মৃত্যুগ্রহ
লেখক: ফ্রেড ও জিওফ্রে হয়েল অনুবাদ: অদ্রীশ বর্ধন
শিল্পী: টিম কল্পবিশ্ব
মূল গল্প: দ্য প্ল্যানেট অব ডেথ
ব্রেকফাস্ট টেবিলে বসে উইলিয়াম শুনতে পেল, খবরের কাগজ পড়তে পড়তে বাবা বলছেন, মড়ক শুরু হল চিন দেশে—কেউ আর বাঁচবে না।
শুনেই খটকা লাগল উইলিয়ামের। চোখ তুলল সঙ্গে সঙ্গে। কিন্তু বাবার মুখটা দেখতে পেল না—খবরের কাগজের আড়ালে ঢাকা রয়েছে। মায়ের মুখে কিন্তু বেশ উদ্বেগ ফুটে উঠেছে।
ব্যাপারটা কী? বেশ চিন্তায় পড়ে উইলিয়াম। সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে দুধ আর সেই বিচ্ছিরি খাবারটা আর-এক চামচ তুলে সটান চালান করে দেয় মুখের মধ্যে। গত তিনটে হপ্তা মোটেই মজার মধ্যে কাটেনি উইলিয়ামের। হাতে সময় অঢেল। কী যেন একটা মড়ক লেগেছে বলে স্কুলে লম্বা ছুটি দিয়েছে। দিদিটাও এমন ভুগছে অসুখে যে দুষ্টুমি করার ইচ্ছে থাকলেও ভালোমানুষটি হয়ে থাকতে হয়েছে উইলিয়ামকে। নতুন অসুখটা যে কী, তা-ই তো ছাই কেউ জানে না। নামটা অদ্ভুত—ফরাসি অগ। লন্ডনের রোগবিশেষজ্ঞরা পর্যন্ত হালে পানি পাচ্ছেন না। ফরাসি অগ কী জাতের ব্যারাম, তা ধরতেই পারছেন না।
বিচ্ছিরি খাবারটা শেষ পর্যন্ত চেটেপুটে খেয়েই ফেলল উইলিয়াম। আর ঠিক তখনই আচমকা বেজে উঠল সদর দরজার ঘণ্টা। এমনই আচমকা যে তিড়িং করে লাফিয়ে দাঁড়াতে গিয়ে চেয়ারটাকেই উলটে ফেলে দিল মেঝের ওপর।
রুষ্ট চোখে তাকিয়ে বাবা আর মা দুজনেই বেরিয়ে গেলেন ঘর থেকে—ঘণ্টা কে বাজাল দেখবার জন্যে। না বসে দাঁড়িয়েই রইল উইলিয়াম। কান খাড়া করে করে শুনল, কথাবার্তা হচ্ছে হলঘরে। কী কথা হচ্ছে, শোনবার কৌতূহল আর চেপে রাখতে পারল না। দাঁড়াল রান্নাঘরের দরজার সামনে।
ডাক্তারবাবু এসেছেন। খুই গম্ভীরভাবে উইলিয়াম দিদির ব্যাপারে কথা বলছেন। মুখটা চিন্তায় কালো হয়ে গেছে। দিদির অবস্থা নাকি ক্রমশই খারাপের দিকে যাচ্ছে।
শুনতে শুনতে মনস্থির করে ফেলল উইলিয়াম। নাঃ, কোমর বেঁধে এবার লাগতেই হবে। এভাবে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকা আর যায় না।
পা টিপে টিপে গেল খিড়কির দরজায়। বাইরে বেরোনোর পোশাক পরে নিয়ে রওনা হল যে বাড়িটার দিকে, তার নাম পিলে-চমকানো বাড়ি। বাড়ির মালিকের নাম আরও সৃষ্টিছাড়া—প্রফেসার গামা। ইনিই থাকেন পিলে-চমকানো ভবনে এক মা-মেয়ে কিরিলকে নিয়ে। দূরের ওই যে ধু ধু মাঠ—এক্কেবারে মাঠ বললেই চলে—তার পরেই জঙ্গল আর জঙ্গল। বনের মধ্যে অদৃশ্য অবস্থায় রয়েছে প্রফেসার গামার অতিশয় আজব বাড়ি—পিলে-চমকানো! প্রফেসার গামা নিজেও যে পিলে চমকে দেওয়ার মতো কীর্তিকলাপের জন্যে কিশোরমহলে অত্যন্ত বিখ্যাত, তা জানা যাবে এই কাহিনি পড়লেই।
মাঠ থেকে দেখা যায় না বাড়িটাকে। কোনোদিক থেকেই দেখা যায় না—অন্তত উইলিয়াম তা-ই জানে। এ তল্লাটের কাউকে যদি জিজ্ঞাসা করা হয়, পিলে-চমকানো বাড়িটা কোথায় বলতে পারো? বেমালুম বলে দেবে, জানি না।
কেন যে এরকম বলে, তা কিছুতেই বুঝতে পারে না উইলিয়াম। বনজঙ্গলের আড়ালে আজব প্রফেসারের তাজ্জব বাড়ি ঢাকাঢুকে অবস্থায় আছে ঠিকই, কিন্তু খুঁজলেই তো পাওয়া যায়। উইলিয়াম তো খুঁজে খুঁজেই বার করে বাড়িটাকে এমনভাবে লুকিয়ে রেখেছেন প্রফেসার, যে একনজরে বোঝা মুশকিল! মিলিটারির লোকেরা যেভাবে গাছ-পাতা দিয়ে লড়াই করবার জিনিসপত্র, তাঁবু ইত্যাদি ঢেকে রেখে দেয়, ঠিক সেইভাবে প্রফেসার গামা (গামা রশ্মির নাম থেকে নামখানাও বাগিয়েছেন বটে!) আইভি লতা দিতে পুরো বাড়িটাকে, মায় দরজা পর্যন্ত ছেয়ে রেখে দিয়েছেন।
শুধু কি আইভি লতা, বাড়ি-ঘেরা বাগানের গাছগুলোকে এমনভাবে পুঁতেছেন প্রফেসার, যে মগডালগুলোও পাতা মেলে ধরেছে ছাদের ওপর। চারদিকের সব ক-টা গাছই ডালপালা মেলে ওপর থেকে ঢেকে রেখে দিয়েছে পিলে-চমকানো ভবন। ফলে, আকাশ থেকেও অভিনব এবং অতীব রহস্যময় এই বাড়িকে দেখা যায় না মোটেই।
এই বাড়িতেই ঢুকল উইলিয়াম—পেছনের দরজা দিয়ে। বরাবরই তা-ই ঢোকে। সামনের দরজার রহস্য বলা হবে যথাসময়ে।
ঢুকতে-না ঢুকতেই শোনা গেল প্রফেসারের কড়িকাঠ-কাঁপানো স্বাগতম্ বাণী—এসো! এসো! এসো!
ভণিতার ধার দিয়েও গেল না উইলিয়াম—উপদ্রব করতে এসেছি, প্রফেসার।
কী ধরনের উপদ্রব?
দিদির খুব অসুখ। ফরাসি অগ হয়েছে। চিনেদের মতো মারা যেতেও পারে।
খুবই দুঃসংবাদ, গমগমে সুরে বললেন প্রফেসার। চিন্তায় যে পড়েছেন, তা বোঝা গেল মুখখানার রং পালটে যেতেই—ঝকঝকে গোলাপি। কথা বলছিলেন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে, এবার উইলিয়ামকে নিয়ে ঢুকলেন। রান্নাঘরে। পেল্লায় সাইজ়ের রান্নাঘর। একদিকে কুচকুচে কালো বিরাট উনুন। রান্নার সরঞ্জাম সাজানো ওপরের খুপরিগুলোয়। দু-পাশে দুটো প্রকাণ্ড চেয়ার।
ধপ করে বসলেন একটা সোফায়। আর-একটায় উইলিয়াম বসল বটে, কিন্তু উঠতে হল পাঁচিলে চড়ার মতো হাত-পায়ের কসরত দেখিয়ে। গদিটা কিন্তু আশ্চর্য রকমের নরম। একদম ভেতরে ঢুকে বসল উইলিয়াম—অথচ খসখস শব্দ পর্যন্ত শোনা গেল না। বসবার সঙ্গে সঙ্গেই মিলিয়ে গেল বাইরের সব রকমের স্বাভাবিক শব্দ। ঘরজোড়া নীরবতা—ছুঁচ পড়লেও যেন শুনতে পাওয়া যাবে।
সেকেন্ডকয়েক উইলিয়ামের দিকে জুলজুল করে চেয়ে রইলেন প্রফেসার। তারপর ধরিয়ে নিলেন বিশাল খোলওয়ালা তামাকের পাইপখানা। নলচেটা দাঁতে কামড়ে ধরে টানতে লাগলেন হু-উ-উস হু-উ-উস শব্দে।
শুভলক্ষণ। প্রফেসার এইভাবে তখনই পাইপ টানেন, যখন তিনি কোনো জটিল সমস্যা নিয়ে গভীরভাবে ভাবতে থাকেন। অদ্ভুত নতুন অসুখটা নিয়েই নিশ্চয়ই এখন ভাবছেন। নিশ্চিন্ত হল উইলিয়াম।
কিন্তু কাঁহাতক চুপচাপ বসে থাকা যায়? তার চাইতে বরং খুঁটিয়ে দেখা যাক সামনেই বসে-থাকা প্রফেসার গামাকে। আজব মানুষ বটে। কখন যে কীরকম চেহারা বাগিয়ে বসে থাকেন, তার ঠিকঠিকানা নেই। উইলিয়াম অন্তত প্রফেসার গামাকে একই চেহারায় দুবার কখনও দেখেনি। মাঝে মাঝে মাথায় চুল ধবধবে সাদা হয়ে যায়। আজ কিন্তু মাথার চুল টকটকে লাল। মুখটাও গোলাপি হয়ে যাওয়ায় বয়স যেন অনেক কমে গেছে। মিলিয়ে গেছে কপালের বলিরেখা। ঝুঁকেও বসে নেই—বড্ড বুড়োটে দেখায় ওভাবে বসলে।
অনেকক্ষণ পরে মুখ খুললেন প্রফেসার। গলায় বিরক্তির সুর—ভিটে হারামজাদার কাজ মনে হচ্ছে।
ভিরো? হকচকিয়ে যায় উইলিয়াম—ভিরো আবার কে?
একসঙ্গেই পড়েছিলাম স্কুলে। পাজির পা-ঝাড়া। দু-চক্ষে দেখতে পারিনি কোনোদিনই। ভিরো। কিন্তু মানুষ নয়।
তবে?
অমানুষও ঠিক বলা যায় না।
তাহলে কী বলা যায়? বেশ ঘাবড়ে যায় উইলিয়াম।
বিচ্ছিরি জিনিস বলতে পারো।
বাড়ি কোথায়?
বাড়ি? খুকখুক করে প্রফেসার গামা কাশলেন কি হাসলেন, ঠিক বোঝা গেল না—যদ্দূর মনে পড়ে, ভিরো একটা জায়গার কিউরেটর! জায়গাটার নাম মৃত্যুগ্রহ।
ভীষণ চমকে ওঠে উইলিয়াম—কিউরেটর রাতে মিউজ়িয়ামের দেখাশুনো করে বলেই জানি।
পাইপের নলটাকে নির্মমভাবে চিবোতে চিবোতে বললেন প্রফেসার গাম, ভিরোও তা-ই করে। ওর মিউজ়িয়াম হল রোগের মিউজ়িয়াম।
রোগের মিউজ়িয়াম! থ হয়ে যায় উইলিয়াম। জীবনে অনেক রকমের মিউজ়িয়ামের নাম সে শুনেছে, রোগেরও মিউজ়িয়াম যে থাকতে পারে, তা তো জানত না!
তা-ই তো বললাম।—পাইপের নলটাকে এবার চুষতে থাকেন প্রফেসার।
ভিরোই তাহলে রোগ পাঠিয়েছে আমাদের কুপোকাত করার জন্যে?
সজোরে মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দিলেন প্রফেসার। ঝাঁকুনির চোটে মটমট করে উঠল শিরদাঁড়া।
মাথা গরম হয়ে যায় উইলিয়ামের—শায়েস্তা করতে পারেন না ভিরোকে?
খুবই দেরি হয়ে গেছে হে—তবে… বলে একটু থামলেন গোলাপিমুখো প্রফেসার—পরের মোক্ষম ব্যবস্থাটা এখন করা যেতে পারে।
সেটা কী?
ফরাসি অগ রোগটার দাওয়াইটা খুঁজে বার করতে হবে। যে রোগের দাওয়াই হাতে নেই, সেরকম কোনো রোগকেই হাতছাড়া করে ভিরো।
কেন?
নইলে যে নিজেই অক্কা পাবে, একটু যেন নিষ্ঠুর হেসেই বললেন প্রফেসার।
তা ঠিক। কথাটা মনে ধরে উইলিয়ামের। হঠাৎ কোত্থেকে হুহু করে বাতাস এসে ঘুরপাক দিচ্ছে সোফা ঘিরে। দেখবার জন্যে একটু ঝুঁকে বসতেই দেখতে পায়, প্রফেসারের মেয়ে কিরিল বন্ধ করছে খিড়কির দরজা। তারপরেই রান্নাঘরে ঢুকল হনহন করে। কী যেন বলছে। মুখ নাড়ছে দেখা যাচ্ছে, কিন্তু কোনো কথা শোনা যাচ্ছে না। গলা দিয়ে আওয়াজই বেরোচ্ছে না। ধপাস করে বসল উইলিয়ামের পাশেই একই সোফায়। এবার ওর কথা স্পষ্ট শুনতে পেল উইলিয়াম।
এই উইলিয়াম, তোর দিদির অসুখের খবর পেলাম।
অবাক হয়ে যায় উইলিয়াম। দিদির অসুখের খবর কিরিল জানল কী করে?
