অদৃত ও জিকাসন
লেখক: অয়ন মুখোপাধ্যায়
শিল্পী: সুপ্রিয় দাস
জুপিটারের উপগ্রহে যখন স্পেসশিপ “INDOX 53” অবতরণ করল, অদৃতের যেন কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছিল না যে তারা অসম্ভবকে সম্ভব করেছে। দীর্ঘ আট বছরের প্রচেষ্টা সফল হওয়ার খবরটা পেয়ে ড. রায়চৌধুরী মৃদু হাসলেন। চেয়ারে বসে প্রত্যয়ীভাবে নিজেকে বললেন, ‘ওয়েল ডান সৌম্য রায়চৌধুরী’।
এর পরের পদক্ষেপ – উপগ্রহপৃষ্ঠের জলবায়ু সরজমিনে পরীক্ষানিরীক্ষা করা। আর এসব কাজ করার জন্য তাদের সফরসঙ্গী ‘Xbot’ নামক রোবট। সে প্রথমে নেমে, একটা নির্দিষ্ট অংশ পরীক্ষানিরীক্ষা করে জানাবে এই উপগ্রহে মানুষ অবতরণ করা এই মুহূর্তে উচিত না নয়। Xbot কে পাঠিয়ে অদৃত ডুবে গেল স্মৃতিচারণায়। ২০৪৮ সালের অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি সে প্রথম ড. সৌম্য রায়চৌধুরীর সান্নিধ্যে আসে। অদৃতের ছোটবেলা থেকেই স্বপ্ন ভিনগ্রহে পাড়ি দেবার। তাই সতেরো বছর বয়সে পারডিও বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্লাইট স্কুলে এই স্বপ্ন নিয়ে সে ভর্তি হয়। অ্যারোস্পেস ইঞ্জিনিয়ারিং-এ বিটেক করার পর সে দু-বছর বিমান পরিষেবার সঙ্গে যুক্ত থাকে। তারপর মিচিগান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে FAA পাইলট ট্রেনিং সফলভাবে সম্পন্ন করেন। সঙ্গে আর্টিফিসিয়াল ইন্টিলিজেন্সে দক্ষতাও অর্জন করেন নিজের চেষ্টায়। পুরোপুরিভাবে স্টেটস-এর বাসিন্দা হওয়ার পথে হঠাৎই অদৃত ইসরো (ISRO) -তে ফেরার সিদ্ধান্ত নেয়। তার সেই সিদ্ধান্তে আত্মীয়স্বজন থেকে পরিচিত সবাই অবাক হলেও অদৃতের এই ঘরে ফেরার পিছনে মূল আকর্ষণ ছিল সৌম্য রায়চৌধুরী ও তাঁর ভবিষ্যত পরিকল্পনা।
(২)
২০৪৬ সালে ড. রায়চৌধুরী কীভাবে পৃথিবীর বিকল্প কোনও গ্রহে মানুষ বসবাস শুরু করতে পারবে, তা নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। পৃথিবীটা দিন দিন বসবাসের অনুপযুক্ত হয়ে পড়ছে, অক্সিজেনের পরিমাণ ক্রমহ্রাসমান। মানুষের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ থমকে যাচ্ছে উপযুক্ত পরিবেশ না পাওয়ার ফলে। এইসব চিন্তা তাঁকে ভেতর ভেতর কুরে কুরে খায়। মানব সভ্যতাকে বাঁচাতে গেলে কিছু একটা করতেই হবে। এই উদ্দেশেই ড. রায়চৌধুরী বিভিন্ন মহাকাশ গবেষকদের সহায়তায় এক নতুন প্রোজেক্ট পরিকল্পনা করেন। ভবিষ্যতে মানুষের বসবাসযোগ্য স্থান খোঁজার এই প্রোজেক্টের সঙ্গে যুক্ত হয় ইসরো এবং জাপানি স্পেস এজেন্সি জাক্সা (JAXA)। প্রোজেক্টের নাম “OUR NEXT HOME”। প্রোজেক্টের রূপরেখা, কীভাবে কাজটি সম্পন্ন করা হবে, ফান্ডের ব্যবস্থার জন্য প্রয়োজনীয় পরিকল্পনা সবকিছু ড. রায়চৌধুরী সেরে ফেলেন। এরপর একদিন ইসরোর বহির্বিশ্ব গবেষণা বিভাগের প্রধান এইচ্এস কুমারস্বামীর সঙ্গে বৈঠকের ব্যবস্থা হয়। ইসরোর সদর দপ্তরের ৩০২ নম্বর ঘরে প্রবেশ করলেন ড. রায়চৌধুরী।
“ওয়েলকাম, ড. সৌম্য রায়চৌধুরী। বসুন।”
“থ্যাঙ্ক ইউ।”
“আপনার পরিকল্পনাটির দেখেছি, ইমপ্রেসিভ” আন্তরিকভাবে বললেন কুমারস্বামী।
“কিন্তু এরকম একটা কাজের জন্য গোপনীয়তা অত্যন্ত জরুরী। জেক্সা নিয়ে আপনার কী মত?”
রায়চৌধুরী একটু হেসে বললেন, “আপনার পরিকল্পনা অনুযায়ী আমি চাই সমস্ত কাজটিই অত্যন্ত গোপনীয়তার মাধ্যমে সারতে। মহাকাশ গবেষণা সংক্রান্ত যুদ্ধ যে পর্যায়ে পৌঁছেছে, সদর্থক ফল না পাওয়া পর্যন্ত কোনও দেশই এখন তার গবেষণা প্রকাশ করতে চাইছে না।”
একটু থেমে তিনি আবার বললেন, “জাপানি স্পেস এজেন্সিতে আমার বন্ধু ড. ওয়াকুরা আছেন। আমরা প্রযুক্তিগত ক্ষেত্রে ওঁদের সাহায্য নিতে চাই। গোপনীয়তার ব্যাপারে আপনি নিশ্চিত থাকতে পারেন। তা ছাড়া জাপানিদের গবেষণায় সততা একটা প্রধান বৈশিষ্ট।”
“ওকে। কিন্তু ওই কর্মকাণ্ডের জন্য দপ্তর কোথায় করবেন, কিছু ঠিক করেছেন।”
“স্যার, আমার ইচ্ছে আন্দামানের কোনও নিরিবিলি দ্বীপ, যেখানে মানুষের বসতি কম – সেরকম কোনও জায়গা এই কাজের জন্য বেছে নেওয়া। এই প্রোজেক্টের মূল বৈশিষ্ট্য হল যথাসম্ভব কম মানবসম্পদ ব্যবহার করা, তাতে গোপনীয়তা বজায় থাকবে। যাবতীয় মেকানিক্যাল কাজের জন্য রোবটবাহিনী থাকছে।”
“তাহলে আন্দামানের রুটল্যান্ড দ্বীপটি ব্যবহার করা যেতে পারে। ওখানে আমাদের রোবোটিক গবেষণার জন্য একটি দপ্তর খোলা হয়েছিল।” আর ফান্ডের ব্যাপারে চিন্তার কিছু নেই। সমস্ত ব্যবস্থা হয়ে যাবে। আপনি রিক্যুইজেশন জমা করুন”, ড. রায়চৌধুরীকে আশ্বস্ত করে বললেন কুমারস্বামী।
রুমের বাইরে বেরিয়ে রায়চৌধুরীর নিজেকে অনেকটা হাল্কা বোধ হল। এবার পরিকল্পনা মাফিক কাজটি শুরু করে দিতে হবে।
আন্দামানে পরিবেশ আর আগের মতো নেই। আগে যেখানে দ্বীপগুলি বছরের অর্ধেক সময় বৃষ্টি হত, এখন এক মাসও নিয়মিত বৃষ্টি হয় না। বনাঞ্চলের পরিমাণ অনেক কমে গেছে। তবু নিরিবিলি দ্বীপের ইসরোর দপ্তরটি বেশ পছন্দ হল ড. রায়চৌধুরীর। থার্ড ফ্লোরের বেশ বড় আয়তনের ঘরগুলি নিয়ে ড. রায়চৌধুরীর চেম্বার। কম্পিউটার রুম, ডিজাইনিং রুম ও ওয়ার রুম নিয়ে গোটা চেম্বারটি গড়ে তোলা হয়েছে। এরপর থেকে ড. রায়চৌধুরীর যাবতীয় পরিকল্পনা রূপায়নের প্রাণকেন্দ্র হবে এই দপ্তর। এখানে বসেই তিনি ভারতকে ভিনগ্রহে প্রাণসন্ধান করার চ্যালেঞ্জটি গ্রহণ করেছেন। চেম্বারের সঙ্গে ভেতরে একটি ছোট্ট শোওয়ার ঘরের ব্যবস্থা করা হয়েছে, সেখানে রয়েছে একটা কিচেনও। স্টাফ কোয়াটারগুলি অত্যাধুনিক সুযোগসুবিধা যুক্ত। সপ্তাহে তিন-চারদিন ধরে সারারাতও কাজ চলতে পারে। তাই চেম্বারেও শোওয়া-খাওয়ার ব্যবস্থা করা আছে। থার্ড ফ্লোরের দেওয়ালে ইসরোর বিভিন্ন মিশনের সাফল্যের কাহিনিগুলো জ্বলজ্বল করছে। এগুলি ড. রায়চৌধুরীকে এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা জোগায়। চেম্বারের উইন্ডস্ক্রিন দিয়ে মাউন্ট ফোর্ডের দিকে তাকিয়ে ড. রায়চৌধুরী চোখ বন্ধ করে ভাবতে লাগলেন।
“মে আই কাম ইন, স্যার।”
“ও… অদৃত। এসো এসো। তোমার অপেক্ষাই করছিলাম।”
“আপনার মেল পাওয়ার পর, তৎক্ষণাৎ চলে এলাম। এবার বলুন আমি কী উপকারে আসতে পারি”- মৃদুস্বরে অদৃত বলল।
মিশনের পরিকল্পনার চলার সময়ই নিজের দক্ষতা বাড়ানোর জন্য ড. রায়চৌধুরী তখন দেশ বিদেশের বিভিন্ন সেমিনারে, ওয়ার্কশপে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। সঙ্গে আরও লক্ষ্য টিম গঠনের জন্য উপযুক্ত সদস্যের খোঁজ। ২০৪৮ সালে এমন এক মহাকাশ অভিযান সম্পর্কিত ওয়ার্কশপে গিয়ে অদৃতের সঙ্গে পরিচিত হন। অদৃতের সাহস, টেকনিক্যাল জ্ঞান, ভবিষ্যৎ সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা, অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয়তা ও সর্বোপরি দেশের জন্য কিছু করতে চাওয়ার বাসনা ড. রায়চৌধুরীকে মুগ্ধ করে। অভিজ্ঞ এই বৈজ্ঞানিকের বুঝতে ভুল হয় না যে মহাকাশ অভিযানের এক সম্পদ হয়ে উঠতে পারে অদৃত। তিনি অদৃতকে তাঁর টিমে যোগদানের জন্য আহ্বান করেন। অদৃতও বেশি না ভেবে রাজি হয়ে যায়।
