অকাল তমসা পর্ব – ২
লেখক: সৌমেন চট্টোপাধ্যায়
শিল্পী: রূপক ঘোষ
পর্ব – ২
এতক্ষণ যা যা লিখেছি তা থেকে নিশ্চয়ই আমার স্বপ্ন তথা দুঃস্বপ্নগুলো কতখানি ভয়ানক ছিল তা বোঝা গেছে। ইতিমধ্যে আমি বেশ টের পাচ্ছিলাম যে বদ্ধ পাগল হবার প্রাথমিক ধাপে আমি প্রবেশ করে ফেলেছি। মাঝে মাঝে ভাবতাম আমার আগে যারা এই ঘটনার শিকার হয়েছে তারাও কি এরকম পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছিল? কে জানে! একদিকে এই সচেতন আর অবচেতন মন যুদ্ধ চালাত আর অন্যদিকে আমার মগজে এইসব বিদঘুটে ভাবনা পাকাপাকি জায়গা দখল করে বসেছিল। ও, একটা কথা বলাই হয়নি, আমার ওই উপকথার থিয়োরিগুলো কিন্তু ইতিমধ্যে স্বীকৃতির তকমা পেয়েছিল। এমনকি ভিনগ্রহীদের মতবাদে বিশ্বাসীরাও আগে ঘটে যাওয়া অনেক কেসের হদিশ দিয়ে আমাকে বিস্তর সাহায্য করেছিলেন। সবথেকে আনন্দদায়ক বিষয় হল তাঁরা আমাকে পাগল তো বলেনই নি বরং এটাকে সাময়িকভাবে স্নায়ুবৈকল্যের উপসর্গই বলেছিলেন। আমার কাজ ছিল শুধু তথ্যসংগ্রহ আর বিশ্লেষণ আর ওনাদের কাজ ছিল মনোবিজ্ঞানের আলোকে সেগুলোর ভুল সংশোধন। এমনকি কিছু ডাক্তার তো আমার আর আমার ওই দ্বৈত সত্ত্বার ওপর রীতিমতো পড়াশোনা আরম্ভ করে ফেলেছিলেন।
যখন আমার প্রথম স্মৃতি-বিভ্রাট ঘটে তখন কিন্তু এগুলো টের পাই নি। সত্যি বলতে কি ওইসব উদ্ভট ব্যাপারস্যাপার তখন আমাকে পুরোপুরি ঘেঁটে দিয়েছিল। একটা অজানা আদিম অপার্থিব আতঙ্ক আমাকে সবসময় কুরে কুরে খেত। অবস্থা এমন পর্যায়ে গিয়েছিল যে যাতে নিজের চেহারা দেখতে না হয় তাই আয়না দেখার পাটই দিয়েছিলাম চুকিয়ে। দাড়িও কাটতাম নাপিতের কাছে গিয়ে। আমার চোখ সবরকম রং সহ্য করতে পারত না তাই নীল বা ছাইরঙা পোশাক পরা কোনও লোককে দেখলে একটা অদ্ভুত স্বস্তি পেতাম। বাদবাকি সময় চাউনি নিচের দিকেই রাখতাম; সরাসরি কোনদিকে তাকাতাম না। অবশ্য এগুলো আমার ওই উদ্ভট কল্পনার কায়িক আকার নেওয়ার অনেক আগের ঘটনা। ইতিমধ্যে আমি কিন্তু টের পাচ্ছিলাম কেউ যেন ইচ্ছে করে ওইসব দৃশ্যের ঝলকগুলো আমার সামনে হাজির করছে যাতে আমি যোগসূত্রগুলো খুঁজে পাই। সত্যি বলতে কি মানেগুলোও আমি আস্তে আস্তে বুঝতে পারছিলাম। কালের চক্রের সাথে সাথে ওই অদ্ভুত জ্যামিতিক আকার, পৈশাচিক দৃশ্য আর অন্যদিকে আমি আর মাঝখানে সেই যোগসূত্র। এটাও বুঝলাম কেউ ওগুলোর সাথে আমার মাধ্যমে সংযোগস্থাপন করতে চাইছে।
এবার আসা যাক আমি যে ঝলকগুলো দেখতাম সেগুলো প্রসঙ্গে। প্রথমেই বলি ওগুলো যতটা না ভয়ানক ছিল তার থেকে অনেক বেশি ছিল উদ্ভট। যেটা আপনাআপনিই একটা ভয়াবহতার সৃষ্টি করত। আমি দেখতাম আমি দাঁড়িয়ে আছি পেল্লায় পেল্লায় পাথুরে খিলানওয়ালা একটা কুঠুরির মধ্যে। অনেকটা রোমান কায়দায় তৈরি ওই খিলানগুলো এমনই অদ্ভুতভাবে খাড়া থাকতো যে মনে হত, যতই মাথা উঁচিয়ে দেখি না কেন – ওগুলো কোথায় যেন হারিয়ে গেছে! শুধু আশেপাশে তৈরি করেছে আলোআঁধারি কিছু ছায়া। প্রায় রোমান কায়দায় তৈরি বিরাট বিরাট গোলাকার জানলা, খিলানওয়ালা দরজা, মাঝেমাঝেই গোলাকার বেদির মত টেবিল, দেওয়ালে আলোআঁধারি ঢাকা কাঠের তাক – যেগুলো ঠাসা থাকত আঁকাবাঁকা হায়ারোগ্লিফিকের মত ভাষা খোদাই করা বইয়ে – এই হল ওই কুঠুরির বর্ণনা। এখন বলার বিষয় হচ্ছে সবকিছুই ছিল সাধারণ ঘরের থেকে অনেক অনেক বড়। পাথুরে কুঠুরিতে অদ্ভুত সব প্রাগৈতিহাসিক জ্যামিতিক নকশা খোদাই করা থাকত। গোটা কুঠুরিটাই ছিল যেন পেল্লায় আকারের এক গম্বুজ! আর একটা অদ্ভুত ব্যাপার ওখানে কোনও চেয়ার ছিল না। কাঠের তাকে হায়ারোগ্লিফিক মার্কা বইয়ের সাথে থাকত কিছু কাগজের তাড়া – যেন লেখার কাজে কেউ ওগুলো ব্যবহার করে। আর থাকত চকচকে ধাতুর তৈরি কিছু বয়াম যার ছুঁচলো ছিপিগুলোতে মরচে পড়ে গেছে। কুঠুরিতে একটা উঁচু পাদানি ছিল, তাই মাঝেমাঝে আমি ওই পাদানিতে উঠে ওপর থেকে গোটা ঘরটাই দেখতে পেতাম। আলোর কাজ করত ওই কুঠুরিতে রাখা কিছু গোলাকার