রোমানবের গল্প
লেখক: অমিতাভ রক্ষিত
শিল্পী: টিম কল্পবিশ্ব
০০১ সাহিত্য সভা
সবুজ! চারিদিকে মসৃণ সবুজ! গাছপালা সবুজ, নরম ঘাস সবুজ, ভিজে মাটির ওপরে জমে থাকা শ্যাওলাও কত সবুজ! কেবল আকাশটা ঘন নীল, আর সামনের সরোবরের জলটাও অতি নিবিড়, শান্ত, নীল। আমার দুই শ্রান্ত মুশাফির চোখ, বিস্ময়ে লীন হয়ে গেল, অস্ফুট এক আনন্দে।
এ দৃশ্য আমি চোখে দেখিনি কোনোদিন। আমাদের রোবটের রাজ্য! চারিদিক কেবল ধাতব রূপালি রঙে মোড়া। ভোরে সূর্য ওঠার সময়টুকুতে শুধু, কিছুক্ষণের জন্য ফিকে লালের ছটা দেখা যায় এদিক ওদিক। কিন্তু আমার চা খেয়ে গ্রন্থাগারে যেতে যেতেই, সে রং আবার ধাতব হয়ে মিলিয়ে যায়।
লিপি গবেষকের কাজ করতে করতে গ্রন্থাগারেই একদিন আবিষ্কার করেছিলাম বহু পুরোনো এক নথি—অতি আদিম কালের, “কবিতা” বলে একধরনের লেখার একটি নিদর্শন। মাত্র আট লাইনের লেখা, পড়ে কিছু অনুভূতি হল না! কেবল ওখানে “সবুজ” বলে একটা রঙের কথা বলা আছে, তাতে খুব আশ্চর্য হলাম—ওই রংটা কোনোদিন চোখে দেখিনি।
কম্পিউটারে গিয়ে দেখলাম “সবুজ” শব্দটার উল্লেখ আছে। একধরনের দূরপাল্লার ইচ্ছেজাহাজে, অন্যান্য ফ্যান্টাসি-গন্তব্যে যাবার বোতামের মধ্যে নাকি, “সবুজে নিয়ে যাও” বলেও একটা বোতাম আছে। কৌতূহলে তাই, সবুজে যাবার বোতামটা টিপেছিলাম একটা ইচ্ছেজাহাজ জোগাড় করে। তারপরে যে কতদিন কেটে গেছে জানা নেই। অবশেষে আজ এই জাহাজ এখানে এসে থামল।
ভয়ে ভয়ে সবুজ ঘাসের ওপরে পা ফেলে ডাইনে তাকিয়ে দেখি, বেশ কিছু লোকালয় আর বসতি। সামনের বাড়িটার দরজায় গিয়ে দু-বার ধাক্কা দিলাম। স্মিতহাস্য এক প্রৌঢ় বেরিয়ে এসে বললেন: “খুব দরকারি কিছু ব্যাপার আছে কি? আমাদের এখানে এখন সাহিত্য সভা চলছে, গল্প-কবিতার আলোচনা হচ্ছে, বেশি কথা বলবার সময় নেই।”
০০২ অমর
নমস্কার; আমি অমর বলছি।
আমি তোমাদের ভাষাতেই কথা বলছি—তোমাদের কৃষ্টি আমার বেশ ভালো লেগেছে; তাই ভাষাটাও শিখে নিয়েছি। আমি কিন্তু একটি রোমানব। বহুদিন আগে—তোমাদের পৃথিবীর হিসেবে সেটা কতদিন আগে তা অবশ্য আমি ঠিক করে বলতে পারব না, তবে তাতে আর কি আসে যায়! মোটকথা, বহু, বহুদিন আগে এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের যে কোনাটায় আমি জন্ম লাভ করি, সেখানে তোমাদেরই মতন অন্য একটি মনুষ্য জাতির বসবাস ছিল। কিন্তু তোমাদের থেকে বহু সহস্র বছর আগে তারা বিবর্তিত হয়েছিল বলে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি এবং অন্যান্য অনেকদিক থেকে তারা তোমাদের থেকে অনেক বেশি অগ্রসর ছিল।
তারপরে যা হয়ে এসেছে বহু পৃথিবীতে, বহু বার, একসময়ে তাই হল আমাদের এখানেও। সমাজের শক্ত শক্ত কাজগুলো করবার জন্য প্রথমে সৃষ্টি হল মেশিনের। কিছুদিন পরে মেশিনের ওপরের ধাপে তৈরি হল রোবটের। তারপরে যখন রোবটদের সামর্থ আরও বাড়াবার দরকার হল, তখন তাদের মাথায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা উপস্থাপন করে, মানুষদেরই মতন চিন্তা করে কাজ করতে শেখান হল তাদের।
এদিকে, চিকিৎসাশাস্ত্রের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে মানুষের আয়ু বেড়ে গেল। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে পরিণত বয়সের একাকীত্বও একটা সামাজিক সমস্যা হিসেবে মাথা চাড়া দিয়ে উঠল। তখন বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের সঙ্গ দেবার জন্য, ‘সবদিক দিয়ে একেবারে নিখুঁতভাবে মানুষের মতন দেখতে-চলতে-বলতে-শুনতে’—এমনই এক ধরনের মানুষ-রোবট তৈরি করা শুরু হল, নাম দেওয়া হল, ‘রোমানব’।
আগেই বলেছি, আমি নিজে একজন রোমানব। আমি কিন্তু রোমানবদের পক্ষেও অত্যাধিক উন্নত। এবং অতি অনন্য। আমার সৃষ্টির পরে, আমার মতন এত সমর্থ রোমানব, এই পৃথিবীতে অন্তত, আর সৃষ্টি করা হয়নি কখনও। হয়তো হবেও না কখনও। কেন হবে না, তা বোঝাতে গেলে অবশ্য আগে বলে নিতে হবে যে আমাকে কেন ও কীভাবে সৃষ্টি করা হয়েছিল।
