Sunday, November 17, 2024
ধারাবাহিক উপন্যাস

জেমস পটার অ্যান্ড দ্য হল অফ এল্ডারস ক্রসিং – পার্ট ৬

লেখক: জি নরম্যান লিপার্ট, ভাষান্তরঃ প্রতিম দাস

শিল্পী: মূল প্রচ্ছদ, সুদীপ দেব

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ

হ্যারির রাতের মিটিং

ক্লাস শেষ হতেই জেমস ছুট লাগালো গ্রিফিন্ডোর কমন রুমের দিকে। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতেই খুলে ফেললো স্কুল ড্রেস। ঝটপট ইভিনিং ক্লোক আর জ্যাকেট গায়ে চাপিয়ে এলোমেলো চুলটাকে বেসিনের জল দিয়ে একটু সমান করে নিলো। আনায় বেশ কয়েকবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নিজেকে দেখেও নিলো ভালো করে। তারপর যে গতিতে ঘরে এসেছিল তার চেয়েও দ্রুত গতিতে একেকবারে দু-ধাপ করে লাফিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে মারলো ছুট।

     স্যার ক্যাডোগানের পোরট্রেটের কাছে নেভিলের সঙ্গে অপেক্ষা করছিলেন হ্যারি।

     ‘সে ছিল এক ভীষণ লড়াই বুঝলে কিনা,’ ক্যাডগান বলছিলেন নেভিলকে। নিজের ছবির মধ্যে তলোয়ারটাকে এদিকে ওদিকে নাড়িয়ে চাড়িয়ে। নেভিল থতমত মুখ করে শুনছিল। ‘আমি সব কিছুই দেখতে পাচ্ছিলাম। ওখানেই তো ছিলাম। বোলোক্স হামফ্রে ছিল তার নাম। লড়ছিল একেবারে বীরের মতো। হেরে গেল যদিও। কিন্তু সে হার মহান রাজাদের মত সম্মানের। ঠিক তুমি যেখানে দাঁড়িয়ে আছো ওখানে দাঁড়িয়ে ছিল সে। লড়তে লড়তে শরীর ক্ষতবিক্ষত হয়ে গিয়েছিল তবু লড়ে গিয়েছিল পাহাড়ী দৈত্যর মতো তেজ নিয়ে। সাহসী মানুষ। অতি বীর!’

     জেমসকে আসতে দেখেই নেভিল চিৎকার করে বলে উঠলেন, ‘ওই তো জেমস এসে গেছে, আমরা এখানে।’ স্যার ক্যাডোগান আর হ্যারি তাকালেন। হ্যারির মুখে ফুটে উঠলো হাসি।

     ‘তোর মাম খুবই খুশী হবেন এটা জেনে যে তুই এই ক্লোকটা পড়েছিস।’

     ‘আমি আজই প্রথম এটাকে ট্রাঙ্ক থেকে বার করলাম,’ জেমস অকপটে বললো, মুচকি হেসে।

     হ্যারি মাথা নেড়ে বললেন, ‘তার মানে আজকের পর ওটা আবার ট্রাঙ্কের ভেতরেই ঢুকে যাবে, তাইতো?’

     ‘এক্কেবারে।’

     ‘ভালোই বুদ্ধি,’ হ্যারি প্রশ্রয়ের সুরে বললেন। ওরা এগিয়ে চললো সামনের সিঁড়ির দিকে।

     ‘আরে চলে যাচ্ছ কেন, থামো!’ ক্যাডোগান চেঁচিয়ে উঠলেন। এক লাফে চলে এলেন ফ্রেমের সামনেটায়। তলোয়ারটাকে খাপে ঢুকিয়ে বলতে শুরু করলেন, ‘ব্যাটল অফ রেড মেজেস এর কথা তোমাদের বলিনি না? এই এলাকায় ঘটে যাওয়া সবচেয়ে বেশী রক্ত ঝরানো গণহত্যা!  ঠিক ওই সিঁড়িটার ধাপের কাছেই হয়েছিল! ও শুনবে না, ঠিক আছে পরেরবারই বলবো তাহলে। সাহসী হও!’

     ‘উনি কে?’ পেছন দিকে তাকাতে তাকাতে জেমস জানতে চাইলো।

     ‘জেনে যাবে সময় হলেই,’ নেভিল বললেন। ‘আপাতত না জানার মজাটা যতক্ষণ পারো উপভোগ করে নাও।’

     জেমস শুনতে পেল ওর ড্যাড নেভিলকে বলছেন এই মুহূর্তে মন্ত্রকের হাল হকিকতের খবরাখবর। নকল পোর্ট কি কান্ডে অনেকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। পাহাড়ের পাদদেশে অনেক ট্রলকে দেখা গিয়েছে। মন্ত্রক থেকে বিশেষ নজরদারির ব্যবস্থা করা হয়েছে সেই সমস্ত বদমাইশদের জন্য যারা মাগলদের এলাকায় অভিযান চালাচ্ছে। নতুন মন্ত্রী, লোকুয়াসিয়াস ন্যাপ, এশিয়ান উইজার্ডিং কমিউনিটির সঙ্গে ব্যবসা বাড়ানোর উদ্দেশ্যে একটি ভাষন দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন যেখানে “ফ্লাইং কারপেট” এবং “শেডস” নামক কিছু একটার ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার কথাও থাকবে।

     ‘ঘুরিয়ে বললে,’ হ্যারি, দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, ‘আসল ব্যাপার আগেও যা ছিল এখনো তাইই থেকে যাচ্ছে। এখানে ওখানে ছোটখাটো গণ্ডগোল হচ্ছে। টুকটাক ষড়যন্ত্র দানা বাঁধছে। বিক্ষোভ হচ্ছে। সঙ্গেই চলেছে রাজনীতি আর পেপারওয়ার্কসের খেলা।’

     মুচকি হেসে নেভিল বললেন, ‘তার মানে তুইকি এটাই বলতে চাস যে এই শান্তিপূর্ণ অবস্থাটা একজন অরোরের পক্ষে যথেষ্টই বিরক্তিকর এবং একঘেয়ে।’

     হ্যারি হাসলেন। ‘হ্যাঁ তা বলতে পারিস। আমার কাজটা আর তত উত্তেজনাপূর্ণ নেই। অবশ্য এর জন্য বোধহয় আমার ধন্যবাদ জানানোই উচিত। এই কারনেই আমি জিনি, লিল আর অ্যালবাসের সঙ্গে বেশীরভাগ রাতগুলো ইদানীং বাড়িতে কাটানোর সময় পাচ্ছি।’ জেমসের দিকে তাকালেন একবার। ‘আর ঠিক সেই কারনেই একটা সুযোগও পেয়ে গেলাম ওরসঙ্গে দেখা করার। অ্যাম্বাসাডার বিশেষ অনুমতি দিলেন হগওয়ারটসে যাওয়ার।’

     ‘খবরটা পেয়েছিস বোধ হয়, জেমসের এর মধ্যেই একবার ডাক পড়েছে ম্যাকগনাগলের অফিসে,’ নেভিল চাপা স্বরে বললেন।

     ‘তাই নাকি?’ হ্যারি জেমসের দিকে এক ঝলক তাকিয়ে বললেন,‘তা কি জন্যে?’

     নেভিল ভ্রু উঁচিয়ে এমন ভঙ্গী করলো যার অর্থ তুই নিজেই জেনে নে।

     ‘আমি, ইয়ে, একটা জানলা ভেঙ্গেছি।’

     হ্যারির হাসি সামান্য সময়ের জন্য থমকে গেল। ‘হুম! আমি পরে শুনবো কি হয়েছিল ব্যাপারটা,’ কিছুটা চিন্তা যেন মিশে থাকলো কথাগুলোয়। জেমসের মনে হলো ড্যাডের এই তাকানোরএকটা চাপ যেন সে অনুভব করতে পারছে।

     আরো কিছুটা হাঁটার পর ওরা পাশাপাশি এক জোড়া দরজার কাছে পৌঁছে গেল। দুটো দরজার পাল্লাই হাট করে খোলা। ভেতরে হল ঘর থেকে ভেসে আসছে খাবারের সুগন্ধ।

     ‘আমরা এসে গেছি,’ নেভিল বললেন, সরে দাঁড়িয়ে জেমস আর হ্যারিকে আগে ঢোকার সুযোগ দিয়ে। ‘এটাই আপাতত আমেরিকানদের থাকার জায়গা। দক্ষিন পশ্চিম প্রান্তে ব্যবস্থাটা করা হয়েছে। সাময়িকভাবে এর সঙ্গে রিক্রিয়েশনাল এরিয়া, কমন রুম, রান্নাঘর এবং আনুষাঙ্গিক যা যা প্রয়োজন তার ব্যবস্থাও করা হয়েছে।’

     ‘বাহ! দারুণ,’ হ্যারি চারদিক দেখতে দেখতে বললেন। কমন রুমটা খুব একটা বড় নয়। গোলাকৃতি দেওয়াল, পুরোনো কড়ি বড়্গার সিলিং, একটা ফাটল ধরা ফায়ার প্লেস এবং দুটো দারুণ লম্বা সরু জানলা। আমেরিকানরা অবশ্য তার মধ্যেই সব সাজিয়ে গুছিয়ে নিয়েছে। মেঝেতে পাতা হয়েছে ভালুকের চামড়ার কম্বল। দেওয়ালে ঝুলছে রঙবেরঙের ট্যাপেস্ট্রি। ঘরের মধ্যে চারপাশ জুড়ে থাকা পাথরের ঘোরানো সিঁড়ি থেকেও ঝুলছে বেশ কিছু। একটা বিরাট মাপের তিন থাকের বুকসেলফে অনেক মোটা মোটা বই সাজানো। যাদের নাগাল পেতে চাকা লাগানো সরু মই ভরসা। তবে সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় যা চোখ টেনে নিচ্ছে তা হল পেতলের গিয়ার এবং আয়নাযুক্ত লেন্স লাগানো একটি জটিল কলাকৃতি। ঝুলছে সিলিং থেকে। ঘরের ওপরের অংশটা জুড়ে আছে এবং ঘুরছে, খুবই আস্তে আস্তে। জেমস অবাক হয়ে ওটার দিকে তাকিয়েছিল। ওটা থেকে মৃদু ক্যাঁচ কোঁচ এবং ক্লিক ক্লিক শব্দ শোনা যাচ্ছিলো।

     ‘আমার তৈরী ডে লাইট সেভিং ডিভাইসটার দিকে তাহলে তোমাদের নজর পড়েছে,’ বেন ফ্র্যাঙ্কলিনের কন্ঠস্বর শোনা গেল। ঘোরানো সিঁড়ির তলার এক বিরাট মাপের আর্চ ডোরের ভেতর থেকে বেরিয়ে এলেন উনি। ‘এটা আমার একটা অত্যন্ত প্রয়োজনীয় জিনিস। বিশেষ করে আমি যখন কোন দীর্ঘদিনের সফরে যাই। অবশ্য একে বহন করা এবং সেটআপ করা রীতিমতো কষ্টসাধ্য ব্যাপার।’

     ‘অদ্ভুত অসাধারণ,’ নেভিল বললেন, ধীর গতিতে ঘুরতে থাকা আয়না এবং বিভিন্ন চক্রের ঘূর্ণন দেখতে দেখতে। ‘এটা ঠিক কি কাজ করে?’

     আগ্রহের সঙ্গে ফ্র্যাঙ্কলিন বললেন, ‘আসুন বুঝিয়ে দিই। বলে রাখা ভালো এটা সবচেয়ে ভালো কাজ করে দিনের বেলায়। তবে চাঁদ তারা যুক্ত ঝকঝকে রাতের আকাশ পেলেও এটা ভালো আলোর সৃষ্টি করতে পারে।আশা করছি আজকের সন্ধেতেও এটা ভালোই কাজ করে দেখাবে। দেখি কি করতে পারি…’

     উনি এগিয়ে গেলেন একটি বহু ব্যবহৃত হাইব্যাক চামড়া মোড়ানো চেয়ারের দিকে। বসলেন । তারপর তাকালেন দেওয়ালের একটা চার্টের দিকে। ‘আজ তেসরা সেপ্টেম্বর, তাইতো। তারমানে চাঁদ এখন চতুর্থ ঘরে অবস্থান করছে। বেশ, তাহলে একটু দেখতে হচ্ছে  …সময় সাতটা বেজে পনের মিনিট। বৃহস্পতি এগিয়ে যাচ্ছে সর্বশেষ …উম ম …হুম …’

     ফ্র্যাঙ্কলিন বিড়বিড় করতে নিজের জাদুদণ্ডটাকে তাক করলেন কিছু নির্দিষ্ট যন্ত্রের দিকে। গিয়ারগুলো সমেত সমগ্র যন্ত্রটা যেন প্রাণ পেলো। কিছু যন্ত্র প্রসারিত হলো, আর কিছু গুটিয়ে গেল। আয়নাগুলো সরে সরে গিয়ে ঘুরতে থাকা লেন্সগুলোর পেছন দিকে চলে গেল। অর্থাৎ বিস্তারন ঘটানো হলো ওদের ক্ষমতার।

