অগ্নিপথ ৬ – অগ্নিবিন্দু
লেখক: সুমন দাস
শিল্পী: সুমন দাস
|| ৬ক ||
স্থানঃ ঢাকেশ্বরী রেস্টুরেন্ট, কল্যাণী
কালঃ ২০০৭
পাত্রঃ সেই যুবক ও সেই যুবতী*
“নিউক্লিয় ফিশন একটি নিউক্লিয়ার বিক্রিয়া যেখানে পারমাণবিক নিউক্লিয়াসের ভাঙন ঘটে এবং তা ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অংশে বিভক্ত হয়। এক্ষেত্রে নিউক্লিয়াস নিউট্রন এবং অপেক্ষাকৃত কম ভরবিশিষ্ট নিউক্লিয়াসে পরিণত হয়। এই নিউক্লিয়ার বিক্রিয়ার ফলে গামা রশ্মির আকারে ফোটন নির্গত হয়। ভারী পদার্থের ক্ষেত্রে নিউক্লিয় ফিশন একটি তাপ উৎপাদী বিক্রিয়া যা বিপুল পরিমাণ শক্তি নির্গত করে। এই শক্তি তড়িৎ-চুম্বকীয় বিকিরণ বা গতিশক্তিরূপে নির্গত হতে পারে। শক্তি উৎপাদনের জন্য ফিশন বিক্রিয়ায় উৎপন্ন পদার্থের মোট বন্ধন শক্তি অবশ্যই প্রাথমিক পদার্থের বন্ধন শক্তির তুলনায় বেশি হতে হবে। উৎপন্ন পদার্থ এক্ষেত্রে প্রাথমিক পদার্থের তুলনায় সম্পূর্ণ ভিন্ন। নিউক্লিয়ার পদার্থবিজ্ঞান এবং নিউক্লিয়ার রসায়নে ফিশন বিক্রিয়া সম্পর্কে আলোচনা করা হয়।
পারমাণবিক শক্তি উৎপাদনের জন্য ফিশন বিক্রিয়া ব্যবহৃত হয়। এছাড়া পারমাণবিক অস্ত্রের বিস্ফোরণ সরিয়ে নেবার জন্যও এই বিক্রিয়া ব্যবহৃত হয়। উভয় পদ্ধতিই সম্ভব হয়েছে কারণ কিছু কিছু পদার্থ যাদেরকে পারমাণবিক জ্বালানি বলে, তারা মুক্ত নিউট্রনের আঘাতের ফলে এই ফিশন বিক্রিয়া ঘটায়। এর ফলে শিকল বিক্রিয়ার (চেইন রিয়্যাকশন) মাধ্যমে শক্তি উৎপন্ন হয়। পারমাণবিক চুল্লীতে এই বিক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রিতভাবে ঘটাতে না পারলে ব্যাপক বিস্ফোরণ ঘটতে পারে।”
– তুমি এইসব কি পড়ছ?
– কেন? আণবিক বোমা সম্পর্কে জানতে চাইলে যে…!!!
– নিউক্লিয়ার ফিশন না কি ছাতা মাথা কাকে বলে পড়ছ, চুল্লী-মুল্লী আবোল তাবোল মোবাইল দেখে দেখে বলছ, আমাকে উল্লু বানাচ্ছ?
যুবক মোবাইলটা রেখে একটু মুচকি হেসে বললে, “আমি এখানে এসেছি প্রেম করতে, আবোল তাবোল বকবক করতে আমার ভাল লাগে না…”
– ও… তাই তো… আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম যে তুমি এসেছ প্রেম করতে। তা হাতটা আমার ধরো…, যুবতীটি টেবিলের ওপর থেকে হাত বাড়িয়ে যুবকের হাত খপ করে ধরে কাছে টানে, তারপর জিজ্ঞাসা করে, “চুমুটা কোথায় খাবে এখানে? না পর্দার আড়ালে?” বলেই আরেকটা হাত দিয়ে ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করতেই যুবকটি বলে ওঠে,
– ইয়ে মানে আণবিক বোমা সম্পর্কে জানতে হলে প্রথমে নিউক্লিয়ার ফিউশান সম্পর্কে জানতে হবে। সেটা জানতে হলে নিউক্লিয়ার ফিশান সম্পর্কে জানতে হবে। সেটার ব্যাপারেই বলছিলাম তোমায়…
– তা ওরকমভাবে বলছিলে কেন?
