স্বপ্নে দেখা
লেখক: পারমিতা ঘোষ পাকড়ে
শিল্পী: টিম কল্পবিশ্ব
স্টেজে সৎপাত্র আবৃত্তি হচ্ছিল। লক্ষাধিকবার শোনা আমার, ছোলা চিবোতে চিবোতে নন্দিনীকে বললাম, “কাল একটা অদ্ভুত স্বপ্ন দেখলাম, জানিস?”
“তা-ই?”
“হ্যাঁ।”
“ও।”
“দূর মড়াখেগো, জানতে চাইবি না কী স্বপ্ন?”
“আমি কিছুই শুনতে পাচ্ছি না। আপাতত গঙ্গারাম আমার পাত্র হিসাবে কানের সামনে নাচছে। এটা শেষ হোক, তারপর ফুচকা খেতে গিয়ে শুনব।”
যথারীতি ফুচকা খেতে গিয়ে কথাটা আবার পাড়তে হল। “দেখলাম একটা টাকমাথা লোক, আমাদের বাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে আছে আমার দিকে তাকিয়ে। আর আমি বাড়ি ফিরছি। লোকটাকে দেখে থমকে গেলাম। লোকটা কেমন বিষাদ-মাখা চোখে আমার দিকে চেয়ে রইল।”
নন্দিনীর মুখ থেকে টক জল গড়িয়ে গেল। “লোকটাকে কেমন দেখতে?”
“টাক।”
“আরে মরণ, টাক ছাড়াও তো লোকের একটা আইডেন্টিটি থাকে। তোর বর্ণনা দিতে দিয়ে যদি আমি বলি বোঁচা নাক, তোর মুখটা কেউ বুঝতে পারবে?”
“অ। ওই তো, টাক, বাঁকা নাক, মাথায় অল্প অল্প চুল আছে, একদম দ্য রকের মতো টাক নয়। চোখ দুটো কেমন অদ্ভুত রকমের গোল গোল, নীচে কালি-পড়া। মুখটা ঠিক, ঠিক সম্পূর্ণ একটা মানুষের মতো নয়, মানুষের কাছাকাছি। যেন কেউ এঁকেছে। থ্যাবড়া থ্যাবড়া মতন। বুঝলি?”
নন্দিনী হাঁ করে তাকিয়ে রইল। “কী হল রে?” জিজ্ঞাসা করলাম।
ফুচকাওয়ালার দাম মিটিয়ে বলল, “এটা কীভাবে সম্ভব হয়?”
“কেন?”
“আমিও এই লোকটাকে কাল এবং পরশু দু-দিনই স্বপ্নে দেখেছি।”
“এই একই লোককে?”
“তোর বর্ণনা শুনে তো তা-ই মনে হচ্ছে। আমি দেখেছিলাম, লোকটা আমাদের স্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আমি ঢুকছি, আমার দিকে তাকিয়েই রয়েছে। কী যেন বলতে চায়। কী যেন দেখাতে চায়। বোধহয় তুই আর আমি একসঙ্গে লোকটাকে দেখেছিলাম কখনও। তাই হয়তো অবচেতনে…”
“এরকম আবার হয় নাকি?”
আমরা দুজনেই আর কোনো কথা বললাম না সারা রাস্তা। এইরকম আশ্চর্যজনক ঘটনা এর আগে জীবনে কখনও ঘটেনি বলেই হয়তো মনে মনে সূত্র খোঁজার চেষ্টা করছিলাম।
আমরা দুজন একটাই স্কুলে পড়াই। স্থানীয় স্কুলে টেম্পোরারি টিচার, যতদিন না একটা চাকরিবাকরি জুটছে—এ-ই আমাদের সম্বল। আমাদের গ্র্যাজুয়েশন করা আছে কম্পিউটার সায়েন্সে, কিন্তু পড়াতে হয় সব বিষয়। বাচ্চা কিনা!
এরকমই এক সকালে আমার ক্লাসের একটা বাচ্চা বলল, “মিস, আমি কাল রাতে একটা ব্যাড ড্রিম দেখেছি।”
“কী দেখলে?”
“দেখলাম, পাপার সঙ্গে একটা কাকু কথা বলছে, আর পাপা খুব রেগে গেছে। তারপর কাকুটা কেমন করে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। আমার খুব ভয় করছিল।”
মনে কেন জানি না, কোথাও যেন একটু খটকা তৈরি হল। জিজ্ঞাসা করলাম, “আচ্ছা, কাকুটাকে কেমন দেখতে?”
“মাথায় চুল কম, গোল গোল চোখ, লম্বা নাক, কালো জামা পরেছিল।”
সে কথা শুনে আমার বুকের প্রকোষ্ঠে এতক্ষণ ধিকধিক-করতে-থাকা হৃৎস্পন্দন, একশোগুণ বেড়ে গেল। আমি মেয়েটাকে বললাম, “ও কিছু না। ব্যাড ড্রিম।”
বাড়ি ফিরে এসে নন্দিনীকে ফোন করলাম, “তুই জানিস, আমার ক্লাসের একটা বাচ্চাও সেম স্বপ্ন দেখেছে। মানে ওই লোকটাকে দেখেছে।”
“কী বলছিস কী তুই?”
