নন-ফিকশনঃ রামচন্দ্র চ্যাটার্জি – অতনু প্রজ্ঞান বন্দ্যোপাধ্যায়ঃ উত্তরাধিকারঃ ওয়েব সাহিত্য পুরস্কার ২০১৭
রামচন্দ্র চ্যাটার্জি
অতনু প্রজ্ঞান বন্দ্যোপাধ্যায়
উনিশ শতকের শেষ দিকে রবি ঠাকুর যখন স্টিমারে চড়ে ভেসে পড়েছেন শিলাইদহের জমিদারি সামলাতে, ঠিক সেই বছর কোলকাতায় এসে পৌঁছলেন জগৎবিদিত বেলুনবিদ্ স্পেন্সার সাহেব। বেলুনে চড়ে আকাশ পরিভ্রমণ করে প্যারাশুটে মাটিতে নেমে আসাই ছিল বিলাত থেকে কোলকাতার মাটিতে আসার উদ্দেশ্য। গ্রীষ্মের এক বিকেলে গিজগিজে দর্শকবৃন্দের অবাক চোখের সামনে দিয়ে এই স্পেন্সার সাহেব হাইড্রোজেন ভর্তি একটি বেলুনে চড়ে আকাশে উঠতে লাগলেন। আর সরলভাবে উঠতে উঠতে এতটাই ওপরে উঠে পড়লেন যে বেলুনটিকে একটি বিন্দুর মত লাগছিল দর্শকদের আর প্যারাশুটটিকে মনে হচ্ছিল একফালি ন্যাকড়া ওই বিন্দু থেকে ঝুলছে!
দর্শকদের মধ্যে সেদিন দাঁড়িয়ে ছিলেন শিমুলিয়া অঞ্চলের কাঁসারিপাড়ার এক সাহসী বাঙালি। নাম রামচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। ইনি ছিলেন চিৎপুর রোডে নর্মান স্কুলের জিমন্যাষ্টিকের মাস্টার। সেদিন আর পাঁচজন দর্শকের মতই অবাক হয়ে দেখছিলেন পাঁচ ছ’হাজার ফুট ওপরে উঠে সাহেব বেলুনটিকে দোলাচ্ছে! আর তারপর প্যারাশুট ধরে ঝুলে পড়লেন! রামচন্দ্র লক্ষ করলেন দেড়শো ফুটখানেক নেমে যাওয়ার পরে সেই প্যারাশুটের ছাতা খুলে গেল আর সাহেব মাটিতে নেমে এলেন সেই ছাতা ধরে।
কোলকাতায় হইহই রইরই পড়ে গেল এই কেরামতি নিয়ে। এই ঘটনা ভীষণ নাড়া দিল রামচন্দ্রকে। শিষ্যত্ব নিলেন ওই বৃটিশ সাহেবের। পাঁচশো টাকা গুরুদক্ষিণায় এই বেলুনবিদ্যা রপ্ত করলেন রামচন্দ্র। তারপর প্রথম দেশি মানুষ হিসেবে নারকেলডাঙা প্রাঙ্গণে হাজার আটেক জুলজুলে চোখের সামনে একদিন বিকেলে পাঁচটা নাগাদ চড়ে বসলেন বেলুনে। সাদা স্যুট পরিহিত রামবাবু গলায় দূরবীন ঝুলিয়ে জনতার উদ্দেশ্যে টুপি নাড়াতে নাড়াতে ওপরে উঠতে লাগলেন। বেলুন উড়তে উড়তে একটু বেশিই ওপরে উঠে গেল। উপস্থিত বিজ্ঞানমনস্ক কেউ কেউ গম্ভীরমুখে বললেন রামবাবু আর নামতে পারবেন না ওখান থেকে। জীবন্ত অবস্থায় ওই বায়ুস্তর থেকে নামা অসম্ভব!
