দাদুর বাক্সো
লেখক: অর্ণব গোস্বামী
শিল্পী: টিম কল্পবিশ্ব
দাদু যে দুটি জিনিস অর্কর জিম্মায় রেখে গেলেন, সে দুটি নিয়েই মহাসমস্যায় পড়েছে সে। দাদু মানে, বাবার দূর সম্পর্কের অকৃতদার কাকা, যদিও সম্পর্ক দেখে দূরত্ব বোঝা দুষ্কর। আর সে কারণেই শেষ বয়েসটুকু এ বাড়িতে কাটিয়ে গেলেন তিনি, কারও কোনোরকম অমত ছাড়াই।
প্রথমটা একখানা বাক্সো, যেটা প্রায় খালিই বলা যায়। এই বাক্সোটা যখন বানিয়েছিলেন, তখন বলেছিলেন, বাক্সোটা দেখে যেরকম মনে হয়, তার চেয়ে নাকি অনেক বেশি জিনিস ধরে ওতে। পারিবারিক ডেমো দিয়েছিলেন প্রবাসী দাদু, ভিডিয়ো কলে।
ফ্লাইটের চেক-ইন লাগেজের সাইজ়ে একটা স্ট্রলি। একের পর এক জিনিস বার করে দেখাচ্ছিলেন তিনি। জিনিসের বহর দেখে চক্ষু চড়কগাছ। দাদু বলেছিলেন, ফ্লাইটে ২৩ কেজি অ্যালাউ করলেও, এ বাক্সে আনা যাবে চারটে অন্য বাক্সের সমান জিনিস।
সুপার-ওয়েটলেস বক্স। সঠিক নাম বটে। যে-কোনো জিনিসের ওজন নাকি বাক্সের ভিতর হয়ে যায় চার ভাগের এক ভাগ। পরের বার প্রথম যখন দাদু কলকাতায় আসেন প্রতিবছরের মতন, তখন সবাই ভেবেছিল, দাদু ওটা সঙ্গে নিয়ে আসবেন। কিন্তু দাদু বলেছিলেন, দরকার না পড়লে মিসইউজ় করে লাভ কী?
দাদুর শেষকৃত্য সম্পন্ন হবার দু-দিন পর বাক্সোটা খুলে খানিক অবাকই হল অর্ক। এত বড়ো বাক্সে কেবল একটা বিকট সাইজ়ের ক্যামেরা আর দুটো পাউচ। একটা পাউচে রয়েছে বেশ কিছু ফোটো, বোধহয় এই ক্যামেরা দিয়েই তোলা। ক্যামেরার উপর এনগ্রস করে লেখা T.C.-এর অর্থ সহজবোধ্য। দাদুর নাম তপন চৌধুরীর শর্ট ফর্ম নিশ্চয়ই। যদিও অর্ক এতে খানিক অবাক হয়েছে। বাক্সোটার উপর কিন্তু দাদুর নামের আদ্যাক্ষর না লিখে লেখা রয়েছে S.W.L.B. অর্থাৎ Super Weightless Box, ক্যামেরার ক্ষেত্রে কি দাদু এতটাই খুশি হলেন যে নিজের নাম লিখে ফেললেন? কী এমন আছে ওই ক্যামেরায়?
পাউচ খুলে দেখা গেল, ছবির সংখ্যা তিরিশ কি চল্লিশ হবে। দু-একটা ছবি দেখে আবার সেগুলো ঢুকিয়ে রেখেছিল অর্ক। ফোটোগ্রাফির প্রতি অর্কর যে আগ্রহ নেই তা নয়। কিন্তু এই ছবিগুলো অতি সাধারণ। কয়েকটা রাস্তা, বাড়ি, সেখানে দু-একটা অচেনা মানুষ। এইসব ছবি দাদু কেন তুলেছেন, বোঝবার উপায় নেই। হয়তো ক্যামেরার টেস্টিং। কিন্তু যত্ন করে রেখে দিয়েছেন কেন? আবেগ বোধহয়।
অন্য পাউচটায় চোখ রেখে চমকে গিয়েছিল অর্ক। কয়েকটা ক্যামেরার ফিল্ম। কিন্তু ফিল্মগুলো খয়েরি নয়, সবুজ রঙের। আজকের দিনে ডিজিটাল ক্যামেরা না বানিয়ে এরকম পুরোনো আমলের ক্যামেরা কেন বানাল দাদু? ক্যামেরাটা হাতে নিয়ে খচখচ করে ঘরের এখান-ওখান থেকে দু-তিনখানা ছবি তুলল অর্ক।
ছবি তুললেই ফ্ল্যাশের আওয়াজ হচ্ছে, কিন্তু কোনো আলো বেরোচ্ছে না। হতে পারে ফ্ল্যাশটা খারাপ। ক-টা ছবি তোলা বাকি এই ফিল্মে, সেটা ডিসপ্লে হচ্ছে একটা ছোট্ট খোপে। আরও ষোলোটা বাকি। তারপর ওয়াশ করাতে হবে। এখনও কোথাও এরকম ফিল্ম থেকে ছবি প্রিন্ট করে? খোঁজ নিয়ে দেখতে হবে। অনেকদিন তো ছবি তোলার সঙ্গে সম্পর্ক নেই।
ছবি তোলার কী শখই-না ছিল একসময় অর্কর। যাদবপুরে পড়বার সময় ফোটোগ্রাফি ক্লাবের থেকে জন্মানো আগ্রহ বেশ কিছুদিন ছিল। ফেসবুক, ইনস্টাগ্রামে ছবি পোস্ট করত প্রায়ই—লাইক-কমেন্টে মন ভরে যেত। কিন্তু একদিন হঠাৎ অনীহা তৈরি হল অর্কর। মনে হল এই যে সোশ্যাল মিডিয়া জুড়ে এত এত ফোটোগ্রাফার, এত ছবি—এগুলো কাউকে আনন্দ দেয় কি? নাকি সবাই ভালো থাকার দেখনদারির প্রতিযোগিতায় মত্ত? সবার ফোনেই ভালো ক্যামেরা। ক্যামেরার কোম্পানিগুলোর ভরাডুবি। অথচ এসব শিল্পকর্ম কার জন্য? সবাই শিল্প সৃষ্টি করতে চাইলে, শিল্পী দাম পায় না, শিল্পের অপমৃত্যু ঘটে। তখন শিল্পের মৃতদেহের উপর বসে উদ্দাম নৃত্যকে আমরা শিল্প ভাবি।
তবে এসব হয়তো কিছুটা ঈর্ষার কথাও। অর্ক অনেক প্রদর্শনীতে গিয়ে দেখেছে, শিল্পভাবনার একেবারে মৃত্যু হয়েছে ভেবে নিলে হবে না। শিল্পের কদর করার মানুষ সংখ্যালঘু হলেও আছেন। তবে কিনা তাঁদের সংখ্যালঘু হয়ে ওঠা শিল্পের দুর্দিনের ছবি তুলে ধরে। অনেকে ফোটো দিয়ে গল্প বলে। অর্ক সেটা চেষ্টা করেও পারেনি। সেটাও একটা কারণ ওর ছবি তোলা থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখার। কাঁহাতক আর শখ মেটাতে স্বঘোষিত শিল্পী হয়ে থাকা যায়? সময় বয়ে গেলে কী-ই বা আর পড়ে থাকে?