“টিমের বাকিদের নামটা একবার দেখে নাও।” অদৃতকে নির্দেশের সুরে বললেন ড. রায়চৌধুরী।
অদৃত ফাইলটাতে চোখ বোলাতে লাগল। প্রথম জনের নাম প্রেয়সী স্যানাল। কম্পিউটার সায়েন্সের ডিগ্রিধারী বায়োকেমিস্ট এই যুবতীর স্বপ্ন ভিনগ্রহে পাড়ি দেওয়া। সাহসও প্রচন্ড। ভিনগ্রহে প্রাণ থাকলে ভিন্ন পরিবেশে কী কী প্রাণীরা সেখানে থাকতে পারে, তার উপর বিভিন্ন গবেষণায় সে ইতিমধ্যে সাড়া ফেলে দিয়েছে। এ ছাড়া রয়েছেন ড. লিং শিং, সিঙ্গাপুরের বিজ্ঞানী। বর্তমানে তিনি জাপানের মহাকাশ গবেষণাকেন্দ্রে কর্মরত। মহাকাশযান নির্মান ও নিয়ন্ত্রণে তিনি পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ। ইরানের বিখ্যাত জীববিজ্ঞানি আল আহতাব, যিনি অক্সিজেন ছাড়া কোন অবস্থায় প্রাণ সৃষ্টি হতে পারে সেই গবেষণায় নিমগ্ন এবং ড. রায়চৌধুরীকে এই কাজে সহয়তা করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এ ছাড়া আছে অদৃতের সঙ্গেই প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত পাইলট মাইকেল রস। রসের যোগদানের মূল উদ্দেশ্য ছিল নিজের মহাকাশ অভিযানের স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করার।
“সবাই এক-দু’দিনে চলে আসবে” এই বলে ড. রায়চৌধুরী অদৃতকে সমগ্র দপ্তরটি ঘুরিয়ে দেখাতে লাগলেন।
ড. রায়চৌধুরী পরিকল্পনামাফিক কাজটা শুরু করতে চান। তাই প্রথম গুরুত্ব দেওয়া হয় সৌরজগতের গ্রহ ও উপগ্রহের উপর। সেইমতো অনুসন্ধান চালিয়ে, প্রাথমিকভাবে পৃথিবীর সদৃশ তিনটি স্থানকে বেছে নেওয়া হয়–শনির উপগ্রহ এনসিলেডাস, বৃহস্পতির উপগ্রহ ইউরোপা এবং মঙ্গল ও বৃহস্পতির মাঝের বড় আকারের অ্যাস্টারয়েডস্, সেরেস। টিমের সঙ্গে পর্যালোচনা করে উষ্ণ, লবণাক্ত জলের সম্ভবনা বিচার করে তারা ইউরোপাকেই বাছাই করে। এরপর শুরু হয় অভিযানের প্রস্তুতি। একবার মানবহীন যান পাঠিয়ে তথ্য জোগাড় করে ফের মানুষ পাঠানো খরচ-সাপেক্ষ। তাই একই সঙ্গে মানুষ ও যন্ত্র পাঠানোর পরিকল্পনা করা হয়। এই অভিযানে সমস্ত কাজে সহায়তার জন্য থাকবেন জাক্সার এক বিশেষ টিম ও ইসরোর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বিভাগ।
ইতিমধ্যেই ISRO-এর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বিভাগ Xbot নামক রোবট তৈরি করেছেন। Xbot একটি অত্যাধুনিক বুদ্ধিমান রোবট যে নিজে থেকে পরিস্থিতি অনুসারে সিদ্ধান্ত নিতে পারে। এ ছাড়া তার অতিসূক্ষ্ম সিস্মোমিটার উপগ্রহ পৃষ্ঠে কম্পন যেমন মাপতে পারে, আবার তার তাপপ্রবাহ মাপার প্রোব তাকে পারিপার্শ্বিক তাপমাত্রা সম্বন্ধে আগাম ধারণা দেয়। এ ছাড়া মহাকর্ষ ত্বরণের সঠিক পরিমাপ, তাপপ্রবাহ হচ্ছে কি না, কোনও তেজস্ক্রিয় বিকিরণ হচ্ছে কি না, বা যে ভূমির উপর দিয়ে মানুষ চলবে সেটা কেমন–সব তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করতে সক্ষম Xbot। এর মধ্যে বসানো রয়েছে একটি অত্যাধুনিক লাইফ-রেসপন্স সেন্সর। ড. রায়চৌধুরী এই যন্ত্রটি তৈরির টিম লিডার ছিলেন। চার বছর আগে যখন এই Xbot তৈরি করা হয়, ড. রায়চৌধুরীর মাথায় ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার ছকটি তখন থেকেই খেলতে শুরু করে। Xbot প্রায় পনেরো কিমি ব্যাসার্ধের অঞ্চলে ও ছয় কিমি গভীরতা পর্যন্ত প্রাণের সন্ধান পেলে তৎক্ষণাৎ সেই তথ্য মূল কন্ট্রোল রুমে পাঠিয়ে দিতে পারদর্শী। Xbot কে পরীক্ষামূলক ভাবে পৃথিবীর বিভিন্ন দুর্গম অঞ্চল ও গভীর সমুদ্র তলদেশে প্রাণের সন্ধানে পাঠানো হয় এবং প্রতিক্ষেত্রেই সে সফল হয়।
“অদৃত, টিমের আরও এক সদস্যের নাম লিখে নাও।” ড. রায়চৌধুরী বলে উঠলেন।
“বলুন”
“Xbot… আমাদের নেক্সট জেনারেশন রোবট”
“রোবট, সে সদস্য”- বিস্ময়সূচক সুরে অদৃত বলল।
“শুধু সদস্য না, এই অভিযানের মধ্যমণি হল Xbot”, একরাশ প্রশান্তি নিয়ে কথাগুলি বলে চলেন ড. রায়চৌধুরী। তার নজর উইন্ডো স্ক্রিনের দিকে, দূরে সূর্যটা নেমে যাচ্ছে মাউন্ট ফোর্ডের গা বেয়ে।
২০৫০ সালের শুরুতেই ড. রায়চৌধুরী টিম নিয়ে কাজ শুরু করে দিলেন। ইতিমধ্যে ইউরোপা অভিযানের জন্য “INDOX 53” স্পেসশিপ তৈরির কাজ শেষমুহূর্তে জোরকদমে চলছে। টারমুগলি দ্বীপে ইতিমধ্যেই লঞ্চিং প্যাড তৈরি সম্পন্ন। ড. রায়চৌধুরী সব কাজ নিজে তদারকি করেন। দেখতে দেখতে তিন বছর কেমন করে যে কেটে গেল, বোঝাই গেল না।
(৩)
অদৃত পুরানো স্মৃতিতে বিভোর, এমন সময় রেসপন্স গ্যাজেটে Xbot বার্তা দিল সব পারিপার্শ্বিক অবস্থা ঠিকঠাক আছে। চাইলে অদৃতরা ইউরোপার মাটিতে পা দিতে পারে। স্পেশ্যাল স্পেস্শিপ INDOX 53 -তে তিনজন–অদৃত, প্রেয়সী এবং মাইকেল রস। পরিকল্পনা অনুসারে অদৃত ও প্রেয়সী উপগ্রহে অবতরণ করবেন এবং মহাকাশযান সামলাবেন রস্। ইউরোপার বেল্ট অঞ্চলে স্পেসশিপকে সঠিকভাবে নিয়ে যাবার গুরুদায়িত্ব মাইকেল রসের উপর দিয়েছেন ড. রায়চৌধুরী। সবকিছু যন্ত্রনিয়ন্ত্রিত হলেও অজানা অঞ্চলে কোনও কারণে যন্ত্র বেঁকে বসলে সেটিকে দেখার দায়িত্ব তার। বিশেষত ইউরোপা পৃষ্ঠে INDOX 53 কে সফট্ ল্যান্ডিং এবং পরে আবার অদৃতদের ফিরিয়ে আনার সময় ল্যান্ডিং করানো খুবই কঠিন। তাই মাইকেল রস্ অতিরিক্ত সচেতন এ বিষয়ে।
আসলে ইউরোপার নিকটবর্তী অঞ্চলে যাবার ঠিক আগে সমগ্র স্পেসক্রাফটকে টাইটেনিয়ামের একটা লেয়ার দিয়ে মুড়ে ফেলা হয়। তারপর তাকে ইউরোপার বহিঃপৃষ্ঠে অবতরণ করানো হয়। অদৃত ও প্রেয়সি, উপগ্রহ পৃষ্ঠে অবতরণ করে। পৃথিবীর চেয়ে প্রায় সাড়ে সাতগুণ কম অভিকর্ষজ ত্বরণে খুব সাবধানে পা ফেলতে হচ্ছে, সামান্য অসতর্কতা বড় বিপদ ডেকে আনতে পারে। একটা মজার ব্যাপার হল এখানে বছর ও দিনের দৈর্ঘ্য সমান–প্রায় ৮৪ ঘণ্টা। এই একদিন বা এক বছরের মধ্যেই অদৃতদের প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করে ফিরতে হবে। প্রচন্ড ঠান্ডায় (প্রায় মাইনাস ১৫০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড) উপগ্রহ পৃষ্ঠে বরফের স্তর জমে গেছে। স্নো-ডেপথ্ ইনস্ট্রুমেন্ট জানাচ্ছে কোথাও কোথাও স্তর দুই কিমি থেকে চার কিমি পর্যন্ত বিস্তৃত। প্রেয়সী Xbot-এর প্রোগ্রামিংগুলো আর একবার চেক করে নিল। ইউরোপাপৃষ্ঠের বেশ কিছু ছবি তারা তুলল, পৃথিবীতে ফিরে বিশ্লেষণ করার জন্য। তারা ফিরে গেলেও Xbot থাকবে ইউরোপাতে। সে সমগ্র ইউরোপা তন্ন তন্ন করে খুঁজে বেরাবে প্রাণের অস্তিত্ব। প্রেয়সির মনটা একটু খারাপ। Xbot কে একা ছেড়ে আসতে তার মন চাইছে না। সে জানে Xbot যন্ত্র, কিন্তু কয়েকদিনের সফরে সে তো তাদেরই একজন হয়ে উঠেছে।