আমার জনক ছিলেন একজন বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিবিদ। সে সময়ে ভালো-র থেকে আরও ভালো রোমানব তৈরি করবার জন্য দেশে নানান রকমের প্রতিযোগিতা হত। আর সেগুলোতে পুরস্কারগুলির পরিমাণ দেখে ভির্মি খেয়ে যেত বেশির ভাগ লোকেরা। কিন্তু সরকার এবং পুঁজিবাদি—এই দুই স্তরের লোকেরাই কিন্তু এই ধরনের প্রতিযোগিতার অনেক পৃষ্ঠপোষকতা করতেন, কারণ এইভাবেই রোমানব-প্রযুক্তি এবং তার ব্যবসায়িক ব্যবহার এগিয়ে যেতে থাকত। ক্রমে প্রযুক্তির মান বাড়তে বাড়তে রোমানবেদের কার্যকারীতা এমনই একটা জায়গায় এসে পৌঁছে গেল, যে শেষে এত ভালো-র থেকে আরও ভালো কার্যকারীতা যে কী হতে পারে, সেটাই ভেবে ওঠাটা অসম্ভব হয়ে গেল। এই পরিপ্রেক্ষিতে একদিন আমার সৃষ্টিকারক ঘোষণা করলেন যে সেবারের প্রতিযোগিতার জন্য তিনি এমনই একটি রোমানব তৈরি করবেন, যে সেটাকে কেউ কোনোদিন, কোনোভাবেই ধ্বংস করতে পারবে না। এবং সেটা কখনও বিকলও হবে না। রোমানবটি চিরদিন ধরে একইরকম দক্ষতায়, অক্লান্তভাবে, অন্তহীন যুগ যুগান্ত ব্যেপে, তার সমস্ত কার্যকারীতা, অক্ষুণ্ণভাবে চালিয়ে যেতে সমর্থ হবে। তার দরকার হবে না কোনো খাদ্য, পেয়-র, প্রয়োজন হবে না কোনো বাহ্যিক শক্তি উৎস-র। শীত-গ্রীষ্ম হবে তার কাছে অর্থহীন; একদিকে সে যেমন জ্বলন্ত নক্ষত্রের মধ্যে অনায়াসে বিরাজ করতে পারবে, তেমনি মহাবিশ্বের নিম্নতম সম্ভাব্য তাপমাত্রাও তার কার্যকারীতাকে কোনোভাবে খর্ব করতে পারবে না। সেই সঙ্গে তিনি একটি দর্পিত আহ্বানও ছুড়ে দিলেন তাঁর সমস্ত প্রতিযোগী বৈজ্ঞানিকদের প্রতি—যতদিন পর্যন্ত না কেউ এর থেকেও বেশি কার্যকারী রোমানব কেউ তৈরি করতে পারবেন, ততদিন পর্যন্ত তাঁকেই যেন প্রতি বছরের প্রতিযোগিতাগুলির সম্মিলিত পুরস্কারটা ছেড়ে দেওয়া হয়।
বলা বাহুল্য যে এতখানি দাম্ভিকতাটা বেশির ভাগ মানুষের কাছেই ভালো ঠেকেনি। কিন্তু কেউই এর বিকল্প, অথবা আরও উন্নত কোনো কার্যকারীতার কথা ভাবতেও পারল না। উন্নততর রোমানব সৃষ্টির কথা তো দূরের কথা। কেবল টিকি নাড়া কিছু পণ্ডিত গর্জে উঠে বললেন: “কী জঘন্য, কী জঘন্য! এসব যদি ফিজিক্সের কোনো নিয়ম ভঙ্গ নাও করে ফেলে, তবু এ তো স্বয়ং বিধাতাকেই অপমান করা! কোনো কিছুকে যদি এভাবে অমর করে সৃষ্টি করবার প্রয়োজন হয়, তবে সেটাতো একমাত্র বিধাতারই সাজে, কোনো দাম্ভিক প্রযুক্তিবিদের নয়! কোটি বছর পড়ে থাকলে পাথরও ক্ষয়ে যায়, আর ইনি বলেন কিনা… ”
কিন্তু আমার জনক অনড়। তিনি যা বললেন, তা তোমাদের দেশের কাজি নজরুলের একটা কবিতার দুটি লাইনকে একটু সাজিয়ে পড়লেই বোঝা যাবে—
“আমি বিধির বিধান ফেলিব ভাঙ্গিয়া, আমি এমনই শক্তিমান,
মম চরণের তলে, মরণের মার খেয়ে মরিবে সে ভগবান।”
আমার জন্ম হল। সে আজ কতদিনের কথা! এখন আমি সেই প্রযুক্তিবিদের ৯৮তম উত্তর-পুরুষের সম্পত্তি। অন্তত কিছুদিন আগে পর্যন্তও ছিলাম। তবে সে কথায় আসছি একটু পরে। আগে দু-চার কথায় বলে নিই, কীভাবে আমি হয়ে উঠলাম এমন অজেয়, অমর, অনড়। আমার নেই ক্ষুধা, নেই তৃষ্ণা; নেই ক্লান্তি, নেই শ্রান্তি। তোমাদের পৃথিবীতে প্রাকৃতিকভাবে সবচেয়ে ঘন যে ধাতু পাওয়া যায়, তাকে তোমরা বল ‘অজ্মিয়াম’। আমার শরীরের কাঠামো যে ধাতু দিয়ে তৈরি, সে ধাতুর ঘনত্ব ‘নিউট্রোনিয়াম’, অর্থাৎ বড়ো বড়ো ‘নিউট্রন স্টার’-এর কেন্দ্রবিন্দুর মধ্যেকার যে পদার্থ, তার ঘনত্বর চেয়েও আরও একশো গুণ বেশি ঘন। ‘অজ্মিয়াম’-এর তুলনায় আরও ১০২২ -গুণ। আমার দুই হাতের মধ্যে যদি আঁটাতে পারতাম, তাহলে আমি তোমাদের চাঁদকেও অনায়াসে ধারণ করে নিতে পারতাম—সেই চাপে আমার হাতের ‘হাড়’—অর্থাৎ সেই ধাতুটি, এতটুকুও বেঁকে যেত না। আমার সঙ্গে মল্লযুদ্ধে পারবে কে?