রোগটা কী ধরনের রে? প্রফেসারের প্রশ্ন।
জঘন্য। হুহু করে ছড়িয়ে পড়ছে। মারাত্মক রোগ, প্রথমে হচ্ছে ছোটোদের, তারপরেই বড়োদের।
শুনেই গা শিরশির করে ওঠে উইলিয়ামের। শুধু দিদিকেই নয়, মা-বাবাকেও হারাতে হবে শেষ পর্যন্ত।
প্রফেসার কিন্তু নির্বিকার। নাকের ডগা চুলকোতে চুলকোতে বললেন, দাওয়াই-টাওয়াই কেউ বার করতে পেরেছে?
একদম না। মেডিক্যাল রিসার্চ ল্যাবরেটরির লোকজনই বিছানা নিচ্ছে একে একে। বেশি দেরি আর লাগবে না—কুপোকাত হতে হবে প্রত্যেককেই।
বলেই মুখ কালো করে তাকায় উইলিয়ামের দিকে। তাকিয়ে আছেন প্রফেসারও। তারপরই শোনা গেল ভারী গলা—নাঃ, প্রতিষেধক ওষুধ বার করতেই হবে দেখছি।
মুখ ব্যাজার করে অমনি বলে ওঠে কিরিল, আমি কিন্তু ভিরোর কাছে যাব না।
না গেলে কি চলে? এ ছাড়া আর উপায়ও নেই। এমনিতেই অনেক দেরি হরে গেছে।
উইলিয়ামকে যাবার জন্যে বলতেও হল না। বরাবরই তা-ই হয়েছে। প্রফেসার গামার যে-কোনো লোমহর্ষক অভিযানে উইলিয়াম যে যাবেই, এ তো জানা কথা। সুতরাং পাইপটাকে পকেটে ঢুকিয়ে প্রকাণ্ড সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন প্রফেসার গামা।
বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে এলেন সবাইকে নিয়ে সামনের দরজা দিয়ে। প্রফেসারের এই এক অভ্যেস। যখনই কোনো অভিযানে বেরোবেন—রওনা হবেন সামনের দরজা দিয়ে। সদর দরজার হেঁয়ালির সমাধান উইলিয়াম করতে পারেনি আজও। আইভি লতার ঠিক কোনখানে লুকিয়ে থাকে দরজাটা, হাজার চেষ্টা করেও বার করতে পারেনি।
সবার আগে হনহন করে চলেছেন প্রফেসার। কোন ফাঁকে পকেট থেকে পাইপ বার করে ফের ধরিয়ে নিয়েছেন—দাঁতে কামড়ে ধরে টানতে চলেছেন। পাইপ বটে একখানা? বিরাট খোলের মধ্যে থেকে অগ্নিশিখা লকলকিয়ে উঠছে। অত যে জোর হাওয়া বইছে, প্রফেসারের আর কিরিলের চুল উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু পাইপের অনির্বাণ আগুন তার নিবছে না।
প্রফেসারের পেছন ধরে রয়েছে কিরিল সমান তালে। যেমন বাবা, তেমনি মেয়ে। পয়লা নম্বরের ডাকাবুকো। দৌড়ঝাঁপে ওস্তাদ। উইলিয়াম হাইফাঁই করে দৌড়েও নাগাল ধরতে পারছে না দুজনের। জ্যাকেটখানা এটে গায়ে বসে আছে বলেই উড়ে যাচ্ছে না—হাঁটু পর্যন্ত বুটজোড়া কিন্তু ছিটকে বেরিয়ে না যায় পা থেকে।
জমি ক্রমশ উঠে গেছে ওপরদিকে। বেশ কিছুক্ষণ লাগল চুড়োয় পৌঁছোতে। মুখ থেকে পাইপ বার করে ঠকঠক করে জুতোয় ঠুকলেন প্রফেসার। ফের কামড়ে ধরলেন দাঁতের ফাঁকে।
জুতোয় পাইপ ঠোকা হল নিশ্চয় নতুন কারদানি দেখানোর জন্যেই। প্রফেসার যে কতরকম কৌশল জানেন, উইলিয়াম তা আজও বুঝে উঠতে পারেনি। তাই পেছন থেকে চোখ বড়ো বড়ো করে চেয়ে রইল। ভেলকিটা ঘটে কীভাবে দেখবার জন্যে।
লাগ ভেলকিই বটে! পাইপের বিরাট খোলটাকে আকাশের দিকে তুলে রেখেছেন প্রফেসার। ভুরু-টুরু কুঁচকে মুখখানাকে যেন কীরকম করে ফেলেছেন।
ওহো! এবার মনে পড়েছে উইলিয়ামের। আগেও দেখেছে তো পাইপের এই খেল। প্রফেসারের পাইপ তো আর পাঁচটা পাইপের মতো নয়। আসলে তো এটা এনার্জি-পাইপ। অদ্ভুত এক ধরনের শক্তিতে ঠাসা পাইপ। কসমিক এনার্জির মতোই অজানা রহস্যময় এই এনার্জির সাধ্য কিছুই নেই। এই মুহূর্তে পাইপের খোল ওপরে তুলে ধরেছেন প্রফেসার, নিশ্চয় রোবট স্পেস-রিলে স্টেশনের সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্যে। আশ্চর্য এই স্টেশন রয়েছে, কিন্তু পৃথিবী থেকে বহু বহু দূরে। সূর্যের অপরদিকে।
রুদ্ধশ্বাসে তাই চেয়ে রইল উইলিয়াম লাগ ভেলকি পাইপের নতুন কাণ্ড দেখবার জন্যে।
এক সেকেন্ডও নয়, কয়েক মাইক্রোসেকেন্ড পরেই যেন জীবন্ত হয়ে উঠল আশপাশের বাতাস… সে কী আলোড়ন… অদৃশ্য ধুনুরি যেন তুলো পেঁজার মতো পিটিয়ে চলেছে বাতাসকে। দু-কান খাড়া হয়ে গেল উইলিয়ামের!
সেই সময়ে কেউ যদি আড়াল থেকে নজর রাখত তিনজনের ওপর, দেখতে পেত চক্ষুস্থির-করা দৃশ্যটা। তিনজনেই পাশাপাশি দাঁড়িয়ে রয়েছে ছোটোখাটো একটা টিলার চুড়োয়। দূরে দূরে অনেক নীচে দেখা যাচ্ছে শস্যখেত, তারও ওদিকে ঘরবাড়ি, গির্জা।
আচম্বিতে ঘটে গেল একটা অতীব তাজ্জব ব্যাপার। চোখের পাতা ফেলতে যেটুকু সময় যায়, তার অনেক কম সময়ের মধ্যেই বেমালুম হাওয়ায় মিলিয়ে গেল মূর্তি তিনটে!
আড়াল থেকে দেখার সময়ে নজরটাকে খরখরে করলে দেখা যেত আরও একটা অদ্ভুত ব্যাপার। একটা রঙিন ঝলক—নিমেষের জন্য। ঝলক মেলাতে-না মেলাতেই কানে ভেসে আসত পড়পড় করে কাপড় ছিঁড়ে ফেলার মতো একটা শব্দ।
ফ্ল্যাশ আর শব্দ শুনে কৌতূহল চাগিয়ে ওঠার পর এগিয়ে এলেই চক্ষু ছানাবড়া হয়ে যেত একটা গর্ত দেখে। চওড়ায় প্রায় তিন মিটার। এক মিটার গভীর! তিন-তিনটে মূর্তি চোখের পলক ফেলতে-না ফেলতেই অদৃশ্য হয়ে গেল যেখান থেকে গর্তটা আবিভূত হয়েছে, ঠিক সেইখানে। তলাটা ভীষণ গরম—পা দেওয়াও সম্ভব নয়!
ব্যাপারটা কী হয়েছে, এবার তাহলে খোলসা করা যাক। প্রচণ্ড এনার্জি-বিদ্যুৎ পাঠিয়েছে রোবট রিলে-স্টেশন। মুহূর্তের মধ্যে ভীষণ গতিবেগে উড়িয়ে নিয়ে গেছে তিন অভিযাত্রীকে।
ব্ৰহ্মাণ্ড জুড়ে এনার্জি পথ রয়েছে বিস্তর। একটা পথ গেছে আর-একটা পথের ওপর দিয়ে। ঠিক যেন এনার্জি পথের জাল বিছিয়ে রাখা হয়েছে মহাশূন্যে। এনার্জি-বিদ্যুৎ এই পথ-জালের ঠিক কোন পথে নিয়ে গিয়ে ফেলবে তিন অভিযাত্রীকে, উইলিয়ামের তা জানা নেই। ভীষণ গতিবেগে মহাশূন্যের বুক চিরে ধেয়ে যাওয়াটাই কেবল টের পাওয়া যাচ্ছে তারাগুলোর অবস্থা দেখে। যেন জড়সড়ো হয়ে দলা পাকিয়ে রয়েছে এক জায়গায়। গায়ে গায়ে লেগে আছে মনে হচ্ছে বটে, কিন্তু উইলিয়াম তো জানে, একটা তারা থেকে আর-একটা তারা রয়েছে কয়েক আলোকবর্ষ দূরে। খুব জোরে ছুটে যাওয়ার জন্যেই নাকি ওইরকম ঘেঁষাঘেঁষি অবস্থায় এদের দেখা যায়। প্রফেসার গামাই বুঝিয়ে দিয়েছেন ব্যাপারটা। বলেছেন আরও একটা গোলমেলে ব্যাপার। এনার্জি পথ খুব নিরাপদ রাস্তা নয়। অগুনতি ব্ল্যাক হোল আছে রাস্তায়। মহাশূন্যের মাঝে কালো গর্ত থাকার মানে কী, উইলিয়াম তা বুঝতে পারেনি। কালো কূপ নিয়ে এত ভয় পাওয়ারই বা কী আছে, তা মাথায় ঢোকেনি।
এনার্জি-বিদ্যুৎ কিন্তু তিনজনকেই অ-বস্তু বানিয়ে ফেলেছে। এটাও একটা মস্ত হেঁয়ালি উইলিয়ামের কাছে। বস্তু মানে জিনিস। অ-বস্তু মানে যা জিনিস নয়। উইলিয়ামের বস্তুময় দেহটা হঠাৎ অ-বস্তুময় দেহ হয়ে যায় কী করে, তা অনেক চেষ্টা করেও বুঝতে পারেনি উইলিয়াম। তবে এই ধরনের দেহ ধারণ করার মজাটা টের পেয়েছে হাড়েহাড়ে। সে এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা। এনার্জি পথের বাইরে থেকে যদি তাকায়, এনার্জি পথের ভেতরের কাউকেই দেখতে পাবে না। কিন্তু এনার্জি পথ বেয়ে বেগে ধেয়ে যেতে যেতে তুমি দেখতে পাবে, বাইরে থেকে কেউ উঁকি দিচ্ছে কি না। তার কাছে তুমি কিন্তু অদৃশ্য!
উইলিয়ামও তো তা-ই চায়। অদৃশ্যই থাকতে চায় মহাশূন্যের বিভীষিকাদের কাছে!
প্রফেসার আর কিরিল যে নাগালের মধ্যেই আছে, তাও জানে উইলিয়াম—চোখে দেখা না গেলেও। অনেক দূরে এক টকটকে লাল রঙের প্রপাত দেখা যাচ্ছে। জলপ্রপাতের মতোই বর্ণপ্রপাত। হুহু করে লাল রং আছড়ে আছড়ে পড়ছে উঁচু থেকে নীচে। পথের শেষ তাহলে ওইখানেই!
