স্ক্রিস মণির সন্ধানে
লেখক: মূল রচনা: জেম্স ম্যাককিমি জুনিয়র অনুবাদ: প্রতিম দাস
শিল্পী: টিম কল্পবিশ্ব
মূল কাহিনি: Where the god decide। প্রকাশিত হয়েছিল ‘Planet Stories July 1953’ সংখ্যায়।
স্যাঁতসেঁতে সমতলভূমি এবং বিক্ষিপ্ত জঙ্গল পার হয়ে অনেক উঁচুতে, ঝকঝকে পাথর আর চকচকে পাতার গাছেদের মাথা ছাড়িয়ে আছে এক মন্দির। প্রাচীনকালের অধিকাংশ মন্দিরের মতোই এর সরু গম্বুজ উঠে গিয়েছে আকাশের সীমানায়। শুক্রের মানুষেরা নিঃশব্দে এই মন্দিরের নীচের নিষিদ্ধ গোলকধাঁধাসম এলাকা দিয়ে হেঁটে যায়। তাদের ধূসর রঙের লম্বা হাতার পোশাকের ভিতর নড়াচড়া করে ব্যাঙের মতো চামড়ার পর্দাযুক্ত সবুজ আঙুল; ধূসর পোশাকের শিরাবরণের নীচে থাকা সবুজ মুখগুলোয় নেই কোনো অভিব্যক্তি। যদিও ওদের নড়াচড়া করতে দেখা যাচ্ছে। আপাদমস্তক ঢাকা মানুষগুলো সোনালি প্রাচীরের একেবারে শেষ প্রান্তে অবস্থিত একটা রুপালি গোলককে ঘিরে ঘুরে চলেছে। নড়াচড়া করছে বটে, কিন্তু তাদের পা ফেলা থেকে শোনা যাচ্ছে না কোনো শব্দ। হাতের সবুজ আঙুলগুলো প্রসারিত হচ্ছে, আবার মুষ্টিবদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। বাঁশির মতো একটা কণ্ঠস্বর বলে ওঠে, ‘স্ক্রিস’। আরও একজন সেই একই শব্দ উচ্চারণ করে ‘স্ক্রিস’। রুপালি গোলকটা একটা মেঘাচ্ছন্ন গ্রহের মতো নিশ্চল হয়েই থাকে। কোনো দ্যুতি দেখা যায় না। বারোজন মানুষের মন শুক্র গ্রহের বিশাল এলাকায় বিচরণ করে বেড়ায়। অনুসন্ধান করে, মন্দ এবং পবিত্রতার উৎসগুলোকে। পায়ের গতি বাড়তে থাকে, মুখগুলো একই রকম অভিব্যক্তিহীন। থমথমে ঘন বাতাস চিরে কমলা চোখের অধিকারী এক বিশাল মাপের কালো বিড়ালের গলা থেকে ভেসে ক্রমবর্ধমান তীব্র চিৎকার। পদচারণা থেমে যায়। পলকবিহীন চোখে সবাই তাকায়। “গ্রিথ?” উচ্চারণ করে একজন। আরও একজন সেই একই উচ্চারণ করে, “গ্রিথ?” আবার পদচারণা শুরু হয়। সবুজ ঠোঁট একটু হলেও কাঁপতে থাকে। মন খুঁজতে থাকে…
এ এমন এক ঋতু যখন শুক্রের বনাঞ্চল অস্পষ্ট, বাষ্পে ঢাকা জলাভূমিতে পরিণত হয়। সরু চকচকে লম্বা সাপের মতো ঝুলে থাকে তুষার। দ্রাক্ষালতার গা থেকে নীচের দিকে মুখ করে ঝোলে ভেজা পাতার দল। নিকোলাস কেইন তার কপালে ঘামের দানা জমার অস্তিত্ব অনুভব করে মুখের পাশটা মোছে। লক্ষ করে ফেয়ারচাইল্ডও ঘামছে। গায়ের জামা ভিজে কালচে দেখাচ্ছে। ক্লিপ দিয়ে শক্ত করে আটকানো চুলের গোছা লেপটে গিয়েছে গায়ের সঙ্গে। শুধু সাদা শার্ট এবং শর্টস-পরা মহিলাকে এখনও বেশ তরতাজা দেখাচ্ছে।
মহিলা কেইনের জেটকপ্টারের পাশেই দাঁড়িয়ে রুপোর গ্লাস থেকে স্কচ পান করছিলেন। আকাশযানটার বাঁদিকের ডানার নীচে ফোল্ডিং চেয়ারে চুপচাপ বসে মহিলার স্বামী মিস্টার ফেয়ারচাইল্ডও একই বস্তু গলায় ঢালছিলেন।
ব্যাপার বেশ ভালোই হতে চলেছে, কেইন ভাবছিল, সত্যিই ভাবছিল।
চারদিকের পরিবেশ থম মেরে আছে, বাতাস নেই। ভেজা ভেজা মেঘ ওদের উপর বিশাল মাপের দম-বন্ধ-করে-দেওয়া কম্বলের মতো ঝুলছিল। মিস্টার ফেয়ারচাইল্ড তার হাঁটুর দিকে তাকিয়েছিলেন এবং মহিলা তার গ্লাসের পানীয়টা দোলাচ্ছিলেন। কেইন চেয়ারের হাতলের উপর হাতের তালু পেতে দিল।
মহিলাকে খুব কাছ থেকে লক্ষ করছিল কেইন। একটু বেশি মাত্রাতেই উচ্ছলতা আছে ওই নারীর ভিতরে, তার সঙ্গেই অতিরিক্ত মাত্রার উদ্বিগ্নতা। মনে হচ্ছে, উনি যেন ভিতরে ভিতরে দগ্ধ হচ্ছেন, আবার একেই সঙ্গে হেসে-খেলে নেচে-গেয়েও বেড়াচ্ছেন। ওই দগ্ধতার অনুভূতি নিয়েই উনি বেঁচে আছেন এবং জীবনস্রোতকে থামাতে পারছেন না। এর কারণ মদ্যপান নয়, এটা কেইন জানে। কারণ, আকাশযান নীচে নামিয়ে আনার মাত্র কয়েক মিনিট পরেই ওঁরা মদ্যপান শুরু করেছেন।
কলোনি থেকে আনুমানিক চারশো মাইল দূরে এই জায়গাটা। শুক্রের এই বিস্তৃত জঙ্গলে এই চারশো মাইল মানে একটা দিন থেকে রাতের দূরত্ব। এখানে যে অন্ধকার তা বড়োই অদ্ভুত, পিলে-চমকানো বন্য প্রকৃতির।
দূরে থেকে কিট্জ পাখিদের চিৎকার ভেসে আসছে। ওদের ডাক অনেকটা মানুষ যখন আগুন ছুঁয়ে ফেলে আর্তনাদ করে, ঠিক তার মতো। ঘন, কর্দমাক্ত একটা নদী তাদের পিছনদিকে পাহাড় পার হয়ে বয়ে গিয়েছে। স্বচ্ছ পাথরের গায়ে সেই জলস্রোতের ধাক্কা খাওয়ার গুমগুম শব্দ কেইনের কানে অনেক দূরের আকাশ থেকে ভেসে-আসা বজ্রপাতের মতো ধাক্কা মারছিল।
কালো ডানা এবং বাঁকানো হলুদ ঠোঁটওয়ালা টিউ পাখিরা বিষণ্ণ আকাশের বুকে কিছুক্ষণ ওড়াউড়ি করার পর ফাঁকা জায়গাটাকে ঘিরে-রাখা গাছেদের মাথায় গিয়ে বসছিল। ওদের ঘুঘু পাখির মতো ডাক তাল মেলাচ্ছিল না-দেখা কিট্জ পাখিদের চিৎকারের সঙ্গে সব মিলিয়ে স্নায়ুচঞ্চল-করে-দেওয়া এক হিমশীতল পরিবেশ।
“আপনি কি আমাদের সঙ্গে পান করবেন না?” মহিলা প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন। হাস্যোজ্জ্বল ঠোঁটের ফাঁকে দেখা গেল সাদা দাঁতের ঔজ্জ্বল্য।
“না, ধন্যবাদ।” কেইন জানাল। মহিলা সামান্য মাথা ঝুঁকিয়ে তাকিয়েই থাকলেন। চোখজোড়া একটু বেশিই নীল। কেইনের উদ্দেশে ওখানে মিশে আছে উপহাস এবং ঠাট্টা। ওর স্বামী সেই একইভাবে নিজের নগ্ন হাঁটুর দিকে তাকিয়ে মদ্যপান করেই চলেছিলেন।
কাজটা জলদিই শেষ করতে হবে, কেইন সিদ্ধান্ত নেয়। চেয়ারের হাতলে হাতের তালু ঘষে।
মহিলার স্বামী খুবই শান্ত, প্রায় নিথর হয়েই বসে আছেন। ইচ্ছাকৃতভাবেই বোধহয় না-দেখার চেষ্টা করছেন, তাঁর স্ত্রী কেইনের সঙ্গে কীভাবে চোখ আর শরীরের অঙ্গভঙ্গি করে একটা খেলায় মেতেছে।
মহিলার পা, কেইন লক্ষ করেছে, নগ্ন বলেই মনে হচ্ছে, অথবা স্কার্টের নীচ থেকে নাইলনে ঢাকা আছে। নিতম্ব এখনও সেভাবে পূর্ণতা পায়নি। তবে স্তনদ্বয় যথেষ্ট উন্নত হয়ে আছে।
মহিলা নীচু হয়ে বাঁ হাঁটুতে আঙুল ঘষে কেইনকে জিজ্ঞেস করেন, “জঙ্গলের এই এলাকায় পোকামাকড় আছে নাকি?”
“কিছু তো আছেই।”
“গ্রিথ বিড়াল নেই?” সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলেন।
“এখানে নেই।” কেইন জানায়।
“আগামীকাল আমরা যেখানে যাচ্ছি, সেখানে আছে, তা-ই না?”
“হ্যাঁ।” কেইন স্বামী ভদ্রলোকের দিকে ফিরে তাকায়। বয়স প্রায় পঞ্চাশ, কেইন ধরে নেয়, মহিলার থেকে অন্তত কুড়ি বছরের বড়ো। মুখ চর্বিহীন এবং বিষণ্ণতা মাখা। চোখ ও মুখের কোণ থেকে পাতলা বলিরেখা জন্ম নিতে শুরু করে দিয়েছে। তার সঙ্গে মানুষটার তারুণ্যময় চুল এক বৈপরীত্যের প্রকাশ ঘটিয়েছে।
কলোনিতে তার সুনাম তৈরি হয়েছে বলেই এই দুজন কেইনের কাছে এসেছিল। তিন বছরেরও বেশি সময় ধরে সে এই জঙ্গলে পর্যটকদের সফর করাতে নিয়ে যায়। পুরো এলাকা ঠিক কেমন—এ নিয়ে তার বলার ক্ষমতা নেই, তবে কলোনির একটা নির্দিষ্ট ব্যাসার্ধের মধ্যে থাকা স্থানগুলোর সাধারণ বৈশিষ্ট্য ওর মুখস্থ।
“আপনি কি কখনও কোনো গ্রিথ বিড়াল শিকার করেছেন?” মহিলা চশমার ভিতর দিয়ে কেইনের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন।
“না।” কেইন উত্তর দিল।
“কিন্তু আপনি শুনেছেন যে প্রাণীগুলো বেশ ভয়ংকর এবং বিপজ্জনক?”
“হ্যাঁ।” হাত দিয়ে কপালের ঘাম মুছল কেইন। মহিলা ওই বিড়ালদের বিষয়ে জানার সময়, প্রত্যেক কথার শেষে স্বামীর দিকে তাকাচ্ছিলেন, প্রতিক্রিয়া দেখার জন্য। এখনও অবধি সে মানুষটার দিক থেকে কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া যায়নি। একইভাবে বসে ছিলেন আর গ্লাসে চুমুক দিচ্ছিলেন।
যা-ই হোক, এই দম্পতির শুক্র গ্রহের জঙ্গলে আসার কারণ গ্রিথ বিড়াল ছিল না। পশু শিকার তাঁদের আর ভালো লাগে না। একটা সময়ে যা ওঁরা প্রচুর পরিমাণে করেছেন। বিরক্তিকর রকমের একঘেয়ে হয়ে গিয়েছে ব্যাপারটা।
ওঁরা এখন আরও বড়ো কিছু করার তালে ছিলেন। এবার ওঁদের নজর স্ক্রিস মণির দিকে। যার কারণে ওঁরা প্রথমে পৃথিবী থেকে মঙ্গল গ্রহে, তারপর মঙ্গল গ্রহ থেকে শুক্রে উড়ে এসেছেন। শুধুমাত্র ওটাকে খুঁজে বের করার জন্য। স্ক্রিস মণির বিষয়টাকে পৌরাণিক গল্প বা মিথ বলা যায়। কেইন এ বিষয়ে নিশ্চিত। ওটা শুক্রের প্রাচীন উপকথা থেকে জন্ম-নেওয়া এক কল্পকাহিনি। সে যা-ই হোক, ওরা ওকে এই সফরের জন্য মোটা অর্থ প্রদান করেছে। ফলে সে এ নিয়ে মাথা ঘামাবে না।
মহিলা পুনরায় বিড়াল নিয়েই প্রশ্ন করলেন। “এই গ্রিথ বিড়ালগুলো কতটা বড়ো হয়, মিস্টার কেইন?”
“আট থেকে দশ ফুট লম্বা তো হয়ই।” কেইন বলল, “প্রায় একটা বড়ো ঘোড়ার মতো।”
“শুধু ওরা দেখতে একটা বিড়ালের মতো, যার দাঁত-নখ সব আছে।”
“হ্যাঁ, সেটাই।”
কেইন মনের ভিতরে অন্যরকম একটা কিছু অনুভব করল। মহিলা তার স্বামীর আপাত নিশ্চুপ অবস্থানের আড়ালটাকে ভাঙার চেষ্টা করছেন। সম্ভবত ওই মানুষটা কোথাও না কোথাও, বিড়ালের মতো প্রাণী শিকার করতে গিয়ে সমস্যায় পড়েছিলেন। সেটা বাঘ বা প্যান্থার হতে পারে। আবার মঙ্গলের ফ্রিঙ্কসও হতে পারে। কিন্তু কিছুতেই সে কাজটা করতে পারছেন না।
এখানে অবতরণ করার পর এই প্রথম লোকটা মাথা তুলে কথা বলল, “মন্দিরটা কতদূরে, সেটা কি বলা যাবে, মিস্টার কেইন?”
“পঞ্চাশ মাইল।” কেইন জানাল।
“আমরা ওটার কতটা কাছে অবতরণ করতে পারি?”
“আট বা দশ মাইল, আমার আন্দাজ।”
“ওর চেয়ে কাছাকাছি যাওয়া যাবে না?” লোকটা জিজ্ঞাসা করল।
“না, আমার মনে হয়, সেটা সম্ভব না।” কেইন বলল, “মন্দিরটা মোটামুটি একেবারে পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত। সেখানে আমার জেটকপ্টার নামাতে পারব না। ওখান থেকে কাছাকাছি ফাঁকা জায়গা আছে আট-দশ মাইল দূরে।”
মিসেস ফেয়ারচাইল্ড তাঁর চেয়ারে গিয়ে বসলেন। “তার মানে, আমাদের সেই এলাকা পার হতে হবে, যেখানে ওই বিড়ালগুলো ঘুরে বেড়ায়?”
