ভাবতে পারছ?”
মেজর মাথুর উত্তর দিতে তিন সেকেন্ডের বেশি সময় নেননি। “ডান। কিন্তু এগজ্যাক্টলি কোথায় যাওয়া হবে সেটাই তো জানা গেল না এখনও।”
“যাবে। একটু সময় দিতে হবে শুধু।”
“আপনি কি সত্যিই বিশ্বাস করেন যে ওখানে কোনও মন্দির আছে? সাপের মূর্তি আছে, ধনসম্পদ আছে?”
“দ্যাখো মাথুর, যেকোনও মিথ গড়ে ওঠার পেছনে একটা প্রাথমিক সত্যি থাকে, এটা তো মানবে? পাইথনের আয়ু কুড়ি থেকে তিরিশ বছর। আমি যদি পঞ্চাশ বছরও ধরে নিই, তাহলেও ওই রিকির পূর্বপুরুষদের পুজো করা সাপ কোনওভাবেই এখনও বেঁচে থাকতে পারে না, এটা ফ্যাক্ট। সাপের গায়ে মণিটণিও থাকতে পারে না। কিন্তু, সাপ নিয়ে একটা গল্প যখন কোনওভাবে তৈরি হয়েছে, ইট প্রুভস দ্যাট কখনও, কোনওসময়ে দেয়ার ওয়জ আ স্নেক। আ বিগ, হিউজ স্নেক। আমার নিজের যেটা মনে হচ্ছে, হয়তো ওই গুহায় পাইথনদের একটা নেস্টিং সাইট বা ওইগোছের কিছু ছিল। একটা পার্টিকুলার জায়গা থেকে প্রায়ই বড়ো বড়ো ময়াল সাপ বেরোতে দেখলে সেই সময়কার শিক্ষাহীন লোকজন ভয় তো পাবেই। আর ভয় থেকে ভক্তির দূরত্ব সবসময়েই খুব কম।”
পরের দু’দিন খাওয়ার সময়টুকু ছেড়ে প্রায় সারা দিনরাতই নিজের লাইব্রেরিতে কাটালেন কর্নেল সাইলো। এখানে ইন্টারনেট কানেকশন খুবই অনিশ্চিত, তবুও তারই মধ্যে ল্যাপটপ খুলেও ঘাঁটাঘাঁটি চালিয়ে গেলেন। মাথুর বিশেষ ঘাঁটাননি ভদ্রলোককে, বরং বাড়ির আশেপাশেই ছবি তোলায় মন দিয়েছিলেন। জেজেকে নিয়ে তাঁর দুশ্চিন্তা যাচ্ছিল না। তাই বেশি দূরে যাওয়ার ঝুঁকিটা আর নেননি।
দুশ্চিন্তাটা খুব অমূলকও মনে হচ্ছিল না। বেশ কয়েকবার বিনা কারণে ঝোপ থেকে পাখিরা ঝটপটিয়ে উড়ে গেছে। বেশ কয়েকবার ঘন পাতার আবরণে ঢাকা গাছের গোড়ার দিকে তাক করা মেজর মাথুরের ক্যামেরার ভিউফাইন্ডারে চকচক করে উঠেছে ধাতু বা কাচ থেকে প্রতিফলিত সূর্যের আলো। চিন্তা বাড়ছিল মাথুরের।
তিনদিনের দিন সকালে ব্রেকফাস্ট টেবিলে মুখ খুললেন সাইলো। চোখ লাল, মুখে ক্লান্তির ছাপ। কিন্তু তার সঙ্গে মিশে আছে আবিষ্কারের আনন্দ আর উত্তেজনা।
“হয়েছে।”
“হয়েছে?” মাথুর টোস্টে কামড় দেওয়া থামিয়ে সাইলোর দিকে তাকান।
“হ্যাঁ হয়েছে। পেয়েছি সন্ধান।”
“বেশ। শুনি।”
কর্নেল সাইলো ল্যাপটপটা মাথুরের দিকে ঘুরিয়ে ধরেন। “এই দেখ। কেইফাং। ইতিহাস বলছে, এই কেইফাং গ্রামেই ছিল সেই রুলচম পুক বা গুহা, যেখানে রিকির পূর্বপুরুষরা ময়াল সাপের কাছে নরবলি দিতেন। এবার এখান থেকে সোজা দক্ষিণদিকে নামো। কী পাচ্ছ?”
“নদী।”
“হ্যাঁ। টুইভল নদী। নদী পেরোলেই পাহাড়ের রিজ। আমার মন বলছে ওখানেই কোথাও আছে ওই গুহা।”
“রিকি তো বলছিল, ঘন জঙ্গল। আপনার ম্যাপে তো ব্রিজ-টিজ দেখছি।”
“সেসব ওর ঠাকুর্দার ঠাকুর্দার আমলে ছিল হয়তো। এখনও কি আর ওরকমই থাকবে? দু-চারটে গাছ পেলেই ঢের। তবে পাহাড় একেবারে ন্যাড়া তো মিজোরামে এখনও হয়নি। দেখাই যাক না। কিচ্ছু না পেলেও একটা লং ড্রাইভ তো হবে। সেটাই বা কম কী?”
কর্নেল সাইলোর প্রৌঢ় চোখজোড়া উৎসাহে চকচক করছিল।
“দ্যাখো মাথুর, আমরা এখন আছি সেলিং আর চামফাইয়ের মাঝামাঝি জায়গায়। চামফাই থেকে কেইফাং বলছে একশো পনেরো কিলোমিটারের মতো। আর সেলিং থেকে চামফাই তা প্রায় দেড়শো কিলোমিটার। তাহলে আমাদের ধর কেইফাং যেতে হলে মোটামুটি দুশো কিলোমিটারের রাস্তা। ও তিন-চার ঘন্টায় মেরে দেব, রাস্তা যতই খারাপ হোক। কী বল?”
“আর রিকির কী ব্যবস্থা করবেন?” মাথুর আস্তে জিজ্ঞেস করেন।
সাইলোর উৎসাহে হঠাৎ যেন ঠান্ডা জল পড়ে।
“তাই তো। এখানে রেখে গেলে ছেলেটা একদিনও বাঁচবে না। ওই জেজে না মেজে ওকে জাস্ট জবাই করে দেবে। কিন্তু ওই জখম হাত নিয়ে রিকি যাবেই বা কী করে আমাদের সঙ্গে!”
এ সমস্যার সমাধান অবশ্য রিকিই করে দিল। রুলপুইয়ের মন্দির খুঁজতে যাওয়া হবে তাকে ছাড়া, এমন একটা অবিশ্বাস্য কথায় সে আমলই দিল না।
“আমাকে লাগবে স্যার, আপনাদের। নইলে হয়তো মন্দির দেখেও চিনতে পারবেন না। আর মাথুরস্যর তো এদিকের ভাষাও বোঝেন না। আমাকে যেতেই হবে আপনাদের সঙ্গে। আমার হাত তো অনেক সেরে গেছে এখন। আন্টির কাছ থেকে ওষুধ নিয়ে যাব না হয়। আর হ্যাঁ, ওই চোখটার মানে রুইপুলের গুহা, যেখান থেকে ঈশ্বর তাঁর প্রজাদের উপর নজর রাখতেন। ওইটুকু আমরা সবাই জানি।”
।।ছয়।।
বড়ো রাস্তার ধারে প্রচুর ঘরবাড়ি, আর তারই একপাশে ন্যাড়া মাঠের মধ্যে একটা ছোটো সুড়ঙ্গের মুখ। বেশ হতাশ হয়ে রিকির দিকে তাকালেন মেজর মাথুর।
“কী হে, এই তোমাদের রুল চম পুক? এই সেই ভয়ংকর রুলপুইয়ের গুহা? তুমি না বলেছিলে জঙ্গলে একেবারে ঘেরা জায়গা, কেউ কাছেও যেতে পারে না এমনই ঘন জঙ্গল। এ তো দেখছি জাস্ট রাস্তার ধারে একটা গর্ত।”
রিকিও একটু অপ্রতিভ হয়ে পড়েছিল। তবে দ্রুত সামলেও নিল।
“আমি তো কোনওদিন নিজের চোখে দেখিনি স্যর, শুধু বাড়ির বুড়োদের কাছে গল্প শুনেছি। তাদের সময় হয়তো ওইরকমই ছিল। কী করে বলব বলুন।”
“তোমার নাগদেবতার গল্পটাও এরকম কিছুই নয় তো?”