স্ফটিক। ওই আলোতে বেশ অদ্ভুত ধরনের কিছু যন্ত্রও দেখতে পেতাম। যন্ত্রগুলো অনেকটা আমার সেই অভিশপ্ত দিনে তৈরি করা বিটকেল রড আর নল-ওয়ালা খুড়োর কলের মতই দেখতে ছিল। কিছু মোটা গরাদওয়ালা জানলাও ছিল, যদিও আমি কখনই ওগুলোর ধারেকাছে যাওয়ার সাহস দেখাই নি! এরপর স্বপ্নে আরও কিছু জিনিস যোগ হল। আমি দেখতাম ওপরে নীচে দানবীয় নকশাওয়ালা এক পাথুরে রাস্তা দিয়ে হেঁটে বেড়াচ্ছি। কোন রাস্তাই তিরিশ ফুটের কম চওড়া ছিল না এবং কোথাও ছিল না কোন সিঁড়ি। রাক্ষুসে মূর্তিগুলো কম করে হাজার ফুট লম্বা ছিল, কারণ ওগুলো দেখলে মনে হত ওগুলো যেন আকাশে মিলিয়ে গেছে। এছাড়াও ছিল কালো রঙের নানা আকারের খিলান আর মুখ আটকে রাখা কিছু দরজা। হয়তো ওগুলোর আড়ালে কোন ফাঁদ পাতা ছিল, দেখলেই মনে হত ওগুলো কখনও খোলা হয় নি। একটা আবছা, ভয়ঙ্কর বিপদের আভাস পেয়ে আমি শিউরে উঠতাম। আমার নিজেকে ওই আতঙ্ক-পুরীতে এক বন্দি মনে হত। দেওয়ালে আঁকাবাঁকা হায়ারোগ্লিফিক নকশাগুলো যেন আমাকে দেখে ঠাট্টা করে বলত – এ যাত্রায় বেঁচে গেলে হে!
এরপর আমার স্বপ্নে যোগ হল বেশ সুন্দর দেখতে গোল-গোল কিছু জানলা আর ওই আতঙ্ক-পুরীর ছাদ। বিরাট ওই ছাদ থেকে আমি একটা বাগান দেখতে পেতাম। বাগানের বেশিরভাগটাই ছিল পাথুরে আর ঢালু। বাগানের চারদিকে আরও অনেক বিরাট বিরাট বাড়ি দেখতাম। ওই বাড়িগুলোতেও এরকম বাগান ছিল। বাড়িগুলোর সামনে দিয়ে কম করে দুশো ফুট চওড়া রাস্তা থাকত। বাড়িগুলোর এক একটার আকার ছিল এক এক রকম। কিন্তু কোনটাই চওড়ায় পাঁচশো ফুট আর লম্বায় হাজার ফুটের কম ছিল বলে মনে হয় না। এক একটা এতই উঁচু ছিল যে মনে হত কোন পাহাড়ি টিলার ওপর রয়েছে। আর মিশে গেছে কোন ধুসর জগতে, হয়তো যেটাকে আমরা স্বর্গ বলে থাকি। বাড়িগুলো দেখলে মনে হত পাথর আর কংক্রিট দিয়ে তৈরি। এবং ওই বাড়িগুলোর গায়েও আমার আতঙ্ক-পুরীর মত হায়ারোগ্লিফিক নকশা আঁকা থাকত। চারদিকে উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা ওই বাড়িগুলোর কোন কোনটার সমান ছাদেই বাগান থাকত। আর যে বাড়িগুলো আমার নজরের আওতার বাইরে থাকত সেগুলোতে কোন বাগান দেখতে না পেলেও মনে হত ভেতরে বাগান রয়েছে। কিছু কিছু জায়গায় নলের মত দেখতে কিছু উঁচু টাওয়ার দেখতাম। সবকিছু ছাপিয়ে যাওয়া এই টাওয়ারগুলোর গায়ে খোদাই করা বিটকেল কারিগরিওয়ালা নকশাগুলো দেখে আমি বিস্ময়ে হতভম্ব হয়ে যেতাম। টাওয়ারগুলোর ওপরটা ছিল গোলাকার আর তাতে মোমবাতির মত একটা ক্ষীণ আলো দেখা যেত। টাওয়ারগুলোতে কোন দরজা বা জানলা দেখতে পেতাম না। এছাড়াও কিছু ছোট ছোট ভাঙাচোরা বাড়ি দেখতে পেতাম। দেখলে মনে হত অগুনতি বছর ধরে ওগুলো একইভাবে রয়েছে। অবশ্য দেখতে ছোটোখাটো হলেও ওগুলো দেখে ওই বন্ধ দরজাগুলোর মতই ভয় পেতাম।
আবার আসি ওই বাগানের কথায় যেগুলো দেখলেই শিরদাঁড়া দিয়ে একটা ঠাণ্ডা ভয়ের স্রোত নেমে যেত। বারবার বাগান বলছি কারণ ওখানে নানারকম অদ্ভুত ফুল-বিহীন ছত্রাকের মত ফ্যাকাসে গাছপালা দেখতাম। আর ছিল সবকিছুকে টেক্কা দেওয়া পাম গাছের মতই দেখতে একটা ভুতুড়ে গাছ। পেল্লায় ওই গাছ থেকে নেমে আসা শুঁড়গুলো দেখলে আবার মনে হত বাঁশগাছ। এছাড়াও ছিল পাহাড়ি এলাকার মত কিছু ঝোপঝাড় আর গাছপালা। কিছু কিছু বাড়ির ছাদের বাগান থেকে আবার কিছু দানবীয় ছত্রাক বাড়ির গা বেয়েই নেমে আসত। দেখলে মনে হবে যেন গিলে খেতে আসছে। তবে কোথাও কোথাও আবার শৌখিন টপিয়ারি ধাঁচের গাছও দেখা যেত। বাগান, বাড়ি, রাস্তা যেমনই হোক, আকাশ সবসময় মেঘলা থাকত। কোন কোন সময় প্রবল বৃষ্টি হতেও দেখেছি। শুধু একবার বোধহয় সূর্যের মত কোনকিছুর একটা ঝলকানি দেখেছিলাম। সূর্যের মত বললাম কারণ সূর্যের থেকে আকারে ওটা ছিল অনেক অনেক বড়। রাতের আকাশ খুব কমই বুঝতে পারতাম। একবার কিছু তারা দেখতে পেলেও ভালো করে বুঝতে পারিনি। মনে হত আমি যেন পৃথিবীর এক অজানা গোলার্ধে রয়েছি।