– আরে ঠাট্টা বোঝ না… বলছি তো সব। ওটা মোবাইল থেকে সংজ্ঞাটা পড়ে শোনাচ্ছিলাম… ছাড়ো এখন… দূরে সরো তো…
– তোমার তো দেখছি কান গাল লাল হয়ে গেছে… হিঃ হিঃ…
– তুমি নির্লজ্জ বেহায়া বলে আমি তো তা হতে পারি না…
– তাই…! এই তোমার প্রেম করার নমুনা? যুবতীটি উল্টোদিকের চেয়ারে বসে বলল, বলো এবারে…
– তোমাকে দেখতে কিন্তু খুব সুন্দর লাগছে।
– আমি কি আবার কাছে এসে বসব?
– তেজস্ক্রিয়তা
– কি?
– সেটা ১৮০০ সালের এক্কেবারে শেষদিক। বেকেরেল নামের একজন বিজ্ঞানীর কথা বলি। বেকেরেল পটাসিয়াম ইউরেনাইল সালফেট নামক দ্যুতিময় খনিজ পদার্থকে আলোকচিত্রের প্লেটে লেপে দেন, এবং এর উপরে কালো বর্ণের আচ্ছাদন দেন, যাতে করে উজ্জ্বল সূর্যালোকে তিনি পরীক্ষা চালাতে পারেন। কিন্তু, আসল পরীক্ষা চালাবার আগে বেকেরেল দেখতে পান যে, তাঁর আলোকচিত্রের প্লেটগুলো এক্সপোজ্ড, অর্থাৎ ব্যবহৃত হয়ে গেছে। ব্যাপারটা তাঁকে নাড়া দেয়। কারণ ফটোগ্রাফিক প্লেটে কোনরকম কোন বিক্রিয়া হওয়ার কথা নয়। বিশেষ করে আলোর অভাবে তো নয়ই। অর্থাৎ অন্ধকারেও কোন একটা বিকিরণ হচ্ছে। তাহলে কি লবণের নিজস্ব বিকিরণের ক্ষমতা আছে? তিনি এবার অনেকরকম লবণকে একইভাবে প্লেটে কালো কাপড়ে মুড়ে রেখে দেন, কিন্তু কোন ফল হয় না। আবার ইউরেনিয়াম সল্ট নিয়ে দেখেন, কাজ হচ্ছে। তিনি বুঝতে পারেন, এই ইউরেনিয়ামই যত নষ্টের মূল। তাঁর যুগান্তকারী আবিস্কার – এই তেজস্ক্রিয়তা। মানে ইউরেনিয়াম ধাতু থেকে স্বতঃস্ফুর্তভাবে বিকিরণ হয়… তারপর আরো অনেক বিজ্ঞানী এগিয়ে আসেন। এক এক করে আরো অনেক ধাতু আবিষ্কৃত হয়। রেডিয়াম, পোলোনিয়াম ইত্যাদি…
– তারপর?
