কিউপিড এবং
লেখক: বামাচরণ ভট্টাচার্য
শিল্পী: টিম কল্পবিশ্ব
না, আর ভালো লাগে না। সেই একঘেয়েমি। ইচ্ছে হলে, ওঠ, কম্পিউটারে বসো, সময় ঠিক কর। তারপর সেই একই জিনিস। যতক্ষণ সময় সেইটুকুই, একটুকুও বাড়তি নয়। আলাদা স্বাদ নেই। একরাস বিতৃষ্ণা। এখন কিউপিডকে দেখলেই যেন বিরক্ত লাগছে। বড্ড মিস করছি অনিমেষকে। সকাল হলেই অন্তত সে বলত গুড মর্নিং। স্বাদ মিটুক না মিটুক জড়িয়ে ধরে কিছুক্ষণ শুয়ে থাকা যেত। মড়ার মতো শীতলতা নিয়ে পাশে পড়ে থাকত না। তার সঙ্গে একটু আদর, একটু খুনসুটি, একটু ঝগড়া থাকতই।
ফোনটা কৃষ্ণাকে করে গড়গড় করে বলে গেল সুনয়না। যেন সমস্ত দোষটা কৃষ্ণারই। কৃষ্ণাই যেন জোর করে এখানে নিয়ে এসেছে। অথচ প্রজেক্টে যোগ দেওয়ার আগে তার সঙ্গে কোনো পরিচয়ই ছিল না। অনিমেষ সরে যাবার পরে কৃষ্ণা সেই শূন্যস্থানের যথার্থ সঙ্গী ছিল।
প্রমিথিউসে এসে সুনয়না বুঝেছে জীবনে সব সুখ দেহের নয়, মনেরও বটে। কৃষ্ণা সেই মনের সাথী। সমস্ত সুখ দুঃখের কথা তাকে নির্দ্বিধায় বলতে পারত। সেও সুনয়নার ধাত বুঝত। সুনয়নার কথাগুলো শুনে সে খুব মৃদু স্বরে বলল, কী হল? অত উতলা কেন?
সুনয়না ছোটো ছেলের মতো হাউমাউ করে কেঁদে উঠে বায়না করার মতো বলল, আমি পৃথিবী যাব।
কৃষ্ণার ধৈর্য যথেষ্ট। এই ধৈর্যই তাকে আজ এই পর্যায়ে নিয়ে এসেছে। না হলে প্রত্যন্ত অঞ্চলের গরীব ঘরের একটা মেয়ের পক্ষে এই প্রমিথিউসে আসা সম্ভব হত না। সে আবার খুব শান্ত স্বরে সুনয়নাকে জবাব দিল, শান্ত হ। বিকেলে আমার কাছে আয়, ভালো লাগবে। আর একটা কথা তো মাথায় রাখতেই হবে—যন্ত্র তো যন্ত্রই, মানুষ তো নয়! এত সব পাবি কী করে?
***
জায়গাটা প্রমিথিউসের একটা আবাসস্থান। পৃথিবী থেকে পয়েন্ট এক আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত একটা নব আবিষ্কৃত গ্রহ। এটা আবার সূর্যকে পাক খায় না, সূর্যের মতো অন্য একটা নক্ষত্র হিমিরাকে পাক খায়। অনেক জায়গায় পৃথিবীর মতো ঋতু পরিবর্তনও হয়। অনেক দিক বিবেচনা করে বিজ্ঞানীরা দেখেছেন এই স্থানের কিছু জায়গা বসবাসের উপযুক্ত, তাই এখানে বসতি স্থাপন করা হয়েছে। তবে এখানে যারা বাস করেন তাঁরা সবাই নারী।
নিয়ম আছে পৃথিবী থেকে কোনো পুরুষই এই গ্রহে আসতে পারবে না। একবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে নারীবাদী আন্দোলন চরমে ওঠে। অনেক নারীরা প্রমাণ করতে চেষ্টা করে পুরুষরা ছাড়াও তারা সবদিক দিয়েই সক্ষম। সেই আন্দোলনের জেরে গড়ে ওঠে পৃথিবীতে গড়ে ওঠে প্রমিথিউস কলোনি। সেই প্রমিথিউস কলোনির আইডিয়া নিয়ে কোম্পানি ব্যাবসা করতে নামে। তারা বিশ্ব গ্রহ সংস্থার কাছ একটা গ্রহ লিজ নেয়, গড়ে তোলে নারীদের নতুন গ্রহ—প্রমিথিউস।
যে সব নারীরা এই গ্রহে এসেছেন তাঁদেরকে চুক্তিপত্র করতে হয়েছে এখানে পুরুষ সঙ্গীকে ত্যাগ করে আসতে হবে এবং পুরুষহীন থাকতে হবে। পুরুষ বলতে এখানে কিউপিড। সে শুধুই শয্যাসঙ্গী। কিউপিডকে সফল শয্যাসঙ্গী করতে সুনয়নার অবদান চরম, অথচ সেই আজ বিরক্ত।
সুনয়না কিন্তু কখনও ভাবেনি সে এখানে আসবে। সে কিছুটা অভিমান করেই এখানে। এই গ্রহটার কথা শুনেছিল যখন সে গ্রাজুয়েশন করছে। বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়াতে প্রমিথিউস নিয়ে দারুণ তর্ক-বিতর্ক। অনিমেষ বলেছিল, যাবি না কি প্রমিথিউসে?
খানিকটা না জানার সুরে সুনয়না জিজ্ঞেস করেছিল, সে আবার কী? সে তো গ্রিক পুরাণের কথা। যিনি রূপের রানি সাইকিকে বিয়ে করেছিলেন?
আরে পুরাণটুরানের কথা আমি বলছি না।
তাহলে?
আমি বলছি প্রমিথিউস নামক গ্রহটার কথা।
সুনয়না জানলেও প্রকাশ করেনি। সে বিস্ময়ে তাকিয়ে ছিল। অনিমেষ দারুণ আগ্রহ নিয়ে প্রমিথিউস গ্রহটার সম্পর্কে নানা অজানা কথা বলেই চলছিল। কিন্তু সুনয়নার আর মাথায় কিছু ঢুকছিল না। শুধু তার ইচ্ছে করছিল একটু জড়িয়ে ধরে চুমু খেতে।
তাদের সাবজেক্ট রোবোটিক ইঞ্জিনিয়ারিং। একই সঙ্গে পড়ার সুবাদে বন্ধুত্ব, তারপরে অন্তরঙ্গতা, ভালোলাগা থেকে ভালোবাসা। আজ সেটা প্রগাঢ় থেকে প্রগাঢ়তর। তাকে ছেড়ে থাকার কথা কল্পনাও করে না।
অবশেষে অনিমেষের বকবকানি থামানোর জন্য সুনয়না বলল, আচ্ছা বাবা, অনেক হয়েছে এবারে চুপ হ। ওখানে আমি যাব না, যেখানে তুই থাকবি না, সেখানে আমি গিয়ে কী করব?
অনিমেষের তখন বিস্ময়ে ঘোর লাগার মতো অবস্থা। একটু অভিমানের স্বরে সে বলল, তার মানে তুই সব জানতিস?
সুনয়না তাকে জড়িয়ে ধরে বলেছিল, না জানার কী আছে? সোশ্যাল মিডিয়া যা প্রচার করছে। কিন্তু ওখানে তোকে ছাড়া আমি থাকব কী করে?
এই কথাটা শোনার পরে অনিমেষের আর অভিমান ছিল না। ছাত্রছাত্রী হিসেবে তারা খারাপ ছিল না। বিভিন্ন কোম্পানি ওত পেতেই থাকে। বেশ লোভনীয় অফারে তাদের চাকরিতে তুলে নিল তারা।
তারপরে একদিন সুনয়না বলল, চল এবারে আমরা একসঙ্গে থাকি।
শুভক্ষণে চার হাত এক হয়ে গেল।
***
কিন্তু ভালোবাসা আর একছাদের নীচে একসঙ্গে বাস করা এক জিনিস নয় বোধহয়। ক্রমে শুরু ভুল বোঝাবুঝি।
তুই বুঝিস না? সুনয়না বেশ রাগ করেই বলল। সে দেখছে শারীরিক ব্যাপারটাতে অনিমেষের বড্ড তাড়া, যেন কোনোরকমে ব্যাপারটা চুকে গেলেই হয়। অপরজনের যে ভালো লাগা থাকতে পারে তার সম্পর্কে ভাবেই না।
অনিমেষ সুনয়নাকে ছেড়ে সরে এসে বলে, কী?
এই যে তোর হয়ে গেল আর সরে পড়লি। এবারে নাক ডেকে ঘুমাবি। আর আমার খবর একবারও নিবি না?
মানে?
তোর একটা সাধারণ বোধ হয় না, তোর যেমন তৃপ্তি আসে আমারও তেমন থাকতে পারে?
কী বলছিস, আমি কিছুই বুঝছি না।
সুনয়না ভেংচিয়ে বলল, কচি শিশু, কিছুই বোঝেন না। পরক্ষণেই একটু সিরিয়াস হয়ে বলল, অর্গ্যাজম জানিস না?
এই দ্যাখ বলে সুনয়না নিজেই অনিমেষ জাগানোর চেষ্টা করে। নিজের উলঙ্গ শরীরটাকে তার কাছে নিয়ে আসে, স্পর্শ করে এখানে সেখানে। উত্তেজনা প্রবল অঞ্চলে চুমু দিতে থাকে। কিন্তু অনিমেষ নিস্তেজ। তার শরীর আর জাগে না। সেও বুঝতে পারে। কিন্তু ক্লান্তি তাকে টেনে ধরে। কেবলই মনে হয় সুনয়না এবারে থামুক। অবশেষে বিরক্ত হয়েই সে বলে, এই থাম। আর ভালো লাগছে না। কাল আবার অফিস আছে।
সুনয়না থামতে পারে না। সে গোঙাতে গোঙাতে বলে, প্লিজ অনি, আর একবার, প্লিজ…
অনিমেষ তাকে সরিয়ে দিয়ে বলে, কাল দেখা যাবে, আজ সরে যা।
অতৃপ্ত শরীর নিয়ে সুনয়না ছটফট করে। একদিনও সে তৃপ্ত হল না। এইসব ব্যাপারে সে কত গল্পই না শুনেছিল। অথচ, কিছু না। এইভাবে আর পারা যায় না। সে এবারে হিসহিস করে বলে, তুই কোনদিনই পারবি না।
চোখ বুজে অনিমেষ চিন্তা করে সত্যি করেই ব্যাপারটা তাড়াতাড়ি চুকে গেলেই তার শান্তি। তবুও সুনয়নার কথাতে কোথাও একটা খারাপ লাগা চলে আসে। প্রতিজ্ঞা করে আর কখনও সুনয়নার গায়ে হাত দেবে না। আবার না দিয়েও থাকতে পারে না। কোথা থেকে হঠাৎ করে একটা তীব্র ভালোলাগা চলে আসে, আর তখনই সব কিছু ওলটপালট হয়ে যায়। তখন আর মনে থাকে না, কোথায় অর্গ্যাজম বা অন্য কিছু। তখন কেবলই আকাঙ্খা। তীব্র থেকে তীব্রতর চাওয়া। কিন্তু কিছুক্ষনেই ঝড় থেমে যায়। আবার সেই…
***
অনিমেষ খবরের কাগজে পড়েছিল ভারতে বেশির ভাগ মেয়েই এই ব্যাপারে অবহেলিত। কোনো একটা সংস্থা সার্ভে করিয়েছিল। তার নিজের ঘরেও যে এটা হতে পারে সেটা সে ভাবেইনি। তাই সুনয়না কথা বললে সে চুপ করে থাকে। অবশেষে ঘুম সাময়িকভাবে ঘটনাটাকে মিটিয়ে দেয়। কিন্তু ভাঙনের একটা চোরাস্রোত বইতে থাকে।
একদিন সুনয়না বলে, অনি তোকে একটা কথা বলার ছিল…
হ্যাঁ বল না।
একটা অ্যাড বের হয়েছে।
কীসের?
মিশন কিউপিডের।
সেটা কীরকম? অ্যাপ্লাই করবি? চল, দুজনেই করি। আমারও এই জবটা আর ভালো লাগছে না।
সুনয়না অ্যাডটা দেখায়। অনিমেষ খুব মৃদু স্বরে বলে, প্রমিথিউসে?
