গল্পঃ দিজুমিন আর ভালিয়া – সঙ্গীতা দাশগুপ্ত রায়: উত্তরাধিকারঃ ওয়েবসাহিত্য পুরস্কার ২০১৭
দিজুমিন আর ভালিয়া
সঙ্গীতা দাশগুপ্ত রায়
“যাও, চুলার ওপর লোহার ঢাকনাটা বসিয়ে তোমরা এবার গিয়ে শুয়ে পড় বাছারা,” বলে বুড়ি দিজুমিন রান্নাঘরের দেওয়াল ঘেঁষে পাশ ফিরে শোয়।
“কিন্তু মা, তুমি এই স্যাঁতস্যাঁতে মেঝেতে শুলে আরও ব্যথা বাড়বে। তার চেয়ে ঘরে এসে শোও না কেন আজ?বাইরে এমন ভীষণ বৃষ্টি।”
“বৃষ্টি আসে রোজ রাতে
এমন ভারী বর্ষাতে,”
এইটুকু বলেই বুড়ি পাশ ফিরে শোয়। দুই বউ এ ওর মুখ চাওয়াচাওয়ি করে টেনেটুনে লোহার পাতটা কোনওরকমে চুলা অবদি এনে আগুনের ওপর বসায়। তারপর মোটা তেলচিটে ছোট কাঁথাটা ওর ওপর পেতে দেয়। লোহার আগুনে কাঁথাটা ধীরে ধীরে উষ্ণ হয়ে উঠলে বুড়ি দাজুমিন সেটাকে টেনে গায়ে দিয়ে আরামে বাকি রাতটা ঘুমিয়ে নেবে।
“জানি না কী যে আছে রান্নাঘরে!” ছোটবউ নিচু গলায় বলে।
“কী আবার থাকবে! রান্নাবান্না হয়, ঘরটা এমনিতেই গরম থাকে। তাছাড়া আমি তো চিরকালই দেখেছি ওখানেই শুতে। ভাল্লা বলে, মা বহুবছর শোবার ঘরে ঘুমোয়নি।” ঘাঘরার কুঁচিটা তুলে ভিজে উঠোন পেরোতে পেরোতে বড়োবউ উত্তর দেয়।
ছোটবউ পা টিপে টিপে হাঁটে। দু’দিন আগে পিছল দাওয়ায় পড়ে চোট লেগেছে। তাছাড়া বুড়ি মা’র কান চতুর্দিকে। কথা কম বলাই ভাল।
চুলাঘরের পূবের জানালা দিয়ে দিজুমিন বউদের নিজের নিজের ঘরে দোর দিতে দেখে। তারপর নড়েচড়ে উনুনের কাছে আসে। লোহার ওপর থেকে কাঁথাটা সরিয়ে, ঢাকনাটা সরিয়ে পাশে রাখে। অত ভারী ঢাকনা সরানোর শক্তি আর কতদিন থাকবে কে জানে। যাক। বাইরে বৃষ্টির আওয়াজের মধ্যে দিজুমিন তার পাকা চুলের নুটি থেকে একখানা চুল চুলায় ফেলে। দেখতে দেখতে চারদিক ধোঁয়াময় হয়ে যায়। শুধু নিভু নিভু আগুনের মধ্যে একটা পায়ে চলা পথ দেখা যায় আর শোনা যায় মিহি গলায় গান –
‘দাদিবুড়ি থুত্থুড়ি রোজ কেন ডাকে
নাতনির দেখা পেতে চুলাঘরে থাকে…’
গাইতে গাইতে আগুন আগুন রঙের ছোট একটা মেয়ে উঠে আসে উনুন বেয়ে। ফোকলা হাসিতে মুখ ভরে ওঠে দাজুমিনের। তাড়াতাড়ি ঘরের কোণের গর্তে রাখা হাঁড়ি থেকে ভাত আর শিকে থেকে আচার এনে সাজিয়ে দেয়। আদর করে মেয়েকে কোলের কাছে এনে বসায়। মুখে মাথায় চুলে হাত বোলায়। তারপর বিড়বিড় করে বলে, “তুই আমার সেই হারিয়ে যাওয়া ভালিয়া। ভালিয়ার গলাও এমন সুরেলা ছিল। তার হাতের আঙুল পায়ের আঙুল যেন ফুলের মতো নরম ছিল। এমনকি, এই যে গোছা গোছা কোঁকড়া চুলের ঢাল, এও তো আমার ভালিয়ারই মতো একদম।”
“কিন্তু আমি তো ভালিয়া না বুড়িদাদি। আমি তো হিরানি।”
দাজুমিন নাতনির ঠোঁটের কোণে লেগে থাকা আচার মুছিয়ে দেয়। মুখে হাসি আর চোখে জল নিয়ে বিড়বিড় করে গান গায় –
‘ভালিয়া গেল নদীর পার
ফিরে তো এল না আর
হারিয়ে গেল জোয়ার-টানে
রইল বেঁচে দাজুর প্রাণে’
“ভালিয়া কেমন ছিল দাদি?”
