এক প্রপঞ্চর সমাপ্তি
লেখক: সুমন সেন
শিল্পী: টিম কল্পবিশ্ব
[বি. দ্র.: এই গল্পটি কল্পবিশ্ব পত্রিকার ‘সপ্তম বর্ষ, তৃতীয় সংখ্যা’ (শারদীয়া ২০২২)-য় প্রকাশিত আমার গল্প ‘এক প্রহেলিকার জন্ম’-এর পরবর্তী অংশ। সুতরাং, কেউ চাইলে এটা পড়ার আগে ওটা পড়ে নিতে পারেন। তবে ওটা না পড়া থাকলেও এটা বুঝতে কোনোরকম অসুবিধা হবে না।]
এক
২১ ডিসেম্বর ২০১২, কলকাতা:
চারিদিকে উৎসবের আমেজ। পার্কস্ট্রিট অঞ্চলে সাজো সাজো রব। আগামী কয়েকদিনের জন্য এই রাস্তা আলোর রোশনাইয়ে ঝলমলিয়ে উঠবে। তাই চারিদিকে লাগানো হচ্ছে বিভিন্ন রকমের বাহারি বাতি। গত বছর থেকেই এখানে অনুষ্ঠিত হচ্ছে ‘কলকাতা ক্রিস্টমাস ফেস্টিভাল’। এবছর সেই অনুষ্ঠানকে আরও বেশি জাঁকজমকপূর্ণ করে তোলার ইচ্ছা রয়েছে কর্তৃপক্ষের। পশ্চিম আকাশে সূর্য ডুবতে তখন আরও বেশ কিছু সময় বাকি। তার আগে যতটা সম্ভব কাজ মিটিয়ে ফেলতে হবে।
এমন সময় ড্রোনটাকে উড়তে দেখা গেল মাঝ আকাশে। তাতে একটা মোবাইল ফোন পি.ভি.সি. টেপ দিয়ে আষ্টেপৃষ্টে বাঁধা। যারা ড্রোনটা দেখল, তারা ভাবল নিশ্চয়ই কোনো নিউজ চ্যানেল অনুষ্ঠানের সাজসজ্জা নিয়ে ভিডিয়ো বানাচ্ছে!
এরপর দেখতে দেখতেই ঘটে গেল অঘটনটা। ড্রোনটাকে কেন্দ্র করে একটা বৃত্তাকার রেখা স্পষ্ট হয়ে উঠল। সেই বলয়ের ভিতরটা দেখা গেল এক অপার্থিব নিকষ কালো অন্ধকারে পরিপূর্ণ। প্রতি সেকেন্ডের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বেড়ে উঠতে থাকল সেই বলয়ের পরিধি। আর সঙ্গে সঙ্গেই আশপাশের সকলে অনুভব করল একটা টান। চুম্বক যেমন লোহার কুচি নিজের দিকে আকর্ষণ করে, ঠিক তেমনই সেই অন্ধকার গোলকটা যেন আশপাশের সবকিছু আকর্ষণ করছে নিজের দিকে।
প্রথমে পাস্তায় পড়ে থাকা ছোটোখাটো পাথর, গাছের পাতা, শুকনো গাছের ডাল ছুটে গিয়ে মিলিয়ে গেল সেই কৃষ্ণ গোলকের গর্ভে। তারপর আস্তে আস্তে রাস্তায় সাজানো বাহারি বাতি, মানুষের জুতো, ছোটো সাইকেল ইত্যাদি উড়ে যেতে শুরু করল সেই গোলকের দিকে। তারপর একসময় আকর্ষণের মাত্রা এতটাই বাড়ল যে, আস্ত মানুষ, গাড়ি, এমনকি বড়ো বড়ো গাছ শিকড় সমেত উপড়ে যেতে থাকল। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আশপাশের বাড়িঘর, রাস্তাঘাট ইত্যাদি ভেঙে টুকরো হয়ে ছুটতে শুরু করল সেই নিকষ কালো বৃত্তের দিকে। যা গেল তার আর কোনো নিশানাই থাকল না। যেন সেসবের কোনো অস্তিত্বই ছিল না কোনোদিন। দলে দলে মানুষ উড়ে গিয়ে, আশপাশের বস্তুসমেত ধাক্কা খেতে খেতে হারিয়ে গেল সেই সর্বগ্রাসী গোলকের অতল গহ্বরে।
চারিদিকে হাহাকার উঠল। যে যেদিকে পারল ছুটতে শুরু করল। নদীর জলে ডুবে যেতে থাকা পিঁপড়ে যেমন খড়কুটোকে সম্বল করে ভেসে থাকার চেষ্টা করে, তেমনই কেউ কেউ আশপাশের কোনো শক্ত জিনিসকে জড়িয়ে ধরে বেঁচে থাকার চেষ্টা করল।
একটা সময় কিছুই অবশিষ্ট থাকল না। কমলালেবুর খোসা এলোমেলোভাবে ছাড়িয়ে যদি কোনো রাক্ষস ভিতরের ফলটাকে খাবলে-খুবলে খায়, তাহলে ঠিক যেমন হয়; পৃথিবীর অবস্থাটাও আজ ঠিক যেন সেরকম। মাটির স্তরের পর স্তর উঠে আসতে শুরু করেছে। কোথাও জলের বন্যা বয়ে যেতে শুরু করেছে। কোথাও আবার গ্যাসের পাইপ ফেটে অগ্নিকাণ্ড বেঁধেছে।
একসময় মাটির তলায় কিছু কিছু জায়গা থেকে বেরিয়ে আসতে শুরু করল গরম বাষ্প, আর তারপর গলিত লাভা।
পৃথিবীর অন্যান্য অংশের মানুষ স্যাটেলাইট ছবির মাধ্যমে দেখতে পেল—কোনো বিশালাকৃতি দানব যেন পৃথিবীর একটা অংশে বসিয়েছে নির্মম এক কামড়! কিন্তু তাতেও তার ক্ষুধা মেটেনি। ধ্বংসলীলা বেড়েই চলেছে ক্রমশ। আজ যেন সৌরজগতের এই তিন নম্বর গ্রহটার অস্ত্বিত্বই মিটে যেতে চলেছে!
এইরকম চরম বিপদের মুহূর্তে কিছু মানুষের মনে পড়ে গেল আজকের দিনটার কথা। আজ তারিখ কত? ভেবে বাকরুদ্ধ হয়ে গেল তারা। বিগত কয়েক বছর ধরে রটে চলা ভবিষ্যৎবাণীটা যে এইভাবে ফলে যাবে তা কল্পনাও করতে পারেনি কোনো দেশের বিজ্ঞানী মহল।
***
ছয় মাস আগে:
“স্যার, আপনি শিক্ষিত আর বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ হয়ে এইসব কুসংস্কারে বিশ্বাস করেন! তা ছাড়া এটা আদৌ কোনো ভবিষ্যদ্বাণীই নয়। এটা কিছু মানুষের ভুল বোঝার ফলে তৈরি হওয়া একটা রটনা মাত্র। আর… এটা যে একটা ভ্রান্ত ধারণা তা তো এখন প্রমাণিত। ২০১২ সালের ২১ ডিসেম্বরে মায়ান ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ওদের একটা বাখ্তুন অর্থাৎ ১৪৪,০০০ দিনের একটা আবর্ত শেষ হচ্ছে। যেটা ওদের ১৩-তম বাখ্তুন। কিছু ইন্টারপ্রিটার সেটাকে ভুল বুঝে, ভুল ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তাই মানুষের মধ্যে এই ভ্রান্ত ধারণাটা ছড়িয়েছে যে, ওই দিন নাকি পৃথিবীর অন্তিম দিন! তবে এখন এক্সপার্টরা সঠিক তথ্য বুঝতে সক্ষম হয়েছেন। এই দেখুন… ” বলে অচিন্ত্য টেবিলের উপর রাখা ল্যাপটপটাতে কিছু একটা লিখে সার্চ করল। তারপর নির্দিষ্ট একটা লিঙ্কে ক্লিক করে একটা পেজ খুলে, ল্যাপটপটা বিকাশের দিকে ঘুরিয়ে দিল এবং তাকে দেখতে বলল।
কিছুক্ষণ বিকাশ ল্যাপটপে খোলা পেজটার উপর চোখ বুলিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, “অচিন্ত্য… এসব কিছু বাদ দিলেও আমার মন কু-ডাকা বন্ধ করছে না। কারণ আমি আমার বন্ধুকে ভালো করেই চিনি। ও নিশ্চয়ই আবার কিছু একটা অঘটন ঘটাতে চলেছে।”
“আপনার সত্যিই মনে হয়… আপনার বন্ধু… অর্থাৎ মৃন্ময় এখনও বেঁচে থাকতে পারে? কবে সে ওদেশের রাজনীতির শিকার হয়ে ফৌত হয়ে গেছে! ওসামা জাহান্নমে চলে গেল… আর এ তো চুনোপুঁটি! আপনি যাকে দেখেছেন সে তো অন্য কেউও হতে পারে! একই রকম দেখতে মানুষ থাকতে পারে না?”
বিকাশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল অচিন্ত্যর মুখের দিকে। অচিন্ত্য উদ্যমী, কর্মঠ, সাহসী এবং সৎ একটি ছেলে। সে বিকাশের আপ্ত-সহায়ক। ব্যুরো জয়েন করার পরে পরেই অচিন্ত্যকে বিকাশের কাছে পাঠানো হয়। বিকাশ এখন আই.বি. স্পেশাল ব্রাঞ্চের যুগ্ম-অধিকর্তা। গত আট বছর ধরে সে এস.আই.বি. কলকাতায় আছে। আর এই আট বছর ধরেই সে অচিন্ত্যকে দেখছে। ভালো-খারাপ অনেক মুহূর্তে সে তাকে সঙ্গ দিয়েছে। এই কয়েক বছরে অচিন্ত্য বিকাশের বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করেছে ঠিকই, কিন্তু তাও কি তাকে সবটা খুলে বলা যায়! এদের রক্ত গরম, সিদ্ধান্ত নিতে দেরি হয় না। অভিজ্ঞতার আগুনে পুড়ে এদের মনের এখনও সঠিকভাবে পরিপক্কতা পায়নি।
ইতিমধ্যে বিকাশ তাকে তার পুরোনো বন্ধু মৃন্ময়ের সম্পর্কে অনেক কথাই বলেছে। বলেছে তাদের বন্ধুত্বের কথা, পুরোনো কর্মজীবনের কথা, মৃন্ময়ের ধর্ম পরিবর্তন করে সন্ত্রাশবাদী দলে নাম নথিভুক্ত করার কথা, বার বার দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধ বাঁধানোর পরিস্থিতি তৈরি করার কথা, নিউক্লিয়ার হামলা করে জগৎটাকে ধ্বংস করার চেষ্টার কথা। এমনকি সে অচিন্ত্যকে ওই টাইম মেশিনটার কথাও বলেছে, যেটা হাতে পেয়ে মৃন্ময়ের জীবনটা অন্য ধারায় বইতে শুরু করেছিল। প্রমাণস্বরূপ সে মৃন্ময়ের ভাঙা মোবাইল ফোনটাও অচিন্ত্যকে দেখিয়েছে, যেটা মৃন্ময় অনেক দূরে চলে যাবার আগে তাকে দিয়ে গিয়েছিল। তবে যেটা যে অচিন্ত্যকে এতদিন গোপন করে গেছিল, সেটা হল জাম্বুসি নামক সেই অন্য জগতের কথা। যেখান থেকে সে তার স্ত্রী নিম্মিকে পেয়েছিল। আর যেই জগতের সঙ্গে মৃন্ময়ের পরিচয় করিয়েই সে জীবনের সবথেকে ভুলটা করেছিল—তা আজ বুঝতে পারছে।
“স্যার! স্যার… কী ভাবছেন?” অচিন্ত্যর ডাকে সংবিৎ ফিরল বিকাশের।
“অচিন্ত্য… আমি ঘর পোড়া গোরু, সিঁদুরে মেঘ দেখলে ডরাই। জীবনটা তো এতটাও সহজ-সরল নয়! তা ছাড়া… আমরা অনেকেই কম বয়সে অবুঝের মতো অনেক কাজই করে ফেলি। তারপর সেটার খেসারত দিতে দিতে বাকি জীবনটা কীভাবে পার হয়ে যায়, তা বোঝাও যায় না! অনেক সময় একজনের ভুলের মাশুল দিতে হয় গোটা একটা জাতিকে। আমি নিশ্চিত আজ আমি মেট্রো স্টেশনে যাকে দেখেছি, সে মৃন্ময় ছাড়া আর কেউ নয়। জানো… ওর সঙ্গে শেষ আমার মুখোমুখি দেখা হয়েছিল ২০০০ সালে। বয়সের হিসেব করলে ও আমার থেকে দু’বছরের ছোটো মাত্র। আজ আমার বয়স চুয়ান্ন। মুখে বয়সের ছাপ পড়েছে, বলিরেখা দেখা দিচ্ছে, চুলে পাক ধরতে শুরু করেছে। কিন্তু, সে অবিকল একইরকম রয়ে গেছে। বারো বছর আগে তাকে ঠিক যেমনটা দেখেছিলাম, ঠিক তেমনই… ”
“স্যার, আমি তো এটাই বলার চেষ্টা করছি আপনাকে… ওটা তো মৃন্ময় নাও হতে পারে!”
