অকাল তমসা (অন্তিম পর্ব)
লেখক: সৌমেন চট্টোপাধ্যায়
শিল্পী: রূপক ঘোষ
[প্রথম পর্ব পড়বার জন্য এখানে ক্লিক করুন]
[দ্বিতীয় পর্ব পড়বার জন্যে এখানে ক্লিক করুন]
পর্ব-৩
মানবসভ্যতার ইতিহাস সম্পর্কে আমি যা যা পড়লাম এখনকার যেকোনো তথাকথিত পণ্ডিতের মাথা ঘুরিয়ে দেবার পক্ষে যথেষ্ট। বেশিরভাগই হায়ারোগ্লিফিকে লেখা থাকলেও আমি সেগুলো বুঝতে পেরেছিলাম ড্রোনিং মেশিনের সাহায্যে। তবে অন্যান্য বেশ কিছু খণ্ড এমন বিটকেল ভাষায় লেখা ছিল, হাজার চেষ্টা করেও প্রথমে সেগুলো উদ্ধার করতে পারিনি। পরে এগুলো পড়তেও কাজে লাগাই ড্রোনিং মেশিন। তবে জেগে ওঠার পর খুব ঝাপসা ভাবে এই স্মৃতিগুলো আমার মনে থাকত। এই উন্নত জাতি কিভাবে সময়কে জয় করেছে সেটা ভেবে খুব অবাক লাগতো। তার থেকেও বেশি অবাক হতাম এটা ভেবে বর্তমান সময় থেকে আমার চিন্তনকে সরিয়ে আনার পাশাপাশি ঠিক একই সময়ে কেউ ব্যবহার করে চলেছে আমার শরীর। শুধু তাই নয়, বৃহস্পতি, শুক্রর মত গ্রহ থেকেও ঈথরা চিন্তনশক্তি সংগ্রহ করেছিল। আমাদের এই পৃথিবীর চিন্তনশক্তির মধ্যে ছিল অ্যান্টার্কটিকার ডানাওলা, তারার মত মুণ্ডু-ওলা আধা উদ্ভিদ প্যালিওজিয়ন প্রজাতি, ভ্যালুসিয়ার সরীসৃপ প্রজাতি, এমনকি প্রাক-মানবসভ্যতার সাতগুয়ার রোমশ জাতির গোটা চারেক নমুনা, বিবর্তনের শেষ পর্যায়ের মাকড়শা প্রজাতি আর ভয়ানক চো চো প্রজাতির নমুনাও ছিল।
এই সময় পাঁচ হাজার খ্রিস্টাব্দের এক দার্শনিক ইয়াং লির চিন্তনের সাথে কথা বলেছিলাম। কথা বলেছিলাম ষোলো হাজার খ্রিস্টাব্দের এক জাদুকর নাগসোথের সাথেও। এবং এদের সাথে কথা বলে আমি অতীতের বহু সমাধান না হওয়া রহস্যের আর ভবিষ্যতের বহু আসন্ন বিপর্যয় ও ঘটনার কথা জানতে পেরেছিলাম।
এইসব স্বপ্নচারণের পর প্রত্যেকদিন সকালে আমার যখন ঘুম ভাঙত দেখতাম জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও স্বপ্ন থেকে পাওয়া ইতিহাস ও বিজ্ঞান নিয়ে এইসব নানারকম তথ্য নিয়ে আমি গবেষণা শুরু করে দিতাম এবং আরও অনেক নতুন নতুন তথ্য পেতাম। এখনকার বহু বিষয়, মানে যেগুলো নিয়ে অনেকের সন্দেহ আছে, স্বপ্নের মাধ্যমে তা অনায়াসে সমাধান করে দিতাম। টের পেতাম অতীতের এমন অনেক সত্য গোপন ছিল যা প্রকাশ পেলে সমগ্র মানবজাতি এক ভয়ানক বিপর্যয়ের মুখোমুখি হবে। মানবসভ্যতার পরে পৃথিবীর বুকে সৃষ্টি হবে কীট-সভ্যতার। যারা শাসন করবে গোটা দুনিয়া। এবং অবশ্যই ঈথরা শাসন করবে গোটা ব্রহ্মাণ্ডকে। চিন্তন মনন আদানপ্রদানের খেলা অবশ্য চলতেই থাকবে। ঈথীয়ান লাইব্রেরীর যাবতীয় তথ্য নথিভুক্ত করা হত শক্ত সেলুলোজ জাতীয় কাপড়ে। হাতে লেখা আর ছাপানো দুরকমই থাকত বই আকারে বাঁধাই অবস্থায়। বলা বাহুল্য এই স্বপ্নগুলো কখনোই আমাকে দৈনন্দিন জীবনের ছবি দেখায়নি। ঈথীয়ান দুনিয়ায় আমি এতরকম প্রাণী আর প্রজাতি দেখেছিলাম, যে সবার কথা বলতে গেলে খণ্ডের পর খণ্ড লেখা হয়ে যাবে। খুব সম্ভবত আমি স্বপ্নে যে যুগের কার্যাবলী দেখতাম তা ছিল ১৫ কোটি বছরেরও আগেকার সময়ের- যখন পেলোজোয়িক যুগ শেষ হয়ে মেসোজোয়িক যুগ শুরু হতে যাচ্ছে।
এই সময় ঈথরা প্রায় মানুষের মতোই দেখতে এক ধরনের প্রাণীর শরীর দখল করেছিল। এই প্রাণীগুলো ঠিক কি পর্যায়ের বলতে পারব না, কারণ প্রচলিত বৈজ্ঞানিক ধারণার ভিত্তিতে এদের সম্পর্কে বলা সম্ভব নয়। ঈথদের কোষের গঠন ছিল অদ্ভুত আর অভিনব। এবং এই কোষের গঠনের জন্যই তারা কখনো ক্লান্ত হত না। তাই ঘুমেরও দরকার হত না। যাবতীয় পৌষ্টিক কার্যাবলী চালাত ওই শুঁড়ের মত উপাঙ্গ দিয়েই। আমাদের পরিচিত অনুভূতির মধ্যে মাত্র দুটি এদের মধ্যে বিদ্যমান ছিল- দেখা আর শোনা। শোনার কাজ চালাত মাথার ওপরে থাকা ফুলের মত ধুসর রঙের অংশ দিয়ে আর দেখার কাজ চালাত কুঁতকুতে তিনখানা চোখ দিয়ে। এদের রক্ত ছিল থকথকে সবুজ রঙের। ঈথদের মধ্যে কোনরকম যৌন-ক্রিয়া না থাকলেও প্রজননের কাজ তারা চালাত বীজ বা দেহের নীচের দিকে থাকা এককোষী যৌন জননাঙ্গ দিয়ে। অগভীর জলাশয়ে চলত সদ্যজাতদের বেড়ে ওঠার প্রক্রিয়া। ঈথরা ছিল যথেষ্ট দীর্ঘায়ু। কমকরে চার থেকে পাঁচ হাজার বছর ছিল এদের আয়ু। যেহেতু ঈথদের স্পর্শক্ষমতা বা যন্ত্রণাবোধ ছিল না, তাই সদ্যজাতদের মধ্যে কারোর কোন খুঁত থাকলে তা ঈথরা চোখে দেখলেই বুঝে যেত। মৃত্যুর পর মৃতদের শরীর পুড়িয়ে ফেলা হত। ঈথদের হাতে বন্দী হওয়া কেউ কেউ ভবিষ্যৎ দেখতে পাওয়ার ফলেই কখনও কখনও আসন্ন মৃত্যুকে এড়াবার জন্য পালাতে সক্ষম হলেও এই ধরনের ঘটনা প্রায় ঘটত না বললেই চলে। ঈথরা মিলিত হয়ে যে সমাজ গড়ে তুলেছিল, তাতে একনায়কতন্ত্রের প্রভাব লক্ষণীয় ছিল। বিজ্ঞান আর প্রযুক্তি যে উচ্চতায় তারা নিয়ে গিয়েছিল তা ধারনার বাইরে।
স্বপ্নচারণ আর জেগে উঠে যেটুকু মাথায় থাকতো সেগুলো নিয়ে সাতপাঁচ ভাবা এই ভাবেই চলছিল। আমার দুঃস্বপ্নের শেষ হত আমার চিৎকার দিয়ে। এগুলো আমার রোজনামচা হয়ে গিয়েছিল। মাঝে মাঝে একইরকম বিভিন্ন কেস নিয়ে অনুসন্ধান চালাতাম। ১৯২২ সালে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এলেও ওই অপার্থিব আতঙ্ককে অতিক্রম করা ছিল আমার সাধ্যের বাইরে। হয়তো এইভাবেই চলত, তারপর একদিন সমস্ত হিসেব গেল গুলিয়ে।
১৯৩৪ সালের ১০ই জুলাই আমার হাতে এলো সুদূর অস্ট্রেলিয়ার পিলবারা থেকে পাঠানো একটা চিঠি আর তার সাথে কিছু ফটোগ্রাফ আর কাগজপত্র। আর এই চিঠিটাই আমার সামনে তুলে ধরল সেই নারকীয় রহস্য উন্মোচনের এক অভাবনীয় সুযোগ। বেশি কিছু না বলে সরাসরি সেই চিঠির বয়ান হুবহু তুলে দিলাম:
অধ্যাপক ন্যাথানিয়েল উইনগেট পিসলি, ৪৯, ডাম্পিয়ের স্ট্রীট,
প্রযত্নে, মনোবিজ্ঞান বিভাগ পিলবারা, পশ্চিম অস্ট্রেলিয়া,
৩০ই. ৪১ স্ট্রীট, ১৮ই মে, ১৯৩৪
নিউইয়র্ক সিটি, ইউ.এস.এ
মাননীয়েষু,
প্রথমেই জানিয়ে রাখা ভাল যে আপনার সাথে আমার সরাসরি কোন পরিচয় নেই। কিছুদিন আগে পার্থ-এর নিবাসী ডঃ ই.এম.বয়েলের সাথে আমার বিভিন্ন বিষয়ে কথা হচ্ছিল, তা কথা প্রসঙ্গে আপনার কথা অর্থাৎ আপনার ঐ দ্বৈত স্বত্বা নিয়ে কাগজে বিভিন্ন লেখালিখির কথা তিনি আমাকে বলেন। তিনি আমাকে এও জানান যে আপনি আপনার স্বপ্ন নিয়ে বিভিন্ন নিবন্ধ লিখেছেন। এই বিষয়ে আমি আগ্রহ প্রকাশ করায় তিনি আমাকে বলেন যে ডাকযোগে তিনি আমাকে সেগুলো পাঠাবার ব্যবস্থা করতে পারেন। তা কদিন আগে তিনি আপনার লেখা বিভিন্ন নিবন্ধ, কিছু কাগজ ও ছবি আমাকে ডাকযোগে পাঠান। এই প্রসঙ্গে বলে রাখা ভাল যে আমি পেশায় একজন ইঞ্জিনিয়ার আর সরকারি খনি বিভাগের সাথে জড়িত। আপনি হয়ত শুনলে অবাক ও আশ্বস্ত হবেন যে আপনার স্বপ্নে দেখা বিভিন্ন জ্যামিতিক আঁকিবুঁকি আর অদ্ভুত ওইসব বিরাট পাথরের চাঁইয়ের কিছু নমুনা আমিও দেখেছি।
কিভাবে দেখলাম এবার সেই কথা বলি। বছর দুয়েক আগে সোনার খনির কাজে আমাকে যেতে হয়েছিল অস্ট্রেলিয়ার মরুভূমিতে। তা কাজের জন্য সেখানকার আদিবাসীদের সাহায্য নিতেই হয়। এই আদিবাসীদের মুখেই প্রথম শুনি নানারকম অদ্ভুত প্রচলিত কিংবদন্তীর কথা। যার মধ্যে একটা ছিল এক অজানা প্রাচীন শহরের কথা। যেখানে নাকি ওইরকম পেল্লায় পাথরের চাঁই দেখা যায়, যেগুলোর গায়ে থাকে অদ্ভুত নকশা আর আপনার বর্ণনার সেই সব হায়ারোগ্লিফ। স্থানীয় এইসব আদিবাসীরা যে কুসংস্কার-গ্রস্ত হবে তা বলাই বাহুল্য, কিন্তু যেটা দেখলাম এই কিংবদন্তী নিয়ে তাদের মধ্যে এক অজানা চাপা আতঙ্ক। তারা আবার আরও এক ধাপ এগিয়ে এর সাথে নিজেদের কিছু চালু উপকথাকেও মিলিয়ে নিয়েছে। যেমন বুদ্দাই নামে এক বিশালাকার বৃদ্ধ, যে কিনা যুগযুগ ধরে নিজের হাতের ওপর মাথা রেখে ঘুমিয়ে আছে। যেদিন সে জেগে উঠবে তার আগ্রাসী খিদে নিয়ে খেয়ে ফেলবে গোটা দুনিয়াকে। আর যেখানে সে ঘুমিয়ে আছে তার আশেপাশেই দেখা যায় ওইসব রাক্ষুসে পাথরের চাঁই।
এই পাথরগুলো নাকি যেখানে আছে, তার নীচেই আছে এক ভয়ংকর দুনিয়া। যার বিস্তার কতদূর তা কেউ জানে না। এই দুনিয়া কতটা ভয়াবহ তা এই আদিবাসীদের কাছে অজানা হলেও এর প্রসঙ্গ উঠলেই তারা ভয়ে কুঁকড়ে যায়। কারণ তারা নাকি শুনেছে বহুযুগ আগে কিছু সৈন্য যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে গিয়ে আশ্রয় নেয় এইরকমই এক সুড়ঙ্গের ভেতর আর এরপর তারা কেউই আর ফিরে আসে নি। কিন্তু তাদের আশ্রয় নেবার পর থেকেই ওই জায়গা দিয়ে বইতে শুরু করে ভয়ানক ঝোড়ো বাতাস। আমি এদের এইসব আষাঢ়ে গপ্পে তেমন পাত্তা না দিলেও আমার মনে গেঁথে আছে বছর দুয়েক আগের সেই স্মৃতি।
