ডিজাইন বায়াস
লেখক: অভিজ্ঞান রায়চৌধুরী
শিল্পী: টিম কল্পবিশ্ব
‘একটা ব্যক্তিগত সমস্যার জন্য সায়াকা মুরাটা আজ এখানে আসতে পারেননি। আমরা এজন্য খুব দুঃখিত।’
বিখ্যাত প্রকাশনা সংস্থার দিক থেকে এই ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে হলে যেন স্কুল ছুটির মতো শোরগোল শুরু হয়ে গেল।
‘কেন? থাকতে পারবেন না কেন? ওঁর বই এর প্রেস রিলিজ, আর উনি থাকবেন না!’ নিউইয়র্ক টাইমসের সাংবাদিক বলে উঠল।
‘একটা আকস্মিক দুর্ঘটনার জন্য উনি আসতে পারেননি। এজন্য উনি খুব দুঃখিত। তবে…’
পুরো কথা সম্পূর্ণ করার সুযোগ পেলেন না সেই প্রকাশনা সংস্থার মুখপাত্র।
‘ডেইলি মেল’ এর একজন সাংবাদিক এর মধ্যেই চেঁচিয়ে বলে উঠলেন— ‘সেক্ষেত্রে লেখিকার অবর্তমানে বইপ্রকাশ করা উচিত হয়নি। আপনাদের পিছিয়ে দেওয়া উচিত ছিল এই অনুষ্ঠান।’
‘আপনারা একটু ধৈর্য ধরুন, আমাদের বলতে দিন।’ বিখ্যাত প্রকাশনা সংস্থার মুখপাত্র ফের বলে উঠলেন।
কিন্তু তার কথায় ফের বাধা এল। ওয়াশিংটন টাইমসের একজন প্রবীণ সাংবাদিক যিনি খুব ভদ্রলোক বলে পরিচিত, বলে উঠলেন—
‘দেখুন, গত এক বছর ধরেই আমরা সবাই লেখিকাকে সামনে পাব বলে অপেক্ষা করছি। তার জন্য দিন গুনছি। সেখানে উনি যে এবারেও থাকবেন না, এটা আপনাদের আগে জানানো উচিত ছিল। অথবা সঙ্গে সঙ্গে এই ইভেন্ট ক্যান্সেল করে দেওয়া ঠিক ছিল। ওঁর সময় খুব মূল্যবান হতে পারে, কিন্তু আমরাও এখানে সব বিখ্যাত পত্রপত্রিকা-কাগজের তরফ থেকে এসেছি। আমাদের সময়েরও দাম আছে। বিশেষ করে এটা আগে বলা হয়নি যে ওঁর বই প্রকাশের সময় উনি থাকবেন না। তা ছাড়া আমাদের প্রশ্নগুলো, পাঠকদের প্রশ্নগুলো তো ওঁর কাছেই, লেখিকার অবর্তমানে কে তার উত্তর দেবেন?’
এবারে সেই বিখ্যাত প্রকাশনা সংস্থার ম্যানেজিং ডিরেক্টার স্টিফেন লেনক্স পরিস্থিতি সামলাতে নিজে উঠে দাঁড়ালেন।
‘আমরা ভুল কিছু বলিনি। উনি থাকবেন। তবে একদম শেষ মুহূর্তে কিছু অসুবিধে হওয়ায় উনি এখানে থাকতে পারছেন না। উনি ফোনে আছেন। দরকার মতো আপনাদের প্রশ্নের উত্তর দেবেন।’
এবারে শোরগোল চিৎকার একটু কমল। প্রেস রিলিজে উপস্থিত সাংবাদিকদের ও বিশ্বজোড়া ফ্যানক্লাবগুলোর থেকে আসা বিশেষ কিছু পাঠকের হতাশ হওয়ার কারণ আছে।
স্টেজে সায়াকা নেই। সেই সায়াকা মুরাটা, যার প্রথম বই বেরোনোর দশ দিনের মধ্যে সারা বিশ্বে দশ কোটি বই বিক্রি হয়েছিল। গত দেড় বছরে সে সংখ্যা পঞ্চাশ কোটি ছাড়িয়ে গেছে, যা ইতিহাসে আগে কখনও হয়নি। প্রথম বই প্রকাশের পরেই এমন জায়গায় পৌঁছে গেছে, যেখানে বলা যায় বাইবেল ছাড়া আর কোনও বই এত বিক্রি হয়নি।