“না না, অচিন্ত্য… তুমি বুঝতে পারছ না! আমি তোমাকে মৃন্ময়ের ব্যাপারে প্রায় সব কথাই বলেছি, শুধু একটা কথা বাদে। সঙ্গে আমার জীবনেরও একটা রহস্যময় অধ্যায় তোমার কাছে গোপন করেছি। আমরা দুজনেই অন্য একটা জগতের সন্ধান জানি। যেই জগৎটা আমাদের চেনা পৃথিবী থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। সেখানকার মানুষ আলাদা, তাদের ভাষা আলাদা। তাদের নিয়ম-রীতি-নীতি সব আলাদা।”
অচিন্ত্যকে দেখে মনে হবে সে বিকাশের কথায় খুব একটা অবাক হয়নি। যে টাইম মেশিনের অস্তিত্বের কথা শুনেছে তার স্যারের মুখ থেকে, তার কাছে এসব কথা শোনা খুব একটা আশ্চর্যের নয়। মনে মনে তার স্যারকে এসব ব্যাপারে খুব একটা বিশ্বাসও করে না সে। স্যার যেটাকে টাইম মেশিন বলে দাবী করেন সেটা একটা পুরোনো ভাঙা মোবাইল ফোন। সুতরাং সেটার ব্যবহারিক প্রয়োগ সে কোনোদিন চাক্ষুষ করেনি। তবে তার স্যার যে বুদ্ধিমান আর বিচক্ষণ ব্যাক্তি, তা নিয়ে অচিন্ত্যর মনে কোনো সন্দেহ নেই। শুধু এইসব গল্পগুলো শুনলে সে ভাবে স্যারের মাথায় খানিক সমস্যা আছে। ‘অন্য জগৎ’ বলতে স্যার যে অন্য কোনো গ্রহের কথা বলছেন না, তা সে ভালো করেই জানে। কারণ, স্যারের কল্পনার দৌড় সেই পর্যন্ত নয়। “ইউ মিন… অ্যা প্যারালাল ইউনিভার্স?” সে শান্ত স্বরেই বলল।
“ইয়েস। সামথিং লাইক দ্যাট।”
“আচ্ছা।”
“হুমম্। আর এরকমই দুটো জগৎ মাঝে মাঝে যুক্ত হয়ে যায় একটা ওয়ার্মহোল-এর মাধ্যমে। এই ওয়ার্মহোলকে একটা রাস্তা বলতে পারো। এটা দিয়ে এক জগতের মানুষ অন্য জগতে পাড়ি দিতে পারে খুব সহজেই। যুবক বয়সে একদিন হঠাৎই আমি এরকম একটা প্রাকৃতিক ওয়ার্মহোল-এর সন্ধান পেয়ে যাই। এবং সেখান থেকে পৌঁছে যাই জাম্বুসি নামক একটা জগতে। সেখানে আমি বেশ কয়েকমাস থাকি। তারপর যখন আমাদের জগতে ফিরে আসি; তখন দেখি পৃথিবীর সময়ের হিসেবে আমার ওই জগতে যাওয়া, থাকা এবং ফিরে আসায় এক সেকেন্ডও বেশি সময় অতিবাহিত হয়নি। অর্থাৎ কেউ যদি অন্য জগতে গিয়ে পঞ্চাশ বছরও কাটিয়ে আবার নিজের জগতে ফিরে আসে, তাহলে তার জগতের ঘড়ির হিসেবে তার এক মুহূর্তও নষ্ট হবে না। ঠিক যেই মুহূর্তে অন্য জগতে প্রবেশ করবে, সেই মুহূর্তেই আবার নিজের জগতে ফিরে আসবে। মাঝে সে একটা গোটা জীবন কাটিয়ে ফেলতে পারে অন্য জগতে, কিন্তু নিজের জগতে ফিরে তার বয়সের বিন্দুমাত্র হেরফের হবে না।”
“আচ্ছা। এই জন্যই আপনি বলছিলেন, মেট্রো স্টেশনে মৃন্ময়ের দেখা পেয়ে আপনি অবাক হয়েছিলেন—কেন তার বয়স বাড়েনি! আপনি বলতে চাইছেন সে ওই জাম্বুসি নামক জগৎটায় এতদিন আত্মগোপন করে ছিল?”
“বলতে চাইছি না অচিন্ত্য… আমি তোমাকে নিশ্চিতভাবে বলছি, সে জাম্বুসিতেই ছিল এতদিন। আমিই তাকে দেখিয়েছিলাম জাম্বুসিতে যাবার রাস্তা। আমার সেই যুবা বয়সের ভুলের মাশুল এখন কতজনকে দিতে হবে জানি না!” বলে নিজের কপালটা দুই আঙুল দিয়ে খানিক চেপে ধরল বিকাশ। তারপর আবার বলতে শুরু করল, “জাম্বুসির মানুষদের আমাদের থেকে খুব সহজেই আলাদা করা যায় শরীরের একটা বিশেষ অঙ্গ দেখে। সেটা হল কান। আমাদের কানের পিছনটা যেমন গোল হয়, তেমনই জাম্বুসির মানুষদের কানের উপরিভাগটা একটা কোণের মতো হয়ে পিছনদিকে বেঁকে থাকে। ঠিক কোনো শ্বাপদের মতো। আমি মেট্রো স্টেশনের ভিড়ে ওর কাছে গিয়ে কানটা ভালো করে লক্ষ করেছি। ওর কানটা ঠিক জাম্বুসির মানুষদের মতো। সেখানকার মানুষদের সঙ্গে মিলেমিশে যাবার জন্য সে কোনোভাবে নিজের কানটাকে ওরকম বানিয়ে নিয়েছে।”
“হুমম্… বুঝলাম।”
“২০০৪ সাল থেকে ওর আর কোনো ট্রেস পাওয়া যায়নি। ও যদি ২০০৪ সালে জাম্বুসিতে প্রবেশ করে থাকে, তাহলে হিসেবমতো সেখান থেকে বেরোবেও ২০০৪ সালেই। সবথেকে ভয়ংকর কথাটা কী জান? ও নিশ্চয়ই কোনোভাবে আরেকটা টাইম-মেশিন প্রস্তুত করতে পেরেছে। যার সাহায্যে ও ২০০৪ সাল থেকে ২০১২ সালে আসতে সক্ষম হল। আর মৃন্ময়ের এখানে আসাটা যে খুব একটা শুভকর নয়, সেটা তো বুঝতেই পারছ আশা করি!”
“কিন্তু স্যার… মৃন্ময়ের সঙ্গে ২১ ডিসেম্বরের ভবিষ্যদ্বাণীর কী সম্পর্ক?”
“আপাতত কোনোই সম্পর্ক নেই। এটা শুধু আমার আন্দাজ মাত্র। আসলে মৃন্ময়ের উদ্দেশ্যই হচ্ছে আমাদের এই জগৎটাকে ধ্বংস করা। তার জন্য সে যে কোনো পন্থাই অবলম্বণ করতে পারে। এখন যখন ওর উপস্থিতি আমি টের পেয়েই গেছি, তখন আমাদের উচিৎ ওর সকল কাজকর্ম সম্পর্কে সতর্ক থাকা।”
“কিন্তু স্যার… কীভাবে? আপনার সকল থিয়োরি যদি সত্যি হয়েও থাকে, তবুও ওর পিছু করার মতো আমাদের কাছে কোনো উপায় নেই।”
অচিন্ত্যর কথা শুনে বিকাশ বেশ কিছুক্ষণ চুপ রইল। শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল ঘরের এক কোণে। তারপর হঠাৎ বলে উঠল, “অচিন্ত্য… তোমার মনে আছে গত মাসের সেই ঘটনাটা… যখন এই কলকাতার রাস্তায় একটা অদ্ভুত দর্শন প্রাণীকে দেখা গেল, পুলিশ সেটাকে নিয়ে আলিপুর জেলে রাখল, আর তারপর একদিন সেটা জেল থেকে পালিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর বাচ্চা ছেলেটাকে খুন করল?”
“হ্যাঁ। ওইতো… পরে একটা কভার-আপ স্টোরি বানিয়ে মিডিয়া আর পাবলিককে শান্ত করা হল।”
“হুম্ম্। প্রাথমিকভাবে সবাই সেই প্রাণীটাকে ভিনগ্রহী বলেই ভেবেছিল। কিন্তু জিজ্ঞাসাবাদের সময় সে বারবার একটাই কথা বলেছে—সে ৩০৩২ সাল, অর্থাৎ ভবিষ্যৎ থেকে আসা একজন মানুষ। প্রমাণস্বরূপ, নিজের সঙ্গে আনা একটা অদ্ভুত ছোটো যন্ত্রকে টাইম-মেশিন বলে দাবি করে সে।” বলে বিকাশ কিছুক্ষণ অচিন্ত্যর মুখের দিকে তাকিয়ে তার অভিব্যক্তি লক্ষ করে। তারপর আবার বলে, “সে পালানোর আগে সেলের দেওয়ালে কী লিখে গিয়েছিল জানো?”
“কী?”
“‘থ্যাঙ্ক ইউ বিকাশ রায়। ইউ আর দ্য রিসন অফ দ্য এক্সিস্টেন্স অফ হোমো-রোবিয়ান্স্। উই অল থ্যাঙ্ক ইউ।’ পরিষ্কার ইংরেজি হরফে। ব্যাপারটা নিয়ে অনেক ভেবেছি আমি। আমার নাম কেন লিখল প্রাণীটা! দুনিয়ায় এত মানুষ থাকতে আমিই কেন? আজ আমি এর উত্তরটা খুঁজে পেয়েছি। আমরা যখন জানতেই পেরেছি—এই পৃথিবীতে টাইম মেশিনের অস্তিত্ব সূর্যের মতো সত্য, তখন এটাও অস্বীকার করা যায় না যে জিনিসটার অপপ্রয়োগও হবে প্রচুর। আর সেসব আটকাতে হবে আমাদেরই। তুমি একটা কাজ করো তো… হোম-মিনিস্ট্রিতে একটা মিটিং ফিক্স করো।”
“ওকে, স্যার।”
দুই
২০০৪ সাল:
মৃন্ময় বুঝল, তার সন্ত্রাশবাদী কার্যকলাপ এখন আর একটা বড়ো যুদ্ধ বাঁধাতে সক্ষম হবে না। যা পৃথিবীকে ঠেলে নিয়ে যেতে পারবে না আরেকটা বিশ্বযুদ্ধের দিকে। সুতরাং, আবার নতুন করে পরিকল্পনা করতে হবে। সময় নিয়ে সবকিছু নতুনভাবে শুরু করতে হবে। কিন্তু কীভাবে! নতুনভাবে সবকিছু শুরু করব—বললেই তো আর করা যায় না! এখন তার কাছে সেই মোবাইল ফোনটাও নেই। তার সময়যাত্রার একমাত্র অবলম্বন তো ছিল সেই মোবাইল ফোনটাই! তার টাইম মেশিন।
মৃন্ময়ের প্রচণ্ড অনুশোচনা হতে থাকল। কেন যে রাগের মাথায় মোবাইল ফোনটা আছাড় মেরে ভেঙে ফেলছিল সেদিন! সেটা হাতে থাকলে আজ নিশ্চয়ই কিছু একটা ব্যবস্থা করা যেত। এখন তো ভারতের বাজারে মোবাইল ফোন চলে এসেছে। বহু মানুষ পকেটে ফোন নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। চারিদিকে প্রচুর ফোনের টাওয়ার বসেছে। এখন সে নিশ্চিন্তে তার যন্ত্রটা ব্যবহার করতে পারত। ইশ্শ্! কি ভুলটাই না করে ফেলেছে সেদিন!
আচ্ছা… পুরোনো ভাঙা ফোনটা তো তার বন্ধুকে পাঠিয়ে দিয়েছিল সে, তার সমস্ত সম্পর্কের মায়াজাল কাটিয়ে চলে আসার পর! সেটা কি বিকাশ পেয়েছিল? যদি পেয়ে থাকে, তাহলে সেটা নিশ্চয়ই সে যত্ন করে রেখে দিয়েছে। সেটা যদি পাওয়া যায়, তাহলে কোনোভাবে সেটাকে সারিয়ে নিয়েও তো তার কার্যসিদ্ধি হতে পারে! তার অমূল্য সম্পদটা তার বন্ধু নিশ্চয়ই নিজের বাড়িতেই কোথাও রেখেছে! একবার তার বাড়ি গিয়ে খুঁজে দেখা যাক! ভাগ্য সহায় থাকলে পেলেও পেতে পারে তার জিনিস। আর… সে তো চুরি করবে না। ওটা তো তারই জিনিস। শুধু গচ্ছিত রেখেছিল বন্ধুর কাছে। আবার যথা সময়ে নিয়ে নেওয়া যেতেই পারে!