ক্যামেরার সঙ্গে সঙ্গে পাউচ দুটোকেও আবার বাক্সে ভরে রেখে দিচ্ছিল অর্ক। ঠিক তখনই কোথা থেকে ছুটে এসে ফোটোর পাউচটা ধরে টানাটানি করতে শুরু করল জিকো। ও বোধহয় জানে দাদুর শেষ স্মৃতি ওটা। তাই এমন করছে। অর্ক ওর মুখ থেকে পাউচটা ছাড়িয়ে নেবার জন্য ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, ‘ছেড়ে দে জিকো। ছিঁড়ে যাবে।’ কী বুঝল, কে জানে? পাউচটা ছেড়ে ওর পায়ে কয়েকবার মাথা ঘষল। বাক্সোটা আটকে রেখে ওর গায়ে, মাথায় হাত বুলিয়ে দিল অর্ক।
দুই
জিকোকে রুদ্ধশ্বাসে ছুটতে দেখে পড়ি কি মরি করে ওর পিছু নিল অর্ক। দাদু ওর জিম্মায় যে আপাত নিরীহ প্রাণীটি রেখে গেছেন, তাকে নিয়ে যে সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে—এ কথা ভাবেনি অর্ক। বুকের ভিতর ঢিপঢিপ করছে। আবার যদি গত বুধবারের মতো কাণ্ড হয়?
দাদু বলতেন, জিকো নাকি যে-সে কুকুর নয়। ওর বুদ্ধি অন্যান্য কুকুরের তুলনায় অনেক বেশি। তা ছাড়া জিকোর প্রখর দৃষ্টিশক্তির দু-একখানা প্রমাণ অর্কও যে পায়নি তা নয়। সামগ্রিকভাবে অর্করও কম প্রিয় নয় জিকো। তাই হয়তো মৃত্যুর সময় দাদুর শেষ কথা ছিল: ‘জিকোকে দেখিস’। তারপরেও দাদু আরও কিছু বলতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সময় বাধা দিল। কেবলমাত্র তর্জনী তুলে বাক্সোটা দেখাতে পেরেছিলেন, বলা হয়নি আর কিছুই।
জিকো স্প্যানিয়েল প্রজাতির কুকুর। প্লেনের কার্গোয় চেপে কুকুরের মৃত্যুর খবর আকছার শোনা যায়। দাদু তাই জিকোকে নিয়ে জাহাজে আমেরিকা থেকে দেশে ফিরেছিলেন। সব জাহাজে আবার কুকুর নিতে দেয় না, নিতে দিলেও সব প্রজাতির নয়। জিকোর অবশ্য জায়গা জুটে গিয়েছিল একখানা জাহাজে। প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির অধ্যাপনা ছেড়ে দাদু যখন কলকাতা ফিরে এলেন পাকাপাকিভাবে, তখন কোনো এক বিজ্ঞানী বন্ধু এই কুকুরটি উপহার দিয়েছিলেন। ছোট্ট কুকুরছানাটা এখন চার বছরের হয়েছে।
মা প্রথম প্রথম পছন্দ করত না ওকে। কিন্তু কুকুর বড়ো অদ্ভুত প্রাণী। মায়ের কোলের কাছ ঘেঁষে ঘুমোতেই ও সব থেকে ভালোবাসত। এমন করতে করতেই একদিন দেখা গেল, মা-ও ওর গায়ে-মাথায় হাত বোলাতে থাকল।
জিকোকে দেখতেও ভারী সুন্দর। সারা গায়ে সাদা নরম লোম, কোথাও কোথাও কালো ছোপ। অমন মোলায়েম লোমের উপর হাত বুলিয়ে বড়ো আরাম। স্বভাবেও শান্ত। কখনো-কখনো কাউকে দেখে চ্যাঁচামেচি করলে বাবা ওর গালে এক চড় মারে। ও তখনই কুঁইকুঁই করে বাবার পায়ে শুয়ে পড়ে নাক ঘষে, আর ল্যাজ নাড়তে থাকে।
এহেন জিকোই গত বুধবারে এক কাণ্ড করে বসল। বাড়ি থেকে বেরিয়ে ওকে নিয়ে একটু ঘোরাঘুরি করছিল অর্ক। হঠাৎ হাত ছাড়িয়ে দৌড়োতে শুরু করল সে। অর্ক ‘জিকো দাঁড়া, জিকো দাঁড়া’ বলতে বলতে ছুটল ওর পিছনে। যত জোরেই দৌড়োক-না কেন, কুকুরের সঙ্গে পাল্লা দেওয়া মোটেই সম্ভব নয়। দূর থেকেই অর্ক দেখল, জিকো গিয়ে থামল একটু দূরে দাঁড়ানো একটা গাড়ির সামনে। আরও কাছে পৌঁছে বোঝা গেল, গাড়িটা দাঁড়িয়ে রয়েছে জাহাজবাড়ির সামনে। এ পাড়ায় জাহাজবাড়ি বলে একটাই বাড়ি আছে। বাড়ির ছাদে জলের ট্যাংকটা জাহাজের ধাঁচে বানানো।