সায়াকা মুরাটার মুখের সঙ্গে পরিচিতি সারা বিশ্বের যে কোনও বইপ্রেমীর। সেই হাসিমাখা জুলজুলে ছোট চোখ। একটু চাপা নাক। কাঁধ অব্দি চুল। দেখে মনে হয় বয়স তিরিশের কাছাকাছি হবে। যদিও কখনও সামনে থেকে সায়াকা মুরাটাকে দেখা যায়নি। বই-এর ছবির বাইরে উনি কখনও ক্যামেরার সামনে আসেনি।
শোনা গেছে উনি প্রেস বা পাঠকের সামনে আসতে চান না। নিভৃতে সাহিত্যসাধনা করতে পছন্দ করেন। এমন কী সায়াকা ভেবে অন্য কোনও মহিলার পিছনে ধাওয়া করেছে পাঠকের দল, এরকম কিছু ঘটনাও নানান জায়গায় হয়েছে।
এই বই প্রকাশ অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণ পেতেও অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। এমন কী অনেক নামি সংবাদপত্রের সাংবাদিকও এখানে আসার আমন্ত্রণ পাননি। একটা বড় অংশের কৌতূহলের কেন্দ্রে সায়াকা। রহস্যময়ী সায়াকা। কোথায় সেই সায়াকা?
আবার প্রকাশনা সংস্থার প্রধান স্টিফেন বলে উঠলেন— ‘এবার বইপ্রকাশে ফিরে আসি। এটা সায়াকার লেখা দ্বিতীয় বই।’
কিন্তু কথাটা শেষ হল না। চিৎকার চেঁচামেচি চলতেই থাকল। স্টিফেন বেশ জাঁদরেল প্রকৃতির লোক। কিন্তু তার পক্ষেও এখন আর হলের শৃঙ্খলারক্ষা আর সম্ভব নয়। পুলিসের সাহায্যে প্রায় আধঘণ্টা বাদে ফের বলার সুযোগ পেলেন।
ফের বলে উঠলেন— ‘এবারে সায়াকার লেখা দ্বিতীয় বই ‘শেষ রাত’। যার কিছু কিছু অংশ আমরা ইতিমধ্যে বই এর প্রমোশনের জন্য রিলিজ করেছি বিভিন্ন মিডিয়াতে। এই বইয়ের মূল উপজীব্য গ্লোবাল ওয়ারমিং। তার উপরে নির্ভর করে এই বিশ্বব্যাপী থ্রিলার। গ্লোবাল ওয়ারমিং কমানোর জন্য স্ট্রাটোস্ফিয়ার-এ ছড়িয়ে দেওয়া সালফেট কণার মাধ্যমে সূর্যের আলো বিক্ষিপ্ত করে জিও ইঞ্জিনিয়ারিং, কেসলার সিনড্রোম, সন্ত্রাসবাদ ও এসবকে কেন্দ্র করে বিশ্বরাজনীতির একটা বড় ভূমিকা আছে উপন্যাসে। তবে সেসব ছাপিয়ে এই উপন্যাস কিছু পরিবেশপ্রেমীর আপ্রাণ চেষ্টার গল্প যাতে পৃথিবী আগামীদিনেও বাসযোগ্য থাকে। এই দ্বিতীয় উপন্যাসের কেন্দ্রেও প্রথম উপন্যাসের মূল দুই চরিত্র ম্যাক্স ও সারা আছে। তবে যাই বলি না কেন এক্সপেক্ট দ্য আনএক্সপেক্টেড ইন এভরি চ্যাপ্টার। প্রথম উপন্যাসের মতোই এই বইয়ের প্রত্যেকটা চ্যাপ্টার যেন এক অচেনা গুহা থেকে আরেক অচেনা গুহায় যাত্রা, যেখানে অপ্রত্যাশিত অনেক কিছু অপেক্ষা করে আছে। এবারে কিছু প্রশ্ন থাকলে আমরা তা নিতে পারি।’
পিছনে বিশাল স্ক্রিনে এতক্ষণে উপন্যাসের কিছু কথা-লাইন-কথোপকথন ফুটে উঠছে, কিছু ঘটনার ছোট ছোট ভিডিয়ো। সায়াকার ছবি।
