Wednesday, November 20, 2024
ধারাবাহিক উপন্যাস

জেমস পটার অ্যান্ড দ্য হল অফ এল্ডারস ক্রসিং – পার্ট ২

লেখক: জি নরম্যান লিপার্ট, ভাষান্তরঃ প্রতিম দাস

শিল্পী: মূল প্রচ্ছদ, সুদীপ দেব

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

আল্মা আলেরনের অতিথিদের আগমন

ড্রেস পড়ে রেডি হয়ে গ্রেট হলে ব্রেকফাস্টের জন্য জেমস যখন পৌছালো তখন ঘড়িতে দশটা বেজে গেছে। সকালবেলার চাপ কমে গেছে, গোটা বারো ছাত্রছাত্রী এদিক ওদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসেছিল। স্লিদারিন টেবিলের দূরবর্তী কোনায় জ্যান কুঁজো হয়ে বসে ট্যারা চোখে তাকিয়ে আছে সূর্যালোকিত একটা বীম এর দিকে। উল্টোদিকে বসে আছে র‍্যালফ, জেমসকে ঢুকতে দেখে হাত নাড়লো।

     হলটার অর্ধেকটা জেমস পার হয়েছে মাত্র, চার পাঁচটা হাউস এলফ টেবিলগুলোর এদিক ওদিক দিয়ে ঘুরতে শুরু করলো। দেখে মনে হচ্ছিল ওটা বোধহয় ওদের কাজের অঙ্গ। সবার পরনে লম্বা লিনেনের ন্যাপকিন, যার ওপর হগওয়ারটসের চিহ্ন এমব্রয়ডারি করা আছে। মাঝে মাঝে এক একজন ঢুকে যাচ্ছিল টেবিলের তলায় আবার বেরিয়েও আসছিল। টেবিলের তলায় পড়ে থাকা আধখাওয়া বিস্কুট বা কাঁটাচামচ ছুঁড়ে দিচ্ছিল ওপর দিকে। জেমস একটা এলফের পাশ দিয়ে যেতেই ওটা সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে লম্বা হাতটাকে বাড়িয়ে দিয়েই পিছিয়ে নিলো। জেমসের সামনের টেবিলের জিনিষপত্রগুলো হঠাৎ শুন্যে উঠে ঘুরতে শুরু করলো, যেন একটা মিনি সাইক্লোন শুরু হয়েছে ওখানটায়। রুপোর ও অন্যান্য ধাতুর বাসনপত্রের ঠোকাঠুকির আওয়াজে মুখরিত হচ্ছিল গ্রেট হল। টেবিলক্লথের কোনাগুলো গিয়ে মিলিত হল এক জায়গায়, দেখে মনে হচ্ছিল একটা বড় মাপের থলি ভেসে আছে চকচকে পালিস করা কাঠের টেবিলটার ওপর। একটা এলফ চেয়ার থেকে টেবিলে উঠলো লাফিয়ে, সেখান থেকে একলাফে পৌঁছে গেল ব্যাগটার ওপর আলতোভাবে। চেপে ধরলো টেবিল ক্লথের চারকোনা এক হওয়া জায়গাটা, মারলো এক গিঁট। তারপরেই সোজা লাফ দিলো হলের দৈত্যাকার সার্ভিসডোরটা লক্ষ্য করে। জেমস ঝট করে নিচু হল, না হলে ওই বিশাল থলে আর একটু হলেই ওকে ভুমিশয্যা নিতে বাধ্য করতো।

     ‘উরি বাবা’, জ্যান বিড়বিড়ালো, জেমস লাফিয়ে ওর কাছে গিয়ে টোস্ট এর শেষ টুকরোটা হাতে তুলে নিতেই। ‘তোমাদের এই ছোট্ট ওয়েটারগুলো দেখতে বদখত, কিন্তু জানে ভালো কফি কি করে বানাতে হয়।’

     “ওরা ওয়েটার নয়, ওরা হাউসএলফ। আমি ওদের বিষয়ে কাল পড়েছি,’ র‍্যালফ জানালো, একটা সসেজের অর্ধেকটা মুখে পুরতে পুরতে। বাকিটা আটকে থাকলো ওর কাঁটা চামচের। ‘ওরা মাটির তলায় থাকে। ঠিক বাচ্চাদের গল্পের এলফ বামনদের মতই। ওই যে যারা এসে রাতের বেলায় মুচির কাজগুলো করে দিয়ে যেত।’

     ‘মুচি মানে?’ জ্যান কফি মগ থেকে মুখ তুলে জানতে চাইলো।

     ‘ওই যারা জুতো বানায়। সেই যে লোকটা জুতোগুলো অর্ধেক বানিয়ে ফেলে রাখতো, আর তার জন্য ওর অনেক কাজ জমে গিয়েছিল। তুমি এই গল্পটা জানো না? একদিন মাঝরাতে লোকটা ঘুমিয়ে পড়লো কাজ করতে করতে, তখন ওই এলফগুলো এলো ওখানে। সব জুতো নিয়ে চলে গেল শহরে। ফেরত দিয়ে গেল সব একেবারে পুরো তৈরী অবস্থায়। ঘুম ভেঙে ব্যাপার স্যাপার দেখে মুচি তো অবাক। সসেজের বাকি অংশটা মুখে পুরে বললো, ‘অবশ্য আমি কোন দিন ন্যাপকিন পড়া এলফ এর ছবি দেখিনি।’

     ‘হেই, এলিয়েন বয়, তোমার মুখ তো দেখছি একেবারে স্বাভাবিক হয়ে গেছে,’ জ্যান বললো জেমসকে ভালো করে দেখে।

     ‘তার জন্য অনেক কিছুই সহ্য করতে হয়েছেআমাকে,’ জেমস জানালো।

     ‘সাব্রিনা যখন তোমায় আঘাতটা করলো, তোমার লাগেনি?’

     ‘না, তবে অনুভুতিটা বিকট রকমের। অদ্ভুতের চুড়ান্ত যাকে বলে। কিন্তু কষ্টদায়ক নয় মোটেই। রাত পেরিয়ে যেতেই সব ঠিক হয়ে গেছে।’

     ‘সাব্রিনা একজন জাত শিল্পী। তোমাকে দেখাচ্ছিল ব্যাপক। ব্যাঙের মত আঙুলজোড়া পা সমেত।’

     ‘তোমরা কি নিয়ে কথা বলছো?’ র‍্যালফ জানতে চাইলো, দুজনের মুখ বারবার দেখতে দেখতে। ওরা ওকে গতরাতের “রেইজিং দ্য উকেট” এর সব কথা খুলে বললো। জেমসকে এলিয়েনরুপে দেখে ওই লোকটার অজ্ঞান হয়ে যাওয়া। সাথেই হোঁচট খেয়ে লোকটার ওপরেই জেমসের পড়ে যাওয়াটাও।

     ‘আমি ওই সময়টায় কোনার দিকের শেডটার তলায় লুকিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম। তোমরা যখন লোকটাকে দেখছিলে আমি খুব কষ্টে হাসি সামলাচ্ছিলাম। মঙ্গলের প্রানীদের আক্রমণ বলে কথা!’ বলতে বলতে জ্যান হাসিতে ফেটে পড়লো। আর তাতে যোগ দিলো জেমসও।

     ‘ওরা স্পেশশিপটা কোথায় পেল?’ র‍্যালফ জানতে চাইলো ওদের হাসিতে যোগ না দিয়ে।

     ‘ওটা তো সরু তার আর কাগজের মন্ড দিয়ে বানানো,’ কফিতে শেষ চুমুকটা দিয়ে ঠকাস করে কাপটা নামিয়ে রেখে জ্যান উত্তর দিল। হাত দুটো ওপরে তুলে আঙুল মটকালো। ‘সাব্রিনা আর হোরাস ওটা বানিয়ে ছিল হগসমীডে গতবছর ক্রিসমাস প্যারেডের ওড়ানোর জন্য। একটা বিরাট ঘড়া হিসাবে ওটা ব্যবহার হয়েছিল। ওর ওপর কিছু রঙ আর জেন্নিফারের ভাষায় ‘ভিসাম ইনেপসিও’ চার্ম ছুঁড়ে দিতেই ওটা পরিণত হয়ে গেল আর.এম.এস. উকেট।’

     একটা খুব ছোট্ট হাউস এলফ জ্যান এর দিকে এগিয়ে গিয়ে শরীরের তুলনায় যথেষ্ট ভারি কণ্ঠস্বরে বললো, ‘মাস্টার আপনি, ইয়ে চাপড় মারলেন বুঝি?’

     জ্যান ফাঁকা কফি মগটা এলফটার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো, ‘ওহো এসে গেছো দেখছি। কফিটা দারুন হয়েছিল। এরকমই বানাবে সবসময়। এটা তোমার জন্য।’

     এলফটা জ্যানের দেওয়া কাগজের টুকরোটাকে ভালো করে দেখলো। চোখ তুলে তাকিয়ে বললো, ‘ধন্যবাদ মাষ্টার। আর কিছু লাগবে আপনার?’

     জ্যান হাত নেড়ে জানালো, ‘না থ্যাংকস। যাও এবার গিয়ে একটু ঘুমিয়ে নাও। তোমায় দেখে ক্লান্ত লাগছে।‘

     এলফটা একবার র‍্যালফকে দেখলো, একবার জেমসকে তারপর কাঁধ ঝাঁকিয়ে চেষ্টা করলো হাসার। চোখ দুটোকে নড়ানোর, পাঁচ ডলারের নোটটা ন্যাপকিনের ভেতর ঢুকিয়ে নিয়ে টেবিলের তলায় ঢুকে অদৃশ্য হয়ে গেল।

     জ্যান চিন্তান্বিত ভাবে বললো, ‘আমার তো এরকমই করা উচিত।’

     ‘আমার মনে হয় না হাউস এলফদের টিপস দেওয়াটা ঠিক হল’, র‍্যালফ বললো।

     ‘না দেওয়ার কোন কারণ তো নেই। আমার ড্যাড যখন কোথাও বেড়াতে যান সবাইকে টিপস দেন। উনি বলেন এটা একটা স্বাভাবিক ব্যাপার। আর এর ফলে ভালো সার্ভিস পাওয়া যায়।’

     ব্যাপারটা কি ঘটে গেল এটা বুঝতে পেরে এবার জেমস বললো, ‘তুমি একটা হাউস এলফকে কখনোই বলতে পারো না ঘুমাতে যাওয়ার জন্য।’

     ‘কেন, তাতে আবার কি হয়?’