***
১৯১৪ র অক্টোবর মাসের পর থেকে কিছু খাপছাড়া স্বপ্ন দেখতে শুরু করলাম। আমি দেখতাম আমি যেন একটা শহরের ওপর দিয়ে ভেসে বেড়াচ্ছি। সেই শহর যেখানে আমার ওই আতঙ্ক-পুরীও ছিল। ওপর থেকে নানারঙের জঙ্গল দেখতে পেতাম। ওই জঙ্গলগুলোর এক একটা গাছ এতটাই বড় ছিল যে দেখলে শিউরে উঠতাম। আমার বন্দীনিবাস আতঙ্ক-পুরী যে শহরে ছিল তার আশেপাশেও আরও অদ্ভুত দেখতে কিছু শহর দেখতাম। একবার তো মাইলের পর মাইল জোড়া ব্যাসাল্ট পাথরের ধ্বংসাবশেষও দেখেছিলাম। সব থেকে বিস্ময়কর ব্যাপার হল ওই ব্যাসাল্টগুলোর গায়েও নকশা আর কারিগরির মত দেখেছিলাম, ঠিক যেমনটা দেখেছিলাম আতঙ্ক-পুরীর দেওয়ালে! আর একবার ওই গম্বুজের ধারেই ধীর-স্থির, স্রোতহীন এক সমুদ্র দেখেছিলাম।
আমি আগেও বলেছি যে সব দৃশ্যর ঝলক আমি দেখতাম তার থেকে ঢের বেশি ভয়ের স্বপ্ন অনেকে দেখে থাকেন। এবং একটা সময় আমি এগুলোকে স্বাভাবিক বলে মেনেও নিয়েছিলাম। সত্যি বলতে কি ওই ঘটনার আগে কস্মিনকালেও আমি স্বপ্ন-বিলাসিতা করিনি। বরং স্বপ্ন নিয়ে এযাবৎ যা যা তর্ক চালিয়েছি সবই ছিল কিছু মান্ধাতা আমলের পুঁথিগতবিদ্যার প্রতিফলন। কয়েকমাস পর থেকেই কিন্তু গল্প আর এক রইল না। যা যা স্বপ্ন দেখতাম তার প্রায় সবটাই স্মৃতির মধ্যে থেকে যেত; ফলে আমার মনের ভেতর জমে থাকা ভয় এক নারকীয় আকার ধারণ করল। শুধু তাই নয় যখন আমার মগজ ওই দুঃস্বপ্নের সাথে আমার সচেতন অবস্থায় থেকে দেখা ঝলকগুলোকে মেলাতে শুরু করল, আমি বুঝতে পারলাম ১৯০৮ থেকে ১৯১৩ এই সময়ের মধ্যে আমার যে দ্বিতীয় সত্ত্বার সৃষ্টি হয়েছে, তার কাছে আমার ন্যাথানিয়েল উইনগেট পিসলি নামক সত্ত্বাটা গোহারান হেরে গেছে।
ইতিমধ্যে আমার দুঃস্বপ্নে অনেক খুঁটিনাটি তথ্য আসতে শুরু করেছে, ফলে ভয়াবহতা বেড়ে গিয়েছিল কয়েকশো গুন, আমি বুঝতে পারছিলাম যে আমার কিছু করা উচিত,কিন্তু আমার কিছুই করার ছিলনা। ১৯১৫ র অক্টোবর মাসের আগে পর্যন্ত এই স্বপ্ন তথা দুঃস্বপ্নের জাল বিছনোর পর্ব চলল বেশ ভালোভাবেই। এরপরেই আমি বিস্মৃতি আর দৃষ্টিবিভ্রমের ওপর বিভিন্ন কেস ঘাঁটতে শুরু করলাম। গবেষণার উদ্দেশ্য একটাই, যদি ওই দ্বিতীয় সত্ত্বাকে হারিয়ে ন্যাথানিয়েল উইনগেট পিসলিকে জেতানো যায়! আগেই বলেছি এতে ফল হয়েছিল হিতে বিপরীত! আমার মনে এমন ধারনাও আসতে শুরু করেছিল যে এই সব গবেষণার ফলেই হয়ত আমার অবচেতন মনে তার ছাপ পড়ছে এবং ফলস্বরূপ ওই দুঃস্বপ্ন। কারণ ওইসব কেস ঘেঁটে দেখলাম আগের অধিকাংশ ব্যক্তিরই ভূতত্ত্ব সম্পর্কে না ছিল কোনও জ্ঞান আর ওই কেসগুলোতে তারা ঠিক কি ধরনের দৃশ্য দেখত সে সম্পর্কেও ছিলনা কোনোরকম উল্লেখ। যেটুকু ছিল তা থেকে বুঝলাম এরা বিভিন্ন অতিকায় বাড়ি, জংলা বাগান ইত্যাদি দেখত। আর একটা ব্যাপার লক্ষ্য করার মত ছিল, এদের সবাই ধর্মবিরোধিতা করতে গিয়ে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে বসেছিল। সব থেকে জঘন্য ব্যাপার ইতিমধ্যে আমার ওই দ্বিতীয় সত্ত্বা ক্রমাগত আমাকে ওইসব ভয়ংকর স্বপ্ন আর বিভিন্ন ঘটনার পূর্বাভাষ দেখিয়ে চলেছিল। আর এদিকে বিভিন্ন ডাক্তারবাবুরা আমার কেসটাকে দ্বৈত সত্ত্বার আদর্শ কেস হিসেবে মেনে নিয়েছেন। ইতিমধ্যে আমি আমার মেজো ছেলে উইনগেটের ব্যাপক উৎসাহে মনোবিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা আরম্ভ করে দিয়েছিলাম। উইনগেটও অবশ্য অধ্যাপনার পাশাপাশি একই কাজ করছিল। ১৯১৭ – ১৮ সাল নাগাদ আমি মিসকাটোনিকে স্পেশাল কোর্সও করেছিলাম। ইতিমধ্যে আমার চিকিৎসাবিদ্যা, নৃতত্ত্ব, ইতিহাসের হরেকরকম নথি ঘাঁটার রোজনামচায় আরও একটা ব্যাপার যোগ হল, সেটা হচ্ছে আমার ওই দ্বিতীয় স্বত্বার যেসব বিষয়ে প্রবল উৎসাহ – যেমন গুপ্তবিদ্যাসংক্রান্ত যতরকম বই আছে, দূরদূরান্তের লাইব্রেরিতে গিয়ে সেগুলো নিয়ে চর্চা করা। এক একটা বই এতই বীভৎস ছিল যে আমি নিজেও শিউরে উঠেছিলাম। শুধু এটুকুই বলছি আমি আমার দ্বিতীয় স্বত্বার প্রভাবে যেসব বীভৎসতার মুখোমুখি