Sunday, March 17, 2024
অনুবাদ উপন্যাসধারাবাহিক উপন্যাস

জেমস পটার অ্যান্ড দ্য হল অফ এল্ডারস ক্রসিং – পার্ট ১৭

লেখক: জি নরম্যান লিপার্ট, ভাষান্তরঃ প্রতিম দাস

শিল্পী: মূল প্রচ্ছদ, সুদীপ দেব

সপ্তদশ অধ্যায়

প্রত্যাবর্তনের রাত

প্রফেসর জ্যাকসনের অভিযোগ মাদাম কিউরিওর চিকিৎসা ক্ষেত্রে কোন প্রভাব ফেললো না অবশ্য। অনেকটা সময় নিয়ে হাতটা পরীক্ষা করলেন উনি। কখনো টিপলেন, কখনো চিমটি কাটলেন । তারপর ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে   যত্ন করে ব্যান্ডেজ করে দিলেন। আর সেটা করার সময় ওঁর মুখ বন্ধ হলনা ক্ষণিকের জন্যেও।  বক বক করে গেলেন কুইডিচ খেলার সময়ের আহত হওয়ার সম্ভাবনার বিষয়ে। জেমসের মনে হচ্ছিল এইসব কথাগুলো উনি মুখস্ত বলার মতো বলে চলেছেন। হয়তো এর আগে এসব কথা উনি হাজারবার বলেছেন। জেমস অনুমান করতে পারছিল যে মাদাম কিউরিওর মনটা  অন্য কিছুর কথা ভাবছে। কিন্তু এই মুহূর্তে জেমস সে ব্যাপার নিয়ে ভাবতে রাজি নয়।

স্কুল চত্বরে মারটিন প্রেস্কটের অনুপ্রবেশ সবার মনেই যে উৎকণ্ঠার ঝড় তুলে দিয়েছে এটা-তো জানা ব্যাপার। যে একজন মাগল সাংবাদিক এবং তাকে রাখা হয়েছে আলমা আলেরনের অতিথিদের থাকার জায়গায়। এটাও একটা আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। গোটা স্কুলের মানসিক পরিবেশ যথেষ্টই থমথমে হয়ে আছে। মন্ত্রক থেকে লোক আসছে মারটিনের সঙ্গে কথা বলার জন্য হেড মিস্ট্রেসের এই ঘোষনার পরেও উত্তেজনা একটুও কমেনি।

স্কেলি-গ্রো ওষুধটা মাপতে মাপতে ওর দিকে সন্দেহের চোখে তাকাচ্ছেন মাদাম কিউরিও এটা জেমস লক্ষ্য করলো। কেউ একজন ওই সন্দেহজনক মানুষটাকে এই স্কুলের ভেতর ঢুকতে সাহায্য করেছে। হেড অরোরের এই প্রথম বার্ষিকী ছেলেটাই সে কাজ করেনি তো? জেমস বোঝে-যারা প্রোগ্রেসিভ এলিমেন্ট এর মিথ্যেগুলোতে বিশ্বাস করে – তারা ওর কাছ থেকে এরকম ধরণের কিছুর আশাই করছে। সেদিন ছাত্র ছাত্রীদের জটলার মধ্যে থেকে কোন একজন কে বলতে শুনেছিল, ‘ব্যাপারটা তো সেই রকমই মনে হচ্ছে তাই না? মাগল উইচ হান্টারদের হাত থেকে আমাদের বাঁচানোর জন্য ল অফ সিক্রেসী আইন বানানো হয়েছে, এটাই তো অরোররা বলে থাকেন। তা হলে এক্ষত্রে ওরা কি করছেন? তারা-তো এই লোকটাকে স্কুলের ভেতর ঢুকতে দিয়েছেন। আমরা এটা জেনে ভয় ও পাচ্ছি এই ভেবে যে ওই জঙ্গলের গাছগুলোর পেছনে মাগলেরা অস্ত্রশস্ত্র আগুন নিয়ে লুকিয়ে নেইতো আমাদের পুড়িয়ে মারার জন্য! এটাতো মনে হচ্ছে পূর্ব পরিকল্পিত। আমি চাই ওই লোকটা কি চায় সেটা নিজের মুখে আমাদের সামনে বলুক। তাহলেই বোঝা যাবে মন্ত্রকে ক্ষমতা লোভীদের আসল চেহারাটাকে।’

‘এই যে, হয়ে গেছে। একটা টিসটিসে যন্ত্রণা আর নড়াচড়ার অনুভূতি তুমি সারা রাত অনুভব করবে। কারণ, হাড়গুলো নিজেদের ঠিকঠাক সারিয়ে নেবে। সেটাই স্বাভাবিক। ব্যান্ডেজটায় হাত দিও না। তাহলে হাড়ের অবস্থান এদিক ওদিক হয়ে যেতে পারে। সেটা চাইবে না নিশ্চয়। সেটা হলে আমাকে আবার হাড়টা ভাঙ্গতে হবে এবং যা যা করলাম সব আবার করতে হবে। সেটাও আশা করি তুমি চাও না। আমিও চাইবো না।’ সামনের দিকের বিছানাগুলো দেখিয়ে বললেন, ‘বেছে নাও কোনটায় তুমি শুতে চাও। সকালে এখানেই যাতে ব্রেকফাস্ট আসে তার ব্যবস্থা আমি করে দেব। এবার নিজের মতো করে বাকি রাতটা এখানেই আরাম করে কাটাও।’

জেমস নিজের ব্যাকপ্যাকটা বেডসাইড টেবিলে ছুঁড়ে দিয়ে এবং স্বাভাবিকের চেয়ে উঁচু একটা বিছানায় উঠে বসলো। যথেষ্ট আরামদায়ক বিছানা, আর তার কারণ হলো হাসপাতাল বিভাগের সব বিছানাতে রিল্যাক্সেশন মন্ত্র প্রয়োগ করা আছে। যদিও সেই আরাম এই মুহূর্তে হতাশা আর উৎকণ্ঠার মেঘে আচ্ছন্ন জেমসের মানসিকতায় কোন ছাপ ফেলতে পারছে না। প্রফেসর জ্যাকসন বলেই দিয়েছেন আজ রাতটা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। সেটা মোটেই সাধারণ কথা নয়। এদিকে জেমস আজ রাতেই আটকে গেল হাসপাতালের ভেতর। ম্যাকগনাগল ম্যামের নির্দেশকে সামান্য উলট ফের করে প্রফেসর জ্যাকসন কার্যত ওকে বন্দী করে দিলেন এখানে। ঝাড়ু নিয়ে একা একা ওড়ার পর, এই প্রথম একা থাকতে থাকতে জেমস কুইডিচ মাঠকে নিয়ে ঘটে যাওয়া ঘটনাটার ফলাফলটা অনুভব করলো। যথেষ্টই ঝুঁকিপূর্ণ ছিল প্ল্যানটা প্রথম থেকেই। কিন্তু জ্যাকসনের ব্রিফকেস চুরি করার প্ল্যানের মতো নয় মোটেই।  ওটাতে-তো ওরা সফল হয়েছিল, তাই নয় কি? সবই ঠিকঠাকই ঘটে যাচ্ছিলো, এখনো অবধি সম্পূর্ণ ব্যর্থ ওরা নয়। এ যেন এক অদৃশ্য ইঁটের দেওয়াল এসে গেলো শেষ মুহূর্তে। সন্দেহ নেই মারলিনের জাদুলাঠিটাই সবচেয়ে শক্তিশালী তিনটে রেলিকের মধ্যে। এই মুহূর্তে হয়তো করসিকা, মাদাম ডেলাক্রয় এবং প্রফেসর জ্যাকসন প্রস্তুতি নিচ্ছেন তিনটে রেলিককে একত্র করার। জানেননা যে পোশাকটা ওদের কাছে নেই । যদিও বাকি দুটো বহাল তবিয়তে বর্তমান।

এত উৎকণ্ঠার মধ্যেও জেমসের ঘুম ঘুম ভাব এসে যাচ্ছিলো বিশেষ মন্ত্রপূতঃ বিছানার কারণে। ও উঠে বসলো, হৃদপিন্ড লাফিয়ে চলেছে বুকের ভেতর। কি হবে যখন জ্যাকসন ব্রিফকেস খুলে বুঝতে পারবেন ওটা আসল পোশাক নয়? ভিসাম-ইনেপ্সিও মন্ত্রের প্রভাব তো বোধহয় তখন নষ্ট হয়ে যাবে? জ্যাকসন দেখতে পাবেন নকল ব্রিফকেসটাকে। ওর মনে পড়ে যাবে টেকনোম্যান্সি ক্লাসের সেদিনকার ঘটনাটা। জেমস, র‍্যালফ আর জ্যান ওকে বোকা বানাতে চেয়েছিল। উনি ভেবেছিলেন ওরা আসল কেসটা নিতে পারেনি, আর সেকথা আজ হাসপাতালে আসার আগে একবার বলেওছেন। নিশ্চিততভাবেই বুঝতে পারবেন যে ওরা আসলে অসফল হয়নি। জ্যাকসন যথেষ্ট বুদ্ধিমান। উনি বুঝে যাবেন কার কাছে আছে আসল পোশাকটা। র‍্যালফ বা জ্যান নয়, জেমসের কাছেই ওটা আছে। সেই ছেলেটার কাছে যাকে উনি ততটা গুরুত্ব দেননি। জ্যাকসন কি এই হাসপাতাল বিভাগে এসে পোশাকটা চাইবেন ওর কাছে? না, জেমস বুঝতে পারছে উনি সেটা মোটেই করবেন না। সোজা চলে যাবেন গ্রিফিন্ডোর বয়েজ কোয়ার্টারে জেমসের ট্রাঙ্কের কাছে। সম্ভবত উনি  হগওয়ারটসের বিপদের অজুহাতে জেমসের ঘরটায় তল্লাসী চালাবার একটা ছুতো বার করে নেবেন। উনি খুলেও ফেলবেন ট্রাঙ্কটা এবং নিজের দখলে নেবেন পোশাকটাকে। জেমস, জ্যান এবং র‍্যালফ, তদুপরি গ্রেমলিনদের নেওয়া ঝুঁকি পুরো বৃথা হয়ে যাবে। সব কিছুই ঘটে যাবে জেমসের কিছুই করার থাকবেনা।

জেমস বেড সাইড টেবিলটায় হতাশা থেকে একটা ঘুষি মারলো। মাদাম কিউরিও, বুকের কাছে হাত রেখে চমকে উঠলেন। জেমসের দিকে তাকালেন, কিছু বললেন না অবশ্য। জেমসও ওঁকে না দেখার ভান করলো।

ঘুষি মারার ফলে ওর ব্যাকপ্যাকটা পাশে পড়ে গিয়েছিল। উঠিয়ে নিয়ে, খুললো ওটা। বার করলো পারচমেন্ট, কালি ও কলম। ও ভালো করেই জানে অন্য কোনোদিন হলে মাদাম কিঊরিও এই ধপধপে সাদা চাদরের ওপর কাউকে কালির বোতল খুলে বসতে দিতেন না। কিন্তু এখন পরিস্থিতি আলাদা উনি নজর রাখছেন এক বিপদজনক ছেলের ওপর। যাকে ঘাঁটানো মোটেই ঠিক কাজ হবেনা। পারচমেন্টের ওপর ঝুঁকে বসে দ্রুত ভাঙ্গা হাতে লিখতে শুরু করলো। লক্ষ্য করার সময় নেই তাড়াহুড়োতে লেখা ঘষটে যাচ্ছে।

প্রিয় ড্যাড,

সরি, ম্যাপ আর ই-ক্লোকটা চুরি করার জন্য। আমি জানি যে এটা আমার করা উচিত হয়নি। কিন্তু ওগুলো আমার খুব দরকার ছিল। ভেবেছিলাম আমার জায়গায় থাকলে তুমিও তাই করতে। যেটা বুঝে তুমি খুব একটা রাগ করবে না। আমি জানি এটা আমি মামকে বোঝাতে পারবো না । তুমি কি একটু বুঝিয়ে দেবে ওকে?