প্রফেসারের গমগমে গল্প শোনা গেল খুব কাছেই—হুঁশিয়ার। রাস্তা বড়ো খারাপ। কেন যে মেরামত করে না, বুঝতে পারি না।
খারাপ বলে খারাপ, যেন ককিয়ে ওঠে কিরিল—জীবনে এমন খারাপ রাস্তায় যাইনি।
হাসি পায় উইলিয়ামের। মেয়ে-বাবাতে কথা হচ্ছে, দ্যাখো। এ কি শহরের বড়োরাস্তা! নালিশ ঠুকলেই মিউনিসিপ্যালিটি থেকে এসে সারিয়ে দিয়ে যাবে।
এইটুকু সময়ের মধ্যেই প্রপাতের একদম কাছে চলে এসেছে উইলিয়াম। বুক দুরদুর করছে ভয়ে। এসে গেছে রঙের প্রপাত। হুহু করে নেমে যাচ্ছে নীচের দিকে। নদীর স্রোত হঠাৎ নীচের দিকে ঝাঁপিয়ে পড়লে যেরকম দেখায়, এ যেন ঠিক তা-ই। রক্তবর্ণ রঙের মাঝে মাঝে নীলের ঝলক দেখা দিয়েই মিলিয়ে যাচ্ছে। তীব্র বেগে এই রঙের খেলার মধ্যে দিয়ে ধেয়ে যাচ্ছে উইলিয়াম।
আচমকা শেষ হয়ে গেল রঙের প্রপাত। বিশাল একটা লাফ দিয়ে উইলিয়ামের অ-বস্তুময় দেহটা টপকে এল একটা প্রকাণ্ড জলপ্রপাত। উজ্জ্বল হলুদ রঙের জলপ্রপাত। ঝিকিমিকি জোনাকিতে ভরপুর যেন।
উইলিয়ামরা এখন ডিগবাজি খেতে খেতে ধেয়ে যাচ্ছে তো যাচ্ছেই। শেষ নেই, ডিগবাজি খাওয়ার শেষ নেই অন্তহীন গতিবেগের। এবার কিন্তু আর সামনের দিকে ধেয়ে যাওয়ার অনুভূতি নেই—মনে হচ্ছে, অনেক উঁচু থেকে নীচের দিকে পড়ছে তো পড়ছেই।
আচমকা যেন ধপাস করে তিন মূর্তিমান আছড়ে পড়ল ফেনাময় একটা আলোকপিণ্ডের ঠিক মাঝখানে। আলোর বিশাল পুঞ্জ ধকধক করছে চারপাশে। মহাশূন্যের গোলকধাঁধার মধ্যে দিয়ে এনার্জি-ফিল্ড ঠিক নিজের পথ করে নিয়েছে—তিন মূর্তিকে অকল্পনীয় বেগে উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে! অবিশ্বাস্য সেই গতিবেগকে ভাষায় বর্ণনা করা যায় না। নিজেকে ধরে রাখাও যায় না। উইলিয়াম তাই গা ভাসিয়ে দিয়ে দেখছে, কোথায় শেষ হয় এনার্জি-বিদ্যুতের খেল।
আচম্বিতে সাদা আলোর বিরাট প্রাচীর যেন ফেটে চৌচির হয়ে গেল—বহু বর্ণালির অজস্র বর্ণের বিচ্ছুরণ ঘটল!
হাইওয়ে দিয়ে যেতে যেতে যেমন মাঝে মাঝে কুঁজের মতো বাম্পে লেগে গাড়ি লাফিয়ে ওঠে—হাই স্পিডে বাম্প টপকাতে গেলে গাড়ি ঠিকরেও যেতে পারে—এক্ষেত্রেও হল ঠিক তা-ই।
এনার্জি-ফিল্ডের বড়োরাস্তায় বিশাল এই বাম্পে ধাক্কা খেতেই ঠিকরে গেল তিনমূর্তি এনার্জি-ফিল্ডেরই এক্কেবারে শেষ প্রান্তে। চকিতের জন্যে ভয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছিল উইলিয়াম। সর্বনাশ! মহাশূন্যে গিয়ে পড়বে নাকি! অনন্ত মহাশূন্যে আছড়ে পড়লে আর কি খুঁজে পাওয়া যাবে তিনজকে! নিপাত্তা হতে কতক্ষণ!
স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল পরক্ষণেই। সাংঘাতিক শক্তি তো এনার্জি-ফিল্ডের! নিমেষে টেনে ধরে তিনজনকেই ফিরিয়ে নিয়ে এল শক্তিপ্রবাহের ঠিক মাঝখানে।
কিন্তু প্রাণটা বেরিয়ে যাওয়ার উপক্রম হল পর্যায়ক্রমে তাল তাল সাদা আর রঙিন আলোর মধ্যে আছড়ে পড়ায়। শক্তিতরঙ্গও ছুটছে এলোপাতাড়িভাবে। যেন লক্ষ লক্ষ দিকে টানাহ্যাঁচড়া চলছে উইলিয়ামের দেহটাকে নিয়ে। খুবই ঘাবড়ে যায় উইলিয়াম। এরকম বিপজ্জনক জায়গা ব্রহ্মাণ্ডের আর কোত্থাও আছে কি? মনে হচ্ছে, এই বুঝি শরীরের খাবলা খাবলা অংশ ছিটকে গেল শক্তির প্রলয়ংকর আকর্ষণে।
দম-আটকানো গলায় পাশ থেকে বলে ওঠেন প্রফেসার গামা, সবাই ঠিক তো?
আগে বলো, চলেছি কোন চুলো… উঃ! কথাটা শেষ করতেও পারে না বেচারা কিরিল!
কারণ, আচম্বিতে লম্বা হয়ে যাচ্ছে তিনজনেরই দেহ। ঠিক যেন একটা নলের মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে শরীরগুলো। ক্রমশই সরু হচ্ছে নলের ভেতরটা… লম্বা… লম্বা… আরও লম্বা হয়ে যাচ্ছে তিন-তিনটে শরীর।
সহসা ফুটবলের মতো বড়ো বড়ো স্ফুলিঙ্গ আবির্ভূত হল যাত্রাপথে। গোঁ গোঁ শব্দ করে স্ফুলিঙ্গগুলো একপাশ থেকে তীব্রবেগে ধেয়ে এসেই মিলিয়ে যাচ্ছে আর-একপাশে! এদেরই মধ্যে দিয়ে অকল্পনীয় বেগে যাচ্ছে ভীষণ সরু ভয়ানক লম্বাটে দেহ তিনটে!
বিলকুল হতভম্ব হয়ে যায় উইলিয়াম! এ আবার কী কাণ্ড? একে তো মনে হচ্ছে, টানের চোটে লম্বাটে শরীরের মাথা ঠেকছে ছায়াপথের একপ্রান্তে—পা দুটো আর-একপ্রান্তে… মানে, বিশাল ছায়াপথের মতোই বিশাল হয়ে গেছে দেহখানা… তার ওপর কোত্থকে সাঁইসাঁই করে ছুটে আসছে ফুটবল সমান গর্জায়মান স্ফুলিঙ্গ! ভাগ্যিস বপু অতিশয় সরু হয়ে গেছে, তাই গায়ে লাগছে না। নইলে যে কী কাণ্ড হত!
আচমকা বন্ধ হয়ে গেল মারাত্মক এনার্জি-গোলকদের কামানের গোলার মতো ছুটে যাওয়া। আঁকাবাঁকা রাস্তাও বেশ সমান হয়ে এল। মাঝে মাঝে দু-একটা মোড় পড়ছে বটে, সরু শরীরগুলো সাঁত সাঁত করে এঁকেবেঁকে যেন এ গলি-সে গলি দিয়ে ছুটে যাচ্ছে। কিন্তু সেই আছাড়িপিছাড়ি ভাব আর নেই।
আঃ! বাঁচা গেল। শরীর এলিয়ে দেয় উইলিয়াম।
আঁতকে ওঠে পরের মুহূর্তেই। ভয়ানক ভুল করেছে গা ঢিলে দিয়ে। হঠাৎ কুঁচকে এল শরীরটা। টানটান রবারের ফিতে যেন আচমকা ফিরে এল স্বাভাবিক দৈর্ঘ্যে। ঠিক যতখানি লম্বা ছিল উইলিয়াম, ততখানি হয়ে গেল চোখের পলক ফেলতে-না ফেলতে।
প্রফেসার গামা আর কিরিলের যুগপৎ বিস্ময়োক্তি শোনা গেল। পাশে—আঃ!
অর্থাৎ দুজনেই ফিরে গেছে আগের অবস্থায়।
আনন্দে আত্মহারা হয়ে গিয়েছিল উইলিয়াম। তাই খেয়াল করেনি, বাঁইবাঁই করে আবির্ভূত হচ্ছে আর-একটা মহাশূন্য গোলকধাঁধা। অতিকায় দানবিক হেঁয়ালি। দূর দিগন্তে এতক্ষণ যেন ঘাপটি মেরে ছিল বিশাল এই প্রহেলিকা। উইলিয়াম যখন দেখতে পেল, তখন দেরি হয়ে গেছে খুবই।
ঠিক যেন একটা ঘূর্ণিপাক। নীচের দিক থেকে সাঁ করে ছুটে এল উইলিয়ামের দিকে। হুঁশিয়ার হওয়ার আগেই সড়াত করে ঘূর্ণিপাকের ভেতরে তলিয়ে গেল উইলিয়াম। দড়াম করে আছড়ে পড়ল, বলা যায়। দু-হাত আর দু-পা ছিটকে গেল চারপাশে। সে এক বিতিকিচ্ছিরি কাণ্ড!
ভয়াবহ চৌম্বক বন্যা বয়ে চলেছে রহস্যময় এই ঘূর্ণিপাকের মধ্যে। যেন পাক-খাওয়া একটা দড়ি। চৌম্বক প্রবাহগুলো দড়ির মতোই পাকিয়ে পাকিয়ে ছুটছে কল্পনাতীত বেগে। স্রোতে ভেসে যাওয়ার ফলে একইভাবে পাক খাচ্ছে তিন-তিনটে দেহ।
বিদঘুটে এই সমস্যার মধ্যে আচম্বিতে উইলিয়ামের মনে হল যেন লক্ষ লক্ষ খুদে খুদে ইলেকট্রিক শক প্যাঁট প্যাঁট করে গায়ে ফুটছে ছুঁচ ফোটার মতো।
কী জ্বালা! কী জ্বালা! মহাকাশ পর্যটনে এত বিড়ম্বনা কে জানত!
অনেক দূর থেকে ভেসে এল প্রফেসার গামার কণ্ঠস্বর—তোরা সব ঠিক আছিস তো?
ক্ষীণকণ্ঠে জবাব দিল উইলিয়াম, একেবারেই না।
চিৎকার শোনা গেল কিরিলের—সহ্য করে যা… সহ্য করে যা! রোবট-স্টেশনের কারসাজি। ইচ্ছে করেই ফাটিয়ে চৌচির করে দেওয়ার চেষ্টা করছে আমাদের।
ভিরো শয়তানের কারসাজি বলেই তো মনে হচ্ছে, বিড়বিড় করে বলেন প্রফেসার। ঠিক আছে, রোবট-স্টেশনকে সামাল দিচ্ছি আমি।
কী যে করলেন প্রফেসার গামা, তা বুঝতেই পারল না উইলিয়াম। কিন্তু খেলটা দেখালেন এত তাড়াতাড়ি যে চকিতে অতি-তীব্র এনার্জির বাধা উধাও হয়ে গেল যাত্রাপথ থেকে। রোবট-স্টেশনই সৃষ্টি করেছিল এনার্জি দিয়ে তৈরি বাধার পর বাধা—কিন্তু প্রফেসার গামার এক কারদানিতেই ভেঙে পড়ল সব ক-টা বাধা।
পথ এখন পরিষ্কার। স্বচ্ছন্দে মসৃণ গতিতে ভেসে চলেছে তিনজনে।
হাঁপ ছেড়ে বাঁচল উইলিয়াম। কী সাম্প্রতিক ঝঞ্ঝাটের মধ্যে দিয়েই কেটেছে এতক্ষণ। মুহূর্তে মুহূর্তে মনে হয়েছে, এই বুঝি বেরিয়ে গেল প্রাণটা—শরীরটা টুকরো টুকরো হতে আর বুঝি দেরি নেই।
হুঁশিয়ার! আছড়ে পড়ে নামতে হবে কিন্তু। গামার চিৎকারে চমকে ওঠে উইলিয়াম। শক্ত করে শরীরটাকে। না জানি আবার কী ঝামেলায় পড়তে হয় এখুনি।
বকর বকর করেই চলেছেন প্রফেসার—শয়তান চূড়ামণি ভিরো পাকা ধূর্ত। রোবট-স্টেশনকে বলে রেখে দিয়েছে আমরা তিনজনে আসলে তিনটে ভাইরাস। ব্ৰহ্মাণ্ড জুড়ে রোগসংক্রমণ করতে চলেছি। তাই এতক্ষণ নৃশংস হামলা চলেছিল আমাদের ওপর।
নৃশংস বলে নৃশংস! মনে মনেই বলে উইলিয়াম, হাড়েহাড়ে টের পাওয়া গেছে হামলাটা কী জাতীয়। ভিরো হারামজাদা তো মহাকুচুটে…
চেঁচিয়ে ওঠে কিরিল, বাবা! এত জোরে ধেয়ে যাচ্ছি, আছড়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে তো ছাতু হয়ে যাব। বস্তু-শরীর আর পাব না কেউই।
ফ্যাচফ্যাচ করিসনি!—ধমকে ওঠে প্রফেসার। রোবট-স্টেশন মূল প্রবাহপথ থেকে টেনেহিঁচড়ে সরিয়ে এনেছে।
তিনজনকেই। কামানের গোলার মতো ছুড়ে দিয়েছে ম্যাড়মেড়ে ধূসর-বাদামি রঙের একটা গ্রহের দিকে। ভীষণ বেগে ধেয়ে যেতে যেতে তিনজনেই একসঙ্গে দেখতে পেল গ্রহটাকে।
বিতিকিচ্ছিরি রঙের অজানা গ্রহের দিকে তাকিয়ে বুক গুড়গুড় করে ওঠে উইলিয়ামের—প্রফেসার, মরা গ্রহ নাকি? প্রাণে বেঁচে থাকতে পারব কি?
ফুর্তি উথলে ওঠে প্রফেসারের জবাবে—পারবি না মানে? একশোবার পারবি। আবহাওয়া পৃথিবীর আবহাওয়ার মতোই। মানে, কাছাকাছি বলা যায়। তবে কিলবিল করছে ভাইরাস আর ব্যাকটেরিয়া। হুঁশিয়ার!