রিকি উত্তর দিল না। সে তখন গভীর মনোযোগে জানালা দিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখছিল।
কেইফাং পর্যন্ত রাস্তা বেশ ভালোই পাওয়া গিয়েছিল। তারপর একটু অসুবিধে শুরু হল। যত দক্ষিণে নামা যায় ততই রাস্তা পাকা ছেড়ে শক্ত পেটানো লালমাটির হতে থাকে। এমনিতে অসুবিধে ছিল না, কিন্তু গাড়ির চাকার সঙ্গে ঘষা খেয়ে যে ধুলোর ছোটোখাটো ঝড়টা উঠছিল সেটাই সবার নাকেচোখে ঢুকে বড্ড ব্যতিব্যস্ত করে দিচ্ছিল।
মাথুর বেশ কিছুক্ষণ ধরেই পিছনদিকে কিছু একটা মন দিয়ে লক্ষ করছিলেন। এবার মুখ খুললেন।
“কর্নেল সাইলো, কিছু দেখছেন?”
“অনেকক্ষণ ধরেই।” গাড়ি চালাতে চালাতেই জবাব দেন সাইলো। আয়নায় তাঁর সঙ্গে মাথুরের চোখাচোখি হয়।
“কী, কী হয়েছে? কী দেখছেন আপনারা?” রিকি ধড়ফড় করে ওঠে।
“তেমন কিছু না। তোমার অত উতলা হওয়ার মতো কিছু হয়নি।” মাথুর বলেন।
“তবুও, কী বললেন বুঝিয়ে বলুন।”
“আসলে অনেকক্ষণ ধরে দেখছি দুটো বাইক আমাদের ফলো করে আসছে। তাই ভাবছিলাম।”
“বাইক?” রিকির গলা দিয়ে তিন-চারটে সুর বেরোয়। “কিন্তু, আমাদেরই ফলো করছে কী করে জানলেন?”
“জানি না। মনে হচ্ছে। একই দূরত্বে আসছে। এগোচ্ছেও না, পিছোচ্ছেও না। সুযোগ পেলেও ওভারটেক করছে না। তাই ভাবছি, কে হতে পারে।” মাথুর ইচ্ছে করেই খুব হালকা চালে উত্তর দেন।
“জেজে। আমি জানি। এ জেজে ছাড়া কেউ নয়। আমায় খতম করতে আসছে।” দু’হাতে মুখ ঢেকে ফেলে রিকি।
“অত উতলা হয়ো না। দেখাই যাক না।” সাইলোর গলায় বিন্দুমাত্র উত্তেজনা নেই।
অভিযানের পরিকল্পনা চূড়ান্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সাইলো যেন একেবারে পালটে গেছেন। কিংবা হয়তো ওপরের খোলসটা ছেড়ে আসল মানুষটা বেরিয়ে এসেছে। এই কর্নেল সাইলো যেকোনও অবস্থাতেই বরফের মতো ঠান্ডা, শান দেওয়া ইস্পাতের মতো ধারালো। যেকোনও সময়ে যেকোনও পরিস্থিতির জন্য তৈরি।
যাত্রা শুরুর আগে গাড়িতে কিছু এমন জিনিস তুলছিলেন সাইলো, যেগুলো দেখে মাথুরের ভুরু আপনিই উঠে গিয়েছিল। অবশ্য মাথুর ওই ভুরু তোলাটুকু ছাড়া আর কিচ্ছু করেননি। রিকি অবশ্য কৌতূহল চাপতে পারেনি, প্রশ্ন করেই ফেলেছিল। উত্তরে খুব আবছা হেসে একটা অদ্ভুত কথা বলেছিলেন সাইলো।
“তুমি কি ভাবো তোমার একারই গ্যাং আছে?”
সাইলোর গাড়ি থেকেই এখন একে একে নামছিল ভাঁজ করা তাঁবু, স্লিপিং ব্যাগ, স্টোভ, আরও টুকটাক কত কী। রিকি প্রথমে হাঁ করে তাকিয়েছিল, তারপর সেও মাল খালাসে হাত লাগিয়েছে।
চোখে দেখে যতটুকু বোঝা যাচ্ছিল, গাড়ি যাওয়ার মতো রাস্তা এখানেই শেষ। এখান থেকে ধাপে ধাপে জুমচাষের ক্ষেত বুকে নিয়ে ঘন সবুজ পাহাড় নেমে গেছে নদীর পাড় পর্যন্ত। তারই মাঝে মাঝে পায়ে চলা পথের রেখা। ঘনিয়ে আসা সন্ধের আলোছায়ায় অদ্ভুত সুন্দর লাগছিল চারদিকটা।
“আজ রাতের মতো এখানেই ক্যাম্প হোক। কাল সকালে নিচে নামা যাবে। গাড়ি বোধহয় আর যাবে না।” কর্নেল সাইলো ঘোষণা করলেন।
“তাহলে কী করবেন? গাড়িটা রাখবেন কোথায়?” মাথুর বেশ অবাক হয়েই প্রশ্নটা করলেন।
“এখানেই। সকালে দেখব আশেপাশে যদি গ্রামের লোকটোক কাউকে পাই। বলে যাব নজর রাখতে। মিজোরামে এখনও সেই ভরসাটুকু করা যায়।”
মাথুর একটু দূরে দাঁড়িয়ে বাইকদুটোর আওয়াজ শুনতে চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু ক্রমশ গাঢ় হয়ে আসা অন্ধকারে কিছু দলছুট পাখির ডাক, জংলি ঝিঁঝিঁপোকার তীক্ষ্ণ শিসের মতো শব্দ, হাওয়ার শনশন আর গাছপাতার স্বাভাবিক খসখসানি ছাড়া আর কিছুই তাঁর কানে আসছিল না। নিজেকে বিশ্বাস করাতে চেষ্টা করেন, হয়তো মিথ্যেই ভয় পাচ্ছিলেন। হয়তো বাইক আরোহীরা এমনিই ওই রাস্তার যাত্রী ছিল।
রিকির ডাক শুনে পেছন ফিরলেন মেজর মাথুর। অবাক না হওয়াই উচিত ছিল, তবুও অবাক হয়ে দেখলেন সমতল জমিটুকুতে টেন্ট লেগে গেছে, সৌরলণ্ঠন জ্বলছে, মায় সাইলো স্টোভ ধরিয়ে নুডলস বানিয়েও ফেলেছেন এর মধ্যে।
টেন্টটাতে দু’জনের বেশি শোওয়ার মতো জায়গা নেই, এটা একটা সমস্যা। সাইলো অবশ্য সমস্যা বলে ব্যাপারটাকে মানতেই রাজি নন।
“মেজর আর রিকি টেন্টে শোবেন, আমি স্লিপিং ব্যাগ নিয়ে বাইরে শুয়ে পড়ছি। রাতটা কাটানো নিয়ে তো কথা।” ধোঁয়া ওঠা নুডলস মুখে চালান করতে করতে বলেন কর্নেল সাইলো।
মাথুর তাও খুঁতখুঁত করছিলেন। “একেবারে এভাবে বাইরে শোবেন? জন্তুজানোয়ারও তো আসতে পারে।”
“কাম অন মেজর মাথুর, উই আর সোলজার্স। এ তো আমাদের ডালভাত। অন্তত তোমাকে এসব বোঝানোর দরকার হবে ভাবিনি। শুয়ে পড়। কাল নদী পার হওয়ার ব্যবস্থা দেখতে হবে।”
।।সাত।।
সকালে তাঁবু থেকে বেরিয়েই দু’জোড়া অবাক চোখের মুখোমুখি হতে হল। একজন পুরুষ আর একজন নারী। মুখের কোঁচকানো চামড়া দেখে আসল বয়স আন্দাজ করার কোনও উপায়ই নেই, তবে নেহাত কচিও নয়। দু’জনেরই পরনে পুরো এ দেশীয় পোষাক, পিঠে বাঁধা বেতে বোনা ঝুড়ি থেকে খুরপি নিড়ানি আরও কী কী সব উঁকি দিচ্ছে।
মাথুরের পেছন পেছন রিকিও বেরিয়ে এসেছিল। তাকে দেখে দু’জনেই উত্তেজিত হয়ে একসঙ্গে কিছু বলতে আরম্ভ করেছিল। মাথুর হাত তুলে থামালেন। তাঁর দু’চোখ সাইলোকে খুঁজছিল, কিন্তু সাইলোর কোনও চিহ্নই দেখতে পাওয়া যাচ্ছিল না। অনেক আগেই উঠে পড়েছেন বোঝাই যাচ্ছিল অবশ্য। কারণ, স্লিপিং ব্যাগ পরিপাটি গুটিয়ে ছোট্টটি করে টেন্টের মধ্যে রাখা। কখন রেখে গেছেন মাথুর টেরই পাননি। নিজেই লজ্জা পেলেন মেজর মাথুর। যতই ক্লান্তি থাক শরীরে, সৈনিকের ঘুম এত গাঢ় হলে মুশকিল।
“রিকি, তুমি বোঝো এদের ভাষা?”