কেইন কোনো উত্তর দিল না। লোকটার চোখ আবার হাঁটুর দিকে এই স্যাঁতসেঁতে ঘন জঙ্গলে সময় খুব ধীরে ধীরে বয়ে চলেছিল।
“মিস্টার কেইনকে তোমার কাটা দাগটা দেখাও চার্লস।” মহিলা হঠাৎ করেই নীরবতা ভেঙে বলে উঠলেন।
ফেয়ারচাইল্ড তাঁর চেয়ারের হাতল থেকে গ্লাসটা উঠিয়ে নিলেন। শক্ত করে ধরে রাখলেন কোমরের সামনে। খালি হাতের পেশি ফুলে উঠল। আঙুলের গাঁট ফ্যাকাশে মেরে যাচ্ছিল।
“লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই।” মহিলা হাসতে হাসতে বললেন, “আমি নিশ্চিত, মিস্টার কেইন বুঝতে পারবেন, একটা বিড়াল ঠিক কী করতে পারে।”
কথা শেষে মহিলা কেইনের দিকে এমনভাবে তাকালেন, যেন কোনো এক ঘরোয়া গল্প শোনাছেন, যা আজ অবধি শুধু ওই মহিলা এবং তাঁর স্বামীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। “সেটা ছিল একটা চিতাবাঘ, বুঝলেন মিস্টার কেইন। বড়োসড়ো আকারের পাক্কা শয়তান। চার্লস, বুঝতেই পারছেন, ঠিক করে গুলিটা করতে পারেনি। ফলে ওটা ওর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে।” ঘাড়ের ঠিক নীচে একবার হাত ছোঁয়ান মহিলা, “এখান থেকে।” কোমরে আঙুল ঠেকান। “বেশ লম্বা একটা ক্ষত, মিস্টার কেইন। তা-ই না, চার্লস? তিন ইঞ্চি চওড়া এবং…”
চার্লস নামের লোকটা তার গ্লাসটা চেয়ারের হাত থেকে নামিয়ে রাখে। “চুপ করো জ্যানেট। ভালোভাবে বলছি, একদম চুপ!”
“চার্লস,” অতি মাত্রায় বিস্মিত চোখে তাকান মহিলা, “আমি শুধু মিস্টার কেইনকে ব্যাপারটা বলতে চেয়েছিলাম, কারণ উনিও শিকার করেছেন। তা ছাড়া আমি জানি না এই গ্রিথ বিড়ালগুলো চিতাবাঘের মতোই কিছু…”
চার্লসের চোখ এবার রাগে ফুলে উঠল। “আমি কথাটা দ্বিতীয়বার বলতে চাই না, জ্যানেট।”
“আয়াম সরি, চার্লস।” সামান্য হেসে চোখ পিটপিট করল। “আগামীকালের কথা ভেবে আমরা একটু বেশিই উত্তেজিত হয়ে যাচ্ছি, তা-ই না?”
মিস্টার চার্লস ফেয়ারচাইল্ড তাঁর গ্লাসের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলেন, ওটা খালি হয়ে গিয়েছে, ভরতি করে নিলেন।
“আমি কি আপনাকে এক পাত্র পান করার জন্য আমন্ত্রণ জানাতে পারি, মিস্টার কেইন?” মিসেস ফেয়ারচাইল্ড বললেন।
“এই মুহূর্তে নয়।” কেইন বলল।
“ওহ্। কিন্তু আমার মনে হয় আমাদের একটু আনন্দ করা উচিত। চার্লস আর আমি স্ক্রিস মণি খুঁজে পাওয়ার জন্য এতটা পথ পাড়ি দিয়ে এসেছি। এই মুহূর্তে সেটার পঞ্চাশ মাইলের মধ্যে বসে আছি। এর জন্য একটু উল্লাস করাই যায়।”
মিস্টার ফেয়ারচাইল্ড মাথা না তুলে কেইনের উদ্দেশে বললেন, “হয়তো মিস্টার কেইন সত্যিই স্ক্রিস মণির অস্তিত্বে বিশ্বাস করেন না। করেন কি, মিস্টার কেইন?” এবার মুখ তুলে তাকিয়ে বললেন।
কেইন তার শার্টের পকেট থেকে একটা সিগারেট বার করল। “আমার কাজ আপনাদের মন্দিরে পৌঁছে দেওয়া। কিছু ভাবনাচিন্তা করার জন্য আমাকে পারিশ্রমিক দেওয়া হচ্ছে না।”
“আপনি প্রশ্ন এড়িয়ে যাচ্ছেন।” মিস্টার ফেয়ারচাইল্ড বললেন। চোখ কুঁচকে গিয়েছে, চকচক করছে।
কেইন তার সিগারেট জ্বালিয়ে স্যাঁতসেঁতে বাতাসে ধোঁয়া ওড়াল। এমন সুরে কথা বলল, যাতে কোনো নিশ্চয়তার ছোঁয়া নেই। “আমি এ বিষয়ে শুনেছি। কলোনির সবাই শুনেছে এর কথা।”
“একটু সংশোধন করছি,” মিস্টার ফেয়ারচাইল্ড বললেন, “সিস্টেমের সবাই এটার বিষয়ে শুনেছে বা জানে।”
“এটা খুব জনপ্রিয় পৌরাণিক কাহিনি।” কেইন সম্মতির সুরে বলে।
লোকটা উঠে দাঁড়ায়। “এটা কোনো মিথ নয়, মিস্টার কেইন। এটা আছে এবং ওই মন্দিরের মধ্যেই আছে, শুনতে পেলেন আমার কথা? ওটা মোটেই কোনো পৌরাণিক কাহিনি নয়, বরং চরম বাস্তব সত্যি এবং আমি ওটাই খুঁজে বের করতে যাচ্ছি। ওটাকে ওখান থেকে নিয়ে যাব! বুঝতে পারছেন, কী বললাম?”
কেইন লোকটার সুগঠিত স্বাস্থ্যের দিকে তাকাল। সিগারেটে টান দিল। “আমি তো আপনাকে বললাম মিস্টার ফেয়ারচাইল্ড, আমি শুধু আকাশযান ওড়ানোর জন্য পারিশ্রমিক পাই। অন্য কিছু ভাবা আমার কাজ নয়। আমার দায়িত্ব আপনাদেরকে মন্দিরে নিয়ে যাওয়া। ব্যাস, এতটুকুই।”
“শুনুন,” মিস্টার ফেয়ারচাইল্ড দ্রুত কেইনের কাছে উঠে এসে তার শার্ট চেপে ধরার জন্য হাত বাড়িয়ে বলল, “আমার সঙ্গে এরকম উদ্ধত আচরণ…।”
কেইন লোকটার হাত সরিয়ে দিল।
“চার্লস!” মহিলা কণ্ঠস্বর শোনা গেল।
লোকটা চোখ পিটপিট করে সরিয়ে-দেওয়া হাতটা বুকে ঠেকাল। “সরি, মিস্টার কেইন,” বলল, “কথাটা এভাবে বলতে চাইনি। আসলে এতটা পথ একভাবে মহাকাশ ভ্রমণ করার পর মনের উপর একটু চাপ পড়েছে। হন্যে হয়ে জিনিসটা খুঁজে বেড়াচ্ছি। একটু বেশিই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছি।” ফিরে গিয়ে চেয়ারে বসলেন। মুখে আবার ছেয়ে গেল বিষণ্ণতার ভাব। মুখ ও চোখের পাশের দাগগুলো একটু বেশিই গভীর দেখাচ্ছিল।
মহিলা মৃদু হাসলেন। “দয়া করে চার্লসের এই আচরণকে গুরুত্ব দেবেন না।” কেইনকে বললেন, “আসলে এই অভিযান, স্ক্রিস মণি খুঁজে বের করা, ওর কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ। গোটা সিস্টেমে যত সম্পদ আছে, তার সমান মূল্যবান ওটা, এটাই সবাই বলে। যে কারণে চার্লস ওটা পেতে চায়। কেন জানেন মিস্টার কেইন? কারণ ওর কাছে আর একটাও কানাকড়ি নেই।”
“স্বর্গের দোহাই, জ্যানেট।” চার্লস অনুরোধের সুরে বলে।
“গরিব হয়ে গিয়েছ বলে কি বলে তোমার লজ্জা লাগে, চার্লস?” কিছু ছদ্ম উদ্বেগ সহকারে মহিলা জিজ্ঞাসা করেন। চেয়ার থেকে উঠে শুরু করেন পায়চারি। কেইন লক্ষ করে সেই চলায় নেই কোনো জড়তা। নিতম্বদ্বয় দুলছে, লম্বা পায়ের পেশিতে খেলে যাচ্ছে ঢেউ। “না, গরিব বলে ওর কোনো লজ্জা নেই।” কেইনের দিকে তাকিয়ে বললেন, “আসলে ও ভয় পাচ্ছে, তা-ই না চার্লস?”
মিস্টার ফেয়ারচাইল্ড তাঁর গ্লাস ঠোঁটের কাছে নিয়ে গেলেন। যখন নামালেন, কেইন দেখতে পেল, ওটা খালি হয়ে গিয়েছে।
গ্লাসটা পুনরায় ভরে নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে ধরলেন, ওটার দিকে তাকালেন। মনে হল, উনি যেন ওখানে একটা অন্য জগৎ দেখতে পাচ্ছেন। এক শান্তিপূর্ণ জগৎ, যেখানে কোনো বিড়াল বা লালচে চুলের সুন্দরী মহিলা নেই। এমন এক জগৎ, যেখানে অপার শান্তি, ভয় বলে কিছু নেই। গ্লাসটা উপরে তুলে সেই জগতের স্বাদ নিতে চাইছিলেন। মিস্টার ফেয়ারচাইল্ডের চোখ ঝাপসা হয়ে এল।
“শুনুন মিস্টার কেইন, আমি আপনাকে বলছি, কেন ও গরিব হতে ভয় পায়।” মহিলা পুনরায় বলতে শুরু করেন, “এর কারণ, চার্লস শুধুমাত্র বিড়াল দেখলে ঘাবড়েই যায়, তা নয়। ও ভয় পায়, ওর স্ত্রী ওর হাতছাড়া হয়ে যাবে। তা-ই না চার্লস?”
কেইন অনুভব করল, ওই নারীর কণ্ঠস্বরের ভিতর এমন কিছু আছে, যা শুনে তার গায়ে কাঁটা দিচ্ছে। ও এমন কিছু একটা দেখছে, বুঝতেও পারছে, যেখানে বৈবাহিক গোপনীয়তার সিলমোহর অক্ষত থাকা উচিত ছিল। কিন্তু সে এই পরিস্থিতির মধ্যে না চাইতেও এসে পড়েছে। একদিকে বাড়ছিল মহিলার পায়চারির গতি, অন্যদিকে মিস্টার ফেয়ারচাইল্ড আরও যেন জবুথবু মেরে ঢুকে যাচ্ছিলেন চেয়ারের ভিতরে। হাতে যে স্কচের গ্লাস ঝুলছিল, মনে হচ্ছিল, ওটাতেই তাঁর বাকি সব কিছু ঝুলে আছে।
আগামীকাল তাঁদেরকে পায়ে হেঁটে যাওয়ার দশ মাইল পথ পার হতে হবে, যা গ্রিথদের এলাকা। দারুণ ব্যাপার, কেইন মনে মনে পুনরাবৃত্তি করল, সত্যিই দারুণ ব্যাপার।
দুই
“কী জানেন মিস্টার কেইন, চার্লস মনে করে,” মিসেস ফেয়ারচাইল্ড থেমে গিয়ে কেইনের দিকে তাকিয়ে বললেন, “শুধুমাত্র অর্থ দিয়ে ও আমাকে ধরে রাখতে পারবে। যে কারণে ও শেষ পেনিটাও এই অভিযানে লাগিয়ে দিয়েছে, যাতে স্ক্রিস মণিটা খুঁজে বের করা যায়, তাহলেই ওর সুন্দর স্ত্রী ওর হাতের নাগালে থেকে যাবে। তা ছাড়াও কী জানেন, মিস্টার কেইন?” হাত দুটো নিয়ে গিয়ে নিতম্বের উপর রাখল, যার ধাক্কায় কেইন দেখতে পেল, ওই মাংসপিণ্ড দুটো কেঁপে উঠল। “ও খুব একটা ভুল কিছু বলেনি, বুঝলেন।”
কেইন চুপ করে রইল।
“ওকে স্ক্রিস মণি খুঁজে বের করতেই হবে,” মহিলা হাসলেন, “তা না হলে সুন্দরী জ্যানেট চলে যাবে ওর হাতের নাগালের বাইরে। তারপর বেচারা চার্লস ধূসর চুল এবং একটা বড়ো মাপের ক্ষতচিহ্ন নিয়ে, একাকী শীতলতার জগতে ডুবে যাবে, আর জ্যানেট…”
“নিকুচি করেছে, আমি চুপ থাকতে বলেছি!” মিস্টার ফেয়ারচাইল্ড কথাটা বললেন, তবে চেয়ার থেকে উঠলেন না, কণ্ঠস্বরও কেমন যেন নিস্তেজ শোনাল।
“আর জ্যানেট,” মহিলা বলেই চললেন, কণ্ঠস্বর আরও জোরালো এবং নিরুদ্বেগ, “যে কারও সঙ্গে শুয়ে পড়বে, যার তাকে নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখার সামর্থ্য থাকবে। আর বেচারা বুড়ো চার্লস তার অভিশপ্ত শীতল বিছানায় শুয়ে ঠকঠকিয়ে কাঁপবে। একেবারে একা। ভাবতে থাকবে কে সেই মানুষ, যে তার ঈর্ষাজর্জরিত কলিজাটা পুড়িয়ে ছাই করে দিচ্ছে!” মিসেস ফেয়ারচাইল্ড তাঁর স্বামীর দিকে ঘুরে তাকালেন।
ভদ্রলোক গ্লাসটাকে দু-হাতে আঁকড়ে ধরে বসে ছিলেন। কেইন দেখতে পাচ্ছিল, মুখটা ফ্যাকাশে মেরে গিয়েছে। মহিলা হাসতে লাগলেন, অদ্ভুত নরম এক হাসি, যা কেইনের মস্তিষ্কে গিয়ে ধাক্কা মারছিল।
মিসেস ফেয়ারচাইল্ড তাঁর চেয়ারে ফিরে গেলেন, নিজের গ্লাসটা উঠিয়ে নিলেন। হাসি থেমে গেল, গ্লাসে চুমুক দিলেন, তারপর আবার হাসতে শুরু করলেন। স্বামীর দিকে তাকালেন, চোখ দুটো পিটপিট করছিল, বেঁকে গিয়েছিল ঠোঁটের রেখা। হাসির দমকে কাঁপছিল শরীরটা।
“আচ্ছা, যদি তুমি মণিটা খুঁজে না পাও,” স্বামীকে জিজ্ঞেস করল, “তোমার কী মনে হয়, সেই মানুষটা কে হবে?” কেইনের দিকে ফিরে তাকালেন। “মিস্টার কেইন, আপনার আর্থিক অবস্থা কেমন? মানে চার্লসের মতো অত অর্থের দরকার নেই। পুরুষত্বের জন্য আমি কিছুটা ক্ষতিস্বীকার করতে রাজি আছি, বুঝলেন?”
কেইন এ কথার কোনো উত্তর না দিয়ে বলল, “মিস্টার ফেয়ারচাইল্ড, আগামীকাল আমাদের যথেষ্ট রুক্ষ কঠিন এলাকা পার হতে হবে। জানি আপনি এই অভিযানের হোতা, তবুও যদি এভাবে মদ্যপান চালিয়ে যান…”
“আমি যদি এভাবে মদ্যপান করতে থাকি, তাহলে কী?”