যেমন ভাবা তেমন কাজ। পাকিস্তানে সরকার তাকে গৃহবন্দি করে রেখেছে। তবুও, নিজের প্রভাব খাটিয়ে যত শীঘ্র সম্ভব সে পাকিস্তান থেকে চলে এল কলকাতায়। বিকাশ বাড়িতে না থাকার সুযোগে একদিন বিকাশের বাড়িতে চোরের মতোই ঢুকে তোলপাড় করে খুঁজে ফেলল তার সমস্ত বাড়ি। সম্ভাব্য সমস্ত জায়গায় খুঁজল, খুঁজে খুঁজে হয়রান হয়ে গেল, তবুও পাওয়া গেল না তার অমূল্য সম্পদ সেই ভাঙা মোবাইল ফোনটা। তাহলে কি বিকাশ নষ্ট করে ফেলেছে ফোনটার অবশিষ্টাংশ? সর্বনাশ!
নিজের উদ্দেশ্যে অসফল হয়েই যেমন চোরের মতো বিকাশের বাড়িতে মৃন্ময় ঢুকেছিল, তেমনই বেরিয়ে গেল তার বাড়ি থেকে। বিকাশ ফিরে এসে তাকে দেখে ফেললে আরেকটা কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে।
একটু ভাবল মৃন্ময়… এত দূরে এত বছর পর সে যখন ফিরেই এসেছে, তখন একবার কি ব্যারাকপুর থেকেও ঘুরে আসবে? নিজে স্ত্রী-পুত্রকে অন্তত একবার চোখের দেখা দেখে নেবে না হয়! আচ্ছা… তারা কি এখনও ব্যারাকপুরেই আছে? কেমন আছে পাপড়ি? কী করছে এখন?
না না… এসব কী ভাবছে সে! সঙ্গে সঙ্গেই মনটা তেতো হয়ে উঠল তার। সমস্যার শুরু যেখান থেকে, সেখানে আবেগের কোনো জায়গাই নেই।
একদলা থুথু নিক্ষেপ করল সে পৃথিবীর বুকে। কিন্তু তাতেও মনের তেতো ভাবটা কাটল না। আর কিছু না ভেবে সবেগে বেরিয়ে গেল সে ওই স্থান থেকে।
***
এখন আর একটাই রাস্তা খোলা আছে মৃন্ময়ের কাছে। জাম্বুসি। বিকাশের চিনিয়ে দেওয়া সেই সমান্তরাল জগৎটাতে সে যতদিন খুশি লুকিয়ে থাকতে পারবে পৃথিবীর মানুষের কাছ থেকে। পরিকল্পনা করার সময় পাবে, পড়াশোনা করতে পারবে যাতে ওইরকম আরেকটা মোবাইল ফোন অর্থাৎ টাইম-মেশিন সে বানাতে পারে!
তবে জাম্বুসিতে গা-ঢাকা দেবার জন্য একটা প্রতিবন্ধকতা আছে। সেখানকার মানুষ খুব সহজেই তাকে চিহ্নিত করে ফেলবে যে সে ওদের জগতের কেউ না। খুব সহজেই পৃথিবীর মানুষ আর জাম্বুসির মানুষকে উপর থেকে দেখেই আলাদা করা যায়। পৃথিবীর মানুষের কানের পশ্চাদভাগ গোল। কিন্তু জাম্বুসির মানুষের কানের পশ্চাদভাগ একটা কোণ হয়ে পিছন দিনে বেঁকে থাকে, ঠিক কোনো শ্বাপদের মতো।
অর্থের তার কোনো অভাব নেই। তার সংগঠন থেকে সে নিজের জন্য যা সঞ্চয় করতে পেরেছে, তাতে সে গোটা ফিজি আইল্যান্ডটা কিনে নিতে পারে। অতএব, জাম্বুসিতে যাবার আগে পৃথিবীর কোনো ভালো কসমেটিক সার্জেনকে দিয়ে নিজের কানের একটা ব্যবস্থা করিয়ে নিতে হবে!
কিছুদিন কলকাতায় একটা হোটেলে বেনামে থেকে প্রয়োজনীয় সমস্ত তথ্য সংগ্রহ করল মৃন্ময়। তারপর সময় করে একবার দক্ষিণ কোরিয়া গিয়ে, একজন নামজাদা ডাক্তারের কাছ থেকে করিয়ে নিল নিজের কানের সার্জারি। ঠিক যেমনটা সে চাইছিল, ঠিক যেমন জাম্বুসির মানুষদের কান—তেমনটাই দেখতে হল তার কানও। গন্তব্য এখন ‘জাম্বুসি’। বেশি দেরি না করে সে আবার ফিরে এল কলকাতায়।
জাম্বুসি নামক সেই অজানা জগতে প্রবেশ করার দরজা রয়েছে মীর্জাপুর-বাঁকিপুর নামক একটি জায়গায়। হাওড়া কর্ড-লাইন থেকে বর্ধমানগামী কোনো ট্রেন ধরলেই যাওয়া যাবে সেই স্টেশনে। স্টেশন থেকে হাঁটা পথে কুড়ি মিনিট। তারপরেই পড়বে সেই জলাশয়। যেই জলাশয়ে ডুব দিয়ে, জলের তলদেশের দিকে ডুব সাঁতার দিলেই যে কোনো ব্যক্তি একসময় ভেসে উঠবে একটা নতুন জগতের জলাশয়ে। যার নাম জাম্বুসি।
এই সবই মৃন্ময়কে চিনিয়েছিল, দেখিয়েছিল তার বন্ধু বিকাশ। জায়গাটা যে তার এরকমভাবে প্রয়োজনে লেগে যাবে, তা সম্পর্কে সেদিন কোনো ধারণাই করতে পারেনি মৃন্ময়।
***
জাম্বুসিতে প্রবেশ করে আবার নাম ভাঁড়িয়েছে মৃন্ময়। এখন তার নতুন নাম মিরান। এখানে আসার পর একটা নেতা গোছের বন্ধুও জুটিয়ে ফেলে সে। যার নাম প্লৌক। এখানের সবাইকে সে বলেছে—সে জাম্বুসির প্রান্তীয় অঞ্চলের লোক, এখানে এসেছে কাজের খোঁজে।
তবে, সে যে আসলে জাম্বুসির লোক নয়—তা প্লৌকের কাছ থেকে বেশিদিন চেপে রাখতে পারেনি সে। ধরা পড়ে যাবার পর সে পুরোটা স্বীকার না করলেও এটা তাকে বলে যে সে পৃথিবীর লোক, এখানে এসেছে বিশেষ একটা কাজে। তবে জাম্বুসির এবং সেখানকার মানুষের ক্ষতি সে কখনোই করবে না।
মিরান যে আসলে পৃথিবীর মানুষ, সেটা শুনেই প্লৌকের চোখটা যেন একবার দপ্ করে জ্বলে ওঠে। সুযোগ যেন সশরীরে তার কাছে উপস্থিত হয়েছে! মিরানকে না চটিয়ে সে তার সঙ্গে একটা সন্ধি করতে চায়।
বছর দশেক আগে পৃথিবীর একজন এসে প্লৌকের দাদা হুদম্যর বাগদত্তার (যদিও তাদের বাগ দান কোনো কালেই সম্পন্ন হয়নি) সঙ্গে চক্রান্ত করে হুদম্যকে মেরে ফেলে। তখন প্লৌকের বয়স কত হবে… প্রায় ষোলো! পৃথিবীর সেই লোকটিকে দেখতে ছিল হুবহু জাম্বুসির একটি লোক সাম্বো-র মত। শুধু তার কানটা ছিল সাম্বোর থেকে আলাদা। প্লৌকের ধারণা—এই একই দেখতে হবার সুযোগ নিয়ে সেই লোকটা তার দাদার বিরুদ্ধে চক্রান্ত করতে সক্ষম হয়েছিল।
প্লৌক এখন দাদার মৃত্যুর বদলা চায়, এবং জাম্বুসির মেয়েকে জাম্বুসিতে ফিরিয়ে আনতে চায়।
সব শুনে মিরান মনে মনে হাসে। কাকতালীয়তা হয়তো একেই বলে! সে প্লৌককে প্রতিশ্রুতি দেয় যে, পৃথিবীতে গিয়ে সে যেখান থেকে পারুক তার দাদার হত্যাকারীদের খুঁজে বের করবে, এবং জাম্বুসির মেয়েকে জাম্বুসিতেই ফিরিয়ে আনতে সে প্লৌককে সাহায্য করবে। তবে একটা শর্তে… বিনিময়ে সে যতদিন জাম্বুসিতে থাকবে ততদিন প্লৌকের তাকে সবরকমের সাহায্য করতে হবে।
***
প্রায় ছয় বছর কেটে গিয়েছে মৃন্ময় জাম্বুসিতে মিরান নাম নিয়ে আছে। পৃথিবীতে না থাকলেও, পৃথিবীর সমস্ত খবরাখবর রাখে সে। এমনকি পৃথিবীর বেশ কিছু শক্তিশালী মানুষদের সঙ্গে যোগাযোগও রেখেছে সে এই কয়েক বছরে। প্লৌক নিজের প্রভাব খাটিয়ে তাকে সবরকমভাবে সাহায্য করে চলেছে। কিন্তু, মাঝেমাঝেই তার প্রতিশোধস্পৃহা মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। এতগুলো বছর কেটে গেল, অথচ মিরান তার কথা রাখেনি এখনও! মাঝে মাঝে তার মনে হয়—মিরান তাকে ঠকাচ্ছে নাতো! তবে মিরানের কাছে সন্দেহ প্রকাশ করে সে মিরানকে চটাতে চায় না। মিরানই তো তার কাছে একমাত্র আর শেষ সুযোগ!
এরই মধ্যে মিরানের হাতে এসে পড়েছে একটা নোটবুক। নোটবুকটা পৃথিবীর একজন বিখ্যাত ইঞ্জিনিয়ার তথা বিজ্ঞানী জন এফ. মিশেল-এর। জিনিসটা পেয়ে মিরান যেন হাতে চাঁদ পেল। এমন একটা জিনিসেরই তো অপেক্ষা করছিল সে! জাম্বুসিতে আসা ইস্তক সে বিস্তর পড়াশোনা করেছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বিজ্ঞানের বই, এমনকি জাম্বুসিতে উপলব্ধ বিভিন্ন প্রযুক্তিগত ধারণা ও তত্ত্ব নিয়েও পড়াশোনা করেছে সে। তবে কোনো কিছুতেই তার উদ্দেশ্য সফল করার মতো বিশেষ কোনো উপাদান পায়নি সে। কিন্তু মিশেল সাহেবের নোটবুক—তার কাছে একটা নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে। একটা নতুন আরম্ভ! আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠল মিরান।
***
হান্ডুরাস, গুয়াতেমালা, এল সালভাডোর থেকে সেখানকার প্রাচীন সভ্যতার বহু নিদর্শন ও শিল্পকর্ম ইতিহাসে বহুবার লুঠ হয়েছে বহু বিদেশিদের দ্বারা। এমনকি স্থানীয় অধিবাসীরাও অর্থের লোভে সেখানকার বহু প্রাচীন জিনিস চুরি করে বিক্রি করে দিয়েছে বিদেশিদের কাছে।
পঞ্চাশের দশকে প্রখ্যাত ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ার জন ফ্রান্সিস মিশেলের হাতে অদ্ভুতভাবেই এসে পড়ে একটা অদ্ভুত দেখতে যন্ত্র। জিনিসটা অনেক জনের হাত ঘুরেই যে তাঁর কাছে এসেছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। জিনিসটা যাঁর হাত থেকে মিশেল সাহেব পান তিনি বলেছিলেন, ‘তাঁর ধারণা এই পৃথিবীতে একমাত্র ব্যক্তি জন এফ. মিশেল-ই নাকি জিনিসটার সঠিক বিশ্লেষণ ও মূল্যায়ন করতে পারবেন।’
জিনিসটা একটা আয়তাকার বস্তু। যার একদিকটা কাচের মতো মসৃণ এবং অন্য দিকটা শক্ত প্লাস্টিকের আবরণে মোড়া। উপরে এবং পাশে মোট তিনখানা বোতামও আছে বস্তুটাতে।
বস্তুটার ইতিহাস সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানতে পারেননি মিশেল সাহেব। শুধু এটুকুই জেনেছেন—জিনিসটা হান্ডুরাস, গুয়াতেমালা অথবা এল সালভাডোরের কোনো অঞ্চল থেকে প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শন হিসেবে পাওয়া গেছে। অথচ জিনিসটা তৈরিতে এমনসব পদার্থ ব্যবহার করা হয়েছে, যার মধ্যে অনেক কিছু বর্তমান যুগের মানুষের কাছেই অজানা-অচেনা। বিজ্ঞানও ব্যাখ্যা দিতে পারেনি তার। অথচ এত প্রাচীন একটা সভ্যতায় এমন একটা যন্ত্র কোত্থেকে এল, সেটা নিয়ে অনেকেই সন্দীহান। অনেক কন্সপিরেসি থিয়োরিস্টদের মতে জিনিসটা কোনো ভিনগ্রহ থেকে আসা এক বস্তু। তবে জিনিসটা যে কোনো ইলেকট্রনিক যন্ত্র—সে সম্পর্কে প্রায় সকলেই নিশ্চিত। তাই বর্তমান কালের একজন সেরা ইলেকট্রনিক বিশেষজ্ঞ মিশেল সাহেবের হাতে জিনিসটা শেষমেষ এসে ধরা দিল। যাতে তিনি বস্তুটা খুঁটিয়ে দেখে তার ব্যাখ্যা দিতে পারেন।
মিশেল সাহেব সেই বস্তুটা খুলে বিভিন্ন অংশের বর্ণনা ও ব্যাখ্যা লিখতে থাকেন তাঁর নোটবুকে। পরবর্তীকালে তিনি ‘মোটোরোলা’ কোম্পানির জন্য অনেক বড়ো বড়ো কাজ করেন। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল—তিনি মোটোরোলা কোম্পানির জন্য প্রথম অ্যাডভান্স পেজার বানান। যা ছিল পূর্বে ব্যবহৃত পেজারগুলোর থেকে অনেকটাই আলাদা এবং উন্নত। এছাড়া তাঁরই তত্ত্বাবধানে মার্টিন কুপার মোটোরোলা কোম্পানির মাধ্যমে ১৯৭৩ সালে প্রথম বাজারে আনেন সেলুলার মোবাইল ফোন।
মিশেল সাহেবের কাছে থাকা সেই অদ্ভুত যন্ত্রটার যদিও পরে কোনো খোঁজ পাওয়া যায় না। তবে তাঁর নোটবুকটা কোনোভাবে তাঁর কাছ থেকে হারিয়ে যায়, এবং পরবর্তীকালে কালোবাজারে বিক্রি হয়ে যায়। সেই সত্তর-আশির দশকে মিশেল সাহেবের ঘনিষ্ঠ বৃত্তে একটা চাপা গুঞ্জন শোনা যেত—জন ফ্রান্সিস মিশেল নাকি কোনো এক আলাদিনের চিরাগের সন্ধান পেয়েছেন, যার সাহায্যেই তিনি নিজের পেশায় এত নাম করতে পারছেন এবং মোটোরোলা কোম্পানিকে ইলেকট্রনিক যুগের একটা বৈপ্লবিক মাধ্যম হিসেবে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারছেন!