প্রায় সাড়ে তিন দিন (পৃথিবীর হিসাবে) পর Xbot কে রেখে প্রেয়সী ও অদৃত, মাইকেল রসের সঙ্গে পৃথিবীতে ফিরে আসার জন্য মহাকাশ যানে চেপে পড়ল। পৃথিবীতে এসে ইউরোপার বহির্স্তরের পাথর, বরফ প্রভৃতির ছবি গুরুত্ব সহকারে পর্যায়লোচনা করতে শুরু করলো। গবেষণায় বহু গুরুত্বপূর্ণ নতুন তথ্য উঠে এলেও, প্রাণের অস্তিত্ব থাকতে পারে এমন কোনও সংকেত পাওয়া গেল না। মৃদু একটা আশার আলো যাও বা ছিল, ক্রমশ তা হতাশায় পরিণত হতে শুরু করল। প্রায় দু’মাস Xbot -এর কাছ থেকে কোনও তথ্যসংকেত পাওয়া গেল না – কতকগুলো রুটিনমাফিক রিপোর্টিং ছাড়া।
আজকাল ড. রায়চৌধুরীর মনটা খুব একটা ভালো থাকছে না। সন্ধ্যায় একটু করে হাঁটতে বেরোচ্ছেন। রাস্তায় কেউ নেই, দূরে একটা কুকুর চিৎকার করছিল, সেও হঠাৎ চুপ করে গেল। চারপাশে এক অপার নিঃস্তব্ধতা। নজের চেম্বারে ফিরে তিনি কোর্টটা খুলে হ্যাঙ্গারে ঝুলিয়ে রাখলেন। কন্ট্রোল-রুমের ভেতরে এসে একটা চেয়ারে দেহটা এলিয়ে বসলেন। এই শীতের সন্ধ্যায় অদৃত, প্রেয়সী ও আল আহতব কোনও এক গভীর আলোচনায় মগ্ন। এমন সময় কন্ট্রোল রুমের রিসিভারে আচমকা এক বিকট শব্দ শোনা গেল। ড. রায়চৌধুরীর প্রায় চোখ বুজে এসেছিল। এহেন বিকট শব্দে তিনি চমকে উঠলেন। ড. রায়চৌধুরী, অদৃত সব্বাই দৌড়ে গেলেন রেসপন্স গেজেটের দিকে।
Xbot এর ম্যাসেজ। প্রাণের সন্ধান ইউরোপাতে।
“তড়িঘড়ি সেখানে পৌঁছনোর নির্দেশ Xbot এর”- উত্তেজিত হয়ে অদৃত বলল।
ড. রায়চৌধুরী খুব দ্রুত টিম মিটিং ডাকলেন। নির্ণয় নেওয়া হল খুব দ্রুত অভিযান শুরু করার। পৌঁছাতে হবে ইউরোপাতে। ড. লিং শিং ও মাইকেল রস লেগে পড়লেন অভিযানের প্রস্তুতিতে। ড. রায়চৌধুরী ড. ওয়াকুরার সঙ্গে যোগাযোগ করলেন। ওঁরা সাম্প্রতিক এক বিশেষ ধরণের ট্রান্সলেটার তৈরি করতে সফল হয়েছেন যা কোনও শব্দের কম্পাঙ্ক থেকে সেটির অর্থ নির্ধারণ করতে সক্ষম। অর্থাৎ এককথায় ট্রান্সলেটারটি অজানা ভাষাকে ব্যবহারকারির ভাষায় রূপান্তর করবে। ড. ওয়াকুরা কথা দিলেন সময়মতো একজোড়া ট্রান্সলেটার পৌঁছে যাবে রুটল্যান্ড দ্বীপের ISRO দপ্তরে।
বিকেলের দিকে সমুদ্রের ধারে বসে ড. রায়চৌধুরী। সত্যি এ কয়েক বছরে মহাকাশ ভ্রমণ কতটা পালটে গেছে। মনে মনে ধন্যবাদ জানালেন “সোলার সেইল” (Light Sail) প্রযুক্তিকে। এর ফলে আলোর বেগের 1/10 বেগে উন্নতধরনের দ্রুতগামী স্পেসশিপ তৈরি করা সম্ভব হয়েছে। তাই আজ এত সহজে ইউরোপাতে পৌঁছানো সম্ভব হচ্ছে। এক অন্যরকম উত্তেজনা অনুভব করছেন তিনি। Xbot এর খবর যদি সত্যি হয়, এক যুগান্তকারী ঘটনা ঘটতে চলেছে ইউরোপার মাটিতে।
(৪)
সমস্ত ব্যবস্থা তৈরি। লাইট সেলিং প্রযুক্তিযুক্ত INDOX 53 দ্বিতীয়বারের জন্য ইউরোপাতে যেতে প্রস্তুত। অদৃত ও প্রেয়সীর ধৈর্য্য যেন আর ধরছে না। পরিকল্পনামতো তারা ইউরোপাতে অবতরণ করল, Xbot -এর নির্দেশিত অঞ্চলে। Xbot -এর সংকেত এর তথ্য দেখে তারা কাছাকাছি অঞ্চলে পৌঁছানোর চেষ্টা করল। কিছুক্ষণ পর তারা দেখতে পেল Xbot কে। কিন্তু এ কি!! তাকে ঘিরে রয়েছে একদল প্রাণী। অদ্ভুত সেইসব জীবগুলি। মাথায় তিনটি শিং এর মত অ্যান্টেনা। একটিমাত্র চোখজাতীয় কিছু মাথার সামনের দিকে রয়েছে। এ ছাড়া মুখের দুই প্রান্তে দুটি নল। দেহের মধ্য অংশটি গোলাকার। দেহের নিচের অংশে চারটি পায়ের মতো অঙ্গ। পেটের উপরিভাগে একটি সার্কিট যেন ইমপ্ল্যান্ট করা আছে। তাদের হাতে একটি অদ্ভুতদর্শন যন্ত্র। তাই দিয়ে তারা Xbot এর সামনে দাঁড়িয়ে যেন কিছু বোঝার চেষ্টা করছে।
অদৃত ও প্রেয়সী এবার নিজেদের ট্রান্সলেটর ‘অন্’ করল। যদিও তারা জানে এ চেষ্টা বৃথা। তাদের আবিষ্কৃত ট্রান্সলেটর পৃথিবীর প্রায় সব ভাষার অনুবাদ করতে সক্ষম হলেও, এলিয়েন ভাষার অনুবাদ নিশ্চই সক্ষম নয়। অদৃত কি ভেবে ট্রান্সলেটরের বাইনারি মোডটা অন করতেই খুব স্বাভাবিক অনুবাদ আসতে শুরু করল। সে বুঝল, ভিনগ্রহীরা অনেক বেশি বুদ্ধিমান। শব্দ বা ভাষার ঝামেলার মধ্যে না গিয়ে কেবল বেসিক বাইনারি কোডেই তারা ধরা দিতে চাইছে মানবজাতির কাছে।
স্পেসস্যুট্যের সঙ্গে সংযুক্ত ট্রান্সলেটারে তাদের কথা পড়তে পারছে অদৃত ও প্রেয়সী। প্রচন্ড উত্তেজনার চোটে ইংরাজি হরফগুলোকেও কেমন যেন অচেনা ঠেকতে লাগল দুজনের কাছে। কিন্তু একটু ধাতস্থ হয়ে বুঝতে পারল, তারা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করছে, “সম্ভবত এই দু-পেয়েগুলোও আমাদের মতো অন্যগ্রহে প্রাণের সন্ধানে এসেছে। দেখে তো খুব একটা ভয়ানক লাগছে না। আলাপ করে দেখা যাক।” এদের মনোভাব স্পষ্ট হওয়ায় অদৃতরা মনে মনে নিশ্চিত হল। এই প্রাণীগুলোও হয়তো অদৃতদের বুঝতে চাইছে।
এরপর প্রাণীগুলির কথা থেকে অদৃতরা জানল যে তারা ইউরোপার অধিবাসী নয়। তারাও এক অভিযানের অংশীদার। তারা যে গ্রহে থাকে তার নাম ‘জিকাহুকু’। ইংরেজিতে পরিবর্তন করলে দাঁড়ায়- ‘কার্বোওসেন’। ইউরোপা থেকে দূরত্ব পৃথিবীর চাইতে কয়েকগুণ। সম্পূর্ণ সৌরজগতের বাইরের গ্রহ। বহিঃশত্রুর আক্রমণ প্রতিরোধ করতে তারা এমনভাবে গ্রহটিকে ঘিরে রেখেছে, যাতে টেলিস্কোপ জাতীয় যন্ত্রে ধরা পড়া কঠিন। এই গ্রহের মূল বৈশিষ্ট্য হল, এখানকার প্রাণীরা কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্রহণ করে ও অক্সিজেন নির্গমন করে। তাদের সভ্যতা প্রায় ৩০০০০ বছরের পুরানো। এই প্রাণীগুলির দশজনের একটা দল ইউরোপা পর্যবেক্ষণে এসেছে। কিন্তু ইউরোপায় এসে তারা অখুশি। এখানে তারাও ভিন্ন গ্রহের বা উপগ্রহের প্রাণী খুঁজে পায়নি। সেই সময়েই তারা Xbot কে দেখতে পায়। Xbot ও তাদের উপস্থিতির খবর জানান দেয় পৃথিবীর কন্ট্রোলরুমে।
প্রাণীদের দলটি অদৃতকে সঙ্গে করে তাদের গ্রহ দেখাতে নিয়ে যেতে চান। এ ব্যাপারটা অদৃতের কাছে ভীষণ অপ্রত্যাশিত। সে বুঝে পায় না কি করবে! তার কাছে এক ইতিহাস সৃষ্টির হাতছানি, কিন্তু ব্যাপারটা মারাত্মক বিপজ্জনকও বটে। অদৃত আলোচনা করল প্রথমে প্রেয়সী এবং ড. রসের সঙ্গে। তারপর রেডিয়োতে ধরা হল ড. রায়চৌধুরীকেও।
“স্যার, আমি একটা চান্স নিতে চাই।”
“কিন্তু অদৃত, তুমি বুঝতে পারছ না–দিস মে বি আ ওয়ান ওয়ে জার্নি।”
“আমি ওদের সঙ্গে সামান্য কথা বলেছি স্যার। আমাদের পৃথিবীর পরিবেশ নিয়ে আলোচনা হয়েছে। ওরা জিকাহুকুর যে পরিবেশের কথা উল্লেখ করেছে, তাতে বুঝেছি ওদের তাপমাত্রা আমাদের প্রায় কাছাকাছি তবে একটাই সমস্যা, ওরা গাছের মতো কার্বনের অক্সাইড টেনে নেয়, বদলে ছাড়ে বিশুদ্ধ অক্সিজেন। আমাকেও ওখানে হয়তো মাস্ক পড়ে ঘুরতেও হবে না। স্যার, আপনি চিন্তা করবে না – আমি ম্যানেজ করে নেব।”
