অগ্নিপথ ২ – আলোকবর্তিকা
লেখক: সুমন দাস
শিল্পী: সুমন দাস
স্থান : অজ্ঞাত
কাল: ৮০,০০০ বি.সি.ই.
পাত্র: নিও
|| ২ক ||
সমুদ্রের আওয়াজটা বড় মধুর লাগে নিও’র। সে তীরে বসেই অনেকটা সময় কাটিয়ে দেয়। এই সমুদ্রের একটা জায়গায় একটা বড়ো প্রাকৃতিক খাল তৈরী হয়ে মিশে গেছে গভীর অরণ্যের মধ্যে। জোয়ারের সাথে সাথে জল ঢুকে পড়ে খালের মধ্যে। খাল উপচে তীর ছাপিয়ে যায়। অনেক মাছ খেলা করতে করতে উঠে আসে ডাঙায়। মাছরাঙা আসে, আসে আরোও অনেক পাখি – বক, সারসজাতীয়। নিও’র কোন অসুবিধা হয় না শিকার করতে। আর পায় ঝিনুকের মাংস। অনেক বড় বড় ঝিনুক, তার মাংস কী সুস্বাদু! মাঝে মাঝে দলবেধে বড় বড় কচ্ছপ, সীল ইত্যাদিও শিকার করে। মাছ আর পাখী দিয়ে সন্ধ্যাবেলায় সমুদ্রতীরে আগুন জ্বালিয়ে পুড়িয়ে খায়। তারপর বাড়ী ফিরে যায়। কাছেই তার গ্রাম।
তার গ্রামের লোকেরাও আসে সময়ে সময়ে নিও’র কাছে মাছ আর মাংস নিতে। নিও তাদের জন্য রেখে দেয় কিছু, কিছু তারা শিকার করে নিয়ে যায়। তাদের গ্রামে খাবারের অভাব নেই বললেই চলে। সমস্যা কেবল দুটো জায়গায়। এক, হিংস্র জন্তুর মাঝে মাঝে আবির্ভাব। আর দুই, বাইরের মানুষদের আক্রমণ। সমস্যা এই বাইরের মানুষদের আক্রমণ নিয়ে। মেয়েদের দখল করার জন্য চলে অবিরত যুদ্ধ। সবসময় সতর্ক থাকতে হয় ওদের। নিও পাহারায় থাকে সমুদ্রতীরে। নিওর মত আরো অনেকেই থাকে তীর বরাবর, ওই জলাখালের মধ্যে থাকা গাছগুলোর ডালের আড়ালে।
নিও’র এযাবৎ মনে হচ্ছে, যদি আগুন ঘরেও ধরানো যেত। তার বউটার অসুখ। পায়ে ক্ষত হয়েছে। রোজ সেই ক্ষতস্থানে ওষুধ আর পাতা দিতে হয়। আর খাওয়াতে হয় পথ্য। ওদের ঘরের মধ্যে মশালের আগুন নিয়ে যাওয়া যায় না। কারো ঘরেই নিয়ে যাওয়া যায় না। শুকনো পাতার ঘর, একটায় ফুলকি লাগলে গোটা গ্রাম ছারখার। বাইরে একটা খোলা জায়গায় আগুন জ্বালানো হয়। নিও’র বৌ ওই পা নিয়ে বাইরে আসতে পারে না। নিও রাত্রেবেলায় হাতড়ে হাতড়ে বউকে ওষুধ খাওয়ায়, মাথায় জল দেয়, রাতের খাওয়ার দেয়। তবে বড্ড অসুবিধা হয়। আগেরদিন জল মুখে না ঢেলে নাকে ঢেলে দিয়েছিল, সে বিষম টিষম খেয়ে একাকার।
তার আগের বউটা মারা গিয়েছিল বাচ্চা বিয়োতে গিয়ে। অন্ধকারে বাচ্চাটা ঠিকঠাক বের করা যায়নি। অর্ধেক বাইরে অর্ধেক ভিতরে – এই অবস্থাতেই দুজনেই মারা যায়। নিও খুব ভালবাসত বৌটাকে। এবারেরটাকেও ভালবাসে বটে, কিন্তু ভয় হয়, আগেরবারের মতন যদি আবার হয়! ক্ষতস্থান সারতে অনেক সময় নেবে, বেশ গভীর ক্ষত। একটু এদিক ওদিক হলে পচে গিয়ে মরেই যাবে বৌটা। সন্ধ্যের পর থেকেই যত ভয়। অন্ধকারে ভাল দেখা যায় না কিছু। কোনভাবে যদি আগুনটাকে ঘরে নেওয়া যায়, আলো হয় বেশ।