‘আচ্ছা কেসলার সিনড্রোম কী?’ একজন সাংবাদিক প্রশ্ন করে উঠলেন।
‘লোয়ার আর্থ অরবিটে ইচ্ছে করে অ্যান্টি-স্যাটেলাইট ক্ষেপনাস্ত্র দিয়ে বিস্ফোরণের সাহায্যে স্পেসডেব্রি তৈরি করতে পারলে বা বেশ কিছু ভাঙ্গা টুকরো তৈরি করতে পারলে, তখন একটার পর একটা স্যাটেলাইট এদের সঙ্গে ধাক্কা খাবে। এভাবে পুরো স্যাটেলাইট ব্যবস্থা অচল করে দেওয়া যেতে পারে। সেটাই কেসলার সিনড্রোম, যা নিখুঁতভাবে তুলে ধরা হয়েছে উপন্যাসের এক অংশে যার জন্য সন্ত্রাসবাদীদের উপরে পুরো নজরদারিই বন্ধ হয়ে যাবে। আমরা আজ প্রতি স্কোয়ার মাইলে যেভাবে নজরদারি চালাতে পারি, সে ব্যবস্থা ভেঙে পড়লে কী কী সম্ভব, সেটা নিশ্চয়ই বলে দিতে হবে না। যাই হোক এর বেশি কিছু বলব না। বাকিটা পড়ার জন্য। প্রতি পাতায় চমকের জন্য। একই সঙ্গে বিশ্বের দুশো তিরিশটা দেশে আগামীকাল এ বই পাওয়া যাবে। পঞ্চান্নটা ভাষায় অনুদিত এই বই পাওয়া যাবে যা আগে কখনও কোন বই এর ক্ষেত্রে হয়নি।’
‘আচ্ছা, আগের বারের মতো এবারেও কী জামাল আছে?’ একজন সাংবাদিক হঠাৎ প্রশ্ন করে উঠলেন।
‘হ্যাঁ, অবশ্যই। ও এবারেও আছে। ও তো এই উপন্যাসের একটা বড় আকর্ষণ।’
‘ঠিক এখানেই আমার আপত্তি।’ সেই সাংবাদিক এবারে উত্তেজিত হয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন।
‘আপত্তি? কীসের আপত্তি?’
‘জামাল কৃষ্ণাঙ্গ। কেন জামালকে কৃষ্ণাঙ্গ করা হয়েছে জানতে চাই?’
‘এ কীরকম অদ্ভুত প্রশ্ন। লেখার প্রয়োজনে লেখিকা লিখেছেন।’
‘কিন্তু এখানেই খেয়াল করবেন, ম্যাক্স, সারা শ্বেতাঙ্গ। তাদের ভালো ভদ্রমানুষ হিসেবে দেখানো হয়েছে। ঠিক তেমনই আগের উপন্যাসে জামালের মতো কৃষ্ণাঙ্গদের সন্ত্রাসবাদী, খারাপ মানুষ হিসেবে দেখানো হয়েছে।’
এবারে সাংবাদিকদের মতো ফের গুঞ্জন শুরু হয়ে গেল।
বেশ অস্বস্তিতে পড়ে গেলেন প্রকাশনা সংস্থার প্রধান স্টিফেন।
এবারে ওই সাংবাদিক নিজের পরিচয় দিয়ে বলে উঠলেন— ‘আমি ফ্যান্টাস্টিক সায়েন্সের সম্পাদক পল। খোঁজ নিয়ে দেখবেন গত এক বছরে বহু জামাল হেনস্থার শিকার হয়েছে শুধু এই লেখার জন্যে। আগের উপন্যাস জনপ্রিয় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের মনে আরও খারাপ ধারণা হয়েছে কৃষ্ণাঙ্গ মানুষদের জন্য। শুধু তাই নয় একটা নামি ফুড-রিটেলার জামাল নামের এক ব্যক্তির বাড়িতে ডেলিভারি দিতেও অস্বীকার করে। এটাও নিশ্চয়ই আপনি জানেন। এবারের সন্ত্রাসবাদীরাও ঠিক নিশ্চয়ই আগের বারের মতোই ইসালামিক সন্ত্রাসবাদী। ঠিক কিনা! সে ব্যাপারেও আপনি কী বলবেন!’