অগত্যা রাত এগারোটায় আমাদের বাড়ির পিছনে দেখা করতে হল। ইনটারনেট ঘেঁটে স্বপ্ন নিয়ে বেশ কিছুটা পড়াশোনা করে আমরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হলাম যে জেগে-থাকা অবস্থায় উপেক্ষিত বস্তু বা প্রাণীও স্বপ্নে আসতে পারে। শেয়ার্ড ড্রিমিং তখনই সম্ভব যখন কোনো গোষ্ঠীর মধ্যে একটি নির্দিষ্ট বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে, পরে হয়তো মাথা থেকে বেরিয়ে গেছে, কিন্তু অবচেতনে সেই আলোচনার রেশ থেকে যাওয়ায় সেই গোষ্ঠীর লোকজন একই স্বপ্ন দেখছে।
তাহলে আমার ক্লাসের ওই বাচ্চাটা?
নন্দিনী বলল, “হয়তো ওর বাবা-মা কিছু দেখেছে। সেটা ওকে বলেছে। হয়তো আমরা সবাইই সেম জিনিস দেখেছি, কিন্তু কারও খেয়াল নেই। লোকটা হয়তো আমাদের এলাকায় নতুন এসেছে। খেয়াল রাখিস যদি আশপাশে আচারের দোকান বা ঠ্যালা দেখতে পাস। দেখবি, ঠিক পেয়ে গিয়েছিস লোকটাকে। এত ভাবিস না তো।”
নন্দিনী বাড়ি চলে যাওয়ার পর আমি একা বসে রইলাম বাড়ির পিছনদিকের রেলিং-এ। ঝিরঝির করে হাওয়া দিচ্ছে। মনে হল, লোকটা ওই পিছনদিকের আমবাগানের ভেতর থেকে আমায় এখন দেখছে না তো?
আমি লাফ দিয়ে নেমে ঘরে ঢুকে এলাম। ল্যাপটপ বন্ধ করে খাতা আর পেনসিল নিয়ে লোকটার একটা ছবি আঁকতে বসলাম। বড়ো কৌতূহল হচ্ছে আমার। কৌতূহল জিনিসটা ছোটোবেলা থেকেই আমার মারাত্মক। একসঙ্গে তিনটে লোক একই স্বপ্ন কেন দেখবে?
আমি সিঁড়ি বেয়ে নীচে দৌড়ে নেমে বাবাকে জিজ্ঞেস করলাম, “বাবা, লাস্ট কয়েকদিন ধরে তুমি স্বপ্নে কাউকে দেখেছ? একটা টাকমাথা বেঁটে লোক। ফরসা, লম্বা বাঁকা নাক, চোখগুলো গোল গোল।”
বাবা টিভি দেখছিল। ঘাড় ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “কী বলছিস, আরেকবার বল। আমি কোহলির ব্যাটিং দেখছিলাম।”
বাবাকে হাত ধরে উপরে নিয়ে এসে সবটা বুঝিয়ে বললাম। বাবা কাগজে আমার আঁকা স্কেচটা দেখে বলল, “না, আমি দেখিনি একে। কিন্তু এই যে আজ তুই বললি এর কথা, আজ নিশ্চয়ই একে আমি দেখব স্বপ্নে। বাবা রে, কী কদাকার দেখতে! নাকি তুই বাজে আঁকিস?” বাবা আমায় খ্যাপানোর উদ্দেশ্য নিয়ে বাঁকা হেসে তাকাল।
মা বাড়ি ফিরলে মা-কেও জিজ্ঞাসা করা হল। মা জানাল যে মায়ের স্বপ্ন মনে থাকে না। সেই রাতে আর কিছু দেখলাম না। বা হয়তো দেখে থাকলেও মনে রইল না। স্কুলে নন্দিনীকে দেখলাম, বড়ো চিন্তিত লাগছে। সেকেন্ড পিরিয়ডের ক্লাস নিয়ে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে এদিকে এল। “কাল রাতে ঘুম হয়নি। তোর সঙ্গে কথা বলে সেই যে বাড়ি গেলাম, লুসিড ড্রিমিং নিয়ে পড়ছিলাম। অবিশ্বাস্য সব ব্যাপার। পড়তে পড়তে কখন ভোর হয়ে গেছে, বুঝতেও পারিনি।”
নন্দিনী বলল যে স্বপ্নের মধ্যে সেটাকে স্বপ্ন বলে চিহ্নিত করা নাকি সবাই পারে না। যারা পারে, তাদের ঘুম সাধারণত খুবই পাতলা হয়। অথবা জোর করে পাতলা করানো হয়। এবারে, স্বপ্ন দেখতে দেখতে সেটাকে স্বপ্ন হিসাবে চিহ্নিত করে, বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়। ধরুন, আপনি স্বপ্নে দেখলেন আপনার সামনে বিষের ডিব্বা রাখা, আপনি নিজের মনে বুঝে গেলেন এটা স্বপ্ন এবং সেটা খেলেন না।
আমার একটা বিষয়ে খুব আশ্চর্য লাগল, “জোর করে কীভাবে ঘুম পাতলা করা যায়?”