ওগুলো নিয়ে আসার একমাত্র কারণ আমি বুঝতে পেরেছিলাম একটা দারুন রকমের একটা গণ্ডগোল স্কুলের সীমানার মধ্যে হতে চলেছে। কিছু আমেরিকান শিক্ষকও ওটার সঙ্গে জড়িত। মিঃ ফ্র্যাঙ্কলিন নন, উনি একেবারে আলাদা মানুষ। সঙ্গেসঙ্গেই পি ই জড়িয়ে আছে এর সঙ্গে। এসব কথা চিঠি লিখে জানানোর ইচ্ছে আমার ছিলনা । কিন্তু এই মুহূর্তে তুমি, আমি ও মাম এক বিপদের সঙ্গে জড়িয়ে গেছি। তাই চাইছি যে তুমি এখানে চলে এসো। কালকের মধ্যে আসতে পারবে কি? মিস সাকারিনা জানিয়েছেন তুমি একটা বিশেষ কাজে ব্যস্ত। আর সেখানে তোমায় ডিস্টার্ব করা যাবেনা। তাই যদি সম্ভব হয় আসার চেষ্টা কোরো। ঠিক আছে? এটা সত্যিই গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার আর আমি তোমার সাহায্য চাই।

ভালবাসা সহ

জেমস

জেমস পারচমেন্টটাকে ভাঁজ করে সুতো দিয়ে বাঁধলো। জানা নেই কি করে ওটাকে পাঠাবে, কিন্তু চিঠিটা লিখে ফেলে ও অনেকটা স্বস্তি অনুভব করছে। ওর মনে পড়লো এই মারলিন ষড়যন্ত্র বিষয়ে ড্যাডকে চিঠি লেখার কথা পোশাকটা চুরি করার পরই ভেবেছিল।   সেটা তখন করেনি বলে আজ নিজেকে মনে মনে গালাগাল দিলো। সেই সময় তার মনে হয়েছিল ড্যাডকে না বলাটাই সঠিক সিদ্ধান্ত। কিন্তু এখন এই মারলিন চক্রান্ত বাস্তবায়নের রাতে, যখন জ্যাকসন ওর পোশাকটা পেয়ে যেতে পারেন এই সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে তখন হাসপাতালরুপী জেলে আটকে গিয়ে ড্যাডকে চিঠি না লেখাটা নিজের ঔদ্ধত্য আর চরমতম বোকামো বলেই মনে হচ্ছে।

চকিতে একটা আইডিয়া এলো জেমসের মনে, ব্যাকপ্যাকটা হাতড়াতে থাকলো।   হাতে পেলো ওর হাঁসটাকে। জ্যানের হাতের লেখা এখনো ওটার তলায়…লন্ড্রি রুম! জেমস কলম কালিতে চুবিয়ে একটা দাগ টানলো ওটার ওপর, তলায় লিখলো … হাসপাতাল বিভাগ, নবিকে পূর্ব দিকের জানলার কাছে পাঠিয়ে দে। লেখা শেষ হতেই চাপ দিলো হাঁসটার গায়ে। ওটা বলে উঠলো, ‘ঢাকনাটা খুলে ফ্যালো!’

কোনার দিকে ডেস্কে বসে থাকা মাদাম কিউরিও চমকে উঠলেন আবার। কঠোর চোখে তাকালেন জেমসের দিকে। অপরাধী হোক বা না হোক, উনি নিশ্চিত মনে মনে বলছেন এ ছেলেটা আচ্ছা দুষ্টুতো।

‘সরি মাদাম,’ জেমস হাঁসটাকে ওপর দিকে তুলে ধরে বললো। ‘আমি করিনি, এই হাঁসটা বললো কথাটা।’

‘তাই বুঝি,’ উনি বিরক্তির সঙ্গে বললেন। ‘যাই হোক, এবার আমার যাওয়ার সময় হয়েছে। ইয়ে, তোমার কিছু চাই নাকি?’

জেমস মাথা নেড়ে বললো, ‘না মাদাম। ধন্যবাদ। আমার হাতের ব্যাথা এখন অনেক কম মনে হচ্ছে।’

‘বেশী নড়াচড়া কোরোনা, তাহলে কাল সকালের মধ্যেই ওটা একেবারে ঠিক হয়ে যাবে এটা বলতে পারি।’ উঠে দাঁড়ালেন এবং এগিয়ে গেলেন কাঁচের দরজার দিকে। দুটি অবয়বকে দেখা গেল দরজার ওপাশে। জেমস চিনতে পারলো, ফিলিয়া গয়েল আর কেভিন মারডক। যাদের প্রফেসর জ্যাকসন পাঠিয়ে দিয়েছেন দরজা পাহারা দেওয়ার জন্য। মাদাম কিউরিও দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে গেলেন। শুভ সন্ধ্যা জানালেন “রক্ষীদ্বয়” কে। দরজাটা বন্ধ হয়ে গেল, জেমস শুনতে পেল ধাতব হুড়কো লাগানোর শব্দ। হতাশায় একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়েই লাফিয়ে উঠলো ওর হাঁসটা ডেকে উঠতেই। তুলে নিচের দিকটা দেখলো। লেখা ফুটে উঠেছে ওর লেখার তলায়… দশ মিনিট বাদে -জানলা খুলিস।

জেমস একটু স্বস্তি অনুভব করলো। ও নিশ্চিত ছিল না র‍্যালফ বা জ্যান ওর হাঁসের ডাকের জবাব দিতে পারবে কিনা এ বিষয়ে। কারণ ও জানে না বাকি গ্রেমলিনদের কি হয়েছে ওই ঘটনার প্রেক্ষিতে। একটা ক্ষীণ আশা মনে যে ওরা কেউ ধরা পড়েনি। শুধুমাত্র র‍্যালফকে নিয়ে চিন্তা। কারণ ওতো থেকে গিয়েছিল স্লিদারিন খেলোয়াড়দের ঘরটাতে। ওর সঙ্গেই বোধ হয় সবচেয়ে খারাপ কিছু ঘটেছে। তবুও   আশা করছে যে র‍্যালফও ওখান থেকে পালাতে পেরেছে। সবাই যখন জেমসকে টাবিথার ঝাড়ুতে চড়ে উড়ে যেতে দেখলো, এটা নিশ্চিত যে সবার নজর ওদিকেই চলে গিয়েছিল। তারপর টাবিথা ওর ঝাড়ুকে ডাক পাঠায়, ওটা জেমসকে নিয়ে ফিরে যায় মাঠেই। এই সময়ের মধ্যে র‍্যালফ পালিয়ে গেছে নিশ্চিত ছাউনির ভেতর। ফিরে গেছে গ্রেমলিনদের সঙ্গে।

মাদাম কিউরিওর ডেস্কের ওপর টিকটিক করে চলতে থাকা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে জেমস এক এক মিনিট ধরে বয়ে যেতে থাকা সময় কাটাচ্ছিল। নিজেকে অনেক কষ্টে সামলাচ্ছিল দশ মিনিটের আগেই গিয়ে জানলা খোলার ইচ্ছে থেকে। যদি কোন কারণে মাদাম কিউরিও ফিরে আসেন আর ওকে দেখতে পান খোলা জানলার কাছে দাঁড়িয়ে থাকতে তাহলে নিশ্চিত কিছু একটা ভেবে বসবেন। যদিও জানলাটা ত্রিশ ফুট ওপরে মাটি থেকে, তবুও। অবশেষে ঘড়ির কাঁটা আটটা পনেরোর ঘরে পৌছাতেই জেমস বিছানা থেকে লাফ দিয়ে নামলো। বেডসাইড টেবিলের ওপর থেকে চিঠিটা হাতে নিয়ে নির্দিষ্ট জানলার কাছে চলে গেল। ছিটকিনি নামিয়ে জানলা খুললো, বাইরে ঠাণ্ডা কুয়াশা মাখা রাত। আকাশ এখন পরিষ্কার, কিছু তারা দেখা যাচ্ছে । কিন্তু নবির চিহ্ন নেই কোথাও। জেমস ঝুঁকে তাকালো, এদিক ওদিকে দেখলো। একটা দানবীয় আকৃতি অন্ধকারের বুক চিরে তারাদের ঢেকে দিয়ে ওর দিকে এগিয়ে আসছে। ওটা এসে আছড়ে পড়লো ওর ওপর, ওকে ঘিরে ধরলো এবং বার করে নিলো। জানলার বাইরে চিৎকার করে সাহায্য চাওয়ার অবকাশও পেলোনা জেমস।

অবয়বটা এমন করে ওকে ধরেছে যে মনে হচ্ছে দম আটকে যাবে। নিচে থেকে একটা চাপা ফিসফিসে আওয়াজ ভেসে এলো, ‘বেশী জোরে চেপে ধোরো না! ওর হাড়গোড় সব ভেঙে যাবে!’ জেমস অবাক হয়ে গেল জ্যানের গলা চিনতে পেরে। বিশাল হাতের চাপ কমলো খানিকটা, জেমস এবার দেখতে পেল মেয়ে দৈত্যটা ওকে নামাচ্ছে নিচে জমিতে।

‘দারুন কাজ করেছো তুমি প্রেচকা!’ জ্যান বললো, দৈত্যটার পায়ে চাপড় মেরে। একটা আনন্দের আওয়াজ করে প্রেচকা নিজের বিশাল পায়ের ওপর দিয়ে গড়িয়ে ছেড়ে দিলো জেমসকে মাটিতে নামার জন্য।

হাঁফাতে হাঁফাতে জেমস বললো, ‘আমি ভেবেছিলাম তুই নবিকে নিয়ে আসবি!’

ছায়ায় ঢাকা একটা জায়গা থেকে বেরিয়ে এসে র‍্যালফ বললো, ‘এটা টেডের আইডিয়া। ও বুঝতে পেরেছিলো, অন্তত এই মুহূর্তে তুই ওখান থেকে বার হয়ে আসতে চাস ।   মারলিনের ঝামেলাটা নিজের চোখে দেখতে চাস । তোকে নিয়ে জ্যাকসন চলে যেতেই ও চলে যায় গ্র্যাপের খোঁজে। গ্র্যাপ খুঁজে বার করে প্রেচকাকে। কারণ ওর উচ্চতা হাসপাতালের জানলার কাছে পৌছানোর জন্য যথেষ্ট।  আমরা চিন্তা করছিলাম কি করে তোকে খবরটা দেওয়া যায়। ঠিক তখনই তোর হাঁসের আওয়াজ এসে গেল আমাদের কাছে। বাকি কাজটা ভালোই হয়েছে বলেই আমাদের ধারনা।’

বাঁ হাত দিয়ে বুকে পাঁজরের কাছটা ঘষতে ঘষতে জেমস বললো, ‘ভাগ্য ভালো যে প্রেচকা ল্যাটা, তা না হলে আমাকে আবার স্কেলি-গ্রো এর আবার একটা পুরো ডোজ খেতে হতো। বাপরে ওই হাতের যে কি চাপ! তা টেড কোথায়?’

‘বাকি সব গ্রেমলিনদের সঙ্গে ঘরবন্দী করে রাখা হয়েছে,’ জ্যান বললো কাঁধ উঁচু করে। ‘যদিও প্রমান করতে পারেননি তবু ম্যাকগনাগল মনে করেন ঝাড়ুচুরি কান্ডে ওরা জড়িয়ে আছে। উনি হয়তো পুরো ব্যাপারটাকে এতটা পাত্তা দিতেননা- কারণ উনাকে রিক্রিয়ান্ট আর সাকারিনার দিকটা সামলাতে হবে- কিন্তু ওই জ্যাকসন উস্কে এটা করেছেন। উনি বলেছেন প্রেস্কটের ঝামেলা না মেটা পর্যন্ত আগামীকাল অবধি গ্রেমলিন এর সবাইকে আটকে রাখতে। জঙ্গল থেকে গ্র্যাপকে  নিয়ে ফেরা মাত্র টেডকে গ্রিফিন্ডোর এর কমনরুমে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। শুধু   সাব্রিনা বাদে। করসিকার প্রয়োগ করা বিচ্ছিরী রকমের জাইগান্টিজম মন্ত্রে  আক্রান্ত হয়েছে ও। নাকটা ফুলে ফুটবলের মতো হয়ে গেছে। ঘাবড়ানোর কিছু নেই অবশ্য, ঘুম ভাঙ্গলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। ভেবেছিলাম আমাদেরকেও আটকে রাখা হবে। কিন্তু জ্যাকসন ভেবেছেন র‍্যালফের পক্ষে এরকম একটা ঝামেলায় জড়িত থাকার চান্স কম। আর আমার কাছে তো অজুহাত আছেই। আমি পুরো ঘটনাটার সময় খেলার মাঠের ভেতরেই ছিলাম। তারজন্যই এখানে আসতে পেরেছি। এবার বল তোর কি প্ল্যান?’