কেইন লোকটার চোখ এবং বিকৃত মুখটা ভালো করে দেখল। “কিছু না।” উত্তর দিল।
“কিছু না।” বুঝতে পারছিল, একমাত্র স্কচ পান করাই মানুষটার মনের উপর জমে-থাকা চাপ কিছুটা হলেও কমাতে পারবে। সম্ভবত এটা মানুষটার প্রাপ্য।
“আপনি কিন্তু আমার প্রশ্নের উত্তর দিলেন না, মিস্টার কেইন।” মিসেস ফেয়ারচাইল্ড বললেন, “আপনি আমার সম্পর্কে কী ভাবছেন? আমি চাই, আপনি এর উত্তর দিন, যাতে চেয়ার থেকে পড়ে যাওয়ার আগে সেটা আমার স্বামী শুনতে পায়।”
“আমি মনে করি আমাদের সবার একটু ঘুমোনো দরকার।” কেইন শান্তভাবে বলল।
“মিস্টার কেইন, সত্যিই? এত তাড়াতাড়ি? না না, সবার আগে আমাকে আপনার ব্যাংক বুক চেক করে দেখতে হবে। অবশ্যই যদি আপনি আমাকে কথা দেন…”
“আপনি যদি কিছু মনে না করেন,” কেইন এবার কিছুটা কড়া সুরে বলল, “শুনুন, আপনার এবং মিস্টার ফেয়ারচাইল্ডের মধ্যে যা নিয়েই ঝামেলা থাকুক-না কেন, আমি নিজেকে তাতে জড়াতে চাই না।”
“ওহ্,” মহিলা বললেন, “বুঝলাম, ঠিকই আছে, কারণ আপনি সম্পূর্ণ সম্ভাবনাটা দেখতে পাননি। আসুন, আপনাকে বলি, আপনি আপনার অর্থের বিনিময়ে কী পেতে পারেন—যেভাবে চার্লস ভাবে আর কী।” গ্লাসটা মুখের কাছে নিয়ে গিয়ে চুমুক দিয়ে এবং আকাশযানটার দিকে এগিয়ে গেলেন। সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেলেন কেবিনে। রেডিয়োর সুইচটা স্পর্শ করলেন। উষ্ণ পরিবেশে ছড়িয়ে গেল সুরের লহর।
কলোনি স্টেশন থেকে একটা লঘুসংগীতের সুর বাজছিল, যা স্থানীয় ভেনাসিয়ান সুর থেকে নেওয়া। সুরটাকে রূপান্তরিত করে তার সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়েছে পৃথিবীর আদিম আফ্রিকার উদ্দাম ছন্দ। সহসাই মনে হল, ওই সুর যেন শুক্রের এই জঙ্গলের একটা অংশে পরিণত হয়ে উঠেছে।
মিসেস ফেয়ারচাইল্ড দরজায় এসে দাঁড়ালেন, তারপর নেমে এলেন সিঁড়ি বেয়ে। মনে হল যেন ভেসে এলেন। ওখানেই দাঁড়িয়ে থাকলেন আকাশযানের রুপালি ধাতুর দেহাবয়বে হেলান দিয়ে। সুরের তালে তাঁর পশ্চাদ্দেশ দুলছিল, নড়ছিল কাঁধ।
“আমি একজন ড্যান্সার ছিলাম, বুঝলেন মিস্টার কেইন। হ্যাব্রিল, মঙ্গলের খুব ব্যয়বহুল এক ক্লাবে কাজ করেছি। খুব জনপ্রিয় ছিলাম আমি। আমার মিষ্টি চার্লস আমাকে ওখান থেকে সরিয়ে নিয়ে যায়। তা-ই না, চার্লস?”
মিস্টার ফেয়ারচাইল্ড, কেইন দেখতে পায়, ভালো করে তাকাতেও পারছেন না। ওদিকে ছন্দবদ্ধ সংগীতের উদ্দাম তাল বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছিল। ধাক্কা মারছিল কানের পর্দায়। কেইন বুঝতে পারছিল, কী ঘটছে, সে সম্পর্কে উনি সচেতন।
মহিলা কেইনের দিকে এক সহজ ছন্দে এগিয়ে আসতে শুরু করলেন। তাঁর হাঁটায় মিশে ছিল অনুশীলনদক্ষ নিতম্ব এবং কাঁধের দোলানি। “এর জন্যই চার্লস আমাকে ওখান থেকে নিয়ে গিয়েছিল, মিস্টার কেইন, এই সোনার স্পর্শ পাওয়ার জন্য। ‘এসো আমার সঙ্গে’ এই কথাটা বলে আমার কানে পরিয়ে দিয়েছিল হিরের দুল, আঙুলে আংটি। ‘আমাকে সুযোগ দাও মঙ্গল গ্রহের প্রতিটা মানুষের অভিশপ্ত অনুসন্ধানী চোখের দৃষ্টি থেকে তোমাকে দূরে নিয়ে যাওয়ার। তোমাকে এমনভাবে লুকিয়ে রাখতে দাও, যাতে আমি ছাড়া আর কেউ তোমাকে দেখতে বা স্পর্শ করতে না পারে। এর বদলে আমার যা আছে, সব আমি তোমাকে দেব।’ ঠিক বললাম তো, চার্লস?” স্বামীর দিকে চকচকে চোখে ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে বললেন।
লোকটা তার গ্লাসটা তুলে ধীরে ধীরে চুমুক দিতে থাকল। তারপর ওটাকে ছুড়ে ফেলে দিল। ঝনঝন শব্দ করে ভেঙে গেল ওটা। ওদিকে মিসেস ফেয়ারচাইল্ড গানের তালে আগের মতোই কাঁধ আর নিতম্ব দুলিয়েই চলেছিলেন। মাঝে মাঝে গোটা শরীরটাও দুলে উঠছিল।
“আর এখন,” মহিলা বললেন, “বেচারা চার্লসের আর কিছুই নেই, অতএব আমি আবার চলে যাব…।”
নাচের তালেই মাথার উপর তার হাত তুলে, দু-হাতের তালু দিয়ে হাততালি দিলেন। নিতম্ব আর কাঁধ দুলছিল উদ্দাম গতিতে। আঙুল দিয়ে চুল চেপে ধরলেন, সাদা দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরলেন ঠোঁট। গোটা শরীর কাঁপছিল থরথর করে। গোলাপি চামড়ায় মোড়া দেহটার প্রতিটা অংশে শুরু হয়ে ছিল আলোড়ন, ধীরে ধীরে বাড়ছিল তার মাত্রা।
মিস্টার ফেয়ারচাইল্ড চেয়ার ঠেলে ফেলে দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। চোখে একই সঙ্গে বন্য কিন্তু শূন্যতার ছাপ। “এরকম কোরো না…” বললেন, কর্কশ কণ্ঠের উচ্চারিত শব্দগুলোতে মিশে ছিল যন্ত্রণার ছাপ।
মহিলা হাসছিলেন, এক বুনো উদ্দামতার হাসি, যা চলতে-থাকা সংগীত এবং শরীরের উন্মত্ত নড়াচড়ার সঙ্গে তাল মেলাচ্ছিল। বনবন করে ঘুরতে-থাকা অবস্থায় দিচ্ছিলেন হাততালি, শরীরটা কাঁপছিল।
মিস্টার ফেয়ারচাইল্ড কোনোমতে এক-পা এগিয়ে গেলেন। “জ্যানেট, এরকম কোরো না, প্লিজ়…।” তারপর জমির উপর ধপ করে পড়ে গেল। ধীরে ধীরে মহিলা তাঁর নাচ থামালেন। যদিও উদ্দাম হাসি স্যাঁতসেঁতে জঙ্গলের ভিতর অনুরণিত হয়েই চলেছিল।
ফ্যাকাশে রুপালি গোলকের চারপাশে ধূসর মস্তকাবরণী-পরা অবয়বগুলো ছুঁয়ে থাকে ওটাকে। একটা সবুজ মাথা নড়ে ওঠে। তারপর আরেকটা। সোনার দেয়ালের গায়ে দেখা যায় হালচাল। কাছের একটা গম্বুজের চূড়ার মাথার কাছাকাছি অংশে বৃত্তাকার খোলা অংশ থেকে বাইরের বাষ্প ভেদ করে আবছা আলো এসে পড়ে। আঙুলগুলো সরে যায় গোলক থেকে। এক সবুজ অবয়ব বের হয়ে আসে ধূসর পোশাকের ভিতর থেকে। তার হাত নীচের দিকে আন্দোলিত হয়, এটা প্রতীক, সমস্ত মন্দ থেকে বিশুদ্ধতাকে আলাদা করার। আরও একটা হাত এর অনুকরণ করে। তারপর আর-একটা। এক-এক করে নড়ে ওঠে বারোটা হাত। বাঁশির মতো কণ্ঠস্বর ভেসে যায় ফ্যাকাশে গোলকের দিকে। একটা বিড়াল ফ্যাঁস করে ওঠে। মন চালিয়ে যায় তার খোঁজ।
আলো অনেকটাই ম্লান হয়ে এসেছিল, দেখা যাচ্ছিল এক অন্ধকারাচ্ছন্ন নারীর অবয়ব, দাঁড়িয়ে আছে একটা পুরুষের তালগোল পাকিয়ে পড়ে-থাকা শরীরের কাছে। গান বেজে চলে অবিরাম। কেইন উঠে দাঁড়ায়।
“প্রতিবার আমি এই ধরনের সফর করি।” পড়ে-থাকা মিস্টার ফেয়ারচাইল্ডের দেহটার দিকে তাকিয়ে বলে, “নিজের কাছে নিজেই শপথ করি, এরপর আর এরকম সফর করব না, এটাই শেষ। আবার, এই মুহূর্তে ঠিক সেই একই শপথ নিচ্ছি।”
নারী অবয়ব চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে, শুধু মুখে ফুটে ওঠে হাসি, দেখা যায় সাদা দাঁতের সারি আর লালচে চুল। “সফর কিন্তু এখনও শেষ হয়নি, মিস্টার কেইন। আমাদের এখনও অনেক দূর যেতে হবে।” তার চোখ দুটো নেচে উঠল।
“ঠিকই বলেছেন মিসেস ফেয়ারচাইল্ড।” কেইন বলল, নীচু হয়ে পড়ে-থাকা মানুষটাকে ওঠানোর সময়, “দুর্ভাগ্যবশত, আপনি ঠিকই বলছেন।”
কেইন মিস্টার ফেয়ারচাইল্ডকে আকাশযানের ভিতর নিয়ে গেল, তার স্ত্রী শুধুই দেখে গেলেন। কেবিনে ওঠার পর টেনে নিয়ে যেতে-থাকা ছোটোখাটো মানুষটার ওজন কেইনকে চমকে দিয়েছিল। ফেয়ারচাইল্ড বেশ শক্তপোক্ত শরীরের মানুষ। দেখেই বোঝা যায়, জীবনের বেশির ভাগ সময় উনি অদ্ভুত লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে কাটিয়েছেন। করেছেন বৈচিত্র্যময় বন্য, ক্রমাগত নতুন অ্যাডভেঞ্চার। ঘুরে বেড়িয়েছেন রোমাঞ্চের সন্ধানে।
মানুষটাকে আকাশযানের কেবিনের পিছনে একটা বাংকে শুইয়ে দিল কেইন। ফেয়ারচাইল্ডের খোলা জামার আড়ালে থাকা প্রশস্ত ক্ষতচিহ্নের শেষ প্রান্তটা এখন দেখা যাচ্ছে। তার সঙ্গেই চোখ এবং মুখের সূক্ষ্ম বলিরেখাগুলোও। সম্ভবত ওদের কারণ অতিরিক্ত স্কচ পান করা এবং ওই লাল চুলের নারী। কেইনের মনে এল আরও একটা কারণ, ওই শয়তান মহিলার প্রেমের মূল্য পরিশোধ করতে গিয়ে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ফাঁকা হয়ে যাওয়া।
কেইন কেবিনের ভিতর থেকে বেরিয়ে গিয়ে রেডিয়োটা বন্ধ করে দিল।
লাফ দিয়ে নামল নীচে। আলো এখন আরও ম্লান হয়ে গিয়েছে, মিসেস ফেয়ারচাইল্ডের শরীরের শুধুমাত্র রূপরেখাটাই দেখা যাচ্ছে। কিট্জ পাখির চিৎকার আবার বাতাসে ভেসে এল।
অনেক দূর থেকে জলপ্রপাতের একঘেয়ে শব্দটাও শোনা যাচ্ছিল।
“মিসেস ফেয়ারচাইল্ড, আপনি আপনার স্বামীর কাছে কেবিনে যেতে পারেন।” কেইন বলল, “আমি কম্বল মুড়ি দিয়ে এখানেই শুয়ে পড়ব।”
“জীবজন্তুর ভয় নেই?”
“এখানে নেই।” কেইন জানাল, “আমি আগুন জ্বালিয়ে নেব। আপনি যদি কিছু খেতে চান, আমি কেবিনে পৌঁছে দিচ্ছি।”
“না, ধন্যবাদ, মিস্টার কেইন।” মহিলা তাঁর চেয়ারে বসে বললেন, “আপনি যদি কিছু মনে না করেন, বাকি পানীয় উপভোগ করতে চাই।”
“সেটা আপনার উপর নির্ভর করবে।” কেইন জবাব দিল। চেষ্টা করছিল মহিলার দিক থেকে নিজের চোখ সরিয়ে রাখার। ও খুব ভালো করে জানে, একজন নারীর দিকে না তাকিয়ে, তাকে সব চেয়ে ভালোভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
জঙ্গলের মেঝের স্যাঁতসেঁতে উপরের স্তর সরিয়ে নীচ থেকে কাঠ কুড়িয়ে নিল কেইন। চারদিকে অন্ধকার ছেয়ে আসছিল। আগুন জ্বালানোর জন্য নীচু হল কেইন। কয়েক মুহূর্ত বাদেই আগুনের শিখা লাফিয়ে উঠল উপরের দিকে। হলদে আলোর আভা গিয়ে পড়ল আশপাশের গাছগুলোতে।
কেইন সোজা হয়ে দাঁড়াল।
“আপনার কি আমার নাচ ভালো লেগেছে?” মিসেস ফেয়ারচাইল্ড মৃদুস্বরে জিজ্ঞেস করলেন।
“আমি ওটা দেখিনি, কারণ আপনার স্বামী এখানে উপস্থিত।” উত্তরটা দিয়েই আবার আকাশযানে উঠে গেল। নিয়ে এল বেশ কয়েকটা কম্বল। ওগুলো আগুনের কাছে পাতল।
“কিন্তু সে তো এখন এখানে নেই।” মিসেস ফেয়ারচাইল্ড বললেন।
কেইন অবশেষে মহিলার দিকে তাকাল। “তবুও ওর জন্য আমার মনে চিন্তা হচ্ছে।”
“আপনি খুব ভালো মানুষ, মিস্টার কেইন।”
“আমি কিছুই নই।” কেইন বলল, “আমি শুধু একজন ‘গাইড’, যাকে অর্থ দেওয়া হয়, মানুষ যেখানে যেতে চায়, সেখানে নিয়ে যাওয়ার জন্য। আর কিছু না, আপনি কি বুঝতে পারলেন, মিসেস ফেয়ারচাইল্ড?”
