Friday, December 27, 2024
অনুবাদ উপন্যাসধারাবাহিক উপন্যাস

জেমস পটার অ্যান্ড দ্য হল অফ এল্ডারস ক্রসিং – পার্ট ১৯

লেখক: জি নরম্যান লিপার্ট, ভাষান্তরঃ প্রতিম দাস

শিল্পী: মূল প্রচ্ছদ, সুদীপ দেব

ঊনবিংশ অধ্যায়

রহস্যের উন্মোচন

রের দিন অনেকটা বেলা হয়ে যাওয়ার পর হ্যারি ব্রেকফাস্ট করার জন্য গ্রেট হলের নিচে হাউস এলফদের রান্নাঘরে এলেন। সঙ্গে জেমস, জ্যান আর র‍্যালফ। জেমস দেখতে পেল বিরাট আকারের স্টোভটাকে নিয়ন্ত্রণ করছে সেই গোমড়ামুখো এলফটা যে আগেরবার বলেছিল জেমসদের দিকে  ওদের নজরে থাকবে। এলফটা ওদের দিকে তাকাল কিন্তু কিছু বলল না।  একটা ছোট্ট জানলার নিচে থাকা অতি ছোটো টেবিলে বসল ওরা। পামকিন জ্যুস, টোস্ট এবং লাল চা খেতে খেতেই  হ্যারি ওদের কে পোশাক পালটে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হয়ে নিতে বললেন, কারণ ওরা তিনজনে এখনও সেই ঝাড়ু চুরি করার সময়ের পোশাকই পড়ে আছে। জেমসও সেটাই চাইছিল। ও ঠিক করেই রেখেছে, অন্তত মিনিট দশেক বিছানায় শুয়ে নেবে আগে। তাতে ক্লাসে যেতে দেরী হোক ক্ষতি নেই।

কমনরুমের দিকে যাওয়ার পথে জেমস আগে একবার হাসপাতাল বিভাগে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল।  ব্যাকপ্যাকটা নিয়ে আসতে হবে। ফিলিয়া গয়েল বা মারডক কেউই আর পাহারায় ছিল না। কিন্তু জেমস অবাক হয়ে দেখল ওখানে হ্যাগ্রীড বসে আছে। একটা মোটা ম্যাগাজিনের পাতা উল্টাচ্ছে। নাম ‘বীস্ট অ্যান্ড বুন্ডক্স’। ম্যাগাজিনটা বন্ধ করে তাকালো জেমসের দিকে।

‘আরে জেমস, তোমাকে দেখে ভালো লাগল,’ বেশ আন্তরিকতার সঙ্গে যতটা সম্ভব গলা নিচু করে বললেন হ্যাগ্রিড। ‘শুনতে পেলাম তুমি সুস্থই ফিরে এসেছ। তোমার বাবাকেও দেখলাম মনে হলো!’

‘হ্যাঁ, একটু আগেই আমার সঙ্গে ছিলেন।,’ জেমস উত্তর দিলো, হাসপাতাল বিভাগের দরজাটার ফাঁক দিয়ে ভেতর দিয়ে তাকিয়ে। ‘তুমি এখানে কি করছো হ্যাগ্রিড?’

‘আরে এরকমটা তো হওয়ার কথা তাই না? আমি নজর রেখে চলেছি। হেডমিস্ট্রেস অনুমতি না দিলে কেউ ঢুকতে বা বের হতে পারবে না। ওনার বিশ্রাম প্রয়োজন। বাপরে! যা সহ্য করতে হয়েছে ওকে। ’

‘কাকে?’ জেমস অতিরিক্ত কৌতূহলের সঙ্গে জানতে চাইল এবং আবার উঁকি মারলো দুই দরজার ফাঁকটা দিয়ে। একটা বিছানায় কেউ একজন শুয়ে আছেন।  জেমস চিনতে পারল না কে ওটা।

‘কেন প্রফেসর জ্যাক্সন!’ হ্যাগ্রীড উত্তর দিলেন, জেমসের পাশে দাঁড়িয়ে। জেমসের মতোই উঁকি মারলো দরজার ফাঁক দিয়ে বড় কালো চোখ দিয়ে। ‘তুমি কিছু শোনো নি? আধঘণ্টা আগে ওকে দেখতে পাওয়া গেছে স্কুল চত্বরে, যথেষ্ট বিধ্বস্ত দেখাচ্ছিল  ওনাকে।’ তারপর ফিসফিস করে বললেন,  ‘ওকে দেখতে পেয়ে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে একটা চিন্তাজনক কৌতূহলের ঢেউ উঠেছিল। আমরা সরাসরি ওনাকে এখানে নিয়ে আসি। আমাকে দায়িত্ব দেওয়া হয় এই দরজায় পাহারা দেওয়ার। মাদাম কিউরিও ওনার দেখাশোনা করছেন।’

জেমস হ্যাগ্রীডের দিকে তাকাল। ‘উনি কি দারুণভাবে আহত?’

‘আমরা প্রথমে সেটাই ভেবেছিলাম,’ হ্যাগ্রীড একটু পিছিয়ে গিয়ে বললেন। ‘কিন্তু মাদাম কিউরিও জানিয়েছেন খুব একটা চিন্তার দরকার নেই। কয়েকটা পাঁজরার হাড় ভেঙে গেছে। হাতের কয়েক জায়গা পুড়ে গেছে আর মাথায় একটা বিশ্রী ক্ষত হয়েছে। সঙ্গেই সারা গায়ে শত শত কাটা ছেঁড়ার দাগ। যতদূর বুঝেছি উনি একটা দীর্ঘসময় ব্যাপী দ্বৈত যুদ্ধে ব্যস্ত ছিলেন। জঙ্গলের মধ্যে রাতেই ওটা ঘটেছে। অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার আগে এইটুকুই ওনার কাছ থেকে জানতে পেরেছি।’

‘একটা দ্বৈতযুদ্ধ?’ জেমস ভ্রু কুঁচকে বলল। ‘কিন্তু ডেলাক্রয় তো ওনার জাদুদন্ড ভেঙে দিয়েছিলেন!’

‘তাই নাকি?’ হ্যাগ্রিড বললেন। ‘তা এরকম কাজ মাদাম করলেন কেন শুনি?’

‘হ্যাগ্রিড, মাদাম হলেন সেই জন যার সঙ্গে উনি দ্বৈতযুদ্ধ লড়ছিলেন,’ জেমস বলল বোঝানোর ভঙ্গীতে। ‘ইনি এবং মাদাম … বুঝলে, ছাড়ো আমি তোমায় পরে বোঝাব। আমি দেখেছি  ওনার জাদুদন্ডটা মাদামকে দুটুকরো করে দিতে। আমি টুকরোগুলোও দেখেছি এখানে ফিরে আসার আগে। উনি ওগুলো ওখানেই ফেলে এসেছিলেন।’

‘তাইইই বুউউউ …,’ হ্যাগ্রিড বললেন, আবার বসে পড়লেন আগের আসনেই। একটা জোরাল ক্যাঁচ করে শব্দ হলো। ‘উনি একজন আমেরিকান, জানো বোধহয়। ওরা একের অধিক জাদুদন্ড সঙ্গে নিয়ে ঘুরে বেড়াতে পছন্দ করেন। এসব পুরোনোদিনের ওয়াইল্ড ওয়েস্ট উপকথা থেকে জেনেছি। ওরা ওগুলোকে আটকে রাখেন বিভিন্ন জায়গায়। জামার হাতার ভেতর, দুপায়ের বুটের পাশে আবার কখনো নিজেদের লাঠির ভেতরে। সবাইতো এগুলো জানে। কি মনে হয়, আমি ভুল বলছি?’

জেমস আবার দরজার ফাঁক দিয়ে উঁকি মারলো, কিন্তু শুয়ে থাকা অবয়বটা দেখে কিছুই অনুমান করতে পারলোনা। ‘সরি প্রফেসর,’ আস্তে করে বলল। ‘তবে আমি আশা করছি আপনি ভুডু কুইনকে মুখের মতো জবাব দিয়েছেন।’

‘জেমস কিছু দরকার আছে নাকি?’ হ্যাগ্রিড জানতে চাইলেন জেমসের দিকে তাকিয়ে।

‘আমি ব্যাকপ্যাকটা নিতে এসেছিলাম,’ জেমস দ্রুত জবাব দিলো। ‘গতকাল রাতে ওটা এখানে ফেলে গিয়েছি।’

‘কিন্তু তোমাকে তো ওটা নিতে হলে পরে আসতে হবে, পারবে না?’ হ্যাগ্রিড আন্তরিকতার সুরে জানতে চাইলেন। ‘আমি শুধুমাত্র আমার দায়িত্ব পালন করছি। কেউ ঢুকতে পারবেনা, আবার কেউ বেড়াতেও পারবে না। হেডমিস্ট্রেস মনে করছেন যে ওনার ওপর আক্রমণ করেছিল সে কিছু করার জন্য আবার ফিরে আসতে পারে। ভুলে গেলে চলবে না ওই পাগলটার কথা যে নিজেকে মারলিন মনে করছিল।’

‘হ্যাগ্রিড আক্রমণ যে করেছিল তার নাম মাদাম ডেলাক্রয়। যাই হোক। আমি পরেই আসব। খুব ভালো কাজ করেছ তুমি।’

হ্যাগ্রিড মাথা নেড়ে কলের ওপর রাখা ম্যাগাজিনে মন দিলো। জেমস ফিরে চললো যেদিক দিয়ে এসেছিল সেদিকে।

গ্রিফিন্ডোর কমনরুম ফাঁকা পড়েছিল। ফায়ার প্লেসের আগুন ধিকি ধিকি জ্বলছে, তার থেকেই যে তাপ বের হচ্ছে সেটা এই মুহূর্তে আর দরকার নেই। জেমস শয়নকক্ষের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে এক ঝলক ঠান্ডা হাওয়ার পরশ পেল।  ওপরে কেউ নিশ্চিত জানলা খুলে রেখেছে। জানলাটা খুলে রাখবে নাকি বন্ধ করে দেবে এটা ভাবতে ভাবতে ওপরে পৌছে দেখতে পেলো মারলিন ওর বিছানায় আয়েস করে বসে আছেন।’

জেমসের টেকনোম্যান্সির বইটা হাত থেকে নামিয়ে জেমসের দিকে তকিয়ে বললেন, ‘এই যে আমার ছোট্ট পরামর্শদাতা এসে গেলেন অবশেষে।’

জেমস একবার খোলা জানলাটা আর একবার মারলিনের দিকে তাকালো। ‘আপনি,’ ওর মনের মধ্যে উত্তেজনা। ‘আপনি কি …’ জানলাটা দেখালো।

‘আমি  ওখান দিয়ে উড়ে এসেছি নাকি জানতে চাইছ?’ মারলিন বইটাকে একপাশে ‘আমার কি পাখা আছে নাকি? কি মনে কর তুমি নিজেকে জেমস পটার?’