জেমস জ্যান ও রালফের দিকে তাকানোর পর প্রেচকার দিকে তাকালো, একটা গভীর শ্বাস নিয়ে বলল, ‘এখনো সেই একই। আমাদের যেতে হবে লুক্কায়িত দ্বীপে। জ্যাকসন, ডেলাক্রয় এবং আর যারা যারা এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে তাদের আটকানোর জন্য। যে ভাবেই হোক মারলিনের জাদু লাঠিটা চুরি করতেই হবে। যদি সেটা পারি, তাহলে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, আমাদের পালাতে হবে যাতে বোঝা যায় এর সঙ্গে কে কে জড়িয়ে আছে।’

র‍্যালফ সম্মতির সঙ্গে বললো, ‘ঠিক, একদম ঠিক।’

ড্যাডের জন্য লেখা চিঠিটা দেখিয়ে  জেমস বললো, ‘তার আগে, আমাকে এটা পাঠাতে হবে। এটা এক সপ্তাহ আগেই পাঠানো উচিত ছিল। যাকগে একেবারে না পাঠানোর চেয়ে এখন পাঠানোই ভালো। টেড ঠিকই বলেছিল। আমাদের সাহায্য দরকার। আমরা যদি গ্রেমলিনদের সাহায্য না চাইতাম তাহলে আজকে আমকে ওই হাসপাতালেই আটকে থাকতে হতো।’

‘আমরা যদি গ্রেমলিনদের সাহায্য না চাইতাম তাহলে হয়তো তোকে ওখানে যেতে না হতেও পারতো, ‘র‍্যালফ বিড়বিড় করে বললো।

চিঠিটা পকেটে ঢুকিয়ে জ্যানের দিকে ঘুরে জেমস জানতে চাইলো, ‘গ্রহদের সমাবেশের সময়টা ঠিক কখন?’

‘ন’টা পঞ্চান্ন, ‘জ্যান জানালো। ‘আমাদের হাতে আর মাত্র দেড় ঘণ্টা আছে।’

জেমস মাথা নেড়ে বললো, ‘পনেরো মিনিটের ভেতর জঙ্গলের কাছে ওই লেকের ধারে চলে আয়। আমি ওখানেই থাকবো। প্রেচকাকেও নিয়ে আসিস যদি ও আসতে চায়।’

জ্যান মেয়ে দৈত্যটার দিকে তাকালো। ‘মনে হয় না চাইলেও ওকে বাদ দিয়ে যেতে পারবো। ও রেডি হয়েই আছে সাহায্য করার জন্য।’

‘তাহলেতো ভালোই। র‍্যালফ, তুই তোর জাদুদন্ড এনেছিসতো?’

র‍্যালফ পেছনের পকেট থেকে ওর অদ্ভুত রকমের বড় জাদুদন্ডটা বার করলো। সবজেটে লেবু হলুদ রং করা অংশটা হাল্কা একটা আলোর আভা ছড়াচ্ছিল অন্ধকারে। ‘আমি এটাকে কখনোই ঘরে রেখে আসিনা।’

‘ঠিক আছে। ওটা নিয়ে প্রস্তুত থাকবি। তুই আপাতত আমাদের রক্ষী। ভালো করে মনে করে নে কি কি শিখেছিস ডার্ক আর্ট প্রতিরোধের ক্লাসে।  তৈরী থাক সেগুলো ঠিক প্রয়োজন মত ব্যবহার করার জন্য।  বুঝতে পারলি। আর কিছু বলার নেই। চল যাওয়া যাক।’

জেমস ছুটে চললো করিডোরের অন্ধকার ধরে, যত দ্রুত সম্ভব। কোনোদিকে নজর না দিয়েই। এই মুহূর্তে যেটা করা বেশ ঝুঁকির কাজ। পোরট্রেটের দরজার কাছে পৌছাতেই ওখান থেকে বেরিয়ে এলো স্টিভেন মেটজকার ।

‘জেমস!’ স্টিভেন বলে উঠলো, অবাক হয়ে তাকিয়ে। ‘তুই এখানে কি করছিস? তোর তো এখন…’ কথা থামিয়ে জেমসের পেছনের অন্ধকারাচ্ছন্ন করিডোরটা দেখলো। ‘কেউ দেখে ফেলার আগে তাড়াতাড়ি ঢুকে পড়।’

পোরট্রেট সরিয়ে ঢুকতে ঢুকতে জেমস বললো, ‘থ্যাংকস, স্টিভেন।‘

স্টিভেন উত্তর দিলো, ‘ ওসব বলার দরকার নেই।  কারণ আমি তোকে দেখিনি। তুইও আমায় দেখিসনি। আমাকে এর মধ্যে একদম জড়াবিনা।’

‘কিসের মধ্যে জড়াবো? কিছুইতো হয়নি।’

সাব্রিনা বাদে সব গ্রেমলিনরা ফায়ারপ্লেসের কাছে বসে ছিল। সবার মুখেই অস্বস্তি আর ক্ষুব্ধতার ছাপ। নোয়া জেমসকে দেখতে পেয়ে উঠে দাঁড়ালো। ‘প্রেচকা তাহলে সঠিক লোককে পেয়ে গেছে।’ কথাটা শুনে সবাই ঘুরে তাকালো এবং মুচকি হাসলো।

টেড সিরিয়াস ভাবে জানতে চাইলো, ‘তুই এখানে কি করছিস? র‍্যালফ আর জ্যানতো তোকে আনতে গেছে। আমাদের হাতে থাকা সময়ের বেশীটাই চলে গেছে কুইডিচ মাঠে গণ্ডগোল হওয়ার কারণে। অনেক দেরী হয়ে গেল। তোরতো ওই দ্বীপটায় যাওয়া দরকার। তুই কি চাস আমরা তোর সঙ্গে যাই?’

‘না, আমার জন্য এর মধ্যেই তোরা অনেক ঝামেলায় জড়িয়ে গিয়েছিস। আমি এসেছি শুধু এটা পাঠানোর জন্য।’ চিঠিটা দেখালো। টেড ইতিবাচক ভাবে মাথা নাড়লো, বুঝতে পারলো ওটা কাকে পাঠানো হচ্ছে । ‘আমাকে দশ মিনিটের মধ্যে জ্যান আর র‍্যালফের কাছে যেতে হবে জঙ্গলে।’

নোয়া উঠে দাঁড়িয়ে বললো, ‘আমি যেতে চাই। করসিকা সাব্রিনার সঙ্গে যেটা করেছে আমি সেটা ফিরিয়ে দেওয়ার একটা সুযোগ চাই।’

জেমস মাথা নেড়ে বললো, ‘তোমাদের তিনজনের জন্য আজ রাতে অন্য কাজ আছে। সেখানে দু একটা ভয়ানক মন্ত্র ব্যবহারের সুযোগ পেয়ে যাবে বলেই মনে হয়। যদি আমি, র‍্যালফ আর জ্যান কোন কারণে কাজটা করতে না পারি তাহলে জ্যাকসন বা অন্য কেউ মারলিনের পোশাকটার জন্য এখানে আসবে। আমি চাই তোমরা তিনজন ওটা পাহারা দাও। যদি কেউ ওটা নিতে  আসে, তোমরা তাকে থামিয়ো। কিভাবে, সেটা তোমাদের ব্যাপার। আমার খারাপ লাগছে এটা তোমাদের করতে বলার জন্য, কিন্তু …তোমরা?’

পেট্রা সামনের দিকে মাথাটা একবার ঝুঁকিয়ে নোয়া আর টেডের দিকে তাকালো। ‘এটা কোনো ব্যাপারই না। যেহেতু আমরা চাইছি এদের মধ্যে কোন একজনকে বিশেষ শাস্তি দিতে তাই এটাই আশা করবো তোমরা হারবে না, তাই না?’

জেমস মাথাটা একবার সামনের দিকে ঝোঁকালো তারপর শোওয়ার ঘরে যাওয়ার সিঁড়ির দিকে ছুটলো। ঘরটা অন্ধকার, ফাঁকা। ছোট্ট বাথরুমটার কাছে একটা মোমবাতি জ্বলছে । নবি এখনো সবসময় জেমসের জানলার কাছে বসে থাকার বিশেষ অনুমতি পায় নি। দেখা গেল খাঁচার মধ্যে ঘুমাচ্ছে।

‘নবি,’ জেমস জোরালো ফিসফিসানিতে ডাক দিলো, ‘ড্যাডকে পৌছে দেওয়ার জন্য একটা খবর আছে। আমি বুঝতে পারছি অনেক দেরী হয়ে গেছে, কিন্তু এটা খুবই দরকারি।’ বড়সড় পাখিটা পাখার মধ্যে থেকে মাথা তুলে ঠোঁট ঠুকলো অলসভাবে। পা বাড়াল সামনের দিকে, জেমস খাঁচার দরজা ও ঘরের জানলা খুললো।

‘ফিরে আসার পর তুই প্যাঁচাদের থাকার জায়গায় চলে যাবি। আমার কাছে থাকিস এটা আমার ভালো লাগে। কিন্তু এখানে ফিরে আসলে একটু গণ্ডগোল হতে পারে। বুঝতে পারলি?’

প্যাঁচাটা বড় বড় চোখে জেমসকে দেখলো, তার পর উড়ে গেল জানলায়। তারপর পাখার একটা ঝাপ্টা মেরে মিলিয়ে গেল বাইরের অন্ধকারে।

জেমস সিঁড়ির দিকে ফিরে যাওয়ার আগে একবার ট্রাঙ্কটার দিকে তাকালো। জায়গাটা বদলে গেছে নাকি? একটা শীতল স্রোত বয়ে গেল শিরদাঁড়ায়। জ্যাকসন কি তাহলে পোশাকটা নিয়ে চলে গেছেন ? লুক্কায়িত দ্বীপে যাওয়ার আগে নিজের ব্রিফকেসটা খুলে দেখেছিলেন, নিশ্চিত হওয়ার জন্য, আর তখনই ধরে ফেলেছেন ব্যাপারটা। গ্রেমলিনরা নিশ্চিতভাবে জ্যাকসনকে আসতে এবং যেতে দেখেছে। তারপর আবার মনে হলো, হয়তো না।   জ্যাকসন যথেষ্ট বুদ্ধিমান। হয়তো ছদ্মবেশে এসেছিলেন অথবা মাদাম ডেলাক্রয়কে বলেছেন রিমোট ফিজিও-অ্যাপারিশন ব্যবহার করে ছেলেদের শয়ন কক্ষে সরাসরি পৌছে পোশাকটা  নিয়ে আসার জন্য। তারপর আবার মনে পড়লো, টেড বললো জ্যান আর র‍্যালফ এখানেই ছিল কুইডিচ মাঠের গণ্ডগোলটার পর থেকে। জেমসকে জানতেই হবে। জেমস ট্রাঙ্কটার কাছে গেল, বার করলো নিজের জাদুদন্ড। ওর নির্দেশ পেয়েই খুলে গেল ঢাকনা, দেখতে পেলো ওটা একেবারে নিচেই রাখা আছে। না যেখানে ছিল সেখানেই আছে, কিন্তু মনে হচ্ছে ব্রিফকেসের ঢাকনাটা একটু খোলা। একটা আতঙ্কের ঢোঁক গিলে ভেতরে হাত ঢোকালো সে। ছোঁয়া পেল সেই মসৃণ কাপড়ের। এমনকি সেই শিহরণ জাগানো গন্ধটাও এলো ওর নাকে, সেই গাছপালাসহ পৃথিবীর, যেখানে বাতাস তার নিঃশ্বাস ফেলছে। একটা বড় মাপের স্বস্তির নিঃশ্বাস বেরিয়ে এলো জেমসের ভেতর থেকে।

ট্রাঙ্কটা খুলে রেখেই জেমস চারদিকটা দেখতে দেখতে ভাবছিলো দ্বীপে সফর করার আগে আর কিছু নেওয়ার দরকার আছে কিনা। এদিক ওদিকে পড়ে আছে জামা কাপড় আর টুকটাক নানান জিনিসপত্র । একটু ভাবার পর মরাউডার ম্যাপ এবং ইনভিজিবল ক্লোকটা তুলে নিলো। ট্রাঙ্কটা বন্ধ করে পুনরায় জাদুদন্ড দিয়ে ওটাকে বন্ধ করলো। ব্যাক-প্যাকটাকে ফেলে এসেছে হাপাতালের ঘরে। ম্যাপ আর ক্লোকটাকে ভরে নিলো বছরের শুরুতে মামের কাছ থেকে পাওয়া একটা চামড়ার বইয়ের ব্যাগে। দ্রুত নেমে এলো নিচে।  আর একবার থামলো নোয়া, পেট্রা আর টেডকে ডেলাক্রয়ের শক্তির কথা বলার জন্য।

নোয়া বললো, ‘ওসব নিয়ে ভাবতে হবে না।‘ উঠে দাঁড়িয়ে চলল সিঁড়ির দিকে। ‘আমরা এক এক করে তোর ট্রাঙ্কের দিকে নজর রাখবো। এক ঘণ্টা করে একেক জন, তাইতো টেড?’

