যে মানুষটি রে ব্র্যাডবেরিকে ভুলে গিয়েছিল
লেখক: নিল গেইম্যান, অনুবাদ: দীপ ঘোষ
শিল্পী: টিম কল্পবিশ্ব
আমি অনেক কিছুই ভুলে যাচ্ছি, এ তো খুবই ভয়ের কথা।
আমি ভুলছি নানান শব্দ, যদিও শব্দের ধারণাটা কিন্তু ভুলিনি এখনো। অন্তত আমি আশা করছি যে এখনো ধারণাগুলি আমার মনের মধ্যেই আছে। যদি কোনো কিছুর ধারণা ভুলেই যাই, তবে তা বুঝব কী করে? অন্তত আমি জানি না যে ধারণাগুলোও ভুলে গেছি কিনা।
অথচ আমার স্মৃতিশক্তি বরাবরই বেশ ভালো ছিল, এখন সেটা মনে পড়লে মজাই লাগে। সব যেন আমার মাথার মধ্যে আমি সাজিয়ে রাখতে পারতাম। অনেক সময় তো মনে হত যা আমার এখনো জানার কথা নয় তাও যেন আমি ঠিক মনে করে বসে আছি। ভবিষ্যতের স্মৃতি…
নাহ, এরকম কোনো শব্দ বোধহয় এখনো তৈরি হয়নি। যে সব ঘটনা এখনো ঘটেনি তাদের স্মৃতিচারণা। অনেক সময়েই যখন মাথার মধ্যে একটা বিশেষ শব্দ খুঁজতে গিয়ে পাওয়া যায় না তখন একটা অস্বস্তি হয়। কিন্তু এটা ঠিক সেরকম ব্যাপার নয়, এ যেন মাঝরাতে আমার মাথার ভিতর থেকে কেউ শব্দগুলোকে চুরি করে নিয়েছে।
আমি কমবয়সে একটা বড়ো মেসবাড়িতে থাকতাম। তখন আমার ছাত্রজীবন চলছে। রান্নাঘরে আমাদের প্রত্যেকের আলাদা আলাদা তাক থাকত। সেখানে আমাদের নাম পরিষ্কার করে লেখা থাকত। একইরকমভাবে ফ্রিজের মধ্যেও আলাদা তাক বরাদ্দ থাকত, যেখানে আমরা ডিম, দুধ, চিজ বা দই রাখতাম। নিজের জিনিসপত্র ব্যবহার করা আর সাজিয়ে রাখার ব্যাপারে আমি বরাবরই খুঁতখুঁতে ছিলাম। বাকিরা ততটা… ছিল না। ওই দেখুন, আমি একটা শব্দ খুঁজে পাচ্ছি না। এমন একটা শব্দ যার মানে দাঁড়াবে “সবসময় নিয়ম মেনে চলে”। যাই হোক বাড়ির বাকি ছেলেরা তেমন… ছিল না। আমি হয়তো ফ্রিজ খুলে দেখলাম আমার ডিমগুলো হাওয়া হয়ে গেছে।
আমার মাথায় মাঝে মাঝে আকাশ ভরা নানারকম মহাকাশযানের ছবি ভাসে, ঠিক যেন চারিদিক ছেয়ে ফেলা পঙ্গপালের ঝাঁক, ফ্যাকাশে রাত্রির আকাশে যেন উজ্জ্বল রুপোলি বৃষ্টি।
তখন আমার ঘর থেকেও জিনিসপত্র হারিয়ে যেত। আমার বুটজোড়া। আমার মনে পড়ে বুটজোড়া চলে গেল যেদিন। যদিও বলা উচিৎ “হারিয়ে গেল”। কারণ আমি তো সত্যিই বেচারাদের চলে যেতে দেখিনি। বুটজুতোরা উঠে ঘর থেকে নিজে নিজে “চলে যায়” না। কারো সঙ্গে তারা চলে “যায়”। ঠিক আমার বড়ো ডিকশনারিটার মতো। সেই এক বাড়িতে, এক বছরে। আমার মাথার পাশের ছোট্ট বইয়ের তাকটায় ডিকশনারিটা খুঁজতে গেলাম (ঘরের সবকিছুই আসলে আমার খাটের পাশেই ছিল – আমার একার ঘর ছিল বটে, কিন্তু আকারে একটা বড়ো আলমারির বেশি তাকে বলা যায় না)। যাই হোক, আমি হাত বাড়ালাম ডিকশনারিটার জন্যে, কিন্তু সেটা ততক্ষণে কোনো অজানার উদ্দেশে পাড়ি দিয়েছিল। শুধু পিছনে ফেলে গেছিল আমার বইয়ের তাকে ঠিক ডিকশনারিটার সাইজের একটা গর্ত, যা ছিল একমাত্র প্রমাণ আমার ডিকশনারিটার অস্তিত্বের।