– এখন প্রশ্ন হল কেন হয়? আসলে এরা খুব ভারী ধাতু। ভারী ধাতুর অর্থ হল, এদের পরমাণুর নিউক্লিয়াসের ভর অনেক বেশি। এই ধরো না ইউরেনিয়াম, এর আণবিক গুরুত্বই তো ৯২, মানে এর ভর ২৩৮, ভাবো ৯২ টা প্রোটন আর ১৪৬ টা নিউট্রন গা ঘেষাঘেষি করে নিউক্লিয়াসের মধ্যে পড়ে রয়েছে। তারা আর স্থিতিশীল হবে কি করে? একটাই উপায় রশ্মির আকারে আলফা, বিটা, গামা ইত্যাদি সব কণা বের করে ভার কমাও। হাল্কা হও। সুখে থাকো। ত্যগেই শান্তি। শাস্ত্রে বলেছে না? সব যায়গায় এই একই ব্যাপার। আর তোমরা মেয়েরাই সেটা বোঝো না। আজ শাড়ি দাও, কাল গহনা দাও, পরশু হাতীর মাথা দাও, তরশু… এই না না… এগিয়ে আসতে হবে না… বলছি বলছি… তো যেসব মৌলের ভর ২১০ এর বেশি তাদের মধ্যেই এই স্বতঃস্ফুর্থভাবে রশ্মি বিকিরণের প্রবণতা দেখা যায়। তাই এদের তেজষ্ক্রিয় পদার্থ বলে। আর রশ্মিটাকে তেজষ্ক্রিয় রশ্মি বলে।
এইবারেই বলি আসল গল্প…
|| ৬খ ||
জলবিন্দু যেমন হয়…
মানে পদ্মপাতার ওপর হোক, কিম্বা চোখের আগ্রভাগে – জল টলটলই করে। ইউরেনিয়াম সমেত ভারী মৌলগুলোর ব্যাপারটাও তেমনি। টলটল করে, অর্থাৎ কি না স্থিতিশীল নয়। কিন্তু তা হলেও পরমাণুর নিউক্লিয়াসের মধ্যের নিউক্লিয় বল প্রোটন আর নিউট্রনকে ধরে রাখে বেশ শক্তপোক্ত করেই। প্রাথমিকভাবে এই নিউক্লিয়াসগুলো গোলকের আকারেই থাকে। কিন্তু একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ শক্তি প্রয়োগ যদি করা যায় তাহলে আস্তে আস্তে ‘ডাম্বেল’ আকার ধারণ করে অর্থাৎ মাঝখানটা দুর্বল হতে শুরু করে, আরেকটু বেশি মাত্রায় শক্তি প্রয়োগ হলেই ডাম্বেল দ্বিধাবিভক্ত হয়ে যায়, এবং দুটো আলাদা আলাদা নিউক্লিয়াস তৈরী করে। এক্ষেত্রে এই দুটো নিউক্লিয়াসের মধ্যে পুর্বোক্ত নিউক্লিয়াসের কোন বৈশিষ্ট্য থাকে না। দুটো নতুন আলাদা আলাদা মৌলের নিউক্লিয়াস উৎপন্ন হয়। আর সাথে বেশ কিছু পরিমাণ শক্তিও মুক্ত হয়।
এই মডেলটাকেই বলে ‘লিকুইড ড্রপ মডেল’। মানে আমরা কল্পনা করে নিই এরকমই কিছু একটা ঘটে এই ধরণের পরমাণুর নিউক্লিয়াসের অভ্যন্তরে…
পরমাণু বোমার ক্ষেত্রেও এমনই পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়। তবে এক্ষেত্রে ধাক্কা দেওয়া হয় নিউট্রন দিয়ে। এই ধরণের কাজের ক্ষেত্রে সাধারণত নেওয়া হয় ইউরেনিয়াম (২৩৫) বা প্লুটোনিয়ামকে (২৩৯)।
ইউরেনিয়ামের নিউক্লিয়াসকে ধীরগতিসম্পন্ন নিউট্রন দিয়ে আঘাত করলে নিউক্লিয়াসটি নিউট্রন গ্রহণ করে সংযুক্ত নিউক্লিয়াস গঠন করে (U-236)। সেটি অত্যন্ত দুস্থিত হওয়ায়, সঙ্গে সঙ্গে দুটি খণ্ডে বিভাজিত হয়। এদের বলা হয় বিভাজন খণ্ড। বিভাজন খন্ডগুলি হল বেরিয়াম (Ba-141) এবং ক্রিপটন (Kr-92)। এর সঙ্গে 3 টি নিউট্রন, গামা রশ্মি এবং প্রচন্ড শক্তির উদ্ভব হয়। এই শক্তির পরিমাণ প্রায় 200 MeV।
ইউরেনিয়ামের ক্ষেত্রে এই ফর্মুলাটা হলঃ