গাড়িটা একটা সেডান। রং সাদা। তার দরজা খুলে ভিতরে ঢোকার চেষ্টা করছিলেন এক ভদ্রলোক। সেই মুহূর্তে জিকো গিয়ে ওঁর প্যান্ট ধরে শুরু করেছে টানাটানি। প্যান্টের কিছুটা অংশ ছিঁড়ে জিকোর মুখে চলে এসেছে। সামনে জনতা মারমুখী। কেউ কেউ জিকোকে পাথর ছুড়তে উদ্যত।
অর্ক গিয়ে এক ঝটকায় জিকোকে কোলে তুলে নিল বটে, কিন্তু পাবলিক যেরকম মারমুখী, তাতে সে-ও যে কুকুরের মালিক হিসেবে জনতার রোষের কবলে পড়বে না, তেমন আত্মবিশ্বাস ছিল না। ঠিক তখনই একটা বাইক দাঁড় করিয়ে তা থেকে নেমে এলেন এক সাদা পোশাকের পুলিশ।
মীমাংসা হল। মালিককে বুঝিয়ে বললেন কুকুরকে সামলে রাখতে। কিছু লোক, ‘পাগলা কুকুর, ঘরে রাখা উচিত নয়’ টাইপ কমেন্ট করলেও ততক্ষণে অর্ক কুকুর নিয়ে বাড়ির পথে রওনা দিয়েছে। এরপর পুরোনো জিকোর মতনই ব্যবহার করছিল সে। কিন্তু আজ সকালে আবার এই ঘটনা।
দৌড়ে জিকোর কাছে পৌঁছোতে অর্ক দেখল সে এক কাণ্ড। বাসে উঠতে-যাওয়া এক রমণীর ওড়না টেনে ধরেছিল জিকো। অর্ক দেখল মেয়েটি তারই সমবয়সি। জিকোকে কোলে নিয়ে রাস্তার উপর কিছুটা ঝুঁকে বসে রয়েছে সে। সরে-যাওয়া দোপাট্টা যৌবনের স্রোত নামিয়েছে তার শরীর বেয়ে। সেদিকে চোখ পড়তেই অস্বস্তিতে চোখ সরিয়ে নিল অর্ক। তবু সে মেয়ে জামাটা দ্রুতহাতে ঠিক করে নিতে অর্কর মনে হল, ইশ্! ও বোধহয় ভেবেছে, অর্ক ওর দিকে অসভ্যের মতো তাকিয়ে ছিল। ভীষণ অপ্রস্তুত লাগছে। তবু অর্ক ওর মুখ ছেড়ে নিজের চোখ দুটো সরাতে পারছিল না, এমন সৌন্দর্য যে গল্প-উপন্যাস পড়ার সময় কল্পনাতেই কেবল সম্ভব।
মেয়েলি গলার শব্দে ঘোর ভাঙল যেন অর্কর, ‘শুনছেন?’
‘হুম, আই অ্যাম ভেরি সরি, হঠাৎ হাত ছাড়িয়ে জিকো…’ কোনোরকমে বলল সে। মেয়েটি যে কখন উঠে দাঁড়িয়েছে, সে খেয়ালও হয়নি অর্কর। জিকো এখন দিব্যি আদর খাচ্ছে মেয়েটির কোলে চেপে। ‘আপনার বাসটা ছেড়ে গেল যে!’ হড়বড় করে বলল অর্ক।
‘যেতে দিন। ওর নাম জিকো? খুব মিষ্টি কুকুর আপনার।’ আবার জিকোর মাথায় একটু আদর করে মেয়েটি বলল, ‘আপনার সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে। আজ একটু তাড়া আছে। অফিসে দেরি হয়ে যাচ্ছে। উবার ডাকলাম। দু-মিনিটে আসবে, বলল। কিছু যদি মনে না করেন, আপনার বাড়ির ঠিকানাটা বলবেন? আমি আপনার সময়মতো কোনো একদিন আসব।’
ওর কথায় যে অর্কর মনে এখন উল্লাসের বাঁধ ভেঙেছে। তবু নিজেকে যতটা পারল, সংযত রেখে নিজের বাড়ির ঠিকানাটা বলতেই আবার আরেকটা প্রশ্ন ভেসে এল, ‘আর ফোন নম্বর?’
অর্ক ফোন নম্বর বলতেই সে বলল, ‘আমার নাম মেঘ। আপনাকে ফোন করে জেনে নেব, কবে ফাঁকা আছেন। আপনার বাড়ির ঠিকানা তো জানাই রইল। সেখানেও আসতে পারি, আপনি না চাইলে বাইরেও কোথাও দেখা করতে পারি। কিন্তু তাড়াতাড়ি হলেই ভালো হয়।’ জিকোকে কোল থেকে নামিয়ে মেঘ বলল, ‘আমার গাড়িটা এসে গেছে।’
তড়িঘড়ি গাড়িতে উঠেই মেঘ জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে বলল, ‘আপনার নামটাই তো জানা হল না।’
‘অর্ক’—একটু জোরেই উত্তর দিল অর্ক, যাতে গাড়িটা যতই জোরে চলতে শুরু করুক, কথাটা যেন মেঘের কানে পৌঁছোয়। অর্কর হঠাৎ একটা জিনিস খেয়াল হল, মেয়েটা ওর ফোন নাম্বার নিজের ফোনে সেভ করল না, ঠিকানাটাও কোথাও নোট করল না, মনে থাকবে? কে জানে, হয়তো গাড়িতে উঠে নোট করে নেবে?