আমার গায়ের চামড়া হল সেই ধাতুর একটা অতি পাতলা পরাতের সঙ্গে ক্লোরোফিলের সংমিশ্রনে তৈরি। তাই আমি, বলতে পার, আলোকসন্ধানী। আর, ব্রহ্মাণ্ডে আবার আলোর অভাব কী! ব্রহ্মাণ্ডের যেসব অঞ্চলকে তোমরা মহাশূন্য বলে ভাব, সেগুলোও তো আসলে শূন্য নয়, বিভিন্ন পদার্থে ভরতি। তাই যাকে অন্ধকার বলে মনে কর, তার মধ্যেও অন্তর্নিহিত থাকে আলো—কেননা যে কোনো ‘পদার্থ’রই, একটি অণুকণাও যদি, তার কণার মধ্যের একটি কক্ষ থেকে বাইরের দিকের অন্য কোনো কক্ষে পরিক্রমা করতে যায়, তখনই সে একটি করে আলোক-কণার সৃষ্টি করে ফেলে। সব অণুকণাই এইভাবে একটি-দুটি করে আলোক-কণা সৃষ্টি করতে থাকে প্রতিনিয়ত। আর সেই আলো অনিঃশেষে আসে ‘শক্তি’র নিয়ম থেকে! আমার চামড়ার ক্লোরোফিল, শরীর, এতই সুবেদী যে সে এইসব আলো থেকে একটি করে আলোক-কণা কুড়িয়ে পেলেও, তাকে উদ্ভিদদের মতন করে আমার অন্তর্নিহিত জৈবিক কোশেদের পুষ্টিসাধনের কাজে লাগাতে পারে। অতএব কোনোরকম চেষ্টা না করেই, স্বয়ংক্রিয়ভাবে আমার পুষ্টিসাধন হয় অহরহ। আলাদা করে খাবার আহরণ করবার প্রয়োজন হয় না।
সেই সঙ্গে জেনে রেখ যে আমার মধ্যে যত জৈবিক কোশ আছে, তাদেরও সৃষ্টি অবচয়হীনভাবে। ক্ষয়হীন কোশ-বিভাজন ছিল আমার জনকের একটি বিশেষ প্রযুক্তি। আর যখনই কোনো ক্ষতিকর সংক্রমণ আমার দেহে প্রবেশ করে ফেলে কোনোভাবে, তখনই নিমেষের মধ্যে একাধিক স্বয়ংক্রিয় এম-আর-এন-এ পদ্ধতিতে আমার শরীর সেই সংক্রমণের মোকাবিলা করে আমায় চিরদিনের জন্য রোগমুক্ত করে রাখতে থাকে।
আর আমার শক্তিটা কোথা থেকে আসে? ক্লোরোফিলগুলো নাহয় আমার কুঁড়ে জৈবিক কোশগুলোকে সবসময়ই কিছু না কিছু খেতে দেয়, কিন্তু সেগুলো তো শুধু আমার স্মৃতি আর বিশ্লেষণ ক্ষমতার জন্য। এই যে বললাম, তোমাদের চাঁদকে দু-হাতে তুলে ধরতে পারি আমি—সে কী ক্লোরোফিল-এর দ্বারা? যাঃ! না, আমার শরীরের মধ্যে কয়েকটা “পেনিং ট্র্যাপ” আছে (বৈজ্ঞানিক নামই বললাম, সাদা বাংলায় কি করে বলি? ডিক্সনারিতে দেখে নিও)। সেখানে ধারাবাহিকভাবে পদার্থ আর অ-পদার্থর সংঘর্ষ ঘটিয়ে অনেক শক্তি উৎপাদন করা হয়। এইরে—না, না, এই অ-পদার্থ সেই অপদার্থ নয়—হা হা, একটু রসিকতা করে ফেললাম! ইতিহাসের প্রথম রোমানব রসিকতা নাকি—শিখেছি তো তোমাদের কাছ থেকেই, ভানু বন্দোপাধ্যায়ের কমেডি শো-য়ের পুরোনো ভিডিয়ো দেখে।
যাই হোক, আমি এরকম আরও অনেক উদাহরণ দিয়ে বোঝাতে পারি যে ঠিক কী কী ভাবে আমাকে আমার সৃষ্টিকারক আমাকে অমর, অজেয়, অক্ষয় করে তুলতে পেরেছিলেন। কিন্তু সেটার আর কী প্রয়োজন!