আস্তে আস্তে সব বইগুলি আর তাদের মধ্যের শব্দগুলি হারিয়ে যেতে থাকে। পরের মাসে আমি দেখি ওরা আমার রেডিয়োটাও নিয়ে গেছে, শেভিং ক্রিমের টিউবটা, ছোটো নোট রাখার খাতাটা, আর একটা নতুন পেনসিলের বাক্সও। তারপর দইয়ের পাত্রটা, সেটাও নেই আর ফ্রিজে। আর যেদিন কারেন্ট চলে গেল সেদিন বুঝলাম মোমবাতিগুলোও চলে গেছে ওদের সঙ্গে।
এখন আমার মাথায় টেনিস জুতো পরা একটা ছেলের কথা ঘুরছে, যে ভেবেছিল সে চিরকাল এভাবেই দৌড়তে পারবে। নাহ, তাতেও আমি ঠিক খুঁজে পাচ্ছি না কথাটা। হয়তো সেই শুকনো খটখটে শহরটার কথা যেখানে সারা বছর বৃষ্টি হত? অথবা সেই মরুভূমির মাঝের রাস্তাটা, যার উপর ভালোমানুষের পো-রা মরীচিকা দেখতে পেত। ছিল একটা ডাইনোসর যে নাকি সিনেমাও বানাত। আর মরীচিকাটা আসলে ছিল কুবলাই খানের হারেম।
উঁহু, না না…
যখন শব্দগুলো হারিয়ে যায়, আমি মাঝে মাঝে পিছন থেকে গুঁড়ি মেরে ওদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে বন্দি করার চেষ্টা করি। ধরো আমি একটা শব্দ খুঁজছি – যেটা মঙ্গলগ্রহে যারা থাকে তাদের কথা বোঝাবে, আর হঠাৎ করে বুঝলাম যে শব্দটা আর নেই আমার কাছে। তবে আমার মনে আছে যে শব্দটা কোনো বাক্যে বা কোনো বইয়ের নামে ছিল। যেমন দ্য ________ ক্রোনিকলস। অথবা মাই ফেভারিট __________। যদি তাতেও শব্দটাকে ধরতে না পারি, তখন আমি শব্দের ভাবটার চারপাশে চক্কর কাটতে থাকি। ছোটো ছোটো সবুজ মানুষগুলো ছিল যতদূর মনে পড়ে, নাকি লম্বা, কৃষ্ণবর্ণ, শান্তশিষ্ট, হ্যাঁ, কালো গায়ের রঙের আর সোনালি চোখের… আর তক্ষুনি মার্শিয়ান শব্দটা যেন আমার দরজায় কড়া নাড়ল, যেন কত পুরোনো বন্ধু বা প্রেমিক সারা দিনের পরে বাড়ি ফিরল।
রেডিওটাও যখন চলে গেল, আমি বাড়িটা ছাড়তে বাধ্য হলাম। এত মানসিক চাপ আর নেওয়া যাচ্ছিল না, আমার বহুদিন ধরে সযত্নে রক্ষিত একের পর একটা পছন্দের জিনিস, একের পর একটা ব্যবহার্য বস্তু, একের পর একটা অমূল্য দ্রব্য, একের পর একটা শব্দ।
আমার যখন বারো বছর বয়স ছিল তখন একটি বুড়ো মানুষ আমায় একটা গল্প বলেছিল। গল্পটা আজও ভুলিনি।
একজন নিঃস্ব মানুষ জঙ্গলে রাত কাটাতে বাধ্য হয়। তার কাছে কোনো প্রার্থনার বই ছিল না। আর সে কোনো প্রার্থনাও জানত না। সে তাই ভগবানের উদ্দেশে বলল, “তুমি অন্তর্যামী, আমি তোমার প্রতি কোনো প্রার্থনা জানি না। কিন্তু তুমি তো সমস্ত ভক্তের প্রার্থনা জানো। তুমি সর্বশক্তিমান ভগবান। তাই আমি শুধুমাত্র বর্ণগুলি বলে চলেছি, তুমি তোমার মতো সেগুলি দিয়ে প্রার্থনার শব্দ তৈরি করে নাও।