বছর দুয়েক আগে এই মরুভূমিরই ৫০০ মাইল পূর্বে আমি এরকমই কিছু রাক্ষুসে পাথরের চাঁই দেখেছিলাম। প্রায় ১২ ফুট লম্বা এই চাঁইগুলো মাটিতে পোঁতা ছিল। প্রথমে কিন্তু আমি এগুলোর গায়ে কোন চিহ্ন দেখতে পাইনি, কিন্তু একটু কাছে গিয়ে ভালভাবে দেখার পর এর গায়ে গভীরভাবে খোদাই করা অদ্ভুত কিছু আঁকাবাঁকা রেখা দেখতে পাই, ঠিক যেমনটি ওই আদিবাসীরা তাদের আষাঢ়ে গপ্পে বলেছিল। কেন জানিনা আমার মনে হল মাইল-খানেকের মধ্যে এরকম আরও ৩০- ৪০ টা পাথরের চাঁই পোঁতা থাকলেও থাকতে পারে। আমার যন্ত্রপাতির সাহায্যে একটু খোঁজার পর দেখলাম ঠিক তাই। খুঁজে পেলাম এরকম আরও কয়েকটা চাঁই। এবং সেগুলোর কাছে গিয়ে ভাল করে পরীক্ষা করলাম। এবং আশ্বস্ত হবার পর দশ বারোটা ছবিও তুললাম। ছবিগুলো এই চিঠির সাথেই আপনাকে পাঠিয়েছি। এর আগে অবশ্য আমি এই চিঠি আর তথ্যগুলো পার্থের সরকারি বিভাগেও পাঠিয়েছিলাম, কিন্তু তারা এগুলোতে কোন পাত্তাই দেয়নি। এর পর আমার সাথে আলাপ হয় ডঃ বয়েলের। এই ডঃ বয়েল আমেরিকান সাইকোলজিক্যাল সোসাইটির জার্নালে আপনার নিবদ্ধগুলো পড়েছিলেন। আমি তাঁকে এই পাথরের চাঁইগুলোর কথা বলতেই তিনি প্রচণ্ড উৎসাহিত হয়ে পড়েন। আমি তাঁকে এও জানাই যে এই পাথর আর এর গায়ে আঁকা নকশাগুলোর সাথে আপনার স্বপ্নে দেখা নকশাগুলোর যথেষ্ট মিল আছে। সাথে আমি তাঁকে আমার তোলা ছবিগুলোও দেখাই। এর পরেই তিনি আমাকে বলেন অবিলম্বে আপনার সাথে চিঠিতে যোগাযোগ করার জন্য। আমার এই চিঠিটা পাঠাতে একটু দেরী হল কারণ ইতিমধ্যে ডঃ বয়েল আমাকে বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত আপনার প্রায় সব প্রবন্ধ নিবন্ধ আমাকে পাঠান, আমি আরও একবার সমস্ত আঁকা আর বর্ণনাগুলো ভালভাবে মিলিয়ে নিলাম এবং দেখলাম ঠিক যেমনটি আপনি বলেছেন আমার এই ছবিগুলোও সেইরকমই। এবং ওই পত্রপত্রিকার কপি আর যাবতীয় তথ্য ইত্যাদিও চিঠির সাথে পাঠালাম। বাকিটা নাহয় ডঃ বয়েলের থেকে সরাসরি সাক্ষাতেই শুনে নেবেন। সত্যি কথা বলতে কি এগুলো দেখার পর আমি বুঝতে পারলাম এগুলো আপনার কাছে ঠিক কতখানি গুরুত্বপূর্ণ। আমি আগেই বলেছি একজন মাইনিং ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার দরুন ভূতত্ত্ব সম্পর্কে অল্পবিস্তর পড়াশোনা আমার আছে। সেই নিরিখেই বলতে পারি এই পাথরের চাঁইগুলো এতটাই প্রাচীন যে সাধারণ ভূতত্ত্বের জ্ঞান দিয়ে এগুলোর আনুমানিক বয়েস বলা অসম্ভব। তবে এটুকু বলতে পারি পৃথিবীর গঠনের সময়ও এই পাথরগুলোর অস্তিত্ব ছিল। এই পাথরগুলোর উপাদান হিসেবে থাকা কংক্রিট আর সিমেন্টের উপাদান রীতিমতো বিস্ময়কর। এবং আরও বুঝতে পারি বহুদিন, হয় তো সহস্র লক্ষাধিক বছর কিংবা তারও বেশিদিন এগুলো জলের তলায় ডুবে ছিল। এবং বহু যুগের বিবর্তনের সাক্ষী এই পাথরের চাঁইগুলো। আর এগুলো বারেবারে ব্যবহৃত হয়েছে। ঠিক কতদিন আমি বলতে পারব না। সত্যি বলতে কি ভাবতেও চাই না। তবে একটা ব্যাপারে আমি নিশ্চিত আমরা দুজনেই মুখোমুখি হয়েছিলাম বহু প্রাচীন এক সভ্যতার ধ্বংসাবশেষের।
একটা ব্যাপারে আমি নিশ্চিত এগুলো হাতে পাবার পর আপনি অবশ্যই প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণার জন্য অস্ট্রেলিয়ার সেই মরুভূমিতে অভিযান করতে চাইবেন। এ ব্যাপারে আমার আর ডঃ বয়েলের তরফ থেকে সম্পূর্ণ সহযোগিতা আপনি পাবেন। আপনি চাইলে আপনার পরিচিত কোন সংস্থার সাথেও অভিযানের আর্থিক সহযোগিতার ব্যাপারে কথা বলতে পারেন। আমি অভিযানের খোঁড়াখুঁড়ির কাজ চালাবার জন্য কিছু মজুরের ব্যবস্থা করতে পারি। কারণ স্থানীয় ওইসব আদিবাসীদের দিয়ে এসব কাজ আর করানো যাবে না। ব্যাটারা ভয়েই কুঁকড়ে আছে। তবে এই অভিযানের ব্যাপারে আপনি, আমি ও ডঃ বয়েল ছাড়া আর কেউ জানবে না। আর একটা ব্যাপারে আপনি নিশ্চিত থাকতে পারেন, যদি কিছু আবিষ্কারও করতে পারি সেক্ষেত্রে সম্পূর্ণ কৃতিত্ব হবে আপনার।
এবার আসি জায়গাটার প্রসঙ্গে। পিলবারা থেকে মোটর ট্র্যাক্টরে করে ওখানে পৌছতে দিন চারেক লাগবে। ওই মোটর ট্র্যাক্টরে আমাদের যাবতীয় যন্ত্রপাতিও নিয়ে নেওয়া যাবে। ওয়ারবার্টন পাথের দক্ষিণ পশ্চিমে আর জোয়ানা প্রপাতের ১০০ মাইল দক্ষিণে গিয়ে শেষ হবে ট্র্যাক্টর যাত্রা। তারপর ডি গ্রে নদীপথেই আমাদের পরবর্তী যাত্রা শুরু হবে। ওই পাথরের চাঁইগুলোর সঠিক অবস্থান হল ২২ ডিগ্রি ৩ মিনিট ১৪ সেকেন্ড দক্ষিণ অক্ষাংশ আর ১২৫ ডিগ্রি ০ মিনিট ৩৯ সেকেন্ড পূর্ব দ্রাঘিমা। ওখানকার আবহাওয়া কিন্তু খুবই গরম আর ক্রান্তীয় প্রকৃতির। তাই জুন থেকে আগস্টের মধ্যেই যাওয়া ভাল। যদি আপনারও কোন পরিকল্পনা থাকে সেটাও জানাবেন। সে যাই হোক অত চিন্তা করার কিছু নেই। বাকি কথাবার্তা নাহয় সামনাসামনিই হবে। ডঃ বয়েলও আপনাকে পরে চিঠি লিখবেন। আর জরুরী কিছু বলার হলে না হয় পার্থ থেকে তার করে দেওয়া যাবে।
আপনার জবাবের অপেক্ষায় রইলাম।
নমস্কারান্তে
রবার্ট. বি. এফ. ম্যাকেঞ্জি
চিঠিটা পড়বার পর কিছুক্ষণ হতভম্ব হয়ে বসে রইলাম। ঠিক যেন বিশ্বাস হচ্ছিল না। তাই চিঠিটা আরও বার দুয়েক পড়লাম। আনন্দে আর উত্তেজনায় আমার বুকের ভেতর ধুকপুকুনিটা যেন স্পষ্ট টের পাচ্ছিলাম। এরপর আর খুব বেশি দেরী করিনি। আমার জবাব ম্যাকেঞ্জি আর ডঃ বয়েলকে জানিয়ে দিলাম। সৌভাগ্যক্রমে মিসকাটোনিক বিশ্ববিদ্যালয়য়ের সাহচর্য আর পৃষ্ঠপোষকতা পেতে আমার খুব বেশি অসুবিধে হয় নি। ওদিকে অস্ট্রেলিয়া থেকে ম্যাকেঞ্জি আর ডঃ বয়েলও যাবতীয় আয়োজন সেরে ফেলতে লাগলেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় হল আমরা বিষয়টা যতটা গোপন রাখতে চেয়েছিলাম, শেষ পর্যন্ত সেটা আর হল না। সর্বজ্ঞ কাগজ-ওলারা ফেউয়ের মত লেগে গেল আমাদের পেছনে। শুরু হল আমাদের এই আসন্ন অভিযান নিয়ে নানারকম আষাঢ়ে গল্প আর টিটকিরির বন্যা। যদিও আমাদের অভিযানের মূল উদ্দেশ্য তাদের মাথার অনেক ওপর দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল তাই গুজব আর টিটকিরিতেই এগুলো সীমিত থাকল।
এবার এই অভিযানের আমার সহযাত্রীদের নিয়ে বলা যাক। প্রথমেই বলব মিসকাটোনিক বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন অধ্যাপকের কথা। এঁরা হলেন ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক উইলিয়াম ডায়ার (যিনি ১৯৩০-৩১ নাগাদ অ্যান্টার্কটিকা অভিযান করেছিলেন), প্রাচীন ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ফার্ডিনাণ্ড সি অ্যাশলে আর নৃতত্ত্ব বিভাগের টাইলার এম. ফ্রিবরন। এবং এদের সাথে অবশ্যই ছিল আমার মেজো ছেলে উইনগেট। ১৯৩৫ নাগাদ ম্যাকেঞ্জি আর্কহ্যামে আসে। এবং আমাদের চূড়ান্ত প্রস্তুতিতে যারপরনাই সাহায্য করে। আমি এই পঞ্চাশ ছুঁইছুঁই ভদ্রলোকের উৎসাহ, আর অস্ট্রেলিয়ার হাল হকিকত নিয়ে জ্ঞান যত দেখছিলাম ততই অবাক হয়ে যাচ্ছিলাম।
চিঠিতে যেমন বলা ছিল ঠিক সেইভাবেই পিলবারাতে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল মোটর ট্র্যাক্টর। আর এরপর আমরা ভাড়া করে নিই একটা টহলদারি স্টিমার। আমরা একেবারে আধুনিক আর বিজ্ঞানসম্মতভাবে যাতে যাবতীয় পরীক্ষানিরীক্ষা চালানো যায় তার জন্য সবরকম যন্ত্রপাতি সঙ্গে নিয়ে নিয়েছিলাম। ১৯৩৫ এর ২৮শে মার্চ আমরা বোস্টন থেকে এসে পৌঁছলাম লেক্সিংটনে। সুয়েজ খাল বরাবর আটলান্টিক সাগর, ভূমধ্যসাগর পেরিয়ে আমরা এসে পৌঁছলাম লোহিতসাগরে এবং ভারত মহাসাগর পেরিয়ে আমরা চললাম আমাদের গন্তব্যের দিকে। যাত্রাপথের ক্লান্তিকর আর দীর্ঘ বর্ণনায় আর গেলাম না। ইতিমধ্যে আমাদের যাত্রাপথের সঙ্গী হয়েছেন ডঃ বয়েল। মনোবিজ্ঞানের ওপর তাঁর দখল দেখে আমি মুগ্ধ হয়ে গেলাম। এবং বাকি যাত্রাপথ আমি আর উইনগেট তাঁর সাথে নানা বিষয়ে আলোচনা করে কাটিয়ে দিলাম।
যাত্রাপথের শেষে যখন আমাদের অভিযানের দল সেই বালি আর পাথরের দুনিয়ায় প্রবেশ করল, তখন ক্লান্তিতে আমাদের যা হাল হয়েছিল তা হয়ত বর্ণনা করা সম্ভব নয়। অবশেষে ৩১শে মে এক শুক্রবার ডি গ্রে নদীর শাখা বেয়ে আমরা এসে পৌঁছলাম আমাদের বহু আকাঙ্ক্ষিত সেই অজানা আর অদ্ভুত জগতে। যে অপার্থিব বস্তুগুলো এতদিন আমার দুঃস্বপ্নের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল, সেগুলোকে সামনে দেখলে ঠিক কি মনে হতে পারে, একথা ভাবতেই এক অজানা আর নারকীয় আতঙ্ক আমাকে গ্রাস করল।
৩রা জুন, সোমবার আমরা এসে পৌঁছলাম সেই জায়গায়, যেখানে ওই রাক্ষুসে পাথরের চাঁইগুলো রয়েছে। প্রথমে অর্ধেক পোঁতা পাথরটা দেখে কিছুক্ষণ হতভম্ব হয়ে রইলাম। তারপর যখন সেটাকে হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখলাম, তখন যে আমার ঠিক কি অনুভূতি হয়েছিল তা ভাষায় প্রকাশ করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। কারণ ওই পাথরের চাঁইটা ছিল আমার স্বপ্ন তথা দুঃস্বপ্নে দেখা দৈত্যাকার স্থাপত্যে তৈরি বাড়িগুলোর দেওয়ালের একটুকরো ভগ্ন নিদর্শন। ওই পাথরের গায়ে খোদাইয়ের চিহ্ন ছিল। এবং যখন হাত দিয়ে একটা নকশাকে দেখে চিনতে পারলাম, উত্তেজনায় আমার হাত কাঁপতে লাগলো। কারণ বহুদিন ধরে নিয়মিতভাবে যন্ত্রণাদায়ক দুঃস্বপ্ন আর গবেষণার ফলে ওই নকশাটা ছিল আমার কাছে ভীষণভাবে পরিচিত।