টেড ঘাড় নাড়লো। চিন্তা মুক্ত হয়ে পোরট্রেটের দরজা পেরিয়ে জেমস চললো র‍্যালফ আর জ্যানের  উদ্দেশ্যে।

পাঁচ মিনিট পর, দুর্গের ভেতর থেকে বার হয়ে মাঠে এসে গেল জেমস। ভেতরের আলো থেকে বাইরের অন্ধকারে এসে ওর চোখ এখনো ধাতস্থ  হয়নি। আন্দাজে জমির ঢাল অনুসরন করে  এগিয়ে গেল লেকের দিকে। কানে এলো জ্যানের সিটির শব্দ, চেষ্টা করছে পাখির ডাকের নকল করার। বাঁ দিক থেকে শব্দটা আসছে অনুমান করে জেমস করে এগিয়ে গেল সেই দিকে এবং একসময় দেখতে পেল মেয়ে দৈত্যটা দাঁড়িয়ে আছে গাছের মাথা ছাড়িয়ে। জ্যান আর র‍্যালফ কাছেই পায়চারি করছে।

জ্যান মুচকি হেসে বললো, ‘ভালো ছিল না এটা?  জেমস বন্ডের  সিনেমায় এরকম করতে দেখেছিলাম। আমার মনে হল তোর এটা পছন্দ হতে পারে।’

‘দারুণ।’ জেমস মেনে নিলো। রাতের ঠান্ডা হাওয়ায় সঙ্গে এক ধরনের ভয় মেশানো উত্তেজনায় ওর ভেতরটা কাঁপছে। চরমক্ষণ এসে গেছে। আর পিছিয়ে যাওয়ার উপায় নেই। সম্ভবত এতক্ষনে হাসপাতাল থেকে ওর পালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা জানাজানি হয়ে গেছে। কালকে এ নিয়ে একটা ঝামেলা পাকবেই। কিন্তু এই মুহূর্তের কাজটা যদি না হয় তাহলে আরো বড় ঝামেলা অপেক্ষা করে আছে সামনে । জেমস প্রেচকার দিকে তাকালো। ‘ও কি আমাদের কাঁধে করে নিয়ে যাবে? তাহলেই একমাত্র সময়ের মধ্যে পৌঁছানোর সুযোগ আছে।’

প্রেচকা জেমসের কথাটা শুনতে পেয়ে নিচু হল। কেঁপে উঠলো মাটি পাশের পাহাড়ের দেওয়ালে ওর হাঁটুর ধাক্কা লাগায়। ‘প্রেচকা একটু সাহায্য করো,’ চেষ্টা করলো যতটা সম্ভব নিচু স্বরে কথা বলার। ‘প্রেচকা ছোটদের বয়ে নেবে।’ হেসে জেমসের কাছে মাথাটা নামিয়ে আনলো, যেটার উচ্চতা জেমসের সমান। জ্যান, র‍্যালফ আর জেমস ঝটপট ওর কাঁধে ওঠার পথে অগ্রসর হলো। জেমসকে র‍্যালফ আর জ্যানের সাহায্য নিতে হলো ভাঙ্গা হাতের কারণে। প্রেচকা উঠে দাঁড়ানোর সময় ওদের মনে হলো অতি দ্রুতগতির কোন এলিভেটরে ওরা চড়েছে। আর কিছু বলার আগেই প্রেচকা এগিয়ে চললো জঙ্গল ঠেলে। ওদের গায়ে লাগছিল গাছের একেবারে ওপরের দিকের ডাল পালার ছোঁয়া। মাঝে মাঝে প্রেচকা দুহাতে ওগুলো ঠেলে ধরে রাখছিল সামনের পথ করার জন্য।

জেমস জানতে চাইলো, ‘ও কি করে বুঝছে ওকে কোথায় যেতে হবে?’

র‍্যালফ উত্তর দিলো, ‘গ্র্যাপ ওকে বলে দিয়েছে। আমি জানি না কিভাবে বলেছে, দৈত্যদের ব্যাপার। ওরা শুধু মনে রাখে ওরা কোথায় ছিল আর সেখানে কি ভাবে ফিরে যেতে হয়। সম্ভবত এভাবেই ওরা একে ওপরের বাসস্থান খুঁজে নেয়। আমি ওদের ভাষা জানি না এক ফোঁটা, কিন্তু বুঝতে পারছি ও নিজে কি করছে সেটা জানে।’

গ্র্যাপের কাঁধে চড়ে যাওয়া আর প্রেচকার কাঁধে চড়ে যাওয়ার মধ্যে আকাশ পাতাল ফারাক। গ্র্যাপ যেখানে যত্ন নিয়ে সাবধানে যায় সেখানে প্রেচকা চলেছে কোনো দিকে নজর না দিয়ে। প্রতি পদক্ষেপে ওর শরীর কাঁপছে । যা কাঁপিয়ে দিচ্ছে তিন বন্ধুকেও। জেমসের মনে হচ্ছিল এ যেন বড়সড় কোন একচাকার সাইকেলের ওপর চড়ে বসে থাকা। জঙ্গল শেষ হলো। চারদিক এখন ফাঁকা, নিস্তব্ধ। একটু বাদেই জেমস প্রেচকার টিউনিকটা সজোরে টেনে ধরে বললো, ‘প্রেচকা এখানেই থামো। আমরা প্রায় এসে গেছি। আমরা যে এসেছি কেউ বুঝতে পারুক এটা  আমরা চাইনা।’

প্রেচকা হাত বাড়িয়ে একটা ওক গাছ ধরে দাঁড়ালো। সাবধানে নিচু হলো, তিন বন্ধু নামলো কাঁধ থেকে বড় মাপের স্লিপারে প্রায় পিছলে নামার মত করে।

‘প্রেচকা তুমি এখানেই থাকো’, জেমস বললো। বিশাল মাথাটা ঝোঁকালো একটু মেয়ে দৈত্যটা। তারপর আবার সোজা হয়ে দাঁড়ালো। জেমস শুধু আশাই করতে পারে প্রেচকা গ্র্যাপের মতো ওদের ফেলে খাবার খুঁজতে চলে যাবেনা।

হাত তুলে একটা দিক দেখিয়ে জ্যান বললো, ‘ওই দিক দিয়ে যেতে হবে।’ জেমস দেখতে পেলো চাঁদের আলোয় ঝিলমিল করছে লেকের জল। যতটা সম্ভব শব্দ কম করে ওরা এগিয়ে চললো পড়ে থাকা গাছের ডালপালা আর ঝোপঝাড় ঠেলে । কয়েক মিনিটের মধ্যেই ওরা পৌছে গেল লেকের ধারে। লুক্কায়িত দ্বীপ দূরে জলের ধারে দৃশ্যমান। বিশেষ রাতের জন্য তার প্রাচীন গথিক ধাঁচের ক্যাথিড্রালের মতো আকৃতি নিয়ে অপেক্ষমাণ। ড্রাগন মাথার সেতুটাকেও দেখা যাচ্ছে । মুখ হাঁ করে ভয়ানক আমন্ত্রণ জানানোর ভঙ্গীতে তৈরি। জেমস শুনতে পেল র‍্যালফের ঢোঁক গেলার শব্দ। ওরা এগিয়ে চললো নিঃশব্দে।

সেতুটার কাছে পৌছাতেই মেঘের আড়াল থেকে বেরিয়ে এলো চাঁদ। রুপালী আলোয় লুক্কায়িত দ্বীপের রূপ পরিস্ফূট হলো পূর্ণ মাত্রায়। এই মুহূর্তে দ্বীপটার সেই ভয়ানক বন্য রূপের কোন চিহ্ন দেখা যাচ্ছেনা। নিপুনভাবে আতঙ্ক সৃষ্টি করার জন্য বানানো ড্রাগন মাথার সেতু মুখ হাঁ করেই আছে। ওর পেছনে সেই গেট, লতা পাতা অলংকৃত। দেখে মনে হচ্ছে রট আয়রনের বানানো। জেমস এখন লেখাটা পরিষ্কার পড়তে পারছে।

‘ওটাতো বন্ধ,’ জ্যান ফিসফিস করে বললো, কিছু উৎসাহের সঙ্গেই। ‘এর মানেটা কি?’

জেমস মাথা নেড়ে বললো, ‘আমি জানি না। চল, দেখি আমরা ওখানে প্রবেশ করতে পারি কিনা।’

একটা লাইন করে তিন বন্ধু পা টিপে টিপে এগিয়ে চললো সেতুর ওপর দিয়ে। জেমস একেবারে সামনে।  দেখতে পেলো ওদের আসতে দেখেই ড্রাগনের মুখটা প্রশস্ত হলো। একটুও শব্দ হলো না এবার। প্রায় বুঝতে না দেওয়ার মতো করে ঘটে গেল ব্যাপারটা। দরজাটা অবশ্য বন্ধই আছে। জেমস জাদুদন্ড নেওয়ার জন্য হাত বাড়ালো এবং থেমেও গেল যন্ত্রনার আওয়াজ করে। ভুলেই গিয়েছিল ওর হাতে ব্যান্ডেজ করা আছে।

‘র‍্যালফ, তোকেই এই কাজটা করতে হবে,’ ডান দিকে সরে গিয়ে র‍্যালফকে সামনে আসার জায়গা করে দিয়ে জেমস বললো। ‘আমার জাদু দন্ড ব্যবহারের হাত অকেজো হয়ে গেছে। তোকেই দায়িত্ব নিতে হবে মিঃ স্পেল জিনিয়াস।’

র‍্যালফ জাদুদন্ড বার করে তোতলানোর মতো করে বললো, ‘ক-কি ক করতে হবে আমাকে?’

‘শুধু আন-লকিং মন্ত্রটা প্রয়োগ করতে হবে।’

‘কি…আরে থাম থাম!’ জ্যান একটা হাত তুলে বললো। ‘সেবার ওই একই কাজ করতে গিয়ে আমরা গাছের খাদ্য হয়ে গিয়েছিলাম প্রায়। মনে আছেতো?’

জেমস বললো, ‘সেটা তখনকার ব্যাপার ছিল। দ্বীপটা ঠিকঠাক তৈরী ছিলনা। আজ রাত প্রকৃত সময় এর অস্তিত্বের জন্য, আমার অন্তত তাই মনে হয়। এবার ওটা আমাদের ভেতরে ঢুকতে দেবে। তাছাড়া, এ হলো র‍্যালফ। যদি কেউ এই কাজটা করতে পারে তবে সেটা র‍্যালফ ছাড়া আর কেউ না।’

জ্যান মুখ বিকৃত করলো, তবে পাল্টা উত্তর কিছু দিলনা। এক পা পিছিয়ে গেল, র‍্যালফকে আরো খানিকটা জায়গা করে দেওয়ার জন্য। র‍্যালফ কাঁপা কাঁপা হাতে জাদুদন্ডটা তাক করলো দরজার দিকে। গলাটা ঝেড়ে নিলো একবার।

‘কি যেন মন্ত্রটা? আমি শুধু ভুলে যাই!’

জেমস উৎসাহ ব্যাঞ্জকভাবে বললো, ‘আলোহোমোরা। দ্বিতীয় আর চতুর্থ সিলেবলে জোরটা দিবি। এটা তুই অনেকবার করেছিস। চিন্তার কিছু নেই।’

র‍্যালফ নিজেকে শক্ত করলো, হাতের কাঁপুনি থামানোর জন্য। একটা গভীর শ্বাস নিয়ে, কম্পিত কন্ঠস্বরে, বললো মন্ত্রটা।

সঙ্গে সঙ্গেই ডালপালাগুলোতে শুরু হলো চঞ্চলতা। লেখাগুলো মিলিয়ে যেতে থাকলো ডালপালার সঙ্গে সঙ্গে। সবকিছু সরে গেলে  দেখা গেল কাঠের পাল্লা। আরো কয়েক সেকেন্ড বাদে শব্দহীন ভাবে খুলে গেল দরজাটা।

র‍্যালফ জেমস আর জ্যানের দিকে তাকালো, চোখ বিস্ফারিত এবং উৎকণ্ঠায় ভরা। ‘আমার মনে হয় কাজটা হয়েছে।’

সমানের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে জ্যান বল লো, ‘আমার ও তাই মনে হয়।’ তিন জন সাবধানে দরজার ওপারের অন্ধকারে পা বাড়ালো।

লুক্কায়িত দ্বীপের ভেতরটা গোলাকৃতি এবং প্রায় ফাঁকা। থামের মতো গাছ গুলো দিয়ে ঘেরা। ওপর দিকে ডালপালা ও পাতায় ঢাকা একটা গম্বুজাকৃতি সিলিং। মেঝে পাথরের, ধাপে ধাপে নেমে গেছে নিচের দিকে মাঝখানে। সেই মাঝখানটায় বাটি আকৃতির মতো স্থান আলোকিত হয়ে আছে চাঁদের আলোয়। আলোটা এসেছে সিলিং এর একটা গর্ত দিয়ে। চাঁদের আলোতে দেখা যাচ্ছে মারলিনের সিংহাসনটাকে। আর তার ঠিক সামনে সিল্যুয়েটের মতো দাঁড়িয়ে আছেন, মাদাম ডেলাক্রয়।