আমার মাথার ভিতর থেকে অনেক কিছু হারিয়ে যাচ্ছে, আর তা ভাবলেই আমার ভয় করছে।
ইকারাস! এই নামটা তো ভুলিনি। ইকারাসকে আমার মনে আছে। বেচারা সূর্যের বড্ড কাছে উড়ে গিয়েছিল। গল্পে কিন্তু ইকারাসের প্রশংসাই করা হয়েছিল। চেষ্টা করার বিকল্প নেই, যদি শেষ পর্যন্ত বিফলতাই আসে, তবুও। যদি শেষে উল্কার মতো চিরকাল ধরেই পতন নিশ্চিত থাকে, তবুও। অন্ধকারে একবারের জন্যেও জ্বলে উঠে অপরকে উদ্দীপ্ত করা, বাঁচার মতো করে একবার বাঁচা, এসব তারা কী বুঝবে? ওই অন্ধকারেই বাঁচে মরে আর অভিসম্পাত দেয় যারা, তাদের দীপশিখাটি হয়তো কেউ ধার নিয়ে আর ফেরত দেয়নি।
যদিও আমি মানুষদেরও হারিয়েছি।
এই অবাক করা ঘটনাটা মাঝে মাঝে ঘটে। এটা সত্যি সত্যি তাদের চলে যাওয়া নয়। যেভাবে কেউ তার বাবা মা-কে হারায়, সেই ভাবেও না। মনে কর তুমি যখন ছোট্টটি ছিলে, ভিড়ের মধ্যে দিয়ে মায়ের হাতটা আঁকড়ে চলছিলে, আর হঠাৎ মুখ তুলে দেখলে, মা কোত্থাও নেই… অথবা অন্যরকম হারিয়ে যাওয়া। যখন তাদের কথা মনে করার জন্যে তুমি কোনো শ্রাদ্ধবাসর বা স্মরণসভায় প্রাণপণে শব্দ খুঁজে চলেছ, কিংবা তাদের নশ্বর শরীরের ছাই উড়িয়ে দিচ্ছ ফুলের বাগানে বা সমুদ্রের জলে।
আমার মাঝে মাঝে মনে হয় আমার ছাই যদি কোনো লাইব্রেরিতে ছড়িয়ে দেওয়া হত তবে বেশ হত। তবে তাতে লাইব্রেরিয়ানদের বেশ অসুবিধাই হত। পরের দিন লোকেরা আসার আগেই তাদের সকাল সকাল সব কিছু ঝেড়ে পরিষ্কার করতে হত।
হুঁ, আমার ছাই লাইব্রেরিতেই ছড়ানোটাই আমার পছন্দ হবে, অথবা কোনো গ্রাম্য মেলায়। ১৯৩০ সালের কোনো গ্রামের মেলায়, যেখানে তুমি প্রথমবার কোনো কালো … সেই কালো … কী যেন …
ওই দেখো, আবার শব্দটা হারিয়ে গেছে। কী খুঁজছি? মেরি গো রাউন্ড? রোলার কোস্টার? ওই যে, সেই জিনিসটা গো, যেটায় চড়লে আবার আমরা যখন তখন শৈশবে ফিরে যেতে পারি। নাগরদোলা। মনে পড়েছে। আর আরেকরকম মেলা শহরে আসত, সঙ্গে নিয়ে আসত অশুভ শক্তি। “আমার আঙুলে পিন ফুটিয়ে…”১
সেক্সপিয়ার।
সেক্সপিয়ারের কথা আমার মনে আছে, শুধু নামটা নয়, কে ছিল সেক্সপিয়ার আর কী লিখেছিল সে। আপাতত আমার মাথায় সে সুরক্ষিতই আছে। হয়তো এমন মানুষও আছে যারা সেক্সপিয়ারকেও ভুলে গেছে। তাদের মনে করতে হয়, “সেই লোকটা যে ‘টু বি অর নট টু বি’ লিখেছিল”- না না, সিনেমাটা নয়, যেখানে জ্যাক বেনি ছিল। জানো, জ্যাক বেনির আসল নাম ছিল বেঞ্জামিন কুবেলস্কি, থাকত ওকিগান, ইলিনয়ে। চিকাগো থেকে মাত্র এক ঘণ্টার রাস্তা। ওকিগানকে কিন্তু লোকে সবুজ শহর বলেই চেনে। এক মার্কিন লেখক এই শহরকে কেন্দ্র করে অনেকগুলো গল্প লিখে জায়গাটাকে বিখ্যাত করে গেছে। লোকটা নিজে কিন্তু ওকিগান ছেড়ে লস অ্যাঞ্জেলসে গিয়ে থাকত। যতদূর মনে হচ্ছে আমি যে লোকটার কথা ভাবছি, সেই গল্পগুলো লিখেছিল। লোকটার চেহারা আমার চোখের সামনে ভাসছে, আমি চোখ বন্ধ করলেই যেন দেখতে পাচ্ছি তাঁকে।