একমাস ধরে খোঁড়াখুঁড়ি চালাবার পর নানারকম আকৃতির প্রায় ১২৫০ টা পাথরের চাঁই আমরা খুঁজে পেলাম। বেশিরভাগই ছিল ওপর-নীচে ঢেউ খেলানো মান্ধাতা আমলের খোদাই করা স্মৃতিস্তম্ভের মত। কিছু ছিল আমার স্বপ্নে দেখা ওই পাষাণ-পুরীর মেঝে আর রাস্তার ধারের ফুটপাতের মতোই চৌকোণা বা আট-কোণা চ্যাটালো ছোট পাথর। কয়েকটা আবার দানবীয় আকারের পাথরও ছিল। আমরা উত্তরপূর্ব দিক বরাবর যত খোঁড়াখুঁড়ি চালাতে লাগলাম ক্রমাগত এরকম পাথরের নমুনা আরও চোখে পড়তে লাগল। যদিও এযাবৎ আবিষ্কৃত সবকটা পাথরের মধ্যে কোনরকম যোগসূত্র আছে কিনা সেটা আমরা বের করতে পারিনি। অধ্যাপক ডায়ার এই পাথরগুলোর প্রাচীনত্ব দেখে হতবাক হয়ে গেলেন। তবে অধ্যাপক ফ্রিবরন অবশ্য কিছু চিহ্নর সাথে পাপুয়ান আর পলিনেশীয় ভয়ানক কিছু প্রচলিত কিংবদন্তীর মিল খুঁজে পেলেন। তবে পাথরগুলোর অবস্থা দেখে আমরা সকলেই একটা বিষয়ে একমত ছিলাম, এগুলো বহু যুগের বিবর্তনের সাক্ষী।
আমাদের সাথে যে এরোপ্লেন ছিল আমার মেজো ছেলে উইনগেট তাতে চেপে মাঝেমাঝেই বিভিন্ন উচ্চতা থেকে জরিপ করে মরুভূমির বালি আর পাথরগুলোর মধ্যে নতুন কোন চিহ্ন বা সূত্র খুঁজে দেখার চেষ্টা চালাত। অবশ্য তার এই চেষ্টা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ব্যর্থ হয়েছিল। কিন্তু হঠাৎ করেই একদিন সে সাফল্যর মুখ দেখল। ঝোড়ো হাওয়ার ফলে বেশ কিছু বালি এক জায়গা থেকে সরে অন্য জায়গায় চলে গিয়েছিল। আর তার ফলেই তার চোখে পড়ল নতুন এক পাথরের ছাঁদ। আর এইগুলোর মধ্যে দু একটা দেখার পরই আমি চিনতে পারলাম এই ছাঁদগুলোকে। কিন্তু কিছুতেই মনে করতে পারছিলাম না হুবহু কোথায় এগুলোকে আমি দেখেছিলাম। হতে পারে আমার সেই নারকীয় দুঃস্বপ্ন অথবা দিনরাত পড়াশোনা আর গবেষণার ফলেই হয়ত অবচেতন মনে এর ছাপ রয়ে গেছে।
জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহ নাগাদ আমি প্রথম সেই অজানা উত্তুরে ভয়ানক বাসিন্দাদের সম্পর্কে ভয় আর কৌতূহল মেশানো একটা অদ্ভুত গা শিরশিরে অনুভূতি টের পেলাম। হয়ত এর জন্য কিছুটা দায়ী ছিল আমার আগের ভয়ানক অভিজ্ঞতার স্মৃতি। আমি মাথা থেকে এই সব চিন্তা হটাবার জন্য নিজেকে নানারকম মনো-বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দিতে শুরু করলাম। কিন্তু সবই বিফল হল। এই সময় গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মত যোগ হল অনিদ্রা। তবে এটা আমার কাছে তেমন কোন অসুবিধে হয়নি, কারণ ঘুমলেই তো আবার ওইসব স্বপ্ন দেখতে হবে! সে যাইহোক এই সময় আমার একটা নতুন অভ্যাস তৈরি হল। সেটা হল গভীর রাতে উত্তর বা উত্তরপূর্ব দিক বরাবর মরুভূমিতে হাঁটা। কেন জানিনা মনে হত হয়ত আমার বহু আকাঙ্ক্ষিত দুঃস্বপ্ন নগরীর বা তার বাসিন্দাদের দেখা পেলেও পেতে পারি। নিজের ইচ্ছা থাক বা না থাক কেউ যেন জোর করে আমাকে টেনে নিয়ে যেত ওই নৈশভ্রমণে। ঘুরতে ঘুরতেই কখনো কখনো হোঁচট খেতাম মাটি থেকে সামান্য উঁকি মারা সেই আদ্যিকালের স্থাপত্যের কিছু পাথরের টুকরোয়। কিন্তু সেগুলো সংখ্যায় খুব বেশি ছিল না। যদিও আমার বিশ্বাস ছিল মাটির নীচে এই স্থাপত্যের সিংহভাগই বহুযুগ ধরে লুকিয়ে রয়েছে। তার কারণও ছিল অবশ্য। আমাদের ক্যাম্পটা ছিল ওই পাথুরে টুকরোগুলোর থেকে উঁচু জায়গায়। বালির ঝড়ের দৌলতে একটা সাময়িক টিলার সৃষ্টি হয়েছিল। আর টিলার জন্যই অপেক্ষাকৃত নতুন পাথরের টুকরোগুলো কিছুটা মাথা বের করে ছিল।
এই গোটা এলাকার খোঁড়াখুঁড়ি চালালে ঠিক কি কি আবিষ্কার হতে পারে তার জন্য আমি আর কৌতূহল চেপে রাখতে পারছিলাম না। এই নৈশভ্রমণের ফলেই আমি একদিন আবিষ্কার করলাম এক ভয়ানক জিনিস। সেটা ছিল জুলাই মাসের ১১ তারিখ। জ্যোৎস্নায় ঝলমলে হয়ে ছিল গোটা এলাকাটা। আমিও নিজের নৈশভ্রমণের এক্তিয়ার পেরিয়ে এগিয়ে গিয়েছিলাম আরও খানিকটা। এবং ঘুরতে ঘুরতেই আমার চোখে পড়েছিল একখানা রাক্ষুসে পাথরের চাঁই। পাথরটা প্রায় পুরোটাই বালিতে ঢেকে গিয়েছিল। আমি ভালভাবে দেখার জন্য দুহাত দিয়ে সব বালি পরিষ্কার করলাম। তারপর চাঁদের আলো আর আমার ইলেকট্রিক টর্চের যুগলবন্দীতে ভালভাবে দেখতে লাগলাম পাথরটা। একেবারে নিখুঁত বর্গাকার এই পাথরটা ছিল আমাদের অভিযানে আগে দেখা সবকটা পাথরের থেকে এক্কেবারে আলাদা। ব্যাসাল্ট জাতীয় শিলা দিয়ে তৈরি এই পাথরের চাঁইটায় কোন উত্তল বা অবতল অংশ ছিলনা। আর তখনই আমার মাথায় একটা ঝলক দিল! ঠিক এইরকম পাথরগুলোকেই আমি আমার স্বপ্নে দেখতাম। ঈথদের দুনিয়ায় আমি যে জানলা-হীন পেল্লায় পাথুরে বাড়িগুলো দেখতাম, এই পাথরটা সেই বাড়িগুলোরই একটা অংশ। এই বাড়ির মধ্যেই পাতাল-কুঠুরিতে চিরকালের জন্য দরজার মুখ বন্ধ করে রেখে দেওয়া হত কোন অপার্থিব শক্তিকে। আর দেরী নয়, দৌড় লাগালাম আমাদের ক্যাম্পের দিকে। সে রাতে আর ঘুম এলোনা আমার। ভোরবেলা বুঝতে পারলাম কি বোকামিটাই না করেছি! একটা মান্ধাতা আমলের উপকথা আর আমার দুঃস্বপ্নের ভিত্তিতে ওভাবে ভয় পাওয়াটা আমার উচিত হয়নি। একটু বেলা হলে আমি সবাইকে আমার আবিষ্কারের কথা বললাম। তারপর সবাই মিলে একসাথে রওনা দিলাম পাথরটাকে দেখার জন্য। কিন্তু আমার কপালটাই বোধহয় খারাপ ছিল। গতরাতে বালির ঝড়ে গোটা এলাকাটা ঢাকা পড়ে গেছে, ফলে আমি ঠিক কোন জায়গাটায় ওই পাথরটাকে দেখেছিলাম খুঁজে বের করতে পারলাম না।
———-
এইবার আমি আমার এই লেখার সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ অংশ সম্পর্কে বলতে চলেছি। কারণ একটা ব্যাপারে আমি নিশ্চিত ছিলাম যে এগুলো কখনই আমার কল্পনা বা স্বপ্ন নয়, ভয়ঙ্কর রকমের সত্যি। কারণ আমার মেজো-ছেলের মনোবিজ্ঞানের যথেষ্ট জ্ঞান ছিল আর ও কখনোই এই বিষয়গুলোকে হাল্কা-ভাবে নেয়নি। আর আমার এই কেসের গোড়া থেকেই উইনগেট সাক্ষী ছিল। যাই হোক এবার আসি আসল ঘটনায়। সেটা ছিল জুলাই মাসের ১৭ ১৮ তারিখের এক রাতের ঘটনা। বাইরে তুমুল ঝোড়ো হাওয়া বইছিল। আমি ক্যাম্পে তাড়াতাড়ি ফিরে এলেও ঘুম আসছিল না। তখন বোধহয় ১১টা বেজেছিল, দেখলাম আর শুয়ে কাজ নেই। যথারীতি আমার সেই নৈশ-ভ্রমণে বেরিয়ে পড়লাম। ক্যাম্প থেকে যখন বেরোচ্ছি ট্যাপার বলে একজন অস্ট্রেলিয়ান খনি মজুর আমাকে দেখে অভিবাদন জানাল। আকাশে তখন ঝলমলে চাঁদ তার নিজস্ব শোভা নিয়ে বিরাজমান। জ্যোৎস্নায় চারদিক উজ্জ্বল। আমি নিশ্চিত কারোর কবিতা লেখার শখ থাকলে তিনি বেশ কয়েক ছত্র কবিতা লিখে ফেলতেন। কিন্তু আমি তো ঘরপোড়া গরু, তাই কি একটা অশুভ আমাকে যেন ক্রমাগত ইঙ্গিত দিয়ে যাচ্ছিল। খেয়াল করলাম সেই ঝোড়ো বাতাসটা আর তেমন জোরে বইছে না। বুঝলাম আগামী চার পাঁচ ঘণ্টার মধ্যে আর ঝোড়ো বাতাস বইবে না। আসলে ট্যাপারদের সাথে কথা বলে এইসব ব্যাপারস্যাপার আমিও বেশ জেনে গিয়েছিলাম। কতক্ষণ হেঁটেছিলাম খেয়াল নেই, তখন বোধহয় ৩:৩০ বেজেছিল, আবার সেই ঝোড়ো বাতাস বইতে শুরু করল। সেই ঝোড়ো বাতাসের এমনই দাপট ছিল যে আমাদের ক্যাম্পের সকলের ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। ঘুম ভেঙে যেতে সবাই দেখল আমি গায়েব। কিন্তু যেহেতু আমি রোজই নৈশ-ভ্রমণে বেরুতাম, কেউ গা করেনি। এদিকে তখনও বাইরে জ্যোৎস্না ঝলমল করছে, আকাশে ছিটেফোঁটাও মেঘ নেই। আমাদের ক্যাম্পের কয়েকজন অস্ট্রেলিয়ান মজুর আবার বেশ কুসংস্কার-গ্রস্ত ছিল। তারা মনেপ্রাণে এইসব প্রচলিত উপকথায় বিশ্বাস করত। তাদের ধারনা ছিল মেঘহীন ঝকঝকে আকাশ থাকা সত্ত্বেও যখন অনেকদিন বাদে এই ঝোড়ো বাতাস বইতে শুরু করবে, সেটা নিশ্চিত ভাবে অশুভ। এই বাতাসে কান পাতলে নাকি অনেক অপার্থিব ফিসফিসানি শুনতে পাওয়া যায়। আর এই বাতাসের ফলেই বালির ভেতর থেকে জেগে ওঠে বহু যুগ ধরে মাটির নীচে সুপ্ত থাকা সেইসব রাক্ষুসে আঁকিবুঁকি কাটা পাথরের চাঁই। এই সময় তারা ভুলেও ওই এলাকা কখনও মাড়ায় না। তখন আন্দাজ চারটে বাজে, দুম করে ঝোড়ো বাতাস বওয়া বন্ধ হয়ে গেল। আর ঠিক তখনই বালি ফুঁড়ে তখন অনেক নতুন আকারের পাথর মাথা তুলেছে।