“না।” মহিলা হেসে তার দিকে তাকিয়ে বললেন।
কেইন তার চেয়ারে গিয়ে বসল। “আমাদের সামনে একটা কষ্টকর দিন আসতে চলেছে, মিসেস ফেয়ারচাইল্ড। ওই জঙ্গলের পথ পাড়ি দেওয়ার জন্য আমাদের শারীরিক শক্তির প্রয়োজন হবে। আপনি এর আগে যেসব জঙ্গল দেখেছেন, তার চেয়ে এটা একেবারেই আলাদা। শুক্র গ্রহে বেশ কিছু ভয়ানক জায়গা আছে। আমরা যেখানে যাচ্ছি, সেটাও ওইরকম একটা ধরনের জায়গা। আমি আগে কখনও ওখানে যাইনি, ফলে ওই স্থান ঠিক কেমন, সেটা অনুমান করতেও পারছি না। তবে আকাশযানে চেপে ওই স্থানের উপর দিয়ে গিয়েছি। যা বুঝেছি, ওখানে জঙ্গল খুব ঘন এবং ওই যাকে বলে জীবন্ত। ওই স্থানকে একদম বিশ্বাস করার মতো নয়। আপনি যা খুশি ভাবতে বা করতে পারেন, কিন্তু আমি নিজেকে সজাগ রাখতেই চাইব। সেক্ষেত্রে আমার পরামর্শ হল আপাতত ভালো করে ঘুমোনো দরকার।”
মিসেস ফেয়ারচাইল্ড ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালেন, হাত দিয়ে চেপে ধরলেন কোমর। “মিস্টার কেইন, আমি এটাই বলব। আপনি সেরকম মানুষ নন, যাঁর সঙ্গে আমি তর্ক করতে চাই। আমি শুধু পরিস্থিতির সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার জন্য আর কিছুটা মদ খেতে চাই। তাহলেই আমি ঘুমোতে পারব। কিন্তু আমার খুব খারাপ লাগছে, দুঃখ হচ্ছে, আপনি আমার নাচ উপভোগ করেননি। আচ্ছা একটা কাজ করা যাক। আমি প্রস্তুত না-হওয়া পর্যন্ত একটু অপেক্ষা করুন। তারপরে আমরা একসঙ্গে এক পাত্র পান করব। নাচ করতে করতে। আপনার কী মত, মিস্টার কেইন?”
কেইন ধীরে ধীরে একটা সিগারেট জ্বালাল, লাইটারের আগুনের দিকে তাকাল। ঝট করে ওটার ঢাকনা বন্ধ করে বলল, “আপনি এবং আপনার স্বামী উভয়ের জন্যই ভাবনা হচ্ছে, মিসেস ফেয়ারচাইল্ড।”
“নিকুচি করেছে আমার স্বামীর ভাবনা।” ঠোঁটের ফাঁক থেকে ঝলসে উঠল দাঁত। গ্লাসটা উঠিয়ে নিয়ে বাকি পানীয় এক চুমুকে পান করলেন। “আপনি বিশ্রাম করুন মিস্টার কেইন।” বলেই জেটকপ্টারের দিকে হাঁটা দিলেন। “নিজের মতো করে সময় কাটান, উপভোগ করুন।”
কেইন মহিলার হাঁটা দেখেই বুঝতে পারল, মদের প্রভাব ভালোই পড়েছে, মাঝে মাঝেই টাল খাচ্ছেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও ওই চলনে মিশে ছিল করুণা-জাগানো ঔদ্ধত্য। এমন একটা ব্যাপার, যাকে উপেক্ষা করা কঠিন।
আশা করছি, উনি আজ রাতে আর ভিতর থেকে বেরিয়ে আসবেন না, কেইন মনে মনে বলল। আশা করছি, উনি জলদিই ঘুমিয়ে পড়বেন এবং আমাকে আর ব্যতিব্যস্ত করবেন না। আগামীকালটা যেন নির্বিঘ্নে জলদি কেটে যায়।
কিন্তু কিছুক্ষণ পরে কেইন যখন সামনে জ্বলতে-থাকা আগুনের শিখার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে সিগারেটটা শেষ করল, তখন ওর কানে একটা শব্দ ধাক্কা মারল। শব্দটা সংগীতের, জেটকপ্টারের রুপালি শরীর থেকে ভেসে আসছে। এখন ওটায় মিশেছে আরও বেশি বুনো উদ্দামতা। বাজছে গুরুগম্ভীর ড্রাম। আগুনের চটপট শব্দ এবং নিশ্চল জঙ্গলের এই রাত্রিকালীন পরিবেশে ওটা যেন শরীরে গেঁথে যাচ্ছে। কেইন বুঝতে পারল, তার শিরা-উপশিরায় রক্ত চলাচলের গতি বাড়ছে। দপদপ করতে শুরু করেছে মাথার ভিতরে।
একই মুহূর্তে কেবিনের দরজাটা ঝকাং করে খুলে গেল এবং সংগীতের শব্দ ছড়িয়ে গেল বনাঞ্চলে। মহিলা দরজায় দাঁড়িয়ে ছিলেন, হাত দিয়ে ধরে আছেন দরজার রুপোলি প্রান্ত। পরনে অতি সূক্ষ্ম কুয়াশার মতো পাতলা কালো নাইটগাউন। চুল খোলা। ছড়িয়ে আছে কাঁধ ও পিঠে। কালো গাউনের নীচে দেখা যাচ্ছে নগ্ন ধবধবে সাদা পা দুটো।
মহিলা নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন, আঙুলগুলো শক্ত করে আঁকড়ে ধরে রেখেছিল দরজার ফ্রেমটাকে। যেন সংগীতের তালে তাল-মেলানো থেকে নিজেকে আটকে রেখেছেন জোর করে। সুরের লহরি থেমে গিয়ে তখন শুধু ড্রাম বাজছিল। রাতের পরিবেশে সব কিছুর মাঝখানে একটা বিরামচিহ্নের মতোই অস্তিত্বের জন্ম দিচ্ছিল ওই দ্রিমিদ্রিমি ধ্বনি। মিসেস ফেয়ারচাইল্ড দরজা থেকে লাফ দিয়ে নীচে নেমে এলেন, টলে উঠল শরীরটা। দু-পা বেশ কিছুটা ছড়িয়ে দাঁড়ানোর পর দু-হাতে ঘাড়ের কাছ থেকে চুলটা টেনে উঠালেন উপরের দিকে। তারপর হঠাৎ সামনের দিকে ঝূঁকে গেলেন, মাথার চুল এক ঝটকায় সামনের দিকে এসে আগুনের আভা মেখে আগুনের শিখার মতোই নড়েচড়ে উঠল।
ধীরে ধীরে সোজা হয়ে দাঁড়ালেন, এক হাত দিয়ে চুল ঠেলে দিলেন পিছনের দিকে, কেইন দেখতে পেল, শরীরের দোলানির সঙ্গে নাচছে মিসেস ফেয়ারচাইল্ডের চোখ দুটোও। এগিয়ে আসছে তার দিকে। কাঁধ দুলছে, নিতম্বদ্বয় কম্পিত হচ্ছে। কেইন চেয়ারের হাতল চেপে ধরল শক্ত করে। কুঁচকে গেল চোখ। কালো গাউনের নীচে থাকা দেহে উঠেছিল ক্ষিপ্ত আদিম আন্দোলনের হিল্লোল। শরীর দুমড়ে-মুচড়ে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে অবশেষে কেইনের সামনে এসে থামলেন জ্যানেট। চিবুক উঁচু, এক হাত দিয়ে এখনও চেপে ধরে আছেন নরম ঘন চুল। চোখ দুটো যেন জ্বলে উঠল।
“নাইটক্যাপ [শুতে যাওয়ার আগে শেষবারের মতো একপাত্র পান করা]…” মোহময় স্বরে বললেন মহিলা।
কেইন তার চেয়ারে একটু নড়ে বসল। “আমি তৃষ্ণার্ত নই।” জানাল।
মিসেস ফেয়ারচাইল্ড চুল থেকে হাত সরিয়ে নিলেন। শরীরের স্বচ্ছন্দ নমনীয় হিল্লোল খেলে গেল।
“আমার একজন মানুষের কথা মনে পড়ছে,” কেইন দাঁত চিপে দিয়ে, “যিনি মাত্র কয়েক গজ দূরেই, অ্যালকোহলের নেশায় আচ্ছন্ন হয়ে ঘুমোচ্ছেন। কারণ, এক সস্তা মানের বার ড্যান্সার তার রক্ত শুষে নিয়ে তাকে প্রায় মৃত্যুর দোরগোড়ায় পৌঁছে দিয়েছে। আমি আপনার গোলাপি চামড়া ভেদ করে ভিতরে যা দেখতে পাচ্ছি, মিসেস ফেয়ারচাইল্ড, তা আমাকে অসুস্থ করে তুলছে। আপনার আগ্রহ মোটেই আমার প্রতি নয়, কোনোদিন থাকবেও না। কারণ, আমি ঘৃণা এবং স্বার্থপরতা এবং পচে-যাওয়া মানসিকতার কদর্য রূপ দেখতে পছন্দ করি না।”
কথাটা শুনে মিসেস ফেয়ারচাইল্ড পরপর দুটো চড় মারলেন কেইনের মুখে। চোখ থেকে বের হচ্ছিল ক্রোধের আগুন, শরীর কাঁপছিল। আর কয়েকটা আঘাত করলেন উনি কেইনের মুখে। আঙুলের আংটির ছোঁয়ায় কেইনের মুখের চামড়া কেটে রক্ত বের হয়ে এল।
কেইন চুপ করে বসে রইল। ওর হাত তখনও চেয়ারের হাতল আঁকড়ে ধরেছিল। “আপনি কিছুদিন আগেই আপনার ছেলেকে হারিয়েছেন। যান, পোশাক পরে নিন। আমরা কলোনিতে ফিরে যাব। আপনি যা চাইছেন, তার জন্য অন্য কাউকে খুঁজে পেয়ে যাবেন হয়তো। আমার আর ভালো লাগছে না।”
কথা শেষে ওঠার চেষ্টা করতেই মিসেস ফেয়ারচাইল্ড কেইনের বুকে একটা হাত রাখলেন। চোখ থেকে বিদায় নিয়েছিল একটু আগে দেখা ক্রোধের আগুন। সেখানে জমা হয়েছে অশ্রুবিন্দু।
“দয়া করে,” কেইন শুনতে পেল কান্না-ভেজা কণ্ঠস্বর, “‘আয়াম সরি’। আমি খুবই দুঃখিত। আমাকে কিছু কথা বলতে দিন, ‘প্লিজ়’।” হাঁটু গেড়ে বসে পড়লেন মাটিতে। তাকিয়ে থাকলেন কেইনের দিকে। গাল বেয়ে নেমে আসছিল জলের ধারা।
“কী কথা মিসেস ফেয়ারচাইল্ড?” শীতলস্বরে বলল কেইন।
“আমি জানি না, আমি যা করলাম, সেটা কেন করলাম।” চোখের জল মুছে বললেন, “হয়তো বেশি স্কচ খাওয়ার ফল। আমি মনে করি আমি এখনও একজন ‘ড্যান্সার’। এটা আমার রক্তে আছে। না, মিস্টার কেইন, এটা কোনো সস্তা ‘বার-ড্যান্সিং’ নয়। এটা আমার মনের ভিতরে অনেক গভীরে থাকা একটা বিষয়। আমি এটাকে দমিয়ে রাখতে পারি না।”
“খুব ভালো,” কেইন বলল, “অন্তত একজন পুরুষের কাছে তার স্ত্রী-র দিক থেকে।”
“আমি জানতাম, এমনটাই হবে। বুঝতে পেরেছিলাম। ওর ওই মদ খাওয়ার পর ও যেভাবে আমাকে নিজের করে পেতে চাইত, সেটা আমি সহ্য করতে পারতাম না। নিজেকে বাঁচাতেই আমি ওকে কষ্ট দিই। আমি জানি এটা ঠিক নয়, কিন্তু আমি এরকমটাই করে ফেলি। এটা আমি থামাতে চাই। এসবকে ও পাত্তা দেয় না। আমাকে শোনায়, সে আমার জন্য কী করেছে। সেসব শুনেই লেগে যায় ঝগড়া। ওর মনে ঢুকে গিয়েছে, যদি ও ওই স্ক্রিস মণি খুঁজে না পায় তাহলে আমাকে আর পাবে না।”
“এটা কি সত্যি নয়?” ভুরু কুঁচকে কেইন জিজ্ঞেস করল।
“না।” মিসেস ফেয়ারচাইল্ড শান্ত কণ্ঠে বললেন, “আসলে, আমি ওকে ভয় পাই এবং ও সঙ্গে থাকলেও আমি একাকিত্ব বোধ করি। তবুও আমি ওকে ছেড়ে যাব না।”
“দেখুন, আমি আগেই বলেছি,” কেইন বলে, “আমি শুধু একজন অর্থের বিনিময়ে কাজ করা মানুষ। আমার গ্রাহকরা নিজেদের জীবনযাত্রা নিয়ে কী চিন্তা করে, সেটার দিকে নজর দেওয়া আমার কাজ নয়।”
“আপনি এতটাও শীতল মানসিকতার মানুষ নন।” মহিলা কেইনের চোখের দিকে তাকিয়ে বললেন।
“আমি সত্যিই এরকম।”
মিসেস ফেয়ারচাইল্ড একগুঁয়ের মতো মাথা নাড়লেন। “কেইন, আমার প্রতি সদয় হও। আমি জানি, তুমি পারবে। শুধু এই একবারের জন্য, আমার নিজেকে একাকী বা ভয়ার্ত মনে হচ্ছে না। আগামীকালের আগে শুধু এই একটা মুহূর্ত বেঁচে থাকুক—কাল থেকে তো আবার সেই একই পথে চলা শুরু হবে।”
কেইন কোনো উত্তর দিল না, চেয়ারে শরীর শিথিল করে গা এলিয়ে দিল।
মিসেস ফেয়ারচাইল্ড হাসলেন। সে হাসিতে ছিল না কোনো কঠোরতা বা ব্যঙ্গ। এটা আন্তরিক উষ্ণ সরল হাসি। “তুমি কি আমার সঙ্গে এক পাত্র পান করবে? সামান্য একটু, আজকের রাতের অবসান ঘটনোর জন্য। হয়তো তাহলে তোমার মনে আমার জন্য শুধু কিছু খারাপ অনুভূতি থাকবে না। তুমি কি চাও না, আমারও একটা হৃদয় এবং মানবিক অনুভূতি আছে—এটা অনুভব করতে?”
কেইন মিসেস ফেয়ারচাইল্ডের চকচকে চোখ দুটো কিছুক্ষণ দেখল। “শুধু এক পাত্র, ঠিক আছে?”