বাবা! স্পিড যে আরও বেড়ে গেল।—ককিয়ে ওঠে কিরিল।
জবাব দেওয়ার সময় পেলেন না প্রফেসার। আচমকা তিনজনই ফিরে পেল বস্তুময় দেহ। বিদঘুটে গা-হিম-করা গ্রহের প্রায় একশো মিটার ওপরে অ-বস্তু থেকে বস্তু হয়ে গেল তিনজনে।
আতঙ্কে চিলের মতো চেঁচিয়ে ওঠে কিরিল, বাবা! এ কী করলে? আছড়ে পড়লে আর কি বাঁচব?
বিস্ফারিত চোখে ভয়ানক গ্রহের দিকে তাকিয়ে রইল উইলিয়াম। আগ্নেয়গিরি আর জ্বালামুখগুলো হুহু করে উঠে আসছে ওপরদিকে। মাটি ফেটে চৌচির—স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। এই গতিবেগে বস্তুময় দেহ নিয়ে আছড়ে পড়লে আর রক্ষে নেই।
কিন্তু কী আশ্চর্য! গ্ৰহপৃষ্ঠের একদম কাছাকাছি আসতেই কমে গেল পতনের বেগ। ঠিক যেন হালকা শোলার মতো ভাসতে ভাসতে নেমে এল তিনটে দেহ। প্যারাসুটে করে নামলে যেমন মনে হয়, ঠিক সেইভাবে।
সোল্লাসে বললেন প্রফেসার গামা, একেই বলে মাধ্যাকর্ষণের ম্যাজিক! মাধ্যাকর্ষণের রহস্য যদি জানতে চাস, এই হল তার মোক্ষম সুযোগ!
মাধ্যাকর্ষণের রহস্য জানবার এই কি সময়? প্রফেসার জ্ঞান দেওয়ার আর সময় পেলেন না?—ভীষণ রাগ হয়ে যায় উইলিয়ামের।
রেগেছিল কিরিও। তাই খেঁকিয়ে ওঠে ভাসমান অবস্থাতেই—মাধ্যাকর্ষণের টান কাকে বলে, বাবা?
আহা রে! যেন কিছুই জানে না। আসলে খেপিয়ে দিচ্ছে বাবাকে।
প্রফেসার গামাও তেমনি। খোঁচাটা গায়েই মাখলেন না। ভাসমান শরীরটাকে আস্তে আস্তে একপাশে বেঁকিয়ে নিয়ে ঝকঝকে দাঁতে হেসে বললেন, কাকে বলে, সেটা ভালো করেই জানিস। জানিস শুধু এখানকার মাধ্যাকর্ষণ কত।
কত?—কিরিল এবার সত্যিই জানতে চায়।
পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণের একশো ভাগের এক ভাগ। তাই সেকেন্ডে দশ মিটার গতিবেগে আছড়ে পড়ার বদলে সেকেন্ডে দশ সেন্টিমিটার স্পিডে নামছি বিচ্ছিরি গ্রহে।
আচমকা শোনা গেল একটা বিরাট কড়মড় শব্দ। যেন অনেকগুলো পাথর ধাক্কা খেল একসঙ্গে।
ওপরের দিকে তাকিয়েই রক্ত জল হয়ে যায় উইলিয়ামের।
মাথার ওপর ধকধক করে জ্বলছে টকটকে লাল রঙের একটা লম্বাটে গোলক। গোলকের সামনের দিকে অনেকগুলো হলদে চাকা ঘুরছে বাঁইবাঁই করে।
প্রফেসার! প্রফেসার! দেখেছেন?
ঘাড় বেঁকিয়ে দেখলেন প্রফেসার। নিশ্চিন্ত গলায় বললেন, লোহিত জ্বর।
সেটা আবার কী?
স্কারলেট ফিভার।
জ্বর কি ওইরকম দেখতে হয়?
দুর বোকা! জ্বরের জীবাণু ওটা।
এত বড়ো?
মাধ্যাকর্ষণ কম বলেই অত বড়ো অবস্থায় দেখা যাচ্ছে। পৃথিবীতেও মাধ্যাকর্ষণ কম হলে বড়ো আকারেই দেখতে পেতিস।
বিপজ্জনক নিশ্চয়?
সাংঘাতিক বিপজ্জনক। দাঁতের একটা কামড় খেলেই দু-একদিনের মধ্যেই জ্বরে বেহুঁশ হতে হবে, বলতে বলতে আস্তে আস্তে অজানা গ্রহের মাটিতে পা দিলেন প্রফেসার।
উইলিয়ামের পা-ও ঠেকেছে মাটিতে! অবাক বিস্ময়ে ওপরপানে তাকিয়ে বলে, গ্রহে গ্রহে জীবাণু পাঠায় কী করে ভিরো ব্যাটাচ্ছলে? পৃথিবীতে এত বড়ো জীবাণু কিন্তু নেই।
যেভাবে আমরা এলাম মহাশূন্যের বুক চিরে—ঠিক সেইভাবে জীবাণুর দলও যায় গ্রহে গ্রহে। সাইজ় নির্ভর করে যেখানে যাচ্ছে, সেখানকার মাধ্যাকর্ষণের ওপর। পৃথিবীতে এদের দেখতে হয় অণুবীক্ষণের মধ্যে দিয়ে—প্রকৃতির মধ্যে মিশে থাকে। ভিরো আগে থেকেই সাইজ় ছোটো করে দেয়—যাতে খালি চোখে না দেখা যায়।
এবড়োখেবড়ো পাথুরে জমির ওপর ততক্ষণে নামা হয়ে গেছে তিনজনেরই। রুক্ষ গ্রহের চেহারা দেখে গা শিরশির করছে উইলিয়ামের। প্রফেসার কিন্তু নির্বিকার। হনহন করে এগিয়ে চললেন সামনের দিকে। ঠিক যেন ক্যাঙারুর মতো লম্বা লম্বা লাফ মেরে ধেয়ে যাচ্ছেন ঝড়ের বেগে। কম মাধ্যাকর্ষণ বলেই এক-এক লাফে পেরিয়ে যাচ্ছেন অনেকটা পথ। দেখাদেখি উইলিয়াম আর কিরিও লাফ দিয়ে দিয়ে চলল পেছন পেছন। কিন্তু হিমশিম খেয়ে গেল বুড়ো প্রফেসারের নাগাল ধরতে। চুল উড়ছে, নেকটাই উড়ছে, কোট উড়ছে—সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ে প্রফেসার নিজেও যেন উড়ে চলেছেন।
পেছন পেছন একইভাবে উড়ে চলার ভঙ্গিমায় লাফিয়ে লাফিয়ে ছুট দিল উইলিয়াম আর কিরিল।
বেশি দূর যেতে হল না। পালটে গেল পায়ের তলার পাথুরে জমির চেহারা। এতক্ষণ ছিল কঠিন কর্কশ, আচম্বিতে হয়ে গেল তরল গোলাপি। থইথই করছে গোলাপি জলের মতো গোলাপি তরল পাথর পায়ের তলায়।
বলিহারি যাই প্রফেসার গামার ক্ষিপ্রতা। উইলিয়াম আর কিরিলকে নিমেষে খামচে ধরলেন দু-হাতে। কলার চেপে ধরে লম্বা লাফ মেরে উড়িয়ে নিয়ে গেলেন তরল বিভীষিকার ওপর দিয়ে।
যেন কদর্য পাঁক দেখে গা ঘিনঘিন করছে, এমনি সুরে বলে ওঠে কিরিল, ম্যা গো! কী জিনিস এটা?
গোলাপি অঞ্চলটা পেরিয়ে এলেন প্রফেসার এক লাফেই। ভূমিতলে অবতীর্ণ হয়ে বললেন নিরুদ্ধশ্বাসে—পেটের রোগের জীবাণু।
জঘন্য জায়গা—কিরিলের মন্তব্য।
তা আর বলতে, একমত হয় উইলিয়ামও। মৃত্যুগ্রহ যে এত বিচ্ছিরি, ভাবতেও পারেনি। আর একটা মুহূর্তও থাকতে ইচ্ছে যাচ্ছে না এখানে।
আবার লম্বা লম্বা লাফ দিয়ে ধেয়ে চলেছেন প্রফেসার। পেছনে পেছনে হাঁসফাঁস করতে করতে ছুটে আসছে কিরিল আর উইলিয়াম। বুড়ো হাড়ের ভেলকি দেখে অবাক দুজনেই।
হঠাৎ আবার এ কী। কথা নেই বার্তা নেই, বাতাস চিরে ফালাফালা হয়ে যাওয়ার মতো বিকট একটা শনশন শব্দ শোনা গেল পেছনে। শব্দ তো নয়—যেন হুহুংকার!
চকিতে পেছনে তাকায় তিনজনে।
ঘন বেগুনি আর লাল রঙের একটা বাতাসে ফোলা বল সাঁইসাঁই করে ছুটে আসছে ওদের দিকে। পালাবার সময়ও আর নেই—এত কাছে এসে গেছে।
কিন্তু কয়েক মিটার তফাতে এসেই ধাঁই করে মাটিতে আছাড় খেল বলটা। বল নয় নিশ্চয়—আর-একটা জীবাণু। আছাড় খেতেই ফেটে চৌচির হয়ে গেল বাইরের খোলসটা। ভেতর থেকে পিলপিল করে বেরিয়ে এল শয়ে শয়ে খুদে বল—বেগুনি আর লাল রঙের।
সংবিৎ ফিরে পেয়ে তিন মূর্তিই বিরাট লাফ দিয়ে সরে গেল নিরাপদ দূরত্বে।
বাবা গো, কোথায় নিয়ে যাচ্ছ আমাদের? কিরিল শুধোয় আর্তকণ্ঠে।
সামনেই একটা বাংকার আছে—কোথায় আছে ঠিক জানি না—সেইখানে। আরও দুশো মিটারের মতো পথ ক্যাঙারু-লাফ মেরে পেরিয়ে এল তিনজনে। দেখা যাচ্ছে বাংকারটা। চকচকে ধাতুর তৈরি একটা গম্বুজ-ঘর। মৃত্যুগ্রহের বুকে এরকম বাংকার দেখতে পাবে, আশা করেনি উইলিয়াম।
কিন্তু প্রফেসার তো সবই জানেন, দেখা যাচ্ছে। গম্বুজ-ঘরে ঢুকতে হবে কী করে, তাও জানেন। পকেট থেকে শক্ত কার্ডের মতো একটা জিনিস বার করে গম্বুজ-ঘরের চকচকে দেওয়ালের একটা ফাঁকে ঢুকিয়ে দিলেন!
কার্ড নয়—চাবি। লুকোনো একটা দরজা খুলে গেল ধাতব দেওয়ালে।
সটাসট তিনজনে ঢুকে পড়ল ভেতরে। নিঃশব্দে চোরা দরজা বন্ধ হয়ে গেল পেছনে—আপনা থেকেই।
স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বললে কিরিল, আঃ বাঁচলাম এতক্ষণে।
টিপ্পনী কাটলেন প্রফেসার গামা সঙ্গে সঙ্গে, বাঁচলি মানে? কী থেকে বাঁচলি? জীবাণুর খপ্পর থেকে, না ভিরোর মৃত্যুফাঁদ থেকে?
রেগে যায় কিরিল—আর ভয় দেখিয়ো না, বাবা!
গলা খাটো করে বললেন প্রফেসার, ভয় কি আর এমনি দেখাচ্ছি রে। ভয় পাওয়া কাকে বলে, এখনও তা জানলি না। আসল ভয়ের পালা শুরু হল এইবারে।
বলতে বলতে শিরদাঁড়া খাড়া করে সিধে হয়ে দাঁড়ালেন গামা। মনে হল, যেন কয়েক সেন্টিমিটার বেশি হয়ে গেছেন মৃত্যুগ্রহে পা দিয়ে। পৃথিবীতে এত লম্বা তো ছিলেন না। হনহন করে এগিয়ে গেলেন ছোট্ট গলিপথ বেয়ে। পেছন পেছন এল ভয়ে আধমরা উইলিয়াম আর কিরিল।
গলিপথ শেষ হয়ে গেল অচিরেই। সামনেই একটা গর্ত। উজ্জ্বল নীল আলোয় আলোকিত।
হুঁশিয়ার করে দিলেন প্রফেসার, অচেনা কারও সঙ্গে একদম কথা বলবি না।
বলেই পা দিলেন সামনের পাতাল গহ্বরে!