“কিছুটা বুঝি স্যর।”
“দ্যাখো তো কথা বলে, কারা এরা, কোথা থেকে এল।”
রিকি নিজেদের ভাষায় কিছু প্রশ্ন করল পুরুষটিকে। উত্তরে অনেকক্ষণ ধরে অনেক হাত-টাত নেড়ে কিছু বলল লোকটি। মাঝে মাঝে মহিলাও যোগ দিচ্ছিলেন। বেশ কিছুক্ষণ ধরে উভয়পক্ষের এই অবোধ্য বার্তালাপ চলার পর মাথুর ধৈর্য হারালেন।
“কী ব্যাপার আমাকেও তো একটু বল।”
“সরি স্যর।” রিকি লজ্জা পেয়ে ওঁর দিকে ফেরে। “ইনি হলেন রোথুয়ামা, আর সঙ্গের ওই উনি এঁর স্ত্রী। নিচে নদীর কাছ পর্যন্ত এঁদের জুমচাষের ক্ষেত আছে। আর এখান থেকে বেশ একটু দূরে এঁদের বাড়ি। রোজ এই পথ দিয়ে সকালে ক্ষেতে যান আর বিকেলে ফেরেন। কাল যখন ফিরেছেন তখনও এখানে কাউকে দেখেননি, আজ হঠাৎ আমাদের তাঁবু-টাঁবু দেখে অবাক হয়ে গিয়েছেন।”
“জিজ্ঞাসা কর দেখি নদী পেরিয়ে ওপারে যাওয়ার কোনও উপায় এঁদের জানা আছে নাকি।”
হঠাৎ কর্নেল সাইলোর গলা শুনে চমকে ওঠে সকলে। মাথুর বুঝতেই পারেননি কখন কোথা দিয়ে সাইলো নিঃশব্দে তাঁদের পেছনে এসে দাঁড়িয়েছেন। কিছু বলতে গিয়েও সাইলোর চোখের ইশারায় থেমে যান মাথুর।
“আমি জিজ্ঞেস করব? কিন্তু আপনি নিজেই তো বলতে পারেন।”
“তুমিই কর না হে। আমি অত ভালো বুঝি না এদিকের ভাষা।”
আবারও মাথুরকে হালকা ইঙ্গিত করে কিছু বোঝাতে চেষ্টা করেন সাইলো। মাথুরের বুঝতে অসুবিধে হয় না যে সাইলো এদের জানাতে চাইছেন না যে তিনি স্থানীয় ভাষাটা বোঝেন।
রিকি আবারও অনেকক্ষণ ধরে দু’জনের সঙ্গেই কথা বলতে থাকে। তারপর এদিকে ফেরে।
“নদীর ধার ধরে বাঁদিকে কিছুদূর গেলে অনেক সময় নৌকো নিয়ে একজন বসে থাকে। রোজ থাকে না। কপালে থাকলে তাকে পাওয়া যাবে। আধপাগল লোক। ইচ্ছে হলে পার করায়, ইচ্ছে না হলে যায় না। তার সাথে কথা বলতে হবে। কত নেবে, কী নেবে এঁরা জানেন না। এঁরা কোনওদিন ওইপারে যাননি। খুব কম লোকই যায়।”
“বেশ। তাই যাওয়া যাক তাহলে। এঁদের বল আমাদের গাড়িটা এখানেই থাকবে। আমরা ক’দিনের জন্য ওপারটা একটু বেড়াতে যাব। ওঁরা রোজ এই পথ দিয়ে যাওয়া আসার পথে গাড়িটায় নজর রাখলেই হবে। চল হে মাথুর, লাগেজপত্তর প্যাক করে ফেলি।”
“কোথায় হাওয়া হয়ে গিয়েছিলেন সকাল সকাল? চিন্তায় পড়ে যাচ্ছিলাম তো!”
“এই একটু দেখে এলাম এদিক ওদিক।”
সাইলো এড়িয়ে যাচ্ছেন বুঝে আর কথা বাড়ান না মাথুর।
তিনটে বড়ো বড়ো ব্যাকপ্যাকে টেন্ট স্লিপিং ব্যাগ ইত্যাদি সব ঢুকিয়ে ফেলা হল। আরও কিছু কিছু জিনিসপত্রও ব্যাগবন্দি হল, যার কিছু কিছু মাথুরের চেনা, কিছু আবার একেবারেই অচেনা। ভারী বস্তাগুলো পিঠে বেঁধে এক এক করে ওঁরা তিনজন নামতে শুরু করলেন।
রোথুয়ামার দেখিয়ে দেওয়া পথে গিয়ে নৌকোওয়ালাকে ঠিকই পাওয়া গেল। তবে যে অবস্থায় পাওয়া গেল সেটা এঁরা কেউই আশা করেননি। মানে ধরে নেওয়া হল যে সে-ই নৌকাওয়ালা। কোনও প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার অবস্থায় তো সে ছিল না। নৌকোর চিহ্নমাত্রও অবশ্য কোথাও দেখতে পাওয়া গেল না।
সাইলো পিঠ থেকে ভারী বোঝাটা নামিয়ে ফেলেছেন ততক্ষণে। পাড়ের কাছে কাদাজলে অর্ধেক ডুবে থাকা শরীরটাকে আস্তে আস্তে ডাঙায় টেনে তোলার চেষ্টা করছিলেন। রিকি একবার দেখেই ধপ করে বসে পড়েছিল। থরথর করে কাঁপছিল তার শরীরটা।
মেজর মাথুরও ব্যাকপ্যাকটা খুলে মাটিতে রাখলেন। তাঁর মাথার ভেতরে অনেকগুলো প্রশ্ন রাগি বোলতার মতো ভোঁ ভোঁ করে ঘুরছিল। সাইলো ফুলে ওঠা দেহটাকে চিৎ করে শুইয়ে দিয়েছিলেন জল থেকে কিছুটা ওপরে। মুখটার দিকে একবার তাকিয়েই দৃষ্টি সরিয়ে নেন মাথুর। সারারাত ধরে নদীর মাছেরা বিশেষ কিছু অবশিষ্ট রাখেনি আর। তবে বুকের বাঁদিকে গর্তটা যে মাছেদের কীর্তি নয়, সেটা বলাই বাহুল্য। আর বাঁদিকের কপাল-গালজোড়া থ্যাঁতলানো এলাকাটাও নয়। মাছেদের খোবলানোর পরেও যেটা বেশ বোঝা যাচ্ছে।
“সম্ভবত ওপারে নিয়ে যেতে রাজি হয়নি।” কর্নেল সাইলো বিড়বিড় করেন।
“ফিরে চলুন। প্লিজ, ফিরে চলুন। ওরা শয়তান।” রিকি হঠাৎ লাফিয়ে উঠল। তার ফ্যাকাশে মুখ ঘামে ভিজে গেছে, চোখে ভূতে পাওয়া চাউনি।
“কাউকে ছাড়বে না ওরা, কাউকে না। কেন এলাম আমি আপনাদের সঙ্গে, কেন এলাম? ওখানে থাকলেই বেঁচে যেতাম। এখানে কেউ বাঁচাতে পারবে না, কেউ না। আমি যাব না, কিছুতেই ওপারে যাব না আমি। রুলপুই আমাকে বাঁচতে দেবে না, দেবে না বাঁচতে। আপনারা না ফিরলে না ফিরুন, আমি চললাম।”
হাঁচড়পাঁচড় করে পাহাড়ের গা বেয়ে ওপরের দিকে দৌড়তে শুরু করে রিকি। মাথুরও ধড়মড় করে উঠছিলেন ওকে ফিরিয়ে আনতে, সাইলো হাত তুলে থামালেন।
“যেতে দাও। ভয় পেয়ে আছে, তোমার কথা শুনবে না। মাথা ঠান্ডা হলে নিজেই ফিরে আসবে। আসতেই হবে। আমাদের একটু অপেক্ষা করতে হবে, এই আর কী।”
“কিন্তু এখন ওপারে যাওয়ার কী উপায় হবে কিছু ভাবলেন?”