তিন
জুলাই ২০১২, কলকাতা:
“কী ব্যাপার? আজ তোমার মন ঠিক নেই মনে হচ্ছে?” নিম্মি দরজার সামনে এসে জিজ্ঞেস করল বিকাশকে।
বিকাশ নিজের স্টাডি রুমে বসে ঘন ঘন মদ্যপান করছে, আর মাঝে মাঝে উঠে ঘরের এপাশ থেকে ওপাশ দ্রুত পায়চারি করছে। নিম্মি বুঝেছে তার স্বামীর মাথায় আজ কিছু একটা দুশ্চিন্তার বিষয় ঘুরছে। না হলে আজ বাড়ির ছবিটা অন্যদিনের মতোই অন্যরকম হত।
বিকাশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল নিম্মির দিকে। তারপর হাতের ঈশারা করে ভিতরে ঢুকে বসতে বলল।
নিম্মি এসে একটা চেয়ার টেনে বসলে, বিকাশ বলল, “তোমার মৃন্ময়কে মনে আছে?”
“হ্যাঁ, মনে থাকবে না কেন? ওইতো… তোমার যেই বন্ধুটা সন্ত্রাসবাদী হয়ে গিয়েছিল তো? আর আমাদের এই জগৎটাকে ধ্বংস করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছিল।” বলল নিম্মি।
“হ্যাঁ। সে আবার ফিরে এসেছে। সে এতদিন লুকিয়ে ছিল তোমার বাপের বাড়ির এলাকায়।”
“বাপের বাড়ির এলাকা! মানে… ”
“হুম্ম্, জাম্বুসি।”
“কী করে বুঝতে পারলে?”
“কিছুদিন আগে আমি স্বচক্ষে দেখেছি ওকে। জাম্বুসিতে ধরা যাতে না পড়ে যায়, সেইজন্য নিজের কানগুলোও তোমাদের মতো বানিয়ে নিয়েছে।”
“বল কী! বাবা ঠিক আছে তো? ও জাম্বুসির কোনো ক্ষতি করবে না তো?”
“না না। ওর উদ্দেশ্য অন্য। জাম্বুসির ক্ষতি হলে ও নিজেই বিপদে পড়বে। আচ্ছা… তোমার মনে আছে বছর অষ্টেক আগেকার একটা দিনের কথা? যেদিন আমি অফিস থেকে ফিরে দেখলাম আমাদের বাড়ির দরজা হাট করে খোলা। আর তুমি অঘোরে ঘুমোচ্ছ তোমার বিছানায়। বাড়ির সমস্ত জিনিসপত্র-জামাকাপড় সব উলট-পালট হয়ে ছড়িয়ে পড়ে রয়েছে মেঝেতে। আলমারিগুলোর লক ভাঙা। আপাতভাবে দেখলে মনে হয় ঘরে কোনো চোর ঢুকেছিল। কোনো মূল্যবান জিনিসের খোঁজে সারা বাড়ি তছনছ করে রেখেছে। অথচ ভালো করে দেখে বোঝা গেল ঘর থেকে কোনো মূল্যবান জিনিসই চুরি হয়নি। তোমার ঘুম ভাঙার পর তোমায় জিজ্ঞেস করেছিলাম ওসব সম্পর্কে কিছু জানো কিনা! তুমি তো যেন আকাশ থেকে পড়লে!”
“হ্যাঁ হ্যাঁ… আমার মনে পড়েছে। ওরকম অদ্ভুত অভিজ্ঞতা আর কোনোদিন হয়নি আমার। বাড়িতে এতকিছু হয়ে গেল, আর আমি বিন্দুমাত্র টের পেলাম না!”
“… আজ বুঝতে পারছি, চোর এসে কোন্ মূল্যবান জিনিসটার খোঁজ করেছিল সেদিন। সে তো জানত না—এরকম একটা সন্দেহ আমি আগেই করেছিলাম। তাই আমি জিনিসটা নিজের কাছে না রেখে, রেখেছিলাম ব্যাঙ্কের লকারে। যদিও তাকে চোর বলা বোধহয় যুক্তিসম্মত হবে না। কারণ, সে যেটা নিতে এসেছিল, সেটা তো তারই জিনিস।”
“তার মানে তুমি বলছ… মৃন্ময় এসেছিল, তার সেই ভাঙা মোবাইল ফোনটার খোঁজে?”
“একদমই তাই।”
“যদি তাই-ই হয়… তাহলে মৃন্ময়কে আটকানোর একটা পথ কিন্তু এখনও খোলা আছে… ”
বিকাশ অবাক হয়ে তাকাল নিম্মির দিকে।
“ফোনটা তো এখনও তোমার কাছেই আছে।”
***
“অচিন্ত্য, তুমি বলেছিলে না… উইশটেল মোবাইল ফোন কোম্পানির মালিকের ছেলে তোমার ব্যাচমেট ছিল?” বিকাশ জিজ্ঞেস করল।
“হ্যাঁ, স্যার। ঋষভ। আমরা আই.আই.এম. কলকাতায় একসঙ্গে পড়তাম।” অচিন্ত্য বলল।
“ভরসাযোগ্য ছেলে? মানে… কোনো কনফিডেনশিয়াল কাজে ওকে ব্যবহার করা যাতে পারে?”
“স্যার… ছেলে হিসেবে তো এমনি ভালোই। ডাউন টু আর্থ। আমার সঙ্গে যোগাযোগ আছে এখনও। উইশটেল এর ম্যানুফ্যাকচারিং ইউনিটটা ওই সামলায় এখন। বাকি… আপনি ওর সঙ্গে কথা বলে বুঝে নেবেন এরকম কোনো দায়িত্ব ওকে দেওয়া যেতে পারে কিনা!”
“বেশ। তুমি ওর সঙ্গে কথা বলে একটা দিন ঠিক করো।”
“ওকে, স্যার।”
***
উইশটেল ভারতবর্ষের একটা নামকরা মোবাইল ফোন প্রস্তুতকারী সংস্থা। দেশে তো বটেই, বিদেশেও এদের তৈরি পণ্যের যথেষ্ট নামডাক হয়েছে এখন। বর্তমানে এই সংস্থায় কর্মরত কর্মীর সংখ্যা প্রায় দশ হাজারেরও বেশি।
উইশটেল-এর নয়ডা হেডকোয়ার্টারে যখন বিকাশ ও অচিন্ত্য পৌঁছোল, তখন একেবারেই অপেক্ষা করতে হল না তাদের। ঋষভ ওদের আসার খবর শুনেই নিজের অফিসে ডেকে নেয়। অচিন্ত্য অবশ্য ঋষভকে আগে থেকেই জানিয়ে রেখেছিল যে, তারা একটা কনফিডেন্সিয়াল প্রোজেক্ট নিয়ে খুব জরুরি কথা বলতে আসবে।
ভূমিকা বেশি না বাড়িয়ে এবং ইতিহাস বিবৃতি না করেই বিকাশ সরাসরি কাজের কথা বলল। তার সঙ্গে করে আনা মৃন্ময়ের ভাঙা ফোনের টুকরোগুলো সে ঋষভের সামনে পেশ করল। “এই ফোনটা ঠিক যেমনভাবে তৈরি আছে, তেমনভাবেই আমার চাই। এর পি.সি.বি.-তে বসানো প্রত্যেকটা কম্পোনেন্ট ঠিক যেমন যেমন আছে, তেমন তেমন ভাবে নতুন করে তৈরি করে বসাতে হবে। ফোনের অপারেটিং সিস্টেমটাও ঠিক যেমনভাবে কাজ করে তেমনই রাখতে হবে। অর্থাৎ কোডিং-এ কোনোরকম হেরফের চলবে না। এমনকি ফোনের মডেলটাও যেমন আছে ঠিক সেরকমই চাই। মোদ্দা কথা—এই ভাঙা ফোনটা ‘অ্যাস ইট ইস’ আমার নতুনভাবে এবং সচল অবস্থায় চাই। তবে… তোমরা তোমাদের কোম্পানির কোনোরকম লোগো বা সিগ্নেচার ব্যবহার করতে পারবে না এতে।”
ঋষভের মুখ দেখে বোঝা গেল বিকাশের এরকম আবদারে সে খানিকটা অবাকই হয়েছে। সে কিছুক্ষণ ফোনটা, আর কিছুক্ষণ বিকাশের মুখের দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে থেকে তার একজন কর্মচারীকে ডাকল।
“আরেকটা কথা… ” বিকাশ আরও বলল, “অচিন্ত্য বোধহয় তোমাকে আগেই বলেছে—কাজটা খুবই কনফিডেন্সিয়ালি করতে হবে। রাষ্ট্রীয় সুরক্ষার ব্যাপার জড়িত আছে এর সঙ্গে। এই কাজের সমস্ত নির্দেশ খোদ হোম-মিনিস্টার থেকে আসছে। সুতরাং… ”
কথা বলতে বলতে তলব করা কর্মচারীটি এসে ঢুকল ঋষভের ঘরে।
“আপনারা কিছু নেবেন? ঠান্ডা, গরম?” ঋষভ জিজ্ঞেস করল বিকাশদের।
“চা চলতে পারে।” বিকাশ বলল। অচিন্ত্যও ঘাড় নাড়িয়ে সায় দিল।
“রামুকে বলে দুটো চা পাঠাও এখানে। আর অতুলবাবুকে বলো আমার কাছে আসতে। … বলবে আর্জেন্ট আছে।” বলে ঋষভ কর্মচারীটিকে বিদায় দিল। তারপর বিকাশের দিকে ঘুরে বলল, “আপনি একদম চিন্তা করবেন না স্যার। মি. অতুল গুলাটি আমাদের চিফ ইঞ্জিনিয়ার। খুবই বিশ্বস্ত লোক, আর অভিজ্ঞতাও অনেক। আপনি নিশ্চিন্তে ওঁকে পুরো ব্যাপারটা বলবেন, আশাকরি আপনি আশাহত হবেন না।”
***
দিন পনেরো পর উইশটেল-এর নয়ডা অফিসে আবার ডাক পড়ল বিকাশের। ঋষভ জানাল ফোনের পি.সি.বি. ডিজাইন প্রায় প্রস্তুত। তবে, অতুলবাবু জানিয়েছেন পুরোনো ফোনটার মাদারবোর্ডে বসানো একটা বিশেষ ত্রিভুজাকৃতি কম্পোনেন্ট নাকি কোনো মোবাইল ফোনে ব্যবহারই করা হয় না, এবং সেটাকে নতুনভাবে প্রস্তুত করাও সম্ভব নয়। অতুলবাবু নাকি এরকম জিনিস জীবনে প্রথমবার দেখছেন। তবে তিনি এটা বুঝতে পেরেছেন যে, ওটা একটা ক্যাপাসিটর। যেটা ফোনের রেডিয়ো-ওয়েভকে অ্যাম্পলিফাই করতে সাহায্য করে। তবে, সুখবর হচ্ছে এটা যে জিনিসটা পুরোনো ফোনটার মধ্যে থাকা অবস্থাতেও সেটার কার্যক্ষমতা হারায়নি। যদি বিকাশ অনুমতি দেয়, তাহলে অতুলবাবু পুরোনো ফোনটা থেকে সেটা তুলে নতুন ফোনের পি.সি.বি.-তে বসিয়ে দিতে পারেন।
এরপর, বিকাশ অনুমতি দেবার দিন সাতেকের মধ্যেই ঋষভ বিকাশের হাতে নতুন বানানো ফোনটা অর্থাৎ মৃন্ময়ের ভাঙা টাইম-মেশিনের নতুন সংস্করণ তুলে দেয়। ঠিক যেমন যেমন বিকাশের দাবি ছিল তেমন তেমনভাবেই প্রস্তুত হয়েছে সেটা। সেই অদ্ভুত ক্যাপাসিটরটা পুরোনো ফোন থেকে তুলেই নতুনটাতে বসানো হয়। এমনকি, পুরোনো ফোনের রম (ROM) থেকে অপারেটিং সিস্টেমের সমস্ত কোডিং কপি করে নতুন ফোনটাতে ভরে দেওয়া হয়।
যদিও ফোনটা বিকাশের হাতে তুলে দেবার সময় ঋষভের কোনো ধারণাই ছিল না—জিনিসটা আসলে কী, এবং জিনিসটার প্রভাব অদূর ভবিষ্যতে তার উপর কতটা পড়তে চলেছে! কনফিডেন্সিয়াল কাজ বলে বিকাশও তাকে বিস্তারিত কিছু বলেনি, এবং সেও এই নিয়ে ঘাঁটায়নি বিকাশকে। তার উপর যখন সে শুনেছে ব্যাপারটা ন্যাশনাল সিকিয়োরিটির সঙ্গে জড়িত—তাই গরম রক্তে দেশভক্তির আবেগ নিয়ে বিকাশ যা যা বলে গেছে, বাধ্য ছাত্রের মতো সে তাই তাই শুনে গেছে।
চার
জাম্বুসি, পৃথিবীর হিসেবে ২০১০ সাল:
মিরান ছয় বছর জাম্বুসিতে থেকে একনিষ্ঠ অধ্যাবসায় ও একাগ্রতা সহকারে জন ফ্রান্সিস মিশেল-এর নোটবুক থেকে পাওয়া তথ্য এবং নিজের পড়াশোনা ও গবেষণা একত্রিত করে সেই ইলেকট্রনিক যন্ত্রটার ডিজাইন পুনর্নির্মাণ করে।
সে অনেক আগেই বুঝেছিল প্রাচীন ওই সভ্যতা থেকে খুঁজে পাওয়া জিনিসটা আসলে হল বর্তমান কালের একটা স্মার্টফোন। কিছু মানুষ যে সেটাকে নিয়ে অ্যানসিয়েন্ট সিভিলাইজেশন-এর সঙ্গে এলিয়েনদের যোগসূত্র প্রমাণ করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছিল, তা ভেবেই একচোট খুব হেসেছিল সে।
যন্ত্রটার ডিজাইন নিয়ে মিরান পৃথিবীর আমেরিকাতে একজন বড়ো ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারের কাছে যায়, এবং তার কাছ থেকেই আসল বস্তুটা বানায়। এসবের পিছনে নিজের সঞ্চিত অর্থের একটা বিশাল পরিমাণ অর্থ খরচ করে ফেলতে হয় তাকে। কিন্তু কী আর করা যায়! তার উদ্দেশ্যর থেকে বড়ো তো কোনো কিছুই হতে পারে না! এই মোবাইল ফোনটা অর্থাৎ যেটা কিনা আসলে একটা টাইম-মেশিন, সেটা পুনরায় তৈরি করতে না পারলে তার উদ্দেশ্য কোনোদিনই সফল হতে পারবে না যে!