জেমস মুখের হাঁ বন্ধ করল, বুঝতে পারল এটা এক ধরনের পরীক্ষা। নিজের প্রাথমিক ভাবনাকে দূরে সরিয়ে রেখে চারদিকে তাকাল।

‘না,’ উত্তর দিল। ‘না, আসলে আমি ভেবেছিলাম আপনি ওই জানলাটা খুলেছেন। আপনি তো বাতাস ভালবাসেন।’

‘হ্যাঁ, আমি বাতাসের গন্ধ পছন্দ করি, বিশেষ করে বছরের এই সময়টার,’ মহান জাদুকর উত্তর দিলেন, খোলা জানলার দিকে তাকিয়ে। ‘ধরিত্রী থেকে ভেসে আসে জীবন আর পরিস্ফুটনের গন্ধ, ভরিয়ে দেয় আকাশকে। এমন কি যারা জাদু জগতের অংশ নয় তারাও এটা অনুভব করে। ওরা এই বসন্তের সময় বলে বাতাসে ভালবাসা ভেসে বেড়াচ্ছে। এটা সত্যের অনেকটাই কাছাকাছি কিন্তু বাস্তবের নয়, কারন এ ভালোবাসা নারী পুরুষের মধ্যের নয়। এ ভালোবাসা  মাটির জন্য শিকড়ের আর সূর্যের আলোর জন্য পাতার। সঙ্গে সঙ্গেই বাতাসের সঙ্গে ডানার ভালবাসা।’

জেমস সতর্ক ভাবে বলল, ‘কিন্তু আপনিতো চাইছিলেন যে, আমি বিশ্বাস করি আপনি ওই জানলা দিয়ে এসেছেন।’

মারলিন হাসলেন এবং জেমস কে ভালো করে দেখলেন। ‘দশ ভাগের মধ্যে নয় ভাগ জাদু সংঘটিত হয় মনের মধ্যে জেমস পটার। জাদুর সবচেয়ে বড় কৌশল হলো এটা বুঝতে পারা দর্শক কি দেখতে চাইছে, আর সেটাকে নিশ্চিত করা।’

জেমস অন্য বিছানাটার দিকে এগিয়ে গেল এবং বসলো। ‘এসব কথা বলার জন্যই কি আপনি এসেছেন? নাকি আমার বলা কথাগুলো জানতে পেরে এখানে এসেছেন?;’

জাদুকর উত্তর দিলেন, ‘তুমি আমাকে শেষ দেখার পর থেকে অনেক কাজ আমায় করতে হয়েছে। এখানে ওখানে যেতে হয়েছে। অনেক অনেক পুরোনো বন্ধুদের সঙ্গে কথা বললাম। নিজেকে পুনরায় সংযুক্ত করলাম পৃথিবীর সঙ্গে, জন্তু জানোয়ারের সঙ্গে এবং বাতাসের সঙ্গে। অরণ্যে থাকা সমস্ত রকম অদ্ভুত বস্তু আদির সঙ্গে পরিচিত হলাম। এই সময়ের সম্বন্ধ… বর্তমান জগতটার সম্বন্ধে শিখলাম অনেক কিছু। আমি তোমাকে অনুভব করলাম। অনুভব করলাম তোমাদের সঙ্গে থাকা মানুষদের।’

জেমস একটু হাসলো, কিছু একটা বুঝে। ‘আপনি আমাদের ছেড়ে আসলে কোথাও যাননি! আপনি টাওয়ারের ওই ওপরে অদৃশ্য হয়ে আমাদের বোঝাতে চেয়েছিলেন পাখিদের সঙ্গে উড়ে চলে গেলেন। আসলে আপনি কোথাও যাননি।  ঠিক বলছি না? আপনি শুধু নিজেকে অদৃশ্য করেছিলেন!’

কন্ঠস্বর নামিয়ে মুখের একটাও মাংসপেশি না নড়িয়ে মারলিন বললেন, ‘জেমস পটার! তোমার তো দেখছি একটা দারুণ ক্ষমতা আছে।  সাধারন আয়নাতে অনেক কিছু দেখার। তবে এটা স্বীকার করছি যে আমি তোমাদের সব কথা শুনেছি। প্রফেসর ফ্র্যাঙ্কলিন এবং লংবটম, মাদাম পেনড্রাগন এবং তোমার বাবা যা বলেছেন আমার বিষয়ে সব শুনেছি। আমি একইসঙ্গে অবাক হয়েছি আবার রেগেও গেছি যে। ওরা আমার ব্যাপারে কত কি ভাবছেন এটা জানতে পেরে। তবে এখন আমি আর ঔদ্ধত্যের দাস নই। আমি নিজেকে প্রশ্ন করেছি, আচ্ছা ওরা যেটা ভাবছেন সেটাই যদি আমার ব্যাপারে সত্যি হয়  তাহলে? তারপর ওখান থেকে চলে গিয়েছি আমার পুরানো জায়গায়। ঘুরে ঘুরে বেরিয়েছি এখানে সেখানে, হেথায় হোথায়। আমি নিজের অন্তরাত্মাকে যাচাই করে দেখেছি, যেটা ফ্র্যাঙ্কলিন মনে করেছেন আমার করা উচিত। আর বুঝতে পেরেছি, খুঁজে পেয়েছি ওদের ভাবা সত্যের একটা ছায়াকে। একটা ছায়া …’

মারলিন অনেকক্ষণ চুপ করে থাকলেন। জেমস কিছু না বলার সিদ্ধান্ত নিয়ে চুপ করে থাকলো, তাকিয়ে থাকলো উইজার্ডের দিকে। মারলিনের মুখাবয়ব অনড়, কিন্তু চোখ নড়ছে। প্রায় দু মিনিট পর মারলিন আবার কথা বললেন।

‘কিন্তু একটা ছায়া যথেষ্ট নয় যা আমাকে ফিরিয়ে আনতে পারে দুমুখো কথাবার্তা আর সিদ্ধান্তহীনতায় ভরা এক যুদ্ধক্ষেত্রের সম্ভাবনাময় এক অন্ধকার সময়ে। আমি এসব থেকে অনেক দূরে, খুঁজে বেড়াচ্ছি, হাতড়ে বেড়াচ্ছি একটা স্থান, একটা সময়, একটা বিরক্তির অবকাশবিহীন পৃথিবীকে। নিমজ্জ হয়েছি হাওয়া আর বৃষ্টির গভীরতম ভাষার জগতে। যেখানে গাছেদের পক্ষ থেকে শোনা যাচ্ছে নতুন গান। সেই সময়ে পেলাম তোমার বার্তা, জেমস পটার, যা তুমি বলেছ আমার উদ্দেশ্যে।’

জেমস অবাক হলো এটা লক্ষ্য করে যে এবার ওই বিশাল মানুষটার কন্ঠস্বরে ছাপ পড়েছে  অনুভুতির। জেমসের দিকে উনি তাকিয়ে আছেন ভিজে ভিজে চোখে। জেমসের নিজের কেমন যেন খারপ লাগছিলো মানুষটার রাগের কথা ভেবে। এমন কি ওর নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছিলো নিজের বলা কথাগুলোর জন্য, যে কথা সরাসরি গিয়ে আঘাত হেনেছে ওই বিরাট মাপের মানুষটার হৃদয়ে। এর পরেই রাগহীন পাথরের মতো মুখটা নিজেকে সংহত করলো। যেটা মোটেই অনুভুতির আস্তরণ চাপানো নয় জেমস বুঝতে পারলো।  ও সাক্ষী হয়ে থাকলো একজন মানুষের ওপর অনুভুতির প্রভাব কিভাবে পড়ে সেটা দেখার। একজন মানুষ যার শিক্ষা সংস্কৃতি তার কাছে একেবারে অজানা। এমন একজন মানুষ যার হৃদয় এতটাই পৃথিবীর সঙ্গে সম্পৃক্ত যে অনুভূতির চাদর লজ্জাহীনভাবে  তার মুখকে আচ্ছন্ন করতে সম্পূর্ণ ভাবে সক্ষম। ঠিক যেমনভাবে একটা মেঘ সূর্যকে ঢেকে দিতে পারে, কিছু সময়ের জন্য হলেও।

‘তাই, জেমস পটার…,’ জাদুকর বললেন, আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়িয়ে, মনে হল গোটা ঘর ভরে গেল ওনার উপস্থিতিতে। ‘…আমি ফিরে এলাম। আমি এখানে উপস্থিত তোমার কথা শোনার জন্য। আমার আত্মার আমার হৃদয়ের এটা সত্যি দরকার। আজ সারাদিনের ভ্রমণে আমি অনেক কিছু শিখেছি, যার খুব অল্পই আমার পছন্দ হয়েছে। তবে বুঝতে পেরেছি এই সময়ের এক শয়তানের উপস্থিতির কথা। যে মুখোশ পড়ে আছে দ্বৈতাচার এবং সম্ভ্রান্ত আচার আচরণের। সম্ভবত সেই শয়তানকে হারানোটা  তত মুখ্য ব্যাপার নয় যতটা মুখ্য ওই শয়তানকে তার আসন থেকে নামিয়ে আসল রূপটা মানুষকে দেখানো। ’

জেমস একগাল হেসে লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালো। বুঝতে পারছিলো না মারলিনের সঙ্গে হ্যান্ডশেক করবে নাকি আলিঙ্গন করবে  নাকি নত হয়ে সম্মান দেখাবে। ওসবের কোনোটাই না করে মুষ্ঠি বদ্ধ হাত শূন্যে ছুঁড়ে দিয়ে বলল, ‘ইয়েস! ইয়ে থ্যাঙ্ক ইউ, মারলিন। ইয়ে মারলিনাস। মিঃ অ্যাম্ব্রোশিয়াস?’

উইজার্ডটি হাসলেন, ওঁর নীল চোখ চকচক করে উঠলো।

‘তাহলে,’ জেমস বলল, ‘আমরা এখন কি করবো? মানে বলতে চাইছি যে আমাদের হাতে আর মাত্র কয়েক ঘণ্টা আছে, তারপরেই প্রেস্কট আর তার দলবল এই স্কুলের সব কিছু ফিল্ম করে নেবে। আমার মনে হয় আমার সব কিছু আপনাকে খুলে বলা দরকার। কিন্তু সমস্যা  হলো তাতে অনেকটা সময় লেগে যাবে।’

‘জেমস পটার ভুলে যেওনা আমি মারলিন,’ উইজার্ড বললেন দীর্ঘশ্বাস ফেলে। ‘আমি এর মধ্যেই এই জগত সম্বন্ধে যা যা জানার তা সবই জেনে নিয়েছি। তুমি হয়তো অবাক হয়ে যাবে, আমার মনে হয়, আশেপাশের গাছেরা তোমাদের আদব কায়দা কালচার সম্বন্ধে অনেক কিছু জানে। মিঃ প্রেস্কট মোটেই কোনো সমস্যা নয়। আমাদের এখন দরকার একটা সংগঠন বা কিছু লোক। যারা আমাদের  সাহায্য করবে।’

জেমস পুনরায় বিছানায় বসে বলল, ‘বেশ। বলুন , কি ধরনের সংগঠন বা লোকজন আমাদের দরকার?’

মারলিনের চোখ কুঞ্চিত হলো। ‘আমাদের দরকার এমন কিছু মানুষ যাদের একইসঙ্গে উপস্থিত বুদ্ধি  আছে। বড় ধরনের কোন শক্তির মোকাবিলা করার জন্য যে কোন রকম হুজ্জুতি পাকাতে পারে। যুদ্ধ করার ক্ষমতা থাকাটা খুব একটা জরুরী নয়। বুঝলে জেমস পটার, এই মুহূর্তে আমাদের দরকার  দুষ্টুমি করতে পারে এমন কিছু সম্মানিত ব্যাক্তিদের।’

জেমস মাথা ঝুঁকিয়ে জানালো, ‘আমার মনে হচ্ছে এরকম একটা গ্রুপকে আমি জানি। সম্মানিত দুষ্টুর দল পেয়ে গেছি।’

‘তাহলে তাদের আমাদের এই মুহূর্তে দরকার, হে ছোট্ট পরামর্শদাতা,’ মারলিন বললেন দুষ্টুমি মাখা হাসিসহ। ‘চলো যাওয়া যাক।’

মারলিনের সঙ্গে পোরট্রেটের গর্ত দিয়ে বার হওয়ার সময় জেমস বলল, ‘তাহলে, আপনি কি মনে করেন আমরা জিততে পারবো?’