আঁতকে উঠল উইলিয়াম আর কিরিল প্রফেসারের কাণ্ড দেখে। ভয়ডর কি একদম নেই? এভাবে গর্তের মধ্যে কেউ লাফ দেয়? চকিতে প্রফেসারের মাথা পর্যন্ত অদৃশ্য হয়ে গেল গহ্বরের মধ্যে।
“পাগল নাকি? বলেই আর কোনো কথা না বলে কিরিল পা বাড়িয়ে রাখল গর্তের মধ্যে। ভয়ে ভয়ে উইলিয়াম পেছন থেকে চেপে ধরতে গিয়েছিল বটে, কিন্তু নিজেই তাল সামলাতে না পেরে হুমড়ি খেয়ে ছিটকে গেল গর্তের মধ্যে। হুহু করে পড়তে লাগল শূন্যের মধ্যে দিয়ে।
কিন্তু পতনের বেগ কমে গেল একটু পরেই। মৃত্যুগ্রহে নামবার সময়ে যেভাবে হালকা পালকের মতো ভাসতে ভাসতে নেমেছিল, সেইভাবে শরীরটা হেলেদুলে নামতে লাগল নীচের দিকে। কখনও ডিগবাজি খাচ্ছে শূন্যপথে, কখনও হাত-পা ছড়িয়ে যাচ্ছে চারপাশে কিছু একটা আঁকড়ে ধরার চেষ্টায়। কিন্তু পাচ্ছে না কিছুই। পতনের ধীরগতিকেও রোধ করতে পারছে না কিছুতেই।
ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গিয়েছিল বলেই উইলিয়াম দেখতে পায়নি কিরিল আর প্রফেসারকে। গর্তের গায়ে একটা চাতালে দাঁড়িয়েছিল দুজনে। পাশ দিয়ে ওলট-পালট খেয়ে আর-একটু হলে নেমে যেত উইলিয়াম। হাত বাড়িয়ে খপ করে কলার চেপে ধরলেন প্রফেসার। টেনে এনে দাঁড় করিয়ে দিলেন পাশে।
সিধে হয়ে দাঁড়িয়েই খাবি খেতে খেতে জিজ্ঞেস করেছিল উইলিয়াম, উঠব কী করে? বেরোব কীভাবে?
তামাক খাওয়ার বিশাল পাইপটা এক হাতে ধরে নাড়তে নাড়তে প্রফেসার বললেন, যা নীচে নামে, তা ওপরেও ওঠে। তা না হলে, যা কিছু নীচে নেমেছে, কোনোদিনই আর ওপরে উঠে যেত না। বুঝেছিস, কী বললাম?
বলা বাহুল্য, বিন্দুবিসর্গ বোঝেনি উইলিয়াম। কিন্তু মুখে তা প্রকাশ করার আগেই আচমকা দু-ফাঁক হয়ে গেল পেছনের পাথুরে দেওয়াল। ছেলেমেয়ে দুজনের হাত ধরে হনহন করে একটা টানা লম্বা গলিপথে ঢুকে পড়লেন প্রফেসার গামা।
হেঁটেই গেলেন লম্বা লম্বা পা ফেলে। বেশ কিছুক্ষণ পরে পৌঁছোলেন একটা প্রকাণ্ড হলঘরে। কাঠ হয়ে গেল উইলিয়াম, পাজির পা-ঝাড়া ভিরোর সঙ্গে দেখা হবে নিশ্চয় এখুনি।
কিন্তু তাড়া লাগালেন প্রফেসার—দাঁড়িয়ে গেলি কেন রে? খোঁজ… খোঁজ… মেঝের ওপর একটা সার্কল আছে… চটপট খুঁজে বার কর।
এবং, উইলিয়ামই সবার আগে দেখতে পেল বৃত্তটা। রয়েছে হলঘরের ঠিক মাঝখানে। ম্যাড়মেড়ে হলদেটে ধাতু দিয়ে বাঁধানো একটা সার্কল। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে চৌখুপি ঘর-কাটা চকচকে মেঝের ওপর, বিরাট বিরাট কারুকাজ-করা থামের পাশ দিয়ে ছুটতে ছুটতে চেঁচিয়ে উঠেছিল সোল্লাসে, ওই তো! ওই তো! ওই তো!
শাবাশ, কিরিলকে আর উইলিয়ামকে হ্যাঁচকা টানে সার্কলের মাঝে দাঁড় করিয়ে ফুর্তি-ফুর্তি গলায় বললেন প্রফেসার, কিন্তু সাবধান! সার্কলের বাইরে কেউ পা দিবি না। কোনোমতেই না। দিলেই ধুলোর মেঘ বানিয়ে ছাড়বে হতচ্ছাড়ারা।
ভয়ের চোটে ধপ করে বসে পড়ে উইলিয়াম। কিরিল বাবার কনুই খামচে ধরে দাঁড়ায় গা ঘেঁষে। এরকম অদ্ভুত বিশাল হলঘর জীবনে কেউ দেখেনি। নীলাভ পাথর দিয়ে তৈরি বিরাট খিলেনের আশ্চর্য সুন্দর কারুকাজওয়ালা থামগুলো ধরে রেখে দিয়েছে মাথার ওপরকার ছাদকে। মেঝের চৌখুপি পাথরও নীলচে রঙের। সে যে কত বড়ো ঘর, তা বলে বোঝানো যাবে না।
হতভম্ব হয়ে হলঘরের সৌন্দর্য দেখছে উইলিয়াম, এমন সময়ে চোখে পড়ল সোজা থামের মতো সঞ্চরমাণ কতকগুলো বস্তু। শনশন করে ধেয়ে আসছে মসৃণ মেঝের ওপর দিয়ে খাড়া অবস্থায়। কুচকুচে কালো থাম বলেই তো মনে হচ্ছে। কিন্তু প্রত্যেকের মাথায় ডিমের মতো স্ফটিক আধার থেকে ঘনঘন স্ফুলিঙ্গ ছিটকে বেরোচ্ছে। প্রত্যেকের গায়ে অদ্ভুত গড়নের মস্ত কামানের মতো রে-গান লাগানো রয়েছে।
চল্লিশটা কি তারও বেশি থাম। দানব নিশ্চয়। দেখতে থামের মতো। শনশন করে কোত্থেকে ঢুকে পড়ল হলঘরে। শনশন করে এগিয়ে এল সার্কলের দিকে। ঘিরে ধরল চারদিকে।
দেখেই আত্মারাম খাঁচাছাড়া হয়ে গিয়েছিল উইলিয়ামের। তড়াক করে লাফিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে জাপটে ধরল প্রফেসারকে।
থামের মতো দানবাকার প্রাণীগুলো কিন্তু কোনো শব্দ করছে না। মাথায় প্রত্যেকেই ছ-মিটার উঁচু। প্রায় দোতলা বাড়ির সমান। বপুগুলো দেখে মনে হচ্ছে যেন পাইন গাছের সটান গুঁড়ি। এক মিটার মোটা মাথার ওপর ডিম্বাকৃতি স্ফটিক আধারের মাঝে একটা রঙিন আলোর চাকা ঘুরছে বনবন করে। ঘনঘন স্পার্ক বেরোচ্ছে তা থেকে। নিঃশব্দে বিচিত্র দৈত্যরা চারদিক থেকে গোল হয়ে ঘিরে ধরল তিনমূর্তিকে—তারপর ঝটাং করে প্রত্যেকের রে-গানের নলচে ফিরে গেল তাদের দিকেই!
বুকটা ধড়াস করে ওঠে উইলিয়ামের। ফিশফিশ করে শুধোয় গামাকে, এরা আবার কারা, প্রফেসার? পা নেই তো হাঁটছে কী করে?
এ গ্রহের রক্ষী এরা? রোগেদেরও রক্ষী, জবাব দিলেন প্রফেসার।
জ্যান্ত কেন? বলতে বলতে হেঁট হয় উইলিয়াম—পা যখন নেই, চাকা নিশ্চয় আছে। চাকার ওপর গড়িয়ে গড়িয়ে ছুটে এসেছে শনশন করে। কিন্তু চাকাই বা কোথায়?
ধমকে ওঠে কিরিল, আচ্ছা বোকা তো! জ্যান্ত হবে কেন? রোবট কখনও দেখিসনি?
রোবট।
হ্যাঁ রে। রোবট এরা প্রত্যেকেই।
সর্বনাশ!
মনের আনন্দে পাইপের নলচে চুষতে চুষতে যেন আপন মনেই বলেন প্রফেসার, ভাবছি এদের সর্দারটা কে।
ওই তো… ওই আসছে সর্দার, হাত তুলে দেখায় উইলিয়াম।
সর্দার? সর্দারের চেহারা এরকম হয়? এ তো একটা চৌকোনা বাক্সো। একদিকে একটা বর্শার ফলা লাগানো রয়েছে যেন। শূন্যপথে তিরবেগে বাক্সোটা এগিয়ে আসছে সার্কলের দিকে। দাঁড়িয়ে গেল কয়েক ফুট দূরে এসে। ভাসতে লাগল শূন্যে। বর্শার ফলাটা ফেরানো রয়েছে ওদের দিকেই!
প্রফেসার কিন্তু ঠিক চিনেছেন। হইহই করে বলে উঠলেন, দূত এসেছে—আমরা কে জানতে এসেছে।
বলতে বলতে পকেট থেকে বার করলেন সেই শক্ত কার্ডটা, যা দিয়ে ধাতব গম্বুজ-ঘরের চোরা দরজা খুলেছিলেন। কয়েক পা এগিয়ে গেলেন সামনে। ভাসমান বাক্সের সামনের দিকে একটা খাঁজের ভেতর ঢুকিয়ে দিলেন কার্ড। শোঁ করে শুষে নেওয়ার মতো শব্দ শোনা গেল সঙ্গে সঙ্গে এবং অদৃশ্য হয়ে গেল পরিচয়পত্র। আচমকা সামনে-পেছনে দুলে উঠল বাক্সের গায়ে লাগানো বর্শা-ফলক। ঠিক যেন ইশারা করছে কাউকে।
ইশারাই বটে। হঠাৎ একটা দরজা খুলে গেল হলঘরের একপ্রান্তে। খুলে গেল মানে পাশের দিকে সরে গেল। স্লাইডিং ডোর তো। হড়কে সরে গেল দেওয়ালের খাঁজে। ওপাশে দেখা গেল আর-একটা হলঘর।
ভিয়োর সঙ্গে মোলাকাত হবে মনে হচ্ছে? শুধোয় উইলিয়াম।
না হলেই মঙ্গল! চাপা গলা প্রফেসারের। দূত যে খবর দিয়ে গেল, তা থেকেই বুঝলাম, কাজকারবার নিয়ে দারুণ ব্যস্ত ভিরো। কাজটা আমাদের নিকেশ করার কাজ কি না, সেটা কিন্তু বলেনি।
বাক্সে কীভাবে খবর দিতে হবে, জানলেন কী করে? আবার শুধোয় উইলিয়াম।
আমার কার্ডকে বলা যায় সব কাজের কার্ড। ঠিক যে খবরটা ওদের দরকার, কার্ড থেকে তুলে নিয়েছে শুধু সেইটুকু।
ভাসমান বাক্সো বর্শা-ফলক নেড়ে নেড়ে বিশালদেহী রোবটদের হুকুম দিতেই দু-সারি থামের মতো দাঁড়িয়ে গেল কিম্ভূতকিমাকার যন্ত্রদানবরা। মাঝখান দিয়ে হেঁটে চলল তিনজনে সামনের হলঘরের দিকে। কয়েক পা যেতে-না যেতেই হু-উ-উ-স করে একটা শব্দ হতেই চমকে পেছন ফিরে তাকিয়েছিল উইলিয়াম।
চোখ পড়ল একটা যন্ত্রদানবের দিকে। রে-গান তাক করে রয়েছে হলঘরের খোলা দরজার দিকে। লাল রশ্মির রেশ দেখা যাচ্ছে রে-গানের নলচের মুখে।
দরজার সামনে পৌঁছে বোঝা গেল, কাকে তাক করে রশ্মি-বন্দুক বর্ষণ করেছে যন্ত্রদানব।
মেঝের ওপর পড়ে একটা সবুজ রঙের ছোট্ট ঘনক। অনেকটা লুডো খেলার ছক্কার মতো দেখতে। তবে এক-একটা ইঞ্চি তিনেকের মতো। সাদা জ্যোতি ঠিকরে যাচ্ছে গা থেকে। ঝলসে যাওয়ার ফল। গনগনে আভা সাদা জ্যোতির আকারে বেরিয়ে আসছে। দেখতে দেখতে মিলিয়ে গেল আভা।
পাশ কাটিয়ে যেতে যেতে উদাসীন গলায় চিনিয়ে দিলেন প্রফেসার—নিউমোনিয়ার জীবাণু। খতম করে দিল চক্ষের নিমেষে।
গা শিরশির করে ওঠে উইলিয়ামের। নিউমোনিয়া বড়ো বিচ্ছিরি ব্যারাম।
ঢুকে পড়েছে তিনজনে সামনের হলঘরে। এখানেও মেঝেতে রয়েছে হলদেটে ধাতুর একটা সার্কল।
বাবা, সার্কলগুলোর কাজ কী?—কিরিলের প্রশ্ন।
কারও জারিজুরি এখানে খাটবে না। রোবটদের ক্ষমতা সার্কলের বাইরে—ভেতরে চড়াও হতে পারবে না।
উইলিয়াম তখন তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে, হলঘরে আর কেউ আছে কি না। কিন্তু কেউ তো নেই। হঠাৎ…
একটা সিংহাসন মেঝে ফুঁড়ে উঠে এল। একদম সামনেই। দেখতে দেখতে উঠে গেল তিন মিটার উঁচুতে।
অবাক হয়ে আর-একটু হলে হলদে সার্কলের বাইরে পা বাড়িয়ে দিত উইলিয়াম। ক্যাঁক করে পেছন থেকে চেপে ধরলেন প্রফেসার গামা।
চক্ষুস্থির হয়ে গেল উইলিয়ামের পরক্ষণেই। সিংহাসনের মাথায় ওটা আবার কী? অনেকটা গুবরেপোকার মতো দেখতে ভয়ানকদর্শন একটা প্রাণী প্রচণ্ড গোঁ গোঁ শব্দ করতে করতে উঠে পড়ল শূন্যে। বপুটা অনেকটা কুমড়োর মতো। কুচকুচে কালো। ওপরদিক ঢাকা রয়েছে টুপি দিয়ে। লাল রঙের স্ফুলিঙ্গময় টুপি। রামধনুর সাতটা রঙের তেজ ছিটকে ছিটকে বেরিয়ে আসছে টুপি থেকে। মুণ্ডুর বালাই নেই। শুধু দুটো শুঁড় কিলবিল করছে শূন্যে। একটা শুঁড়ের ডগায় ধরা বলটার রং ঘোর লাল। অ্যান্টেনা নিশ্চয়। নড়ছে ক্রমাগত। পাকসাট দিচ্ছে, দুলছে, বাতাসে আছড়ে পড়ছে। দেখলেই গা হিম হয়ে যায়।
উইলিয়ামের চোখ ঠেলে বেরিয়ে এল মূর্তিমান সেই আতঙ্ককে দেখে। দম আটকে এল কথা বলতে গিয়ে—প্রফেসার, এটা আবার কী?