আকাশে তখন মেঘ-রোদ্দুর খেলা। জিকোর গায়ে-মাথায় অন্যমনস্ক হাত বোলাতে বোলাতে বাড়ির দিকে হাঁটল অর্ক। অন্যান্য দিনের মতো জিকোর আজব ব্যবহার, বা অফিসের দেরি হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা নয়, তার ভাবনার দখল নিয়েছে হঠাৎ-দেখা একটা মুখ।
তিন
মেয়েটি সত্যিই দেখা করল অর্কর সঙ্গে। কাছাকাছি একটা কফি শপে। পরের দিনই ফোন করে জানতে চেয়েছিল, কবে অর্কর সময় হবে। শনিবার দুপুরে শুভক্ষণ স্থির হল। এই নতুন-হওয়া কফি শপে দুপুরের দিকটা তেমন ভিড় হয় না। নিরিবিলিতে কথা বলা যাবে, ভেবেই অর্ক এখানে আসার কথা বলল। মেঘ এককথায় রাজি হয়ে গেল। এর মাঝেও অবশ্য একদিন দেখা হয়েছিল দুজনের, তবে অমন দেখা না হলেই ভালো হত।
সেদিন অটো থেকে সাত-পাঁচ না ভেবেই দুম করে মাঝপথে নেমে পড়েছিল অর্ক। এমন বৃষ্টির মধ্যে অমন করে নামতে চাওয়ায় অবাক হয়ে তাকিয়ে পচাত করে ব্রেক কষে অটো থামিয়ে দিলেন ড্রাইভার।
বৃষ্টির মধ্যে নেমে বন্ধ দোকানটার দিকে এগোতে লাগল অর্ক দৌড়ে দৌড়ে। মাথাটা কিছুটা বৃষ্টি থেকে বাঁচাতে হাতের ফাইলটা ছাতার মতো ধরেছে সে। বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় বৃষ্টি ছিল না। হঠাৎ অটোতে উঠেই দেখা মিলল ফোঁটা ফোঁটা মুক্তধারার, তারপর মাঝারি গতিতে। আর এর মাঝেই বন্ধ দোকানের শেডে অনেক লোকের মাঝে সেদিনের দেখা চেহারাটা চিনতে বিন্দুমাত্র ভুল হয়নি অর্কর।
অর্ক দ্রুতগতিতে গিয়ে মেঘকে চমকে দেবে ভাবতে-না ভাবতেই বিপত্তি। আরেকটি ছেলে ছাতা নিয়ে এসে হাজির। মেঘ হাসিমুখে দোকানের শেডের থেকে নেমে ছাতার তলায় চলে এল। দুজনে ওরা একই ছাতায়। ছেলেটি নিজের হাত দিয়ে মেঘের কাঁধটা ধরল।
এরপর আর ওখানে থেকেই বা কী লাভ? অর্ক পিছন ফিরে হাঁটতে শুরু করেছিল। আর তখনই গলাটা ভেসে এল, ‘অর্কবাবু না?’
ফিরে তাকাল অর্ক। নির্লজ্জ ছেলেটা এখনও তেমনি ছুঁয়ে আছে মেঘের কাঁধ। মেঘ বলল, ‘এদিকে কী মনে করে?’
‘একটা কাজে এসেছিলাম।’ ফ্যাকাশে মুখে উত্তর দিল অর্ক।
‘এ আমার বন্ধু অঙ্কিত। অঙ্কিত, তোকে সেদিন যার কুকুরের কথা বলছিলাম, মনে আছে? ইনিই সেই অর্কবাবু।’
মেঘের কথা শুনে হাতটা ওর কাঁধ থেকে নামাল অঙ্কিত, উদ্দেশ্য হয়তো করমর্দন। কিন্তু ওই হাত ছুঁতে ইচ্ছে করছিল না অর্কর। সামনে এখন একটা অচেনা বাস। অর্ক দুম করে বলল, ‘আমার বাস এসে গেছে। আমি চলি।’ পালিয়ে বেরুটের বাসে উঠে পড়ল। তারপর ফাঁকা বাসে জানলার ধারে বসে মন-খারাপের বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে রইল।
অতএব আজ কফি শপে যাওয়া নিয়ে তেমন উত্তেজনার কারণ নেই। তবু সকাল থেকে একটা অদ্ভুত ছটফটানি অর্কর মনকে আনন্দে ভরিয়ে রাখল। অন্তত খানিকটা সময় তো একা কাটবে মেঘের মুখের দিকে চেয়ে? কী এমন বলতে চায় ওকে মেঘ? এক মুহূর্তের দেখাতেই কী এমন দরকার পড়ল?
অর্ক ধরেই নিয়েছিল, বাঙালি যখন, খানিক দেরিতেই আসবে মেঘ। কিন্তু আজকাল অনেক ক্ষেত্রেই দেখেছে, বাঙালির এহেন বদনাম ধোপে টেকে না। এক্ষেত্রেও হল তা-ই। সময়ের পাঁচ মিনিট পরে কফি শপে ঢুকে অর্ক দেখল, একটা টেবিল নিয়ে বসে মেঘ মেনু কার্ড নেড়েচেড়ে দেখছে। ওর সামনে যাবার পথেই মুখ তুলে তাকাল মেঘ। অর্ক থতোমতো খেয়ে বলল, ‘সরি, একটু লেট হয়ে গেল।’
‘আরে না না, লেট কোথায়? বসুন। আমি ভাবছিলাম, একটা এস্প্রেসো অর্ডার করব, মিডনাইট ব্লেন্ড একটা আছে, দেখলাম। সেটা আপনার?’
‘আমি একটা ক্যাপুচিনো নেব।’
অর্ক অর্ডার করে এসে বসল। দুজনেই কিছুক্ষণ চুপচাপ। মেঘ মেনুটা পাশে রেখে কিছু বলবে বলে মুখ খুলতেই অর্ক বলে উঠল, ‘ব্ল্যাক কফি আমি একেবারে খেতে পারি না। তেতো লাগে। মিডনাইট ব্লেন্ড তো আরও কড়া নিশ্চয়ই?’
‘একবার টেস্ট গ্রো করে গেলে দেখবেন দারুণ আমেজ। আমি নাইট ডিউটি করেছি। তারপর এখনও শোয়া হয়নি। একটা বিশেষ কাজে পার্ক স্ট্রিট যেতে হয়েছিল। তাই নিজেকে জাগিয়ে রাখার এর চেয়ে ভালো উপায় আর নেই।’
‘সে কী, আগে বলবেন তো, অন্য কোনো সময় আসা যেত?’