হ্যাঁ।
তুই যাবি? অনিমেষের মনে পড়ে সুনীল গাঙ্গুলীর কবিতা খানি, কেউ কথা রাখেনি। আগে সে ভালো আবৃত্তি করত। অনেকদিন পরে আবার অনিমেষ শুরু করল। কিন্তু গলাটা…
সুনয়না কোনো কথা না বলে চুপচাপ উঠে যায়। তারও ভিতর থেকে একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে, চোখগুলো জ্বালা করে। কিন্তু একটা চরম সিদ্ধান্ত নিয়েই নেয় যে সিলেক্ট হলে সে যাবেই। ভাগ্যক্রমে প্রজেক্টাতে সে সিলেক্টও হয়ে যায়।
***
ইন্ট্রোর দিন সিলেকশন কমিটির চেয়ারপার্সন মধুজা সেন বলেন, আপনাদের নিশ্চয় মিশনটি সম্পর্কে সামান্য হলেও ধারণা আছে।
সবাই মোটামুটি হ্যাঁ বলেন।
মধুজা সেন আবার শুরু করেন। আপনারা নিশ্চয় জানেন প্রমিথিউস পুরুষহীন একটা গ্রহ। কিন্তু সব মানুষেরই কিছু জৈবিক চাহিদা থাকে। নারীরাও নিশ্চয়ই তার ব্যতিক্রম নয়।
একটু থেমে আবার শুরু করেন, আমাদের শারীরিক চাহিদা থাকবেই, এটা চিরন্তন শ্বাশত। কিন্তু এই অভাব মিটবে কী করে? বাজার চলতি সাধারণ জিনিসের মতো হলে হবে না। মস্তিষ্কহীন একটা নিখুঁত পুরুষ তৈরির গবেষণা বহুদিন ধরেই হচ্ছে বা হয়েছেও। আমাদের কোম্পানি নতুন করে আবার এই প্রজেক্টে হাত দিয়েছে, আরও উন্নততর করার জন্য। এই প্রজেক্টের মূল উদ্দেশ্য শুধুমাত্র নারীর জৈবিক চাহিদা মেটানো। গ্রিক দেবতার স্মরণে এর নাম দেওয়া হয়েছিল কিউপিড। তাই এই প্রজেক্টের নামকরণ হয়েছে মিশন কিউপিড। এবারে তিনি একটু থামলেন, থামার পরে গ্লাসে রাখা জলে একটু চুমুক দিয়ে আবার শুরু করলেন, কিউপিড হলেন গ্রিক পুরাণ অনুসারে কামনার দেবতা। তাই তাকে গড়তে হবে নারীর কামনার প্রকৃত সঙ্গী হিসেবে। জানবেন, সব দেশ কিন্তু একবারে এটাতে সায় দেয়নি, বিশেষ করে মধ্যপ্রাচের কিছু দেশ। তারা এখনও বিরোধিতা করে যাচ্ছে। তাই সফলতাই আমাদের মূল প্রতিবাদ এটা মনে রাখতেই হবে। তবে সামগ্রিকভাবে কোম্পানিকে চুক্তি করতে হয়েছে পৃথিবীতে কোনোভাবে কিউপিডকে ব্যবহার করতে তারা দেবে না।
***
সুনয়না হয়েছে প্রজেক্ট লিডার। কিউপিডকে ডেভলপিং এর কাজটা তাকেই করতে হচ্ছে। বছরধরে তাকে রিসার্চ করতে হয়েছে। বিভিন্ন বিষয়ের প্রয়োজনে তাকে মিশতে হয়েছে নানা ধরনের পুরুষের সঙ্গে, নারীদের সঙ্গে। বিভিন্ন নারীদের তৃপ্তি বিভিন্ন রকম ভাবে হয় সেইসব বিষয় তথ্য সংগ্রহ করতে হয়েছে। সেইসব বিষয়ের প্রোগ্রামিং করতে হয়েছে। খুব মনযোগ দিয়ে লক্ষ রেখেছে পুরুষদের লিঙ্গের আকৃতি, গঠন। নিয়েছে ভিন্ন বয়সি, ভিন্ন প্রদেশী পুরুষদের স্পার্মের নমুনা, তার ঘনত্ব। ভালো করে লক্ষ করেছে ইরেকশন স্পিড। করেছে স্পার্মের সংরক্ষণ। তার পরামর্শেই প্রমিথিউসে গড়ে উঠেছে, স্পার্ম রিজার্ভার। এই সময় কৃষ্ণা ছিল যোগ্য সহযোগী। সমবয়সি এই মেয়েটি ভীষণ চটপটে এবং নানা বিষয়ে পারদর্শী। কিউপিডের প্রোগ্রামিংটা সম্পূর্ণভাবেই কৃষ্ণার কৃতিত্ব। তবে সে বিভিন্ন রকমের লিঙ্গ দেখে, ভিডিয়ো দেখে রঙ্গ করতেও ছাড়ত না আবার কাজের সময় তার মতো সিরিয়াস কাজও কেউ করত না।
কিন্তু স্পার্ম রিজার্ভার প্রয়োজনীয়তা মধুজা সেনকে বোঝাতেও কম বেগ পেতে হয়নি, সুনয়নাকে। স্পার্ম সংরক্ষণের কথা বলতেই মধুজা সেন বলেন, কীরকম?
সেখানে ম্যাডাম স্পার্ম সংরক্ষণ করে রাখতে হবে। সেটাই হবে কিউপিডের নন অ্যাক্টিভ স্পার্ম ফিলিং সেন্টার।
কেন?
না হলে আমরা প্রমিথিউসে স্পার্ম পাব কী করে?
স্পার্ম না পেলে কী এমন ক্ষতি হবে?
ক্ষতি কিছুই হবে না কিন্তু আমাদের উদ্দেশ্য ব্যহত হবে।
মধুজা সেন অবাক হন। তিনি বলেন, কেন উদ্দেশ্য ব্যহত হবে? কিউপিড তো একটা নিখুঁত পুরুষ মানুষ, সেটাই কি বড়ো ব্যাপার নয়?
সুনয়না উত্তর দিয়েছিল, আমাদের গ্রামে একটা প্রচলিত কথা ছিল—শিশিরে কি ভেজে মাটি বিনা বরষণে, চিঠিতে কি মেটে আশা বিনা দরশনে। কথাটা শুনে মধুজা সেন হাসেন। সুনয়না আরও বলে, স্পার্ম না থাকলে কী করে আর নিখুঁত থাকল? সে তো খেলনার সামগ্রী হয়ে রইল। স্বয়ংক্রিয়তা ছাড়া লিবিডোর সঙ্গে তার পার্থক্য কোথায়?
মধুজা সেন বুঝেছিলেন। পরবর্তী দিনগুলোতে কয়েক কোটি পুরুষের স্পার্ম নেওয়া হয়েছিল। সেগুলোর সঙ্গে কিছু রাসায়নিক মিশিয়ে সেগুলোকে নন অ্যাক্টিভ করে রিজার্ভারে সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছিল।
***
সমস্ত সংগ্রহ শেষ হলে তাদের টিম রওনা হয়ে গেছিল, প্রমিথিউসে। মিশন কিউপিডে যোগ দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অনিমেষের তার সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ। পৃথিবীতে কিছু মনে হয়নি কিন্তু এখানে এসে প্রথম কয়েকদিন খুব মন কষ্টে ছিল সুনয়না। তারপরে কাজের চাপে ভুলে গেছিল অনিমেষকে। আবার সম্পর্কও ভেঙে ফেলেনি। তখন তার মন জুড়ে ছিল কিউপিড। তার সফলতা। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত একটাই চিন্তা কিউপিড নিখুঁত পুরুষ হল কী না?
ট্রায়ালের দিনটা যত এগিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে সুনয়নার টেনশনও বেড়ে যায়। প্রমিথিউসের সমগ্র নারী জাতির ভালোলাগা এর মধ্যে জড়িয়ে আছে। বার বার চেক করে নেয়—প্রোগ্রামিং এর সঙ্গে তাল মিলিয়ে কিউপিডের ইরেকশন স্পিড, পেনিসের হার্ডনেস, স্ফিংটার পেশির সবলতা, স্পার্ম রিজার্ভারের ক্যাপাসিটি।
কিউপিডের পেনিসটা বানিয়েছে একটা আমেরিকান সংস্থা। উত্তেজিত অবস্থায় সেটি আসলের মতোই স্ফিত হয়, দৃঢ়তা আসে। পেনিসের ভিতরের দিকে রয়েছে একটা স্পার্ম রিজার্ভার সেখানেই জমা থাকে নন অ্যাক্টিভ স্পার্ম। সেটা শুক্রাশয়ের কাজ করে। প্রোগ্রামিং এর নির্দেশিত নির্দিষ্ট সময়ের পরেই স্ফিংটার পেশি সজাগ হয় তারপরেই পেনিসের মধ্যে দিয়ে স্পার্ম বাইরে বের হয়ে আসে।
***
অবশেষে সেদিন আসে। ট্রায়াল রুমে মধুজা সেন, সঙ্গে প্রমিথিউসের মান্যগণ্য অনেকেই। তাঁদের সামনে কিউপিডকে ব্যাখ্যা দিচ্ছিল সুনয়না। আজকেই খাতা কলমে লঞ্চ হবে কিউপিড। তারপর থেকে শুরু হবে বুকিং। আগামী বছরের মধ্যে প্রমিথিউসের সমস্ত নারী কিউপিডের অধিকারী হবেন।
সুনয়না শুরু করছিল। কিউপিড এক স্বপ্নের রূপকথার মতো। সে স্বপ্নের পুরুষ। শুধুমাত্র তার মস্তিষ্কটা নেই। তার বদলে আছে একটা প্রোগ্রামিং। সেখান থেকেই নিয়ন্ত্রিত হয় তার জৈবিক চাহিদা। কম্পিউটারের একটা অ্যাপসে কিছু তথ্য দিলেই সেটা প্রোগ্রামিং হয়ে যায়। সুনয়না বোঝাচ্ছিল কীভাবে সেই তথ্য সেখানে আপলোড করতে হয়। সেখানের প্রোফাইলে কীভাবে দেখতে হয় স্পার্মের স্টোরেজ। স্টোরেজ শেষ হলে আবার ফিলিং সেন্টারে নিয়ে গিয়ে সেটাকে স্টোর করতে হবে। ফোরপ্লের টাইম, অর্গ্যাজমের টাইম, এবং ইন্টারকোর্সের টাইম সেট করার পরে ব্লুট্যুথ কানেক্ট করলেই কিউপিড তার কাজ শুরু করবে। একটু চুপ করে সে আবার বলে, এবারে আপনাদের কোনো প্রশ্ন থাকলে করতে পারেন।
একজন হাত তুলে বলেছিলেন, স্পার্ম কি একবারে অরিজিনাল?
সুনয়না উত্তর দিয়েছিল, হ্যাঁ।
তাহলে একটা কনসিভের চান্স আছে?
সুনয়না আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলেছিল, না নেই।
কী করে?
সুনয়না উত্তর দিয়েছিল, ক্ষতিকর নয় এমন কিছু রাসায়নিক এর সঙ্গে মিশিয়ে নন অ্যাক্টিভ করে রাখা হয়েছে যাতে ডিম্বানুকে নিষিক্ত করতে না পারে। এর ফলে অবশ্য স্পার্মের গুণাগুণের কোনো তারতম্য ঘটবে না। এছাড়াও স্পার্মের মাধ্যমে ঘটতে পারে এমনসব রোগের কথা খেয়াল রেখেও বিভিন্ন পরীক্ষানিরীক্ষার মাধ্যমে একবারে নিশ্চিত হয়েই তবেই রিজার্ভারে সংগ্রহ করা হয়েছে। তাই এইসব ব্যাপারে আপনারা একবারে নিশ্চিত থাকতে পারেন। স্পার্ম ফিলিং করার সময় সেই স্পার্মের রিপোর্ট আপনারা দেখে নিতে পারবেন।
তিনি ধন্যবাদ দিয়ে বসে পরতেই অন্যেরাও দু-একটা প্রশ্ন করেছিলেন।
পরে সুনয়না তার বক্তব্য শেষ করে।
তারপরে ধীরে ধীরে স্বয়ংক্রিয় পর্দা যেতেই উন্মোচিত হয়েছিল কিউপিড। একটা নগ্ন নিখুঁত পুরুষ মানুষ। ট্রায়াল হয়েছিল কয়েকজনের সঙ্গে। সবাই মুখে তৃপ্তি হাসি নিয়ে বের হয়ে এসেছিলেন। সুনয়নারা বুঝেছিল, মিশন সফল। আর ভাবতে হয়নি সুনয়নাদের। পালটে গেছিল জীবন। এখন প্রমিথিউসের ঘরে ঘরে কিউপিড।
***
সেই কিউপিড নিয়ে আজ সুনয়নার বিতৃষ্ণা। সে পৃথিবী ফিরে যাওয়ার আবেদন করে। অনেক টালবাহানার পরে অনুমতি মেলে। সুনয়নার বিশ্বাস আছে অনিমেষের উপর। অনিমেষ ঠিক বুঝতে পারবে সুনয়নাকে। মনের কল্পনায় সাজিয়ে নেয় নতুন করে। সে বলবে, সরি অনি। যতই হোক যন্ত্র যন্ত্রই। আর তৃপ্তির জন্য না হয় কিউপিডকে তার সঙ্গে রাখবে। এটা ভেবেই নিজেই উৎফুল্ল হয়ে উঠল, দেহের জন্য কিউপিড, মনের জন্য অনি। তারপরেই মন খারাপ হয়ে গেল, নিয়মানুযায়ী কিউপিডকে তো পৃথিবীতে রাখতে পারবে না।
দীর্ঘ পাঁচ বছর। সময়টা নেহাত কম নয়। পরিবর্তন কম হয়নি পৃথিবীতে। একবার ফোন করেছিল, অনি আমি ফিরছি। সে জানত অনিমেষ আসবেই। তার ভালোবাসার এইটূকু বিশ্বাস আছে। স্পেস স্টেশনেই অনেকেই এসেছেন। আজ দুশো মেয়ে পৃথিবীতে ফিরে এল। অনি কই? ওই তো। ডাকতে গিয়েই থেমে গেল সুনয়না। অনির সঙ্গে আর একজন। সুনয়নাকে দেখেই বলে, আমার বউ—তিতলি।
ভেবে আসা স্বপ্নটা এক লহমায় চুরমার হয়ে যায় তবু সুনয়না হাতটা এগিয়ে দিয়ে বলে, কী দারুণ দেখতে তুমি। তুমি এসেছ কী ভালোই না লাগল। কিন্তু মনের মধ্যে দোলা খেতে থাকল, ‘ছেঁড়া শিকড় পাবে কি আর পুরোনো তার মাটি?’