“ধর, এক ঘণ্টা পরপর অ্যালার্ম দিয়ে রাখলি, ঘুমোলি, উঠলি, আবার ঘুমোলি। এই করতে করতে তোর ব্রেন বারবার স্বপ্ন আর বাস্তবের দুনিয়ায় ঘোরাফেরা করতে করতে একসময়ে দুটো ঘেঁটে ফেলবে। তখন তুই নিজের স্বপ্নের ভেতরেও সিদ্ধান্ত নিতে পারবি নানা রকমের। এটা অনেকে এমনিই পারে।”
“আজকে রাতটা আমার বাড়ি থেকে যা-না। একটু চেষ্টা করব।”
নন্দিনী আমার দিকে হেসে তাকাল। ও এটাই ভাবছিল। রাতে খাওয়াদাওয়ার পর আমরা দুজন আমাদের ঘরে চলে এলাম। ফোনে সকাল ছ-টা অবধি সাতটা অ্যালার্ম দিলাম। দুজনেই উঠব। চোখটা হালকা লেগে আসতেই খেয়াল হল, নন্দিনী কেন জানি না আজকে ভীষণ মনমরা। আমায় একটাও গালি না দিলে ওর ভাত হজম হয় না। সেখানে আজ সকাল থেকে একবারও আমায় গাধা পর্যন্ত বলেনি। একটু চোখ মেলে জানতে চাইলাম, “কী রে, কিছু হয়েছে?”
“সৌরভ বিয়ের জন্য চাপ দিচ্ছে। চাকরির জন্য আর পড়তে দেবে না।”
“তুই কী বললি?”
“এখনও কিছুই বলিনি। আমার যদি বিয়ে না হয়, তুই-আমি থেকে যাব বুড়ি বয়স অবধি। কারণ তোরও বিয়ে হবে না। তোর মতো গাধাকে কেউ বিয়ে করবে না।”
এবার আমার ধড়ে প্রাণ এল। চোখটা বুজে পড়ে রইলাম। ঘুমকাতুরে মানুষ বলে আমার বেশ অখ্যাতি আছে, যে-কোনো জায়গায় আমি ঘুমিয়ে পড়তে পারি। প্রথম অ্যালার্ম বাজার পর চোখ মেলে কিছুই বুঝলাম না, অ্যালার্ম দিয়ে রেখেছি, সেটাই মাথা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল। দ্বিতীয়বার, দ্বিতীয়বার বিরক্ত হলাম স্বপ্নে দেখা একটা আলুওয়ালার উপর, দেখলাম যে আলু ছুড়ে মেরে আমার ঘুম ভাঙাল। পাশে দুবারই দেখলাম, নন্দিনী পড়ে পড়ে ঘুমোচ্ছে। ওর ঘুম ভাঙেনি তার মানে। তৃতীয়বার বা চতুর্থবার হয়তো, আমি লোকটাকে দেখলাম। আমার বাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে বৃষ্টিতে ভিজছে। আকাশে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে, লোকটার মাথায় লেগে-থাকা দুই-চারটে চুল ভিজে আটকে আছে, মুখে বিষাদ। আমার মন বলল এটা স্বপ্ন, আমায় গিয়ে জিজ্ঞাসা করতে হবে আপনি কে। কিন্তু পা এগোল না। অ্যালার্ম বেজে উঠল। প্রচণ্ড বিরক্তি নিয়ে আমি উঠে চেঁচিয়ে উঠলাম। নন্দিনী উঠে পড়ল। “কী হয়েছে? কী হয়েছে?”
“জাস্ট আরেকটু, আর-একটু হলেই আমি ওর কাছে চলে যেতাম। মনে হয়, অ্যালার্ম ঠিকঠাক সময়ে সেট করা হয়নি। আরও ডিসট্যান্স বাড়াতে হবে।”
“কী লাভ? আমার তো ঘুমই ভাঙছে না।”
“কুম্ভকর্ণ কোথাকার।”
আর তাকে দেখতে পেলাম না সেই রাতে। ক্লান্ত চোখ-মুখ নিয়ে স্কুল গেলাম, হেডমিস্ট্রেস সরলতাদি জানতে চাইলেন, “কী ব্যাপার মথুরা, রাত জেগে পড়াশোনা করছ নাকি আজকাল?”
“ওই আর কী। আচ্ছা ম্যাডাম, আপনিও তো আশপাশেই থাকেন।”
“হ্যাঁ। কেন?”
“কোনো অদ্ভুত স্বপ্ন দেখছেন ইদানীং? মানে একই স্বপ্ন বারবার?” আমি চেষ্টা করছিলাম, যাতে লোকটার আইডিয়াটা মাথায় না ঢোকে।
“হ্যাঁ দেখছি বটে। কিন্তু তুমি কীভাবে জানলে? এই একটা লোক, দেখছি যে স্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। নন্দিনী আর আমি ঢুকছি, লোকটা আমাদের দিকে তাকাচ্ছে। কী যেন বলতে চাইছে।”
“টাক মাথা, লম্বা নাক, বড়ো বড়ো চোখ?”