     ‘হয় মানে, ওটা এবার ওই কাজটাই করবে মন দিয়ে!’ জেমস হতাশার সাথে বললো। ওর মনে পড়ে গেল ওদের নিজেদের বাড়ির এলফটার কথা। একটা দুঃখ দুঃখ মুখের এলফ যে সব সময়েই সুযোগ খুঁজে নিত ওকে যা বলা হবে তার বাইরে একফোঁটা কিছু না করার। তার মানে এই নয় যে জেমস ক্রিচারকে অপছন্দ করতো। আসলে ক্রিচারকে দিয়ে কাজ করানোর জন্য ঠিকঠাক ভাষা ব্যবহার করাটাও শিখতে হবে। ‘হাউস এলফরা শুধু মাত্র সেই কাজটাই করে যা ওদের মনিব করতে আদেশ দেন। এটাই ওদের স্বভাব। নিশ্চিত ও ব্যাটা এখন এই দিনের বেলাতেই ঘুমানোর একটা জায়গা খূঁজে নিতে ব্যস্ত।’ বলতে বলতেই জেমসের পুরো ব্যাপারটাই বেশ মজার মনে হল। ও চেষ্টা করছিল হাসি চাপার, কিন্তু তাতে ওর মুখের ভাব হাস্যকর হয়ে উঠছিল। আর সেটা লক্ষ্য করে জ্যান আঙুল তুলে খিলখিলিয়ে হেসে বললো, ‘হাঃ হাঃ! তোমারও হাসি পাচ্ছে তাই না পুরোটা ভাবলে।’

     র‍্যালফ ভুরু কূঁচকে বললো, ‘আমি কল্পনাই করতে পারছি না যে ওদের আমরা যা বলবো ওরা সেটাই করবে। অথচ আমরা একেবারে নতুন এখানে। প্রথম বার্ষিকী। আমরা কারো মালিকও না।’

     জেমস জ্যানের দিকে ঘুরে জানতে চাইলো, ‘সাব্রিনা উকেটটাকে রকেটের মত করার জন্য যে মন্ত্রটা বলে ছিল সেটা তোমার মনে আছে?’

     ‘ভিসাম ইনেপ্সিও’, গর্বের সাথে বললো জ্যান। ‘এর মানে হল ‘চোখকে ভুল দেখানো। তোমার ল্যাটিন পড়া থাকলে ঝট করে বুঝতে পারতে। হোরাস বলেছিল, ওটা মানুষকে সেটাই দেখতে সাহায্য করে যা সে দেখার কথা ভাবে।’

     জেমস বললো, ‘তারমানে আলোকস্তম্ভ নেমে আসছে দেখে ওই মানুষটা একটা এলিয়েন স্পেসশিপ দেখার কথা ভেবেছিল?’

     ‘অবশ্যই। সবাই জানে মাঝরাতে আকাশ থেকে সহসা আলোকস্তম্ভ নামার মানেই হলো সবুজ প্রানীরা আসছে।’

     ‘জ্যান, তুই একটা অদ্ভুত’, র‍্যালফ বললো, মোটেই প্রশংসা করে নয়।

     জেমসের মনে হল কেউ একজন ওর পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। তিনজনেই একসাথে মাথা ঘুরিয়ে তাকালো। গতকাল রাতের স্লীদারিন টেবিলের সেই মেয়েটি। যে জেমসের সর্টিং হ্যাট পড়ার আগে হাততালি দিচ্ছিল। এখন জেমসের দিকে তাকিয়ে শান্ত প্রশ্রয়ের দৃষ্টিতে। ওর সাথে আছে আরো দুজন। একটা দারূন সুন্দর দেখতে ছেলে, হাসছে ঝকঝকে সাদা দাঁত বার করে। অপরজন একটি মেয়ে, গম্ভীর। জেমসের বুকের ভেতর ধকধক করে উঠলো এটা বুঝে যে ও বসে আছে স্লিদারিনের টেবিলে। উঠে দাঁড়াবে কিনা ভাবছিল জেমস কারন ওর মুখে তখনো চিবাতে থাকা টোস্টএ ভর্তি।

     ‘আরে উঠতে হবে না!’ সুন্দরী স্লিদারিন তরুণী হাত তুলে বললো, জেমসকে। ‘আমি খুব খুশী হয়েছি এটা দেখে যে তুমি আমাদের সাথে স্লিদারিন টেবিলে বসেছো। তোমার বাবার সময়ের থেকে এখনকার সময় অনেক অনেক পালটে গেছে। হয়তো আমি একটু বেশীই ভেবে নিচ্ছি। মিঃ ডিডলে, তোমার বন্ধুদের সাথে আমাদের পরিচয় করিয়ে দাও?’

     র‍্যালফ থতমত ভাবে একটু কাশলো। ‘হ্যাঁ, এ হল আমার বন্ধু, জেমস পটার। আর ও জ্যান। ওর টাইটেলটা আমার মনে নেই। সরি।’ জ্যানের উদ্দেশ্যে বললো শেষ শব্দটা। জ্যান কাঁধ ঝাঁকিয়ে হাসলো, তারপর লাফিয়ে উঠে সোজা চলে এলো মেয়েটির কাছে বাড়িয়ে দিল হাত। হ্যান্ডশেক করার জন্য।

     ‘ওয়াকার। জ্যান ওয়াকার। আমি খুবই আনন্দিত এবং সম্মানিত বোধ করছি আপনার সান্নিধ্য পেয়ে মিস…’

     মেয়েটির হাসি একটু চওড়া হল, ঘাড় কাত করে তাকিয়েই থাকল র‍্যালফের দিকে।

     র‍্যালফ আবারো থতমত খেয়ে বললো, ‘ওহ, হ্যাঁ, মানে ইনি হলেন টাবিথা করসিকা। স্লিদারিন হাউসের প্রীফেক্ট, যতদূর জানি ষষ্ঠ বার্ষিকী ছাত্রী। স্লিদারিন কুইডিচ টিম ক্যাপ্টেন। ডিবেট টিমেরও। এবং, ওনার… একটা দারুন উড়ন্ত ঝাড়ূ আছে।’ হড়বড় করে এত গুলো কথা বলে র‍্যালফের সব এনার্জি শেষ বলেই মনে হল।

     টাবিথা এবার জ্যানের বাড়ানো হাতটা ধরল আলতো ভাবে এবং ছেড়েও দিল। ‘আমিও খুশী তোমাদের সঙ্গলাভে। মিঃ পটার নাকি জেমস কি বলে ডাকবো তোমাকে?’ জেমসের দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলো মধুক্ষরা কণ্ঠে।

     জেমস বুঝতে পারলো ওকে একটা কিছু জিজ্ঞাসা করা হয়েছে। মাথাটা একবার ঝাঁকিয়ে নিয়ে ও উত্তর দিল, ‘ইয়ে, জেমস বলেই ডাকুন।’

     ‘আমি আরো খুশী হবো যদি তুমি আমায় টাবিথা বলে ডাকো’, মিষ্টি একটা হাসির সাথে জানালো টাবিথা। ‘আমি স্লিদারিন হাউসের পক্ষ থেকে জানাতে চাই আমরা খুবই আনন্দিত যে তোমরা আমাদের এখানে এসেছো। আশা করবো অতীতে যে সমস্ত পক্ষপাত ছিল সেসব চিরকালের মতো সেখানেই থেকে যাবে।’ সঙ্গে থাকা দুই সঙ্গীর দিকে একবার করে তাকিয়ে নিয়ে বললো, ‘তোমার বাবার জন্য আমাদের মনে আছে কেবলই অগাধ শ্রদ্ধা ও সম্মান, তোমার জন্যেও তাই। আমরা কি, আশা করতে পারি যে আমরা সবাই বন্ধু হিসাবেই বিবেচিত হবো আজ থেকে?’

     টাবিথার সঙ্গী ছেলেটী একভাবেই হাসি মুখে তাকিয়ে ছিল জেমসের দিকে। বাঁদিকে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটি মনোযোগ দিয়ে টেবিলের একটি দাগ পর্যবেক্ষণ করে চলেছে ভাবলেশহীন মুখে।

     ‘অ-অবশ্যই। ব-বন্ধু নি- নিশ্চিত ভাবেই’, জেমস তোতলাচ্ছিল। বিশাল হলটার নীরবতায় ওর কণ্ঠস্বর শোনাই যাচ্ছিল না।

     টাবিথার হাসি আর প্রসারিত হলো। সবুজ চোখ ঝকমক করে উঠলো। ‘আমি দারুন আনন্দ পেলাম তুমি এটা মেনে নেওয়ায়। নাও এবার তোমরা তোমাদের,ইয়ে, ব্রেকফাস্টটা সেরে নাও। টম, ফিলিয়া চল আমরা যাই।’

     তিনজন একসাথে ঘুরে এগিয়ে গেল দুসারি চেয়ারের মধ্যের পথ ধরে চলে গেল।

     স্লিদারিনরা অনেকটা দূর চলে যাওয়ার পর র‍্যালফ জানতে চাইলো, ‘তুই কি মেনে নিলি ?’

     টাবিথার পোষাকের নড়া চড়ার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে জ্যান উত্তর দিল, ‘জেমস একজন দারুন বন্ধু পেল অথবা একজন জমকালো শত্রুর মুখোমুখি হল আজ। আমি বুঝিয়ে ঠিকঠাক বলতে পারবোনা কেন আমার এরকম মনে হচ্ছে।’

     জেমস গভীর ভাবনায় ডুবে গেল। ড্যাড আর মাম এর সময়ের তুলনায় অনেক কিছুই পাল্টেছে। কিন্তু নিশ্চিত করে বলা যায় না সেগুলো ভালো না মন্দ।

সকালের বাকি সময়টা ওরা তিনজন স্কুল চত্বরটা ঘুরে ফিরে দেখাতেই কাটিয়ে দিল। কুইডিচ মাঠে গেল, উজ্জ্বল সূর্যালোকে যেটাকে গত রাতের তুলনায় একেবারে অন্য রকম মনে হল জেমস আর জ্যানের। জ্যানের মুখ হাঁ হয়ে গিয়েছিল পুরনো ছাত্রদের থ্রি অন থ্রি কুইডিচ ম্যাচে খেলোয়ারদের কলা কৌশল, গতি, চিৎকার, খেলার স্ট্রাটেজী দেখে।

     ‘সাঙ্ঘাতিক!’ জ্যান চেঁচিয়ে উঠলো উল্লাসে, একজন খেলুড়ে আর একজন কে ব্লাজার দিয়ে মাথায় সজোরে আঘাত করলো দেখে। ঘা খাওয়া খেলোয়ারটা উড়ন্ত ঝাড়ুসহ শূন্যে একপাক ঘুড়ে গেল বিপদজনক ভাবে। ‘এতো রাগবী ম্যাচের থেকেও উত্তেজনার।’