আমি বইয়ের পিছনে লোকটার যে ছবি থাকত তার দিকে চেয়ে থাকতাম অনেকক্ষণ। দেখে মনে হত সে খুবই শান্ত স্বভাবের, অনেক জ্ঞানী, এবং খুবই দয়ালু প্রকৃতির মানুষ।
লোকটা পো-কে নিয়ে একটা গল্প লিখেছিল। যাতে লোকে পো-কে ভুলে না যায়। এমন এক ভবিষ্যৎ যেখানে তারা সব বই পুড়িয়ে ফেলে, ভুলে যায় সব লেখকদের কথা। আর মজার ব্যাপার জানো, গল্পটা ছিল মঙ্গলে, তবে সেটা বড়ো কথা নয়, ওটা ওকিগনে বা লস এঞ্জেলসেও হতে পারত। সেই সমালোচকরা, যারা কলমের খোঁচায় একটি বইকে বিস্মৃতির অন্ধকারে ছুড়ে দিত, সেই লোকগুলো যারা শব্দ চুরি করে নিত, সব কথা কেড়ে নিত, ডিকশনারি আর রেডিয়ো ভরতি কত কত কথা, সব কিছু। সেই লোকগুলো যখন একটা বাড়িতে আমন্ত্রণ পেল, তাদের এক এক করে হত্যা করা হল, ওরাংওটাং দিয়ে, গর্তে ফেলে, পেন্ডুলাম দিয়ে; হে ভগবান, মনট্রেসরের২ মতো…
পো। পো-কে আমি খুব ভালো করেই চিনি। আর মনট্রেসরকেও। আর বেঞ্জামিন কুবেলস্কিকে আর তার স্ত্রী সাদিয়া মার্কসকেও। তার সঙ্গে কিন্তু মার্কস ভাইদের কোনো সম্পর্ক ছিল না, সে শুধুই সিনেমায় মেরি লিনভিংস্টনের ভূমিকায় অভিনয় করেছিল। এই সব নামগুলো আমি যত্ন করে মনে রেখেছি।
আমার তখন বারো বছর বয়স ছিল।
আমি সব বইগুলো পড়েছিলাম। সব সিনেমাগুলো দেখেছিলাম। আর ওই যে তাপমাত্রায় কাগজ পুড়ে যায়, ঠিক তখনই আমি বুঝেছিলাম যে আমাকে এই সবই মনে করে রাখতে হবে। কারণ আমাদের মনে রাখতেই হবে এই বইগুলোর কথা, ওরা যদি বই পুড়িয়ে দেয়, সব কিছু আমাদের ভুলিয়ে দিতে চায়, আমরা তখন আমাদের মাথায় গেঁথে রাখব বইগুলো। আমরা হয়ে উঠব এক একটা বই, তাদের লেখক।
ওহ, কী যেন বলছিলাম। খারাপ লাগছে, আমি যেন জঙ্গলের মধ্যে রাস্তা হারিয়েছি, একা, আর একমাত্র রাস্তাটাও শেষ হয়ে গেছে হঠাৎ করে এখানে, আর এখানেটা যে কোথায় সেটাও আর মনে পড়ছে না।
তোমার কিন্তু অন্তত একটা সেক্সপিয়ারের নাটক পড়া উচিত। তোমায় দেখে টাইটাস অ্যান্ড্রোনিকাসের কথা মনে পড়ে আমার। আর তুমি, আমার প্রিয় বন্ধু, তুমি আগাথা ক্রিস্টি পড়ো না কেন? তুমি হবে আমার মার্ডার অন দ্য ওরিয়েন্ট এক্সপ্রেস। আর কাউকে বলো না, জন উইলমট, রোচেস্টারের আর্লের কবিতাগুলো হতে। আর তুমি যেই হও না কেন, যে আমার কথাগুলো পড়ছ, তুমি হবে ডিকেনসের বই। যখন আমি ভুলে যাব বার্নাবি রুজের কী হয়েছিল, তখন আমি তোমার কাছে আসব। তুমি মনে করিয়ে দেবে আমায়।