‘না না, তার কোনো দরকার নেই। আমার অভ্যেস আছে।’ হাসল মেঘ।
মেঘ হাসলে সামনের দুটো গজদাঁত উঁকি মারে। এমন হাসি দেখার জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বসে থাকতে পারবে অর্ক।
‘কী ভাবছেন? কেন এমন জরুরি তলব করলাম?’ মেঘ নিজেই আবার বলতে শুরু করল, ‘আপনার কখনও মনে হয়নি যে জিকোর কোনো বিশেষ ক্ষমতা আছে?’
‘ক্ষমতা, কেন বলুন তো?’
‘পরেশকাকুকে তাড়া করে গিয়েছিল যেদিন, সেদিন রাতেই মনে হয়েছিল।’
‘পরেশকাকু মানে?’
‘জাহাজবাড়ির সামনে গত বুধবারে যাকে তেড়ে গিয়েছিল জিকো।’
‘আপনি ওঁকে চেনেন? আপনি ঘটনার সময় ওখানে ছিলেন?’
‘হুম, চিনি বই-কি, উনি আমার বাবার দূর সম্পর্কের ভাই। জাহাজবাড়ি আমার মাসির বাড়ি। ওখানে সেদিন একটা গেট টুগেদার ছিল। আমি জানলার কাছ থেকে ঘটনাটা দেখছিলাম।’
‘ও, তা-ই নাকি?’
‘ইয়েস। এবার আমার প্রশ্নটার উত্তর দিন?’
‘কোন প্রশ্ন?’
‘ওই যে জিকোর কোনো বিশেষ ক্ষমতা আছে কি না?’
‘কীরকম ক্ষমতার কথা বলছেন, বলুন তো?’
‘একাধিক। যেমন ওর প্রখর দৃষ্টিশক্তি। সেদিন অতদূর থেকে আমার কাছে যে ছুটে এল, আপনি কি আমার মুখ দেখতে পাচ্ছিলেন সমান দূর থেকে?’
অর্ক মনে মনে ভাবল, দেখলেও কি আর চিনতে পারতাম? মুখে বলল, ‘আপনার কি মনে হয়, আপনাকে দেখে কোনো কারণে ওর চেনা লেগেছিল?’
‘হতেও পারে। কিন্তু আরেকটা সম্ভাবনাও আমি উড়িয়ে দিচ্ছি না। ওই বাসটা ছিল বড়ো অদ্ভুত। বাসটার সামনে যে ছবিটা আঁকা ছিল, সেটা একটা ডাইনোসরের। খুব বেশি বাস আমি দেখিনি, যেখানে এত বড়ো এবং অ্যাকিউরেট একটা ডাইনোর ছবি আঁকা আছে। কিন্তু, সেটাও কি আপনি অতদূর থেকে দেখতে পেয়েছিলেন?’
‘আমি কাছে এসেও অতটা খেয়াল করিনি। তবে আপনি বলার পরে মনে হচ্ছে, এমনটা ছিল যেন।’
‘সেক্ষেত্রে বলতে হবে আপনার পর্যবেক্ষণক্ষমতা খুব ভালো নয়। কিন্তু যেটা দেখেই জিকো ছুটে আসুক-না কেন, এর কোনোটাই সাধারণ কুকুরের পক্ষে সম্ভব নয়। আপনি হয়তো জানেন, কুকুরের ঘ্রাণ এবং শ্রবণশক্তি প্রবল হলেও দৃষ্টিশক্তি কিন্তু অত ভালো নয়।’
‘হুম, এমনটা শুনেছি বটে।’
‘মানুষ কোনো জিনিসকে ৭৫ ফুট দূর থেকে যতখানি স্পষ্ট দেখতে পায়, কুকুর দেখতে পায় মাত্র কুড়ি ফুট দূর থেকে। অথচ দুটো ঘটনার ক্ষেত্রেই দেখছি জিকোর দেখার ক্ষমতা আপনার থেকে যথেষ্টই বেশি।’ অর্ককে হয়তো একটু অপ্রস্তুত দেখাচ্ছিল, তাই মেঘ আবার বলল, ‘আপনাকে উদাহরণ হিসেবে নিলাম, আসলে আমি বলতে চাইছি ওর দৃষ্টিশক্তি যে-কোনো মানুষের থেকেই অনেকখানি বেশি।’
‘কিন্তু ঘটনাগুলো তো কাকতালীয়ও হতে পারে? হয়তো এমনিতেই ও অমন করে তেড়ে যাচ্ছিল?’
‘হতে পারত। কিন্তু আমি নিশ্চিত সেটা হইনি। আপনি হয়তো জানেন না, পরেশকাকুর গাড়ি সেদিন একটা অ্যাক্সিডেন্ট করে। গাড়িটা একেবারে তুবড়ে গিয়েছে। এখনও হসপিটালে ভরতি পরেশকাকু।’
‘সে কী কথা?’
‘এমনকি সেদিন যে বাসটায় ওঠার কথা ছিল, সে বাসেরও একটা ঘটনা ঘটেছিল।’
‘দাঁড়ান, দাঁড়ান, এবার মনে পড়েছে। টিভি-র খবরে বাস অ্যাক্সিডেন্টের কথা শুনেছি। সেখানেই ডাইনোসরের ছবি আঁকা বাসটা চোখে পড়েছিল। তাই মনে হল যেন আপনার বাসে ডাইনোসর আঁকা ছিল। হতাহতের সংখ্যা কম নয়। আপনি তো খুব বাঁচা বেঁচে গেছেন।’
‘বাসটা ওইদিন অ্যাক্সিডেন্ট করেনি। খবরটা বেরিয়েছিল তার ঠিক একদিন পর। তার মানে আমি ওই বাসে উঠলেও বেঁচে যেতাম। হয়তো ওই বাসটার একটা অ্যাক্সিডেন্ট হবে—এটা টের পেয়েছিল জিকো, তাই আমাকে আটকাতে গিয়েছিল। তাহলে এবারও কি বলবেন যে দুটো ঘটনাই কাকতালীয়?’