যখন পাঁচটা নাগাদ চাঁদ পশ্চিমদিকে বিদায় নিলো, আমিও টলতে টলতে ফিরে এলাম ক্যাম্পে। আমার মাথায় না ছিল কোন টুপি, আর ইলেকট্রিক টর্চটাও গিয়েছিল হারিয়ে। আর আমার চেহারা অবিকল লাশকাটা ঘরের কোন কাটাছেঁড়া করা লাশের মতোই ফুটিফাটা,শীর্ণ হয়ে গিয়েছিল। ক্যাম্পের সবাই তখন ঘুমিয়ে পড়লেও অধ্যাপক ডায়ার ক্যাম্পের সামনে বসে জুত করে পাইপ টানছিলেন। আমার চেহারার হাল দেখে তিনি সঙ্গে সঙ্গে ডঃ বয়েলকে ডেকে আনলেন। তারপর দুজনে মিলে আমাকে ধরাধরি করে নিয়ে গেলেন আমার বিছানায়। এর পর ডঃ বয়েল, অধ্যাপক ডায়ার আর উইনগেট মিলে আমাকে ঘুমপাড়ানোর চেষ্টা চালাতে লাগল। কিন্তু আমার তখন যা মানসিক অবস্থা ওসব ঘুমটুম তখন বিশ বাঁও জল। হয়ত এযাবৎ আমার মানসিক অবস্থা যতবার বিগড়েছে, এবারেরটা ছিল সবথেকে ভয়াবহ। কিছুক্ষণ বাদে আমি এলোমেলো ভাবে আমার হাল কিকরে এরকম হল বর্ণনা দিতে শুরু করলাম। আমি ওদের বললাম যে আমি ক্লান্ত হয়ে বালির ওপরেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। এবং ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে আমি যেসব ভয়ানক স্বপ্ন দেখেছিলাম তা এযাবৎ কাল যত দুঃস্বপ্ন দেখেছি, সবগুলোকে টেক্কা দিয়েছিল। অবশেষে যখন আমার স্নায়ু আর দুঃস্বপ্নের ভার বইতে পারে নি, তখন আমি জেগে উঠি। এবং প্রচণ্ড ভয়ে ক্যাম্পে ফিরে আসার সময় ওই হঠাৎ গজিয়ে ওঠা পাথর-গুলোয়ে ধাক্কা খেয়েই হয়ত আমার শরীর এভাবে কেটেছড়ে গেছে। হয়ত আমি একটু বেশিই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। তবে একটা কথা মানতেই হবে যে ওই বীভৎসতার মুখোমুখি হয়েও আমি নিজেকে খুব ভালভাবে সামলে নিয়েছিলাম। এরপর আমি জানাই আমাদের অভিযানের কর্মসূচী একটু পালটে যাবতীয় খোঁড়াখুঁড়ির কাজ উত্তরপূর্ব দিক বরাবর করলে ভাল হয়। যদিও আমার কথায় কোন যুক্তি ছিল না। শুধু কিছু দুঃস্বপ্ন আর অনুমানের ওপর ভিত্তি করে কেউই কর্মসূচী পালটাতে রাজি হয়নি। এদিকে আমাদের অভিযানের পুঁজিও ফুরিয়ে আসছে, আর আমার যা শরীর ও মনের অবস্থা তাতে কোন নতুন ঝুঁকি নিতে কেউ রাজি হয়নি, এমন কি উইনগেটও নয়।
পরের দিন ঘুম থেকে উঠে ক্যাম্পের চারদিকে একটু টহল দিলেও ওদের খোঁড়াখুঁড়ির কোন কাজে কোন অংশ নিলাম না। দেখলাম এদের সাথে থাকলে আমার কাজ তেমন এগোবে না। কিন্তু আমাকে কাজ চালিয়ে যেতেই হবে। তাই ঠিক করলাম আমাকে দেশে ফিরতে হবে। আমার মেজো-ছেলে উইনগেটকে বললাম আমার সাথে বিমানে প্রায় হাজার মাইল দক্ষিণ পশ্চিম -পার্থে যাবার জন্য। সাথে এও বললাম সেখানে পৌঁছনোর পর যাবতীয় যা কাজ সব আমি একাই করব। জুলাই মাসের ২০ তারিখ নাগাদ উইনগেট আমার সাথে পার্থে রওনা দিল। ২৫ তারিখ লিভারপুল থেকে স্টিমার ছাড়া অবধি ও আমার সাথে ছিল। এবং স্টিমারের কেবিনে বসে বসেই আমি এই লেখা লিখছি। কারণ আমার মনে হয়েছে, উইনগেটের গোটা ব্যাপারটাই জানা দরকার। বিশেষ করে সেই রাতের ঘটনাটা যেটা আমি কাউকে বলিনি। আমার দুঃস্বপ্নের প্রতীক সেই নারকীয় হায়ারোগ্লিফিক লেখাওলা সাইক্লোপিয়ান পাথরগুলো যখন পাতাল ফুঁড়ে আমার সামনে হাজির হয়েছিল, আমার যাবতীয় দুঃস্বপ্ন আর তাদের কেন্দ্র করে আমার গবেষণা সবকিছু নিছকই শিশুসুলভ মনে হয়েছিল। হয়ত আকাশ থেকে জরিপ করার সময় উইনগেট এই পাথরগুলোই দেখেছিল আর এদের মধ্যে মিল দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিল। হয়ত আমি যখন এগুলো তেমন ভাবে খেয়াল করি নি, কোন এক অজানা, অশুভ শক্তি প্রাণপণ চেষ্টা চালাচ্ছিল এগুলো আমার দৃষ্টিগোচরে আনতে। আমি আগেই বলেছি জুলাই মাসের ১৮ তারিখের সেই চাঁদনী রাতে ঝোড়ো বাতাস হঠাৎ করেই থেমে গিয়েছিল। অস্ট্রেলিয়ার সেই মরুভূমি আচমকাই সমুদ্রের মত শান্ত আর স্থির হয়ে গিয়েছিল। যেহেতু আমার এই অভিযানে তেমন কোন কাজ ছিল না, তাই উদ্দেশ্যবিহীন ভাবে এলোমেলো ঘুরে বেড়াতাম, উদ্দেশ্য একটাই যদি কপালফেরে সেই দুঃস্বপ্ন নগরীর কোন নিশান খুঁজে পাই! আমরা জানি আমরা সবথেকে বেশি ভয় পাই অজানা, অচেনাকে। কিন্তু সেই অজানা অচেনা জিনিস যদি আমাদের চোখের সামনে বারেবারে উঠে আসে আমাদের ভয় অনেকটাই কমে যায়। আমার ক্ষেত্রে কিন্তু আদৌ তাই হয় নি, বরং উল্টোটাই হয়েছিল। স্বপ্নের জগতের সেই সব করাল বিভীষিকারা যখন স্বপ্নের গণ্ডি পেরিয়ে আমার রোজকার জীবনে হানা দিয়েছিল, আমার জীবন আক্ষরিক অর্থেই হয়ে উঠেছিল দুর্বিষহ। আমার চোখের সামনে প্রাক মানবসভ্যতার সেইসব ভয়াবহ পাথুরে আতঙ্ক-পুরীর বালি-আবৃত বারান্দা, খিলান, কুঠুরি – বারেবারে ফিরে ফিরে আসত। সাথে অবশ্যই সেইসব হায়ারোগ্লিফিক নকশা। এখানেও কিন্তু আমি ঠিক ঐ আতঙ্ক-পুরীর মতোই বিভিন্ন বালি দিয়ে ঢাকা পাথরের চাঁই দেখতাম। সেদিন ঠিক কতক্ষণ ধরে কোন দিক বরাবর আমি হেঁটেছিলাম আমার কোন খেয়ালই ছিল না। তাই যখন আমি হাঁটতে হাঁটতে ওই পাথরের চাঁইগুলোর কাছে সেদিন পৌঁছলাম, আমার বুকের ভেতর দামামা বাজতে লাগল। কারণ একসাথে এতগুলো পাথরের চাঁই আমি এখনও পর্যন্ত দেখিনি। আকাশের চাঁদ আর মরুভূমিকে এখন আর সৌন্দর্যের প্রতীক মনে হচ্ছিল না, বরং মনে হচ্ছিল অগণিত বছর ধরে কোন অন্ধ অতীতের সাক্ষী এরা।
আমি এবার একটু কাছে এগিয়ে ধ্বংসস্তূপের ওপর আমার ইলেকট্রিক টর্চের আলো ফেললাম। প্রায় চল্লিশ ফুট দুরে একটা টিলা দেখতে পেলাম। আমার কেন জানিনা মনে হল এই পাথরের চাঁইগুলো কোনভাবেই সাধারণ হতে পারে না। এযাবৎ আমরা যেকটা নমুনা দেখেছি, এগুলো তার থেকে অনেক গভীর অর্থপূর্ণ ছিল। এগুলোর ওপর যে আঁকাবাঁকা রেখাগুলো ছিল, সেগুলো আমি দেখেই চিনতে পারলাম। গবেষণা করে করে এই রেখাগুলো আমার খুবই পরিচিত। অনেক কসরত করে আমি একটু নিচু জায়গা দেখে নামলাম। তারপর এখানে ওখানে যে বালি লেগেছিল, সেগুলো আঙুল দিয়ে পরিষ্কার করতে লাগলাম। তারপর ক্রমাগত এগুলোর আকার,আকৃতিগত সামঞ্জস্য খুঁজতে লাগলাম। প্রথমে কিন্তু কিছুই বুঝতে পারলাম না। ঠিক তারপরেই টের পেলাম এই ধ্বংসস্তূপকে কোথায় দেখেছি! এগুলো হল আমার দুঃস্বপ্নে দেখা সেই রাক্ষুসে তিরিশ ফুট লম্বা ইমারতেরই ভগ্নাংশ! কিন্তু এগুলো ঠিক কতদিন ধরে মাটির নীচে লুকিয়ে ছিল কোন কূলকিনারা পেলাম না। আমি এই পেল্লায় ইমারতের লাইব্রেরী, বারান্দা, সেইসব ঘরগুলো এবং সর্বোপরি সেই দানবীয় ঈথদের অনেক আগেই দেখেছিলাম। আমার মেরুদণ্ড দিয়ে ভয়ের ঠাণ্ডা স্রোত বইতে লাগল।
হঠাৎ টের পেলাম সেই পাথরের গাদা থেকে আবার ঠাণ্ডা, দমকা হাওয়া বইতে শুরু করেছে। ঠিক যেন গভীর পাতাল থেকে কোন ঘূর্ণাবর্ত জেগে উঠছে ধীরে ধীরে। বাইরের এই ধ্বংসস্তূপগুলো যার খোলস। আমার প্রথমেই মনে পড়ল স্থানীয় আদিবাসীদের সেইসব উপকথার কথা। কিন্তু তারপরেই আমার মনে পড়ে গেল আমার সেইসব দুঃস্বপ্নের কথাগুলো। টের পেলাম আমার বহু আতঙ্কিত রাতের সেইসব দুঃস্বপ্ন এবার সত্যি হতে চলেছে। এই সময় হয়ত আমার পালিয়ে আসাই উচিত ছিল, কিন্তু একটা কৌতূহল আর বৈজ্ঞানিক মানসিকতা যাই হোক না কেন আমাকে সাহায্য করল সেই ভয় কে জয় করতে। কোনকিছুর সাহায্য ছাড়াই আমি তরতরিয়ে এগোতে লাগলাম, সেই ঠাণ্ডা ঝোড়ো হাওয়ার উৎসের সন্ধানে। কোন অলৌকিক বল যেন আমাকে আকর্ষণ করতে লাগল। কি করে জানিনা প্রথমেই আমি এক ঝটকায় একটা পেল্লায় পাথরের চাঁইকে সরিয়ে ফেললাম। আমার শরীরে তখন অমানুষিক শক্তি ভর করেছে। তারপর একের পর এক পাথরকে অনায়াসে সরিয়ে ফেলতে লাগলাম। একটা জিনিস টের পেলাম এই মরুভূমির দেশে থাকলেও পাথরগুলো কেমন যেন স্যাঁতস্যাঁতে। তারপর কিছু বুঝে ওঠার আগেই সেই অলৌকিক বল আমাকে টেনে নিয়ে গেল অতল গহ্বরে। তলিয়ে যাবার সময় আমি আবার সেই বিদ্যুতের ঝলকানি দেখতে পেলাম। যখন হুঁশ ফিরল, দেখি সেই গহ্বরের মধ্যে আমি পড়ে আছি। আমার আশেপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে সেই ধ্বংসস্তূপের নানা নিদর্শন। পাশেই পড়ে আছে আমার ইলেকট্রিক টর্চ। আমি টর্চটা জ্বালালাম। কিন্তু সেই অন্ধকার ঘোচাবার পক্ষে ওই টর্চ নিছক খেলনা ছাড়া কিছুই নয়। এই মরুভূমির অতলে কত যুগ ধরে এই প্রাচীন সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ রক্ষিত হয়েছে, কে জানে? খুব সম্ভবত পৃথিবীর সৃষ্টির আদিকাল থেকেই। আমি ব্যাটারির আয়ু বাঁচাবার জন্য টর্চটা নেভালাম। আমার আগের অভিজ্ঞতা থেকে স্পষ্ট বুঝলাম খুব ভয়ানক অশুভ কিছু আমার জন্য অপেক্ষা করছে। যাইহোক আমি হাত ও পা একসাথে কাজে লাগিয়ে এগোতে লাগলাম।
আমার সামনে দুটো রাস্তা খোলা ছিল, সেই দানবীয় আঁকিবুঁকি কাটা বিশাল দেওয়াল আর সীমাহীন অন্ধকার। আমি প্রথমটাই বেছে নিলাম। আমি ঠিক কোন পথে নীচে এলাম সেটা কোনভাবেই আঁচ করতে পারলাম না। অতঃপর এলোমেলো কিছু স্মৃতির ওপর ভরসা করেই এগোতে লাগলাম। আমার শরীর তখন পুরোপুরি অসাড়। তার ওপর ভয়ও কাজ করছিল। এগোতে এগোতে এতক্ষণে একটা ঘরের মেঝে মত পেলাম। মেঝের এদিক ওদিক বিভিন্ন পাথরের টুকরো পড়ে আছে। সাথে ধুলো ও জঞ্জাল। ঘরের অন্যদিকে প্রায় তিরিশ ফুট উঁচু একটা দেওয়াল উঁচু হয়ে কোথায় যেন মিলিয়ে গেছে। ওই দেওয়ালেও আঁকিবুঁকি থাকলেও সেগুলো ঠিক কিরকম এতদূর থেকে আমি ঠাহর করতে পারলাম না। কিন্তু যে জিনিসটা দেখে আমি সবথেকে ঘাবড়ে গেলাম সেটা হল এই ঘরের ধনুকের মত বাঁকানো ছাদ। যদিও টর্চের আলোয় সবটা বোঝা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না, কিন্তু ওই ছাদের নীচের অংশটা দেখেই আমি বুঝতে পারলাম এগুলো আমার সেই দুঃস্বপ্নের পাতালপুরীর মতোই! এই অতল গহ্বর থেকে আমি কি করে ফিরবো কোনভাবেই বুঝে উঠতে পারলাম না। আমি এবার আমার বাঁদিকের দেওয়ালের দিকে এগিয়ে গেলাম। এই দেওয়ালটা অন্যগুলোর থেকে কিছুটা কম এবড়োখেবড়ো ছিল। অনেক কষ্টে আমি এগোতে লাগলাম। এগোনোর সময় আমি কয়েকটা পাথরের টুকরোকে জঞ্জালের গাদায় ঠেলে দিতেই টের পেলাম এই ঘরের শান বাঁধানো মেঝেও হুবহু আমার আতঙ্ক-পুরীর মতোই।