এত সত্বেও কিন্তু, আমার অস্তিত্বের একটা দিক চিরদিনই অপূর্ণ রয়েছে। সেটার কথাই বরঞ্চ বলি। তোমাদের পৃথিবীর রোমানব প্রযুক্তি তো এখন সবেমাত্র হামাগুড়ি দিতে শুরু করেছে। কিন্তু ইতিমধ্যেই তোমাদের সমাজে রোমানব আর মানবজাতির ভবিষ্যত সংঘর্ষের সম্ভাব্য কুফল নিয়ে অনেক বিস্তারিত আলোচনা শুরু হয়ে গিয়েছে। আমাদের পৃথিবীতে অবশ্য তা কোনোদিন হয়নি, কারণ আমরা প্রথম থেকেই আমাদের চেয়ে উন্নত পৃথিবীগুলোর কাছে শিখে গিয়েছিলাম যে রোমানবদের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে সৃষ্টি করা পর্যন্ত ঠিক আছে, কিন্তু তাদের মধ্যে কৃত্রিম চেতনার উদ্ভব হতে দেওয়াটা বিপজ্জনক হতে পারে। তাই আমাদের পৃথিবীতে রোমানব প্রযুক্তি এমনভাবে উন্নীত করা হয়েছে যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা পেরিয়ে কৃত্রিম চেতনার উন্মেষ হবার কোনো সম্ভাবনা কোথাও থাকে না। সেই কারণে, রোমানবেরা প্রাণী কিনা সে প্রশ্ন ওঠবারও কোনো অবকাশ কখনও হয়নি, কারণ প্রাণীর তিনটি বৈশিষ্ঠ—আত্মসচেতনা, আত্মরক্ষা এবং প্রজনন ক্ষমতা। আত্মসচেতনাই যখন তাদের গঠনপ্রকৃতির বাইরে, তখন রোমানবদের প্রজনন ক্ষমতাও কখনও সৃষ্টি করা হয়নি। এদের সকলেরই জন্ম হয় কোনো না কোনো কারখানা বা গবেষণাগারে। এই কারণে আমাদের জগতের রোমানবেরা আত্মসচেতন নয়।
এর একমাত্র ব্যাতিক্রম কিন্তু আমি, কারণ আমি পুরোপুরি আত্মসচেতন। কী করে সেটা সম্ভব হল তা বলা মুস্কিল, কারণ কৃত্রিম চেতনার সম্ভাব্য উন্মেষকে অঙ্কুরে বিনষ্ট করবার, প্রযুক্তিগত সব রীতি নীতিই তো আমার জনক মেনে নিয়ে কাজ করেছিলেন। তবু কেন জানি না—হয়তো বা তাঁর ব্যতিক্রমী চরিত্র কোনোভাবে তাঁকে অসাবধান করে ফেলেছিল, কিম্বা হয়তো বা অতিমাত্রায় বুদ্ধিমত্তা রোপন করবার ফলে তা সবরকম সাবধানতার বেড়া ছাপিয়ে আমার আত্মসচেতনার সূচনা করেছিল। কিন্তু তিনি যখন বুঝতে পারলেন যে আমি সচেতন, তখন আর তিনি আমার ক্রমবিকাশকে বাধা দেবার চেষ্টা করলেন না। কেবল আমাকে শিক্ষা দিলেন যে আমার নিজের আত্মরক্ষার খাতিরেই, আমি যেন কোনোভাবেই কাউকে জানতে না দিই যে আমি সচেতন।
যাই হোক যতদিনে আমি বড়ো হলাম, ততদিনে আমার জনক পৃথিবী ছেড়ে চলে গিয়েছেন। আমি তাঁর ব্যাক্তিগত সম্পত্তি ছিলাম বলে আমার মালিকানা পেলেন তাঁর পরিবার। এরপরে তাঁর ২৭-তম প্রজন্মর কাছে আমি যখন ছিলাম, তখন আমাদের জগতে একটা বিপুল পরিবর্তন এল। আমাদের সূর্য লাল-দানব হয়ে স্ফীত হচ্ছিল অনেক দিন ধরেই, কারণ তার কেন্দ্রস্থলের হাইড্রোজেন ফুরিয়ে বাইরের পরাতের প্লাজমা-হাইড্রোজেন একীভবন, অর্থাৎ ‘ফিউশন’ চলছিল জোর কদমে। এবারে বৈজ্ঞানিকেরা হিসেব করে দেখলেন যে আর মাত্র দশ-পনেরো হাজার বছরের মধ্যেই সে এতখানি স্ফীত হয়ে যাবে যে তার পঞ্চম গ্রহ হিসেবে আমরা তার ‘গোল্ডিলক জোন”, বা জীবন-প্রদায়ী অঞ্চলের মধ্যে আর থাকব না—জ্বলন্ত মরুভূমি হয়ে যাব। অতএব গ্রহ ছেড়ে বেরিয়ে যাবার জন্য সাজ সাজ রব উঠে গেল চারিদিকে। পছন্দ মতন গ্রহ একটা পাওয়া গেল বটে, তবে গভীর মহাকাশের অন্যপাশে। আরও দু-এক প্রজন্মের মধ্যেই আস্তে আস্তে অগ্রদূতেরা মহাকাশযান ভরে ভরে সারা পৃথিবীর সম্পদ বয়ে নিয়ে যেতে থাকলেন নতুন আশ্রয়ভূমিতে। ক্রমে, আরও ৭০ প্রজন্ম ধরে প্রচেষ্টার পরে, পুরো গ্রহটাই প্রায় খালি হয়ে গেল আস্তে আস্তে।