“সে যে বড়ো সুন্দরী ছিল দিদি। আর ছিল ভাবুক। দিনের বেলা পাখির গানে ফুলের সুবাসে আনমনা হয়ে কোথায় কোথায় চলে যেত। তাকে সামলানো আমার কম্ম ছিল না।”
“তারপর?”
“তারপর এক শীতের মাসে নতুন চাঁদের শুরুতে, আমার বড়ো ছেলে ভাল্লা এসে বলল, মা গো, এখানে কাছেপিঠে শিকার করার মতো কিছু পাই না। সংসারে খাবার জোটাতে হলে দূর পাহাড়ে যেতে হবে। পাহাড়ের ঢালে নাকি এক বাগান আছে। সেখানে থরে থরে ফল, ক্ষেত জুড়ে ধান আর খরগোশ হরিণ বুনোহাঁস গিজগিজ করছে। আমরা দুইভাই মিলে ফল চাল আর মাংস গুছিয়ে আনতে পারি অঢেল। কিন্তু তোমাকে আর ভালিয়াকে একা রেখে যেতে ভরসা পাই নে।
“শুনে আমি বললুম, আমাদের নিয়ে ভেব না বাছারা। তিনজনেই যাও। আমি ভালিয়াকে নিয়ে ঘর আগলাব।আর একপক্ষ পেরোলেই ঝামরি নদীতে ভাসিয়ে দেব বটপাতায় লেখা আমাদের কুশল পত্তর।”
“তারপর?”
“তারপর আমায় পেন্নাম করে বড়ো বড়ো ঝোলা নিয়ে ভাল্লা, বাকু আর ইবলু তো গেল পাহাড়ে। এদিকে আমি আর ভালিয়া সকাল সকাল কাঠকুটো জোগাড় করি, ঝামরিতে নাইতে নেমে কামঠ পেলে তুলে আনি, কখনও কখনও কচ্ছপের ডিম, ছোটবড়ো মাছও পাই। মেটে আলু পোড়াই, কচু দিয়ে মাছের ঝোল রান্না করি। তারপর বিকেল বিকেল দোর দিয়ে মায়ে ঝিয়ে সেই ঝোল খেয়ে শুয়ে পড়ি। কিন্তু একমুহূর্তও ভালিয়া মাকে আমার চোখের আড়াল করি না। এমনি করে করেই কেটে গেল একপক্ষ কাল। আমার অত দিনক্ষণের হিসেব ছিল না। কিন্তু একদিন শুতে গিয়ে গোটা চাঁদ দেখে ভালিয়া বলল, দাদাদের পত্তর লিখব না মা? আমি বললুম, সেই তো! আয়, এখনি বসে লিখি।
“সে বলল, তুমি শুয়ে পড়। আমি উঠোন থেকে বটপাতা এনে লিখে নদীতে ভাসিয়ে আসি,” এই অবধি বলতে বলতে দাদির গলা ধরে আসে।
হিরানি আরও কাছে ঘেঁষে আসে। গল্প থেকে দুঃখু দুঃখু বাস সারা ঘরে ছড়িয়ে পড়ে।
“তারপর?”