এবার আমি টর্চটা আবার জ্বেলে ভালভাবে দেখলাম। বেলেপাথরের ওপর কোন জলপ্রবাহের ক্রিয়ায় কিছু কিছু জায়গা আলগা আর নরম হয়ে ভেঙ্গেচুরে গেছে। কিন্তু যেটা দেখে আমি সবথেকে বেশি অবাক হলাম সেটা হচ্ছে পাথরের ওপর আঁকিবুঁকি নকশাগুলো দেখে। এগুলো হচ্ছে সেই নকশা যা বহু যুগের আতঙ্ককে একসাথে আমার অবচেতন মন দেখতে পেয়েছিল। রাতের পর রাত আমি দেখেছিলাম দুঃস্বপ্ন। যে দুঃস্বপ্ন আমাকে তাড়িয়ে নিয়ে এসেছে এতদূর। এই ধ্বংসস্তূপের প্রত্যেক টুকরোর সাথে আমি পরিচিত, ঠিক আর্কহ্যামে আমার ক্রেন স্ট্রীটের বাড়ির মতোই। কিন্তু স্বপ্নে আমি যা দেখেছি, তার থেকে অনেক অনেক বেশি ভয়াবহ বাস্তবে এই দুঃস্বপ্ন নগরীতে হাজির হওয়া। এই আতঙ্ককে হুবহু ভাষায় বর্ণনা করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমার দুঃস্বপ্নে আমি যেসব জলজ্যান্ত বিভীষিকাদের দেখেছিলাম, যদি তাদের মুখোমুখি হই, তাহলে কিভাবে নিজেকে রক্ষা করব এবং আদৌ পারব কিনা সেটা ভেবেই আমার হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে গেল। হঠাৎ করেই আমি যেন আমার চারপাশে সেইসব বিভীষিকাদের অস্তিত্ব টের পেতে লাগলাম। অন্ধকারের কোথাও যেন তারা ঘাপটি মেরে আমাকে লক্ষ্য করছে। দুঃস্বপ্নের সেইসব দৃশ্য আমার চোখের সামনে ভেসে উঠতে লাগল। এখনও কি সেই লাইব্রেরীতে ঈথরা ঘুরে বেড়ায়? এখনও কি সেই আতঙ্ক-পুরীর বারান্দা আর বন্ধ কুঠুরিগুলোর অস্তিত্ব আছে? যদিও আমার স্বপ্নে দেখা আর ওইসব কিংবদন্তীর অনেককিছুই ভবিষ্যতের ইতিহাসের খোলনলচে পাল্টে দিয়েছিল। অবশ্যই এক ভয়ানক উন্মাদনা আমাকে গ্রাস করেছিল, কিন্তু যে ভয়াবহতার সামনে এখন আমি দাঁড়িয়ে – তার কাছে সেগুলো কিছুই নয়। এইসময় আমার হঠাৎ করেই মনে পড়ল ঈথদের সেই লাইব্রেরীর কথা। যেখানে আমিও তাদের মত একজন হয়ে গিয়ে ঝড়ের গতিতে লিখে চলতাম পাতার পর পাতা। যদি সত্যিই ওরকম কিছুর অস্তিত্ব থেকে থাকে, তাহলে আমি নিমেষেই সেখানে পৌছতে পারব।
আমার মাথার মধ্যে এবার যেন ঝড় বইতে লাগল। সমস্ত স্মৃতি থমকে থমকে ভিড় জমালো মগজে। আমার ইলেকট্রিক টর্চের কমজোরি আলো দেখে যেন ওই অনন্ত অন্ধকার বিদ্রূপের হাসি হাসতে লাগল। সত্যি বলতে কি টর্চের ওই আলোয় জায়গাটা আরও ভুতুড়ে লাগছিল। এক-জায়গায় দেখলাম আলসেটা প্রায় পুরোপুরি ভেঙে পড়েছে, তাই ঠিক করলাম ওই দিকেই যাওয়া যাক। আলসে থেকে পাথরের চাঁই পড়ে টুকরো টুকরো হয়ে গাদা হয়ে জমে আছে। অনেক কষ্টে সেগুলোর ওপর ওঠা গেল। এই দানবীয় গুহায় আমার আকৃতি ছাড়া সবকিছুই বেশ মিলে যাচ্ছিল আমার দুঃস্বপ্নের সাথে। নিজেকে মনে হচ্ছিল দানবের দেশে গ্যালিভার। যাইহোক টলতে টলতে, লাফ দিয়ে, হামাগুড়ি দিয়ে আমি কোনমতে এগিয়ে চললাম আমার কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যের দিকে। একবার তো কোনমতে তাল সামলালাম, আর একটু হলে আমার টর্চটাই ভেঙে যাচ্ছিল। তবে আমার এখন আর কোন কিছু মনে হচ্ছিল না, কারণ এই পাতাল গহ্বরের প্রত্যেকটা ইঞ্চি এখন আমার কাছে পরিচিত মনে হল। মনে হচ্ছিল এরা যেন আমাকে বলছে “ক্ষণিকের অতিথি হয়ে কেন এলে আমাদের কাছে? আমরা যে যুগ যুগ ধরে তোমার অপেক্ষায় রয়েছি। এসো আমাদের কাছে এসো।“
এখানকার বেশিরভাগ ঘরগুলোই হয় ভেঙ্গেচুরে গেছে নয়তো আবর্জনায় ভর্তি। কয়েক জায়গায় দেখলাম কিছু ধাতব পাত পড়ে আছে। কয়েকটা অক্ষত থাকলেও অধিকাংশই ভেঙে-চুড়ে গেছে। আমি বুঝতে পারলাম এগুলো হচ্ছে আমার দুঃস্বপ্নে দেখা সেই টেবিলের অংশ, যেগুলোর ওপর রেখে আমি পাতার পর পাতা লিখে চলতাম। এবার একটু নীচের দিকে নামলাম। দেখলাম নীচের দিকটা বেশ ঢালু। এগোতে এগোতে এবার থামলাম। দেখলাম ফাটলের জন্য সামনে প্রায় ফুট চারেক ফাঁকের সৃষ্টি করেছে। ওই অন্ধকারের জন্য ফাঁকের ভেতরে কি আছে তা আন্দাজ করা ছিল আমার সাধ্যের বাইরে। আমি জানতাম এই ইমারতের মাটির নীচে আরও দুটো তলা আছে। আর একদম শেষ তলায় আছে ধাতুর তৈরি সেই সেই চিরকালের জন্য বন্ধ করে দেওয়া দরজা। এদিকে এই ফাটল বাঁচিয়ে বাঁচিয়ে আমার পক্ষে এগোনো রীতিমতো কষ্টকর হয়ে উঠেছিল, কিন্তু কেন জানি না হয়তো নিজের পাগলামির ভরসাতেই আমি এগোতে থাকলাম বাঁদিকের দেওয়াল ঘেঁষে ঘেঁষে। এইভাবে পৌঁছলাম একেবারে শেষের ধাপে। আমার ক্ষীণ স্মৃতি আমাকে বলল এই পথে গেলেই আমি আমার বহু আকাঙ্ক্ষিত সেই মেশিন ঘরে পৌছতে পারব। কালের প্রকোপে যেগুলো হয়তো আজ ধ্বংসাবশেষে পরিণত হয়েছে-কিংবা হয়নি! কোথায় কি ছিল, আমার একদম মুখস্থ। তাই বেশ মনের জোর নিয়েই আমি সেই ধ্বংসস্তূপের গাদা পেরিয়ে এগোতে লাগলাম। আমি জানতাম একসময় এই তেরচা বারান্দা পেরিয়েই আমি পৌঁছতাম সেই দুঃস্বপ্নের লাইব্রেরীতে। তাই আমার আশা ছিল এবারেও সেখানে পৌঁছে যাব।
যত এগোতে লাগলাম আমার মনে হল বহু যুগ ধরে লুকিয়ে রাখা গোপন রহস্য এবার আমার সামনে উন্মোচিত হতে চলেছে। দেওয়াল, বারান্দার ধ্বংসাবশেষ দেখে আমার দুঃস্বপ্নের সাথে কিছু কিছু মিল খুঁজে পেলাম, কিছু আবার নতুন জিনিষও দেখলাম যেগুলো আগে দেখিনি। আমি জানতাম মাটির নীচের কোন রাস্তা এই আতঙ্ক-পুরীকে মূল রাস্তার সাথে যোগ করেছে। শুধু এই বাড়িই নয় আশেপাশের সেই রাক্ষুসে বাড়িগুলোকেও। তবে এখনও অবধি আমি আমার স্বপ্ন থেকে খুব বেশি কিছু ফারাক খুঁজে পাই নি। খুব আবছা-ভাবে হলেও কিছু কিছু রাস্তা আমার এখনও মনে ছিল। তবুও আমি আরও ভাবতে লাগলাম। মাথায় বেশি জোর দেবার ফলে আমার অবস্থা আরও কাহিল হয়ে পড়ল। তবুও আমি মনে করতে পারলাম, মাটির নীচের সেই গোলাকার গম্বুজঅলা ঘর কমকরে দুশো ফুট জুড়ে ছিল। মেঝেটা এতই চকচকে ছিল যে আমি নিজের ছায়াও দেখতে পেতাম। ঈথদের দরকার না থাকায় এখানে কোন সিঁড়িও ছিল না। স্বপ্নের সেই দানবীয় মিনারগুলো ঈথরা কড়া পাহারায় রক্ষণাবেক্ষণ করত, কিন্তু এখন তো আর সেখানে কোন পাহারা নেই! ভেবেই আমার মাথা ঘুরতে লাগল।
এবার সেই বারান্দায় এক-জায়গায় গিয়ে থামতে বাধ্য হলাম। এখানে পাথরের স্তূপ প্রায় পাহাড়ের মত উঁচু হয়ে আছে। আর দেখলাম একটা বিশাল বড় গহ্বর, যেটা দেখে বুঝলাম আমার ইলেকট্রিক টর্চ এখন দেওয়াল বা গহ্বর কোন কিছু দেখার জন্যই আর কাজে আসবে না। আমার কেন জানি না মনে হল এটা মাটির নীচের সেই চোরা কুঠুরির কোন ধাতু দিয়ে তৈরি সীমারেখা। আমি বুঝতে পারলাম ঈথদের সেই তথ্যভাণ্ডারের খুব কাছাকাছি এসে গেছি। কিন্তু তিন নম্বর ধাপে উঠে যা দেখলাম সেটা সম্পর্কে আমার কোন ধারণা ছিল না। মনে হল এতক্ষণ যা করলাম সব পণ্ডশ্রম! এত কাঠ খড় পুড়িয়ে আবার আমি এসে হাজির হয়েছি নতুন এক প্রকাণ্ড বারান্দায়। এখানে ভাঙাচোরা পাথরের টুকরো প্রায় ছাদ ছুঁয়ে ফেলেছে। এরপর পুরোপুরি হয়তো আমার পাগলামির ওপর ভর করেই হ্যাঁচকা দিয়ে ওই পাথরের স্তূপগুলোকে সরাবার জন্য উদ্যোগী হলাম। স্বপ্ন নাকি সত্যি নাকি দুঃস্বপ্ন জানি না, কিন্তু অনেক কসরত করে এক-ফালি এগোবার রাস্তা বানাতে সক্ষম হলাম। আমার ইলেকট্রিক টর্চ ক্রমাগত জ্বালাতে ও নেভাতে(অবশ্যই ব্যাটারি বাঁচাবার জন্য) লাগলাম পাথর সরাবার কাজে। একবুক তেষ্টা নিয়ে কিভাবে এই অসাধ্য সাধন করলাম তার বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিতে গেলে হয়তো আরও একটি অধ্যায় লিখে ফেলতে হবে।
