মড়া
লেখক: রণেন ঘোষ
শিল্পী: টিম কল্পবিশ্ব
কী আছে মৃত্যুর পর? অস্তিত্ব, না, অনস্তিত্ব? ঈশ্বর না শয়তান? সর্বশক্তিমান শক্তিতরঙ্গ, না নিছকই অনন্ত তমিস্রা? অনুসন্ধিৎসু বিজ্ঞান-তাপসরা উদ্যোগী হলেন সেই হেঁয়ালির সমাধানে… তারপর…
?
দুঃস্বপ্ন ভয়ংকর জীবন্ত বিভীষিকা… না, না… ভাষায়, কোনো জাগতিক ভাষায় বর্ণনা করা যায় না… বিশ্বাস করুন সত্যি যায় না… বিশ্বাস করলেও হিম হয়ে আসে সর্বাঙ্গ… জোর করে বন্ধ করতে হয় চিন্তার প্রবাহকে… বিশ্বাস করুন… পারি না, পারি না গলা টিপে মারতে সেই নারকীয় চিন্তাগুলো… দুঃস্বপ্নের মধ্যে কী ভয়ংকর সেই দিনগুলো… না, না… ভুলতে চাই… বেমালুম অস্বীকার করতে চাই সেই… সেই দিনগুলো… পারেন… পারেন আপনারা কেউ ভুলিয়ে দিতে সেই দিনগুলোর কথা… জীবন খাতার পাতা থেকে কেউ পারেন না মুছে দিতে সেই দিনগুলো… শুধু একবার… একবারটি শুধু… এখনও তো আছে অনেক সাধু সন্ন্যাসী… নানান ধর্মগুরু… একবার… একবার শুধু স্বাভাবিক করে দিন আপনারা আমাকে… সব অসম্ভব তো সম্ভব হয় সিদ্ধ পুরুষের করুণায়… হায় ভগবান! আমার বেলায় কেউ কি এগিয়ে আসবে না অমৃত পরশ নিয়ে… না… কেউ আসবে না… এমন অসম্ভব যে অসম্ভবের জাগতিক মাত্রাও যে এর কাছে অসম্ভব অকল্পনীয়… মুক্তি… হ্যাঁ হ্যাঁ মুক্তি চাই… পালাতে চাই আমার এই পার্থিব দেহ থেকে… জগৎ থেকে… ছাড়বে না… কিছুতেই ছাড়বে না আমাকে… কে ছাড়বে না… কী বলে তার পরিচয় দেবে ভেবে পাচ্ছি না… ড. রুদ্রশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়! না, না… রুদ্রশঙ্কর নয়… হতে পারে না রুদ্রশঙ্কর… তাকে যে নিজের হাতে হত্যা করেছি আমরা… হত্যা কথাটা কি ঠিক হবে… না হত্যা নয়… আত্মহত্যাও নয়… বলিদান… স্বইচ্ছায় জীবন উৎসর্গ করেছে রুদ্রশঙ্কর… বিজ্ঞানের এক ধূসর দিগন্তকে জ্ঞানের আলোয় প্রোজ্জ্বল করে তুলতে… দধীচির মতো মৃত্যুবরণ করেছে রুদ্রশঙ্কর… আমরাও স্বেচ্ছায় মেরে ফেলেছি ওকে… কিন্তু সেই রুদ্রশঙ্কর… আর মূর্তিমান বিভীষিকার মতো আমাকে খুঁজে ফিরছে যে রুদ্রশঙ্কর সে কি এক?… অভিন্ন… না, না… মৃত্যুর পরপারের ভয়াল ভয়ংকর এক উন্মাদনায় আচ্ছন্ন আজ রুদ্রশঙ্করের রক্তমাংসের হিমশীতল দেহটা… না, না… মুক্তি চাই… হ্যাঁ হ্যাঁ এক্ষুনি… আজই… নিজের হাতেই মুক্তি নেব আমি… কিন্তু বলতে চাই… জানাতে চাই আপনাদের অনেক… অনেক কথা… অবিশ্বাস্য এক গবেষণার নারকীয় পরিণতির ভয়ংকর সেই ঘটনা… সমস্ত ঘটনা শোনার পর… দোহাই আপনাদের… শুধু বিশ্বাস করবেন আমার কথাগুলো… বিশ্বাস করবেন আপনাদের মাঝখানে ঘুরে বেড়াছে মূর্তিমান এক বিভীষিকা… হিমশীতল প্রাণহীন রুদ্রশঙ্করের জীবন্ত দেহটা বা অন্য কারুর মৃতদেহ… নারকীয় জিঘাংসায় খুঁজে বেড়াচ্ছে সে আমাকে। না পেয়ে হয়তো আরও দুর্দম হয়ে উঠবে সে… শুরু হবে নৃশংস বর্ণনাহীন সেই হত্যাকাণ্ড… তাই… তাই… আর সময় নষ্ট না করে তন্ন তন্ন করে খুঁজুন আপনারা… এই সুন্দর সবুজ পৃথিবীর কল্যাণেই ধ্বংস করুন সেই মৃতদেহে জীবন্ত প্রাণপ্রবাহকে… ভয়ংকর দুঃস্বপ্ন থেকে মুক্ত হবে কি কোনোদিন পৃথিবী… কে জানে… কিন্তু আপনাদের তো জানা দরকার চার চারজন ডাক্তারের দুর্জ্ঞেয় জিজ্ঞাসার সমাধানের এক বিস্ময়কর সাধনার কথা… এক… একবার দয়া করে পড়ুন আমার ডায়েরিটা… শুধু একবার… মৃত্যু-পথযাত্রীর অন্তিম বাসনার কথা স্মরণ করেই পড়ুন আমার দিনলিপি… বিচার করুন সত্যি কি কোনো অন্যায় করেছিলাম আমরা… দুর্জ্ঞেয় রহস্যময় অজানাকে জানার প্রয়াস কি পাপ…
২ জানুয়ারি
উঃ কী দারুণ উত্তেজনা। এত দিনের জল্পনা কল্পনা আজ বাস্তবে রূপ পেতে চলেছে। ডক্টর রুদ্রশঙ্কর ব্যানার্জী রাজি হয়েছে। স্বেচ্ছায় সে নিহত হতে অঙ্গীকার বদ্ধ। আমরা সবাই রাজি হতাম… একজনের জীবন তো দিতেই হবে… কিন্তু সবার আগেই রুদ্র রাজি হয়ে গেল হাসি মুখে। আর দরকার হল না লটারি করার।
রদ্র অবিবাহিত। পৈতৃক সম্পত্তি অঢেল। সারাজীবন সে লেখাপড়া আর আমাদের সঙ্গে নানান উদ্ভট উদ্ভট গবেষণায় মত্ত। ওর মতো স্বভাবের লোক বড়ো একটা দেখা যায় না এখন। ডাক্তারি শাস্ত্রের হেন বই নেই যা নেই ওর লাইব্রেরিতে। একতলায় ছোটোখাটো এক ল্যাবরেটরিও করেছে সে অনেক মাথা খাটিয়ে। তবে হ্যাঁ, আমাদের মতো নয়… সনাতন হিন্দুধর্মে ওর অগাধ বিশ্বাস। বেদ উপনিষদ গীতা ওর অবসর সময়ের সঙ্গী। সত্যি অদ্ভুত ওর রুচি আর অভ্যাস।
যাক শুক্রবারের মধ্যেই সেরে ফেলতে হবে বাকি কাজগুলো। সব দিক থেকে প্রস্তুত করে নিতে হবে রুদ্রকে। পরের দিন মানে শনিবারেই মারা যাবে রুদ্র। বিজ্ঞানের এক বিস্ময়কর অধ্যায়ের সূত্রপাত হবে। তবে হ্যাঁ, মৃত্যুই কি জীবনের শেষ, না মৃত্যুর পরেও মানে আমাদের রক্তমাংসে গড়া পার্থিব জীবনের সমাপ্তির পরেও আরও কিছু আছে… মানে আত্মা… আত্মা বলে কিছু থাকলে, যদি থাকে, তাহলে তার অনুভূতি… উপলব্ধি… অভিজ্ঞতা… মানে মৃত্যুর ঠিক পূর্ব মুহূর্তে বা পর মুহূর্তের সঠিক অভিজ্ঞতার বর্ণনাই জানতে চাই আমরা।
মৃত্যু আর পরকাল আর আত্মা নিয়ে গবেষণার শেষ নেই আমাদের। পাগল আমরা পাঁচজন। সেই কলেজ জীবন থেকেই শুরু হয়েছে আমাদের কৌতূহল। যতদিন গেছে ততই বেড়েছে আমাদের উৎসাহ। আজ আমরা চল্লিশের কোটা পেরিয়েছি সকলেই। সকলেই আমরা নাম করেছি চিকিৎসক হিসাবে। যত দিন যাচ্ছে ততই নেশার মতো পেয়ে বসেছে।
আগামী কাল বিশেষ কোনো জরুরি কাজ নেই আমাদের, নেই কোনো জরুরি অপারেশন। তাই খাবার পর রাতে বেশ জমিয়ে আলোচনা করছিলাম আমরা। চার পাঁচটা দামি সিগারেটের প্যাকেট খালি হয়ে যাচ্ছে ঘণ্টায় ঘণ্টায়। বাইরে বেশ অন্ধকার। রাস্তায় গাড়ি ঘোড়ার আওয়াজ নেই একেবারে।
আমরা ডাক্তার… সার্জেন… মৃত্যু বা মৃতদেহ তো দেখছি আকছাড়। কিন্তু জীবনের পরিসমাপ্তির পর কী হয়… কী হয় মৃত্যুর ঠিক পূর্ব মুহূর্তে… আমরা কেন কেউই জানি না… সবই অনুমান… আকাশ পাতাল জয় করলেও বিজ্ঞান অজ্ঞ এ বিষয়ে। জীবন কী, মৃত আর জীবিত দেহের মধ্যে পার্থক্যের কারণ কী, মৃত দেহের সঙ্গে কী যোগ করলে জীবিত হয়, সেটা কী, তার রূপ আকার আয়তন কেমন, জীবন কী, তার সংজ্ঞাই বা কী, কী হয় জীবিত দেহে মৃত্যুর জয়যাত্রার মুহূর্তে… কী বা অনভূতি হয় সংজ্ঞাহীন জীবন নামক অজ্ঞাত সেই বিস্ময়কর বস্তুর। জীবন কি বস্তু? বা অন্য কোন কিছু? মৃত্যুর সংজ্ঞা কী? মৃত্যু কী? এসব প্রশ্নের কোনো সদুত্তর নেই বিজ্ঞানের ভাণ্ডারে।
জীবন বাঁচাবার আপ্রাণ চেষ্টা করি আমরা… বাঁচাতে না পারলে বলি মৃত্যু ঘটেছে ব্যক্তি বিশেষের। পরের অনুষ্ঠান সাধারণ… শবযাত্রা… শ্মশানে সৎকার… দাহ করা, না হয়তো মাটির অভ্যন্তরে পাঠানো। মৃত্যু কি জীবনের শেষ… যত দূর জানি পৃথিবীর চারটে প্রধান ধর্ম হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান আর মুসলমান মতো প্রায় এক! দেহ বিনষ্ট হয় কিন্তু আত্মা অমর। আমি হিন্দু… আমার গীতায় আছে—
বাসাংসি জীর্ণানি যথা বিহায় নবানি গৃহাতি নরোহ পরানি,
তথা শরীরানি বিহায় জীর্ণনি অন্যানি সংঘাতি নবানি দেহী।
মৃত্যু আর কিছু নয়—শুধু পুরোনো কাপড় ছেড়ে নতুন কাপড় পরার মতো। অর্থাভাবের প্রশ্নের উত্তরে ঋষি যাজ্ঞবল্ক বললেন বৃহদারণ্য উপনিষদে যে মৃত্যুর পর লোকে (আত্মা) নিজ নিজ কর্ম অনুসারে পরলোকের বিভিন্ন স্তরে বাস করে। অবশ্য এ-বাস আবার চিরকালের নয়… প্রেতলোক বা পরলোকে স্বীয় কর্মফল ভোগ করার ফলে আবার সেই আত্মা জন্ম নেই এই মাটির ধরণীতে।
আরও অনেক আলোচনা হল… একটা বিষয়ে স্থির হলাম যে যদি ভগবান বা মৃত্যুর পরে জীবন থাকে তাহলে আমাদের জ্ঞানমতো সাধ্যমতো চেষ্টা প্রশংসনীয়। কিন্তু ভগবান যদি না থাকে… মৃত্যুই যদি জীবনের পরিসমাপ্তি হয়… তাহলে এক একটি মানুষের মৃত্যু মানে আধুনিক বিজ্ঞান বা চিকিৎসা শাস্ত্রের ব্যর্থতার ফল… নতুন মানুষকে চিরকাল বাঁচিয়ে রাখা তো অসম্ভব নয়। অর্থাৎ জীবনই মানুষের চরম আর শেষ পরিণতি। আত্মার অস্তিত্ব শুধু মিথ্যা নয় অলীক কল্পনা মাত্র। বিজ্ঞান চিকিৎসা শাস্ত্র এবং ধর্ম কেউই মৃত্যুকে পরীক্ষা করে দেখেনি বিচক্ষণভাবে। ফলে অসুস্থ মৃতপ্রায় বা এমনকি মৃতদেহে প্রাণ ফিরিয়ে আনার আপ্রাণ চেষ্টা করি আমরা। আর দেশবিদেশের সব ধর্মই মৃতের আত্মীয়স্বজনকে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করেছে সুদূর অতীত থেকে। কিন্তু কেউ কি গভীরভাবে জানতে চেষ্টা করেছে মৃত্যুর পরে কী হয় মৃত ব্যক্তির মন বা আত্মার? সত্যি কি কিছু আছে আত্মা বলে? যদি সত্যি থাকে তবে কখন সে ছেড়ে যায় জীবিত দেহ? তখনকার অনুভূতিই বা কী? মৃত্যু যদি জীবনের শেষ না হয় তবে কোথায় যায় আত্মা মৃত্যুর ঠিক পরমুহূর্তে? সেই রোমাঞ্চকর অজানা অজ্ঞাত যাত্রার বিবরণ কি জানতে পারবে না কেউ?
অবশ্য প্রচলিত সব মাধ্যমে চেষ্টা করেছিলাম আমরা। মিডিয়াম সিয়ান্স… অন্যান্য সব আধিভৌতিক ক্রিয়া প্রক্রিয়াও বাদ দিইনি আমরা। কিন্তু যে অন্ধকারে সেই অন্ধকারেই রয়ে গেছি বার বার… ভূত দেখা দূরে থাক এমনকি প্ল্যানচেটে পেন্সিলও নড়েনি একবারও।
ড. শেখর বন্দোপাধ্যায় মানে আমাদের শেখর কুকুর নিয়ে পরীক্ষা করেছে বেশ অনেক দিন আগে। কুকুরের মৃত্যুর পরেও মৃত কুকুরের মস্তিষ্ককে বাঁচিয়ে রেখেছিল বেশ কয়েকদিন শুধুমাত্র মস্তিষ্কের কোশে কোশে তাজা তরল রক্ত প্রবাহের মাধ্যমে। আর তাজা রক্ত মানেই তো অক্সিজেন। জটিল সব ইলেকট্রনিক্স মনিটরিং যন্ত্রের মাধ্যমে ধরা পড়েছিল মস্তিষ্কের কর্মব্যস্ততার লক্ষণ। তার দেহটার মৃত্যু ঘটেছিল বেশ অনেকক্ষণ আগে। কুকুরের উপর সফল হলে মানুষের উপরেই হবে না কেন? ঠিক এই রকম পরীক্ষাই করব বলে ঠিক করলাম আমরা।
শারীরিক মৃত্যুর ঠিক পূর্ব মুহূর্তে আমরা যদি কোনো উপায়ে বাঁচিয়ে রাখতে পারি মস্তিষ্কটাকে… তাহলে… তাহলে মৃত ব্যক্তি তো বুঝতে পারবে মৃত্যুর সময়কার সমস্ত ঘটনা। শুধু মৃত্যু মুহূর্তেই বর্ণনাই নয়… আত্মা বা ভৌতিক বা পরলোক সম্বন্ধে জানাও বোধহয় সম্ভব হতে পারে মৃত্যুঞ্জয়ী সেই মস্তিষ্কের?
ড. দেবপ্রিয় রায় মানে আমাদের দেবু নতুন এক উপায় উদ্ভাবন করেছে। ক্রেনিয়োটমি মানে মাথার খুলিতে অপারেশানে এক্সপার্ট দেবু। সেবার একটি রুগীর ক্রেনিয়োটমির জন্য সমস্ত মাথাটা কামিয়ে অপারেশানের জন্য তিনটি স্থান নির্দিষ্ট করে একটা করে ইলেকট্রোড ঢুকিয়ে দেওয়া হল ফ্রন্টাল আর টেম্পোরাল লোবের মধ্যে। স্টিরিয়োট্যাঙ্ক ম্পিক যন্ত্র আর ইলেকট্রো এনকেফালোগ্রাফ মনিটরের মাধ্যমে ধরা পড়ল রুগীর ব্রেনওয়েভের নানান প্রতিক্রিয়া। আর একটি গুরুতর ব্যাপার সম্বন্ধে নিশ্চিত হওয়া গেল যে মৌখিক উত্তর দিতে সম্পূর্ণ অপারগ রুগীটি। অথচ কয়েক প্রকার ব্রেন সার্জারীতে রুগীর সঙ্গে কথা বলা বিশেষ প্রয়োজন সার্জেনের। উত্তরের প্রকারভেদ, সময়, কথার মানে উচ্চারণের এবং চিন্তার পরিচ্ছন্নতা ইত্যাদি অনেক কিছুই ব্রেন সার্জারীতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই অবস্থায় রুগীকে কয়েকটি নির্দিষ্ট শব্দ চিন্তা করতে বলল দেবু। মস্তিষ্কের যে কোনো ক্রিয়া বা অ্যাকশনই ব্রেনওয়েভ সৃষ্টি করে, আর এই ওয়েভগুলো মনিটরে রেকর্ড হয়ে গেল। পরে এই রেকর্ড করা ওয়েভগুলোকে ডিফারেন্সিয়াল কমপিউটারে পরে দেওয়ার পর এক আশ্চর্য ফল পাওয়া গেল। দেখা গেল এক একটা শব্দ-চিন্তা বিভিন্ন ধরনের ব্রেন ওয়েভ সৃষ্টি করেছে।
পরে আমাদের ব্যাখ্যা করে বলেছিল দেব,—“দেখ, আঙুলের ছাপের মতো আমরা যদি মানুষের ভাষাগুলো মানুষের ব্রেনে চালান করে দিতে পারি সরাসরি এবং সে শব্দগুলোকে যদি চিন্তা করতে বলি তা হলে প্রতিটি শব্দের জন্যে আমরা ভিন্ন ভিন্ন ওয়েভ বা তরঙ্গ পাব। পরে সেই ওয়েভগুলোকে কমপিউটারের মাধ্যমে ডি-কোডিং করলেই আমরা চিন্তার ভাষা তৈরি করতে পারব।”
সত্যি অকল্পনীয়… অবিশ্বাস্য ওর চিন্তাধারা। অসম্ভব চিন্তাধারাকে বাস্তবে রূপদান বিস্ময়কর। এইভাবেই বিজ্ঞান এগিয়েছিল অসম্ভব আর অবিশ্বাসের অন্ধকার ভেদ করে। জীবন আর মৃত্যুর মাঝখানে সমঝোতার কোনো চেষ্টাই করেনি আমাদের ধর্ম। মৃত্যুর পরে জীবনের অস্তিত্বের কখনই বাস্তবসম্মত প্রমাণ দিতে পারেনি ধর্ম।
আর ঠিক এই কারণেই আমাদের এই যুগান্তকারী পরীক্ষাই হবে মৃত্যু সম্বন্ধে এক যুক্তিসম্মত বিজ্ঞাননির্ভর গবেষণা… মৃত্যুপারের সঙ্গে জীবিত থাকাকালীন যোগাযোগ অক্ষুন্ন রাখা… এবং একমাত্র বিজ্ঞান সম্মত উপায়ে!!!