মহিলা হেসে উঠে দাঁড়ালেন, ফিরে গেলেন আকাশযানটার কাছে, যেখানে মিস্টার ফেয়ারচাইল্ড তাঁর ‘মোবাইল বার’ সাজিয়ে রেখেছিলেন। কেইন তাকিয়ে ছিল। উনি দুটো গ্লাসে পানীয় ঢালছেন। লক্ষ করল, মহিলার সোজা, গতিহীন ভঙ্গিটা থেকে প্রাণোচ্ছল পাশব লাবণ্য অদৃশ্য হয়ে গিয়েছে। যখন ফিরে এলেন, তখন মিসেস ফেয়ারচাইল্ডকে খুব সহজ-সরল এবং সাদাসিধা চেহারার দেখাচ্ছিল। গালে তখনও জলের দাগ লেগে আছে।
কেইনকে একটা গ্লাস দিয়ে নিজেরটা উপরের দিকে তুলে ধরলেন। “স্বল্প কথায় একটা গতানুগতিক উদ্যাপন—শুক্র গ্রহের রাতে দেখা হয়েছে এমন দুজনের কাছে…।”
“দুজন মানুষের কাছে।” কেইন তার নিজের গ্লাস তুলে ওটাই বলল। স্কচ তার গলা জ্বালিয়ে নীচের দিকে নেমে গেল।
মিসেস ফেয়ারচাইল্ড আবার হাঁটু গেড়ে বসলেন, কেইনের দিকে তাকিয়ে হাসলেন। কেইন সহসাই খেয়াল করল, এখনও রাতের বাতাসে সংগীতের সুর ভাসছে এবং সামনে থাকা নারীর কালো গাউনটা খুবই পাতলা। উঠে গিয়ে নিজের গ্লাসটা ভরে নিয়ে এসে চটজলদি গলায় ঢালল। ওই সরলতা এবং অশ্রুধারা দেখার পর এখন সে নিজেকেই বিশ্বাস করতে পারছে না।
স্কচ সম্ভবত তার রক্তস্রোতকে নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করেছে। বুঝতে পারছে, ওটা ছুটে বেড়াচ্ছে তার শিরা-উপশিরায়।
তৃতীয়বার গ্লাস ভরে নিয়ে এল। যে হাতে সে গ্লাসটা ধরে ছিল, সেটা কেমন যেন দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন মনে হল। মাথায় মধ্যে একটা গানের সুর ভেসে এসেই হারিয়ে গেল। মিসেস ফেয়ারচাইল্ডের দিকে যখন তাকাল, তখন মহিলার হাস্যোজ্জ্বল ঠোঁটগুলো অত্যন্ত লাল আর সাদা দাঁতগুলো ঝকমক করে উঠল। মাথায় স্পন্দিত হল সংগীতের সুর। ওটা যেন মস্তিষ্কের ভিতর গিয়ে আঘাত হানছিল।
“কী আছে এ…?” ওর কথা জড়িয়ে এল। মাথা ঝাঁকিয়ে তাকাল হাতের গ্লাসটার দিকে। ওটা পড়ে গেল আঙুলের ফাঁক থেকে।
“সামান্য জাদু ওষুধ,” মহিলা উঠতে উঠতে বললেন, “মঙ্গল গ্রহের ভাঁড়ার থেকে নিয়ে এসেছিলাম। দ্রুত এবং ওহ্, এত কার্যকর।”
এক অদ্ভুত অনুভূতির সঙ্গে লড়াই করছিল কেইন, যা ওকে পাকে পাকে ঘিরে ধরেছিল। মনে হচ্ছিল মস্তিষ্কটা যেন শুকিয়ে গিয়েছে। ওখানে শুধুই ড্রাম পেটানোর শব্দ। ইন্দ্রিয়গুলো যেন জীবন্ত হয়ে আগুন ছড়াচ্ছে। সামনে মিসেস ফেয়ারচাইল্ডকে দেখতে পেল। উনি শরীর দোলাচ্ছেন, সামনে-পিছনে। মহিলার হাত দুটো নড়ছে মুখের সামনে। চেয়ারের হাতল চেপে ধরল কেইন নিজেকে সামলানোর জন্য।
বোঝার চেষ্টা করল, কী ঘটছে, কিন্তু তার হাত যেন সব কিছু ছেড়ে দিতেই বেশি আগ্রহী।
দূরে কোথাও আগুনের শিখা লাফিয়ে উঠল। সামনে থাকা কালো পোশাকে আবৃত শরীরে পুনরায় শুরু হয়েছিল আন্দোলন। দুটো গোলাপি হাত শূন্যে উঠে গিয়েছিল, বস্ত্র আবৃত পেশিগুলো কাঁপছিল থরথর করে, ওগুলো নাচছিল, নেচেই চলেছিল।
কেইন চেয়ারটা আঁকড়ে ধরল, দাঁত কিড়মিড় করল, কিন্তু ড্রামের আওয়াজ ওর ইন্দ্রিয়গুলোতে ক্রমাগত ধাক্কা মেরে চলেছিল। সামনে একটা ঠোঁটে ফুটে উঠেছিল হাসি। সাদা দাঁত ঝকঝক করছিল এবং একটা গোলাপি শরীর ড্রামের তালে দুলছিল।
“এখনও ইচ্ছে নেই?” শুনতে পেল কেইন, অনেক দূর থেকে ভেসে এল কথাগুলো।
শরীরটা ধীরে ধীরে ঘুরে গেল, আবছা অন্ধকারে নাচের ছন্দে দোদুল্যমান একটা নারীর অবয়ব।
কেইনের হাত চেয়ারের হাতল থেকে পিছলে গেল। কানে ভেসে এল হাসির শব্দ। জোরালো সে আওয়াজ কানে যেন গেঁথে যেতে থাকল পেরেকের মতো। ও নিজেকে আটকাতে পারছিল না। হাসির শব্দ শুনতে শুনতে ওর আঙুল স্পর্শ করেছিল মসৃণ চামড়া। তারপর সব কিছু মিশে গিয়েছিল শুধুমাত্র ঘন অন্ধকারে।
মন পরীক্ষা করে দেখছিল। বিচার করছিল। সিদ্ধান্তও নিয়ে নিল। “গ্রিথ?” এক জোরালো কণ্ঠ বলে ওঠে। সোনালি দণ্ডগুলো এক ঝটকায় সরে যায়। একটা কালো বিড়াল গুঁড়ি মেরে বের হয়ে আসে। সবুজ মাথাগুলো মস্তকাবরণীর মধ্যে নড়ে ওঠে। বিড়ালটা লাফ দেয়, আবার গুঁড়ি মেরে এগিয়ে যায়, শুরু করে অন্বেষণ। পলকহীন চোখগুলো ঘুরে যায় শীতল গোলকের দিকে। কণ্ঠস্বরগুলো একসঙ্গে বলে ওঠে, “গ্রিথ?”
তিন
মাথার পাশে বুটের ঠোকা খেয়ে কেইনের ঘুমটা ভেঙে গেল। মাটির উপর দিয়ে গড়িয়ে গেল ওর শরীরটা। মাথার ভিতরে যন্ত্রণার দপদপানি অনুভূত হচ্ছিল। আবার একবার বুটের ঠোকা লাগল। এবার চোখের উপরে। গুঙিয়ে উঠল কেইন। চেষ্টা করছিল পেশিগুলোকে নিয়ন্ত্রণে আনার, কিন্তু মনে হচ্ছিল, ও যেন এক দুঃস্বপ্নের জগতে আটকা পড়েছে।
“অ্যাই হারামজাদা শুয়োরের বাচ্চা।” হাঁক শুনতে পেল, তারপরেই ওর চোখ দেখল, কুয়াশাচ্ছন্ন জগতের ভিতর থেকে একটা হাতের মুঠো এসে আছড়ে পড়ল ওর মুখে। মুখ গুঁজে কেইন এক পাক গড়িয়ে গেল মাটির উপর। চেষ্টা করল নিজেকে লুকোনোর, নিজেকে বাঁচানোর, যতক্ষণ না নিজেকে ধাতস্থ করতে পারে।
“তুমি তো দেখছি, ওকে মেরে ফেলবে।” একটা মহিলার কণ্ঠ শোনা গেল। খুব চেনা লাগল ওই তির্যক মেয়েলি আওয়াজটা। কেইন উদ্বিগ্ন হয়ে অপেক্ষা করছিল পরবর্তী আঘাতের।
“ওঠ।” পুরুষকণ্ঠ বলল।
কেইন তার পায়ের উপর বুটের চাপ অনুভব করল। ধীরে ধীরে শরীরটাকে ওলটাল, উঠে বসল। মাথা ঝাঁকাল, নাড়ল, কিন্তু সকালের পরিবেশে ছড়িয়ে-থাকা ঘন কুয়াশা যেন ওর মস্তিষ্ককে আবৃত করে রেখেছে বলে মনে হচ্ছিল। হাত ও পা এতটাই ভারী লাগছিল যে, ওর মনে হল, শিরায় শিরায় যেন সিসা ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে।
একটু একটু করে সব স্মৃতি ফিরে এল। মিসেস ফেয়ারচাইল্ড। স্কচ। কুয়াশা-ঢাকা সামনের এলাকাটার দিকে তাকাল। মিস্টার ফেয়ারচাইল্ড, কেইনের পিস্তলটা হাতে নিয়ে বিকৃত মুখে তার দিকেই তাকিয়ে আছে। মহিলা স্বামীর পিছনেই ছিলেন, এখনও সেই কালো গাউনটাই পরে আছেন। কেইন দেখতে পায়, ওটা ছিঁড়ে গিয়েছে।
“ইচ্ছে হচ্ছে, তোকে এখনই মেরে ফেলি।” মিস্টার ফেয়ারচাইল্ড বলল, কণ্ঠস্বর ক্রোধের তাড়নায় বিশ্রী শোনাল, “কিন্তু আপাতত আমার মণিটা চাই। ওঠ।”
“ডার্লিং,” মিসেস ফেয়ারচাইল্ড তার স্বামীকে বলল, কেইনের তাকিয়ে চোখ নাচাতে নাচাতে, “ওই লোকটা যাকে বলে একটা যা-তা, জঘন্য।”
কেইন ঢোঁক গেলার চেষ্টা করল, সেটাও খুব কষ্টকর মনে হল। শরীরের প্রতিটা অঙ্গ, তার মদের মধ্যে যে মাদক মিশিয়ে দেওয়া হয়েছিল, তার প্রভাবে আচ্ছন্ন হয়ে আছে। নিশ্চিতভাবেই এই মুহূর্তে ঠিকঠাক করে কোনো কাজ করাই ওর পক্ষে অসম্ভব। একটা হাত মুখে ঠেকাল, আঙুলগুলোতে চটচটে কিছু একটা লাগল।
“ওঠ!” মিস্টার ফেয়ারচাইল্ড চোখ-মুখ কুঁচকে চেঁচিয়ে উঠলেন।
কেইন হাঁটুতে ভর দিয়ে উঠেই আবার ধপ করে পড়ে গেল। মাটি আঁকড়ে ধরে অপেক্ষা করছিল আবার একটা বুটের ঘা খাওয়ার জন্য। সেটা ঘটলও, ও আবার চেষ্টা করল ওঠার। আর-একবার হাঁটুতে ভর দিয়ে শরীরটা খাড়া করল, তারপর একটু একটু করে উঠে দাঁড়াল। ক্ষণিকের জন্য মনে হল, তার মাথাটা যেন কাঁধ থেকে আলাদা হয়ে দূরে ভাসছে। শরীরের নীচের দিকে তাকাল, ওর মনে হল, যা দেখা যাচ্ছে, সেটা অন্য কারও শরীর। কেমন যেন ল্যাতপেতে, ক্ষতবিক্ষত, কোনো পোশাক নেই সেখানে। ও আবার পড়ে যাচ্ছিল।
মিস্টার ফেয়ারচাইল্ড কেইনের হাত ধরে সোজা করে দাঁড় করিয়ে দিল। “আমি তোকে দু-মিনিট দিচ্ছি, শুনতে পাচ্ছিস হতচ্ছাড়া! জলদি জামাকাপড় পরে, তোর আকাশযানের চালকের আসনে গিয়ে বসার জন্য।”
বোকার মতো দৃষ্টিতে কেইন মিস্টার ফেয়ারচাইল্ডের দিকে তাকাল। লোকটা কেইনকে জোরে একবার ঝাঁকাল। কেইন ঘুরে নিবে-যাওয়া আগুনের আশপাশে তাকাল জামাকাপড়ের খোঁজে। ওর শরীর টলে উঠল, পরপর দুবার। অন্ধকার নেমে এল চোখের সামনে। ও আবার হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল।
তারপর আবার উঠে দাঁড়াল, কোনোমতে পোশাক চাপাল নিজের শরীরে। অস্পষ্টভাবে হলেও বুঝতে পারছিল, রক্ত তার চিবুক বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে জ্যাকেটের উপর। আঙুল দিয়ে সেই রক্ত স্পর্শ করল, কিন্তু কিছুই বুঝতে পারল না।
মিস্টার ফেয়ারচাইল্ড এবার তাঁর স্ত্রী-র দিকে ফিরলেন। “তোমাকেও বলছি, জলদি কেবিনে যাও! পোশাক পরে নাও।”
“চার্লস,” অনুনয়ের সুরে বলল, “বুঝতেই পারছ, ওই আমাকে এত পান করতে বাধ্য করেছিল।”
“যাও!” পিস্তল নাচিয়ে বললেন মিস্টার ফেয়ারচাইল্ড।
মহিলা বাঁকা হাসি হেসে আকাশযানের দিকে এগিয়ে গেলেন। চারদিকে জঙ্গলে এত ঘন কুয়াশা জমেছিল যে, দশ বা বারো গজের বেশি দূরে না-থাকা জেটকপ্টারটাকেও ভালো করে দেখা যাচ্ছিল না। কেবিনের দরজা খোলা ও বন্ধ হওয়ার শব্দ শুনতে পেল কেইন।
মিস্টার ফেয়ারচাইল্ড কেইনের পেটের দিকে বন্দুক তাক করলেন। “এখন থেকে ভেবেচিন্তে পা ফেলবি, বুঝলি।” বললেন, “এই বন্দুক সব সময় তোর দিকে তাক করাই থাকবে, যতক্ষণ না আমি স্ক্রিস মণিটা খুঁজে পাই। শয়তানের বাচ্চা, তোকে বাঁচিয়ে রেখেছি একটাই কারণে, আর সেটা হল, ওটা আমার চাই। বুঝতে পারছিস?”