বারেবারে পিছলে যেতে যেতেও দাঁতে দাঁত চেপে আঁকড়ে ধরেছিলাম পাথরের চাঁইগুলোকে। যুদ্ধশেষে একটা মোটামুটি দাঁড়াবার জায়গা পেয়ে খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিলাম। এবং অবশেষে টের পেলাম আমার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যবস্তু সেই লাইব্রেরীর খুব কাছাকাছি এসে গেছি। চারদিকে তাকিয়ে দেখলাম আমি এসে পৌঁছেছি চারদিক বন্ধ খিলানওলা একটা নিচু গোলাকার সমাধি-গৃহে। এই সমাধি-গৃহের অবস্থা কিন্তু অতটা তথৈবচ নয়। বরং দেখলে মনে হবে দীর্ঘদিন ধরে এর রক্ষণাবেক্ষণ হয়েছে। এর দেওয়ালগুলো আমার টর্চের নাগালের মধ্যেই ছিল। তাই টর্চের আলোয় ভাল করে দেখলাম। এবং দেখে চমকে উঠলাম! আরে! এগুলোতে তো হায়ারোগ্লিফিক লেখা ও আঁকিবুঁকিতে ভর্তি! কিছু কিছু আঁকিবুঁকি তো হুবহু আমার স্বপ্নের মত। বুঝলাম আমার নিয়তি আজ আমাকে এগিয়ে নিয়ে চলেছে সেই আলোআঁধারির দেশে। আমার বাঁদিকের একটা ধনুক আকারের খিলানওলা পথ গেছে দেখলাম, তাই সেদিকেই পা বাড়ালাম। এই পথে এগোতে এগোতে দেখলাম ওপরে আর নীচে যে অংশগুলো এখনও টিকে আছে, এখান থেকে নাগাল পাওয়া যেতে পারে। একটা জিনিস ভেবে অবাক হয়ে গেলাম সমস্ত পৃথিবী থেকে সুরক্ষিত, সৌরজগতের যুগান্তরের নিখুঁত বর্ণনা-সমৃদ্ধ এই তথ্যভাণ্ডার নির্মাণে কি অমানবিক দক্ষতা প্রয়োগ হয়েছে। এই গোটা স্থাপত্যটা নিজেই যেন এক স্বয়ংক্রিয় সিস্টেম! নিখুঁত গাণিতিক পদ্ধতিতে সিমেন্টের সাহায্যে এই বিরাট পাথরগুলোকে বিস্ময়কর ভাবে সাজিয়ে তৈরি করা হয়েছে এই স্থাপত্য। পৃথিবীর কেন্দ্র-মণ্ডলের মতোই মজবুত এর ভর। ভাবতে ভাবতে এগিয়ে চললাম। একটা জিনিস খেয়াল করলাম এই নতুন রাস্তা বানিয়ে নেওয়ার পর তুলনামূলক ভাবে হাঁটতে আমার সুবিধে হচ্ছে বরং একরকম দৌড়েই এগোতে লাগলাম। এই ব্যাপারটা আমাকে একটু হলেও অবাক করল আর ভাবিয়ে তুলল। এযাবৎ ওই দুঃস্বপ্নে আমি যা যা দেখেছিলাম তার সাথে আমি আমার গতিপথের অস্বাভাবিক মিল দেখে যারপরনাই অবাক হয়ে যাচ্ছিলাম। আমার দুদিকে হায়ারোগ্লিফিক নকশা আঁকা ধাতুর দরজা থাকে থাকে তাদের স্বকীয় মহিমায় বিরাজমান। কালচক্রে এই স্থাপত্যের অনেককিছু ধ্বংসস্তূপে পরিণত হলেও এগুলোতে তেমন ভাবে সময় তার থাবা বসাতে পারে নি। ওই দরজার থাকের সারির মাঝে মাঝে ধুলোর পাহাড় তৈরি হয়েছে। বুঝতে পারলাম ভূমিকম্পের ফলে এই ফাঁকের সৃষ্টি হয়েছে। মাঝে মাঝে আবার বিভিন্ন লেখাওলা গম্বুজ রয়েছে, যেগুলো দেখে বোঝা যায় কোন তাকে কি কি খণ্ড রয়েছে তার বিবরণ রয়েছে ওতে। হঠাৎ দেখি সমাধি ঘরের মত দেখতে একটা ঘরের দরজা খোলা! আমিও থমকে দাঁড়িয়ে গেলাম। দেখি এখানে কয়েকটা ধাতব তাক-ওয়ালা আলমারি দিব্যি মাথা উঁচিয়ে রয়েছে, এবং এগুলোতে একটুও ধুলো জমে নি। আমারও এবার গোয়েন্দাগিরির শখ চাগিয়ে উঠল। কসরত করে ওই পেল্লায় আলমারি বেয়ে উঠতে লাগলাম। ওপরের তাকে কয়েকটা রোগা পাতলা নমুনা দেখতে পেলাম। ঠিক করলাম ওগুলো মাটিতে নামিয়ে একটু পরীক্ষা করে দেখতে হবে, ওগুলোতে ঠিক কি লেখা আছে। যেমন ভাবা তেমনি কাজ। মাটিতে নামালাম কয়েকটা পাতলা নমুনা।
এবার উল্টেপাল্টে দেখতে লাগলাম। ধাতব মলাট ওয়ালা বইগুলো লম্বায় ছিল কুড়ি ইঞ্চি আর চওড়ায় পনেরো ইঞ্চি। আর বইগুলোর ঘনত্ব ছিল ইঞ্চি দুয়েক। এগুলোর পাতায় পাতায় হায়ারোগ্লিফিক লেখায় ভর্তি! এগুলোর কিছু কিছু আমার দুঃস্বপ্নে দেখা হায়ারোগ্লিফিকের মত। এবার আমি আর একটু মনোযোগ দিয়ে দেখলাম। এবার আমার মাথায় বিদ্যুতের ঝলকানি দিয়ে উঠল। এগুলোর লেখার পদ্ধতি আমার খুব ভালভাবে পরিচিত। যখন আমি গবেষণা চালাতাম এই ধরনের লেখা আমি অনেক দেখেছি! ডি এরলেটসের কাল্টস ডি গাউলস, লুডউইগ প্রিনের ডি ভারমিন মিস্ট্রিজ, ভন জানৎসের আনঅসপ্রেলিচেন কাল্টেন , আব্দুল আলহাজারদের “নেক্রোনোমিকন” আর সেগুলোর সূত্র ধরে যে যে জিনিস নিয়ে আমি গবেষণা চালিয়েছিলাম, সেটা থেকে এই বইয়ের হায়ারোগ্লিফিক বর্ণমালা যে পদ্ধতি অনুসরণ করেছে, তাতে এর বিষয়বস্তু পুরোপুরি না বুঝলেও এর সম্ভাব্য সারমর্ম কিছুটা হলেও আন্দাজ করলাম। সেলুলোজ দিয়ে তৈরি পাতায় অদ্ভুত রঙিন কালি দিয়ে হায়ারোগ্লিফিকে অনেককিছু লেখা। কত কালচক্রের ইতিহাস যে লেখা রয়েছে আন্দাজ করতে পারলাম। এই হায়ারোগ্লিফিক কোন পরিচিত পার্থিব হায়ারোগ্লিফিক নয়, এ হল সম্পূর্ণ অশুভ অপার্থিব কোন লিপিমালা। আমার শরীরে আশ্রয় নিয়েছিল যে দুর মেঘলোক থেকে আসা কোন প্রাণীর চিন্তন, এ হল তার ভাষায় লেখা বিবরণ! কোন অজানা গ্রহের সৃষ্টির সময়ের বিবরণ হয়তো বন্দী আছে এখানে, তারপর সেটা জায়গা পেয়েছিল ঈথদের সংগ্রহশালায়। তবে আমি নিশ্চিত এ আমাদের পরিচিত সৌরজগতের কোন গ্রহ নয়। এদিকে পাতা ওলটাতে ওলটাতে আমার খেয়াল ছিল না যে আমার টর্চের ব্যাটারির হাল খারাপ। যখন দেখলাম ব্যাটারির দৌলতে টর্চ দপদপ করতে শুরু করেছে, চটজলদি ব্যাটারি পাল্টে নিলাম। আমার সঙ্গে অতিরিক্ত ব্যাটারি সবসময়ই থাকে, তাই কোন অসুবিধে হল না। আমার দুঃস্বপ্নের জন্য আমি এই গোলকধাঁধা আর অলিগলির অনেকটাই চিনতে পেরেছিলাম, তাই জানতাম বলেই সঙ্গে অতিরিক্ত সরঞ্জাম রেখেছিলাম। এদিকে আমার পায়ের শব্দের প্রতিধ্বনি শুনে নিজেরই কেমন একটা অদ্ভুত লাগছিল। কতকাল এই পাণ্ডববর্জিত ধ্বংসাবশেষে কোন জীবিত প্রাণীর পায়ের শব্দ শোনা যায়নি কে জানে? বহুযুগ ধরে জমে থাকা ধুলোর পরতের ওপর নিজের পায়ের ছাপ দেখে নিজেরই বুকটা কেঁপে উঠল। আমার অবচেতন মন ক্রমাগত জানান দিচ্ছিল কোন অশুভ শক্তি হয়তো কোথাও ওত পেতে রয়েছে। এবার আমি আর একটু গভীরে যাবার জন্য নীচের দিকে দৌড় লাগালাম। আমার সামনে শুধু টর্চের আলো। দৌড়নোর সময় টর্চের আলোয় অনেক অদ্ভুত জিনিসের নিদর্শন দেখতে পেলেও, একবারের জন্যও থামলাম না। দৌড়ের গতির সাথে কেন জানি না, হয়তো আমার অবচেতন মনের নির্দেশেই বারেবারে ডানহাত ঝাঁকাতে লাগলাম! যেন আমি আধুনিক প্রযুক্তির কোন বিশেষ কম্বিনেশনের তালা খুলতে চাইছিলাম। স্বপ্নে দেখেছিলাম নাকি সত্যি জানি না, কিন্তু ওই তালাটার ব্যাপারে যেন আমার অবচেতন মন যেন একশো ভাগ নিশ্চিত ছিল। স্বপ্ন না হলেও হয়তো সেই দুঃস্বপ্ন-ভ্রমণের সময় কোন প্রাচীন অপার্থিব শক্তি নিখুঁতভাবে আমাকে ওই তালার গঠনপ্রণালী শিখিয়েছিল। এইসব ধ্বংসাবশেষের সাথে দুঃস্বপ্নের ক্রমাগত মিল খুঁজে পেয়ে আমার মন বারেবারে শিউড়ে উঠেছিল। এই গোটা ধ্বংসাবশেষ যেন কোন অলীক অপার্থিব আতঙ্কের ভগ্নাংশ মাত্র।
ইতিমধ্যে আমি সব থেকে নীচের ধাপে চলে এসেছিলাম। কিন্তু কথায় বলে না, “যেখানে বাঘের ভয়-“! ওই অন্ধকারের নাগপাশের জন্যই হয়তো আমার দৌড়ের গতি কিছুটা কমে গিয়েছিল। আর যে জায়গায় এসে গতিটা কমল, আমার বুক ভয়ে কেঁপে উঠলো। কারণ আমার পূর্ববর্তী অভিজ্ঞতা থেকে আমি জানতাম এই জায়গাটা পার করা সবথেকে কঠিন। কারণ এখানেই রয়েছে সবথেকে নিরাপত্তা-যুক্ত ধাতুর গরাদওলা দরজা। এবং এই দরজা অনধিকার প্রবেশকারীদের জন্য একটা ফাঁদও বটে। এই দরজার পাহারায় থাকতো অনেক রক্ষী। যদিও এখন কোন রক্ষী সেখানে থাকার কথা নয়, কিন্তু তাহলেও ভয়ে আমার হাত পা কেঁপে উঠল। কারণ কোনক্রমে এই ব্যাসাল্টের গুহা পার করলেও ঠিক একই রকম আরেকটা দরজার ফাঁদ আমার জন্য অপেক্ষা করছে। হঠাৎ একটা ঠাণ্ডা কনকনে, ভ্যাপসা হাওয়া আমাকে ওই দরজার দিকে এগিয়ে নিয়ে চলল। আমার ইচ্ছে না থাকলেও ওই হাওয়ার প্রকোপে আমি ওইদিকে যেতে বাধ্য হলাম। যখন ওই হাওয়ার দমক থামল, আমি দেখলাম ওই ধাতুর গরাদওলা হাঁ করে খোলা! কি করে ওটা খুলে গেল আমার মাথায় এলো না। ওই দমকা হাওয়ার জন্যই হবে হয়তো। যাইহোক আমি আর একটু এগোলাম। সামনে আবার সেই সারি সারি ধাতুর তাকওলা আলমারি। এবার মেঝের দিকে তাকালাম। এক-জায়গায় ধুলোর পাহাড় জমেছে, এবং গোটাকতক আলমারি মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। ঠিক এই সময়েই এক অজানা আতঙ্কে আমার বুক কেঁপে উঠল। কারণ যে আলমারিগুলো মুখ থুবড়ে পড়ে আছে, সেগুলো আমার কাছে অপরিচিত ছিল না। সেই বিগ ব্যাং এর সময় থেকে পৃথিবী সৃষ্টির সমস্ত রহস্য লিপিবদ্ধ হয়ে জায়গা নিয়েছিল ওই তাকে। আর অগুনতি বছর ধরে যখন মাঝে মাঝে কিছু বিরতিতে পৃথিবীর বিবর্তন ঘটেছে, এই আলোহীন গোলকধাঁধাও বিধ্বস্ত হয়েছে বারেবারে। আর সেইজন্যই এইসব দানবীয় আলমারি যখন নিজেদের জায়গা ছেড়ে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে, সেই শব্দের প্রতিধ্বনিতে কেঁপে উঠেছে এই পাতালপুরী।
যখন আর একটু কাছে এগোলাম বুঝতে পারলাম ঠিক কি কারণে আমার বুক কেঁপে উঠেছিল। না, ওই ধুলোর পাহাড় নয়। বরং ওই ধুলোর গাদার মধ্যে বিশেষ কিছু আমাকে ভাবিয়ে তুলেছিল। আমি এবার টর্চের আলোয় ভালভাবে জায়গাটা দেখলাম। এখানে ঠিক যতটা ধুলো জমে থাকার কথা, ততটা নেই। ঠিক যেন মাস-খানেক আগে এখান থেকে কিছু সরানো হয়েছে, কারণ বাকি জায়গার ধুলোর আস্তরণ এর তুলনায় যথেষ্ট পুরু। আরও ভালভাবে টর্চের আলো ফেলে যা দেখলাম সেটা আমার কাছে খুব একটা আনন্দদায়ক ছিল না। কারণ ধুলোর ওপর যে তিনটে ছাপ পড়েছিল, সেগুলো ছিল আমার খুব পরিচিত। মিসকাটোনিক ইউনিভার্সিটিতে ক্লাস নেওয়ার সময় আমার চোখের সামনে যে বিদঘুটে অপরিচিত জ্যামিতিক আকার ভেসে উঠেছিল, এগুলো ছিল তারই একটা। ঠিক ওই সময়ই আমার ক্লাসরুমের আকারও গিয়েছিল পাল্টে। ধুলোর ওপর এই ছাপগুলো ছিল কোন কিছুর বর্গাকার চারটে পায়ার। আর ছাপগুলো ছিল প্রায় গোলাকার আর পাঁচ ইঞ্চি মত পুরু। চারটে পায়ার একটা বাকি তিনটের তুলনায় দেখলাম একটু বড়। ঠিক যেন এগুলোকে এখান থেকে সরিয়ে নিয়েও কোন কারণে ফিরিয়ে আনা হয়েছিল। কিন্তু কি কারণ? হয়তো যে কারণে এই দানবীয় ধাতব তাক-ওয়ালা আলমারি মুখ থুবড়ে পড়েছে বা ঠাণ্ডা, ভ্যাপসা হাওয়ার প্রকোপে ধাতুর গরাদওলা এই দরজা খুলে গেছে এক নিমেষেই!