জেমসের নিজেকে কেমন যেন দুর্বল বোধ হচ্ছিল ভয়ের চাপে। ওঁর পেছনদিকটা ওদের সামনে, উনি নড়ছেন না। একদৃষ্টে তাকিয়ে আছেন সিংহাসনটার দিকে। মারলিনের সিংহাসনটা কাঠের তৈরি, লম্বা, পেছনের হেলান দেওয়ার কাঠ সোজা এবং সরু। দারুণভাবে পালিশ করা ওটা। যদিও জেমসের ভাবনার চেয়েও বেশী কারুকার্য করা। গোটা গায়ে জাফরির মতো লতাপাতার খোদাইতে ভর্তি। খোদাইহীন কেবলমাত্র বসার আর হেলান দেওয়ার জায়গাটা। দেখে মনে হচ্ছে সিংহাসনটা লুক্কায়িত দ্বীপের মতো জন্ম নিয়েছে। কেউ ওটাকে বানায়নি। আর কাউকে  দেখা যাচ্ছে না। সম্ভবত ডেলাক্রয় আগেই এসে গেছেন। জেমস ভাবতে চেষ্টা করছিল একটুও না নড়ে উনি কতক্ষণ ধরে ওখানে দাঁড়িয়ে আছেন। নিরীক্ষণ করে চলেছেন সিংহাসননটাকে। পেছনে কারোর পায়ের শব্দ শোনা গেল। ড্রাগন মাথা সেতুর ওপর দিয়ে কেও আসছে। জেমস নিঃশ্বাস চেপে রাখল। বুঝতে পারলো র‍্যালফ আর জ্যান নিচু হয়ে পেছন দিকের ঘাস ঝোপের কাছে লুকোচ্ছে।

জেমস শুনতে পেলো এক অজানা ভাষায় একজন পুরুষ মানুষ কিছু একটা আদেশ দিলো। যেটা শুনতে একই সঙ্গে মাধুর্যময় এবং আতঙ্কজনক। বাইরের দরজায় গাছপালার নড়াচড়ার শব্দ শোনা গেল। পায়ের শব্দ এগিয়ে এলো পাথরের ধাপের ওপর দিয়ে। প্রফেসর জ্যাকসনকে দেখা গেল এবার। এগিয়ে গিয়ে দাঁড়ালেন মাদাম ডেলাক্রয়ের পেছনে।

‘প্রফেসর জ্যাকসন,’ মাদাম ডেলাক্রয় মুখ না ঘুরিয়েই বললেন, ‘আপনি কখনোই আমার চাহিদা পূরণে ব্যর্থ হননি।’  ওঁর ভারী গলার শব্দ অনুরণিত হলো গম্বুজাকৃতি ঘরটাতে।

‘আপনিও তাই মাদাম। আপনি তো দেখছি আগেই এসে গেছেন।’

‘আমি সময় বাঁচানোয় বিশ্বাস করি থিয়োডোর। এক দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয়েছে এই মুহূর্তে আসার জন্য। যদি আমি সুযোগ বিষয়ে বিশ্বাসী হই তাহলে বলতে বাধ্য হচ্ছি “অত্যন্ত দীর্ঘ”। কিন্তু আমি সেটা নই। আমি সেটাই করেছি যেটা করা বাঞ্ছনীয়। এমন কি আপনিও সেই দায়িত্ব পালন করে চলেছেন যা আপনার ওপর ন্যস্ত আছে বলে আপনি মনে করেন।’

মাদাম ডেলাক্রয় থেকে বেশ খানিকটা দূরেই থেমে গেলেন প্রফেঃ জ্যাকসন। ‘আপনি কি সত্যিই তাই বিশ্বাস করেন মাদাম?’  জেমস দেখল জ্যাকসনের হাতে উনার হিকোরী জাদুদন্ড। ‘আমার তো অবাক লাগছে। আপনি তো জানেন, আমি কোন রকম সুযোগ বা ভাগ্যে বিশ্বাসী নই। আমি কেবলমাত্র বিশ্বাস করি বেছে নেওয়াকে।’

‘থিওডোর, আপনি কি বিশ্বাস করেন তাতে কিছু যায় আসে না, যদি আপনার বেছে নেওয়াটা সঠিক পথের পথিক হয়।’

জ্যাকসন সহসাই গলার মোলায়েম ভাব ত্যাগ করে বলে উঠলেন, ‘আপনি ভালো করেই জানেন আমার কাছে আছে পোশাকটা। সবসময় ওটা আমি আমার কাছে রেখে দিয়েছি। আপনি ওটা কিছুতেই পাবেন না। এখানে এসেছি সেটা বলার জন্যই। এসেছি আপনাকে আটকানোর জন্য। মাদাম যতই আপনি আমাকে দূরে রাখার চেষ্টা করুন না কেন।’

জেমস অবাক হয়ে ঢোঁক গিললো। আওয়াজটা চাপা দেওয়ার জন্য মুখে হাত চাপা দিল। জ্যাকসন এখানে এসেছেন মাদামকে আটকানোর জন্য! কিন্তু কি ভাবে? জেমস একটা শীতল স্রোত শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে যাওয়ার অনুভুতি পেলো। ওর একেবারে পেছনে দাঁড়িয়ে প্রায় শব্দহীন ফিসফিসানিতে র‍্যালফ বললো, ‘উনি কি এটাই বললে…’

জ্যান ধমকে উঠলো, ‘শ শশ! চুপ করে থাক!’

ডেলাক্রয় একটা অদ্ভুত ছন্দময় শব্দ করলেন। উনার কাঁধ নড়ে উঠলো সামান্য, জেমস বুঝলো উনি হাসছেন। ‘মাই ডিয়ার, থিওডোর, আমি কখনোই আপনাকে আটকানোর চেষ্টা করিনি। কেন করবো, আরে আমি যদি বুঝতাম আপনি এখানে এলে এক ফোঁটা অসুবিধা আমার হবে, তাহলে তো আপনাকে এখানে আসতেই দিতাম না।  আপনার একগুঁয়েমি আর সন্দেহজনক চরিত্র আমার কাজের সেরা অস্ত্র। প্রফেসর, আপনাকে আমার দরকার ছিল। আমার দরকার ছিল আপনার কাছে যেটা আছে বা যেটা আপনি মনে প্রাণে বিশ্বাস করেন যে আপনি রক্ষা করে চলেছেন সেটা হাতানোর জন্য।’

জ্যাকসন কাঠের পুতুলের মত দাঁড়িয়ে। ‘আপনি কি ভাবেন যে আমি পোশাকটা এখানে নিয়ে এসেছি? আমি এতটাই বোকা? তাহলেতো আমাকেই ভাবতে হবে যে আপনি অতি মাত্রায় উর্বর মস্তিষ্কের অধিকারিণী। উঁহু, সেই পোশাক সুরক্ষিতই আছে। ওটা রাখা হয়েছে সবচেয়ে সেরা কাউন্টার আসসিও মন্ত্রের বন্ধনে। আমি জানি ওরা ওটা আমার জন্যই করে রেখেছে। আপনি কোনদিনই ওটা খুঁজে পাবেন না।  এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত।’

ডেলাক্রয় কিন্তু আরো জোরে হেসে উঠলেন কথাগুলো শুনে। এখনো উনি ঘুরে দাঁড়াননি। ওপর থেকে আসা আলোয় চেয়ারটা আরো বেশী উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। জেমস বুঝতে পারলো গ্রহদের আলোতে ওটার উজ্জ্বলতা বাড়ছে। গ্রহগুলো এখন এই জায়গার ওপরেই এসে পড়েছে। হল অফ এল্ডারস ক্রসিং এর ক্ষণ সমাগতপ্রায়।

‘ওহ প্রফেসর, আপনার আত্মবিশ্বাস আমাকে উৎসাহী করে দিচ্ছে। আপনার মত শত্রু থাকার জন্য এই সাফল্য আরো সুস্বাদু হয়ে উঠছে। আপনি কি মনে করেন, আমি জানতাম না যে আপনি মারলিনাসের পোশাকটাকে আপনার ব্রিফকেসে বয়ে নিয়ে বেড়ান সবসময়ে? আপনি কি মনে করেন, আমি এখানে আসার পর থেকে ওই পোশাকটাকে ঠিক সময়ে পাওয়ার কোন ব্যবস্থাই করিনি, শুনে রাখুন আজ রাতে ওই পোশাক আমার সামান্য অঙ্গুলি হেলনে নিজে থেকে এসে উপস্থিত হবে।’

জেমসের মনে একটা ভয়ানক ভাবনা উপস্থিত হলো। ওর মনে পড়লো ডিফেন্স এগেইন্সট দ্য আর্টস ক্লাসের সেই দিনটার কথা, যেদিন জ্যাকসন প্রফেসর ফ্র্যাঙ্কলিনের সঙ্গে কথা বলছিলেন। মাদাম ডেলাক্রয় এসে জানালেন ওর ক্লাসের দেরি হয়ে যাচ্ছে। জেমস সে সময় নিচের দিকে তাকিয়ে ছিল, দেখতে পেয়েছিল ব্রিফকেসটা খোলা। তাহলে কি মাদাম ডেলাক্রয়ই ওটা খুলেছিলেন, যাতে জেমস ওটা দেখতে পায়? উনি কি ওকে কোনোভাবে ব্যবহার করেছেন? ওর মনে পড়লো জ্যান আর র‍্যালফ বলেছিল  পোশাক হাতানোটা খুব সহজেই হয়ে গেল। খুবই সহজে। জেমস কেঁপে উঠলো।

‘জেমস,’ র‍্যালফ জানতে চাইলো, ‘তুই নিশ্চয় পোশাকটা আজ রাতে সঙ্গে করে নিয়ে আসিসনি?’

জেমস উত্তর দিলো, ‘মোটেই না, আমি কি পাগল!’

জ্যান যতটা সম্ভব চাপা স্বরে বললো, ‘তাহলে তোর ওই ব্যাগে কি আছে?’

জেমস একই সঙ্গে রাগ আর ভয় অনুভব করলো। ‘মরাউডার ম্যাপ আর ইনভিজিবল ক্লোক।’

র‍্যালফ জেমসের কাছে গিয়ে টেনে নিজের দিকে ওকে ঘোরালো। মুখে আতঙ্কের ছায়া। ইনভিজিবল ক্লোক !’ ঢোঁক গিলে বিকৃত স্বরে বললো। ‘জেমস, ওটা আমার কাছে আছে। স্লিদারিনদের খেলোয়াড়দের ঘরে ওটা আমার কাছেই থেকে গিয়েছিল, ভুলে গেছিস? আমি ওটার সাহায্যেই পালাতে পেরেছিলাম! আমার ঘরে, আমার ট্রাঙ্কে রাখা আছে ওটা!’

জেমস পাথরের মূর্তির মতো র‍্যালফের দিকে তাকিয়ে থাকলো। ওদিকে নিচে লুক্কায়িত দ্বীপ ঘরের মাঝখানে মাদাম ডেলাক্রয় হাসতে থাকলেন।

হাসির সঙ্গেই দিলেন ডাক, ‘মিঃ জেমস পটার। কোনো রকম সংকোচ না করে আমাদের এখানে চলে এসো। চাইলে তোমার বন্ধুদের নিয়েও আসতে পারো।’

জেমসের নড়ার ক্ষমতা চলে গেছে।  মোটেই ওই নিচে যাবেনা ও। বরং দৌড়ে পালাবে। বুঝে গেছে ছলে-বলে ওকে ইনভিজিবল ক্লোক আনার ভাবনায় ভুলিয়ে মারলিনাসের পোশাক এখানে নিয়ে আসতে বাধ্য করা হয়েছে। এটাই সঠিক সময় পালানোর। কিন্তু সেটা ও করতে পারছে না। র‍্যালফ ওকে ঠেলছে। পালাতে বলছে। ঠিক ওই মুহূর্তে জেমসের অন্যদিকটায় বসে থাকা জ্যান আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ালো। নিজের জাদুদন্ডটা হাতে নিয়ে।

গাছের মতো থামগুলোর আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে জাদুদন্ড তাক করে চিৎকার করে বললো, ‘এই যে, ভুডু কুইন! নিজেকে খুবই স্মার্ট মনে করেন তাইনা!  আসলে আপনি যতটা বিশ্রী দেখতে ততটাই শয়তান। স্টুপিফাই!’