     সমগ্র যন্ত্রটাকে ধরে থাকা দণ্ডটি শুরু করলো ঘুরতে। ফ্র্যাঙ্কলিনের জাদুদন্ডের তালে তালে একটা নির্দিষ্ট ছন্দে যেন এবার নাচতে শুরু করলো পুরোটা। ওটা ঘুরতে শুরু করার সঙ্গেসঙ্গেই একটা অবয়ব তৈরী হতে শুরু হল ওটার মাঝখানটায়। এক আয়না থেকে আর এক আয়নায় বিচ্ছুরিত হতে থাকলো গোলাপি ভুতুড়ে আলো। পেন্সিলের মতো সরু। ভেসে থাকা ধুলোর কণাগুলো পরিণত হলোকুচি কুচি অগ্নি বিন্দুতে। অনেক অনেক আলোর সরু সরু রশ্মি রেখা নড়েচড়ে আলোর নাচ দেখিয়ে গঠন করতে থাকলো এক জ্যামিতিক আকৃতি। এবার একেবারে মধ্যে শুরু হল কম্পন। জেমস এদিকে ওদিকে মাথা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বিস্ময়াবিষ্ট ভাবে দেখছিল ছোট্ট ছোট্ট গ্রহাণু যেন বেরিয়ে আসছে রঙ্গীন আলোর ভেতর থেকে এবং জুড়ে যাচ্ছে একে অপরের সঙ্গে। এবার সেগুলোও শুরু করলো ঘুরতে। দুটো বড় মাপের আকৃতি দেখা গেল একেবারে কেন্দ্রস্থলে। জেমস চিনতে পারলো ওদের। চাঁদ এবং সূর্য। সূর্যের রঙ গোলাপি, আলো ছড়িয়ে পড়ছে কয়েক ফুট জায়গা জুড়ে চারপাশে। চাঁদটা ছোট কিন্তু তুলনায় অনেক বেশী ঘন। সিলভার কোয়াফেলের মতো। দুটি অংশ নিখুঁতভাবে বিভক্ত আলো এবং অন্ধকারে। ঘুরছে আস্তে আস্তে। সমগ্র নক্ষত্রমন্ডলী এখন ওদের চোখের সামনে।ঘুরপাক খাচ্ছে।মহাবিশ্বের আলো পেতলের যন্ত্রটায় প্রতিফলিত হয়ে মায়াময় এক জগতের জন্ম দিয়েছে ঘরের মধ্যে।

     ‘প্রকৃতির আলোর চেয়ে স্বাস্থ্যকর আর কিছুই নেই,’ ফ্র্যাঙ্কলিন বললেন। ‘জানলা দিয়ে আসা আলোকে চেষ্টা করেছি ধরার, তারপর তাকে জমাট বাঁধিয়েছি লেন্স আর আয়নার সঠিক সংস্থাপনে। নিজস্ব অপ্টিক্যাল ক্ল্যারিটি মন্ত্র দিয়ে আলোকে ছেঁকে নিয়েছি। আর তারই ফসল, যা আপনারা দেখতে পাচ্ছেন। চোখের পক্ষে খুব ভালো, রক্তের পক্ষেও এবং অবশ্যই স্বাস্থ্যের পক্ষে।’

     হ্যারি নিঃশ্বাস না ফেলেই জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এটাই কি আপনার দীর্ঘজীবনের চাবিকাঠি?’

     ‘হ্যাঁ তা বলতেই পারি। তবে সেটা খুব সামান্য একটা ব্যাপার ওই বিষয়ে।’ ফ্র্যাঙ্কলিন বললেন উচ্ছাসহীন স্বরে।‘আসলে আমি রাতের বেলায় পড়তে ভালবাসি। আর টর্চ ব্যবহারের তুলনায় এটা বেশী মজার।’ জেমসের দিকে তাকিয়ে চোখ টিপলেন।

     প্রফেসর জ্যাক্সনের আগমন হলো সেই একই আর্চ ডোরের তলা দিয়ে।জেমস দেখতে পেল ফ্র্যাঙ্কলিন ওনার দিকে তাকালেন। জ্যাক্সনের মুখে ক্লান্তির ছাপ। ‘ডিনার সারভ করা হয়ে গেছে। আমরা কি ডিনার রুমে যাবো নাকি এখানেই আনার ব্যবস্থা করবো?’

     হ্যারি, জেমস, নেভিল, মন্ত্রকের প্রতিনিধিরা ছাড়াও হগওয়ারটসের বেশীরভাগ শিক্ষক শিক্ষিকা উপস্থিত হয়েছেন।প্রফেসর কারিও ছিলেন ওখানে। জেমস বেশ খানিকটা চমকে গেল যখন প্রফেসর কারি জেমসের ফুটবল খেলায় দক্ষতার কথা ড্যাডকে বললেন। সঙ্গেই এটাও বললেন যে, জেমসের এই দক্ষতা যাতে আরো আরো উন্নত হয় তার ব্যবস্থাও নাকি উনিকরবেন।

     খাবার সময় জেমস বুঝতে পারলো ড্যাডের কথা মোটেই মিলছে না। খাদ্যসম্ভারের যে আয়োজন করা হয়েছে তা যথেষ্টই উপভোগ্য এবং বিভিন্ন ধরনের। মাদাম ডেলাক্রয়ের গাম্বো পরিবেশিত হল সবার আগে। উনি ওটা নিজেই বয়ে নিয়ে এলেন। দৃষ্টিহীন হওয়া সত্ত্বেওএকটা ফোঁটাও না ফেলে উনি ওটাকে টেবিলে এনে রাখলেন।তার চেয়েও আশ্চর্যজনক ভাবে, আঙ্গুরগাছের শিকড়ের মতো ব্যাঁকাচোরা ভয়ানক দেখতে নিজস্ব জাদুদণ্ড নাড়াচাড়া করে বড় হাতাটাকে নিয়ন্ত্রণকরে সকলের বাটিতে খাবারটি পরিবেশন করে দিলেন। জেমস এটাও লক্ষ করলো পুরো সময়টা উনি বিড়বিড় করতে করতে তাকিয়ে থাকলেন সিলিং এর দিকে। গাম্বোটা খুব বেশী রকমের মশলাদার, সঙ্গেই চিংড়ি আর সসেজ মেশানো, তবু জেমসের বেশ ভালোই লাগলো। এরপর এলো রোল এবং বিভিন্ন রকম মাখন। বাদামী চটচটে একটা জিনিষের দিকে জেমস তাকাতেই প্রফেসর জ্যাক্সন জানালেন ওটা আপেলের মাখন। জেমস প্রথমে একটু চেখে দেখলো। আরে দারুণ তো, মনে মনে কথাটা বলেই পরিমানে অনেকটা তুলে নিল রোলটায় মাখিয়ে নেওয়ার জন্য।

     মিন্ট জেলি দেওয়া ভেড়ার মাংস ছিল ভোজসভার মূল আকর্ষণ।এই টিপিক্যাল আমেরিকান খাবারটা ঠিক কেমন হবে সেটা  বুঝতে না পেরে জেমস প্রশ্নটা করেই বসলো।

     উত্তরে জ্যাক্সন জানালেন ‘জেমস, আমেরিকান খাবার বলে কিছু নেই।‘আমাদের রান্নাবান্না ওই যাকে বলে একেবারে আমাদের জনগনণর মতো। অনেক রকম বিশ্ব সংস্কৃতির মেলবন্ধন।’

     ফ্র্যাঙ্কলিন ফুট কেটে বললেন, ‘মোটেই ওটা সত্যি বলা হল না। আমরা স্পাইসি বাফেলো উইং খাবারটার বিষয়ে নিজেদের মালিকানা জাহির করতেই পারি, ওটা একেবারে আমাদের নিজেদের।’

     জেমস আগ্রহ সহকারে জানতে চাইলো, ‘আজ রাতে কি সেটা খেতে দেওয়া হবে?’

     ‘আমি দুঃখিত,’ ফ্র্যাঙ্কলিন বললেন,’ ওতে যা যা মশলা লাগে তা যোগাড় করা বেশ কঠিন। অবশ্য তুমি যদি মাদাম ডেলাক্রয়ের অদ্বিতীয় ভুডু ক্ষমতার সাহায্য নাও তাহলে সবই সম্ভব।’

     ‘ও বাবা, তাই বুঝি?’ নেভিল বলে উঠলেন আর খানিকটা মিন্ট জেলি নিতে নিতে। ‘মাদাম, তা সেই ব্যাপারটা কি?’

     যদিও অন্ধ তবু প্রফেসর ফ্র্যাঙ্কলিনের দিকে একটা ভৎসনার দৃষ্টি ছুঁড়ে দিয়েও নিজেকে যেন কিছুটা সামলে নিলেন মাদাম ডেলাক্রয়। ‘আর বলবেন না ডিয়ার প্রফেসর,ওই বুড়ো ভদ্রলোক, ঠিকঠাক বোঝেন না কি নিয়ে কি মন্তব্য করতে হয়। বিশ্বস্তসূত্রে আমার কাছে যা খবর আছে তা অনুসারে উনি নিজের যন্ত্রপাতি আর গিজমো ছাড়া এসব ব্যাপারে একটু কম জানেন।’

     ফ্র্যাঙ্কলিন হাসলেন। তবে সেটা শীতল হাসি। ‘মাদাম ডেলাক্রয় অত্যন্ত ভদ্র মানুষ। আপনারা হয়তো জানেননা, উনি হলেন আমাদের দেশের অন্যতমা বিশেষজ্ঞা রিমোট ফিজিও-অ্যাপারিশন বিষয়ে। জেমস তুমি কি জানো এর কি অর্থ?’

     জেমসের বিন্দুমাত্র ধারণা নেই। ফ্র্যাঙ্কলিন ওর দিকেই তাকিয়েছিলেন, একটা উত্তরের আশায়। মাদাম ডেলাক্রয়ের সাদা চোখের দিকে তাকিয়ে জেমস মাথা নাড়লো নেতিবাচক ভাবে। ফ্র্যাঙ্কলিন কিছু বলার আগেই হ্যারি বলে উঠলেন।

     ‘এর একটাই অর্থ জেমস।  মাদামের, যাকে বলে, এদিকে ওদিকে বিশেষভাবে ঘুরে বেড়াবার ক্ষমতা আছে।’

     ফ্র্যাঙ্কলিন হেসে উঠলেন, ‘বিশেষভাবে বললে কথাটা একতরফা হয়ে যাবে।’ হাসির ধরনটা জেমসের ভালো লাগলো না। কেমন যেন একটা হেয়ভাব মাখানো। ও লক্ষ করেছে ইতিমধ্যেই প্রফেসর তিন পাত্র গলায় ঢেলে ফেলেছেন। ‘জেমস, ব্যাপারটা ভাবার চেষ্টা করে দেখো। রিমোট ফিজিও-অ্যাপারিশন কিছুই কি মাথায় আসছে না? যাকগে। শোনো। এর মানে হলো ওই প্রায় অসহায় অন্ধ বুড়ি মাদাম ডেলাক্রয় নিজেকে অন্য জায়গায় পাঠাতে পারেন। বা বলতে পারো এ বিশ্বের যেকোনো  স্থানে নিজের একটা প্রতিরুপকে পাঠাতে পারেন। যেকোনো জায়গা থেকে যা ইচ্ছে তাই নিয়ে আসতে পারে সেই প্রতিরুপ।  আর তার চেয়েও বড় ব্যাপারটা হলো, যাকে উনি নিজের প্রতিরূপে পাঠান সে কিন্তু অসহায় বৃদ্ধাহয়না বা অন্ধ।’

     ডেলাক্রয় এক দৃষ্টিতে ফ্র্যাঙ্কলিনের কাঁধের ওপর কোন একটা জায়গায় চেয়ে রইলেন। এই মুহূর্তে মুখটায় চেপে বসেছে রাগের একটা মুখোস। তারপরই হাসলেন, ঠিক যেমনটা জেমস দেখেছিল যেদিন উনি এই স্কুলে আসেন। হাসির সঙ্গেসঙ্গেই যেন মুখটা বদলে গেল। ‘ওহো ডিয়ার প্রফেসর, আপনি এমন এমন সব গল্প ফাঁদেন না।’ কথাগুলো উচ্চারণ করলেন ওজন মেপে মেপে। ‘আমার দক্ষতা সেরকম বড় কিছু নয় যা আপনারা বলেন। আর বয়স হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তো সেই দক্ষতাও অনেক কমে গেছে। আমি যদি সত্যিই আপনার কথা মতো ওরকম প্রতিরূপ বানাতেই পারতাম, তাহলে আমার এই আসল রূপটা কেউ দেখতেই পেতো না।’

     ঘরের দমবন্ধ করা পরিবেশটা কাটলো এবং শোনা গেল হাসির শব্দ। ফ্র্যাঙ্কলিনও হাসলেন তবে সেটা না হাসার মতোই ।

     ডেজারট খাওয়ার পর্ব চোকার পর, হ্যারি, জেমস এবং অন্য হগওয়ারটস সদ্যস্যরা ফিরে গেল কমন রুমটায়। যেখানে ফ্র্যাঙ্কলিনের ডেলাইট সেভিংস ডেলাইট যন্ত্র আপাতত তার আওতায় এনে দেখাচ্ছে এক মিল্কিওয়েকে। ঘরটায় এখন ছেয়ে আছে রুপালী আলোর ছায়া। জেমসের মনে হচ্ছিল আলোগুলো যেন ওর চামড়াকে ছুঁয়ে যাচ্ছে। জ্যাক্সন ডিনারের পর বয়স্ক মানুষদের আহ্বান জানালেন সামান্য ককটেল পানীয় গ্রহণের জন্য যা এলো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গ্লাসে। নেভিল ওরটা ছুঁলেন না। মিস সাকারিনা এবং মিঃ রিক্রিয়ান্ট এক পাত্র করে খেয়ে জোর করে হাসার চেষ্টা করতে থাকলেন। হ্যারি আলোতে তুলে ধরে কালচে বাদামী পানীয়টা দেখেই একচুমুকে পুরোটা খেয়ে নিলেন।তারপর চোখ কুঁচকে মাথা ঝাঁকিয়ে কথা বলতে না পেরে প্রশ্নসূচক চোখে প্রফেসর জ্যাক্সনের দিকে তাকালেন।

     জ্যাক্সন জানালেন, ‘অতি উত্তম মানের জিনিস, টেনেসিতে প্রস্তুত। শুধু ওর সঙ্গে একটু উইজার্ড আফটারবার্ন মেশানো হয়েছে।’

     অবশেষে হ্যারি আমেরিকানদের বিদায় জানালেন গুডনাইট সম্ভাষণ করে।

     অন্ধকার করিডোরে সিঁড়ির ধাপ আন্দাজে খুঁজতে খুঁজতে হ্যারি আর জেমস এগিয়ে যাচ্ছিলো। হ্যারির হাত জেমসের কাঁধে।

     ‘জেমস তুই কি আমার সঙ্গে গেষ্ট কোয়ার্টারে থাকতে চাস? কারণ কালকে ঠিক কতটা সময় পাবো তোর সঙ্গে দেখা করার তা বলতে পারছি না। খুব ব্যস্ততার মধ্যে কাটবে দিনটা। প্রথমে আমেরিকানদের সঙ্গে মিটিং,তারপর আবার ডিপার্টমেন্ট অফ অ্যাম্বাসাডোরিয়াল রিলেশন থেকে আসা বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করতে হবে। কোনো ছুতোতেই বিশেষ কোনো “আন্তর্জাতিক ঘটনা” র সূচনা না হয়ে যায় সেদিকেও নজর রাখতে হবে। এর মাঝে সময়ই পাবো না বাড়ির পথে রওনা দেওয়ার আগে।তাই বলছি। কি করবি?’