বড়দির চোখ আকাশ ছুঁল। উনি চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়লেন। ঘুরপাক খেয়ে জল খেয়ে আমায় বললেন, “তুমি কীভাবে জানলে?”
“আন্দাজ করলাম।”
মনে হয়, আমার কথাটা বিশ্বাস হয়নি। কিন্তু এই মুহূর্তে আমি ভয় পাওয়াতে চাইছি না। বড়দির ঘর থেকে বেরিয়ে এসে আমি কড়া করে কফি খেলাম। চোখে ঘুমটা লেগেই আছে এখনও, দেখি, নন্দিনী ক্লাস করিয়ে ফিরছে। আমার দিকে চোখ পড়তেই বাঁক নিয়ে ক্যান্টিনে ঢুকে এল।
“সৌরভ একপ্রকার আল্টিমেটাম দিয়ে দিয়েছে। ওর নাকি বিয়ের ঠিক হয়েই গেছে প্রায়। আমার জন্য অপেক্ষা করবে না আর।”
“আমি ভাবছিলাম যে, যদি এলাকার আর কাউকে জিজ্ঞাসা করা যায় লোকটার ব্যাপারে? কেউ চেনে কি না।”
“মথু, ওসব ছাড়বি? আমার কথাটা একবার ভাব। স্বার্থপরের মতো একটা আইডিয়া নিয়ে পড়ে রয়েছিস।” নন্দিনী চিৎকার করে উঠে চলে গেল।
শুরুর দিন থেকেই ওকে আমি বলেছিলাম সৌরভ ছেলেটা স্টেবল নয়। ওর চোখ ঘুরঘুর করে এদিক-সেদিক। অন্য অপশন খোঁজে সর্বদা। ওকে বলতেও শুনেছি যে নন্দিনীর ভাগ্য ভালো যে ওর মতো ছেলে ওর দিকে চেয়েছে। ওর থেকেও সুন্দরী মেয়েরা নাকি স্কুলেই আছে। নন্দিনী উপন্যাসের লেখনীর মতো ধীরস্থির। যেমনভাবে কবিরা তাদের প্রেমিকার বর্ণনা দেয়, নন্দিনী ঠিক তেমনই সুন্দর। আমিই বরং একটু এবড়োখেবড়ো। মাথাময় কোঁকড়া চুল, জট ছাড়ানো যায় না। আমি নন্দিনীকে ভীষণ ভালোবাসি। ও আমার দিদির মতো। অভিভাবকের মতো। তাই ওর পিছনে ছুটলাম।
“এই ননি, সরি। সরি। আচ্ছা বল, বল, কী বলছিলি।”
“আমি কাল সারারাত লোকটাকে দেখেছি স্বপ্নে। প্লিজ় তুই এসব নিয়ে গবেষণা করা বন্ধ কর। আমার মানসিক অবস্থা ভালো নয়।”
“আচ্ছা বেশ। তোকে আমি এসবের মধ্যে টানব না আর।”
নন্দিনী আমার দিকে তাকাল না। চলে গেল। স্কুল ছেড়ে দিল। সৌরভের সঙ্গে ওর বিয়ে হয়ে গেল। নন্দিনী চলে গেল। আমি একা হয়ে গেলাম। ছোটোবেলা থেকেই বন্ধুবান্ধব কম, অতিরিক্ত নির্ভরশীল হয়ে পড়ি, তাই। বন্ধুদের বারবার ডাকি, তারা নিজেদের অনুষ্ঠানে আমায় ভুলে গেলে উষ্মা প্রকাশ করে ফেলি, তাই। দুনিয়া আমায় ক্রমাগত শিখিয়ে চলেছে, পেশাদার হও, সামনে হেসে পিছনে দাঁত-নখ বের করে তাকেই তুলোধোনা করো, আমি পারি না।
নন্দিনীকে আমি খুব শক্ত চরিত্রের ভেবেছিলাম, সৌরভের সঙ্গে বিয়ে হওয়ার পরে ওর ভাবমূর্তি আমার কাছে কিছুটা নষ্ট হয়ে গেল। সম্মানটা কমে গেল কি? হবে হয়তো। আমাদের সামান্য কথা হত। হানিমুনের ছবি দেখতাম, এসবের মধ্যে ওই লোকটা আমার স্বপ্নে মাঝেসাঝেই আসত। আমি পাত্তা দিতাম না।
একা লাগত বলে মায়ের সঙ্গে ঘুমোতাম আমি। নন্দিনীর চলে যাওয়ার পর জীবনটা অন্যরকম হয়ে যাচ্ছিল। সল্ট লেকে সরকারি চাকরির পরীক্ষা দিতে যাওয়া, টিউশনি, স্কুলে তিনটে পিরিয়ড। বন্ধু হারাতে ভয় পাই, কারণ আমি নিজেকে চিনি, বন্ধু তৈরি হতে আরও বিশ বছর লাগবে। বিশেষ করে নন্দিনীর মতো বন্ধু।
মায়ের পাশে শুয়ে থাকতে থাকতে একদিন অনুভব করলাম, মা উঠে বসল। লুসিড ড্রিমিং অভ্যাস করতে করতে এখন আমার ঘুম এমনিই পাতলা হয়ে গেছে। চোখটা ফট করে খুলে দেখলাম, মা আমার দিকে তাকিয়ে বসল। “লোকটাকে দেখলাম, জানিস? সেই যে তুই বলেছিলি অনেকদিন আগে, একটা লোক। আজ তাকে দেখলাম। বাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। তুই আর আমি বাজার থেকে ফিরছি। লোকটা এদিক-ওদিক তাকিয়ে কী যেন খুঁজছে।”
নন্দিনীর চলে যাওয়ার একাকিত্ব কাটাতে আমি আবার তাকে নিয়ে পড়লাম। লাইব্রেরি গিয়ে নানাবিধ বই বের করে পড়তে শুরু করলাম। তার পাশাপাশি পরীক্ষা আর টিউশনি। যতটা সম্ভব নিজেকে ব্যস্ত রাখা যায়। আমায় গুছিয়ে দেওয়ার লোক চলে গেছে, এখন একাই বাঁচতে হবে।
লাইব্রেরিয়ান জিজ্ঞাসা করল, “মথুরা, তুমি কি সাইকোলজি ধরলে নাকি?”