‘মিঃ পটার,’ মারলিন নিচে নেমে এসে  কোমরে দুহাত রেখে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘তুমি সেই মুহূর্তেই জিতে গিয়েছ যখন আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি তোমার দলে যোগ দেওয়ার।’

জেমস কিছুটা সাহসের সঙ্গেই বলল, ‘এটা কি বিখ্যাত মারলিন গর্বের ঘোষনা?’

‘যেমনটা আমি আগেই বলেছি,’ মারলিন উত্তর দিলেন জেমসকে অনুসরণ করে এগিয়ে যেতে যেতে, ‘দশ ভাগের নয় ভাগ ম্যাজিক সম্পন্ন হয় মনে। আর শেষ দশমাংশ, মিঃ পটার, পুরোটা একেবারে খাঁটি ব্যাপার এবং খাদহীন চমক। এটা মাথায় গেঁথে বসিয়ে নাও তাহলেই। তুমি যা করবে সেটা খুব ভালভাবে সম্পন্ন হবে।’

 

 

**********

 

 

সকালের কুয়াশা কেটে যাওয়ার পর  ঝকঝকে দিন গড়িয়ে চললো এক অদ্ভুত রকমের গরম আবহাওয়ার সঙ্গে। হেডমিস্ট্রেস যদিও ঘোষণা করেছিলেন মারটিন জে প্রেস্কট এবং তার দলবল আসার কারনে ক্লাস বন্ধ হবেনা কিন্তু দেখা গেল বেশ কিছু শিক্ষার্থী চত্বরে জটলা পাকিয়েছে মাগল সাংবাদিকের দলকে দেখার জন্য। সেই জটলার একেবারে সামনে জেমস আর হ্যারি পাশাপাশি দাঁড়িয়েছিল। কিছুটা দূরেই টাবিথা করসিকা এবং ওর স্লিদারিন সহযোগীরাও আগ্রহী চোখে তাকিয়ে আছে। স্কুলে ঢোকার প্রধান দরজার আগের সিঁড়ির একেবারে ওপরের ধাপে দাঁড়িয়ে আছেন ম্যাকগনাগল সঙ্গেই মিস সাকারিনা এবং মিঃ রিক্রিয়ান্ট। একেবারে নিচের ধাপে দাঁড়িয়ে বার বার ঘড়ি দেখছেন মারটিন প্রেস্কট।

‘মিস সাকারিনা আপনি নিশ্চিত তো ওরা ওদের গাড়ি নিয়ে এখানে ঠিকঠাক পথে আসতে সক্ষম হবে?’ সূর্যের আলোতে চোখ কুঁচকে ওপরের দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলো প্রেস্কট। ‘ওরা যাতে আসছে সেগুলো চাকার সাহায্যে চলে, যেমনটা আমি জানিয়েছি। চাকা। সেগুলোতে কোনো জাদু নেই, কোন রকম দৈত্য দানব ওগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করে না কিন্তু?’

সাকারিনা উত্তর দিতে যাচ্ছিলেন তার আগেই যন্ত্রচালিত গাড়ির শব্দ কানে এলো। প্রেস্কট লাফিয়ে উঠে ফিরে তাকালে, উদ্গ্রীব হয়ে উঠলেন দলীয় সদস্যদের দেখার জন্য। জেমস, ড্যাডের সঙ্গে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে ভাবছিল হেডমিস্ট্রেস নিজেকে ভালভাবেই সামলাচ্ছেন, পরিস্থিতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে। বিরাট গাড়িগুলো চত্বরে ঢুকতেই ঠোঁটে ঠোঁট চেপে ধরলেন ম্যাকগনাগল। জেমস দুটোকে চিনতে পারলো, জ্যান বলেছিল এগুলোকে বলে ল্যান্ডরোভার। প্রথম গাড়িটা একেবারে সিঁড়ির ধাপের সামনে এসে থামলো। খুলে গেল চারটে দরজা, ভেতর থেকে বাইরে আসা মানুষগুলোর  চোখ কুঁচকে গেলো সূর্যের আলোয়। ওদের হাতে অনেকগুলো করে পকেটওয়ালা বড় বড় চামড়ার ব্যাগ। প্রেস্কট এগিয়ে গেলেন ওদের দিকে, নাম ধরে ডেকে বুঝিয়ে দিতে থাকলেন কাকে কি করতে হবে।

‘সিঁড়ির ডানদিক থেকে দরজার দিকে কোনাকুনিভাবে আমি লাইট আর রিফ্লেক্টর চাই। ওখানেই আমি সর্বশেষ বক্তব্যটা রাখবো এবং ইন্টারভিউগুলো নেবো। এডি চেয়ার আছে? নেই ? ঠিক আছে, অসুবিধা নেই। আমরা দাঁড়িয়েই কাজ চালাবো।। যদিও বসে কাজ করলে, বুঝতেই পারছ একটা আলাদা ওজন এনে দেয়। আমরা সব সময়ে এই চিত্রগ্রহণটাকে “লাইভ” ঘটছে এরকমভাবে দেখাতে চাই। ভিন্স তুমি কোন ক্যামেরায় থাকছো? আমি থারটিফাইভ মিলিমিটার হ্যান্ডি ক্যামে সবটা রেকর্ড করতে চাই। দুটো ফিল্মে পুরোটা রেকর্ড হবে বুঝতে পারলেতো? আমারা পুরো ফুটেজটাকে এডিট করবো এমনভাবে যে মনে হবে লুকানো ক্যামেরায় সব তোলা হচ্ছে। পারফেক্ট যাকে বলে। গ্রেটা কোথায়, মেকআপ হবেতো নাকি?’

সিঁড়ির ধাপে দাঁড়িয়ে থাকা ছাত্রছাত্রী , হেডমিস্ট্রেস বা মন্ত্রক অফিশিয়ালদের পাত্তাই দিচ্ছিল না দলটি। চারদিকে একদল  নিজ নিজ কাজে দক্ষ মানুষ ব্যস্ত হয়ে পড়লো ক্যামেরা, লাইট, সাউন্ড সিস্টেম ইত্যাদি সাজানোর কাজে। প্রেস্কটের মতো কলারে লাগানো মিনি মাইক্রোফোনে শুধু শোনা যাচ্ছিলো “টেস্ট” এবং “চেক” শব্দ। জেমস দেখল কিছু লোক এমনও ঘুরে বেড়াচ্ছে যারা এই টেকনিক্যাল ব্যাপারে যুক্ত নয়। ওদের পোশাক এদের তুলনায় উন্নত ধরনের এবং তাদের কৌতূহল চারপাশ এবং দুর্গের প্রতি। ওদের মধ্যে একজন টাকমাথা, পরনে গ্রে স্যূট, সৌম্যকান্তি বয়স্ক মানুষ সিঁড়ি দিয়ে উঠে এগিয়ে গেলেন হেডমিস্ট্রেসের দিকে।

‘খুবই ঝামেলা তাই না?’ পেছনদিকের গাড়িগুলোকে দেখে বললেন। তারপর হেডমিস্ট্রেসের দিকে তাকিয়ে একটু মাথা ঝোঁকালেন। ‘আমি, র‍্যান্ডলফ ফিনি, ডিটেক্টিভ, ব্রিটিশ পুলিস। এখনো রিটায়ার করিনি, তবে সে দিন এগিয়ে আসছে। মিঃ প্রেস্কট হয়তো আমার কথা বলেছেন? উনি আমাকে এখানে উপস্থিত করে পুরো ব্যাপারটাকে একটা গুরুত্বপূর্ণ চেহারা দিতে চেয়েছেন, এরকমই মনে হচ্ছে। আপনার আর আমার মধ্যে… উনি মনে করেছেন, আমরা একে ওপরের সঙ্গে কথা বলতে পছন্দ করবো… আশা করি বুঝতে পারছেন আমি কি বলতে চাইছি। তাহলে, এটা হল এক ধরনের  যাকে বলে… স্কুল, ঠিক বলছি কি?’

‘একদম ঠিক, মিঃ ফিনি,’ সাকারিনা বললেন হাত বাড়িয়ে দিয়ে। ‘আমার নাম ব্রেন্ডা সাকারিনা, মিনিস্ট্রি অফ ম্যাজিকের ডিপারটমেন্ট অফ অ্যাম্বাসাডোরিয়াল রিলেশন বিভাগের প্রধান। আমার মনে হচ্ছে আজকের দিনটা আপনার কাছে খুবই আকর্ষণীয় একটা দিন হবে।’

‘মিনিস্ট্রি অফ ম্যাজিক। বাহ কথাটা তো বেশ,’ ফিনি বললেন সাকারিনার সঙ্গে আলতোভাবে করমর্দন করে। দৃষ্টি নিবদ্ধ হেডমিস্ট্রেসের ওপর। ‘আর আপনি কে মাদাম?’

‘ইনি হলেন –,’ সাকারিনা উত্তর দিতে যাচ্ছিলেন, অযাচিত এধরনের পরিস্থিতির সামলানোর বিষয়ে দক্ষ ম্যাকগনাগল সহজেই গলা চড়িয়ে জবাবটা দিলেন।

‘মিনারভা ম্যাকগনাগল, মিঃ ফিনি। আপনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে খুশি হলাম। আমি এই স্কুলের হেডমিস্ট্রেস।’

‘আরে বাহ! বাহ!, ফিনি বললেন, ম্যাকগনাগলের হাত আন্তরিকতার সঙ্গে হাতে নিয়ে পুনরায় সামান্য আনত হলেন। ‘হেডমিস্ট্রেস ম্যাকগনাগল, আমি অত্যন্ত খুশি হলাম আপনার সঙ্গে দেখা করতে পেরে।’

‘প্লিজ, মিনারভা বলে সম্বোধন করলে খুশি হবো,’ ম্যাকগনাগল বললেন। জেমস দেখতে পেল একটা বেদনার ছায়া ভেসে গেল মিনারভা ম্যাডামের মুখের ওপর দিয়ে।

‘ঠিক আছে, তাই হবে। তবে আপনিও আমায় র‍্যান্ডলফ বলেই ডাকুন এটাই চাইবো।’ এরপরের কয়েক সেকেন্ড ফিনি হাসলেন হেড মিস্ট্রেসের দিকে চেয়ে, তারপর গলা ঝেড়ে চশমাটা মুছলেন। স্কুল চত্বর এবং দুর্গটা একবার ভালো করে দেখে নিয়ে বলেন, ‘আমি জানতামই না এই জায়গাটায় একটা স্কুল আছে, সত্যি বলছি। আর সেটা এতোটাই সুন্দর হবে তাও ভাবতে পারিনি। কেন এটা  একটা ঐতিহাসিক স্মৃতিচিহ্ন রুপে নথিভুক্ত নেই তাই ভাবছি। মিনারভা, আপনারা এটাকে কি নামে ডাকেন?’