৭ জানুয়ারি… ভোর ৫টা।
এখনও অন্ধকার কাটেনি ভালো করে। রাস্তায় লোকচলাচলের আভাস। আজ বলে নয় ভোরবেলায় ওঠা বরাবরের অভ্যাস। সেই ছোটোবেলায় বাবা ডেকে দিতেন। ঠিক ভোর ৪টের সময়। আমি আর ছোটো ভাই মুখ হাত ধুয়ে পড়তে বসতাম। সে আজ কতকাল হবে। সেই অভ্যাস রয়ে গেছে এখনও। ডাক্তার বিশেষ করে সার্জেনদের পক্ষে ভোরে ওঠা খুব ভালো। পারিপার্শ্বিক নির্জনতার মধ্যে সব কিছু গুছিয়ে চিন্তা করা যায় ভালোভাবে। ভোরের ঠান্ডা বাতাস মন প্রাণ দেহ জুড়িয়ে দেয় পলকের মধ্যে। এখনও কেউ ওঠেনি ঘুম থেকে। আমার দুই ছেলে রানা বাদশা পাশের ঘরে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। এইবার আমি ডেকে তুলব ওদের… ঠিক যেমন করে বাবা আমাদের ডেকে তুলতেন। ঘুমের মধ্যে বিড় বিড় কী যেন বলে উঠল কৃষ্ণা মানে আমার স্ত্রী। রাত পর্যন্ত জেগে থাকতে কষ্ট হয় না। কিন্তু ভোরবেলায় উঠতে হলে সর্বনাশ। বেলা ৬-৩০ পর্যন্ত ঘুমানো বাঁধা কৃষ্ণার। এক হাতে সংসারের যাবতীয় ঝক্কি ঝামেলা সয়ে যায় নীরবে। শুধু তাই নয়, ছেলেদের পড়াশুনা, আমার যাবতীয় ঝামেলা কোনো কিছুতেই বিরক্তির আভাস নেই। সার্জেনদের নিরিবিলির অবকাশ খুব কম। যেটুকু সময় থাকে সেটুকু আগামী অপারেশনের কথা ভাবতেই সময় চলে যায়। চায়ের কাপটা সামনে নামিয়ে রাখল সুনীতি। রান্নার দায়িত্ব ওর ওপর। নিঃশব্দে কাপটা তুলে নিয়ে একবার তাকালাম কৃষ্ণার দিকে। ভোরের ঘুম নাকি গভীর হয়… কিন্তু কৃষ্ণার কি রাত আর কি ভোর। ঘুমালে আর সাড়া নেই। আর সময় নেই। এই সময় নানান চিন্তাই ঘোরাফেরা করে মাথার মধ্যে। বড়ো সুন্দর সময় এই ভোরবেলা। একান্ত নিজের… কেউ নেই কোথাও যে ভাগ বসাবে সময়ের উপর। নাঃ ৬টা বাজছে। রানা বাদশাকে ডেকে দিয়ে তৈরি হয়ে নিলাম জামা প্যান্ট পরে। মনে মনে ব্যস্ত হয়ে পড়েছি… কখন পৌঁছাব রুদ্রর বাড়ি। এতক্ষণে সব বোধহয় এসে গেছে।
দারুণ উত্তেজনা সারা শরীরে। এতদিন এক বিরাট প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে। আত্মা আছে কিনা… আমরা পাঁচজনই পাগল হয়ে উঠেছি জানার জন্যে। মাঝে মাঝে মনে হয় আমাদের জীবনটাই এক প্রকাণ্ড জিজ্ঞাসা। সন্তোষজনক উত্তর নেই কিছুর। কত প্রকাণ্ড আমাদের বিশ্বব্রহ্মাণ্ড? কে এর সৃষ্টিকর্তা? কেমন করেই বা জন্ম হল এর? ব্রহ্মাণ্ডের জন্মের আগে ছিল কি কিছু? থাকলে পরে কী সে? প্রাণ কী? পৃথিবী ছাড়া আর কি কোথাও জীবনের অস্তিত্ব আছে? সুদূর নীহারিকায় … গ্রহান্তরে? উত্তর নেই নয়… নিশ্চয় এ সবের এবারে এক যুক্তিসম্মত উত্তর আছে। থাকতেই হবে। শুধু আমরা এখনও পর্যন্ত জানি না সে উত্তরের সন্ধান। আর এই জানার চেষ্টায় ছুটে চলেছে মানব সভ্যতা। ঠিক যেমন করে আমরা ক’জন ছুটে চলেছি সৃষ্টির আদিম রহস্যের আবরণ উন্মোচনের জন্য।
রানা বাদশা উঠে পড়েছে। ৬-১৫ মি.। আর নয়। প্রায় আধ ঘণ্টা লাগবে পৌঁছাতে। ঘুমন্ত কৃষ্ণাকে ঠেলে বললাম যাচ্ছি। ঘুম জড়ানো গলায় বলে উঠল—যাচ্ছ! এত সকাল। আবার পাশ ফিরে শুয়ে পড়ল। দ্রুত পায়ে নেমে এলাম। সিঁড়ি বেয়ে একতলায়। কয়েক মিনিটের মধ্যে ফিয়েট ছুটে চলল পাহাড়ি পথ বেয়ে রুদ্রর বাড়ির দিকে। কি সুন্দর সকাল। হালকা কুয়াশা জড়িয়ে রয়েছে দূরের গাছপালার মাথায় পাহাড়ের গায়।
রুদ্রর মুখটা ভেসে উঠছে বার বার। রুদ্রশঙ্কর বন্দোপাধ্যায়। রুদ্রর বাবা ড. হরিশঙ্কর বন্দোপাধ্যায় নাম করা একজন বিজনেসম্যান… তা অবশ্য ৩০/৪০ বছর আগে। অদ্ভুত ব্যাপার। ডাক্তারি পাশ করে শুরু করলেন ব্যাবসা। কয়েকজন মাড়োয়ারি বন্ধুর সঙ্গে। কয়েক বছরের মধ্যে হু-হু করে বড়ো হয়ে উঠলেন হরিশঙ্কর। জায়গা-জমি বাড়ি-গাড়ি ব্যাঙ্ক-ব্যালেন্স হল। গরীবের এক সুন্দরী কন্যাকে নিজেই পছন্দ করে বিয়ে করলেন। কিন্তু রুদ্রশঙ্করকে এক মাসের রেখে চোখ বুজলেন হরিশঙ্করের সুন্দরী স্ত্রী। আর বিয়ে করেননি হরিশঙ্কর… বিলাস আর ব্যবসায় ডুবে রইলেন চব্বিশ ঘণ্টা। আয়ার কোলে পিঠে মানুষ হল রুদ্রশঙ্কর। যেমন খামখেয়ালি ঠিক তেমনি মেধাবী একরোখা। ডাক্তার হিসাবে দারুণ সুনাম। বাবা মারা যাবার পর ব্যাবসাপত্তর বিক্রী করে নিজেদের প্রকাণ্ড বাড়িটায় গড়ে তুলেছে এক প্রকাণ্ড ল্যাবরেটরি। অবসর সময়ে ল্যাবরেটরিতেই সময় কাটে রুদ্রর। আমাদের আড্ডা জমে কোনো সময়ে ল্যাবরেটরিতে আবার কোনো সময়ে বৈঠকখানায়। বাবার আমলের চাকর সুখলাল ছাড়া আর কেউ নেই এত বড়ো বাড়িতে। সেই সুখলালকেও একমাসের ছুটি দিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছি আমরা। সম্পূর্ণ বাড়িটা এখন আমাদের দখলে।
সকাল ৮টা—ল্যাবরেটরির পাশে অস্থায়ী অপারেশন রুমে জড়ো হলাম আমরা সকলে। আমার পরিচয় তো সকলেই জানেন, এছাড়া রুদ্রশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, শেখর বন্দ্যোপাধ্যয়ে, দেবপ্রিয় রায় আর শঙ্কর সাহা। আমাদের এখন প্রধান কাজ হল ড. রুদ্রশঙ্করের মগজে ভাষাকে চালান করা মানে প্রোথিত করা… তারপরে সেই কথা বা শব্দগুলো ওকে ভাবতে বলা সঙ্গে সঙ্গে চিন্তাধারার ওয়েভ মানে তরঙ্গ আকারে রেকর্ড করা। আরও কাজ আছে—এর পর কমপিউটারে পুরে দিতে হবে ওয়েভের রেকর্ডগুলোকে… তারপরেই সেই চিন্তাগুলো শব্দের আকারে পড়া যাবে।
সমস্ত মাথাটা বেশ ভালো করে কামিয়ে ফেলার পর কীরকম যেন অদ্ভুত দেখাচ্ছে রুদ্রকে। ক্রেনিয়োটমির আগে পরিষ্কার করে কামানো দরকার মাথাটার। কেমন ধবধবে সাদা। মাথার তিনটে জায়গায় দাগ দেওয়া হয়েছে। এইখানেই ইলেকট্রোড বসাতে হবে মগজের মধ্যে। প্রাথমিক কাজ সব শুরু হয়ে গেছে। ভালো করে সব পরীক্ষা করে দেখল দেশপ্রিয়। স্টিরিওট্যাক্সিক যন্ত্রগুলো, স্টিমুলেটর আর রেকর্ডার এমন কি প্রকাণ্ড ইলেকট্রোএনকেফালোগ্রাফ মনিটরগুলো ঠিকভাবে কাজ করে চলেছে। এক্স-রে মনিটরের সাহায্যে সেরিব্রাল কর্টেক্সের মধ্যে ফ্রন্টাল আর টেম্পোরাল লোব খুঁজে পেতে দেরি হল না আমাদের। কারণ ফ্রন্টাল আর টেম্পোরাল লোবই তো আমাদের চিন্তা, স্মৃতি আর কথা বলাকে নিয়ন্ত্রিত করে।
পূর্ব নির্ধারিত ওয়ার্ড বা শব্দগুলোকে গুঁজে দেওয়া হল কমপিউটারের মধ্যে। সঙ্গে সঙ্গে কমপিউটারের মধ্যে দিয়ে সেগুলোকে চালান করে দেওয়া হল রুদ্রশঙ্করের মগজের মধ্যে স্মৃতিভাণ্ডারের মধ্যে। প্রচণ্ড দ্রুতবেগে এই শব্দ পোরার কাজ চলতে লাগল। অসীম ক্ষমতা আমাদের মগজের। এক একবার অসংখ্য তথ্য সে নিতে পারে খুব স্বাভাবিকভাবে। পরক্ষণেই তরঙ্গের আকারে ফেরত পাঠাতে লাগল রুদ্রর মগজের চিন্তাকোশগুলো। ইলেকেট্রোএনকেফালোগ্রাফ মেসিন থেকে অতি অল্পসময়ে এই তরঙ্গগুলো শব্দায়িত করা হল কমপিউটারের মাধ্যমে। এগুলো যত্নসহকারে গুছিয়ে রাখলাম… ভবিষ্যতে কাজে লাগবে আমাদের। প্রতিটি শব্দের চিন্তাগুলো এখন আঙুলের ছাপের মতো সুস্পষ্ট। বেলা ৪টে—তরঙ্গায়িত শব্দ, এবং শব্দায়িত তরঙ্গ করার কাজ শেষ হল আমাদের। রক্ত আর অক্সিজেন সরবরাহের যন্ত্রগুলো খুব ভালোভাবে পরীক্ষা করলাম। এগুলোই রক্ত আর অক্সিজেন সরবরাহ করবে রুদ্রশঙ্ককের মগজে। কারণ আর কিছুক্ষণের মধ্যেই তো রুদ্রশঙ্ককের দেহ আর রক্ত আর অক্সিজেন জোগাবে না মগজকে। জোগাবে না মানে পথগুলো বন্ধ করে দেব আমরা। আর কাল ভোরেই পৃথিবীর চোখে হত্যা করব রুদ্রশঙ্করকে।
রাত ১০টা—পাঁচজনে আমরা একসঙ্গে খেলাম। এই শেষ খাওয়া একসঙ্গে পাঁচজনের। পরিষ্কার করে কামানো মাথায় বায়ু নিরোধক সাদা টুপি পরে বসে আছে রুদ্র, কেমন যেন চুপচাপ! ঠিক যেন দধীচি… আমরা সবাই যেন ওর শিষ্য। মনে মনে চিন্তিত আমরা সকলেই… উত্তেজনাও কম নয়। আর সেই কারণেই হয়তো অকারণে হাসি বা বেশি বলে ফেলছি মাঝে মাঝে। মনের কোণে এক রকম অপরাধ বোধ যেন দানা বাঁধছে ধীরে ধীরে। এক রকম জোর করে দূরে সরিয়ে দিতে হচ্ছে চিন্তাধারাকে।
৮ জানুয়ারি, সকাল ৮-৩০ মি.
সকলেই হাজির রুদ্রশঙ্করের বাড়িতে। সাদা ধবধবে খদ্দরের পায়জামা আর পাঞ্জাবি পরেছে রুদ্র। হাতে ওর অ্যানি বেসান্তের অনুবাদ করা গীতা। অপরাধ বোধটা মাথা চাড়া দিয়ে উঠল আবার। আত্মা আর পরলোক নিয়ে নানান ধর্মগ্রন্থ পড়েছি… রুদ্রও কিনেছে অনেক বই। কিন্তু গীতাকে এভাবে হাতে নিয়ে ঘুরবে চিন্তা করিনি কোনো দিনও।
মনে মনে দারুণ উত্তেজিত আমরা শত শতাব্দীর অজ্ঞতাকে পরাভূত করতে বসেছি। হয়তো… হয়তো… অনন্ত এক আলোক পথের দিশারী হবো আমরা… নতুবা যুগ-যুগান্তরের অজ্ঞতাকেই মেনে নিতে হবে আামাদের। একেবারেই চুপচাপ রুদ্রশঙ্কর। মনে ভয় হল… পিছিয়ে… আসবে নাকি রুদ্র… কিন্তু পেছালেও আমরা কিন্তু পেছাব না। মনে মনে আমরা চারজনই এক। মানে, যদি প্রয়োজন হয় তাহলে জোর করেই, হয়তো শহীদ করব রুদ্রশঙ্করকে। এতখানি এগিয়ে কোনোক্রমেই পেছাতে রাজি নই আমরা।
সকাল ৯-০০টা
নিঃশব্দে একতলায় অপারেশন ঘরে ঢুকলাম আমরা। আর ভাবার কিছু নেই। শুধু এগিয়ে যেতে হবে। জানতে হবে আত্মা আছে কিনা। গীতা হাতে মিনিট পাঁচেক চুপ করে চোখ বুজে দাঁড়াল রুদ্রশঙ্কর। ঠোঁট দুটো নড়ে উঠল কয়েকবার। গীতাটাকে মাথায় ঠেকাল বারবার। তারপর শেষবারের মতো বেঁচে থাকতে থাকতে কথা বলে উঠল রুদ্র—মৃত্যুর পর কিছু থাকলে অনন্তজীবন পাব আমি। আর যদি না থাকে তা হলেই বা কি আছে… মরতে তো হবেই… হয় আজ নয়তো কুড়ি-পঁচিশ বছর পরে। কী যায় আসে এই ক-টা বছরের জন্যে। বেঁচে থাকার সময়টাই বড্ড কম… কাল রাতেই একটা কথাই বাজছিল কানে বারবার। গীতার সেই লাইনটা… কী করে লিখল মুনিঋষিরা সেই যে… আত্মা সম্বন্ধে বলেছে…
নৈনং ছিদন্তি শস্ত্রা—নৈনং দহতি পাবকঃ।
ন চৈনং ক্লেদয়ঃ স্ত্যাপো ন শোষয়তি মারতেঃ।।
গম গম করে উঠল ছোটো ঘরটা। অবাক হয়ে তাকালাম রুদ্রর মুখের দিকে। ভাবলেশহীন নিষ্প্রাণ মুখ। চাপা ঠোঁট দুটোতে দৃঢ়তার ছাপা।
চারপাশে একবার তাকাল রুদ্র। তারপর পাঞ্জাবিটা খুলে ফেলে চিত হয়ে শুয়ে পড়ল অপারেশন টেবিলের উপর। দু-হাতের মধ্যে রইল গীতাটা। বেশ বুঝতে পারছি গীতার মাধ্যমে মনোবল রাখার চেষ্টা করছে রুদ্র। ভগবানের উপর বিশ্বাস ওর চিরকাল। আর কিছুক্ষণের মধ্যে দেখব আত্মা, ভগবান, পরকাল বলে সত্যি কিছু আছে কিনা।
বেলা ১০-৪০ মি.
আবার অ্যান্টিসেপটিক লোশন দিয়ে পরিষ্কার করলাম রুদ্রর মাথাটা। ইলেকট্রোডগুলো সব ঠিকমতো মগজের মধ্যে বসানো আছে। কানেকসন সব ঠিক করলাম। মনিটর আর রেকর্ডিং চলতে শুরু করল সঠিকভাবে। কথা বলতে বারণ করলাম রুদ্রকে। বললাম কথাগুলো চিন্তা করতে ভাবতে। চিন্তার তরঙ্গ মনিটরের মাধ্যমে প্রবেশ করল কমপিউটারের মধ্যে। সেখানে শব্দান্তরিত হল চিন্তার তরঙ্গগুলো… পরক্ষণেই কমপিউটারের মধ্যে থেকে বেরিয়ে এল টাইপ করা কাগজ… রুদ্রর চিন্তার শব্দরূপ: কেন জানি না আমার দৃঢ় বিশ্বাস মৃত্যুর পরেও কিছু আছে… ভীত বা চিন্তিত নই মোটেই… কোনো চিন্তা করো না… প্ল্যান মতো করো…
বেলা ১১-০৫ মি.
রুদ্রের সমস্ত শরীরটা অবশ করে দেওয়া হল। কমপিউটারের মাধ্যমে আমাদের প্রশ্নগুলো সাংকেতিক শব্দের আকারে চালান করতে শুরু করলাম ওর মগজের মধ্যে।
—যন্ত্রণা হচ্ছে?
—না… কোনো যন্ত্রণা নেই।… কিন্তু… কিন্তু সব বুঝতে পারছি… অনুভূতি নেই কোনো। গীতাটা আমার হাতে আছে তো?
—হ্যাঁ, ঠিক করে ধরিয়ে দিয়েছি তোমার হাতের মধ্যে।
বেলা ১১-১৫ মি.—
—রুদ্র… রুদ্র… শোন… এবার তোমাকে আমরা রক্ত আর অক্সিজেন সরবরাহের যন্ত্রের সঙ্গে যোগ করে দিচ্ছি… বুঝতে পারছ?… দেহ থেকে সম্পূর্ণ আলাদা হয়ে পড়বে তোমার মস্তিষ্ক… মস্তিষ্কের রক্ত আর অক্সিজেন পাবে যন্ত্রের মাধ্যমে…
—হ্যাঁ… এটাই তো আমাদের প্ল্যান ঠিক আছে… চিন্তা করো না… কাজ করে যাও প্ল্যান মতো…
—বেশ… প্ল্যান ধরে কাজ করব… তোমার দেহ আর মস্তিষ্ক সম্পূর্ণ আলাদা হয়ে পড়বে… কেউ কারও উপর নির্ভরশীল থাকবে না আর…
—বুঝেছি।…
—শোন… আর কিন্তু পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনতে পারব না তোমাকে… বুঝতে পারছ রুদ্র…
হ্যাঁ… বুঝতে পেরেছি।
—তাহলে… প্ল্যান অনুযায়ী এগিয়ে যাব আমরা?
হ্যাঁ… নিশ্চয়… শোন… গীতার দ্বিতীয় পরিচ্ছেদটা খুলে ধরিয়ে দাও। আমার হাতে…
গীতার দ্বিতীয় পরিচ্ছেদটা বের করে ধরিয়ে দিলাম ওর অবশ ঠান্ডা দুটো হাতের মধ্যে… চোখে পড়ল… নৈনং ছিন্দন্তি শস্ত্রাণি…
—পরিচ্ছেদটা খুলে ধরিয়ে দিয়েছি তোমার হাতে…
বেশ… প্রস্তুত আমি… শুরু করে দাও তোমাদের কাজ…
বেলা ১২-৫০ মি.