হঠাৎ আমার মনের মধ্যে একটা অদ্ভুত অনুভূতির সৃষ্টি হল, ঠিক কি রকম ভাষায় ব্যাখ্যা হয়তো করতে পারব না, কিন্তু একথা ঠিক যে এখন আমার আর আগের মত ভয় করছিল না। আর ওই পায়ার ছাপগুলো দেখে আমি বুঝতে পারলাম যে আমার স্বপ্নের কিছু প্রভাব এখনও আমার অবচেতন মনে রয়ে গেছে। এদিকে আমার ডানহাত তখনও সেই বিশেষ কম্বিনেশন তালা খোলার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। আর আমি ওই উল্টে পড়া আলমারি আর ধুলোর গাদা পেরিয়ে নিজের অজান্তেই ছুট লাগালাম একটা বিশেষ দিকে, যেন এই রাস্তা আমার কতদিনের পরিচিত! আমার নিজের এই আচরণের কোন ব্যাখ্যা আমি খুঁজে পেলাম না। শুধু আমার শরীরের কার্যকলাপের সাথে তাল মেলাতে লাগলাম আর ভাবতে লাগলাম কোন প্রাণীর চিন্তন এখন আমার শরীরকে নিয়ন্ত্রণ করছে? কোন মানুষ কি আদৌ সেই বিশেষ প্রযুক্তির তালার নাগাল পেতে পারে? যে প্রাণীর চিন্তন এখন আমার শরীরকে নিয়ন্ত্রণ করছে সেকি আদৌ এর কম্বিনেশন জানে? আর জানলেও এতযুগ বাদে সেই তালা কি আদৌ টিকে আছে? মনের মধ্যে প্রশ্নের ঝড় বইতে লাগল। ওই তালাবন্ধ কুঠুরির ওপারে এমন কি রয়েছে যার মুখোমুখি হবার আগে আমার মন এভাবে ভয়ে কেঁপে উঠছে? আমার মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছিল। শুধু এইটুকু মনে ছিল যে আমার দৌড় সাময়িক ভাবে থামিয়ে আমি হাঁ করে তাকিয়েছিলাম একসারি হায়ারোগ্লিফিক লিপি আঁকা বিরাট দরজাওলা আলমারির দিকে। এগুলোর বৈশিষ্ট্য একটু অন্যরকম ছিল। এগুলো দেখলে মনে হচ্ছিল এগুলোর কিন্তু যথেষ্ট রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে তিনটের দরজা আবার হাট করে খোলা। এগুলো দেখে আমার ঠিক কি মনে হচ্ছিল ভাষায় বর্ণনা করতে পারব না, শুধু এটুকু বলতে পারি এগুলো দেখে মনে হচ্ছিল এরা বহুযুগ ধরে আমার পরিচিত। আমি তাকগুলোকে একবার মেপে নিলাম। নাঃ, সহজে এগুলোর নাগাল পাওয়া যাবে না। কোন ফন্দি আঁটতে হবে। খানিকক্ষণ ভেবে একটা উপায় বের করলাম। একটা আলমারির নীচের দিকের খোলা দরজা আর অন্যান্য বন্ধ দরজাগুলোর সাহায্য নিলে হাত পা এর সাহায্যে বেয়ে বেয়ে ওপরে ওঠা যাবে। সেইভাবেই কোনরকম শব্দ না করে টর্চটাকে কামড়ে ধরে উঠতে লাগলাম। আমার ডান হাত যেভাবে কাজ করছিল, আমি নিশ্চিত ছিলাম যে ওই কম্বিনেশন তালা আমি খুলতে পারব। এখন তালাটা কাজ করলে হয়! এদিকে বন্ধ দরজাগুলোর খাঁজে পা লাগিয়ে আমার উঠতে তেমন কোন অসুবিধে হচ্ছিল না। হঠাৎ তাক বেয়ে উঠতে উঠতে ডানদিকে চোখ গেল আর আমার বহু আকাঙ্ক্ষিত সেই তালাটাকে দেখতে পেলাম।
ওপরে চড়তে চড়তে আমার আঙ্গুলগুলো প্রায় অসাড় হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু যেই না আমি তালাটাকে দেখতে পেলাম, ওমনি আমার আঙ্গুলে সাড় ফিরে এলো। কিন্তু চমকের তখনও শেষ হয় নি। আমাকে হতভম্ব করে ওই ধাতব দরজা আস্তে আস্তে খুলে গেল!! যেন আমার আসার জন্যই অপেক্ষায় ছিল।এগিয়ে গেলাম ওই দিকে। আমার ডান হাতের কাছেই একটা হায়ারোগ্লিফিক নকশাওলা বইয়ের তাকে একটা বাক্স ছিল। সেটা দেখে আমার ডানহাত এমনভাবে কাঁপতে শুরু করল যে যন্ত্রণায় প্রায় কুঁকড়ে গেলাম। শুধু মনের জোরে আমি ওই ব্যথাটা ভুলে ছিলাম, নয়তো আর একটু হলেই হাতটা ফসকে যেত আর কি! বাকি তাকগুলোর থেকে এটা একটু বেশিই বড় ছিল আর এর বেধ ছিল ইঞ্চি তিনেক। আর এই বাক্সটাতে ছিল অনেকরকম গাণিতিক নকশা। আমি অনেক কসরত করে বাক্সটার নাগাল পেলাম। তারপর কোটের কলারের সাথে আটকে সেটাকে নিয়ে নিলাম পিঠে। আর চিন্তা নেই, এখন আমার হাত খালি। এবার আমি তরতরিয়ে নীচে নামতে লাগলাম। আমার মনে তখন তীব্র কৌতূহল, আমার এত যন্ত্রণা সহ্য করার পর পুরস্কার হিসেবে যে বাক্সটা পেলাম, কি আছে তার ভেতরে। নীচে নেমে ধুলোর ওপরেই হাঁটু গেড়ে বসলাম। তারপর পিঠ থেকে বাক্সটাকে নিয়ে এলাম সামনে। আমার হাত রীতিমতো কাঁপছিল। বাক্সটা খুলে আমি একটা বই বের করলাম। যেন আমার ভেতর থেকে অন্য কারোর অদম্য ইচ্ছাশক্তি বইটাকে বের করে আনল। এই বইটার মলাটেও আমার পরিচিত হায়ারোগ্লিফিক নকশা আছে। এবার যেন আমি একটু হলেও আমি বুঝতে পারলাম ঠিক কি জিনিস খোঁজার জন্য এতদিন আমি অপেক্ষা করেছি আর এতদূর ছুটে এসেছি। যদি আমি সত্যিই স্বপ্ন না দেখে থাকি, আর যেটা ভাবছি সেটা হয়, তাহলে সমগ্র মানবসভ্যতা যে ভয়াবহতার মুখোমুখি হতে চলেছে, তা সহ্য করার ক্ষমতা তাদের নেই। সবথেকে ভয়ানক ব্যাপার হল যে আমি চেষ্টা করেও এই ঘটনাগুলোকে স্বপ্ন ভেবে উড়িয়ে দিতে পারছিলাম না। এমনকি এটা লিখতে লিখতেই যতবার ঘটনাগুলো মনে পড়ছে, আমার হাত কেঁপে কেঁপে উঠছে।
যাই হোক ঘটনায় ফিরে আসি। বইটার হায়ারোগ্লিফিক নকশাওলা ধাতব মলাটের দিকে তাকিয়ে আমি চুপচাপ বসে রইলাম কিছুক্ষণ। সত্যি বলতে কি বইটার মলাট উলটে ভেতরে কি আছে সেটা দেখার জন্য আমার সাহসে কুলোচ্ছিল না। আমার সেই দুঃস্বপ্নে ড্রোনিং মেশিনের সাহায্যে এটার সারমর্মের অনুবাদ করেছিলাম কিনা সেটাও মনে পড়ছিল না। যা হবে দেখা যাবে ভেবে কপাল ঠুকে আমি মলাট উল্টোলাম। ব্যাটারি বাঁচাবার জন্য মুখ থেকে টর্চটা বের করে বন্ধ করলাম। অন্ধকারে বসে বসে খানিকক্ষণ সাহস সঞ্চয় করলাম। তারপর অবশেষে টর্চ জ্বালিয়ে সেই আলোয় তাকালাম খোলা পাতার দিকে।
——
যা ভেবেছিলাম তাইই। পাতায় যা লেখা ছিল সেটা দেখে আমার দাঁতে কাঁপুনি লেগে গেল। হয় আমি স্বপ্ন দেখছি, নয়তো সময় আর স্থান নিয়ে যা যা থিয়োরি আছে সব ভাঁওতা। আমি ঠিক করলাম যে করেই হোক এই বইটা নিয়ে গিয়ে আমার ছেলে উইনগেটকে এটা দেখাতে হবে। যদিও আশেপাশের অন্ধকারে আমি অন্য কিছুর অস্তিত্ব টের পাইনি, কিন্তু অতীতের সেই ভয়াবহ স্মৃতির ঝলক আমার চারদিকে ভিড় জমাতে লাগল। আমার মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিল। আমি বইটা বন্ধ করে আবার কোটের কলারের সাথে আটকে পিঠে ঝুলিয়ে নিলাম। সত্যিই যে এই পাতালপুরীর অস্তিত্ব আছে তা সবার জানা দরকার। অবশ্য বাইরের জগতের এমনকি আমারও আদৌ কোন অস্তিত্ব আছে কিনা, বুঝতে পারছিলাম না। কিন্তু নীচে নামার সময় আমার যে ভয়টা করে নি, সেটা এবার হতে লাগল। মনের জোরে তো এই অবধি আমি নেমে এসেছি। কিন্তু ওই পরিমাণ প্রতিকূলতা কাটিয়ে আবার ফিরে যাবই বা কি করে? আর একটা ভয় হল ঈথরাও ভয় পেয়েছিল যাদের, তারা হয়তো এখনও এই পাতালপুরীর অন্ধকারে কোথাও ঘাপটি মেরে লুকিয়ে আছে। মনের মধ্যে আরও নানারকম ভয় ঘুরতে লাগল। স্থানীয় আদিবাসীদের ঝোড়ো হাওয়ার গল্প, ধ্বংসাবশেষ, শিষের মত শব্দ, ধুলোর ওপর পায়ার ছাপ, দুঃস্বপ্নে ভেসে আসা জ্যামিতিক আকার- সব মিলেমিশে একেবারে সাড়ে বত্রিশ ভাজা হয়ে গেল।
ঠিক কি ধরণের অজানা আতঙ্ক আমার জন্য অপেক্ষা করছে, তা যদিও আমার ধারনার বাইরে ছিল। কিন্তু তার কিছু কিছু নমুনা আমি আগে দেখেছিলাম। একটা দেখেছিলাম এখানে ঢোকার আগে একটা খাঁজকাটা দেওয়ালের গায়ে আঁকা একটা চিহ্নে। আর একটা দেখেছিলাম প্রথম যে বইটা নামিয়ে নেড়েচেড়ে দেখেছিলাম, তার আগে ধনুকের মত খিলানওলা আঁকাবাঁকা পথ পেরিয়ে গোলাকার গম্বুজওলা হলে। ডানদিকের খিলানটার দিকে তাকালাম। নাঃ এবার ফিরতে হবে। এটা বেয়ে নেমে এখানে এসে পৌঁছলেও ফিরতে আমার যে কি অবস্থা হবে, ভেবেই আমার অবস্থা খারাপ হয়ে গেল। পিঠে এই ধাতব মলাটওলা বইয়ের ভার নিয়ে এই ধ্বংসস্তূপ পেরনো যে খুব সহজ হবে না তা বলাই বাহুল্য! এবং হলও ঠিক তাই। এই ধ্বংসস্তূপের এক একটা টুকরো আমার কাছে হয়ে দাঁড়াল পাহাড়প্রমান বাধা। কিন্তু প্রতিকূল অবস্থা অতিক্রম করে করে আমার এমন অবস্থা দাঁড়িয়েছিল, যে নির্দিষ্ট গন্তব্যে না পৌঁছনো অবধি আমি হাল ছাড়তাম না। এক্ষেত্রেও তাইই হল। আমি দেখলাম অবশেষে আমি এসে পৌঁছেছি সেই পাহাড়ের মত ধ্বংসস্তূপের ঢিপির সামনে, যেটা পেরিয়ে আমি প্রথম একটু যাওয়ার রাস্তা বানিয়ে নিতে পেরেছিলাম। কিন্তু আমার মনে একটা ভয় কাজ করছিল। প্রথমবার এখানে ঢোকার সময় কিঞ্চিত শব্দের সৃষ্টি হয়েছিল। সেটা যেন আর না হয়। কারণ ধুলোর ওপর ওইসব ছাপ দেখে আর এই পাতালপুরীর ভেতর হাড় হিম করে দেওয়া নানারকম শব্দ শুনে আমার আত্মবিশ্বাস পুরোপুরি আগের মত ছিল না। আর ওই বাক্সবন্দী বইটা পিঠের ওপর হয়ে দাঁড়িয়েছিল গোদের ওপর বিষফোঁড়া। কিন্তু আমি ওসব তোয়াক্কা না করে এগোতে লাগলাম বেয়ে বেয়ে। টর্চটা কামড়ে ধরলাম মুখে আর বইয়ের বাক্সটাকে ওঠার পথে পথে যা যা ফাঁকফোকর পাচ্ছিলাম, সাময়িক বোঝা লাঘব করার জন্য ঠেলে ঠেলে দিচ্ছিলাম। কিন্তু ওই সাময়িকই! তার পরের মুহূর্তেই পিঠের বোঝার জন্য বেয়ে উঠতে আমার অবস্থা কাহিল হয়ে যাচ্ছিল।