সাকারিনা উত্তর দিতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু কোন শব্দ বের হলনা। একটা ছোট্ট শব্দ হল, একটু কাশি তারপর দ্রুত নিজের মুখটা এক হাত দিয়ে ঢাকলেন, বিস্ময়ের ছাপ ওঁর মুখে।

‘মৃদু হেসে ম্যাকগনাগল উত্তর দিলেন, ‘হগওয়ারটস, র‍্যান্ডলফ। হগওয়ারটস স্কুল অফ উইচক্র্যাফট অ্যান্ড উইজারড্রি।’

‘কি বললেন?’ ফিনি ওনার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘কি অদ্ভুত রকমের গোলমেলে ব্যাপার।’

‘আমরাও সেটাই মনে করছি।’

‘ডিটেক্টিভ ফিনি!’ সহসা প্রেস্কট উঠে এসে ডাকলেন, মুখে প্যান কেক মেকআপ মাখানো আর  কলারের ওপর টিস্যু পেপার  রাখা। ‘আরে আপনি দেখছি হেড মিস্ট্রেসের সঙ্গে পরিচয় সেরে ফেলেছেন। তবে জেনে রাখা ভালো,  মিস সাকারিনা আর মিঃ রিক্রিয়ান্টই আসলে  আমাদের সফরে সাহায্য করার জন্য এসেছেন। মাননীয়া হেড মিস্ট্রেসও থাকবেন সঙ্গে… তবে… সেটা …ইয়ে কেবলমাত্র ফাঁক ভরাট করার জন্য, যেখানে যেমন দরকার পড়বে।’

‘উনি ওনার দায়িত্বটা ভালোই পালন করেন তাই না?’ ফিনি ম্যাকগ। গলের দিকে তাকিয়ে বললেন একটু হাসিসহ। জেমস দেখলো মিনারভা ম্যাডাম কিছুটা সপ্রতিভ ভঙ্গীতেই চোখ বড়  বড় করে তাকালেন।

‘মিস সাকারিনা আর মিঃ রিক্রিয়ান্ট এর সঙ্গেও আপনি কথা বলেছেন বোধহয়? প্রেস্কট এগিয়ে গেলেন ফিনি আর ম্যাকগনাগলের মাঝখান দিয়ে। ‘মিস সাকারিনা, আপনি ডিটেক্টিভ ফিনিকে একটু বুঝিয়ে বললে ভালো হয় আপনি ঠিক কি জন্যে এখানে এসেছেন?’

সাকারিনা মোলায়েম হেসে সামনের দিকে এগিয়ে গেলেন, হাত দিয়ে ফিনিকে সামান্য টানলেন। যার অর্থ একটু এদিকে আসুন। হেডমিস্ট্রেসের থেকে সামান্য দূরে।

সাকারিনা কিছু একটা বললেন। ঠোঁট নড়ল কিন্তু শব্দ বের হলোনা। থামলেন, হাঁ বন্ধ করে ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করলেন। ওনার মুখটা  অদ্ভুত দেখাচ্ছিল।  ফিনি ভ্রূ কুঁচকে তাকালেন সাকারিনার দিকে।

‘আপনি ঠিক আছেন তো মিস?’

রিক্রিয়ান্ট মুখে একটা হাসির চাদর চাপিয়ে, যার সঙ্গে সাকারিনার অভ্যাস গত হাসির এক ফোঁটা মিল নেই, বললেন, ‘মিস সাকারিনা বোধ হয় এই আবহাওয়ায় একটু অসুস্থ বোধ করছেন, ডিটেক্টিভ ফিনি। আমিই বরং বলি। এটা একটা ম্যাজিক শিক্ষার স্কুল, যেটা মাননীয়া হেডমিস্ট্রেস ইতিমধ্যেই উল্লেখ করেছেন। বিস্তারিত ভাবে বললে এটা আসলে জাদুকরদের জন্য বানানো হয়েছে। আমরা—’ রিক্রিয়ান্টের পরের কথাটা সম্ভবত গলার কাছে এসে আটকে গেছে এরকমটাই মনে হলো। মুখ হাঁ করে দাঁড়িয়ে আছেন, তাকিয়ে আছেন ফিনির দিকে। মনে হচ্ছে উনি যেন জালে আটকে যাওয়া একটা মাছ। বেশ খানিকটা অস্বস্তিকর সময় ব্যয় করার পর হাঁ বন্ধ করলেন। চেষ্টা করলেন বড় বড় অসমান দাঁত বিকশিত করে হাসার ।

ফিনির ভুরু এখনো কুঁচকে আছে। নিজেকে সাকারিনার বাহু বন্ধন থেকে মুক্ত করে দুজনের দিকে একবার করে তাকালেন। ‘হ্যাঁ কি হল? তারপর বলুন, আরে কিছু বলছেননা কেন? আপনারা কি দুজনেই অসুস্থ বোধ করছেন?’

প্রেস্কট ওদের সঙ্গে সঙ্গে প্রায় লাফিয়ে লাফিয়ে  চলাফেরা করছিলেন। ‘আমার মনে হয় আমাদের সফর শুরু করা উচিত, কি বলেন আপনারা? অবশ্য, আমি এই দুর্গের ভেতর কিভাবে কোথায় যেতে হবে তা একটু আধটু জানি। আমরা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব … যত তাড়াতাড়ি সম্ভব …’ কথা বলতে বলতেই বুঝতে পারলেন জামার কলারের ভেতর আরো কিছু টিস্যুপেপার আটকে আছে। ওগুলো টেনে বার করে প্যান্টের পকেটে ঢোকালেন। ‘মিস সাকারিনা, আপনি বলেছিলেন যে আর একজন কে যেন আপনাদের সঙ্গে থাকবে? একজন বিশেষজ্ঞ যিনি সব কিছু বুঝিয়ে দেবেন এরকম কি বলছিলেন না? আমার মনে হয় এটাই ভালো সময় সেই মানুষটার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার তাই না?’

সাকারিনা সামনের দিকে মাথাটা বাড়ালেন, চোখ ফোলা ফোলা এবং মুখ খোলা। আর কিছুটা শব্দহীন সময় কাটনোর পর হেডমিস্ট্রেস গলা খাঁকাড়ি দিয়ে সামনে চত্বরের দিকে ইশারা করলেন। ‘ওই যে  আমার মনে হচ্ছে, উনি এসে গেছেন। আপনারা তো জানেন মিঃ হুবার্ট একটু লেটলতিফ ধরনের মানুষ। মানুষটা মাঝে মাঝে কাজের চাপে নিজের মাথাটা কোথায় আছে তাই ভুলে যান। তবুও বলতেই হবে উনি নিজের কাজের ক্ষেত্রে একজন জিনিয়াস, তাই না ব্রেন্ডা?’

মুখ হাঁ অবস্থায় সাকারিনা ম্যাকগনাগলের ইঙ্গিত করা দিকে তাকানোর জন্য ঘুরলেন। স্কুল চত্বরে একটা গাড়ি এসে ঢুকলো। অতি প্রাচীন সে গাড়ি, নীলছে ধোঁয়া বার হচ্ছে পাইপ থেকে। ফিনি ভ্রু কপালে তুলে তাকালেন , গাড়িটা আস্তে আস্তে এগিয়ে আসছে। সাকারিনা এবং রিক্রিয়ান্ট গাড়িটার দিকে তাকালেন, দুজনার মুখেই হতচকিত ভাব সঙ্গেই বিরক্তি। সিঁড়ির কাছে জটলা করে দাঁড়িয়ে থাকা শিক্ষার্থীরা পিছিয়ে গেল গাড়িটাকে আসতে দেখে। ওটা গিয়ে দাঁড়ালো প্রথম ল্যান্ডরোভারটার সামনে।  ইঞ্জিনটা ঘর ঘর ঘটাং ঘটাং কয়েকটা শব্দ করে উঠলো তারপর থেমে গেল একসময়।

ফিনি বললেন, ‘ওটাতো মনে হচ্ছে ফোর্ড অ্যাংলিয়া, তাই না? আমি গত কয়েক দশকের ভেতর এ গাড়ি দেখিনি! অবাক হচ্ছি এটা ভেবে যে ওটা এখনো চলছে?’

ম্যারগনাগল ঝটিতি উত্তর দিলেন, ‘ওহ, বুঝলেন কিনা র‍্যান্ডলফ, মিঃ হুবার্ট আবার ইঞ্জিনের ব্যাপারে এক মহা সমঝদার ব্যক্তি। সমঝদার বলার চেয়ে জাদুকর বলাই ভালো।’

ড্রাইভারের দিকের দরজাটা খুলে গেল এবং একটা অবয়ব বেরিয়ে এলো ওখান থেকে। আকারে বেশ বড় সড়, ফলে নেমে আসার সঙ্গে সঙ্গে গাড়িটা নড়ে  উঠলো।  সিঁড়ির দিকে তাকিয়ে মানুষটা চোখ কুঁচকে বোকার মতো হাসলেন। লম্বা রুপালী চুল এবং দাড়ি, সঙ্গে একটা বড় কালো  ফ্রেমের চশমা চোখে। চুলগুলো পেছন দিকে পনিটেল করে বাঁধা।

‘মিঃ টেরেন্স হুবার্ট,’ মানুষটার দিকে তাকিয়ে ম্যাকগনাগল বললেন। ‘চ্যান্সেলর অফ হগওয়ারটস স্কুল অফ উইচক্র্যাফট অ্যান্ড উইজারড্রি। ওয়েলকাম স্যার। আসুন আমাদের অতিথিরা এখানেই আছেন।’

মিঃ হুবার্ট হাসলেন তারপর তাকালেন গাড়িটার দিকে, পেছনের দরজাটা খোলার আওয়াজ হলো।

‘আমার মনে হয় আপনারা কিছু মনে করবেন না,’ মিঃ হুবার্ট চশমাটা ঠিক করে চোখের ওপর সেট করতে করতে বললেন। ‘আমি আমার স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে এসেছি। ডিয়ার, সবাইকে হ্যালো বলো।’

জেমস চমকে গিয়ে ঢোক গিললো কারন মাদাম ডেলাক্রয় বেরিয়ে এলেন গাড়ির ভেতর থেকে। ধীরে হাসলেন বেশ খানিকটা তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে। ‘হ্যালো,’ বললেন  অদ্ভুত রকমের একমাত্রিক কন্ঠস্বরে।

হুবার্ট স্মিত হেসে তাকালেন ওনার দিকে। ‘খুবই প্রিয় একজন তাই না? যাই হোক, আমরা কি কাজটা শুরু করতে পারি?’

সাকারিনা কাশলেন, মিঃ হুবারটের গাড়ি থেকে ডেলাক্রয়কে নামতে দেখে বিস্ময়ে চোখ বিস্ফারিত। রিক্রিয়ান্টকে কনুই দিয়ে একটা খোঁচা মারলেন, কিন্তু কোনও সাড়া পেলেন না কারন রিক্রিয়ান্টও তারমতোই বোবা এই মুহূর্তে।

‘চ্যান্সেলর?’ প্রেস্কট হুবার্ট আর ম্যাকগনাগলের দিকে তাকিয়ে বললেন। ‘কোনো চ্যান্সেলর এর কথা তো জানা ছিলনা!  ইনি আবার কোথা থেকে উদয় হলেন?’