…কার্যত দেহ থেকে আলাদা হয়ে গেল রুদ্রের ব্রেন… মস্তিষ্ক… যন্ত্রই এখন রক্ত আর অক্সিজেন সরবরাহ করছে নিরবচ্ছিন্নভাবে… দেহের হৃদপিণ্ড আর কোনো কাজে লাগছে না…
—রুদ্র… শোন… ২৫ সি.সি. ইনসুলিন এবার ঢুকিয়ে দেব তোমার ধমনীতে… মানে ইনজেকশান করব… তার ফলেই মুহূর্তের মধ্যে থেমে যাবে তোমার হৃৎপিণ্ড—বুঝতে পারছ—
—হ্যাঁ… এসব তো আমার জানা কথা—
—শঙ্কর এক থেকে দশ পর্যন্ত গুনবে—ঠিক দশ গোনার সঙ্গে সঙ্গে তুমি মারা—মারা যাবে তুমি রুদ্র—
—হ্যাঁ আমি জানি—এই তো আমাদের প্ল্যান—শঙ্করের গম্ভীর গলা গম্গম্ করে উঠল—এক—দুই—তিন—দশ। সঙ্গে সঙ্গে দেবপ্রিয় হতে সিরিঞ্জের ছুঁচটা বিঁধে গেল রুদ্রের হাতের ধমনীতে। কমপিউটারের মাধ্যমে গুনে চলল শঙ্কর—কমপিউটার তরঙ্গের আকারে পাঠাল সেগুলো রুদ্রর মগজে—এক—দুই—তিন—চার—পাঁচ—ছয়—সাত—আট—নয়—দশ।
২৫ সি.সি. ইনসুলিন চলে গেল রুদ্রর ধমনীতে। লাব—ডুপ—লাব—ডুপ—মুহূর্তের মধ্যে স্তব্ধ হয়ে গেল হৃদ্স্পন্দন—মেরে ফেললাম আমরা রুদ্রকে লাব—ডুপ—রুদ্র এখন মৃত।
কমপিউটরের মাধ্যমে ভেসে এল রুদ্রর চিন্তা—শব্দান্তরিত হয়ে—মরে গেছি আলি—কোনো যন্ত্রণা নেই—কিছুই আমি শুনতে, দেখতে, বলতে বা পড়তে পারছি না—হ্যাঁ আমি এখন মৃত—কিন্তু চিন্তা করতে পারছি আমি—অন্ধকার—অন্ধকারে আচ্ছন্ন চতুর্দিক—কোনো ছায়া বা কেউ নেই চারপাশে—আলোর রেশ নেই কোনোখানে কিন্তু—কিন্তু আমি জানি মরে গেছে আমার দেহ—মৃত আমি—
এই—এইটা চরম আর পরমুহূর্তে—জীবিত থেকে মৃত্যুও উত্তরণ—এই মুহূর্তে আত্মা—প্রাণবায়ু—বা অন্য কিছু (যদি থাকে) কোথায় যাবে দেহ ছেড়ে?—একটা লোককে মেরে ফেললাম আমরা এই রহস্য উদ্ঘাটনের জন্যে—অথবা—অথবা—হত্যা করে নতুন জীবন দিলাম রুদ্রকে—সঙ্গে সঙ্গে আমাদেরও জানা হয়ে যাবে অজানাকে—মৃত্যু-রহস্যের সব তত্ত্ব আর তথ্য। আমরা কি যাত্রা করছি সম্পূর্ণ অজ্ঞাত অজানা পরকালের রাজত্বে? অথবা এখানে সবশেষে আমাদের সমস্ত প্রচেষ্টা—মানে—মানে—চির রহস্যময় মৃত্যুর পরপারে সব কিছুই অজ্ঞাত রয়ে যাবে—আসল সত্যের প্রকাশ ঘটবে না কোনোদিন?
ক্রমাগত রুদ্রর চিন্তা-তরঙ্গকে শব্দান্তরিত করে বলেছে কমপিউটার।
—শূন্যে… অনন্ত নির্জনতা… কিন্তু গাঢ় অন্ধকারে আচ্ছন্ন… না, না, অন্ধকারের সমদ্র বা স্রোত নয়… কেমন যেন খুব শক্ত করে পাকানো গাঢ় তমিস্রার বিশাল এক মহাপিণ্ড… এর বাইরে কিছুই দেখতে পারছি না… চিন্তাও অবশ হয়ে পড়ছে অন্ধকারের ওপারের বিষয়ে… অপেক্ষা… শান্ত হয়ে অপেক্ষা করব আমি…
আত্মা কখন দেহ মুক্ত হয়? পার্থিব এই স্থূল দেহ ছেড়ে কখন মহাপ্রস্থানের পথে যাত্রা শুরু করে বহু কথিত দেহস্থ আত্মা? আত্মার স্বরূপ কি? যম কি সত্যি নিতে আসে দেহ মুক্ত আত্মাকে? যদি আত্মা থাকে তবে তার অনুভূতি কী? সম্পূর্ণ অজ্ঞাত অপরিচিত রাজত্বে কিবা হবে ওর পরিচয়? আর যদি সত্যি অন্ধকার হয় যেমন বলছে রুদ্র তাহলে মৃত্যু খুবই সাধারণ… মারা গেছে রুদ্র… শুধু মরার পরেও চিন্তা করছে কারণ এখন কাজ করে চলেছে মস্তিষ্ক… যদি মেরে ফেলা হয় মস্তিষ্ককেও… তাহলে সবশেষে… কিছুই অবশিষ্ট… বা ফল-শ্রুতি থাকবে না। তার মানে… মিছিমিছি মেরে ফেললাম একটা লোককে… একথাটা তো জানে অনেকে… মৃত্যুই যে জীবনের শেষ পরিসমাপ্তি এ তো অজানা নয় অনেকের কাছে… না, না… রুদ্রর জন্যে… সমস্ত মানুষের জন্য দারুণ দুঃখ হল আমার…
হঠাৎ গীতাটা শক্ত করে চেপে ধরল রুদ্রর মৃত হাত দুটো।—নিশ্চয় নিশ্চয়… কিছু দেখেছে রুদ্র। ফিসফিসিয়ে উঠল শেখর।
—মনে হয় ঠিক বলেছ। ঘটেছে কিছু… রুদ্রর দেহের উপর থেকে দৃষ্টি না সরিয়ে বলল দেবপ্রিয়।
বেলা ১২-১১ মি.—
ডাক্তারি মতে পুরো ছ-মিনিট হল মৃত্যু হয়েছে রুদ্রশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের। কমপিউটার কিন্তু রেকর্ড করে গেছে মৃত রুদ্রর জীবিত মগজের চিন্তারাশিগুলো।
—অন্ধকার… নিকষ কালো… শূন্য নিস্তব্ধ চারপাশ… এখন শরীর সম্বন্ধে বোধ আছে আমার… দেহের বাঁধন থেকে কেমন করে বেরুব আমি… বেরিয়েই বা যাব কোথায়… আমার দেহ থেকে বেরবে কে?… যাবার স্থান নেই কোথাও… অন্ধকার অন্ধকার…
—অন্ধকার… অন্ধকার… একই কথা ঘুরে ফিরে… গোল্লায় যাক সব… চাপা স্বরে রাগতভাবে বলল শঙ্কর।
আমিও কেমন হয়ে গেলাম। শঙ্করকে সায় দিয়ে বললাম—অন্ধকার… অন্ধকার মানে কিছুই নেই… কিছুই নেই… কিছু না থাকার মানেই হচ্ছে অন্ধকার।
—এর একটাই কারণ রণেন… মনটা রুদ্রর কাজ করে বলেছে এখনও। উত্তর দিল শঙ্কর।—আর সেই জন্যেই মনে করছে মানে কল্পনা করছে অন্ধকার বলে। মস্তিষ্কটাকেও মেরে ফেলো… দেখ মুহূর্তের মধ্যে মিলিয়ে যাবে সব… প্রকাণ্ড শূন্যতা ভরে উঠবে রুদ্রর চারপাশ।
শঙ্করের শেষ কথাটা মানতে পারলাম না। বললাম—দেখ… এক মিনিটের উপর নির্ভর করে স্থির সিদ্ধান্ত নিয়ো না শঙ্কর। মনে করে দেখ… মৃত্যুর পরেও জীবন ফিরে পেয়েছে এমন লোক তো দেখতে পাওয়া যায়… ধরো না কেন খ্রিস্টই বেঁচে উঠেছিলেন তিন দিনের দিন… তাই যদি হয় তাহলে মাত্র ছ-মিনিটের মধ্যে অসম্ভব অভাবনীয় কিছু ঘটবে বলে ধরে নেওয়া যুক্তিযক্ত হবে না মোটেই। আত্মা… শক্তি… যাই থাকুক না মানব দেহে… মন… মগজ বেঁচে থাকাকালীন কেমন করে আত্মা ছেড়ে যাবে দেহ থেকে। মনটাই তো মানুষের একান্ত আপন জন।
কমপিউটারের মাধ্যমে প্রশ্ন করল শঙ্কর রুদ্রকে।
—তোমার কি মনে হয় ক্ষুদ্র মগজকে বাঁচিয়ে রেখে কষ্ট দিচ্ছি তোমাকে?
—কষ্টর কোনো মানে নেই এখন। আমি জানিও না সে সব কথা শুধু অন্ধকার… আর তোমাদের উপস্থিতিটা অদ্ভুতভাবে অনুভূত হচ্ছে…
—আমাদের উপস্থিতি? কোথায়… কোথায় রদ্র?
—কেন… যেখানে তোমরা আছ… একটু আগে আমিও ছিলাম সেখানে… বেঁচে ছিলাম… জানি ভালো করেই জানি আর ফিরতে পারব না সেখানে… কিন্তু কোথায় যাব এখন কিছুই জানি না আমি… ধরো… ধরে রাখ আমাকে… ছেড়ে দিও না… যেতে দিও না আমাকে তোমরা…
—কেন কেন যেতে দেবো না?…
—কারণ… কারণ… হয়তো যাবার কোনো জায়গা নেই… কোথায় যাব জানি না আমি… ভীষণ ভীষণ ভয় হচ্ছে… উঃ কী দারুণ অন্ধকার… দোহাই তোমাদের… যেতে দিও না… ছেড়ে দিও না আমাকে।
বেলা ১২-১৪ মি.—
পুরো ন-মিনিট হল মারা গেছে ড. রুদ্রশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। দারুণ হতাশ আমরা। উত্তেনার শৈলশিখর থেকে ব্যর্থতার সুগভীর সলিলে হাবুডুবু খাচ্ছি আমরা। আত্মা—পরকাল—ভূত—স্বর্গ—নরক—ভগবান আর যমদূত—সব যেন অলীক কল্পনার ফসল—
বেলা—১-৩২ মি.—
—অন্ধকার—অনন্ত শূন্যে—সূচিভেদ্য গাঢ় নিকষ কালো—বর্ণহীন জমাট অন্ধকার—
—হে ভগবান—এতদিনের বিশ্বাস সব ব্যর্থ হল—দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বলল শঙ্কর।
—কি যে বলো শঙ্কর—ভগবান… কোথায় ভগবান… এইমাত্র তো শুনলে মৃত্যুর পরপারে কোনো অস্তিত্ব নেই ভগবানের—চাপা স্বরে বললে দেবপ্রিয়।
না, না… দেবপ্রিয়র সঙ্গে একমত নই আমি। সব বিচার হয়ে গেল এক্ষুনি… ভগবানের অস্তিত্ব মুছে গেল মাত্র ন-মিনিটের মধ্যে। সবে মাত্র তো রুদ্রশঙ্কর পা বাড়িয়েছে পরকালের রাজত্বে… আরও সময় দিতে হবে ওকে… দেখা যাক না অন্ধকারই শেষ কথা না আরও কিছু আছে অন্ধকারের বুকে… পরলোকের অস্তিত্ব কি কয়েক মিনিটে বোঝা সম্ভব? অথবা জন্ম-নক্ষত্রের নাড়ি বন্ধনের মতো রুদ্রর মস্তিষ্ককে বাঁচিয়ে রেখে আমরাই বাধা দিচ্ছি ওকে পরলোকের পথে অবাধ বিচরণের… নতুন জীবনের আস্বাদ থেকে… হ্যাঁ হ্যাঁ এই প্রশ্নটাই করতে হবে রুদ্রকে… আমরা কি ছেড়ে দেবে ওকে… মেরে ফেলবে রুদ্রর জীবন্ত মগজকে…
—জানি না… জানি না বুঝতে পারছি না… ধরে থাক… ছেড়ে দিও না আমাকে… আর একটু একটু বেশিক্ষণ ধরে থাক আমাকে…
রুদ্রই বুঝতে পারছে ওর অবস্থা। অবস্থার সঙ্গে সমঝোতার চেষ্টা করছে সে… আমরা কি করে বুঝব ওর অবস্থা… আমরা তো শুধুই ওর মৃতদেহ ঘিরে বসে আছি মাত্র। বিচিত্র পরিবেশ… নিশ্চল নিথর মৃতদেহ রুদ্রর… অথচ যন্ত্র মারফত রক্ত আর অক্সিজেন সরবরাহে জীবন্ত রুদ্রর মস্তিষ্ক… চিন্তা-তরঙ্গে কথা বলে চলেছে আমাদের সঙ্গে…
বেলা ২-৪৩ মি.—
…অন্ধকার… কালসমূদ্র জমাট অন্ধকারে আচ্ছন্ন… কিছু নেই… শুধু শুধু… নিকষ কালো আর কালো…
ক্লান্ত… ভীষণ ক্লান্ত আমরা সকলে… অচেনা অজানা রহস্যময় পরলোক যে শুধুই অন্ধকার একথা কে ভেবেছিল আগে… উত্তেজনার অবশেষে শ্রান্তিতে ভেঙে পড়ছে শরীর মন সর্বাঙ্গ। আশাহত আমরা… কিন্তু একটু ভাবলে বোঝা যায় এক অকল্পনীয় কাজ করেছি আমরা… এক লাফে বিজ্ঞানকে এগিয়ে নিয়ে গেছি কয়েক হাজার বছর ভবিষ্যতের পানে… মৃত লোকের সঙ্গে ভাবের আদান প্রদান করছি আমরা বৈজ্ঞানিক যন্ত্রের মাধ্যমে…
একটা বিরাট সমস্যা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে আমাদের মনে… রুদ্রর জীবন্ত মস্তিষ্ক নিয়ে কী করব আমরা… কারণ গলা থেকে মুখে মাথা বাদ দিয়ে মৃত সমস্ত শরীরটা ফুলতে শুরু করছে… খুব স্বাভাবিক এটা… কতক্ষণই বা ভালো থাকবে মৃতদেহ… পচন ক্রিয়া তো শুরু হবেই। একটাই সহজ পথ আছে… মস্তিষ্কে রক্ত আর অক্সিজেন সরবরাহের যন্ত্রটা বন্ধ করে দিলেই দেহের মতো মরে যাবে রুদ্রর জীবন্ত মগজ। তারপরে পরিকল্পনা মাফিক বাড়ির পেছনে মাটি খুঁড়ে অনেক গভীরে কবর দিলেই চুকে যাবে সব।
—রুদ্র… রুদ্র শোন… রক্ত আর অক্সিজেনের যন্ত্রটা বন্ধ করে দিচ্ছি আমরা।
—নাঃ নাঃ নাঃ দোহাই তোমাদের… মেরে ফেলো না আমাকে… আরও… আরও … একটু দেখতে দাও… শব্দান্তরিত কথাগুলোর মধ্যেও কেমন যেন রাগ আর মিনতি ছোঁয়ানো।
নাঃ আপাতমৃত রুদ্রর কাছে বন্দি হয়ে পড়লাম আমরা। নিজেদের বিবেকের দংশনে জ্বলছি আমরা। রুদ্রর বিনা মতে কি করেই বা বন্ধ করে দি যন্ত্রটাকে… রুদ্রই তো স্বেচ্ছায় মৃত্যুবরণ করেছে আমাদের কৌতূহল চরিতার্থ করার জন্যে। আর সেই রুদ্রকে অজানা রহস্যময় অন্ধকারের মধ্যে রেখে কেমন করে বন্ধ করে দোব যন্ত্রটা? নিজের জীবন দিয়ে প্রমাণ করেছে রুদ্র যে মৃত্যুর পর আর কিছু নেই… সব শেষ মৃত্যুর মধ্যে… হ্যাঁ… এখনও পর্যন্ত এটাই সত্যি আমাদের কাছে।
বেলা ৪-১৭ মি.—
একটু কাত করে শোয়ানো আছে রুদ্রর মৃতদেহ। পেটটা ফুলে উঠছে আস্তে আস্তে… শরীরের সমস্ত রক্ত গিয়ে জমা হচ্ছে পেটের মধ্যে। দেহস্থ নানা গ্যাসে বিকৃত হয়ে পড়ছে দেহটা। মূত্র আর বিষ্ঠা সব বেরিয়ে এসেছে দেহ থেকে। সেগুলো পরিষ্কার করে দিলাম সঙ্গে সঙ্গে। পচে উঠছে সমস্ত দেহটা… অথচ সুন্দর কাজ করে চলেছে মগজটা… ঠিক জীবন্ত দেহের মতো স্বাভাবিকভাবে রক্ত আর অক্সিজেনের জোগান পাচ্ছে মগজটা… আর তার ফলেই… কিন্তু এরও তো একটা সীমা আছে… মৃতদেহের কোশ… টিসু মাংস সব পচে উঠতে শুরু করেছে… কয়েক ঘণ্টার মধ্যে জীবন্ত মগজটাকেও বিষিয়ে উঠবে এদের সংস্পর্শে। তা ছাড়া আমাদের এক্সপেরিমেন্টটা তো ছিল ঠিক মৃত্যুর পরের অবস্থা জানার জন্যে… অনির্দিষ্টকাল পর্যন্ত মগজকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য তো নয়।
শঙ্করের দিকে ফিরে তাকালাম। বললাম—আর নয়, রুদ্রকে বলে দাও… এখানেই বন্ধ করে দিচ্ছি আমাদের এক্সপেরিমেন্ট।
মুহূর্তের মধ্যে সংকেত চলে গেল রুদ্রর মগজের মধ্যে… উত্তরও এল সঙ্গে সঙ্গে… নাঃ নাঃ নাঃ কিছুতেই নয় এখন… অন্ধকারের চেয়েও আরও কিছু যেন… হ্যাঁ… হ্যাঁ… অনুভব করছি… ঠিক যেন ঢেউ—তরঙ্গের পর তরঙ্গ… অথবা… বৃত্তাকারে ছোটো ছোটো জল বলয়… ক্রমেই বড়ো হয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে গভীর অন্ধকারের মধ্যে… মনে হয়… কেউ যেন… কিছু যেন আসতে চেষ্টা করছে… গাঢ় অন্ধকার মধ্যে দিয়ে… বুঝতে পারছি না… তবে…
অন্ধকারের চেয়েও আরও কিছু। ঢেউ বা বৃত্তাকারে ছোটো ছোটো তরঙ্গ। অদ্ভুত দুর্বোধ্য কথাবার্তা।
বিরক্তি সঙ্গে এক অবিশ্বাস্য উক্তি করে উঠল শেখর।—মিথ্যে… মিথ্যে কথা বলছে রুদ্র।
নিজের কানকেও অবিশ্বাস করতে ইচ্ছে হল। সবাই আমরা তাকালাম ওর দিকে।
—হ্যাঁ, যা বলছি সত্যি বলছি। মেশিনটা যাতে বন্ধ করে না দি তার জন্যেই মিথ্যা কথা বলছে—দৃঢ়তার সঙ্গে বলল শেখর।
—মিথ্যে কথা বলে রুদ্রর লাভ?
—সময়—বেঁচে থাকার আরও কিছু সময় পাবে—এটাই লাভ।
—মরে তো ও গেছেই—আর কতক্ষণ—আমরা চাইলেও কয়েক ঘণ্টার মধ্যে বিষিয়ে উঠবে ওর মগজের সেলগুলো—না না—শেখর—সম্পূর্ণ ভুল তোমার চিন্তা।
—না না ভুল নয়—জেনে শুনেই তো মরেছে ও—ভাই বাঁচবার চেষ্টা করছে—যতক্ষণ বাঁচা যায়—নেই মামার চেয়ে কানা মামা ভালো আর কি!