প্লুটোনিয়ামের ক্ষেত্রে এই ফর্মুলাটা হলঃ
নিউট্রনের আঘাতে প্রতিটি U-235 (আপাতত আমরা প্লুটোনিয়ামকে পাশে সরিয়ে ইউরেনিয়ামকে নিয়েই এগোই – কারণ, দুজনেরই ক্ষেত্রেই পদ্ধতি এক। একটা বুঝলে অনুরূপভাবে দ্বিতীয়টাও বুঝে যাব।) পরমাণুর নিউক্লীয় বিভাজনের সময় 3টি উচ্চগতিসম্পন্ন নিউট্রন নির্গত হয়। এদের গৌণ নিউট্রন বলা হয়। তাহলে মুখ্য নিউট্রন কে? ওই যে, প্রথমে যেটাকে দিয়ে ধাক্কা মারলাম প্রথম ইউরেনিয়ামকে, সেই তিনি। এই গৌণ নিউট্রনগুলি পার্শ্ববর্তী ইউরেনিয়ামের নিউক্লিয়াসকে আঘাত করে আবার নিক্লিয়ার ফিশান ঘটায় ও নতুন নিউট্রন উৎপন্ন করে। যদি ইউরেনিয়াম পিন্ডের ভর এমন হয় যাতে গৌণ নিউট্রন পিন্ড ছেড়ে যাওয়ার আগেই আবার নিউক্লিয় ফিশান ঘটায় তাহলে নিউক্লিয় ফিশান স্বতঃচালিত হয়। এই কারণেই এই বিক্রিয়া হল শৃঙ্খল বিক্রিয়া বা চেইন রিঅ্যাকশান। এই বিক্রিয়া অনিয়ন্ত্রিত হলেই সেটা বীভৎস বিস্ফোরণ ঘটাবে। অর্থাৎ পরমাণু বোমা।
এর প্রভাব কেমন বীভৎস? হিরোসিমা (ইউরেনিয়াম বোমা) আর নাগাসাকিতে (প্লুটোনিয়াম বোমা) বোমা ফেলার সাথে সাথেই অর্ধেক শহর সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল কয়েক মিনিটের মধ্যেই। শুধু হিরোশিমাতেই তাৎক্ষণিক মৃতের সংখ্যা প্রায় ৭০,০০০! বোমার কেন্দ্রবিন্দুর ৫০০ মিটারের মধ্যে যারা ছিল তারা প্রত্যেকেই মারা গিয়েছিল। বোমা ফেলার তিন সপ্তাহের মধ্যে যারা বেঁচেছিল তাদের মধ্যে বেশির ভাগের চুল ওঠা, অ্যানিমিয়া, ক্যানসার ইত্যদি দেখা দিয়েছিল। আজও বিকলাঙ্গ শিশুর জন্ম হয় সেখানে – প্রায় ৭০ বছর পরেও!
এই নিউক্লিয়ার ফিশান ঘটানো হয় তাহলে কিভাবে? মানে আমরা এই প্রক্রিয়া বোমার মধ্যে উৎপন্ন করা ছাড়াও, যে শক্তি উৎপন্ন হয় তা দিয়ে তো বিদ্যুৎ উৎপন্ন করার মতনও তো কাজ করছি আজকাল। কীভাবে হয় তা? এর জন্য প্রয়োজন হয় পারমাণবিক চুল্লীর। পারমাণবিক চুল্লীর গঠনশৈলীর কথা নিয়ে পাঠকদের বিরক্ত করব না। সে অন্য একদিন বলা যাবে। তবে এটুকু বলতে পারি, বেশ ভজোকটো ব্যাপারই সেটা…
এখন, আমরা দেখছি, নিউক্লীয় ফিশান থেকে যে পরিমাণ শক্তি তাপের আকারে নির্গত হচ্ছে তা নেহাত কম নয়। হিরোশিমার মত একটা শহরের অর্ধেক উড়িয়ে দেওয়ার পক্ষে তা যথেষ্ট। এই তাপশক্তিই হল নিউক্লিয়ার ফিউশান ঘটানোর কাঁচামাল। নিউক্লিয়ার ফিউশানকে নিউক্লিয়ার ফিশানের বিপরীত ঘটনা বলা হয়। কেন? পূর্ববর্তী ক্ষেত্রে যেমন ভারী মৌলের পরমাণুকে ব্যবহার করা হয়, তেমনি, এক্ষেত্রে খুব হাল্কা মৌলের পরমাণু ব্যবহার করা হয়। যেমন ধর হাইড্রোজেন। এবং এ থেকেই সৃষ্টি হয়েছে ব্রক্ষ্মাস্ত্র – হাইড্রোজেন বোম।