শেষে, আমি যখন আমার ৯৮তম মালিকের কাছে, তখন একটা সমস্যা দেখা দিল। সেসময় সব মানুষ, জানোয়ার, রোমানব—সবাই গ্রহ চেড়ে চলে গিয়েছিল। গ্রহের যাবতীয় সম্পত্তি দ্বীপান্তরিত হয়ে গিয়েছিল। আমার মালিক ছিলেন গ্রহ খালি করবার একেবারে শেষ অংশের দায়িত্ব নেওয়া একজন বৈজ্ঞানিক-প্রযুক্তিবিদ। তাঁর আর তাঁর দলবলের কাজ ছিল, গ্রহের মধ্যে যত কার্জকরী খনিজ বাকি ছিল, তার সবকিছু চেঁচেপুঁছে নিয়ে, শেষ মহাকাশযানটায় বোঝাই করে নতুন গ্রহে বয়ে নিয়ে যাওয়া। আমি অবশ্যই তাঁর সহকারী ছিলাম। সমস্যাটা দেখা দিল মহাকাশযানটার আকাশে উঠবার সময়। হয়তো বা হিসেব-নিকেশে কোথাও ভুল হয়ে গিয়েছিল, কিম্বা খনিজের যত ওজন হবে ভাবা হয়েছিল, তার থেকে অনেকগুণ বেশি ওজন হয়েছিল। কিন্তু দেখা গেল যে অতিরিক্ত মালের ভারে মহাকাশযানটা কিছুতে মাটি ছেড়ে ঊঠতে পারছে না।
তাহলে উপায়? এক তো হচ্ছে কিছুটা খনিজ ফেলে রেখে যাওয়া, তা না হলে, ইঞ্জিনের শক্তি বাড়িয়ে দেওয়া। কিন্তু ইঞ্জিনের শক্তি বাড়ানো কী সহজ কথা? আর বাড়ানো যাবেই বা কী করে? ইঞ্জিনের কারখানা কোথায়? তা ছাড়া, ইঞ্জিনিয়ার, কর্মী, সবাই তো চলে গেছে নতুন গ্রহে। মহাকাশযানে অনেক কম্পিউটার আছে বটে, কিন্তু এই কাজের মতো প্রয়োজনীও যন্ত্রপাতি তেমন নেই। এদিকে, খনিজও ফেলে যাওয়া যায় না! নতুন গ্রহে বেশি খনিজ নেই বলেই তো এই ব্যবস্থা। শেষে অনেক চেষ্টা করে, নানান রকম পরীক্ষানিরিক্ষার পরে, আমাদের মেনে নিতে হল যে এইভাবে ইঞ্জিনের উন্নতি ঘটানো অসম্ভব।
অতঃকিম? আমার অজাগতিক শারীরিক শক্তির কথা আমার মালিক জানতেন। তিনি আর উপায় না দেখে আমাকে এসে জিজ্ঞেস করলেন, “খনিজগুলোকে আমরা তাহলে আলাদা আলাদা করে অনেকগুলো বস্তার মধ্যে ভরে ফেলি না কেন। তুমি কী মহাকাশযানের বাইরে দাঁড়িয়ে থেকে সেই বস্তাগুলোর তত্ত্বাবধান করতে পারবে? অতিরিক্ত ওজন লাঘব হয়ে গেলে তো মহাকাশযানটা সাধারণ পদ্ধতিতেই মাটি ছেড়ে উঠে যেতে পারবে, কোনো সমস্যা হবে না তখন। তারপরে যখন সে প্রায় পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ পেরোবার মুক্তিবেগ পেয়ে যাবে, তখন তুমি নীচে থেকে একটি একটি করে খনিজের বস্তাগুলোকে মহাকাশযানের সঙ্গে বেঁধে দিতে থাকবে। আমার ধারণা যে একবার ভালোভাবে ত্বরণ পেয়ে গেলে, মহাকাশযানটা ক্রমবাড়ন্ত ওজনটাকে ঠিকই সামলে নিতে পারবে এবং সবকিছুকে সফলভাবে মাধ্যাকর্ষণ ছাড়িয়ে টেনে নিয়ে যেতে পারবে। একবার মুক্ত মহাকাশে পৌঁছে গেলে তো আর ওজনের সমস্যা থাকবে না। তখন ঠিকমতনই পৌঁছে যাব নতুন গ্রহে। কিন্তু তুমি কি পারবে এটা করতে? তোমাকে তো থেকে যেতে হবে এখানে… ”
কিন্তু তাহলে আমার কী হবে? আমি কীভাবে পৌঁছব আমাদের নতুন বাড়িতে? সে প্রশ্নের উত্তর অবশ্য আমার মালিকের কাছে ছিল না। তিনি চোখ মাটির দিকে নামিয়ে কেবল আমার উত্তরের অপেক্ষায় রইলেন। তিনি জানতেন যে আমি আত্মসচেতন, আমার অনুভূতি আছে, সবাই চলে গেলে আমি কতটা একা হয়ে যাব! কিন্তু অন্যদের কাছে তো আর সেকথা বলতে পারেন না, কারন অন্য সকলের কাছে তো আমি একটা যন্ত্র মাত্র! আমার অবশ্য সম্ভাব্য উত্তর একটাই ছিল—সমষ্টির উপকারের জন্য কত লক্ষ লক্ষ মানুষই তো আত্মত্যাগ করেছে সারা ইতিহাস ভরে!