     ওরা হ্যাগ্রিডের কটেজটার পাশ দিয়ে গেল, যেটা ফাঁকা এবং ভেতরটা অন্ধকার বলেই মনে হল জেমসের। চিমনী দিয়েও ধোঁয়া বার হচ্ছে না। দরজাটাও চেপে বন্ধ করা আছে। একটু বাদেই ওদের দেখা হল টেড লুপিন আর নোয়া মেটজকার এর সাথে, ওরা ওদের নিয়ে গেল নিষিদ্ধ অরন্যের ধারে। একটা দৈত্যাকার প্রাচীন উইলো গাছের দেখা পেল ওরা যা প্রায় অরন্যের সীমানা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। টেড জেমসের হাতটা চেপে ধরলো এবং র‍্যালফকে থামালো আর এগিয়ে যাওয়া থেকে।

     ‘উঁহু অত কাছে যেও না বন্ধু’, টেড বললো, ‘দ্যাখো এবার কি করি।’

     সাথে নিয়ে আশা বড়সড় লন্ড্রি ব্যাগের মুখটা খুলে টেড একটা জিনিষ বার করলো। যেটা দেখতে মোটামুটি চারপেয়ে একটা প্রানীর মত, ঠোঁট ও ডানা আছে। বিভিন্ন রঙের কাগজ ওটার ওপর সাঁটানো। হাল্কা হাওয়ার নড়াচড়ায় যাদের রঙ বদল হচ্ছে।

     ‘আরে বাহ! এটাতো একটা পিনাটা! পার্টি হলে বানানো হয়। যার মধ্যে অনেক কিছু থাকে।’ জ্যান বলো। ‘এটার আকৃতিটা… আরে ওই যে… কেও বলবে না, কিন্তু… স্ফিঙ্কসোর‍্যাপ্টরের মত!’

     জেমস হাসতে হাসতে বললো, ‘এটা একটা হিপ্পোগ্রিফ।’

     র‍্যালফ বলল, ‘আমার জ্যান এর বলা নামটাই পছন্দ।’

     নোয়াও সম্মতি জানালো র‍্যালফকে।

     টেড হাত তুলে বললো, ‘একদম চুপ। কোন শব্দ নয়।’ তারপর পিনাটাটাকে হাতে নিয়ে যতটা জোরে সম্ভব ছুঁড়ে দিল উইলো গাছটার ঝুলে থাকা ডালগুলোর দিকে। ঘন পাতাগুলোর আড়ালে ওটা চকিতে অদৃশ্য হয়ে গেল। খানিকক্ষণ কিছুই হল না। তারপরেই শুরু হল এক আলোড়ন চাবুক সদৃশ শাখায় শাখায়। ওগুলো এমন ভাবে ঝাপ্টাচ্ছিল যেন বিরাট একটা কিছু ভেতরে ঢুকেছে ও নড়ে চড়ে বেড়াচ্ছে। সহসাই গাছটায় যেন বিস্ফোরণ ঘটলো। পাগলের মতো পাতাগুলো এদিক ওদিক করছিল, কোঁথাচ্ছিল, চ্যাঁচাচ্ছিল। একটা দারুন ঝড় যেন বয়ে যাচ্ছিল ওটার ওপর দিয়ে। আর খানিকটা সময় পরে পিনাটাটাকে দেখা গেল। ডজন খানেক সরু ডাল ওটাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছে। হঠাৎই সব বাঁধন যেন ছিঁড়ে গেল। পিনাটার মধ্যে থাকা বালাস্টিক চার্ম যেই তার কাজ করলো সাথে সাথেই একরাশ বিভিন্ন রঙের কাগজএবং উইজার্ড ক্যান্ডি ছিটকে বেরিয়ে এলো ওটার ভেতর থেকে। কনফেট্টি আর ক্যান্ডি ছড়িয়ে পড়লো গাছটার গায়ে এবং চারিপাশে। গাছটা যেন হতভম্ব হয়ে গেল এই ঘটনায়, থমকে গেল। তারপর ফিরে এলো নিজের স্বাভাবিক শান্ত রুপে।

     টেড আর নোয়া হাসির চোটে গড়াগড়ি দিচ্ছিল প্রায়। ‘স্ফিঙ্কসোর‍্যাপ্টরের মৃত্যুতে আমরা গভীর শোক প্রকাশ করছি।’ নোয়া বললো ছদ্মগম্ভীরভাবে। জেমস শুনেছিল হুম্পিং উইলো গাছের কথা, একই সাথে ওটার নিষ্ঠুরতার দিক এবং গ্রিফিন্ডোরদের সেটাকে নিয়ে মজা করা ওকে আবিষ্ট করে দিল। জ্যান আর র‍্যালফতো হাঁ হয়ে গেছে রকমসকম দেখে। না দেখেই নিজের মাথার চুলের ভেতের থেকে একটা এভরি ফ্লেভার বীন বার করে মুখে চালান করে দিল। কিছুটা সময় ধরে মনোযোগ দিয়ে ওটা চিবানোর পর জেমসের দিকে তাকিয়ে বল লো, ‘একেবারে ট্যাকোর স্বাদ, কুউ-ল!’

     আরো কিছুটা সময় বাদে জেমস কে দেখা গেল সিঁড়ি দিয়ে ঊঠে গ্রীফিন্ডোর কমন রুমের দিকে যেতে।

     ‘পাসওয়ার্ড’, জানতে চাইলেন স্থূলকায় মহিলা।

     ‘জেনিসোলারিস’, ও উত্তর দিল, এখনো ওটা বদলায়নি আশা করে।

     ‘চলে যাও ভেতরে’, ছবি থেকে উত্তর এলো।

     কমন রুমটা এখন ফাঁকা, ফায়ারপ্লেসের আগুন নিভে গেছে। জেমস এগিয়ে গেল শোওয়ার ঘরের দিকে নিজের বিছানা লক্ষ্য করে। যদিও এখন দ্বিপ্রহর, যথেষ্টই ঠান্ডা তবুও ও বেশ একটা উষ্ণতা অনুভব করলো আপন স্থানের। বিছানাটা সাজিয়ে রাখা আছে নিটোল ভাবে। নবি, জেমসের বিরাট বাদামী লক্ষীপ্যাঁচাটা ঘুমাচ্ছে নিজের খাঁচার মধ্যে পাখনায় মুখ গুঁজে। জেমস বিছানায় উঠে এক টুকরো পারচমেন্ট আর কলম নিয়ে শুরু করলো লেখা। অতি সাবধানে যাতে কালি ছিটকে না পড়ে কম্বলের ওপর।

     ডিয়ার মাম ও ড্যাড,

          গত রাতে এখনে পৌঁছে গেছি। কোন সমস্যা হয়নি। দারুন কিছু নতুন বন্ধু পেয়ে গেছি এর মধ্যেই। যার মধ্যে র‍্যালফ এর জায়গা হয়েছে স্লিদারিনে, যা আমি ভাবতেও পারিনি। জ্যান র‍্যাভেনক্ল এর সদস্য হয়েছে। ও একেবারে আঙ্কল রনের মত পাগলাটে। ওরা দুজনেই মাগল। যে কারনে পড়াশোনা শুরু হওয়ার আগেই আমি অনেক কিছু শিখে ফেলেছি। ওদের সাহায্যে মাগল স্টাডির ক্লাসগুলো ভালোভাবেই উতড়ে যাবো বুঝতেই পারছি। মাম, টেড আমাকে হুম্পিং উইলো দেখিয়েছে, আমরা অবশ্য ওটার বেশী কাছে যাইনি। বেশ কিছু নতুন শিক্ষক দেখলাম। নেভিলকেও দেখেছি, কিন্তু সাক্ষাৎ করে তোমাদের শুভেচ্ছা জানানোর সুযোগ হয়নি। ওহ লিখতেই ভুলে যাচ্ছিলাম, আমেরিকান উইজার্ডদের একটা দল আজ বিকেলে এখানে আসছে। জ্যান যেহেতু ওখানকার ছেলে ফলে ব্যাপারটা বেশ মজার হবে। অনেক কথা বলার আছে। পরে জানাবো।

          তোমার … জেমস

          পুনঃ আমি এখন একজন গ্রিফিন্ডোর।

     স্মিত হাসি মুখে ঝুলিয়ে গর্বের সাথে চিঠিটা ভাঁজ করে সিল করলো। ও যে গ্রীফিন্ডোরেই স্থান পেয়েছে এটা মাম আর ড্যাড কে কিভাবে জানাবে এই নিয়ে অনেকক্ষন থেকে ভাবছিল। তারপর সরাসরি জানিয়ে দেওয়ার ব্যাপারটাই ওর সেরা মনে হয় [অনেকেই অপেক্ষা করে আছে ওটা ওর মা বাবার কাছ থেকে জানার জন্য।]

     ‘হেই নবি,’ জেমস ফিসফিস করে ডাকলো। পাখীটা মাথাটা অর্ধেক ওঠালো, একটা বড় কমলা রঙের চোখ খুলে তাকালো। ‘একটা চিঠি আছে, দিয়ে আসতে হবে। বাড়ি যেতে তোর ভালোই লাগবে কি বলিস?’

     নবি আড়মুড়ি ভাঙলো, শরীর ফুলালো এতটা যে ওকে নিজের শরীরের ডাবল মাপের মনে হচ্ছিল। তারপর একটা পা বাড়িয়ে দিল বাইরের দিকে। জেমস নবির খাঁচা খুলে চিঠিটা আটকে দিল। প্যাঁচাটা সাবধানে ঊড়ে গেল জানলার কাছে। পাখা বিস্তার করলো, তারপর অতি সহজে ঝাঁপিয়ে পড়লো ঝলমলে সূর্যালোকিত আকাশের বুকে। জেমস সহসাই দারুন পুলক অনুভব করছিল, তাকিয়ে থাকলো নবির উড়ে দূরে নীল পাহাড়ের চূড়াতে মিলিয়ে যাওয়ার দিকে। তারপর শিস দিতে দিতে বেরিয়ে এলো ঘর থেকে, নামতে থাকলো সিঁড়ি দিয়ে।