জেমস দেখলো জ্যানের জাদুদন্ড থেকে একটা লাল আলোর ঝলক ছিটকে গেল । আছড়ে পড়লো মাদাম ডেলাক্রয়ের পিঠে । জেমস ভেবেছিলো উনি অজ্ঞান হয়ে এবার পড়ে যাবেন। বাস্তবে উনি একটুও নড়লেন না। অবাক হয়ে শুধু দেখলো লাল আলোর ঝলকটা ওকে ভেদ করে চলে গেল। সিংহাসনের কাছের মাটিতে ওটা পড়ে মিলিয়ে গেল। ডেলাক্রয় হাসতে হাসতে জ্যানের দিকে ফিরলেন।

‘আমি দেখতে বিশ্রী বুঝি?’ হাসি থেমে গেল জ্যানের দিকে তাকানোর পর। এখন আর উনি মোটেই অন্ধ বা বুড়ি নন। এই মুহূর্তে উনার প্রতিরূপ ওদের সামনে দাঁড়িয়ে। ‘শয়তান? হতে পারে। তবে সেটা একটা হবি মাত্র।’ প্রতিরূপটা একটা হাত ওঠালো, সঙ্গে সঙ্গেই জ্যান ভেসে উঠলো শূন্যে। হাত থেকে বেরিয়ে গেল জাদুদন্ডটা।  জ্যান ধাক্কা খেলো গাছরুপী স্তম্ভে। তারপর ভেসে থাকলো তিন ফুট উঁচুতে। মনে হচ্ছিল একটা হুকে আটকে ওকে টাঙিয়ে রাখা হয়েছে। ‘আমি যদি শয়তান হতাম তাহলে এই মুহূর্তে আমি তোমাকে মেরে ফেলতাম বুঝলে কিছু?’ হাসলেন, তারপর ঘুরে হাতটা বাড়ালেন সেইদিকে যেখানটায় জেমস লুকিয়ে আছে। ‘মিঃ পটার, প্লিজ, আমার সঙ্গে লড়তে চেষ্টা করাটা খুবই বোকা বোকা ব্যাপার। আর সত্যি কথা এটাই যে এই বিষয়টাতে তুমি একেবারে নভিস। মিঃ ডিডলকেও সঙ্গে করে নিয়ে এসো। সবাই একসঙ্গে মজাটা উপভোগ করি। কি হলো, আসবে না নাকি?’

জ্যাকসন ঘুরে দাঁড়িয়েছিলেন জ্যান যখন বেড়িয়ে এসেছিল তখনই। উনার জাদুদন্ড এখনো ওর হাতেই আছে  নিচের দিকে নামানো। দেখলেন কাঁপতে কাঁপতে জেমস আর র‍্যালফ সিঁড়ি দিয়ে  নেমে চলেছে নিজেদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে। ওর সঙ্গে চোখাচোখি হলো জেমসের। ভ্রু ওপরে তুলে রাগের সঙ্গে বলে উঠলেন, ‘পটার, থামো,’ খানিকটা উঁচু করে ধরেছেন জাদুদন্ডটাকে, তাক করেছেন জেমস আর র‍্যালফের সামনেটায় । জেমসরা থেমে গেল, যেন ওদের পায়ের তলায় হঠাৎ আঠা লাগিয়ে দিয়েছে কেউ।

‘ওহ, থিওডোর, তুমি দেরী করিয়ে দিতে চাইছো?’ ডেলাক্রয় দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। হাত ঘুরিয়ে একটা আজব রকমের নাড়াচাড়া করলেন নিজের আঙুলগুলোকে। জ্যাকসনের জাদুদন্ডটাও ছিটকে গেল উনার হাত থেকে। যেন সুতো বেঁধে টেনে নেওয়া হলো। জ্যাকসন ধরতে গেলেন ওটাকে কিন্তু ওটা দূরে চলে গেল। ডেলাক্রয় আবার আঙুল নাড়লেন, জাদুদন্ডটা সশব্দে ভেঙে গেল মাঝ আকাশে। জ্যাকসনের মুখে কোন পরিবর্তন দেখা গেল না। উনি আস্তে আস্তে হাতটা নামালেন। তাকিয়ে থাকলেন ভেঙে যাওয়া হিকোরী দন্ডটার দিকে। তারপর ঘুরে তাকালেন ডেলাক্রয়ের দিকে। মুখ রাগে সাদা। এগিয়ে চললেন ভুডু কুইনের দিকে। ডেলাক্রয়ের হাত নেচে উঠলো বিদ্যুতের মতো। পোশাকের ভেতর থেকে আঙ্গুলের ডগায় বার করে আনলেন নিজের অদ্ভুত দর্শন আঙুরগাছের শিকড় থেকে তৈরি জাদুদণ্ডটা ।

‘এটা আসল জিনিষটার একটা নমুনা মাত্র, ‘বললেন রসিয়ে রসিয়ে, ‘এর জন্ম হয়েছে এখানকার মাটি থেকে, আমার নিজের কাজের জন্য।  কিন্তু আমি আগে থেকেই নিশ্চিত করে বলে দিতে চাই যে, থিওডোর, এটা ততটাই শক্তিশালী যতটা আমি জানি। আমায় বাধ্য কোরোনা তোমাকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার জন্য।’

জ্যাকসন থেমে গেলেন, কিন্তু মুখের ভাব একইরকম রইলো, ‘আমি তোমাকে কিছুতেই এই কাজ করতে দেব না ডেলাক্রয়।  তুমি সেটা ভালো করেই জানো।’

খিলখিলিয়ে হেসে ডেলাক্রয় বললেন, ‘ও হো, তুমিতো ইতিমধ্যেই সে চেষ্টাটা করে ফেলেছো। জাদুদন্ডটা তাক করলেন জ্যাকসনের দিকে, নাড়লেন। একটা কমলা আলোর ঝলক বার হল ওটা থেকে, যা জ্যাকসনকে উড়িয়ে নিয়ে চলে গেল পেছন দিকে। আছড়ে পড়লেন ওপরের দিকের সিঁড়ির ধাপে। চেষ্টা করলেন উঠে দাঁড়ানোর, ডেলাক্রয় চোখ ঘোরালেন। কঠোর স্বরে বললেন, ‘এরা আবার হিরো হবে!’  পুনরায় নাড়লেন নিজের জাদুদন্ড। জ্যাকসন আবার ভেসে গেলেন শূন্যে আছড়ে পড়লেন একটা স্তম্ভের গায়ে। সম্ভবত অজ্ঞান হয়ে গেলেন, আর নড়লেন না।

‘এবারে,’ জেমস আর র‍্যালফের দিকে জাদুদন্ড তাক করলেন, ‘এসো, আমার কাছে এসো।’

দুজনকেই শূন্যে ভাসিয়ে বাকি ধাপগুলোর ওপর দিয়ে টেনে আনলেন। নামিয়ে দিলেন মাঝখানের ঘাসে ভরা জায়গাটায়। ওরা পৌছে গেল একেবারে মাদাম ডেলাক্রয়ের প্রতিরুপের সামনে। যার চোখ দুটোর রঙ পান্না সবুজ  এবং দৃষ্টি অন্তর্ভেদী। ‘পোশাকটা আমাকে দাও। আর দয়া করে এমন কিছু কোরনা যাতে তোমাদের ক্ষতি করতে হয়। আমি মাত্র একবারই একটা কথা বলতে ভালবাসি।’

বইয়ের ব্যাগটা জেমসের কাঁধ থেকে পড়ে গেল মাটিতে পায়ের কাছে। ও তাকালো ওটার দিকে, নিজেকে কেমন যেন অসহায় এবং হতবুদ্ধি মনে হচ্ছে। ‘প্লিজ’, ডেলাক্রয় বললেন এবং জাদুদন্ড  নাড়লেন। জেমস হাঁটু গেড়ে বসতে বাধ্য হল, অতি ওজনের কেউ যেন ওর ঘাড়ে চেপে বসলো। হাত চলে গেল ব্যাগের ভেতর, চেপে ধরলো পোশাকটাকে, টেনে বার করে আনলো। র‍্যালফের মনে হচ্ছিল ওকে আটকে রাখা হয়েছে এক জায়গায়, কোনোদিকেই একটুও নড়তে পারছে না। ‘জেমস, ওটা দিস না।’

‘আমি নিজেকে আটকাতে পারছি না,’ জেমস বললো হতাশ ভাবে।

ডেলাক্রয়ের চোখে ঝলসে উঠলো লোভের ছায়া। হাত বাড়িয়ে আস্তে করে পোশাকটা নিয়ে নিলো জেমসের কাছ থেকে। ‘ভালো ইচ্ছেকে সবসময় বড্ড বেশী গুরুত্ব দেওয়া হয়।’ বললেন হাল্কাচ্ছলে।

জেমস ক্রুদ্ধ স্বরে বললো, ‘আপনি সফল হতে পারবেন না। আপনার কাছে সব কটা রেলিক নেই।’

ডেলাক্রয় পোশাক থেকে মুখ তুলে জেমসের দিকে তাকালেন অতি অবাক হওয়ার ভঙ্গীতে। ‘তাই নাকি মিঃ পটার, আমার কাছে নেই?’

‘না!’ জেমস বললো দাঁত কিড়মিড় করে। ‘আমরা আসল ঝাড়ুটা নিতে পারিনি। ওটা টাবিথার কাছেই আছে। আমি এখনো জানিনা ও আদপেই জানে কিনা ওটা আসলে কি। কিন্তু এই মুহূর্তে ওটা এখানে নিয়ে ওর আসার কোন চান্স নেই।’ জেমসের আশা ও যা বললো সেটাই ঠিক। আশেপাশে কোথাও ঝাড়ুটার চিহ্ন নেই। যদি লুকিয়ে না থাকে, যেমন ওরা ছিল, তাহলে টাবিথা এখানে নেই ।

ডেলাক্রয় মৃদু হাসলেন এমনভাবে, মনে হল জেমস যেন কোন মজাদার কথা বললো। ‘আরে তাইতো! তোমার মতে ওটাই সবচেয়ে ভালো লুকিয়ে রাখার জায়গা তাই না মিঃ পটার? মিস করসিকা হলো পারফেক্ট মানুষ যে ওটা আমার কাছে এনে দেবে। আসলে ওটা এতটাই পারফেক্ট, যে তুমি ধরতেই পারনি গোটাটাই আসলে একটা দারুণভাবে সাজানো মিথ্যে। খুবই কৌতূহলজনক যাকে বলে। আসলে ওর ঝাড়ুটা খুবই ভালো একটা জিনিস ছিল ধোঁকা দেওয়ার পক্ষে। এই পোশাকটার মতই মারলিনের জাদু লাঠিও ঠিক পথ খুঁজে নেবে আমার কাছে চলে আসার, সে তুমি যাই মনে করো না কেন। আসল কথা হলো ওটার যত্নও ভালোই নেওয়া হয়েছে।’

সুন্দরী মাদাম ডেলাক্রয়ের প্রতিরুপ এবার র‍্যালফের দিকে ঘুরে হাত বাড়ালো। ‘তোমার জাদুদন্ডটা দাও তো মিঃ ডিডল, প্লিজ।’

‘ন নাহ,’ র‍্যালফ গোঙ্গানোর মতো করে প্রতিবাদ করলেন। চেষ্টা করলো পিছিয়ে যাওয়ার।

‘আমাকে জোর করতে বাধ্য কোরোনা র‍্যালফ,’ ডেলাক্রয় বললেন নিজের জাদুদন্ডটা তুলে ধরে।

র‍্যালফের হাতটা ঝাঁকুনি দিয়ে ব্যাকপ্যাকে পৌঁছে গেল। কাঁপতে কাঁপতে ও বার করে আনলো সেঈ অদ্ভুত রকমের বড় জাদুদন্ডটা। এই প্রথম, জেমস ভালো করে দেখে বুঝতে পারলো ওটা আসলে কি। শুধুমাত্র অস্বাভাবিক মোটাই নয়, একটা দিক চাঁছা। এটা কোন এক সময়ে আরো বড় কিছুর অংশ ছিল। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে জীর্ণ হয়েছে। কিন্তু তবুও ওর বাকি অংশটা আজও যথেষ্টই শক্তিশালী। ডেলাক্রয় এগিয়ে গেলেন এবং ঝট করে টেনে নিলেন মারলিনের লাঠিটাকে র‍্যালফের হাত থেকে।