কেইন অনেক কষ্টে কথা বলার ক্ষমতা ফিরে পায়, তাও সেটা উচ্চারিত অদ্ভুতভাবে, “আমি আপনাকে নিয়ে উড়তে পারব না…” কথাটা শুনে সামনের লোকটার মুখ ফ্যাকাশে মেরে যায় এবং মিস্টার ফেয়ারচাইল্ডের হাত সমেত বন্দুকটা দুলে ওঠে। কেইন ভালোভাবেই সেটা দেখতে পায়, ওটা এসে আঘাত হানে তার দু-চোখের মাঝখানে।
কেইনের মুখ ও বুক থেকে ঘাম ঝরে পড়ছিল। নিশ্বাস নেওয়ার জন্য আঁকুপাঁকু করছিল ও। মস্তিষ্কের ভিতর যন্ত্রণার লহর বয়ে চলেছিল। হাত ও পায়ের অসাড় ভাব ওকে জমির সঙ্গে আটকে রেখে দিয়েছিল। অবশেষে চোখ খুলে তাকাল, বুঝতে পারল, ওকে টানতে টানতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। জাহাজের কেবিনে উঠে-যাওয়া সিঁড়ির ধাপ ঠেকল ওর পিঠে। মাথাটা নাড়তেই দাঁত ঠোকা খেল রুপালি ধাতুর সঙ্গে। ও বুঝতে পারছিল না, ওকে নিয়ে ঠিক কী করা হচ্ছে।
“যা, উপরে উঠে যা।” মিস্টার ফেয়ারচাইল্ডের কণ্ঠস্বর শুনতে পেল।
হাত তুলে সিঁড়ির পাশের অংশ চেপে ধরল কেইন। টেনে তুলতে লাগল শরীরটাকে। খুবই ধীর গতির প্রচেষ্টা। চোখের ভিতর ঢুকে যাচ্ছিল রক্ত। মাথা ঘুরছিল বনবন করে, শরীরের সঙ্গে ওটার কোনো সম্পর্কই নেই মনে হচ্ছিল। কেইন সিঁড়িতে শরীরটা ঝুলিয়ে কোনোক্রমে এক ধাপ উপরে ওঠাল। তারপর আর-এক ধাপ। পৌঁছে গেল শেষ ধাপের কাছে। মিস্টার ফেয়ারচাইল্ড ওকে ঠেলে কেবিনে ঢুকিয়ে দিতেই, কেইন হাত-পা ছড়িয়ে পড়ে গেল মেঝের উপর।
শুনতে পেল, মিস্টার ফেয়ারচাইল্ড তার পিছনে উঠে আসছেন, দরজাটা ঝকাং করে বন্ধ হয়ে গেল।
কেইন চিত হয়ে শুয়ে উপরের দিকে তাকাল। মিসেস ফেয়ারচাইল্ড নতুন সাদা শর্টস এবং ব্লাউজ় পরে দাঁড়িয়ে আছেন। চুল এখন ভালো করে আঁচড়ানো। গোলাপি ত্বক উজ্জ্বল আভা ছড়াচ্ছে। কেইনের দিকে তাকিয়ে হাসলেন মহিলা, সাদা দাঁতের সারি দেখা গেল, “আপনি খুব মজার জিনিস, মিস্টার কেইন।”
কেইন বুঝতে পারছিল, ওই মহিলা তার সঙ্গে যা করেছেন, তার জন্য এই মুহূর্তে ওর রাগে ফেটে পড়া উচিত। কিন্তু মাদকের প্রভাব এই মুহূর্তে তাকে কিছুই করতে দিচ্ছিল না। চেতনা এবং শক্তির ফিরিয়ে আনার জন্য লড়াই করা ছাড়া।
“ওকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করো,” মিস্টার ফেয়ারচাইল্ড বললেন, “জলদি। তারপরেই আমরা এখান থেকে বিদায় নেব।”
মহিলা কেবিনের পিছন থেকে সাবান ও জল নিয়ে এলেন। কেইনের মুখটা ভালো করে ধুয়ে দেওয়ার সময় ইচ্ছে করেই আঙুল দিয়ে কাটা এবং ফোলা জায়গাগুলোতে জোরে চাপ দিলেন। ক্ষতস্থানে ঢেলে দিলেন আগুনে পোড়ার মতো প্রতিক্রিয়া হয় এমন ওষুধ। কেইন নিশ্চল হয়ে শুয়ে থাকল। নিজেকে সময় দিচ্ছিল শরীরে নতুন করে শক্তি ফিরে পাওয়ার। মহিলা উঠে দাঁড়িয়ে স্বামীর দিকে তাকালেন।
“ঠিক আছে।” মিস্টার ফেয়ারচাইল্ড বললেন, “চল, উঠে পড়, অ্যাই হতচ্ছাড়া কেইন।”
কেইন লোকটার মুখের দিকে তাকাল, নিজের মুখের অবস্থা অনুমান করল। বন্দুকটার দিকে তাকাল, তারপর তাকে আঘাত-করা বুটের দিকে। ধীরে ধীরে উঠে গিয়ে বসল জেটকপ্টারের চালকের আসনে। নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষেত্রে তার গতিবিধি ধীর এবং এলোমেলো ধরনের হচ্ছিল। মিস্টার ফেয়ারচাইল্ডের দিকে তাকাল, জেট থেকে কুয়াশাভারাক্রান্ত পরিবেশে ছিটকে গেল আগুনের ফুলকি। “এভাবে উড়তে পারব না। ভারসাম্য পাচ্ছি না, ‘কোঅর্ডিনেশন’ হচ্ছে না। ‘ভিজ়িবিলিটি’ নেই, আমি…।”
লোকটা পিস্তলটা কেইনের দিকে ঘোরাল।
কেইন ‘ইনস্ট্রুমেন্ট প্যানেল’টার দিকে তাকাল, চেষ্টা করছিল দোলানি থামানোর। হাতটা নড়াতেই বুঝতে পারল, আকাশযান উপরের দিকে উঠছে। চেষ্টা করল যানটাকে যতটা সম্ভব স্থির রাখার এবং ধীরে ধীরে ভেসে ওঠার। কিন্তু ওর হাত কেঁপে গেল, যানটা দুলে উঠে ফাঁকা জায়গাটার একপাশে ভেসে গেল। ঘন কুয়াশা ভেদ করে সহসাই দেখা গেল গাছপালার জটলা, কেইন জেটকপ্টারটাকে জোর করে সোজা উপরে ওঠানোর চেষ্টা করল। শোনা গেল জেটের গর্জন। রুপালি জেটকপ্টার সামনে-পিছনে দুলছিল, উঠছিল, নামছিল, ঝাঁকুনি খাচ্ছিল। ঠিকমতো নিয়ন্ত্রণ করতে পারছিল না কেইন।
জলপ্রপাতের শব্দ ওদের কানে এসে ধাক্কা মারল। কেইন আকাশযানটাকে এক ঝটকায় বিপরীত দিকে ঘুরিয়ে দিল। ওটা উঠে গেল গাছেদের মাথার উপরে। কয়েক মুহূর্ত বাদেই জঙ্গল এবং পাথুরে এলাকা থেকে অনেকটাই উপরে ভেসে উঠল জেটকপ্টার।
সহজাত প্রবৃত্তি কেইনকে অস্পষ্ট দিক্নির্দেশনা দিচ্ছিল। নিজের অস্থির ইন্দ্রিয়গুলোকে কোনোমতে সামলে ও আরও বেশি উচ্চতায় ওঠার দিকে মন দিল।
“কেউ কেউ বলে স্ক্রিস মণি আসলে একটা হিরে।” মিসেস ফেয়ারচাইল্ড স্বপ্নালু স্বরে বললেন, “আবার কেউ বলে ওটা একটা পান্না। কারও মতে ওটা নাকি একটা রুবি। তোমার কী মনে হয়, চার্লস?”
মিস্টার ফেয়ারচাইল্ড নিশ্চুপ, কেইনের পাশের আসনে বসে ছিলেন। এখনও পিস্তলটাকে কেইনের দিকে তাক করেই ধরে আছেন।
“অন্যরকম কিছু করার চেষ্টা কোরো না কেইন।” বললেন, “হাল ছাড়ার আগে আমি সব কিছু শেষ করে সবাইকে নরকে নিয়ে যাব, বলে দিলাম।”
কেইন তার আকাশযান ভাসিয়ে নিয়ে চলল।
“বেশ রোমান্টিক, তা-ই না?” মহিলা বললেন, কেইনের পিছন থেকে, “এই মহাবিশ্বের সব চেয়ে মূল্যবান রত্ন পড়ে আছে শুক্র গ্রহের গহিন জঙ্গলের ভিতরে, যাকে পাহারা দিচ্ছে অতিকায় কিছু বিড়াল। আর আমার প্রিয় চার্লস সেটাই আমার জন্য নিয়ে আসতে চলেছে। তোমার মাথায় আশীর্বাদ ঝরে পড়ুক, চার্লস। তুমি একজন অসাধারণ স্বামী। আশা করছি, বিড়ালগুলো তোমার নাগাল পাবে না।”
কেইন কথাগুলো শুনল, কিন্তু এর ভিতর যে তির্যক ব্যাপারটা লুকিয়ে আছে, সেটা তার মাদকের প্রভাবে আচ্ছন্ন মস্তিষ্ক খুব একটা ভালো করে বুঝতে পারল না। বন্দুকটা মিস্টার ফেয়ারচাইল্ড তার দিকে তাক করে রেখেছে—এটা বুঝে শুধুমাত্র যাননিয়ন্ত্রণেই মনোনিবেশ করেছিল। এটা ভালো করেই বুঝতে পারছিল. এই অবস্থায় ও যদি লোকটাকে বোকা বানানোর ফন্দি আঁটে, যেটা করতে ওর মন চাইছিল তাহলে মিস্টার ফেয়ারচাইল্ড ওকে গুলি করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করবেন না।
কেইনের অসাড় আঙুলগুলো দিয়েই কাজ করে চলেছিল। শুধুমাত্র যদি সে নিজের শরীরটাকে নিয়ন্ত্রণ করার মতো একটা পথ খুঁজে পেত…
ওরা সেই অঞ্চলের দিকে যাচ্ছিল, যেখানে কেইন ভেবেছিল মন্দিরটা থাকা উচিত।
“এখানেই কোথাও।” ও বলল। অসাড় জিবটা উচ্চারণ করার সময়েও সহযোগিতা করছিল না ঠিকমতো। “এখানেই কোথাও।”
কুয়াশার প্রলেপ আকাশযানটার চারপাশে নরম টিস্যুর মতো ছড়িয়ে ছিল। ওটার একটা ডানা যতটা লম্বা, তারপর আর কিছুই সেভাবে দেখা যাচ্ছিল না। কেইন ধীরে ধীরে ওটাকে নীচে নামাতে শুরু করল। ডান পাশের ডানার নীচের দিকে একটা সোনালি গম্বুজ আকৃতির বস্তু দেখা গেল। কেইন আবার জেটকপ্টারটাকে উপরে উঠিয়ে নিয়ে গেল।
মুচকি হাসল, সে হাসিতে মিশে ছিল ধূর্ততা। “মন্দিরটার,” একটু যেন আনমনাভাবেই বলে উঠল, “এত কাছে আর কোনোভাবেই যাওয়া সম্ভব নয় মনে হয়।” তারপর যে কথাটা বলল, তার ভিতর লুকিয়ে-থাকা অর্থটা ভেবে ও মনে মনে হেসে উঠল। বুঝতে পারল, মাতালের মতোই তার কথা বলাটাকে সে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। আটকাতে পারছে না হাসিটাকেও। অভিশপ্ত মাদকের প্রভাব। ভাবতে-না ভাবতেই হাসিটা বের হয়ে এল ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে। সেটা প্রতিধ্বনিত হল কেবিনের ভিতর।
কেইন বুঝতে পারল, পিস্তলটা চেপে বসছে ওর শরীরের পাশে, ইস্পাতের নল খোঁচা মারছে ওর পাঁজরে। হাসিটা থেমে গেল, যেন কেউ ওর মুখ চেপে ধরল। “আমার কিছু করার…”
মিস্টার ফেয়ারচাইল্ডের মুখটা কেইনের মুখের কাছে এগিয়ে এল। “খুব হাসি পাচ্ছে তা-ই না মিস্টার কেইন? ঠিক আছে, আমিই তোকে হাসাব।” লোকটা ক্ষিপ্ত কণ্ঠে ফিশফিশ করে বলল, “যা ঘটেছে, তার কারণেই তোকে হাসাব, মনে রেখো! কী বললাম, মাথায় ঢুকল, হারামজাদা…।”
কেইন বুঝতে পারল, পিস্তলটা তার পাঁজরের কাছ থেকে সরে গেল, তারপরেই আঘাত হানল হাতের উপর। আবছা ব্যাপারটা অনুমান করে ও নিজেকে সরাতে চেয়েছিল, কিন্তু পারেনি। যন্ত্রণার অনুভূতি ওকে প্রায় পঙ্গু করে দেয়, চিৎকার ছিটকে বের হয়ে আসে ঠকঠক করে কাঁপতে-থাকা দাঁতের ফাঁক দিয়ে। জেটকপ্টারটা দুলে ওঠে, নেমে যেতে থাকে নীচের দিকে।
“তুমি একটা বোকার হদ্দ!” মিসেস ফেয়ারচাইল্ড তাঁর স্বামীর দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে ওঠেন।
কেইন বুঝতে পারে, সে তার তার আসন থেকে পিছলে যাচ্ছে, শরীর কাঁপছে ব্যথায়। হাত বাড়ায় নিয়ন্ত্রণের হাতলটা আঁকড়ে ধরার জন্য। গাছের মাথাগুলো চোখে পড়ার আগে আকাশযানটাকে কিছুটা সোজা করতে পারে মাত্র। জেট বন্ধ করে দেয়। ওদের চারপাশে তখন শুধুই গাছের জটলা। জেটকপ্টারের ডানা ভাঙার শব্দ কানে আসে। তার সঙ্গেই ভেসে আসে কাচ ভাঙার আওয়াজ। তারপর আর কিছুই শুনতে পায় না।
দেখার ক্ষমতা ফিরে পেয়ে নিজের হাতের দিকে তাকায় কেইন। অদ্ভুতভাবে ওটা বেঁকে গিয়েছে।
ওটা কার হাত? ভাবে।
ওর মস্তিষ্ক চাইছিল, সামনে থাকা ওই অদ্ভুতভাবে বাঁকা হাতটা দেখে কেইন হাসুক, ওটাতে একটা চাপড় মারুক। হাসি ফুটে ওঠে ওর মুখে এবং যে হাতটা অক্ষত ছিল, সেটাকে এগিয়ে নিয়ে যায়।
“ওহ্, মা গো!” হঠাৎ করে চোখে অন্ধকার-দেখা ব্যথা অনুভব করে বলে ওঠে। পাশের ভাঙা ধাতব কিছু চেপে ধরে। যন্ত্রণার চাপে ওর চোখ দিয়ে বের হয়ে আসে জল।
আমার খুব ঘুম পাচ্ছে, এবার মনে হয় মরে যাব, ভাবল। অস্পষ্ট একটা প্রশ্ন তার সঙ্গেই ভেসে এল, তার ইচ্ছা এবং শারীরিক শক্তি কোথায় গেল? সব কি শরীর থেকে বের হয়ে গিয়েছে? লোকটা যখন তাকে আঘাত করেছিল, তখনই কি ওরা বিদায় নেয়? গত রাতে ওই মহিলা কি সব শুষে নিয়েছিলেন, যেমন করে ভ্যাম্পায়াররা রক্ত চুষে নেয়?