     গ্রিফিন্ডোরের টেবিলে বসে লাঞ্চ করার পর দেখা হল জ্যান আর র‍্যালফের সাথে। বাকি শিক্ষার্থীরা তখন রেডি হচ্ছে প্রধান চত্বরে যাওয়ার জন্য। ইউনাইটেড স্টেটস এর অতিথিদের আগমনের সময়ে আমেরিকান জাতীয় সঙ্গীত বাজানোর জন্য স্টুডেন্টদের ছোট্ট অর্কেস্ট্রার দলটাও একত্র হচ্ছে। শোনা যাচ্ছে একটা মিশ্রিত বাজনার জগঝম্প। জ্যান বললো ও এই প্রথম ব্যাগপাইপ আর অ্যাকরডিয়ানে “স্টার স্প্যাংগল্ড ব্যানার” বাজতে শুনবে। চত্বরটা ভর্তি হয়ে চলেছে একটু একটু করে। অবশেষে প্রফেঃ লঙবটম এবং আর একজন জেমসের অজানা প্রফেসর শিক্ষার্থীদের সংঘবদ্ধ ভাবে দাঁড় করাতে শুরু করলেন। জেমস, জ্যান আর র‍্যালফ এর জায়গা হলো এক্কেবারে গ্রেট ফ্রন্টগেটের কাছেই। শুরু হল অপেক্ষা একটা দারুন কিছু দেখতে পাওয়ার আশা নিয়ে। জেমসের মনে পড়লো বাবা মার কাছে শোনা ট্রাই উইজার্ড কাপে খেলতে আসা বিঊব্যাটন আর ড্রামশট্র্যাং ডেলিগেটদের কথাগুলো – বিশালাকায় ঘোড়ায় টানা ঊড়ন্ত গাড়িতে এসেছিল প্রথম দলটি। আর দ্বিতীয় দলটা এসেছিল রহস্যময় সাবমেরিনে করে। ওর মন এখন চিন্তায় মশগুল আমেরিকানরা কিভাবে আসতে পারে এই কল্পনায়।

     উপস্থিত জনতাও অধীর আগ্রহে গুঞ্জনে রত। অর্কেস্ট্রা রেডি একটা ছোট্ট ঘাস দিয়ে তৈরী বেদীর ওপর, বাজনা গুলো চকচক করছে বিকেলের হলদেটে আলোতে। মেন হলে ঢোকার মুখের গাড়িবারান্দায় অপেক্ষমাণ হেডমিস্ট্রেস ম্যাকগনাগল ও বাকি শিক্ষকশিক্ষিকারা। সবার চোখ আকাশের দিকে।

     অবশেষে কেউ কিছু একটা দেখাতেই জনতার চিৎকার ধ্বনিত হলো। সবাই তাকালো একই দিকে, দূরের কিছু দেখার জন্য চোখ মুখ কুঁচকে। দূরে পাহাড়ের চুড়ার সোনালী আলোর দিকে তাকালো জেমসও। একটা বিন্দু, ক্রমশ বড় হচ্ছে এগিয়ে আসছে। দেখতে দেখতে আর দুটো বিন্দু দেখা গেল, প্রথমটাকে অনুসরণ করে এগিয়ে আসছে। চত্বরটায় ধ্বনিত হচ্ছে এক ধাতব শব্দ ওই আসতে থাকা জিনিষগুলো থেকে। জেমস জ্যানের দিকে তাকালো, যার চোখে মুখে বিস্ময় পরিষ্কার। যে শব্দটা ভেসে আসছিল তা মৌমাছির গুনগুন এর মতো তবে অনেক বেশী জমকসহ। দারুন গতিতে ওগুলো এগিয়ে আসছিল চত্বরটা লক্ষ্য করে। সহসাই যেন শব্দর মাত্রা কমে গেল, মনে হচ্ছে দৈত্যাকার কোন পোকা যেন নিজের ডানা কাঁপাচ্ছে। জেমস দেখলো বস্তুগুলো এবার প্রায় মাটি ছুঁতে চলেছে, ওদের ছায়া স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে ঘাসজমিতে।

     ‘কু-উ-ল! আরে বাহ ওগুলো তো গাড়ি!’, জ্যান চেঁচিয়ে বলে উঠলো।

     জেমস শুনেছিল ওর দাদুর মন্ত্রপূত ফোরড অ্যাংলিয়া গাড়িটার কথা। যেটা একবার আঙ্কল রন আর ওর ড্যাড ঊড়িয়ে নিয়ে এসেছিল হগওয়ারটসে এবং ঘটনাচক্রে ওটাকে ফেলে আসতে বাধ্য হয় নিষিদ্ধ অরন্যে। তারপর আর ওটাকে খুঁজে পাওয়া যায় নি। এগুলো অবশ্য ওটার মতো নয়। জেমস অ্যাংলিয়ার যে ছবি দেখেছিল তার তুলনায় এগুলো অনেক বেশী চকচকে আর পরিপাটি। ওগুলোর গায়ে আলো ঠিকরে পড়ছে চারদিকের চত্বরে। আর একটা পার্থক্য হল প্রত্যেকটা গাড়ির দুটো করে ডানা বেরিয়ে আছে মঝখান থেকে যা অ্যাংলিয়ার ছিল না। যেগুলোতে রামধনুর সাত রং প্রতিফলিত হচ্ছে একঘেয়ে কাঁপুনির সাথে।

     ‘ওটা একটা ডজ হরনেট!’ জ্যান বললো, প্রথম যেটা নামলো সেটার দিকে আঙুল তুলে। সামনের দুটো চাকা আগে মাটি ছুঁলো ওটার। খানিকটা এগিয়ে গেল ঐভাবেই তারপর পেছন দিকটাও নেমে এলো জমির ওপর। দুটো দরজা। ঝকমকে হলুদ রঙ। সাথেই দুটো বোলতার মত ডানা। জ্যানের কথা মতো দ্বিতীয়টা, মনে হচ্ছে ও এসব ব্যাপারে এক্সপার্ট, স্টুটজ ড্রাগনফ্লাই। বটল গ্রীন কালার, উচ্চতায় খাটো, অনেকটা লম্বা, সামনের হলদেটে মাডগারড বেঁকে সরু হয়ে ওপরে গিয়ে মুকুটের রুপ নিয়েছে। এটার পাখনাগুলোও বেশ বড় এবং প্রান্তসীমা সরু। যার কাঁপুনির রণন জেমসের বুকের ভেতরে অনুভুত হচ্ছে। শেষ যেটা নেমে এলো সেটাকে চেনার জন্য জ্যানের দরকার পড়ল না। ও জানে ওটার নাম ভক্সওয়াগন বীটল। আগুন লাল রঙা গাড়িটার গোলাকৃতি শরীরটা নামার আগে স্থির হয়ে না থেকে আগে পিছে নড়ছিল। সাথেই কম্পনরত ডানাদুটো সমেত ওটাকে আসল বীটলের মতই দেখতে লাগছিল। মাটি ছোঁয়ার পর ডানা দুটোর কম্পন থামলো এবং ধীরে ধীরে গুটিয়ে ঢুকে গেল নির্দিষ্ট খোপে।

     হগওয়ারটস এর সদস্যদের উল্লসিত চিৎকারের সাথে সাথেই বেজে উঠলো অর্কেস্ট্রা। জেমসের পেছন থেকে একটি মেয়ের তির্যক উক্তি ভেসে এলো, ‘আমেরিকান্স আর ওদের যন্ত্রসম্ভার!’

     জ্যান ঘুরে তাকালো মেয়েটার দিকে। ‘শেষেরটা কিন্তু জার্মানির। আমার মনে হয় এটা তোমার জানা আছে।’ তারপর একটু হেসে মন দিল অতিথি দেখায়।

     আমেরিকান জাতীয় সংগীত শুরু করেছে অর্কেস্ট্রার দলটি। ওদিকে খুলে গেছে গাড়িগুলির দরজা, এক এক করে বেরিয়ে আসছেন অতিথিগন। একই রকম দেখতে একজন করে উইজার্ড প্রথমে বেরিয়ে এলেন এক একটি গাড়ি থেকে। পরনে থাই পর্যন্ত ঝুলের কালছে ধূসর সবজে রঙের ক্লোক, কালো হাফহাতা জামা উঁচু সাদা কলার, ছাই রঙা প্যান্ট, সাদা মোজা ও কালো জুতো। প্রায় তিরিশ সেকেন্ড ধরে তারা উপস্থিত জনতাকে চোখ পিটপিট করে দেখলেন পর্যবেক্ষণের মতন করে। তারপর চত্বরটির নিরাপত্তা বিষয়ে সন্তুষ্টি লাভ করে দরজা ছেড়ে খানিকটা পিছিয়ে গিয়ে প্রহরীর মত দন্ডায়মান হলেন। একেবারে কাছের গাড়িটি বীটল, জেমস ওটার ভেতরটার কিছুটা দেখতে পাচ্ছিল। কিছু অবয়ব ওখানে নড়াচড়া করছিল। এবার শুরু হল তাদের বাইরে বেরিয়ে আসা।

     এতজন ওটার ভেতর থেকে বার হল যে জেমসও চমকে গেল। ও বেশ কয়েকবার উইজার্ড টেন্টে থেকেছে, ফলে ও ভালোমতো জানে যে সাধারন চোখে দেখা একটা স্থান উইজার্ড স্পেস রুপে কতটা বড় হতে পারে। বার্গান্ডি রঙের ক্লোক পড়া মালবাহকের দল চলে গেল গাড়িগুলোর বুট থেকে জিনিষপত্র নামানোর জন্য। ছোট ছোট ঠেলা গাড়ির আবির্ভাব ঘটিয়ে তার ওপরে চাপিয়ে নিলো অগুন্তি ট্রাঙ্ক আর বাক্স। তরুণ উইচ আর উইজার্ডদের পরনে একেবারে সাধারন পোষাক। কেউ কেউ তো জিন্স পড়ে আছে, চোখে সানগ্লাস। চত্বরটির মাঝে বাড়ছিল ওদের সংখ্যা। হাল্কা ছাইরঙা ক্লোক আর টিউনিক পরিহিত আমেরিকান ডিপার্টমেন্ট অফ ম্যাজিক্যাল অ্যাডমিনিশট্রেশনের বয়স্ক উইচ আর উইজার্ডদের সহজেই চেনা গেল। ওরা নেমেই আগে হেসে হাত নাড়ালেন গাড়ি বারান্দার কাছে দাঁড়িয়ে থাকা মিসেস ম্যাকগনাগল এবং বাকি টিচিং স্টাফের উদ্দেশ্যে।