কিউকিড
ঘরে লাগানো আলেক্সা বলছে, কল ফ্রম প্রমিথিউস। প্রমিথিউস থেকে কল এলেই বুকটা কেমন ধড়ফড় করে সুনয়নার। একটা মানসিক সমস্যা কাজ করে। আগে ছিল না, ইদানীং হচ্ছে। মনে হয় অফিসিয়ালি তাকে ওখানে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হবে। কিন্তু অনেক বন্ধুরা এখনও ওখানে, কাজে-অকাজে ফোন আসে। রিসিভ করলেই থ্রি-ডি কলিং শুরু হয়। পুরো আস্ত মানুষটাকেই মনে হয় নিজের কাছে হেঁটে চলে বেড়াচ্ছে। তবুও এই অবসেশনটা থেকে সে বেরিয়ে আসতে পারে না। অবশেষে রিসিভারটার কাছে এসে তার বুক ধড়ফড়ানিটা কমে, দ্যাখে কৃষ্ণা।
ফোনটা ধরতেই ওপারে কৃষ্ণা। পুরো শরীরটা সোফাতে এলিয়ে রেখে ফোনটা করেছে। রাতের কাপড়ও বদলায়নি। পোশাকও বেশ অগোছালো। সুনয়না বলে, কী খবর, সাত সকালে? অফিস যাবি না?
কৃষ্ণা উত্তর দেয়, আজ আর যাব না। শরীরটা ভালো নেই। তুই কেমন আছিস?
আমি ভালোই আছি কিন্তু তোর শরীরের আবার কী হল? অঙ্গ প্রত্যঙ্গ ঠিক আছে, তো? কিউপিড ঠিকঠাক খেয়াল রাখছে না? বেশ মজা করে কথাগুলো বলল সুনয়না।
কৃষ্ণা বলল, এমনই। তারপরে সব কথা এড়িয়ে বলল, এখানে একটা সাঙ্ঘাতিক সমস্যা চলছে। খবর পেয়েছিস?
বুকটা ছ্যাঁত করে উঠল সুনয়নার। না তো। কী হয়েছে? সুনয়না প্রশ্নটা করে।
মধুজা সেন ফোন করেননি?
বুকে ধুকপুকানি নিয়ে সুনয়না উত্তর দেয়, না এখনও করেননি। কী হয়েছে, বল না?
কৃষ্ণা এবারে বলে, আমি মানে আমরা মা হতে চলেছি। প্রমিথিউসের প্রায় হাজার তিনেক মহিলা গর্ভবর্তী।
সুনয়না নিজের কানকে যেন বিশ্বাস করতে পারে না। সে জিজ্ঞেস করে, কীভাবে?
কৃষ্ণা হাসে। হাসিটা কেমন যেন রহস্যময় মনে হয় সুনয়নার। যন্ত্রে সমস্যা আসবে সেটা জানা কথা। কিন্তু এইভাবে? সেটা ভাবেওনি। কিন্তু এমন হবার কথা ছিল না। সেইজন্যই কৃষ্ণা বলছিল, শরীর খারাপ। সে খুঁটিয়ে দেখতে থাকে, কৃষ্ণার শরীরে গর্ভের লক্ষণ সুস্পষ্ট কি না? বেশ কিছুক্ষণ তারা অনেক কথা বলে। ফোনটা রেখে দিতেই বুঝতে পারে, আজই তাকে একবার মনোবিদের কাছে ছুটতে হবে। একটা সেশন খুব জরুরি।
সে ভাবতে থাকে নানা কথা। মাথার মধ্যে চলতে থাকে ফার্স্ট ফরোয়ার্ড মুভি। চিন্তাতে আসতে থাকে একের পর এক কনসিভ আটকানোর জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা। কিউপিডের স্পার্মগুলোর সঙ্গে রাসায়নিক মিশিয়ে অপেক্ষাকৃত দুর্বল এবং নন অ্যাক্টিভ করে রাখা হয়েছিল, তাহলে? কিন্তু এখন কৃষ্ণার কথানুযায়ী তারা প্রেগন্যান্ট। তার মানে কেউ কোনো কারসাজি করেছে। কখন, কীভাবে? সার্ভিসিং এর সময় না অন্য কোনোভাবে? যা করেছে করুক, আমার কী? আমি আর যাচ্ছি না বাবা। এখানেই বেশ আছি। যন্ত্র দিয়ে সব চাহিদা মেটে না। কিন্তু…
***
সবসময় জীবনের হিসেব মেলে না। সুনয়নারও মেলেনি। সে ভেবেছিল, নতুন করে ঘর বাঁধবে অনিমেষের সঙ্গে। কিন্তু স্পেসস্টেশনে তিতলিকে দেখে আর এগোয়নি। যেটুকু ভাব ভালোবাসা ছিল সেখানেই রেখে মনকে প্রবোধ দিয়েছিল, কেউ কারও নয়। সময় বাড়লে ভাঙা সম্পর্কের ফাটলও বাড়ে। অনিমেষ জিজ্ঞেস করেছিল, যাবে কোথায়? বউএর দিকে তাকিয়ে তারপর বলেছিল, আমাদের কাছেই চল, ব্যবস্থা করে তারপরে না হয়… সুনয়না কথাটা তার শেষ করতে দেয়নি, বলেছিল, এত বড়ো পৃথিবীতে আমার একটু জায়গা মিলবে না? পরক্ষণেই বলেছিল, না গো, তুমি এসেছ এটাই অনেক। আমার একটু কাজ আছে। কাজ সেরে হোটেল বুকিং আছে সেখানেই উঠব। তিতলি এবারে কথা বলেছিল, আমরা থাকতে হোটেলে কেন? সুনয়না তখন উত্তর দেয়, তোমরা তো আছই। সে পরে যাওয়া হবে। এখন আসি। ট্যাক্সিতে বসে হাঁফ ছেড়ে বসেছিল সে। কিছুক্ষণের জন্যে হলেও সে একবার অনিমেষকে জড়িয়ে ধরতে চেয়েছিল। মনকে সেই সময়টুকুতে আটকে রাখাই কঠিন হয়ে পড়েছিল। তবুও সে পেরেছিল। ভালোবাসা মানুষকে দুর্বল করে দেয়। সে দুর্বলতাকে প্রশয় দিতে চায়নি।
ঘরটা বেশ। ইন্টারনেটে থাকা ছবির সঙ্গে খুব একটা পার্থক্য নেই। অনিকে মিথ্যা কথা বলেছিল, কোনো ঘর বুকিং তার ছিল না। ট্যাক্সিতে বসেই ঘরটা বুকিং করেছিল। ঘরে ঢুকে ব্যাগটা রেখেই বাথরুমে ঢুকল সুনয়না। গায়ে জল না ঢাললে মনে হয় স্পেস ল্যাগটা কাটবে না। চোখের কোণে এত যে জল জমে আছে তা শাওয়ারটা না খুললে মনে হয় সে বুঝতেই পারত না।
স্নান করে একটু ঝরঝরে লাগে নিজেকে। তারপরে ইন্টারকমে দেয় একটা ব্ল্যাক কফির অর্ডার। হোটেলটা বেশ ভালো। চিনি খাওয়াটা বহু আগেই ছেড়ে দিয়েছিল। মিষ্টি খাওয়া ছাড়া, খাওয়ার ব্যাপারে কোনো বাদ বিচার করে না সে। তবে তেল জাতীয় খাবারটা সাধারণত এড়িয়ে চলে সে। আর প্রতিদিন সকালে সামান্য ফ্রি হ্যান্ড এক্সসারসাইজ করতেও ভোলে না। তাই মধ্য ত্রিশেও শরীরটাকেও স্লিম আর ফিট দেখায় এখনও। সেভেনটিন ফ্লোরে তার কামরা। সেখান থেকে নীচেটাকে খুব ক্ষুদ্র মনে হয়।
কফি মাগটাতে চুমুক দিতেই নানা কথা মনে আসে। কত সুখ স্মৃতি, কত অভিমান। হঠাৎই অনিমেষের উপর রাগ করে। সে কি একবার ফোন করতে পারত না? ফোন করলে কি না ফিরে থাকতে পারত? পরক্ষণেই ভাবে সে নিজেও তো করেনি। মানভঞ্জনের দায়িত্ব একা অনিমেষেরই ছিল?
কফিটা শেষ করে প্রমিথিউসে ফোন করেছিল, কৃষ্ণাকে। ওপার থেকে কৃষ্ণা বলেছিল, এ কোথায়? এটা তো অনিমেষের বাড়ি নয় মনে হচ্ছে।
সুনয়না বলে, না এটা হোটেল।
মানে?
মানে আবার কী, এমনিই।
কৃষ্ণা আর প্রশ্ন করেনি। ছলছল চোখ দেখে কিছুটা হয়তো আন্দাজ করতে পেরেছিল। আচ্ছা রেস্ট কর। স্পেস ল্যাগের ক্লান্তিতে সুনয়নার চোখটা বুজে আসছিল, সেও শরীরটাকে নরম বিছানায় এলিয়ে দিয়েছিল।
***
তবে হ্যাঁ, এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে জৈবিক ক্ষুধা নিয়ে অনিমেষের সঙ্গে সুনয়নার সম্পর্কের অবনতি হয়েছিল। অঞ্জনা বলেছিল, এমন ভুল করিস না। শরীর নয়, মানুষটাকে দেখ, তার মনটাকে দেখ। সে ভালোবাসে কি না দেখ। শরীর তুচ্ছ। একটু বয়স হলেই ওই খিদেটা আর থাকবে না। মন সঙ্গী খুঁজবে, তখন পাবি কোথায়?
সুনয়না শোনেনি। সে বরং বিদ্রোহের সুরে বলেছিল, তোরা কী সব? এত সেন্টিমেন্টাল? সামান্য চামড়ার জন্য এত টান? নিজেদের কথাটা একটুও ভাববি না? এই দেশে সেইজন্যই মেয়েদের এত দুর্গতি। সব কিছু পুরুষতান্ত্রিক, তাদের মর্জিমতো। এমনকী বিছানায় শোওয়াটাও। আজ আমার ইচ্ছে নেই এই কথাটাও বলতে ভয় পায়।
বেশ দৃঢ় কণ্ঠে অঞ্জনা উত্তর দিয়েছিল, শোন, আমি নিজের স্বার্থ ভালোই বুঝি। তাই বলে ফেমিনিস্ট হতে পারব না। তুই এখন ডাইভার্ট হয়ে আছিস, তাই বুঝবিও না। তবুও বলছি যাস না। সুনয়না হেসেছিল। অঞ্জনা আরও বলেছিল, কয়েকদিন আলাদা থাক। একবারে চরম সিদ্ধান্তে যাস না। একটু গভীরে ভাবিস।
সুনয়না দম্ভ নিয়ে বলেছিল, ভাবছি তো—একটা যন্ত্র, যেটা নারীদের চরম তৃপ্তি দেবে। মিশন কিউপিড তেমনি এক প্রকল্প। কোম্পানির পক্ষ থেকে আমি এই রকম হাজার মেয়ের সঙ্গে মিশেছি যারা কোনোভাবেই কোনো পুরুষের দ্বারা তৃপ্ত হয়নি। আমার তো মনে হয় সেই আকাঙ্খা থেকেই একদিন প্রমিথিউস কলোনি গড়ে উঠেছিল। কলোনিটা গড়ে ওঠার পিছনে ছিল পুরুষ শাসিত সমাজের বিদ্রোহ, তাদের মন মর্জির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ। তারা বলেছিল, পুরুষেরা যদি আমাদের তৃপ্তই না করতে পারে তাহলে কেন আমরা তাদের মুখাপেক্ষি হয়ে থাকব? শুধুমাত্র তাদের শারীরিক সুখ দেবার জন্যে? আমি যাতায়াত করেছি তাদের কলোনিতে। কলোনির সভাপতি চারুলতাদি কী বলল জানিস? “পুরুষ জাতটাই ধর তক্তা মার পেরেক গোছের। আরে বাবা তোদের তাড়াতাড়ি হয় বলে, পার্টনারকে বুঝবি না? তোর তৃপ্তিটা আসল? আমরা কেউ নয়। এই আমার বরটা—ফাঁকা পেলেই কাপড় জামা খুলে হাঁপরের মতো দু-তিনবার টেনেই নেতিয়ে পড়ত। ব্যাস, হাজার কসরতে তার আর উঠত না। আর আমার তখন কী অবস্থা, মনে আগুন, শরীরে আগুন, নিভাবার জায়গা নেই। কোম্পানির পরিকল্পনাটা বেশ ভালো। আমরা কলোনি থেকে এই প্রকল্পের সঙ্গে আছি, থাকব।”
মিথ্যা কথা।
মিথ্যা কথা? বুকে হাত দিয়ে তুই নিজে বল তো তোর বর কতদিন তোকে তৃপ্ত করতে পারে?