হায় ভগবান—একী শুনলাম। একটা লোক—বন্ধু—আমাদের জন্যে সত্যের জন্যে নিজের জীবন দিতে দ্বিধা করল না—আর সেই মৃত লোককে আর কয়েকটি মিনিট দেব কি না বলে তর্ক করছি আমরা! এক্সপেরিমেন্টের ব্যর্থতাই দুর্বল করে তুলেছে আমাদের—দূর হয়ে গেল কি সত্যানুসন্ধানের দুর্নিবার নেশা?—আর সেই জন্যে কি এখন আইন আদালতের ভয়ে ভীত হয়ে উঠছি? কিন্তু সত্যি কি আইনের চোখে অপরাধী আমরা? যুগ যুগান্তর ধরে তো গবেষণা চলেছে অজানাকে জানার জন্যে—এক—দুই—বহুলোকের প্রাণও বিনষ্ট হয়েছে—তাই না সভ্যতা বিজ্ঞান এগিয়ে চলেছে ভবিষ্যতের দিকে। বিজ্ঞান আর ধর্ম কেউই এ বিষয় নিয়ে মাথা ঘামায়নি এতদিন—সকলেই মনগড়া অনুমানের উপর ভিত্তি করে বলে গেছে অনেক কথা—আর সেই মৃত আত্মার বৈজ্ঞানিক গবেষণা তো আমরাই শুরু করেছি—আবিষ্কারের ফলাফল তো আমাদের একার নয়—সমস্ত সভ্যতার। আর এই সত্য আবিষ্কারের জন্য যে নিজের জীবন উৎসর্গ করল তার সম্বন্ধে কিনা—
—বেশ তো—যদি মিথ্যেই বলে থাকে—তুমি হলে কী করতে?—স্বেচ্ছায় মৃত্যুবরণ করে রুদ্র এখন অজানা পথে একেবারে নিঃসঙ্গ—একা—চিরকালের মতো। যদি—সত্যি—সত্যি কিছু না থাকে মৃত্যুর পর—তাহলে কেনই বা সে বাঁচতে চাইবে না আরও কিছুক্ষণ। আমরা তো বেঁচে আছি শেখর—কি দাম আছে আমাদের কাছে আরও কয়েক মিনিটের? কিন্তু ভেবে দেখত—রুদ্রর কাছে কয়েক মিনিটই অমূল্য—অনন্ত। চিৎকার করেই একটানা বলে গেলাম কথাগুলো।
রুদ্রের জন্য কান্নায় ভেঙে পড়তে চাইছে আমার মন। ওর সঙ্গে আমার কেমন যেন এক একাত্মতা… ঘনিষ্ঠতা বোধ হচ্ছে। যথার্থই নিঃসঙ্গ… সম্পূর্ণ একা সে। আমরা, আমরা তো সকলে একসঙ্গে… সঙ্গে আছে বিশাল জীবন্ত পৃথিবী। কি নেই আমাদের? স্ত্রী পুত্র বন্ধুবান্ধর আত্মীয় পরিজন—সমাজে ভালো প্রতিষ্ঠা ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স—কিন্তু এই যে স্ত্রী পুত্র সব—মৃত্যুর পরও কি নিজের আকারে—এমন কি যদি সবাই মারা যায় একসঙ্গে? না, না—মৃত্যুর পর কেউ কারুর নয়। জীবনের পরমাত্মীয় সম্বন্ধ মৃত্যুর কষ্টিপাথরে উবে যায় এক মুহূর্তে। একদিন—দু-দিন আরও কয়েকদিন—তারপরে শোক ভুলে যে সব কাজ করে চলবে ইচ্ছামতো। কিন্তু এই যে রুদ্র—সত্যানুন্ধানে প্রাণ দিল—ও কিন্তু একান্তভাবে চাইছে আমাদের সাহায্য। বলতে কি আমাদের করুণার উপর বেঁচে আছে ওর জীবন্ত মগজ! অজানা অচেনা রহস্যময় এক পরিবেশে সম্পূর্ণ নিঃসঙ্গ রুদ্র—অবশ্য দু-দিন বাদে আমাদের, যেতে হবে সে দেশে। আর রুদ্র—অন্ধকার অজানা কালসমুদ্রে তরী ভাসিয়ে জানার চেষ্টা করছে পথ আর পরিবেশ—যা হয়তো আমাদেরও সাহায্য করবে মৃত্যুর পরে। আমাদের জ্ঞানের জন্যে যে জীবনাহুতি দিল তাকেই কি কয়েক মিনিটের জন্য মেরে ফেলব—বিশ্বাসঘাতকতা করব এমন এক বন্ধুর সঙ্গে?
—না না শেখর—মিথ্যে কথা বলিনি রুদ্র? যে লোকের মরবার সাহস থাকে সে কখনই মিথ্যে বলে ধরে রাখবে না কয়েকটা মিনিট—সে তো জানেই বেঁচে ওঠা সম্ভব নয় মোটেই।
সন্ধ্যা ৬-১০ মি.—
—রুদ্রর মৃতদেহ থেকে টেনে বার করে ফেললাম সমস্ত রক্তটা। জীবন্ত মাথা বাদ দিয়ে মৃত সমস্ত দেহটার চারপাশে চাঁই চাঁই বরফ রাখলাম ভালো করে—উদ্দেশ্য আরও কিছুক্ষণ পচনের হাত থেকে রক্ষা করা দেহটাকে। কমপিউটারের মাধ্যমে রুদ্রকে জানতে ভুললাম না আমরা।
—সব রক্ত বার করে ফেললাম তোমার শরীর থেকে।
—বেশ… ভালো করেছ।
—চারপাশে বরফ দিয়ে প্যাক করে দিয়েছি দেহটা।
—ঠিক করেছ… নয়তো পচে যাবে যে তাড়াতাড়ি।
—রুদ্র এখনও কি অনুভব করেছ তরঙ্গের?
—হ্যাঁ—অন্ধকার সমুদ্রের ছোটো ছোটো ঢেউ—ঠিক যেন—ঠিক যেন—গাঢ় তমিস্রার হৃদ্স্পন্দন!
—নির্দিষ্ট কোনো ছন্দে কি উঠছে তরঙ্গগুলো?
না না—ছন্দোবদ্ধ নয়—তবে হ্যাঁ—দাঁড়াও—দাঁড়াও—কী রকম নতুন অনুভূতি—ঠিক যেন ধাক্কা মারছে—না—হ্যাঁ অস্পষ্ট হলেও ধাক্কা মারছে—শুধু অন্ধকার—গাঢ় অন্ধকার—আবার—আবার ধাক্কা—হ্যাঁ—আবার—আবার—না সব স্তব্ধ—
রুদ্রর শব্দান্তরিত রেখাগুলো গভীর আগ্রহে পড়ছিল দেবপ্রিয়—এবার একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে সিগারেট ধরিয়ে টান মারল বেশ জোরে। বলল—এই—এই রকম হৃদ্স্পন্দন—কি মনে হয় রণেন—যদি ধরে নেওয়া যায় যে এটা ওর মনের ভুল নয়—তাহলে এটা কি ওর চিন্তার তরঙ্গ—স্পন্দন? মোটের উপর আমরাই তো যোগাযোগ করছি ওর সঙ্গে। এই যোগাযোগের কোনো মানসিক শক্তি তো রূপান্তরিত হচ্ছে না ওর কাছে তরঙ্গ বলে? কী মনে হয় রণেন?
না—এ মত সত্যি হলেও হতে পারে—হয়তো এটা হওয়া সম্ভব।
যাই হোক, দেবপ্রিয়র অনুমানটা জানালাম রুদ্রকে। বললাম এখন পাঁচ মিনিট কোনো কথা বলব না ওর সঙ্গে। আবার যোগাযোগ করব ঠিক পাঁচ মিনিট পরেই। যোগাযোগ না করার জন্যে wave তরঙ্গের হ্রাস-বৃদ্ধি হল কিনা রুদ্রর কাছ থেকে জানতে পারব আমরা।
সন্ধে ৬-০১ মি.—
…বরফে প্যাক করা রুদ্রর আড়ষ্ট দেহটা ঘিরে সরবরাহকারী যন্ত্রের মৃদু একটানা গুঞ্জন। কৃত্রিম উপায়ে রক্ত আর অক্সিজেন সরবরাহ করে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে রুদ্রর মগজের কোশ আর টিসুগুলোকে।
সামনের বন্ধ কাচের জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছে বাইরে রাত্রির অন্ধকার গাঢ় হয়ে নেমেছে চারপাশে। কেমন যেন থম্থমে আবহাওয়া চারপাশে। ঘরের মধ্যে আমরা তিনজন ছাড়া মনে হয় আর কেউ জেগে নেই বাইরের জগতে।
উঃ কী দীর্ঘ এক মিনিট। যেন চলতেই চায় না ঘড়ির কাঁটা। ভবিষ্যতের পানে চলতে যেন ভয় হচ্ছে ওর। ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছি বারে বারে। একে একে তিনশো সেকেন্ড পেরিয়ে গেল অনেক… অনেক মন্থর গতিতে। অনেক কথাই ভিড় করে আসছে মনের মধ্যে। সত্যানুসন্ধানের যে উত্তেজনা ছিল প্রথমে অনেক কারণেই ম্লান গেছে এখন। মৃত্যুই যে জীবনের পরিসমাপ্তি এটাই বড়ো হয়ে বাজছে মনের মধ্যে। আত্মা, পরকাল স্বর্গ নরক এসব এখন কবির অলস কল্পনা বলে মনে হচ্ছে। বুঝতে পারছি না মেশিনটা বন্ধ করে দিলে কোন অন্ধকারের অতল গহ্বরে হারিয়ে যাবে রুদ্রর আত্মা… বা মনটা… এতক্ষণ ধরে যে চিন্তাতরঙ্গের মাধ্যমে কথা বলে এসেছে আমাদের সঙ্গে। সত্যি… সত্যি কি নেই মৃত্যুর পরে জীবনের অস্তিত্ব? পরলোক কি একান্তই মানস কম্পনা?
সন্ধে ৬-১৪ মিনিট—
…আবার চালু করলাম কমপিউটার, আর মনিটারগুলো। শঙ্করই প্রথম কথা বলল রুদ্রের সঙ্গে। জিজ্ঞাসা করল এই পাঁচ মিনিটের মধ্যে আর কোনো তরঙ্গের উপস্থিতি অনুভূত হয়েছে ওর কাছে!
অভাবিতভাবেই উত্তর এল—হ্যাঁ… একবারও বন্ধ হয়নি তরঙ্গের অনুভূতি।
তড়িতাহতের মতো চমকে উঠলাম। এখনও তরঙ্গের অনুভূতি। রুদ্রর নিজের মনের অস্তিত্বের অনুভূতিই কি তাহলে অনুভূত হচ্ছে তরঙ্গের মাধ্যমে… আর এও যদি না হয়… তাহলে… তাহলে… ভাবতেও রোমাঞ্চিত হয়ে উঠছে সমস্ত শরীর। অন্ধকারের চেয়েও নিশ্চয় আরও কিছুর অস্তিত্ব আছে জীবন-মৃত্যুর সূক্ষ্ম সীমারেখার ওপারে। কোন্ শক্তির অস্তিত্ব? অথবা অন্য কিছু… অন্য কোনো অজানা… নিশ্চয় আছে কিছু… আছে কেউ! বিশদ ব্যাখ্যা করে বলতে বললাম রুদ্রকে আমরা।
—হ্যাঁ… মনে হচ্ছে অন্ধকারের ওপারে আছে কিছু… আছে কেউ…
এই তো! এই তো!! আনন্দে উত্তেজনায় লাফিয়ে উঠলাম আমরা। এতদিনের অনুমান বিশ্বাস… রুদ্রর আত্মত্যাগ মূল্যহীন নয় তাহলে? গাঢ় তমিস্রার পরপারে কিছু আছে… কেউ আছে… আছে কোনো শক্তির আভাস! অন্ধকার আর এই শক্তির পার্থক্য বুঝতে অসবিধে হয়নি বরুদ্রর!
—শোন… শোন… মনে হচ্ছে… স্পষ্ট বোধ হচ্ছে তরঙ্গের চেয়ে আরও বেশি কিছু… মনে হয়… মনে হচ্ছে… অন্ধকারের ওপারের থেকে যেন ধাক্কা মারছে জমাট অন্ধকারের বুকে, ধাক্কা মারছে আমার কাছে আসার জন্য…
একটা হিমেল স্রোত বয়ে গেল মেরুদণ্ডের মধ্যে দিয়ে… অজানা আতঙ্কে কেঁপে উঠল সর্বাঙ্গ। কেউ আসতে চাইছে… চেষ্টা করছে রুদ্রর কাছে আসতে! প্রশ্ন করলাম… রুদ্র, তোমার মনকে আটকে রেখে তোমাকেই বন্দি করে রেখেছি। অন্ধকার বোধটাই সম্ভবত জীবনের শেষ ক্ষীণ যোগসূত্র… যা আমরা ধরে রেখেছি যন্ত্রের মাধ্যমে—অন্ধকারের ওপারে হয়তো বহু আলোচিত পরকাল। মনে হয় তোমার মনকে—মানে তোমার মগজকে মেরে ফেললেই—অন্ধকার লোপ পাবে মুহূর্তের মধ্যে। তাই বন্ধ করে দোব কি যন্ত্রটা?
কয়েক মুহূর্ত চুপচাপ—পরক্ষণেই শব্দান্তরিত হল রুদ্রর সুচিন্তিত মত।—হয়তো তোমার কথা ঠিক রণেন—কিন্তু এখনই বন্ধ করে দিও না যন্ত্রটা। ভুলে যেও না আমার স্বেচ্ছায় মৃত্যু বরণের উদ্দেশ্য নয় শুধুমাত্র পরলোকে আত্মার আভাস উপলব্ধি করা—সঠিকভাবে জানা—তার প্রকৃত রূপরেখা বর্ণনাই মুখ্য উদ্দেশ্য! তাই নয় রণেন?
অবিশ্বাস্য ব্যাপার। কিন্তু এর চেয়ে যুক্তিসঙ্গত বক্তব্য আর কি থাকতে পারে? বিশেষত যে লোকটা এক ভয়ংকর পরিস্থিতির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সত্যানুন্ধান করে চলেছে।
—আমার চারপাশে ভিড় করে আসছে—আঘাতের পর আঘাত করছে অন্ধকারের বুকে—মনে হচ্ছে নিকষ কালো মসৃণ ভেলভেটের পর্দার উপর ঘুসির পর ঘুসি মেরে চলেছে।
ভেলভেটের পর্দার উপর ঘুসি!! কালো পর্দা! পর্দা মানেই চিরস্থায়ী নয়—গুটিয়ে তুলে নিলেই অগণ্য অসংখ্য রহস্যের সমাধান পাওয়া যাবে! সন্ধান পাওয়া যাবে যুগ-যুগান্তরের অমীমাংসিত প্রশ্নের উত্তর। উদ্ভাসিত হয়ে উঠবে চির সত্যের অনির্বাণ রূপমাধুরী!
আমার মনের মধ্যে মাথা চাড়া দিয়ে উঠল বিজ্ঞানী সত্তা। বলল—নিজের বা আমাদের সম্মিলিত চিন্তার শক্তিই দেখা দিচ্ছে তরঙ্গরূপে। রুদ্র তো এখন কার্যত মনে পরিণত হয়েছে। তরঙ্গ শক্তির দ্বারাই হয়তো প্রভাবিত হয়েছে ওর মন। বৈদ্যুতিক যন্ত্র মারফত রক্ত আর অক্সিজেন সরবরাহটাই হয়তো ধাক্কা মারছে মস্তিষ্কের সূক্ষ্মতিসূক্ষ্ম কোশ সমষ্টিকে—তার ফলেই বোধ হচ্ছে ভেলভেট পর্দায় কেউ যেন ঘুসি মারছে।
অথবা সত্যি হয়তো কিছু আছে অন্ধকারের ওপার পারে। হয়তো একরাশ পুঞ্জ পুঞ্জ শক্তির উপস্থিতি রয়েছে গাঢ় তমিস্রার ওপারে—ব্ৰহ্মাণ্ড সৃষ্টির সেই আদিম অক্ষয় অব্যয় শক্তিপুঞ্জ! তাহলে মৃত্যুই জীবনের শেষ নয়—
আবার এক নতুন সম্ভাবনার ইঙ্গিত দিল দেবপ্রিয়। এই যে তরঙ্গের অনুভূতি—স্পন্দনবোধ—ভেলভেট পর্দায় ঘুসি মারা এগুলো হয়তো যোগাযোগের এক প্রাথমিক প্রয়াস—বিশেষ কোন সাংকেতিক প্রচেষ্টা।
—রুদ্র—যোগাযোগের চেষ্টা করো… চিস্তার মাধ্যমে চেষ্টা করো বারবার—চিন্তা কর তোমার পরিচয় উদ্দেশ্য—সব কিছু—
রুদ্র কাজ করল কথামতো। চিন্তার রূপ শব্দান্তরিত হয়ে ধরা দিল আমাদের চোখের সামনে।
—আমার নাম রুদ্রশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়—মানুষ আমি—কিছুক্ষণ আগেই মৃত্যু হয়েছে আমার—আমি এখন কোথায় জানি না—যদি আমার কথা বুঝে থাকেন—তাহলে দয়া করে তরঙ্গের ধারাকে বন্ধ করুন এক্ষুনি—তাহলেই বুঝব আমার কথা বুঝতে পেরেছেন—আরও সুচিন্তিতভাবে বোঝার জন্য—বারবার তিনটে দীর্ঘ তরঙ্গের অনুভূতি দিন আমার মধ্যে—আমার নাম রুদ্রশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়।
ক্রমান্বয়ে চিন্তা করে গেল রুদ্র বেশ কিছুক্ষণ ধরে। একই কথা বারংবার চিন্তা করার ফলে কেমন যেন অস্বস্তি একঘেয়েমি বলে মনে হচ্ছিল আমাদের। অধৈর্য হয়ে উঠলাম অবশেষে। হাজার বার, লক্ষ বার, কোটি বার—বলে গেলে কি ক্ষতি হয় ওর? কিছুই যায় আসে না রুদ্রর। জীবনের শেষ প্রান্তে মৃত্যুর দ্বারে পৌঁছে শুধু সময়ের জন্য অপেক্ষা করা। সময়—মুহূর্তের কি কোনো মূল্যে আছে ওর? অনন্ত মহাকালের বুকে শুধুমাত্র ঝরে পড়ার অপেক্ষায় রুদ্র এখন নিরবচ্ছিন্ন নিরবধি একই কথা বলে যেতে পারে বারংবার। কিন্তু আমরা যে অপেক্ষা করে থাকতে পারি না অনন্তকাল—বাস্তব জগতে সময়ের মূল্যে যে অনেক।
সন্ধে ৭-২০ মি.—
একইভাবে রুদ্র আহ্বান করে চলেছে অন্ধকারের ওপারের রহস্যকে। অপারেশন রুম ছেড়ে দোতলায় কিছু জলযোগ, বিশ্রাম, প্রয়োজনীয় ফোন করার জন্যে যেতে শুরু করলাম আমরা এক এক করে। সময়সীমা পনেরো মিনিট মাত্র।
ঘর ছেড়ে বাইরে আসার সঙ্গে সঙ্গেই ভীষণ হালকা মনে হল নিজেকে। ফোন করলাম বাড়িতে—কৃষ্ণাকে পেয়ে গেলাম সঙ্গে সঙ্গে। বললাম জটিল অপারেশনে আটকে পড়েছি—বাড়ি আসতে পারব না রাত্রে। এ তো নতুন নয়—সুতরাং অবাক হবার কিছু নেই। শুধু ঠিকমতো খাওয়া হয়েছে কিনা জিজ্ঞাসা করে ফোন ছেড়ে দিল কৃষ্ণা।
রুটি মাখন আর ফ্রিজে রাখা মিষ্টি খেলাম তাড়াতাড়ি। কেমন যেন হাসি পেল আমার—ক্ষণভঙ্গুর জীবন নিয়ে অনন্ত মহাকালের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছি আমরা। ছোটো ছোটো চাহিদার পার্থিব জীবন যখন মুখর—সত্যানুসন্ধানী রুদ্র শুধুমাত্র মগজের উপর নির্ভর করে পাড়ি দিয়েছে পরকালের রহস্য উম্মোচনে। রুদ্র না হয়ে যদি আমি হতাম! চিন্তার সঙ্গে সঙ্গে কেমন যেন অবশ হয়ে এল সর্বাঙ্গ। অজানা আতঙ্কে শির শির করে উঠল হাত পা। পরক্ষণে দারুণ মিষ্টি লাগল জীবনকে। মনে হল আমি তো বেঁচে আছি আরও পাঁচজনের সঙ্গে। গাঢ় অন্ধকার নেমে এসেছে চারপাশে। সমস্ত আকাশটা কেমন যেন সিঁদুরে লাল হয়ে এসেছে—মহাকালের দিশারী লক্ষ কোটি নক্ষত্ররা গা ঢাকা দিয়েছে লাল মেঘের আড়ালে। থম থমে ভাব চারপাশে। ঝড় উঠবে!
রাত ৭-৪৫ মি.—
অপারেশন ঘরে ফিরে এলাম আমি। এবার শেখরের পালা—নিঃশব্দে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল ও। যোগাযোগের চেষ্টায় ব্যস্ত রুদ্র।
রাত ৮-৩০ মি.—
—এখনও কি অন্ধকারের বুকে ধাক্কা মারছে কেউ—ভেলভেটের পর্দার উপর ঘুসি মারার মতো—কী মনে হয় রুদ্র?
—হ্যাঁ এখনও—কিন্তু অন্ধকার পেরিয়ে আসতে পারবে বলে মনে হচ্ছে না!
—তাহলে—কী মনে হচ্ছে?
—মনে হচ্ছে—ব্যর্থতায় ক্রুদ্ধ হয়ে উঠছে—হতাশায় বেপরোয়া হয়ে উঠছে অনন্ত শক্তিময় সেই অজানা রহস্য—
অধৈর্য হয়ে উঠল দেবপ্রিয়!
—রুদ্র—ঠিক বুঝতে পারছি না তোমার কথা—কেমন যেন হেঁয়ালি ভরা—পর্দার উপর ঘুসির সঙ্গে ক্রুদ্ধ হওয়া—মানে তুমি কি বলতে চাইছ অন্ধকারের ওপারের কেউ কী ভয়ংকর হয়ে উঠছে তোমাকে পাবার জন্য? ভেবে উত্তর দাও রুদ্র?