     সবশেষে গাড়ি গুলো থেকে যারা নামলেন তারা বয়স্ক, কিন্তু তাদের পোষাক আর বয়সের মাত্রা থেকে বোঝা গেল এরা শিক্ষার্থী বা ডিপার্টমেন্ট অফিসিয়াল নন। জেমস অনুমান করলো এরাই আমেরিকান উইজার্ডিং স্কুল আল্মা আলেরনের শিক্ষকবৃন্দ। এক একটি গাড়ি থেকে এক একজন নেমে এলেন। বীটল থেকে যিনি নামলেন, শক্তপোক্ত ব্যারেল সদৃশ চেহারা, লম্বা ছাই রঙা চুল পাট করে আঁচড়ানো। চৌকোনা মুখ। চোখে চারকোনা ছোট চশমা। এক ঔদ্ধত্যের হাসি ছড়িয়ে উনি তাকালেন হগওয়ারটসের জনতার দিকে। কার সঙ্গে যেন জেমস ওর মিল খুঁজে পাচ্ছিল, ঠিকমত মনে করতে পারলো না। জেমস এবার তাকালো দ্বিতীয় প্রফেসরটির দিকে, যিনি স্টুটজ ড্রাগনফ্লাই থেকে বের হয়ে এলেন। যথেষ্টই লম্বা, সাদা চুল, লম্বাটে ফ্যাকাশে নির্মম মুখ, হাসির লেস মাত্র নেই। দেখলেন সবাইকে একঝলক। ওনার কপালের ওপর কালো রঙের ভুরু দুটো নড়ছিল শুঁয়োপোকার মত। একজন মালবাহক হাজির হলো, এগিয়ে ধরলো একটা কালো চামড়ার স্যুটকেশ। না দেখেই উনি ওটা ধরে নিলেন নিজের মোটা গাঁটওয়ালা আঙুল দিয়ে। তারপর এগিয়ে গেলেন গাড়ি বারান্দার দিকে দ্রুতগামী জাহাজের মত।

     জ্যান চাপা গলায় বললো, ‘আমার নিউইয়ার রেজ্যুলিউশন হবে এর সাথে কোন ক্লাস না করার।’ র‍্যালফ আর জেমসও মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো।

     জেমস এবার দেখতে পেল তৃতীয় প্রফেসর যিনি এসেছেন আল্মা আলেরন থেকে। একজন মহিলা, নামলেন ডজ হরনেট থেকে। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে ধীর ভাবে মাথা ঘোরালেন, মনে হল উনি প্রত্যেকটা মানুষকে গেঁথে নিলেন মনের খাতায়। জেমস ঢোক গিলে, কিছু না ভেবেই, ও র‍্যালফের পেছনে সরে গেল। উঁকি মেরে দেখতে থাকলো কাঁধের ওপর দিয়ে।

     ‘কি ব্যাপার? কি হলোটা কি?’ র‍্যালফ তেরছাভাবে জেমসকে দেখার চেষ্টা করে জানতে চাইলো।

     জেমস উপস্থিত জনতার দিকে তাকালো। মহিলাটি মোটেই ওর দিকে তাকাচ্ছিলেন না। মনে হচ্ছিল উনি যেন কাঊকেই দেখছেন না, যদিও ওনার মুখে এক খোঁজের ছাপ স্পষ্ট প্রতিভাত হচ্ছিল। ‘ওই যে লম্বা মহিলাটি। স্কার্ফ জড়ানো আছে মাথার ওপর দিয়ে। আমি ওকে দেখেছি লেকের ওপর এখানে আসার দিন।‘

     জ্যান বুড়ো আঙ্গুলের ওপর ভর দিয়ে উঁচু হয়ে দেখতে দেখতে বললো, ‘একে দেখতে একেবারে জিপ্সী মাম্মিদের মতো।’

     ‘হুম,’ জেমস বললো, নিজেকে কেমন বোকা বোকা মনে হচ্ছিল। স্কার্ফ পড়া মহিলাটিকে অনেক বেশী বয়সের মনে হচ্ছে ওই রাতের মেয়েটির তুলনায়। চোখ দুটো ফ্যাকাশে ধূসর। কালছে মুখাবয়ব বলি রেখাঙ্কিত এবং শীর্ণ হাড় সর্বস্ব। মালবাহক ওনার হাতে একটি লম্বা বেতের লাঠি ধরিয়ে দিতেই উনি মাথা ঝুঁকিয়ে কৃতজ্ঞতা জানালেন। তারপর লাঠিটা ঠুকে ঠুকে রাস্তা বুঝে নিয়ে ধীর পায়ে এগোতে থাকলেন।

     ‘দেখে মনে হচ্ছে উনি বাদুড়ের মতই দৃষ্টিহীন,’ জ্যান বললো দ্বিধা জড়ানো কণ্ঠে। ‘আমার মনে হয় তুমি সেদিন অন্যকিছু দেখেছিলে। এক্কেবারে গুলিয়ে ফেলেছো সব।’

     চৌকো চশমা পড়া অবয়বটির দিকে নির্দেশ করে র‍্যালফ হঠাৎ আবেগ মিশ্রিত গলায় বলো, ‘ওই শিক্ষকটিকে তোমরা চিনতে পেরেছ?’ তোতলাতে শুরু করলো প্রায়, ‘ওই যে…! ওই যে …! উনি সেই পঞ্চম …না! ধুর মনে পড়ছে না… দাঁড়াও বলছি, পঞ্চাশের।।!’

     জ্যান গাড়ি বারান্দার দিকে তাকিয়ে বললো, ‘জন লেননের মত চশমা পড়া আর অদ্ভুত জামার কলারওয়ালা ওই ছোট্ট মানুষটাতো?’

     ‘হ্যাঁ!’ র‍্যালফ উত্তেজনায় ছটফট করতে করতে জ্যান এর দিকে এগিয়ে গেল যেন মাথার ভেতর থেকে নামটা বার করতে ওরই সাহায্য নিতে হবে ওকে। ‘আরে … ও…হো…কি যেন নামটা? উনি নোটে আছেন!’

     র‍্যালফের পিঠে একটা চাপড় কষিয়ে জ্যান বললো, ‘কি সব অদ্ভুত কথা বার্তা বলছো, র‍্যালফ।’

     ওদিকে প্রফেঃ ম্যাকগনাগল নিজের কণ্ঠে জাদুদন্ডটা ঠেকিয়ে নিলেন, যাতে ওনার বক্তব্য সমগ্র চত্বরটার প্রতি প্রান্তে পৌছায়, বলতে শুরু করলেন, ‘সমস্ত শিক্ষার্থী, সহ-প্রফেসরগন এবং হগওয়ারটসের সমস্ত কর্মচারীবৃন্দকে অনুরোধ জানাচ্ছি আল্মা আলেরন এবং ইউনাইটেড স্টেটস ডিপারটমেন্ট অফ ম্যাজিক্যাল অ্যাডমিনিস্টেশন থেকে আগত প্রতিনিধিদের স্বাগত জানানোর এই অনুষ্ঠানে আমার সাথে সামিল হওয়ার জন্য।

     উচ্ছাসের একটা গর্জন গোটা চত্বরটাকে কাঁপিয়ে দিল। বুঝতে ভুল করে অর্কেস্ট্রার দলটি আবার জাতীয় সংগীতটা বাজাতে শুরু করে দেওয়ার প্রফেঃ ফ্লিটউইক ওদের থামালেন।

     ‘সম্মাননীয় অতিথিগন’, সদ্য আগতদের দিকে সামান্য ঝুঁকে হেড মিস্ট্রেস আবার বলা শুরু করলেন, ‘ধন্যবাদ আপনাদের আমাদের সাথে যোগদান করার জন্য। আগামী একবছরের দিকে আমরা তাকিয়ে থাকবো, আমাদের মধ্যে সাংস্কৃতিক ও পারস্পরিক শিক্ষা আদানপ্রদানের সাফল্য কামনায়। আশা করবো এক দীর্ঘকালীন এবং সংবদ্ধ বন্ধুত্ব গড়ে উঠবে আমাদের মধ্যে। মাননীয় আল্মা আলেরনের অতিথিগন আমি আপনাদের পরিচিত করিয়ে দিতে চাই আপনাদের নতুন শিক্ষার্থীদের সাথে। দয়া করে সামনের দিকে একটু এগিয়ে আসুন।’

     জেমসের ধারনা হয়েছিল ওই লম্বা প্রফেসরটি এদের লিডার, কিন্তু বাস্তবে তা মিললো না। বরং গাঁট্টাগোট্টা চৌকো চশমা পড়া উইজার্ড এগিয়ে এলেন এবং হেডমিস্ট্রেসকে আনত হয়ে সম্মান দেখিয়ে ঘুরে দাঁড়ালেন ভিড়ের দিকে। উনি জাদুদন্ড ব্যবহার করলেন না। যথেষ্টই পরিষ্কার এবং উচ্চসুরে বাঁধা ওনার কণ্ঠস্বর। বোঝাই গেল এরকম ভাবে বলাতেই উনি অভ্যস্ত।

     ‘হগোয়ারটসের ছাত্রছাত্রী বৃন্দ, সমস্ত সহ শিক্ষকগন এবং বন্ধুরা, অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাদের উষ্ণ অভিনন্দনের জন্য। আমরা এরকম কিছু আশা করেই আসিনি। সত্যি করেই আমরা এত জমকদার কিছু চাইনি।’ হাসলেন এবং চোখ টিপলেন ভিড়কে লক্ষ্য করে। ‘আমরা দারুন রোমাঞ্চিত এই বছরে এই স্কুলের সাথে যুক্ত হতে পেরে। আর এটা না বলে পারছি না যে এই শিক্ষাটা হবে উভয় তরফের জন্যই। এই মুহূর্তে আমি এখানে দাঁড়িয়ে অজস্র উদাহরণ পেশ করতে পারি ইউরোপীয়ান এবং আমেরিকান ম্যাজিক্যাল জগতের মিল ও অমিল বিষয়ে, এবং এটাও জানি আগামীদিন গুলোতে হয়তো এসব নিয়ে অনেক আলোচনার সূত্রপাত হবে, যা চলতেই থাকবে…’ আবার হাসলেন উনি এবং হাল্কাচ্ছলে বললেন, ‘আমি অবশ্য এখনই দেখতে পাচ্ছি আমার সাথে আসা ছাত্রছাত্রীরা ইতিমধ্যেই উদগ্রীব হয়ে উঠেছে তাদের পুরনো ধ্যানধারনা ছুঁড়ে ফেলে দেওয়ার জন্য। মনে হচ্ছে আমার হগোয়ারটসের বন্ধুরাও সেরকম কিছু একটাই চাইছেন। এবার বেশী কথা না বাড়িয়ে আমি জানিয়ে দিতে চাই আমরা কে কোন বিষয়ে শিক্ষাদান করবো।’

     জেমস শুনতে পেল টেডের গলা, ‘আমার এই মানুষটিকে দারুন পছন্দ হয়েছে।’

     উচ্চকণ্ঠে অতিথি প্রফেসর বললেন, ‘আসুন চিনে নেওয়া যাক আমাদের টেকনোম্যান্সি অ্যান্ড অ্যাপ্লায়েড ম্যাজিকের শিক্ষাদাতা মাননীয় মিঃ থিওডোর হিরশাল জ্যাক্সনকে। উনি একসময় থ্রী স্টার জেনেরাল ছিলেন সালেম-দারগাস ফ্রি মিলিশিয়াতে, যে কারনে আমার আবেদন তোমাদের কাছে, যখনই তোমরা ওকে ডাকবে ‘স্যার’ কথাটা অবশ্যই জুড়ে দেবে।’