আর সেই সব অগ্নিপুরুষ আর মূর্খরা, যারা শব্দ পুড়িয়ে ফেলে, তাক ফাঁকা করে বই নিয়ে চলে যায়, যারা ভয় পায় গল্পকে, যারা ভয় পায় শব্দকে, স্বপ্নকে, হ্যালোউইনকে, আর ভয় পায় তাদের, যারা নিজেদের শরীরে সেই কাহিনিগুলোকে উল্কি করে রাখে, আর শৈশবকে! তোমরা নিষ্কর্মা মস্তিষ্কের সেলারে ব্যাঙের ছাতার চাষ করতে পারো! তুমি, তোমার কথাগুলো, যা মানব জাতির পরিচয়ক, দিনের আলোর মতো উজ্জ্বল, যা আমার জীবনের সব কিছু, তাকে বাঁচিয়ে রেখো। যতদিন তোমার শব্দরা বেঁচে থাকবে, ততদিন তাদের মধ্যে তুমিও অমর হয়ে থাকবে, তুমিও প্রাসঙ্গিক থাকবে, দুনিয়াটা পালটে যাবে তোমারই জন্যে, যদিও আমি তখনো তোমার নাম মনে করতে পারব না।
আমি তোমার বই থেকে শিখেছি জীবনটাকে। তারপরে প্রতিটি অক্ষর গেঁথে নিয়েছি আমার মনের ভিতর। অগ্নিপুরুষরা শহরে আমায় খুঁজতে এলে কিছুই পাবে না।
কিন্তু তোমায় আমি হারিয়ে ফেলেছি। বহুদিন অপেক্ষায় কবে আবার তুমি ফিরে আসবে। যেমন অপেক্ষা করে আছি আমার সেই ডিকশনারির, আমার রেডিয়োর, আমার বুটজোড়ার, কিন্তু অপেক্ষার শেষ যে আর হয় না।
আমার মাথার মধ্যে যেখানটা জুড়ে তুমি ছিলে সেই ফাঁকা জায়গাটাই তোমার শেষ স্মৃতি, আমার শেষ সম্বল।
আর মাঝে মাঝে মনে হয় সেই জায়গাটাও আমি হারিয়ে ফেলেছি।
সেদিন এক বন্ধুকে বলছিলাম, “এই গল্পগুলো কি তোমার চেনা লাগছে?” কাহিনিগুলো আমার যতটা মনে ছিল তাকে আমি বললাম, সেই গল্পটা যেখানে কয়েকটা রাক্ষস বাড়িতে ফিরে একটি মানব শিশু খুঁজে পেয়েছিল, অথবা সেই বজ্র-বিদ্যুতের ফেরিওয়ালা আর তার সঙ্গে সঙ্গে চলা অদ্ভুত মেলার গল্প, বা সেই মঙ্গলবাসীদের আর তাদের কাচের পরিত্যক্ত শহর, তাদের নিপুণ হাতে কাটা খালের কথা। আমি তাদের নিয়ে যা যা শব্দ জানতাম তা সব আমার বন্ধুকে বললাম, কিন্তু হায়, সে জানালো এসব কোনোদিনই সে শোনেনি। এসবের অস্তিত্ব নাকি কোনোদিনই ছিল না।
আমি চিন্তায় পড়লাম।
আমার উদ্বেগের কারণ হল হয়তো আমিই এই গল্পগুলোকে বাঁচিয়ে রেখেছি। সেই গল্পের লোকগুলির মতোই, যারা গল্পের শেষে বরফের মধ্যে পায়চারী করতে করতে গল্পের কথাগুলিকে আওড়াচ্ছিল আর প্লটটা মনে করছিল, তাতেই গল্পটা সত্যি হয়ে উঠছিল।
আমার মনে হয় এর জন্যে একমাত্র ভগবানই দায়ী।