মুখাবয়বে স্মিত হাসির প্রলেপ লেগে থাকা ডেলাক্রয়কে পাশে নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে হুবার্ট  বললেন, ‘আমি ক্ষমা চাইছি স্যার,  শেষ কয়েকটা দিন এখানে ছিলাম না। ব্যবসার কারনে মন্ট্রিয়ল কানাডা ইত্যাদি জায়গায় যেতে হয়েছিল। দারুণ সব ছোটো ছোটো বন্টন কেন্দ্র সব ওখানে। জানেন বোধহয় আমরা সেরা ম্যাজিকের জিনিষপত্রই এখানে সরবরাহ করি। অর্ডার দেওয়ার আগে আমি নিজে হাতে সব পরীক্ষা করে দেখে নিই, বুঝলেন কিনা। না না আর বেশী কথা বলাটা ঠিক হচ্ছে না। হি হি!’ হুবার্ট নিজের নাকের ডগাটায় তর্জনী দিয়ে একটা টোকা মেরে রহস্যময় চোখে হাসলেন প্রেস্কটের দিকে তাকিয়ে।

প্রেস্কটের মুখ পাথরের মতো হয়ে গেছে কোন এক সন্দেহে। একবার হুবার্ট একবার মাদাম ডেলাক্রয়ের দিকে তাকালেন। তারপর দুহাত তুলে চোখ বন্ধ করে বললেন, ‘ঠিক আছে ঠিক আছে, আমাদের কি আসে যায়? মিঃ হুবার্ট আপনি যদি আমদের গাইড হতে চান তাহলে সেই কাজটা শুরু করুন।’

দেরী না করে প্রেস্কট ক্যামেরার দায়িত্বে থাকা ক্রুদের দিকে একবার তাকিয়ে মিঃ হুবার্টকে সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে গেলেন বিশালাকৃতি দরজাটার দিকে। ‘চ্যান্সেলর হুবার্ট। আপনি কি আমাদের এবং আমাদের দর্শকদের বলবেন যে আপনি ঠিক কি করেন এই হগওয়ারটস স্কুল অফ উইচক্র্যাফট অ্যান্ড উইজারড্রিতে?’

‘কেন বলবো না, নিশ্চয় বলবো,’  হুবার্ট বললেন এবং ঘুরলেন। ওরা এসে গেছেন এন্ট্রান্স হলের একেবারে মাঝখানে। ‘আমরা জাদু বিদ্যা শিখাই! সমগ্র ইউরোপের মধ্যে সবচেয়ে উঁচু ধাপে থাকা একটি ম্যাজিকের স্কুল এটি।’ হুবারটের নজর সম্ভবত এই প্রথম ক্যামেরার ওপর পড়লো। একটু নার্ভাসভাবে হাসলেন উনি। ‘শিক্ষার্থীরা, ইয়ে, মহাদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসে, এমনকি বাইরে থেকেও। আসে এই বিষয়ের প্রাচীনতম কলাকৌশল শেখার জন্য। বুঝে নেওয়ার জন্য, নিজের মধ্যে সমাহিত করার জন্য, ইয়ে যা মধ্যে থাকে ডিভাইনেশন, ইলুমিনেশন, প্রেস্টিডাইজেশন এবং ইয়ে আর অনেক কিছু অনেক অনেক কিছু।’

প্রেস্কট তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে হুবার্টের দিকে তাকিয়ে ছিলেন, গাল রক্তাভ হয়ে উঠেছে। ‘বেশ বেশ। তার মানে আপনি স্বীকার করছেন যে এখানে চার দেওয়ালের ভেতর আসল জাদুবিদ্যা শেখানো হয় ?’

‘ইয়ং ম্যান , সেটাই তো হয়। আমি এটা অস্বীকার করবো কেন?’

প্রেস্কট এবার ওজনদার স্বরে বললেন, ‘তাহলে আপনি অস্বীকার করছেন না যে এই সব পেইন্টিংগুলো, যা এই ঘরের চারদিকে সাজানো আছে, সব ম্যাজিক্যাল, নড়াচড়া করতে সক্ষম পেইন্টিং?’ ইশারা করলেন দেওয়ালের দিকে। ক্যামেরাম্যান ঘুরে দ্রুত সন্তর্পণে ছবিগুলোর দিকে এগিয়ে গেল। বুম মাইক্রোফোন অপারেটর যন্ত্রটাকে নিচু করলেন যাতে হুবার্টের প্রতিক্রিয়া ধরা যায়।

‘ন-নড়াচড়া করা পেইন্টিং?’ হুবার্ট বললেন বিকৃত স্বরে। ‘ওহ। ওহ-হো হ্যাঁ হ্যাঁ। আসলে ব্যাপারটা হলো ওদেরকে ওইভাবেই নির্দেশ দেওয়া আছে। মানে আপনি এই ঘরের যেখানে যাবেন ওই আঁকা অবয়বগুলোর চোখও সেই দিকে যাবে।  সে আপনি এঘরের যেখানেই যাননা কেন। ‘হুবার্ট রহস্যময় ভাবে নিজের হাতটা নেড়ে বিষয়টাকে আরো জমকদার করে বললেন, ‘আসলে ব্যাপারটা হলো ওরা আপনার ওপর নজর রাখবে!’

ক্যামেরাম্যান ভিউ ফাইন্ডার থেকে চোখ সরিয়ে প্রেস্কটের দিকে তাকালো। প্রেস্কটের মুখে অন্ধকারের নেমে এসেছে যেন। ‘আমি কিন্তু এটা জানতে চাইনি। ওদের ঘুরে বেড়াতে দিন! আপনি জানেন যে ওরা সেটা পারে! আপনি!’ ঝট করে ঘুরে ম্যাকগনাগলের দিকে তাকালেন। ‘আপনি গতকাল আপনার অফিসে একটা পোরট্রেটের সঙ্গে কথা বলছিলেন! আমি দেখেছি! আমি শুনেছি ছবিটাকে কথা বলতে!’

ম্যাকগনাগল মুখের এমন একটা হাস্যকরভাব করলেন যা দেখে জেমস সহ উপস্থিত ছাত্রছাত্রীরা অনেক কষ্টে হাসি সামলালো। হেডমিস্ট্রেস উত্তর দিলেন, ‘আমি ঠিক বুঝতে পারছি না আপনি কি বলতে চাইছেন স্যার।’

ফিনি একপা এগিয়ে ম্যাকগনাগলের সামনে এসে দাঁড়ালেন, উচ্চতায় উনি প্রায় ছয় সাত ইঞ্চি ছোট মিনারভার চেয়ে। বললেন, ‘আমার মনে হয় উনাকে এসব প্রশ্ন করা থেকে দূরে রাখাই ভালো। বুঝলে কিনা? শুধু তোমার অসামান্য ইনভেস্টিগেশনটা চালিয়ে যাও প্রেস্কট। এসব ব্যাপারগুলো বাদ দাও।’

প্রেস্কট থতমত খেয়ে কিছুটা সময় নিলো নিজেকে ধাতস্থ করতে। ‘ও-কে। বাদ দিন আমার ওই বোকাবোকা ভাবে নড়াচড়া করা পেইন্টিং এর কথা জানতে চাওয়ার ব্যাপারটা।’ ঘুরলেন হুবারটের দিকে। ‘আমার মনে হয় বর্তমান সেশনের ক্লাস চলছে এই সময়ে তাই না মিঃ হুবার্ট?’

‘উঁ?’ হুবার্ট হতচকিত ভাবে বললেন, ‘বর্তমান সেশন? হ্যাঁ… আ …আমারতো তাই মনে হয়। আমি আশা করিনি –’

‘আপনি আশা করেননি যে আমরা দেখতে চাইবো, তাই না?’ প্রেস্কট কথার মাঝেই বলে উঠলেন। ‘হ্যাঁ, আমরা দেখতে চাই। আমাদের দর্শকদের অধিকার আছে জানার যে ঠিক কি হচ্ছে এখানে… ঠিক…আমাদের… নাকের ডগায়।’

‘দর্শক?’ হুবার্ট বললেন, ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘মানে, ইয়ে, এটা কি লাইভ নাকি?’

প্রেস্কট মাথাটা সামনের দিকে ঝুঁকিয়ে বললেন, ‘না, মিঃ হুবার্ট। এটা লাইভ নয়। আপনারা কেউ  ঊনাকে বলে দেন নি এটা কি ভাবে কাজ করে? আমরা রেকর্ড করছি। ওটাকে এডিট করে সম্প্রচার করবো। মিস সাকারিনা, আপনি এগুলো বুঝতে পারছেন বোধহয়, কি ঠিক বলছিতো?’ তাকালেন সাকারিনার দিকে, যিনি হেসে দু হাত প্রসারিত করলেন দুপাশে। অনেক কিছু বলার জন্য উনি ছটফট করলেও সব গলার কাছে এসে আটকে যাচ্ছে। রিক্রিয়ান্ট নিজের হাসির মাত্রাটা একটু বাড়ালেন। ওনার কপালের ওপর ফোঁটা ফোঁটা ঘামের বিন্দু। ‘বেশ বেশ,’ প্রেস্কট বিড়বিড় করলেন। ‘তাহলে তো কিছু বলার নেই। খুব ভালো। চলুন শুরু করি আবার।’ সোজা হয়ে হুবার্টের দিকে তাকালেন। ‘হ্যাঁ, আমাদের দর্শকেরা খুবই আগ্রহী হবেন এই সব তথাকথিত ক্লাসরুমগুলোতে কি হয় সেটা জানতে, মি চ্যান্সেলর। দয়া করে আমাদের নিয়ে চলুন।’

হুবার্ট ডেলাক্রয়ের দিকে তাকালেন। ‘ডিয়ার তোমার কি ইচ্ছে? ডিভাইনেশন নাকি লেভিটেশন?

‘দুটোই আকর্ষণীয় হানি,’ অনেক কষ্ট করে ডেলাক্রয় বললেন কথাগুলো। মনে হলো উনি আরো কিছু বলতে চান, কিন্তু চোয়াল নড়লেও ঠোঁট সহায়তা করছিল না।

‘আমার স্ত্রী বিদেশিনী, দেখতেই পাচ্ছেন,’ হুবার্ট বললেন ক্ষমা প্রার্থনার সুরে। ‘যদিও চেষ্টা করছেন যতটা পারা যায়।’

‘মিঃ হুবার্ট প্লিজ, ক্লাসরুম,’ প্রেস্কট আদেশের মতো করে বললেন, ‘আপনি এভাবে প্রেসকে দাঁড় করিয়ে রাখতে পারেন না।’

‘না না, একদমইনা। আমরা এরকম পাবলিসিটিকে গুরুত্ব দিই,’ হুবার্ট বললেন, সবাইকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যেতে যেতে। ‘আসলে এটা এতোটাই সম্মানজনক ব্যাপার যে সবসময় মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকাটাই কষ্টকর ব্যাপার। ম্যাজিক হলো, ইয়ে, এক বিশেষ ধরনের শিক্ষা কমকথায় এটাই বলা যায়। অল্প কিছু বিশেষ ধরনের ব্যক্তিত্বের মধ্যে এটা শেখার মতো ধৈর্য এবং উচ্চাকাঙ্খা থাকে। এই যে আমরা এসে গেছি। ডিভাইনেশনের ক্লাসে।’

প্রেস্কট খোলা দরজা দিয়ে ঢুকে পড়লেন ক্লাসরুমে, পেছন পেছন ক্যামেরাম্যান এবং বুম মাইক্রোফোন ক্রু। প্রেস্কটের সঙ্গে তাল রাখতে বেশ খাটতে হচ্ছিল ওদেরকে।  ফিনি দলটার পেছনদিকে ছিলেন ম্যাকগনাগলের কাছাকাছি। হ্যারি আর জেমস দলটার সামনে, দরজা দিয়ে ঝুঁকে উঁকি দিলো ভেতর দিকে দেখার জন্য।

‘এখানে আমাদের ছাত্রছাত্রীরা অতি প্রাচীনতম এক বিদ্যার শিক্ষাগ্রহন করে। ভবিষ্যতকে অনুমান করার,’ হুবার্ট বললেন গর্ব সহকারে। গোটা বারো শিক্ষার্থী এদিকে ওদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আছে, নিজের ডেস্কে রাখা জিনিসের দিকে তাকিয়ে। ক্লাসঘরের এক প্রান্তে প্রফেসর ট্রেলোওনি দুহাত তুলে কব্জিতে পড়ে থাকা বালা নাড়িয়ে একটা বাজনার মত বাজাচ্ছেন।

‘খোঁজার চেষ্টা করো!’ উনি বললেন রহস্যমাখা কণ্ঠস্বরে। ‘মন দিয়ে দেখো, সবজান্তা কসমসকে ভালো করে পর্যবেক্ষণ করো। যেখানে ছড়িয়ে আছে অনাদির ঘূর্ণায়মান সব ছক আর নকসা! খুঁজে বার করো কি আছে তোমার ভাগ্যে!’