প্রশান্তস্বরে সিধে হয়ে দাঁড়িয়ে ফুকফুক করে পাইপ টানতে টানতে প্রফেসার বললেন, ভিরোর ল্যাবরেটরির ডিরেক্টর।
প্রফেসারের গা ঘেঁষে দাঁড়ায় উইলিয়াম—প্রতিষেধক ওষুধটা শুধু রাখলেই হত এখানে। কী দরকার ছিল ল্যাবরেটরিতে এত রোগ আর প্রাণী রাখার?
বোকার মতো কথা বলিসনি! ধমকে ওঠে কিরিল। রোগ না থাকলে প্রতিষেধক ওষুধ তৈরি হবে কী করে?
আঃ! বড়ো গোলমাল হচ্ছে! দাবড়ানি দেন প্রফেসার। এতজনে রয়েছি—এই একটা বদমাশকে শায়েস্তা করতে পারব না?
ভাগ্যিস ভিরো নেই ল্যাবরেটরিতে। জুলজুল করে ভাসমান বিভীষিকার পানে চেয়ে বলে উইলিয়াম।
ভাসমান বিভীষিকা ততক্ষণে ভেসে এসেছে সার্কলের একদম সামনে। আর এগোতে পারছে না। কানে তালা-ধরানো শব্দে গুঁইগুঁই করে যাচ্ছে প্রচণ্ড আক্রোশে। লাল টুপি থেকে পটপট শব্দে সাতরঙা স্ফুলিঙ্গ ছিটকে যাওয়া আরও বেড়েছে। অদ্ভুত তাণ্ডবনৃত্য শুরু করেছে কিলবিলে অ্যান্টেনা দুটো।
ভয়ে ভয়ে প্রফেসারের দিকে তাকিয়েই অবাক হয়ে গেল উইলিয়াম। নতুন ভেলকি দেখাচ্ছেন প্রফেসার গামা। আধবোজা চোখে পরম নিশ্চিন্ত মনে পাইপ টেনে যাচ্ছেন। কিন্তু এ কী অবস্থা হয়েছে পাইপের? আগুনের আঁচে চেরি ফলের মন লাল হয়ে গেছে পাইপখানা। লাল আভা ছুটে যাচ্ছে সামনের বিকট প্রাণীটার দিকে। দেখতে দেখতে লাল আভা ঘূর্ণির মতো পাক খেতে লাগল ল্যাবরেটরি ডিরেক্টরের ভাসমান বপু ঘিরে। ক্ষিপ্তের মতো ছটফটিয়ে উঠল বিদঘুটে জীবটা। পরমুহূর্তেই ধপাস করে আছড়ে পড়ল হলদে সার্কলের মধ্যে—প্রফেসার গামার পায়ের কাছে। তীব্র ঝলকে চোখ ধাঁধিয়ে গেল ক্ষণিকের জন্যে। পটপট পটাস শব্দে তালা লেগে গেল কানে। বিতিকিচ্ছিরি পোড়া গন্ধে গা পাক দিয়ে উঠল উইলিয়ামের। তারপরেই আর কিছু দেখা গেল না—বাতাসে মিলিয়ে গেল নিষ্প্রাণ বিকট প্রাণী মহাশয়।
তিরিক্ষে গলায় বলে উঠল কিরিল, এত নিষ্ঠুর না হলেই কি চলত না?
আর উপায় ছিল না। ডিরেক্টর সাহেব ভিরোকে খবর পাঠাচ্ছিল অ্যান্টেনা নেড়ে নেড়ে, সাফ জবাব প্রফেসার গামার।
দমাদম গুমগাম শব্দ আরম্ভ হয়ে গেছে চারপাশে। যেন দক্ষযজ্ঞ কাণ্ড চলছে। মহাপ্রলয়ের বুঝি আর দেরি নেই। দরজাগুলো খুলে যাচ্ছে আপনা থেকে—বন্ধও হয়ে যাচ্ছে নিজে নিজে। গোটা ল্যাবরেটরিই যেন অস্থির হয়ে উঠেছে ডিরেক্টরের অকস্মাৎ অক্কা পাওয়ায়। একটা দরজা নিমেষের জন্যে খুলে যেতেই ওপাশে আর-একটা ল্যাবরেটরি দেখতে পেল উইলিয়াম। থরে থরে সাজানো যন্ত্রপাতি।
প্রফেসার, দেখেছেন? চেঁচিয়ে ওঠে উইলিয়াম।
চকিতে দেখে নিলেন প্রফেসার। হেঁকে বললেন, যা, যা তোরা। ওখানেই যা। ভয় নেই… এই দিলাম ধোঁয়ার পাঁচিল তুলে।
কথা শেষ হতে-না হতেই ভসভস করে সাদা ধোঁয়ার মেঘ বেরিয়ে এল পাইপের খোল থেকে। ঘিরে ধরল উইলিয়াম আর কিরিলকে। ধোঁয়ার মধ্যে একেবারে ঢাকা পড়ে গেল দুজনে।
সঙ্গে সঙ্গে ছুট দিল দুজনে নতুন ল্যাবরেটরি ঘরের দিকে। যেতে যেতেই বাবার ওপর ঝাল ঝেড়ে নিল কিরিল, খালি ম্যাজিক আর ম্যাজিক! সব কিছুতেই বাড়াবাড়ি। একদিন ঠ্যালা বুঝবে-খন।
উইলিয়ামের ভয় তখন ভিরো শয়তানকে নিয়ে। বলেও ফেলল ফস করে, ভিরো তো খবর পেয়ে গেছে—এসে গেল বলে।
পৌঁছোনোর আগেই সরে পড়ব, অভয় দেয় কিরিল।
ভিরোকে দেখতে কীরকম জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছে উইলিয়াম, এমন সময়ে হাজির হলেন প্রফেসার গামা। তিনজনেই একসঙ্গে ঢুকল ল্যাবরেটরিতে।
ঢুকেই আর-এক কাণ্ড করলেন প্রফেসার। দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে পাইপটা ঝুলিয়ে দিলেন তালার ওপর।
তারপর বললেন দেঁতো হাসি হেসে, নম্বরি তালা তো, নম্বর গোলমাল করে দিলাম। এখন আর চট করে ঢুকতে পারবে না বাছাধনেরা!
প্রতিষেধক ওষুধটা আগে খোঁজো না, তাড়া লাগায় কিরিল।
আর ঠিক তখুনি কনুইতে কীসের খোঁচা খেতেই মেঝে থেকে প্রায় এক বিঘত লাফিয়ে উঠল উইলিয়াম। সভয়ে তাকিয়ে দেখে পাশেই শূন্যে ভাসছে একটা কালো রঙের ট্রে।
দেখেই সে কী উল্লাস প্রফেসারের—ইনটারেস্টিং! এই তো চাই!
আমি তো ভেবেছিলাম, ভিরো এসে খোঁচা মারছে, মুখটা করুণ করে বলে উইলিয়াম।
কালো ট্রে আবার খোঁচা মারে উইলিয়ামকে। একবার—দুবার—তিনবার। ঠিক যেন ইশারায় ডাকছে—পেছন পেছন যেতে বলছে।
গামাও তাই বললেন, উইলিয়াম, যা-না পেছন পেছন?
হুকুম মাথা পেতে নিল উইলিয়াম। কালো ট্রে-র পেছন ধরতেই গামা আর কিরিলও পেছন নিল তার। দু-সারি বেঞ্চির মাঝখান দিয়ে ভেসে চলেছে কালো ট্রে। কিছু বেঞ্চি যন্ত্রপাতিতে ঠাসা—খানকয়েক একেবারেই খালি।
ঘরের ঠিক মাঝখানে রয়েছে একটা বিরাট মঞ্চ। মঞ্চের ওপর একটা অতিকায় চেয়ার। ঘনঘন পাইপ ফুঁকতে ফুঁকতে মঞ্চে লাফিয়ে উঠলেন প্রফেসার—মঞ্চ থেকে চেয়ারে। বিরাট চেয়ার। ওপরে উঠতেই হিমশিম খেয়ে গেলেন প্রফেসারের মতো লম্বা মানুষও। এত বড়ো চেয়ারে নিশ্চয়, ভিরো একা বসে। তাহলে আকার-আয়তনে সে যে কত বড়ো, ভাবতেই বোঁ করে মাথা ঘুরে যায় বেচারা উইলিয়ামের। চেয়ারে বসবার জায়গা দিয়ে প্রফেসার দিব্যি হাঁটছেন। দু-পাশের দুটো হাতলে দুটো কম্পিউটার যন্ত্র বসানো ছিল। একটা যন্ত্রের সামনে পৌঁছে অনেকগুলো বড়ো বোতাম টিপে দিলেন পটাপট করে। কম্পিউটার কনট্রোল ইউনিট নাড়াচাড়া করার অভ্যেস আছে বলেই দ্বিধা করলেন না একটুও।
বোতাম টেপার সঙ্গে সঙ্গে প্রাণচঞ্চল হয়ে উঠল গোটা ল্যাবরেটরি ঘরখানা। টগবগ করে ফুটে উঠল তরল পদার্থ, ভুড়ভুড় করে বুদ্বুদ উঠে এল ওপরদিকে, বকযন্ত্রগুলোয় শোনা গেল কুলকুচো করার মতো আওয়াজ। দপদপ করে আলো জ্বলে উঠল সব ক-টা অণুবীক্ষণে, গোঁ গোঁ করে চালু হয়ে গেল সেন্ট্রোফিউজ় মেশিন, টিক টক টিক টক শব্দে মুখরিত হল কাউন্টারগুলো। গোটা ঘরখানা যেন আর ল্যাবরেটরি রইল না—হয়ে গেল জাদুকরের গুহা।
চেয়ারের নীচে এত কাণ্ডকারখানার দিকে ভ্রূক্ষেপ নেই প্রফেসার গামার—কম্পিউটার নিয়ে তিনি তন্ময়। প্রোগ্রাম ঠিক করে দিচ্ছেন—যে প্রোগ্রাম অনুসারে কাজকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে যন্ত্রমগজ।
অধীর হয়ে পড়েছে কিরিল। মিনিটকয়েক চুপচাপ থাকার পর চেঁচিয়ে উঠল তারস্বরে, এত সময় লাগছে কেন?
তারস্বরেই জবাব দিলেন প্রফেসার, খড়ের গাদায় ছুঁচ খোঁজার মতো প্রতিষেধক খুঁজছি। রোগটা কী, তা-ই জানি না। প্রতিষেধক কী হবে, জানব কী করে? তাই তদন্ত করে দেখছি, ঠিক কোন জায়গায় হাতড়ালে পাওয়া যাবে আসল দাওয়াই।
সেকেন্ডকয়েক পরেই কিন্তু ল্যাবরেটরির সমস্ত আওয়াজ ছাপিয়ে শোনা গেল একটা গমগমে কণ্ঠস্বর—কোথায় গেল মানুষগুলো?
পরক্ষণেই দুমড়ে গেল ভারী ধাতুর দরজা।
গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে উইলিয়ামের। ঠ্যালার চোটে দরজা ভেঙে পড়বে এখুনি। তাই ককিয়ে ওঠে বিষম উৎকণ্ঠায়, প্রফেসার, পালাই, চলুন।
পালাব কী রে? আগে প্রতিষেধক ওষুধটা খুঁজে বার করি। চেয়ারের ওপরে দাঁড়িয়ে নির্বিকারভাবে জবাব দেন গামা।
তাড়াতাড়ি করো-না। উদ্বেগে ছটফটিয়ে ওঠে কিরিলও।
দরজা ভেঙে পড়ছে—আওয়াজ শুনে নীচের দিকে তাকান প্রফেসার—ওষুধ না খুঁজেই চলে যাব?
কক্ষনো না! চিল্লিয়ে ওঠে উইলিয়াম, দিদির জ্বর সারাতে হবে না?