স্টিফেন এরকম কঠিন পরিস্থিতিতে আগে কোনওদিন পড়েননি। গলা খাঁকরে বলে উঠলেন— ‘প্রত্যেক লেখকের স্বাধীনতা থাকে তার নিজের মত প্রকাশের, তার লেখার প্রয়োজনমতো চরিত্র সৃষ্টি করার। একজন প্রকাশক হিসেবে আমি তাকে সে স্বাধীনতা দিতে বাধ্য। তা ছাড়া আমার ধারণা লেখিকা কোনওরকমভাবে ধর্ম বা বর্ণের ভিত্তিতে কোনও পক্ষপাত দেখাননি।’
‘সেটা রক্তমাংসের লেখিকা হলে আমি মেনে নিতে পারতাম। কিন্তু এক্ষেত্রে সেরকম নয়, তাই না? এক্ষেত্রে লেখিকা তো আপনাদের তৈরি প্রোগ্রাম, তাই না?’
প্রশ্নটা করা মাত্র মনে হল কেউ যেন হলে একটা বোমা ফাটিয়েছে। কয়েক মুহূর্ত নীরবতা, তারপরেই প্রশ্নের অর্থ বুঝে রীতিমতো শোরগোল শুরু হয়ে গেল পুরো হলে।
বেশ কয়েকজন উঠে দাঁড়িয়ে আবার প্রশ্ন করে উঠল— ‘সায়াকাকে দেখতে চাই। ভিডিয়ো কনফারেন্সে সামনে আসার কী অসুবিধে থাকতে পারে! কে তিনি! কেন তিনি সবার থেকে দূরে সরে থাকেন।’
বেশ কিছু প্রশ্ন উঠে আসতে লাগল। চূড়ান্ত বিশৃংখলা শুরু হয়ে গেল হলের মধ্যে।
চারদিকে তখন শুধুই একটা নাম শুধুই সায়াকা, কে সায়াকা! তিনি না থেকেও সব আলোচনার মধ্যমণি।
ফের বলে উঠলেন সাংবাদিক পল— ‘আমি অনুসন্ধান চালিয়ে খবর পেয়েছি সায়াকা মুরাটা মানুষ নয়। একটা প্রোগ্রাম, একটা আর্টিফিসিয়াল ইনটেলিজেন্স দ্বারা পরিচালিত প্রোগ্রাম। সেজন্য সায়াকা কোথায় কী পড়েছেন, কোথায় থেকেছেন— এসব কিছুই জানা যায় না। এমনি কী যে আইল্যান্ডে উনি থাকেন, সেখানেও যে উনি থাকেন না সে খবর আমরা তদন্ত করে পেয়েছি। সায়াকা শুধুই একটা প্রোগ্রাম। এমন এক প্রোগ্রাম যে মানুষের থেকেও ভালো লিখতে পারে। মানুষের মন বুঝতে পারে। সে জন্যই এরকম প্রোগ্রাম একটা ‘ডিজাইন বায়াস’ বা পক্ষপাতদুষ্টভাবে তৈরি করা হয়েছে। বই মূলত পড়ে সাদা চামড়ার মানুষ। তাদের হাতেই টাকা। তাই তাদের কথা ভেবে কৃষ্ণাঙ্গ মানুষদের ‘ভিলেন’ করা হয়েছে উপন্যাসে। সেভাবে এই প্রোগ্রামকে বিশেষ ডেটার ভিত্তিতে ডিপ লার্নিং এর সাহায্যে ট্রেন করা হয়েছে, যাতে সেভাবে এই প্রোগ্রাম মানুষকে দেখতে শুরু করে, যাতে ব্যাবসার সুবিধে হয়।’