মাসে একদিন হলেও তো হয়। সেদিন মন আর শরীর এক হয়ে যায়। এক অনাস্বাদিত আনন্দে ভরে উঠি। সেই আনন্দ পেতে হলে মানুষকেই চায়। তুই অনিকে ধীরে সুস্থে সুযোগ করে দে, আমি বলছি তার কাছে যা তৃপ্তি পাবি অন্য কোথাও পাবি না।
সুনয়না শোনেনি। অঞ্জনা আর কথা বাড়ায়নি। চলে গেছিল। প্রমিথিউসে থাকার সময় এই কথাগুলো খুব মনে পড়ত তার। পৃথিবীতে ফিরেও সেই একই অবস্থা। কিন্তু অঞ্জনাকে আর ডাকেনি। লজ্জা লাগত। অঞ্জনার কথাগুলো জিতে গেছিল। বাস্তব আর কল্পনা দুটো আলাদা মেরুর সেটা ভালোই বুঝেছিল সুনয়না। অঞ্জনা আগেই বুঝেছিল বলেই বলতে পেরেছিল, শারীরিক সম্পর্কের বাইরেও এমন কিছু থাকে যা একমাত্র রক্ত মানুষের কাছ থেকেই পাওয়া যায়।
***
পৃথিবীতে থাকার কয়েকদিন পরে সমস্যাটা আরও জটিল হয়। অনিমেষ নেই। তার নৌকা ভিড়েছে অন্য ঘাটে। হোটেলে কয়েকদিন থাকার পরে একটা ফ্ল্যাটে সিফট করেছিল সে। কিন্তু সেখানে তীব্র একাকিত্ব। মানসিক অবসাদ। নাচ, গান, হইহুল্লোড়, নেশা কোনো কিছুকেই ভালোবাসার পরিপূরক করতে পারেনি। কৃষ্ণাকে ফোনে বলতেই, সে বলে, ফিরে আয়।
আবার প্রমিথিউস? সেই কিউপিড। না না।
তোর এই একই প্রব্লেম, খুব তাড়াতাড়ি ডিসিশনে চলে যাস।
সত্যিই তাই। একা ঘরে বসে এটাই ভাবছিল সুনয়না। এই জীবনে কত মানুষ দূরে সরে গেল—বাবা, মা থেকে অনিমেষ পর্যন্ত। দূর আকাশে তখন আগুন লেগেছে। এমন দিনে অনিমেষের সঙ্গে কত সময় পার করেছে। মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে উঠল।
***
মনোবিদের চেম্বারটা তার অ্যাপার্টমেন্ট থেকে খুব একটা দূরে নয়। হেঁটেই যাওয়া যায়। সেদিন মনোবিদ ড. সেনের কাছ থেকে সেশনের পর ফিরছিল। আগে লক্ষ করেনি, সেদিন চোখ যেতেই লক্ষ করে একটা আর্ট এক্সিজিবিশন চলছে। সেখানে ঢুকে পড়তেই দ্যাখে নানা ধরনের ছবি। বেশির ভাগ ছবিরই কোনো মাথামুণ্ড বোঝেনি। তবুও ছবির রংগুলো দেখে বেশ ভালো লাগছিল। সে লক্ষই করেনি কখন একজন পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। লম্বা, গায়ে একটা ঢিলেঢালা পাঞ্জাবি, উসকোখুসকো চুলে বেশ দেখাচ্ছিল তাকে। প্রথম কথা সেই বলেছিল, হাই।
সুনয়না উত্তর দিয়েছিল, হ্যালো।
আমি গোরা। ছবিটি কি আপনার পছন্দ হয়েছে?
সুনয়না স্পষ্টভাবে বলেছিল, আসলে আমি কিছুই এর বুঝতে পারছি না। রঙের কম্বিনেশনটা বেশ লাগছে তাই দাঁড়িয়ে দেখছি।
একটা অট্টহাসি দিয়ে গোরা বলেছিল, থ্যাঙ্কিউ।
সুনয়না ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলেছিল, কেন?
গোরা উত্তর দিয়েছিল, এত সহজ কথা ক-জন বলতে পারে। তারপর ব্যাখ্যা করেছিল ছবিটার। সে বলেছিল, প্রতিটা রঙের আলাদা আলাদা তাৎপর্য আছে। বিভিন্ন চেতনা নিয়ে সেই রংগুলি তুলে ধরা হয়েছে। এই যেমন ডার্ক শেডের আড়ালে রয়েছে গভীর চিন্তার বিষয়।
***
গোরা শিল্পী। ছবি আঁকে। সুনয়না ছবির কিছুই বোঝে না। অবাক চোখে রংগুলো দেখে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে তার তুলির টান দেখে। সময় কাছে নিয়ে আসে তাদের। ধীরে ধীরে মনোবিদের সেশন কমে আসে। ড. সেনের কথাতে বিশ্বাস জন্মে, ম্যাডাম আপনার মানুষের স্পর্শ চাই, যন্ত্রের নয়। গোরার সঙ্গে সম্পর্ক দৃঢ়তর হয়।
ছবির বাইরেও তাদের কম্পাঙ্ক মিলে যেতে থাকে। সপ্তাহের মাঝে মাঝে তাদের দেখা সাক্ষাৎ চলতে থাকে। একদিন নদীর ধারে সন্ধে নামছিল। আকাশের বুকে ছিল রঙের খেলা। গোরা সেদিন কাছে টেনে নিয়ে ঠোঁট মিলিয়েছিল গভীরভাবে। সুনয়নাও বাধা দেয়নি। সেও মনে মনে হয়তো এটাই চেয়েছিল। সেদিন রাতে এক সঙ্গেই ডিনার সারে তারা।
রেস্তোরাঁ থেকে সুনয়নার অ্যাপার্টমেন্টটা কাছে। তবু হেঁটে গেলে বেশ দূর। ফেরার পথটা তারা হাঁটতে থাকে। হাতে হাত ধরে একসঙ্গে এগিয়ে যায় তারা। খুব তাড়াতাড়ি যেন অ্যাপার্টমেন্টটা চলে আসে। সুনয়না বিদায় জানাবার আগে একবার জড়িয়ে ধরে গোরাকে। আলিঙ্গন দৃঢ় হয়। বিদায় জানানো হয় না। ভিতরে দুই মানব মানবী আদিম খেলাতে উন্মুক্ত হয়ে ওঠে। সুনয়না অনুভব করে গোরার কোনো তাড়া নেই, ধীরে সুস্থে সে কাঙ্খিত লক্ষে এগিয়ে যাচ্ছে। তার প্রতিটা রোমকূপ শিহরিত হচ্ছে গোরার স্পর্শে। সেও থেমে থাকে না। তুফান ওঠে, লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় সবকিছু। অবশেষে ঝড় থেমে যায়। শান্ত হয়ে আসে প্রকৃতি। গোরা সুনয়নার কপালে থাকা চুলগুলোকে সরিয়ে দিয়ে আলতো করে চুমু খায়। শান্ত হয়ে জিজ্ঞেস করে, ভালো লাগল?
সুনয়না লজ্জায় রাঙা হয়ে ওঠে। ওষ্ঠে একটা মৃদু হাসি ফুটে ওঠে। মনে ভাবে এমন কিছুর অপেক্ষায় সে ছিল, শুধু মন নয় আবার শরীরও নয়। গোরার মধ্যে দেহমন সব মিলেমিশে একাকার। পার্টনার হিসেবে গোরা উপযুক্ত, ভীষণভাবে উপযুক্ত।
এখন সে গোরার সঙ্গেই থাকে। বেশ আছে। শরীর মন দুটো দিকেই সে তৃপ্ত। অনিমেষের সঙ্গে অফিসিয়ালি ডিভোর্সটা নিয়ে নিয়েছে। সে এখন পাকাপাকিভাবে গোরার।
গোরা তাকে অনেকটাই বোঝে। মুখ দেখেই আজ বলে, কী হল সু? মনখারাপ? কেন? বেড়াতে যাবে? সুনয়না ভেবে পায় না কী বলবে? অনেকসময় মন খারাপের নির্দিষ্ট কোনো বিষয় হয় না। তবে আজকের কৃষ্ণার ফোনের পরে সে জানে তার মন খারাপটা কেন? প্রমিথিউসে ফেরাটা এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা। অপেক্ষা শুধু মধুজা সেনের নির্দেশের। আজই একবার ড. সেনের কাছে যেতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে কিছু বলে না গোরাকে। সময় নেয়। কৃষ্ণার কথাটা খেয়াল করে, তুই বড্ড তাড়াতাড়ি ডিসিশন নিস।
সে গোরাকে বলে, চল তাহলে একটু কফি খেয়ে আসা যাক।
***
মনের ভিতর টানাপোড়েন চলে কয়েকদিন। ড. সেন পরামর্শ দেন, আপনি নির্দ্বিধায় সব কথা আপনার পার্টনারকে খুলে বলুন। তবুও বেশ কয়েকদিন সময় নেয় সুনয়না।
সে অফিস থেকে তাড়াতাড়ি ফিরে গেলেও গোরার ফিরতে রাত হয়। কোনো কোনোদিন হয়তো ঘুমিয়েই পড়ে সুনয়না। শরীরে স্পর্শ না পেলে বুঝতেও পারে না গোরা ফিরল কি না? সেদিন অনেকটা রাত। গোরা তখনই ফেরেনি। ঘড়ির কাঁটাটা যখন মধ্যরাত্রি ছুঁয়ে ফেলতে চলেছে তখনই সে ফিরল। সুনয়নাকে জেগে থাকতে দেখে গোরা অবাক হয়। জিজ্ঞেস করে, কী ব্যাপার ঘুমাওনি?
ঘুম আসছে না।
তাই? চোখের মধ্যে একটু দুষ্টুমি এনে গোরা বলে, আদর খাবার মন হয়েছে? একটু ওয়েট কর, আসছি আমি।
ফ্রেশ হয়ে আসে গোরা। তারপরে অনেকক্ষণ… এই স্বাদ পুরোপুরি আলাদা। কিউপিডের মতো বোরিং নয়। একটা আলাদা অনুভূতি। শিহরণ। তৃপ্তি। সবকিছুর পরে সুনয়নাই প্রথমে কথা বলে, একটা প্রব্লেম হয়েছে।
গোরা মজা করে, আমি থাকতে প্রব্লেম? বলে ফেলুন মহারানি, সমস্যাটা কীসের? গোরা ভাবে অফিসের কোনো সমস্যা। বা পূর্বেকার কোনো সমস্যার জের। কিন্তু বাস্তব আর ভাবনা দুটো দুই মাত্রার, সমাপতন ঘটে না।
সুনয়না উত্তর দেয়, হয়তো আমাকে আবার প্রমিথিউসে ফিরে যেতে হতে পারে।
মানে?
হ্যাঁ, তেমনই। এখনও তবে অফিসিয়ালি কিছু আসেনি। কিন্তু আমার মনে হয় আসতে আর দেরি নেই।
গোরা একটু দমে যায়। এতক্ষনের তৃপ্তির ঢেঁকুরটা হঠাৎই টক হয়ে যায়। অম্বলের চুয়া ঢেঁকুরটা পেট থেকে মুখে উঠে আসে। সুনয়না উঠে পড়ে। গোরা বলে, আমাদের ভবিষ্যৎ?
সুনয়না পেটের দিকে হাত দিয়ে বলে, এখানে।
গোরা সুনয়নার পেটে কান দিয়ে নবাগতের হৃদস্পন্দন শোনার চেষ্টা করে। বলে, এটা দেখিয়েও যাওয়া আটকানো যায় না?