অনেক বাদানুবাদের পর ঠিক হল, অদৃত আর Xbot ভিনগ্রহীদের সঙ্গে যাবে। Xbot ওই গ্রহ থেকে প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ করবে আর কন্ট্রোলরুমের সঙ্গে যোগাযোগ রাখবে নিয়মিত। প্রেয়সী আর ড. রস ফিরে যাবেন পৃথিবীতে।
স্পেসশিপ-এর ভিতর অদৃত দেখল সমস্ত ব্যবস্থাই মজুত। স্পেসশিপের ভেতরের অংশ অনেকগুলি প্রকোষ্ঠে বিভক্ত। এ ছাড়া ইঞ্জিন ঘরটি স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রের নিয়ন্ত্রণাধীন। একটা বড় স্ক্রিনে বাইরের জগতটা দেখা যাচ্ছে। স্ক্রিনের একটা অংশে তাদের নিজস্ব গ্রহের চিত্র ফুটে উঠেছে।
এদের গ্রহের অভিকর্ষজ ত্বরণ পৃথিবীর দ্বিগুণ। তাই সেই পরিবেশে মানানোর জন্য অদৃতকে বিশেষ পোশাক দেওয়া হয়। স্পেসশিপের ভেতরটা এমনভাবে তৈরি যে এর অর্ধেক অংশটা তাদের গ্রহের পরিবেশের সদৃশ। বাকী অংশে সমস্ত যন্ত্রপাতি। স্পেসশিপের একটি বিশেষ ঘরে অদৃতকে ট্রেনিং দেওয়া হল কীভাবে জিকাহুকুতে হাঁটতে চলতে হবে। পোশাককে কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। অদৃত মনোযোগ দিয়ে সব শিখতে লাগল।
(৫)
মাসখানেক পর জিকাহুকুতে নামতেই অদৃত কেমন হতবাক হয়ে গেল। তাপমাত্রা পৃথিবীর সামান্য বেশি। তবে পরিবেশ রুক্ষ। ছোট ছোট হ্রদের মাঝে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ভূখন্ড। এখানে আলাদা আলাদা দেশের ধারণা নেই। সমগ্র গ্রহটাই একটা দেশ। অদৃত প্রাণীগুলোর নাম রাখল জিকাসন। এই জিকাসনরা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের বিভিন্ন প্রান্তে প্রাণের সম্ভাবনা নিয়ে বিস্তর গবেষণা ও অভিযান চালিয়েছে। একই সঙ্গে বহিঃশত্রুর হাত থেকে গ্রহকে রক্ষা করার ব্যবস্থায় তারা যথেষ্ট সক্ষম। জিকাহুকুর যে পরিবেশ আজ দেখা যাচ্ছে তা কিন্তু বেশ কয়েক দশক আগে ছিল না। ছিল পর্যাপ্ত কার্বন-ডাই-অক্সাইড। শ্বাসকার্য ও শক্তি যোগানের উৎসগুলি হঠাৎই কমতে শুরু করেছে। তাই জিকাসনরা বিকল্প বাসস্থান অথবা সমস্যা সমাধানের উপায় খুঁজছে।
জিকাহুকুতে অবতরণের পর জিকাসনদের সঙ্গে অদৃতকে প্রথমে মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে অদৃতকে পরীক্ষানিরীক্ষা করে তাদের গ্রহের প্রবেশের ছাড়পত্র দেওয়া হয়। গ্রহটিতে কয়েক পা হাঁটতে হাঁটতে Xbot জানাল জিকাসনদের কথামতোই এখানে কার্বন-ডাই-অক্সাইড বেশি, অক্সিজেন কম, কিন্তু যেহেতু জিকাসনরা কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্রহণ করে ও অক্সিজেন ত্যাগ করে, তাই অক্সিজেনের মাত্রা ক্রমবর্ধমান। এই অবস্থায় অবশ্য অদৃতের শ্বাসকার্য চালাতে অসুবিধা খুব একটা হয় না। কিন্তু অক্সিজেন ঠিক ততটাও নয় যে একদম খোলা হাওয়ায় একজন মানুষ ঘুরে ফিরে বেড়াতে পারে। জিকাহুকুতে কিছু ছোট আগ্নেয়গিরি আছে, ফলে তাপমাত্রা স্বাভাবিকের থেকে একটু বেশি। ছোট ছোট হ্রদের ধারে ভূখন্ডগুলিতে জিকাসনদের বাস। জল ও স্থলভাগ মিশ্রিত অঞ্চলে বসবাসের জন্য তারা হাঁটতে-চলতে ও সাঁতার কাটতে সক্ষম। এদের দেহের গঠনও সেরকমভাবে তৈরি। এদের এক একটা বসতি বড় কাচের অর্ধ-গোলক দ্বারা আবৃত।
এক একটি অর্ধগোলক এক-একটি লোকালিটি নির্দেশ করে। তাদের ১৫০-২০০ জন জিকাসন বসবাস করে। জিকাসনদের যানবাহন অনেকটা তিমি মাছের মতো দেখতে স্পিডবোট, যা জলে ও আকাশে- উভয় মাধ্যমেই যাতায়াত করতে পারে। অদৃত একটা অর্ধগোলকের ভিতর প্রবেশ করল। সে জানতে চায়, কেন তাদের বসতি এইরকম গোলক দ্বারা আবৃত? জিকাসনদের যে টিমটা অদৃতকে ঘুরিয়ে দেখানোর দায়িত্বে ছিল, তার একজন জানাল যে ষাট থেকে সত্তর বছর আগে জিকাসনদের উন্নয়নের প্রভাবে পরিবেশ বিঘ্নিত হয়। তাই পরিবেশের ক্ষতিকর উপাদানগুলির হাত থেকে বসতিগুলিকে রক্ষা করার জন্য তারা এভাবে কাচজাতীয় উপাদানের গোলকে বসতিগুলিকে ঢেকে ফেলে। অদৃত তার বিশেষ পোষাকের কার্যকারিতা এবার উপলব্ধি করতে পারছে। জিকাহুকুর চারদিকে এক বিশেষ ধরণের মাশরুম জাতীয় কিন্তু বৃহদাকার উদ্ভিদে ভর্তি। গাছগুলির উচ্চতা ৫-৬ ফুট। এগুলির এক-একটির রং সাদা, ছাই বা হলুদ। জিকাসনরা জানায় এটি হল তাদের একমাত্র খাদ্য উপাদান। এই উদ্ভিদের উপর জিকাসনদের পুষ্টি ও শক্তিলাভ নির্ভর করে আছে। এইসব দেখতে দেখতে অদৃতের চোখেও ভেসে ওঠে কীভাবে মানুষও পৃথিবীর ভবিষ্যৎ অন্ধকারের দিকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে। পৃথিবীতে আজ মোট বনভূমির ১ শতাংশও অবশিষ্ট নেই। বায়ুমণ্ডলে অক্সিজেনের পরিমাণ ১১ শতাংশ ও কার্বন-ডাই-অক্সাইড ৭ শতাংশ। মানুষ কৃত্রিম অক্সিজেনের উপর নির্ভরশীল হয়ে উঠেছে। কিন্তু সেখানেও জাল অক্সিজেন কারবারিদের রমরমা। খাদ্যের পরিমাণও কমছে। বৈজ্ঞানিকরা সিন্থেটিক খাদ্যের জোগান দিলেও সেই খাদ্য মানুষকে শারীরিকভাবে দুর্বল করছে। এইসব ভাবতে ভাবতে অদৃত হতাশ হয়ে পড়ে। পৃথিবীর সভ্যতাকে বাঁচাতে ও মানুষজনকে নিরাপদ আশ্রয় দেবার জন্যই তো সে নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এক অজানা, বিপদসঙ্কুল অন্য গ্রহে এসেছে। তাকে যে কিছু করতেই হবে মানব সভ্যতার জন্য।
একজন এসে অদৃতকে একটি প্লেটে করে মাশরুম-এর পেস্ট দিয়ে গেল। এদের ভাষায় এটির নাম ‘স্পাইরো’ বা ‘শক্তি-কুন্ড’। অদৃত এই পেস্ট খেতেই এক অপার শক্তি লাভ করল। হতাশ ও ক্লান্ত অদৃত যেন এক অদ্ভুত শক্তিতে পরিপূর্ণ হয়ে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে তার পানীয় জলের তেষ্টাও মিটে গেল। ফুরফুরে মেজাজে অদৃত Xbot কে সঙ্গে নিয়ে লোকালয়গুলি ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগল। তার দিকে তাকিয়ে জিকাসনেরাও বেশ অবাক হল। এরকম দু-পেয়ে এবং লম্বা জীবকে তারা ইহজন্মে দেখেনি। তবে অদৃতের সঙ্গে থাকা গাইড সবার সঙ্গে তার ছোট করে পরিচয় করিয়ে তাদের ভয় ভাঙিয়ে দিচ্ছিল। অদৃত দেখল, একটি অঞ্চলে কতগুলি ছোট ছোট বাচ্চা মহাকাশের দিকে টেলিস্কোপের মতো কিছু একটা তাক করে কি যেন দেখছে। সে বুঝল, জিকাসনদের অন্য গ্রহ নক্ষত্রদের প্রতি আকর্ষণ বেশ ছোটবেলা থেকেই সঞ্চারিত হয়।