     ‘এটা আবার কেউ …অবশ্যই থাকবো ড্যাড!’ জেমস সটান বলে দিল। ‘তোমার কোয়ার্টারটা কোথায়?’

     হ্যারি হাসলেন।‘কোয়ার্টারটা! দ্যাখ তাহলে মজা!’ হাঁটা থামিয়ে দাঁড়ালেন হলের মাঝে। এলোমেলোভাবে এদিকে ওদিকে পায়চারি করলেন, তাকালেন ঝাপসা সিলিং এর দিকে। ‘আমি চাই…একটা দারুণ ঘর আজ রাতের জন্য,সঙ্গে দুটো আরামদায়ক বিছানা, আমার আর আমার ছেলে জেমসের জন্য।’

     জেমস অবাক চোখে তাকিয়ে ছিল ড্যাডের দিকে। বেশ কয়েক মুহূর্ত চলে গেল, হ্যারি পদচারণা করেই চলেছেন। মনে হচ্ছে উনি যেন একটা কিছুর জন্য অপেক্ষা করছেন। জেমস সবেমাত্র জিজ্ঞাসা করতে যাবে ব্যাপারটা কি, তার আগেই একটা শব্দ কানে এলো। ওদের পেছনদিকের দেওয়াল থেকেই ধেয়ে এলো হাল্কা একটা কম্পন।জেমস ঘুরে দাঁড়াতেই দেখতে পেলো পাথুরে দেওয়ালে শুরু হয়েছে নড়াচড়া। চোখের নিমেষে ওখানে আবির্ভাব হলো একটা বড় দরজার … যা একটু আগেও ওখানে ছিল না। হ্যারি ছেলের দিকে সবজান্তার ভাব নিয়ে হাসি মুখে তাকালেন এবং এগিয়ে গিয়ে খুললেন দরজাটা।

     ভেতরটা একটা বড় অ্যাপারটমেন্টের মতো।দুটো বিছানাসাজানো আছে, দু থাকে।দেওয়ালে ঝুলছে গ্রীফিন্ডোর পোস্টার। ওয়াড্রোবে রাখা আছে হ্যারির ট্রাঙ্ক আর জেমসের স্কুলের পোষাক।একপাশে একটা ছোট সাজানো গোছানো ওয়াশরুম। জেমস ভেতরে ঢুকে, কোনো কথা না বলে চারদিকটা তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিল।

     ‘একে বলে রুম অফ রিকোয়ারমেন্ট,’ হ্যারি বললেন, একটা গদিওয়ালা চেয়ারে বসে। ‘মনে হয় না আগে তোকে কোনোদিন এই ব্যাপারে বলেছি।’

     পোশাক বদলে জেমস বিছানায় যাওয়ার উদ্যোগ নিতে নিতে লক্ষ করলো হ্যারি বেসিনে হাত মুখ ধুয়ে ডিনারের পোশাক ছেড়ে জিন্সের প্যান্ট আর সোয়েটার পড়ে নিলেন।

     ‘আমায় একটু বাইরে যেতে হবে,’ হ্যারি জেমসকে জানালেন। ‘ডিনারের পর প্রফেসর ফ্র্যাঙ্কলিন ব্যক্তিগত ভাবে আমাকে একটু দেখা করতে বললেন। কালকের মিটিং এর বিষয়ের বাইরে কিছু ব্যাপারে আলোচনা করতে চান।’ কথা বলার ভঙ্গীতেই জেমস বুঝতে পারলো যে ওর ড্যাড এই প্রাইভেট মিটিংটার ব্যাপারে অফিশিয়াল মিটিং এর চেয়েও বেশি আগ্রহী। ‘খুব একটা দেরী হবে না আমার। আমি এই হলের নিচেই থাকবো। আমেরিকানদের থাকার জায়গাটায়। কাল ব্রেকফাস্টে দেখা হচ্ছে তাহলে?’

     জেমস খুশী মনেই মাথা নাড়লো। ড্যাডকে কুইডিচ মাঠে বিচ্ছিরি ঘটনাটার কথা এখনো বলার সাহস করে উঠতে পারেনি। সেই বলাটা যত দেরী করে হয় সেটাই ভালো।

     হ্যারি চলে যাওয়ার পর, জেমস ওপরের বিছানাটায় উঠে শুয়ে পড়ল। ভাবতে থাকলো সন্ধে থেকে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোকে। প্রফেসর ফ্র্যাঙ্কলিনের হঠাৎ করে অসৌজন্যসূচক ব্যবহার ওকে অবাক করে দিয়েছে। ভুডু কুঈন মাদাম ডেলাক্রয়ের হাসির সঙ্গেসঙ্গে চরিত্রের ভোলবদলটাও মনে দাগ কাটার মতো। না দেখতে পেয়েও ঠিকঠাক ভাবে নিজের অদ্ভুতদর্শন কালো জাদুদণ্ডটা দিয়ে এক ফোঁটা ঝোল না ফেলে চামচটাকে নিয়ন্ত্রণ করাটাও ওর মনের আয়নায় ভেসে উঠলো।

     জেমস বুঝতে পারলো এখন কিছুতেই ওর ঘুম আসবে না। বিছানা থেকে নেমে ঘরটাকে ভালো করে দেখতে শুরু করলো। ওয়ার্ডরোবটার একেবারে নিচে ড্যাডের ট্রাঙ্কটা, খোলা অবস্থায় রাখা আছে।জেমস তাকালো ওটার দিকে, থমকে গেল। ঝুঁকলো ভালো করে দেখার জন্য। ভালোই বুঝতে পারছে ও ঠিক কি দেখতে পাচ্ছে ট্রাঙ্কটার ভেতরে। ড্যাড ওটা সঙ্গে করে এনেছে বলে অবাক হচ্ছে তার থেকেও বেশী। এখানে ওটা ড্যাডের কি কাজে দরকার? জেমস একটু ভাবলো। তারপর ট্রাঙ্কটার ভেতর থেকে তুলে নিলো ইনভিজিবল ক্লোকটা। ভাঁজ খুললো ওটার, বেশ বড় ঝুল।

     স্কুল জীবনে হ্যারি পটার নিজে কতবার এই পোষাকটার অন্তরালে থেকে সুরক্ষিতভাবে হগওয়ারটসে অভিযান করেছেন? জেমস অনেক গল্প শুনেছে, ড্যাড, রন আঙ্কল এবং হারমায়োনি আন্টির কাছে। ও বুঝতে পারছে এটা একটা দারুণ সুযোগ যা মোটেই হাতছাড়া করা যাবে না। কিন্তু যাবেটা কোথায়?

     একটু ভাবতেই ওর মুখে ফুটে উঠলো এক দুষ্টুমির হাসি। ঝপ করে ওটা পড়ে নিলো, আগেও বারকয়েক পরেছে এটা বাড়িতে খেলার ছলে। এই মুহূর্তে জেমসকে আর দেখা যাচ্ছিল না। রুম অফ রিকোয়ারমেন্টের দরজাটা নিজে নিজেই খুলে গেল বলেই মনে হলো জেমস একটু এগিয়ে যেতেই।তারপর বন্ধও হলো নিঃশব্দে।

     পা টিপে টিপে জেমস এগিয়ে চললো আল্মা আলেরনের প্রতিনিধিরা যেখানে থাকছেন সেই দিকে।

     করিডোরটার অর্ধেক পার হয়েছে সবে একটা কিছু নড়াচড়া করতে দেখা গেল। মিঃ ফিলচের বদমাইশ বিড়ালটা। ফুট কুড়ি দূর থেকে এদিকেই এগিয়ে আসছে। জেমস দমবন্ধ করে দাঁড়িয়ে গেল। ‘তোর তো এতোদিনে মরে ভুত হয়ে যাওয়ার কথা, হতচ্ছাড়া পুরানো লোমের বান্ডিল?’ নিজের ভাগ্যকে গাল দিতে দিতে ফিসফিস করে বললো জেমস। ওর পেছন পেছন এলো আর এক বিপদ, শোনা গেল ফিলচের কণ্ঠস্বর।

     ‘ধরে ফেলতো দেখি সোনা আমার,’ সুর খেলিয়ে বলছিল ফিলচ। ‘ওই পুচকেটা যেন পালাতে না পারে। এমন শিক্ষা দিবি যাতে ওই ইঁদুরের সাঙ্গপাঙ্গোগুলো ভয়ে কেঁপে ওঠে।’ ফিলচের ছায়ার অংশ এবার দেখা গেল, আকারে বাড়ছে এগিয়ে আসার সঙ্গেসঙ্গে।

     জেমস জানে যে ও অদৃশ্য হয়ে আছে, তা সত্ত্বেও নিজেকে দেওয়ালের সঙ্গে মিশিয়ে নেওয়ার ইচ্ছেটা দমন করতে পারলো না। দরজা আর একটা দেওয়ালে ঝোলানো বর্মের সরু ফাঁকে গুঁজে দিল নিজের শরীরটাকে। চেষ্টা করতে থাকলো অল্প করে নিঃশ্বাস নিয়ে শব্দটা কমানোর।

     বর্মটার কনুই এর পাশ দিয়ে উঁকি মারতেই দেখতে পেলো ফিলচ এসে গেছে করিডোরের সংযোগস্থলটায়।টলতে টলতে হাঁটছে। ‘কিরে ওরা কি লুকানোর গর্ত খুঁজে পেয়ে গেলো? জড়ানো গলায় প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিলো মিসেস নরিসের উদ্দেশ্যে। কোটের পকেটে হাত ঢুকিয়ে বার করলো একটা রুপালী রঙের ফ্লাস্ক। ভেতরের পানীয় এক চুমুক খেয়ে মুখটা মুছলো জামার হাতায়, ঢাকনা লাগালো ফ্লাস্কটার। ‘ওই ওই ওরা আসছে, এদিকেই আসছে, এদিকে চলে আয় সোনা। আয় আয়।’

     দুটো ইঁদুর এদিক ওদিক ছোটাছুটি করে ফিলচের পায়ের দিকেই এগিয়ে গেল। মিসেস নরিস ঝাঁপিয়ে পড়লো ওদের ধরার জন্য। নাগাল অবশ্য পেলো না। ইঁদুর দুটো ছুটে এলো জেমস যেখানটায় লুকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সেদিকে। মিসেস নরিসও গড়গড় শব্দ করে পিছু নিলো। জেমস শিঊরে উঠলো, ইদুর দুটো বর্ম দিয়ে উঠে ওর ইনভিজিবল ক্লোকের ভেতর ঢোকার চেষ্টা করছে। ওদের ঠান্ডা খুদে খুদে পা জেমসের পায়ের পাতার ওপর, তারপর চুপ করে স্থির হয়ে গেল দুটোতেই ওর পায়ের ফাঁকটাতে। যেন একটা লুকানোর জায়গা পেয়ে গেছে ওরা। জেমস চেষ্টা করলো ওদের লাথি মেরে সরিয়ে দেওয়ার, কিন্তু দুটোই নাছোড়বান্দা।

     মিসেস নরিস এদিক ওদিক থাবড়ে থাবড়ে দেখছিল। ওর নখ ঘষার আওয়াজ শোনা যাচ্ছিলো। ইনভিজিবল ক্লোকটার কাছে এসে দাঁড়ালো। এপাশ ওপাশ দেখলো, চোখ দুটো ঝলসে উঠলো যেন, বুঝতে পারছিল কাছাকাছি কোথায় ইঁদুরগুলো আছে, কিন্তু দেখতে পাচ্ছিলো না।

     ‘খবরদার আমায় বোঝাতে চাস না যে ওরা তোকে বোকা বানিয়ে দিয়েছে,’ ফিলচ বললো ওদের দিকে এগিয়ে আসতে আসতে।