একটু থেমে পল আবার অন্যদের জন্য জ্ঞান জাহির করলেন— ‘ঠিক যেভাবে গাড়ির সিটবেল্ট ডিজাইন করার সময় সেখানে শুধু সাদা পুরুষ মানুষের কথা মাথায় রেখে গত একশো বছর ধরে ডিজাইন করা হয়েছে। মেয়েদের কথা ভেবে সিটবেল্ট ডিজাইন হয়নি,এমন কী ভালো চেহারার কৃষ্ণাঙ্গ মানুষদের কথা ভেবেও গাড়ির সিটবেল্ট ডিজাইন করা হয়নি। ফোন এশিয়ান মানুষদের হাতের মাপ অনুযায়ী তৈরি করা হয়নি বা মহিলাদের কথা ভেবেও ডিজাইন করা হয়নি। এসবের পিছনেই থাকে ডিজাইন বায়াস। এখানেও ঠিক একইভাবে একটা ‘ডিজাইন বায়াস’ জোর করে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে একটা আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্সের প্রোগ্রামের মধ্যে যাতে তা পাঠকদের খুশি করতে পারে।’
স্টিফেন এবার বাধ্য হয়ে বলে উঠলেন— ‘আচ্ছা, আপনি প্রশ্ন করছেন। তারপরে কোনও কিছুই বলার সুযোগ না দিয়ে বলে যাচ্ছেন। আমাকে বলতে দিন অন্তত। হ্যাঁ, আমি এটা আজ স্বীকার করতে বাধ্য হচ্ছি যে সায়াকা মুরাটা কোনও মানুষ নয়, কোনও মহিলা নয়। হয়তো আগামী দিনে এটা আমরা বলতাম। আমরা চাইছিলাম এই সারপ্রাইজটা, এই চমকটা কোনওদিন বই এর মার্কেটিং এর জন্য ব্যবহার করতে। কিন্তু এখন সামনে এসে গেছে বলে স্বীকার করে নিচ্ছি যে সায়াকা আমাদের বিজ্ঞানীদের তৈরি করা একটা অসামান্য প্রোগ্রাম যে নিজের থেকে অসাধারণ উপন্যাস-গল্প লিখতে পারে। তবে একই সঙ্গে জোর দিয়ে বলছি এরকম কোনও ডিজাইন বায়াস আমাদের প্রোগ্রামে নেই। সবরকম রেলিভ্যান্ট ইনফরমেশন এর ভিত্তিতে ওই প্রোগ্রাম প্লট ভাবে, চরিত্র ভাবে, নিজস্ব ভাষায় উপন্যাস লেখে। গল্প কীভাবে আকর্ষণীয় করা যায় সে বিষয় ওই প্রোগ্রাম আমাদের মতোই ভাবে।
‘কিন্তু এসব কাকতালীয়ভাবে কিছু ধারণার সঙ্গে মিলে যেতে পারে না। প্রথম বইতেই দেখেছি, এমনভাবে লেখা যেন সাদা মানুষ অনেক বেশি বিশ্বাসযোগ্য। যেখানেই খারাপ লোক, সেখানে তারা হয় কালো বা মুসলিম। উপন্যাসে যতজন সায়েন্টিস্ট তাদের সবার রং সাদা, বা তারা ভারতীয় বা ইউরোপিয়ান। কিন্তু তারা কেউ আফ্রিকান নন। খেয়াল করুন একজনও নয়। মেয়েদের ভূমিকা উপন্যাসে খুব কম। ষোলজন বিজ্ঞানী চরিত্রের মধ্যে মাত্র দুজন মহিলা। এসবই ডিজাইন বায়াস। এমন কী ফ্রেড্রিক যে কিনা এলজিবিটি কমিউনিটির লোক তাকেও নেগেটিভভাবে প্রোজেক্ট করা হয়েছে। সে তাই ড্রাগ বেঁচে। এসব ইনপুট বায়াস, একটা পক্ষপাতদুষ্ট দৃষ্টিভঙ্গী একধরনের আউটপুট বায়াসের জায়গা তৈরি করেছে। সেজন্য এই প্রোগ্রাম ভাবতেই পারে না যে মহিলারা লিডারশিপ রোলে থাকতে পারে বা কৃষ্ণাঙ্গ মানুষরা পড়াশোনায় ভালো হতে পারে বা বিজ্ঞানী হতে পারে। এবারে ভাবুন, এই দ্বিতীয় বই যদি আরও পঞ্চাশ কোটি পাঠক পড়ে, তাদের মধ্যেও কীভাবে এ বিষয়ে বিশ্বাস গড়ে উঠবে। তারা ভাববে সন্ত্রাসবাদীরা শুধু একটা বিশেষ ধর্ম থেকেই হয়, শুধু মধ্য এশিয়া থেকেই হয়, তারা ভাববে পাকিস্থান, আফগানিস্থান, ইরাক, সিরিয়া মানেই খারাপ লোক, যারা হিংসা আর দুর্নীতি ছাড়া অন্য কিছু বোঝে না।’