আমি জানি ভগবানের পক্ষে সব কিছু মনে রাখা সম্ভব নয়। তাঁর কাজকর্ম আছে। তাই হয়তো তিনি আমাদের উপরে সেই দায়িত্বটা দিয়ে রাখেন মাঝে মাঝে। “এই, তুমি, তোমার কাজ হল একশো বছরের যুদ্ধের সাল তারিখ মুখস্ত রাখবে। আর তুমি, তুমি ওকাপি কি সেটা মনে রাখবে। তোমার কাজ জ্যাক বেনিকে চিনে রাখা, যার আসল নাম বেঞ্জামিন কুবেলস্কি, ওকিগান, ইলিনয়ের লোক”। আর তারপরে যখন তুমি ভুলে যাও ভগবানের দেওয়া দায়িত্বের কথা, দুম! ওকাপি বলে আর কিছু জগৎ সংসারে থাকে না। দুনিয়ায় একটা গর্ত তৈরি হয়, যার গড়নটা ঠিক একটা ওকাপির মতো। গর্তটা দেখতে অর্ধেকটা অ্যান্টিলোপ আর বাকিটা জিরাফের মতো। জ্যাক বেনিও আর থাকে না। ওকিগানকেও কেউ আর খুঁজে পায় না। যেখানে সেই মানুষটা বা কোনো জিনিসের ধারণা থাকত, সেখানে তোমার মাথায় শুধু একটা গর্ত পড়ে থাকে।
আমার মনে পড়ে না।
আমার মনে পড়ে না আমার কোথায় খোঁজ করা উচিত। আমি কি কোনো সাহিত্যিককে হারিয়ে ফেলেছি? যেরকম একদিন হারিয়ে গেছিল আমার ডিকশনারিটা? অথবা আরো খারাপ কিছু হতেই পারে। ভগবান আমায় হয়তো এই সামান্য কাজটাই দিয়েছিলেন, আর আমি তাতেই ব্যর্থ হয়েছি। আর আমি তাঁকে ভুলে গিয়েছি বলেই হয়তো বইয়ের তাকে আর তাঁর জায়গা হয় না, সমস্ত সম্পর্কিত কাজে তাঁর আর উল্লেখ নেই, আর এখন তিনি আছেন শুধু আমাদের স্বপ্নের মধ্যে…
আর আমার স্বপ্নে। তোমার স্বপ্নের কথা আমি বলতে পারব না। হয়ত তুমি আফ্রিকার সেই প্রান্তরের স্বপ্ন দেখো না, যা শুধু দেওয়ালের গায়ে আঁকা অথচ গ্রাস করেছিল দুটো শিশুকে। হয়তো তুমি জানো না যে মঙ্গলই আসলে স্বর্গ, সেখানে আমাদের প্রিয়জনেরা মৃত্যুর পরে অপেক্ষায় থাকে, আর রাতের বেলায় খুন করে আমাদেরই। তুমি তো কখনো স্বপ্নে দেখোনি সেই লোকটাকে যে গ্রেপ্তার হয়েছিল ফুটপাথে হাঁটার জন্যে।
আমি এই স্বপ্নগুলোই দেখি।
যদি তাঁর অস্তিত্ব সত্যিই ছিল, তবে আমি তাঁকে হারিয়ে ফেলেছি। হারিয়ে ফেলেছি তাঁর নাম। তাঁর বইয়ের শিরোনামগুলি, এক এক করে তাঁর গল্পগুলিও।
আমার ধারণা আমি আস্তে আস্তে পাগল হয়ে যাচ্ছি, শুধু বয়স হওয়ার জন্যে তো এমন হতে পারে না।
হায় ভগবান, আমি যদি এই কাজটিতে ব্যর্থ হই, তাহলে আমার একটা অনুরোধ শুধু রাখো। দয়া করে পৃথিবীকে সেই গল্পগুলো আবার ফিরিয়ে দাও।
হয়তো, তখন মানুষ তাঁকে মনে রাখবে। তারা সবাই তাঁর নাম করবে আবার। আরো একবার তাঁর নামের সঙ্গে সমার্থক হয়ে উঠবে হলোইনের সময়কার আমেরিকার এক ছোট্ট শহর, যে সময়ে ঝরা পাতারা ফুটপাতে ভীত সন্ত্রস্ত পাখিদের মতো সরসরিয়ে চলে যায়, অথবা মঙ্গলগ্রহের সঙ্গে, অথবা ভালোবাসার সঙ্গে। সেদিন যেন আমার নাম কেউ মনে না রাখে।
কিন্তু সেই দামটা দিতে আমি রাজি আছি। যদি আমি যাওয়ার আগে আমার মনে ভিতরের বইয়ের তাকের সেই শূন্যতাটা আবার পূরণ করতে পারি।
ভগবান, দয়াময়, আমার প্রার্থনা সত্যি করো।
এ … বি … সি … ডি … ই … এফ … জি …