তাহলে ‘গুড নাইট’, ধাতব বস্তুটা থেকে হাতটা নামিয়ে নিল। ‘গুডবাই’। কেইন চোখ বন্ধ করল।
ও চিৎকার করছিল, বুঝতেও পারছিল এবং কোথা থেকে যেন একজন লোকের কণ্ঠস্বরও শুনতে পেল, “গজ। গজ দরকার।” কেমন যেন ক্যাড়কেড়ে একটা শব্দ। ধাতব চাকা নুড়িপাথরের উপর দিয়ে ঘষটে যাওয়ার মতো। কেইন চোখ খুলল। মিস্টার ফেয়ারচাইল্ড কিছু একটা ওর ভাঙা হাতের চারপাশে জড়িয়ে দিচ্ছেন। ওটা কেবিনের প্যানেলিং-এর একটা অংশ থেকে ছিঁড়ে-নেওয়া কাপড়ের টুকরো।
ফেয়ারচাইল্ড কেইনের দিকে তাকালেন। গালে গলায় বড়ো বড়ো দাড়ি। কেইন লক্ষ করল, লোকটার চোখে এখন আর দুঃখের ছাপ নেই। তাঁর স্ত্রী-র মতোই জ্বলজ্বল করছে। উনি কেইনের দিকে তাকিয়ে হাসলেন, সে হাসিতে বিন্দুমাত্র আনন্দ মিশে নেই। দাঁতে দাঁত-চেপা স্বরে বললেন, “তুমি ভাগ্যবান, কেইন। হাতটা কেটে ফেলার বদলে সেট করে দিয়েছি।”
কেইন মুচকি মুচকি হাসতে-থাকা মুখটা দেখল। একটা কাঁপুনি অনুভব করল সারা শরীরে। মুখে জমে-থাকা ঘাম ঠান্ডা হয়ে গেল। আমি নিক কেইন নই, ওর মনে হল। নিশ্চিতভাবেই না। আমি শুধু একজন ভয়ার্ত, ঠান্ডা-হয়ে-যাওয়া মানুষ, যার কোনো সাহস নেই বা সাহস দেখানোর মতো কারণ। আমি একটা রাবারের পুতুল, হ্যাঁ আমি সত্যিই তা-ই। সুতো ধরে টান মারলেই যে পুতুল নাচবে।
“ওঠো।” বললেন মিস্টার ফেয়ারচাইল্ড।
“সেটাই ভালো।” কেইন বিড়বিড় কথাটা বলে পাগলের মতো হাসল।
নিজেকে ঠেলে তুলতেই ভাঙা আকাশযানের কেবিনটা দুলে উঠল। চারপাশে তাকাল, তার চোখে ফুটে উঠল ভয়। “এই ভাঙাচোরা বস্তুটাই কি আমার প্রিয় সিলভার শিপ?” চিৎকার করে উঠল, “কী সর্বনাশ!” লাথি মারার চেষ্টা করল ভেঙে-যাওয়া একটা প্যানেলে।
বুঝতে পারল, সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ে যাচ্ছে, অক্ষত হাতটা সামনের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে নিজেকে সামলাল। মাদক, ব্যথা, মস্তিষ্কের গভীরে অনুরণিত হল তার সঙ্গে ভাঙা হাত।
এই মুহূর্তে ও যেন একই দেহে দুজন মানুষ, যারা একে অপরকে দেখছে, ক্ষণেক্ষণে বদলে যাচ্ছে তাদের অবস্থান, এক পরিচয় থেকে অন্য পরিচয়ে। যুক্তিহীন, অযৌক্তিকভাবে তারা হাসছে, কাঁদছে।
সামনে মহিলার দিকে তাকাল কেইন। কেবিনের পিছনের দিকটায় বসে ছিলেন। চোখের উপরের সরু একটা কাটা থেকে মুখের পাশ দিয়ে একটা দাগের মতো গড়িয়ে যাচ্ছে রক্ত। “আমরা এখান থেকে আর কখনোই ফিরে যেতে পারব না।” বললেন। উচ্চকিত কণ্ঠস্বর, কোনো ওঠানামা নেই তাতে। “আমরা ফিরে যেতে পারব না।”
“আপনি আমাদের জন্য একটু নাচ করছেন না কেন?” কেইন পরামর্শ দেওয়ার সুরে বলল।
“এগিয়ে চলো কেইন।” লোকটা কেইনের পিঠে ঠ্যালা মেরে বলল, “ও তখনই নাচবে, যখন আমি ওকে স্ক্রিস মণিটা দেব।”
আস্তে আস্তে হামাগুড়ি দিয়ে কেবিন থেকে বেরিয়ে এল কেইন। জেটকপ্টারের নীচের দিকটা একেবারে ভেঙেচুরে গিয়েছে। কেবিনটা নেমে গিয়েছে জমির কাছে। ভিতর থেকে বের হয়ে আসার পর কেইনের মনে হল, ও যেন বাষ্পের সমুদ্রে প্রবেশ করল।
কতদিন? নিজের ভাঙা হাতের দিকে তাকিয়ে ভাবার চেষ্টা করল। কতদিন ধরে মাদকের প্রভাব তার মস্তিষ্কে ছেয়ে আছে? এই কেইন আসল কেইন নয়। এ এক দুর্বল মাদকের নেশায় আচ্ছন্ন-হয়ে-থাকা কাকতাড়ুয়া।
সহসাই বেদনার একটা স্রোত তার চেতনায় ছেয়ে যায়। আবার নিমেষেই মিলিয়ে গেল। চরম একটা যন্ত্রণাবোধের পর মস্তিষ্কের ভিতরটা যেন বনবন করে বোকার মতো ঘুরছে। একটা ল্যাতপেতে ম্যানেকুইনের মতো কুয়াশার শূন্যতার মাঝে কিছু একটা খোঁজার জন্য ধীরে ধীরে ঘুরে গেল।
“আমি কোথায়?” জোরে চেঁচিয়ে উঠল।
“স্বর্গ থেকে প্রায় মাইলখানেক দূরে।” পিছন থেকে শোনা গেল মিস্টার ফেয়ারচাইল্ডের কণ্ঠ। এই মুহূর্তে কেইনের কেবিন থেকে নেওয়া রাইফেলটা ধরে আছেন হাতে। “জ্যানেট?” লোকটা কেবিনের দিকে ঘুরে বলল। “ওখান থেকে একটা রাইফেল নিয়ে নাও। মিস্টার কেইন এবার আমাদেরকে আসল জায়গায় নিয়ে যাবেন। শোনো, সবার আগে মণিটা চাই।” শেষ কথাটা কেইনকে বললেন, “তারপর তোমার ব্যবস্থা হবে। চিন্তা নেই, মরার আগে মণিটা তোমাকেই সবার আগে ছুঁয়ে দেখতে দেব।”
মিসেস ফেয়ারচাইল্ড কেবিন থেকে বেরিয়ে এলেন, হাতে রাইফেল। স্বামীর দিকে তাক করে বললেন, “আমরা এখান থেকে কোনোদিনই ফিরে যেতে পারব না।” কথাটা পরপর দুবার গানের মতো করে বললেন।
“আমাকে বাদ দিয়ে তো নয়ই।” মিস্টার ফেয়ারচাইল্ড শান্তস্বরে তাঁর দিকে তাক করা রাইফেলের দিকে তাকিয়ে বললেন। তারপরে ঘুরে দাঁড়ালেন।
মহিলার মুখের গোলাপি দীপ্তি কোথায় যেন হারিয়ে গিয়েছে। রক্ত-লেগে-থাকা জায়গাগুলো বাদে সবটাই ফ্যাকাশে সাদা দেখাচ্ছে।
“কেইন, চলো, এগোনো যাক।” মিস্টার ফেয়ারচাইল্ড বললেন।
“আমি জানি না, কোথায় যেতে হবে।” কেইন নেহাত বোকার মতো বলল।
“উপরে,” মিস্টার ফেয়ারচাইল্ড বললেন, “শুধু উপরে নিয়ে চলো। ওই মন্দির কোথায়, সেটা তোমার জানার দরকার নেই। তুমি আমাদের পরিকল্পনার চেয়ে অনেক কাছাকাছি নিয়ে এসেছ। তুমি এখন শুধুই একটা টোপ, কেইন। বিড়ালদের জন্য টোপ। বিড়ালদের কথা মনে আছে তো?”
“আমি এসবের ভিতর দিয়ে যাব না।” মহিলা তাঁদের চারপাশের কুয়াশার দিকে তাকিয়ে বললেন।
“ঠিক আছে, যেতে হবে না,” মিস্টার ফেয়ারচাইল্ড বললেন, “এখানেই থাকো, অপেক্ষা করো বিড়ালদের জন্য। আমি মণিটা নিয়ে ফিরে আসব তোমার কাছে। ততক্ষণ যদি ওরা তোমার কিছু অবশিষ্ট রাখে। শোনো, বাজে কথা রাখো, তুমিও আমাদের সঙ্গে যাচ্ছ ওই বস্তুটা নিয়ে আসার জন্য। আমার কথা শুনতে পেলে?” পুনরায় ঘুরে জ্যানেটের মুখোমুখি হলেন। “তুমি ওটা পাবে, যদি আমি সতেরোটা বিড়াল মারতে পারি। আর কেইন, বেঁচে থাকো বা মরে যাও, তুমিও আমার সঙ্গে যাবে ওটা আনার জন্য, শুনতে পেলে?”
জ্যানেটকে বেশ ফ্যাকাশে এবং অসুস্থ দেখাচ্ছিল। কেইন মনে করার চেষ্টা করল, আগের রাতে মহিলাকে কেমন দেখাচ্ছিল। ভাবতেই মাথা টনটন করে উঠল।
কেইনকে হুমকির স্বরে লোকটা বলল, “চলো! চলো! এগোও মিস্টার কেইন।”
চার
কেইন এগোতে থাকে। চেষ্টা করে নিজেকেই ঘেন্না করার, যেভাবে সে ওই রাইফেল দেখে ভয় পেয়ে লোকটার কথায় কাজ করতে বাধ্য হচ্ছে তার জন্য। কিন্তু ওর মধ্যে শুধু অদ্ভুত রকমের একটা চাঞ্চল্যই কাজ করছিল, যেখানে সমস্ত শক্তি আর স্নায়ুর স্পন্দন ধাক্কা মারছিল। মনে হচ্ছিল, মাদকের প্রভাবে তার ভিতরে থাকা ইস্পাতসম দৃঢ়তা গলে বের হয়ে গিয়েছে।
আমি আসলে একটা মাছের মতো, পাতার জটলা ঠেলে এগিয়ে যেতে যেতে কেইন ভাবল একটা পাখনা-ভাঙা মাছ। বিড়ালেরা পাখনা-ভাঙা মাছ পছন্দ করে কি? ভাবার চেষ্টা করছিল। শুক্র গ্রহের বন্য জগতের ভিতর দিয়ে সার বেঁধে তিনজন মানুষ নিঃশব্দে এগিয়ে চলেছিল ধীরে ধীরে।
আশপাশে শব্দগুলো কেইনের মস্তিষ্কে একসঙ্গে বড়ো হলঘরের ভিতর বাজতে-থাকা এক ডজন রেকর্ডের মতো প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল। টিউ পাখিরা তাদের হলুদ ঠোঁট নাড়িয়ে ওর মাথার ভিতর ঢুকে চিৎকার জুড়েছিল। কিট্জ পাখিগুলো ঝোপের ভিতর থেকে ঝটপট করে বের হয়ে যেভাবে চিৎকার করছিল, সেটা শুনে মনে হচ্ছিল, নখ দিয়ে কেউ মসৃণ স্লেটের উপর আঁচড় কাটছে।
জঙ্গলের এই অংশে অন্য আর-একটা জিনিসও ছিল। নরম জেলির মতো এক ধরনের অদ্ভুত বেদানার মতো ফল। এক-একটা মানুষের হাতের মতো বড়ো। লতাগুচ্ছের গা থেকে ঝুলছিল। কেইন যখন তাদের পাশ কাটিয়ে যাচ্ছিল, ওগুলো গাছ থেকে তার গায়ে নেমে এসে ওর শরীররস শুষে নেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছিল। একটাকে ঠেলে দূরে ফেলে দিতে আরও অনেকগুলো নেমে আসছিল তড়তড় করে।
“তোদের জন্য আমার শিরায় কিছুই অবশিষ্ট নেই।” ওগুলোকে উদ্দেশ করে বলে কেইন, “হয়তো ওখানে এখন বইছে গরম চায়ের স্রোত?”
মিস্টার ফেয়ারচাইল্ড ওর পিঠে রাইফেলের খোঁচা মারলেন এবং কেইন একটা ফলকে ঝেড়ে ফেলে দিল দূরে।
একটা সাপের মতো ‘ট্রিল’ কেইনের সামনে নড়েচড়ে উঠল। বেগুনি এবং কালো চামড়ার প্রাণীটার দেহটা দেখে মনে হচ্ছিল, তেল মাখানো আছে। প্রায় চার ফুট লম্বা এবং দড়ির মতো মোটা। ওটার কখনও বন্ধ-না-হওয়া চোখ কেইনের দিকে তাকিয়ে ছিল।
“হ্যালো, বন্ধু।” কেইন তার ভালো হাতটা এগিয়ে দিল। ট্রিলটা সরে গেল।
ওটা একেবারে আমার মতো, ওর মনে হল। ভাবছিল, আবার কখন ব্যথার তরঙ্গ তার দেহ-মনকে ছিন্নভিন্ন করে দেবে। আমি ওই ট্রিলের মতোই। হাঁটার বদলে আমারও ওটার মতোই বুকে হেঁটে গিয়ে চলা উচিত।
ভাবতে ভাবতেই ব্যথা ছড়িয়ে গেল শরীরে, যার প্রভাবে মস্তিষ্ক থেকে মাদকের প্রভাব অনেকটাই সাফ হয়ে গেল। এবার ব্যথাটা অনেকক্ষণ স্থায়ী হল। মাদকের প্রভাব কমে আসছে ঠিক তখনই, যখন আমি চাইছি না। এরকম সময়ে ওর মনে ভেসে এল বিড়ালগুলোর চিন্তা; ভয়ংকর বিড়াল, সাংঘাতিক বিড়াল…
মস্তিষ্কটা যেন জোরে কেউ ঝাঁকিয়ে দিল, মাদকের পর্দা একেবারেই খসে পড়ে গেল। আমি কী নিয়ে চিন্তা করছিলাম? নিজেকেই প্রশ্ন করল। বিড়াল? সত্যিই কি বিড়ালের কথা ভাবছিলাম? কেন? বিড়ালেরা তো খুব সুন্দর, খুব ভালো, বিশেষ করে গ্রিথ বিড়াল। ওরা লেপার্ডের গায়ের দাগের মতো কালো। আচ্ছা, আমার মনে লেপার্ডের কথা এল কেন? আমার পিছনে থাকা লোকটাকে জিজ্ঞাসা করে দেখি। কেইন থমকে দাঁড়াল।
“এগোতে থাকো কেইন।” মিস্টার ফেয়ারচাইল্ড ফিশফিশ করে বললেন, “এগো হতচ্ছাড়া!”
লেপার্ড? লেপার্ডের কথা ভাবছি? কেইন নিজেকে জিজ্ঞেস করল, তারপর আবার এগোতে থাকল। সামনের রাস্তা ক্রমশ খাড়া হয়ে উপরে উঠে গিয়েছিল।
চাকুর মতো ধারালো গাছের পাতার ছোঁয়া লেগে শরীরের দশ-বারো জায়গায় কেটে গিয়েছিল। আহত হাতের চারপাশে বাঁধা গজ বড়োসড়ো ফোড়ার মতো ফুলে ছিল। মনে হচ্ছিল, কম্বল জড়ানো আছে। যদি কোনো বিড়াল দেখতে পাই, কেইন নিজেকে প্রতিশ্রুতি দিল, হাত থেকে একটা হাড় ছাড়িয়ে নিয়ে ওটার মাথায় আঘাত করব।
কুয়াশার পর্দা ওদের চারপাশে ক্ষুধার্ত প্রাণীর জিবের মতো ঝুলে ছিল, চাইছিল, এই গ্রহের ভিতরে থাকা সব কিছুকে চ্যাটচেটে আর্দ্রতা দিয়ে ঢেকে রাখতে। আশপাশে গাছপালার সংখ্যা কিছুটা কমতেই কেইন দেখতে পেল, এখানে-সেখানে পাথর পড়ে আছে। এই স্থান দিয়ে এগিয়ে যাওয়া অনেক সহজ। ওর মস্তিষ্কের কোনো একটা স্থান ওকে জানান দিচ্ছিল, এটাই গ্রিথদের বিচরণের এলাকা। প্রতিটা পদক্ষেপ ওদের এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে কমলা চোখ, ধারালো দাঁত দিয়ে সাজানো কালো মুখাবয়বের কাছাকাছি।
কেইনের নিজেকেও খুব দুর্বল মনে হচ্ছিল এবং প্রতিটা পদক্ষেপ ওকে খুব কষ্ট করেই ফেলতে হচ্ছিল। বাড়ছিল উত্তাপ। কিন্তু মুখে এখন ঘাম নেই, শুধু জ্বলেপুড়ে যাওয়ার মতো শুষ্কতা। ওর মাথাটা শরীর ছেড়ে যেন আবার ভেসে উঠতে শুরু করেছে, ওর মনে হল, একটা বেলুনের মতো ওটা গাছের উপর দিয়ে ভেসে যাবে এবার।
ভাবনাটা খুব মজার মনে হল, পেটের ভিতর হাসি ঘুলঘুলিয়ে উঠল। হেসেও ফেলল, অনুভব করল তার পেটের পেশির নড়াচড়া। তারপরেই ও থমকে গেল, কুয়াশা-মাখা বাতাসে ছড়িয়ে পড়ল হাসির অনুরণন। কেইন সরাসরি তাকিয়ে ছিল একটা গ্রিথ বিড়ালের কমলা চোখের দিকে।
থেমে গেল মুখের হাসি। একবার চোখ পিটপিট করল। বিড়ালটা নড়ল না। মিস্টার ও মিসেস ফেয়ারচাইল্ডও, কেইন বুঝতে পারল, পিছনে থমকে দাঁড়িয়ে গিয়েছেন। বিড়ালের চোখজোড়া কুয়াশার ভিতর দিয়ে জ্বলন্ত দুটো গোলকের মতো দেখাচ্ছে। ওটাকে আমি পুষব। কেইনের যন্ত্রণাক্লিষ্ট মস্তিষ্ক ভাবল, তারপর চলে যাব।
বিড়ালটা নিশ্চল দাঁড়িয়ে ছিল।
কেইন ধীরে ধীরে নতজানু হয়ে বসে সোজা বিড়ালটার চোখের দিকে তাকাল। প্রায় দশ গজ দূরে আছে ওটা।
কেইন মিস্টার ফেয়ারচাইল্ডের দিকে তাকাল। লোকটাও এক হাঁটু ভাঁজ করে বসে রাইফেল তাক করে ছিল বিড়ালের মাথার দিকে। মিসেস ফেয়ারচাইল্ড তার পিছনেই রাইফেলটা বাগিয়ে কুঁকড়ে কাঠের পুতুলের মতো দাঁড়িয়ে আছেন।
ধীরে ধীরে মাথা নড়িয়ে কেইন বিড়ালটার দিকে ফিরে তাকাল। দেখতে পেল, প্রাণীটা বিরাট ল্যাজটা ঝাপটাচ্ছে।
মিস্টার ফেয়ারচাইল্ড গুলি করছেন না কেন? কেইন নিজেকে প্রশ্ন করল। কীসের জন্য অপেক্ষা করছেন উনি?