সাইলো সঙ্গে সঙ্গেই কিছু বলেন না। ছোটো ছোটো চোখে হাসি চিকচিক করে। “জাঙ্গল সারভাইভাল কোর্স মনে আছে, মেজর মাথুর?”
“ওহ্ ইয়েস!” মাথুর লাফিয়ে ওঠেন প্রায়।
“যা আশেপাশে পাবে তাই কাজে লাগাবে, এটাই শিখেছিলাম তো আমরা? আশেপাশে সবথেকে বেশি কী চোখে পড়ছে বল তো?”
“বাঁশ। লটস অ্যান্ড লটস অফ ব্যাম্বু গ্রোভস।”
“রাইট ইউ আর মেজর, রাইট ইউ আর। সো, আর দেরি কেন? চল তবে। ভেলা বানাতে হবে তো একটা। তবে তার আগে আর একটা কাজ।”
মাথুর প্রথমে বোঝেননি সাইলো কী করছেন। নদীর জল সবথেকে বেশি যতটা ওঠে, কাদার ওপর সেই দাগ ছাড়িয়ে আরও একটু উঁচুতে উঠে যাচ্ছিলেন সাইলো। হাতে একটা লোহার রড, যার মুখটা চ্যাপটা কিন্তু ধারালো। অনেকটা শাবলের মতো। এতক্ষণ এটাকে ট্রেকিং স্টিকের মতো ব্যবহার করে হাঁটছিলেন সাইলো। মাথুর খেয়ালই করেননি যে ওটার মুখটা ওরকম।
মাটি খুঁড়ছিলেন সাইলো, একটা আয়তক্ষেত্রের আকারে।
।।আট।।
খুব গভীর কবর খোঁড়া সম্ভব হল না। সময় বা উপযুক্ত যন্ত্রপাতি দুটোরই অভাব। তবুও ওরই মধ্যে ক্ষতবিক্ষত শরীরটাকে যথাসম্ভব যত্ন করে শুইয়ে দিয়েছিলেন ওঁরা দু’জনে মিলে। শক্ত চোয়ালে নিজের ভাষায় কিছু বিড়বিড় করতে করতে কবরে মাটি ফেলছিলেনে কর্নেল সাইলো। মাথুরও ফেললেন কয়েক মুঠো। আত্মীয় পরিজনদের থেকে দূরে, সকলের চোখের আড়ালে শুধু নিজের কাজটুকু মন দিয়ে করে যাওয়া এক অনামী মানুষ এভাবেই শুয়ে রইল চিরকালের জন্য।
“চেষ্টা কোরো হলুদ পাকা বাঁশ কাটতে। কাঁচা বাঁশের ভেলায় বেশি দূর যাওযা যাবে না, ডুবে যাবে।” নিজের ব্যাকপ্যাক থেকে ধারালো দা বার করতে করতে বলেছিলেন সাইলো।
কাজটা যে এত সময় নেবে আন্দাজ করতে পারেননি মাথুর। তাঁর নিয়মিত ভারী ব্যায়াম করা শরীর বেয়েও দরদর করে ঘাম গড়াচ্ছিল। যাই হোক, কাটাকাটি শেষ হয়েছে শেষপর্যন্ত। দরকারমতো বাঁশও জোগাড় করা গিয়েছে। দুটো প্রায় চোদ্দ ফুটের মতো লম্বা বাঁশ নদীর পাড়ে পাশাপাশি শোওয়ানো আছে এখন, মাঝখানে ফুট আষ্টেকের মতো ফাঁক নিয়ে।
আড়াআড়ি বাঁশ পেতে মাঝের ফাঁকটা ভরছিলেন কর্নেল সাইলো। কী একটা সাংঘাতিক শক্ত লতা কেটে এনেছেন, সেটা দিয়েই একটার সঙ্গে আর একটা বাঁশের বাঁধন দেওয়া হচ্ছিল। দুটো আড়াআড়ি বাঁশ, একটু ফাঁক, আবার চারটে বাঁশ, একটু ফাঁক, আবার চারটে, তারপর দুটো। ফুরিয়ে আসা দিনের হালকা বেগুনি আলোয় এইভাবে একটা ছক মেনে ভেলাটা আস্তে আস্তে মেজর মাথুরের চোখের সামনে তৈরি হয়ে উঠছিল।
“আজ রাতে আর রিভার ক্রসিংয়ের রিস্ক নেব না।” লতার ফাঁসের দৃঢ়তা টেনে পরীক্ষা করতে করতে সাইলো মন্তব্য করেন।
“তাহলে টেন্ট লাগিয়ে ফেলি?”
“সেই ভালো। কাল সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই জলে নেমে পড়ব।”
হঠাৎ খচমচ আওয়াজ শুনে চমকে পিছনে তাকালেন মাথুর। “ওহ। তুমি। ফিরে এলে যে?”