‘চায়ের পাতা!’ ফিনি বললেন কিছু খুঁজে পাওয়ার আনন্দ মাখা গলায়। ‘আমার মা চায়ের পাতার সাহায্যে আগত ভ্রমণকারীদের ভাগ্যগণনা করতেন! পুরোনো দিনের সেইদিনগুলোর কথা মনে পড়ে গেল। বাহ কি সুন্দর ছবির মতো, সেই ঐতিহ্য বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে এখানে।’

‘ঐতিহ্য, ধুসস!’ ট্রেলোওনি বললেন, চেয়ার থেকে উঠে নিজের পোশাককে নাটকীয় ভঙ্গীতে নাড়িয়ে। ‘আমরা এখানে ওই সব পাতার মধ্যে প্রকৃত যে সত্য গেঁথে রাখা আছে তাকে খুঁজছি স্যার। অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যত সব ওখানে খোলা পড়ে আছে তাদের জন্য যারা ওটাকে দেখতে পায়!’

ফিনি ফিক ফিক করে হেসে বললেন, ‘আমার মা’ও ঠিক এই কথাগুলোই বলতেন!’

‘একজন শিক্ষার্থীর কাপের দিকে অবজ্ঞার চোখে তাকিয়ে প্রেস্কট বললেন, ‘এইভাবে আপনারা ভবিষ্যৎ বলেন? অসহ্য ব্যাপার। ক্রিস্টাল বল কোথায়? ঘুরতে থাকা ধোঁয়া আর ভুতুড়ে দৃশ্যাবলী কই?’

হুবার্ট বললেন, ‘সে সবও আমাদের আছে মিঃ প্রেস্কট। আছে না ডিয়ার?’

‘অ্যাডভান্সড ডিভাইনেশন। দ্বিতীয় সেমিস্টারে। দু হাজার পাউন্ড ল্যাব-ফি,’ ডেলাক্রয় যন্ত্রের মতো জবাব দিলেন।

হুবার্ট হাত তুলে বললেন, ‘ক্রিস্টাল বলগুলো ঢেকে দাও। ওগুলো অত সহজে দেখানো যাবেনা। আমরা চিন থেকে ওগুলো বিশেষভাবে বানিয়ে এনেছি। সব কিছুই আসল ক্রিস্টালের। আর আমাদের ছাত্রছাত্রীরা ওগুলো বছরের শেষে নিজের নিজের বাড়িতে নিয়ে যায়। একধরনের মেমেন্টো বলতে পারেন।’

ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে প্রেস্কট বললেন, ‘আমার মনে হয় আপনি লেভিটেশন এর কথাও বলেছিলেন!’ প্রেস্কটের দলবল ওকে অনুসরণ করলো দ্রুততার সঙ্গে, আরো আরো ইলেকট্রিকের তারের কয়েল খুলতে খুলতে।

‘হ্যাঁ বলেছিলামতো। জাদুকলার এক উৎকৃষ্ট নমুনা।’ হুবার্ট উত্তর দিলেন, হল পেরিয়ে অন্য একটি ক্লাসরুমের পথে প্রেস্কটকে অনুসরণ করে যেতে যেতে।  ‘আমরা ওই ক্লাসটাকে বেসিক প্রেস্টীডাইজেশনের সঙ্গে একসঙ্গে করাই। হ্যাঁ, এটাই, আমরা এসে গিয়েছি।’

জ্যান ক্লাসরুমের মাঝখানে দাঁড়িয়ে ছিল জাদুদন্ড হাতে। বেশ কিছু ছাত্রছাত্রী দোয়ালের দিকে সারি দিয়ে বসে ছিল। দেখছিল গড্রিক গ্রিফিন্ডোরের আবক্ষ মূর্তি হাওয়ার ভেসে বেড়াচ্ছে। জ্যানের নাড়াতে থাকা জাদুদন্ডের ছন্দ মেনে। প্রেস্কটের দলের সদস্যরা এটা দেখে অবাক হয়ে ঢোঁক গিললো। ক্যামেরাম্যান আস্তে আস্তে এগিয়ে গেল ব্যাপারটাকে আর ভালোভাবে দেখানোর জন্য।

‘আহা! এইতো!’ প্রেস্কট বলে উঠলেন উৎসাহিত ভাবে। ‘আসল জাদু! আর সেটা করে দেখাচ্ছে একটা বাচ্ছা ছেলে!’

হুবার্ট গর্বিত ভঙ্গীতে বললেন, ‘যেমন বলেছিলাম। মিঃ ওয়াকার এই ক্লাসের সেরা। মিঃ ওয়াকার তোমার যেন কোন বছর?’

জ্যান হেসে আনন্দের সঙ্গে জানালো, ‘প্রথম বছর স্যার।’

হুবার্ট বললেন, ‘এক্সিলেন্ট, দারুণ। একটা পাক খাইয়ে দেখাও দেখি, পারবে না?’

সঙ্গে সঙ্গেই শোনা গেল উপস্থিত শিক্ষার্থীদের উচ্ছ্বাস কারন আবক্ষ মূর্তিটি শূন্যে আস্তে আস্তে ঘুরতে শুরু করেছে। তারপরেই ওটা নিচে পড়ে গেল, যেখানে একটা মাদুর জাতীয় জিনিস পাতা আছে।

হুবার্ট আশাহত ভাবে বললেন, ‘ওহো, এটাতো ঠিক হলোনা মিঃ ওয়াকার। শেষ মুহূর্তে ফেলে দিলে।’

জ্যান ককিয়ে উঠে বলল, ‘এটা আমার দোষ নয় স্যার! যে পেছন থেকে এটা করছে তার দোষ! টেড, বোকা কোথাকার!  টানার বদলে ছেড়ে দিলো! আর কতবার বুঝিয়ে বলবো বলোতো তোমাকে!’

‘ওই!’ টেড একটা বিরক্তি সূচক আওয়াজ করে বেরিয়ে এলো ঘরের শেষ প্রান্তে রাখা একটা আলমারির ভেতর থেকে। হাতে একগোছা তার, যেগুলো ওই আলমারির ভেতরে আটকানো কিছু কপিকলের পুলিতে আটকানো। ‘এখানে এই অন্ধকারের ভেতর এসে কাজ করে দেখেছিস কখনো? দোষ দিচ্ছে? তাছাড়া এটার জন্য নোয়া দায়ী। ক্রসপুলিটা টানতে ওইতো দেরী করলো।’

আলমারিটার ভেতর থেকে একটা ক্রুদ্ধ আওয়াজ ভেসে এলো, ‘কি? ঠিক আছে! এরপর থেকে আমি খেলা দেখাবো। আর এই সহকারীর কাজ ভালো লাগছেনা। আমিও  জাদুকরের টুপি পড়তে চাই।’

জ্যান চোখ পাকিয়ে বলল, ‘নোয়া, এখানে কেউ কোন টুপি পড়ে নেই।’

নোয়া চেঁচিয়ে বলল, ‘নেই তো কি হয়েছে, ওই টুপি কারো একজনের অবশ্যই পড়া উচিত।’ দেখা গেল নোয়ার মাথা আলমারির দরজায়। ‘তা না হলে লোকেরা বুঝবে কি করে কে আসল জাদুকর আর কে তার সহকারী?’

‘আরে আরে, ঝগড়া থামাও, ‘হুবার্ট দুহাত ওপরে তুলে বললেন। ‘এক একটা ক্লাসরুমের জন্য একটা করে টুপি বরাদ্দ। এই ক্লাসেরটা মিস মরগ্যানস্টারন নিয়েছেন খরগোসের খেলাটা দেখাবেন বলে। মিঃ প্রেস্কট, মিঃ ফিনি আপনারা কি খরগোসের খেলাটা দেখতে আগ্রহী?’

‘অবশ্যই, দেখবো না কেন,’ ফিনি বললেন উৎসাহের কন্ঠে।

প্রেস্কট চেঁচিয়ে বললেন, ‘না!’

টাবিথা করসিকা ঠেলে ঠুলে ছাত্রছাত্রীদের জটলা কাটিয়ে সামনে এসে দাঁড়ালো। মুখ লাল হয়ে গেছে রাগে। ‘মিঃ প্রেস্কট,’ বলতে শুরু করলো, ‘আপনি—’

হুবার্ট ধীরে ধীরে টাবিথার দিকে ঘুরলেন। ‘মিস করসিকা এটা অটোগ্রাফ নেওয়ার সময় নয় মোটেই।’

হাতে একটা ছোটো নোট বুক আর পেন , টাবিথা ঝাঁঝিয়ে উঠে বলৎলো, ‘আমি এখানে অটোগ্রাফ নিতে আসিনি, চ্যান্সেলর…।’  কথার মাঝপথেই থামলো, তাকালো হাতের জিনিষ দুটোর দিকে। নোট বইটার রঙ গোলাপি আর তার ওপর সাদা দিয়ে লেখা “অটোগ্রাফস”।

‘এসব করার জন্য পরে অনেক সময় পাবে মিস করসিকা। তবে আমি নিশ্চিত তোমার এই আগ্রহে মিঃ প্রেস্কট বেশ খুশি হয়েছেন।’

‘চ্যান্সেলর হুবার্ট?’ পেট্রার গলা ভেসে এলো, যে তাকিয়ে আছে একটা কালো টপ হ্যাটের দিকে। যেটা রাখা আছে অত্যধিক চকচকে একটা টেবিলের ওপর। ‘আমার মনে হচ্ছে মিঃ ওয়াইফেলসের সঙ্গে কিছু একটা সমস্যা হয়েছে। খরগোসেরা কি এভাবে শুয়ে থাকে?’

‘এখন না মিস মরগ্যানস্টারন, ‘হুবার্ট উত্তর দিলেন, এসব পরে হবে এরকম ভঙ্গীতে হাত নেড়ে। ‘মিঃ প্রেস্কট, আমার মনে হয় আপনি আমাদের সয়িং-ইন-হাফ কক্ষটি দেখতে চাইবেন?’