“শুধু কি ডিগ্রির জন্য পড়াকে ধরা বলে, করবাবু? কৌতূহলের চেয়ে বড়ো শিক্ষক হয় না।” আমি একটু হাসলাম।
সেই রাতে আমি হালকা ডোজ়ের ঘুমের ওষুধ খেলাম বাবার কাছ থেকে চুরি করে। স্বপ্নে দেখলাম, বৃষ্টি হচ্ছে, আমি আর নন্দিনী পাশাপাশি হাঁটছি। সামনে স্কুল। স্কুল স্পষ্ট হতেই লোকটাকে দেখতে পেলাম। বড়দি ঢুকছে, আমি গতি বাড়িয়ে তাড়াতাড়ি ছুটে গেলাম লোকটার দিকে। জিজ্ঞাসা করলাম, “আপনার নাম কী?”
লোকটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে আমার দিকে তাকাল। “আমার নাম বিদ্যুৎ রায়। আপনি আমায় সাহায্য করুন। আমায় সাহায্য করুন।”
আমার ঘুম ভেঙে গেল। ফোনে দেখলাম নন্দিনীর বেশ কয়েকটা মিস্ড কল। মা দরজা ধাক্কা দিচ্ছে। বেলা এগারোটা বাজে। আজ রোববার। মাথাটা ভার লাগছে। বিছানা ছেড়ে উঠে দরজা খুলে দেখলাম মা নয়, নন্দিনী।
কিছুক্ষণের স্তব্ধতা। তারপর পিছিয়ে এসে বললাম, “কেমন আছিস?”
ও ভেতরে ঢুকে বইয়ের পাহাড় দেখে বলল, “তুই এখনও…”
“দ্যাট শুড নট বদার ইউ।”
“তুই আমার উপর রেগে আছিস, জানি। আমি একটা ভালো খবর দিতে এসেছি। আয়, বোস।”
আমি নিমরাজি হয়ে বসলাম। ওর চোখের দিকে তাকাতে পারছিলাম না। নন্দিনী আমায় ভালো করে চেনে। একবার নিজেকে গুটিয়ে নিলে স্বয়ং ঈশ্বরের ক্ষমতা নেই আমায় আগের পথে ফিরিয়ে আনার। আন্দাজ করেছিলাম সুখবরটা কী, নন্দিনী আমার হাতটা ওর পেটের উপর রাখল। আমি মৃদু হাসলাম। “জীবনে কতটা এগিয়ে গেলি, সেটা জানাতে এসেছিস?”
“না। না। একদমই নয়। বিশ্বাস কর মথুরা, আমি মন থেকে এসেছি।”
জানি না, হয়তো অতিরিক্ত বই পড়ার ফলে আমি ধীরে ধীরে তিক্ত হয়ে উঠেছিলাম, কোনো আনন্দ-দুঃখ আমায় স্পর্শ করতে পারছিল না আর। নন্দিনীর সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করলাম কি?
চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিলাম, নন্দিনী হঠাৎ বলল, “গতকাল রাতে তোকে, আমাকে আর বড়দিকে স্বপ্নে দেখলাম। তুই লোকটাকে জিজ্ঞাসা করলি ওর নাম কী? লোকটা নাম একটা বলল। সেটা মনে নেই।”
“তা-ই?” আমি চাই না, ওর গর্ভবতী অবস্থায় এসব চাপ পড়ুক। দুই-চারটে কথা বলে ওকে বাড়ি পাঠিয়ে দিলাম।
স্কুলে গিয়ে বড়দিকে জিজ্ঞাসা করতেই জানতে পারলাম আমার সন্দেহ সত্যি। আমরা তিনজনেই একই স্বপ্নে ছিলাম।
ভদ্রমহিলার মতো অমায়িক মানুষ আর দুটো নেই দুনিয়ায়। ওঁকে বাড়ি নিয়ে এলাম। বাবা-মা আয়োজন করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। আমি উপরের ঘরে নিয়ে আসতেই বইয়ের পাহাড় দেখে উনি বেশ চমকে গেলেন।
“আপনি শেয়ার্ড ড্রিম বোঝেন তো?”