“কী করব? গাড়ির চাবি আপনাদের কাছে। পায়ে হেঁটে আর কতদূর যাব? মরতে যখন হবেই, এক সঙ্গেই মরি।” গোঁজ হয়ে জবাব দেয় রিকি। তার চেহারা ক্লান্ত, বিধ্বস্ত।
“মরা-টরার কথা পরে ভাবা যাবে, এখন চটপট খেয়ে নিয়ে শুয়ে পড় দেখি। কাল ভোরে রিভার র্যাফটিং।”
কর্নেল সাইলোর এই ঘোষণা শোনার পর দুর্দান্ত রুলপুই গ্যাংয়ের মেম্বার রিকির চেহারাটা দেখে পেটের ভেতর থেকে উপছে আসতে চাওয়া হাসিটাকে যে কী কষ্ট করে গিলতে হল তা কেবল মাথুরই জানেন।
ভেলাটা দেখে যত পলকা মনে হচ্ছিল কাজের বেলায় দেখা গেল সত্যি সত্যি ততটা নয়। একটু নড়বড় করলেও মোটামুটি ঠিকঠাকই ভেসে ছিল জলের ওপর। তিনজন মানুষ আর তাদের মালপত্রকে অবশ্য অনেক হিসেব করে ভেলার ওপর বসাতে হয়েছিল, যাতে কোনও একদিকে ওজন বেশি না হয়ে যায়। দুটো লম্বা বাঁশের সাহায্যে সাইলো আর মাথুর সাবধানে টলমলে জিনিসটাকে এপার থেকে ওপারে একটু ডানদিকে কোনাকুনি বেয়ে নিয়ে চলেছিলেন। যাতে মোটামুটি যেখানে তাঁরা নেমেছিলেন অন্তত তার কিছুটা সমান্তরালে ওইদিকে ওঠা যায়। ভেলার ঠিক মধ্যিখানটায় পাথরের মূর্তির মতো স্থির হয়ে বসে ছিল রিকি।
ছেড়ে আসা পাড়ের তুলনায় এই পাড়ে পাথুরে ভাব যেন একটু বেশি। লালচে কাঁকর মাটির সঙ্গে বালির মিশেল। জঙ্গলও বেশি। আর, কেমন যেন শুনশান ভাব। ওদিকে যেমন প্রায় নদীর কিনার থেকেই ধাপে ধাপে জুম উঠে গেছে, এদিকে সেসব কিচ্ছু নেই। জঙ্গলের ধরন দেখলেই বোঝা যায়, মানুষের পা এদিকে কমই পড়ে।
পাড়ের কাছাকাছি হতে হতেই একটা জিনিস সকলেরই চোখে পড়ল। দেশি ডিঙি নৌকো একখানা। আধখানা ডাঙায় আর আধখানা জলে। বোঝাই যাচ্ছে এটাতে চড়েই এপারে এসেছে সেই তারা, যাদের পরিচয় মোটামুটি আন্দাজ করা গেলেও চেহারা এখনও অদেখা।
ভেলা পাড়ের সঙ্গে ঠেকার আগেই একটা বিপর্যয় হতে যাচ্ছিল প্রায়। পাথর হয়ে বসে থাকা রিকি ডাঙার দেখা পেয়ে আর নিজেকে সংযত করতে পারেনি। একটা বিরাট লাফ এবং তার প্রতিক্রিয়ায় বাঁশের ভেলা প্রায় ডুবন্ত। কোনওরকমে সাইলো আর মাথুর প্রাণপণ চেষ্টায় আবার তাকে ঠিক পথে এনে কূলে ভেড়ালেন।
“এই ছেলেমানুষির ফল কী হতে পারত তুমি জান?” রাগে মাথুরের চোখমুখ গনগন করছিল।
“আহ্, মাথুর। ভুল করে ফেলেছে। ছেড়ে দাও। এখন এসবের সময় নেই। এস, হাতে হাতে আনলোড করে ফেলি। সামনে মস্ত কাজ।” সাইলো যথারীতি হিমশীতল।
ভেলা থেকে সব জিনিস নামানোর পর সেটাকে টেনে হিঁচড়ে নদীর পাড় থেকে অনেকটা উঁচুতে নিয়ে যাওয়া হল। রিকিকে দেখেই বোঝা যাচ্ছিল এই খাটুনিতে হাত লাগানোর বিশেষ ইচ্ছে নেই, তাছাড়া তার কাঁধেও চোট। সাইলো তাই তাকে অব্যাহতি দিয়েছেন। তবে তার প্রশ্ন করা থামেনি।
“ওটা অত উঁচুতে তুললেন কেন?”
“ফিরে যাবে না ওপারে? কীসে করে যাবে রিকি? নৌকোটায় যদি ওরা থাকে?”
“ওহ।”
ভেলাটা তোলার পরে কিন্তু নৌকোটাকেও ঠেলেঠুলে তোলা হল। শুধু তোলাই নয়, যেখানে ছিল তার সম্পূর্ণ অন্যদিকে জঙ্গলের মধ্যে লুকিয়ে রাখা হল। এবার রিকি প্রশ্ন না করলেও সাইলো নিজেই কারণটা বলে দিলেন।
“যাতে পালাবার তাড়া থাকলে ওদের আগে আমরা নৌকোটা খুঁজে পাই।”
কর্নেল সাইলোর ব্যাকপ্যাকটা থেকে এবার যে জিনিসটা বেরোল সেরকম জিনিস মেজর মাথুর এর আগে দেখেননি।
“ওটা কী, স্যার?” আবার রিকি।
“এটা? এটাই তো আসল। তোমার মহানাগের গুহার সন্ধান পাওয়ার যন্ত্র।”
একটা চৌকো বাক্সমতো জিনিস, তার গায়ে কিছু ডায়াল আর বোতাম। চারটে ইলেকট্রিক কেবলও রয়েছে, যেগুলোকে সাইলো টেনে লম্বা করছিলেন। প্রত্যেকটার শেষ মাথায় একটা করে ইলেকট্রোড। পা মেপে মেপে কম্পাসের চারটে পয়েন্টে এক এক করে প্রত্যেকটাকে মাটিতে পুঁতে দেওয়ায় যে বর্গক্ষেত্রটা তৈরি হল তার মাপ মোটামুটি আটশো বর্গমিটারের মতো হবে।
“এইভাবে খুঁজতে খুঁজতে যেতে হবে, বুঝলে মিস্টার রিকি দার্নেই? মেশিন বলে দেবে মাটির তলায় রেজিস্ট্যান্স কোথায় বেশি, কোথায় কম। তোমাদের রূপকথায় যদি এক ছটাকও সত্যি থাকে, আর যদি আমি ওই কোডেড ডিরেকশন পড়তে ভুল করে না থাকি, তাহলে এইখানেই কোথাও পাওয়া যাবে সেই গুহা।”
“কিন্তু এরকম করে ক’দিন ধরে খুঁজবেন, স্যর? অনেক সময় লাগবে তো!”
“উঁহু। বললাম তো। কোড যদি ঠিক পড়ে থাকি তাহলে এই এলাকাতেই হবে তোমার মহানাগের গুহা। খুব বেশি খোঁজাখুঁজি করতে হবে বলে মনে হচ্ছে না।”
“আমাকে কিন্তু একটা জিনিস ভাবাচ্ছে, কর্নেল সাইলো।” মাথুর আস্তে বলেন।
“জানি। ওরা এক্ষুনি কিছু করবে না। আমার ধারণা, গুহার রহস্য উদ্ধার না হওয়া পর্যন্ত দেখাও দেবে না। তবুও, চোখকান খোলা রেখো।”
ভদ্রলোকের স্নায়ুর জোরের প্রশংসা করতে হয়, মনে মনে ভাবলেন মাথুর।
।।নয়।।
সময় কিন্তু লাগল। একটা গোটা দিন ধরে খুঁজেও মাটির নিচে কোনও গহ্বরের চিহ্নই পাওয়া গেল না। রিকি নেহাত সাহস পাচ্ছিল না খোলাখুলি কিছু বলতে, তবে তার মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছিল সে এই পুরো ব্যাপারটাকে একটা ছেলেমানুষি সময় নষ্ট ছাড়া আর কিছুই ভাবছে না।
দ্বিতীয় দিনটাও খুব একটা আশাব্যঞ্জকভাবে এগোচ্ছিল না। সেই ভোর থেকে পাথুরে, জঙ্গুলে জমি স্ক্যান করতে শুরু করেছিলেন কর্নেল সাইলো। বেলা দশটার কাছাকাছি পৌঁছেও যন্ত্র কিছুই বলছিল না।
ভেজা ভেজা চাপা গরমে বেশ কষ্টই হচ্ছিল। মেজর মাথুর জলের বোতলের মুখ খুলে গলায় ঢালার জন্য মাথাটা সবে পেছনে হেলিয়েছিলেন, সাইলোর চাপা গলার ডাক তাঁকে আবার সোজা করে দিল।
“হিয়ার, মাথুর। সি দিস।”
বোতলটা সাবধানে বন্ধ করলেন মাথুর। জল পরে খেলেও চলবে। অনভ্যস্ত চোখেও মাথুর দেখে বুঝতে পারছিলেন সাইলোর যন্ত্রের ডিসপ্লে স্ক্রিন কিছু একটা দেখাচ্ছে।
“এই দ্যাখো। এখানে মাটির তলায় বড়ো ক্যাভিটি রয়েছে। কোয়াইট বিগ। আমি ক্রসচেক করেছি দু-তিনবার। তারপরেই তোমাকে ডেকেছি। সি হিয়ার। তিনটে দিক বন্ধ, কিন্তু একটা দিক কীভাবে এগিয়ে যাচ্ছে বুঝতে পারছ? লাইক আ টানেল? মনে হয় ওই সুড়ঙ্গটাই গিয়ে বাইরের দিকে গুহার মুখ হয়েছে।”
রিকি এতক্ষণ উদাস হয়ে এদিক ওদিক দেখছিল। এখন হঠাৎ তার মধ্যে উত্তেজনার ছোঁয়াচ লাগে।
“পেয়েছেন, স্যর? পাওয়া গেছে? এটাই তো?”