‘আপনি কী বলতে চাইছেন, একটু খোলসা করে বলতে পারবেন?’
‘প্যারাসাইকোলজিতে বিশ্বাস করেন? প্রিকগনিশন?’
‘সেটা কী?’
‘কারও কারও ভবিষ্যৎ দেখবার ক্ষমতা থাকে। আমার ধারণা, জিকো হয়তো ভবিষ্যৎ দেখতে পায়। তাই পরেশকাকুকে বা আমাকে সাবধান করার জন্যই অমন করে আটকাতে গিয়েছিল? আমি শুনেছি বলে বেঁচে গিয়েছি, কিন্তু পরেশকাকুর ক্ষেত্রে শেষরক্ষা হয়নি।’
‘কিন্তু একটা সংশয় তো থেকেই যাচ্ছে।’
‘কী?’
‘জিকো যদি ভবিষ্যৎ দেখতে পায়, তাহলে এ-ও জানত যে বাসটার অ্যাক্সিডেন্ট ওইদিন হবে না। তাহলে সেদিন আপনাকে আটকাতে যাবার কারণ কী?’
‘হুম, সেটাও যে ভাবিনি তা নয়। তবে কিনা আরেকটা প্রশ্নের উত্তরও আমি পাইনি। আরও লোক ওখান থেকে সেদিন বাসে উঠছিল, আমাকেই কেন জিকো আটকাতে চাইল? এ প্রশ্নের উত্তর পাইনি। হতে পারে, আমাকে উঠতে না দিয়ে ও ভবিষ্যৎ বদলে ফেলেছে? অথবা অন্য কিছু হতে পারে। উত্তরটা খোঁজা দরকার।’
‘এসব আপনি বিশ্বাস করেন? গল্প-উপন্যাসে হতে পারে, তা বলে বাস্তবে?’
‘নিশ্চয়ই হয়। কোনো বিশেষ ক্ষমতা কারও কারও মধ্যে থেকেই যেতে পারে। জাতিস্মরের খোঁজও তো পাওয়া যায়। গুগ্ল করে দেখবেন, একটা দু-বছরের বাচ্চা একখানা প্লেন ক্র্যাশের কথা হুবহু বলে দিয়েছিল। সে নাকি সেই প্লেনে পাইলট ছিল। আর তা ছাড়া… আমার নিজেরই একটা বিশেষ ক্ষমতা আছে। সেটা প্যারাসাইকোলজিক্যাল কিছু নয়। একেবারে বিজ্ঞান। কাজেই প্রিকগনিশন বিশ্বাস করি-না করি, একটা কুকুরের যে বিশেষ দৃষ্টিশক্তি থাকতে পারে, সে কথা অবিশ্বাস করতে পারছি না।’
‘আপনার কী বিশেষ ক্ষমতা আছে?’ অর্কর দৃষ্টিতে বিস্ময়।
মেঘ একটা কাগজ নিয়ে খচখচ করে কিছু লিখে অর্কর দিকে কাগজটা এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘দেখুন তো কী লিখলাম?’
‘আমার ঠিকানা আর ফোন নাম্বার। সেদিন দেখেছিলাম, আপনি নোট করেননি। আপনার দেখছি দারুণ মেমরি।’
‘আপনার মনে আছে, ঠিক কখন আপনি প্রথমবার কোন বন্ধুর দ্বারা প্রতারিত হয়েছিলেন? মনে আছে, ঠিক ক-টার সময় বাস ধরে স্কুলে এসেছিলেন? মনে আছে, স্কুলে কোন ক্লাসে কার পাশে বসতেন? কোন বন্ধুর কোন রোল নম্বর ছিল?’
‘ধুস, এসব আবার মনে থাকে নাকি?’
‘থাকে, আমার মতন মস্তিষ্ক হলে থাকে। কত কী ভুলতে চেয়ে পারি না, জানেন? যেদিন কোনো কিছু ভুলতে পারব, সেটাই হবে আমার কাছে আশীর্বাদ। মেমরির চাপে মাথাটা ফেটে যেতে চায়। কিছুতেই ভুলতে পারি না। এ এক অভিশাপ, বুঝলেন? কফি রেডি হয়ে গেছে, নিয়ে আসবেন প্লিজ়? অর্ডার দিয়েছিলেন ঠিক চোদ্দো মিনিট আগে। আমাকে দেখে কোনো কারণে অস্বস্তি হচ্ছিল বলে ঠোঁট কামড়াচ্ছিলেন। কী কী কথা আমাদের মধ্যে হল, এতক্ষণ আমি লাইন বাই লাইন আপনাকে বলব? তাহলে বুঝবেন, আমি সত্যি বলছি।’
একটু থেমে মেঘ বলল, ‘জানেন, খুব কঠিন প্লটের রহস্য গল্প আমার দারুণ লাগে। পুঙ্খানুপুঙ্খ ঘটনা, ক্লু, এমনকি চরিত্রের নামগুলো এমনভাবে মনে থাকে যে রহস্য উন্মোচনের সময়টা আমি যেন একটু বেশি করেই এনজয় করতে পারি।’
কফি নিয়ে এল অর্ক। এরপর দুজনেই কেন যেন চুপ করে কফির কাপে মুখ গুঁজে বসে রইল খানিকক্ষণ।
চার
মেঘের সব কথা অর্কর ঠিক হজম হচ্ছে না। সমস্ত কিছু মনে রাখবার ব্যাপারটা গুগ্ল করলে অবশ্য পাওয়া যাচ্ছে। কোনো কোনো মানুষের মস্তিষ্কের বিশেষ কোনো অংশ অজ্ঞাত কারণে অতিসক্রিয় হয়ে যাওয়ার নিদর্শন বেশ কিছু আছে। কিন্তু জিকো ভবিষ্যৎ দেখতে পায়, এটা সত্যি হতে পারে না। তা-ই যদি হত, যেদিন দাদুর অ্যাক্সিডেন্টে পা ভেঙে গেল, সেদিন জিকো বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে দাদুর চলে যাওয়া দেখতে দেখতে ল্যাজ নাড়ছিল কেন, ওর তো দাদুকে আটকানোর কথা ছিল? এর পিছনে নিশ্চয়ই অন্য কোনো কারণ আছে।
আজ সকালে মেঘকে একবার ফোন করেছিল অর্ক। মেঘ সেদিন ওর মিস্ট্রিতে ইনটারেস্টের কথা বলছিল। আর আজই চোখে পড়ল, এরকিউল পোয়ারোর গল্পের উপর একটা ছবি এসেছে। খানিকটা আমতা আমতা করেই বলে ফেলল মেঘকে। তবু বিধি বাম। মেঘের নাকি আজ ওই ছবিটাই দেখতে যাবার কথা, টিকিটও কাটা আছে, কোন এক বন্ধুর সঙ্গে। বন্ধুটা কে, সে কথা সাহস করে আর জিজ্ঞাসা করেনি অর্ক। মেয়ে হলে নিশ্চয়ই বান্ধবী বলত। সেটা সব সময় সবাই না বললেও, মন কুডাক ডাকতে আজ দ্বিধা করেনি। মনটা খারাপ হয়ে গিয়েছিল অর্কর, বিস্বাদ লেগেছিল রবিবার দুপুরের কচি পাঁঠার ঝোল।
দুপুরবেলা বসে মেঘের বলা কথাগুলো ভাবতে ভাবতে কখন যেন চোখ দুটো লেগে গিয়েছিল। ঘুম ভাঙল জিকোর গলার শব্দে। অদ্ভুত একটা আকুতি ওর গলার স্বরে। যেন কিছু বলতে চায়। কোথায় জিকো? শব্দটা দাদুর ঘরের দিক থেকে আসছে না?