সুনয়না কথা বলে না, উঠে যায় বিছানা থেকে।
***
পরের দিনই মেল আসে, সঙ্গে ফোন মধুজা সেনের। ফিরে এস, আর্জেন্ট।
সুনয়নার ইচ্ছে হয় না। কিন্তু আগের শর্তটাই এমন, উপায় নেই যেতেই হবে। তবু বলে, ম্যাম আমি প্রেগন্যান্ট।
মধুজা সেন উত্তর দেন, তাতে আর অবাক কী! এখানে অনেকেই, চলে এস।
সুনয়না বোঝে উপায় নেই। যেতেই হবে। আইনি প্রক্রিয়াতে গেলেও তা সময় সাপেক্ষ। হেরে গেলে তাতে সমস্যা আরও বাড়বে। গোরার মনটা খারাপ হয়। কিন্তু…
***
প্রমিথিউসে এখন যুদ্ধকালীন তৎপরতায় কাজ চলছে। খুব তাড়াতাড়ি হাসপাতালগুলিতে লেবার রুম করে ফেলতে হবে। করতে হবে শিশু বিভাগ। কয়েকদিনের মধ্যে জন্ম নেবে যন্ত্র-মানব সন্তান, কিউকিড। কোনো কিছুতে ফাঁকি থাকলে চলবে না। পৃথিবী থেকে শ’খানেক মহিলা ডাক্তার এসেছেন। তাদের মধ্যে কিছু স্ত্রী বিশেষজ্ঞা, আর কিছু শিশু বিশেষজ্ঞা।
সুনয়নার এখনকার আবাসস্থলটা অন্য জায়গায়। তবে কাজের জায়গা থেকে খুব একটা দূরে নয়। স্পেস স্টেশনে নেমে একবার অফিস যেতে হয়েছিল। ওখান থেকে নতুন আবাসস্থলের ঠিকানা দেওয়া হয়। আবাসস্থলে ফিরতেই ফোনটা বেজে উঠল। নিশ্চিতভাবে কৃষ্ণার, ধরতেই, ওয়েলকাম ব্যাক।
সুনয়না বলে, থ্যাঙ্কিউ।
আচ্ছা রেস্ট নে। পরে কথা হবে। স্পেসল্যাগ কাটতে সময় নেবে।
হ্যাঁ রে, টায়ার্ড লাগে। কৃষ্ণার ফোন কাটতেই গোরাকে পৌঁছানোর খবরটা দিল। তারপর দু-একটা টুকরোটাকরা কথার পরে সে ফোনটা রেখে দিল। তারপর ঘুমের রাজ্যে।
স্পেসল্যাগ কাটতে সময় লাগল পাক্কা দুইদিন। এই দুইদিন সে অফিস যায়নি। খেয়েছে, ঘুমিয়েছে আর কয়েকবার গোরাকে ফোন করেছে। মাঝে মাঝে কফি মাগটা হাতে করে জানালার কাছটাতে এসে বসেছে। ভেবেছে কত কিছু, কিছু অলীক কিছু বাস্তব।
***
বায়োমেট্রিক দিয়ে ল্যাবে ঢুকল সুনয়না। একটা কিউপিডকে টেবিলে শুয়ে রাখা হয়েছে। একটু ইমোশনাল হয়ে পড়ল সুনয়না। সেই আপাতত গিনিপিগ। একটা অজ্ঞান থাকা মানুষের মতোই কিউপিডকে দেখাচ্ছে। হঠাৎই নিজেকে কেমন যেন ডাক্তার ডাক্তার মনে হল সুনয়নার। মাথায় ক্যাপ, হাতে গ্লাভস, দেহে আপ্রোন পরে সে যেন পুরোপুরিই ডাক্তার।
টেবিলের পাশটাতে তিনজন দাঁড়িয়ে। মধুজা সেন দাঁড়িয়ে আছেন টেবিলের অপর প্রান্তে, মাথার কাছে। চোখেমুখে সব উৎকণ্ঠা।
কিউপিডের কঙ্কালটা তৈরি হয়েছে এক নব আবিষ্কৃত এক উন্নতমানের ধাতু দিয়ে, যা একজন সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের কাঠামোর সমতুল্য। সেই কঙ্কালের মধ্যেই রাখা আছে প্রোগ্রামিংএর ইন্ট্রিগেটেড চিপ, হার্ড ডিস্ক, ব্যাটারি। কঙ্কালটাকে ঢেকে রেখেছে একধরনের সিন্থেটিক চামড়া। যা মূলত মানবদেহের মতো নরম, হালকা লোমশ। মাথার উপর থেকে চুলগুলো সরালে চামড়াটার জোড়াটা দেখা যায়। সেখান থেকে সোজা শিরদাঁড়া বরাবর সেই জোড়াটা নীচে পর্যন্ত নেমে গেছে।
খুব সাবধানে সেই চামড়াটাকে ধীরে ধীরে সরিয়ে নেওয়া হল। তারপরে চামড়াটাকে একটা অ্যালকোহল যুক্ত তরলে খুব তাড়াতাড়ি ডুবিয়ে দেওয়া হল। এতে চামড়া তার বিশেষত্বকে হারাবে না।
কিউপিডের কঙ্কালে বিভিন্ন ধাতব যন্ত্রাংশ। নানা ধরনের সার্কিট। পেটের মধ্যে একটা উন্নতমানের ব্যাটারি। চার্জারের পয়েন্টটা কোমরের কাছটা থেকে সামান্য বেরিয়ে থাকে। দিনে দু-ঘণ্টা চার্জ সেখান থেকেই দেওয়া হয়। মস্তিষ্ক মানে একটা ইন্ট্রিগেটেড চিপ। সমস্ত প্রোগ্রামিং সেখানেই করা থাকে। সেখানে থেকেই সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম স্নায়ুর মতো সার্কিট দেহের বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গের সেনসরের সঙ্গে যুক্ত থাকে। বুকের কাছে আছে হার্ডডিস্ক। কয়েক টেরাবাইট মেমোরি দিয়ে রাখা হয়েছে সেখানে। সবকিছু সার্কিটের মাধ্যমে ব্যাটারির সঙ্গে যুক্ত।
কাজের শুরুতেই সুনয়নারা ইন্ট্রিগেটেড চিপটা বের করে নিল। সেটা সেন্ট্রাল সিস্টেমের সঙ্গে ইন্টারনেটের সঙ্গে যুক্ত থাকে। তারপর পরীক্ষা করার জন্য হার্ডডিস্কও খুলে নেওয়া হল। এবারে সুনয়না তার সহকারীকে নির্দেশ দিল, স্পার্ম রিজার্ভার থেকে কিছুটা নমুনা নিয়ে ল্যাবে পাঠিয়ে দিন।
ল্যাব থেকে বেরিয়ে এসে সুনয়না তার কম্পিউটারে বসল। হার্ডডিস্কের ডেটাগুলো ট্রান্সফার করার জন্য চিপটাকে কানেক্টরের মাধ্যমে কম্পিউটারের সঙ্গে জুড়ে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে লেখা ফুটে উঠল, আন অথরাইজড কানেকশন। প্লিজ অথরাইজ ইওর সিস্টেম।
মধুজা সেন বললেন, তার মানে কী…
সুনয়না উত্তর দিল, বোধহয় আমাদের কিউপিডের সেন্ট্রাল সিস্টেমটা হ্যাক হয়েছে। সেটা থেকেই এত কর্মকারখানা চলছে।
তাহলে?
সময় লাগবে ম্যাডাম। হ্যাক করা প্রোগ্রাম থেকে বেরিয়ে এসে নতুন করে প্রোগ্রামটা করতে হবে। তবে ব্ল্যাক হ্যাট হ্যাকারদের প্রোগ্রামিং করা সিস্টেমটা ব্রেক করে আবার নতুন করে সিস্টেম প্রোগ্রামকে রান করা বেশ টাফ।
কথাটা শুনে মধুজা সেনের মুখে একটা বিষাদের ছায়া নেমে আসে। তার মধ্যেই আবার তাঁর ফোনটা ট্যাঁ ট্যাঁ করে বেজে ওঠে, ওপার থেকে আওয়াজ আসে, কনগ্রাচুলেশন ম্যাডাম, ফার্স্ট কিউকিড বর্ন।
ভ্যাবাচ্যাকা মধুজা সেন প্রশ্ন করতে পারলেন না, ছেলে না মেয়ে?
ক্রাইসিস
ফোনে কথা আর সাক্ষাৎ একজিনিস নয়। এসে থেকে কাজের চাপে আর দেখা হয়ে উঠেনি কৃষ্ণার সঙ্গে। সে এই কোম্পানি ত্যাগ করেছে। কিউপিডের সমস্যাটা এতটাই জটিল হয়ে আছে তার সঙ্গে যুঝতেই দিনরাত এক হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সমস্যাটা মিটছেও না। হ্যাকারদের দাবিটাও প্রশাসনের পক্ষ থেকে মেনে নেওয়া হয়নি। তারা দাবি করেছিল, প্রমিথিউস পুরুষ বা নারী সকলের জন্য উন্মুক্ত হোক।
কোম্পানি উত্তর দিয়েছিল, প্রমিথিউসকে সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেবার জন্য প্রস্তুত করা হয়নি। চুক্তিপত্রে স্পষ্ট উল্লেখ আছে কোনোভাবেই পুরুষদের আনা যাবে না। প্রমিথিউস প্রশাসনও তাই এই ব্যাপারটাতে যথেষ্ট কঠিন।
মধুজা সেনকে চিন্তিত দেখায়। প্রশাসন কোম্পানিকে নির্দেশ দিয়েছে কিউপিডকে দ্রুত সমস্যা মুক্ত করার জন্য। এর জন্য প্রমিথিউস প্রশাসন তাদের সঙ্গে থাকবে। কৃষ্ণা যদি থাকত ভালো হত। সুনয়না দেখেছে সে খুব সহজেই সমস্যার কেন্দ্রবিন্দুতে ঢুকতে পারে। আর কিউপিডের ব্যাপারে তার অবদান ফেলে দেওয়ার নয়। মাঝে মাঝে ভাবে তার ব্যাপারে মধুজা সেনকে বলবে। তারপরে পিছিয়ে আসে, সঠিক কারণ না জেনে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া ঠিক হবে না।
আসলে কিউপিডের সেন্ট্রাল প্রোগ্রামিংটাকে এমনভাবে বদলে দেওয়া হয়েছে সেখানে কাউকে ঢুকতেই দিচ্ছে না। জরুরি ভিত্তিতে প্রমিথিউসে কিউপিডগুলোকে তুলে নেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। সেখানেও সমস্যা। অনেক মানুষই সেটা দিতে আগ্রহী নয়। অনেকগুলি বাস্তব সমস্যার মুখোমুখি এখন প্রমিথিউস প্রশাসন। সেইসব নিয়ে আদালতে মামলা হয়েছে। এটা না কি সাধারণ মৌলিক অধিকার রক্ষার লড়াই। প্রশাসন উভয় সঙ্কটে, তারা চুপ থাকাটা বাঞ্ছনীয় ভেবেছে। কিন্তু চুপ থাকাটা সমাধান নয়, উকিলই ভরসা।
সুনয়নার অফিসে গিয়ে কাজে মন লাগে না। মধুজা সেনের চেম্বারটা দোতলাতে। সুনয়না লিফটে করে নেমে এল সেখানে। মধুজা সেন সুনয়না দেখতেই বলল, কী হল? কোনো সমস্যা?
সুনয়না উত্তর দিল, না ম্যাম কোনো সমস্যা নেই। তবে আমার দু-দিন ছুটি দরকার। মাথাটা আমার হ্যাং হয়ে আছে। একটু রিফ্রেশ না হলে…
মধুজা সেন সুনয়নার কথাটা শেষ না করতে দিয়ে শুরু করলেন, ঠিকই। তোমার ছুটি দরকার এই তো?