এরপর অদৃতকে জিকাসনরা একটি লাইব্রেরি জাতীয় বিল্ডিং-এ নিয়ে যায়। সেখানে একজন অদৃতকে জিকাহুকুর ইতিহাস তুলে ধরেন। মানব সভ্যতার মতো এদেরও বিবর্তনের মাধ্যমে আজকের অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। এককালে এখানে অন্য প্রাণীরাও ছিল। ছিল কিছু উদ্ভিদ যারা অক্সিজেন গ্রহণ করে ও কার্বন-ডাই-অক্সাইড ত্যাগ করে পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রেখেছিল। কিন্তু জিকাহুকুর একদল প্রাণী, জিকাসনদের মধ্যে সবচেয়ে উন্নত ও ক্ষমতাশালী অংশটি নিয়ে নিজেদের মধ্যে ধ্বংসের খেলায় মেতে ওঠে। এক অংশের জিকাসনরা অন্য অংশের জিকাসনদের হারাতে বিভিন্ন ধ্বংসলীলায় বৈজ্ঞানিক বুদ্ধিতে কাজে লাগাতে থাকে। প্রায় ২০০ বছর আগে এক বিশেষ ধরণের জৈব অস্ত্রের প্রয়োগে সমগ্র জিকাহুকুর প্রাণীকুল-উদ্ভিদ-জলজ জীবন ধ্বংস হয়ে যায়। বেঁচে যায় কেবলমাত্র কয়েক হাজার জিকাসন যারা বিভিন্ন কাজে ভূ-গর্ভে ১০০-১৫০ ফুট নীচে ছিল। আর বাকি সব উদ্ভিদ ধ্বংস হলেও মাশরুম জাতীয় উদ্ভিদ বেঁচে যায়। এই স্পাইরোর ওপর নির্ভর করেই জিকাসনরা বেঁচে আছে ও নতুন করে তাদের গ্রহটিকে গড়ে তোলার চেষ্টা করেছে।
প্রবল ধ্বংসের পরবর্তী সময়ে যে সব জিকাসনরা বেঁচে যায়, তাদের মধ্যে থেকে ‘শিংফো’ নামক এক মহৎ জিকাসন, ধ্বংসপরবর্তী জিকাহুকুকে গড়ে তুলতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নেন। ‘শিংফো’ তাদের কাছে ঈশ্বর-স্বরূপ। শিংফো দীর্ঘ গবেষণা চালিয়ে এমন এক ‘চিপ’ তৈরিতে সফল হন, যা এই চিপধারী প্রাণীদের মস্তিষ্কে কখনও অপকারের চিন্তা আসতে দেবে না। তিনি বেঁচে থাকা সমস্ত জিকাসনদের দেহে এটি এমনভাবে ইমপ্ল্যান্ট করে দেন যে, এটি তাদের দেহের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে ওঠে। বংশপরম্পরায় এই বৈশিষ্ট্য এক জিকাসন থেকে অন্য জিকাসনে দেহে চালিত হয়। এই ‘পিস্-চিপ’ জিকাসনদের ডিএনএ-তে সংযুক্ত হয়ে গেছে। তাই সমগ্র জিকাহুকু এখন একটা পরিবার। কিন্তু এই উপলব্ধি করতে যে পরিমাণ ধ্বংসলীলা তাদের প্রত্যক্ষ করতে হয়েছে, তা অকল্পনীয়। শিংফোর নির্দেশমতো জিকাসনরা অন্য গ্রহে প্রাণ সন্ধান করতে শুরু করে। ধ্বংসের ফলে তাদের গ্রহে কার্বন-ডাই-অক্সাইড কমে গেছে, জীব বৈচিত্র্যের অভাবে জিকাসনরা প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ থেকে বঞ্চিত। সঙ্গে সঙ্গে তাদের বিকাশের হারও থমকে গেছে। কিন্তু ‘শিংফো’ তাদের একটা সতর্কবাণী দিয়ে রেখেছিলেন। জিকাসনরা কোনও বহিঃশক্তির প্রভাবে পড়লে বা তাদের ওপর কেউ জোর খাটানোর চেষ্টা করলে ‘পিস্-চিপ’ -এর কার্যকারিতা কমে যাবে এবং তারা ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাবে। জিকাসনদের চিপ দ্বারা স্পাইরোর বংশবিস্তার নিয়ন্ত্রিত হয়। তাই ‘পিস্-চিপ’ ধ্বংস হলে স্পাইরোর ধ্বংসও অনিবার্য। ফলে জিকাসনরা খাদ্য সংকটে পড়ে শেষ হয়ে যাবে চিরতরে।
অদৃত এবার তাদের মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্রে প্রবেশ করে। সেখান থেকে যোগাযোগ করা হয় ড. সৌম্য রায়চৌধুরীর সঙ্গে। ওঁকে অদৃত সব সংক্ষেপে বর্ণনা করেন। ড. রায়চৌধুরী অদৃতকে পৃথিবীর সমস্যা সমাধানে ওই গ্রহের প্রাণীগুলি থেকে কোনও উপায় পাওয়া যায় কি না সে বিষয়ে বিশদে আলোচনা করতে বলেন। অদৃত জিকাসনদের প্রস্তাব দেন পৃথিবীতে যাওয়ার। তারা যদি পৃথিবীতে একটি কলোনী করে, তাহলে পৃথিবীর কার্বন-ডাই-অক্সাইড কমবে ও অক্সিজেনের মাত্রা বাড়বে। পরিবর্তে ভবিষ্যতে জিকাহুকুতেও মানুষরা এসে থাকবে ও এখানকার বাতাসে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের মাত্রা বাড়াবে।
রায়চৌধুরী জিকাসনদের অদৃতের মাধ্যমে আরও একটা প্রস্তাব দেন। যেহেতু অন্য গ্রহ বা জীবদের পর্যবেক্ষণের হাত থেকে নিজেদের গ্রহকে লুকিয়ে রাখার প্রযুক্তি জিকাসনদের আছে। তাই পৃথিবীতে আসার মহাকাশযানকেও তাই তারা যেন ‘ইনভিসিবেল’ মোডে নিয়ে আসে। পৃথিবীর তাবড় তাবড় শক্তিধর দেশ ও তাদের সঙ্গে যুক্ত ব্যবসায়ীদের মানসিকতা সম্বন্ধে ড. রায়চৌধুরীরা ওয়াকিবহাল। এই মিশন সফল হওয়ার আগে তাই তিনি বিষয়টি পাঁচ কান হতে দিতে চান না। সমস্ত ব্যবস্থা ও পরিকল্পনা সীমাবদ্ধ থাকবে ড. রায়চৌধুরীদের টিমের সদস্যদের মধ্যে। এ ছাড়া রুটল্যান্ড দ্বীপের দপ্তরটি রোবট পরিচালিত হওয়ায় খবর পাচার হওয়ার সম্ভবনাও কম। ড. রায়চৌধুরী তার কোর টিম নিয়ে কাজে লেগে পড়লেন। লিটল আন্দামান দ্বীপে জিকাসনদের অবতরণ করানো ও রাখার সিদ্ধান্ত হয়। গ্লোবাল ওয়ার্মিং এর প্রভাবে এই দ্বীপের একটা অংশ অত্যন্ত রুক্ষ ও উচ্চতাপমাত্রাযুক্ত অঞ্চলে পরিণত হয়েছে। সঙ্গে কমে গেছে বৃষ্টির পরিমাণও। বিস্তীর্ণ অঞ্চলে বেশ কয়েক বর্গকিলোমিটার জুড়ে জিকাসনদের কলোনি তৈরি করা হয়। সারা পৃথিবীর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এই অঞ্চলেরও তাপমাত্রা বেশি ও অক্সিজেনের পরিমান কম। সমস্ত অঞ্চলটির নিরাপত্তা ও অন্যান্য ব্যবস্থাপনার জন্য বেশ কয়েকশো রোবটকে নিযুক্ত করা হল। সমস্ত ব্যবস্থার দায়িত্ব দেওয়া হল ড. রায়চৌধুরীর সহকারী ও বিশ্বস্ত শৈলেশ ঝা-কে। সমুদ্র তীরবর্তী এক নির্জন এলাকায় স্পেসক্রাফট অবতরণ করানোর ব্যবস্থা করা হল।
এ ছাড়া জিকাহুকুর তুলনায় পৃথিবীর অভিকর্ষজ ত্বরণ প্রায় অর্ধেক। এর জন্য জিকাসনদের পৃথিবীর অভিকর্ষে খাপ-খাওয়ানোর লক্ষ্যে এক বিশেষ ধরণের ‘গ্রাভিটোমিটার’ যন্ত্র তৈরি করা হল। এই পরিধানযোগ্য গ্রাভিটোমিটার জিকাসনদের পৃথিবীর বুকে মানিয়ে নিতে সাহায্য করবে। পৃথিবীতে জিকাসনদের রাখার সমস্ত ব্যবস্থা সম্পন্ন হওয়ার খবর জিকাহুকুতে পৌঁছল।
(৬)
এবার অদৃতদের পৃথিবীর উদ্দেশ্যে রওনা দেওয়ার পালা। পঞ্চাশ জন জিকাসনদের সঙ্গে নিয়ে Xbot ও অদৃত পৃথিবীর দিকে রওনা হল। মঙ্গল অতিক্রম করা মাত্রই স্পেসক্রাফটটিকে ইনভিসিবল মোডে চালনা করা হল এবং কয়েক দিনের মধ্যেই লিটিল আন্দামানের X53XZ অবতরণস্থল ছুঁল জিকাহুকু থেকে আসা স্পেসক্রাফট। জিকাসনরা একে একে অবতরণ করলেন। পৃথিবীর পরিবেশ, সমুদ্রে, উদ্ভিদ তাদের মুগ্ধ করল। তাদের প্রজন্ম এত জীববৈচিত্র দেখেনি। প্রাথমিক পরিচয়পর্ব মিটে গেলে তাদের জিকাসন কলোনিতে নিয়ে যাওয়া হল।
ড. সৌম্য রায়চৌধুরী জিকাসনদের কলোনির নিরাপত্তা ভালো করে দেখে নিলেন। এর আশে পাশে স্পাইরোর বীজ বপন করা হল। ‘পিস্-চিপ’ -এর প্রভাবে কয়েক দিনের মধ্যেই স্পাইরোগুলি দ্রুত বৃদ্ধি পেতে থাকল। একমাসের মধ্যেই ওই অঞ্চলে কার্বন-ডাই-অক্সাইড কমতে থাকল এবং অক্সিজেনের মাত্রা বৃদ্ধি পেল। অদৃতরা আশার আলো দেখতে শুরু করল, এবার অন্তত পৃথিবীর পরিবেশটাকে একটু ভালোর দিকে নিয়ে যাওয়া যাবে।
