ব্যোমকেশ বক্সী বৈজ্ঞানিক ছিলেন না
লেখক: প্রসেনজিৎ দাশগুপ্ত
শিল্পী: টিম কল্পবিশ্ব
লন্ডন শহরের বিখ্যাত কনসাল্টিং ডিটেকটিভ শার্লক হোমস সাহেবের সঙ্গে কলকাতার ব্যোমকেশ বক্সীর আলগা সাদৃশ্য যতই থাকুক হোমস সাহেবের মতো বৈজ্ঞানিক ছিলেন না বক্সীবাবু। ল্যাবরেটরিতে রীতিমতো গবেষণায় মেতে থাকতেন হোমস। রক্ত নিয়ে, চুরুটের ছাই নিয়ে এবং আরও অনেক বিজ্ঞান সংক্রান্ত বিষয়ে তাঁর লেখা পণ্ডিতমহলে যথেষ্ট সমাদৃত হয়েছে। বস্তুত, হোমসের জীবনীকার এবং ঘনিষ্ঠ বন্ধু ডক্টর ওয়াটসনের সঙ্গে হোমসের প্রথম সাক্ষাৎই ঘটেছিল এক বীক্ষণাগারে। ব্যোমকেশ বক্সীর পূর্বজ, সমসাময়িক বা তাঁর পরবর্তী সময়ে এই কলকাতা শহরেই এমন কয়েকজন গোয়েন্দাকে দেখা গিয়েছে যারা বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক পরীক্ষানিরীক্ষা নিজেরাই শুধু করতেন না, তাঁদের বাড়িতে নিজস্ব ল্যাবরেটরি পর্যন্ত তৈরি করে নিয়েছিলেন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, জয়ন্তবাবু এবং দীপকবাবুর নাম।
যে ব্যক্তির মাধ্যমে ডিটেকটিভ জয়ন্তর কীর্তিকলাপ সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রচারিত হয়েছিল সেই ভদ্রলোক, হেমেন্দ্রকুমার রায়, বলেই দিয়েছিলেন বিদেশে যে বৈজ্ঞানিক গবেষণায় যখন যেমন বিশেষ অগ্রগতি ঘটছে, জয়ন্ত নাকি প্রতিনিয়ত সেসবের খবর রাখতেন এবং নিয়মিত সেগুলি নিয়ে চর্চা করতেন। জয়ন্তবাবুর মতো দীপক চ্যাটার্জির ভবানীপুরের বাড়িতেও একখানা ব্যক্তিগত ল্যাবরেটরি ছিল। তদন্তের জন্য দরকারি কেমিক্যাল অ্যানালিসিস তিনি সেখানেই সেরে নিতেন। আবার খুব জরুরি কাজ হাতে কিছু না থাকলে সময় কাটাতেন ওই ল্যাবরেটরিতেই নানারকম পরীক্ষানিরীক্ষা করে।
ব্যোমকেশ বক্সীর এমন কোনো ল্যাবরেটরি ছিল না। তিনি সাধারণ মধ্যবিত্ত ভদ্রলোক। জয়ন্ত বা দীপকের মতো অতুল ঐশ্বর্যের উত্তরাধিকারী বা মালিক নন। হয়তো শখ ছিল ব্যোমকেশের। সামর্থ হয়নি। পশার সর্বদা সমান চলত না। একবার তো, ঠাট্টাচ্ছলে হলেও, ছাগল চরানোর কথাও ভাবতে হয়েছিল।
যতটুকু আন্দাজ পাওয়া যায়, তাতে বোঝা যায় বিজ্ঞানের ছাত্র ছিলেন ব্যোমকেশ। সেবার ‘দুর্গ রহস্য’র ঘটনায় চোর-কুঠুরির মধ্যে যে সাদা গুঁড়ো পাওয়া গিয়েছিল, সেগুলি কিন্তু পুলিশের কর্তা পাণ্ডেজির হাতেই ব্যোমকেশ তুলে দিয়েছিলেন। কেমিক্যাল অ্যানালিসিস করে বস্তুটি কী, তা জানার জন্য। কে বলতে পারে, এই মামলায় জয়ন্ত বা দীপক চ্যাটার্জির মতো কেউ থাকলে সাদা গুঁড়োগুলো হাতে নিয়ে হয়তো দু-একবার শুঁকেই তাঁরা বলে দিতেন, এগুলো সোহাগা। আর বৈজ্ঞানিক বুদ্ধি খাটিয়ে রাজারাম যে মোহরগুলি গলিয়ে সোনার তাল বানিয়ে লুকিয়ে রেখেছিলেন, সেই রহস্য তখনই গোয়েন্দা বুঝে যেতেন।