—না—ভয়ংকর কথাটা বলব না এখনই—এখনই কিছু নয়—রাগ বা ক্রোধের মতো কিছু অনুভব করতে পারছি না এখনই—
—মনে—মানে অন্ধকারের পর্দাটাই ঢেকে রেখেছে—দেখতে দিচ্ছে না কি আছে ওর পেছনে—ঠিক তাই না রুদ্র?
—অনেকটা তাই—হ্যাঁ আবরণ—ঠিক আবরণের মতো—তবে—ক্ষতিকারক—বিপজ্জনক সেটা—
—ক্ষতিকারক? বিপজ্জনক? সেটা কি রকম রুদ্র?
—না, না—ঠিক বোঝাতে পারবো না ব্যাখ্যা করে—তবে পর্দার আড়ালে সে আসতে চাইছে—হ্যাঁ হ্যাঁ—আমার কাছে আসার প্রয়োজন আছে ওর—
—তোমার কথা বুঝতে পারছি না রুদ্র—কী বলছ তুমি—প্রয়োজন আছে—হতাশায় ব্যর্থতার ক্রুদ্ধ হয়ে উঠেছে সে—কী সেই প্রয়োজন?
—প্রয়োজন! প্রয়োজন কথাটাই ঠিক।
—কিন্তু কেন? কেন রুদ্র?
—জানি না—ঠিক বলতে পারলে না—তবে কেমন জানো রণেন—ট্রেন ধরতে এসেছ স্টেশনে—আর ঠিক সেই ট্রেনটাই ছিটকে বেরিয়ে গেল নাকের উপর দিয়ে—কীরকম হয় মনের অবস্থা—অথচ ট্রেন ধরাটাই তো দারুণ প্রয়োজন ছিল—যেরকম করেই হোক ধরতে হবে ট্রেনটাকে—ধরতে হবেই—ধরতেই হবে—
একটা হিমেল স্রোত বয়ে গেল মেরুদণ্ড দিয়ে—ঘাম-ঘাম হয়ে উঠেছে সমস্ত শরীর।
—কেন? কেন রুদ্র—বুঝতে পারছ কিছু?
—জানি না, জানি না রণেন তবে ওর আসা দরকার আমার কাছে। আমার দারুণ প্রয়োজন—হারাতে চাই না—কিছুতেই হারাতে চাই না ওকে—কিছুতেই—কিছুতেই আসতে পারছে না ও।
—আবরণ—পর্দাটাই কি আটকে রেখেছে রুদ্র?
—হ্যাঁ।
ট্রেন—ট্রেন মানে কী—কী বোঝাতে চাইছে—ট্রেন মানে ভ্রমণ—দূরে চলে যাওয়া—ট্রেন মানে—একগাদা সহযাত্রী—সহযাত্রীর সঙ্গে ভ্রমণ—দূরে চলে যাওয়া—কোনো দূর দেশে—সহযাত্রীরা কী আত্মা—প্রেতাত্মা—এক—দুই—অনেক—ধোঁয়ার মতো আবছা অস্পষ্ট চিন্তা—হাজার চেষ্টা করেও কি মনটাকে ঠেলে দিতে পারলে রুদ্রর মনের কাছাকাছি—রুদ্রর চিন্তা ধারার সঙ্গে কি যোগ করতে পারবো আমার চিন্তা-শক্তি—বুড় বুড় করে ভেসে উঠল আর একটা সম্ভাবনা—পর্দা—কালো পর্দা—আমাদের উপস্থিতিটাই কি রূপ নিল কালো পর্দা রূপে। হয়তো তাই—
—রুদ্র—শোন রুদ্র—আমরা—আমাদের উপস্থিতি কি কালো পর্দা বলে মনে হচ্ছে তোমার? মনে হয় মগজেই তো আত্মা বা অলৌকিক শক্তির আধার। আর তুমি তো মারা গেছ—মৃত্যু হয়েছে তোমার—জীবন্ত মগজের মধ্যে কি বন্দি হয়ে রয়েছে তোমার আত্মা? তোমার মন তো কথা বলছে আমাদের সঙ্গে! আর পর্দার ওপরে অজানা সেই কী আসতে চাইছে তোমার কাছে—তোমার আত্মার কাছে—অথবা আত্মাকে নিয়ে যেতে?
বেশ কয়েক মিনিট নৈঃশব্দ্য। চোখ দুটো বোজা রুদ্রর। অসাড় নিস্পন্দ মৃতদেহটা নীল হয়ে আসছে।
—হয়তো তাই রণেন। হয়তো আমার আত্মাকেই চায় ও। কিন্তু ঠিক… সঠিক ভাবে বুঝতে পারছি না কিছু।
—ভাব… গভীরভাবে চিন্তা কর রুদ্র। তোমার যে মৃত্যু হয়েছে সেকথা নিশ্চয় অজানা নয় কালো আবরণে ঢাকা অজানা শক্তির। কিন্তু মৃত্যু হলেও নিতে পারছে না আত্মাকে… তোমায় জীবন্ত মগজে আটকা পড়েছে সে… অথচ যেতে তো হবেই আত্মাকে… অনন্ত ব্রহ্মাণ্ডের বুকে কোথায় নিয়ে যাবে সে। তোমার আত্মাকে… কোন সে অনন্ত দূরত্বে… তাই মৃত্যুর পরেও তোমাকে বাঁচিয়ে রেখে হয় তো অন্যায় করছি আমরা। তোমাকে ছেড়ে দেওয়াই উচিত আমাদের।
আবার চুপচাপ। নিস্তব্ধ কমপিউটার। নির্বাক নিষ্পন্দ আমরা। কিছুক্ষণ পরেই ভেসে এল রুদ্রর চিন্তাধারা।
—হ্যাঁ… হয়তো ঠিক বলেছ রণেন।
সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত এই উত্তর। এমন উত্তরের কথা স্বপ্নেও ভাবিনি আমরা। অথচ বেশ ভালোভাবে চিন্তা করেই উত্তর দিয়েছে রুদ্র। মানে মুক্তি দেওয়া হোক রুদ্রকে। ইহজন্মের মতো মুক্তি। পরকাল থাকলে হয়তো দেখা হবে… নয়তো শেষ… সবশেষ এখানেই। কী আছে সেই অন্ধকার যবনিকার ওপারে? কী এমন সেই দুর্নিবার মোহময় হাতছানি? অজানা গাঢ় অন্ধকারের বুকে কী সেই রহস্য?
সিদ্ধান্ত নেবার ভার আমাদের চারজনের। চারজন বেঁচে আছি আমরা। সাক্ষী এক মৃতব্যক্তি… আমাদের অন্তরঙ্গ বন্ধু। আমরা… তাকে মেরে ফেলেছি। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে হবে আমাদের। শেখর আর আমার মত ছেড়ে দেওয়া হোক রুদ্রর জীবন্ত সত্তাকে। মানে মেরে ফেলা হোক ওর জীবন্ত মগজকে। কোনো মতামত দিল না শঙ্কর। আর দারুণভাবে আপত্তি করল দেবপ্রিয়। অথচ আমার মনে হল… অনেক… অনেক দূর এগিয়েছি… হয়তো অধিকারের সীমারেখার বাইরে চলে গেছি আমরা..
দেবপ্রিয় কিন্তু অনড় অচল।
—রণেন… ডাক্তার আমরা… বিজ্ঞানের পূজারি আমরা… অজানাকে জানার জন্যেই প্রাণ দিয়েছে রুদ্র… ঠান্ডা মাথায় আমরাই হত্যা করেছি ওকে… আর সেই চরম সত্যের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ভাবপ্রবণ হওয়াটা কি উচিত আমাদের… উচিত কি আমাদের সত্যের আবরণ উন্মোচন না করে পরাজয়ের গ্লানি নিয়ে পিছিয়ে আসা? তাহলে… তাহলে কেন—কীসের জন্যে আত্মাহুতি দিল?
—দেবপ্রিয়… রুদ্রই তো ছেড়ে দিতে বলছে আমাদের। রুদ্রর মৃতদেহ ওটা। না, না রণেন, রুদ্রর অস্তিত্ব নেই এখন—যে ভাবছে কথা বলছে সে কি রুদ্র না অন্য কিছু? এই তো কিছুক্ষণ আগেই রক্ত আর অক্সিজেনের নল দুটোকে বারণ করছিল খুলতে, ঠিক ছিল সেই পর্যন্ত। স্পন্দন অনুভব করছিল সে… চিন্তা করছিল আমাদের মতো—স্টেশন—রেল—ঠিক যেন ছেলেবেলার স্বপ্ন দেখা—বাল্যস্মৃতি—
—বাল্যস্মৃতিরই বা প্রমাণ কি দেবপ্রিয়?—সত্যি নয় বলে অবিশ্বাসই বা করব কেন? আস্তে আস্তে প্রশ্ন করল শঙ্কর।
কেমন যেন গোঁয়ার হয়ে উঠল দেবপ্রিয়। বাচ্চাদের মতো তর্কে জেতাই যেন প্রধান মনে করল ও।
—ঠিক বলেছ শঙ্কর। প্রমাণ কই? আর প্রমাণের অভাব আমাদের অনুমানকেই তো মেনে নিতে হবে। ধরা যাক কোনো কিছু নেই মৃত্যুর পরে, তাহলেও আর কিছু করার নেই রুদ্রর। আর পরকাল বলে যদি কিছু থাকে তো কে আটকাবে রুদ্রকে পরকালের দিকে যেতে। বরং আলাদা জীবন পাবে রুদ্র সেখানে। কিন্তু আমরা—আমাদের জিজ্ঞাসু মন তো থেমে থাকবে না—যার জন্যে এত আয়োজন—সেটাই না জেনে কেমন করে মরতে দোব মগজটাকে। মনে হয় আমাদের জানাতে চায় না রুদ্র… আর সেই জন্যেই মরে পালাতে চায় আমাদের হাত থেকে। কিন্তু সেটা হোতে দেবে না আমরা—বাঁচিয়ে রাখব আমরা ওর জীবন্ত মগজকে—প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে জানতেই হবে কী সে গূঢ় অজানা রহস্য? কিছুতেই ব্যর্থ হতে দোব না আমাদের গবেষণাকে।
তর্কের যথেষ্ট অবকাশ ছিল দেবপ্রিয়র সঙ্গে। কিন্তু তর্ক করে কী সম্ভব হবে কোনো যুক্তিপূর্ণ মীমাংসায়? তাই সে পথে গেলাম না আমরা।
—যাক সে কথা দেবপ্রিয়, কিন্তু গবেষণার সবটাই তো আর আমাদের হাতের মধ্যে নয়—ইতিমধ্যে পচনক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে দেহটার মধ্যে—বড়ো জোর আরও আরও আটচল্লিশ ঘণ্টা বাঁচিয়ে রাখতে পারি মগজটাকে। ইতিমধ্যে রুদ্রর রুগীরা হয়তো যোগাযোগ শুরু করবে ওর সঙ্গে। কেউ কেউ আসবে বাড়িতে—তাই এই ক-ঘণ্টার মধ্যেই শেষ করতে হবে এক্সপেরিমেন্ট। বেশ জোর দিয়ে বলল শেখর।
কেন জানি না হাসি পেল আমার। মনে মনে বললাম হায়রে রুদ্র—এই ছিল তোমার কপালে। শেখরের বক্তব্যে বাস্তবতার ছোঁয়াচ আছে। সত্যি তো ক-ঘণ্টা আর ফেলে রাখা যাবে মৃতদেহটাকে। তাই বললাম—বেশ তো, আটচল্লিশ ঘণ্টা আর এমন কী আমাদের জীবনে—কিন্তু রুদ্রর কাছে—বা আমাদের এক্সপেরিমেন্টের জন্যে দারুণ প্রয়োজন কিন্তু এই ক-ঘণ্টা।
—মাত্র আটচল্লিশ ঘণ্টা। আমরা যে অনন্ত পরকাল নিয়ে গবেষণা করতে যাচ্ছি রণেন! ঠেস দিয়ে কথা বলল দেবপ্রিয়।
—এমন কেন বলেছো দেবপ্রিয়—হয়তো একঘণ্টায় বাঁধা পড়বে অনন্ত পরকাল—জানা হয়ে যাবে পরকালের চিরকালীন রহস্য!
—বাঃ বড়ো সুন্দর বলেছ তুমি। ঠিক এইটাই তো চাইছি আমরা। নিজের জন্যে তো মরেনি রুদ্র—রুদ্রর স্বেচ্ছা মৃত্যু তো বিজ্ঞানের সাধনার জন্যে!
—বেশ! সবাই আমরা একমত এ বিষয়ে! আমাদের সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে দিচ্ছি রুদ্রকে।
রাত বারোটা—
দু ঘণ্টা করে পালা করে এক একজনে রাত জাগব ঠিক করলাম। শিফ্ট ডিউটি হল আমাদের। তিনজন ঘুমাব—একজন জেগে থাকবে রুদ্রর আড়ষ্ট মৃতদেহটা আগলে। বোধহয় ঠিক বলা হল না। রুদ্রর দেহটা মৃত বটে কিন্তু মগজটা যে জীবন্ত—পরকালের অজানা রহস্য উদ্ঘাটনে ব্যস্ত।
দোতলার বাথরুমে বেশ কিছুক্ষণ স্নান করলাম। দাড়ি কামালাম। দারুণ ভালো লাগছে। ডিম সেদ্ধ মাখন রুটি যেন অমৃত মনে হল। ডানলোপিলোর নরম গদীর উপর এলিয়ে দিলাম নিজেকে। কেমন যেন স্বপ্ন বলে মনে হল আজকের সমস্ত ঘটনা। কে রুদ্র? ক-টা আছে এমন পাগল? সত্যি কি বিজ্ঞানের জন্যে আত্মত্যাগ করল না নিঃসঙ্গ একলা জীবনটাই মৃত্যুকে আলিঙ্গন করল মুক্তির পথ ভেবে? সত্যি কি রুদ্র ভেবেছিল এমন কোন কিছু? রুদ্র—রুদ্র আমার বন্ধু—বন্ধু—
রাত ১টা—
—হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল শেখরের আর্ত চিৎকারে। শোবার ঘর ছেড়ে দ্রুত পায়ে নামলাম সিঁড়ি দিয়ে—আমার সামনে দেবপ্রিয় ছুটছে উন্মত্তের মতো। পেছনে শঙ্কর।
হুড়মুড় করে একসঙ্গে ঢুকলাম অপারেশন রুমে।
সিনেমা বা নাটকে ‘ফ্রিজ’ শট দেখেছেন নিশ্চয় আপনারা!
পাথরের মূর্তির মতো নিশ্চল স্তব্দ মানুষগুলো। ঠিক সেই অবস্থা হল আমাদের। চৌকাঠ পেরিয়ে স্থাণুর মতো নিশ্চল হয়ে গেল শেখর। উত্তেজনায় বিস্ফারিত ওর চোখ দুটো। কোনোরকমে দেওয়াল ধরে দাঁড়াল শঙ্কর! স্থান কাল মুহূর্তে সব যেন স্তব্দ হয়ে গেছে ঘটনার আকস্মিকতায়।
একইভাবে রয়েছে রুদ্রর মৃতদেহ—বরফের বিছানায় নীল হয়ে যাওয়া শক্ত কাঠের মতো আড়ষ্ট প্রাণহীন দেহ—চাপা গুঞ্জনে রক্ত আর অক্সিজেন সরবরাহ করে চলেছে মেশিন—এখনও জীবন্ত রুদ্রর মগজ। পরিষ্কার কামান মাথা থেকে তার গেছে মনিটরে—মনিটর থেকে কমপিউটারে। সামনেই পড়ে আছে শেখর—না, না শেখরের ছিন্নভিন্ন রক্তাক্ত দেহ। কেউ যেন ফালা ফালা করে চিরে ফেলেছে দেহটাকে। লম্বা ধারালো ছুরি বা অবিশ্বাস্য কোনো তীক্ষ্ণ নখ ভিন্ন কিছুতেই সম্ভব নয় ফালা ফালা করে চিরে ফেলা জীবন্ত একটা দেহকে। এক রাশ রক্তলাল পদ্মের মতো দেহের পাশে পড়ে আছে ফুসফুস দুটো। অন্যপাশে এক রাশ নাড়িভুড়ি—এখনও রক্তের বান ডাকছে ছিন্নভিন্ন দেহটা থেকে। নিদারুণ আক্রোশ ক্ষত বিক্ষত মুখ—কেউ যেন আঙুল ঢুকিয়ে উপড়ে নিয়েছে চোখের মণিদুটো—অন্ধকার কালো কালো গর্ত দুটোয় যেন অন্ধ দৃষ্টি নিয়ে কিছু বলতে চাইছে আমাদের। ঘরের দু-দিকে ছড়িয়ে আছে শেখরের হাত দুটো অমানুষিক কোনো শক্তি যেন উপড়ে নিয়েছে হাত দুটো—ছিন্ন হাত দুটোর শেষ প্রান্তে সাদা হাড়টা বড্ড বেশি উজ্জ্বল দেখাচ্ছে—সারা ঘর জুড়ে রক্তের হোলি খেলা।
এই ভয়ংকর বীভৎসতার ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে বেশ সময় লাগল আমার। বিড় বিড় করে কী যেন বলে চলেছে শংকর। দেবপ্রিয়র দিকে তাকালাম। বিচিত্র রহস্যময় হাসিতে ভরে উঠেছে ওর মুখে। কেমন যুদ্ধ জয়ের হাসি! আশ্চর্য! ছিন্নভিন্ন রক্তাক্ত শেখরের দেহ পড়ে আছে সামনে আর দেবপ্রিয়র মুখে জয়ের উল্লাস! আশ্চর্য! কোনো বাক্য সরলো না আমার মুখে। এ কী বিচিত্র পরিহাস!
রাত ২-১৫ মি.—
—ধীরে ধীরে আত্মবিশ্বাস ফিরে এল আমার। দেবপ্রিয় আর আমি শেখরের দেহটার মধ্যে পুরে ফেললাম ওর নাড়িভুড়ি ফুসফুস। বিছানার চাদরে সম্পূর্ণ মুড়ে নিলাম ওর দেহটাকে। রক্তে ভিজে উঠল চাদর। ধরাধরি করে চাদরে মোড়া দেহটাকে সিঁড়ির তলার ছোটো ঘরে ঢুকিয়ে দিলাম যত্ন করে। রক্তের আলপনা আঁকা সমস্ত ঘরে। ধোয়ার বা পৌঁছবার কোনো মানে হয় না এখন।
চিরকালীন প্রশ্নের জবাব পাওয়া গেল একটা। কে বা কেমন করে প্রশ্নের উত্তর নিরর্থক আমাদের কাছে। জলজ্যান্ত রক্তাক্ত দেহটাই তো জলজ্যান্ত উত্তর। পার্থিব কেউ যে দায়ী নয় এ ব্যাপারে সে বিষয়ে নিঃসন্দেহ আমরা। কোনো মানুষের পক্ষে এমনভাবে হত্যা করা অসম্ভব অবাস্তব। ভেলভেটের মতো কালো অন্ধকারের ওপার থেকে অজানা রহস্যই এই নৃশংস হত্যার জন্যে দায়ী। ঘটনার প্রচণ্ডতা আর ভয়াবহতা দেখে দারুণ শঙ্কিত হয়ে উঠলাম আমরা। নিদারুণ ব্যর্থতায় ভয়ংকর হয়ে উঠেছে সে—সরাসরি আঘাত হেনেছে আমাদের মধ্যে।
বিদ্যুৎ তরঙ্গের মাধ্যমে সমস্ত ঘটনাই জানানো হল রুদ্রকে। সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত উত্তর পেলাম—তাহলে মিথ্যে নয় আমার অনুমান… অনুভূতি! অন্ধকারের ওপারে কেউ আছে নিশ্চয় মৃত্যুর দ্বারে। আর এটাই বোধহয় শেষ নয়। আরও ঘটনার জন্যে অপেক্ষা করছি আমি।
আরও ঘটনার জন্যে অপেক্ষা করছি। আরও ঘটবে এই অনৈসর্গিক অপার্থিব বীভৎস ঘটনা। রুদ্রর কথাগুলো কেমন নিঃস্পৃহ নির্বিকার! তবে যাই হোক—সম্পূর্ণ সফলতার পথে আমাদের এক্সপেরিমেন্ট! মৃত্যুই জীবনের শেষ নয়। মৃত্যুর পরেও অস্তিত্ব আছে আরও জীবনের… পরকালের যম আর ভগবানের—বা স্বর্গের—প্রেতাত্মাও আছে নাকী? মৃত্যু মানে চৌকাঠ পেরিয়ে অন্ধকার ঘরে ঢোকা মাত্র—কী আছে সে ঘরে—আছে নিশ্চয়—আছে অনন্ত আত্মার অস্তিত্ব—পরকালের জ্বলন্ত নিদশন।
শঙ্কর কেমন যেন ম্রিয়মান। ভাবাবিষ্ট দেবপ্রিয়—এক্সপেরিমেন্টের সার্থকতায় উজ্জ্বল। শেখরের নির্মম মৃত্যু শুধুমাত্র ল্যাবরেটরি রিস্ক ছাড়া কিছু নয় ওর কাছে। তবে একটা বিষয়ে ভালো করেছে দেবপ্রিয়—ওই বাধা দিয়েছিল জীবন্ত মগজ থেকে রক্ত আর অক্সিজেনের নলগুলো খুলে ফেলতে। আর সেই জেদের জন্যেই সার্থকতার পথে আমাদের এক্সপেরিমেন্ট।
শব্দান্তরিত হয়ে ফিরে এল রুদ্রর চিন্তাধারা। শেখরের মৃত্যুর বিস্তারিত বিবরণ জানতে চাইছে রুদ্র। পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বর্ণনা করলাম সেই নৃশংস দৃশ্য। এক ভয়ংকর উত্তর পেলাম ওর কাছ থেকে।
—সন্দেহ নেই অন্ধকার পর্দার উপরে যে করাঘাত করছিল, এ কাজ তারই—হ্যাঁ, হ্যাঁ, তার।
—কেন? রুদ্র কেন?