‘এরকম একটা জিনিসকে দখল করে নিজের কাছে রাখার ঝুঁকি নেওয়ার কোনো মানেই নেই। যে কেউ ধরে ফেলতে পারতো ওটা আমার কাছে আছে। তারজন্যই ওটাকে তোমার আর তোমার প্রিয় বাবাকে বিক্রি করার ব্যবস্থা করে দিই। আমিই ছিলাম সেদিনের বিক্রেতা, অবশ্য অন্য রুপে। আমার মনে হয় তুমি ওটা ব্যবহার করে মজাই পেয়েছো। একটু বেশী মাত্রায় কার্যকরী তাই না? ওহো, কিন্তু এখনতো  দেখতে পাচ্ছি,’ উনি কিছুটা ক্ষমা চাওয়ার কন্ঠে বললেন, ‘তুমি ভাবতে শুরু করেছিলে যে তুমি দারুণ ক্ষমতাশালী এক জাদুকর, তাই না?’ আমি খুবই দুঃখিত, মিঃ ডিডল। তুমি কি মনে করো তুমি এখানে আসার সুযোগ পেতে, যদি না মারলিনের জাদুলাঠি তোমার কাছে থাকতো? মজাটা বোধ হয় বুঝতে পারছো তাই না? তুমি তো মাগল-জাত। প্লিজ আমাকে ক্ষমা করে দিও।’ হেসে উঠলেন দুষ্টুমির ভঙ্গীতে।

ঘুরে দাঁড়ালেন, অতি যত্নে সাজিয়ে রাখলেন বাকি রেলিক দুটোকে সিংহাসনের ওপর। জেমস আর র‍্যালফ একে ওপরের দিকে তাকালো ফ্যালফ্যাল করে ।  এই ঘটনায় না জেনেও জড়িয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা বুঝে।

‘এবার হবে আসল কাজ। বলে বোঝাতে পারছি না আমি কি পরিমাণ খুশী। বলতে ইচ্ছে করেছে না তবু না বলে পারছি না সব কিছু এক্কেবারে আমার পরিকল্পনা মতই ঘটছে। হে আমার তরুণ বন্ধুগন এবার উপভোগ করো সেই বিস্ময়কর ঘটনা। আমি অবশ্য কোন নিশ্চয়তা দিতে পারছি না যে মারলিনাস ফিরে এসেই তোমাদের ধ্বংস করবেন নাকি বাঁচিয়ে রাখবেন। তবে এটা বলতেই পারি এরকম একটা ঘটনা দেখার জন্য মরতে পারাটা খুব বেশী কিছু না।’

জেমস কর্কশ স্বরে বললো, ‘ওটা আরো মূল্যবান হবে যদি উনি ফিরে এসে আপনাকে খতম করেন ।’

ডেলাক্রয় হেসে বললেন, ‘এত বিষাক্ত মানসিকতা? অবাক হবো না যদি তুমি মারলিনের একজন সেরা অনুগত হয়ে যাও।’

সিংহাসনের ওপর পোশাকটা  এমন ভাবে উঠে গেল যেন মারলিন ওখানে উপস্থিত হলেই ওটা ওর শরীরের ওপর ন্যস্ত হবে। সামনে হেলান দিয়ে রাখা আছে জাদুলাঠিটা। গম্বুজাকৃতি ছাদের ফুটো দিয়ে নেমে আসা  চাঁদ আর তারাদের সম্মিলিত আলোয় এই মুহূর্তে আরো উজ্জ্বল হয়েছে কক্ষটির মধ্যের স্থানটি। রুপালী আলোয় চকচক করছে তিনটে রেলিক। এসে গেল হল অফ এল্ডারস ক্রসিং এর সেই কাঙ্ক্ষিত ক্ষণ।

জেমস কিছু একটা শুনতে পেলো। মাদাম ডেলাক্রয় এবং র‍্যালফও যে সেটা শুনতে পেয়েছে বুঝতে পারলো। তিনজনেই একসঙ্গে ঘাড় ঘোরালো, বোঝার চেষ্টা করলো কোথা থেকে আসছে শব্দটা। এটা অনেক দূর থেকে আসা একটা কম্পনের মতো। নিচুমাত্রায় একসঙ্গে যেন একশোটা বাঁশি বাজছে। শব্দটা বাড়ছে। মাদাম ডেলাক্রয়ের প্রতিরুপের মুখে যেন একটা ভয়ের ছাপ পড়েছে বলেই মনে হল জেমসের। উনি ওদের দুজনার কাঁধ চেপে ধরলেন শক্ত হাতে, জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিতে নিতে বললেন, ‘ওই দ্যাখো!’

কুয়াশার শুঁড় কক্ষটির স্তম্ভগুলোর আশপাশ দিয়ে ছড়িয়ে পড়ছে। তার সঙ্গেই শোনা যাচ্ছে শব্দটা। জেমস চারদিক দেখলো। কুয়াশার ডালপালা উঠে যাচ্ছে সিলিং এর দিকেও। দেখতে ধোঁয়ার মতো হলেও ওদের চলন নিয়ন্ত্রিত ছন্দে এবং বাড়তে থাকা গতিতে চলছিল। এগিয়ে গেল সিংহাসনের দিকে, শুরু করলো একত্র হতে। শুরু হল একটা আলোড়ন। ভেঙে ভেঙে যেতে থাকলো কুয়াশার ডালপালা। একটা অবয়ব যেন গঠন হতে শুরু করল। প্রথমে ঝাপসা, তারপর আস্তে আস্তে ঘন হতে থাকলো । সিংহাসনের মাঝখানে এক সারি সোজা দাগ দেখা গেল। জেমস শিহরণের সঙ্গে বুঝতে পারলো ওগুলো একটা কঙ্কালের বুকের পাঁজর। একটা শিরদাঁড়া এসে গেল পেছন দিকটায়। যার ওপর দিকে একটা নরকরোটি আর নিচের দিকে শ্রোনির হাড় প্রকাশিত হল। জেমস বুঝতে পারলো অতি মন্থর গতিতে ওখানে সংগঠিত হচ্ছে অ্যাপারিশন। মারলিনের অ্যাটমগুলো কয়েক শতাব্দী ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকার পর একত্র হচ্ছে । আর সেই কাজ হতে গিয়ে সৃষ্টি হচ্ছে এক অপার্থিব শব্দ, যার মাত্রা এবং লয় বেড়েই চলেছে। ক্রমশ রূপ পরিগ্রহ হচ্ছে এক মানবদেহের।

‘এই যে ভুডু কুইন,’ জেমসের পেছন থেকে আসা কন্ঠস্বটা ওদের তিনজনকেই একসঙ্গে চমকে দিল। ‘সামলাও দেখি এবার।’

একটা লাঠির আঘাত পড়লো ডেলাক্রয়ের মাথায় । পুরো মূর্তিটা শত শত ছোট কাদার তালের মত ধ্বসে পড়লো মাটিতে। সঙ্গে সঙ্গেই জেমস আর র‍্যালফের আড়ষ্ঠ ভাব কেটে গেল, বডি-বাইন্ড মন্ত্রের প্রভাব মুক্ত হয়ে। জেমস ঘুরে দাঁড়িয়ে দেখলো জ্যান ধরে আছে মোটা লাঠিটার অন্য দিক, টেনে আনছে প্রতিরূপটার থলথলে দলাটার ভেতর থেকে।  ওটা চেষ্টা করছে নিজেকে পুনঃনির্মাণ করার। দেখে মনে হচ্ছে ডেলাক্রয়ের এই প্রতিরুপ গঠিত হয়েছে কাদা, পচা শিকড় আর পোকামাকড় দিয়ে। একটা হাত মাথাটাকে খুঁজে পেয়ে চেষ্টা করছে ঠিক জায়গায় লাগানোর।

‘মারলিন রুপ পরিগ্রহ করা শুরু করতেই উনি আমার কথা ভুলে গিয়েছিলেন,’ জ্যান চেঁচিয়ে বললো, লাঠিটাকে মাথার ওপর তুলে ধরে। ‘আমি ভাসমান অবস্থা থেকে পড়ে যাওয়ার পর হাতের কাছে শক্ত যা পাই সেটাই আঁকড়ে ধরি। তোরা তাড়াতাড়ি পোশাক আর জাদু লাঠিটা ওখান থেকে নিয়ে আয়! বেসবলের ব্যাটের মত হাতের লাঠিটাকে এক পাক ঘুরিয়ে জ্যান এবার আঘাত করলো প্রতিরুপের একটা হাতে । ওটা ছিটকে গেল কিছুটা দূরে আর গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে পরিণত হল কাদা আর ক্রিমির মতো পোকায়।

জেমস লাফিয়ে এগিয়ে গিয়ে গঠিত হতে থাকা জাদুকরের শরীরের ভেতর দিয়ে হাত ঢুকিয়ে মারলিনের পোশাকটা ধরে মারল টান। কিন্তু পোশাকটাতেও এসে গেছে শক্তি, বজায় রাখল নিজের অবস্থান। জেমস নরম মাটিতে পায়ের চাপ দিয়ে যত জোরে সম্ভব টান দিলো। পোশাকটা সিংহাসন ছেড়ে বেরিয়ে আসতে থাকলো বসে থাকা কঙ্কালটার ভেতর দিয়ে। আকৃতিটা সিংহাসনের হাতল আঁকড়ে ধরে চিৎকারের মাত্রা বাড়িয়ে দিল আর এক ধাপ। র‍্যালফ ছুটে গিয়ে চেপে ধরলো জাদুলাঠিটাকে, যেটা এই মুহূর্তে মাপে বেড়ে গেছে অনেকটাই। টেনে নিয়ে লাফিয়ে পিছিয়ে এলো, তুলে ধরলো মাথার ওপর।

মাদাম ডেলাক্রয়ের প্রতিরূপ অবশিষ্ট দেহাংশ নিয়ে চেষ্টা চালালো পোশাক আর লাঠিটাকে পুনরায় আগের জায়গায় ফিরিয়ে দেওয়ার। একমাত্র হাতটা র‍্যালফের দিকে তুলে নাড়িয়ে, চেপে ধরলো পোশাকটাকে। জ্যান নাচের ভঙ্গীতে পৌছে গেল প্রতিরুপের পেছনে, হাতের লাঠিটাকে উঁচিয়ে ধরে চালালো ভাঙাচোরা অবয়বটার কোমর লক্ষ্য করে। জেমস তাকালো সিংহাসনের দিকে। দেখতে পেলো, বিরাট মাপের কঙ্কালটা কাঁপছে থরথর করে, আবার পরিণত হচ্ছে কুয়াশায়। মারলিনের আ্যপারিশনের শব্দ এই মুহূর্তে শোনাচ্ছে কাতর চিৎকারের মতো।

এমন সময়, প্রায় শূন্য থেকেই যেন আবির্ভাব হল আর একটা অবয়বের। লুক্কায়িত দ্বীপের কক্ষটির পেছন দিকের অন্ধকার থেকে এগিয়ে এলো অভাবনীয় গতিতে। এটা সেই ড্রায়াডটা, যার হাতে ভয়ঙ্কর লম্বা নীল নখ। আরো কিছু একটা ওই অবয়বের সঙ্গে পাশে ছুটছে, মনে হচ্ছে ড্রায়াডটা আসলে যেন একটা আলাদা কাপড়। অর্ধেক রূপ নেওয়া চিৎকার করতে থাকা মারলিনের কণ্ঠ ছাপিয়ে শোনা গেল এক নতুন কণ্ঠস্বর।

“মাস্টার! প্রভু! না! আমি আর এই কাজ অসফল হতে দেবনা! আপনার সময় এসে গেছে অবশেষে!”

অবয়বটা যেভাবেই হোক একে ওপর থেকে আলাদা হয়ে গেল, ফেলে দিলো ড্রায়াডের রূপটাকে। পরিণত হল বিরাট মাপের দুটো কালো থাবায়। ধেয়ে এলো জেমস আর র‍্যালফের কাছে, কেড়ে নিলো পোশাক আর লাঠিটাকে। ছুড়ে ফেলে দিলো ওদেরকে পাথরের সিঁড়িতে। জাদুলাঠি আর পোশাকটাকে থাবা দুটো রেখে দিলো আগের জায়গায়,  তারপরই ধুলো হয়ে মিলিয়ে গেল ।

সিংহাসনে বসে থাকা কঙ্কাল কেঁপে উঠলো ভয়ানকভাবে, কুয়াসার ডাল আবার শুরু করলো ঘন হওয়া। এবার আকৃতি গঠনের গতি অনেক অনেক বেশী। হাড়ের কাঠামোর ওপর মাংসপেশী জমে উঠলো পরতের পর পরত। বুক আর পেটের অভ্যন্তরস্থ প্রত্যঙ্গ গঠিত হল নিমেষের মধ্যে। ছড়িয়ে গেল শিরা উপশিরার জাল। এক পাতলা কুয়াশার আবরণের মত প্রথমে চামড়ার মোড়ক দেখা দিলো। কয়েক পলকেই সেটা বদলে গেল মোটা চামড়ায়। হাতের আঙুলগুলো আঁকড়ে ধরলো জাদু লাঠিটাকে।  যেটা এখন লম্বায় ছফুট। মাথার দিকটায় একটা বড়সড় মোটা গুটলি। একটা হাল্কা সবুজ আলোর ঝলক লাঠিটার ওপর থেকে নিচে নেচে বেড়াচ্ছে। মারলিনের প্রত্যাবর্তনের সর্বশেষ টানা চিৎকারটি ধ্বনিত হটলো। সম্ভবত সব দম শেষ। উইজার্ডের মাথা পেছনের দিকে ঢলে পড়লো, গলার শিরা ফুলে উঠেছিল মোটা শিকড়ের মতো। বেশ খানিকটা সময় কেটে গেল এভাবেই ।   কয়েক হাজার বছর বাদে নিলেন প্রথম শ্বাস, ভরে নিলেন নিজের বিশাল মাপের ফুসফুসে অনেকটা হাওয়া, নিচু করলেন মাথা।

“প্রভু!” একটা ভূতুড়ে কন্ঠ শোনা গেল। জেমস তাকিয়ে দেখলো, যেখানে থাবা মিলিয়ে গিয়েছিল সেখানেই এক ক্ষুদ্র অবয়ব। একটা ছোট্ট মানুষ, প্রায় অদৃশ্য। হাঁফাচ্ছে, টাকমাথা চকচক করছে চাঁদের আলোয়। “আপনি ফিরে এসেছেন! আমার কাজ শেষ! আমি এখন মুক্ত!”