সময় যেন থমকে গিয়েছিল।
কেইন আবার মুখ ফিরিয়ে ফেয়ারচাইল্ডের দিকে তাকাল। আরে এই হতভাগা পাগল, ভাবল। তোর হাতে রাইফেল আছে, তুই…
আর ঠিক তখন ও দেখল, লোকটার মুখ থেকে ঘাম ঝরে নেমে এসেছে অপলক চোখের উপর, নিশ্চিত ঠিক করে ‘ফোকাস’ করে পারছেন না। মিস্টার ফেয়ারচাইল্ডের শরীর কাঁপছিল, কেইনের মনে হল, এবার লোকটার হাত থেকে রাইফেলটা পড়ে যাবে, ও…
মহিলা চিৎকার করে উঠলেন, “গুলি করো! ওটাকে মেরে ফ্যালো!” ওঁর হাতের রাইফেলটাই গর্জে উঠল, গুলি ছুটে গেল বাতাস কেটে। কেইনের কাঁধে এসে ধাক্কা মারল আগুনের হলকা। বিড়ালটা নিমেষে ভয়ংকর একটা গর্জন ছেড়ে সামনের দিকে লাফ মারল, বাতাসে ভেসে গেল একটা উজ্জ্বল কালো অবয়ব।
রাইফেলের শব্দ, মহিলার চিৎকার এবং বিড়ালের গর্জনে মথিত হল পরিবেশ। কেইন অপেক্ষা করছিল, ওর মনে হচ্ছিল, সে একটা স্বপ্ন দেখছে। বিড়ালটা সোজা লাফ দিয়েছিল মিসেস ফেয়ারচাইল্ডকে লক্ষ করে। কালো-সাদা নখ দিয়ে সামনের শরীরটাকে তালগোল পাকিয়ে দিচ্ছিল। কেইন শুধু একটা পাক-খেতে-থাকা পিণ্ড থেকে চিৎকার শুনতে পাচ্ছিল।
কয়েক মুহূর্ত বাদে মহিলার দিক থেকে আর কোনো শব্দ পাওয়া যাচ্ছিল না। শুধু একটা দলিত-মথিত রক্ত-মাখা শরীর পড়ে ছিল। বিড়ালটা গুঁড়ি মেরে ঘুরল। কালো চামড়ার উপর দেখা যাচ্ছিল বিন্দু বিন্দু লাল রক্ত, তার সঙ্গে জ্বলজ্বলে বন্য কমলা চোখ।
কেইন আবার চোখ পিটপিট করল। বুঝতে পেরেছিল, মিস্টার ফেয়ারচাইল্ড তার পাশে পড়ে আছেন। তাঁর মাথার ভিতর ঢুকে গিয়েছে একটা বুলেট, হাতটা ধরে আছে অব্যবহৃত রাইফেলটাকে।
আমি কিছুই করতে পারব না, রাইফেলের দিকে তাকিয়ে কেইন ভাবল। ওই আগ্নেয়াস্ত্র স্পর্শ করার আগেই আমার শরীরে ঢুকে যাবে ধারালো নখ।
বিড়ালটা জমির দিকে আরও ঝুঁকে যায়, ওটার শরীরের পেশিগুলো টানটান হয়।
তবুও আমি চেষ্টা করব, কেইন ভাবল, ধীরে ধীরে হাত বাড়াল রাইফেলের দিকে। অতি ধীরে যেন কোনো পালক ভেসে যাচ্ছে।
‘লাফিয়ে পড় আমার উপর, যা ভাবছি, তা করতে পারব না।’
“গ্রিথ?” বাঁশির মতো কণ্ঠস্বর শোনা গেল।
বিড়ালটি নিশ্চল হয়েই রইল।
“গ্রিথ?”
বিড়ালটি ধীরে ধীরে শরীর ওঠাল, ল্যাজ ঝাপটাল। সবুজ কিছু হাত একসঙ্গে করতালি বাজাতেই বিড়ালটা ঘুরে নিমেষে অদৃশ্য হয়ে গেল।
কেইন তার হাতের তালু দিয়ে জমিতে চাপ দিয়ে মাথা তুলে এগিয়ে-আসতে-থাকা আবছা অবয়বগুলোর দিকে তাকাল। কুয়াশা মিলিয়ে যাচ্ছে বলেই মনে হচ্ছে। কেইন আরও স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিল, ধূসর মস্তকাবরণীর নীচে থাকা গম্ভীর মুখের সবুজ চামড়া এবং বড়ো বড়ো পলকহীন চোখকে।
মন্দিরের পুরোহিত? কেইন বিস্মিত হল। মন্দির থেকে? নিজেকেই বলল, আমি জানতাম না যে, এখানে শুক্র গ্রহের মানুষেরা আছে, খুব কমই ওদের দেখা মেলে। হঠাৎ করেই ওর মনে পড়ল, এই গ্রহে মহিলাদের তুলনায় পুরুষের সংখ্যা বেশি। ওদের দেখে সে একই সঙ্গে বিস্মিত এবং মুগ্ধ হল। “ইয়ে, বলছিলাম যে,” কেইন বলল, ওদের দিকে তাকিয়ে একটু হেসে, “না, মানে তেমন কিছু নয়।”
হাঁটুতে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়াল এবং মুখে এখনও হাসি। নিজের হাতের দিকে তাকাল, গজের বাঁধন আলগা হয়ে গিয়েছে। অবাক হয়ে মাথা নাড়ল। চোখ কুঁচকে কাঁধ থেকে গড়াতে-থাকা রক্তর দিকে তাকাল। “না, মানে তেমন কিছু…” আবারও একই কথা বলল এবং উঠে দাঁড়াল।
ভেজা মাটিতে মিসেস ফেয়ারচাইল্ডের দেহটা তালগোল পাকিয়ে পড়ে ছিল। মিস্টার ফেয়ারচাইল্ডও নিথর পড়ে ছিলেন। কেইন ওদের এক-এক করে দেখল। “একদম, হ্যাঁ একদম।” জোর গলায় বলল।
ধূসর পোশাকে আবৃত শুক্র গ্রহের মানুষদের দিকে ফিরে তাকাল। দেখল, ওরা বিষণ্ণতা-মাখা সদয় চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। একজন এগিয়ে এসে কেইনের ভাঙা হাতের উপরে কাঁধের অংশ ছুঁয়ে দেখল। অন্যরা দুটো মৃতদেহের দিকে এগিয়ে গেল। ওদের শরীরের উপর ঝুঁকে ধীরে ধীরে শীর্ণ সবুজ হাতগুলো নাড়াতে থাকল।
প্রার্থনা করছে? কেইন বিস্মিত চোখে দেখতে থাকল ওদের হস্তসঞ্চালন। কাঁধ ঝাঁকাল। কোনো একটা চিন্তা বেশিক্ষণ মাথায় ধরে রাখতে পারছে না।
কুয়াশা দ্রুত বাষ্পীভূত হচ্ছিল। কেইন, উপরের দিকে তাকাল, ভেবেছিল, এক বিশেষ সুচালো রূপরেখা দেখতে পাবে। সহসাই উপরে দেখা গেল সোনালি মন্দিরটাকে। হলুদরঙা সৌন্দর্যের বিশাল চূড়াটা ঝিলমিল করছিল উজ্জ্বল রোদের আলোয়।
কেইন এক অদ্ভুত সূর্যের দিকে তার মুখ ঘুরিয়েছিল, এক চোখধাঁধানো সূর্য, যে তার উজ্জ্বল জীবনরশ্মি প্রেরণ করছিল পাতার ফাঁক দিয়ে। কেইন বুঝতে পারল, ধূসর পোশাকধারীরা চারদিকে হাঁটু গেড়ে বসে প্রার্থনা শুরু করেছে। ওদের হাত উঠে আছে আলোর উৎসের দিকে।
ওরা কী বলছে? কেইন বিস্ময়ের হাসি হেসে নিজেকেই জিজ্ঞেস করল। কী বলছে ওরা? স্ক্রিস? সূর্য? শুক্র গ্রহের সব চেয়ে মূল্যবান রত্ন? ওটাকেই কি ওরা কি সোনার মন্দিরে পূজা করে? কেইন প্রথমে মিস্টার ফেয়ারচাইল্ড, তারপর ওঁর স্ত্রী-র দিকে তাকাল। এর জন্যেই কি ওঁরা মঙ্গল গ্রহ হয়ে পৃথিবী থেকে এসেছিলেন? সূর্য? পুনরায় অনুভব করল, তার পেটের মধ্যে আবার হাসি ঘুলঘুলিয়ে উঠছে। যেন অন্য কেউ হাসছে। ওর মুখ হাঁ হল, দাঁত সূর্যের আলোতে চকচক করে উঠল, উচ্চকিত হোহো হাসিতে ফেটে পড়ল কেইন।
“এই যে,” লোকটার নিথর শরীরের পাশে নিজেকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে গিয়ে বলল, “মিস্টার ফেয়ারচাইল্ড, দেখতে পাচ্ছ ওই যে তোমার মণি। দেখতে পাচ্ছ?” আকাশের দিকে ইশারা করল। “দাও, ওটা ওখান থেকে নামিয়ে ওকে দাও।” নিজের বলা কথায় নিজেই হেসে বলল, “না? আমিই বরং তোমার হয়ে ওকে দিয়ে দেব। সেটা ভালো হবে কি, বলো?” ঘুরে ধীরে ধীরে মিসেস ফেয়ারচাইল্ডের দেহের কাছে গেল। “এই যে,” মহিলার অপলক দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে বলল, “ওই যে, দেখতে পাচ্ছেন?”
মিসেস ফেয়ারচাইল্ডের মুখের দিকে তাকাল, উপরে ঝুলে-থাকা একটা লতানো গাছের বড়ো পাতার ছায়া এসে পড়েছে ওখানে। উঁচু হয়ে পাতাটা সরিয়ে দিল কেইন, যাতে সূর্যের আলো এসে পড়ে জ্যানেটের সাদা মুখটার উপর। “ওই যে ওখানে! নিয়ে নিন! চার্লসের তরফ থেকে আপনাকে পৌঁছে দিলাম আমি। ওটা কী সুন্দর, তা-ই না? কত বড়ো, কত উজ্জ্বল, তাই…।” হাসির দমকে ওর কথা আটকে গেল। বুঝতে পারল, গালের উপর দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে চোখের জল।
ফ্যাকাশে সবুজ হাতগুলো ওকে ধরে রেখেছে, যাতে কেইন পড়ে না যায়। ওরা ওকে মন্দিরের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। কেইন তার চারপাশের বড়ো বড়ো সদয় চোখের দিকে তাকিয়ে দেখল। অনুভব করল, সেই হাতগুলোর স্পর্শ, যারা ওকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। হাসি থামাতে পারছিল না। ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করছিল, যাতে ওটা থামানো যায়। ব্যথা আরও বেড়ে যাচ্ছিল হাসির কারণে। আর বেশি ব্যথা সে সহ্য করতে পারছে না।
সবুজ মুখওয়ালা এক শুক্রবাসীর ঠোঁট নড়ে উঠল। “বিস্রাআম?” শব্দটা বেশ কষ্ট করেই উচ্চারণ করল মানুষটা।
“বিশ্রাম?” কেইন বলল, হাসির দমকের মাঝে, হাসির দমক বদলে গিয়েছে কান্নায়। হ্যাঁ, ও নিশ্চিত, ও কাঁদছে। “হ্যাঁ, হ্যাঁ,” চোখের জল মুছতে চেষ্টা করে বলল, “ওহ্, হ্যাঁ। বিশ্রাম…।”
ফ্যাকাশে সবুজ হাতগুলো আবার প্রসারিত হল, তালু নীচের দিকে। বারবার নীচের দিকে কিছু ঝেড়ে ফেলার ভঙ্গিতে নাড়তে থাকল। সবরকম খারাপ বা মন্দকে দূরে সরাচ্ছিল ওরা। তারপর দু-হাতের তালু কাপের মতো করে উপরের দিকে ধীরে ধীরে ওঠাল, যেন সোনার গম্বুজ এবং তার পড়ে থাকা জগৎ থেকে বিশুদ্ধতা আঁজলা ভরে সংগ্রহ করছে। যেখানে উজ্জ্বল সূর্য জ্বলজ্বল করছে, শব্দহীনভাবে পা ফেলে উপরের দিকে উঠে গিয়ে হাঁটু গেড়ে বসল। ওইভাবেই চক্কর দিতে থাকল একটা হাতের মুঠোর সমান মাপের গোলককে ঘিরে। বাঁশির মতো কণ্ঠস্বর উচ্চারণ করল, ‘স্ক্রিস’। ‘স্ক্রিস,’ আরেকজন বলল। বারোটা কণ্ঠস্বর একসঙ্গে বলল। নাড়াতে থাকল হাতগুলো। রুপালি গোলকটা আর আগের মতো নিস্তেজ কুয়াশা আবৃত ছিল না, বিশুদ্ধ উজ্জ্বল সূর্যালোক মেখে ওটা সহস্র হিরের মতো চকচক করছিল। ওদের ঠোঁট নড়ছিল নীরবে। কোথাও একটা বিড়াল গর্জন করে উঠল। তারপর সবাই যেন ঘুমিয়ে পড়ল। চারদিকে ছেয়ে গেল নীরবতা। অতন্দ্র নীরবতা।
Tags: জেম্স ম্যাককিমি জুনিয়র, নবম বর্ষ প্রথম সংখ্যা, প্রতিম দাস