সুনয়না হেসে ফেলল, হ্যাঁ ম্যাম।
ওকে দেন, ইনজয়। বাট ওনলি ওয়ান ডেজ।
থ্যাঙ্কিউ ম্যাম। কিন্তু আমি দু-দিনের কথা বলছিলাম।
মধুজা সেন বললেন, হ্যাঁ দু-দিনই হবে। পরশু উইক এন্ড।
সুনয়না লজ্জায় পড়ে গেল। তার কাজের চক্করে উইক এন্ডের কথা ভুলেই গেছিল। সে বেরিয়ে এল। গোরাকে বড্ড মিস করছে। দু-বেলা করে নিয়মমাফিক ফোনে একঘেয়েমি লাগে। একটা মানুষ পাশে থাকা আর দূরে থেকে দু-বার ফোন করে খবরাখবর নেওয়ার পার্থক্য অনেক। সামান্য স্পর্শ, একটুকরো অভিমান, চোখের চাওনি সব কিছু মনকে শান্ত রাখে। এখানে কোথায় কী? সর্বত্র অতৃপ্তি। না শুয়ে সুখ, না খেয়ে সুখ। প্রমিথিউস যেন দীপান্তরের সাজা। সুনয়নার চোখ ফেটে জল আসে, নিজেই স্বগোতক্তি করে, কবে এ সাজা শেষ হবে কে জানে? ভাবতে অবাক লাগলেও এটাই সত্যি এর জন্যই সুনয়না পৃথিবী ছেড়েছিল, অনিমেষকে ছেড়েছিল। এখনকার সঙ্গে তখনের পার্থক্য ইচ্ছা আর অনিচ্ছার।
***
কৃষ্ণার বাসস্থানটা এখন আলাদা জায়গায়। আগে অফিসের কাছেই ছিল। সুনয়না টিউবে গিয়ে একটা টিকিট কেটে ওয়েটিং এ বসল। এক্ষুনি ট্রেন চলে আসবে। ট্রেনগুলি সব এক কামরার, কিন্তু সবই ট্রাকে চলে। সেটাতে চেপে অপ্সরা ৬ তে নামলেই হবে। প্রমিথিউস গ্রহটাকে পুরোপুরি ব্যবহার করা হয়নি। কিছুটা অংশকে মনুষ্যবাসের উপযোগী করে তোলা হয়েছে। মোটামুটি ১০০০ বর্গকিমি জায়গাটাকে মোট দশটা জোনে ভাগ করা হয়েছে, অপ্সরা ১ থেকে রম্ভা বি পর্যন্ত। প্রথম দিকের তিনটে জোন অপ্সরা ১, মেনকা ১২, উর্বশী সি অফিস, আদালত, হাসপাতাল এইসব কাজে ব্যবহার করা হয়েছে, বাকিগুলো বাসস্থানসহ, আমোদ প্রমোদের জায়গা।
কৃষ্ণাকে ফোনটা করে বলল, আমি আসছি।
এখানকার ট্রেনগুলো বিশেষ বড়ো নয়। একটাই কামরা। গোটা কুড়িটা সিট। কোনো চালক নেই। প্রোগ্রামিং করা আছে এবং তার মাধ্যমেই চলে। ট্রেনে উঠে লিফটের মতো কোথায় যাবে সেটা টিপে দিলেই সেখানে ট্রেন দাঁড়িয়ে যাবে। দাঁড়ানোর পরে ইন্টারলকিং দরজা আপনিই খুলে যায়। ট্রেনগুলির ব্যাটারি সব হিমিরার আলোতে চার্জ হয়। সেই ব্যাটারিতেই ট্রেন চলে। শুধু ট্রেন কেন, প্রমিথিউসের সবকিছুই হিমারালোকের জন্য। সেই আলো অনেকটা সূর্যালোকের মতোই। সেই আলোটাকে কাজে লাগানো হয়েছে।
ট্রেন থেকে নেমে টিউব স্টেশন থেকে বেরিয়ে সুনয়না দেখতে পেল কৃষ্ণাদের অ্যাপার্টমেন্ট। পাশে পাশে আট-দশটি ঘর। একটু ছাড়া ছাড়া। ঘরগুলি এমনভাবে ডিজাইন করা রয়েছে সামনে থেকে দেখলেই ফুটবলের মতো লাগে। ফলে হিমিরার আলো খুব কম জায়গায় পড়ে। এছাড়া দুটি দেওয়াল, মাঝের অংশটা ফাঁকা। দেওয়ালগুলিতে বাইরের দিকে একধরনের টালি বসানো—যেগুলো আলোর প্রতিফলন ঘটায়। ফলস্বরূপ ঘরের তাপ নিয়ন্ত্রিত থাকে। এছাড়াও আছে ডাইনিং এর দেওয়ালে জালি বসানো। ঘরে রাখা আছে ঘর শীতল রাখার এক ধরনের গাছ। এই গাছটা এখানেই পাওয়া যায়। পৃথিবীতে ফিরে যাবার সময় সুনয়না গাছটি সঙ্গে করে নিয়ে গেছিল, বাঁচেনি। হিমিরার এক ধরনের শর্ট ওয়েভ তরঙ্গে এরা সংশ্লেষ করতে পারে। সূর্যের আলোতে সেই শর্ট ওয়েভটা নেই, তাই বাঁচেনি।
সুনয়না এগিয়ে গিয়ে বেলটা বাজাল। আর সেটা সুর করে বেজে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে কৃষ্ণা বেরিয়ে এল।
***
কেমন আছিস? সুনয়না প্রশ্ন করতেই কৃষ্ণা উত্তর দেয়। ঠিকই আছি, সমস্যা নেই। তবে একটু বমিভাব ছিল, কেটে গেছে। তোর খবর বল। গোরার খবর বল।
আমার আর কী! এখানে একদমই ভালো লাগছে না। পেটের দিকে তাকিয়ে আরও বলে, এর জন্য মাঝে মাঝে ট্রাবল হচ্ছে বাট ডাজ নট ম্যাটার। তোর বেবি বাম্পটা বেশ হয়েছে। আর গোরার কথা, কী আর বলব? আঁকা, এক্সিবিশন এইসব নিয়ে বেশ আছে।
কৃষ্ণা উত্তর দেয়, হ্যাঁ রে। সময় তো হয়ে এল। ডাক্তার বলেছেন আট মাসেই তুলে নেবেন। সাত মাস চলছে। বাচ্চার গ্রোথ যথেষ্ট ভালো। আট মাসেই পূর্ণাঙ্গ রূপ পেয়ে যাবে।
সুনয়না অবাক হয়ে বলে, আট মাসেই?
হ্যাঁ রে। আয় ভিতরে আয়, তোকে দেখাই।
ভিতরের দিকটা বেশ ছিমছাম। ডাইনিং, লিভিং, আর বেড রুম মিলে সর্বমোট তিনটে ঘর। রান্নাঘর আলাদা। সব ঘরেই স্কাই লাইটের ব্যবস্থা আছে। তাতে ঘরগুলো বেশ আলোময়। লিভিং রুমে বেশ কিছু ইন্সট্রুমেন্ট রাখা আছে। তার মধ্যে একটা আধুনিক USG মেশিন। লিভিং রুমের সোফাতে গা’টা এলিয়ে বসল সুনয়না। সামনেই একটা চেয়ারের উপরে বসে কৃষ্ণা তার পেটের আল্ট্রাসোনোগ্রাফি করতেই স্পষ্টভাবে বেবিটা দেখা গেল। মেশিনটা বেশ আধুনিক। পুরো বেবির ডিটেলস দেখিয়ে দিচ্ছে। বোঝাই যাচ্ছে সেটার পূর্ণাঙ্গরূপ পেতে দেরি নেই।
কৃষ্ণা বলে, আয় তোরটা দেখি।
সুনয়না বলে, থাক। পরে দেখবি। এখন আয় দুটো কথা বলি। প্রথমে বল কাজের জায়গা থেকে এতটা দূরে এলি কেন? তারপরে বল, কাজটা ছাড়লি কেন? তুই ছাড়া প্রোগ্রামিং এর বিষয়টা দেখা কতটা কষ্টের তা তো তুই জানিস।
কৃষ্ণা একটা মলিন হাসি হেসে বলে, সব জানতে পারবি ধীরে ধীরে, এখন থাক।
***
প্রমিথিউসের আদালত চত্বর। সুনয়নাকে নিয়ে এসেছেন মধুজা সেন। কিউপিডের কোম্পানির প্রমিথিউসের কর্ণধার হিসেবে মধুজা সেন এসেছেন। আসবার আগে সুনয়নাকে একবার মাত্র বলেছেন, হয়তো তোমাকে প্রশ্ন করতে পারে, খুব ভেবেচিন্তে উত্তর দেবে। সুনয়না একটু ভড়কে গিয়ে জিজ্ঞেস করেছিল, আমাকেও? মধুজা সেন অভয় দিয়ে বলেছিলেন, ভয় নেই। তবুও আদালত শুনলেই সুনয়নার মনটা ভড়কে যায়।
সমস্যা শুরু হয়েছিল কিউপিডকে তুলে নিতে গিয়ে। কিছুজন কিউপিডকে নিঃশর্তে সংস্থার অফিসে জমা দেন। কিন্তু ‘দ্য ওয়াল’ আদালতে মামলা করেন। বলেন, এটা না কি তাদের মৌলিক অধিকার খর্ব হচ্ছে। আজকে তার ফার্স্ট ট্রায়াল।
ওয়ালের উকিল বলছেন, কোম্পানি ইচ্ছাকৃতভাবে সার্ভিসিং এর সময় কিউপিডকে ত্রুটিযুক্ত করেছে যাতে তাদের লভ্যাংশ বাড়ে। কোম্পানির এগ্রিমেন্টে ছিল কিউপিডের কোনোরকম ত্রুটির দায়ভার কোম্পানির। তাহলে আমাদের প্রশ্নের সঠিক জবাব না পেলে তারা কীভাবে কিউপিডকে কোম্পানির হাতে তুলে দেবেন?
মধুজা সেনের কাছ থেকে মামলার পিটিশনটি নিয়ে পড়তে থাকে সুনয়না। পিটিশনকারীরা আবার দুই দলে বিভক্ত। একদল আছে তারা গর্ভপাতে আগ্রহী আর একদল বাচ্চা নিতে। সংঘাত দিন দিন বেড়েই চলে। আইন শৃঙ্খলার চরম অবনতি হয়। ওইটুকু সময়ে প্রায় চল্লিশ পৃষ্ঠার পিটিশনটিকে পুরোপুরি পড়া সম্ভব হয় না। যেটুকু পড়া সম্ভব সেটুকুতে বুঝতে পারে পিটিশনকারীদের কমন প্রশ্নগুলি হল, ১) কিউপিডকে আদেও কি সারানো সম্ভব? ২) সারনো হলে, তার সময়সীমা কত? ৩) তার গ্রহণযোগ্যতা কী পরে একই রকম থাকবে? ৪) যে প্লেজার এতদিন কিউপিড দিয়ে এসেছে তার কি রদবদল হবে? ৫) সর্বোপরি এই সার্ভিসিং এর ব্যয়ভার কে গ্রহণ করবে?
এবারে যারা গর্ভপাত করাতে চায় তাদের উকিলের দাবি, গর্ভসঞ্চারের ফলে তাদের মক্কেলের শারীরিক ক্ষতি হয়েছে, তাই মোটা অঙ্কের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। আর যারা বাচ্চা নেবে তাদের জিজ্ঞাস্য যেসব বাচ্চা জন্মাবে তাদের ভবিষ্যৎ কী? ছেলে হলে কী হবে আর মেয়ে হলেই বা কী হবে? কীভাবে তাদের সঙ্গে ট্রিট করা হবে? যদিও সুনয়না বুঝতে পারে এই প্রশ্নগুলির উত্তরটা কোম্পানি এড়িয়ে যাবে কারণ অনেক প্রশ্ন প্রমিথিউস প্রশাসনের অন্তর্গত।
কোম্পানি কোনো প্রশ্নেরই উত্তর দেয়নি। তারা সময় চেয়েছে। ব্যবসায়িক ক্ষতি কোনো কোম্পানিই চাই না। অতএব চুপ করে থেকে কোম্পানি ভেবেছিল একটা সময়সীমা বেঁধে দিয়ে কোম্পানি কিউপিডগুলিকে তুলে নেবে। কিন্তু বাধ সাধল একটি সংগঠন, দ্য ওয়াল। এর ফলস্বরূপ একটা জনস্বার্থ মামলা এবং আজ আদালতে তার ট্রায়াল। পাবলিক প্রসিকিউটর মধুজা সেনকে প্রশ্ন করতে চেয়ে আদালতে আবেদন করেন। মহামান্য আদালত তা মঞ্জুর করেন।
বাস্তবিকই মধুজা সেনের কাছে কোনো উত্তর থাকে না। তিনি চুপ করে থাকেন। একটা কথা বুলি আওড়ানোর মতো বলে যান, কোম্পানির বোর্ড মিটিং এখনও নির্দিষ্ট হয়নি। বোর্ড এইসব ব্যাপারে ডিসিশন নেবে। এরপরে ডাক পরে এক্সপার্ট হিসেবে সুনয়নার। প্রসিকিউটর প্রথমেই তাকে জিজ্ঞাসা করেন, কিউপিডকে কি সারানো সম্ভব?
সুনয়না উত্তর দেন, অবশ্যই।
প্রসিকিউটর আবার প্রশ্ন করেন, আপনি তো কিউপিডের স্রষ্টা। কিউপিডের হয়েছে কী, আপনি কী আদালতে বলতে পারবেন?
সুনয়না অল্পকথায় উত্তর দেয়, না স্রষ্টা আমি নই। আমি কিউপিডকে ডেভলপ করেছি মাত্র। এখন এই সমস্যার কারণ হিসেবে আমি যেটুকু বুঝেছি তা হল কিউপিডের স্পার্মের চরিত্রের বদল হয়েছে ফলে আমাদের জেন্টলওম্যানেরা কন্সিভ করে ফেলছেন।
আবার প্রশ্ন আসে, কেন এমন হল?
সুনয়না বলে, কোনোভাবে কিউপিডের সিস্টেম প্রোগ্রামিং হ্যাক করে নন অ্যাক্টিভ স্পার্মের চরিত্র বদল করে অ্যাক্টিভ করে দেওয়া হয়েছে যা ফার্টিলাইজেশনের অন্যতম কারণ।
পাবলিক প্রসিকিউটর জিজ্ঞাসা করেন এবারে, কিউপিডকে নন অ্যাক্টিভ স্পার্মে ফিলিং করা হয়, তাহলে তা অ্যাক্টিভ হচ্ছে কী করে?
হ্যাকিং করে সেই নন অ্যাক্টিভ করার জন্য যে রাসায়নিকটিকে ব্যবহার করা হয় তা কিউপিডের মধ্যে এসে কার্যক্রম হারাচ্ছে।
এর জন্য দায়ী কে? কোনো ভিতরের লোক? তাদের দাবিটাই বা কী?