“এটাই কি না জানি না, তবে কিছু একটা যে পেয়েছি তাতে সন্দেহ নেই। এবার এতে ঢোকার মুখটা খুঁজে পেলেই বোঝা যাবে ঠিক কী পাওয়া গেল।”
সেই পর্যন্ত পৌঁছতে আরও আধবেলা গেল। মাটির নিচের সুড়ঙ্গ সোজা নয়, তাই ওপরের পথের যাত্রীদেরও মাঝেমধ্যেই বাঁক নিতে হচ্ছিল। জঙ্গল এখানে বেশ ঘন। অনেক সময়েই দা কাটারি চালিয়ে চলার রাস্তা বের করার দরকার পড়ছিল। কর্নেল সাইলোর যন্ত্রের ইলেকট্রোড গাঁথার জন্য ফাঁকা জমি পেতেও দস্তুরমতো পরিশ্রম করতে হচ্ছিল। কাঁটা-ঝোপ ভেদ করে চলতে চলতে সকলেরই হাত পা ভালোমতে ছড়েছে। পিঠের ব্যাগগুলোর ওজন মনে হচ্ছিল প্রতি পদক্ষেপে দশ কিলো করে বেড়ে যাচ্ছে।
মাথুর খুব সজাগ হয়ে চলছিলেন। শপথ করে বলতে পারবেন না, কিন্তু অন্তত দু’বার তাঁর মনে হয়েছে ঘন গাছপালার আলোছায়ার আড়ালে দ্রুত সরে যাওয়া মানুষের শরীরের আভাস পেয়েছে তাঁর চোখ।
খুব হালকা সিগারেটের গন্ধও যেন একবার হাওয়ায় ভেসে এসেছে তাঁর নাকে। রিকি কতদূর কী টের পেয়েছে মাথুর জানেন না, কিন্তু সাইলো যে গন্ধটা পেয়েছেন সে ব্যাপারে মেজর মাথুর একশোভাগ নিশ্চিত। সাইলোর শরীরের ভাষা, পা ফেলার ধরন, সব কিছুতেই শিকারি বেড়ালের সতর্কতা ফুটে বেরোচ্ছিল।
এমনিতেই খুব একটা দ্রুত চলা যাচ্ছিল না। এখন সাইলো এগোনোর বেগ আরওই কমিয়ে এনেছিলেন। খুব সন্তর্পণে, পা মেপে মেপে চলছিলেন তিনি। স্ক্যানার এখন মোটামুটি সোজা রাস্তাই দেখাচ্ছিল। একবার যন্ত্র বসালে বেশ অনেকটাই এগিয়ে যাওয়া যাচ্ছিল। তবু সাইলো একেবারেই তাড়াহুড়ো করছিলেন না।
মোটামুটি একটা লাইন ধরে হাঁটছিলেন ওঁরা তিনজন। লাইনের একদম মাথায় কর্নেল সাইলো, কিছুটা দূরত্বে মাঝামাঝি জায়গায় রিকি, আর একেবারে সবার শেষে মেজর মাথুর। মাথুর খেয়াল করছিলেন, রিকির পা টেনে টেনে চলায় চলায় ক্লান্তি আর অনিচ্ছা স্পষ্ট। মনে মনে প্রমাদ গুনছিলেন মাথুর।
তাঁর আশঙ্কা সত্যি হতে সময় লাগল না। অনেকক্ষণ ধরেই নিজের মনে গজগজ করছিল রিকি। হঠাৎ তার অসন্তোষ একেবারে বাঁধ ভেঙে ফেটে পড়ল।
“আমি আর এক পাও যাব না। আপনাদের যেখানে যেতে ইচ্ছে হয় যান। সেই কখন থেকে হাঁটছি তো হাঁটছিই। পিঠে দেড়মণি একটা বস্তা তুলে দেওয়ার আগে একটু ভাবলেনও না যে আমার অত বড়ো চোটটা এখনও পুরোপুরি ভালো হয়নি! ব্যথায় আমার কাঁধ ছিঁড়ে যাচ্ছে, জোঁকে সারা শরীরের রক্ত চুষে নিল, আপনাদের কোনও ভ্রূক্ষেপই নেই। যাব না আমি, কোত্থাও যাব না। কী কুক্ষণে আপনাদের কাছে রুলপুইয়ের গল্প করেছিলাম। তফাত নেই, কোনও তফাত নেই। জেজে আর আপনাদের মধ্যে কোনও তফাত নেই। যান, আপনারাই যান ওই গুহার খোঁজে, আমি যাব না। যাব না, যাব না, যাব না।”
শেষ না-টা বলার সঙ্গে সঙ্গে সামনের ঝাঁপালো ঝোপটায় একটা সজোর লাথি ঠোকে রিকি এবং কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই মুহূর্তের মধ্যে পিঠের বোঝা, হাতের লাঠি, গলার জলের বোতল সবসুদ্ধু দু’জোড়া হতভম্ব চোখের সামনে থেকে বেমালুম অদৃশ্য হয়ে যায়।
।।দশ।।
ঘটনাটা এত দ্রুত এবং এত আচমকা ঘটল যে একেবারে হকচকিয়ে গিয়েছিলেন। একটু এগিয়ে যাওয়া সাইলো বড়ো বড়ো পা ফেলে দৌড়ে এলেন।
“কী হল বল তো ব্যাপারটা?”
“বুঝতেই পারলাম না তো।” মেজর মাথুর এখনও বিস্ময় কাটিয়ে উঠতে পারেননি।
যে ঝোপটায় রিকি লাথি মেরেছিল কর্নেল সাইলো খুব সাবধানে সেটার কাছে এগিয়ে গেলেন।
“আই সি।”
“কী হল, কর্নেল সাইলো?” এগিয়ে আসেন এবার।
“দেখতে পাচ্ছ, মাথুর?” কর্নেল নিজের লাঠির ডগাটা দিয়ে ঝোপটার দিকে দেখান। একটা খোঁচা দিতেই লাঠিটা কাঁটা-ঝোপের অনেকটা ভেতরে চলে যায় ঝপ করে। “সি, সি দ্যাট ওপেনিং দেয়ার।”
মাথুর অবাক হয়ে দেখলেন পাতা-লতার মধ্যে দিয়ে একটা অন্ধকার গুহামুখ দেখা যাচ্ছে পরিষ্কার। মাথুর দু’হাত মুখের কাছে জড়ো করে যতটা পারেন জোরে চিৎকার করেন। “রিকি। রিকিইই…”
অনেক দূর থেকে একটা ক্ষীণ গোঙানির শব্দ ভেসে আসে যেন। সত্যি কি কোনও আওয়াজ, না শোনার ভুল?
উত্তরটা আর পাওয়া হল না। কারণ, ঠিক সেই সময়ে মেজর মাথুর অনুভব করলেন কারা যেন তাঁদের দু’জনকে নিঃশব্দে ঘিরে ফেলেছে। ঘুরে দেখতে যাওয়ার আগেই ঘাড়ে একটা ঠান্ডা ধাতব স্পর্শ তাঁকে থামিয়ে দিল।
“আগে বঢ়ো।” গলাটা রুক্ষ, খসখসে। কথার সঙ্গে সঙ্গে ঘাড়ের খোঁচাটা আরও জোরালো হল।
“তোমরা কারা?” সাইলোর পেছনেও একজনকে আবছা দেখতে পাচ্ছিলেন মাথুর। “আমাদের কাছে কী চাই তোমাদের?”