কী তার উদ্দেশ্য? এবার তার উদ্দেশ্য একটু অন্যরকম। আগে সে টাইম-মেশিন ব্যবহার করত শুধু সময়-যাত্রা করার জন্যই। কিন্তু এখন যে জানতে পেরেছে এই ফোন দিয়ে শুধুমাত্র অতীত বা ভবিষ্যতে যাবার দরজাই খোলা যায় না, তার থেকে বেশি কিছুও করা যায়! একটা ব্ল্যাকহোলের দরজাও খোলা যেতে পারে এর দ্বারা। ব্যাস… তা যদি সত্যিই সম্ভব হয় তাহলেই তো কেল্লাফতে! এর থেকে বেশি ধ্বংসলীলা চালাতে পারে আর কী এমন আছে!
তবে একটা সমস্যা এখনও আছে। আগের ফোনটার অতীত বা ভবিষ্যতের দরজা খোলার জন্য যে পরিমাণ রেডিয়ো ফ্রিকোয়েন্সি দরকার পড়ত, তা ফার্স্ট বা সেকেন্ড জেনারেশনের মোবাইল টাওয়ার থেকেই পাওয়া যেত। কিন্তু একটা ব্ল্যাকহোলের দরজা খুলতে গেলে যেরকম ইলেক্ট্রোম্যাগ্নেটিক ফিল্ড তৈরি করতে হবে, তার জন্য দরকার অনেক অ্যাডভান্স মোবাইল টাওয়ারের। যার সাহায্যে মোবাইল ফোনে ব্যাবহৃত রেডিয়ো ফ্রিকোয়েন্সি একটা উচ্চমাত্রায় নিয়ে যাওয়া যাবে।
বর্তমানে তার হিসেবে পৃথিবীতে, অর্থাৎ ২০০৪ সালে, বিশেষ করে ভারতে বহুল পরিমাণে যেই মোবাইল নেটওয়ার্ক ব্যবহার করা হয়—তা হল ফার্স্ট ও সেকেন্ড জেনারেশনের। এর দ্বারা সম্ভব নয় তার পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করার। যদিও থ্রি-জি নেটওয়ার্ক নিয়ে গবেষণা চলছে এবং ইতিমধ্যেই বেশ কিছু দেশের, বেশ কিছু জায়গাতেই তা স্থাপন করা হয়েছে। তবুও… সে তার নতুন বানানো টাইম মেশিন ব্যবহার করে দেখেছে—ভারতে থ্রি-জি ঢুকবে ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে।
তার জন্য তো পৃথিবীতে সময়ের পরিবর্তন হয় না। অতএব, বিস্তর সময় আছে তার হাতে। আরও কিছু অপেক্ষা করলে পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সম্ভাবনাও বাড়বে, এবং এই সময়ের মধ্যে নিজের গবেষণার উপর আরও দক্ষতা অর্জন করা যাবে। ফলে, তার পরিকল্পনা হয়ে উঠবে সেরার থেকেও সেরা… একেবারে অব্যর্থ!
***
সবই ঠিকঠাক মিরানের পরিকল্পনা মাফিক চলছে। তবে, প্লৌক কেমন যেন অধৈর্য হয়ে উঠছে দিনে দিনে। সে খালি ভাবছে—মিরান বুঝি তাকে ব্যবহার করছে নিজের কাজে, অথচ ভিতরে ভিতরে তাকে ঠকাচ্ছে! এই ছয় বছর ধরে সে মিরানকে সবরকমভাবে সাহায্য করে গেছে, কিন্তু তার নিজের উদ্দেশ্যের প্রতি এতটুকু সান্ত্বনাবাক্যও সে পায়নি মিরানের কাছ থেকে। আর কতদিন এভাবে চলবে! এবার তার মনের ভিতরে বিদ্রোহী সত্তা মাথা চাড়া দিতে শুরু করেছে। মিরান তার দাদার হত্যাকারীর মতোই অন্য জগতের একজন মানুষ। একে বিশ্বাস করা শুরু থেকেই উচিৎ হয়নি তার! যদি মিরান তাকে ঠকিয়ে জাম্বুসি থেকে পালিয়ে যায়—তাহলে কী করবে সে!
ফলে, প্লৌকের কিছু ব্যবহারে মিরান প্রমাদ গুনল। এই ছেলেটাকে হাতে রাখতে না পারলে তার জাম্বুসিতে থাকা এবং পরিকল্পনা কার্যকর করা সম্ভব হবে না। এতদিন সে কোনোভাবে প্লৌকের দাবী বিভিন্ন উপায়ে কাটিয়ে এসেছে। অজুহাত দিয়েছে—মোবাইল ফোনটা প্রস্তুত না হওয়া পর্যন্ত তার কোনো ক্ষমতা নেই। কিন্তু এখন তো ফোনটা প্রস্তুত হয়ে গেছে। এখন সে কী অজুহাত দেবে প্লৌককে? সফলতা যখন তার এত কাছে চলে এসেছে, তখন প্লৌককে চটানো তার পক্ষে হিতকর হবে না। অনেক ভেবে সে প্লৌককে শান্ত করার একটা উপায় বের করল। সে প্লৌককে বলল—সে তাকে পৃথিবীতে নিয়ে যাবে এবং তার দাদার হত্যাকারীদের চিনিয়ে দেবে।
***
মিরান সবসময় তার বাম হাতে পৃথিবীর একটা ঘড়ি পরে থাকে। তাতে পৃথিবীর সময়, দিন, মাস, সাল—সব দেখায়। সেটার সাহায্যেই সে হিসেব কষে বের করে পৃথিবীতে সে কখন-কোথায় যাবে। নতুন ফোনটা তৈরি হবার আগেও সেটা হাতে পরে থাকত, ফোনটা তৈরি হয়ে আসার পরেও সেটা পরে থাকে।
প্লৌককে সাময়িকভাবে আস্বস্ত করার জন্য সে ঠিক করে তাকে পৃথিবীতে নিয়ে আসবে। তবে, সে নিজে যেহেতু ২০০৪ সালে জাম্বুসিতে প্রবেশ করেছিল, তাই জাম্বুসি থেকে বেরোনোর পর হিসেবমতো ২০০৪ সালেই পৃথিবীতে গিয়ে পৌঁছোবে। কিন্তু প্লৌক যেহেতু আগে জাম্বুসির বাইরে বেরোয়নি, এটাই তার প্রথমবারের মতো পৃথিবীর মাটিতে পদার্পণ হবে, তাই সে সমান্তরাল কোনো সময়েই পৃথিবীতে পৌঁছবে। যেহেতু পৃথিবীতে এখন ২০১০ সাল চলছে, তাই ধরা যায় প্লৌক পৃথিবীতে প্রবেশ করলে ২০১০ সালেই গিয়ে পৌঁছবে। অর্থাৎ, মিরান আর প্লৌক একসঙ্গে জাম্বুসি থেকে পৃথিবীতে যাবার যাত্রা শুরু করলেও—দুজনে আলাদা হয়ে পড়বে এবং পৌঁছবে আলাদা আলাদা সময়ে। একজন পৌঁছবে ২০০৪ সালে, আরেকজন ২০১০ সালে।
এই সমস্যার সমাধানটাও ঠিক করে মিরান। সে প্লৌককে জানিয়ে রাখে—সে পৃথিবীতে পৌঁছে যেন একটা নির্দিষ্ট জায়গায় অপেক্ষা করে। মিরান সেখানে পৌঁছনোর পর, তার টাইম মেশিনের সাহায্য সঠিক সময়ে গিয়ে প্লৌককে খুঁজে নেবে এবং তারা আবার একসঙ্গে হয়ে পৃথিবীতে যেখানে যাবার যেতে পারবে।
প্লৌক মনে মনে মিরানকে পুরোপুরি বিশ্বাস করতে না পারলেও, মনে দ্বন্দ্ব নিয়ে শেষপর্যন্ত কোনোরকমে তার কথা মেনেই নেয়। মিরান যদি বিশ্বাসঘাতকতা করেও, তবুও তো তার কাছে ফেরার পথ খোলাই আছে! তা ছাড়া পৃথিবীতে যাওয়া আসার উপায়টাও তো লব্ধ করতে পারবে সে! দরকার হলে সে একাই তার দাদার হত্যাকারীদের খুঁজে বের করে উচিৎ শাস্তি দেবে
***
তবে, প্লৌকের দুশ্চিন্তা করার মতো আর কোনো কারণ ঘটল না। মিরানের পরিকল্পনা মাফিকই সবকিছু হল।
সেই জলাশয়টা অর্থাৎ দুই জগতের মধ্যবর্তী দরজাটা পার করার পর প্লৌক আর মিরান আলাদা হয়ে গেল। প্লৌক গিয়ে উঠল ২০১০ সালের কোনো একটা দিনে, আর মিরান গিয়ে উঠল ২০০৪ সালের কোনো একটা দিনে।
মিরান নিজের টাইম মেশিনের সাহায্যে প্লৌককে বলে রাখা নির্দিষ্ট জায়গাতে গিয়ে দুজনে আবার একসঙ্গে হল। তারপর চলল প্লৌকের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করার উদ্দেশ্যে।
***
পৃথিবীর নাম না জানা একটা জায়গায় নিয়ে গিয়ে প্লৌককে দূর থেকে দুজনকে দেখাল মিরান। একটা বাড়ির পিছন দিকের একটা খোলা জানালা থেকে প্লৌক দেখল দুজন প্রৌঢ় মানুষকে। লোকটি একটা চেয়ারে বসে আছে, আর মহিলাটি টেবিলের উপর তাকে খাবার পরিবেশন করছে। ভালো করে লক্ষ করে প্লৌক দেখল—মহিলাটির কালো চুলের পাশ থেকে তার কানটা ত্রিভুজের মতো হয়ে পিছন দিকে বেঁকে গেছে! ঠিক যেমন হয় জাম্বুসির লোকেদের!