প্রশ্নটা আসতেই কোম্পানির প্রসিকিউটর উঠে দাঁড়িয়ে বলেন, অবজেকশন মাই লর্ড। বন্ধু আমাদের কোম্পানির ভিতর ভাঙন ধরানোর চেষ্টা করছেন।
মহামান্য আদালত পাবলিক প্রসিকিউটর নির্দেশ দেন, আপনি সংযত হয়ে প্রশ্ন করুন।
সুনয়নার কাছে একই প্রশ্ন একটু অন্যভাবে আসে। সুনয়না জবাব দেয়, আমি ওই সময়টাতে পৃথিবীতে ছিলাম। তদন্ত চলছে, তদন্ত শেষ হলে পুরোটা বোঝা যাবে।
এরপরে সামান্য প্রশ্নোত্তর পর্বের আদালত কোম্পানিকে নির্দেশ দেয়, আগামী ত্রিশ দিনের মধ্যে হলফনামা জমা দিতে। সেই সঙ্গে প্রশাসনের অবস্থানও পরিষ্কার করতে নির্দেশ দেওয়া হয়। সেদিনের মতো আদালত ওখানেই মুলতুবি হয়। সুনয়নারা বেরিয়ে আসে।
***
আদালত থেকে ফেরবার পথে মধুজা সেন বলেন, চল আজ একসঙ্গে লাঞ্চ করি। সুনয়নারও কিছু জিজ্ঞাস্যর আছে। কৃষ্ণা কেন এই জব ছাড়ল তার উত্তরও অজানা। এই সুযোগে দু-একটা প্রশ্ন মধুজা সেনকে করা যাবে হয়তো বা তাকে ফেরানোর কথাও বলা যাবে। তবে আশ্চর্যের কথা কৃষ্ণাও ফেরার ব্যাপারে খুব একটা আগ্রহী বলে মনে হল না।
রেস্তোরাঁটা খোলা জায়গায়। বেশ সুন্দর জায়গাটা। ছিমছাম খোলা প্রান্তর। সামনে লাল পাহাড়। পৃথিবীর ল্যাটেরাইট মাটির মতোই একবারে। বেশ কিছু গাছ রয়েছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। কিছু চেয়ার টেবিল পাতা আছে। পড়ন্ত বেলা, হিমিরার আলো কমে আসছে। এই সময়টাতে আকাশটা অদ্ভুত রকমের লাল হয়ে যায়। মনে হয় কেউ যেন আকাশের গায় আলতা ঢেলে দেয়। মধুজা সেন খাবারের অর্ডার করলেন। খাবার টেবিলে সুনয়না প্রশ্ন করল, ম্যাডাম দ্য ওয়াল কবে গঠিত হল?
মধুজা সেন বলেন, তুমি যাওয়ার পরপরই নিজেদের অধিকার রক্ষার জন্য একটা সংগঠনের দাবি ওঠে। এবং একসময় সেই সংগঠনে আদালত সিলমোহর দেয়। এই আন্দোলনের জন্যই কৃষ্ণা চাকরি ইস্তফা দেয় বা দিতে বাধ্য হয়। সে তো এই সংগঠনের মূল কর্মকর্তা।
তাহলে হ্যাকার আর এই সংগঠন কী…
মধুজা সেনকে পুরোপুরি প্রশ্নটা করতে হল না, তিনি উত্তর দিলেন, হয়তো বা আছে, সরাসরি না হলেও ইন্ধন আছেই আছে।
কৃষ্ণাকে জিজ্ঞেস করলে সেও ব্যাপারটা একবারে এড়িয়ে গেছিল। মধুজা সেনের কাছে কৃষ্ণার কথা শুনে সুনয়নার আগ্রহ জন্মায়। সে আরও আগ্রহী হয়ে ওঠে। এদিকে খাবারও চলে আসে। মধুজা সেন বলেন, খেয়ে নিই চল।
সুনয়না বলে, তাহলে কৃষ্ণা যখন ইস্তফা দেয় তখন কি সে কনসিভ করেছে?
মধুজা সেন মুখে খাবারটা ভরতে ভরতে বলেন, বোধহয়।
সুনয়না কৌতূহলী হয়ে ওঠে। কিন্তু মধুজা সেনকে আর কোনো প্রশ্ন করে না। তাহলে আসল ব্যাপারটা কী? প্রোগ্রামিং এর ব্যাপারে কৃষ্ণা যথেষ্ট পারদর্শী, তাহলে কী হ্যাকিংটা… সে আর ভাবতে পারল না, খাওয়াতে মনোযোগ করল।
সলিউশন
অবশেষে সমস্যা মিটল। অবশ্য সমস্যাটা একা মেটানো সুনয়নার পক্ষে সম্ভব ছিল না। হ্যাকিং এর ব্যাপারটা এত ভালো সুনয়না বোঝে না। আবার তাদের কোম্পানির হ্যাকাররাও কিছুতেই কিউপিডের মেন প্রোগ্রামে ঢুকতে পারছিলেন না। কৃষ্ণাও কোম্পানিতে নেই। আর ফোর্সফুলি ঢুকতে গেলে পুরো সিস্টেমটা ক্রাক করে সম্ভাবনা প্রবল, তাই মধুজা সেনও তা অনুমতি দিতে পারছিলেন না। তাই একটা মিটিংএ তিনি বললেন, ফোর্সফুলি ছাড়া অন্য কিছু ভাব। কিউপিডকে তো কোনোভাবেই কার্যক্ষমতাহীন বলা যাচ্ছে না। তার শুধুমাত্র কিউপিডের মধ্যে এসে স্পার্ম লিক্যুইডটা তার চরিত্র বদল করছে, এছাড়া কাজের দিক দিয়ে সে পুরোপুরি ফিট। একটা প্রিকশন নিয়ে তাকে ব্যবহার করলে কোনো সমস্যা নেই। তাই আমার মত হ্যাকারদের সিস্টেমকে হ্যাক কর।
সুনয়নারও ফোর্সফুলি সিস্টেমের মধ্যে ঢুকতে মতো ছিল না। অগত্যা সে ফোন করল, রবিনকে। রবিন তার অনেক দিনের বন্ধু। অনেক কাজে বরাবর তাকে সাহায্য করে এসেছে।
রবিন আবার প্রমিথিউসে সরাসরি আসতে পারবে না। কিন্তু তাকে যখন সমস্যার কথাটা সুনয়না বলে তখন সে বলে, দ্যাখ সুনয়না প্রাকটিক্যালি না দেখলে আমি সমস্যাটা মেটাতে পারব না। এখন তোমাদের সামনে দুটো পথ খোলা, হয় কিউপিডের সেন্ট্রাল সিস্টেমকে পৃথিবীতে নিয়ে আসা, নয়তো আমাকে ওখানে নিয়ে যাওয়া।
কথাটা মধুজা সেনকে বলতেই তিনি বলেন, একটু ভাবতে সময় দাও। পরক্ষণেই তিনি বলেন, আমাদের হ্যাকাররা কী জন্য আছে?
সুনয়না বলেছিল, আমাদের হোয়াইট হ্যাট হ্যাকাররা যে ব্যর্থ সেটা তো বোঝাই যাচ্ছে। আপনি তো জানেন যারা কিউপিডের সিস্টেমকে হ্যাক করেছে তারা ব্ল্যাক হ্যাট হ্যাকার। ওরা এমনভাবে সিস্টেমকে করে রেখেছে কোনোভাবেই সেটা আমাদের কন্ট্রোলের মধ্যেই নেই।
আচ্ছা আমাকে একটু সময় দাও। তা ছাড়া আমি কেবল অনুমতি দিলেই তো হবে না। প্রমিথিউস প্রশাসনকে জানাতে হবে, আদালতের অনুমতি নিতে হবে।
সুনয়না ঘাড় নেড়ে বলে, জানি ম্যাডাম রবিন পুরুষ বলেই সমস্যাটা। এই রকম উচ্চমানের হোয়াইট হ্যাট হ্যাকার রবিন ছাড়া আমি আর কাউকে দেখছি না।
কিছুদিন প্রশাসন থেকে রবিনের প্রমিথিউসে আসার জন্য আদালতে অনুমতির আবেদন নেওয়া হয়। সেইদিন ভরা কক্ষে শর্তসাপেক্ষে রবিনের প্রমিথিউসে আসার অনুমতি হয়। সেই সঙ্গে কোম্পানির পক্ষ থেকে হলফনামাও দেওয়া হয়। বলা হয়, কিউপিডের তারা নতুন ভার্সন নিয়ে আসবে—কিউপিড ২.০। বিনা খরচে সমস্ত কিউপিডের সার্ভিসিং এবং নতুন ভার্সন আপডেট করে দেওয়া হবে। যারা তাদের শরীর নিয়ে চিন্তিত তাদেরকেও ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে। খুব সত্ত্বর কাজ শুরু হবে, যদি প্রমিথিউসের সমস্ত নারী কোম্পানিকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়। সেইসঙ্গে কিউপিডের সিকিউরিটি সিস্টেমকেও ঢেলে সাজানো হচ্ছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাদের উকিল জানান, কিউকিডদের সম্পর্কেও ভাবা হচ্ছে। যেহেতু তারা প্রমিথিউসে জন্মাচ্ছে তাই ছেলে হোক বা মেয়ে হোক এখানেই বেড়ে উঠবে। তাদের জন্য নতুন করে আবার এই গ্রহটাকে আবার সাজানো হবে। এবং সেই প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে।
জাজের মুখ দেখে মধুজা সেন বুঝতে পারলেন, বরফ গলেছে। জাজ বলতে শুরু করলেন, সমস্ত দিকগুলি বিবেচনা করে রবিন নামে হ্যাকারকে এখানে আসার অনুমতি দেওয়া হচ্ছে। তবে কিউপিডের সমস্যাটা মিটলেই সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে ফিরে যেতে হবে। এছাড়া প্রমিথিউসের সমস্ত নারীদের অনুরোধ করছি কোম্পানির হাতে তাদের ডিফেক্টিভ কিউপিডকে তুলে দেওয়ার জন্য। এক বছরের মধ্যে জমা পড়া সমস্ত কিউপিডকে আবার তাদের কাছে ফিরিয়ে দিতে বাধ্য থাকবে কোম্পানি। তার মধ্যে কোম্পানি যদি তাদের কাজ করে উঠতে না পারে তাহলে দৈনিক ৫০ থিউস করে আর্থিক ক্ষতিপূরণ দিতে কোম্পানি বাধ্য থাকবে। এক থিউসের মূল্য প্রায় পঁয়তাল্লিশ ডলারের সমান।
কোম্পানির উকিল বিনা বাক্যব্যয়ে কথাটি মেনে নেন। রবিনের প্রমিথিউসে আসার বাধা কেটে যায়।
***
সুনয়না স্পেসস্টেশনে দাঁড়িয়ে ছিল। রবিন দেখতে কোনো সময়ে সুপুরুষ ছিল না। লম্বমতো হাড় গিলগিলে চেহারার একটা ছেলে। তবে মাঝের অনেক ক-বছর দেখা হয়নি। এখন একটু পালটালে পালটাতে পারে। যাইহোক ঘোষণা হয়ে গেল, স্পেসশিপ এবারে ল্যান্ড করবে। কোম্পানি রবিনের জন্য কোনোদিকেই কমতি রাখেনি। তার এখানে ব্যবহারের গাড়ি, বাংলো সবই রেডি করে রেখেছে। তার সঙ্গে থাকছে ভালো রকমের আর্থিক সুবিধা। এখন দরকার হ্যাকার সিস্টেমকে ক্রাক করা। আর তার জন্যই রবিন।
সুনয়না দেখতে পেল সে বের হচ্ছে। মুখের আদল একই থাকলেও একটু মোটা হয়েছে। মাথাটাতে বেশ টাক পড়েছে। সুনয়নাকে দেখতে পেয়েই সে হাত নাড়ল। সুনয়নাও উত্তর দিল।
হাই।
হ্যালো।
সুনয়নার পেটের দিকে তাকিয়ে রবিন বলল, ইউ আর এক্সপেক্টিং অ্যা বেবি। হাউ ফিল?
ইটস গুড। চল গাড়িতে যাওয়া যাক। স্পেসল্যাগের ধকল গেছে। একটু রেস্ট নিয়ে নাও। আগামীকাল থেকেই আবার শুরু করে দিতে হবে।
তা তো বটেই।
রবিনকে তার বাংলোতে পৌঁছে দিয়ে সুনয়না বলল, ইউ নো, ইউ আর দ্য ফার্স্ট ম্যান ট্যু কাম প্রমিথিউস।
রবিন একটা গর্বের হাসি হেসে বলল, দ্যাটস গুড।
সুনয়না পরে বলল, টেক রেস্ট। সি ইউ।
রবিনকে পৌঁছে দেওয়ার পরে নিজেকে একটু হালকা বোধ হল সুনয়নার। এই ক-দিন ধরে দৌড়ঝাঁপ কম হয়নি। আজ মনে হলে একটু খোলা হাওয়াতে নিজেকে মেলে ধরা দরকার। বড্ড মনে পড়ছে গোরাকে। ফোনে গোরার নম্বরটা ডায়াল করে, সে কানে দিল ফোনটা। সুনয়নার খুব বিরক্ত লাগছিল। এখনও কেন যে গোরা ফোনটা ধরছে না কে জানে! সে মনে মনে বলতে থাকে, গোরা প্লিজ পিক আপ দ্য ফোন, ব্যাডলি নিডস্ ইয়্যু।
কিন্তু সময় থেমে থাকে না। গোরার ফোন কেটে যায়। একটু দুশ্চিন্তা হয় তারপরেই ভেবে নেয় নিশ্চয় সে কোনো কাজকর্মে ব্যস্ত।
***
সুনয়নার যাওয়া থেকে মনটা খুব খারাপ হয়ে আছে গোরার। খবরটা শোনার পরে ভেবেছিল বাবা হওয়ার প্রত্যেক মুহূর্তের অনুভূতি সে অনুভব করবে। কিন্তু সব কিছু তো আর চাইলেই পাওয়া যায় না। এমন একটা জায়গায় সুনয়না আছে যে সে হাজার চাইলেও তা পাবে না। ফোনটা রিং হয়ে গেলেও তার আর ধরতে ইচ্ছে করে না। ক্রমাগত বেশ কয়েকবার রিং হয়ে যাবার পরে কেটে যায়। ক্যানভাসে কালি ছিটিয়ে বিষাদসিন্ধু আঁকে। অনেকক্ষণ পরে সে আবার কলব্যাক করে। ওপার থেকে আওয়াজ আসে, ধরলে না কেন আমার ফোনটা?