     জেমস নজর রাখছিল মিসেস নরিসের দিকে। অনেক বছর আগে বিড়ালটার সঙ্গেএই বিশেষ পোশাকের মোলাকাত হয়েছিল। রন আঙ্কল আর হারমায়োনি আন্টি দুজনেই সে গল্প বলেছেন ওকে।

     হয়তো ও সেই চেনা গন্ধটা আবার পাচ্ছে। অথবা ও জেমসের অস্তিত্ব বুঝতে পারছে, ওর গায়ের তাপমাত্রা বা ওর গন্ধ বা ওর হৃৎপিণ্ডের শব্দের মাধ্যমে।

     ‘আমার সোনামণি,পাতি হেরো পার্টি হয়োনা মিসেস নরিস,’ ফিলচ আরো খানিকটা এগিয়ে এসেছে। এতটাই কাছে এসে গেছে যে হাত বাড়ালেই জেমসকে ছুঁতে পারবে। ‘ও দুটো যদি পালায়, ওরা নিশ্চিত গিয়ে নিজেদের বন্ধুদের বলবে। আর সেটা একটা বিরাট পরাজয় হবে কিন্তু তোর পক্ষে।’

     মিসেস নরিস আর একটু এগোলো। জেমসের পায়ের মধ্যে বসে থাকা ইঁদুর দুটো কুঁকড়ে গেল। একে অপরকে জড়িয়ে ধরলো, পিছিয়ে গেল একটু। মিসেস নরিস থাবা উঠালো। জেমসকে কাঁপিয়ে দিয়ে সেই থাবা আছড়ে পড়লো অদৃশ্য পোষাকের কানায়। ফ্যাঁস করে ডেকে উঠলো বুড়ো বেড়াল।

     সে শব্দ শুনে ইঁদুর দুটো আরো কুঁকড়ে গেল। হঠাৎই দুটোতে ভয়ডর ঝেড়ে ফেলে সোজা দৌড় লাগালো মিসেস নরিসের পা লক্ষ করে।

     যা দেখে লাফিয়ে উঠলো বিড়ালটা। ঘুরে তাকালো ইঁদুরদুটোর করিডর দিয়ে ছুটে পালানোর দিকে।

     ফিলচ খ্যালখেলিয়ে হেসে উঠলো।

     ‘ওহ সোনা আমার, ওরা তোকে ভয় পাইয়ে দিয়েছে! যদিও আমি ওটা আশা করিনি। ওই যে ওরা পালাচ্ছে, যা যা ওদের ধরগে যা।’

     কিন্তু মিসেস নরিস আবার জেমসের দিকেই ফিরলো, চকচকে কমলা চোখ দুটো চকচক করছিল। বিস্তৃত হয়েছে চোখের মণি কাটা দাগ।

     ‘যা, নরিস, যা! ধর ধর ওদের হতচ্ছারী!’ ফিলচের কণ্ঠস্বরে বিরক্তির ছোঁয়া। এক লাথি মারলো, ছিটকে গেল বিড়ালটা ইঁদুরগুলোর দিকে জেমসের কাছ থেকে। ওদের অবশ্য আর দেখা যাচ্ছে না, করিডোরের কোনো এক কোনায় লুকিয়ে পড়েছে। ফিলচের পা ঠেকলো ক্লোকটায়। ফিলচ একটা ঠান্ডা হাওয়ার ছোঁয়া অনুভব করলো পায়ের পাতায়।

     মিসেস নরিস ঘুরে জেমসের দিকে তাকিয়ে ফ্যাঁসস করে ডাক ছাড়লো। ফিলচের মনোযোগ অবশ্য লুকিয়ে পড়া ইঁদুরদের দিকে। ‘ব্যাটা কানার হদ্দ, ওরা ওই দিকে গেছে। উফ ভাবতেই পারছি না দুটো বোকা জন্তু তোকে থতমত করে দিয়ে পালিয়ে গেল। যা যা! ধর! ধর! ওদের। আর অনেক আছে রান্নাঘরের আশেপাশে।’ করিডোরের অন্ধকারে মিলিয়ে গেল ফিলচ, পেছন পেছন মিসেস নরিস। বার কয়েক পিছু ফিরে জেমসকে দেখলো তারমধ্যেই।

     ওরা বাঁকটা ঘুরতেই, বড়সড় কয়েকটা শ্বাস নিয়ে নিজেকে ধাতস্থ করলো জেমস। তারপর আবার এগিয়ে চললো একটার পর একটা করিডোর পেরিয়ে। প্রায় দৌড়ানোর মত করেই। নিজেকে যথেষ্টই ভাগ্যবান বলে মনে হচ্ছিল ওর।

     আমেরিকানদের থাকার জায়গায় পৌঁছে দেখতে পেলো দরজা বন্ধ হয়ে গেছে ভেতর থেকে। অন্ধকারে নিস্তব্ধতায় জেমস ওর ড্যাড আর ফ্র্যাঙ্কলিনের গলার আওয়াজ পাচ্ছিলো, কিন্তু ওরা কি বলছেন তা বোঝা যাচ্ছিলো না। না এখানে এসে লাভ হলোনা, এর চেয়ে সেড্রিকের ভুতের সঙ্গে দেখা করতে গেলে বা ওই মাগল অনুপ্রবেশকারীর খোঁজ করতে গেলে ভালো হত এই সব ভাবছে জেমস এমন সময় দরজাটায় শব্দ হলো।নড়ে উঠলো দরজাটা, জেমস চমকে সরে গেল একপাশে, ভুলেই গেছে ও এখন অদৃশ্য হয়ে আছে। দেওয়ালের সঙ্গে একবারে সেঁটে দাঁড়ালো, দরজাটা খুলে গেল। ফ্রাঙ্কলিন বেরিয়ে এলেন আগে, মৃদুস্বরে কথা বলতে বলতে, পেছনে হ্যারি।প্রয়োজন নেই তবু দরজাটা লাগালেন একজন অরোরের অভ্যস্ত ভঙ্গীতে। অনেকবার হ্যারি ছেলেকে বলেছেন, ‘দরকার না থাকলেও অভ্যাস বজায় রাখার অভ্যাসটা ছাড়বে না। আর যখন সেটা করবে তখন কেন করছো এ নিয়ে একদম ভাববে না।’

     ‘আমার মনে হয় ব্যক্তিগত কথাবার্তা কোন এক জায়গায় বসে না করাটাই উচিত কাজ,’ ফ্র্যাঙ্কলিন বললেন। ‘এখানে তো   সেই সমস্ত মানুষেরা আড়িপাতার জন্য তৈরি হয়ে বসে আছে যাদের সঙ্গে আমার মত মেলে না। পায়চারি করতে করতে  কথা বললে অন্তত আমাদের আশেপাশে কোন অযাচিত কান আড়ি পাততে পারবে না।’

     ‘কি অদ্ভুত ব্যাপার,’ হ্যারি বললেন। ‘একসময় যখন ছাত্র ছিলাম তখন কত কতবার এই সব হল আর করিডোর এ ভয়ে ভয়ে ঘুরে ঘুরে বেরিয়েছি গোপন খবর পাওয়ার জন্য।আর এখন যখন বড় হয়ে গেছি তখনও সেই ইচ্ছেটা ছাড়তে পারছি না। সেই ভয়টা পাওয়ার, ধরা পড়ার এবং শাস্তি পাওয়ার।’

     দুজন আস্তে আস্তে হাঁটতে থাকলেন।বিশেষ কোনও দিকে যাওয়ার উদ্দেশ্য নিয়ে নয়। জেমস নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে ওদের অনুসরণ করতে শুরু করলো। সঙ্গেই সতর্ক থাকল যাতে নিঃশ্বাসের শব্দ জোরে না হয় বা কোন স্ট্যাচু বা দেওয়ালে ঝোলানো কিছুতে ধাক্কা না খায়। ‘পরিস্থিতি তেমন কিছুই বদলায় নি, বুঝলেন,’ ফ্র্যাঙ্কলিন বললেন। ‘এখন অবশ্য শাস্তি পাওয়ার থেকেও খারাপ ব্যাপার নিয়ে আমাদের ভাবা দরকার।’

     ‘হয়তো তাই,’ হ্যারি বললেন। জেমস অনুভব করলো এর সঙ্গে একটা মিচকে হাসির ছোঁয়া। ‘আমি অবশ্য অনেক সাংঘাতিক সাংঘাতিক শাস্তি পেয়েছি এরকম করতে গিয়ে।’

     ‘হুম,’ ফ্র্যাঙ্কলিন বিড়বিড় করলেন। ‘আমাদের দুজনের স্কুলের ইতিহাসেই জড়িয়ে আছে অনেক বিদঘুটে চরিত্র এবং অপ্রয়োজনীয় নোংরামো। আপনাদের মিস আম্ব্রিজ, আমাদের প্রফেসর ম্যাগনুসসেন। আপনাদের ভলডেমরট, আমাদের… ইয়ে, সত্যি বলতে কি আমাদের ইতিহাসে অবশ্য ওই মাত্রার কেউ নেই যার সঙ্গে ওর তুলনা হয়।স্বীকার করতেই হবে আমাদের সকলের জীবনযাত্রার পক্ষে ওনার বেঁচে থাকাটা একটা ভয়ানক দুশ্চিন্তার বিষয় ছিল। আপাতত আমাদের প্রধান দায়িত্ব হলো ওরকম ঘটনা যাতে আর না ঘটে সেদিকে নজর রাখা।’

     ‘আমি কি ধরে নিতে পারি যে আমাদের এই সাক্ষাৎ তাহলে ওই রকম কোন ভয়ানক দুশ্চিন্তা বিষয়ে আলোচনা করার জন্যই হচ্ছে? মানে বলতে চাইছি যে, অফ দ্য রেকর্ড সেরকম কিছু কি আপনি বলতে চান?’ হ্যারি জানতে চাইলেন গুরুত্ব সহকারে।

     ফ্র্যাঙ্কলিন একটু হতাশভাবেই বললেন, ‘মিস্টার পটার,সব মানুষের অনেক বন্ধু থাকেনা বা খবর যোগাড় করার লোক থাকে না। তার ওপর আমি অরোরও নই। আমার সেরকম অফিসিয়াল অনুমতিও নেই যে আমি আমার দেশে বিশেষ কিছু করতে পারি। আমি একজন সাধারণ বৃদ্ধ শিক্ষক মাত্র। আর এই ধরনের বৃদ্ধ শিক্ষকদের যে খুব একটা পাত্তা দেওয়া হয়না সেটা আপনি ভালো মতোই জানেন। কিন্তু এই বুড়ো শিক্ষকগুলোই অনেক কিছু দেখে ফেলে।’

     ‘আল্মা আলেরনে কি প্রোগ্রেসিভ এলিমেন্ট এর মতো সংগঠন আছে?’

     ‘আছে,তবে দুর্ভাগ্যবশত যা সব ঘটছে সে ব্যাপারটা ওর চেয়েও অনেক বড় কিছু। ভলডেমরট এবং ডেথ ইটারসদের বিষয়ে তথ্যাদি খতিয়ে দেখার জন্য অনেক শিক্ষার্থী এবং কর্মচারীই উঠে পড়ে লেগেছে। অবাক লাগছে এটা ভেবে যে অতি অল্পদিনের মধ্যেই ইতিহাসকে ঘুরিয়ে দেখানোর প্রবণতাটা হঠাৎ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে।’

     হ্যারি নিচুস্বরে বললেন, ‘প্রোগ্রেসিভ এলিমেন্টদের বোঝা উচিত যে ওরা যেটা করছে সেটা ঠিক না। এখনো অনেক মানুষ বেঁচে আছেন যারা ভলডেমরট আর ওর স্বেচ্ছাচারিতার স্মৃতি বহন করে চলেছেন।অনেক মানুষ আছেন যারা ওর কারনে নিজেদের পরিবার বন্ধুবান্ধবকে হারিয়েছেন। যাদের হত্যা করেছিল ডেথ ইটারস এর দল। আর সেই ইতিহাসকে চ্যালেঞ্জ করার ভাবনা, তা সে যে স্তরেই হোক, তরুণদের মধ্যে একটু বেশিমাত্রায় দেখা যাচ্ছে। আমি অবশ্য এটাকে একটা স্বাভাবিক ঘটনা ধরে নিয়েছি। এসব বেশিদিন টিকবে না। ওরা যা চাইছে সেটাই হবে। ইতিহাস ওদের সব প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দেবে।’

     ‘ইতিহাস একটা ফাঁকা আওয়াজ,’ ফ্র্যাঙ্কলিন বললেন বিরক্তির স্বরে। ‘আমি খুব ভালো করে বুঝি। আমি এই ইতিহাসে দীর্ঘদিন ধরে বিচরণ করছি।আর সেই অভিজ্ঞতা থেকেই বলছি নথিভুক্তিকরণে একটা বিরাট ফারাক থেকে যায় যা তথ্য সংগৃহীত হয় আর যা আদতে ঘটেছে হয় তার মধ্যে।’

     ‘আমি আশা করবো আপনার কথাটা যেন ব্যতিক্রম রূপেই থাকে, নিয়মে পরিণত না হয়,’ হ্যারি বললেন।

     ফ্র্যাঙ্কলিন একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেন এবং ওরা একটা বাঁক ঘুরলেন।‘আমিও তাই চাই। ঘটনা হলো এই সব ব্যতিক্রম নামক জিনিসগুলোই ওই হতচ্ছাড়া প্রোগ্রেসিভ এলিমেন্ট জাতীয় সংগঠনগুলোকে সুযোগ দেয় ইতিহাসের তথ্যকে চ্যালেঞ্জ করার। ভলডেমরটের উত্থান ও তার ইতিহাস, যেটা আমরা জানি, সেটা ওদের চাহিদার সঙ্গে খাপ খাচ্ছে না। যে কারনেই ওরা বিশেষ ভাবে এটাকে লক্ষ্য বানিয়েছে। আসলে একটা জমি তৈরি করার প্রয়োজন পড়েছে ওদের,যা করতে পারলে   যেখানে যত গরমিল গণ্ডগোল সেগুলোর প্রতি জনগনের বিশ্বাস বাড়বে বলে ওদের ধারনা।’

     ‘আমার তো মনে হচ্ছে,’ হ্যারি বললেন গলার স্বর আর খানিকটা কমিয়ে, ‘আপনার ভালোই একটা আইডিয়া আছে আসলে ওরা ঠিক কি করতে চাইছে সে বিষয়টার।’

     ‘অবশ্যই আছে এবং আপনারও আছে মিঃ পটার। হাজার বছরেও ওই বিশেষ অ্যাজেন্ডাটা কিন্তু বদলায়নি, বদলেছে কি?’