     প্রফেঃ জ্যাক্সনের মুখটা গ্রানাঈট পাথরের মতই ভাবলেশহীন থেকে গেল বক্তার লঘু মন্তব্যর পরেও। উনি বেশ আকর্ষণীয় ভাবে বো করলেন, থুতনি উঁচু আর চোখের দৃষ্টিকে দূরপ্রান্তে নিবদ্ধ রেখে।

     বক্তা এবার হাত তুলে দেখিয়ে বললেন, ‘মিঃ জ্যাক্সনের পাশে যিনি আছেন উনি প্রফেসর অফ ডিভাইনেশন, আডভ্যান্সড এনচ্যানমেন্টস অ্যান্ড রিমোট প্যারসাইকোলজি, মাননীয়া ডেসডিমোনা ডেলাক্রয়। উনি আবার খুব ভালো সুস্বাদু গাম্বো বানাতেও ওস্তাদ। আশা করছি তোমাদেরও সৌভাগ্য হবে সেই স্বাদ গ্রহনের।’

     স্কার্ফ দিয়ে মাথা ঢাকা মহিলাটি বক্তার দিকে তাকিয়ে হাসলেন। যে হাসিটা ওনার হাড় সর্বস্ব মুখাবয়বে প্রতিভাত হল দুষ্টুমি ভরা কোন ঠাকুমার মতো। উনি ঘুরলেন, ওনার দৃষ্টিহীন চোখদুটো ভিড়ের দিকে নিবদ্ধ হলেও কোন নির্দিষ্ট লক্ষ্যে ছিল না। মুখে সেই আগের মতই হাসি। জেমসের অবাকই হলো এটা ভেবে যে সে কি করে এই অন্ধ মহিলার সাথে সেদিন রাতে লেকের ওপর দেখা অবয়বটিকে এক করে ভাবছিল। তার ওপর ইনি আজই এলেন। গত রাতে ওনার এখানে থাকার কোন সম্ভাবনাই নেই।

     ‘এবার সবশেষে’, বক্তা প্রফেসর বললেন, ‘এই অধম, নিজেকে আপনাদের সামনে পেশ করছে। আমি তোমাদের নতুন ডিফেন্স এগেইন্সট ডার্ক আর্টস এর শিক্ষক, আল্মা আলেরনের ডিবেট টিমের প্রধান, এবং আনঅফিসিয়ালি কিন্তু হতে চাই, উইজার্ড দাবার আগামী খেতাবের দাবিদার। বেঞ্জামিন আমেদিউস ফ্র্যাঙ্কলিন, আপনাদের সেবায় হাজির।’ দুপাশে হাত ছড়িয়ে উনি আনত হলেন, ওনার ছাইরঙা চুল ঝুলে পড়লো সামনের দিকে।

     ‘এই সেই মানুষটা যার কথা আমি মনে করার চেষ্টা করছিলাম!’ র‍্যালফ ফিস ফিসিয়ে বললো। ‘উনি সেই লোকটাই যিনি তোমার ডলারে আছেন!’ জ্যানের পাঁজরে কনুইএর খোঁচা মেরে। যার ধাক্কায় জ্যান আর একটু হলে পড়েই যাচ্ছিল।

কিছু সময় পরে… জেমস, জ্যান আর র‍্যালফ সিঁড়ি ভেঙে চলেছে র‍্যাভেনক্ল এর কমন রুমের দিকে।

     ‘বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন?’ জ্যান অবিশ্বাসের সুরে কথাটা বললো। ‘মোটেই উনি আসল বেন ফ্রাঙ্কলিন হতে পারেন না। ওনার তো…’ ও কিছুক্ষন ভাবলো কপাল কুঁচকে। ‘জানিনা ওনার বয়স কত। কিন্তু অনেক অনেক বছর বয়স হওয়া উচিত। ভাবতেই পারছি না। হেডমিস্ট্রেসের চেয়েও বেশী হতে হবে। না হতেই পারে না।’

     র‍্যালফ চেষ্টা করলো বোঝানোর, ‘আমি বলছি মিলিয়ে নিও, এই উইজার্ড মানুষগুলো – মানে আমরা যারা উইজার্ড – আমাদের হাতে আছে অনেক অনেক বছর ধরে এ জগতে থাকার চাবিকাঠি। এসব ভাবলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। বেন ফ্র্যাঙ্কলিন সম্বন্ধে যদি পড়ো মাগলদের বইয়ে দেখতে পাবে উনিও উইজার্ডদের চেয়ে কম কিছু ছিলেন না। তা না হলে একটা মানুষ কখনো ঘুড়ি উড়িয়ে তার সুতোতে চাবি লাগিয়ে বিদ্যুত ধরার কথা ভাবতে পারে।’

     জেমস কিছু একটা ভেবে নিয়ে বললো, ‘আমার মনে পড়ছে হারমায়নি আন্টি আমায় বলেছিলেন ওদের প্রথম বছরে দেখা একজন বয়স্ক উইজার্ডএর কথা। নিকোলাস ফ্লানেল না কি যেন। উনি একটা পাথর বানিয়েছিলেন যা ওনাকে অনন্ত জীবনের সুযোগ দিয়েছিল। আর বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই এসব অদ্ভুত জিনিষ গুলো খারাপের হাতে পড়ে বিপদ ডেকে আনে বলে উনি ওটাকে ধ্বংস করে দেন এবং নিজে স্বাভাবিক মৃত্যুর পথই বেছে নেন। তবে আমার মনে হয় ফ্লানেলের পাথর ছাড়াও অনেক উইচ এবং উইজার্ড জানেন কি করে আয়ুকে বাড়ানো যায়।’

     র‍্যালফ জ্যানকে রাগানোর জন্য বললো, ‘তাহলে আর কি, তোমার ১০০ ডলারের নোটে ওনার একটা অটোগ্রাফ নিয়ে নিও।’

     ‘আমার কাছে কোন একশোর নোট নেই। শেষ পাঁচ যেটা ছিল সেটা ওই এলফ দ্বাররক্ষীকে দিয়ে দিয়েছি।’

     জেমস বললো, ‘ও মোটেই দ্বাররক্ষী না।’

     ‘হতে পারে, কিন্তু ও তো আমাদের জন্য দরজা খুলে দিয়েছিল।’

     ‘ও মোটেই আমাদের দরজা খুলে দিচ্ছিলো না। র‍্যালফ ওকে এমন ধাক্কা মারে যে ও টাল সামলাতে গিয়ে ওটা খুলে ফেলে।’

     ‘যাই হোক আমার কাছে আর কিছুই নেই। আশা করছি এর জন্য ওদের সার্ভিস পেতে অসুবিধা হবে না।’

     জ্যান র‍্যাভেনক্ল কমন রুমের সামনে থমকে দাঁড়ালো। দরজায় লাগানো ঈগল মুখো ডোর নকার টঙটঙে স্বরে জানতে চাইলো, ‘ম্যাজিকে দক্ষ হওয়ার ক্ষেত্রে হ্যাটএর কি গুরুত্ব?’

     ‘উফস, ধুর, প্রশ্নগুলো এর থেকে সহজ হওয়া দরকার,’ জ্যানের গলায় অভিযোগের ছায়া।

     ‘আমাদের ভেতরে যেতেই হবে এব্যাপারে তুমি নিশ্চিত তো?’ র‍্যালফ বললো পা নাড়াতে নাড়াতে। ‘নিজের কমন রুম ছাড়া অন্যের কমন রুমে ঢোকার জন্য আবার আলাদা কোন নিয়ম কানুন আছে নাকি?’

     ‘যতদূর জানি এরকম কিছু নেই। আর এক হাউসের ছাত্রছাত্রীরা অন্যের কমনরুমে যেতেও পছন্দ করে না।’ জেমস উত্তর দিল। যদিও সেটা র‍্যালফকে খুব একটা স্বস্তি দিল বলে মনে হয় না। ও ভয়ার্ত চোখে বারান্দার এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত দেখতে থাকলো।

     ‘হ্যাট …হ্যাট … কি গুরুত্ব?’ জ্যান জুতোর দিকে তাকিয়ে বিড় বিড় করে যাচ্ছিলো, ‘হ্যাট, হ্যাট, হ্যাট… টুপি থেকে বের হল খরগোস। হ্যাট থেকে তুমি জিনিষ বের করতে পারো। এটা একধরনের কি বলে যেন…হ্যাঁ রুপান্তর। তুমি নিজের মাথায় একটা হ্যাট পড়ে আছো। তোমার মস্তিস্ক তোমার মাথায় আর সেটা চাপা পড়ে আছে হ্যাটের তলায়। বাপরে …’

     আঙুল মটকে ও তাকালো ঈগলটার দিকে। ‘তুমি তোমার হ্যাট থেকে সেটা বার করতে পারবে না যেটা তোমার মাথায় আগে থেকে ঢোকানো নেই, ঠিক বললাম না?’

     ‘পুরোটা না হলেও, কাছাকাছি হয়েছে উত্তরটা।’ ডোরনকারটা জানালো। সাথে সাথেই খুলেও গেল দরজাটা।

     ‘আরে বাহ জ্যান! তোমার মা বাবা সত্যি মাগল তো?’, জেমস বলে উঠলো।

     ‘দ্যাখো আমি বলেই ছিলাম আমার বাবা সিনেমা বানান। আর মম এর আছে ই এস পি মানে সিক্সথ সেন্স। কোন কিছুই লুকিয়ে করার উপায় নেই ওনার চোখ এড়িয়ে। হয়তো এর জন্যই আমার স্বাভাবিক একটা ন্যাক হয়ে গেছে ম্যাজিকাল জগতের জন্য।’ জ্যান বললো খুব একটা পাত্তা না দিয়ে। ‘বন্ধুরা, এই হলো র‍্যাভেনক্ল কমন রুম। একটা ইলেকট্রিক লাইট বা কোক মেসিন দেখতেও পাচ্ছিনা কোথাও। একটা দারুন স্ট্যাচু আছে এখানে আর একটা কথা বলা ফায়ারপ্লেস। কালকে আমার বাবাকে এখানে কল্পনা করছিলাম। যিনি এসবের সাথে ভালোই মানিয়ে নিতে পারতেন।’