হয়েছিলাম, এগুলোর বীভৎসতা ছিল তার থেকে অনেকটাই বেশি। কিছু কিছু বইয়ের আধুনিক সংস্করণে আমি কিছু শব্দ আর বাগধারার পরিবর্তন দেখলাম, কারণ মূল শব্দগুলো এতটাই বীভৎস ছিল যে কোনও আধুনিক সভ্যতা ওগুলোকে মেনে নেবে না। বইগুলো নানা ভাষায় লেখা হলেও কিছু কিছু চিহ্ন সব বইগুলোতেই দেখেছিলাম। আর আমার ধারণা যারা এই সংশোধনের কাজ করেছিলেন মূল শব্দগুলোর অর্থ তাঁদের অজানা ছিল না। উদাহরণ হিসেবে বলতে পারি ভন জানৎসের লেখা আনঅসপ্রেলিচেন কাল্টেন বইটার কথা। এতে যে হায়ারোগ্লিফিক মার্কা সাংকেতিক চিহ্নগুলো ছিল সেগুলোর সাথে কোনও পার্থিব চিহ্নর কোনোরকম মিল নেই। কিন্তু সবথেকে অবাক করার মত বিষয় হচ্ছে ওই চিহ্নগুলো যে কালিতে আঁকা ছিল, সংশোধনও করা হয়েছে একই কালিতে!! তাহলে লেখক আর সংশোধক কি একই লোক? তিনি কি জানতেন এই বই সঠিক হাতে না পড়লে কি কি বিপর্যয় হতে পারে? এই পৃথিবীর সমস্ত প্রাণীকে কোনও আসন্ন অপার্থিব বিপর্যয় থেকে বাঁচাবার জন্যই কি এই সংশোধন করা হয়েছে? বিষয়টা আমাকে ভাবিয়ে তুলল। আর সবথেকে পিলে চমকে দেবার মত বিষয় হল হায়ারোগ্লিফিক মার্কা সাংকেতিক চিহ্নগুলোকে যখন আমি চিনতে পারলাম – না ওগুলোর মানে বুঝতে পারিনি ঠিকই, কিন্তু এই চিহ্নগুলোই যে আমার স্বপ্নে ঘুরেফিরে আসত সে বিষয়ে আমার আর সন্দেহ ছিল না।
***
যেহেতু আমার দ্বৈত সত্ত্বা তখন খবরের কাগজে একটা আলোচিত বিষয় তাই অনেক লাইব্রেরিয়ান আমার ধোঁয়াশা কাটাতে এটাও বলল যে ওই চিহ্নগুলো আমি নিজেই অচেতন ভাবে আমার দ্বৈত সত্ত্বার প্রভাবে ঘোরের মধ্যে এঁকে ফেলেছি। তাদের ধোঁয়াশা কাটাবার ঠেলায় আমার ঘিলু আরও ঘেঁটে গেল। এই সব নথিপত্র ঘেঁটে একটা কথা সার বুঝলাম এই সব গুপ্তবিদ্যায় ব্যবহৃত তিনটে ভাষা সম্পর্কে আমার কোনোরকম ধারণা নেই। চিকিৎসাবিজ্ঞান আর নৃতত্ত্বের পুরনো আর নতুন সমস্ত নথি থেকে বিভিন্ন ছড়ানো ছিটনো তথ্য এক জায়গায় করে দেখলাম, এগুলো অধিকাংশই অলীক আর প্রচলিত কিছু ধারনার ওপর ভিত্তি করে প্যালেওজোইক, মেসোওজোইক, জুরাসিক, ট্রায়াসিক যুগের কিছু ছবি তুলে ধরেছে। আমি এটা ভেবে স্বস্তি পেলাম যে ১৭ থেকে ২৫০ লক্ষ বছর আগের পৃথিবীর কিছু উপকথা মার্কা থিয়োরি নিয়ে হয়তো সত্যিই তেমন ভাবে ভাবার কিছু নেই। কিন্তু এগুলোর বীভৎসতা আমার মাথার মধ্যে পোকার মত কিলবিল করতে লাগলো। এত পুরনো দিনের ঘটনা শুধু ধোঁয়াশাই বাড়ায়। কিন্তু স্বীকার করতে বাধা নেই আর সবার মত আমিও ওই অজানা আদিম আতঙ্ককে ভয় পেতে লাগলাম। যুগে যুগে এই সব উপকথায় একটু একটু করে রং চড়েছে আর সেটা আমার মত স্মৃতি-বিভ্রাটের রুগীর চিন্তনের জগতে একটা কাল্পনিক দুনিয়া তৈরি করে তালুক গেড়ে বসেছে। আমি নিজেই তো তার জলজ্যান্ত প্রমাণ।
আবার কিছু কিছু উপকথা, বিশেষ করে কিছু হিন্দু পুরাণে মানবসভ্যতার সৃষ্টির আগে থেকে কালচক্রে কি করে আধুনিক ধর্মের সৃষ্টি হয়েছে তার উল্লেখ আছে। এসব পড়লে যে কোন লোক শিউরে উঠবে বা বিস্ময়ে হতভম্ব হয়ে যাবে, কিন্তু আমি ক্রমশ এগুলোতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিলাম। পুরাণ আর বিভ্রান্তি সবকিছুর সারসংক্ষেপ থেকে এটা প্রমাণিত যে এই পৃথিবীর সৃষ্টি নিয়ে যতই রহস্য থাকুক মানুষই একমাত্র প্রাণী যে সব ঝড় ঝাপটা অতিক্রম করে শুধু টিকেই থাকেনি সারা দুনিয়ায় তার আধিপত্য কায়েম করেছে। কিন্তু ওইসব পুরাণে একথাও উল্লেখ আছে মানুষ সৃষ্টির তিনশো কোটি বছর আগেই এক প্রজাতি মেঘলোক থেকে হাজির হয়ে আয়ত্ত করেছিল এই প্রকৃতির সমস্ত রহস্য। তাদের আকার, প্রকৃতি কোনকিছু নিয়েই ওইসব বইয়ে কোন উল্লেখ ছিল না। তাদের কেউ কেউ হয়তো এসেছিল আমাদের এই মহাবিশ্ব বা তার থেকেও প্রাচীন কোন নক্ষত্রলোক থেকে। আর খুব দ্রুতভাবে সৃষ্টি করেছিল জীবনচক্রের সেই প্রথম জীবাণু। সৃষ্টির হাজার লক্ষ বছরের বিবর্তনে আমরা যে জিনিসটাকে সময় বলে মেনে নিয়েছি, আদপে নাকি তার কোন অস্তিত্বই নেই!!