পুরো হলে আবার এমন চিৎকার প্রতিবাদ শুরু হয়ে গেল যে তার মধ্যে স্টিফেনের পক্ষে কিছুই বলা সম্ভব হচ্ছিল না। একজন আবার জুতো খুলে ছুড়ে মারলেন স্টেজের দিকে। বেশ কিছু পুলিস দেহরক্ষী নেমে পড়ল কাজে, শৃংখলারক্ষার কাজে।
আবার বেশ খানিকক্ষণ লাগল পরিস্থিতি শান্ত হতে।
পুরো সময় স্টিফেন চুপ করে অসহায়ভাবে দাঁড়িয়ে ছিলেন। পরিস্থিতি শান্ত হলে সেই সাংবাদিক পলকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলেন— ‘দেখুন আমার মনে হয় আপনি বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে এই অনুষ্ঠান যাতে বন্ধ হয়, তার জন্য এসেছেন। হয়তো আপনি ফসিল ফুয়েল লবি বা ম্যানুফাকচারিং লবির লোক, তাই চান না গ্লোবাল ওয়ারমিং- এর বিপদের কথা সাধারণে জানুক। এরকম আকর্ষণীয় লেখা তাদের মনে আরও সচেতনতা গড়ে তুলুক, যাতে কিছু সংস্থা নিয়মভেঙ্গে পরিবেশের আরও ক্ষতি করতে পারে। সবার আগে আমি বলব নতুন বইটা পড়ুন, পড়ে তারপরে এসব কথা বলবেন।’
‘কিন্তু তার আগেই যে সে বই আরও পঞ্চাশ কোটি মানুষকে ভুল পথে নিয়ে যাবে, তাদের মধ্যে ভুল বিশ্বাস গড়ে তুলবে। আপনি চেয়েছেন আপনার বই এর টার্গেট সেগমেন্ট অনুযায়ী পাঠকদের খুশি করতে। অন্যদের সম্বন্ধে খারাপ ধারণা তৈরি করতে। সেজন্য প্রথম বই এত সফল। আমি সরাসরি এ ব্যাপারে সেই লেখিকার মুখ থেকেই শুনতে চাই।’
‘মানে? বললাম তো সে এক প্রোগ্রাম।’
‘সেই প্রোগ্রাম যদি একটা উপন্যাস লেখার মতো উন্নত হয়, তাহলে সে নিশ্চয়ই আমার এই সহজ প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবে। আমি জানতে চাই তার কাছে যে তার মধ্যে কোনও পূর্বধারণা বা পক্ষপাত গড়ে উঠেছে কিনা!’
প্রথমে ‘না’ বললেও শেষে স্টিফেন বাধ্য হলেন সে অনুরোধ রাখতে। অবশ্য তাকে অনুরোধ না বলে দাবী বলাই ভালো। একটা কম্পিউটারকে সামনে নিয়ে আসা হল। পল ইতিমধ্যেই বলে দিয়েছেন যে তিনিই সায়াকাকে প্রশ্ন করবেন। স্টিফেন নয়। সেজন্য স্টেজে পলকে নিয়ে আসা হল।
তারপরে পল সেই কম্পিউটারকে প্রশ্ন করে উঠলেন – ‘আপনার নাম?’
‘আমার নাম সায়াকা মুরাটা। সাহিত্যিক সায়াকা মুরাটা।’
‘তুমি কী সব মানুষকে সমান চোখে দেখ? তোমার মধ্যে কী কোন ধরনের মানুষের বিরুদ্ধে খারাপ ধারণা আছে বা কারো প্রতি কোনও পক্ষপাত আছে?’