এই তো চাই, উৎফুল্লস্বরে বলেন প্রফেসার, যতক্ষণ কম্পিউটার আমার কনট্রোলে, ততক্ষণ বাছাধনদের নাকানিচোবানি খাইয়ে ছাড়ব।
গমগমে কণ্ঠস্বরটা এবার যেন বজ্রধ্বনির মতো ফেটে পড়ে দরজার বাইরে—তবে রে মানুষ! নিকুচি করেছে তোদের! দাঁড়া, মজা দেখাচ্ছি এখুনি।
ধাতুর ভারী দরজাটা ভাঙল না বটে, কিন্তু জ্বলজ্বলে লাল হয়ে গেল হুংকার শেষ হতে-না হতেই—তারপরেই কর্কশ সাদা হয়ে গেল পাল্লা—তাকিয়ে থাকা যায় না এত ঝকঝকে সাদা। পরমুহূর্তেই ভয়ানক মড়াত শব্দের সঙ্গে সঙ্গে কপাট মিলিয়ে গেল বাতাসে।
প্রফেসার গামা পাগলের মতো বোতামের পর বোতাম টিপে নির্দেশ দিয়ে চলেছেন চেয়ারের হাতলে লাগানো কম্পিউটারে। দরজা যেখানে ছিল, সেখান দিয়ে ঠিকরে এল রাশি রাশি স্ফুলিঙ্গ। দানবিক রোবটরা যতবার দরজা পেরিয়ে ঢুকতে গেল ল্যাবরেটরি ঘরে, ততবারই স্ফুলিঙ্গবর্ষণে জ্বলজ্বলে ধাতুর পিণ্ড হয়ে গলে পড়ল মেঝের ওপর।
ওদিকে চেয়ারে দাঁড়িয়ে নিজের মনেই বকে চলেছেন প্রফেসার, শক্তি… শক্তি… শক্তি যতক্ষণ আছে, ততক্ষণ আমাদের কাছেও আসতে দেব না ব্যাটাদের!
বেঞ্চির পাশ দিয়ে মুখ বাড়িয়ে ভিরোর চেহারাটা দেখবার অনেক চেষ্টা করে গেল উইলিয়াম, কিন্তু একবারের জন্যেও দেখতে পেল না ভয়-দেখানো ভয়ানককে।
বিদ্যুদ্বেগে কম্পিউটারে আলো নির্দেশ ঢুকিয়ে দিতে দিতে চেয়ারে দাঁড়িয়ে বাজখাঁই গলায় বলে উঠলেন গামা, ভিরোর দাওয়াই ভিরোকেই একটু দেওয়া যাক।
মুহূর্তের মধ্যে কালো ট্রে ধেয়ে গেল ঘরের একদিক থেকে আর-একদিকে—ফিরে এল লাল-সাদা ফুটকি দাগওয়ালা একগাদা বল নিয়ে।
উইলিয়াম জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিল জিনিসগুলো কী, তার আগেই গামার মেজাজি গলা শোনা গেল চেয়ারের ওপর থেকে—সাংঘাতিক লাল ফ্লু-র ভাইরাস। ঠান্ডায় জমে আছে। এখুনি খেল দেখাবে। দেখে যা… দেখে যা… গামার খেল দেখে যা!
সাঁ করে ট্রে পেয়ে গেল দূরের দরজার দিকে—মিলিয়ে গেল লাগোয়া গলিপথে। আর তারপরেই…
আচমকা দরজা দিয়ে ঘরে ঢুকল একটা যন্ত্রদানব। কিন্তু স্ফুলিঙ্গ ঠিকরে গেল না একেবারেই। ফলে, গলেও গেল না ধাতু-দানব। সড়াত করে এসে গেল ঘরের মধ্যে।
আঁতকে উঠলেন প্রফেসার—সর্বনাশ হয়েছে! শক্তির জোগান বন্ধ করে দিয়েছে হারামজাদা ভিরো! টেক্কা মারল, দেখছি!
লুকিয়ে পড়ার আগেই রশ্মিবর্ষণ শুরু করে দিয়েছে মহাকায় যন্ত্রদানব। নানা রঙে রঙিন আলো ধেয়ে যাচ্ছে ঘরের নানা দিকে।
একটুর জন্যে একটা রশ্মির খপ্পর থেকে বেঁচে গেলেন প্রফেসার। ঝপ করে নেমে এলেন চেয়ারের ওপর থেকে নীচে।
বললেন হাঁপাতে হাঁপাতে, সময় আর নেই!
আরও রোবট ঢুকছে ঘরের মধ্যে। রশ্মি-বন্দুক ছাড়াও বাগিয়ে ধরেছে ইলেকট্রন বন্দুক। ঝাঁকে ঝাঁকে বিস্ফোরক ছুটে যাচ্ছে টেবিল, যন্ত্রপাতি, দেওয়াল লক্ষ করে। কলকবজা গুঁড়িয়ে যাচ্ছে, দেওয়াল ফুটো হয়ে যাচ্ছে, টেবিলে আগুন লেগে যাচ্ছে।
আর সাহস নেই কিরিলের। এক লাফে বাবার পাশে গিয়ে বললে রুদ্ধশ্বাসে, চলো, পালাই।
পথ দেখিয়ে নিয়ে গেল ভাসমান ট্রে। অগুনতি বেঞ্চির ফাঁক দিয়ে এঁকেবেঁকে উড়ে চলল কালো ট্রে। পেছনে কখনও গুঁড়ি মেরে, কখনও ছুটে—নাগাল ধরে রইল তিনমূর্তি। দেখতে দেখতে পৌঁছে গেল ল্যাবরেটরির শেষ প্রান্তে।
আচমকা খুব কাছেই গমগমিয়ে উঠল সেই বজ্রনাদ কণ্ঠস্বর—রে রে মানুষের দল! দৌড়ে কি বাঁচতে পারবি? দাঁড়িয়ে যা! দাঁড়িয়ে যা!
সত্যিই তো! পালাবার পথ কই? দেওয়ালে লাগানো একটা বিরাট কাচের প্যানেলের সামনে গিয়ে থমকে রয়েছে কালো ট্রে!
কিন্তু বাহাদুর বটে প্রফেসার! ম্যাজিক পাইপটা শুধু নাড়লেন সুইচের সামনে। অমনি কাচের প্যানেল উঠতে লাগল ওপরদিকে!
পেছন ফিরে তাকিয়ে কিন্তু রক্ত জল হয়ে গেল উইলিয়ামের। কী বীভৎস দৃশ্য! খোলা দরজা দিয়ে গড়িয়ে আসছে একটা সুবিশাল জেলির মতো পিণ্ড—মিশমিশে কালো রঙের। সারা গা থেকে ছিটকে ছিটকে যাচ্ছে স্ফুলিঙ্গের পর স্ফুলিঙ্গ—বিশেষ করে থামের গায়ে ঘষটে গেলেই স্ফুলিঙ্গ ঝরছে বৃষ্টির মতো। দেখতে দেখতে গোটা প্রাণীটাই এসে গেল ল্যাবরেটরির মধ্যে। ধুকপুকে দেহসর্বস্ব কাদার পিণ্ড বলেই মনে হচ্ছে। আঠালো, চটচটে, জঘন্য। আচমকা চোখের পলক ফেলতে চেহারা পালটে গেল কদাকার পিণ্ডটার। মুহূর্তের মধ্যে সরু, লম্বা, খাড়া হয়ে গিয়েই নিমেষে মেঝে জুড়ে ছড়িয়ে পড়ল ঘরময়।
গুঙিয়ে ওঠে উইলিয়াম, এ কে?… এ কে?… এ কে?
জবাব দিল না কেউই। বড়ো বড়ো চোখে প্রত্যেকেই তাকিয়ে বিশ্বের পুঞ্জীভূত বিভীষিকাটার দিকে। কালো পিণ্ডের ওপর সহসা আবির্ভূত হয়েছে একটা বিরাট লাল বল। খুদে খুদে হলদে আলোর কণা চোখের মতো জ্বলজ্বল করছে লাল গোলকে। শোনা যাচ্ছে হাড়-হিম-করা দাঁত কড়মড়ানির শব্দ। ঠিক যেন পাথর চিবিয়ে গুঁড়ো করছে ক্রূর কুটিল জিঘাংসা নিষ্ঠুর কোনো দৈত্য।
কাচের প্যানেল তখনও উঠছে ওপরের দিকে। ওদিকে দাঁড়ানোর জায়গায় কিরিল আর উইলিয়ামকে টেনে নিয়ে গিয়ে শান্তস্বরে বললেন গামা, ওই হল ভিরো! পয়লা নম্বর শয়তান!
বলেই, পাইপ নেড়ে চালু করে দিলেন কলকবজা। সঙ্গে সঙ্গে নীচের দিকে নামতে লাগল কাচের প্যানেল। খুব আস্তে আস্তে। নীচের দিক থেকে বাতাসের স্রোত এসে বেগে উঠে যাচ্ছে ওপরদিকে। বিলক্ষণ টের পাচ্ছে উইলিয়াম। প্যান্টে বাতাস ঢোকায় প্যান্ট ফুলে উঠেছে বেলুনের মতো। উড়ছে জামাকাপড়। ওপরদিকে তাকিয়ে দেখল, কুয়োর মতো খাড়া গর্ত সটান উঠে গেছে অনেক উঁচুতে। অত উঁচুতে খাড়াই গর্তের গা বেয়ে উঠবে কী করে?
কাচের প্যানেলের মধ্যে দিয়ে দেখা যাচ্ছে, বিশাল কালো পিণ্ডটা মেঝের ওপর দিয়ে গড়িয়ে ছড়িয়ে যাচ্ছে নানা দিকে। আগুনের মতো লাল মাথাটা ক্ষিপ্তের মতো বাঁইবাঁই করে ঘুরছে আর খুঁজছে মানুষ তিনজনকে, বেঞ্চির ফাঁক দিয়ে, তলা দিয়ে চুইয়ে চুইয়ে আসছে থকথকে পাঁকের মতো কুৎসিত সেই প্রাণী—নাম যার ভিরো!
হেঁড়ে গলায় হুংকারও দিয়ে যাচ্ছে থেকে থেকে, পালাবি? কোথায় পালাবি? রেহাই নেই… রেহাই নেই তোদের।
কাচের পাল্লা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে তিন মানুষের সামনে। দাঁড়িয়ে ছিল যেখানে, সেখানে নীচ থেকে উঠে-আসা বাতাসের প্রবাহও বেড়ে চলেছে। শোঁ শোঁ শব্দে বাতাস উঠে যাচ্ছে ওপরদিকে।
ঠিক এমনি সময়ে গাঁক করে চেঁচিয়ে উঠলেন গামা, ট্রে!
আচমকা চ্যাঁচানিতে চমকে লাফিয়ে উঠেছিল উইলিয়াম। তারপরেই দেখতে পেল, কাচের প্যানেলের বাইরে শূন্যে ভাসছে কালো ট্রে। ওপরে রয়েছে একটা ছোট্ট নীল গোলক।
চিলের মতো চেঁচিয়ে ওঠে কিরিল, প্রতিষেধক ওষুধ! খুঁজে দিয়েছে কম্পিউটার!
টুক করে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে উইলিয়াম। কাচের প্যানেল তখন একদম মেঝের কাছ বরাবর চলে এসেছে। সামান্য ফাঁকটুকুর মধ্যে দিয়ে হাত গলিয়ে নীল গোলকসুদ্ধ কালো ট্রেখানা খামচে ধরে টেনে নেয় ভেতরে। জেলির মতো ভিরোর থকথকে দেহের অংশ ঠিক সেই সময়ে আছড়ে পড়ল কাচের প্যানেলের ওপর—কাচ না থাকলে উইলিয়ামের মুখেই আছড়ে পড়ত ঝপাস করে। সভয়ে সেদিকে তাকাতেই একটা উড়ন্ত লাল ফ্লু-র জীবাণু সেঁটে গেল ওর হাতে।
যন্ত্রণায় কাতরে উঠেছিল উইলিয়াম। সঙ্গে সঙ্গে কিন্তু খাড়া হয়ে গেল কালো ট্রে। হাত থেকে চেঁচে ফেলে দিল কদম ফুলের মতো কাঁটা-কাঁটা জীবাণুটাকে। নিষ্প্রাণ দেহে মেঝেতে খসে পড়ল লাল আতঙ্ক।
আর ঠিক তখুনি ক্লিক করে কাচের প্যানেল সেঁটে গেল মেঝের সঙ্গে। ভিরো হুড়মুড়িয়ে ঢুকতে গিয়েছিল ভেতরে—প্যানেল মেঝেতে সেঁটে যাওয়ায় সে সুযোগ আর পেল না। একচুলের জন্যে বেঁচে গেল মানুষ তিনজন।
কিন্তু ভিরো তার বিশাল দেহ নিয়ে লেপে রইল পুরো কাচের প্যানেলে। আলো পর্যন্ত আর আসছে না। ভেতরে নিঃসীম অন্ধকার। কিন্তু তার মধ্যেই হুহু করে বেড়ে উঠল বাতাসের স্রোত—যে স্রোতকে জাগিয়ে দিয়েছে গামার আশ্চর্য পাইপ—উদ্দাম উত্তাল প্রবল বায়ুপ্রবাহ নিমেষের মধ্যে তিনজনকে টেনে নিয়ে গেল ওপরদিকে—এনে ফেলল মৃত্যুগ্রহের ওপর। পরমুহূর্তে এনার্জির এক ধাক্কায় তিনজনেই ঠিকরে গেল বাড়ি ফেরার পথে।
পাঁজর-খালি-করা নিশ্বাস ফেলে বললে উইলিয়াম, আঃ! বাঁচা গেল!