—কেন? এ তো খুবই স্বাভাবিক রণেন, সে চায় আমাকে, আমার আত্মাকে—কিন্তু তোমরাই ধরে রেখেছ আমাকে।
এবার সব স্পষ্ট হয়ে উঠল আমার কাছে। আমরাই তাহলে অন্ধকার পর্দা—আমরাই তফাৎ করে রেখেছি রুদ্রকে ওর অজানা রহস্য থেকে। রুদ্রর মনকে আটকে রেখে—বন্দি করে রেখেছি ওর আত্মাকে—দেহ বিমুক্ত আত্মাকে—পরবর্তী পদক্ষেপের প্রধান অন্তরায় আমরা, অথচ পরবর্তী পদক্ষেপ তো নিতেই হবে ওকে।
—দেবপ্রিয়, এবার আমরা ছেড়ে দি রুদ্রকে, স্বাভাবিক মৃত্যু হোক জীবন্ত মগজের। শেখরের কিন্তু মত ছিল এ বিষয়ে।
—না না না। এত বড়ো সত্যের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে পিছু হঠব না কিছুতেই! রুদ্রর মগজকে বাঁচিয়ে রেখেছিলাম বলেই তো জানতে পারছি সব। শেখরের কথা তুলে আর লাভ নেই কোনো। সে তো এখন মৃত। এক্সপেরিমেন্ট করতে গেলে ক্ষয়ক্ষতি হতেই পারে—শেখরের বেলায় হয়েছেও তাই। তাই বলে কি বন্ধ করে দিতে হবে এক্সপেরিমেন্ট। না, কখনোই না! দেবপ্রিয়র স্বরে অস্বাভাবিক দৃঢ়তার আভাস। একটু থেমে আবার বলতে শুরু করল দেবপ্রিয়। মুখে ওর বিচিত্র হাসি।
—অজানা ভয়ংকর চাইছে রুদ্রকে—রুদ্রর আত্মাকে, অনন্তের আহ্বানে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে রুদ্রর আত্মা, জানতে চাইছে কী সেই অজানা রহস্য—ভয়ংকর বিভীষিকা, যার নিষ্ঠুর আঘাতে মারা গেল শেখর—কী তার স্বরূপ, কে, কে, সে?
—কিন্তু শেখরকে হত্যার পেছনে কী মতলব ওর?
—খুব সাধারণ মতলব—হুমকি দেখিয়ে ছিনিয়ে নেওয়া রুদ্রর আত্মাকে।
—নিজে কেন সে মুক্ত করে নিতে পারছে না রুদ্রকে? প্রশ্ন করল শঙ্কর।—শেখরকে হত্যা করার মতো ক্ষমতা যার আছে সে তো অনায়াসে চুরমার করে দিতে পারে এইসব যন্ত্রগুলোকে—তাহলেই তো মৃত্যু হবে জীবন্ত মগজের, মুক্তি পাবে রুদ্রর আত্মা।
—একমাত্র রক্তমাংসের শরীরকেই হয়তো ধ্বংস করতে পারে ওই বিদেহী প্রাণ। কিন্তু মানুষের গড়া যন্ত্রপাতি হয়তো ধ্বংস করার ক্ষমতা নেই ওর। কিম্বা মানুষই হয়তো একমাত্র আক্রমণের লক্ষ্যস্থল—মানুষ না থাকলে যন্ত্র তো অচল হবেই একদিন না একদিন। হয়তো এটাই নিয়ম বিদেহী জগতের।
—নিয়ম! নিয়ম! ঠিক বলছো রণেন, এই নিয়মটাই মানিনি আমরা—দেহকে হত্যা করে বাঁচিয়ে রেখেছি মগজটাকে। তাই এবার শেষ হোক আমাদের এক্সপেরিমেন্ট, মুক্ত হোক রুদ্রর আত্মা। তা ছাড়া শেখরের এই মর্মান্তিক মৃত্যুর জন্যে তো দায়ী আমরা—আমাদের অস্বাভাবিক জেদ আর দম্ভ। বেশ জোরের সঙ্গে কথাগুলো বলল শঙ্কর!
—মায়া নয় প্রাণের ভয় শঙ্কর! ব্যঙ্গের সুরে বলল দেবপ্রিয়।—প্রেতাত্মার ছোঁয়াচ লাগতেই দেখি ভয়ে শিউরে উঠলে তুমি! এই জন্যেই কি এক্সপেরিমেন্টে রাজি হয়েছিলাম আমরা? সবে মাত্র অজানা জগতের দ্বারপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছি—এখনই তো মূর্ত হয়ে উঠবে অপার্থিব জগতের সমস্ত রহস্য!
সত্যি কি কোনো বন্ধ ঘরের দরজা খুলতে পেরেছি? মৃত্যুই যে জীবনের শেষ কথা নয়—নতুন জীবনের সূত্রপাত সেটাই কি প্রমাণ করতে চলেছি আমরা? পরকাল, আত্মা, প্রেতাত্মা, স্বর্গ, নরক এসবের সমাধান কি সত্যি সম্ভব! তাই যদি সত্যি হয়—তাহলে জীবন্ত অবস্থায় কি যাওয়া যায় সেখানে—অথবা পরকালের আত্মা বা প্রেতাত্মা কী জলজ্যান্ত চলে আসতে পারবে আমাদের পার্থিব জগতে? পারবে কেন—এসেছে নিশ্চয়—নয়তো নৃশংসভাবে হত্যা করল কে শেখরকে?
আমাদের মুখের দিকে তাকাল দেবপ্রিয়। বলল—এক্সপেরিমেন্ট চলবে, কিছুতেই থামাতে দেব না আমি।
—কিন্তু শেখর মারা গেছে আমাদের অন্যায় জেদের জন্য? অত্যন্ত নৃশংসভাবে হত্যা করেছে অসীম শক্তিশালী কোনো বিদেহী আত্মা! তাই, আর নয়, বন্ধ হোক এ এক্সপেরিমেন্ট! প্রতিবাদের ঝড় তুলে বলল শঙ্কর।
—বাঃ বাঃ সত্যি তারিফ করতে হয় তোমার বুদ্ধির। শেখর মারা গেল আমাদের ভুলে—কিন্তু রুদ্র মারা গেল কার ভুলে, শঙ্কর? সেও কি আমাদের ভুলে? কি বলো শঙ্কর?
—নিশ্চয় আমাদের ভুল। দম্ভ আর নাম কেনার নেশায় অন্ধ হয়ে গেছলাম আমরা—তা নয়তো ছোটোবেলাকার বন্ধুকে কেন হত্যা করব আমরা। ভুল, নিশ্চয় ভুল আমাদের।
—কি যা তা বকছ শঙ্কর। তুমি না ডাক্তার—বিজ্ঞানী—যুগ-যুগান্তরের অনুমান আর অনুভূতিকেই না বিজ্ঞানের কষ্টিপাথরে যাচাই করতে চেয়েছি আমরা! মৃত্যুই যে জীবনের শেষ নয়—এটাতো বৈজ্ঞানিক সত্য এখন আমাদের কাছে—সত্যের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে পালিয়ে আসব আমরা? না না, যত নিষ্ঠুর আর ভয়ংকরই হোক না কেন সত্যকে জানব আমরা—জানবো মৃত্যুর পরপারে অচিনলোকের আত্মা প্রেতাত্মার অস্তিত্ব!!
রাত ২-৫৫ মি.
—মুহুর্মুহু শব্দান্তরিত হচ্ছে রুদ্রর চিন্তাস্রোত, অজস্র, আর পড়ছি সেগুলো—কিছুতেই ছাড়া পাবে না রুদ্র তার জীবন্ত মগজের মধ্যে থেকে… তাই।
—রণেন, শঙ্কর, দেবপ্রিয়, শোন, শোন আমার কথা। পাতলা হয়ে আসছে গাঢ় অন্ধকারের পর্দা, নরম হয়ে আসছে যেন—ক্রমেই চাপ বাড়ছে অজানা সেই রহস্যের।
পাতলা, নরম হয়ে আসছে অন্ধকারের পর্দা। শেখরের মৃত্যু্র জন্যেই কি পাতলা হয়ে আসছে ব্যবধানের দুস্তর বাধা? আমরা যদি পর্দা হই তাহলে আমাদের মৃত্যু হলে ঘুচে যাবে কি দুস্তর ব্যবধান? মিলিয়ে যাবে অন্ধকারের পর্দা?
রুদ্র—রুদ্র—তোমাকে কি ছেড়ে দেব আমরা? তুমি কি যেতে চাও অন্ধকারের ওপারে?
হ্যাঁ—যেতে চাই এই মুহূর্তে।
যন্ত্রের হাত থেকে মুক্তি দিলে কোথায় যাবে রুদ্রর দেহ মুক্ত আত্মা? মিশে যাবে কি শেখরের হত্যাকারীর সঙ্গে? মৃত্যুর পরপারে মানে কি ভয়ংকর ভয়ানক অসীম শক্তিশালী কোনো রহস্য? শক্তিশালী রহস্যটাই কি ভগবান না শয়তান প্রেতাত্মা? রুদ্রর আত্মা কি বিলীন হয়ে যাবে ভগবানের মধ্যে না শয়তান প্রেতাত্মার অনুচর হয়ে রাজত্ব করবে চিরকাল?
রুদ্র, রুদ্র—আর কারুর উপস্থিতি কি টের পাচ্ছ? শান্তি, পরম শান্তির পরশ কি অনুভব করেছ কখনও?
না না, পরম শান্তি নয়। কেমন যেন অশুভ আতঙ্ক—ভয়ংকর আতংকের পরশ আছে অন্ধকারের প্রতি রন্ধ্রে রন্ধ্রে।
রুদ্র, দেবপ্রিয় বলছি আমি, বুঝতে পারছি দৃশ্য শব্দ স্পর্শ সমস্ত কিছুর বাইরে রয়েছে সেই অর্জিত শক্তিশালী রহস্য—কিন্তু সেই রহস্য কি জীবন্ত—আমাদের মতো রক্তে মাংসে গড়া, না বাতাসের মতো অদৃশ্য আত্মার?
না—সঠিক করে বুঝতে পারছি না—মনে হয়—বিশ্বচরাচরে ব্যাপ্ত আত্মা।
শব্দান্তরিত যন্ত্রের উপর থেকে চোখ তুলে দেবপ্রিয়র দিকে সোজাসুজি তাকাল শঙ্কর।
সব তো জানা গেল এবার! আত্মা, আত্মা অবিনশ্বর, তাহলে এখানে শেষ হোক আমাদের এক্সপেরিমেন্ট!
না না, কোথায় হল জানা? জানার তো শুরু হয়েছে সবে। সেই আত্মা কি আমাদের উপস্থিতির উপর নির্ভরশীল? মানে আমরা মানে জীবন্ত জীবন না থাকলে কি মিথ্যে হয়ে যাবে আত্মার অস্তিত্ব। আমরা আছি বলেই কি আছে আত্মা প্রেতাত্মা আর কত কি? নয়তো রুদ্রর অন্ধকারের ওপারের প্রাণ কি ভিনগ্রহের কোনো জীবন? জীবনের শেষ মুহূর্তে দেখা দেয় ভিন্নরূপে? জানতে হবে এসব কথা শঙ্কর। তা ছাড়া আত্মা কী? আত্মার অস্তিত্ব কি আছে? এসবের বাস্তব প্রমাণ কোথায়?
শুধু অন্ধকারের ওপারের রহস্যময় কোনো কিছুর উপস্থিতি অনুভব করা মানেই তো প্রমাণিত হয় না যে আত্মা আছে! বল বল শুভঙ্কর—ঠিক কিনা বল?
দেবপ্রিয়র চিস্তাগুলোকে আবার পাঠানো হল রুদ্রর মগজে।
না না, তোমার মতে সায় দিতে পারলাম না দেবপ্রিয়। যদি আমাদের পৃথিবীর সঙ্গে আর কোনো পৃথিবী সহ বর্তমান Coexist করে থাকে তাহলে তো জীবনের যে কোনো মুহূর্তে পরিচয় ঘটবে ওদের সঙ্গে। অথচ শুধুমাত্র জীবনের এক মাহেন্দ্রক্ষণে মৃত্যুর দোরগোড়ায় টের পাওয়া গেল ওদের অস্তিত্ব! এমনই বা হবে কেন রণেন। না না এমন হতে পারে না কিছুতেই। আমার কি মনে হয় জান দেবপ্রিয়, অজানা ওই ভয়ংকর শক্তির সঙ্গে অচ্ছেদ্য বন্ধনে আবদ্ধ আমরা যত জীবন্ত পৃথিবীর প্রাণী। এ যেন জন্ম লগ্নের নাড়ির বন্ধন। জীবন মৃত্যু যেন বাঁধা রয়েছে অদৃশ্যে এক অচ্ছেদ্য বন্ধনে।
বেশ, রুদ্র বুঝলাম তোমার কথা। কিন্তু ভয়ংকর শক্তি বললে কেন? কোনো অশুভ অমঙ্গল কি অনুভব করতে পারছ তুমি?
নিস্তব্ধ কয়েক মিনিট। পরক্ষণেই শব্দান্তরিত হল ওর চিন্তাধারা। বুদ্ধি আর যুক্তির পূর্ণ চিন্তা।
ভুলে যাচ্ছ কেন দেবপ্রিয়। স্বর্গ আর নরক দুটোই না আছে সব দেশের ধর্মগ্রন্থে। হয়তো—হয়তো বিচার আমার হয়ে গেছে ইতিমধ্যে, স্বর্গভোগ জোটেনি কপালে। নরকই নির্বাচিত হয়েছে আমার জন্যে। আর নরকের প্রেতাত্মারা তো অশুভ অমঙ্গলের প্রতীক। তাই শক্তিশালী ভয়ংকর কোনো প্রেতাত্মাই হয়তো পথ দেখিয়ে নিয়ে যেতে এসেছে আমাকে।
নরক—প্রেতাত্মা—সব যেন কেমন এলোমেলো হয়ে গেল। আমার সামনেই রুদ্রর দেহটা মৃত্যু রঙে নীলাভ বিবর্ণ আর একজনের রক্তাক্ত মৃতদেহ পড়ে রয়ে সিঁড়ির তলায় ছোটো ঘরে। সম্ভব অসম্ভবের সীমারেখা লোপ পেতে চলছে আমাদের সামনে। ভয়ংকর কোনো অশুভ শক্তির হাতে নির্মমভাবে নিহত হয়েছে শেখর। উঃ কী বীভৎস সে দৃশ্যে। অক্ষিকোটর থেকে ওপড়ানো চোখ দুটোর ড্যাবডেবে নিষ্পলক চাউনি! অপার্থিব অমানুষিক!
ঠিক এমন সময় ঘটল ঘটনাটা।
অপার্থিব নারকীয় বীভৎস চিৎকারে কেঁপে উঠল সমস্ত ঘরটা… অবশ হয়ে পড়ল সর্বাঙ্গ!
সবাই ঘুরে দাঁড়ালাম একসঙ্গে! ওইতো দাঁড়িয়ে আছে—
শয়তান ভয়ংকর ভূত প্রেত যম! না না… কথায় বর্ণনা করা যায় না সে ভয়াল ভয়ংকর অপার্থিব বীভৎস মূর্তির! শুধু দেখা যায় দু-চোখ মেলে—মনের পটে আঁকা হয়ে থাকে চিরকাল। লম্বায় ন ফুট—ছাদ ছুঁই ছুঁই… টাটকা রক্তের বন্যায় আচ্ছন্ন সর্বাঙ্গ—দগ্দগে ঘা আর আবের মতো মাংসের ঢেলায় বীভৎস সে-মূর্তি। বড়ো বড়ো সাদা পোকা সব কিলবিল করছে ঘাড়ের মধ্যে—পুঁজ রক্ত রস গড়িয়ে পড়ছে সর্বাঙ্গ দিয়ে—নারকীয় দুর্গন্ধে ভারী হয়ে উঠেছে ঘরের বাতাস… সমস্ত শরীর ঘিরে কেমন যেন ধোঁয়ার আচ্ছাদন, চোখ তো নয়—জ্বলন্ত অঙ্গারও নয়—গনগনে দুই সূর্য যেন পড়িয়ে ফেলতে চাইছে আমাদের সকলকে। সমস্ত মুখগহ্বর যেন বিশাল এক ব্ল্যাকহোল—নিকষ কালোয় আচ্ছন্ন। থেকে থেকে লক্লকে আগুনের হলকা বেরুচ্ছে অগ্নিময় দু-চোখ থেকে।
ঘটনার অপার্থিবতায় কিংকর্তব্যবিমূঢ় আমরা। অবিশ্বাস্যের আবির্ভাবে যুক্তিবাদী বাস্তব মন আমাদের পক্ষঘাতগ্রস্ত।
একটা হাত তুলে ধরল সামনের দিকে—অজস্র অন্ধকার গহ্বর ওর হাত জুড়ে—মুড়ির মতো বড়ো বড়ো ম্যাগট ঝরে পড়তে শুরু করল হাতের চারপাশ থেকে—কী অমানুষিক সেই হাত—লম্বা লম্বা আঙুলের সামনে তীক্ষ্ম ধারালো ছুরির মতো নখ—রক্তাক্ত! একটা ছবি ভেসে উঠল চোখের সামনে। ওই তীক্ষ্ম নখে ফালা ফালা হয়ে গেছে শেখরের দেহ, আর শেখরের রক্তে লাল ওর সর্বাঙ্গ—যেন হাওয়ায় ভাসছে—দুলে দুলে উঠছে মূর্তিমান ভয়ংকর—বাস্তবে রূপ নেবার চেষ্টা করেও যেন ব্যর্থ হচ্ছে বারবার। ঠিক যেন জলের ঢেউয়ের মাঝে কোনো ছবি—এঁকেবেঁকে মিলিয়ে যাচ্ছে বারে বারে—কী আশ্চর্য! আস্তে আস্তে রক্তাক্ত পুতিগন্ধময় হাত এগিয়ে আসছে ভেসে ভেসে রুদ্রর দেহের দিকে… কী যেন বোঝাতে চায় অমানুষিক আর্তনাদে—ক্রমেই তীক্ষ্ণ থেকে তীক্ষ্ণতর সেই চিৎকার—
দারুণ আতংকে স্ট্যাচুর মতো নিশ্চল আমরা—হাজার দামামা বেজে বেজে চলেছে মাথার মধ্যে। থেকে থেকে আগুনের হল্কায় গরম হয়ে উঠছে ঘরের বাতাস… দু-হাতে কানচাপা দিয়ে ব্যর্থ চেষ্টা করলাম বারবার—ভয়ার্ত আর্তনাদ বেরিয়ে এল আমাদের গলা চিরে—মৃগীরুগীর মতো অর্থহীন সেই অবিশ্রান্ত আর্তনাদ—আমাদের আর্তনাদ—কান্নায় পরিণত হল এক সময়ে—সংবিৎ ফিরল ধীরে ধীরে—উৎকট দুর্গন্ধে ভারী হয়ে উঠেছে ঘরের বাতাস।
হঠাৎ সটান মেঝের উপর পড়ে গেল শঙ্কর। দেবপ্রিয় তাকাল আমার দিকে—বৃথাই পরীক্ষা করলাম আমরা—চিরদিনের মতো স্তব্ধ হয়ে গেছে শঙ্করের হৃৎপিণ্ড—খুবই স্বাভাবিক এই পরিবেশে হার্টফেল করা—
রাত ৩-১০ মি.—
ধীরে ধীরে পরিবেশকে মানিয়ে নিলাম আমরা দুজনে। দেবপ্রিয় আর আমি। একে একে নিভিছে দেউটি। ধরাধরি করে ঘরের এককোণে রাখলাম শঙ্করের মৃতদেহ। একটা চাদরে ঢেকে দিলাম দেহটা। না, ড্যাবডেবে বিস্ফারিত চোখ দুটো বন্ধ করিনি আমি। ওই ভয়ার্ত দৃষ্টির দিকে কোনোমতেই তাকাতে পারছিলাম না আর।
এযাবৎ কমপিউটারের কাজ চালাচ্ছিল শঙ্কর। শঙ্কর নেই। এখন অনভ্যস্ত হাতে আমাদের হাল ধরতে হল। সমস্ত ঘটনা জানালাম রুদ্রকে! বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ। তারপর লেখার ছাপ পড়ল কাগজের উপর।
—তাই নাকি? যা ঘটার তা ঘটবেই—এবার—এবার জানতে পারব সব—জানতে পারব কে সেই ভয়ংকর?