     জ্যান ওদেরকে গোটা র‍্যাভেনক্ল এর ঘরটা ঘুরে ঘুরে দেখালো। অনেক কিছুর ব্যাপারেই ওর বিন্দুমাত্র জানা নেই। এরপর র‍্যালফ আর জ্যান জেমস কে মাগলদের তাস খেলা জিন রামি শেখানোর চেষ্টা করলো। কিন্তু জেমস কোন উৎসাহই পেল না কারন কিং কুইন আর জ্যাক সত্যিকারের লড়াই করবে না এটা ওর পছন্দ হল না। এবার র‍্যালফ ওদের নিয়ে চললো স্লিদারিন কমন রুমে। যাওয়ার পথটা মশাল আলোকিত আবছায়া ভূগর্ভস্থ প্যাসেজ। শেষ হল একটা দরজার সামনে যেটাতে পেতলের একটা সাপের কুন্ডলী পাকানো মূর্তি বাইরের দিকে বেরিয়ে কিলকাকৃতি মাথাসহ ভয়ানক রুপে হাঁ করে আছে।

     ‘ওহো, ওইটা লাগবে তো’, র‍্যালফ নিজের মনেই বললো। নিজের হাতটা একবার ঝাড়তেই আঙ্গুলে আবির্ভাব হল একটা আংটির। যার ওপর একটা বড় সবুজ এমারেল্ড পাথর, দেখতে একেবারে একটা চোখের মতো, মনিটা চেরা। র‍্যালফ ওটাকে সাবধানে সাপটার একটা চোখে চেপে ধরলো। সঙ্গে সঙ্গে অন্য চোখটা সবুজ আলো ছড়াতে শুরু করলো।

     ‘কে প্রবেশ-শ- শ -শের অনুমতি চাইছে?’ হিসহিসে স্বরে সাপের মাথাটা জানতে চাইলো।

     ‘আমি র‍্যালফ ডিডল। স্লিদারিন, প্রথম বর্ষ।‘

     আলোকিত চোখটা জেমস আর জ্যানের গায়ে আলো ফেলে জানতে চাইলো, ‘আর এই দুজন?’

     ‘আমার বন্ধু। আ- আমি ও-ওদের দায়িত্ব নিচ্ছি।’

     বেস অনেকটা অস্বস্তিকর সময় ধরে জ্যান আর জেমসকে পর্যবেক্ষণ করলো চোখটা। তারপর নিভে গেল ওটার আলো। শোনা গেল অনেকগুলো বিভিন্ন রকমের যান্ত্রিক শব্দ দরজাটা থেকে এবং খুলে গেল ওটা।

     স্লিদারিনদের ঘরটা তৈরী হয়েছে লেকের গা থেকে উঠে আসা পাহাড়ের গুহায় গথিক স্থাপত্যে। মোটা কাচের জানলা দিয়ে লেকটার ভেতরে অনেকদূর পর্যন্ত দেখা যায়। কাঁচ ভেদ করে জলের ভেতর দিয়ে আসা সবুজ সূর্যের আলো এসে পড়েছে সালাজার স্লিদারিন এবং তার অনুগামীদের পোরট্রেটে। র‍্যালফ বেশ উৎসাহের সাথেই ওদের সব ঘুরিয়ে দেখালো। কমন রুমে তখন গোটা কয়েক ছাত্র ছাত্রী ছিল, জমকালো সব পোশাক পড়া। ওরা লক্ষ্য করছিল জ্যান আর জেমসকে, হাসছিল মুখ টিপে, কিন্তু কোন রকম বিদ্বেষ দেখায়নি। র‍্যালফ সবাইকেই সম্বোধিত করে যাচ্ছিল কাঠকাঠ ভাবে।

     স্লিদারিনদের শয়ন কক্ষটা দেখে জেমসের মনে হল একটা খুব ধনী এবং ভোগী জলদস্যু ক্যাপ্টেনের জন্য বানানো হয়েছে। যথেষ্টই প্রশস্ত ঘরটা, ভিজে ভিজে ধরনের মেঝে, সাথেই নিচু সিলিং। যেখানে এদিকে ওদিকে ঝুলছে গারগয়েলের মাথার আকৃতির লণ্ঠন। চৌকো, মেহগনি কাঠ দিয়ে তৈরী, প্রত্যেকটা খাট। প্রত্যেকটা বিছানার শেষপ্রান্তে ঝুলছে স্লিদারিনের হাউস মস্তকাবরণ। র‍্যালফের পরিপাটি করে পেতে রাখা বিছানাটিতে ওরা উঠে বসলো।

     র‍্যালফ নিচু স্বরে বললো অন্য স্লিদারিনদের দেখিয়ে, ‘এখানকার অধিবাসীরা একটু ট্যাঁঠা ধরনের। সত্যি বলছি আমার নিজেরই এখানে অস্বস্তি লাগছে। তোদের র‍্যাভেনক্ল এর ঘরটা এর চেয়ে অনেক ভালো।’

     ‘হতে পারে, তবে আমি এটা বলতে পারি এদের নিশ্চিত সহজাত দক্ষতা আছে ঘর সাজানোর। যদিও এই সব জীবজন্তুর সাথে ঘুমানো খুব একটা সহজ কাজ নয়। আচ্ছা ওটা কি ড্রাগনের মাথা?’

     ‘হ্যাঁ।“ র‍্যালফ জানালো কিছুটা বিরক্তির সাথে। ‘এখানকার এক সদস্য ওটা বাড়ি থেকে এনেছে। ওর ফ্যামিলীর লোকেরা ড্রাগন শিকার করতে যেত।’

     ‘আমি জানতাম ড্রাগন শিকার করা নিষিদ্ধ।’জেমস বললো।

     ‘ইয়া। আমিও তো তাই জানি। ওই ওদের ফ্যামিলিদের নিজস্ব জায়গা আছে শিকার করার। যা খুশি শিকার করতে পারে। !’ র‍্যালফ খুবই নিচু স্বরে বললো। ‘ওইটা একটা ইউনিকরনের মাথা। এখনো ওটার সিং দেখা যাচ্ছে। আর ওই যে টমের বিছানার পেছন দিকে যেটা দেখা যাচ্ছে ওটা হাউসএলফ এর মাথা। ওরা ওদের মাথাও ঝুলিয়ে রাখে ওদেরকে হত্যা করলে! আমি দিব্যি কেটে বলছি ওটা মাঝেমাঝেই আমার দিকে তাকিয়ে থাকছে!” একথা বলতে বলতে র‍্যালফ শিহরিত হলো। বুঝতে পারলো ও একটু বেশীই কথা বলে ফেলেছে। মুখের ওপর একটা লাইন টেনে জেমস আর জ্যানের দিকে একবার করে দেখলো।

     ‘হুম,ঠিক বলেছ। ব্যাপার স্যাপার সব কেমন যেন অদ্ভুতুড়ে। তবুও আমার মনে হয় এগুলোর বেশির ভাগই একটা বাড়িয়ে দেখানোর প্রচেষ্টা,’ জেমস বললো। আর মনেমনে সিদ্ধান্ত নিলো স্লিদারিনের সদস্যদের নিয়ে যে সব গল্পগাছা শুনেছে তার একটাও র‍্যালফকে বলবে না।

     ‘ওটা কি?’ জ্যান সহসা বললো, বিছানার দিকে তাকিয়ে। ‘ওটা কি গেম খেলার যন্ত্র? মনেতো সেরকমই হচ্ছে! তার মানে তুমি পেয়েও গেছে অনলাইনে কম্পীটীশন এবং অন্য সব কিছু করার মত ওয়ারলেস আপ লিঙ্ক! ’ র‍্যালফের বিছানার প্রান্তে রাখা একটা ব্যাগ নিয়ে এলো হাত বাড়িয়ে। ভেতর থেকে বের করলো ছোট্ট তাসের প্যাকেটের মত কালো রঙের একটা বাক্স। একটা ছোট্ট স্ক্রীন লাগানো আছে সামনেটায়, আর অনেকগুলো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বোতাম সাজানো তার ঠিক নিচে। ‘কি গেম আছে এটায়? আরমাগেডন মাস্টার থ্রী আছে নাকি?’

     ‘না!’ বলেই র‍্যালফ ওটা কেড়ে নিল জ্যানের কাছ থেকে। ‘আমি চাই না এটা আর কেও দেখুক! এরকম কোন কিছু এখান থেকে সরিয়ে নেওয়ার নির্দেশ আছে।’

     জ্যান বিস্ময়ের সাথে জানতে চাইলো, ‘কিন্তু কেন?’

     ‘আমি কি করে জানবো? এখানে উইজার্ড আর ইলেক্ট্রনিকস যন্ত্রাদির মধ্যে সমস্যাটা কোথায় জানা আছে তোমার?’ র‍্যালফ জেমসের দিকে প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিল।

     কাঁধ ঝাঁকিয়ে জেমস বললো, ‘না আমি জানি না। তবে আমার মনে হয় এখানে আমাদের ওগুলোর দরকার নেই। ইলেকট্রনিকস জিনিষপত্র, যেমন কম্পিউটার বা ফোন একেবারে মাগলদের নিজস্ব ব্যাপার। আমার অনুমান আমরা সেগুলোই ব্যবহার করতে পাবো যেগুলো ম্যাজিকের কাজে লাগবে।’

     র‍্যালফ মাথা নেড়ে বললো, ‘কিন্তু এখানেতো সেই মনোভাবটা দেখছি না। ওরা এমন করছে যেন আমি অতি জঘন্য কিছু স্কুলে নিয়ে এসেছি। বলা হয়েছে আমি যদি আসল স্লিদারিনের মত হতে চাই তাহলে সমস্ত ভাঁওতাবাজির ম্যাজিক আর মেশিনকে ছুড়ে ফেলে দিতে হবে।’

     জেমসের দিকে তাকিয়ে জ্যান বললো, ‘ভাঁওতাবাজির ম্যাজিক?’