দর্শকের মুখ চুণ। সাহসী এই বাঙালি এভাবে হেরে যাবে! অনেকে চোখে দূরবিন রেখেছে। দেখা গেল বেলুনটি ক্রমাগত পাক খাচ্ছে। কিন্তু প্যারাশুট খুলছে না! এক একবার পাক খেতে খেতে গোঁত্তা খেয়ে পঞ্চাশ-ষাট হাত নেমে আসছে, আবার ওপরে উঠে যাচ্ছে। কিন্তু প্যারাশুট খোলার নাম নেই।
অবশেষে একসময় প্যারাশুট খুলে গেল। দর্শক আনন্দে হাততালি দিয়ে উঠল। আওয়াজ উঠল, ‘জয় রামবাবুকী জয়।’ আস্তে আস্তে প্যারাশুট নেমে এল। বেলুনে চড়ার আধঘন্টাখানেক পরে সোদপুর থেকে মাইল দুয়েক দূরে নাটাগড় নামক স্থানে অবতরণ করলেন রামবাবু। পরিচিত লোকজন দৌড়ে গিয়ে শরবত খাইয়ে ওঁকে সুস্থির করলেন খানিক। তারপর জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এত দেরি করলেন কেন বেলুন থেকে প্যারাস্যুটে লাফাতে?’ উনি ঠোঁটে লেগে থাকা শরবত হাত দিয়ে মুছে বললেন, ‘আরে ভায়া আর বোলো না, যতবার নামতে যাই মনের ভেতর কেমন কেমন করে ওঠে। হাত সরিয়ে নিই প্যারাস্যুটের দড়ি থেকে। যখন দেখলাম অনেক বেশিই উঠে গেছি, তখন ‘জয় মা’ বলে ঝাঁপিয়ে পড়লাম।’
তাঁর এই অবিশ্বাস্য ভ্রমণের কথা ১১ই মে’র ‘দ্য বেঙ্গলি’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। (সঙ্গে তাঁর বালুন অভিযানের একটা সমসাময়িক উডকাটের ছবি দেয়া হল) এরপর এই বেলুন নিয়ে উনি ভারতের নানা যায়গায় ঘুরে ঘুরে কেরামতি দেখান ও রাজা মহারাজা ও দর্শকদের প্রশংসা পান।
বেলুন খেলার পাশাপাশি ওঁর মাথায় চিড়বিড় করছিল আরো একটি ভাবনা। বললেন, এবারে বাঘের সঙ্গে লড়াই করতে হবে। যে সে বাঘ নয়, রয়েল বেঙ্গল টাইগার। কোত্থেকে একটা বাঘ জোগাড় করে খেল দেখালেন পাথুরেঘাটার রাজবাড়িতে। সাহেবরা খেলা দেখাত লোহার খাঁচায় বাঘের দুপাশে বন্দুক নিয়ে দাঁড়িয়ে যাতে বাঘ বেগড়বাই হলে ব্যবস্থা নেওয়া যায়। রামবাবু ঠিক করলেন খোলা উঠোনেই দেখাবেন তাঁর কেরামতি। ছোট একটা খাঁচায় বাঘটাকে আনা হল। চড়থাপ্পড় মেরে বেশ বাগে আনলেন বাঘটাকে। খেলা দেখিয়ে দর্শকের হাততালি কুড়িয়ে আবার খাঁচায় পুরে দিলেন বাঘটিকে।
শোনা যায় একসময় উনি হিমালয়ে চলে গেছিলেন সব কিছু ছেড়ে ছুড়ে। বাকি জীবনটা তপস্যায় কাটিয়ে দিতে। নাটকীয়তা আর ঘটনায় ভরা অসীম সাহসী এই বাঙালির মৃত্যু বড় করুণ। বেলুনে চড়েই সারা ভারতের মানুষের মন জয় করেছেন উনি, আবার এই বেলুনই মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয় ওঁকে। বেলুনে উড়ে যাওয়া অবস্থায় একটি পাহাড়ে ধাক্কা লাগে তাঁর ও গুরুতর আহত হন। ১৮৯২ এর ৯ই আগষ্ট এই অ্যাডভেঞ্চার প্রিয় বাঙালি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।