এদিকে এই কসরত করতে করতেই ঘটল আসল বিপত্তি! যেইনা পরের ধাপে একটা পাথরের ফাঁকে বইয়ের বাক্সটাকে চালান করতে যাব, আমার হাত ফসকে বাক্সটা ঢাল বেয়ে গিয়ে পড়ল ধ্বংসস্তূপের গাদায়। আর শুধু যে পড়ল তাই নয়, পড়ে এমন একটা শব্দের সৃষ্টি করল যে তার প্রতিধ্বনিতে এই পাণ্ডববর্জিত পাতালপুরীর প্রত্যেকটা দেওয়াল যেন কেঁপে উঠল! আর আমার মেরুদণ্ড বেয়ে ভয়ের একটা ঠাণ্ডা স্রোত বেয়ে গেল। আমি ঠিক যে জিনিসটা মনেপ্রাণে চাইনি, সেটাই হল। আর এই সময়ই বহু দুর থেকে যেন একটা খনখনে, তীব্র শিসের মত শব্দ ভেসে এলো আমার কানে। শব্দটা যে ঠিক কি রকম ভাষায় বর্ণনা করতে পারব না। সত্যি কথা বলতে কোন পার্থিব শব্দের সাথে এর কোন মিল নেই, তাই কোনকিছুর সাথে তুলনা দিয়ে এটা বোঝাতে পারব না। আমি নিজেকে সান্ত্বনা দেবার জন্য বোঝাতে লাগলাম, ওই শব্দ সম্পূর্ণ আমার কল্পনা। কিন্তু আমার সচেতন আর অবচেতন মন এর বিরোধিতা করতে লাগল। যদিও আমার আতঙ্কের শেষ এতেই ঘটে নি, কারণ এরপর যেটা ঘটল, সেটা এতটাই ভয়ানক ছিল যে ভাবলেও এখন আমি শিউড়ে উঠছি। আমি বইয়ের বাক্সটাকে হস্তগত করার জন্য দৃঢ়ভাবে টর্চটা ধরে আবার লাফিয়ে লাফিয়ে নেমে এলাম। আমি তো তখন বাইরের দুনিয়ায় চাঁদের আলো আর মরুভূমিতে পৌঁছোবার আনন্দে মশগুল! তাই আমার ধারণা ছিলনা বইটাকে হস্তগত করার পরও এই পৈশাচিক ঘটনাক্রমে কোন ইতি ঘটবে না। জিনিসটা ঘটল ওই ধ্বংসস্তূপের পাহাড়ের ঢিপির ওপর ওঠার পর। হঠাৎ করেই আমার পা গেল পিছলে, আর আমি শুধু দেখলাম কিছু গাঁথনি আর পাথরের টুকরোর ধ্বসের সাথে আমিও গড়িয়ে পড়ছি। আর সেই ধ্বসের কি আওয়াজ! মনে হবে একশোটা কামান যেন একসাথে দাগা হয়েছে। এই বিপর্যয়ের ঠিক পরেই কি ঘটেছিল, আমার মনে ছিল না। যখন আমার হুঁশ এলো দেখলাম চাতালের ওপর পড়ে আছি। আমার পাশেই পড়ে রয়েছে আমার টর্চটা আর সেই বইয়ের বাক্সটা। শুধু এইটুকু মনে করতে পারলাম, ওই সশব্দ ধ্বসের সাথে প্রবল গতিতে আমিও নিমজ্জিত হতে চলেছি কোথাও। আর ওই ধ্বসের শব্দে আমার চিৎকারও ঢেকে গিয়েছিল। এদিকে ওই ধ্বসের বিকট শব্দের প্রতিধ্বনি তখনও যেন ফিরে ফিরে আসছে পাতালপুরীর দেওয়াল থেকে। আর ঠিক সময়ই আবার সেই অপার্থিব খনখনে শিসের মত শব্দটা ভেসে এলো খুব স্পষ্টভাবে। নাঃ এবার আর কোন ভুল হবার কথা নয়। কারণ এবার শব্দটা আর আমার পিছনদিক থেকে নয়, আসছে সামনের দিক থেকে! সামনের সেই খোলা দরজার ওপারে থাকা সীমাহীন অন্ধকারের মধ্যে থেকে। আর শুধু শব্দই নয়, তার সাথে বইছে এক ভয়ঙ্কর দমকা হাওয়া। আর হাওয়াটা কোন ঠাণ্ডা,সোঁদা বা ভ্যাপসা হাওয়া নয়। যেন ওই নরকের অন্ধকারের মধ্যে থেকে কোন অশুভ উদ্দেশ্য নিয়েই এর আগমন। আর এই হাওয়াটা আমাকে কেন্দ্র করেই যেন কোন বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে বইতে লাগল। আর প্রত্যেক মুহূর্তে এই হাওয়ার দমক বেড়ে চলল। সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলল সেই খনখনে শিসের শব্দ। হাওয়ার ধরনটা দেখে মনে হল যেন এটা কোন ফাঁস বা কাউবয়দের ল্যাসোর মত আমাকে বেঁধে ফেলতে চাইছে। এবং এই হাওয়ার দমকের সামনে আত্মসমর্পণ করা ছাড়া আমার আর কোন উপায় ছিলনা। শুধু খেয়াল ছিল একটা ভয়ানক চক্রাবর্তের সাথে আমিও ঘুরছি।
কতক্ষণ ঘুরেছিলাম খেয়াল নেই, কারণ এরপরেই আমি টর্চ আর বইয়ের বাক্স সহযোগে নিজেকে আবিষ্কার করলাম কমকরে দু ধাপ নীচের একটা চাতালের ওপর পড়ে আছি, যেখানে ওই গুপ্ত দরজাগুলো হাঁ করে রয়েছে। আমার রীতিমতো কান্না পেল। কিন্তু দেখলাম কান্নার বদলে আমি বিড়বিড় করছি নিজের মনে- হয়তো এটা গোটাটাই একটা স্বপ্ন, হয়তো আমার ঘুম ভাঙবে আর্কহ্যামের পাগলা গারদে কিংবা মরুভূমিতে আমাদের ক্যাম্পে। যদিও আমি জানতাম ওই ফুট চারেক ফাঁকটা আরেকবার পেরোতে হবে। কিন্তু হয়তো এবার আমার জন্য নতুন কোন অজানা আতঙ্ক অপেক্ষা করছে। আমি ভেবে দেখলাম লাফ দিয়ে দিয়ে আমি এগিয়ে যেতে পারব, কিন্তু এক্ষেত্রে আমার সঙ্গী সেই অপার্থিব খনখনে শিস-ওয়ালা বিভীষিকা। এদিকে আমার টর্চের আলো ক্রমশ ক্ষীণ হয়ে যাচ্ছে। অর্থাৎ আমাকে আমার স্মৃতিশক্তির ওপর ভর করেই এগোতে হবে। আর ভেবে দেখলাম এগিয়ে যেতে গেলে আমাকে এই ভয় কাটাতেই হবে। আর তার জন্য আমাকে এই নারকীয় আতঙ্কের মুখোমুখি হতে হবে। এইসব বাধাবিপত্তির কথা ভাবলে যেটুকু সাহস সঞ্চয় করেছি সেটুকুও গায়েব হয়ে যাবে। তাই আমি আবার এগোতে লাগলাম। আর ওই ফাটলের কিনারা দেখতে পেলাম। সাহসে ভর করে যেই না এগোতে যাব, ওই ঝোড়ো দমকা হাওয়া, নারকীয় অন্ধকার, অপার্থিব শব্দ সবকিছুর মিলিত একটা ঘূর্ণি আমাকে গ্রাস করল। শুধু ক্ষীণ স্মৃতি হিসেবে মনে আছে আমি ওই নারকীয় চক্রাবর্তে হারিয়ে যাচ্ছি। গলা ফাটিয়ে চিৎকার করলেও ওই চক্রাবর্তের মিলিত শব্দের সামনে তা হারিয়ে গেল অচিরেই।
ব্যাস, এই ছিল আমার অভিজ্ঞতা। মানে আমার যতটুকু মনে ছিল আমি লিপিবদ্ধ করলাম। এর বেশি কিছু বলতে গেলে হয়তো আমাকে আশ্রয় নিতে হবে আমার উন্মাদনা কিংবা অলৌকিক তত্ত্বের। স্বপ্ন, দুঃস্বপ্ন,স্মৃতি, পাগলামি সবকিছুর মিলিত যোগফলে হয়তো জন্ম হয়েছিল কোন অপার্থিব বিভ্রমের যার সাথে এই পার্থিব জগতের কোনকিছুরই মিল নেই। এর বেশি আর কিই বা বলতে পারি? যুগ যুগ ধরে এই মহাজাগতিক বিবর্তন, বিভিন্ন গুপ্তবিদ্যা সংক্রান্ত বই নিয়ে পড়াশোনা, রাতের পর রাত দুঃস্বপ্নের মোকাবিলার যোগফলই ঘটেছিল হয়তো বা। তবে এরপরেও কিন্তু ওই ভয়ানক শহর আমার স্বপ্নে হানা দিয়েছিল। আমিও তখন ঈথদের একজন হয়ে গিয়ে শঙ্কু-আকৃতির দেহ নিয়ে চলাফেরা করতাম। শুঁড়ের সাহায্যে তাক থেকে বই নামিয়ে নিতাম আবার রেখেও দিতাম। তারপর এই পাতালপুরীর ভয়ানক স্মৃতি(সে সত্যি মিথ্যে যাই হোক না কেন) আর সবশেষে নারকীয় চক্রাবর্তে হারিয়ে যাওয়া সব মিলিয়ে কোনটা কোনটা সত্যিই ঘটেছিল আর কোনটা নিছকই আমার কল্পনা তা এই মুহূর্তে হয়তো আমার পক্ষে বলা মুশকিল। কারণ এই সবকিছুই ঘটেছিল উল্টো-ক্রমে। নিজেকে ঈথরুপে দেখা, চক্রাবর্তে হারিয়ে যাওয়া, দমকা হাওয়া আর খনখনে শিসের শব্দ, ধ্বংসস্তূপ বেয়ে ওঠা, বইয়ের বাক্সটা খুঁজে পাওয়া, হায়ারোগ্লিফিক নকশাওলা বইয়ের তাক, আঁকাবাঁকা খিলানওলা পথ, অস্ট্রেলিয়ার মরুভূমিতে মাথা ফুঁড়ে ওঠা নকশাওলা পাথরের চাঁই, চাঁদনী রাত- সবকিছু।
এই দৃশ্যায়নের উল্টো ক্রমপর্যায় যখন শেষ হল দেখলাম অস্ট্রেলিয়ার সেই মরুভূমিতে বালি খামচে পড়ে আছি। আমার চারদিকে এক অদ্ভুত হাওয়া বইছে শনশন করে, এই হাওয়া কোন পার্থিব হাওয়া নয়। আমার জামাকাপড়ের অবস্থা রীতিমতো শোচনীয়। পুরো ফর্দাফাঁই! দেখলে মনে হবে কোন যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ফিরেছি। সারা শরীর কেটে ছড়ে গেছে। সচেতন অবস্থায় আসতে বেশ কিছুক্ষণ সময় লেগে গেল। স্বপ্ন, অভিযান – সবকিছুই ক্ষীণ স্মৃতি হিসেবে রয়ে গেল! কোথা থেকে আমার স্বপ্ন শুরু হয়েছিল আর কোথায়ই বা অভিযানের শেষ হয়েছিল, আমার কিছুই মনে নেই। আমার আশেপাশে কয়েকটা রাক্ষুসে পাথরের চাঁই যেন দুঃস্বপ্নের অভিযানের সাক্ষী হয়ে ব্যাঙ্গের হাসি হাসছে। যাই হোক একটা দুঃস্বপ্নের অভিযান, একটা নারকীয় আতঙ্কের প্রহরের সমাপ্তি ঘটল অবশেষে। এর মধ্যে কতটা সত্যি আর কতটা আমার কল্পনা বা স্বপ্ন সেটা অজানাই রয়ে গেল। আমার টর্চ, আমার সংগ্রহ করা বইয়ের বাক্স কিছুই আমার আশেপাশে খুঁজে পেলাম না। ওগুলো থাকলে হয়তো সাক্ষী হিসেবে কাজ করত। ওই বইয়ের বাক্সটা দুটো দুনিয়ার মধ্যে মিসিং লিংকের কাজ করতে পারত। কিন্তু সত্যিই কি কোন পাতালপুরী ছিল? বা ওই বইয়ের বাক্সটা, অথবা সেই প্রাচীনতম সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ? নাকি সবই আমার কল্পনা? কিন্তু আমার এই প্রশ্নগুলোর উত্তর দেওয়ার জন্য আমার আশেপাশে মরুভূমির রুক্ষ বালি ছাড়া আর কিছুই ছিলনা। সেই অশুভ হাওয়াটা আর বইছিল না। রাঙাভাঙা চাঁদও পশ্চিমে ঢলে গিয়েছিল। আমিও কোনরকমে আমার ক্ষতবিক্ষত শরীরটাকে নিয়ে উঠে দাঁড়ালাম, তারপর রওনা দিলাম ক্যাম্পের দিকে। কিন্তু আমার মনে একটা প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে লাগল। যদি আমি জ্ঞান হারিয়ে গোটাটাই স্বপ্ন দেখে থাকি, তাহলে আমি এতক্ষণ বেঁচে রইলাম কি করে? আরও একবার সেই উপকথার গল্পগুলো আমার মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হল। যদি ওই পাতালপুরীর অস্তিত্ব সত্যি হয়ে থাকে, তাহলে ঈথরাও সত্যি! আর বিশ্বব্যাপী কালচক্রের সেই চক্রাবর্তও একটা হৃদয়বিদারক সত্যি ছাড়া কিছু নয়। সত্যিই হয়তো আমি হারিয়ে গিয়েছিলাম কয়েকশো কোটি বছর আগের প্রাক মানবসভ্যতার যুগে আমার সেই অন্ধকারের দিন-গুলোয়। হয়তো সত্যিই প্যালিওজিয়ন যুগের কোন ভিনগ্রহের ভয়ংকরের মনন আমার এই শরীরটাকে ব্যবহার করেছিল সময় অভিযানের বাহন হিসেবে। কিন্তু এর কিছু অংশও যদি সত্যি হয়, তাহলে তা মানবসভ্যতার জন্য অপেক্ষা করছে সেই ভয়াবহ অকাল তমসা! পাশাপাশি একথাও ঠিক এগুলোকে সত্যি হিসেবে প্রমাণ করার জন্য আমার কাছে কোন প্রমাণ ছিল না। যাওবা ওই বইয়ের বাক্সটা ছিল, সেটাও হারালাম! অবশ্য সত্যি না হলে সেটা গোটা মানবসভ্যতার জন্যই আশীর্বাদ।
যাইহোক উইনগেটের জন্য সবই খুঁটিনাটি আমি লিখে রাখলাম। একজন মনস্তাত্ত্বিক আর আমার বিপর্যয়ের সাক্ষী হিসেবে ওই নাহয় এগুলোর বিচার করুক। আর শেষ করার আগে একটা কথা বলে রাখা ভাল, ওই পাতালপুরীর নরকে টর্চের আলোয় যখন আমি বাক্স থেকে বইটা বের করে দেখেছিলাম তখন ঠিক কেন শিউড়ে উঠেছিলাম। ওই বইয়ের সেলুলোজের পাতায় কোন প্রাচীন হায়ারোগ্লিফিক বর্ণমালা ছিল না। যা ছিল সেটা সত্যি হলে সময় আর স্থানের শিশুসুলভ সূত্রের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা মানবসভ্যতা যেকোনো দিন ডুবে যাবে সেই ভয়াবহ অকাল তমসায়। ঈথরাও যাদের ভয় পেয়েছিল তারা শাসন করবে এই গোটা মহাবিশ্ব! হ্যাঁ, ওই বইয়ের সেলুলোজের পাতায় হায়ারোগ্লিফিক বর্ণমালার বদলে আমি দেখেছিলাম নিজের হাতের লেখায় রোজকার খুঁটিনাটি বিবরণ! যে ভাষায় আমি কথা বলতাম মিসকাটোনিক ইউনিভার্সিটিতে, সেই চালু ইংরেজিতে!
(সমাপ্ত)
Tags: দ্বিতীয় বর্ষ প্রথম সংখ্যা, ধারাবাহিক অনুবাদ গল্প, রূপক ঘোষ, সৌমেন চট্টোপাধ্যায়