প্লৌক উত্তেজিত চোখে মিরানের দিকে তাকাল। আর সঙ্গে সঙ্গে মিরানের চোখের ঈশারায় সে বুঝে নিল—এরাই তার দাদার হত্যাকারী।
প্লৌক দৌড়ে ঘরের ভিতরে ঢুকতে যায়। উদ্দেশ্য ছিল হয়তো—এখনই তাদের হত্যা করে দাদার মৃত্যুর প্রতিশোধ নেওয়া! কিন্তু মিরান তাকে বাধা দিয়ে, তার হাতটা টেনে ধরে।
কিছু একটা ভেবে উত্তেজনা দমন করে প্লৌক। মিরানের অবাধ্য হয় না সে।
মিরান তাড়াতাড়ি তার হাত ধরে বাইরের একটা ফাঁকা রাস্তায় নিয়ে যায়। বাইরে এসে প্লৌক মিরানকে জিজ্ঞেস করে এত ভালো একটা সুযোগ হাতছাড়া করার কারণ কী!
“সেটার সময় এখনও আসেনি। আজ শুধুমাত্র ওদের দেখানোর জন্য নিয়ে এলাম তোমাকে। চিনিয়ে দিলাম তোমার দাদার হত্যাকারীদের। তুমি তো আমায় অবিশ্বাস করছিলে, তাই এটা করলাম। তবে, আজ তোমার প্রতিশোধ নেওয়া যাবে না। তাহলে আমার একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ অসমাপ্ত থেকে যাবে। সময় হলে ঠিক তোমায় আবার নিয়ে আসব। তবে, তার আগে করতে হবে অনেক পরিকল্পনা। আর… তোমার যদি ভবিষ্যতে আর কোনোদিন আমার উপর অবিশ্বাস জন্মায়, তাহলে আজ তো তুমি সব চিনেই গেলে, যেদিন খুশি এসে ওদের মেরে নিজের প্রতিশোধ নিয়ে নিও।” মিরান বোঝানোর চেষ্টা করল প্লৌককে।
প্লৌক বুঝতে পারে না কোন্ অসমাপ্ত কাজ সম্পূর্ণ করার কথা বলছে মিরান। তবে তার কথায় সে খানিক শান্ত হয়। সে জানে মিরান খুব বুদ্ধিমান, তার মাথায় অনেক রকমের পরিকল্পনা ঘুরপাক খায় সবসময়। মিরানের সঙ্গে বন্ধুত্ব বজায় থাকলে তার লাভই হবে। আর সে এতদূর তাকে যখন নিয়েই এসেছে, নিজের কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছে, তখন তাকে ভবিষ্যতেও বিশ্বাস করা যেতেই পারে। সে বলে, “আমি ওদের দুজনকে মারব না। মারব ওই লোকটাকে। আর মেয়েটাকে নিয়ে আবার যাবো জাম্বুসিতে। মেয়েটা যেই সময়ে জাম্বুসি থেকে পালিয়েছিল, তাহলে আবার সেই সময়েই জাম্বুসিতে গিয়ে ঢুকবে। আমি চাই জাম্বুসির মেয়ে জাম্বুসিতেই থাকুক। তার শাস্তিও নির্ধারণ করুক আমাদেরই লোক।”
মিরান কিছু বলে না। শুধু মৃদু ঘাড় নাড়িয়ে প্লৌকের কথায় সম্মতি জানায়।
***
আগস্ট ২০১২, কলকাতা
“স্যার, টাইম মেশিন যখন তৈরি হয়েই গেছে, তখন সেটা ঠিকঠাক কাজ করছে কিনা সেটা একবার পরীক্ষা করে দেখা উচিত বলে মনে হয় না আপনার?” অচিন্ত্য বলে বিকাশকে। আসলে অচিন্ত্য এখনও বিকাশের কথাগুলো পুরোপুরি বিশ্বাস করে উঠতে পারেনি। তার এখনও সন্দেহ আছে বিকাশের টাইম মেশিন ও অন্য জগতের গল্পের উপর। তাই হাতেনাতে প্রমাণ পাবার জন্য সে অধৈর্য হয়ে উঠেছে, এবং বিকাশকে ক্রমাগত উস্কানি দেবার চেষ্টা করছে উইশটেল থেকে বানানো মোবাইল ফোনটা আদতেও কোনো টাইম মেশিনের মতো কাজ করে কিনা তার ডেমো দেখানোর জন্য!
বিকাশ কিন্তু এই ব্যাপারে খুবই উদাসীন। আসলে সে ভয় পায় টাইম মেশিনটা ব্যবহার করতে। প্রথমত, আগে সে কোনোদিন এরকম জিনিস ব্যবহার করেনি। শুধু মৃন্ময়ের মুখেই শুনেছে এটা ব্যবহার করার কথা। দ্বিতীয়ত, মৃন্ময়ের মুখে সে শুনেছে এই জিনিস ব্যবহারের ভয়ংকর পরিণতির কথা! প্রতিবার মৃন্ময় নিজে যখন এই টাইম মেশিন ব্যবহার করেছে তখন ভয়ানক বিপর্যয় দেখা দিয়েছে তার জীবনে। বিকাশ নিজে ওটা ব্যবহার করলে যে কোনো মারাত্মক পরিস্থিতির শিকার সে হবে না—তার নিশ্চয়তা কী আছে! মৃন্ময়ের মতো যদি উলট-পালট হয়ে যায় তারও জগৎ! তাহলে কী করে ঠিক করবে সে ওসব! এই জিনিসের পাল্লায় পড়েই মৃন্ময়; যে একদা প্রাণোচ্ছল, হাসিখুশি, বুদ্ধিমান ছেলে ছিল—সে এখন একটা ভয়ানক সাইকোপ্যাথ রাক্ষসে রূপান্তরিত হয়েছে!
“এই টাইম মেশিনের সবথেকে বড়ো খুঁত কী জানো, অচিন্ত্য? এটা হাতে নিয়ে যে কোনো সময়ের অতীতে পৌঁছিয়ে যাওয়া তো যাবে… কিন্তু আবার ফিরে আসা যাবে শুধুমাত্র নির্দিষ্ট একটা সময় পর্যন্তই।” বিকাশ বলল।
“ঠিক বুঝলাম না, স্যার।”
“ধরো… এই ফোনের সাহায্যে তুমি এমন একটা সময়ে গিয়ে পৌঁছোলে, যেখানে মোবাইল ফোনের ব্যবহার নেই, চারিদিকে মোবাইল নেটওয়ার্কের টাওয়ার নেই… তখন এই ফোন আর কোনো কাজের নয় তোমার কাছে। যাবার সময় তো ফোনটা একটা একমুখী দরজা খুলে তুমি যেখানে চাইলে পাঠিয়ে দিল, কিন্তু ফেরার সময় তুমি যদি সঠিকভাবে মোবাইল ফোনের নেটওয়ার্ক না পাও—তাহলে ফিরে আসার দরজা এই ফোন আর খুলতে পারবে না। আর তুমি আটকে যাবে সেখানেই, বাকি সারাটা জীবনের মতো।”
“বাপরে! এই জন্যই মৃন্ময়ের ওরকম অবস্থা হয়েছিল তাহলে?”
“হুম্ম্। এই ফিরে আসার ব্যাপারটা নিয়ে আমাদের অন্য কিছু ভাবতে হবে। বৈজ্ঞানিকভাবে এই টাইম মেশিন যাতে আরও ভালোভাবে ও সঠিকভাবে কাজ করে তার প্রচেষ্টা করতে হবে আমাদের। তোমাকে ওই ভবিষ্যত থেকে আসা মানুষটার কথা বলেছিলাম না…! যে আলিপুর জেল থেকে পালিয়েছিল। তার কাছে অন্যরকম একটা টাইম মেশিন ছিল। যেটা আমাদের কাছে নেই। ফলে তার একটা রেপ্লিকা বানিয়েও নিতে পারব না এখন… ঠিক যেভাবে এই ফোনটা বানাতে পারলাম। আমাদের অন্য কিছু ভাবতে হবে। আর পৃথিবীতে টাইম মেশিনের উপস্থিতি যখন সূর্যের মতো সত্য, তখন এটার যে অপব্যবহার হবে না—সেটাও বলা যায় না। অদূর ভবিষ্যতে আমাদের অনেক কাজ করতে হবে অচিন্ত্য। আমাদের একটা দল গঠন করতে হবে। যাতে থাকবে কিছু বিশ্বাসযোগ্য সদস্য, তোমার মতো। যাদের মধ্যে কেউ কেউ অতীতে গিয়ে, স্বহস্তে অতীতের কোনোকিছু না ছুঁয়ে, শুধু মুখের কথায়, লোকজনকে বুঝিয়ে ভবিষ্যতে ঘটা অপরাধ বা কোনো খারাপ কিছু বদলানোর চেষ্টা করবে। মোদ্দা কথায়—তারা হবে আমাদের দূত। সময়-দূত। এই ব্যাপারে আমি হোম মিনিস্টারের সঙ্গেও কথা বলেছি।”
“হোম মিনিস্টার স্যার শুনলেন আপনার কথা? রাজি হলেন?”
“ওই… নিমরাজি আর কি…! কোনোরকম ডেমো বা আমার কথার সাপেক্ষে প্রমান দেখাতে পারিনি যে! কিন্তু আমার এই পরিকল্পনা সফল হলে অনেক বিপদের হাত থেকে বেঁচে যাবে পৃথিবী।”
পাঁচ
২১ ডিসেম্বর ২০১২, কলকাতা:
বাইরে মহাপ্রলয় চলছে। দোতলা বাড়িটার নীচের তলে ড্রয়িং রুমের মেঝে কাঁপছে থরথর করে। ঘরটায় চারজন দাঁড়িয়ে আছে—দুজন দুজনের মুখোমুখি হয়ে খানিক দূরে। একপাশে রয়েছে বিকাশ ও নিম্মি, এবং উলটোদিকে রয়েছে মিরান ও প্লৌক। গোটা বাড়িটা যেন মাঝে মাঝেই দুলে উঠছে। যে-কোনো মুহূর্তে ঘরের ছাদ ভেঙে পড়তে পারে তাদের উপর। চারজনের একসঙ্গে কংক্রিট সমাধি হবে তাহলে।
“মৃন্ময়, পাগলামো করিস না। শোন আমার কথা… এসব বন্ধ কর। আমরা কথা বলে নিশ্চয়ই কিছু একটা সমাধানের রাস্তা বের করতে পারব। তার জন্য কোটি কোটি নিরপরাধ মানুষের এভাবে বলি নিস না।” বিকাশ বলল মিরানের উদ্দেশে।
“তাই নাকি! তুই করবি সমাধান! তোকে তো আমি অনেক আগেই সমাধানের রাস্তা বলেছিলাম। নিম্মিকে নিয়ে দিব্যি জাম্বুসিতে গিয়ে থাকতে পারতিস। তাহলে আর বাকিদের মতো এখানে বেঘোরে প্রাণটা হারাতে হত না তোদের… ” মিরান বিকাশকে উদ্দেশ্য করে বলছিল, কিন্তু প্লৌকের ক্রুদ্ধ ডাকে বাধা পড়ল তার কথায়। সে একবার প্লৌকের দিকে ঘুরে তাকাল। তারপর আবার বিকাশ ও নিম্মির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “একে চিনতে পারছিস?”
বিকাশ আর নিম্মি একে অপরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করল। এটা আন্দাজ করতে পারছে যে লোকটা জাম্বুসির, কারণ লোকটার কানদুটো ওখানকার মানুষের মতোই। কী জানি… আবার মৃন্ময়ের মতো অপারেশন করেও বানিয়ে নিতে পারে! তবে বেশি ভাবতে হল না ওদের।
প্লৌক নিজেই বলল, “হুদম্যকে মনে আছে? যাকে মেরে তোমরা জাম্বুসি থেকে পালিয়ে এসেছিলে! আমি সেই হুদম্যর ভাই। তখন কত ছিল আমার বয়স… পনেরো-ষোলো হবে! অনেক ছোটো ছিলাম। এখন অনেক পালটে গিয়েছি। তাই চিনতে অসুবিধা হচ্ছে… না?” বলে জোরে জোরে হেসে উঠল সে।
বিকাশ ও নিম্মি অবাক হয়ে দেখল তাকে। প্লৌকের সঙ্গে সঙ্গে মিরানও হেসে উঠল উচ্চস্বরে। তারপর হঠাৎই, নিজের কোমর থেকে ধারালো কোনো অস্ত্র বের করে প্লৌকের গলায় আমূল গেঁথে দিল মিরান।
ঘটনাটা এত তাড়াতাড়ি ঘটে গেল যে, প্লৌক আশ্চর্যতা প্রকাশ করারও সময় পেল না।
“তুই কী ভেবেছিস… তোর উদ্দেশ্য সফল করার জন্য তোকে এখানে নিয়ে এসেছি আমি? আমার বন্ধু বিকাশের শত্রু তুই। বন্ধুর শত্রু মানে আমারও শত্রু।” বলে মিরান করুণ চোখে একবার বিকাশের দিকে তাকিয়ে বলে, “ভবিতব্য কোনোদিন বদলানো যায় না রে বিকাশ… অনেক চেষ্টা করেছি আমি… কিন্তু… যা হবার, তা হবেই… ”
“কিন্তু… তুই যে নিজেকে গোটা মানবজাতির শত্রু প্রমাণ করেছিস মৃন্ময়! সেই হিসেবে… ” আর কিছু বলার সুযোগ পেল না বিকাশ।
ছাদ থেকে একটা বড়ো কংক্রিটের চাঁই ধ্বসে পড়ল মৃন্ময়ের উপর। প্লৌকও ততক্ষণে মেঝেতে শুয়ে পড়েছে রক্তাক্ত শরীর নিয়ে।
আর এখানে দাঁড়িয়ে থাকার মতো পরিস্থিতি নেই। বন্ধুর মৃত্যুতে শোকপ্রকাশ করারও অবস্থা নেই। বিকাশ নিম্মির হাত ধরে দৌড়ে বাড়ির বাইরে বেরিয়ে পড়ে। চারিদিকটা একবার দেখে নেয়। পুরো পৃথিবীটা যেন ভেঙেচুরে ফুটিফাটা হয়ে যাচ্ছে!