‘রক্তমুখী নীলা’র ঘটনায় মহারাজ রমেন্দ্র সিংহের সেক্রেটারি হরিপদ গলায় যেভাবে পকেট তৈরি করেছিল, তার উপায় বা পদ্ধতি সম্পূর্ণ বৈজ্ঞানিক। একই সঙ্গে শারীরবিদ্যা এবং রসায়নবিদ্যা এর সঙ্গে জড়িত। হয়তো কোনো বিজ্ঞানীই গলার ভিতরে পকেট বানানোর পদ্ধতিখানা আবিষ্কার করেছিলেন। তবে হরিপদর গলায় পকেট থাকা আর তার ভিতর নীলা লুকিয়ে রাখার ব্যাপারটা আন্দাজ করতে ব্যোমকেশ বক্সীর বিজ্ঞানী হওয়ার প্রয়োজন ছিল না। ব্যাপারখানা সম্ভবত তিনি জানতেন অপরাধ জগতের সঙ্গে যোগাযোগ থাকার অভিজ্ঞতায়।
এই অভিজ্ঞতাই হয়তো ব্যোমকেশকে বুঝতে সাহায্য করেছিল সদানন্দ সুরের মৃত্যুর কারণ এবং অপরাধীর মোডাস অপারেন্ডি। হ্যান্ড গ্রেনেড ব্যবহার করে ‘বুবি-ট্র্যাপ’ বানাতে যথেষ্ট বুদ্ধির প্রয়োজন। আর পুরো ব্যাপারটির মধ্যে নিহিত আছে কিছু বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব। যাকে মারতে চাওয়া হচ্ছে, সে যেইমাত্র দরজা খুলবে বা দরজার ওপারে পদার্পণ করবে, গ্রেনেড ফাটবে প্রায় তৎক্ষণাৎ। গ্রেনেডটি যথাস্থানে স্থাপন, তার পিনে টান পড়ার যান্ত্রিক ব্যবস্থা, আর সর্বোপরি নিখুঁত কালসাম্য, যাকে বলে টাইমিং, করতে হয়েছিল খুনিকে। ‘অমৃতের মৃত্যু’র ঘটনার সঙ্গে জড়িতে সেই খুনির বিজ্ঞান-বুদ্ধির তারিফ করতেই হয়।
সদানন্দের খুনির বুদ্ধি আর বিজ্ঞানের প্রয়োগ ক্ষমতার সঙ্গে তুলনা চলে না অভয় ঘোষালকে যে ব্যক্তি হত্যা করেছিল তার দোসরটির বুদ্ধির। কারণ, ‘দুষ্টচক্র’র অন্যতম সদস্য সুরেশ রক্ষিত নিজেই ছিল ডাক্তার। তাই ‘প্রোকেন’ জাতীয় ‘অ্যানাস্থেশিয়া’র ওষুধের খবর জানতে আলাদা কৃতিত্বের দরকার ছিল না। এক্ষেত্রে বরং দুষ্টচক্রের শয়তানি ধরে ফেলায় আন্দাজ পাওয়া যায় ব্যোমকেশ বক্সীর অগাধ অনুসন্ধিৎসার। চিকিৎসা বিজ্ঞানের অগ্রগতির খবরাখবরের প্রতি নিত্য নজর না রাখলে ব্যোমকেশের পক্ষে কখনোই সম্ভব হত না ওই বিশেষ গোত্রের ওষুধ আর তার ব্যবহার সম্পর্কে অবহিত থাকার। বিশু পালকে পুলিশের ডাক্তার দিয়ে পরীক্ষা করিয়ে বাড়ি ফিরে আসার পর সারা দুপুর ব্যোমকেশ যখন উদভ্রান্ত চোখে কড়িকাঠের দিকে তাকিয়ে তক্তাপোশে পড়ে রইলেন আর একের পর এক সিগারেট ধ্বংস করলেন, তখন যে তাঁর মনের মধ্যে অভয় ঘোষালের খুনের পটভূমি ছাড়াও তাঁর আয়ত্ব করা নিজস্ব জ্ঞানের উথাল-পাথাল পর্যালোচনা চলছিল, তা তো বোঝাই গেল। তার সঙ্গে মনে হল, যে মানুষ চিকিৎসা বিজ্ঞানের খবরাখবরে আগ্রহী তিনি বিজ্ঞানের অন্য প্রতিটি শাখার খবর রাখবেন না, তা হতেই পারে না। ব্যোমকেশ বক্সী নিজে হয়তো বৈজ্ঞানিক ছিলেন না, তবে বিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহ কিছু কম ছিল না তাঁর। ছিল না শুধু সাধ্য। থাকলে তিনিও বাড়িতে ছোটোখাটো একটি ল্যাবরেটরি অবশ্যই বানাতেন।