     ‘হুঁ’, জেমস উত্তর দিল হতাশ ভঙ্গীতে, ‘কিছু উইজার্ড পরিবার এটাই বিশ্বাস করে মাগলদের ইলেক্ট্রনিক্স আর যন্ত্রপাতি সম্বন্ধে। ওদের মতে এগুলো পাতি নকল, আসল উইজার্ডরা যা করেন তার। ওরা এটাও মানেন যে উইজার্ড মাগলদের যন্ত্রাদি ব্যবহার করে সে জাদু ঐতিহ্যের পক্ষে বিশ্বাসঘাতকের সমান।’

     র‍্যালফ সম্মতি জানিয়ে বললো, ‘একদম ঠিক, এই কথাগুলোই আমাকেও বলা হয়েছে। ‘ওরা এই জাদু ঐতিহ্যর বিষয়ে দারুন ভাবে সমর্পিত প্রান! আমি আমার সব কিছুই লুকিয়ে রেখে দিয়েছি।পরের বার যখন ড্যাড আসবেন আমি ওগুলো ফেরত পাঠিয়ে দেব।’

     জ্যান নিচু মাত্রার সিটি মেরে বললো, ‘আমি বাজি ধরতে পারি আজকে আমার দেশের লোকেদের ওই সব গাড়িতে করে আসাটা তোমাদের রক্ষনশীল উইজার্ডদের পছন্দ হয়নি। ডজ হরনেট এর মত প্রকৃত যন্ত্র আর কিছু হতেই পারে না।’

     জেমস মেনে নিল এবং বললো, ‘ঠিকই বলেছ। ওরা ওটা খুব একটা পছন্দ করেননি। তবে একটা ইলেক্ট্রনিকস যন্ত্র আর একটা প্রকৃত ঘড়ির মধ্যে অনেক পার্থক্য। ওনাদের মতে একটা গাড়ি কেবল মাত্র কিছু গিয়ার আর পিস্টনের সমষ্টি। ভাঁওতা ম্যাজিকের থেকেও বেশী এক অপ্রয়োজনীয় জটিল যন্ত্রসজ্জা। একই কারনে ওরা কম্পিউটার বা অন্য কিছুকে পছন্দ করেন না।’

     ‘আমি তো বললামই’, র‍্যালফ গেমডেকটাকে ব্যাগে ঢোকাতে ঢোকাতে হতাশ ভাবে বললো। ‘চলো এবার এখান থেকে যাওয়া যাক। ডিনারের সময়ও হয়ে এসেছে। আর আমার খিদেও পেয়েছে খুব।’

     ‘তোমার কখনো খিদে মেটে র‍্যালফ?’ জ্যান বিছানা থেকে নামার সময় বললো।

     র‍্যালফ বললো, ‘আমার চেহারাটা দেখেছো তো। কিছু করার নেই এটা একটা গ্ল্যান্ডিউলার প্রবলেম। অ্যান্ড জাস্ট শাট আপ।’

     ‘আমি খারাপ কিছু ভেবে বলিনি কিন্তু’। জ্যান দুহাত ওপরে তুলে বললো। ‘সত্যি বলছি, এখানে তোমার মতো একটা বড়সড় মাপের বন্ধু থাকাটা সত্যিই কাজের বলেই আমার ধারনা।’

     ডিনারের সময় ওরা একসাথে গ্রীফিন্ডোরের টেবিলে বসলো। টেড এসে জ্যান এর পিঠে একটা উৎসাহব্যঞ্জক চাপড় দেওয়ার আগে অবধি জেমস ব্যাপারটা নিয়ে একটি দ্বিধায় ছিল।

     ‘তারপর কেমন দিন কাটছে আমাদের র‍্যাভেনক্ল বিচ্ছুর? ক্যাম্পাসের দ্বিতীয় সেরা হাউসে সব ঠিকঠাক আছে তো?’ এসময়েই জেমস লক্ষ্য করলো জ্যান আর র‍্যালফই শুধু না আর অনেকেই অন্যান্য হাউসের টেবিলে বসেছে।

     ডিনার করার পর ওরা আগামী দিনের পরিকল্পনা শুরু করলো। জ্যান জেমসের সাথে প্রফেঃ জ্যাক্সনের টেকনোম্যান্সির ক্লাস করবে ঠিক করলো। ওদিকে র‍্যালফ ডিফেন্স এগেইন্সট দ্য ডার্ক আর্টস এর ক্লাস করবে জেমসের সাথে। এবার ওরা চললো লাইব্রেরীর দিকে। সংরক্ষিত এলাকায় বেশ খানিকক্ষণ ঘোরা ফেরা করার পর লাইব্রেরীয়ানের কড়া বকুনি খেয়ে ওরা পালালো, গুডনাইট জানিয়ে যে যার কমন রুমের দিকে।

     র‍্যাভেনক্ল কমন রুমের সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে জ্যান বললো, ‘কাল দেখা হবে প্রফেসর স্টোনওয়ালের ক্লাসে।’ ওর সহজাত প্রতিভা আছে অন্যদের একটা করে ডাকনাম দেওয়ার।

     জেমস কমন রুমে ঢুকে দেখলো টেড বসে আছে পেট্রার কাঁধের ওপর দিয়ে একটা হাত রেখে। সাব্রিনা আর ড্যামিয়েন কাছেই একটা টেবিলে বসে কিছু ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কাগজপত্র নিয়ে আলচনায় মগ্ন।

     ‘তাহলে কাল থেকে স্কুলে যাওয়ার জন্য তৈরীতো জুনিয়র?’ টেড ওকে দেখে বললো।

     ‘ইয়া! মনে তো হচ্ছে।’

     ‘বেশি ভাবার কিছু নেই।’ টেড আশ্বাসের ভঙ্গীতে বললো। ‘প্রথম বছরে শুধু থিয়োরী পড়তে হয় আর শিখতে হয় জাদুদন্ডের ব্যবহার। প্রফেসর ট্রে্লোওনির ক্লাস করার জন্য ফোরথ ইয়ার পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।’

     ‘মনে হচ্ছে আমরা চিড়েচ্যাপ্টা হব এবার স্টেটস থেকে আসা ওই সব বড় বড় পন্ডিত আর ট্রেলোওনির চাপে।’ বললো পেট্রা।

     জেমস ভুরু কুঁচকে জানতে চাইলো, ‘কি বলতে চাইছো তুমি?’

     টেড উত্তরটা দিলো, ‘মনে হচ্ছে ওরা এবার ক্লাসটা দুজন মিলে নেবেন। গত বছর ট্রেলোওনি আর ফিরেঞ্জ দ্য সেন্টুর [অশ্বমানব] দায়িত্বে ছিলেন। কিন্তু ফিরেঞ্জতো চলে গেছেন গ্রেহ্যাভেনের সেন্টুর ভ্যালীতে। যে কারনে এই বছর ট্রেলোওনি আর ওই ভুডু ক্যুইন মাদাম ডেলাক্রয়।’

     ড্যামিয়েন দার্শনিকের মতো বললো, ‘আমার বিবেচনায় ওনারা পরিণত হবেন একে ওপরের প্রানের সখীতে। ঠিক যেমন চাঁদ আর চকোর। অথবা ড্রাগন ডিম্বের গুঁড়ো আর ম্যান্ড্রেক স্যাপের মুড়ো।’

     ড্যামিয়েন ঠিক কি বলতে চাইলো, জেমস চোখ পিটপিট করে এটা জানতে চাওয়ার আগেই টেড জেমসের মাথাটা নেড়ে দিয়ে মিচকি হেসে বললো, ‘কল্পনাশক্তির একটু ইস্তেমাল করো দোস্ত।’

     আরও কিছুটা সময় পরে জেমস আড্ডা ছেড়ে উঠে এলো শোওয়ার জায়গায়। পরের দিনটার জন্য এই মুহূর্তে ওর ভেতরে উত্তেজনা আর উৎকণ্ঠা একই সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে। কিছুক্ষনের জন্য ও চন্দ্রালোকিত ঘরটায় দাঁড়িয়ে একজন গ্রিফিন্ডোর হিসাবে এই প্রাকশিক্ষা শুরুর মুহূর্তটার উত্তেজনা শরীরের প্রতিটি বিন্দুতে চেটেপুটে নিতে থাকলো। আগামী বছরগুলোতে অপেক্ষা করে থাকা অ্যাডভেঞ্চারগুলোর ভাবনা ওকে সম্মোহিত করছিল। অবশ করে দিচ্ছিল। ওর মন চাইছিল একটা বিরাট লাফ দিয়ে ওইসব সময়গুলোতে পৌঁছে যেতে।

     নোয়া বের হয়ে এলো ক্ষুদ্র ওয়াসরুমটা থেকে। জেমস কে আড়চোখে দেখলো বিছানায় ওঠার আগে। ‘আমরাও এক সময় ওইরকম অনুভুতিতেই আচ্ছন্ন হয়েছি,’ নোয়া কথাগুলো এমন ভাবে বললো যেন ও জেমসের মনের কথা পড়তে পেরেছে স্পষ্টই। ‘কাল সন্ধে পর্যন্ত কোনমতে কাটাতে পারলেই এই ঝিমঝিম ভাবটা কেটে যাবে। কানে ঝুড়ি ঝুড়ি লেকচার ঢুকবে আর ঘাড়ের ওপর একগাদা হোমওয়ার্কের চাপ পড়লেই সব সাফ।’ বিছানার কাছে জ্বলতে থাকা মোমবাতিটা নিভিয়ে দিল কথা শেষ করেই।

[চলবে]

লেখক পরিচিতিঃ  জর্জ নরম্যান লিপারট আমেরিকান লেখক এবং কম্পিউটার অ্যানিমেটর। তবে ওনার বর্তমান পরিচয় উনি জেমস পটার সিরিজের লেখক। যে কারনে ওনাকে “আমেরিকান রাউলিং” নামেও ডাকা হয়ে থাকে। এই সিরিজের প্রথম লেখা “জেমস পটার অ্যান্ড দ্য হল অফ এল্ডারস ক্রশিং” প্রকাশিত হয় ২০০৭ সালে। নানান কারনে এটি অনেক বিতর্কে জড়িয়ে যায়। সেসব সমস্যা পেরিয়ে আজ এটি পাঠক পাঠিকাদের চাহিদায় সারা বিশ্বে যথেষ্ট জনপ্রিয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য এই সিরিজের সব কটি বই ই-বুক এবং ফ্রি হিসাবেই প্রকাশ করেছেন মাননীয় জর্জ নরম্যান লিপারট। এই সিরিজ ছাড়াও ওনার আরো ১২ টি বই আছে। বর্তমানে উনি এরি, পেনসিল্ভ্যানিয়ার বাসিন্দা।

অনুবাদকের পরিচিতিঃ উপন্যাসটির অনুবাদক প্রতিম দাস মূলত চিত্র শিল্পী, ২০১৩ সাল থেকে ভারতের সমস্ত পাখি আঁকার লক্ষ্য নিয়ে কাজ চলছেন। ৭৭৫+ প্রজাতির ছবি আঁকা সম্পূর্ণ হয়েছে। তবে শুধু পাখি নয় অন্যান্য বিষয়েও ছবি আঁকা চলে একইসাথে। সাথেই দারুণ রকমের পাঠক, যা পান তাই পড়েন ধরনের। প্রিয় বিষয় রূপকথা, ফ্যান্টাসী, সায়েন্স ফিকশন, অলৌকিক। টুকটাক গল্প লেখার সাথে সাথে আছে অনুবাদের শখ। 

বিঃ দ্রঃ উপন্যাসটি লেখকের অনুমতি নিয়ে বাংলায় অনুবাদ করা হয়েছে। 

Tags: অনুবাদ, জেমস পটার অ্যান্ড দ্য হল অফ এল্ডারস ক্রসিং, ধারাবাহিক অনুবাদ গল্প, ধারাবাহিক উপন্যাস

Leave a Reply

Connect with

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

error: Content is protected !!
Verified by MonsterInsights