কেন্দ্রীণ সংযোজন (ইংরেজি ভাষায়: Nuclear fusion) বা নিউক্লীয় সংযোজন একধরনের কেন্দ্রীণ বিক্রিয়া যাতে দুটি হাল্কা পারমাণবিক নিউক্লিয়াস একত্রিত হয়ে একটি ভারী নিউক্লিয়াস ও বিপুল পরিমাণ শক্তি তৈরি করে। নিউক্লীয় ফিশন বিক্রিয়াসমূহে একটা বড় নিউক্লিয়াসকে ভাঙার জন্য একটি নিউট্রন ব্যবহার করা হয়, কিন্তু নিউক্লীয় ফিউশন বিক্রিয়ায় বিক্রিয়াকারী নিউক্লিয়াসদ্বয়ের মধ্যে সংঘর্ষ ঘটাতে হয়। উভয়েই ধনাত্মক আধানযুক্ত হওয়ায় নিউক্লিয়াসদ্বয়ের মধ্যে শক্তিশালী বিকর্ষণ বল ক্রিয়াশীল থাকে, যা অতিক্রম করা যায় কেবলযদি নিউক্লিয়াসদ্বয়ের গতিশক্তি হয় অনেক বেশী। এই উঁচু গতিশক্তি অর্জন করতে প্রয়োজন হয় উচ্চতাপমাত্রার যা ১ কোটি কেলভিন-এর কাছাকাছি। যেহেতু নিউক্লীয় আধান (অর্থাৎ, পারমাণবিক সংখ্যা) বাড়ার সাথে সাথে প্রয়োজনীয় গতিশক্তির মানও বাড়তে থাকে, সেহেতু নীচু পারমাণবিক-সংখ্যার নিউক্লিয়াস নিয়ে বিক্রিয়া করাটা সবচেয়ে সোজা। অবশ্য এহেন উঁচু তাপমাত্রায় ফিউশন বিক্রিয়াগুলি স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়; এই তাপমাত্রায় বিক্রিয়কসমূহ প্লাজমা অবস্থায় বিরাজ করে (অর্থাৎ, নিউক্লিয়াসগুলি এবং মুক্ত ইলেকট্রনগুলি আলাদা আলাদা থাকে) যেখানে নিউক্লিয়াসগুলির উচ্চ গতিশক্তি তাদের মধ্যকার স্থির-তাড়িতিক বিকর্ষণ বলকে অতিক্রম করতে পারে। ফিউশন বোমা (নিউক্লীয় অস্ত্র দেখুন) এবং নক্ষত্র এমনি করে শক্তি উৎপাদন করে থাকে।
কীভাবে হয় এটা? একটা উদাহরণ নেওয়া যাক। দুটি হাইড্রোজেন নিউক্লিয়াস, অর্থাৎ দুটি প্রোটনের মধ্যে সংযোজনের সম্ভাবনা খুবই কম। নিউক্লীয় ফিউশনের সবচেয়ে সহজতম উদাহরণ হল দুটি ডয়টেরনের সংযোজন। প্রসঙ্গত ভারী হাইড্রোজেন অর্থাৎ ডয়টেরিয়ামের নিউক্লিয়াসকেই ডয়টেরন (1H2) বলা হয়।
এছাড়া হাইড্রোজেনের আরেকটি আইসোটোপ ট্রিটিয়ামের (1H3) নিউক্লিয়াস, অর্থাৎ ট্রাইটনের সঙ্গে ডয়টেরিয়ামের সংযোজনের সম্ভাবনাও বেশি।
এই সংযোজনের ঘটনা ঘটে তারকার মধ্যে, নক্ষত্রের ক্রমবিবর্তনের সময়। আমরা আগের পর্বে (অগ্নিপথ ৫) তা আলোচনা করেছি বলে আর নিগুঢ় বিশ্লেষনে না গিয়ে কেবলমাত্র কিছু তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করছি। উৎসাহী পাঠকদের ওই পর্বটিতে একবার চোখ বোলাতে অনুরোধ করি।
আমরা দেখতে পাচ্ছি, মাত্র 1 গ্রাম ডয়টেরনের সবগুলি নিউক্লিয়াসকে সংযোজিত করা সম্ভব হলে মুক্ত শক্তির পরিমাণ হবে আরোও বেশি, প্রায় 9×1010 jule। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, ইউরেনিয়াম ২৩৫ –এর নিউক্লিয়ার ফিশানে যে পরিমাণ শক্তি মুক্ত হয়, অপেক্ষাকৃত সহজলভ্য ডয়টেরিয়ামের বা ট্রয়টেরিয়ামের নিউক্লিয় ফিউশানে মুক্ত শক্তির পরিমাণ অনেক বেশি। তা ছাড়া বিভাজন ফিশান অপেক্ষা ফিউশানে অপেক্ষাকৃত বেশি নিউক্লিয়াস অংশগ্রহণ করে। এইজন্যেই নিউক্লিয় ফিশানের তুলনায় নিউক্লিয় ফিউশানে দশগুণ বেশি শক্তি মুক্ত হয়। এই ফিউশান বিক্রিয়ার ভিত্তিতেই হাইড্রোজেন বোমা বানানো হয়।
নিউক্লিয় ফিউশনের কিছু শর্ত আছে। কি সেগুলো?
এক) নিউক্লীয় ফিউশনের জন্য হাইড্রোজেনের আইসোটোপগুলিকে কয়েক কোটি ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় উত্তপ্ত করতে হয়, এর চেয়ে কম উষ্ণতায় ফিউশান ঘটাতে পারে না (মনে করুন কীভাবে মহাবিশ্বে গ্যাসকণা জড়ো হয়ে এই ঘটনার প্রেক্ষিতে তারকার উদ্ভব ও তাঁর বিবর্তন সম্ভবপর হয়)। এইজন্যেই এই ফিউশান আসলে তাপ-নিউক্লিয় বা থার্মো নিউক্লিয়ার রিঅ্যাকশান। এই ধরনের উচ্চ উষ্ণতা তৈরী করার সবচেয়ে কার্যকর উপায় হল অনিয়ন্ত্রিত নিউক্লীয় ফিশান, অর্থাৎ কার্যত একটি পারমাণিবিক বোমার বিস্ফোরণ!!!
দুই) ধণাত্মক আধানযুক্ত একাধিক নিউক্লিয়াসকে সংযোজনের জন্য পরস্পরের সংস্পর্শে আনতে হলে স্থির-তড়িৎ বিকর্ষণ বলের বিরুদ্ধে কাজ করতে হয়। এজন্য হাইড্রোজেনের মতো হালকা মৌল নেওয়াই সুবিধাজনক, কারণ সেক্ষেত্রে নিউক্লিয়াসের ধণাত্মক আধানের পরিমাণ কম হয়, ফলে পারস্পরিক বিকর্ষণ বলও কম থাকে।
প্রসঙ্গত বলি, সূর্য ও নক্ষত্রসমূহের অভ্যন্তরে তাপ-নিউক্লীয় বিক্রিয়ার মাধ্যমে শক্তি উৎপন্ন হয়। এদের কেন্দ্রীয় অঞ্চলের কয়েক কোটি ডিগ্রি সেলসিয়াস উষ্ণতা এই ধরণের নিউক্লীয় ফিউশনের পক্ষে অত্যন্ত উপযোগী।
বর্তমানে স্বীকৃত তথ্য হল সূর্যের অভ্যন্তরে কয়েকটি ধাপে তাপ-নিউক্লীয় বিক্রিয়ার একটি চক্র সম্পূর্ণ হয়। প্রতি চক্রে মূলত চারটি প্রোটনের নিউক্লীয় ফিউশনের ফলে তৈরী হয় একটি হিলিয়াম নিউক্লিয়াস এবং দুটি পজিট্রন। সূর্যে বিপুল পরিমাণ হাইড্রোজেন আছে। প্রতি বছরে এই হাইড্রোজেনের প্রায় 1011 ভাগের 1 ভাগ মাত্র রূপান্তরিত হয় শক্তিতে। তা সত্ত্বেও সূর্যের অভ্যন্তরে নিউক্লীয় ফিউশনের ফলে শক্তি উৎপাদনের হার খুবই বেশি, যার মান প্রায় 4×1026 W। এই হারে শক্তি উৎপাদন হলেও সূর্যে যে বিপুল পরিমাণ হাইড্রোজেন জ্বালানী আছে তাঁর সাহায্যে কোটি কোটি বছর ধরে এই শক্তি উৎপন্ন হবে।
|| ৬গ ||
ডায়রী শেষ, অসম্পূর্ণ। বাকি পাতাগুলো রক্ষা করার সময় লেখক পান নি। তীব্র গামা রশ্মিতে বাকি পাতার অধিকাংশ পুড়ে গেছে। কোনক্রমে এইক’টা পাতা বেঁচে আছে, পুণরুদ্ধার করা সম্ভবপর হয়েছে। আমি একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে ডায়রী বন্ধ করলাম।