     ‘না, একদমই বদলায়নি।’

     ‘ডিয়ার হ্যারি পটার।’ করিডোরের অন্ধকারে দাঁড়িয়ে গেলেন ফ্র্যাঙ্কলিন, তাকালেন হ্যারির মুখের দিকে। ‘বিশ্বাস করবেন কিনা জানি না তবে আমার দেশের বেশ কিছু পরিমাণ মানুষ বিশ্বাস করে লর্ড টম রিডল, ভলডেমরটকে ওরা ওই নামেই ডাকতে ভালোবাসেন। যাকে আপনি হারিয়ে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছিলেন।সেই শয়তানটাকে, শয়তানের তকমা পরানো আসলে আপনার কারসাজি। ওরা বিশ্বাস করতে ভালবাসেন ভলডেমরট আসলে একজন বৈপ্লবিক নায়ক, একজন শুদ্ধ চিন্তক, ওনার ভাবনাগুলো আসলে চিরন্তন রীতিনীতির পক্ষে একটু বেশি উন্নত হয়ে পড়েছিল। ওরা মনে করেন ওনাকে ধ্বংস করা হয়েছিল তার কারণ উনি সব কিছু বদলে দিয়ে ভালো কিছু করার হুমকি রূপে প্রতিভাত হয়েছিলেন। যেটা মোটেই নাকি খারাপ ছিল না। কিন্তু ধনী এবং শক্তিশালীরা নিজেদের স্বার্থে এর বিরোধিতা করেছিল।’

     জেমস কয়েক ফুট দূরেই দাঁড়িয়ে, ক্লোকটার আড়ালে, ভালোই বুঝতে পারছে ড্যাডির চোয়াল শক্ত হয়ে উঠেছে ফ্র্যাঙ্কলিনের কথায়। কিন্তু হ্যারির কথা বলায় সেটা প্রকাশ পেলো না। স্বর আগের মতই শান্ত এবং মাপা।

     ‘আশা করছি, আপনি জানেন নিশ্চয় ওই সব ভাবনাগুলো মিথ্যে এবং সাজানো।’

     বেশ রাগের ভঙ্গীতেই হাত ঝেড়ে ফ্র্যাঙ্কলিন বললেন, ‘অবশ্যই আমি জানি। কিন্তু ঘটনা হলো এই সব সাজানো মিথ্যেগুলোই অনেক মানুষকে আকর্ষণ করছে। যারা এই মিথ্যেগুলো ছড়াচ্ছে তারা খুব ভালো করে জানে কিভাবে মানুষের মনও অনুভূতি নিয়ে খেলা করতে হয়। ওদের বিশ্বাস অনুযায়ী সত্য হল একটা তারের মতো যাকে ওরা নিজেদের ইচ্ছেশক্তি দিয়ে বেঁকিয়ে দেবে। আর এটাই ওদের একমাত্র অ্যাজেন্ডা যেটাকে ওরা গুরুত্ব দেয়।’

     হ্যারি চুপ করে দাঁড়িয়েই রইলো, ‘আর এই সবের পেছনে আসল কারণ মাগলদের জগতটায় শাসন করা।এটাই মুখ্য বিষয়, এটাই তো আপনি মনে করেন?’

     ফ্র্যাঙ্কলিন হাসলেন, রুক্ষভাবে, জেমসের মনে পড়ে গেল ডিনারের সময়ে প্রফেসরের কুৎসিত ভাবে হাসাহাসি করার দৃশ্য, মাদাম ডেলাক্রয় এর ক্ষমতা নিয়ে। ‘আমি ওদের এ নিয়ে বলতে শুনিনি। না। এখন ওরা কাজ করে আরো গুছিয়ে। ওরা ঠিক বিপরীত জিনিসটা চাইছে। ওদের চাহিদা এখন মাগল আর জাদু জগতের মধ্যে সমন্বয় আনা। একেবারে খোলাখুলিভাবে মেশা, সব রকম গোপনীয়তা এবং প্রতিযোগিতায় বৈষম্য নিশ্চিহ্ন করা। ওরা প্রচার করছে মাগলদের পক্ষে সেটাই অপমানের যেখানে যেখানে ওদের সামান্য ভাবে হলেও দূরে সরিয়ে রাখা হচ্ছে জাদুজগৎ থেকে।

     হ্যারি মাথা নোয়ালেন সম্মতির। ‘ঠিক যেমনটা আমরা এখানে দেখতে পাচ্ছি। এতো দুধারি তলোয়ার। অযৌক্তিক সিদ্ধান্ত এবং অবৈষম্যর প্রচার একটাই বার্তার মাধ্যমে।’

     ‘ঠিক তাই,’ ফ্র্যাঙ্কলিন সম্মতি জানালেন, হাঁটা শুরু করে। ‘আমেরিকাতে আমরা আবার সেই গল্প শুনতে পাচ্ছি, মাগল বিজ্ঞানীরা নাকি উইচ আর উইজার্ডদের অপহরণ করছে, অত্যাচার করছে ম্যাজিকের পেছনে লুকিয়ে থাকা সূত্রগুলো জানার জন্য।’

     ‘সেই পুরানো সালেম উইচ ট্রায়াল এর মতো?’ হ্যারি জানতে চাইলেন।

     ফ্র্যাঙ্কলিন হাসলেন, যে হাসি একেবারে অমলিন। ‘বোধহয় না। সেসব দিন ছিল সুখের। সত্যি বলছি। সেসময় উইচদের বিচারের অনিবার্য শাস্তি ছিল পুড়িয়ে মারা। কিন্তু নিশ্চয়ই জানেন উইচদের কাছে জাদুদণ্ড থাকলে মাগলদের কোন আগুনের ক্ষমতা নেই কিছু করার। আগুনের মধ্যে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ চিৎকার করা, যেটা আসলে মাগলদের খুশী করতে অভিনয়। তারপর নিজেকে ট্রান্সপোর্ট করা আগুন থেকে নিজের ঘরের ফায়ারপ্লেসে। আর এটা থেকেই এসেছিল ফ্লু নেটওয়ার্ক এর প্রাথমিক স্তরের ভাবনা, এটা ভুলে যাবেন না। এখন উইচ আর উইজার্ডদের নিয়ে যে সমস্ত কথা শোনা যাচ্ছে তা সবই গুজব, নির্ভেজাল মিথ্যে। বিশ্বাসীদের কাছে অবশ্য এসবের কোন দাম নেই। ভয় আর অযৌক্তিক আচার আচরণকে পাশাপাশি রেখে কাজ করানো হচ্ছে “সমতা” আনার লক্ষ্য দেখিয়ে। ওদের মতে সব কিছু খোলাখুলি ভাবে হলে নাকি শান্তি আর স্বাধীনতা কায়েম হবে। গোপনীয়তা বজায় রেখে কাজ করলেই নাকি উইজার্ডিং সোসাইটির ওপর ক্রমবর্ধমান মাগল জগতের আক্রমণ বাড়তেই থাকবে।’

     হ্যারি একটা জানলার কাছে থামলেন। ‘আর যখন ওরা সব কিছু খোলাখুলিভাবে প্রকাশ করার সুযোগ পাবে তখন কি হবে?’

     ‘তাহলে, তার ফলাফল একতরফাই হবে।আপনার কি মনে হয়?’

     হ্যারির মুখে চিন্তার ছাপ দেখা গেল চাঁদের আলোয়। ‘মাগল আর উইজার্ডরা প্রতিযোগিতা আর ঈর্ষার খেলায় মেতে উঠবে। যেরকম অনেক অনেক যুগ আগে হয়েছে। আর এর সুযোগ নেবে ডার্ক উইজার্ডরা। প্রথমে খুব ছোট মাত্রায় চ্যালেঞ্জ বা বিক্ষোভ হবে। আইন পাস হয়ে যাবে। চাপ বাড়ানো হবে সমতা বজায় রাখার জন্য। কিন্তু সমস্যা হবে এটাই যে নতুন আইন ব্যবহৃত হবে এক বিশেষ কারণে। সমতার নাম করে উইজার্ডরা চাইবেন মাগলদের শাসনতন্ত্রে প্রবেশ করতে। একবার ঢুকতে পারলেই আরো ক্ষমতা লাভের জন্য চাপ বাড়ানো শুরু হবে। এবং ওরা জিতেও যাবেন মাগল নেতাদের হারিয়ে, যেনতেন প্রকারে। সে মিথ্যা বলেই হোক বা প্রতিশ্রুতি দিয়ে বা ভয় দেখিয়ে অথবা শেষ অস্ত্র ইম্পেরিয়াস কারস ব্যবহার করে। পরিণতি দাঁড়াবে একটাই, সব সিস্টেম তছনছ হয়ে যাবে। আর অবশেষে শুরু হবে এক মরনপণ যুদ্ধ।’ হ্যারির গলাটা যেন ভারি হয়ে এলো। ফ্র্যাঙ্কলিনের দিকে ঘুরলেন, যিনি একভাবে ওর দিকে তাকিয়ে ছিলেন। ওনার মুখের ভাব শান্ত কিন্তু চিন্তাক্লিষ্ট। ‘এটাই তো ওরা চায় তাই না প্রফেসর? মাগলদের সঙ্গে একটা যুদ্ধ।’

     ফ্র্যাঙ্কলিন সম্মতি জানিয়ে বললেন, ‘এতো ওরা চিরকালই চেয়ে এসেছে। এই টানাপোড়েন থামেনি কখনোই। শুধু রূপ বদলে নতুন অধ্যায় তৈরি হয়েছে।’

     ‘কারা আছে এসবের পেছনে?’ হ্যারি সোজাসুজি প্রশ্নটা করলেন।

     ফ্র্যাঙ্কলিন আবার দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, চোখটা একবার কচলালেন। ‘অত সোজা নয় ব্যাপারটা। আপাতভাবে ওদের অনুগামীদের মধ্যে থেকে মাথাগুলোকে খুঁজে বের করা অসম্ভব। ওদের মধ্যে কিছু একক ব্যক্তিত্ব আছে যাদের ওপর নজর রাখতেই হচ্ছে।’

     ‘মাদাম ডেলাক্রয়।’

     ফ্র্যাঙ্কলিন তাকালেন হ্যারির মুখের দিকে। সম্মতি সুচক মাথা ঝোঁকালেন‘এবং প্রফেসর জ্যাক্সন’।

     জেমস ঢোঁক গিলতে গিয়ে কেশে ফেলে মুখটা হাত দিয়ে চেপে ধরলো। ওর ড্যাড আর প্রফেসর ফ্র্যাঙ্কলিন থমকে দাঁড়ালেন। জেমস নিশ্চিত ওরা শব্দটা শুনে ফেলেছে। হ্যারি বললেন।

     ‘আর কাউকে সন্দেহ হয়?’