জিকোর এ ডাকের মানে জানে অর্ক। জিকোর বুদ্ধি অন্য কুকুরের চেয়ে যে বেশি, সে কথা মানতে কোনোদিন দ্বিধাবোধ হয়নি। দাদু মজা করে বলতেন, দাদুর বিজ্ঞানী বন্ধু নিশ্চয়ই ওকে ক্লোন করে বানিয়েছে, আর নয়তো ও এক খুব উচ্চমানের রোবট। কখনো-কখনো এ কথা বিশ্বাস করতেও ইচ্ছে করে। আজ জিকোর এ ডাকের মানে হল, ও কিছু একটা বলতে চায় অর্ককে। ও দেরি না করে দাদুর ঘরে গিয়ে হাজির হল।
দাদুর বাক্সোটার উপর একটা পা তুলে আঁচড়াচ্ছে জিকো। ওকে দেখে এবার পা নামিয়ে নিয়ে বাক্সের ডিজিটাল লকের কাছে মুখ ঘষতে থাকল। কী মনে হতে অর্ক বাক্সোটা খুলে দিল। দিতেই জিকো সেই ফোটোর পাউচটাকে মুখে করে বার করে আনল।
অর্ক জিকোর মুখ থেকে পাউচটা নিয়ে একবার দেখল। তাহলে কি ওই ছবিগুলোর মধ্যে কিছু একটা আছে, যেটা ও অর্ককে বলতে চায়? ছবিগুলোকে জিকো আগেও এমনভাবে আঁচড়েছে। তখন পাত্তা না দিলেও মেঘের সঙ্গে গতকালের কথাবার্তার পর মনে হচ্ছে, জিকোকে আরেকটু সিরিয়াসলি নেওয়া দরকার। একটা একটা করে আপাত নিরীহ ছবিগুলোতে ভালো করে চোখ বোলাতে থাকল অর্ক।
প্রথম ছবি সেই রাস্তা, লোকজন। পরের ছবি প্রায় একই রকম। দ্বিতীয়, তৃতীয়, না, কোনো বিশেষত্বই চোখে পড়ছে না। চতুর্থ ছবি হাতে নিয়ে প্রথমবার চমকাল অর্ক। ওটা সরিয়ে রেখে আবার ফিরল আগের ছবিতে। এটা তো প্রসূনদের বাড়ি। বাড়ির রংটা নীল। কীভাবে সম্ভব? ওদের বাড়ির রং হল যে দাদুর মৃত্যুর পর। জন্ম থেকে ও বাড়ির রং হলুদ ছিল। রেনোভেশন হয়ে নীল হল প্রথমবার। তাহলে কি এ ছবি অর্কর জ্ঞান হবার আগে তোলা, তখন হয়তো অন্য রং ছিল? তা কী করে হয়? পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে এ ছবি এখনকার। সামনের লোকটার হাতে মোবাইল ফোন।
এবার দ্রুত ছবিগুলো দেখতে লাগল অর্ক। প্রায় দশটা ছবির পর চোখ আটকে গেল অর্কর। ও ঠিক দেখছে? এ তো সেই ডাইনোসর-আঁকা বাসটা। কিন্তু জায়গাটা ই এম বাইপাস, চিংড়িঘাটার কাছে। চিংড়িঘাটার উড়ালপুল দেখেই চেনা যাচ্ছে। বাসটা একেবারে তুবড়ে গিয়েছে। ছবির তারিখটা বছর তিনেক আগের। গায়ে কাঁটা দিল অর্কর।
আরেকবার ছবিগুলো ওলটাল অর্ক। আরও তিন-চারটে ছবির পর যে ভদ্রলোককে দেখা যাচ্ছে, তাঁর মুখটা বেশ চেনা। জাহাজবাড়ির সেই ভদ্রলোকের মুখটা এখনও মনে আছে অর্কর। ছবিটা একটা খবরের কাগজের প্রথম পাতার খবরের। কাগজটা এই ঘরেরই টেবিলে রাখা। ট্যাক্সি দুর্ঘটনায় মৃত্যু ট্যাক্সিচালকের, গুরুতর আহত আরোহী। আহতের নাম পরেশ মল্লিক। সেদিনের পাঞ্জাবি ট্যাক্সিচালকের বসন্তের দাগওয়ালা, মাঝখানে সিঁথি-করা স্টাইলিশ চুলটা আরেকবার না দেখলে হয়তো বিনা কারণে মনে পড়ত না। এ ছবির তলাতেও বছর তিনেক আগের তারিখ।
নেশার মতো লাগছে অর্কর। তার মানে এ ভবিষ্যৎ দেখবার ক্ষমতা জিকোর নয়, জিকো কেবল ছবি দেখেছে, আর ক্যামেরা দেখেছে ভবিষ্যৎ। ছবিগুলো হাতে নিয়ে হিসেব মেলানোর চেষ্টা করছে অর্ক। এ-ও কি সম্ভব? অর্কও তাহলে নিশ্চয়ই তিন বছর পরের ছবি তুলে রেখেছে ক্যামেরার ওই অদ্ভুত সবুজ রঙের ফিল্মে, কী আছে তাতে?