‘হ্যাঁ, আমি ফিরে এলাম,’ মারলিন বললেন সম্মতির সুরে। মুখাবয়ব পাথরের মতো, তাকিয়ে আছেন ভুতটার দিকে। ‘কিন্তু অ্যাস্ট্রামাড্ডুক্স, এ কোন সময়ে তুমি আমাকে ফিরিয়ে আনলে?’

“এ-এ পৃথিবী এখন তৈরী প্রভু! আপনারই জন্য।” ভুতটা থতমত হয়ে বললো। ‘আমি শতাব্দীর পর শতাব্দী অপেক্ষা করেছি! আমার দায়িত্ব…আমার দায়িত্ব আমি পালন করেছি আমার সাধ্যের বাইরে গিয়ে! আমি অপেক্ষা করেছি যতটা আমার পক্ষে সম্ভব। আমি খুব অল্পই সাহায্য করতে পেরেছি! প্রভু, আমি একজন মেয়েকে খুঁজে পেয়েছিলাম! যার হৃদয়ের  কোনো কথাই আমার কাছে গোপন থাকেনি! সে আমাদের লক্ষ্যকেই মেনে চলতো, তাই আমি … আমি তাকে উৎসাহ দিয়েছি! আমি সাহায্য করেছি, খুব সামান্য! অতি সামান্য!”

মারলিনের দৃষ্টি গিয়ে পড়েছে অ্যাস্ট্রামাড্ডুক্সের ওপর থেকে মাদাম ডেলাক্রয়ের প্রতিরুপের ওপর, যেটা এখন অনেকটাই নিজেকে ঠিকঠাক করে নিয়েছে। হাঁটু গেড়ে বসে , মুখ ভর্তি কাদা আছে এমন একটা ঘলঘলে কন্ঠস্বরে সেই প্রতিরুপ বললো, ‘মারলিনাস, আমি আপনার অনুগতা। আমি আপনাকে ফিরিয়ে এনেছি আপনার নিয়তির নির্দেশ পূর্ণ করার জন্য । আপনি আমাদের নেতৃত্ব দেবেন মাগল পোকাদের ধ্বংস করার জন্য। আমরা তৈরি আপনার জন্য। এ বিশ্ব প্রস্তুত আপনার কাজের জন্য।’

নিচুমাত্রায়  কিন্তু মেঘের গর্জনের মতো মারলিন বললেন, ‘নোংরা দিয়ে তৈরি এই পাপেট আমার সহচরী? আমি ওর যে রুপ সেই রুপে দেখতে চাই। যে রুপ সে দেখাতে চায় সে রুপে নয়।’

ডেলাক্রয় নিজেকে সোজা করলেন, কিছু বলতে গেলেন, কিন্তু কথা বের হলোনা। চোয়াল নড়ছিল যন্ত্রের মতো ।    সহসাই একটা ধরা গলার আওয়াজ বের হয়ে এলো উনার ভেতর থেকে। প্রতিরুপের হাতটা উঠলো ওপর দিকে, চেপে ধরলো নিজের গলাটা । ভেতরে ঢুকিয়ে দিলো লম্বা আঙুল যাতে সম্ভবত ভেতরের কাদা বার হয়ে আসতে পারে। কোলাব্যাঙের গ্যাঙ্গানির মতো শব্দ বের হয়ে এলো মূর্তিটার গলা দিয়ে। প্রতিরুপ সহসাই নুয়ে গেল কোমর থেকে, মনে হচ্ছিল কিছু একটা সমস্যা হচ্ছে। মারলিনের চোখ চকচক করে উঠলো প্রতিরুপের দিকে তাকিয়ে ।   জাদুলাঠিটায় ঊদ্ভাসিত হল হাল্কা সবুজ আলো। অবশেষে, এক ঝাঁকুনি দিয়ে প্রতিরূপটা খাড়া হলো। স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশী বিস্তৃত হলো তার মুখের হাঁ। কিছু একটা ছিটকে বেরিয়ে গেল মুখের ভেতর থেকে। পড়লো গিয়ে সামনে। প্রতিরুপের শরীরটা এবার কুঁচকে ছোট হয়ে যেতে থাকলো। যেন মনে হল প্রতিরুপের ভেতরের সব কিছুই বেরিয়ে গেল, নিজেকেই উগড়ে দিলো সে নিজের ভেতর থেকে। একসময় সবটাই মিলিয়ে গেল শুধু পড়ে থাকলো সামনের বিশ্রী কাঁপতে থাকা জমাটপিন্ডটা। ওটা মাদাম ডেলাক্রয় নিজে। নিজেরই পাপেট রুপ   সুরক্ষিত জায়গা থেকে উগড়ে বার করে আনলেন নিজেকে। মেঝেতে পড়েই থাকলেন সিলিং এর দিকে দৃষ্টিহীন চোখে তাকিয়ে  নিজের হাড় বার করা চেহারাটা  নিয়ে। বোঝাই যাচ্ছিলো বেশ কষ্ট হচ্ছে।

‘অ্যাস্ট্রামাড্ডুক্স, তুমি আমায় এক মৃত সময়ে ফিরিয়ে নিয়ে এসেছো,’ মারলিন বললেন। তার চাপা কণ্ঠস্বর কক্ষটিতে গমগম করে উঠলো। পড়ে থাকা মাদাম ডেলাক্রয়ের থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে ছেন ক্ষুদ্র ভুতটার দিকে। ‘গাছেরা আমার জন্য জেগে উঠেছে, কিন্তু তাদের বাকশক্তি নেই। এমন কি এই পৃথিবী শত শত বছরের নিদ্রায় আচ্ছন্ন। তুমি আমাকে ফিরিয়ে আনলে এমন এক সময়ে যেটা কেবলমাত্র তোমার পক্ষে ঠিক। তুমি আসলে  যে এক অপদার্থ পরিচারক, যাকে আমি নিজের শিষ্যত্ব দিয়েছিলাম । সেটা এখন ফিরে আসার পর বুঝতে পারছি। বুঝতে পারছি আমার ভুলের ব্যাপ্তি। আমি তোমায় আমাকে সাহায্য করার দায়িত্ব থেকে মুক্তি দিলাম। চলে যাও।’

মারলিন নিজের খালি হাতটা তুলে কর প্রসারণ করলেন অ্যাস্ট্রামাড্ডুক্সের দিকে। ভুতটা আরো ঝাপসা হয়ে গেল, কুঁচকে গেল, হাত দুটো ওঠালো যেন কোন তীর ওর দিকে ধেয়ে আসছে। “না! না! আমি তো অনুগতই থেকেছি! দয়া করুন! আমাকে তাড়িয়ে দেবেন না! আমিতো আমার দায়িত্ব পালন করেছি! আমি তো আনুগত্যই দেখিয়েছি! না আ আ আ!

শেষ শব্দটার উচ্চারণ বিলম্বিত হল, উঠলো উচ্চ মাত্রায়, সঙ্গে সঙ্গেই ভুতটা আরো ছোট হয়ে গেল কুঁচকে। একটু সময়ের জন্য নীল ড্রায়াডের রুপ নেওয়ার চেষ্টাও করলো, তারপর সব কিছুই মিলিয়ে গেল। জেমস দেখতে পেল ওটাকে নিজের প্রসারিত হাতের থাবার মধ্যে মধ্যে যেন টেনে নিলেন মারলিন। ভুতটার শেষ শব্দগুলো শুনতে লাগলো আতঙ্কের কান্নার মতো। একটা জোরালো আলোর ঝলকের ভেতর ঢুকে গেল ভুতটা। মারলিন থাবা গুটিয়ে নিলেন, তারপর আবার খুললেন আঙুলগুলোকে ঘুরিয়ে। ভুতটাকে দেখা গেল, আবার মিলিয়েও গেল, শোনা গেল শেষ চিৎকারের অনুরণন।

অবশেষে, এই প্রথম মারলিন তাকালেন জেমস, র‍্যালফ আর জ্যানের দিকে। জেমস সামনের দিকে এগিয়ে গেল, জানে না আসলে সে ঠিক কি করতে চলেছে, কিন্তু বুকের ভেতর থেকে কে যেন বলছিল  কি যেন একটা করতে হবে। মারলিন আবার হাত উঠালেন, এবার জেমসের দিকে। জেমসের মনে হল আশপাশ কেমন যেন নরম হয়ে গেল, অন্ধকার হয়ে আসছে সব। হাঁচড়পাঁচর করে  চিৎকার করার চেষ্টা করলো, কিন্তু লাভ কিছু হলো না । মারলিনের শক্তির সঙ্গে ওর লড়া প্রবল ঝড়ে একটা ধুলিকনার মতো। মাটি নরম হয়ে একটা ফানেলের আকৃতিতে নিচে নেমে গেল, সেখান থেকে মারলিনের হাত বেরিয়ে এসে জেমসকে টেনে নিলো। হাতের মাঝখানটায় একটা চোখ, বরফের চোখ, নীল রঙের। চোখটা বন্ধ, মারলিন একটা শব্দ উচ্চারন করলেন, একটা শব্দ যা ছড়িয়ে গেল আশেপাশের অন্ধকারে, আর সে শব্দ হল ‘ঘুমাও’।

 

 

[চলবে]

লেখক পরিচিতিঃ  জর্জ নরম্যান লিপার্ট আমেরিকান লেখক এবং কম্পিউটার অ্যানিমেটর। তবে ওনার বর্তমান পরিচয় উনি জেমস পটার সিরিজের লেখক। যে কারনে ওনাকে “আমেরিকান রাউলিং” নামেও ডাকা হয়ে থাকে। এই সিরিজের প্রথম লেখা “জেমস পটার অ্যান্ড দ্য হল অফ এল্ডারস ক্রসিং” প্রকাশিত হয় ২০০৭ সালে। নানান কারনে এটি অনেক বিতর্কে জড়িয়ে যায়। সেসব সমস্যা পেরিয়ে আজ এটি পাঠক পাঠিকাদের চাহিদায় সারা বিশ্বে যথেষ্ট জনপ্রিয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য এই সিরিজের সব কটি বই ই-বুক এবং ফ্রি হিসাবেই প্রকাশ করেছেন মাননীয় জর্জ নরম্যান লিপারট। এই সিরিজ ছাড়াও ওনার আরো ১২ টি বই আছে। বর্তমানে উনি এরি, পেনসিল্ভ্যানিয়ার বাসিন্দা।

অনুবাদকের পরিচিতিঃ উপন্যাসটির অনুবাদক প্রতিম দাস মূলত চিত্র শিল্পী, ২০১৩ সাল থেকে ভারতের সমস্ত পাখি আঁকার লক্ষ্য নিয়ে কাজ চলছেন। ৭৭৫+ প্রজাতির ছবি আঁকা সম্পূর্ণ হয়েছে। তবে শুধু পাখি নয় অন্যান্য বিষয়েও ছবি আঁকা চলে একইসঙ্গে। দারুণ রকমের পাঠক, যা পান তাই পড়েন ধরনের। প্রিয় বিষয় রূপকথা, ফ্যান্টাসী, সায়েন্স ফিকশন, অলৌকিক। টুকটাক গল্প লেখার সঙ্গে আছে অনুবাদের শখ। 

Tags: অনুবাদ উপন্যাস, জর্জ নরম্যান লিপারট, জেমস পটার অ্যান্ড দ্য হল অফ এল্ডারস ক্রসিং, জেমস পটার এ্যান্ড দ্য হল অফ এল্ডারস ক্রসিং, ধারাবাহিক উপন্যাস, প্রতিম দাস, সুদীপ দেব

Leave a Reply

Connect with

Your email address will not be published.

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

error: Content is protected !!
Verified by MonsterInsights