     ফ্র্যাঙ্কলিন ধীরে ধীরে মাথা নেড়ে বললেন, ‘অবশ্যই হয়। কিন্তু তাহলে তো আপনাকে সবকিছু এবং সবার দিকে নজর রাখতে হয়। এটা একটা দেওয়ালে অনেক আরসোলার সমাবেশ দেখতে পাওয়ার মতো ব্যাপার। হয় আপনাকে ফাঁকটা খুঁজে নিয়ে ওদের আসা বন্ধ করতে হবে, অথবা নিজের বাড়ির ক্ষতি করে ওদের পুড়িয়ে মারতে হবে। বেছে নিন কোনটা করবেন।’

     জেমস সন্তর্পণে পিছাতে থাকলো। যখন বুঝলো ওর আওয়াজ আর কেউ শুনতে পাবে না, তখন দ্রুত হাঁটতে শুরু করলো আমেরিকানদের কোয়ার্টার লক্ষ্য করে। ওর হৃৎপিণ্ড এত জোরে লাফাচ্ছিল যে ও নিশ্চিত এই শব্দ ওর ড্যাড এবং প্রফেসরের কানে পৌঁছে যেতো।

     ওই প্রোগ্রেসিভ এলিমেন্ট নামক গ্রুপটা মোটেই ভালো কিছু না এটা জেমসের বুঝতে অসুবিধা হয় না।আর এখন ও নিশ্চিত যে আসলে ওরা ছক কষছে মারলিনাস অ্যাম্ব্রোসিয়াসকে ফিরিয়ে আনার। যিনি ওদের সাহায্য করবেন ওই ভুয়ো সমতা আনয়নের বিষয়ে। যার নিশ্চিত পরিণতি একটা যুদ্ধ। মারলিনতো বলেই গেছেন তিনি ফিরে আসবেন যখন মাগল আর জাদুজগতের ভারসাম্য তার শাসনযোগ্য হয়ে উঠবে। এ কথাটার মানে কি? ওর একটুও আশ্চর্য লাগছে না এটা জেনে যে মাদাম ডেলাক্রয় এই ষড়যন্ত্রের মধ্যে থাকতে পারেন। কিন্তু প্রফেসর জ্যাক্সন? জেমসের ওনাকে বেশ পছন্দই হয়ে গিয়েছিল। রুক্ষ আচরণ সত্ত্বেও। ও কল্পনাতেও আনতে পারছে না জ্যাক্সন মাগল জগতকে শাসন করার পরিকল্পনা করছেন। ফ্র্যাঙ্কলিনের কোথায় একটু ভুল হচ্ছে উনার বিষয়ে।

     ছুটে জেমস আমেরিকানদের থাকার জায়গাটা পেরিয়ে গেল। খুঁজতে চেষ্টা করলো সেই দরজাটা যেটা দিয়ে ও আর ড্যাড ঘরটার মধ্যে ঢুকেছিল। এক ঝলক আতঙ্ক ওকে ধাক্কা মারলো যখন ও বুঝতে পারলো দরজাটা অদৃশ্য হয়ে গেছে ও বেরিয়ে আসার পর। বন্ধ হওয়ার সঙ্গেসঙ্গেই। একটা জাদুর ঘর ওটাএটা ভুললে চলবে কি করে। কিন্তু এখন ও ভেতরে যাবে কি করে? ড্যাড যখন ফিরে আসবে তখন তো ওর ভেতরে থাকা দরকার,ঘুমের দেশে। করিডোরে দাঁড়িয়ে ও খোঁজার চেষ্টা করলো দরজাটাকে।বুঝতে চাইলো ঠিক কোথায় ওটার আবির্ভাব হয়েছিল। কিছু একটা সূত্র যদি মেলে কোথায় দরজাটা লুকিয়ে আছে। কি যেন বলে ছিল ড্যাড ঘরটার নাম? রুম অফ রিকোয়ারমেন্ট? জেমসের জাদুদণ্ডের কথা মাথায় এলো। বার করলো ওটাকে। হাতটা বার করলো ক্লোকের ভেতর থেকে।

     ‘ইয়ে,’ দেওয়ালের দিকে দণ্ডটাকে তাক করে ফিসফিসিয়ে বললো, ‘রুম অফ রিকোয়ারমেন্ট … খুলে যাও?’

     কিছুই হলো না যদিও। জেমসের কানে এলো একটা আওয়াজ। ওর সব কটা ইন্দ্রিয় এই মুহূর্তে টানটান। শরীরে বয়ে যাচ্ছে অ্যাড্রেনালিনের স্রোত। কথা বলার শব্দ ভেসে আসতেই ও শোনার চেষ্টা করলো। ফ্র্যাঙ্কলিন আর ড্যাড ফিরে আসছেন। সম্ভবত জেমস ফিরে আসার একটু বাদেই ওরাও ফেরার পথ ধরেন। চাপাস্বরে ওরা কথা বলছেন। বোধহয় আমেরিকানদের কোয়ার্টার এর দরজায় কাছেই দাঁড়িয়ে আছেন।কিছুক্ষণের মধ্যেই ওর ড্যাড এসে যাবেন এখানে।

     জেমসের মনে ভাবনার ঝড়। ড্যাড ঠিক কি করেছিলেন দরজাটা খোলার জন্য? উনিতো শুধু দাঁড়িয়ে ছিলেন এখানে…  একটু অপেক্ষা করলেন…দেওয়ালটা কেঁপে উঠলো…আর একটা দরজা… তাই কি? জেমস প্রথম থেকে ভাবতে থাকলো। উনি প্রথমে কিছু একটা বললেন। তারপর পাইচারী করলেন। জেমস মনে করার চেষ্টা করলো, কি বলেছিলেন ওর ড্যাড। মনে পড়লো না।

     একটা আলো জ্বলে উঠলো করিডোরের প্রান্তে। পায়ের শব্দ এগিয়ে আসতে থাকলো। জেমস উদভ্রান্তের মতো তাকালো সেদিকে। ওর ড্যাড হেঁটে আসছেন, আলোকিত জাদুদণ্ডের মুখ নিচের দিকে নামানো, হ্যারির মুখ ঝুঁকে আছে নিচের দিকে। জেমসের মনে পড়লো জাদুদণ্ড সমেত হাতটা ক্লোকের বাইরে আছে। ঝট করে ওটা ঢুকিয়ে নিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে গেল, ভালোকরে ঢেকে নিলো নিজেকে অদৃশ্যতার মোড়কে। এটা করার যদিও কোন মানে হয় না। ড্যাড ভেতরে ঢুকবেন দেখতে পাবেন জেমস ওখানে নেই। আচ্ছা জেমসতো ওনার পেছন পেছন ঢুকে পড়তে পারে? তারপর না হয় বলবে দরকারী একটা বই আনতে গিয়েছিল। কোনদিনই ঠিকঠাক মিথ্যে বলতে পারে না ও।তার ওপর আবার সঙ্গে আছে ইনভিজিবল ক্লোকটা। বেশ জোরালোভাবে একটাগোঙানী না চাইতেই বেরিয়ে এলো ওর ভেতর থেকে।

     হ্যারি এসে দাঁড়ালেন। জাদুদণ্ডটা তুলে দেওয়ালটা দেখলেন এবং বললেন, ‘আমি সেই ঘরটায় ঢুকতে চাই যেখানে আমার ছেলে ঘুমাচ্ছে।’ কিছুই ঘটলো না। হ্যারি বিন্দুমাত্র অবাক হলেন না।

     ‘হুম ম,’ নিজেই নিজেকে বললেন। ‘আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি কেন দরজাটা খুললো না! আমার মনে হয় …,’ উনি চারদিকটা একবার দেখে নিয়ে একটু হাসলেন। ‘এর কারণ আমার ছেলে এখন রুম অফ রিকোয়ারমেন্টে আদপেই ঘুমাচ্ছে না। বরং এখানেই দাঁড়িয়ে আছে। এই করিডোরে আমার কাছেই। ইনভিজিবল ক্লোকের তলায়। আর প্রাণপনে ভাবার চেষ্টা করছে কি করে এই অদ্ভুত দরজাটা খোলা যায়। কি আমি ঠিক বলছিতো জেমস?’

     জেমস আটকে রাখা নিঃশ্বাসটা ছাড়লো এবং বেরিয়ে এলো ক্লোকের আড়াল থেকে। ‘তুমি সব জানতে পেরে গিয়েছিলে তাই না?’

     ‘আমি অনুমান করেছিলাম ওখানে তোমার কাশি শুনেই। নিশ্চিত হলাম দরজার ব্যাপারটা ঘটার পর। চলো, ভেতরে যাই।’ হ্যারি হাসলেন ক্লান্তভাবে। উনি তিন পা হেঁটে গেলেন সামনে তারপর সেই কথাটা বললেন যা রুম অফ রিকোয়ারমেন্টের দরজা খুলে দিলো। ওর ঢুকলো ভেতরে।

     কিছুক্ষণ বাদেই ওরা যে যার বিছানায়। জেমস ওপরের বাঙ্কে শুয়ে তাকিয়ে ছিল অন্ধকার সিলিং এর দিকে।

     ‘জেমস তুমি আমার পদাঙ্ক অনুসরণ করো এটা আমি চাই না। তুমি ভালো করেই জানো।’

     জেমস চোয়াল দৃঢ় করলো, কিছু বললো না। শুনতে থাকলো।

     ‘তুমি ওখানে ছিলে, ফলে প্রফেসর ফ্র্যাঙ্কলিন যা যা বলেছেন সবই শুনেছো। আমি শুধু এটাই বলতে চাই যা শুনলে তা একটা বিষয়ের খণ্ডাংশ মাত্র। যে কোন কাজের চলার পথে ষড়যন্ত্র এবং বিপ্লব থাকেই। যুদ্ধটা চিরকাল একই রকম ধরনের হয়, শুধু বদলে যায় সময়টা। বদলে যায় পদ্ধতি। পৃথিবীকে রক্ষা করার দায়িত্ব তোমার নয় এটা মাথায় রেখো। আর যদি করতেও চাও তাহলে একটা বিরাট বিপদে নিজেকে জড়িয়ে ফেলবে। আর সেটা একবার নয় বার বার ঘটে চলবে। এই ধরনের বিষয়ের এটাই প্রকৃতি।’

     হ্যারি থামলেন, মৃদু হাসির আওয়াজ শুনতে পেলো জেমস। ‘আমি জানি, এই অনুভবটা কেমন। আমিই সেই, যে শয়তানকে থামাতে পারি… যুদ্ধটা জিততে পারি…। চিরন্তন ভালোর জন্য লড়তে পারি! এই রকম ভাবনাগুলোর পেছনে কতটা দায়িত্ব আর মাথা ঘুরিয়ে দেওয়ার মতো উত্তেজনা থাকে আমি ভালো করেই বুঝি। কিন্তু জেমস, তা সত্ত্বেও বলছি, কিছুই আমার একার কাজ নয়। এসবই একসঙ্গে সকলের লড়াই। সকলের স্যাক্রিফাইসের জায়গা। অনেক অনেক মানুষ এমন আছেন যাদের বলিদান আমার থেকে বেশী মহৎ। দুনিয়াকে বাঁচানো কখনোই একজন মানুষের কর্তব্য হতে পারে না। আর এটা কখনই সেই ছেলেটার দায়িত্ব হতে পারে না যে রুম অফ রিকোয়ারমেন্টের দরজা কি করে খুলতে হয় সেটাই জানে না।’

     জেমস শুনতে পেল নিচে একটা নড়াচড়ার আওয়াজ। ওর ড্যাড উঠে দাঁড়িয়েছেন, তাকিয়ে আছেন জেমসের দিকে। অন্ধকারে ওনার মুখের ভাব ও দেখতে পাচ্ছে না, কিন্তু বুঝতে অসুবিধাও হচ্ছে না। ড্যাড হাসছেন, সেই চিরপরিচিত মুচকি হাসি। ওর ড্যাড সব জানেন। ওর ড্যাড যে হ্যারি পটার।

     ‘কিরে কি ভাবছিস?’

     জেমস একটা বড় করে নিঃশ্বাস নিলো।ও ড্যাডকে সব কিছু বলতে চায় ও কি দেখেছে এবং শুনেছে। ওর ঠোঁটের ডগায় এসে গেছে সব কথা। মাগল অনুপ্রবেশকারী থেকে শুরু করে, সেড্রিক ডিগরির ভুত। অ্যাস্ট্রামাড্ডুক্স এর গোপন কথা থেকে মারলিনের ফিরে আসার ছক, যা থেকে এক সর্বশেষ যুদ্ধ করার পরিকল্পনা চলছে। কিন্তু না, ও সিদ্ধান্ত নিলো। কিছুই বলবে না। একটু হাসলো ড্যাডের দিকে তাকিয়ে।

     ‘আমি জানি ড্যাড। একদম ভেবো না আমাকে নিয়ে। আমি যদি একার হাতে এ দুনিয়া রক্ষা করার কথা কখনো ভাবি তাহলে সবার আগে তোমাদের খবর পাঠাবো। তাহলে হবেতো?’

     হ্যারি হাসলেন ফিক্‌ করে এবং মাথা নাড়লেন। কথাগুলো মনে না ধরলেও বুঝতে পারলেন এনিয়ে অতিরিক্ত কথা বাড়িয়ে কোন লাভ হবে না। শুয়ে পড়লেন নিজের বাঙ্কে।

     মিনিট পাঁচেক পর, জেমস জানতে চাইলো। ‘ড্যাড ওই ইনভিজিবল ক্লোকটা আমার কাছে রেখে দেওয়ার সুযোগ পেতে পারি কি?’