লেখক সম্ভবত এর পরে আরোও কিছু লিখেছিলেন, লিখেছিলেন হাজার বছর আগের মানব প্রজন্মের আরো কিছু কথা। তাদের অগ্নিতত্ত্ব। অগ্নির বিবর্তন। বা সবচেয়ে বড় কথা, সেই সময়কার সমাজ, সম্পর্ক ও অন্যান্য ব্যবস্থার কথা। সেটা জানার আর কোন উপায় রইল না। লেখকের সঙ্গে কেমন একটা আত্মীয়তা বোধ তৈরী হয়ে গিয়েছিল। তাঁর নাম, আর আমার নাম যে এক – সুমন।
আজ থেকে হাজার বছর আগে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্যবহৃত হয় গামা বোম। হাইড্রোজেন বোমার থেকে কয়েকশ’গুণ শক্তিশালী বোমা। এর পরিণতি হয় ভয়ঙ্কর। সমস্ত মানব প্রজন্মের বিনাশ। শুধু তাই নয়, পৃথিবী তাঁর কক্ষপথ থেকে বিচ্যুত হয়ে মঙ্গলের কক্ষপথের কাছাকাছি চলে আসে। এখন বর্তমানে মঙ্গল আর পৃথিবী পরস্পরকে কেন্দ্র করে ঘুরতে ঘুরতে পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করে চলেছে। আমাদের এখন তিনটে উপগ্রহ – চাঁদ, ফোবোস, ডিমোস। আশঙ্কার কথা চাঁদ দূরে সরে যাচ্ছে দ্রুত। আর বাকি দুটো উপগ্রহ আস্তে আস্তে কাছে সরে আসছে। মঙ্গল আর পৃথিবীর মধ্যের গতি বাড়ছে, ঘুরতে ঘরতে কাছাকাছি চলে আসছে। যারা মাটির তলায় থাকার দরুণ সেই মুহুর্তে বেঁচে গিয়েছিল, তাদের পরবর্তী প্রজন্মেরা, আমরা, লড়াই করে যাচ্ছি এখন বেঁচে থাকার জন্য। মঙ্গলে বসতি স্থাপন করেছি। কিন্তু পৃথিবীর ওপরে টিকতে পারার কোন সম্ভাবনা তৈরী করতে পারিনি এখোনো। গামা রশ্মি আমাদের মস্তিষ্কের অভূতপূর্ব পরিবর্তন করে আমাদের সভ্যতাকে কয়েক হাজার বছর এগিয়ে দিয়েছে বটে, কিন্তু ভবিষ্যত প্রজন্মকে দুর্বল ক্ষীণ করে দিয়েছে। আমরা তাই চেষ্টা করছি পৃথিবীতে যা কিছু ধ্বংসস্তুপ থেকে পাওয়া যায়, অতীত পৃথিবীর সেইসব চিহ্ন নিয়ে সৌরজগতের বাইরে গিয়ে নতুন কোথাও বসতি স্থাপন করা। কোয়ান্টাম ফিজিক্স সেই ক্ষমতা আমাদের দিয়েছে বটে, কিন্তু অক্সিজেন বড় বালাই আমাদের জন্য।
লেখককের সাথে কথা বলার কৌতুহল হচ্ছে। কেবলমাত্র স্থান-কাল-পাত্র জানা থাকলে তা করা সম্ভব, ভাগ্যিস লেখক সাল-তারিখ তাঁর ডায়রিতে লিখে রেখেছিলেন। আমি পোর্টেবল টাইম মেশিনটা বার করলাম…
[ক্রমশ…]
[সব চরিত্র কাল্পনিক]
* — পূর্বের পর্বে দেখুন
Tags: দ্বিতীয় বর্ষ চতুর্থ সংখ্যা, প্রবন্ধ, সুমন দাস