খানিকক্ষণ সব চুপ, পুরো হলে পিনড্রপ সাইলেন্স।
তারপরে আবার সেই যান্ত্রিক মহিলাকণ্ঠে উত্তর শোনা গেল, ‘আমার কাছে সব মানুষ সমান নয়। কারণ তথ্য আমাকে যা শেখায়, আমি সেভাবে ভাবি, সেভাবে মানুষ সম্বন্ধে ধারণা করি। যদি দেখি সন্ত্রাসবাদীদের ৯৯.১ শতাংশ কোনও এক বিশেষ ধর্মের থেকে হয়, তাহলে আমার উপন্যাসে সে ধরনের চরিত্র তৈরি করার সময় ৯৯.১ শতাংশ ক্ষেত্রে সে ধর্মের মানুষ থেকেই আমি বেছে নেব। এটাই স্বাভাবিক। আমি যদি দেখি বিশেষ কিছু দেশ থেকে সন্ত্রাসবাদ অন্য দেশে ছড়িয়ে পড়ছে ৯৮.৭ শতাংশ ক্ষেত্রে, আমি গল্পের প্রয়োজনে সেইসব দেশেরই নাম রাখব। আমি কী বলব, কী বলব না, কী লিখব, কী লিখব না, তা আমি ইচ্ছে করে সাজাই না। কারণ আমার মধ্যে সত্যি কোনও পক্ষপাত নেই। এমন কোনও পক্ষপাত নেই যার জন্য তথ্যের বাইরে গিয়ে অন্য কোনও কথা বলব। আমার উপন্যাসে একশো মিটার দৌড়ে যে বিজয়ীর কথা আছে সে কিন্তু কিনিয়ার কৃষ্ণাঙ্গ মানুষ, কারণ সেটাই হওয়ার সম্ভাবনা ৯৩.১ শতাংশ। আমি তথ্যের উপরে দাঁড়িয়ে যে সাহস দেখাতে পারি, হয়তো মানুষ তাদের লেখাতে সে সাহস দেখাতে পারে না কারণ তারা প্রমাণ করতে চায় যে তাদের কোনও বায়াস নেই। তারা তাই সেভাবে সেটা প্রকাশ করে না। আমার মধ্যে সেই বিভ্রান্তি বা হিপোক্রাসি নেই।’
হলের মধ্যে ফের প্রচুর চিৎকার চেঁচামেচি শুরু হয়ে গেল। একদল সাংবাদিক স্টেজের উপরে ওঠার চেষ্টা করলেন। কয়েকজন কম্পিউটার ভাঙার জন্য উপরে ওঠার চেষ্টা করলেন। নিরাপত্তারক্ষীরা ইতিমধ্যে ধাক্কা দিয়ে কিছু সাংবাদিককে ফেলে দিচ্ছিলেন বা বাইরে ধাক্কা দিতে দিতে নিয়ে যাচ্ছিলেন।
বাধ্য হয়ে স্টিফেন বইপ্রকাশ অনুষ্ঠান স্থগিত করতে বাধ্য হলেন।
Tags: অভিজ্ঞান রায়চৌধুরী, কল্পবিজ্ঞান গল্প, ষষ্ঠ বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা
অসাধারণ।
Close to my heart ❣️
Interesting.
The Story is not merely an fiction, but a nearly truth.
অসাধারণ লেখা । যন্ত্র কখনো মানুষের মতো আত্মপ্রবঞ্চনা করে না ।
অসাধারণ লাগলো। এই ডাটার ওপর ভিত্তি করে সত্য জাহির করে unbiased থাকতে গিয়ে প্রচুর বন্ধু হারাচ্ছি। মানুষ আজকাল নিজেকে প্রগতিশীল আধুনিক দেখানোর দায়ে অদ্ভুত এক মিথ্যার ভ্রমে বাঁচতে অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছে। সত্যের পথে থাকলে আর ডিপ্লোম্যাটিক থাকা যায়না। কখনো আলাপচারিতায় বসবো, দাদা। অনেক কিছু জানার আছে, শেখার আছে আপনার থেকে। আপাতত এই গল্পের অভিঘাত আমার মানস জগতে লড়াই করার নতুন উন্মাদনা দিলো, যেন এরকম ভন্ডামির মুখোশ পরা আধুনিক প্রগতিশীল না হতে পারি। খুব ভালো থাকুন, এরকম অসাধারণ লেখা উপহার দিতে থাকুন।