     ‘কোনোভাবেই সেটা সম্ভব নয়, মাই বয়।একদমই না,’ হ্যারি উত্তর দিলেন ঘুম জড়ানো কণ্ঠে। জেমস শুনতে পেল ওর পাশ ফিরে শোওয়ার শব্দ। কিছুক্ষণ বাদে দুজনেই হারিয়ে গেলেন ঘুমের জগতে।

     পরের দিন সকালে জেমস আর হ্যারি পটার গ্রেট হলে ঢুকতেই, জেমস অনুভব করলো ঘরের আবহাওয়াটাই পালটে গেল। জাদুজগতে এধরণের পরিস্থিতি আগেও লক্ষ করেছে জেমস, যখনইও ওর ড্যাডের সঙ্গেকোথাও গিয়েছে। কিন্তু এই মুহূর্তের অনুভুতিটা একেবারেই আলাদা। সরাসরি ওদেরকে দেখার বদলে সকলেই যেন একটু এদিক ওদিকে তাকাতেই ব্যস্ত। কথাবার্তাও থেমে গেছে অনেকটাই। কারও দিকে মানুষের তেরছাভাবে তাকানো বা পেছন থেকে তাকিয়ে থাকার একটা অদ্ভুত চাপ আছে সেটা আজ বেশ ভালোভাবেই বুঝতে পারলো জেমস। ওর ভেতরে একটা রাগ জন্মাচ্ছিল। এই সব লোকজনগুলো কারা? বেশীরভাগই তো ভালো উইচ আর উইজার্ডের দল। যাদের সম্পর্ক আছে সেই সব বাবামায়েদের সঙ্গে, যারা সব সময় হ্যারি পটারকে সমর্থন করে এসেছে। সেই হ্যারি পটার যে ছোটবেলাতে ভালোবাসার ঘেরাটোপে থেকে বেঁচে গিয়েছিল এক মহা শয়তানের হাত থেকে।তারপর সেই তরুণবয়সে সেই হ্যারিই ভলডেমরট এর পতনে প্রভূত সাহায্য করেছিল। সহ্য করেছিল অনেক কষ্ট। আর এখন হেড অরোর রূপেও নিজের দায়িত্ব পালন করে চলেছেন।অথচ কিছু হতচ্ছাড়া গুজব সৃষ্টিকারীদের জন্য সেইসব মানুষদের সন্তানেরাই হ্যারির দিকে সরাসরি তাকাতে পারছে না বা চাইছে না।

     জেমস এইসব ভাবলেও, একসময় দেখা গেল ওর ভাবনার অনেকটাই ভুল। জেমস আর হ্যারি গ্রিফিন্ডোর টেবিলে গিয়ে বসতেই (জেমস অনুনয় করেছিল হ্যারির কাছে এরকমটাই করার জন্য।শিক্ষকদের নির্দিষ্ট টেবিলে না বসে উনি যেন শিক্ষার্থীদের টেবিলে বসেন)একরাশ হাসির উচ্ছাস সহ একাধিক শুভেচ্ছাসূচক কথা ভেসে এলো। টেড হ্যারিকে দেখতে পেয়েই ছুটে এলো পড়িমড়ি করে। তারপর হ্যান্ডশেক আর আলিঙ্গন মিলে মিশে যেটা হল সেটা প্রায় কুস্তির কাছাকাছি।

     হ্যারি হাসতে হাসতে প্রায় পড়েই গেলেন বেঞ্চের ওপর। ‘টেড তুমি নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলছো বোধহয়। পাগল হয়ে গেলে নাকি!’

     ‘এই যে সবাই শোনো, ইনি আমার গডফাদার,’ টেড বললো কম্পিত স্বরে, ঘরের চারদিকে তাকিয়ে। ‘হ্যারি তোমার নোয়ার সঙ্গে পরিচয় হয়নি বোধ হয়? ও আমার আর পেট্রার মতো একজন গ্রেমলিন।’

     হ্যারি নোয়ার সঙ্গে হ্যান্ডশেক করলো। ‘আমার মনে হচ্ছে আমরা গত বছর কুইডিচ চ্যাম্পিয়ানশিপে পরিচিত হয়েছি, তাই না?’

     ‘একদম ঠিক,’ নোয়া বললো। ‘কি করে ভুলি বলুন ওই গেম, যেখানে টেড বিপরীত দলের জয়ের জন্য দরকারী পয়েন্টটা স্কোর করেছিল?’

     ‘টেকনিক্যালি, ওটা সাহায্য করতে গিয়ে ঘটে গিয়েছিল,’ টেড বললো সাফাই এর সুরে। আমি ওদের টিমের কোয়াফল ক্যারিয়ারকে প্রেসবক্সের দিকে পাঠাতে গিয়ে গোলে ঢুকিয়ে ফেলি।’

     ‘তোমাদের কথা ভালোই লাগছে তবু কিছু মনে না করলে, আমি আর জেমস একটু ব্রেকফাস্টটা সেরে নিতে চাই, সুযোগ পাবোকি?’ হ্যারি ওদের কথার মাঝে বলে উঠলেন।

     ‘অবশ্যই, অবশ্যই। কি যে বলো না,’ টেড অতি উচ্ছ্বাসেরসঙ্গে বললো। ‘আর হ্যাঁ যদি কেউ কোনোরকম গণ্ডগোল করে আমাকে একবার জানিয়ে দিও। আজ কুইডিচের রাত, আর আমরা তৈরি হয়েই আছি বদলা নেওয়ার জন্য।’ শানিত দৃষ্টিতে গোটা ঘরের সবাইকে একবার দেখে নিল, হাসলো এবং ওখান থেকে চলে গেল।

     ‘আমি কিন্তু ওকে সেরকম ভাবে কিছু বলিনি। কিন্তু ও যেন মজা ভুলে সিরিয়াস হয়ে গেল। একটু পাগল আছে ছেলেটা। কি বলিস?’ হ্যারি টেড এর চলে যাওয়া দেখতে দেখতে বললেন। জেমস হাসলো। টেবিলের কাছে রাখা গরমাগরম খাবার তুলে নেওয়াতেই ব্যস্ত হল এবার দুজনেই। খাওয়া শুরু করতেই জেমস দেখতে পেল জ্যান আর র‍্যালফ হলে ঢুকছে। ওদের দিকে ইশারা করে ও হাত নাড়লো।

     ‘ড্যাড এরা আমার বন্ধু, জ্যান আর র‍্যালফ,’ জেমস বললো ওরা বেঞ্চিতে বসতেই, এদিকে ওদিকে মুখোমুখি বসার পর। ‘ব্লন্ড চুল জ্যানের আর ওই পাহাড়টা হলো র‍্যালফ।’

     ‘তোমাদের সঙ্গে পরিচিত হয়ে খুশি হলাম, জ্যান, র‍্যালফ,’ হ্যারি বললেন। ‘জেমস তোমাদের সম্বন্ধে অনেক ভালো ভালো কথা বলেছে।’

     ‘আমি আপনার বিষয়ে পড়েছি,’ র‍্যালফ বললো, হ্যারির দিকে তাকিয়ে। ‘আপনি সত্যিই ওইসব কাজগুলো করেছেন?’

     হ্যারি হেসে ফেললেন। ‘একবারে সরাসরি কথা বলতে ভালোবাসে তাইনা?’ জেমসের দিকে ভ্রু উঁচিয়ে বললেন। ‘হ্যাঁ, ওই কাজগুলো করেছি। তবে তুমি যদি ওই সব সময়ে উপস্থিত থাকতে, তাহলে মনে হয়না ওগুলো কোনো বলে বেড়ানোর মতো কাজ করেছি বলে তোমার মনে হতো।বেশিরভাগ সময়েই আমি আর বন্ধুরা চেষ্টা করেছি কেউ যাতে আমাদের খেয়ে না ফেলে বা অভিশাপ দিয়ে না দিতে পারে তার জন্য, বাকি সব ঘটে গেছে।’

     জ্যান কোনো কথাই বলছিল না, যেটা মোটেই ওর স্বভাব নয়। ‘আরে কি ব্যাপার! তুই যে একেবারে চুপ?’ জেমস জানতে চাইলো।‘ অবশ্য তোর পক্ষে এটা একটা নতুন ব্যাপার। গ্রেট হিরো হ্যারি পটারকে সামনা সামনি দেখা।’

     জ্যানের মুখটা একটু কঠোর হল। ও নিজের ব্যাকপ্যাক থেকে “ডেইলি প্রফেট” এর সংস্করণটা বার করলো। ‘এটা খুবই বাজে একটা ব্যাপার,’ কাগজটা টেবিলের ওপর ছুঁড়ে দিয়েহতাশার সুরে বললো। ‘অ্যায়াম সরি! কিন্তু কিছু করার নেই। কখনো না কখনো এটা আপনাকে দেখতে হতোই।’

     জেমস ঝুঁকে পড়ে ওটার দিকে তাকালো। “হগওয়ারটসে ইন্টারন্যাশনাল ম্যাজিক সম্মেলনে অ্যান্টি-অরোর বিক্ষোভের ছায়া”, এটাই প্রধান হেডলাইন। ওর নিচে ছোট অক্ষরে লেখা “মিঃ পটারের সম্মেলনে আগমনে স্কুল জুড়ে উত্তাল বিক্ষোভ। ওদের দাবি ম্যাজিক্যাল কমিউনিটি অরোর নিয়মনীতি নতুন করে সেট করুক।” জেমস বুঝতে পারছিল রাগে ওর গাল লালছে হয়ে যাচ্ছে। কিছু বলার আগেই ওর কাঁধে হ্যারি হাত রাখলেন।

     ‘হুমম, পুরো রিপোর্টটাতে রিটা স্কীটারের প্রভাব দেখাই যাচ্ছে,’ হ্যারি বললেন শান্ত গলায়।

     জ্যান ভ্রু উঁচিয়ে হ্যারির দিকে তাকালো, একবার কাগজটার দিকেও তাকালো তারপর বললো, ‘শুধুমাত্র হেডলাইন দেখে আপনি বলে দিতে পারলেন রিপোর্টটা কে লিখেছেন?’

     ‘না,’ হ্যারি হাসলেন, সংবাদপত্রটা একপাশে সরিয়ে রেখে ফ্রেঞ্চ টোস্টে এক কামড় দিয়ে বললেন। ‘নামটা একপাশে লেখাই আছে। তবে হ্যাঁ বলতে পারি এই ধরনের লেখা একমাত্র ওরই স্টাইল। ওটায় গুরুত্ব দিয়ে লাভ নেই। এক সপ্তাহের মধ্যে মানুষ এসব কথা ভুলে যাবে।’

     জেমস পড়ছিল প্রথম অনুচ্ছেদটা, রাগে ওর গা চিড়বিড় করছিল। ‘ওই মহিলা লিখেছেন প্রায় গোটা স্কুল ওখানে উপস্থিত ছিল, যারা ওই প্রতিবাদে সামিল হয়েছিল। একেবারে নির্জলা মিথ্যে! আমি ওখানে ছিলাম, খুব বেশি হলে শ’খানেক ছাত্রছাত্রী ছিল। এনিয়ে যা বলবে তাই বাজি ধরতে পারি। তার ওপর ওদের মধ্যে বেশীরভাগ কি হচ্ছে জানার কৌতূহলে গিয়েছিল! ওই শ্লোগান দেওয়া এবং ব্যাজ পড়ে থাকা শিক্ষার্থীর সংখ্যা খুব বেশী হলে পনেরো বা কুড়ি হবে।’

     হ্যারি একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বললেন, ‘জেমস এগুলো আসলে একধরনের গল্প লেখা। কাগজের বিক্রি বাড়ানোর জন্য যা খুশী তাই ছাপানো।’

     ‘কিন্তু এরকম আজেবাজে লেখাকে কি করে পাত্তা না দিয়ে থাকতে পারছো তুমি? এসবের ফল তো ভয়ঙ্কর হতে পারে! প্রফেসর ফ্র্যাঙ্কলিন…’

     হ্যারি জেমসের দিকে যে ভাবে তাকালেন তার একটাই অর্থ আর একটাও কথা নয়। তারপরই আবার আগের রূপে ফিরে গেলেন। ‘আমি বুঝতে পারছি তোমাকে এটা কষ্ট দিচ্ছে, সহ্য করতে পারছোনা। তার জন্য আমি তোমাকে দোষও দিচ্ছি না। কিন্তু জেনে রাখো এরকম ব্যাপারকে অন্যভাবেও সামলানো যায়। তার একটা পথ হল রীটা স্কিটারের মত মানুষদের সঙ্গে কথা না বাড়ানো।’

     ‘তোমার কথা বলার ধরণটা ম্যাকগনাগল ম্যামের মতো শোনাচ্ছে ড্যাড,’ জেমস বললো, চোখ বন্ধ করে একটা সসেজে কামড় দিয়ে।

     ‘সেটাই হওয়া উচিত। কারণ উনিইতো আমার শিক্ষক ছিলেন একসময়। আর এখন তো উনি তোমারো হেডমিস্ট্রেস,’ হ্যারি জবাব দিলেন।

     জেমস নিজের প্লেটটার দিকে তাকালো। তারপর চোখ সরিয়ে নিয়ে ঝটপট কাগজটা ভাঁজ করে চোখের সামনে থেকে সরিয়ে রাখলো।

     ‘তাহলে এই মরসুমের প্রথম কুইডিচ খেলা হবে আজ রাতে, তাই না?’ হ্যারি জানতে চাইলেন, তিন বন্ধুর দিকে কাঁটা চামচ ধরা হাতটা দুলিয়ে।

     জ্যান বললো, ‘র‍্যাভেনক্ল বনাম গ্রিফিন্ডোর! ‘আমার প্রথম গেম! আমি ছটফট করছি সময়টা কখন আসবে এটা ভেবে।’

     জেমস তাকিয়ে দেখল ড্যাড জ্যানের দিকে তাকিয়ে হাসছেন। ‘তার মানে তুমি র‍্যাভেনক্ল টিমে চান্স পেয়েছো! দারুণ ব্যাপার। আমার কাজ যদি তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যায় আমি চলে আসবো খেলা দেখার জন্য। আমি অপেক্ষা করবো তোমার ওড়া দেখার জন্য। কোন পজিশনে খেলবে তুমি?’

     হাতের কাঁটা চামচ দিয়ে ব্লাজার মারার ভঙ্গী করে জ্যান বললো, ‘বিটার।’

     ‘ও খুবই ভালো ওড়ে বুঝলেন মিঃ পটার,’ র‍্যালফ বললো অনুরাগের সুরে। ‘আমি ওর প্রথম ওড়াটা স্বচক্ষে দেখেছি। মাটিতে সজোরে আছড়ে পড়বে বলেই যখন সবাই ধরে নিয়েছে, ও একেবারে শেষ মুহূর্তে সব সামলে নিয়ে ওপর দিকে উঠে যায়।’

     ‘আরে বাব্বা, তার মানেতো দারুণকন্ট্রোল তোমার!’ হ্যারি জ্যানের দিকে ভালো করে তাকিয়ে বললেন। ‘তুমি ঝাঁটায় ওড়ার ক্লাস করেছো নাকি?’