দেখতে দেখতে মৃত্যুগ্ৰহ ছাড়িয়ে অনেক দূরে চলে এল তিনজনে। হাসছেন প্রফেসার। হেসে হেসে বলছেন, ছুটি কাটল ভালোই—তা-ই না রে?
ব্যাজার মুখে জবাব দিতে যাচ্ছে কিরিল, এমন সময়ে চোখ ঠিকরে যাওয়ার উপক্রম হল পেছনে, বহু দূরে একটা বিশাল কালো পিণ্ডকে তীব্রবেগে ধেয়ে আসতে দেখে। পরের মুহূর্তেই নীল বিদ্যুৎশিখা লকলকিয়ে ধেয়ে গেল তিনজনের আশপাশ দিয়ে। কানে ভেসে এল ভিরোর মেঘমন্দ্র হুংকার—রে রে মানুষ। জ্যান্ত ঝলসে মারব তোদের!
কিন্তু রাখে কেষ্ট, মারে কে! আচমকা যেন একটা নিরেট দেওয়ালের ওপর আছড়ে পড়ল তিনজনে। ফলে, যে পথে ধেয়ে যাচ্ছিল তিন পলাতক, ঠিকরে গেল সেই পথ থেকে। সামনেই দেখতে পেল অগ্নিময় বিশালকায় একটা নক্ষত্র। অত্যুজ্জ্বল তারকা! চোখে ধাঁধা লেগে যাচ্ছে—এত গনগনে।
সামাল সবাই! ফিশফিশ করে বললেন প্রফেসার।
জ্বলজ্বলে নক্ষত্রের আগুনের তাপ আর সহ্য হচ্ছে না। গায়ে বুঝি ছ্যাঁকা লেগে গেল। চামড়া বুঝি ঝলসে গেল। মনে হচ্ছে, নাকে চামড়া-পোড়া গন্ধও ভেসে আসছে।
প্রফেসার গামার ম্যাজিক দেখা গেল ভয়ংকর এই মুহূর্তে। আচমকা বিনা নোটিশে তিনজনের দেহে সাঁত করে ঢুকে পড়ল ফাঁদলের মতো সরু একটা কিছুর মধ্যে। ছুঁচের মতো সরু হয়ে গেল তিন-তিনটে দেহ। আর তারপরই সরু দেহগুলো নব্বই ডিগ্রি কোণ করে বেঁকে গেল মাঝখান থেকে—ঠিক যেন রাস্তার মোড় ঘুরছে উইলিয়ামরা সরু লম্বা দেহ নিয়ে।
ধকলটা কম নয়। কিন্তু অবসান ঘটল এহেন যন্ত্রণাদায়ক অবস্থার একগাদা বোমার মতো স্ফুলিঙ্গ আবির্ভূত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে। দুমদাম করে ফাটতে ফাটতে স্ফুলিঙ্গগুলো ধেয়ে গেল ভিরোর দিকে।
হৃষ্টকণ্ঠে অমনি বলে উঠলেন প্রফেসার, কিছুক্ষণ আটকে রেখে দেওয়া যাবে হারামজাদাকে।
বিকট আর্তনাদ ভেসে এল দূর থেকে। ভিরো চ্যাঁচাচ্ছে। ঘাড় ফিরিয়ে দেখল উইলিয়াম, একটা সরু লম্বা কালো ছুঁচের মতো বস্তু ভীষণ বেগে ছড়িয়ে পড়ছে মহাশূন্যের বুকে। আচমকা উধাও হয়ে গেল বস্তুটা—আর দেখা গেল না।
আর ঠিক সেই সময়ে একটা এনার্জি-ফিল্ডের ওপর আছড়ে পড়ল তিনজনে। আজব এই এনার্জি-ক্ষেত্র, এক জায়গায় থাকে না কখনোই। মুহূর্তে মুহূর্তে জায়গা পালটাচ্ছে। ঠিক যেন একটা ধাবমান পাহাড়—ধেয়ে যাচ্ছে মহাশূন্যের বুক চিরে। বিচিত্র এই এনার্জি-ক্ষেত্র ভেদ করে তিন মূর্তিমান নিমেষে ঠিকরে এল বাড়ি ফেরার সহজ পথে। মসৃণ গতিবেগে ধেয়ে চলল পৃথিবীর দিকে।
খুশি-উচ্ছল গলায় বলে ওঠে উইলিয়াম, কিন্তু ভিরোর কী অবস্থা করলেন প্রফেসার?
অট্টহেসে বললেন প্রফেসার, ভিরো এখন ব্রহ্মাণ্ডের অন্যদিকে। আমাদেরও ওই অবস্থা হত। হঠাৎ মনে পড়ে গেল মোড়টার কথা। তাই বাঁচিয়ে নিলাম নিজেদের, কিন্তু রেহাই পেল না ভিরো। মরুক ব্যাটা—ঘুরে মরুক অনন্ত ব্রহ্মাণ্ডে।
পৃথিবী থেকে যেতে যত সময় লেগেছিল, তার অনেক কম সময়ের মধ্যে ফিরে এল তিনজনে। নামল সেই একই জায়গায়—মাঠের মধ্যে টিলার চুঁড়োয়। যে গর্তটা সৃষ্টি করে গিয়েছিল রওনা হওয়ার সময়ে, এখন তা মাটি দিয়ে বুজিয়ে দেওয়া হয়েছে। ঘাস গজিয়েছে মাটিতে। তবে শুধু গর্তের ওপরকার ঘাসের রংটা পালটে গেছে। সবুজ নয়—নীল ঘাস।
বৃষ্টি পড়ছে অঝোরে। হন্তদন্ত হয়ে টিলা থেকে নেমে বনের মধ্যে গাছতলায় পৌঁছোতে পৌঁছোতেই ভিজে গেল তিন দুঃসাহসী? তখনই খেয়াল হল কিরিলের—কালো ট্রেখানা পড়ে রয়েছে টিলার চুড়োয়।
দৌড়োল উইলিয়াম তৎক্ষণাৎ। ভিজে চুপসে টিলার চুড়োয় গিয়ে দেখলে ক্ষতবিক্ষত ফুটোফাটা অবস্থায়, নীল ঘাসের ওপর পড়ে রয়েছে কালো ট্রে—ওপরে জ্বলজ্বল করছে নীল গোলকটা।
ট্রে হাতে নিয়ে দৌড়ে গাছতলায় ফিরে এল উইলিয়াম। ছিনিয়ে নিলেন প্রফেসার—বেচারা! এক্কেবারে ঝাঁজরা হয়ে গেছে। ঠিক আছে… রোদে শুকিয়ে নিলেই আবার তেজ ফিরে পাবে। এনার্জি দরকার… রোদ্দুর থেকে টেনে নেবে এনার্জি। চল রে, বাড়ি ফেরা যাক।
বনের মধ্যে দিয়ে ‘পিলে-চমকানো’ ভবনে ফিরে এল তিনজনে।
বাড়ি ঢুকেই জিজ্ঞেস করে উইলিয়াম, প্রফেসার, প্রতিষেধক ওষুধে এখন কাজ হবে তো?
নিশ্চয় হবে, রান্নাঘরে ঢুকতে ঢুকতে বললেন প্রফেসার। আর ঠিক তখনই উইলিয়ামের খেয়াল হল, বাড়িতে ঢুকেছে সামনের দরজা দিয়ে—কিন্তু দরজাটা যে ঠিক কোথায়, তা টের পায়নি! রহস্যময় সদর দরজা কি চিরকালই রহস্যে ঢাকা থাকবে?
বাঁ হাতে নীল গোলকটা তুলে ধরলেন প্রফেসার। চোখ বড়ো বড়ো করে চেয়ে রইলেন চারখানা আঙুলের দিকে।
মাঝের আঙুলটার খানিকটা নেই।
বললেন ভুরু কুঁচকে, সকালবেলায় আঙুলটাকে দেখেছিলাম, মনে হচ্ছে?
খেয়ালই নেই আঙুল ছিল কি না! পথের ধকলে আর কারও কিছু হয়নি—প্রফেসার গামাই কেবল একটা আঙুল খুইয়ে এসেছেন!
বিড়বিড় করে বললেন আপন মনে, নিশ্চয় ভিরোর সঙ্গে ব্রহ্মাণ্ড পর্যটনে বেরিয়েছে বেচারা আঙুল। আঙুল বলে কথা—আর কী করে ফিরে পাব?
হেসে ফেলে কিরিল—অত দুঃখ কোরো না বাবা। নতুন আঙুল তোমাকে এনে দেব-খন।
ঠিক, ঠিক। নতুন আঙুল ঠিক পেয়ে যাব। তার আগে প্রতিষেধক ওষুধটাকে পাঠানো যাক মেডিক্যাল রিসার্চ কাউন্সিলে—এখুনি।
ঘড়ির দিকে তাকায় উইলিয়াম, সওয়া একটা বাজে। খাবার সময় হল। বেরিয়ে পড়ে বাড়ি থেকে। বাগানের শেষ অবধি যেতেই শুনল, কিরিল ডাকছে পেছন থেকে।
ঘুরে দাঁড়াতেই দৌড়ে এল কিরিল। হাতে গুঁজে দিল কালো ট্রে আর একটা পকেট ক্যালকুলেটর—নিয়ে যা।
কেন?
ট্রেখানাকে চালাবি না? এইটাই তো কনট্রোল ইউনিট। ঠিকমতো টেপাটেপি করলে দেখবি, তোর হুকুম মানছে।
এতক্ষণে ট্রে রহস্য বুঝতে পারল উইলিয়াম। ধুরন্ধর প্রফেসার এই অস্ত্র দিয়েই কালো ট্রে-কে খাটিয়ে মেরেছেন।
বাড়ির দিকে দৌড়োতে দৌড়োতে বললে কিরিল, যা পালা! দিদি সেরে যাবে—আর ভয় নেই।
ট্রে বগলে নিয়ে আর ক্যালকুলেটর পকেটে পুরে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে বাড়ি ফেরে উইলিয়াম?
সামনেই মা। ধমকে ওঠেন ভিজে-চুপসোনো চেহারা দেখে, এ কী! চুলের এরকম অবস্থা হল কী করে?
মাথায় হাত দিয়ে চমকে ওঠে উইলিয়াম। চুল আছে ঠিকই, কিন্তু লেপটে রয়েছে আঠার মতো।
গজগজ করতে থাকেন মা, কী দুষ্টু! কী দুষ্টু! যা, ওপরে যা। ভিজে জামাকাপড় পালটে নে।
ভাগ্যিস মা আর জেরা করেননি। তরতরিয়ে ওপরতলায় উঠে যায় উইলিয়াম। শোবার ঘরে ঢুকে কালো ট্রে আর কনট্রোল ইউনিটটাকে লুকিয়ে রাখে বালিশের তলায়। তারপর গিয়ে দাঁড়ায় আয়নার সামনে চুলের চেহারা দেখতে। রং ঠিক আছে। লম্বাতেও ঠিক আছে। শুধু যা সব ক-টা চুল গায়ে গায়ে জুড়ে গেছে। বুরুশ দিয়ে বা চিরুনি দিয়েও আলাদা করা যাবে না।
কেন এমন হল?
নিশ্চয় রোবটদের ইলেকট্রন বন্দুকের এনার্জি মাথা ঘষটে গেছে। চুলগুলোকে সেঁটে দিয়েছে প্রচণ্ড শক্তি দিয়ে!
পরের দিন সকালে ডাক্তার এসে জানালেন, ফরাসি অগ অসুখটার আশ্চর্য একটা দাওয়াই পাওয়া গেছে লন্ডন শহরে।
শুনে তো বেজায় খুশি উইলিয়ামের বাবা আর মা। ছেলের চুলের হাল এরকম হল কেন, তা নিয়ে ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলতেও ভুলে গেলেন।
বিকেল হতেই গ্রামের নাপিতের কাছে গিয়ে কদমছাঁট দিয়ে এল উইলিয়াম। জঘন্য চুল ছাঁটা দেখে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন মা আর বাবা। কিন্তু…।
তিন দিন পরেই জ্বরে পড়ল ছেলে। ডাক্তার প্রথমে ভেবেছিলেন বুঝি রোগটা ফরাসি অগ। তারপর অবশ্য গলার লালায় তুলো ভিজিয়ে নিয়ে ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা করার পর জানা গেল, লাল ফ্লু কাহিল করেছে উইলিয়ামকে।
অবাক হলেন প্রত্যেকেই। চোখ কপালে তুলে ডাক্তার বলেন, গত বিশ বছরে লাল ফ্লু কারও হয়নি। এ রোগ কোত্থেকে জোটাল, ভেবে পাচ্ছি না।
মুখে থার্মোমিটার লাগিয়ে মিটিমিটি হাসতে থাকে উইলিয়াম। মুখ লাল হয়ে গেছে জ্বরের দাপটে। রোগের কারণটা তো নিশ্চিহ্ন হতেই চিহ্ন ফেলে গেছে। লাল ফ্লু-র জীবাণু হাতের যেখানে আটকে গিয়েছিল—এখনও লাল দাগ রয়েছে সেখানে।
অবশ্য দাগ দেখে ডাক্তারও বুঝতে পারতেন না, এ রোগ এল কোত্থেকে!
Tags: অদ্রীশ বর্ধন, নবম বর্ষ প্রথম সংখ্যা, ফ্রেড ও জিওফ্রে হয়েল