কিন্তু সমগ্র পৃথিবীর পরিবেশ যেভাবে ক্ষতিকর, দূষিত গ্যাসে ভরে গেছে, তাতে সমস্ত পৃথিবীর পরিবেশের কার্বন-ডাই-অক্সাইড কমাতে বহু জিকাসন ও প্রচুর সময় দরকার। ইতিমধ্যেই পৃথিবীতে ‘টেকনেক্সট’ ও ‘ফিউচার আর্থ’ বলে দুটি কর্পোরেট হাউস অক্সিজেন মাস্ক, সিলিন্ডার, ইন্-হাউস্-গ্রীন এনভায়রনমেন্ট প্রভৃতি পরিষেবা প্রদানের ব্যাবসায় টাইকুন হয়ে গেছে। তাদের দাপটে বিভিন্ন দেশের সরকার পরিবেশ রক্ষায় কড়া আইন রূপায়ণ করতে পারছে না। এরা পৃথিবীর সমস্ত অঞ্চলে উপগ্রহ মারফত নজরদারি চালাচ্ছে। সমগ্র পৃথিবীর ভবিষ্যৎ যেন এরাই নিয়ন্ত্রণ করছে। এইসব ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আঁতাত রয়েছে রাজনীতিবিদদের। ফলে ফেডারাল গভর্মেন্টের সহায়তায় এই সব কোম্পানিগুলি বিভিন্ন দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলায়। ড. রায়চৌধুরী তাই এই প্রকল্পটি অত্যন্ত গোপনে চালাতে চাইছিলেন। তিনি জানতেন এই সব মানুষরা চায় না পৃথিবীর পরিবেশ পূর্বের মতো হয়ে উঠুক। নিজেদের ব্যাবসায় মুনাফার জন্য তারা মানবজাতির ক্ষতিসাধনেও পিছপা হবে না। তবে তিনি এটাও জানেন তাঁর সাধ ও সাধ্যের মধ্যে বিস্তর ফারাক আছে। তিনি প্রচেষ্টা করলেও মানবসভ্যতার কতটা কল্যাণ করতে পারবেন- সে বিষয়ে তিনি দিশাহীন।
ফিউচার আর্থ-এর সদরদপ্তরে গুরুত্বপূর্ণ মিটিং চলছে। আলোচ্য বিষয়, কীভাবে ভবিষ্যতে পুষ্টিকর খাদ্যের বাজারটা পুরোপুরি হাতের মুঠোয় করা যায়। সংস্থার সিইও-এর রিপোর্ট অনুসারে কৃত্রিম অক্সিজেনের বাজারে ৮০ শতাংশ তাদের দখলে। পৃথিবী জুড়ে সমস্ত জায়গায় কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ মাপার সিস্টেম ইনস্টল করায় তাদের বাজারে চাহিদা মতন জোগান দেওয়ার সুবিধা হয়েছে। সিন্থেটিক খাদ্যদ্রব্য মানুষের সব রকমের চাহিদা মেটাতে পারছে না। তাই সংস্থার মূল লক্ষ্য এমন খাদ্যদ্রব্য কৃত্রিমভাবে তৈরি করা, যাতে ভবিষ্যতে মানুষ তাদের কোম্পানির খাদ্যের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। আর তা সম্ভব হলে, বাজারের সিংঘভাগই তাদের। ফিউচার আর্থ-এর সঙ্গে টেক্নেক্সট্-এর চুক্তি রয়েছে, ওরা একে অপরের ব্যাবসায় প্রবেশ করে না। সমগ্র বাজারের বেশির ভাগটাই এই দু’জনের দখলে। টেকনেক্সট্-এর বাজারও পরিবেশ দূষণ ও পৃথিবীর আবহাওয়া পরিবর্তনের ফলে অনেকগুণ বেড়েছে। এমন সময় ফিউচার আর্থ-এর CEO মার্ক আর্থার-এর কাছে গুরুত্বপূর্ণ ফোন কল এল। কোম্পানির R & D বিভাগের প্রধান বৈজ্ঞানিক ড. চ্যাঙ সহ পাঁচজনের উচ্চপদস্থ কমিটির বৈঠকের পর তারা মার্ক আর্থারের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে চান। আর্থার সাহেব দ্রুত কোম্পানির R&D বিভাগে পৌঁছে যান। বৈজ্ঞানিকরা তাকে জানান ভারতের আন্দামান দ্বীপপুঞ্জ অঞ্চলের এক অংশে অদ্ভুতভাবে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ কমছে ও অক্সিজেন সমহারে বাড়ছে। এই বিষয়ে বিশেষ খোঁজখবর ও গবেষণার জন্য তারা অনুমতি ও অর্থ চান।
আর্থার সাহেবের কাছ থেকে গ্রীন সিগন্যাল পেয়ে শুরু হয় তদন্ত। প্রচুর চেষ্টার পর তারা আঁচ করতে পারে, এই অঞ্চলে কিছু একটা অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটে চলেছে। তাদের স্পাই টিম ছড়িয়ে পড়ল। একমাসের প্রচেষ্টায় তারা জিকাসনদের ঠিকানা খুঁজে বের করল। সমস্ত ব্যবস্থা আঁটোসাঁটো থাকলেও যেভাবেই হোক স্পাইরোর নমুনা পৌঁছে গেল ফিউচার আর্থের হাতে। পরীক্ষা করে তারা নিশ্চিত, যা তারা চেয়েছিল তা তাদের হাতের মুঠোয়। কিন্তু চুরি করে আনা স্পাইরোগুলি কিছুতেই বৃদ্ধি পাচ্ছিল না। কোনও কিছুর একটা অভাবে তারা মৃতপ্রায়। ড. চ্যাঙ অনেক চেষ্টা করে বেশ কিছু অর্থের বিনিময়ে জিকাসনদের তথ্য জোগাড় করে ফেলল। এই তথ্য মোতাবেক, স্পাইরোগুলিকে কর্মক্ষম করতে পারে ভিনগ্রহের প্রাণীরা। এদের কাছে আছে ‘পিস্-চিপ’ যা স্পাইরোগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করে। ফলে কর্পোরেট দুনিয়ার নজর পড়ল জিকাসনদের উপর।
“আমার যে কোনও ভাবে জিকাসন-এর একটা নমুনা দরকার” ড. চ্যাঙ নির্দেশ দিলেন।
ফিউচার আর্থের সিঙ্গাপুর দপ্তরের পক্ষে টিম বার্ন, “স্যার, সমস্ত ব্যবস্থা হয়ে যাবে। আর দু’দিন সময় চাই।”
“ওকে”।
টিম বার্ন-এর নির্দেশে মালেশিয়ার এক দুষ্কৃতি দল পৌঁছে গেল লিটল আন্দামানে। একদিন গভীর রাতে ইসরোর আন্দামান গবেষণাগারের কয়েকটি রোবট হঠাৎ বিকল হয়ে গেল।
গভীর রাতে শৈলেশ ঝা-এর ফোন এল, “স্যার, দুটি জিকাসন অপহৃত হয়ে গেছে। একাধিক রোবটকে হ্যাক করে সমস্ত ব্যবস্থাকে অচল করা হয়। তারপর দেখি দুটি জিকাসন নেই।”
মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লেন ড. রায়চৌধুরী। অদৃতের ঘরে গিয়ে ডাকলেন, “অদৃত… অদৃত।”
“স্যার। এত রাতে… কিছু হয়েছে?”
“হ্যাঁ… ওরা জিকাসনদের অপহরণ করেছে। এই প্রকল্পটি হয়তো ব্যর্থ হবে। ওদের হাতে জিকাসন ও স্পাইরো পৌঁছে গেলে সর্বনাশ। মুনাফার জন্য এরা সব করতে পারে। জিকাসনদের ওরা ধ্বংস করে ফেলবে।”
কয়েক দিন পর জিকাহুকু থেকে বার্তা এল, “তোমরা তোমাদের কথা রাখোনি। জিকাসন ও স্পাইরোকে অন্যায়ভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। এমন হলে জিকাসনদের সামনে সমূহ বিপদ। তাই যত দ্রুত সম্ভব জিকাহুকুতে তাদের ফেরৎ পাঠানো হোক।”
(৭)
ড. রায়চৌধুরী, অদৃত ও প্রেয়সী সমস্ত টিমকে নিয়ে আলোচনায় বসল। ফিউচার আর্থ ও টেক্নেক্সট্ -এর মিলিত আক্রমণে অচিরেই হয়তো হার মানতে হবে। আর্থারদের দল আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে পৌঁছালে সমস্ত জিকাসনদের হেফাজতে নেওয়ার চেষ্টা করবে। জিকাসনসহ স্পাইরো তাদের হাতে চলে গেলে, তারা যেমন ভবিষ্যতের খাদ্য জোগানে একাধিপত্য অর্জন করবে, তেমনি তারা চেষ্টা চালাবে জিকাসনদের কাছ থেকে কোনভাবে ‘পিস্-চিপ্’-এর প্রযুক্তি শিখে মানুষের উপর তার প্রয়োগ করা। এমন চিপ্, যা দিয়ে একটি অংশের মানুষকে তারা নিজেদের দাসে পরিণত করতে পারবে।
ড. চ্যাঙ খুব চিন্তিত। তাদের হাতে থাকা জিকাসন দুটিকে কাজে ব্যবহার করার প্রয়াস শুরু করতেই, স্পাইরোগুলি আর পিস্-চিপ্ দ্বারা সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে না। ফলে তারা শুকিয়ে যাচ্ছে। এদিকে স্পাইরো তাদের খাদ্য, এবং তার অভাবে জিকাসন দুটিও মৃতপ্রায়। কিছু একটা গন্ডগোল হচ্ছে, যা ড. চ্যাঙ কিছুতেই বুঝতে পারলেন না।
দু’জন জিকাসনের এই পরিণতিতে জিকাহুকু থেকে ড. রায়চৌধুরীকে কঠোর বার্তা দেওয়া হল। তাঁর ব্যাল্কনি থেকে অনেক, অনেক দূরের আকাশটা দেখা যায়। সেখানে আকাশটা নেমে এসেছে সবুজ গাছগুলির মাথায়। আজ নারকেল গাছগুলিও যেন তার পাতার দোলা স্তব্ধ করে রেখেছে। এদিকে জিকাসনদের “ইনভিসিবল স্পেসক্রাফট”-কে পাঠানোর জন্য বিশেষ লঞ্চিং রকেট নির্মান শেষ হয়নি। তা না হলে তো, জিকাসনদের টারমুগলি দ্বীপের লঞ্চিং প্যাড থেকেই ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা করা যেত। জিকাসনদের স্পেসশিপটার সঙ্গে অ্যাডজাস্ট করে লঞ্চিং রকেট নির্মাণ করতে হবে বলেই আগে থেকে ব্যবস্থাও করা যায়নি।
দরজা ঠেলে ঢুকল অদৃত, “স্যার, জিকাহুকু থেকে কি কোনও খবর এল?”