তার ফোটোগ্রাফি ক্লাবে শেখা প্রথমদিকের ক্লাসের কথা মনে পড়ছে অর্কর। একটা সিলভার হ্যালাইডের তৈরি ফিল্ম। আলো পেলেই তার রাসায়নিক পরিবর্তন হয়ে কতকগুলো ইমেজ তৈরি হয়। তারপর ডার্করুমে সেই নেগেটিভ থেকে ধীরে ধীরে তৈরি করা হয় ফোটো।
খানিক ভাবতে বসল অর্ক। কীভাবে দেখা যায় ভবিষ্যৎ? অর্কর তো আগেই ধরতে পারা উচিত ছিল। দাদুকে কতবার জিজ্ঞাসা করেছিল তাঁর রিসার্চের ব্যাপারে। দাদু একবার বলেছিলেন, ‘আমি শুধু মরবার আগে কয়েকটা ট্যাকিওন্সকে কাজে লাগাতে চাই।’
অর্ক অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘ট্যাকিওন্স কী, দাদু?’
দাদু বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, ‘ট্যাকিওন্স নাকি এক ধরনের পারটিক্ল, যা আলোর চেয়ে দ্রুত চলে। হয়তো তাকে আরও, আরও দ্রুত করে তুলতে পারলে ভবিষ্যৎকে দেখে ফেলা যাবে?’
অর্ক হেসে বলেছিল, ‘কী হবে জেনে? আগে থেকেই হয়তো জেনে যাব, কবে মরব। তখন বাকি জীবনটাও বাঁচার ইচ্ছে চলে যাবে।’
তার মানে এ শুধু কথার কথা নয়, দাদু পেরেছিলেন। তাহলে কি ওই ট্যাকিওন্স দিয়েই এই ক্যামেরা বানানো? আচ্ছা, তার মানে T.C. তপন চৌধুরী না-ও হতে পারে? ওটা কি তবে Tachyons Camera? আর এই কারণেই হয়তো ফ্ল্যাশ থেকে আলো বেরোয় না। হয়তো ফ্ল্যাশ থেকে দ্রুত গতিতে বেরিয়ে আসে ট্যাকিওন্সের স্রোত? তারপর অতি দ্রুত সময় পেরিয়ে তিন বছর পরের কোনো ছবি তুলে এনে ওই সবুজ ফিল্মের উপর ফুটিয়ে তোলে ফোটোগ্রাফ? জীবন্ত হয়ে ওঠে না-ঘটা কোনো দৃশ্য? গায়ে কাঁটা দিচ্ছে অর্কর।
ঠিক এ সময় অর্কর মনে পড়ল মেঘের বলা কথাটা। ওই ডাইনোসর-আঁকা বাসে তো সেদিন আরও অনেকে উঠেছে। জিকো কেবল মেঘকেই আটকাতে গেল কেন? নিশ্চয়ই অন্য কোনো কারণ থাকবে, থাকতেই হবে। জিকো একমুখ প্রশান্তি নিয়ে পাশে বসে বসে ল্যাজ নাড়ছে। দ্রুতহাতে ঝড়ের মতো ফোটোগুলো ওলটাতে থাকল অর্ক, উত্তর আছে এই ছবিগুলোতেই, থাকতেই হবে। দশ, কুড়ি, তিরিশ, বত্রিশ—পেয়েছে। পেয়েছে অর্ক আলোর দিশা—এ কী দেখছে সে? এবার থরথর করে কাঁপছে সে, আনন্দে নাকি বিস্ময়ে?
এক বছর আগে তোলা একটা ছবি। ফোটোটা এ ঘরের দেওয়ালের, যেখানে অর্কর কনভোকেশনের ছবি আছে, সেখানের। পাশে আরেকটা বড়ো ছবি। অর্কর বিয়ের ছবি। সিঁদুরদান। যার কপালে সিঁদুর এঁকে দিচ্ছে, বন্ধ চোখের সে মেয়েকে চিনতে বিন্দুমাত্র অসুবিধা হচ্ছে না অর্কর। মাথায় তোলা আঁচল আর সিঁদুরে ভারী সুন্দর দেখাচ্ছে মেঘকে।
কখন যে ফোনটা বাজতে শুরু করেছে, অর্ক খেয়ালই করেনি। চটক ভাঙতেই এক ঝটকায় ফোনটা তুলে নিল। কোনোরকমে কাঁপা গলায় হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে মেঘের গলা ভেসে এল। ‘আমার বন্ধু আজ সিনেমায় যেতে পারবে না। তুমি যাবে বলছিলে, তোমার যদি আপত্তি না থাকে তাহলে ওই টিকিটটায়…।’
মেঘকে কথা শেষ করতে দিল না অর্ক। কখন যে আপনির দূরত্ব ঘুচে সম্পর্কের দখল নিয়েছে তুমি সম্বোধন, তার হিসেব কে রাখে? হঠাৎ যেন ওর সব সংশয় ঘুচে গেছে। বুকজোড়া আত্মবিশ্বাস নিয়ে সে বলল, ‘আমি আসব, মেঘ।’
জানলার বাইরে থেকে তখন কালো মেঘের ফাঁক থেকে উঁকি দিচ্ছে এক টুকরো অর্কপ্রভা।
Tags: অর্ণব গোস্বামী, কল্পবিজ্ঞান, নবম বর্ষ প্রথম সংখ্যা, পূজাবার্ষিকী