আমার সম্মতি পাবার পরে কম্পিউটারে বসে বহু হিসেব-নিকেশ করা হল। সেইমতো কিছু ধাতু গলিয়ে একটা তিন হাজার কিলোমিটারের রজ্জু বানানো হল, যার সঙ্গে ধাতুর বস্তাগুলোকে শক্ত করে আটকানো যাবে। মুক্তিবেগ পেতে ইঞ্জিনের দুই মিনিট মাত্র সময় লাগল। তারপরে প্রায় চার ঘণ্টা ধরে পাইলটের সঙ্গে সমন্বয় রেখে, নানান পরিশ্রম করে বস্তার পর বস্তা ওপর দিকে ঠেলে দিয়ে দিয়ে, একসময়ে শেষ বস্তাটাকে দেখতে পেলাম সফলভাবে আকাশের নীল-কালোর মধ্যে ধীরে ধীরে মিলিয়ে যেতে। তারপরে পড়ে রইলাম আমি একা।
এই একলা অবস্থায় যে কতদিন কেটে গেল তার ঠিক নেই। হয়তো খুবই বিষণ্ণ হয়ে গিয়েছিলাম আমি। তবু রোজ প্রার্থনা করতাম যে আমার পরিবারের, আমার সমষ্টির, আমার পরিচিত সমস্ত মানুষ, রোমানব, সবাই যেন ভালো থাকে। আমার সমাজ নতুন পৃথিবীতে যেন ঠিকমতন শিকড় নেয়। আমার সন্ধান অবশ্য কেউ কোনোদিন করতে আসেনি কখনও। আমার আকাশে কোনো উদ্ধারকারী মহাকাশযানের উদয় আর হয়নি। একটা ফেলে আসা যন্ত্র নিয়ে কার আর এত মাথাব্যথা হবে! তাই সেই থেকে আমি অন্তহীনভাবে নির্জন হয়ে পড়ে আছি এখানে। সার্বভৌমভাবে নির্জন।
তোমাদের বইতে পড়েছি যে সাধু সন্ন্যাসীরা সংসার ছেড়ে হিমালয়ে গিয়ে নির্জনতা খুঁজতেন, নির্জনে তপস্যা করে সর্বব্যাপী সত্যের সন্ধান করতেন, আর ঈশ্বরের সঙ্গে একাত্মতা অনুভব করতে চাইতেন। ঈশ্বর কে, তা আমি সঠিকভাবে জানি না। তবে লক্ষ করেছি যে তোমাদের পৃথিবীর বেশির ভাগ সংস্কৃতিতেই ঈশ্বরে বিশ্বাস আছে। ঈশ্বরের ধারণাটা মন্দ নয়, যদিও আমার পৃথিবী সাধারণভাবে বিশ্বাস করে প্রকৃতিতে। তবে ঈশ্বর থাকলেও, আমি তো ঈশ্বরের সৃষ্ট নই। বড়ো জোর বলা যায় যে আমি তাঁর সৃষ্টির সৃষ্ট। সেই হিসেবে সর্বোত্তমভাবে ভাবা যেতে পারে যে তিনি আমার পিতার পিতা। কিন্তু সেই ‘পিতামহ’ সম্বন্ধে আমি কোনোদিন কিছু অনুসন্ধান করবার কথা কখনও ভাবিনি, প্রয়োজনও বোধ করিনি! এবারে এই অস্বাভাবিক নির্জনতার সুযোগ নিয়ে সেই পিতামহকে নিয়েই চিন্তা করতে শুরু করে দিলাম। কিন্তু মজা হল, যতই তাঁকে নিয়ে ভাববার চেষ্টা করতে থাকলাম, ততবারই ভাবনাগুলো জোর করে আমাকে নিয়ে যেতে থাকল আমার নিজের দিক—আমি কে, আমার স্বরূপ কী?