প্রেস্কট ততক্ষনে ওখান থেকে চলে গেছেন, হতভম্ব করসিকাকে পাশ কাটিয়ে ওর পেছন দিকের করিডোরের পথে। ওর দলের লোকেরা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যাচ্ছে তাল রাখতে গিয়ে, কারন প্রেস্কট প্রত্যেকেটা রুমে একবার করে ঢুকছেন আর বেরিয়ে আসছেন। একেবারে শেষ প্রান্তে গিয়ে একটা উল্লাসের চিৎকার ছাড়লেন এবং ইশারা করলেন দলীয় সদস্যদের দ্রুত আসার জন্য।

‘এইখানে!’ চিৎকার করে বললেন প্রেস্কট, পাগলের মতো ডানহাতটা নাড়তে নাড়তে। অনুসরন করতে থাকা জটলা ঢুকে পড়লো ঘরটাতে, ছাত্রছাত্রীরা হাসতে শুরু করে দিয়েছে প্রেস্কটের ভাবভঙ্গী দেখে। ‘একেবারে আপনাদের চোখের সামনে! একজন অশরীরী প্রফেসর! ভিন্স, যতটা পারো এর ছবি তুলে নাও! অকাট্য প্রমান এটা মরণের পরবর্তী জীবনের।’

এবার আর কোনও চমকের ঢোঁক না গিলে ভিন্স সামনের দিকে এগিয়ে গেল, এক হাতে ফোকাস তা ঠিক করে।

হুবার্ট উচ্ছাসের স্বরে বললেন, ‘ওহ, হ্যাঁ ইনি প্রফেসর বিনস। প্রফেসর! এই ভালো মানুষগুলোকে হ্যালো বলুন।’

প্রফেসর বিনস প্যাঁচার মতো চোখে জটলার দিকে নজর বুলিয়ে নিজের ক্ষীন অদ্ভুতুড়ে কণ্ঠে বললেন, ‘শুভেচ্ছা।’

ভিন্স নামক ক্যামেরাম্যানটি জানালো, ‘এটাতো ধোঁয়ার ওপর প্রজেকশন করে করা হয়েছে।’

হুবার্ট কিছুটা আত্মরক্ষার ভঙ্গীতে বললেন, ‘আসলে উনি এতটা কাছাকাছি কাউকে দেখা দিতে অভ্যস্ত নন। শিক্ষার্থীরা ওর থেকে বেশ দূরেই থাকে। যার ফলে একটা দারুণ রকমের রহস্য এবং সুপার ন্যাচারাল আবহাওয়া সৃষ্টি হয়।’

র‍্যালফ ছিল ক্লাস করতে থাকা শিক্ষার্থীদের ভেতর। ক্যামেরাম্যানকে বিরক্তির সঙ্গে বলল, ‘আপনি এটা উপভোগের আবহাওয়াটাকে নষ্ট করে দিচ্ছেন। আপনার উচিত নয় সব কিছুর কাছাকাছি গিয়ে এভাবে সব পন্ড করা।’

উপস্থিত মানুষদের দিকে তাকিয়ে বিনস আবার বললেন, ‘শুভেচ্ছা।’

‘অসম্ভব! হতেই পারে না।’ প্রেস্কট ক্রুদ্ধ চিৎকার করে উঠলো। ‘এটা একটা ভুত! আমার চেয়ে ভালো কেউ সেটা জানেনা!’

ভিন্স ক্যামেরা নামিয়ে বলল, ‘এটা একটা প্রোজেকশন, মারটিন। আমি এরকম আগেও দেখেছি। তাছাড়া এটা খুব ভালো মানের নয় মোটেই। ওই শোনো প্রোজেক্টারের আওয়াজও শোনা যাচ্ছে। ওই ডেস্কের তলাতেই রাখা আছে। আর এদিকে তাকাও, দেখতে পাচ্ছো? ড্রাই আইস মেশিন। এর থেকে ধোঁয়া বানানো হয়।’

ফিনি দরজার কাছ থেকে গলা ঝেড়ে বললেন। ‘মিঃ প্রেস্কট, যা চলছে তা খুবই বিরক্তিকর।’

প্রেস্কট পাগলের মতো ঘুরে দাঁড়ালেন। দেখেই বোঝা যাচ্ছে কি পরিমাণ রেগে গেছেন ভেতরে ভেতরে। ‘না!’ চিৎকার করে উঠলেন। ‘এসবই সাজানো হয়েছে! এসব ওই লোকটার কারসাজি! ওই তোমাদের সবাইকে ধোঁকা দিতে চাইছে!’ হুবারটের দিকে আঙুল তুলে দেখালেন।

‘আরে, আমরা তো এখানে এটাই করি,’ হুবার্ট বললেন, মোলায়েম হেসে। ‘আমাদের কাজটাই হল কৌশল খাটানোর। যদি কিছু মনে না করেন তাহলে বলতে পারি মানুষকে ভ্রান্তি প্রদর্শন করাইতো আমাদের কাজ। যাকে  ইলিউশন বলা হয়।’

হুবারটের দিকে হাত উঠিয়ে রেখেই প্রেস্কট বললেন, ‘আমি দেখতে পাচ্ছি আপনারা ঠিক কি করার চেষ্টা করছেন এখানে। ম্যাকগনাগল সহ সাকারিনা এবং রিক্রিয়ান্ট কথাটা শুনে মাথা নাড়লেন। ‘আপনারা সবাই মিলে আমাকে পাগল সাজানোর চেষ্টা করছেন! তবে আমার দর্শকেরা এবং আমার সহকর্মীরা ভালো করেই আমাকে চেনে। আপনারা সব কিছু লুকাতে পারবেননা! সঞ্চরণশীল সিঁড়ির কি হবে? অথবা দৈত্যদের? কি হলো বলুন? অথবা …’ প্রেস্কট থামলেন, আঙুল এখনো ওঠানোই আছে। কিছু সময়ের জন্য দৃষ্টিতে উদ্ভ্রান্তভাব এলেও এবার হাসলেন শয়তানি চোখে। ‘আমি ব্যাপারটা জানি একদম জানি সেই ব্যাপারটা। ভিন্স, এডি, বাকি যারা আছো সব এসো আমার সঙ্গে।’

হুবার্ট, প্রেস্কটের লোকেরা এবং ছাত্র ছাত্রীর জটলা অনুসরণ করলো। ‘আপনি কোথায় যাচ্ছেন মিঃ প্রেস্কট? আমিতো আপনার গাইড, ভুলে গেছেন বোধহয়। আপনি যা দেখতে চাইবেন আমি দেখিয়ে দেবো।’

‘দেখাবেন? কথা দিচ্ছেন তো?’ প্রেস্কট বললেন, হুবারটের দিকে ঘুরে। কৌতূহলী ছাত্রছাত্রীরা সরে গেল প্রেস্কট আর ওর দলের জন্য, যাতে কথা বলতে সুবিধা হয়। ‘আপনি আমায় দেখাবেন…,’ নাটকীয় ভঙ্গীতে থেমে গিয়ে মাথা ওপর দিকে উঠিয়ে , ‘গ্যারাজটা?’

‘গ্যা …,’ হুবার্ট চোখ পিট পিট করে তাকালেন প্রফেসর ম্যাকগনাগলের দিকে। জেমস বুঝতে পারলো হ্যারি ওর কাঁধটা চেপে ধরলো শক্ত করে। কিছু একটা সমস্যা এবার দানা বাঁধছে। ‘গ্যারাজটা?’ হুবার্ট কথাটা এমন ভাবে পুনরায় উচ্চারন করলেন যে মনে হল এ ব্যাপারে আগে কোনো দিন শোনেননি।’

প্রেস্কট শিকারীর ঢং এ হাসলেন। ‘আহারে! এইটা তো ঠিকঠাক সাজানো হয়নি। তাই না? আজ সকালে আমি ভালো করে সব ঘুরে ঘুরে দেখেছি যখন সবাই নিজের নিজের কাজে ব্যস্ত ছিল। এদিকে ওদিকে উঁকি মেরে মেরে আমি অনেক কিছুই দেখে নিয়েছি! ওখানে একটা গ্যারেজ আছে,’ ক্যামেরার দিকে মুখ ঘুরিয়ে বললেন। ‘যেটার সাহায্যে সময় কালের গণ্ডী ভেদ করা যায়। একটা ম্যাজিক্যাল পোর্টাল এক জায়গার সঙ্গে আর আর এক জায়গার যোগাযোগ স্থাপনের পথ –  যাদের মধ্যে দূরত্ব হাজার হাজার কিলোমিটারের!  এখানকার সঙ্গে আমেরিকার, যদি আমার অনুমান ভুল না হয়! আমি নিজের চোখে এটা দেখেছি। আমি ওইটার ভেতরে ঢুকেছিলাম এবং অনেক দূরের কোনো স্থানের গন্ধ অনুভব করেছি। আমি দেখেছি সেখানকার সূর্যোদয়, যখন এখানে সূর্য ছিল মাথার ওপরে দিগন্তরেখায়।  ওটা কোনও ট্রিক বা ইলিউশন ছিল না। এই মানুষগুলো আমাদের কাছে নিজেদের প্রমান করতে চাইছেন যে ওরা আসলে ভাঁওতাবাজির মাষ্টার। কিন্তু আমি নিজের চোখে দেখেছি এবং প্রমান পেয়েছি যে এরা আসলে এমন এক জাদুর চর্চা করেন যার মধ্যে কোন ভাঁওতাবাজি নেই। বদলে আছে শুদ্ধ এবং সহজ ভাষায় যাকে বলে এক অতিলৌকিক চর্চার ফসল। আর এবার সেটাই আমি প্রমাণ করব!’ এক ঝটকায় প্রেস্কট ঘুরলেন এবং হাঁটা শুরু করলেন এন্ট্রান্স হলের দিকে। হ্যারি হুবারটের পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন, কিন্তু হ্যারিকে যেন উনি দেখতেই পেলেননা।

‘মি; প্রেস্কট!’ হুবার্ট উপস্থিত জটলার গুঞ্জন ছাপিয়ে চিৎকার করে উঠলেন। ‘আমি আপনাকে বলতে বাধ্য হচ্ছি যে আমাকে ব্যাপারটা দেখতে দিন… মিঃ প্রেস্কট! এটা একটা অনিয়মিত ঘটনার সামিল!’

প্রধান দরজা দিয়ে বার হয়ে সমানের চত্বর দিয়ে প্রেস্কট এগিয়ে চললেন দলবল নিয়ে। শিক্ষার্থীদের জটলা আকারে বড় হয়েছে, ওদের কথা বলার শব্দে চারদিক মুখরিত। সবাই আল্মা আলেরনের গ্যারাজটার বাইরেটা দেখেছে কিন্তু খুব অল্পই তাদের মধ্যে সুযোগ পেয়েছে ভেতরে যাওয়ার বা দেখার কি আছে ওখানে।  সেসব কথার কৌতূহলজনক আলোচনাতে এই মুহূর্তে ব্যস্ত সবাই।

হ্যারি নিচু স্বরে জেমসকে বললেন, ‘বাজে কিছু একটা হয়ে যেতে পারে বুঝলি জেমস।’

‘আমরা কিই বা করতে পারি?’