“আমার সেদিন কী জানি কী মরণঘুমে ধরল। ঠান্ডা ছিল চারিপাশ বড্ড বেশি আর কাঁথাখানাও যেন শক্ত করে জড়িয়ে ছিল আমায়। কী আলিস্যিতেই বললুম, বেশ তো বাছা। যা। আমরা ভালো আছি এটুক জানিয়ে চলে আসিস দৌড়ে।
“সে দোর খুলল। বুঝলাম, ঠান্ডা বাতাস রুখতে শক্ত করে দোর আটকাল। তাও বুঝলাম… কিন্তু তারপর আর তার ফিরে আসা বুঝলাম না। একপহর পেরোয় দু’পহর পেরোয়, চাঁদ নামতে থাকে গাছের মাথায়, আমি কাঁথাখানা জড়িয়ে পথে নামলাম। উঠোনের বটগাছকে জিজ্ঞেস করলাম মেয়েকে দেখেছে কি না। সে উত্তর দিলে না। আকাশের আলোকে জিজ্ঞেস করলাম, সেও উত্তর দিলে না। নদীর জলকে জিজ্ঞেস করলাম, সেও যেন শুনতে পায়নি এমন ভাব।”
বলতে বলতে বুড়ি জোরে জোরে ফুঁপিয়ে ওঠে। হিরানি কোল ঘেঁষে বসে। চোখের নিচের চামড়ার ভাঁজে চকচক করে বুড়ির চোখের জল।
“নদীর ওপাশে চাঁদ মুখ নিচু করে ডুবতে যায় যায়। আমি তাকে ডেকে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কি দেখেছ আমার ফুটফুটে ভালিয়াকে? চাঁদ কিছু যেন বলতেই যাচ্ছিল তখনি ভরা জোয়ারে নদী উঠল ফুলে আর কপ করে গিলে নিল চাঁদটাকে। সারাদিন পথে পথে ঘুরে মেয়ের নাম ধরে চিৎকার করে ডেকে ডেকে আমার মাথা ঘুরছিল বনবন, গায়ে পায়ে ব্যথা ঝনঝন… আমি নিজেও পথ হারালাম একসময়। অন্ধকার বনের মধ্যে ছুটে যাওয়া হরিণ আমায় দেখে লুকিয়ে পড়ছে বুঝে আমি তাকেও ডেকে জিজ্ঞেস করলাম মেয়ের কথা। এমন সময় শালগাছের মাথা ডিঙিয়ে আলো দেখা দিল। সেই আলোয় বনের মধ্যে ঘাসের বিছানায় শুয়ে শুয়ে আমি কাঁদতে লাগলাম ভালিয়ার নাম ধরে। সাড়া দিল না কেউ। শুধু কাঠবিড়ালিগুলো এগাছ থেকে ওগাছে লাফিয়ে ঘুমোতে যাওয়ার আগে আমার হাতে দুটি বাদাম দিয়ে গেল।
“এভাবেই কাটছিল দিন। আমি বনের অন্য কাঠুরেদের সঙ্গী হয়ে বাড়ি ফিরে এসেছিলাম। রোজ চুলায় আগুন দিতাম আর মনে মনে আগুনের দেবতা হেপাস্টাসের কাছে প্রার্থনা করতাম আমার ভালিয়াকে আমার কোলে ফিরিয়ে দিক। এদিকে ছেলেদেরও কোনও খবর নেই। কিন্তু তাদের নিয়ে আমার চিন্তা ছিল না। সারাদিন শুধু ভালিয়াই আমার মনের দরজা আগলে বসে থাকত। তারপর একদিন আকাশ কালো মেঘে ছেয়ে গেল। হেইদিসের পরিরা পাখা দিয়ে ঢেকে দিল সূর্যের সব আলো। শোঁ শোঁ আওয়াজে ঝড় উঠে আমার এই কুঁড়ের ছাদের খড় উড়িয়ে নিয়ে গেল দেড় কোশ পথ কি তারও বেশি হবে। আমি সারাদিন এই চুলার পাশে বসে বসে কাঁদতে লাগলাম আমার ভালিয়া, ভল্লা, বাকু আর ইবলুর নাম ধরে ডাকতে লাগলাম। তিনদিনের টানা বৃষ্টিতে ঝামরির জল আমার উঠোন অবধি উঠে এল।আমি ঘরের কাঁথাখানা মুড়ি দিয়ে কেবল ভাবছি, এই বুঝি মাথার ওপর বাকি ঘরটুকু ভেঙে পড়ে।