কিন্তু এছাড়াও ওইসব পুরাণে অপেক্ষাকৃত নবীন এক প্রজাতির কথা বলা হয়েছে। জটিল আর বীভৎস আকৃতির ওই প্রজাতির তথাকথিত বিজ্ঞানের আলোকে পরিচিত কোন আকার ছিলনা। এরা মানুষ সৃষ্টির পঞ্চাশ কোটি বছর আগেই বিলুপ্ত হয়ে যায়। কিন্তু তার মধ্যেই এরা আয়ত্ত আর জয় করে ফেলে সময়ের সেই গোপন রহস্য। আর সেই জন্যই এদের শ্রেষ্ঠ জাতি হিসেবে ওইসব পুরাণে উল্লেখ করা আছে। এই পৃথিবীর ভূত – ভবিষ্যৎ- বর্তমানের যাবতীয় জ্ঞান এদের আয়ত্তে চলে আসে। নিজেদের তীব্র মানসিক ক্ষমতা দিয়ে তারা অনায়াসে চলে যেত অতীত কিংবা বর্তমানে। এবং সেই সময়ের সমস্ত জ্ঞান পুরোপুরি আয়ত্তে নিয়ে আসে। এমনকি মানবসভ্যতার যাবতীয় পুরাণও ছিল তাদের নখদর্পণে!! এদের একটা কেতাবি নামও অবশ্য উল্লেখ আছে ওইসব বইয়ে – ঈথ! ঈথদের বিশালাকার লাইব্রেরীতে এই পৃথিবীর বছরের পর বছরের সমস্ত প্রজাতির শিল্প, ভাষা, মনোবিজ্ঞান, কৃতিত্ব – সবকিছুর সচিত্র বিবরণ ঠাসা থাকত। ঈথরা প্রত্যেক যুগ থেকেই নিজেদের স্বভাব আর পরিস্থিতির সাথে মানানসই কাউকে বেছে নিত। ভূত – ভবিষ্যৎ – বর্তমানের এই জ্ঞান তাদের আয়ত্তে থাকার ফলে তাদের কোন সমস্যাই হত না। পরবর্তীকালে উপযুক্ত যন্ত্র এসে যাওয়ার ফলে এদের কাছে এই কাজ আরও সহজ হয়ে যায়। তখন ঈথরা অনায়াসে তাদের সময়-ভ্রমণে ইচ্ছেমত যুগে নিজেদের সশরীরে হাজির করতে পারত। প্রাথমিক কিছু পরীক্ষানিরীক্ষা চালাবার পর এরা সেই যুগের সেরা প্রজাতিকে বেছে নিত। তারপর তাদের কাজ ছিল চিন্তন তরঙ্গের মাধ্যমে সেই জীবের মস্তিষ্কে নিজেদের ভাবনাকে চালান করা। খুব স্বাভাবিক ভাবেই যে জীবের মগজে ওই ভাবনা-প্রবাহের আমদানি হত, সময়চক্রের এক বিপরীত প্রবাহের সৃষ্টি হত তার শরীরে। সে তখন সেই ঈথদের উত্তরসূরি ছাড়া কিছুই নয়। তার কাজ হত বেছে নেওয়া যুগের যাবতীয় তথ্য আর কারিগরি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব শিখে নেওয়া। ব্যাপারটা এমনি ভাবলে হয়তো বেশ মজা লাগবে, যেন চাহিদা আর যোগানের খেলা। কিন্তু এর পর যেটা হত সেটা আরও ভয়ংকর। ঈথরা তাদের পরীক্ষার গিনিপিগের চিন্তন আর মননকে ফিরিয়ে আনত নিজেদের যুগে এবং নিজেদের শরীরে। তারপর যত্ন নিয়ে সেগুলো রক্ষা করত। এইভাবেই ছোট প্রজাতির সাথে ভরের আদান প্রদান ঘটিয়ে ঈথরা নিজেদের অস্তিত্ব-লোপকে ঠেকিয়ে রাখত আর হয়ে উঠত সর্বজ্ঞ। কোন প্রজাতির ভাষা তাদের অজানা থাকলেও তাদের কাছে এমন যন্ত্র ছিল যা দিয়ে তারা অনায়াসে ওই ভাষার অনুবাদ করে ফেলতে পারত। ঈথদের চেহারার বর্ণনাও দেওয়া ছিল কিছু বইয়ে। ঈথরা আকারে ছিল প্রায় দশ ফুট লম্বা। দেখলে মনে হবে ঠিক যেন শঙ্কু আকৃতির কিছু কুঁজো হয়ে রয়েছে। ওই শঙ্কু আকৃতির ধড়ের ওপর থাকত মাথা। সেই মাথা থেকে অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো ছড়িয়ে থাকত। তারা কথা বলত তাদের বিশালআকারের শুঁড় দিয়ে ক্লিক ক্লিক শব্দ করে। চলাফেরার দরকার হলে স্যাঁতস্যাঁতে জেলির মত ওই দশ-ফুটের অবয়বকে হড়কে হড়কে নিয়ে যেত এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায়।
যেসব প্রাণীদের চিন্তাভাবনা ঈথরা বন্দী করত, তারা প্রথমে খুব ভয় পেত বা আশ্চর্য হয়ে যেত কিন্তু পরে অভ্যস্ত হয়ে যেত ঈথদের দুনিয়ায়। যেমন হয়েছিলাম আমি – যাইহোক সে কথায় পরে আসছি। যদিও তাদের এই নতুন পরিবেশে মানিয়ে নেওয়া সম্পূর্ণভাবে ঈথদের ইচ্ছা অনুযায়ীই হত। বন্দীরা এরপর রাক্ষুসে উড়োজাহাজ বা পারমাণবিক ইঞ্জিনওয়ালা বোটে করে যেত ঈথদের লাইব্রেরীতে। সেখানে তাদের বিভিন্ন গ্রহের অতীত ও ভবিষ্যৎ নিয়ে চর্চা করতে দেওয়া হত। এরপর অনেক বন্দী একজোট হয়ে লেগে পড়ত পৃথিবীর গোপন সব রহস্যভেদে। অতীতের বহু হারানো অধ্যায় আর সুদূর ভবিষ্যতের অগ্রগতি দেখে তারা বিস্ময়ে হতভম্ব হয়ে যেত।