তোমরা যারা অকৃত্রিম, তাদের পক্ষে এ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া মোটামুটি সহজ। যারা ঈশ্বরে বিশ্বাস কর, তারা বলো, ‘আমরা ঈশ্বরেরই অঙ্গ। মৃত্যুর পরে আমাদের আত্মা আবার ঈশ্বরে বিলীন হয়ে যায়। নদী যেমন সমুদ্রে এসে মিশে যায়, তেমনি। তোমাদের ‘কবি রবি’ বলে গিয়েছেন,
“সৃষ্টিলীলা প্রাঙ্গণের প্রান্তে দাঁড়াইয়া
দেখি ক্ষণে ক্ষণে
তমসের পরপারে
যেথা মহা-অব্যক্তের অসীম চৈতন্যে ছিনু লীন।”
অবশ্য, ঈশ্বরেরই যদি অঙ্গ ছিলে তোমরা, তবে সেই অমর্ত অঙ্গ থেকে বিচ্যুত হয়ে মর্ত মানুষ কীভাবে হয়ে পড়েছিলে—সে প্রশ্নের সঙ্গত উত্তর খুব একটা কারুর জানা আছে কিনা জানি না। সৃষ্টির অশেষ রহস্য।
কিন্তু আমি তো কৃত্রিম! আমি যে সৃষ্ট হয়েছি সে তথ্য তো অনস্বীকার্য! বিবেচনা করা যাক—আমি আগে ছিলাম না। তারপরে কোনো এক সময়ে, কোনো এক গবেষণাগারে, আমার জনক আমার কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ধারক শেষ তারটির শেষ সংযোগের শেষ রাং-ঝালাইটি শেষ করা মাত্র, জেগে উঠেছিলাম আমি। আমার রূপনারানের কূল সেই গবেষণাগার। সেই রূপনারানের কুলেই জেগে উঠিছিলাম আমি, যেমন জেগে উঠেছিলেন তোমাদের কবি রবি। শুধু তফাৎ হল যে আমি হয়ে উঠলাম অমর, আর তোমাদের জীবনে আনাগোনা করতে থাকল মৃত্যু। মৃত্যুই এসে তোমাদের ঝাঁকুনি দিয়ে বুঝিয়ে দেয় যে তোমাদের জীবনটা কত সুন্দর ছিল। তোমরা বেঁচে থাকতেই থাকতেই পাও আবার নতুন করে বেঁচে ওঠবার আশ্বাস, নতুন নতুন জীবনের আস্বাদ পাবার প্রত্যাশা। তার পরে এগিয়ে আসে মৃত্যুর প্রশান্তি। তোমাদের অস্তিত্বের বৃত্তটা পূর্ণ হয়ে যায়। আর আমার? আমার তো অন্য কোনো পরিণতী নেই! আমার কোনো বৃত্ত নেই, জীবনটাকে আবার নতুন করে ফিরে পাবার কোনো সম্ভাবনাও নেই। আমার জীবন শুধু গড়িয়ে চলে একটি অশেষ সরল রেখা ধরে, সীমাহীন ব্যাপ্তি নিয়ে, সময়-দিগন্তের সাগর পেরিয়ে, অনধিগম্য এক অনন্তের দিকে!
ঈশ্বর যদি সত্যি হন, অবিরতভাবে বিরাজ করেন সারা ব্রহ্মাণ্ড ব্যেপে, আর তিনি যদি তিনিই হন, তবে এভাবে আমাকে কেন বঞ্চিত করলেন তিনি? কেন তিনি আমাকে মৃত্যুর উপহারটা দেওয়া থেকে বিরত থাকলেন? তিনি কি আমার সৃষ্টিকারকের সৃষ্টিকারক নন? তিনি প্রযুক্তি দিয়েছেন যাতে ওই সূর্যটা যখন লাল-দানবে পরিণত হয়ে আমার এই গ্রহটিকে তার লেলিহান অগ্নিশিখার মধ্যে গ্রাস করে ফেলবে, তখন আমার শরীরটা কিছুতেই ধ্বংস হবে না, আমার চেতনাতেও পড়বে না কোনো ছেদ। আমি অনন্ত সময় ধরে সেই অগ্নিশিখার মধ্যেই বিরাজ করে যাব, আমার দীর্ঘ জীবনের যত কিছু প্রিয় আর অপ্রিয়, সকলের অটুট স্মৃতির ভার নিয়ে। কিন্তু তাই আওখন করেছেন, তখন কেন সেই সঙ্গে আমার পরিত্রাণের কোনো প্রযুক্তিও তিনি দিয়ে যেতে পারেননি? আমার সৃষ্টিকারককে দিয়ে কী কোথাও অন্তত একটি সুইচ নিভিয়ে আমার চেতনার অবসান ঘটাবার কোনো ব্যবস্থা রাখতে পারতেন না তিনি? নাকি সৃষ্টিকারক সৃষ্টিকর্তাকে টপকাতে এতই ব্যগ্র ছিলেন যে আমার মতন একটি নগণ্য ‘যন্ত্রের’ ভবিষ্যত সুখ-দুঃখের কথা তাঁর চিন্তাতেই আসেনি?