“না। মানে শব্দটার অর্থ বুঝেছি, কিন্তু সেটা কোন প্রসঙ্গে, বুঝছি না।”
“ধরুন, আপনি একটা স্বপ্ন দেখছেন, যেখানে আমি আছি। আমি একটা স্বপ্ন দেখছি, যেখানে আপনি আছেন। আমরা একই জায়গার স্বপ্ন দেখছি। খুব অল্প সম্ভাবনা থাকে যে আমরা একই স্বপ্নে আছি। এবং চাইলে একে অন্যের সঙ্গে কথোপকথন করতে পারব।”
“খুবই, খুবই আকর্ষণীয় বিষয়, কিন্তু মথুরা, এসবের তো কোনো প্রমাণ নেই। তা ছাড়া লোকটা যে খুব বিরক্ত করছে, তাও তো নয়।”
“ম্যাডাম, হতেও তো পারে, লোকটা আমাদের কাছে হেল্প চাইছে। হয়তো আটকে আছে, কোনো আত্মা, বা কারও স্মৃতি।”
বড়দি উঠে পড়লেন। “মথুরা, তুমি বরং কয়েকদিন কোথাও ঘুরে এসো। এসব… এসব সিনেমায় হয়। বাস্তবে হয় না।”
“বাস্তবে কী হয়, ম্যাডাম? আপনার স্কুলের ছাত্রী দিনের পর দিন মানসিক অবসাদে ভোগে, সাহায্য চায়, আর আপনার প্রিয় শিক্ষিকা সে নাটক করছে বলে তাকে ধীরে ধীরে অবধারিত মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়। আর আপনি সেই শিক্ষিকাকে বাঁচান। বাস্তবে এটাই হয়, তা-ই তো?” কথাগুলো বলার পর আমার খেয়াল হল যে হয়তো বলা উচিত হয়নি। বড়দি মাথা ঝুঁকিয়ে বসে থেকে বললেন, “আমি যা করেছি, অনেক ভেবেচিন্তে করেছি। অভিজ্ঞতা তোমার চেয়ে কিছু বেশিই আমার। আর যদি তোমার মনে হয়, আমি বড়দি থাকাকালীন তোমার স্কুলে আসতে দর্শনে আর রুচিতে বাধছে, এসো না। তুমি আর্থিকভাবে সচ্ছল, এমন কোনো ক্ষতি তোমার হবে না।”
অগত্যা স্কুল আমার জন্য বন্ধ হল। গুটিয়ে গেলাম। মনোবিদের কাছে গিয়ে ঘুমের ওষুধ আদায় করলাম। একটা গোটা দিন দিয়ে দিলাম এই রহস্য সাধনের পিছনে। ফোনে দেখলাম মেসেজ এসেছে নন্দিনীর। খুললাম না। ফোন উলটে রেখে ঘুমের ওষুধ মুখে পুরে শুয়ে পড়লাম।
দেখলাম, আমাদের বাড়ির পিছনদিকের আমবাগানের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। আশপাশে কেউ নেই, ঝোড়ো হাওয়া দিচ্ছে, বড়ো বড়ো গাছের মাথাগুলো দুলছে। আমি জানি, লোকটা আসবে। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর পায়ের আওয়াজ পেলাম। ঘুরে তাকিয়ে দেখলাম, লোকটা এসেছে। আগের তুলনায় তার আকার-আকৃতি অনেকটাই স্পষ্ট। মুখে একটা সারল্য লেগে আছে।
“আপনি কী খুঁজছেন?”
“বাড়ি যাওয়ার রাস্তা।”
“আপনার বাড়ি কোথায়?”
“জানি না। আমার মনে পড়ছে না। শুধু, শুধু নামটুকু মনে আছে।”
ঘুমের ঘোরটা একটু কাটতেই মনে হল, এতক্ষণ কেউ একটা আমার বিছানার পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল। ভয়ে গা-হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গেল। ধীরে ধীরে উঠে এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখলাম, আলো জ্বালিয়ে দিলাম, কেউ নেই। পিছনের জানলা দিয়ে আমবাগান দেখা যাচ্ছে। লোকটা এখানে চলে এল নাকি? নাকি এটা স্বপ্ন? আমি জেগে আছি? নীচে নেমে এসে চোখে-মুখে জল দিলাম। বাড়িটা অসম্ভব শান্ত লাগছে। একটাও আওয়াজ নেই। তখনও আমার সন্দেহ কাটছে না। বাথরুম থেকে খুট করে একটা আওয়াজ এল। চমকে ফিরে তাকালাম।
“এ কী! তুই? তুই কখন এলি?”