অনেকসময় হয়তো ভবিষ্যৎ থেকে বন্দী হয়ে আসা কারও সাথে জ্ঞানের আদানপ্রদান হত। তারপর তাদের কাজ হত নিজেদের ভাষায় বিভিন্ন-যুগের ওইসব নথি ঈথদের লাইব্রেরীতে জমা করা। কোনকোন বন্দী অবশ্য কিছু বাড়তি সুবিধা পেত। তবে তারা সংখ্যায় ছিল খুবই কম। মুমূর্ষু এইসব বন্দীদের পাঠানো হত চিরনির্বাসনে। তার অবশ্য কারণও ছিল। ভবিষ্যতে এদের কায়িক অবয়ব হয়তো কোন ঈথের হাতে বন্দী। ঈথরা খুব সম্ভবত মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছিল, তাই মানসিক অবলুপ্তির হাত থেকে মুক্তির জন্যই তাদের এই ফন্দি। তবে এই ঘটনার সংখ্যা ছিল খুবই কম। বন্দী মন যখন তার ভবিষ্যতের ইচ্ছা জানতে পারত, তখন একটা যন্ত্রের সাহায্যে সে এই গোটা পদ্ধতিটাই উল্টোদিকে চালাত। ফলে ভবিষ্যতে সঠিক শরীরে সে ফিরে যেতে পারত। অবশ্য শরীর নষ্ট হয়ে গেলে এটা সম্ভব ছিলনা। তখন ওই মন হয় কোন ভিনগ্রহীর আকার ধারণ করত আর না হয় চিরকালের মত বন্দী হয়ে থাকত ঈথিয়ান জগতে। অবশ্য বন্দী হওয়া মন যদি কোন ঈথের হত তাহলে ব্যাপারটা এতটা ভয়ানক হত না। নিজেদের ভবিষ্যতের ব্যাপারে ঈথরা যথেষ্ট সচেতন ছিল। যখন কোন ভিনগ্রহী প্রজাতির বন্দী মন তার নিজের শরীরে ফিরে যেত, তখন যান্ত্রিকভাবে হিপনোসিসের মাধ্যমে ঈথীয়ান দুনিয়ার যাবতীয় জ্ঞান ও স্মৃতি মুছে ফেলা হত। এর কারণ অবশ্যই ভবিষ্যতের ঝামেলা এড়ানো। পৃথিবীতে বিভিন্ন বিপর্যয়ের কারণ হিসেবে এগুলোই ওইসব পুঁথিতে উল্লেখ করা আছে। অবশ্য এই সবকিছুই যুগ-যুগান্ত দুরের ঘটনা, যার ধ্বংসাবশেষ পড়ে আছে সমুদ্রের গভীরে। কিছু ঘটনার উল্লেখ আছে ভয়ানক প্লাকোটিক পাণ্ডুলিপিতে। ঈথীয়ান দুনিয়া থেকে যেসব মন চিন্তন তরঙ্গের মাধ্যমে নিজের শরীরে ফিরে আসত, ওই জগতের ছিটেফোঁটা স্মৃতিও তার থাকত না। সব পুরোপুরি মুছে দেওয়া হত।
যেসব সংগঠন গুপ্তবিদ্যা চর্চার সাথে জড়িত, তারা অবশ্যই এই ব্যাপারগুলো খুব ভালভাবে জানত। নেক্রোনেমিকনে তো স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা আছে বিভিন্ন গুপ্ত-সমিতির কথা যারা কালসমুদ্রে ঈথীয়ান দুনিয়ায় পাড়ি জমাত। ঈথরা শুধু পৃথিবীই নয়, আরও বিভিন্ন গ্রহে চিন্তন আর মনন আদানপ্রদানের কাজ শুরু করেছিল। খুব সম্ভবত ঈথরা নিজেদের সেই উৎসের সাথে কালচক্রকে মেলাতে পেরেছিল। যার শুরু হয়েছিল সেই বিগ ব্যাং -এর আমলে। ঈথদের শরীরের থেকেও তাদের মানসিক বয়েস ছিল বহু প্রাচীন। শরীরী অবয়ব তারা অনেক পরে লাভ করে। নিজেদের বিলুপ্তির কথা জানতে পেরেই তারা তাদের চিন্তনকে ভবিষ্যৎ দুনিয়ায় পাঠাতে চেয়েছিল কয়েক লক্ষ কোটি বছর আগে, এবং সফলও হয়েছিল।
***
১৯২০ সাল নাগাদ আমি আমার জট পাকানো চিন্তাভাবনাগুলোকে একটা ঠিকঠাক জায়গায় আনতে পেরেছিলাম। আমার ওই উদ্বেগ আর উত্তেজনাও অনেক কমে গিয়েছিল। আমি আস্তে আস্তে আমার স্মৃতি-বিভ্রাটের সময়ের ঘটনাগুলোকে এক সুতোয় বাঁধতে চাইছিলাম। ওই সময় আমি যে জড়িয়ে জড়িয়ে কথা বলতাম বা ওই হায়ারোগ্লিফিক চিহ্নগুলো স্বপ্নে দেখতাম, নিঃসন্দেহে ওইসব পুঁথিপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করার ফল। আমার অবচেতন মনে ব্যাপক ছাপ পড়ার ফলেই ওগুলো ঘটত। আমি এই সময় বিভিন্ন গুপ্ত-সমিতির শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তির সাথে কথা বলেছিলাম এইসব বিষয়গুলো নিয়ে – কিন্তু কোন কূলকিনারাই পাই নি।