এমন সময়, উঠোনের ওপর একটানা ছপছপ শব্দে গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। যেন কেউ জল টেনে টেনে এগিয়ে আসছে। কোনওরকমে বাইরে বেরিয়ে দেখি এক এত্তবড়ো ঘোড়া, কালো গায়ের কালো ঝাঁকালো চুলের ঘোড়াটা চাঁদের আলোয় কাঁচের মূর্তির মতো চকচক করছিল। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি দেখে সে ধীর পায়ে এগিয়ে এসে মাথা ঝাঁকালো আর ওমনি তার মিশমিশে কালো কেশর থেকে একখানি মাথার কাঁটায় গাঁথা পাতা খসে পড়ল। তুলে দেখি একখানি ছবি আঁকা। কালো ঘোড়ার পিঠে বসা এক বুড়ির ছবি। বুঝলাম, কেউ আমাকে ডাক দিয়েছে। দোর টেনে দিয়ে সেই ঘোড়াখানার পিঠে চড়ে বসলুম আমি, আর কী অদ্ভুত সে ঘোড়া! আমাকে পিঠে নিয়েই একটানে আকাশে সোজাসুজি উড়ে উঠল।”
“তারপর?”
হিরানির মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে দিজুমিন বলতে থাকে, “তারপর কে জানে ক’দিন ক’রাত ঝড়ের সাথে পাল্লা দিয়ে উড়েছিল সেই ডানা মেলা ঘোড়াখানা। শেষে বোধহয় আমিও ঘুমিয়ে গেছিলাম, বুঝলি? যখন ঘুম ভাঙল তখন দেখি ঝকঝকে রুপোর মতো সাদা আলো ঠিকরানো এক দোরের সামনে দাঁড়িয়ে আছে ঘোড়াটা। মুহূর্তের মধ্যে চারদিক থেকে ভারী সুন্দরী সব মেয়েরা দৌড়ে এল। ওরাই আমায় হাত ধরে নামাল ঘোড়ার পিঠ থেকে। তারপর আগে পিছে ঘেরাও করে নিয়ে গেল বিরাট একটা ঘরে।”
হিরানিও গল্প শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে গেছে এতক্ষণে। বুড়ি তবুও একা একাই উনুনের আগুনের দিকে তাকিয়ে গল্প বলে চলে, “সে ঘরের মাঝখানটিতে বিশাল এক পালঙ্কে শুয়ে আছে আমার ভালিয়া। চোখদুটি বন্ধ। লাল টুকটুকে পোষাকে ঘুমিয়ে থাকা ভালিয়া আমার যেন একখানা পদ্মফুল রে, বুঝলি নাতনি! সারা ঘরে কোন না জানি ফুলের সুবাস। আমি তার কাছে যেতেই উল্টোদিকের দরজা দিয়ে এক রাজার কুমারের মতো না জানি কে ঘরে এসে ঢুকল।তারপর আমার সামনে এসে মাথা নিচু করে বলল, মা, এই যে তোমার মেয়ে। তুমি তাকে খুঁজে খুঁজে পথে পথে ঘোরো। এদিকে সেও তোমাকে কাছে না পেয়ে বিছানা নিয়েছে আজ কতদিন। আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কে বাছা? আমার ভালিয়াই বা এখানে কেন?