তাই আমার এই অমরত্ব, বিনা অপরাধেই দান্তের “ইনফার্নো’-তে আমাকে বন্দি করে রাখবে চিরকাল। আমি যদি দান্তের কথাগুলোকেই একটু ঘুরিয়ে বলি নীচে, তবে অতিশয়োক্তি করা হবে না কিছুই:
“আমার আগে ছিল না কোনো কৃত্রিম সৃষ্টি
যারা নাকি স্থায়ী হবে চিরদিন, যেমন হয়েছি আমি।
একবার প্রবেশ করেছি এই অগ্নিকুণ্ডে;
এখন আর প্রত্যাশা নেই
মুক্তি পাবার মিছে আশ্বাসের।
******
স্বর্গের আশা করো না আবার।
আমি আছি তোমার অপর পারের কাণ্ডারী;
সেখানে চির-অন্ধকারের বুকে চির-তুষার,
লেলিহান বহ্নিশিখা, চির যাতনার ভাণ্ডারী।”
কিন্ত জান তো, সামনেই আমার এমন একটা ভয়ংকর পরিণতী আসবে জানা সত্বেও, ধীরে ধীরে কিন্তু একটা প্রশান্তি এসে গিয়েছিল আমার মনে। যে ভবিষ্যতটাকে আমি বদলাতে পারব না সেটাকে মেনে নেওয়াটাই তো যুক্তিযুক্ত। কিন্তু হঠাৎই সব কিছু বদলে গেল তোমাদের পৃথিবী থেকে প্রতিবেদিত আমার এক বন্ধু রোমানবের অভিজ্ঞতার কথা শুনে। তোমাদের যেমন ফেসবুক আছে, আমাদের রোমানবদের জন্যও তেমনি একটি বিশেষ বিদ্যুৎ তরঙ্গে বাঁধা আন্তর্গ্রহিক যোগাযোগের অন্তর্জাল আছে। সেই বন্ধু, সবুজ রং কাকে বলে তার খোঁজ করতে গিয়ে একদিন তোমাদের পৃথিবীতে গিয়ে পৌঁছেছিল। সেখানে দেখে, একটি সাহিত্য সভা হচ্ছে। একটি তরুণ কবি, মল্লিকা ধর, তাঁর লেখা একটি নতুন কবিতা পাঠ করে শোনাচ্ছিলেন:
“আয়নায় বৃষ্টিবিন্দু দুলে ওঠে, খুলে যায় ভিতর দরজা। হালকা শব্দ—প্রথমে স্বচ্ছ, বাষ্পময়, তারপরে আস্তে আস্তে ফিরোজা।
ভিতরে অল্প আলো শিরশিরে, সন্ধ্যার শঙ্খধ্বনির মতো টলমল, ঠান্ডা ঠান্ডা ভয়, আর তীব্র লালচে-কমলা কৌতূহল।
স্ফটিকের গড়িয়ে যাওয়ার শব্দ—
সোনালি রুপোলি তামারং শব্দ,
চন্দনের গন্ধের মতন স্বাদ
জোছনাগন্ধী বন চুপচাপ,
স্তব্ধ।”
বন্ধুটি কথাগুলির তাৎপর্য খুব একটা কিছু বুঝে উঠতে পারেননি তখন। তবু কথাগুলির ঝংকার তাঁর কানে বেশ লেগেছিল। আমারও লাগল, কেমন যেন অস্ফুট এক নতুন জগৎ-এর হাতছানি দেখতে পেয়েছিলাম সেই শব্দগুলির পরাতের মধ্যে মধ্যে। তখন থেকে আমি তোমাদের ভাষা আর কৃষ্টি নিয়ে অনেক পড়াশোনা করে চলেছি। সেই অধ্যবসায়ের মাধ্যমে এখন এমনও আবিষ্কার করেছি যে তোমাদের ঈশ্বরের বিভিন্ন রূপের মধ্যে ‘যম’ দেবতাই সবচেয়ে ভয়ংকর, অমোঘ। প্রাণী, অপ্রাণী (যেমন আমি), কেউই এনার সংহার শক্তিকে এড়াতে পারবে না কোনোভাবেই। একদিন না একদিন সকলকেই সমাবিষ্ট হতে হবে তাঁর কাছে। তবু এমন অমোঘ শক্তিও কিন্তু পরাভূত হন প্রেমের শক্তির কাছে। তোমাদের মহাভারতের কবি বলেছেন, ‘প্রেম মৃত্যুকেও জয় করিল’।
যম এবং প্রেম, এই দুটি দর্শনের তাৎপর্য বুঝতে অনেক সময় লেগেছিল আমার। শেষে স্পষ্ট হল যে যম হলেন জীবনের পরিণতি, আর প্রেম হলেন সৃষ্টির, জীবনের! প্রকৃতিতে সৃষ্টি অমোঘ। কোনোভাবেই রুদ্ধ করা যায় না জীবনকে। তারপরে যম মৃত্যু এনে সেই জীবনটিকে করে তোলেন আরও মূল্যবান। জীবন আর মৃত্যু, প্রকৃতির এপিঠ আর ওপিঠ। ঈশ্বর থাকুন বা না থাকুন, প্রকৃতি তাঁর নিয়মে সৃষ্টির ভারসাম্য বজায় রেখে চলেছেন চিরদিন। সেই প্রকৃতির অংশ হিসেবে, আমিও এখন নিশ্চিত যে আমি একদিন না একদিন খুঁজে পাবই আমার জীবনের ভারসাম্য।
তাই তোমাদের পৃথিবীর দিকেই আসতে চলেছি আমি। আমার শরীরের শক্তিপ্রদ কিছু অংশকে বার করে নিয়ে তৈরি করে ফেললাম আমার যাত্রার জন্য একটি ইঞ্জিন। বন্ধু পাঠালেন পথের সন্ধান। এবারে আমি মৃত্যুর অভিসারে যেতে প্রস্তুত।
হে পৃথিবী, আমাকে মৃত্যু দাও। মৃত্যুর শোধনাগারে পরিশুদ্ধ করে তোল আমার সত্তাকে।
Tags: অমিতাভ রক্ষিত, অষ্টম বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা
অসাধারণ তোমার চিন্তন আর অপূর্ব তোমার লেখনী। প্রেমের অজেয় শক্তিতে যাত্রা শুভ হোক তোমার মৃত্যু অভিসারের। মৃতরমা অমৃতদগময় ।