১ “বাই দ্য প্রিকিং অফ মাই থাম্বস, সামথিং উইকেড দিস ওয়ে কামস” – ম্যাকবেথের চতুর্থ অংক, প্রথম দৃশ্যে দ্বিতীয় ডাইনি এই কথাটা বলেছিল।
২ এডগার অ্যালান পো-এর ‘কাস্ক অফ অ্যামনটিলাডো’ গল্পের প্রধান খলচরিত্র।
© নিল গেইম্যান ২০১২
“যে মানুষটি রে ব্র্যাডবেরিকে ভুলে গিয়েছিল” প্রসঙ্গে নিল গাইম্যান
আমি অনেকদিন ধরেই রে ব্র্যাডবেরিকে নিয়ে লিখতে চাইছিলাম। ব্র্যাডবেরি যেভাবে পো-কে নিয়ে উশার ২-তে লিখেছিলেন, ঠিক সেইভাবেই আমি তাঁকে নিয়ে লিখতে চেয়েছি। ব্র্যাডবেরির থেকেই আমি পো-এর সঙ্গে পরিচিত হই।
একটি পরিচিত বৃত্তের থিয়েটারে ক’দিন আগে আমায় কিছু পড়ার জন্যে অনুরোধ করা হয়। এডিনবরার ফিঞ্জ ফেস্টিভালে অনেক রাতে অনুষ্ঠানটি ছিল। আমি ও আমার স্ত্রী আমান্ডা মিলে মাঝরাতে গান ও গল্প পড়ার আসর বসিয়েছিলাম। আমি ঠিক করেছিলাম সময়ে লেখাটা শেষ করব, যাতে চল্লিশ জন দর্শকের কাছে সেটি পড়তে পারি। একটি ছোট্ট সুন্দর সাজানো স্টেজের উপর আমরা সোফা আর কুশন নিয়ে মেঝেতে বসে ছিলাম। ঘরটা সাধারণত বেল্ট আপ থিয়েটার কোম্পানির নিজস্ব ব্যক্তিগত নাটকের শো-এর জন্যেই নির্দিষ্ট থাকত।
আমায় যদি পড়তেই হয় তবে গল্পটা অবশ্যই মনোলগ হবে।
গল্পের কথাটা মাথায় এসেছিল আমার এক পুরোনো বন্ধুকে ভুলে যাওয়া থেকে। সে মারা গিয়েছিল বছর দশেক আগেই। আর একদিন যখন আমি তার নামটা মনে করার চেষ্টা করলাম, কিছুই মনে পড়ল না। অথচ আমি আর সবকিছুই মনে করতে পারছি তার ব্যাপারে – কোন কাগজগুলোয় সে লিখত, কোন কোম্পানির বারবন মদ সে খেতে পছন্দ করত। এমনকী তার সঙ্গে আড্ডার প্রত্যেকটা বিষয় আমি মনে করতে পারছি, এখুনি আমি সেগুলো আবার বলতেও পারব। তার লেখা সব ক’টা বইয়ের নামও আমার মুখস্ত।
কিন্তু তার নাম, তার নাম সম্পূর্ণ বিস্মৃত হয়েছি। এবং সেটা ভাবলেই আমার ভয় লাগছে। আমি হাল ছাড়িনি, অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেছি, যদি নামটা আমার কাছে ফিরে আসে। আমি নিজের কাছে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম যে গুগল খুলে বন্ধুর নামটা খুঁজব না, আমি নিজে থেকেই মনে করতে চাই। কিন্তু না, কিছুতেই মনে পড়ল না। এ যেন জগৎ সংসারে একটা শূন্যস্থান তৈরি হয়েছে, ঠিক আমার বন্ধুর আকারের। রোজ রাতে বাড়ি ফেরার সময় আমি তার নামটা মনে করার চেষ্টা করতাম। এমনকি অক্ষর ধরে ধরে, “অ্যাল? নাহ, বব? না। তবে কি চার্লস? ক্রিস? না, এরাও নয়…”
আর তারপরে একদিন আমার মনে হল, সে তো শুধু আমার বন্ধু নয়, একজন লেখকও। তার সারা জীবনের সমস্ত কাজ যদি মুছে যায়? যদি বাকি সবাইও তাকে ভুলে যায়?