“আমার গলার আওয়াজেই কিনা কে জানে, মেয়ে আমার তখুনি চোখ খুলে উঠে বসল, বুঝলি? তারপর আমাকে জড়িয়ে ধরে তার সে কী কান্না! আমাদের মা মেয়েকে কাঁদতে দেখে সেই রাজকুমারের মতো ছেলেটি আর ফুটফুটে সব মেয়েরা ধীরে ধীরে ঘর থেকে সরে গেল। ভালিয়া কাঁদতে কাঁদতেই আমাকে বলল, কী করে সে ঐ রাজপ্রাসাদে পৌঁছেছে।
“সেদিন ঐ মাঝরাতে যখন মেয়ে আমার দাদাদের পত্তরটি লিখে নদীতে ভাসাবে বলে বেরিয়েছিল তখন আকাশে চাঁদটি ঝকঝকে। কিন্তু নদী অবধি পৌঁছতে পৌঁছতেই হঠাৎ আকাশে মেঘ ছেয়ে যায়। অন্ধকারে কোনওরকমে নদীর ধারে পৌঁছেই ভালিয়া দেখে নদীতে জোয়ার এসেছে, ফুলে উঠেছে জল। জলের অমন রূপ দেখে ভালিয়া পায়ে পায়ে আরও কাছে যায় আর সেই সময়েই ঝামরির বুক দাপাদাপি করে জেগে ওঠে বিশাল আপালু অজগর। আপালুকে এই ধরিত্রীর সব্বাই ভয় পায়। ওর বিশাল ফনার ছায়ায় আমার ছোট্ট ভালিয়া প্রায় ঢেকে গেছে যখন, সেই সময় মেঘ যায় সরে আর নিজের আট পা-ওয়ালা ঘোড়ায় চড়ে প্রভু ওডিন হঠাৎ কোথা থেকে উড়ে এসে এক ঝটকায় নিজের কোলে তুলে নেন ভালিয়াকে।
“জানিস নাতনি, যে প্রাসাদে আমার ভালিয়া বিছানায় শুয়েছিল সেটি প্রভু ওডিনের প্রাসাদ। ওডিন চেয়েছিলেন তার ছেলের সঙ্গে আমার ভালিয়াসোনার বিয়ে দেবেন। এদিকে মেয়ে আমার তার মায়ের শোকে কেবলই কাঁদে। তাইতেই প্রভু ওডিন তাঁর বিশ্বস্ত ঘোড়াটিকে পাঠিয়েছিলেন আমাকে তুলে নিয়ে যেতে।”
বুড়ির বিনবিনে কথার সুরেই ঘুমিয়ে গেছিল হিরানি। আবার একটু পরে সেই বিনবিনানি সুরেই তার ঘুম ভেঙে যায়। ছোট ছোট হাতদু’খানি সে দাজুমিনের মুখে মাথায় বুলিয়ে দেয়। হাতে ভিজে ভিজে চোখের জল লেগে যায়।
“সে প্রাসাদ থেকে তুমি আবার এই কুঁড়েতে এলে কী করে দাদি?”