এরকম অবস্থাতেও নিম্মির হাত ধরেই একটা নির্দিষ্ট দিকে প্রাণপণে ছুটতে শুরু করল বিকাশ। বেশি দূরে যেতে হবে না, কাছেই গন্তব্য। একটা শেষ চেষ্টা করে দেখতেই হবে তার!
***
শহরের অন্য একদিকে, খবরের চ্যানেলে ঘটে চলা ঘটনার লাইভ-টেলিকাস্ট দেখেই অচিন্ত্য ঠিক করে ফেলেছে তার কর্তব্য। সে নিজের মোটর সাইকেল বের করে ছুটতে শুরু করে পার্ক স্ট্রিটের দিকে, যেখানে সেই উড়তে থাকা ড্রোনটা এই সমস্ত বিপদ ঘটাচ্ছে।
প্রবল বাধাবিঘ্ন পেরিয়ে, কখনও শর্টকাট রাস্তা ধরে, প্রাণপণে প্রবল গতিতে মোটর সাইকেল ছুটিয়ে সে পৌঁছোয় তার গন্তব্যে।
টিভি চ্যানেলে স্যাটেলাইট ছবির সাহায্যে দেখা যাচ্ছিল—ড্রোনটার সামনের দিকে ঘিরে রয়েছে একটা বিশাল বলয়, তার ভিতরের দিকটা নিকষ কালো অন্ধকার। আশপাশের সমস্ত জিনিস কোনো এক টানের প্রভাবে উড়ে গিয়ে প্রবেশ করছে সেই কালো বলয়ের ভিতরে।
অথচ, সে মোটর সাইকেল ছুটিয়ে যে স্থানে উপস্থিত হল সেটা সেই বলয়ের পিছন দিক। এদিক থেকে কালো বলয়টাকে বোঝাই যাচ্ছে না! যেন স্বচ্ছ একটা পর্দার ভিতর থেকে দেখা যাচ্ছে বিকেলের আকাশ! বলয়টার সামনের দিকে যে পরিমাণ ধ্বংসলীলা চলছে, বলয়ের পিছনের দিকটায় সেই ধ্বংসের হার অনেকটাই কম।
সে আশ্চর্য হয়ে দেখল একটা অদৃশ্য বলয় যেন ক্রমাগত তার উলটোদিকের পার্থিব জিনিসপত্র সমানে গিলেই চলেছে। বলয়ের পিছনের দিকটাতে সেও হালকা একটা টান অনুভব করল। আরেকটু এগিয়ে গেলেই আরও বেশি করে টানটা অনুভব করতে পারবে ভেবে, এগিয়ে গেল সে। সত্যিই! সে যেন মাটি থেকে আস্তে আস্তে হাওয়ায় ভাসতে শুরু করল। একটা অদৃশ্য হাত যেন তাকে কোথাও টেনে নিয়ে যেতে চাইছে! সে বুঝল আর কিছুক্ষণ পর এভাবেই হালকা টানে সে পৌঁছে যাবে বলয়টার সামনের দিকে, যেখান থেকে দেখা যাবে নিকষ কালো মহাজাগতিক শূন্যকে। তারপর সেটা তাকেও গিলে নেবে চিরতরে।
কোনোরকমে হাচড়পাচড় করে অচিন্ত্য রাস্তা থেকে একটা ভারী পাথরের টুকরো তুলে নিল। তারপর হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে ড্রোনটার অনেকটা কাছাকাছি যেতেই, সে হাতে ধরে রাখা পাথরটা সজোরে নিক্ষেপ করল উড়তে থাকা ড্রোনটার উপর।
অব্যর্থ নিশানায় পাথরটা গিয়ে লাগল ড্রোনটার পিছন দিকে। এবং সঙ্গে সঙ্গেই মোবাইল ফোন সমেত গোটা ড্রোনটা ছিটকে পড়ল কিছুটা দূরের রাস্তায়। একই সঙ্গে সর্বগ্রাসী বলয়টাও যেন তার কাজ বন্ধ করে বাতাসে মিলিয়ে গেল!
অচিন্ত্য হাওয়ায় ভাসতে থাকা অবস্থাতেই পড়ে গেল রাস্তায়। কনুই আর হাঁটুতে চোট পেল খানিক। কিন্তু সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই তার। প্রলয় থেমে গিয়েছে। সে দৌড়ে গেল রাস্তার একপাশে পড়ে থাকা ড্রোন সহ মোবাইল ফোনটার দিকে।
ড্রোনের দুটো বাহু ভেঙে গিয়েছে। সেটা আর উড়বার মতো অবস্থায় নেই। মোবাইল ফোনটার ব্যাটারি খুলে আলাদা হয়ে পড়ে রয়েছে।
অচিন্ত্য হাঁফাতে হাঁফাতে চারিদিকটা একবার দেখে নিল। কৃষ্ণ-গহ্বর তার করাল মুখ বন্ধ করেছে ঠিকই, কিন্তু ততক্ষণে অনেকটাই দেরি হয়ে গিয়েছে। এখান থেকে যদিও ভালোভাবে বোঝা যায় না, তবুও মনে হচ্ছে যেন অর্ধেক পৃথিবীকেই গিলে নিয়েছে সেটা। সামনের দিকে দূর-দূরান্তে কোনো সমতল ভূমি চোখে পড়ল না তার। পৃথিবীর অবস্থা এখন ঠিক যেন কোনো কমলা লেবুর খোসা ছাড়িয়ে খাবলে-খুবলে খেয়েছে কোনো অমানুষ। দূরে জায়গায় জায়গায় কালো ধোঁয়া। পৃথিবীর বুক চিরে তপ্ত লাভা বেরিয়ে এসেছে বিভিন্ন জায়গা থেকে।
এরপর আর সিদ্ধান্ত নিতে দেরি হল না অচিন্ত্যর। সে জানে অদূরে পড়ে থাকা ওই মোবাইল ফোনটা কীভাবে কাজ করে। সে দৌড়ে গিয়ে ড্রোনটা থেকে মোবাইল ফোনটা খুলে নিয়ে, পাশে পড়ে থাকা ব্যাটারিটা লাগিয়ে ফেলল তাতে। তারপর সেটাকে চালু করার চেষ্টা করল।
দু-তিন বার পাওয়ার বাটনটা চেপে ধরে রাখার চেষ্টা করার পরেই মৃদু কাঁপুনি দিয়ে চালু হতে শুরু করল ফোনটা।
অচিন্ত্যর মাথায় এখন শুধুই ঘুরছে—এই প্রলয় শুরুতেই বন্ধ করে দেবার চিন্তা। তার স্যার বিকাশ রায়ের প্রতিও আর কোনো অবিশ্বাস নেই এখন তার।
কিছুক্ষণের মধ্যে ফোনটা চালু হতেই, সে সোজা ফোনের ক্যালেন্ডার খুঁজে বের করার চেষ্টা করল। ফোনের স্ক্রিনটাতে একটু সমস্যা হচ্ছে। কখনও কোথাও আলতো চাপ দেবার বদলে জোরে চাপ দিতে হচ্ছে, আবার কখনও নিজে নিজেই বিভিন্ন জায়গায় ক্লিক হয়ে যাচ্ছে। তবে, এসব দেখার সময় নেই তার। তার উদ্দেশ্য কোনোরকমে ক্যালেন্ডার খুলে প্রলয়ের আগের দিন পৌঁছোনো। অনেকবারের চেষ্টায় ক্যালেন্ডারটা খুলতে সক্ষম হল সে।
কিন্তু একি! আগের দিনের তারিখে আঙুল ছোঁয়ালেও কোনো কাজ হচ্ছে না! তার বদলে নিজে থেকেই তারিখ পিছোতে শুরু করেছে! দিন, মাস, বছর পেরিয়ে যেতে যেতে যুগ পেরোতে শুরু করল।
অচিন্ত্য বিপদ বুঝে বারবার ফোনটার ব্যাক-বাটনে চাপ দিতে থাকল। কিন্তু কোনো কাজ হল না। এক সময় তার সারা শরীরে একটা কাঁপুনি দিল, এবং সঙ্গে সঙ্গেই তার সামনে খুলে গেল একটা বলয়। অন্য সময়ের দরজা।
বাধ্য হয়ে সামনের দিকে পা বাড়াল সে। দেখল সে একটা ঘন জঙ্গলে ঘেরা জায়গায় এসে পড়েছে। পিছনে ঘুরতেই সে দেখল বলয়টা অদৃশ্য হয়েছে। আর তার বদলে একটু দূরেই দেখা যাচ্ছে একটা স্থাপত্য। এটা সে চেনে। ছবি দেখেছে আগে। টিকাল মন্দির। গুয়াতেমালায় অবস্থিত এটা। প্রাচীন মায়া সভ্যতার একটা নিদর্শন এটা। কিন্তু এটাকে দেখে তো প্রাচীন মনে হচ্ছে না!
তারপরেই সে দেখল আশপাশ থেকে বেশ কিছু মানুষ এসে তাকে প্রায় ঘিরে ধরেছে। অদ্ভুত তাদের দেখতে। সকলের উর্ধাঙ্গ অনাবৃত। মাথায় বড়ো বড়ো চুল, অদ্ভুতভাবে পিছনের দিকে গুটিয়ে বাঁধা। নাকের মধ্যে মোটা মোটা নথ পরা। গলায় বুনো জন্তুর দাঁত বা নখের হার। একেকজনের শরীরে একেক ধরনের অদ্ভুত উল্কি আঁকা।
অচিন্ত্যর মুখ থেকে অস্ফুটে বেরিয়ে এল তিনটে শব্দ—এটা মায়া সভ্যতা! ভাগ্য তাকে বিকাশ স্যারের বন্ধু মৃন্ময়ের মতো পরিস্থিতিতেই টেনে এনে ফেলল! ফিরে যাবার আর কোনো পথ নেই তার কাছে। কারণ, এখানে কোনো মোবাইল ফোনের টাওয়ার খুঁজে পাওয়া যাবে না। আজ থেকে কয়েক হাজার বছর পর আবিষ্কার হবে মোবাইল ফোন।
তার আর বুঝতে বাকি থাকল না যে, তার অচিন্ত্য সান্যাল নামটা কালের গর্ভে বিলীন হয়ে গেল চিরতরে। গলাটা খুব শুকিয়ে যাচ্ছে তার। একটু জল পেলে খুব ভালো হত! ভাবতে ভাবতেই সে মাথা ঘুরিয়ে লুটিয়ে পড়ল মাটিতে।
***
বিকাশের মাথায় মৃন্ময়ের শেষ কথাগুলো সমানে ঘুরতেই থাকে। ‘ভবিতব্য কোনোদিন বদলানো যায় না রে বিকাশ…।’ মৃন্ময়ের কাছ থেকে এই কথাগুলো সে আগেও শুনেছে। ভবিতব্য নাকি কোনোদিন বদলানো যায় না। সময় ঠিক কোনো না কোনো রাস্তার মাধ্যমে সবাইকে সবার ভবিতব্যে পৌঁছিয়েই দেয়!
কিন্তু যদি… কোনোভাবে সকল রাস্তাগুলোকেই বন্ধ করে দেওয়া যায়… তাহলে?