অবাক হলাম। পরপর দুই বন্ধু, মারা গেল তারপরেও কোনো দুঃখ বোধ নেই রুদ্রর লেখায়। আশ্চর্য! কিন্তু না, মৃত লোকের কি অনুভূতি থাকতে পারে—রুদ্র তো মৃত আমাদের কাছে। ওই তো ওর অসাড় দেহটা বরফের মধ্যে কাঠ হয়ে পড়ে আছে—পচতে শুরু করবে আর কিছুক্ষণের মধ্যে। কেমন যেন মনে হল আমার—আর বন্ধু বলে মনে হল না রুদ্রকে—রুদ্রর আত্মত্যাগও ভুলতে শুরু করলাম। রুদ্র এখন ল্যাবরেটরির গিনিপিগ—তাই বা কী করে হবে—না না কারুর সঙ্গে তুলনা হয় না এর। এক রহস্যময় ভীতিপ্রদ বস্তু এখন ও। শক্ত কাঠ হয়ে যাওয়া মৃত দেহের মধ্যে জীবন্ত মন—মগজ। সেই জীবন্ত মনের মধ্যে আত্মার খোঁজে হানা দিয়েছে নরকের বিভীষিকা। না, না। আর মানুষ বলা যায় না। আমরাও ভয় পেতে শুরু করেছি ওকে। বন্ধু—সহকর্মীর বদলে ভয়ংকর বিপজ্জনক রুদ্র এখন আমাদের কাছে।
—না না—আর না—শেষ করে দাও মগজটাকে—খুলে ফেল রক্ত আর অক্সিজেনের পাইপগুলো। নিজের অজ্ঞাতে চিৎকার করে উঠলাম আমি।
কোনো কথা না বলে ধীর পদক্ষেপে আমার দিকে এগিয়ে এল দেবপ্রিয়। জয়ের আনন্দে জ্বলজ্বল করছে ওর চোখ। আমার দু-কাঁধ ধরে ঝাঁকি মেরে বলল—না না কখনোই নয়—কেন বন্ধ করব এক্সপেরিমেন্ট। সবে তো শুরু—আসতে আরম্ভ করেছে সে—আরও—আরও আসবে সে—একেবারে কাছ থেকে—দেখতে হবে—জানতে হবে রণেন।
—কাকে? কাকে জানতে হবে? মৃত্যুকে? চিৎকার করে প্রতিবাদ করলাম আমি।
—হ্যাঁ—হ্যাঁ! মৃত্যু—পৃথিবীর সবচেয়ে আদিম রহস্য—হেঁয়ালি, পরজন্ম—স্বর্গ—আত্মা—পরলোক নরক—আরও কত কি—সব সব জানতে পারব এখন! জানতে পারব মৃত্যু কী? মৃত্যু কি জীবনের শেষ না শুরু। উত্তেজনায় রীতিমতো কাঁপছে দেবপ্রিয়।
শুধু অবাক বিস্ময়ে তাকালাম ওর দিকে। এই দেবপ্রিয় কি আমার বন্ধু? না কোনো অচেনা অজানা লোক!
—দেবপ্রিয়—শোন—ঠান্ডা মাথায় বুঝতে চেষ্টা করো সব। আর নয়—এবার বন্ধ করা দরকার এক্সপেরিমেন্ট!
—দোহাই রণেন—দোহাই তোমার! মন থেকে মুছে ফেল এসব কথা। সব কিছু জানার জন্যেই তো মরেছে রুদ্র—শেখর—শঙ্কর জানতে হবেই—জানতে হবে আমাদের আসল পরিচয়—কে আমরা—এলাম কোথা থেকে এখানেই বা এলাম কেন—কোথায় যাব আমরা—মানুষ কি চরম বিস্ময় নয় পৃথিবীর? আর এই সব প্রশ্নের সঠিক উত্তর জানার অধিকারও নিশ্চয় আছে আমাদের—আর ঠিক সেই জন্যেই বন্ধ করব না এক্সপেরিমেন্ট!
—দেবপ্রিয়—তুমি কি পাগল হয়ে গেছ? মৃত্যুর পরপারে ভয়ংকর এক শক্তির দেখা পেয়েছি আমরা—আর—আর জানতে চেয়ো না গূঢ় সত্যের নিষ্ঠুর রূপ—সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে যেয়ো না আর—
—সৃষ্টিকর্তা? কে সে? সে কি ভগবান? কোথায় থাকে সে? কি তার স্বরূপ? নরকের সেই বিভীষিকাই কি ভগবান? পেছনে হাত দিয়ে দ্রুতপায়ে পায়চারী করতে শুরু করল দেবপ্রিয়। ভয়ংকর উত্তেজনার শিকার ও। বার কয়েক নেড়ে নেড়ে দেখল রুদ্রর মৃত দেহটা। কেমন যেন বিস্ফারিত ওর দু-চোখ। আমার মুখোমুখি দাঁড়াল আবার। পরক্ষণে ছুটে গেল বন্ধ জানলার দিকে। চিৎকার করে উঠল—কোথায়? কোথায় তুমি ভগবান? সত্যকে জানা কি পাপ? অপরাধ? তুমি কি শুধুই মৃত্যু আর বিভীষিকা—জঘন্য নরকের দানবীয় রূপই কি তোমায় আসল স্বরূপ? কোথায় তোমার ভুবন ভোলানো মনোহর রূপ? জীবন আর ভালোবাসার আসল স্বরূপ?
স্তম্ভিত আমি। পাগল হয়ে গেল কি দেবপ্রিয়? একইভাবে জানলার সামনে দাঁড়িয়ে আছে ও। কী করা উচিত এখন? কী করব এখন? কিন্তু আবার কথা বলে উঠলো দেবপ্রিয়।
—দেবে না—দেবে না উভয়। শোন ভগবান—তোমাকে বিশ্বাস করি—ভালোবাসি বলেই তোমার আর তোমার স্বর্গের স্বরূপ জানতে চাই আমি। শোন—শোন তুমি—তোমার ওই নারকীয় রূপকে স্বীকার করি না—স্বীকার করি না ভয়ংকর—বিভীষিকাকে? কোথায়? কোথায় তুমি—দেখা দাও—বিশ্বাস করতে দাও তোমার অস্তিতের! দেখা দাও—দেখা দাও—
আর থাকতে পারলাম না। চিৎকার করে উঠলাম—দেবপ্রিয় দেবপ্রিয়—শোন শোন—আছে—আছে—নিশ্চয় আছে ভগবান—
—কোথায়? কোথায়—নরকের বিভীষিকাই তাহলে ভগবান?
—না না—ভগবান নয় সেই বীভৎস ভয়ংকর।
আমরা দুজন মুখোমুখি। দুজনের মাঝখানে রুদ্রর বিবর্ণ দেহটা প্রাণহীন আড়ষ্ট শক্ত কাঠ। এখন আর কেউ আমরা স্বাভাবিক নই—ভূত ভবিষ্যৎ বর্তমান সব মূল্যহীন আমাদের কাছে। দুজনেই চিৎকার করে চলছি তারস্বরে।
—না না—বীভৎস না ভগবান—সত্যম শিবম সুন্দরম তিনি।
হ্যাঁ হ্যাঁ—তোমার কাছেই ভগবান সুন্দর—আর…
—বিশ্বাস করো—সত্যিই সুন্দর ভগবান—ভগবানই স্বর্গ।
—না না—স্বর্গ নয়—নরক!
—ভালোবাসি ভালোবাসি ভগবানকে আমি—সমস্ত মন প্রাণ দিয়ে বিশ্বাস করি তাঁর অস্তিত্বে—
—ভালোবাস! বিশ্বাস কর! কাকে ভালোবাস রণেন? ওই ওই বীভৎস ভয়ংকর কে—ওই যে কিছুক্ষণ আগে যে এসে দাঁড়িয়েছিল আমাদের সামনে—জঘন্য নোংরা পোকা সব কিলবিল করছিল সমস্ত দেহে—দুষিত ক্ষতে আচ্ছন্ন সর্বাঙ্গ—
—না না না—ভগবান নয় সে—হায় ভগবান—কী করে বোঝাব তোমার স্বরূপ—
আর পারলাম না—দু-হাত দিয়ে সামনের টেবিলটাকে ধরে কোনোরকমে দাঁড়িয়ে রইলাম—আলোর সামনে রুদ্রশংকরের বিবর্ণ মৃতদেহ বরফের বিছানায় শোয়ানো—ভগবানের অস্তিত্ত্ব প্রমাণই বড়ো কাজ আমার—ভগবানের অস্তিত্বের উপরই কি নির্ভর করছে আমার স্নায়ুর ভারসাম্য? কৃষ্ণ, দুর্গা, লক্ষ্মী, সরস্বতী, শিব সবাইকার ছবি ভেসে উঠল চোখের সামনে—মা কালীর মূর্তি যেন হাসতে শুরু করল চোখের সামনে—ভগবান ছাড়া কী করে বাঁচবে সকল জীব—বিড়বিড় করে বলে চললাম—মা মা মা—দেখা দাও—শক্তি দাও মা মা মা—
বেশ কিছুক্ষণ কেটে গেল এরকমভাবে—পরিশ্রান্ত হয়ে পড়লাম দুজনেই—প্রচণ্ড শকের প্রাথমিক ধাক্কা কাটিয়ে উঠলাম। দেহ নিঃসৃত অ্যাড্রিনালিন ধীরে ধীরে সুস্থ করে তুলল আমাদের।
—দেবপ্রিয়—প্রথমে ও রুদ্রর দিকে আঙুল দেখিয়ে নিজের দিকে দেখল—এর মানে বোঝাতে চাইল যে রুদ্র এখন ওর—শান্তভাবে বুঝতে চেষ্টা করলাম সমস্ত ঘটনা।
ঘাড় নেড়ে সায় দিল দেবপ্রিয়। বলল—রণেন, আর একটা মানেও বেশ পরিষ্কার—আমাদের দুজনকে হত্যা করতে চায়নি ও। তার মানে আমাদের হত্যা করলে রুদ্রর আত্মাকে পাবে না আর—আমরা যদি বন্ধ করে দি রক্ত আর অক্সিজেনের যন্ত্রটা তাহলে মৃত্যু হবে রুদ্রর জীবন্ত মগজের, আত্মাও মুক্তি পাবে সঙ্গে সঙ্গে—তার মানে বোঝা যাচ্ছে যতই শক্তিশালী হোক না কেন নরকের জীবটা মেশিন বন্ধ করতে পারে না ও। যন্ত্রকে অচল করতে প্রয়োজন পড়বে মানুষের। কি বলো রণেন?
—আচ্ছা, আমাদের হত্যা করে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলেই তো হত। অ্যাডজাস্টমেন্টের অভাবে কিছুক্ষণের মধ্যে বন্ধ হয়ে যেত যন্ত্রগুলো—আর তার পরেই তো মুক্তি পেত রুদ্রর আত্মা।
—হ্যাঁ, ঠিক বলেছ কথাটা, তবে হয়তো দেরি করতে চায় না সে, হয়তো অজানা অনন্তের নির্দিষ্ট একটা সময়সূচি আছে—আছে নির্দিষ্ট কোনো কর্মপদ্ধতি—হয়তো নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে আত্মাকে না পেলে বিশৃঙ্খলা ঘটবে অনন্ত বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে—হয়তো—
দেবপ্রিয় কিন্তু অনড় অচল। কোনো যুক্তিতেই হার মানতে রাজি নয় সে।
—রণেন, এক্সপেরিমেন্ট চালিয়ে যাব আমরা, রুদ্রর আত্মাকে অধিকার করতে চায়—অথচ অপেক্ষা করার সময় নেই ওর, আর ঠিক সেই জন্যেই মরিয়া হয়ে উঠেছে বীভৎস ওই প্রেতাত্মা!
আবার চুপচাপ কিছুক্ষণ। যন্ত্রের মৃদু গঞ্জন কেমন যেন মাদকতা মায়াজাল বুনে চলেছে ঘরের মধ্যে। মাথা নীচু করে কী যেন ভাবছে দেবপ্রিয়।
—রণেন, আমার কি মনে হয় জান, আর একজনকে হয়তো হত্যা করবে আমাদের মধ্যে—তাহলে থাকব একজন—সে আমি বা তুমি যে কেউ—হয়তো সেই একজনই বন্ধ করে দেবে মেশিনটা।
সম্ভাব্য সব যুক্তিগুলোই চিন্তা করে চলছে দেবপ্রিয়। ঠান্ডা মাথায় ভেবে চলেছি আমরা। আর ভয় করি না আমরা অশরীরী আতঙ্ককে। ভয় করি না জীবনের পরপারে ভয়ঙ্করের অস্তিত্বে। মৃত্যুর বীভৎসতা সাহস এনে দিয়েছে আমাদের মনে, আমরা প্রস্তুত মোকাবিলার জন্যে। দেবপ্রিয়র যুক্তিকে মেনে নিয়েছি নিঃশব্দে। দুজনের মধ্যে একজনকে মরতে হবে আমাদের। তাহলেও হার মানব না আমরা, শেষ পর্যন্ত চালিয়ে যাব এক্সপেরিমেন্ট—মৃত্যু রহস্যের রোমাঞ্চকর প্রহেলিকার রহস্য ভেদ করব আমরাই। জানি অকথ্য অবর্ণনীয় অপার্থিব অত্যাচার চলবে সেই বেঁচে থাকা একজনের উপর যন্ত্র বন্ধ করবার আপ্রাণ চেষ্টা চালাবে সেই পুতিগন্ধময় প্রেতাত্মা। সত্যিই কি দুর্বিসহ হয়ে উঠবে অনন্তের আকর্ষণে?
তবে হ্যাঁ আমার চেয়ে সাহসী দেবপ্রিয়। আমি যদি মারা যাই দেবপ্রিয় যুঝে যাবে শেষ পর্যন্ত। বিপদের মুখোমুখি দাঁড়িয়েও অবিচল থাকবে দেবপ্রিয়।
—জান রণেন, তোমার ভগবান বিশ্বাসে অসম্মান করা উচিত হয়নি আমার। উত্তেজনার মাথায় অনেক কটু কথা বলেছি তোমার ভগবানকে, কিছু মনে করো না তুমি।
—না না—এই পরিস্থিতিতে অনেক কিছুই হতে পারে দেবপ্রিয়, অত মনে রাখতে কি চলবে এখন? বিশ্বাস ছাড়া—বলতে বলতে থেমে গেলাম। বিচিত্র এক অনুভূতি হল মনের মধ্যে। কেমন যেন মায়া হল রুদ্রর উপর।
—দেবপ্রিয়—রুদ্র হয়তো কষ্ট পাচ্ছে, ওকে কি কষ্ট দেওয়া উচিত আমাদের? তাই শান্তিতে মরতে—
আবার—আবার সেই এক কথা তোমার মুখে। না, না শেষ না দেখা পর্যন্ত এক্সপেরিমেন্ট চলবে আমাদের।
—শোন, শোন—উত্তেজিত হয়ো না—নরকের মুখোমখি হয়তো দাঁড়াতে হবে আমাদের।
—তাই দাঁড়াব রণেন, নরক প্রত্যক্ষ করব স্বচক্ষে—জানব ওর গোপন কথা, দেখব কী আছে ওই ভয়াল ভয়ংকরের মধ্যে।
মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকিয়ে রইলাম দেবপ্রিয়ের মুখের দিকে। এক অমানবিক উত্তেজনায় জ্বলজ্বল করছে ওর সমস্ত মুখমণ্ডল। ফুলে ফুলে উঠছে নাসারন্ধ্র। না, না, বৈজ্ঞানিকের ধীর শান্ত মুখে এ নয়—নয় এ গবেষকের শুচিস্নিগ্ধ মুখমণ্ডল। শতসহস্ৰ ধূমায়িত বহ্নি ওর দু-চোখ জুড়ে। মৃত্যু্র মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মৃত্যুভয়কে জয় করেছে দেবপ্রিয়। মৃত্যুরহস্য ভেদে তাই সে আজ দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। জীবনের ভয় করতম মুহূর্তকে দেখেছি আমরা—ভূত-ভবিষ্যৎ-বর্তমান সব লুপ্ত হয়ে গেছে দেবপ্রিয়র—ভয় আজ ভয় পাবে ওর মানসিক দৃঢ়তায়—ভয়কে সে দেখতে চায় পুঙ্খানুঙ্খভাবে—মৃত্যুভয় তাই আজ ওর কাছে পরম উৎসাহের বিষয়।
না, ভরসা ছাড়িনি আমি। রুদ্রশঙ্করের জীবন্ত মগজ তো আছে এখনও আমার কাছে। কোডের ভাষায় কমপিউটারের মাধ্যমে সমস্ত ঘটনা জানালাম রুদ্রশঙ্করকে। জানালাম আমাদের ভিন্ন ভিন্ন অভিপ্রায়ের কথা। কয়েক মিনিট চুপচাপ—পরমুহূর্তে সচল হয়ে উঠল কমপিউটার।
হ্যাঁ, হ্যাঁ, ছেড়ে দাও, যেতে দাও আমাকে—এক্ষুনি যেতে দাও—আমার জন্যেই অপেক্ষা করছে সে—যেতে যে আমাকে হবেই রণেন, দোহাই তোমাদের—যেতে দাও আমাকে।
লেখাটা চোখে দেখছি না, কানের মধ্যে বাজছে রুদ্রশঙ্করের কথাগুলো। এত জোর দিয়ে আর কখনও বলেনি সে। কোনো দ্বিধা-দ্বন্দ নেই আর, যাবার জন্যে ব্যগ্র হয়ে উঠছে ওর আত্মা।
—যাবে—কোথায় যাবে রুদ্রশঙ্কর… কোথায়? প্রশ্ন পাঠাল দেবপ্রিয়।
—জানি না, জানি না, জানি না—কিন্তু যেতে আমাকে হবেই, যাবই আমি, আমাকে না নিয়ে যাবে না ও—ওর সঙ্গেই তো মিশে যেতে হবে—অথবা, ওই হয়তো মিশে যাবে আমার সঙ্গে—কে, মানে কী রহস্য আছে ওর মধ্যে—কিন্তু যাই হোক না কেন, ও যে মিশতে চাইছে আমার দেহের সঙ্গে।
—তোমার দেহ? তোমার দেহ তো মৃত—শক্ত কাঠ হয়ে গেছে অনেকক্ষণ আগে, রদ্রশঙ্কর।
—জানি—আমি জানি দেবপ্রিয়—কিন্তু আমাকে ছেড়ে না দিলে ওই আড়ষ্ট দেহেই ঢুকবে সে—প্রতিহিংসার নেশায়—একবার ঢুকলে আর রক্ষা নেই কারুর—নরকের দাবাগ্নি ছড়িয়ে দেবে সে তোমাদের জীবনে—নরকের অভিশাপ নেমে আসবে পৃথিবীর বুকে—
—ভুলে যেও না রুদ্রশঙ্কর, দেহ তোমার চিরস্থায়ী নয়—তোমার দেহ নষ্ট হলে, কোথায় থাকবে নরকের কীট?
—মূর্খ! মূর্খ তোমরা! মূর্খ তোমাদের বিজ্ঞান! জান না কি অসীম শক্তিধর সেই অজানা রহস্য—সমস্ত বিশ্বচরাচর গ্রহ নক্ষত্র সমগ্র ব্ৰহ্মাণ্ড চলে ওর ইশারায়—কি আসে যায় এক আধার ধ্বংস হলে—শত সহস্র জীবন্ত আধারে তোমাদের পৃথিবী—এক নরকাগ্নি থেকে জ্বলে উঠবে শত সহস্র নরকাগ্নি—রক্ষা পাবে না তোমরা কেউ—আর সেই জন্যে যেতে দাও আমাকে—বিলীন হতে দাও আমাকে পরম শক্তির সঙ্গে—
—দেবপ্রিয়—দেবপ্রিয়—যেতে দাও—এবার যেতে দাও রুদ্রশঙ্করকে। মিনতির সুরে বলে উঠলাম আমি।
না না না! টেবিলের উপর ঘুসি মেরে বলে উঠল দেবপ্রিয়। পরক্ষণেই প্রশ্ন পাঠাতে শুরু করল কমপিউটারের মাধ্যমে।
—পরম শক্তি? কে সেই শক্তি? কী নাম তার?