“কী করব নাতনি! সে প্রাসাদে আমার মতো মানুষের একটা ঠাঁই হয়েই যেত, কিন্তু আমার ভাল্লা, বাকু আর ইবলুও যে অনাথ হয়ে যেত সাথে সাথে! ভালিয়া মা ভাগ্যবতী। সাতমহলা প্রাসাদে শ্বেতপাথরের থালায় সে ভাত খায়,মেঘের মতো নরম বিছানায় ঘুমোয়। এই দেখেই আমার চোখ জুড়িয়ে গেল। সে ভালো আছে এটা জেনেই আমার সাতজন্মের সুখ পাওয়া। কিন্তু আমার ভাল্লা বাকুরা যে পাহাড় থেকে ফিরে খুঁজবে আমায়! তাদের জন্যও তো আমার চোখ অপেক্ষা করে থাকে। আমি এই বুড়ি নিজের মনকে দু’ভাগ করে দিলাম তখন। এক ভাগ রাখলাম ভালিয়ার পশমের মতো বালিশের নিচে যাতে রোজ রাতে সে আমার গলার ঘুমপাড়ানি গানটুকু শুনতে পায় মন চাইলেই, আর অন্য মনটিকে রাখলাম নিজের কাছে। সেটি খেয়াল রাখবে আমার ছেলেদের।
“ফেরার সময় যখন আমার চোখের জল আর বাঁধ মানছে না, ভালিয়াও আকুল হয়ে কাঁদছে আমার গলা জড়িয়ে ধরে তখন রানি ফ্রিজা আমার মাথায় হাতটি বুলিয়ে বলেন, যখনি মন কেমন করবে তোমার দিজুমিন, তুমি মাথা থেকে একটি চুল ছিঁড়ে আগুনে দিও। দেখবে তোমার মেয়ের মতোই একটি মায়াবী মেয়ে তোমাকে গিয়ে আদর করে আসবে।সেই থেকেই…”
হিরানি টিপিটিপি হাসে, “তাই বুঝি তুমি আমাকে তোমার ভালিয়া বল?”
“হ্যাঁ রে নাতনি। তবে ক’দিন আর তোকে আমি দেখতে পাব জানি না। মাথায় এই ক’টি শনের নুড়ি যদ্দিন আছে তদ্দিনই…”
“তাহলে তুমিও আমার সাথে চল না কেন দাদি? আমার কাছে থাকবে। যদি ভগবানের ইচ্ছে থাকে তো আবার হয়তো তোমার মেয়ের সাথেও দেখা হয়ে যাবে।”
“সত্যি বলছিস নাতনি!” বুড়ি চঞ্চল হয়ে ওঠে, “এখন তো গেলেই হয়। ছেলেরা সংসারী হয়েছে। বউরা সুন্দর করে ঘরদোর গুছিয়ে তাদের দেখাশোনা করে। আর তো আমার প্রয়োজন নেই কোথাও। তোর সঙ্গে নিয়ে যাবি আমায়?”
মিষ্টি করে হাসে হিরানি। ছোট ছোট হাতদুটি দিয়ে চোখের জল মুছিয়ে দেয় বুড়ির। তারপর হাতটি ধরে উঠে দাঁড়ায়। এক পা এক পা উনুনের দিকে হাঁটতে হাঁটতে গান গায় –
‘দাদি দিজুমিন
পেয়েছে নাতিন
চলেছে অচিন দেশে
হাসিটি রঙিন’
ভোরবেলায় বড়োবউ এসে রান্নাঘরের দরজা খুলে চিৎকার করে কেঁদে ওঠে। শাশুড়ির শরীর ঠান্ডা শক্ত হয়ে নিভে যাওয়া উনুনের ধারে পড়ে আছে।
শ্বেতপাথরের প্রাসাদে রুপোলি মুকুট পরা রানি ফ্রিজা হিরানির মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, “এ ঘরে গোল কোরো না যেন। দাদিকে শান্তিতে ঘুমোতে দাও।”
ভালিয়া বিছানায় মায়ের মাথাটির কাছে বসে অপেক্ষা করে ঘুমটি ভাঙার। ছোট্ট হিরানি তার বন্ধুদের সঙ্গে মিলে লক্ষ তারার কুচির মতো আলো দিয়ে প্রাসাদ সাজিয়ে তোলে। আজ তার দাদি আর মায়ের মিলন উৎসব কিনা!
অলঙ্করণঃ ঋতম মুখার্জি