নিম্মির হাত ধরে বাড়ি থেকে বেরিয়ে, রাস্তা বরাবর দৌড়োতে দৌড়োতে বিকাশ দেখল হঠাৎ যেন প্রলয়লীলা থেমে গিয়েছে! অশান্ত পৃথিবী খানিকটা হলেও শান্ত হয়ে পড়েছে। তার বাড়ি থেকে অফিসের দূরত্ব খুব একটা বেশি নয়। বাকি রাস্তাটা জমে থাকা ধ্বংসাবশেষ পেরিয়ে দুজন মিলে বিকাশের অফিসে গিয়ে ঢুকল।
বিকাশ দেখল তার অফিস বিল্ডিং-এর ছাদ উড়ে গেছে। বড়ো বড়ো কংক্রিটের চাঁই পড়ে আছে এদিকে-সেদিকে। কয়েকজন হতভাগ্য মৃত মানুষকেও দেখা গেল। নিজের ঘরটা লক্ষ্য করে এগোতে যাবার আগে সে নিম্মিকে বাইরেই দাঁড়াতে বলল। নিম্মি তার কথা মানল না। জেদ করে সঙ্গেই যেতে চাইল। অবশেষে বাধ্য হয়ে নিম্মিকে নিয়েই বিকাশ ঢুকল তার ভাঙা অফিস বিল্ডিং-এ।
অনেক বাধাবিঘ্ন পেরিয়ে নিজের ঘরের সামনে এসে সে একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল। তার কাজের টেবিলটা ঘরের এককোণে চলে গিয়েছে ঠিকই। কিন্তু তাতে কোনো ক্ষতির আভাস পাওয়া যাচ্ছে না। আরেকটু সামনে গিয়ে সে নিজের পকেট থেকে একটা চাবি বের করে টেবিলের একটা দেরাজ খুলল। সঙ্গে সঙ্গে বেশ কিছু দরকারি জিনিসের সঙ্গে বেরিয়ে এল সেই মোবাইল ফোনটা, যেটা সে কয়েকমাস আগে উইশটেল কোম্পানি থেকে বানিয়েছিল। এটা ব্যবহারের সময় এখন এসেছে।
ফোনটা হাতে তুলে নিয়ে বিকাশ দেখল সেটা চালু আছে। বিকাশের হাত কাঁপছে। কাঁপা হাতেই আলতো করে একটা চুমু খেল সে ফোনটাতে। তারপর আর এক মুহূর্ত দেরি না করে ফোনের ক্যালেন্ডার বের করে ২০০৪ সালের আগস্ট মাসের একটা দিনের উপরে গিয়ে ওকে বাট্নে চাপ দিল সে।
এটা তেমন একটা সময় যখন সে সদ্য সদ্য আই.বি. জয়েন করেছিল। শরীরে একটা কাঁপুনির মাধ্যমে সে আর নিম্মি পৌঁছে গেল দিনটাতে।
অন্য কোনোদিকে সময় নষ্ট না করে বিকাশ খুঁজে বের করল নিজেরই যুব বয়সের সত্তাটাকে। যুবক বিকাশ নিজের ও তার স্ত্রীর প্রৌঢ় রূপটাকে দেখে হতচকিত হয়ে গেল।
প্রৌঢ় বিকাশ যুবক বিকাশকে যথাসম্ভব বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করল গোটা ঘটনাটা।
তাদের উদ্দেশ্য মির্জাপুর-বাঁকিপুরের সেই জলাশয়টাকে সরকার যাতে কোনোভাবে অধিগ্রহণ করে, এবং সেই জলাশয়টাকে বুজিয়ে, তার উপর যেন কোনো সরকারি অফিস বানানো হয়।
যুবক বিকাশ প্রৌঢ় বিকাশের কথায় সম্মতি প্রকাশ করল, কিন্তু সে আই.বি. জয়েন করেছে খুব বেশি কাল হয়নি। ফলে এত বড়ো একটা কাজ তার পক্ষে এত তাড়াতাড়ি করে ফেলা সম্ভব হবে না।
প্রৌঢ় বিকাশ বলে সে শুধু নিশ্চিত করতে চায় ওই জলাশয়টা যেন বুজিয়ে ফেলা হয়। সেটা আজ না হোক কাল, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব করলেই হবে।
যুবক বিকাশ তাকে আশ্বাস দিয়ে বলে ভবিষ্যতের কথা মাথায় রেখে সে নিজের সাধ্যমতো চেষ্টা করবে যাতে জলাশয়টা বুজিয়ে ফেলা হয়।
এরপর প্রৌঢ় বিকাশ ও নিম্মি আবার বর্তমানে, অর্থাৎ ২১ ডিসেম্বর ২০১২ সালে ফিরে আসে।
এসে তারা দেখে যাবার আগে যে প্রলয় ঘটে চলেছিল, এখন সেই প্রলয়ের চিহ্নমাত্র নেই। তারা নিশ্চিন্ত হল। তার মানে কাজ হয়েছে! যুবক বিকাশ নিজের চেষ্টায় জলাশয়টা বুজিয়ে ফেলেছে!
পৃথিবী আর জাম্বুসির মাঝের রাস্তা বন্ধ হয়ে গেছে চিরকালের জন্য। মৃন্ময় আটকা পড়ে গিয়েছে জাম্বুসিতে। বিকাশ নিম্মির দিকে একবার দেখল। সে জানে এরপর থেকে কোনোদিন নিম্মি চাইলেও জাম্বুসিতে ফিরতে পারবে না, দেখতে পাবে না তার বাবাকে। মুখে কিছু বলল না সে। নিম্মি হয়তো বুঝতে পেরেছিল বিকাশের মনে কথা। কিছু না বলে সে বিকাশের হাতটা জড়িয়ে ধরে তার কাঁধে মাথা রাখল।
***
নিম্মিকে বাড়িতে রেখে, বিকাশ আবার অফিসে গিয়ে খোঁজ নিয়ে জানতে পারল ২০০৬ সালে মির্জাপুর-বাঁকিপুরের সেই জলাশয়টা বুজিয়ে, তার উপর একটা সরকারি ভবন প্রস্তুত হয়েছে। সে বুঝল টানা দুই বছরের চেষ্টায় যুবক বিকাশ এই কাজ করতে সক্ষম হয়েছে।
হঠাৎ তার মনে পড়ে অচিন্ত্যর কথা। সে কোথায়? এত বড়ো একটা খবর তাকে না জানালে কী করে চলবে! সে অচিন্ত্যর খোঁজ করে অফিসে। কিন্তু কেউই সেই নামে কোনো ব্যক্তির খোঁজ দিতে পারে না। একজন যুবক বিকাশকে দেখে তার সামনে এগিয়ে আসে। যুবকটি বিকাশের অচেনা। হয়তো ডিপার্টমেন্টে নতুন ঢুকেছে। সেই যুবকটিই প্রথম জিজ্ঞেস করল বিকাশকে, “কী ব্যাপার স্যার? আপনি এখন…?”
বিকাশ কিছুক্ষণ যুবকটির দিকে তাকিয়ে থেকে জিজ্ঞেস করল, “অচিন্ত্য কি আজ আসেনি?”
“কোন অচিন্ত্য, স্যার?”
“অচিন্ত্য… অচিন্ত্য সান্যাল। আমার অ্যাসিস্টেন্ট। কবে জয়েন করেছ তুমি?” কিছুটা ধমকের সুরেই বলল বিকাশ।
এইবার যুবকটি এমনভাবে তাকাল, যেন সে আকাশ থেকে পড়েছে! সে থতমত খেয়ে বলল, “স্যার… আমি আপনার অ্যাসিস্টেন্ট, গত আট বছর ধরে। সুদর্শন… সুদর্শন ঘোষ। স্যার… আপনার কি শরীর খারাপ লাগছে?”
এইবার বিকাশের অবাক হবার পালা। তার যেন সত্যিই শরীর খারাপ লাগছে! সুদর্শন…! গত আট বছর ধরে তার অ্যাসিস্টেন্ট! সে বুঝল ২০০৪ আর ২০১২ সালের মাঝে একটা বড়োসড়ো পরিবর্তন হয়ে গেছে। একটু পিছিয়ে গিয়ে সে একটা চেয়ারের উপর থপ করে বসে পড়ে। সুদর্শন এগিয়ে আসে, “স্যার… শরীর কি খুব খারাপ করছে? কাউকে ডাকব?”
***
ওদিকে মিরান তো জাম্বুসিতে আটকা পড়ে গেল ঠিকই। কিন্তু আমেরিকা থেকে সদ্য বানিয়ে আনা মোবাইল ফোনটা, অর্থাৎ টাইম মেশিনটা তার কাছেই থেকে গেল। এভাবে কতদিন তাকে জাম্বুসিতে আটকে রাখা যাবে কে জানে!
***
এরপরেও বিকাশের কর্মযজ্ঞ থেমে যায়নি। টাইম মেশিনে বর্তমান যেসব অসুবিধাগুলো আছে সেগুলোকে মেটানোর জন্য সে পৃথিবীর বহু বৈজ্ঞানিকদের সঙ্গে গোপন বৈঠক করে।
একটা নতুন ধরনের প্রযুক্তি আবিষ্কার হয়। ডিজিটাল ও অ্যানালগ সিস্টেমকে একই সঙ্গে যুক্ত করে, আরও উন্নত মানের হয় সেই প্রযুক্তি। তার নাম দেওয়া হয় ‘নাডিও’ (NADIO – Neo Analog and Digital Implanted Objects)। এই প্রযুক্তির মাধ্যমে যেই টাইম মেশিন তৈরি হল, তাতে কোনো মোবাইল টাওয়ার বা নেটওয়ার্কের প্রয়োজন পড়ে না। অর্থাৎ ব্যবহারকারী অতীতে যতদূর খুশি গিয়ে আবার ফিরেও আসতে পারেন।
এছাড়াও, টাইম মেশিনের অপব্যবহারের কথা মাথায় রেখে বিকাশ একটা দল গঠন করে। যার নাম সে দেয় ‘সময়-দূত’। যাদের প্রধান কাজ হল ভবিষ্যতের বিপত্তির কথা অতীতে গিয়ে কোনো নির্ভরযোগ্য ব্যক্তিকে জানিয়ে, তাকে বুঝিয়ে-শুনিয়ে কোনো বিশেষ কাজ বা ঘটনাকে তার মাধ্যমে রুখে দেওয়া। সময়-দূতদের উপর কড়া নির্দেশ আছে এই কাজ করার সময় তারা নিজেরা যেন পারিপার্শ্বিক কোনো ব্যাক্তি বা বস্তুকে প্রত্যক্ষভাবে প্রভাবিত না করে।
এই দলের আরও একটা কাজ হল এদের দ্বারা ব্যবহৃত কোনো টাইম মেশিন ছাড়া, খোঁজ পাওয়া বাকি সমস্ত রকমের টাইম মেশিন বাজেয়াপ্ত করা।
বিকাশ নিজের ব্যক্তিগত টাইম মেশিনটা অর্থাৎ সেই মোবাইল ফোনটা নিজের সঙ্গে রাখার ঝুঁকি নিল না আবারও। সে ওটাকে একটা ব্যাঙ্কের লকারে তালাবন্দি করে এল।
***
২০১৬ সাল, কলকাতা:
একদিন সকালে একটা নামকরা ব্যাঙ্কে ডাকাতি হয়ে গেল। যদিও দুষ্কৃতিরা প্রায় সকলেই ধরা পড়ে গেছে। এক অদ্ভুত পোশাক পরা, অদ্ভুত ক্ষমতাসম্পন্ন একটা লোক এসে সমস্ত ডাকাতকে ধরে ফেলে। টিভিতে বলছে সেই লোকটার নাম নাকি ‘ইলেক্ট্রোনট্’।
তবে, পুলিশ আর মিডিয়া এখনও জানে না যে এসবের মধ্যেও একজন ডাকাত সেখান থেকে পালিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছে। সে ব্যাঙ্কের লকারগুলো ভাঙার দায়িত্বে ছিল। নিজের গোপন ডেরায় এসে চুরি করা মালগুলো ব্যাগ থেকে বের করতে ব্যস্ত এখন সে। তার সামনে টিভি চলছে। টিভির সাংবাদিকের মুখে অদ্ভুত পোশাক পরা লোকটার নাম শুনে বিদ্রুপের হাসি খেলে গেল তার মুখে। “ইলেক্ট্রোনট্! হাহ্… কোনো অ্যাস্ট্রোনটের ছোটো ভাই নাকি?”
চুরি করা জিনিসগুলো বের করতে করতে একটা মোবাইল ফোন বেরোল তার মধ্যে থেকে। লকার ভাঙার সময় চোখ বন্ধ করে যা পেরেছে ব্যাগে ঢুকিয়েছিল সে। এখন এই পাতি মোবাইল ফোনটা দেখে খানিক বিরক্তই হল সে। “ব্যাঙ্কের লকারে এইসব হাবিজাবি জিনিস কে রাখে ভাই?” ঘরে থাকা এক পকেটমার বন্ধুর উদ্দেশে কথাগুলো বলে সে।
“ব্যাঙ্কের লকারে রেখেছিল মানে নিশ্চয়ই কিছু ঘাপলা আছে। দেখ তো কোনো বিশেষ ফোটো বা ভিডিয়ো আছে নাকি? কোনো রাঘববোয়ালের যদি কিছু ঘাপলা কেস থাকে, তাহলে ব্ল্যাকমেইল করতে পারবি।” পকেটমার ছেলেটি পরামর্শ দিল।
লকার ভাঙা ছেলেটি ফোনের মেমোরি ভালোভাবে ঘেঁটে দেখে বলল, “ধুস্স্… কিচ্ছু নেই।”
পাশের জন আবার উপদেশ দেয়, “তাহলে কাল ছোটুকে দিয়ে দিবি। বিক্রি করিয়ে দেবে। শ’পাঁচেক টাকা পেলেও পেতে পারিস।” বলে হাসতে থাকে সে।
Tags: অষ্টম বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা, কল্পবিজ্ঞান, সুমন সেন