হ্যারি মাথাটা ঝাঁকালেন। দেখলেন প্রেস্কট দলের লোকেদের পথ দেখিয়ে এগিয়ে নিয়ে  যাচ্ছে লেকের ধারে অবস্থিত ক্যানভাসের তাঁবুটার দিকে। ঘুরলো, নিজেকে তাঁবুর দেওয়ালের সামনে থামালো ক্যামেরার মুখোমুখি। ওর দলের লোকেরা জায়গা মতো দাঁড়িয়ে গেল, বুম মাইক্রোফোন নেমে এলো কাছে আর বিরাট সাদা ছাতাটা এমন ভাবে রাখা হল যাতে কোন রকম ছায়া পড়াকে আটকানো যায় প্রতিফলনের সাহায্যে। প্রেস্কট একটু ঘুরলেন, নিজেকে কোনদিক থেকে ভালো দেখায় সেটা ওর জানা আছে। ভিন্স এগোতে থাকলেন একটু একটু করে। জেমস স্বীকার করতে বাধ্য হল যে বেশ নাটকীয় মনে হচ্ছিল পুরো ব্যাপারটা।

‘লেডিজ অ্যান্ড জেন্টলমেন,’ প্রেস্কট বলতে শুরু করলেন সামান্য গলার স্বর চড়িয়ে, ‘আমার দলবল এবং আমি  এবং আপনারা সকলেই জড়ো হয়েছেন একটা সাজানো গোছানো মিথ্যে দেখতে। এটা মোটেই কোনও সাধারণ হাত আর কার্ডের ম্যাজিক শেখার স্কুল নয়। একদমই না, কারন আমি নিজে ওই দেওয়ালের ভেতরে সাক্ষী থেকেছি বিভিন্ন চমকপ্রদ ও শিহরণ জাগানো ম্যাজিক দেখার ক্ষেত্রে। আমি সত্যি করে ভুত দেখেছি, দেখছি সত্যি করে লেভিটেশন বা জিনিস ভাসানোর খেলা। আমি এটাও দেখেছি পাথরের দেওয়ালে সহসাই আবির্ভাব হয়েছে একটা দরজার। আমি এমন সব জন্তু জানোয়ার এবং দানব দেখেছি যা মনকে নাড়া দিতে সক্ষম। আজ, আমাদের নিয়ে বোকা বানানোর খেলা চলেছে, সেটা করেছেন একদল উইচ আর উইজার্ড – হ্যাঁ আসল জাদুকরের দল ওরা – যারা মনে করেন আমাদের কিছু সাজানো জিনিস দিয়ে ধোঁকা দেওয়া যাবে। কিন্তু এবার আমি এই জায়গাটার আসল সত্য উন্মোচন করতে চলেছি। এই তাঁবুর ভেতরে এমন অপ্রাকৃত ম্যাজিকের অস্তিত্ব আছে যা আপনাদের স্তম্ভিত করে দেবে। আর যখন সেই সত্য সবার সামনে আসবে তখন  মিঃ রুডলফ ফিনি, ব্রিটিশ স্পেশ্যাল পুলিসের ডিটেক্টিভ, একটা বড় মাপের সরকারী তদন্তের ব্যবস্থা করবেন এই সম্পূর্ণ বিষয়টা নিয়ে। আর তাতে সহযোগিতা করবে ইউরোপের সমস্ত পুলিস বিভাগ। আজকের পর, লেডিজ অ্যান্ড জেন্টলম্যান, দ্বিধাবিহীন ভাবে প্রমানিত হবে, উইচ আর উইজার্ড ব্যাপারটা আসলে কোন গল্প কথা নয়, আসলে ওরা আমাদের সঙ্গে আমাদের আশেপাশে ঘুরে বেড়ায়।’

প্রেস্কট থামলেন, সময় দিলেন নিজের বলা কথাগুলোর প্রতিধ্বনি উপস্থিত হতচকিত মানুষজনকে শুনতে দেওয়ার জন্য। তারপর এগিয়ে গেলেন সেই দিকে যেখানে ম্যাকগনাগল, হুবার্ট, সাকারিনা এবং রিক্রিয়ান্ট দাঁড়িয়ে আছেন। ফিনি দাঁড়িয়ে আছেন হেডমিস্ট্রেসের পাশেই চোখ বড় বড় করে ভ্রু উঁচিয়ে। ‘মিঃ হুবার্ট,’ প্রেস্কট ডাকলেন, ‘আপনি কি ওর ভেতরে ঢোকার দরজাটা খুলে দেবেন আমাদের জন্য? এটাই আপানার শেষ সুযোগ ঠিকঠাক কাজ করার জন্য।’

হুবার্টের মুখ গম্ভীর। তিনি তাকালেন প্রেস্কটের দিকে। ‘মিঃ প্রেস্কট আমি আপনাকে উপদেশ দিচ্ছি এধরনের কাজ না করার জন্য।’  

‘আপনি ওটা খুলবেন নাকি আমি নিজেই খুলে নেব।’

হুবার্ট বললেন, ‘আপনি সব গোলমাল পাকিয়ে দেবেন স্যার।’ পাশে দাঁড়িয়ে ডেলাক্রয় পুতুলের মতো মিটিমিটি হাসছিলেন।

‘আমি কিছুই গোলমাল পাকাবোনা কেবলমাত্র আপনাদের সব গোপনীয়তা ফাঁস হয়ে যাবে মিঃ হুবার্ট। এই জগতের জানার দরকার আছে ওই তাঁবুর পেছনে আসলে কি আছে।’

হুবার্টকে দেখে মনে হচ্ছিল উনি যেন পাথরে পরিণত হয়েছেন। মনে হচ্ছিল কাজটা করার কোন ইচ্ছেই ওনার নেই। তারপর এগিয়ে গেলেন মাথা নিচু করে। একটা সমবেত উৎকন্ঠার শব্দ সৃষ্টি হল আশপাশে। প্রেস্কট একটু সরে দাঁড়ালেন, ক্যামেরার দিকে তাকালেন বিজয়ীর ভঙ্গীতে। হুবার্ট তাঁবুর কাছে এগিয়ে গিয়ে দাঁড়ালেন। একটা বড় দীর্ঘশ্বাস ফেলে, নিচু হয়ে হাতে তুলে নিলেন তাঁবুর দরজায় বেঁধে রাখা দড়ি। ফিরে একবার তাকালেন প্রেস্কটের দিকে। অস্বস্তিকর খানিকটা সময় অপেক্ষা করে টান দিলেন দড়িতে। গিঁট খুলে ক্যানভাসে বানানো দরজা ঝুলে গেল একদিকে, ঝুলে থাকলো পতাকার মতো। হাওয়ার নড়ে ঝাপ্টা মারতে থাকলো তাঁবুর দন্ডে।  উপস্থিত জনতা সশব্দে ঢোঁক গিললো, তারপর ওখানে নেমে এলো এক দীর্ঘ, হতচকিত হয়ে যাওয়া নীরবতা।

জেমস উঁকি মারলো। প্রথম দেখাতেই বুঝতেই পারলো না ও ঠিক কি দেখতে পাচ্ছে ভেতরে। ভেতরটা বাইরের তুলনায় অন্ধকার, কিন্তু এটা বুঝতে পারলো উড়ন্ত গাড়িগুলো একটাও ওখানে নেই। একটা বিরাট চ্যাপ্টা গোল ধরনের বস্তু ভেতরে রাখা আছে। একেবারে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা জনতা খিলখিলিয়ে হাসলো প্রথমে তার পর সেটা সঙ্ক্রামিত হল সবার ভেতর। বয়ে গেল একটা হাসির ঝড়।

হুবার্ট বললেন, ‘তাহলে, আপনি এটা করেই ফেললেন। আপনি আমাদের গোপনীয়তাকে নষ্ট করে দিলেন। আর এর অর্থ আমরা একবারে শেষ হয়ে গেলাম। স্যার আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি, আপনি আর মোটেই হাসির পাত্র নন।’ হুবার্ট পিছিয়ে এলেন যাতে ক্যামেরা ও শব্দগ্রহনকারী দল তাঁবুর ভেতরটা সোজাসুজি দেখতে পায়। একটা বিরাট কাগজ দিয়ে তৈরী ফ্লাইং সসারের চারপাশে ছোট ছোট ক্রিসমাসের লাইট ছন্দবদ্ধ ভাবে জ্বলছে নিভছে । কালো রং এর একটা  লেখা একপাশে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।

টেডের দিকে ঘুরে হুবার্ট বললেন, ‘ও হো, মিঃ লুপিন ইচ্ছে না থাকলেও বলতে বাধ্য হচ্ছি তুমি আবার রকেট বানান ভুল লিখেছো। এটা খুবই বিশ্রী ব্যাপার।’

 

 

[চলবে]

লেখক পরিচিতিঃ  জর্জ নরম্যান লিপার্ট আমেরিকান লেখক এবং কম্পিউটার অ্যানিমেটর। তবে ওনার বর্তমান পরিচয় উনি জেমস পটার সিরিজের লেখক। যে কারনে ওনাকে “আমেরিকান রাউলিং” নামেও ডাকা হয়ে থাকে। এই সিরিজের প্রথম লেখা “জেমস পটার অ্যান্ড দ্য হল অফ এল্ডারস ক্রসিং” প্রকাশিত হয় ২০০৭ সালে। নানান কারনে এটি অনেক বিতর্কে জড়িয়ে যায়। সেসব সমস্যা পেরিয়ে আজ এটি পাঠক পাঠিকাদের চাহিদায় সারা বিশ্বে যথেষ্ট জনপ্রিয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য এই সিরিজের সব কটি বই ই-বুক এবং ফ্রি হিসাবেই প্রকাশ করেছেন মাননীয় জর্জ নরম্যান লিপারট। এই সিরিজ ছাড়াও ওনার আরো ১২ টি বই আছে। বর্তমানে উনি এরি, পেনসিল্ভ্যানিয়ার বাসিন্দা।

অনুবাদকের পরিচিতিঃ উপন্যাসটির অনুবাদক প্রতিম দাস মূলত চিত্র শিল্পী, ২০১৩ সাল থেকে ভারতের সমস্ত পাখি আঁকার লক্ষ্য নিয়ে কাজ চলছেন। ৭৭৫+ প্রজাতির ছবি আঁকা সম্পূর্ণ হয়েছে। তবে শুধু পাখি নয় অন্যান্য বিষয়েও ছবি আঁকা চলে একইসঙ্গে। দারুণ রকমের পাঠক, যা পান তাই পড়েন ধরনের। প্রিয় বিষয় রূপকথা, ফ্যান্টাসী, সায়েন্স ফিকশন, অলৌকিক। টুকটাক গল্প লেখার সঙ্গে আছে অনুবাদের শখ। 

Tags: জর্জ নরম্যান লিপারট, জেমস পটার অ্যান্ড দ্য হল অফ এল্ডারস ক্রসিং, জেমস পটার এ্যান্ড দ্য হল অফ এল্ডারস ক্রসিং, ধারাবাহিক অনুবাদ গল্প, ধারাবাহিক উপন্যাস, প্রতিম দাস, সুদীপ দেব

One thought on “জেমস পটার অ্যান্ড দ্য হল অফ এল্ডারস ক্রসিং – পার্ট ১৯

  • Ibrahim Liman

    অসংখ্য ধন্যবাদ পার্থ প্রতিম দাস এবং কল্পবিজ্ঞান টিমকে James Potter and The hall of elders crossing এর জন্য

    Reply

Leave a Reply

Connect with

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

error: Content is protected !!
Verified by MonsterInsights