গোরা চুপ থাকে। তার ইচ্ছে করছে সুনয়নার কাছে যাওয়ার। তার পেটে মাথা দিয়ে বাচ্চাটাকে একটু অনুভব করার। সুনয়না আবার বলে, রাগ করেছ?
আধো আধো গলায় এবারে গোরা উত্তর দেয়, খুব মন খারাপ। আমার কিছু আর ভালো লাগছে না।
সময় যত এগিয়ে আসে দুশ্চিন্তা তত বাড়ে। আর মাত্র একটি মাস। তারপর নবজাতক আসবে। তার একান্ত আপন। কনসিভ করার একটি মাসের পর থেকেই এখানে। আর প্রায় সাতটি মাস সে পৃথিবী ছাড়া। গোরার দুঃখটা সেও বোঝে। কিন্তু সেও নিরুপায়, কী করবে? এখানে আসার শর্তটাই এমন ছিল। সে তাকে প্রবোধ দেয়, আমি খুব তাড়াতাড়ি ফিরছি।
আনন্দে গোরা জিজ্ঞেস করে, কবে?
খুব তাড়াতাড়ি। আশা করি বাচ্চাটা ওখানেই হবে।
কল শেষ করার পরে সুনয়না ভাবতে থাকল, কথাটা তো দিল, রাখতে পারবে তো?
***
অবশেষে রবিন সফল। টানা পাঁচ দিন একনাগাড়ে কাজ করার পরে কিউপিড মুক্ত। কোন আইপি এড্রেস থেকে হ্যাকিং হয়েছিল তাও সমস্ত তথ্যসহ কোম্পানিকে তুলে দেওয়ার পরে মধুজা সেনের চেম্বারে রবিন এসে বলল, আমরা পেরেছি। পুরো সেন্ট্রাল সিস্টেমকে হ্যাকারদের কবল থেকে মুক্ত করা গেছে।
কনগ্রাচুলেশন। এবারে আমাদের সিস্টেমকে আরও উন্নত করতে হবে। এই ব্যাপারে তোমার সাহচর্য একান্ত প্রয়োজন। কোম্পানির ইচ্ছে তুমি আমাদের প্রোজেক্টের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যাও।
কিন্তু কীভাবে? এখানে তো আমার থাকা যাবে না।
নতুন ব্যবস্থাতে আমরা কীরকম কিউপিডকে করতে চলেছি তার সম্পূর্ণ ব্যাখ্যা পাঠিয়ে দেওয়া হবে। পৃথিবী থেকেই তুমি আমাদের কিউপিডের সিস্টেমকে উন্নত করার কাজ করতে থাকবে, আমাদের কিউপিড ২.০ লঞ্চ হতে চলেছে, সেখানের প্রোগ্রামিং এমন অবস্থায় রাখতে হবে যাতে করে কোনভাবেই কেউ যেন হ্যাক না করতে পারে, সেই বিষয়ের উপরেই তোমাকে কাজ করতে হবে। কিন্তু তার আগে কিছু ফর্মালিটি পূরণ করতে হবে।
রবিন কিছুটা সময় চেয়ে নিয়ে বলে, আপাতত আমার যাওয়ার ব্যবস্থা কী হবে?
আগামী সপ্তাহে তোমার স্পেসশিপ। সুনয়না এই মাঝের সাতদিন তোমাকে হেল্প করবে।
সুনয়না পাশ থেকে বলে, আমিও পৃথিবী ফিরে যেতে চাই। আমাকেও সেখানে গিয়ে কাজটা করতে দিলে ভালো হয়। আমাদের প্রথম নবজাতক আসছে, আমি চাই না সে বাবার অনুপস্থিতিতে ভূমিষ্ঠ হোক।
মধুজা সেন হাসলেন। তারপর উত্তর দিলেন, আচ্ছা দেখছি।
***
মেয়েটার নাম রেখেছে ভেনাস। গ্রিক দেবতারা সুনয়নার জীবনের সঙ্গে এমনভাবে জড়িয়ে গেছেন তাই মেয়ের নাম গ্রিক দেবতার নাম অনুসারে রেখেছে সে। গোরার কোলে ভেনাস খিলখিল করে হাসছে। সুনয়না দিন রাত এক করে কাজ করে যাচ্ছে। আর একমাসের মধ্যে কিউপিড ২.০ কে বাজারে নামাতে হবে। বাচ্চা হওয়ার পরে একমাস রেস্ট পেয়েছিল তারপরেই কাজে নামতে হয়েছে তাকে। এক বছরের মধ্যে কিউপিড ২.০ কে প্রমিথিউসের নারীদের হাতে তুলে দিতে না পারলে কোম্পানিকে মোটা অঙ্কের জরিমানা দিতে হবে।
ওদিকে তদন্তও শেষের দিকে। রবিনের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী তদন্ত হয়েছে। খুব তাড়াতাড়ি তাদের আদালতে তোলা হবে। দ্য ওয়ালের কিছুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তার মধ্যে কৃষ্ণাও রয়েছে। কিউপিডের সেন্ট্রাল সিস্টেমকে হ্যাক করা সেখানের আইনবিরুদ্ধ। দ্য ওয়ালের সঙ্গে হ্যাকারদের সরাসরি সম্পর্ক প্রমাণিত হওয়ায়, প্রশাসন সংগঠনকে নিষিদ্ধ করার আবেদন করেছে। দ্য ওয়ালের উকিল এই ব্যাপারটি নিয়ে জোর সওয়াল করেছিল। কিন্তু জাজ নরম হননি। কড়া নির্দেশ দিয়ে বলেছেন, নৈতিক অধিকারের লড়াইয়ে অপরাধ করলে তা মেনে নেওয়া যেমন যায় না তেমন অপরাধের মাত্রাও ছোটো হয়ে যায় না। গ্রেপ্তার হওয়া প্রত্যেকেই সংগঠিত অপরাধ করেছেন। তারা অপরাধী। এর ফলে প্রত্যেককে পাঁচ বছর করে সংশোধনাগারে থাকতে হবে এবং কুড়ি হাজার থিউস করে জরিমানা কোম্পানিকে মেটাতে হবে। তার সঙ্গে সংগঠনটি যেহেতু এই অপরাধে মদত দিয়েছে তাই আগামী দশ বছরের জন্য সংগঠনটিকে নিষিদ্ধ করা হল।
খবরটা শোনার পর থেকে সুনয়নার মনটা খারাপ। কৃষ্ণা তার কাছের বন্ধু ছিল। কয়েকদিন আগে সে বলেছিল, প্রমিউথিসের বাতাবরণ বদলে এছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না। আমাদের গ্রেপ্তার বা সাজা হলেও আমাদের উদ্দেশ্য সফল। আমাদের বিপ্লব মাঠে মারা যায়নি। আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম যন্ত্র নিয়ে বড়ো হবে না। তাদের সঙ্গীদের মন থাকবে। নারীপুরুষ মিলিত হয়ে এক নতুন প্রমিথিউসের জন্ম হবে।
কৃষ্ণার কথার পরে সুনয়না প্রশ্ন করল, তোরা এটা কেন করলি?
একাকীত্ব, যে একাকীত্বে তুই চলে এসেছিলি। সেই একাকীত্বের দূর করার জন্য গড়ে উঠেছিল, আমাদের সংগঠন—দ্য ওয়াল। আমরা কোম্পানি এবং প্রশাসনকে বহুবার অনুরোধ করেছিলাম, এখানে না হোক বছরে অন্তত দু-বার পৃথিবীতে পুরুষ সঙ্গীর কাছে পাঠানো হোক। তারা কেউই বিষয়টি মানতে চাইনি। তাদের যুক্তি প্রমিথিউস নাকি চিরকাল পুরুষবর্জিতই থাকবে। এতে আমাদের মানসিক সমস্যা তৈরি হচ্ছিল। তাই দ্য ওয়াল থেকে ঠিক হয়েছিল সিস্টেমের বদল করতে হবে। আমি তো জানতাম কীভাবে বদল করতে হবে, কী বদল করতে হবে? এবং তারপরেই আমি আর আমার কয়েকজন সঙ্গী মিলে স্পার্মকে নিয়েই খেল দেখিয়ে দিলাম। এতেই হেলে গেল কোম্পানি, প্রশাসন।
সুনয়না আর কথা বলতে পারে না, সরাসরি না বললেও মনের দিক থেকে কৃষ্ণা সহ বাকিদের ধন্যবাদ দিল।
এবারে প্রমিথিউসের প্রশাসন নতুনদের জন্য অনেক কিছুই ভেবেছে। সেখানে কিউকিডদের জন্য গড়ে উঠেছে প্লে স্কুল থেকে সবকিছু। তবুও সেখানের নাম শুনলেই তার মনটা ভয় পেয়ে যায়। সে কোনোভাবেই আর সেখানে ফিরে যেতে চায় না। রবিন বলে, ওখানে গেলে অসুবিধা কী? আমার তো বেশ লেগেছে।
সুনয়না আড়চোখে তাকায়। তারপর ইয়ার্কির ছলে উত্তর দেয়, তা তো লাগবেই।
আবার কাজে তারা ডুবে যায়। রবিন বলে, আর কয়েক দিনের মধ্যে আমরা সফল হয়ে যাব।
প্রোগ্রামিংটা দুইভাবে হচ্ছে। অর্থাৎ দুইভাবে কিউপিডকে ব্যবহার করা যাবে। কেউ যদি কিউকিড নিতে চায় তাহলে সেই ব্যবস্থাকেও খোলা রাখা হচ্ছে। তারা তখন অ্যাপের মাধ্যমে নন অ্যাক্টিভ স্পার্মকে অ্যাক্টিভ স্পার্মে কনভার্ট করে নিলেই হল। মধুজা সেনের সঙ্গে কথা হয়েছে, তিনি বলেছেন, ওখানেও নতুন ভার্সেনের কিউপিডের স্ট্রাকচার সব রেডি। প্রোগ্রামিংটা ইন্সটল হয়ে গেলেই তারা আবার কিউপিডদের বিতরণ করে দেবে। আদালতেও সেইমতো সমস্ত কিছু জানানো হবে।
***
আদালতের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে দুই হাজার নারীর হাতে নতুন ভার্সেনের কিউপিড ২.০ কে তুলে দেওয়া হয়েছে। তাঁরা সাত দিন ধরে ব্যবহার করে আদালতে গোপন জবানবন্দি দেবেন।
আজ আদালতে সেইসব প্রতিনিধি এবং কোম্পানির লোকেরা উপস্থিত। গোপনে জাজ নতুন কিউপিড ২.০ হাতে পাওয়া নারীদের সঙ্গে কথা বলেছেন।
কোম্পানির উকিল শুরু করলেন, আমরা আপাতত দুই হাজার কিউপিডকে তাদের মালিকানার কাছে তুলে দেওয়া হয়েছে। আগামী এক মাসের মধ্যে বাকিদের হাতেও তুলে দেওয়া হবে।
সাধারণ নারীদের পক্ষের আইনজীবীও বললেন, আমাদের নারীরা নতুন ভার্সেনের কিউপিড ২.০ নিয়ে কোনো অভিযোগ করেননি। অতএব আমাদেরও নতুন ভার্সেনের কিউপিডকে নিয়ে কোনো অভিযোগ নেই।
জাজ অবশেষে বললেন, বাচ্চার জন্ম দেওয়া নারীদের তাদের মৌলিক অধিকারের মধ্যে পড়ে। কোম্পানি এই ব্যাপারটা মাথায় রেখে নতুন মডেলের যে কিউপিড তৈরি করেছে তা বেশ ভালো লাগল। প্রশাসনকেও অভিনন্দন, তাদের নতুনভাবে প্রমিথিউস গড়াকে স্বাগত। তা ছাড়া জগৎ পরিবর্তনশীল। আমরাও সেই জগতের বহির্ভূত কোনো জাতি নই। তাই পরিবর্তন আমাদের প্রমিথিউসেও ঘটুক। কিউবয় এবং কিউগার্লেরা নতুন প্রমিথিউস গড়ে তুলুক।
হাততালির মাধ্যমে জাজের কথাকে স্বাগত জানাল উপস্থিত সভ্যারা। মধুজা সেন আদালতের বাইরে এসে সুনয়নাকে ফোন করলেন, আসবে না কি নতুন প্রমিথিউসে?
ওপার থেকে কী উত্তর এল বোঝা গেল না, কিন্তু তিনি হাসতে থাকলেন উচ্চস্বরে।
Tags: নবম বর্ষ প্রথম সংখ্যা, বামাচরণ ভট্টাচার্য