নানা সময়ে আমি যে কেসগুলো ঘেঁটেছিলাম, প্রথম প্রথম আমার সাথে পেশেন্টদের মিল দেখে প্রচণ্ড ভয় পেতাম। কিন্তু পরে বুঝলাম ওইসব পুঁথিতে যেসব কথা বলা হয়েছে, তা নেহাত উপকথারই সামিল, কারণ এখনকার সময়ের থেকে অতীতের সাথেই ওগুলোর মিল বেশি। আমার আগে যাদের এরকম ঘটেছিল, খুব সম্ভবত স্মৃতি-বিভ্রাটের পর তারা তাদের পারিপার্শ্বিক কিছু চালু ধারনার সাথেই নিজেদের জড়িয়ে ফেলে, তারপর সেখান থেকে বেরোতে না পেরে নিজেদের কল্পনাতেই এক অমানবিক জগত বানিয়ে বসে সেখানে পাড়ি জমায়। আমার ক্ষেত্রে এগুলো হয়নি কারণ আমি এগুলো নিয়ে চর্চা আরম্ভ করি প্রাথমিক ধাক্কাটা কাটিয়ে ওঠার পরে। আমার আগের পেশেন্টদের স্মৃতিশক্তি ফিরে এলেও ওই কাল্পনিক দুনিয়া থেকে তারা আর বেরোতে পারেনি। আমি আমার মনে কখনই এইসব চিন্তাভাবনাকে গেড়ে বসতে দিইনি। সব সময় যুক্তি – পাল্টা যুক্তি দিয়ে ভাবতাম। পরে বিভিন্ন নামকরা মনোবিদ আর নৃতত্ত্ববিদরাও আমার সাথে একমত হন।
যাইহোক আমি কিন্তু ওইসব ভুতুড়ে ঝলক,স্বপ্ন আর চিন্তাভাবনার থেকে আত্মরক্ষার বেশ ভালো একটা উপায় ঠাউরেছিলাম। রাতে যদি কোন অদ্ভুত স্বপ্নও দেখতাম, বুঝতাম ওইসব পুঁথিপত্র নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করার ফলেই আমার অবচেতন মনে ওগুলোর ছাপ পড়েছে। এই থিয়োরিটা বেশ কাজে দিয়েছিল। আমার স্নায়ুতন্ত্রেও একটা স্থিতিশীলতা আসে। ১৯২২ সাল নাগাদ আমি বুঝতে পারলাম আবার স্বাভাবিক কাজকর্ম করতে পারব। এবং নতুন যা যা কিছু শিখেছি সেগুলো হাতে কলমে প্রয়োগের এটাই সেরা উপায়। এইসময় আমি তাই ইউনিভার্সিটির মনোবিজ্ঞান বিভাগের প্রশিক্ষক হিসেবে যোগ দিলাম। এদিকে অধ্যাপনার পাশাপাশি পোস্ট গ্রাজুয়েশনের জন্য আমার মেজো ছেলে উইনগেটও এইসময় ইউনিভার্সিটিতে এল। আমাদের দুজনের জুটিতে আরও অনেকদূর এগোতে পারব ভেবে আমার মনটা খুশিতে ভরে উঠল।
হ্যাঁ একথা ঠিক যে আমি যে স্বপ্নগুলো দেখতাম,সেগুলো নরকযন্ত্রণার থেকে কিছু কম ছিল না। কিন্তু তা সত্ত্বেও আমি আমার স্বপ্নের একটা ধারাবাহিক রেকর্ড রাখতে শুরু করি। বড়াই করব না কিন্তু আমি নিশ্চিত আমার ওই রেকর্ড যেকোনো মনোবিদ লুফে নিতেন অনায়াসে। খুব ধীরে ধীরে হলেও আমি আমার এই নরকযন্ত্রণা থেকে একটু হলেও বেরিয়ে আসতে পেরেছিলাম। ১৯১৪ সালের পর থেকে আমার স্বপ্নের মধ্যে নানারকম পরিবর্তন আসতে শুরু করে। এখন আমি স্বপ্নের মধ্যেই নানা জায়গায় অবাধে ভেসে বেড়াতে পারতাম। বেড়াতে বেড়াতে কোথাও দেখতে পেতাম অদ্ভুত পাথুরে বাড়ি, যেগুলোর ভেতরের চোরাপথ দিয়ে এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় যাতায়াত করা যেত। আবার কোথাও দেখতে পেতাম ওইরকমই গা ছমছমে বন্ধ হওয়া চোরা দরজা। এছাড়াও বিভিন্ন খোপ খোপ আঁকা দরজা, নানারকম অদ্ভুত আকারের বাসনপত্র, জটিল কারিগরিতে ভরা বিভিন্ন গুহা (যেগুলোর উদ্দেশ্য বুঝতাম না ) দেখতে পেতাম।
কিন্তু সত্যিকারের ভয় কাকে বলে সেটা টের পেলাম ১৯১৫ নাগাদ। এই সময় আমি আমার স্বপ্নে বিভিন্ন জ্যান্ত জিনিস দেখতে শুরু করলাম। শুধু দেখা বললে ভুল হবে, তাদের প্রত্যেকটা খুঁটিনাটি আমার চিন্তায় গেঁথে গেল। হ্যাঁ ঠিকই – আমি ঈথদের কথাই বলছি। যদিও তখনও আমার মগজে ওইসব রাক্ষুসে বিল্ডিং আর রাস্তার স্মৃতি ভালভাবেই ছিল। ওই পুরনো পুঁথিগুলোতে ঈথদের চেহারার বর্ণনা পড়ার পর যখন নিজের চোখের সামনে ওদের দেখলাম আমার ভয় বহুগুণে বেড়ে গেল। ঈথরা আমার চোখের সামনে যখন ভেসে উঠত, এক একসময় মনে হত পুরো গায়েব, আবার ঠিক