রামেশ্বরবাবুর উইল-এর ব্যাপারে রহস্যভেদের মূলে ছিল ব্যোমকেশের এই বিজ্ঞান-বুদ্ধি আর বিজ্ঞানের অতি সরল অথচ চমকপ্রদ ব্যাপারগুলি জেনে রাখার আতিশয্য। পেঁয়াজের রস দিয়ে কাগজে লিখে পরে সেই কাগজে তাপ দিলে লেখা ফুটে ওঠা সাধারণের দৃষ্টিতে ম্যাজিশিয়ানদের খেলা হলেও এর ভিত্তি হল অতি সরল বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব। চিঠির রহস্য কী হতে পারে, সেই নিয়ে রহস্য যখন জমে উঠেছে তখন পেঁয়াজের গন্ধে ব্যোমকেশের মগজের ধূসর কোশ থেকে উঠে এসেছিল এই বিশেষ তত্ত্বখানা।
‘অগ্নিবাণ’ বানিয়েছিলেন দেবকুমারবাবু। তিনি ছিলেন খ্যাতনামা বিজ্ঞান গবেষক। তিনি যে মারণাস্ত্রটি তৈরি করেছিলেন, তার একটির দাম সে যুগে অর্থাৎ দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের আগেই পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত উঠেছিল। সেই কারবার অবশ্য চোরাবাজারে। কারণ ওই দেশলাই কাঠি, যার ধোঁয়ায় এমন বিষ যে শ্বাসের সঙ্গে শরীরে তার সামান্য প্রবেশ করলে তৎক্ষণাৎ মৃত্যু ঘটবে, তার বিক্রি খোলা বাজারে সম্ভব ছিল না। দেবকুমারবাবুর ওই আবিষ্কার পরে কখনও এদেশে বা অন্য দেশে কোনো রাষ্ট্রের বা ব্যক্তির বা সংস্থার উদ্যোগে নির্মিত হয়েছে বলে জানা যায় না।
এই প্রসঙ্গে আরও অনুমান করা যায়, দেবকুমার সরকার তাঁর আবিষ্কারের ফরমুলা কাউকে জানাননি। এমনকি দেশের সরকারকেও না। তিনি যে ব্যক্তিগত প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে ওই দেশলাই কাঠিগুলো তৈরি করেছিলেন সেকথা সহজবোধ্য। তা ছাড়া পয়সা রোজগারের একটা ‘মোটিভ’ বা ‘অ্যাজেন্ডা’ও ছিল। অথচ তিনি চাননি তাঁর আবিষ্কার ভুল লোকের হাতে গিয়ে পড়ুক।
অজিত বন্দোপাধ্যায়ের লেখা ব্যোমকেশের কীর্তিকলাপ পড়ে কেউ হয়তো দেবকুমার সরকারের আবিষ্কারকে কল্প-কাহিনি বলে উড়িয়ে দেবেন। বিশেষ করে অজিতের লেখা ‘শূন্য শুধু শূন্য নয়’ গল্পখানা পড়ার পর তো বটেই। অজিত বন্দোপাধ্যায় কল্পবিজ্ঞান কাহিনি লেখেননি বললেই চলে। কিন্তু ভূতের গল্প বা অলৌকিক কাহিনি প্রচুর লিখেছেন। কিন্তু ওই বিশেষ গল্পটিকে অলৌকিক কাহিনি বলা যাবে না। বলা যাবে না এই কারণে যে, কাহিনির নায়িকার অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার কারণ ছিল একটি বজ্রাঘাত। এই ধরনের কাহিনি যাঁরা পড়েন, তাঁরা জানবেন সুইস বিজ্ঞানী ডক্টর ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনের বিখ্যাত গবেষণায় বজ্রাঘাতে উৎপন্ন বিদ্যুৎ ব্যবহার করে একটি অসম্ভবকে সম্ভব করা গিয়েছিল। অজিতের গল্পের নায়িকা হয়তো প্রাকৃতিক কোনো বিপর্যয়ের অভিঘাতে অদৃশ্য হয়ে যায়। একে সায়েন্স ফিকশন না হলেও সায়েন্স ফ্যান্টাসি গণ্য না করার কারণ থাকতে পারে না।