মাথুরের কথার জবাবে চারদিক থেকে একটা বিশ্রী হাসির হররা উঠল।
“আমরা? আমরা রুলপুই। ওই যে, যে দেবতার দর্শনের জন্য এত দূর থেকে ছুটে এসেছ, সেই মহানাগ, সেই রুলপুইয়েরই ছেলেপিলে আমরা। চল চল, কথা বাড়িও না। সময় অনেক নষ্ট করিয়েছ, আর না।”
“কী করে জানলে এটা রুলপুইয়েরই গুহা? আমরা যে রুলপুইকেই খুঁজছি তাই বা কে বলল তোমায়?” সাইলো এবার কথা বলেন।
“বোকা পেয়েছ, কর্নেল সাহেব? ওই আকাট রিকি দার্নেইয়ের মতো বোকা পেয়েছ আমায়? এত দূর থেকে, এতদিন ধরে তোমাদের ফলো করছি কি এমনি এমনি? আমি জেজে, বুঝেছ সাহেব? খাঁটি রুলপুই। একবার যাকে ধরি, পুরো পাকে পাকে ছিবড়ে করে ছেড়ে দিই। ফালতু না বকে এগোও সাহেব, এগোও। পথ দেখাও।”
“প্যাক থেকে টর্চটা বার করতে দেবে? গুহার ভেতরে অন্ধকার। আলো ছাড়া বেশিদূর এগোনো যাবে না।” সাইলো নরম গলাতেই বলেন।
“না। বলে দাও কোথায় আছে, আমার ছেলেরা বার করে দেবে।”
“বাইরেই আছে, বাঁদিকের পকেটে।”
“বেশ। আর হ্যাঁ, দু’জনের হাতের ওই দুটো লাঠিও মাটিতে ফেলে দাও তো দেখি।”
মাথুর সাইলোর দিকে তাকিয়েছিলেন। বিনা প্রতিবাদে ট্রেকিং স্টিকটা হাত আলগা করে ফেলে দিতে দেখে একটু অবাকই হলেন। সাইলো এভাবে এক কথায় লড়াইয়ের ময়দান ছেড়ে হার মেনে নেবেন এটা মাথুর একেবারেই আশা করেননি। হতাশভাবে নিজের হাতের লাঠিটাও বাধ্য হয়েই ফেলে দিতে হল। জেজের এক সঙ্গী ক্ষিপ্র হাতে সেটাকে কুড়িয়ে নিল।
এইটুকু সময়ের মধ্যে আরও দু’জন এসে যোগ দিয়েছে ছেলেগুলোর সঙ্গে। জেজের ইশারায় তারা ধারালো ছুরি চালিয়ে গুহার মুখের সামনের ঝোপঝাড় অনেকটাই সাফ করে ফেলেছিল। ঘাড়ে আর একটা জোরালো খোঁচা খেয়ে মাথুরকে ওদিকে এগোতেই হল।
সুড়ঙ্গের মুখটা শুরু হয়েই এক ধাক্কায় অনেকটা ঢালু হয়ে গেছে। রিকির অদৃশ্য হওয়ার রহস্য এতক্ষণে বুঝলেন মাথুর। জোরে লাথি ছোঁড়ার ফলে শরীরের ব্যালেন্স হারিয়ে গিয়েছিল ওর। যার জন্য টাল রাখতে না পেরে গড়িয়ে চলে গেছে নিচে। কতটা নিচে কে জানে।
সুড়ঙ্গের ভেতরটা বেশ অন্ধকার। উৎরাই থাকার দরুণ বাইরের আলো বলতে গেলে ঢুকছেই না। সবার হাতের টর্চগুলোই যা ভরসা। ভেতরে অদ্ভুত দম আটকানো গন্ধ। পায়ের নিচের মাটিটা কীরকম কাঁকুরে। জুতোর গ্রিপ রাখা যাচ্ছে না ঠিকমতো।
সাইলো হঠাৎ হোঁচট খেলেন। পড়েই যেতেন হয়তো পুরো মুখ থুবড়ে, যদি না দু’হাত মাটিতে চেপে ধরে নিজেকে আটকাতেন।
“কায়দা করছ, সাহেব? জেজের সঙ্গে কায়দা? ওঠো। ওঠো বলছি। সিধা চলো।”
সাইলো কিছু একটা দেখছিলেন। জেজের কথায় খুব একটা মন দিচ্ছিলেন বলে মনে হচ্ছিল না।
“কী হল, কথা কানে যাচ্ছে না?”
“এটা দেখেছ?” খুব আস্তে প্রশ্ন করেন সাইলো।
“কী?” বিরক্তি চাপা থাকে না জেজের।
“সাপের খোলস চেন না? পাইথন। রেটিকিউলেটেড পাইথনের খোলস। ওই দ্যাখো। সাইজটা আন্দাজ করতে পারছ?”
“রুলপুই!” একটা সম্মিলিত শ্বাস টানার শব্দ ওঠে চারদিক থেকে। সুড়ঙ্গের এক ধারে সত্যিই পড়ে আছে এক বিশাল চিত্রবিচিত্র খোলস।
“সাথিয়োঁ, ঠিক পথেই চলছি আমরা। এখানেই আছে সেই রত্নের ভান্ডার। এই তার প্রমাণ। চলো সাহেব, আগে চলো।” জেজের উত্তেজনা স্পষ্ট।
সুড়ঙ্গের ঢাল ধরে বেশ খানিকটা এগোনোর পর হঠাৎ সামনের জমিটা সমতল হয়ে এল। এতক্ষণ একটু ঝুঁকে হাঁটতে হচ্ছিল সবাইকেই। এবার মাথা সোজা করে দাঁড়ান গেল। টর্চের আলোয় মাথুর ঘাড় না ঘুরিয়ে যতটুকু বুঝলেন, জায়গাটা অনেকটা একটা ছ-কোনা ঘরের মতো। এবড়োখেবড়ো কাঁকুরে দেওয়ালের মাঝে মাঝে বড়ো বড়ো ফাটল।
হঠাৎ একটা গোঙানি শুনে সবার চোখ পায়ের দিকে গেল। রিকির সেই এলোমেলো বেসামাল গড়ানি শেষপর্যন্ত এইখানে এসে থেমেছে। নিজেকে কুঁকড়ে ছোটো করে গুহার মেঝেতে বসে ছিল রিকি, চোখে খ্যাপাটে চাউনি। সাইলো আর মাথুরকে দেখে সে বাচ্চাদের মতো হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে আসে, প্রাণপণে আঁকড়ে ধরে সাইলোর বুট পরা পা। অন্য কাউকে সে তখনও দেখেনি।
“আরে দ্যাখো দ্যাখো, রুলপুই কাকে পাইয়ে দিলেন।” কর্কশ হাসে জেজে। “একটা ভিতু শেয়াল দ্যাখো কেমন জান বাঁচানোর জন্য গুহার মধ্যে লুকিয়ে আছে।”
ভীত চোখে এদিক ওদিক তাকায় রিকি। মাথুরের পেছনে জেজেকে দেখে সে চোখ আরও বিস্ফারিত হয়।
“জেজে? জেজে?”
“কেন, ভেবেছিলে বেঁচে যাবে, জেজের হাত থেকে পালিয়ে বাঁচবে, নাকি? রিকি দার্নেই?”