প্রতিদিনই এই চিন্তাটা মাথায় ঘুরপাক খায় নিও’র। কীভাবে? কোমরে দড়ি বেধে গাছের ওপর উঠে বসে। চারিদিক দেখে কেউ কোথাও আছে কি না। দেখে কিছু দূরে তার গাছের ডালে তার দুই বন্ধু, তারা খুব বড়ো যোদ্ধা। তীর ধনুকে অব্যর্থ লক্ষ্য। নিও’র হাতেও তীর ধনুক আছে বটে। তবে তাদের মত অত ভালো তীর ছুড়তে পারে না। তার অব্যর্থ লক্ষ্য বর্শায়। অবলীলায় জলের মাছ থেকে শুরু করে কয়েকশো গজ দুরের সীলের মাথাতেও বর্শা বিধিয়ে দিতে পারে। যুদ্ধের সময় দু’হাতের দুই বর্শা দুজনের প্রাণ নেবেই এ নিশ্চিৎ। কিন্তু তারপর সম্মুখ যুদ্ধে অতটা পারদর্শী না হলেও বুদ্ধির জোরে এখনো পর্যন্ত প্রতিটা যুদ্ধেই সে বেঁচে ফিরে এসেছে।
নিও তাদের দিকে তাকায়। তারা তার দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ে। অর্থাৎ শত্রুর কোন চিহ্ন নেই। নিও হাল্কা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। তারপর নিশ্চিন্তে ডালে বসে। চোখ থাকে সমুদ্রের দিকে, দূরে।
রাতে মশাল হাতে নিয়ে দাওয়ায় বসে নিও ভাবে, কেবল ভাবে। এক আকাশ তারার নীচে নিওর ঘর। ওপরে কত কি ঘটে। তারাগুলো আস্তে আস্তে এদিক থেকে ওদিক সরে যায় মাঝখানে দেবতাদের রাস্তাটাকে সঙ্গে নিয়ে। সে দেখে, ঘরে বৌয়ের ডাকের অপেক্ষা করে। তার খিধে পেলে সে তাকে খাওয়াবে। প্রতিটা গ্রাসে সে দেখতে পায় বউয়ের চোখে কৃতজ্ঞতা। তাদের এখানে ছেলে মেয়ে কোন কারণে অক্ষম হলে ছেড়ে চলে যাওয়াটাই রীতি। সে যায় নি। সে বড্ড ভালবাসে বৌটাকে। সেই থেকে তার প্রতি কৃতজ্ঞতা ওর। অন্যান্য মেয়েরা মুখ বেঁকায়। ছেলেরা ওকে ভীতু, না-মরদ বলে।
না! আগুনের কথাটা মাথা থেকে বেরোচ্ছে না। তার হাতে একটা ঝিনুক, পাশে নারকেলের মালায় ওই ঝিনুকটারই মাংস অনেকখানি, আজকে বৌটার জন্য আনা খাওয়ার। ও অপেক্ষা করছে তার ডাকের।
দূরে আগুন জ্বলছে। তীব্রভাবেই জ্বলছে। অনেকেই ফিরে গেছে ঘরে। বেশ কয়েকজন আগুনের চারপাশে জটলা করছে, আর গল্প করছে। তাদের বেশিরভাগই আজকের রাতের পাহারাদার। নিও চোখের সামনে ঝিনুকটা তুলে ধরে। ফুটো থাকলে জল খাওয়ানো যাবে না।
এই যাঃ! বেশ বড় একটা ফুটো! এদিক দিয়ে ওদিকের আগুনটা অনেকখানি দেখা যাচ্ছে। না! পালটে অন্য ঝিনুক নিতে হবে। আর তখনই বউয়ের ডাকে পিছন ফিরল। দাওয়ায় বসেছিল। ডাকটা ঘরের ভিতর থেকে এসেছে। নিও বলল, “আসছি”। আর তারপরই নিজের ছায়া দেখে চমকে উঠল। তার মুখের বাকি কথা মুখেই রয়ে গেল। স্তব্ধ হয়ে গেল সে। বউয়ের ডাকে আবার সম্বিত ফিরল। সে দ্রুত ঘরে ঢুকে গেল।
বউকে খাইয়ে আবার দাওয়ায় এসে বসল। এবার হাতে সেই ফুটো ঝিনুকটা। সে দেওয়ালের একটু আগে ঝিনুকটা ধরল। দেওয়াল থেকে যত দূরে ঝিনুকটা ধরল ততই ছায়াটা বড় হতে লাগল, আর সেই সাথে ঝিনুকের মাঝের ফুটোটা দিয়ে আলো দেওয়ালে পড়তে লাগল। ঝিনুক যত কাছে আছে ফুটোর আলো তত তীব্র হয়, যত দূরে যায়, ম্লান হয়, ছোট হয়।
অনেকক্ষণ ভাবনা চিন্তার পর নিও’র মুখে চওড়া হাসি খেলে গেল। সে পথ পেয়েছে। আগুনের শিখাকে সে ছোট করবে।
পরদিন, সমুদ্রতীরে নিওকে দেখা যায় কাজে ব্যাস্ত। পাশে পড়ে আছে দড়ি, মাংসের চর্বি, আর বড়ো বড়ো কয়েকটা ঝিনুক।
নিও প্রথমে একটা পাথরের ওপর চর্বিগুলোকে আগুনে দিয়ে তরল করে। এটাই সবচেয়ে কঠিন কাজ। অনেক সময় নিয়ে যত্ন করে এই কাজটা করে সে। তিন-চারটে নারকেলের মালায় সেই গলিত চর্বি রাখে। তারপর বড় বড় ঝিনুকগুলোকে ভালো করে ঘষে ঘষে বাটির মতন করে তৈরী করে। এমনভাবে আস্তে আস্তে বানায় যাতে করে যতটা সম্ভব বেশি পরিমান চর্বি ও রাখতে পারে ঝিনুকগুলোর মধ্যে। তারপর ঝিনুকগুলোকে চর্বি দিয়ে ভর্তি করে, দড়ি টুকরো টুকরো করে কেটে ধার দিয়ে আস্তে করে চর্বির মধ্যে ডুবিয়ে দেয়। ব্যাস, তৈরী…
সন্ধ্যাবেলা, সারা গ্রামের লোক হতবাক হয়ে দেখে, নিও’র কুটিরে আগুন জ্বলছে। তারা আতঙ্কিত হয়। আগুন ধরে গেল নাকি? ছুটে এসে দেখে ঘরের মাঝখানে নিও জ্বালিয়েছে ছোট্ট একটা আগুন। বড় নরম তার শিখা, কিন্তু বড় তীব্র তার আলোকবর্তিকা। নিও’র বউ অবাক চোখে দেখছে সেই আগুনটাকে। এমন জিনিস সে দেখেনি কোনদিন। এমন জিনিসের কথা সে ভাবেওনি কোনদিন। তার দুই চোখ দিয়ে নেমে এসেছে জলের ধারা। তার ইচ্ছা করছে নিওকে চুমু খেতে। কৃতজ্ঞতায় না, ভালোবাসায়। কিন্তু এতগুলো লোকের সামনে পারছে না। আর নিও? আমাদের বৈজ্ঞনিক বাবুটি, তার বউয়ের এই অবস্থা দেখে খুব হাসছে…
|| ২খ ||
তৈলাধার আলোকবর্তিকা – নাম কি এই হবে? Oil Lamp-এর? যাই হোক না কেন? এই ল্যাম্পের (এই নামেই ডাকি আপাতত) বয়স প্রায় আশি হাজার বছরেরও বেশি। বহু প্রাচীনকালে অজ্ঞাতভাবে এর আবিষ্কার, ব্যবহার। কোন দেশ, বা কোন প্রাচীন অঞ্চল থেকে এর ব্যবহার সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে তা জানা যায় না বটে, কিন্তু একথা বলা যেতেই পারে এর ব্যাপক প্রচলন শুরু হয় ১০,০০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে (প্যালিওলিথিক যুগ, অর্থাৎ কিনা প্রস্তর যুগে)। তখন আস্তে আস্তে কৃষিজীবন শুরু হয়েছে মানুষের। আস্তে আস্তে বিভিন্ন রকমের ফসল ফলানোর পাশাপাশি জঙ্গল কেটে গ্রাম বানানোর সাথে সাথে হাতে আসে অলিভ পাতা, যার রস ব্যবহার হতে শুরু করে অয়েল ল্যাম্পের জ্বালানীর কাজে।
এর ব্যাপক ব্যবহার শুরু হতেই লক্ষ্য করা যায় যে, এর ব্যবহার বিভিন্নরকম উৎসবে, বা পূজা পার্বনে হতে শুরু করেছে, যা আজও অব্যহত আছে। তার আগে পর্যন্ত, অর্থাৎ কি না ৮০,০০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দ থেকে ১০,০০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত এর ব্যবহার হত মূলত চর্বি দিয়ে। তখনকার দিনের মানুষ মূলত পাথর বা ঝিনুক জাতীয় পদার্থকেই ধারকপাত্র হিসাবে ব্যবহার করত। ঝিনুক জাতীয় পদার্থের মধ্যে চর্বি ভরে তাতে গাছের ছালের তৈরী দড়ি দিয়ে বানানো হয়, যাকে বলে Crude Lamp। এরপর আসে তেলের ব্যবহার। যেমনটা বলছিলাম আর কি।
বিভিন্ন রকমের ল্যাম্প ব্যবহার করেছে মানুষ – এককথায় ল্যাম্পের অভিযোজন হয়েছে অনেক। যেমন ধরুন টেরাকোটা ল্যাম্প। সঙ্গের ছবিতে যেটা দেখা যাচ্ছে। মাঝের অংশটাকে বলে শোল্ডার। এখানে থাকে একটা বড় ছিদ্র। ০.৫ – ৫ সেন্টিমিটার সাধারণত এর ব্যাস হত।
চিত্র ১ – টেরাকোটা ল্যাম্প
এখানেই ভরা হত তেল। আর নজেল আছে দুটো। অর্থাৎ কি না এর মধ্যে সুতলি পাকিয়ে ঢুকিয়ে দেওয়া হত আর একসাথে ডবল আলো জ্বলে উঠত, যা কি না দ্বিগুন তীব্রতাবিশিষ্ট। নজেলের উল্টোদিকে থাকত হাতল। যেখানে এই ল্যাম্পটাকে ধরা হত।
বিভিন্ন রকমের ল্যাম্পের মধ্যে মিশরীয়রা আর গ্রীকরা তৃতীয় শতকে যে ল্যাম্প ব্যবহার করত তাকে বলা হত হুইল ল্যাম্প। খুবই সাদামাটা এই ল্যাম্পে থাকত কেবল বড় তৈলাধার আর তার ওপর জ্বলার জন্য সুতো টাইপের মুখ। এর কোন হ্যান্ডেল ছিল না। কেবল লাগ (lug) ছিল, যা দু’হাতে ধরতে হত।
ল্যাম্পের সুন্দর ব্যবহার হতে শুরু করল প্রাক রোমান সময়ে, মূলত ইতালীতে। স্পাইরাল বা সর্পিলাকার দেখতে হত এর তৈলাধার। এবং এর নজেল অংশটাও ছিল। একে বলা হত ভলিউট (Volute)। এরপর রোমের সুবর্ণযুগে যে ল্যাম্প ব্যবহৃত হতে লাগল, তার শোল্ডারটা ছিল অনেক বড় এবং অত্যন্ত কম কারুকার্যবিশিষ্ট। এর হ্যান্ডেল যেমন ছিল তেমন নজেলও ছিল। এর নাম হাই ইম্পেরিয়াল। ৩০০ খ্রিষ্টাব্দে মিশরে যে ধরনের ল্যাম্পের ব্যবহার হত তাকে বলা হত ফ্রগ। এরপর সবথেকে যে ল্যাম্পের ব্যবহার জনপ্রিয় সেটা হল আফ্রিকান রেড স্লিপ। অনেকটা চওড়া এই ল্যাম্প আর খুব সুন্দর কাজ করা। ২০০ – ৭০০ শতকে এর ব্যবহার বহুলরূপে ছিল। পূর্ব মেডিটেরিয়ান অঞ্চল, যাকে লেভান্ট (Levant) বলে অভিহিত করা হয়, তৃতীয় থেকে নবম শতক পর্যন্ত সেখানে যে ল্যাম্পের ব্যবহার দেখা যায় তাকে বলা হয় স্লিপার। ডিম্বাকৃতি সাইজের হত এই ল্যাম্পটি। আর সবথেকে বিস্ময় যে ল্যাম্পটি ছড়ায় তা বের হয় জার্মানি থেকে, নাম ফ্যাক্টরি ল্যাম্পস – ফিরমালাম্পেন।
চিত্র ২ – রোমান সুবর্ণযুগের টেরাকোটা ল্যাম্প
কোন দেশ বা অঞ্চলে, কোন যুগে না ল্যাম্পের ব্যবহার হয়েছে! ৪৫০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে চালকোলিথিক যুগ, ব্রোঞ্জ যুগ (এই যুগে তো ল্যাম্পের তিনরকমের অভিযোজন দেখা যায়), লৌহযুগে হয়ে আধুনিক যুগ। পার্সিয়ান, গ্রীক, চীনা, রোমান (এদের সময়ে ল্যাম্পের অনেক ধরন পাওয়া যেতে শুরু করে), বাইজান্টাইন, ইসলাম, আর ভারতের কথা তো ছেড়েই দিলাম।
চিত্র ৩ – চিরাচরিত ভারতীয় মাটির প্রদীপ
বেদের সময় থেকে শুরু করে আজও অবধি এর যে কী বহুল ব্যবহার, তা একমাত্র ভারতে এলেই টের পাওয়া যায়। দীপাবলিতে ঘরে ঘরে সেজে ওঠে যে মাটির প্রদীপ, তাকে বলে ‘দিয়া’। বিয়েতে যে প্রদীপের ব্যবহার হয় তাকে বলে ‘দীপদান’। এছাড়া বড়ো দন্ডের ওপর প্রদীপ ধরিয়ে দেবার্চনার কাজে লাগে ‘পিদিম’ বা ‘পিলসুজ’। আর দক্ষিণ ভারতে দোতলা, তিনতলা, বা বহুতল প্রদীপ আজও ব্যবহৃত হয় দেবার্চনার কাজে, যার নাম ‘কাম্বা ভিলাক্কু’। এরই ছোট ভার্সান, যা বাড়ীঘরে ব্যবহার করা শুরু হয়, তার নাম ‘দীপবর্ষিকা’। এগুলো সবই তামা বা পিতলের তৈরী।
ভারতে প্রাথমিক প্রদীপ তৈরী হয় পাথর কেটে, বা ঝিনুক দিয়ে। এরপর মাটি পুড়িয়ে বানানো হয় প্রদীপ, যা আজও চলছে। রামায়ন বা মহাভারতে তো সোনার বা রূপার প্রদীপের ব্যবহারের কথা উল্লেখ আছে। বিষ্ণুর উপাসকরা যে প্রদীপ বানায় তার আকার ছিল মাছ, বা কচ্ছপের খোলের আকারের, মৎস অবতার আর কুর্ম অবতারের কথা মাথায় রেখে। এছাড়াও বিভিন্ন পশুপাখীর আকার বা আকৃতিবিশিষ্ট প্রদীপের ব্যবহার পরবর্তীকালে দেখা যেতে থাকে।
কিছুদিন আগে পর্যন্তও যখন গ্রাম বাংলায় এত বিদ্যুৎ ছিল না, প্রদীপ ছাড়াও ব্যবহার হত লম্ফ, অসাধারণ জিনিস। একটা কৌটার মাথা ফুটো করে পলতে ভিতর পর্যন্ত দিয়ে দেওয়া হত, কৌটার মধ্যে ভরে দেওয়া হত কেরোসিন তেল। ব্যাস, লম্ফ তৈরী। কী তার তেজ, আর কী তার আলো! আমি আমার ছোটবেলায় দেখেছি। এখনও এরকম একটা লম্ফ আমাদের বাড়ীতে আছে। বিষ্ময়কর প্রতিভা তথাকথিত সাধারণ মানুষদের, ভাবলে অবাক হতে হয়।
এছাড়াও দেখতাম হ্যারিকেন আর চিমনি। এই দুটোর ছবি আর বোধকরি চাক্ষুষ দর্শন বেশিরভাগ পাঠকদের হয়ে গেছে। তাই এর সম্পর্কে বেশি আর কিছু বললাম না। তবে একথা বলা ভুল হবে না যে, আজও বহু গ্রামে এর যথেষ্ট ব্যবহার আছে। অত্যন্ত প্রয়োজনীয় আলোকবর্তিকা হল এই হ্যারিকেন ও চিমনী।
শেষ করব যাকে দিয়ে তার ব্যবহার তো আজও ঘরে ঘরে হয় – মোমবাতি। আগে চর্বি দিয়ে মোমবাতি বানানো হত। এখন তা মোম দিয়ে বানানো হয়। আর তার কী না কাজে লাগে এই ছোট্ট সুন্দর আলোকবর্তিকা! উৎসবে এর ব্যবহার সবচেয়ে বেশি। তা জন্মদিনেই হোক, কিম্বা বড়দিনে, বা দীপাবলিতে…
|| ২গ ||
নিও সবসুদ্ধ মোট পাঁচটা ল্যাম্প বানিয়েছিল। একটা উপহার দিয়েছিল গ্রামের পুরোহিতকে, একটা দলপতিকে, একটা গ্রামের শেষে কবরখানায় – তার বাবা মা’য়ের সমাধিতে। আর দুটো তার বউকে। তার বউয়ের পা একদম ঠিক হয়ে গেছে। সে একটা ল্যাম্প রাখত ঘরের দাওয়ায়, লোকেরা দূর থেকে ওই ল্যাম্প দেখে বলত, “ওই হল নিওর আগুন। ওইটা নিওর বাড়ি। নিও আগুনকে বশ করেছে। যাও দেখে আসো গিয়ে…” আর আরেকটা ল্যাম্প রাখত ঘরে, যাতে নিও পাশে শুলে তার মুখটা ল্যাম্পের আলোতে দেখতে পায়…
নিও’র অনেক বয়েস হল। চোখে আস্তে আস্তে ছানি’র পর্দা নেমে আসছে। সে চোখে কম দেখে। কিন্তু একটা জিনিস সে তৃপ্তি নিয়েই দেখে রাত হলে। আজ গ্রামের বাড়ী বাড়ী তার তৈরী ল্যাম্প মানুষ গ্রহন করেছে। ঘরে, ঘরের দাওয়ায় সন্ধ্যা হলেই আলো জ্বলে। দেওতার মন্দিতে আলোর রোশনাই। মন্দিরের চারদিকে আলো জ্বলে। লোকে রাতেও পূজা দেয় দেওতাকে। আর দলপতির বাড়ীর ঘরে ঘরে ল্যাম্প। ওটা দলপতির শৌর্য বীর্যের প্রকাশ। নিও’র বৌ মারা গেছে অনেককাল হল। নিও একা। বড় একা। গ্রামের লোকেরা তাকে খেতে পরতে দেয়। তার ছেলেদের কিছু গেছে মারা গেছে জানোয়ারের পেটে, বাকিরা দলগত সংঘর্ষে। মেয়েদের কাউকে কাউকে লুঠ করে নিয়ে গেছে অন্য দলের লোকেরা। বৃদ্ধ ও অশক্ত নিও পারেনি তাদের বাঁচাতে। তাদের জামাইদের কেটে রেখে গেছে তার চোখের সামনে, নিও কিছু করতে পারেনি। সে একা হয়ে গেছে।
নিও ল্যাম্প তৈরী করে। সেই ল্যাম্প বিক্রী করে তার দিন গুজরান হয়। একটা ল্যাম্প সবসময় জ্বালানো থাকে তার বাড়ীর উঠানে, যেখানে তার বউ অন্তিম শয্যায় শায়িত। রাত্রে শুয়ে শুয়ে সে তার ঘরের কোনের মায়াময় ল্যাম্পের আলোটার দিকে তাকিয়ে থাকে। ওই একটাই ল্যাম্প তার মধুর স্মৃতি… কারণ ওটা তার বউয়ের বানানো…
[সব চরিত্র কাল্পনিক]
[ক্রমশ]
Tags: প্রথম বর্ষ চতুর্থ সংখ্যা, প্রবন্ধ, সুমন দাস