যে দেশলাই কাঠি দেবকুমার সরকার একান্ত নিজস্ব এবং ব্যক্তিগত প্রয়োজনে তৈরি করেছিলেন তার ফরমুলা কেউ জানতে পারেনি। তিনি অনিচ্ছাকৃত খুনের দায়ে ধরা পড়ার পর বাজেয়াপ্ত কাঠিগুলি সরকারি বা পুলিশের হেফাজত থেকে চুরি যায়। সেগুলি পুনরুদ্ধার করা গিয়েছিল ব্যোমকেশ বক্সীর কৃতিত্বে এবং তৎপরতায়, আর খানিকটা পুঁটিরামের প্রত্যুৎপন্নমতিত্বে। এমন আশা করা অন্যায় যে কাঠিগুলি পুনরুদ্ধারের পর এদেশের তৎকালীন ইংরেজ শাসকের তরফে ওই কাঠিগুলির রাসায়নিক বিশ্লেষণ করা হবে না। তবে যেহেতু সেই বিষয়ে আর কোনো খবর পাওয়া যায়নি বা ওই ধরনের দেশলাইয়ের ধোঁয়ায় মৃত্যুর খবর আর যেহেতু আসেনি, তাই অনুমান করা যায় সরকারি তরফে বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা দেবকুমারবাবুর আবিষ্কারের রহস্য ভেদ করতে পারেননি। পারলে নিশ্চয়ই কয়েক বছরের মধ্যে শুরু হওয়া দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে এই অগ্নিবাণ ব্যবহার করা হত। দেবকুমারবাবুর গবেষণালব্ধ আবিষ্কার অন্য বিজ্ঞানীরা বুঝতে পারেনি বলেই এই ফরমুলাটি অজিতের কল্পনা ভেবে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
আর তেমনই যদি কেউ ভাবে তাহলে তো পেশাদার খুনিতে পরিণত হতে বাধ্য হওয়া যে লোকটি নিজেকে প্রফুল্ল রায় নামে পরিচয় দিয়েছিল, তার আবিষ্কারটিও কল্পবিজ্ঞান বা সায়েন্স ফ্যান্টাসি বলে উড়িয়ে দিতে হয়। প্রফুল্ল রায় হয়তো লোকটির আসল নাম নয়। তবে তার আবিষ্কারে ভেজাল ছিল না। সাইকেলের ঘণ্টিকে সে পরিণত করেছিল একটি মেকানিক্যাল বন্দুকে। তবে তার থেকে বুলেট নয়, তীব্র গতিতে ছুটে যেত একটি গ্রামোফোনের পিন। তীক্ষ্ণ অগ্রভাগযুক্ত সেই পিন বিদ্ধ হত শিকারের হৃৎপিণ্ডে। মানুষটির মৃত্যু ঘটত মুহূর্তের মধ্যে। পরে ঘণ্টিখানা হাতে নিয়ে জিনিসটির কার্যপ্রণালী আর ব্যবহার অজিতকে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন ব্যোমকেশ।
আর খুশি হয়েছিলেন প্রফুল্ল রায় পুলিশের হাতে ধরা না দিয়ে আত্মহত্যা করতে সক্ষম হওয়ায়। ব্যোমকেশের মনে হয়েছিল প্রফুল্ল রায়ের মতো আর্টিস্ট-এর সাধারণ খুনির মতো ফাঁসি যাওয়া মোটেই ভালো ব্যাপার হত না। বৈজ্ঞানিক ছিলেন না ব্যোমকেশ বক্সী। কিন্তু বিজ্ঞানের প্রতি বা বৈজ্ঞানিকের প্রতি তাঁর অগাধ শ্রদ্ধা আর বিজ্ঞানের প্রতি তাঁর দুর্নিবার আকর্ষণ ‘পথের কাঁটা’র ঘটনাপ্রবাহের শেষের এই ছোটো সংলাপেই বোঝা যায়।
Tags: অষ্টম বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা, প্রসেনজিৎ দাশগুপ্ত