রিকি চোখ নামিয়ে নেয়।
।।এগারো।।
গুহার অন্যদিকে আলোআঁধারিতে সবার অলক্ষ্যে তখন অন্য এক নাটকের সূত্রপাত হচ্ছিল। সারা গায়ে চৌখুপি নকশা আঁকা একটা দীর্ঘ শরীর তখন আস্তে আস্তে বেরিয়ে আসছিল অন্ধকার এক ফাটল বেয়ে। এত আলো, এত কাঁপন, এত কথাবার্তার শব্দতরঙ্গ তাকে বিরক্ত করছিল, রাগিয়ে তুলছিল। অস্বস্তি হচ্ছিল তার। লম্বা চেরা জিভটা বার বার মুখ থেকে বের করে দিচ্ছিল সে। গুহার পুরোনো বদ্ধ বাতাসে মিলে মিশে যাওয়া অপরিচিত গন্ধের অণুগুলোর স্বাদ বোঝার চেষ্টা করছিল।
জেজে তখনও ব্যঙ্গ করছিল রিকিকে। তার কর্কশ হাসি গুহার ভেতরে ঘুরে ঘুরে বাজছিল।
এর মধ্যেই সাইলো হঠাৎ নিজের মাথাটা সজোরে পেছনে হেলালেন। গুহার দেওয়ালগুলো থেকে হাড় ভাঙার গা শিরশিরে আওয়াজটার প্রতিধ্বনি ফিরে এল।
ভাষাহীন একটা আর্তনাদ করতে করতে দু’হাতে নিজের নাক চেপে ধরে বসে পড়ল জেজের সহচর।
এই সুযোগটারই অপেক্ষায় থাকা মাথুর ততক্ষণে ডান-পা পেছনে নিয়ে গিয়ে একটা লাথি মেরেছেন জেজের হাঁটুতে। স্পাইক লাগানো বুটের এক আঘাতেই তার হাত থেকে ছুরি ছিটকে গেল। তীব্র যন্ত্রণায় বেঁকে যেতে যেতে কিছু বোঝার আগেই আর একটা প্রচন্ড লাথি এসে লাগে তার কুঁচকিতে। কাটা ছাগলের মতো গড়াগড়ি খেতে থাকে জেজে।
দলের অন্য চারজন ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল। এখন তারা অবস্থা সামলানোর জন্য এদিকে ছুটে আসতে চেষ্টা করে। তারা দেখেনি, মাথুরের হাতে কখন উঠে এসেছে জুতোয় লুকিয়ে রাখা ছুরিটা। তাঁর নিশানা ভুল হয় না।
ওরা আশা করেনি সবার আগে থাকা লোকটা এমন কাটাগাছের মতো পড়ে যাবে। নিজেদের সামলাতে না পেরে বাকি তিনটে শরীরও হুড়মুড় করে পড়ল একজনের ওপর আরেকজন।
গুহার সুদীর্ঘ চিত্রবিচিত্র প্রহরী ততক্ষণে ফাটল ছেড়ে এগিয়ে এসেছে আরও অনেকটা। এত লোকের পায়ের চাপে, নাকি অন্য কোনও কারণে তার বুকের তলায় মাটি তখন কাঁপছে দিম দিম। ঝুরো কাঁকর গড়িয়ে পড়ছে গুহার দেওয়াল বেয়ে। বিরক্তিতে গা মোচড়ায় সে, পাক দেয়। তার যাত্রাপথে জড়াজড়ি করে পড়ে থাকা তিনটে শরীরকে ঘিরে নেয় রুলপুইয়ের পেশল লেজ। চাপ দেয় সে। ঘিরে ঘিরে পাক দেয়, চাপ দেয়।
মাটির কাঁপন আরও একটু বাড়ে। কাঁকরের সঙ্গে সঙ্গে দু-চারটে পাথরও পড়তে শুরু করেছে এখন।
সাইলো রিকির বগলের তলায় দু’হাত দিয়ে তাকে সোজা দাঁড় করিয়েছেন ইতিমধ্যে।
“রান। জাস্ট রান। দ্যাট ওয়ে। আউটসাইড ইজ দ্যাট ওয়ে।”
রিকি ভয়ার্ত চোখে একবার চারদিকে তাকায়।
নাক ভাঙা লোকটা উঠে বসার চেষ্টা করছিল। জেজে তখনও জ্ঞানহীন। সামান্য দূরে একটা তালগোল পাকানো পিন্ড থেকে বীভৎস কাতরানোর আওয়াজ আসছিল। শুনে বোঝা যাচ্ছিল না ওটা মানুষের গলার আওয়াজ।
মাটি বেশ জোরে কাঁপছিল তখন।
“আর্থকোয়েক, মাথুর! বুঝতে পারছ না? দৌড়োও। তিনজনেই চাপা পড়ে মরব না হলে।”
সেই উন্মত্ত পড়ি কি মরি দৌড় মেজর সুনীল মাথুর আমৃত্যু ভুলবেন না। গুহা থেকে ছিটকে বেরিয়ে এসেও সে দৌড় থামেনি, যতক্ষণ না পায়ের তলায় প্রচন্ড রকম দুলতে থাকা পৃথিবী তাঁদের তিনজনকেই আর দাঁড়িয়ে থাকতে দিল না।
উপুড় হয়ে শুয়ে দু’হাতে মাথা ঢেকে রেখেছিলেন ওঁরা। গাছপালার ডাল ভেঙে ভেঙে পড়ছিল পিঠের ওপর।
কতক্ষণ? দেড় মিনিট বড়জোর। মনে হচ্ছিল যেন অনন্তকাল।
যখন সব শান্ত হল, সামান্যতম আফটারশকও আর টের পাওয়া যাচ্ছিল না, তখন ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল সবাই।
“কর্নেল সাইলো, দেখুন।” সামনের দিকে হাতটা বাড়িয়ে দেন মাথুর।
রুলপুইয়ের গুহার প্রবেশমুখ এখন চিরকালের জন্য বন্ধ। গাছপালা-মাটি-পাথর সব নিয়ে ধ্বসে গেছে জায়গাটা। নতুন একটা ঢিপি তৈরি হয়েছে তার বদলে।
“রুলপুই তাঁর সেবায়েতদের নিজের কাছেই রেখে দিলেন তাহলে।” একটা জোর শ্বাস ফেলেন সাইলো।
“কিন্তু, রত্নভাণ্ডার? আর তো কোনওদিন তার হদিশ পাওয়াই যাবে না!” মাথুরের মন মানতে চাইছিল না। এত দূরে এত কষ্ট করে এসেও খালি হাতে ফিরতে হচ্ছিল, গুহার রহস্য ভেদ না করেই। এতে তাঁর মন সায় দিচ্ছিল না।
“ভালোই তো হল, তাই না? এই রহস্যময় গুহার সন্ধান পেয়ে লোভী মানুষ এসে খোঁজাখুঁজি করবে, খোঁড়াখুঁড়ি করবে, এই অপূর্ব জঙ্গলকে তছনছ করে দেবে, সেটাই কি চাও মাথুর? তার চেয়ে এই ভালো। রুলপুইয়ের রহস্য তাঁরই থাক।”
আট মাস পরে
সাউথ ওয়েস্টার্ন কম্যান্ডের কোনও এক ইউনিটেঃ
“সাব, পার্সেল।”
মেজর সুনীল মাথুর একটু অবাক হলেন। তাঁকে কে পার্সেল পাঠাবে? এখন হোলিও নয়, দিওয়ালিও নয়। জন্মদিনেরও দেরি আছে। একটু দুশ্চিন্তাও যে হচ্ছিল না তা নয়। আজকাল এইসব পার্সেলের মধ্যে লুকিয়ে বোমা-টোমাও পাঠানো হচ্ছে অনেক জায়গায়। খুললেই ব্লাস্ট।
প্যাকেটটা হাতে নিয়ে অবশ্য আশঙ্কা কেটে গেল অনেকটাই। পার্সেল এসেছে কর্নেল ডেভিড সাইলোর কাছ থেকে। কত কথা মনে পড়ে গেল এক লহমায়। হালকা হাসি ঠোঁটে নিয়ে পার্সেলের প্যাকিং কাটেন মেজর মাথুর।
একটা চিঠি, আর একটা ছোট্ট কৌটো। চিঠিটাই আগে খোলেন।
‘হ্যালো সুনীল,
আশা করি সুস্থ আছ। তোমার জন্য একটা ছোট্ট উপহার পাঠালাম। বলতে পার রুলপুইয়েরই উপহার। মনে আছে গুহার ভেতরের সেই কাঁকুরে মাটি? সেই গ্র্যাভেল? তখনই সন্দেহ হয়েছিল। পড়ে যাওয়ার ভান করে দু’হাতে বড়ো বড়ো দু’মুঠো গ্র্যাভেল তুলে নিয়েছিলাম। সেগুলো ওয়াশ করে যা পেয়েছি, তার কয়েকটা তোমায় পাঠালাম, আমাদের অভিযানের স্মারক হিসেবে।
আরও যে কত সম্পদ ছিল ওই গুহায় তা আর কোনওদিনও মানুষ জানতে পারবে না। চিরকালের জন্যই সেসব রয়ে গেছে রুলপুইয়ের পাহারায়।
ভালো থেকো।’
সাইলোর চিঠির মাথামুন্ডু কিছুই বুঝতে পারছিলেন না মাথুর। বেশ একটু কৌতূহল নিয়েই কৌটোটা খুললেন তাই।
আর স্তম্ভিত হয়ে দেখলেন ছোট্ট কৌটোটার ভেতরে সাদা ভেলভেটের বিছানায় পাশাপাশি শুয়ে রয়েছে জমাট রক্তের ফোঁটার মতো তিনটি নিখুঁত রক্তলাল চুনি।
অলঙ্করণঃ স্যমন্তক চট্টোপাধ্যায় (হেডপিস ব্যতীত)