“সন্ধেবেলায়। তুই আজ সারাদিন ঘুমিয়েছিস। কাকু-কাকিমা খুব চিন্তায় আছে। এবার এই জেদ ছেড়ে দে মথু।”
“এতদূর এসে আমি আর পিছিয়ে যেতে পারব না। তা ছাড়া, আমার কেন জানি না, মনে হচ্ছে এটা সত্যি নয়।”
“তুই স্বপ্ন আর সত্যির পার্থক্য করতে পারছিস না। দেখ, আয়নায় নিজেকে দেখ। চিনতে পারছিস? সেই প্রাণোচ্ছল মথুরার কী হল? আমায় ভুলতে তুই নিজের জীবন দুর্বিষহ করে তুলেছিস। তুই আমার উপর এত নির্ভরশীল জানলে আমি যেতাম না রে। বড়ো ভুল করে ফেলেছি।”
“ননি, তুই সত্যিই এসেছিস? আর যাবি না তো?”
নন্দিনী নিজের পেটের উপর হাত রেখে বলল, “স্বপ্নের মধ্যে স্বপ্নই সত্যি।”
চোখ খুলেই আমি মা-কে দেখতে পেলাম। “মা, মা, ননি এসেছিল। ও কোথায়?”
“না মা, ও আসেনি।” মা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল। মায়ের চোখ লাল। জিজ্ঞাসা করলাম, “কী হয়েছে?”
“নন্দিনী গতকাল সন্ধেবেলায় মারা গেছে। শ্বাসকষ্ট হয়েছিল, বাড়ির লোক বহুদিন ধরেই সেইভাবে খেয়াল করেনি, ডাক্তার দেখায়নি…”
জেগে থাকতে ভালো লাগছিল না আর। ভেবেছিলাম, ওর বাচ্চাটা হলে সব মিটিয়ে নেব। আমার মতো মাসি ও আর পেত না। বুকের মধ্যে দলা-পাকানো কান্না বমির রূপ নিয়ে বেরিয়ে এল।
এলাকার থানা আর হাসপাতালে খোঁজ নিতে শুরু করলাম, বিদ্যুৎ রায় নামের কাউকে তারা দেখেছে কি না বা চেনে কি না। থানা থেকে একপ্রকার আমায় তাড়িয়ে দিল। স্থানীয় নার্সিং হোম থেকে জানাল যে বিদ্যুৎ রায় নামের একজন বেশ কয়েক মাস আগে ভরতি হয়েছিলেন। কিন্তু তাঁকে তাঁর বাড়ির এলাকার হাসপাতালে ট্রান্সফার করা হয়। মাথায় চোট পেয়ে স্মৃতিভ্রষ্ট হয়েছিলেন। দুর্ভাগ্যবশত ওঁরা খোঁজ দিতে পারলেন না কোনো হাসপাতাল।
সেই রাতে স্বপ্নে আমি লোকটাকে খুঁজলাম। প্রতিবার ঘুরেফিরে নিজের ঘরে, নয়তো স্কুলের সামনে পৌঁছে যাচ্ছিলাম, নন্দিনীর চলে যাওয়াটা মেনে নিতে পারছি না। কী অসম্ভব বাস্তব মনে হচ্ছে এইসব কিছু। গায়ে শিরশিরে ঠান্ডা হাওয়া এসে লাগছে। চোখ ছোটো করে দূরে তাকিয়ে দেখলাম, লোকটা বসে আছে রাস্তার ধারে। সেদিকে এগিয়ে গিয়ে জানতে চাইলাম, “আপনাকে কোন হাসপাতালে দেওয়া হয়েছিল, মনে আছে? আপনার গাড়ি অ্যাক্সিডেন্ট করে পড়ে গিয়েছিল। আপনার মাথায় চোট লেগেছে।”
লোকটা বলল, “না। তবে এইটুকু মনে আছে, আপনাকে আমি সেদিন দেখেছিলাম। আপনাদের স্কুলের সামনে ঘটেছিল ঘটনাটা। আপনারা ঢুকছেন তখন। সেই থেকেই তো এই জায়গাটা ছেড়ে আমি বের হতে পারছি না। ঘুরে বেড়াচ্ছি। সাহায্য চাইছি। হয়তো সবাই বিরক্ত হচ্ছে। কিন্তু আমারই বা কী করার আছে!”
“আপনার হাতে আর বেশি সময় নেই। আপনি দিন দিন আরও স্পষ্ট হয়ে উঠছেন। বুঝতে পারছেন তো, কী বলছি?”
লোকটা দু-দিকে ঘাড় নাড়ল।
“আপনি এখানে স্পষ্ট হচ্ছেন মানে ওখানে মারা যাচ্ছেন।”
“গেলে যাব। আমার কোনো বন্ধু নেই। একা মানুষ আমি।”
“আমি আপনার সেই হাসপাতালে গিয়ে খোঁজ নেব। যদি আপনাকে পাই, পৌঁছে দেব। যদি দেখি আপনি আর নেই, তাহলে আপনি আমায় আর বিরক্ত করবেন না, কথা দিন।”
লোকটা উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “তা-ই হোক।”
অনুভব করতে পারলাম, আমার পিছনদিকে নন্দিনী এসে দাঁড়িয়েছে। আমি না তাকিয়েই বললাম, “কেন এসেছিস?”
“আমায় ক্ষমা করবি না?”