—জানি না—জানি না আমি।
—ভগবান—পরমশক্তি কি ভগবান রুদ্রশঙ্কর?
—না।
ব্রহ্মা বিষ্ণু মহেশ্বর না অন্য কেউ?
—না না।
—যম—না তার কোনো অনুচর?
—হ্যাঁ হ্যাঁ বুঝতে পারছি—স্পষ্ট হয়ে উঠছে সব—যম—হ্যাঁ হ্যাঁ যম—যম ব্রহ্মা বিষ্ণু মহেশ্বর সব—সব এক একাকার সেই ভয়ংকর ব্রহ্মাণ্ড বিনাশকারী পরম শক্তি! এবার এবার যেতে দাও—ছেড়ে দাও আমাকে—
যন্ত্র আর আমার মাঝে দাঁড়িয়ে দেবপ্রিয় জ্বলন্ত যেন এক অগ্নিশিখা। উত্তেজনায় থরথর করে কাঁপছে ওর সর্বাঙ্গ। আমায় দিকে ফিরে হা হা করে হেসে উঠল দেবপ্রিয়।
—রণেন—রণেন—বুঝেছি—বুঝেছি—সব এক—স্বর্গ নরক—পাপপুণ্য—যম ব্রহ্মা বিষ্ণু মহেশ্বর সব এক—যে যেমন মনে করে সে তেমন ভোগ করে—যাক এতদিনে জানতে পেরেছি—এনার্জি বা শক্তিই সব—আর সেই দুর্জয় শক্তি আজ আমাদের সামনে এক কণা শক্তির জন্যে ভয়ংকর হয়ে উঠেছে—হা হা হা―ধরেছি—ধরেছি—ওলট পালট করে দিয়েছি বিশ্বের চিরাচরিত নিয়মকে—শক্তি আজ মুঠোর মধ্যে—শক্তির স্বরূপকে জানতেই হবে আমাদের!
বন্ধ কর! বধ কর যন্ত্রটা। খুলে ফেল নলগুলো—মুক্তি দাও রুদ্রশঙ্করকে! দ্রুত হাতে বন্ধ করতে গেলাম কমপিউটরকে।
সজোরে বাধা দিল দেবপ্রিয়, চেপে ধরল হাতদুটো।
—না না,—অনন্তকে জানার সুযোগ হাতছাড়া করতে দোব না তোমাকে—কিছুতেই না!
—ছাড় ছাড় আমাকে—বন্ধ কর মেশিনটা—নয়তো নয়তো মৃত্যু নিশ্চিত জেনো—দেবপ্রিয়—গোঁয়ার তুমি, বন্ধ কর এবার।
—মৃত্যু? মৃত্যু কি? কাকে বলে মৃত্যু রণেন? চিৎকার করে উঠল দেবপ্রিয়।—না না মৃত্যুই শেষ কথা নয়। জীবনের পরপারে মৃত্যু তো প্রথম পদক্ষেপ মাত্র! আর সেই অজানা রহস্যময় পরমশক্তিকেই চ্যালেঞ্জ করেছি আমরণ! মৃত্যু তো অতি নগণ্য ওর কাছে—মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে জানব ওর সত্য স্বরূপ। মৃত্যুও হার মানবে আমাদের কাছে—জীবন থেমে গেলেও এগিয়ে যাব আমরা মৃত্যুর সদর দরজা দিয়ে চির রহস্যময় জগতে পরম শক্তির খোঁজে—
—দেবপ্রিয়—প্রাকৃতিক শক্তির বিরুদ্ধে যাওয়া উচিত নয় আমাদের। তার ফলে ভারসাম্য হয়তো নষ্ট হয়ে যাবে—মহাপ্রলয়ের ধ্বংস লীলা শুরু হয়ে যাবে মুহূর্তের মধ্যে—
—ভারসাম্য? কীসের ভারসাম্য রণেন?
—জানি না—ঠিক বুঝিয়ে বলতে পারব না তোমাকে। তবে—দৃষ্টির অগোচরে রয়েছে সেই বিশাল শক্তি—আমরা রয়েছি আমাদের পার্থিব জগতের মধ্যে—এটাই কি ভারসাম্য নয়?
—না, না। মানুষ মানুষই সব—সেই পরম শক্তির চরম বিকাশ তো মানুষের মধ্যে—আত্মার তাই অজানা অগম্য কিছু নেই মানুষের কাছে। সমস্ত কিছুর জানার অধিকার আছে আমাদের।
কেমন যেন ঠান্ডা হয়ে আসছে ঘরের আবহাওয়া। শীত শীত করছে আমার। এমন তো হবার কথা নয়—উঃ দারুণ ঠান্ডা! হিমালয়ের তুঙ্গে যেন উঠে পড়েছি আমরা।
—ভুল—ভুল দেবপ্রিয়—মানুষই শেষ কথা নয়—পরমশক্তির কাছে অতি তুচ্ছ—নগণ্য আমরা—দেখ দেখ আসছে—আসছে সে—এই ঠান্ডার কারণ কি বুঝতে পারছো না দেবপ্রিয়?
বুঝেছি—সব বুঝতে পারছি। আমাদের কাছে যে আসতেই হবে ওকে—আসার জন্যেই তো ফাঁদ পেতেছি আমরা। অপ্রকৃতিস্থর মতো কেঁপে কেঁপে উঠছে ওর সমস্ত শরীর। পাগলের মতো হেসে উঠল একবার। বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল রুদ্রশঙ্করের নিষ্পলক চোখ দুটোর দিকে। প্রাণহীন আড়ষ্ট দেহটা বিবর্ণ হয়ে উঠেছে ইতিমধ্যেই।
—রণেন—বুঝেছি—বুঝেছি এবার! রুদ্রশঙ্কর কেন আমাদের ছেড়ে যেতে চায় জান? সে একাই আবিষ্কার করতে চায় অখণ্ড শক্তিকে। আবিষ্কারের আর কোনো ভাগীদার রাখতে চায় না সে!—দেখছ না—আর সে চায় না আমাদের? আর যেন আমরা ওর সহকর্মী নই—বন্ধুত্বের যেন মূল্য নেই কোনো ওর কাছে!
প্রায় শূন্য তাপাঙ্ক এখন ঘরের মধ্যে। প্রচণ্ড ঠান্ডায় আর দারুণ ভয়ে কাঁপছি আমি। আশ্চর্য—বিন্দু বিন্দু ঘাম ফুটে উঠেছে দেবপ্রিয়র সারা মুখে। অ্যাড্রিনাল গ্রন্থির দ্রুত নিঃসরণ আর উত্তেজনাই এর কারণ বুঝতে দেরি হল না আমার। কোনো ঠান্ডাই অনুভূত হচ্ছে না এখন ওর কাছে।
না—আর দেরি নয়—জানি বাধা দেবে আমাকে—তাহলেও যেমন করেই হোক বন্ধ করে দেবে কমপিউটার, খুলে নেব ইলেকট্রোড আর পাইপগুলো। খুলতেই হবে আমাকে যেমন করেই হোক।
অপার্থিব বিকট আর্তনাদে ভরে উঠল সমস্ত ঘর। থরথর করে কেঁপে উঠল কাচের জানলাগুলো। যন্ত্রের মতো তাকালাম চারপাশে। না—কেউ নেই কোনো পাশে। এ কী! রুদ্রশঙ্করের বিবর্ণ মুখের মধ্যে দিয়েই ছুটে আসছে ভয়ংকর আর্তনাদ। থর থর করে কাঁপছে ওর কালচে দুটো ঠোঁট। দারুণ আতঙ্কে বাক্যহারা আমি। ঠিক সেই মুহূর্তে নড়ে উঠল শক্ত কাঠ হয়ে যাওয়া রুদ্রশঙ্করের হাতটা।
বিস্মিত হতবাক আমরা। অবিশ্বাসও বোধহয় অবিশ্বাস করবে এমন এক অবিশ্বাস্য ঘটনায়। ডান হাতটা উপরে তুলে ধরল রুদ্রশঙ্কর। বরফের উপর থাকার জন্যে রক্তশূন্য ফ্যাকাসে সেই হাত। একটানে খুলে ফেলল রক্ত আর অক্সিজেন সরবরাহের নলদুটোকে। মাথা থেকেও খুলে ফেলল ইলেকট্রোডগুলোকে। এক ঝটকায় ফেলে দিলে বরফের বিছানাটা। চারপাশে ছিটকে পড়ল ছোটোবড়ো বরফের টুকরো। এই ভয়ংকর অবস্হায় কিংকর্তব্যবিমূঢ় আমরা। উত্তেজনায় বন্ধ হয়ে আসছে নিজেদের নিশ্বাস প্রশ্বাস। এও কি সম্ভব?
ধীরে ধীরে উঠে বসল রুদ্রশঙ্কর। বিস্ফারিত দুই চোখ পলকহীন শুকনো কালো কালো ঠোঁট দুটো নিস্তব্দ। নিথর। আওয়াজ করে উঠল অপারেশান টেবিল। বীভৎস বোজা চোখে আমাদের দিকে তাকাল রুদ্রশঙ্কর। পরক্ষণেই আবার সেই অমানুষিক ভয়াল আর্তনাদ উঠল নিথর ঠোঁট দুটোর মধ্যে দিয়ে।
সেই ভয়ংকর শক্তি প্রবেশ করেছে রুদ্রশঙ্করের মৃত দেহে। প্রতিহিংসায় উন্মত্ত হয়ে উঠবে এবার। পচনশীল পার্থিব শরীরকে আশ্রয় করে জেগে উঠেছে অপার্থিব এক দানবীয় শক্তি। রুদ্রশঙ্করের আত্মার মুক্তিই কাম্য—আর—যারা সেই মুক্তির বিলম্বের জন্য দায়ী—
উন্মাদের মতো হাসতে শুরু করল দেবপ্রিয়।
—পেয়েছি! পেয়েছি! বন্দি হয়েছে সেই নরকের কীট! হাঃ হাঃ হাঃ—
কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই দেবপ্রিয়র। একটা মৃতদেহ ধীরে ধীরে উঠে বসল অপারেশান টেবিলের উপর—আস্তে আস্তে নেমে এল টেবিল ছেড়ে মেঝের উপর। এগিয়ে আসছে আমাদের দিকে। নির্বিকার দেবপ্রিয়—ভয় শংকার কোনো চিহ্ন নেই কোনোখানে—জয়ের উল্লাসে আত্মহারা সে। যন্ত্রচালিত রোবটের মতো ধীরে ধীরে পা ফেলে পায়ে পায়ে এগিয়ে আসছে রুদ্রশঙ্করের মৃতদেহ—ধীরে ধীরে হাত তুলে ধরছে আমাদের দিকে। মাথাটা কেন যেন নড়বড় করছে—শরীরের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ সম্বন্ধে সম্পূর্ণ অনভ্যস্ত রুদ্রশঙ্কর। আনাড়ির মতো নেড়েচেড়ে দেখছে যেন হাত-পাগুলোকে।
আবার হাঁ হয়ে গেল রুদ্রর ঠোঁট দুটো। কষ্টকর শ্বাস প্রশ্বাসের শব্দ ভেসে এল যেন—কেমন যেন বিকট ঘড় ঘড় শব্দ উঠছে ভেতর থেকে—আকাশ ছোঁয়া ঘৃণা আর প্রতিশোধের উল্লাসে চিৎকার করে উঠল রুদ্র। বার বার কেঁপে উঠল সমস্ত বাড়িটা। আবার—আবার সেই চিৎকার।
পাগলের মতো হেসে চলেছে দেবপ্রিয়। সম্পূর্ণ উন্মাদ দেবপ্রিয়। দু-চোখ বেয়ে জলের ধারা নেমেছে গালের দু-পাশ দিয়ে, কষ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে সাদা ফেনা!
—বন্দি! বন্দি করেছি মৃত্যুপারের শক্তিকে। রুদ্র, রুদ্র—তুমি কি বেঁচে আছ এখনও! দেখ! দেখ অমিতধর শক্তি কেমন বন্দি হয়েছে তোমার দেহের মধ্যে। হাঃ হাঃ হাঃ!
আবার—আবার আকাশ ফাটানো আর্তনাদ করে উঠল রুদ্র। রুদ্র না রুদ্রর দেহে ভর করা বিদেহী আত্মা? কে জানে কে সে! লক্ষ লক্ষ পশুর মরণ-আর্তনাদ যেন শুনতে পাচ্ছি ওর অপার্থিব চিৎকারের মধ্যে! কি নিদারুণ যন্ত্রণায় তিলে তিলে মরণ যন্ত্রণায় জ্বলছে সেই আত্মা।
আস্তে আস্তে ঘুরতে শুরু করল বিস্ফারিত পলকহীন দুই চোখের কালো মণিদুটো! বন্বন্ করে ঘুরছে। জ্বলন্ত দুটো অঙ্গার খণ্ড যেন ওর দু-চোখে।
—এস—এস—আমার মৃত্যু পারের বন্ধন! কাছে এস আমার—ভালো করে দেখি তোমার স্বরূপকে। পাগলের মতো বকে চলেছে দেবপ্রিয়!
কলের পুতুলের মতো হাত বাড়িয়ে ধরতে চেষ্টা করল রুদ্র দেবপ্রিয়কে। একটু পাশে সরে গেল সে। অনেক কষ্টে ঘুরে দাঁড়াল রুদ্র! আবার এগিয়ে দিল হাত দুটোকে—শক্ত মড়ার মতো হাতের আঙুলগুলো কেমন যেন প্রতিহিংসায় তীক্ষ্ণ।
—কেমন! কেমন মজা। দেহটাকেও ঠিকমতো ব্যবহার করতে শেখনি এখনও। হাঃ হাঃ হাঃ! এস—এস, ধর আমাকে, হাঃ হাঃ হাঃ! টেবিলের চারপাশে ঘুরতে শুরু করল দেবপ্রিয়।—রণেন—রণেন দেখ দেখ একবার, অনন্ত শক্তি কেমন বন্দি হয়েছে রুদ্রর শরীরে। বন্দি! হাঃ হাঃ হাঃ।
আবার অমানবিক আর্তনাদ করে সামনের দিকে এগিয়ে গেল রুদ্র। একটুর জন্য লক্ষ্যভ্রষ্ট হল, পড়ে গেল টেবিলের উপর। নানান ধরনের অপারেশানের যন্ত্র ছড়ানো টেবিলের উপর। ধারালো একটা স্ক্যালপেল আমূল বিঁধে গেল ঠিক পেটের উপর। একটানে খুলে ফেলল রুদ্র স্ক্যালপেলটা। ফাঁক হয়ে রইল ক্ষত স্থান, রক্তের চিহ্ন নেই মৃতদেহে।
চারপাশে চোখ মেলে খুঁজল দেবপ্রিয়কে। চোখে পড়ল টেবিলের একপাশে রাখা বিরাট কাচের জারে লাল রক্ত, এই রক্তই বাঁচিয়ে রেখেছিল রুদ্রের মগজকে। দু-হাতে তুলে নিল জারটাকে। মাথার উপরে তুলে সজোরে ছড়ে দিল দেবপ্রিয়র দিকে। চকিতের মধ্যে সরে দাঁড়াল সে, মুহূর্তের মধ্যে মেঝের উপর আছড়ে পড়ল লাল রক্তে ভরা জারটা, কাচের টুকরো আর লাল রক্তে ভেসে গেল সমস্ত ঘর। ব্যর্থতায় ক্ষোভে মুহুর্মুহু চিৎকার করল রুদ্র। হাততালি দিয়ে নাচতে শুরু করেছে দেবপ্রিয়।
—হল না, হল না বন্ধু, আবার পারলে না। এস, এস, কাছে এস, তাড়াতাড়ি এস কাছে। মানুষ! মানুষ আমরা। তোমার মতো দেহহীন হাওয়ার মতো শক্তি নই, আর তার জন্যই বড়ো, বড়ো আমরা, হাঃ হাঃ হাঃ—
নিজের অজান্তে রক্তের উপর পা পড়ে গেল দেবপ্রিয়র। তাল সামলাতে না পেরে আছাড় খেয়ে পড়ল মেঝের উপর। ওঠার চেষ্টার সঙ্গে সঙ্গে আবার পড়ল হুমড়ি খেয়ে। সেই সুযোগে ঘাড়ের উপর এসে পড়ল রুদ্রর জীবন্ত মৃতদেহ। বন্বন্ করে ঘুরছে ওর নিষ্পলক চোখ দুটো।
ধস্তাধস্তি শুরু হল উন্মাদ দেবপ্রিয় আর জীবন্ত মৃতদেহের। রক্ত স্রোতের মধ্যে শব্দ হল জীবনপণ খেলা। ভাঙা কাচের টুকরোয় ক্ষত-বিক্ষত হয়ে গেল দেবপ্রিয়র সর্বাঙ্গ। মুহূর্তের মধ্যে দেবপ্রিয়র গলাটা চেপে ধরল লোহার মতো শক্ত দু-হাত। মড়মড় করে আওয়াজ উঠল, পরক্ষণেই দেবপ্রিয়র মুণ্ডুটা উপড়ে নিল রুদ্রর মৃতদেহ, নিষ্ফল আক্রোশে অন্ধ যন্ত্রণায় ছটফট করল দেবপ্রিয়র কবন্ধ দেহটা। রক্ত-ভেজা ওপড়ানো মুণ্ডুটা চোখের সামনে তুলে ধরল রুদ্র, পরক্ষণেই অমানুষিক চিৎকারে ভরে উঠল আকাশ-বাতাস। কিছু বোঝার আগেই দেবপ্রিয়র মুণ্ডুটা ছুড়ে মারল রুদ্র আমার দিকে। একটুর জন্যে লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে সজোরে আঘাত করল ইলেকট্রিকের খোলা তারের উপর। চোখ-ঝলসান বিদ্যুতের সঙ্গে সঙ্গে আলোটা নিভে গেল, শর্টসার্কিটের ফলে আগুন জ্বলে উঠল ঘরের মধ্যে, লাল আগুনের মধ্যে মূর্তিমান বিভীষিকার মতো আমার দিকে ধেয়ে এল মৃতদেহটা, সামনের দরজা দিয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়লাম এবার—দাউদাউ করে জ্বলছে বাড়িটা—
হাসপাতালে জ্ঞান ফিরল আমার সাতদিন পরে। শুনলাম রুদ্রর বাড়ির আগুন নিভিয়েছে দমকলের পাঁচটা গাড়ি। আর পাওয়া গেছে আধপোড়া দুটো মৃতদেহ। হ্যাঁ, দুটো, ভালো করে খোঁজ নিলাম—তিনটে নয়, মাত্র দুটো মৃতদেহ পেয়েছে পুলিস, তাহলে কোথায় গেল রুদ্রর সেই জীবন্ত মৃতদেহ? প্রতিহিংসায় উন্মাদ দানোয় পাওয়া মড়া? আমাকে যে খুঁজে বার করবেই সে। যেখান থেকেই হোক—পালিয়ে বেড়াচ্ছি আজ কত বছর? না, না, সময়, বছর কিছু মনে নেই। বছরখানেক বোধহয় নিশ্চিন্ত ছিলাম। তারপর—ভীষণ ভিড়ের বাস, রড ধরে দাঁড়িয়ে আছি কোনোরকমে, ঠান্ডায় শির শির করছে সর্বাঙ্গ—পাশের ভদ্রলোকের রড-ধরা হাতের উপর হাত পড়ল হঠাৎ, বরফের মতো হিমশীতল, চকিতে তাকালাম, কালো ওভারকোটে ঢাকা সর্বাঙ্গ। কালো মাফলারে ঢাকা পড়ে গেছে চোখ-মুখ, সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত রক্ত জমে যেন বরফ হয়ে গেল আমার। জ্বলন্ত ভাঁটার মতো দপ্দপ্ করছে চোখ দুটো, না, না, বিশ্ব দুনিয়ায় সব ভুললেও ওই মুখ-চোখ কি ভুলতে পারব কোনো দিনও। মড়ার চোখ—রুদ্রর মড়া, দানোয় পাওয়া—পড়ি কি মরি করে ঝাঁপ দিলাম চলন্ত বাস থেকে, পালাতে হবে, পালাতে হবে—দূরে, অনেক দূরে, মুক্তি চাই আমার জীবন্ত পিশাচের হাত থেকে। আর কোনো পথ নেই—মৃত্যু! মৃত্যুই মুক্তির পথ—মরতে আমাকে হবেই, হে ভগবান মৃত্যু দাও—মৃত্যু দাও আমাকে—
Tags: অষ্টম বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা, রণেন ঘোষ