“তেমন কিছু না… তবে ওরা পরিস্থিতির উপর নজর রাখছে।”
“আমরা, কি নাসার সাহায্য নিতে পারি না?”
“এই মুহূর্তে আর সম্ভব নয়। ওরা মনে হয় না এই অবস্থায় কোনও সাহায্য করবে। তা ছাড়া জেক্সা যেহেতু আমাদের সঙ্গে আছে, আশা খুব কম। যা করার নিজেদের করতে হবে।”
শৈলেশ ঝা-এর ফোন এল, “স্যার, জিকাসনদের সুরক্ষার জন্য একজন সিকিউরিটি অফিসার নিয়োগ করেছি। সবটা যন্ত্রের উপর নির্ভর করা ঠিক হবে না।”
ড. রায়চৌধুরী তাকিয়ে আছেন দিগন্তের দিকে। সূর্য ডুবছে। তিনিও হয়তো ভেতর ভেতর হার মানার জন্য তৈরি হচ্ছেন। আর্থাররা এবার ইন্টারন্যাশনাল রিসার্চ বডিতে আবেদন করে ফেলেছে ভারত যেন এলিয়েন সম্পর্কিত সমস্ত তথ্য প্রকাশ করে। আন্তর্জাতিক কমিটিকে পরিদর্শন করে দেখতে দেয় প্রকৃত অবস্থাটা। কী করবেন এবার? তিনি কিছুই ভেবে পান না। তাহলে কি জিকাসনদের আর্থারদের হাতে ছেড়ে দিতে হবে? অদৃতরা প্ল্যান করেন, যা হবে হোক, এদের হাতে জিকাসনদের কোনওমতেই তুলে দেওয়া হবে না।
প্রেয়সী এখানে আসার আগে বিক্রম সারাভাই স্পেস সেন্টারে ছিল। সেখানকার ডিরেক্টর ছিলেন ওম প্রকাশ শ্রীবাস্তব। তিনি বর্তমানে মঙ্গলগ্রহে জ্বালানী অনুসন্ধান সংক্রান্ত গবেষণায় যুক্ত। প্রেয়সীর সঙ্গে ক’দিন আগেই তার কথা হয় এবং তিনি জানান সামনেই মঙ্গলগ্রহে জ্বালানী সংগ্রহের জন্য একটা বড়সড় অভিযানের শেষ মুহূর্তের তদারকিতে তিনি ব্যস্ত রয়েছেন।
প্রেয়সী হঠাৎ বলে ওঠে, “আমাদের শেষ অবধি দেখতে হবে। আমার আগের বস, শ্রীবাস্তব স্যার মানুষ হিসেবে কেমন আমি সঠিক জানি না। তবে একমাত্র তিনিই পারেন এই সমস্যা থেকে আমাদের রক্ষা করতে।”
“কিন্তু কীভাবে?” -চিৎকার করে ওঠে অদৃত।
“আমরা যদি আমাদের সমস্যাগুলি ওঁর সঙ্গে আলোচনা করি” বলতে বলতে ড. রায়চৌধুরীর দিকে তাকাল প্রেয়সী।
“তুমি যখন বলছ, একবার চেষ্টা করে দেখি” গম্ভীর গলায় বললেন ড. রায়চৌধুরী।
পরের দিন ফ্লাইটেই তাঁরা রওনা দিলেন। বিক্রম সারাভাই স্পেস সেন্টারের সাত তলায় ওপি শ্রীবাস্তবের কেবিন। বেশ আগোছালো কেবিনের ভেতরের একটি ছোট্ট ঘরে তিনি বসেছিলেন। ড. রায়চৌধুরীরা পৌঁছাতেই আন্তরিক অভ্যর্থনা জানালেন। চা-বিস্কুট সহযোগে আলোচনা চলল। ঘটনাটি প্রথম শুনে শ্রীবাস্তব তো হতবাক। নিঃশব্দে এত বড় ঘটনা ঘটে গেছে। এই সমগ্র ঘটনা ড. রায়চৌধুরীর পরিকল্পনা মাফিক ঠিকঠাক চললে পৃথিবীর ভবিষ্যতের জন্য দুর্দান্ত ঘটনা হত। কিন্তু জিকাসনদের রক্ষা করাটাও তাঁদের কর্তব্য।
“আমাদের প্রোজেক্টের এক্সটারনাল অবজার্ভার ড. কারকারে কে নিয়ে চিন্তা” মাথা চুলকে মৃদুভাবে বললেন শ্রীবাস্তবজী।
অদৃত ইতিমধ্যেই ড. কারকারে সম্বন্ধে খবর সংগ্রহ করা শুরু করে দিল। খোঁজখবর করে জানা গেল, ইনি একজন সাফল্যের পিছনে ধাওয়া করা মানুষ। নিজের সফলতা অর্জনে তিনি হয়তো সবকিছুই করতে পারেন। এ ছাড়া কর্পোরেট দুনিয়ার সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক খুব ভালো। একাধিক বার মহাকাশ অভিযানে বিভিন্ন কর্পোরেট দুনিয়ার মানুষকে অনৈতিকভাবে সাহায্য করার বেশ কিছু অভিযোগ তাঁর বিরুদ্ধে উঠেছে। সব শুনে ড. রায়চৌধুরী দৃঢ় কণ্ঠে বললেন, “এখন সবার একটাই লক্ষ্য। জিকাসনদের ঠিকঠাক জিকাহুকুতে ফেরত পাঠানো।”
ড. রায়চৌধুরী যদি চাইতেন জিকাহুকুতে সব জানিয়ে সাহায্য চাইলে তারা অবশ্যই জিকাসনদের পৃথিবী থেকে সুরক্ষিতভাবে উদ্ধার করে নিয়ে যেত। কিন্তু ড. রায়চৌধুরী এক্ষেত্রে একটা শেষ চেষ্টা করতে চাইছিলেন। কোনওভাবে তাঁরা নিজেরাই যদি জিকাসনদের সুরক্ষিতভাবে ফেরত পাঠাতে পারেন, ভবিষ্যতে জিকাসনদের সঙ্গে কাজের প্রক্রিয়া চালিয়ে যেতে সুবিধা হবে। “একটা চান্স নিয়েই দেখা যাক না,” ড. রায়চৌধুরী নিজেকে বললেন।
অদৃত, প্রেয়সী ও ড. রায়চৌধুরী একটা গাড়িতে হোটেলে ফিরলেন। রাতটা রেস্ট নিয়েই পরদিন ভোর ভোর শ্রীবাস্তববাবুর কর্মযজ্ঞ চাক্ষুষ করতে যেতে হবে। আর পনেরো দিনের মধ্যেই তার স্বপ্নের উড়ান আল্ট্রা পাওয়ারফুল মার্স পেনিট্রেটর (UPMP) যাত্রা শুরু করবে। তাকে বয়ে নিয়ে যাবে USSLV-XI রকেট। মঙ্গলগ্রহের খনিজ পদার্থকে পৃথিবীর ব্যবহার্য করে তোলার এই অভিযান সফল হলে, পৃথিবীর এই অসীম জনসংখ্যার চাহিদাগুলি কিছুটা মেটানো যাবে। ড. রায়চৌধুরীদের সমস্ত কিছু ঘুরিয়ে দেখাবেন শ্রীবাস্তবজী।
ভোর পাঁচটা। গাড়ি হোটেলের সামনে এসে দাঁড়াল। অদৃতরা রওনা দিল শ্রীবাস্তব স্যারের প্রোজেক্ট এরিয়া চাক্ষুস করার জন্য। পৌঁছেই তাদের জন্য ব্রেকফাস্টের ব্যবস্থা ছিল। খাওয়া-দাওয়ার পর তারা প্রোজেক্ট এরিয়ায় প্রবেশ করল। শ্রীবাস্তবজী বোঝালেন কীভাবে স্পেসশিপের মাধ্যমে একটা পোর্টেবেল খনি তারা মঙ্গলের উপর বানাবেন ও আকরিক শোধন করে পৃথিবীতে পাঠাবেন। ড. রায়চৌধুরী মজা করে বললেন, “এরপর মঙ্গলের অমঙ্গল করতে মানুষ কোমর বেঁধে নেমে পড়েছে।” হাসির রোল উঠল।
কিন্তু এই প্রোজেক্টের কর্মকাণ্ডে “ফিউচার আর্থ” ও “টেক্নেক্সট্”-এর পরোক্ষ যোগাযোগ টের পেলেন ড. রায়চৌধুরী।
“তাহলে কি সিদ্ধান্তটা ভুল হয়ে গেল?” হতাশ গলায় বললেন ড. রায়চৌধুরী।
প্রেয়সী গভীর চিন্তা করে বলল, “গেস্ট হাউসে ফিরে গিয়ে আলোচনা করব।”
প্রোজেক্ট এরিয়া ঘুরে সবে গেস্ট হাউসে এসেছে তারা, এমন সময় ড. রায়চৌধুরীর কাছে খবর এল, জিকাসনদের কলোনীর চিফ সিকিউরিটি অফিসারের খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। হয়তো কেউ তাকে অপহরণ করেছে। ড. রায়চৌধুরীর বুঝতে দেরি হল না যে তাদের হাতে সময় কম। আর্থার সাহেবের দলবল সক্রিয় হয়ে উঠেছে। জিকাসনদের নিজেদের হেফাজতে নিতে তারা আরও নখদন্ত বের করবে। হোটেলে ফিরে ড. রায়চৌধুরী অদৃত ও প্রেয়সীকে জিকাসনদের সম্বন্ধীয় গবেষণার একটি সারসংক্ষেপ তৈরি করতে বললেন। দেখতে দেখতে দু’দিন কেটে গেল। এরপর এক গোপন ফোন পেলেন ড. রায়চৌধুরী। ড. কারকারে ‘ফিউচার আর্থ’-এর কর্ণধার আর্থার সাহেবের সঙ্গে গোপন বৈঠক করছেন। কীভাবে মঙ্গল থেকে আনা খনিজপদার্থ তাদের সংস্থাকে সমস্ত পৃথিবীর উপর এক বিশাল অর্থনৈতিক সাম্রাজ্য গড়ে তুলতে সাহায্য করবে, চলছে তারই নীল-নকশা। সেখানে জিকাসন ও স্পাইরোর বিষয়টিও ওঠে। আর্থার সাহেব ড. কারকারেকে বলেন, “আপনি যতটা সম্ভব চেষ্টা করুন জিকাসনদের হাতের নাগালে পেতে। যতটা খরচ হয় হোক, চিন্তা করবেন না। এই প্রযুক্তি আমার চাই-ই চাই।”