আমি কাগজ কলমে গল্পটা লিখেছিলাম। সেদিন রাতের অনুষ্ঠানে যাওয়ার পাঁচ মিনিট আগে গল্পটা শেষ হয়েছিল। আমি ভীষণ নার্ভাস ছিলাম সেদিন – এর আগে কখনো একটা গল্প লিখেই সেটা পড়তে যাওয়ার কথা ভাবতেও পারিনি।
গল্পটা আমি শেষ করেছিলাম ইংরেজি বর্ণমালার সমস্ত অক্ষর আবৃত্তি করে।
আর তারপরে পুরো গল্পটা টাইপ করে আমি রে-এর কাছে পাঠিয়ে দিই তাঁর একানব্বইতম জন্মদিনে।
আমার মনে আছে ওঁর একাত্তরতম জন্মদিনের অনুষ্ঠান হয়েছিল ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়ামে, সেখানে আমিও উপস্থিত ছিলাম।
সেই স্মৃতিটা রে আর তাঁর সারাজীবনের কাজের মতোই ছিল আমার কাছে, যা কোনোদিন ভোলা সম্ভব নয়।
-নিল গেইম্যান
Copyright © 2012 by Neil Gaiman
সম্পাদকের কথা: কল্পবিশ্ব পাবলিকেশনস থেকে কিছুদিন আগেই প্রকাশিত হয়েছে রে ব্র্যাডবেরির তিনটি অনুবাদ গ্রন্থ। মার্শিয়ান ক্রোনিকলস, ফারেনহাইট ৪৫১ ও ইলাস্ট্রেটেড ম্যান। অনুবাদের সময় একটি ক্লোসড গ্রুপে আলাপ আলোচনা চলত রোজই। দেবজ্যোতিদা, যশোধরাদি, সুমিতদা, গৌতম, সুবিনয়, সুপ্রিয়, দীপ ও আরো কয়েকজন। সেই গ্রুপেই একদিন পড়ালেন দেবজ্যোতিদা একটি গল্প। নিল গেইম্যানের লেখা – দ্য ম্যান হু ফরগট রে ব্র্যাডবেরি। পড়ে আমরা একেবারে চমকে গেলাম। আমেরিকান গড, স্যান্ডম্যানের স্রষ্টা গেইম্যানের ভক্ত তো আগেও ছিলাম, আরো একবার মনে মনে সেলাম ঠুকলাম তাঁকে। এই গল্প কল্পবিশ্বের ব্র্যাডবেরি সংখ্যায় দিতেই হবে। যোগাযোগের চেষ্টা হতে লাগল। শেষ পর্যন্ত মেইলের পর মেইলে রাজি করানো গেল তাঁকে। অনুমতি মিলল অনুবাদের। কিন্তু ততদিনে পত্রিকার ব্র্যাডবেরি সংখ্যা বের হয়ে গেছে। তাই ঠিক হল শারদ সংখ্যাতেই প্রকাশিত হবে সেই অনুবাদ। আশা করি রে ব্র্যাডবেরির প্রতি এই সময়ের অন্যতম স্পেকুলেটিভ ফিকশন লেখক নিল গেইম্যানের এই শ্রদ্ধার্ঘ্য আপনাদের ভালো লাগবে।
Tags: অনুবাদ গল্প, দীপ ঘোষ, নিল গেইম্যান, সপ্তম বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা