অগ্নিপথ ৩ – আলোকচুল্লি
লেখক: সুমন দাস
শিল্পী: সুমন দাস
স্থানঃ হালিশহর
কালঃ ২০১৭
পাত্রঃ ছাত্রী ও শিক্ষিকা
|| ৩ক ||
– আজ কীসের গল্প বলবে?
– আজ কোন গল্প নেই।
– মুসা বা নিমোর মতন কেউ নেই? (অগ্নিপথ ও অগ্নিপথ ২ প্রবন্ধে দ্রষ্টব্য)
– না।
– তুমি ভুলে গেছ?
– কী ভুলব?
– কীসের গল্প আজ শোনাবে সেটা?
– আরে আজ কোন গল্পই বলব না। তোমার কাকা আজ তোমায় নিতে আসবে বলছিলে না?
– হ্যাঁ, সে তো দেরী আছে।
– বেশি দেরী নেই।
– কাকা আসার মধ্যে একটা গল্প হয়ে যাবে।
– না, হবে না। বেশি সময় নেই আমাদের হাতে।
– তুমি রেগে যাচ্ছ কেন?
– যা ব্বাবা! রাগলাম কই?
– তাহলে ব্লাশ করছ কেন? লজ্জা পাচ্ছ না কি?
– উফ্ফ্ফ্… এই মেয়েকে নিয়ে না… (আড়চোখে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে) আচ্ছা শোন, একটা গল্প…
– ইয়ায়ায়ায়ায়া…
* * * * *
– সে বহুকাল আগের কথা…
– কতকাল?
– উমমম… ধরো ৩০০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দ… সেই সময়ের মিশর এক অসাধারন জায়গা। সবচেয়ে আগে মানুষের যে সভ্যতাগুলো গড়ে উঠেছিল, মিশর তার মধ্যে অন্যতম।
– নীল নদের তীরে?
– হ্যাঁ… তাদের প্রধান খাদ্য কি ছিলো বল তো – রুটি। তারও হাজার দুয়েক বছর আগে রুটি মানুষে খেত। কিন্তু তা আজকের মতন না। মানে সেঁকা নয়। আটা বা ময়দা জাতীয় জিনিস দিয়ে এমনি শুকিয়ে তৈরী হত সেই রুটি। মানুষে তাই খেত। কিন্তু মিশরীয়রা তো জানোই কত বুদ্ধিমান মানুষ ছিল। তারা দেখল যে, নাঃ এভাবে তো রুটি ভাল লাগছে না আর খেতে। অন্যরকমভাবে বানাতে হবে-
– এটা গল্প হচ্ছে?
– মানে?
– আগেরবারের মত গল্প না বলে এরকম ভাবে বলছ কেন? কাকা’র আসতে অনেক দেরী আছে।
– আচ্ছা আচ্ছা তোমাকে আর বাক্যি ফলাতে হবে না, শোন তাহলে…
* * * * *
সে বহুযুগ আগের কথা। মিশরের কোন একটা শহরে রিমা নামে এক মহিলা ছিল। তার ছিল তোমার মতন এক দুষ্ট মেয়ে। তার নাম তিষা। সে এতই দস্যি মেয়ে ছিল যে, সারাদিন বনে বাদাড়ে ঘুরে বেড়াত। আর তার দুরন্তপনায় সারা গ্রাম তোলপাড়। রিমা ঘরে রুটি বানাত আর তিষার বাবা শহরে বেচতে যেত সেই রুটি। তার বানানো রুটি খুব সুন্দর ছিল বটে, যদিও সবাই তার রুটির প্রশংশা করত, কিন্তু তিষা একদম খেতে চাইত না। সে বলত, না মা, তোমার রুটি আমার গলায় আটকে যায়। তুমি অন্যরকম রুটি বানাও। আমি খেতে পারি না।
তিষা খুব দস্যু মেয়ে ছিল বলে রিমা তার কথায় খুব একটা পাত্তা দিত না। কিন্তু একদিন রুটি তিষার গলায় আটকে গিয়ে একেবারে যা তা কান্ড। ডাক্তার নিদান দিলেন, উহু, বেশি শক্ত এবং আঠালো রুটি তিষাকে খেতে দেওয়া চলবে না। ওর গলা খুব সরু আর পাতলা, ওকে নরম আর ছোট রুটি দিতে হবে।
রিমা পড়ল ভাবনায়। কী করা যায়? কীভাবে রুটি বানানো যায়। মেয়েটা রোজ ঘ্যানঘ্যান করে, খেতে চায় না। আগে পাত্তা দিত না খুব একটা। কিন্তু এখন তো পাত্তা না দিয়ে আর উপায় নেই। কী করা যায়। কিছু একটা উপায় বার করতে হবে।
আগুনের আলোয় রাতে বসে বসে রুটি করতে করতে দিনরাত ভাবে রিমা। রোজ ভোরে রুটি নিয়ে তার বর যায় বাজারে। ভোররাতে উঠে রুটি বানিয়ে দিতে হয় তাকে। আজকাল বড় অন্যমনস্ক থাকে বলে মাঝে মাঝেই রুটির পরিমান কমবেশি হয়ে যায়। হয় রুটি নষ্ট হয়, না হলে আবার বানাতে বসতে হয়।
একদিন তো এই নিয়ে তার বরের সঙ্গে ঝগড়াই হয়ে গেল। রাগের চোটে শেষের রুটিটা ছুড়েই মারল বরের দিকে। লাগল না বটে। কিন্তু বর ব্যাটা আর ঘাটাল না তাকে।
সকালে ঘর পরিস্কার করতে গিয়ে রিমা অবাক হয়ে গেল। এটা কিরকম ব্যাপার হল! রুটিটা ঠিক পোড়ে নি, কিন্তু আগুনের তাতে বেশ নরম হয়ে রয়েছে। বেশ নরম। আর ফোলা ফোলা। একটু মুখে দিয়ে খেয়ে দেখল রিমা। দারুন খেতে লাগল। আগেকার রুটির মতন শক্ত নয়। বেশ নরম আর খেতে খুব সুস্বাদু। ইস্ট মেশানো তার হাতের রুটি এমনিতেই বিখ্যাত। এখন আগুনের তাতে তা ফুলেফেঁপে চমৎকার নরম আর মিস্টি হয়েছে। কিন্তু আধপোড়া।
কী করা যায়? কী করে রুটি সেঁকা যায়?
রিমা সারাদিন আগুনের ছাইয়ের পাশে বসে ভেবেই গেল। আধপোড়া রুটিটা তিষাকে চেটেপুটে খেতে দেখে তার চোখে জল এসে গেল। অনেকদিন বাদে মেয়েটা এত তৃপ্তি করে খেল।
সন্ধ্যেবেলার মধ্যে মাটি দিয়ে ছোট একটা চৌবাচ্চা বানাল রিমা। তার নীচে খুব সাবধানে গর্ত খুঁড়ে তার থেকে মাটি সরিয়ে নিল। চৌবাচ্চার ওপরে অনেকগুলো চ্যাপ্টা বড় পাথর রাখল। নীচে কাঠ গুঁজে দিয়ে আগুন জ্বালালো ভাল করে। তারপর তেতে ওঠা পাথরের তাওয়ায় রুটি নিলো সেঁকে। দেখতে দেখতে রুটি ফুলে উঠে নতুন রূপ নিল…
রিমারা আজ বড়লোক। স্বয়ং ফারাও আর তার রাণী তাদের তৈরী রুটি খায়। তারা ঈশ্বরের প্রতিনিধির বাবুর্চি। আর তিষারও খাওয়ার সমস্যা মিটেছে…
|| ৩খ ||
চিত্র ১ঃ উনোন – জিন ফ্রাঙ্কোইস মিলেটের তুলির ছোঁয়ায়
উনানের আবিষ্কার মোটামুটি ২৯,০০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দেই হয়ে গিয়েছিল, মানে ব্যবহার শুরু হয়ে গিয়েছিল আর কি। ওই ম্যামথ পুড়িয়ে খেতে গিয়ে বেশ বড় রকমের অগ্নিকুন্ডের প্রয়োজনে মাটিতে গর্ত খুড়ে উনান বানানোর চল শুরু হয়ে গিয়েছিল আদিম মানবের মধ্যে। ২০,০০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে ইউক্রেনের অধিবাসীরা কয়লার ব্যবহার শুরু করে দেয়। যে খাবার সুসিদ্ধ করা হবে তা পাতা দিয়ে মুড়ে উনানের খানিকটা ওপরে ঝুলিয়ে রাখা হত। এরপরে মহেঞ্জোদাড়োর অধিবাসীরা আর মিশরীয়রা তাদের ঘরাণায় উনানের ব্যবহার এক উচ্চতায় নিয়ে যায়। সিন্ধু সভ্যতার অধিবাসীদের ঘরে ঘরে একটা করে মাটির উনান ব্যবহৃত হত।
চিত্র ২ঃ পোর্টেবল উনান, গ্রীস
প্রথম পোর্টেবল উনান ব্যবহার করে গ্রীকরা। উন্নত মানের ভাপানো রুটি তৈরীর মুন্সিয়ানা এরাই প্রথম দেখায়। এরপর সেরামিক উনানের ব্যবহার দেখা যেতে শুরু করে। মধ্যযুগে ইউরোপের অধিবাসীরা ফায়ারপ্লেসের ব্যবহার শুরু করে। ডাচ উনানও অনেকটা এইরকমের হতে শুরু করে এই সময় থেকেই। উনানের জ্বালানীরও অনেক পরিবর্তন হয় আস্তে আস্তে। কাঠ, কয়লা, গ্যাস হয়ে সবশেষে ইলেকট্রিক। উনান বা ওভেনের রকমফের যেক’টা পাওয়া যায় তা হল – মাটির উনান, সেরামিক উনান, গ্যাস ওভেন, মেসনারি ওভেন, মাইক্রোওয়েভ ওভেন এবং ওয়াল ওভেন। এছাড়াও বিভিন্ন ক্ষেত্রে, যেমন শিল্পক্ষেত্রে, ল্যাবরেটরিতে বা বড় রান্নাশালায় ওভেন বা উনানের আকার ও আকৃতির প্রভেদ দেখা যায়। আর তাছাড়া বর্তমানে অপ্রচলিত শক্তি উৎসের বিভিন্ন উনান দেখা যায় – সোলার ওভেন যার অন্যতম।
বেশ কিছু উনানের সম্পর্কে এবার একটু জেনে নেওয়া যাক। Double Oven –এর বাংলা কি হতে পারে? দোতলা উনান? কিম্বা দ্বৈত উনান – সে যে নামেই ডাকা হোক না কেন, মোট কথা দুটো উনান একত্রে ব্যবহার করা হয়। অতীতে দুটো উনান হলেও বর্তমানে একটা চুল্লীর সাথে একটা মাইক্রোওভেনও যুক্ত করা হয়েছে।
চিত্র ৩ঃ মাটির উনান, বাংলাদেশ
যে উনান আমরা একটু বয়স্ক মানুষেরা খুব ‘মিস’ করি তা হল মাটির উনান। পিঠে পার্বনের দিনে সরা পিঠা বা ভাপা পিঠার কথা যাদের মনে আছে, তার জানেন যে মাটির উনানের কী মাহাত্ম্য। সরা পিঠার গায়ে লেগে থাকা পোড়া কাঠের গন্ধ আজও মন মেদুর করে দেয়। একদম যে আমরা এই ধরনের উনান দেখি না তা নয়। একটু গ্রামাঞ্চলের দিকে গেলেই এই ধরনের উনান দেখা যায়। আর তাছাড়া বিরিয়ানী রান্না করতে গেলে তো কাঠের উনান অবশ্যম্ভাবী। আর এখনো দল বেধে নদীর চড়ায় যারা পিকনিক করতে যান, তারা জানেন যে, মাটির তৈরী উনান কতটা প্রয়োজনীয় সেই মজার সময়টাতে। এহেন উনান পৃথিবীর প্রায় সমস্ত জায়গাতেই পাওয়া যায়। সূদুর অতীতকাল যদি আমরা যাই তো দেখতে পাবো নেটিভ আমেরিকান থেকে শুরু করে এশিয়া হয়ে সুদুর অস্ট্রেলিয়া – সব জায়গাতেই এর পর্যাপ্ত ব্যবহার। তবে বিভিন্ন দেশে বা অঞ্চলে এর নামকরণ কিন্তু ভিন্ন ভিন্ন। চিলিতে এর নাম ‘কুরান্টো’; আমেরিকায় ‘কাম বেক’; মরোক্কোয় ‘তান্দির’ (আস্ত ভেড়া রান্না হয়ে যেত এতে); হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জে ‘কালুয়া’; প্রোটো-ওশিয়ানিক অঞ্চলে ‘উমু’; ফিজিতে ‘লোভো’; পাপুয়া নিউগিনি’তে ‘মুমু’ ইত্যাদি ইত্যাদি আরোও কত নাম…। বেদুইনরা তো ছোট ছোট মাটির পোর্টেবল উনান বানিয়েই নিয়েছিল, যেখানেই যেত সেখানেই এই উনান হত সঙ্গী, সে মানুষ একাই যেত, কিম্বা পরিবার সমভিব্যহারে। এতে মূলত রুটি বানাতেই কাজে লাগত।
৩০০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে হিন্দু প্রদেশের অধিবাসীরা মাটি পুড়িয়ে বা নানান ধরনের সেরামিক দিয়ে বিভিন্ন আকার আকৃতির উনান বানাতো। অবশ্যই এই আকার বা আকৃতি নির্ভর করত কি ধরনের উৎসবে ব্যবহৃত হচ্ছে তার ওপর। আবার ইটের তৈরী উনান বা সেরামিক উনান এই অঞ্চল ছাড়াও ইতালীতেও ব্যবহৃত হত। আসলে পিজা বানানোর ইতিহাসের সাথে এই সেরামিকের উনান অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত।
জাকাউস উইনজিয়ার, ১৮০২ খ্রীষ্টাব্দে এক নৈশভোজের পার্টিতে প্রথম গ্যাস স্টোভ ব্যবহার করেছিলেন বলে শোনা যায়। মানব ইতিহাসের সর্বপ্রাচীন গ্যাস স্টোভের ব্যবহার এটি। ১৮৩৪ সালে ব্রিটিশ বিজ্ঞানী জেমস শার্প প্রথম গ্যাস ওভেন বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহার করা শুরু করেন। ১৮৫১ সালে তো গ্যাস স্টোভ রীতিমতো এক প্রদর্শনীতে দেখানো হয়েছিল, যা জনমানসে বেশ আলোড়ন তুলেছিল। আর এখন গ্যাসের উনান বাড়ী বাড়ীতে দেখা যায়।
চিত্র ৪ঃ ম্যাসনারি ওভেন
ম্যাসনারি ওভেন, বা ইটের/পাথরের তৈরী উনান। এতে একটা চেম্বারই থাকে যেখানে জ্বলে আগুন। এই আগুন কাঠ বা কয়লা দিয়ে জ্বালানো হত মূলত ১৯ শতকে। বর্তমানে তো প্রাকৃতিক গ্যাস বা তড়িৎ-এরও বহুল ব্যবহার দেখা যায়। বাণিজ্যিকভাবে রুটি বা পিজা তৈরীতে এর ব্যবহার লক্ষনীয়।
মাইক্রোওয়েভ ওভেন, বা টোস্টার ওভেন সম্পর্কে খুব একটা কিছু বলছি না। কারণ এই ধরনের উনানের সঙ্গে আমরা এখন বেশ ভাল করেই পরিচিত। প্রথোমোক্ত ওভেনে মাইক্রো রেডিয়েশান আর দ্বিতীয়োক্ত ওভেনে তড়িৎ ব্যবহৃত হয়, আমরা সকলেই জানি।
চিত্র ৫ঃ ব্লাস্ট ফার্নেস
বাণিজ্যিক, ল্যাবরেটরি, বা শিল্পোৎপাদনে ব্যবহৃত হয় ব্লাস্ট ফার্নেস, কিন, অটোক্লেভ, ইন্ডাস্ট্রিয়াল ওভেন ইত্যাদি। গ্লাস উৎপাদনে, বা কোন ধাতু গলানোর কাজে ব্লাস্ট ফার্নেস অপরিহার্য। জ্বালানী হিসাবে সাধারণত কয়লার ব্যবহার দেখা যায় এতে। সিমেন্ট তৈরীর কারখানায়, কাঠ শুষ্কীকরণ, বা সেরামিকের কাজে লাগে কিন (Kiln)। অত্যন্ত উচ্চ উষ্ণতা এর মধ্যে সৃষ্টি করা যায়।
এই হল মোটামুটি অগ্নিচুল্লীর ব্যাখ্যান। আরোও অনেক কথা বাকী রইল। তা থাক। ভবিষ্যতে যদি কোনভাবে আবার চুল্লীর কথা উত্থাপনের সুযোগ হয়, সেক্ষেত্রে না হয় আবার বসা যাবে কথা নিয়ে…
|| ৩গ ||
– টা টা আন্টি…
– টা টা…
– আসলাম।।
সময় শেষ হয়… একসময়ে এই সময়ও শেষ হল…
ছাত্রীকে নিয়ে তার কাকা বাইকে করে পথের ধুলো উড়িয়ে চলে গেল। আশেপাশের একরাশ লোক দেখতে পেল না, শিক্ষিকার গালে লাল আভা। ছাত্রী দেখতে পেল বাইকের কাঁচে তার আন্টির চেহারা আস্তে আস্তে লোকারণ্যে মিশে যাচ্ছে। কেবল জাজ্বল্যমান হয়ে থাকছে চালকের হৃদয়ে।
[ক্রমশ]
[সব চরিত্র কাল্পনিক]
Tags: দ্বিতীয় বর্ষ প্রথম সংখ্যা, প্রবন্ধ, সুমন দাস