     ‘এক্কবারেই না!’ র‍্যালফ প্রায় চিৎকার করে বললো, মনে হচ্ছে ও জ্যানের পাব্লিক রিলেশন এজেন্ট। ‘সেজন্যই তো পুরো ব্যাপারটা চমকে দেওয়ার মতো, তাই না?  কি বলেন আপনি?’

     থমথমে মুখে জেমস র‍্যালফের দিকে তাকালো, চেষ্টা করলো চোখে চোখ মেলানোর এবং সাবধান করে দেওয়ার যাতে সব কিছু ফাঁস না হয়ে যায়। কিন্তু চেষ্টা বিফল হল।

     ‘ও বোধহয় নিজেও জানতে পারতো না যে অত ভালো উড়তে পারে’, র‍্যালফ বললো, ‘যদিনা ও জেমসের পিছু নিতো। জেমসতো তখন নিয়ন্ত্রণহীন রকেটের মতো সোজা ধেয়ে যাচ্ছিলো মহাশূন্যের দিকে।’ জেমসের উড়ে যাওয়ার ভঙ্গীর নকল করে মুচকে হাসল।

     জ্যান র‍্যালফের কথার মাঝেই বলে উঠলো, ‘আপনিতো নিশ্চিতভাবে গ্রিফিন্ডোরকেই সমর্থন করবেন!’ তারপর র‍্যালফের কপালে হাতের চাপ দিয়ে পেছন দিকে ঠেলে দিলো।

     হ্যারি চারদিকটা একবার দেখলো, টোস্টের টুকরোয় কামড় বসাতে বসাতে, মুখে একটা চিন্তার ছাপ। ‘ইয়ে। মানে… হ্যাঁ, সেটাই স্বাভাবিক,’ সম্মতিসূচক কথাটা বলে সবার মুখের দিকে তাকালেন।

     ‘হ্যাঁ, উচিতই তো। আমি বেশ বুঝতে পারছি।’ জ্যান দ্রুত উত্তর দিলো, হেলদোলহীন র‍্যালফের দিকে তাকিয়ে ভুরু নাচিয়ে। ‘দয়া করে নিজের স্কুল এবং আর বাকি সব কিছুর দিকে নজর দাও র‍্যালফিনেটর। আরে একদমইই খেয়াল নেই, কটা বাজে দেখেছিস। চল চল, ক্লাসে যেতে হবে না নাকি?’

     ‘আমার প্রথম পিরিয়ডে কোন ক্লাস নেই।আর তা ছাড়া আমি এখনো ব্রেকফাস্টও করিনি।’

     ‘নিজের জায়গা থেকে উঠে গিয়ে র‍্যালফের কনুই ধরে ঠেলতে ঠেলতে জ্যান বললো, ‘চলনারে বাবা, কাজ আছে!’ জ্যান একটুও নড়াতে পারলো না র‍্যালফকে।ব্যাপারটা যেন উপভোগই করছিল র‍্যালফ।

     র‍্যালফ জ্যানের বিশেষ ধরনের চোখের ইশারার দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলো, ‘কি বলছিস বলতো, বুঝতে পারছি না?’ ‘আমি কি কিছু করে ফেলেছি। মানে আমি কিছু বলে ফেলেছি যা আমার বলা…” ও থামলো।জেমসের দিকে তাকালো, যে তখন প্রায় পাথরের মূর্তি বনে গেছে। ‘ওহো। বাবারে কি যে করিস,’ র‍্যালফ বললো জ্যান ওকে দরজার দিকে ঠেলে নিয়ে যাওয়ার সময়। ‘আমি একটা বিরাট মাপের বোকা গাধা, তাই না?’

     জেমস একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফলে বললো, ‘ঘটনা হলো, আমি কুইডিচের বাছাই পর্বে একবারে ল্যাজে গোবরে হয়েছি। সরি ড্যাড।’

হ্যারি ছেলেকে ভালো করে দেখলেন। ‘খুবই খারাপ কিছু করেছিস নাকি?’

     জেমস মাথা ঝোঁকালো। বললো, ‘এটা কোনো বড় ব্যাপার নয়। কুইডিচ একটা খেলা মাত্র। আবার আগামী বছরে চেষ্টা করবি। আমাকেও সেটাই করতে হবে না যা তুমি করেছিলে। আমি জানি,আমি জানি। তুমি এসব বলবে না।’

     হ্যারি একভাবে জেমসের দিকে তাকিয়ে ছিলেন, চোয়াল নড়ছিল আস্তে আস্তে, কিছু একটা ভাবছিলেন। নিজের পামকিন জুসের গ্লাসটা হাতে নিয়ে হেলান দিয়ে বসলেন। ‘যাক আমার আর কিছু বলার নেই। যা যা বললি তাতেই আমার বলার কাজ হয়ে গেছে।’

     জেমস ড্যাডের দিকে তাকালো। খুব ধীরে ধীরে চুমুক দিতে দিতে হ্যারি ওর দিকেই তাকিয়ে আছেন। সম্ভবত হাসছেন, আড়াল করছেন হাসিটা গ্লাসটা দিয়ে। জেমস হাসি আটকানোর চেষ্টা করলো। নিজেকে বললো এটা মোটেই হাসার সময় নয়। সিরিয়াস হতে হবে। এটা কুইডিচ বলে কথা। এই সব ভাবতে ভাবতে ও ফিক করে হেসে ফেললো। যেটা আটকাতে হাত তুললো মুখের কাছে। যদিও কিছুই আটকালো না তাতে।

     হ্যারি গ্লাসটা নিচু করলেন, হাসলেন, মাথাটা নাড়লেন হাল্কা ভাবে।‘এটা নিয়ে তুই খুব চিন্তায় ছিলি তাইনারে জেমস?’

     জেমস কোনোমতে হাসি চেপে, ঢোক গিলে বললো, ‘একদম। দারুণ চিন্তায় ছিলাম। মানে বলতে চাইছি যে, কুইডিচতো তোমার এবং দাদুর অতি প্রিয় খেলা। আমি জেমস পটার। আমারও উড়ুক্কু ঝাঁটায় কিছু কামাল করে দেখানোটাই স্বাভাবিক ছিল।বদলে আমি কি করলাম, নিজেকে এবং আমার আশেপাশে থাকা সবাইকে বিপদের মধ্যে ফেলে দিয়েছিলাম আর একটু হলেই।’

     হ্যারি সামনের দিকে ঝুঁকলেন, গ্লাসটা নামিয়ে রাখলেন। সরাসরি তাকালেন জেমসের চোখের দিকে। ‘জেমস চিন্তার কোন কারণ নেই। উড়ুক্কু ঝাঁটাতে তুইও কামাল দেখাবি। মারলিনের দাড়ির দিব্যি। এটা তোর প্রথম সপ্তাহ। তারওপর তুই এখনো ওই বিষয়ে একটাও ক্লাস করিসনি, কি ঠিক বললাম তো? আমি যখন এখানে প্রথম আসি তখন প্রথাগত শিক্ষা নেওয়ার আগে কোনভাবেই ওই জিনিসটা ব্যবহারের অনুমতিই দেওয়া হত না। হাউস টিমের জন্য বাছাই হওয়া তো দুরের কথা।’

     ‘কিন্তু তাও তো তুমি,’ জেমস কথার মাঝে বলে উঠলো, ‘তুমি সবাইকে চমকে দিয়েছিলে ড্যাড।’

     ‘ওটা কোন বড় কথা না। অনেকদিন আগে ঘটে যাওয়া একটা ঘটনার কথা মাথায় রেখে তুই এতটাই চিন্তিত হয়ে পড়েছিস যে আমার মনে হচ্ছে তুই তার থেকেও ভালো কিছু করতে পারিস এটাই ভুলে যাচ্ছিস। নিজেকেই হারিয়ে দিচ্ছিস শুরু করার আগেই। বুঝতে পারছিস কি সেটা? কেউ কখনো কোনও কিংবদন্তীর সঙ্গে লড়াইতে জিততে পারে না। এমন কি আমিও না, কারণ আমাকে নিয়ে যা যা গল্প তৈরি হয়েছে আমি তার অর্ধেক করতে পারলেও খুশী হতাম। প্রত্যেক দিন আমি আয়নার দিকে তাকাই আর নিজেকে বলি ওই বিখ্যাত হ্যারি পটারের মতো হওয়ার আমার কোন ইচ্ছে নেই। বরং আমি হতে চাই তোর ড্যাড আর তোর মামের সহযোগী স্বামী… এবং অবশ্যই একজন সেরা অরোর। যতটা আমার পক্ষে সম্ভব। তবুও সত্যি বলছি সেটাও সব সময় ভালো লাগে না। তোকে এই ভাবনাটা থেকে সরে দাঁড়াতে হবে যে তুই হ্যারি পটারের ছেলে…’ হ্যারি থামলেন, দেখলেন জেমস মন দিয়ে শুনছে, যা আগে কোন দিন ঘটেনি। একটু হাসলেন। ‘আর আমাকে সুযোগ করেদে নিজেকে জেমস পটারের বাবা রূপে ভাবার। কারণ আমি যা কিছু করে চলেছি তা কেবলমাত্র, তোকে, আ্যলবাসকে আর লিলিকে বড় করে তোলার জন্য। এই তিনটে জিনিস যার জন্য আমি গর্ব করতে পারি। বুঝতে পারলি?’

     জেমস মুচকি হাসলো। যেটা ও জানতে পারলোনা তা হল ঠিক এই রকম মুচকি হাসি প্রায়শই দেখা যায় হ্যারি পটারের মুখেও। ‘ওকে ড্যাড। আমি আজ থেকে সেই চেষ্টাই করবো। বুঝতে পারছি কাজটা বেশ কঠিন।’

     হ্যারি সম্মতিসূচক মাথা নাড়লেন এবং ফের হেলান দিয়ে বসলেন। একটুবাদে জানতে চাইলেন, ‘আমি কি বলতে চাই সেটা কি সব সময়েই বুঝতে পারিস?’

     জেমস হি হি করে হেসে ফেললো। ‘অবশ্যই ড্যাড। তোমার এবং মামের দুজনেরটাই বুঝে ফেলি। তুমি নিশ্চয় ওই পাতলা জামাটা গায়ে চাপিয়ে বাইরে বের হওয়ার কথা ভাবছ, তাই না?’ হ্যারি হো হো করে হেসে উঠলো জেমসের জিন্নিকে নকল করা দেখে। জেমস বলেই চললো, ‘এখানে খুব ঠান্ডা, একটা সোয়েটার পড়ে নাও! গ্র্যানীর সমানে গিয়ে বকর বকর করবে না বলে দিলাম। গারডেন জিনোমসদের নিয়ে একদম খেলবেনা। বুড়ো আঙুল সবুজ হয়ে গেলে আমি কিছু করতে পারবো না!’

     রাতে কুইডিচের ম্যাচে আবার দেখা হবে এই প্রতিশ্রুতি দিয়েহ্যারি হাসতে হাসতে প্রায় কেঁদে ফেলার জোগাড় হয়ে ব্রেকফাস্টের টেবিল ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন।

[চলবে]

লেখক পরিচিতিঃ  জর্জ নরম্যান লিপারট আমেরিকান লেখক এবং কম্পিউটার অ্যানিমেটর। তবে ওনার বর্তমান পরিচয় উনি জেমস পটার সিরিজের লেখক। যে কারনে ওনাকে “আমেরিকান রাউলিং” নামেও ডাকা হয়ে থাকে। এই সিরিজের প্রথম লেখা “জেমস পটার অ্যান্ড দ্য হল অফ এল্ডারস ক্রসিং” প্রকাশিত হয় ২০০৭ সালে। নানান কারনে এটি অনেক বিতর্কে জড়িয়ে যায়। সেসব সমস্যা পেরিয়ে আজ এটি পাঠক পাঠিকাদের চাহিদায় সারা বিশ্বে যথেষ্ট জনপ্রিয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য এই সিরিজের সব কটি বই ই-বুক এবং ফ্রি হিসাবেই প্রকাশ করেছেন মাননীয় জর্জ নরম্যান লিপারট। এই সিরিজ ছাড়াও ওনার আরো ১২ টি বই আছে। বর্তমানে উনি এরি, পেনসিল্ভ্যানিয়ার বাসিন্দা।

অনুবাদকের পরিচিতিঃ উপন্যাসটির অনুবাদক প্রতিম দাস মূলত চিত্র শিল্পী, ২০১৩ সাল থেকে ভারতের সমস্ত পাখি আঁকার লক্ষ্য নিয়ে কাজ চলছেন। ৭৭৫+ প্রজাতির ছবি আঁকা সম্পূর্ণ হয়েছে। তবে শুধু পাখি নয় অন্যান্য বিষয়েও ছবি আঁকা চলে একইসাথে। সাথেই দারুণ রকমের পাঠক, যা পান তাই পড়েন ধরনের। প্রিয় বিষয় রূপকথা, ফ্যান্টাসী, সায়েন্স ফিকশন, অলৌকিক। টুকটাক গল্প লেখার সাথে সাথে আছে অনুবাদের শখ। 

Tags: অনুবাদ, জর্জ নরম্যান লিপারট, জেমস পটার অ্যান্ড দ্য হল অফ এল্ডারস ক্রসিং, ধারাবাহিক উপন্যাস, প্রতিম দাস

Leave a Reply

Connect with

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

error: Content is protected !!
Verified by MonsterInsights