“তোকে ক্ষমা করে দিলে তো তুই চলে যাবি।” আমি বুঝতে পারলাম, আমার জামার উপর চোখের জল জড়ো হচ্ছে। “তোকে আমি ক্ষমা করতে পারব না। তোর মুক্তি নেই। আমরা এই কাজে একসঙ্গে নেমেছিলাম। যতদিন না আমি এই প্রশ্নের উত্তর বের করতে পারছি, তোকে আমি যেতে দেব না।”
ওর দিকে না তাকিয়ে আমি হেঁটে গেলাম। ঘুম ভাঙছে না। নন্দিনী হেঁটে হেঁটে আসছে। আমায় ফলো করছে ও। ঘুম থেকে উঠতেই হবে আমায়। না হলে এই আতঙ্ক বয়ে বেড়ানো আমার পক্ষে সম্ভব নয়। এমন সময়ে ওই লোকটা নন্দিনীর সামনে এসে দাঁড়াল। আমায় ইশারায় বলল, “যান।”
আমার ঘুম ভেঙে গেল। খোঁজখবর শুরু করলাম লোকটাকে নিয়ে। চেনাপরিচিত লোক মারফত প্রায় মাসখানেক পর সন্ধান পেলাম যে বর্ধমানের এক নার্সিং হোমে ভদ্রলোক ভরতি আছেন। সেই রবিবার আমার চাকরির পরীক্ষা ছিল, আমি তাও বর্ধমানে গেলাম। কোনো এক অদৃশ্য টান আমায় টানছিল। মন বলছিল, এই সমস্যার সমাধান আমিই করতে পারব। নার্সিং হোমে খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম, ভদ্রলোক কোমায় আছেন। মাথার ভেতরে রক্তক্ষরণ হয়েছে।
কেবিনের বাইরে বোধহয় মা-বাবা বসে। আমি কথা বললাম না। আইসিইউ-এর কাচের জানলা দিয়ে উঁকি মেরে দেখি মুখে নল লাগানো, হাতে-পায়ে ব্যান্ডেজ। এই তো, একেই তো আমি দেখি স্বপ্নে। অবাস্তবের ধাক্কায় আমার পায়ের নীচের মাটি সরে যায়, নন্দিনীকে ডেকে দেখাতে ইচ্ছা করে যে দ্যাখো, দ্যাখো, আমি পেয়েছি। লোকটাকে খুঁজে পেয়েছি। এবার শুধু ঘরে ফেরানোর পালা।
সেই রাতে স্বপ্নে আমরা ট্রেন ধরেছিলাম। বর্ধমান স্টেশনে নেমে বিদ্যুতের চোখ-মুখে বিদ্যুৎ খেলে গেল। যেন সব কেউ এক লহমায় ওর মাথার ভেতর কচুরির পুরের মতো গুঁজে দিয়েছে, হাঁপাতে হাঁপাতে ঘুরে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল, “এবার?”
“চলুন।”
নার্সিং হোমে কেউ নেই। বুঝতেই পারছি যে ওইটুকু সময়ের মধ্যে আমার অবচেতন মন সেরকম কোনো ছবি তৈরি করতে পারেনি। কাচের গোল জানলার মধ্যে দিয়ে নিজেকে শুয়ে থাকতে দেখে বিদ্যুৎ পাগলের মতো ঢুকে গিয়েছিল ঘরটায়। আমার কাজ শেষ। আমি আর ঢুকিনি। শুধু আমার ডানদিকে দাঁড়িয়ে-থাকা নন্দিনীকে বলেছিলাম, “তোকে ক্ষমা করে দিলাম রে।”
ঘুম ভাঙতেই একটা অদ্ভুত প্রশান্তি আমায় ঘিরে ধরল। আমি আবারও একা হয়ে গেলাম। বাবাকে গিয়ে জড়িয়ে ধরলাম। কই না তো! একা কোথায়! বাবা-মা তো আছে।
দীর্ঘ পাঁচ মাস পরে আমার সরকারি চাকরির লিস্ট বের হল। নাম উঠেছে। বাড়িতে খুশির আমেজ। নন্দিনীর কথা বারবার মনে হচ্ছে। মেয়েটা যদি আজ থাকত, যদি থাকত। মিষ্টিটা হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছি, এমন সময়ে কলিং বেলে একটা আওয়াজ হল। উঠে গিয়ে দরজা খুললাম।
হাতে একটা ফুলের তোড়া নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে একটা টুপি-পরা লোক, টাক ঢাকার জন্যই বোধহয় এই সাজ। বয়স বেশি নয়, আমার চেয়ে হয়তো বছর পাঁচেক বেশি। লম্বা নাক, গোল গোল চোখ। বিদ্যুৎ রায়। আমি হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম। মা জিজ্ঞাসা করছে, “কে এল রে?”
আমার মুখ দিয়ে কথা বেরোচ্ছে না। বিদ্যুৎ আমার হাতে ফুলের তোড়া ধরিয়ে বলল, “সেদিন ‘থ্যাংক ইউ’ বলা হয়নি।”
Tags: নবম বর্ষ প্রথম সংখ্যা, পারমিতা ঘোষ পাকড়ে