তার পরের মুহূর্তেই জেলির মত থকথকে দশ-ফুট লম্বা শরীর নিয়ে চলে যেত আর এক জায়গায়। এদের শরীর থেকে তিন চারখানা অংশ বেরিয়ে থাকত। যাদের মধ্যে দুটোকে দেখে আন্দাজ করতে পারতাম ওগুলো ওদের থাবা। তিন নম্বর অংশ থেকে আবার চারটে লাল শুঁড়ের মত অংশ বেরিয়ে থাকত। চার নম্বর অংশের ব্যাস ছিল দু ফুট মত। আর এটা দেখতে ছিল হলদে গ্লোবের মত। এটা থাকত ঈথদের দেহের ঠিক মাঝখানে। এখানে আবার তিনটে কালো কালো চোখ ছিল। তখন বুঝলাম ওই হলদে গ্লোবটা হল ওদের মাথা। মাথা থেকে আবার ছাইরঙা ফুলের মত চারটে অংশ বেরিয়ে থাকত। এর দুদিকেই আবার সবুজ রঙের অ্যান্টেনার মত শুঁড় দেখা যেত।
এমনিতে দেখলে মনে হত এরা তেমন ক্ষতিকারক নয়, কিন্তু এদের কাজকর্ম দেখে আমি সত্যিই ভয় পেতাম। ওই পাথুরে কুঠুরির তাকে যেসব বই থাকত,সেগুলো এরা শুঁড় দিয়ে টেনে বের করে নিয়ে আসত বেদির মত টেবিলে। কখনও আবার ওই সবুজরঙা অ্যান্টেনার মত শুঁড় দিয়ে খুব যত্ন নিয়ে কিসব লিখত। আর কথা বলত ওই শুঁড়গুলো দিয়ে ক্লিক ক্লিক আওয়াজ করে। ঈথদের পিঠে একটা ঝোলার মত অংশ থাকত। যেভাবে এরা ঝড়ের গতিতে নিজেদের লেখাপড়ার কাজ চালাত, তাতে এদের বুদ্ধিমত্তা নিয়ে আমার কোন সন্দেহ ছিল না। আমি নিজেকে স্বপ্নে যে আতঙ্ক-পুরীতে দেখতাম, তার সর্বত্র এরা দলবেঁধে ঘুরে বেড়াত। কখনও বা মাটির নিচের ঘরে রাখা কিছু অতিকায় মেশিনে বিভিন্ন তথ্য জমা করত। এরা কি কি লিখত সেগুলোও আস্তে আস্তে আমার চোখে ধরা পড়তে শুরু করে। অধিকাংশই ছিল ওই আঁকাবাঁকা হায়ারোগ্লিফিক লেখা, কখনও বা একটু অন্যরকম কিছু। খুব সম্ভবত এগুলো ওরা নিজেরা নিজেদের জন্যই কোন বিশেষ বর্ণমালা তৈরি করেছিল। তবে হ্যাঁ, যারা লিখত বাকি ঈথদের থেকে তাদের গতি ছিল একটু হলেও কম।
১৯১৫ সালের আগস্ট মাসের পর থেকে এই ঈথীয়ান কার্যকলাপ আমাকে রীতিমতো ভোগাতে শুরু করল। কারণ এতদিন আমি যা যা দেখেছি সেগুলো ছিল কিছু স্বপ্ন, কিছু আমার কল্পনা। কিন্তু এখন আমি নিজেকে ঈথীয়ান দুনিয়ারই অংশ হিসেবে অনুভব করতে লাগলাম। এর আগে হয়তো আমি আমার নীচের দিকে তাকিয়ে চলা বা আয়না থেকে দুরে থাকার কথা উল্লেখ করেছি। এই ঈথীয়ান দুনিয়াতেও নিজেকে খুব স্বচ্ছন্দ লাগতো কারণ এখানে কোন আয়না ছিল না।
কিন্তু এরপর এল সেই কালরাত্রি,যখন আমি টের পেলাম আমার মুণ্ডুও একটা বিরাট থকথকে ঘাড়ের মত অংশের সাথে আটকানো। আর তার ঠিক নীচেই রয়েছে দশ-ফুট লম্বা, কুঁজো হয়ে যাওয়া শঙ্কুর মত একটা ধড়। যেটা থেকে বেরিয়ে এসেছে রং বেরঙের আঁশওয়ালা কিছু শুঁড়। সেদিন আমার চিৎকারে বোধহয় আর্কহ্যামের অর্ধেক লোক জেগে উঠেছিল।
এক সপ্তাহ পর থেকে এই দৃশ্যগুলো ঘনঘন দেখতে শুরু করলাম আমার স্বপ্নে। এখন অবশ্য আমিও ওই রাক্ষুসে ঈথদের মতই আকারওয়ালা একজন। আমিও বাকি ঈথদের মতই সহজভাবে চলাফেরা করতাম। শুঁড় দিয়ে টেনে নিতাম বই, আবার বেদির মত টেবিলে সবুজ শুঁড় দিয়ে অনেককিছু লিখে চলতাম। ঠিক কি কি লিখতাম আর পড়তাম প্রথম প্রথম আমার খেয়াল থাকতো না, তবে বারবার একই জিনিস দেখার ফলে বুঝেছিলাম ভয়ঙ্কর নানা বিষয়ের সাথেও গোটা ব্রহ্মাণ্ডের বিভিন্ন জীবজগতের বিষয়ই আমার লেখাপড়ার মূল বিষয় ছিল। তবে একটা ভয়ঙ্কর বিষয় আমার আলাদাভাবে মনে আছে। সেটা হল মানব-প্রজাতির সম্পূর্ণ অবলুপ্তির লক্ষ লক্ষ বছর পর এক অদ্ভুত আকারের বুদ্ধিমান প্রাণীর গোটা দুনিয়া শাসনের বর্ণনা।
(চলবে)
(এইচ পি লভক্র্যাফটের দ্য শ্যাডো আউট অফ দ্য টাইম অবলম্বনে)
Tags: ধারাবাহিক অনুবাদ গল্প, প্রথম বর্ষ চতুর্থ সংখ্যা, রূপক ঘোষ, সৌমেন চট্টোপাধ্যায়