আর্থার সাহেবের দল যেভাবেই হোক একমাসের মধ্যে জিকাসনদের কলোনী থেকে তাদের হেফাজতে নিয়ে ফেলবে। ড. রায়চৌধুরী জানেন তাঁর স্বল্প ক্ষমতায় তিনি বেশিদিন এই কর্পোরেট-রাজনীতিবিদদের সম্মিলিত দলকে রুখতে পারবেন না। হঠাৎই তিনি শ্রীবাস্তবজীর কাছে গেলেন, সব ঘটনা খুলে বললেন। “দ্রুত একটা কিছু করতে হবে”- শ্রীবাস্তবজী ঘাড় নাড়লেন। তারপর পিছনের ঘরটায় ঢুকে বেশ কিছুক্ষণ গভীরভাবে ভাবলেন। “একটা প্ল্যান ঠিক করেছি। দেখি কাজ করে কি না” ড. রায়চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে বললেন। এরপর স্পেস সেন্টারে এক উচ্চপর্যায়ের বৈঠক শুরু হল শ্রীবাস্তবজীর নেতৃত্বে। ড. রায়চৌধুরী এদিকে অপেক্ষা করে আছেন একরাশ চিন্তা নিয়ে। প্রায় দু’ঘণ্টা পর বৈঠক শেষ হল। শ্রীবাস্তবজী মৃদু হেসে বললেন, “ব্যবস্থা একটা হয়েছে। আল্ট্রা পাওয়ারফুল মার্স পেনিট্রেটর (UPMP) যাত্রা শুরু করবে নির্দিষ্ট সময়ে। কিন্তু সেটা মার্সে যাবে না, যাবে ইউরোপাতে। আপনি জিকাহুকুতে খবর দিন তারা যাতে জিকাসনদের ইউরোপা থেকে নিয়ে যায়। আর একটা কথা” এই বলে শ্রীবাস্তবজী গ্লাসে এক চুমুক দিয়ে বললেন, “আপনার কোনও চিন্তা নেই। সমস্ত ব্যাপারটা অত্যন্ত গোপনে হবে।” ড. রায়চৌধুরী জিকাসন কলোনীতে থাকা শৈলেশকে সব জানালেন। জিকাহুকুতে খবর পাঠানো ও জিকাসনদের ইউরোপা অভিযানে প্রস্তুতি শুরু হল। এদিকে বিক্রম সারাভাই স্পেস সেন্টারে পুরোদমে শুরু হয়েছে গোপন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অভিযানের প্রোগ্রামিং বদলের।
অভিযানের আগের দিন এক বিশেষ বিমানে জিকাসনদের নিয়ে আসা হয় স্পেস সেন্টারে। USSLV-XI উৎক্ষেপন রকেটের ভিতর মার্স পেনিট্রেটর যন্ত্রের বদলে জিকাসনদের রাখবার বিশেষ কক্ষ তৈরি করা হয়েছে। জিকাসনদের ইউরোপা পর্যন্ত গন্তব্যে যাতে কোনও অসুবিধা না হয়, সে বিষয়ে নজর দেওয়া হয়েছে।
পরের দিন বিকাল ৫টায় উৎক্ষেপন। ২৫ ঘণ্টা আগে সমস্ত ব্যবস্থাকে একবার চেকআপ করে নেওয়া হবে। লঞ্চিং প্যাডের ব্যবস্থাও ভালোভাবে পরীক্ষা করে নেওয়া হয়। জ্বালানি কক্ষও দেখে নেওয়া হল। দেখতে দেখতে দুপুর হয়ে গেল। শ্রীবাস্তবজী ও ড. রায়চৌধুরী একবার জিকাসনদের ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে এলেন।
ইতিমধ্যে আর্থার সাহেবের দল লিটিল আন্দামানের জিকাসন কলোনিতে পৌঁছে দেখল কেউ নেই।
“ড. কারকারে, কি হবে? কোথায় পাচার হল এরা সব?”- রাগমিশ্রিত উৎকন্ঠায় আর্থার সাহেব চিৎকার করে উঠলেন।
এমন সময় ড. কারকারের হাতে ইনজেক্টটেড ডিভাইসটি সিগন্যাল দিল। মার্স মিশনের সঙ্গে যুক্ত পট্টনায়কের ফোন। শ্রীবাস্তবজীর কাণ্ডকারখানা তিনি খবর পেয়েছেন। তাই ড. কারকারে-কে সঙ্গে সঙ্গে জানাচ্ছেন। ড. কারকারে সব শুনে মৃদু হাসলেন। শ্রীবাস্তব-এর চিরশত্রু পট্টনায়ক তাহলে শেষ পর্যন্ত খবরটা দিয়ে কাজের কাজ করল।
“কিন্তু শ্রীবাস্তব তো অনেকদূর এগিয়ে গেছেন। এখন কি করবেন?” আর্থার সাহেবের প্রশ্নে ড. কারকারে বললেন, “এখনও একটা অস্ত্র আছে। চলুন বিক্রম সারাভাই স্পেস রিসার্চ সেন্টার।”
বিকাল ৪টে। সব ব্যবস্থা পরিপূর্ণ। অদৃত ও প্রেয়সী দাঁড়িয়ে লঞ্চিং প্যাডের সামনে। আর কিছুক্ষণ পরেই জিকাসনরা রওনা দেবে। কেমন যেন একটা মন খারাপ তাদের। তবে এটা ভেবেও ভালো লাগছে যে, কর্পোরেট ক্ষমতালোভী মানুষদের হাত থেকে জিকাসনদের বাঁচাতে তারা সফল হচ্ছে। তাদের এই কাজই হয়তো ভবিষ্যতে মানবসভ্যতাকে রক্ষা করতে সাহায্য করবে।
ড. কারকারেরা পৌঁছে গেছেন স্পেস সেন্টারে। এক্সটারনাল অবজার্ভার হিসাবে তাঁর কন্ট্রোলরুমে কম্পিউটারে এক বিশেষ প্রোগ্রাম সেট করা আছে। সেটার এক বিশেষ অংশ চালাতে পারলেই অভিযান বন্ধ হয়ে যাবে। দ্রুত ছুটে চলেছেন তিনি। হাতে বেশি সময় নেই। সামনের লাইনটা পেরোলেই লিফটের দরজা। লিফটে চড়েই ফিফথ ফ্লোরের বোতাম টিপলেন। একতলা… দু’তলা… তিনতলা… হঠাৎ দড়াম করে এক বিকট শব্দে আটকে গেল লিফট। ঘড়িতে ৫টা বাজতে ৫ মিনিট।
ড. রায়চৌধুরী জিকাহুকু থেকেও শেষ মুহূর্তের রেসপন্স ম্যাসেজ পেলেন। তারাও ইউরোপা অভিযানে বেরিয়ে পড়েছে। এদিকে পৃথিবী থেকে আল্টা পাওয়ারফুল মার্স পেনিট্রেটর (UPMP) যাত্রা শুরু হতে কিছু সময় বাকি। এক অদ্ভুত রোমাঞ্চ ড. রায়চৌধুরী, অদৃত, প্রেয়সী, শ্রীবাস্তবজী সবাইকে আচ্ছন্ন করে রাখল।
৪… ৩… ২… ১… ০… প্রচন্ড শব্দ ও ধোঁয়ায় ঢেকে USSLV-XI যাত্রা শুরু করল। কয়েক মিনিটের মধ্যেই সে কক্ষচ্যুত হয়ে অন্যপথে চলতে শুরু করল।
সরকারি বিবৃতি ভেসে উঠল পর্দায়। আল্ট্রা পাওয়ারফুল মার্স পেনিট্রেটর উৎক্ষেপন বিফল।
শ্রীবাস্তবজী মনে মনে বললেন, “এই প্রথম মিশন সফল না হয়েও একরাশ শান্তি নিয়ে ঘুমাতে যাবো।”
সৌম্য রায়চৌধুরী রাতের আকাশের দিকে তাকিয়ে। ঘন অন্ধকার রাতের আকাশ। হাজার হাজার গ্রহ-নক্ষত্রের ভিড়ে মিশে রয়েছে ইউরোপা। দুই সভ্যতার মিলনস্থল ‘ইউরোপা’।
Tags: অয়ন মুখোপাধ্যায়, কল্পবিজ্ঞান গল্প, চতুর্থ বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা, পূজাবার্ষিকী, সুপ্রিয় দাস
অপূর্ব একটি কল্পবিজ্ঞানের গল্প পড়লাম অনেকদিন পর, যে জিনিস টা সবথেকে ভালো লাগলো, সেটা হলো প্রতি টা মোড়ে বাস্তবতার সাথে মিল রেখে নিপুন ভাবে বিজ্ঞান কে সঙ্গী রেখে লেখা হয়েছে, বেশ ভালো।
‘অদৃত ও জিকাসন’-এর পরবর্তী স্পেস অভিযান এর জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে রইলাম, লেখকের কাছে আমার একান্ত অনুরোধ।
সুন্দর এবং বিজ্ঞানসম্মত। সাধারণত যেকোন কল্পকাহিনীতে যে জায়গায় বিজ্ঞানীরা যান সেই জায়গা নিয়ে যারা গবেষণা করেন। এখানে লেখক সম্পূর্ণরূপে ভিন্ন স্বাদের গল্প রচনা করেছেন। যা এক কথায় অনবদ্য এবং অবিস্মরণীয়।নতুন লেখককে পাঠক সমাজের পক্ষ থেকে সাদর সম্ভাষণ জানাই।আপনি আমাদের নতুন অদ্রীশ বর্মন হয়ে উঠুন
খুব সুন্দর ভাবে বিন্যস্ত একটা কল্পবিজ্ঞানের গল্প। Detailed information গুলো গল্প কে আরো বেশী বিশ্বাসযোগ্য করে তুলেছে। লেখকের কলমে পরবর্তী গল্পের অপেক্ষায় থাকলাম।
Prochur porishrom ar odhyabosay ei lekhay ache.onek bhalobasa ar sritshishil mon chhara e lekha possible na
Prochur porishrom ar odhyabosay ei lekhay ache.onek bhalobasa ar sritshishil mon chhara e lekha possible na
বাংলাদেশ থেকে পড়ছি;
গল্পের ভিতরে ঢুকে পড়েছিলাম, মনে হচ্ছিলো সবকিছু আমার সামনেই ঘটছে।
লেখকের অন্যান্য গল্পের অপেক্ষাও থাকলাম ❤️
ধন্যবাদ আপনাকে। চেষ্টা করবো পরের লেখা উপহার দেওয়ার।