অনাহূত – এইচ পি লাভক্র্যাফট
লেখক: এইচ পি লাভক্র্যাফট, বাংলা অনুবাদ - সৌমেন চ্যাটার্জী
শিল্পী: সুপ্রিয় দাস
ছোটবেলার স্মৃতি বলতেই বহুমানুষের মনে ভেসে আসে রঙিন এক ফেলে আসা দুনিয়া, তাই হয়ত মানুষ বারেবারে তার হারানো শৈশবকে ফিরে পেতে চায়। কিন্তু শৈশবের স্মৃতি যাদের জন্য বহন করে দুঃখ আর অবর্ণনীয় আতঙ্ক, তাদের কাছে শৈশবের মানেটা আমার মতই- একটু অন্যরকম। আমার ছোটবেলাটা কেটেছিল আলোআঁধারির মধ্যে বসে বসে দুষ্প্রাপ্য বই পড়ে পড়ে। কখনও বা বিদ্যুতের আলোয় হঠাৎ করেই চেনা গাছগুলোর কিম্ভূতকিমাকার রূপ দেখে আজগুবি আকাশ পাতাল কল্পনা করতাম। একটা জিনিস খুব ভালোভাবে বুঝতে পেরেছিলাম, হয়ত আমার এই চিন্তাভাবনাগুলোই অন্যদের থেকে আমাকে আলাদা করে রেখেছিল, হয়ত এটাই ছিল ঈশ্বরের ইচ্ছা।
যেখানে আমি জন্মেছিলাম সেই জায়গাটার কথা আমার খুব একটা মনে নেই। কিন্তু আমার স্মৃতি ঘাঁটলে বহু পুরনো একটা কেল্লার কথা মনে পড়ে। এই কেল্লায় আমি ঘুরে বেড়াতাম ছোটবেলায়। যখন আমি এর আলোআঁধারি বারান্দা দিয়ে হাঁটতাম, মাঝেমাঝেই চোখ চলে যেত ওপরে, কিন্তু কিছু ঝুল, মাকড়শার জাল আর ঘুপচি অন্ধকার ছাড়া কিছুই ঠাহর করতে পারতাম না। কিন্তু কি জন্য জানি না, একটা অজানা ভয়ে আমার দম বন্ধ হয়ে আসত। কেল্লার বারান্দা দিয়ে যখন হাঁটতাম, এর স্যাঁতস্যাঁতে দেওয়ালগুলো থেকে সোঁদা গন্ধ ছাড়াও আর একটা অদ্ভুত গন্ধ পেতাম। ছোটবেলায় অত বুঝতে পারিনি, কিন্তু এখন বুঝতে পারি, কোন লাশ থেকে যে পচা গন্ধ বেরোয়, গন্ধটা ছিল অবিকল সেইরকম। যেন বহুযুগ ধরে কেল্লার দেওয়ালের ওপারে কোন লাশ পচছে। কেল্লার চারপাশে এত বড় বড় গাছ ছিল যে তাদের ছায়ার জন্য দিনের বেলাতেও সেখানে সূর্যের আলো ঢুকত না। এক একটা গাছ তো কেল্লার চূড়াও ছাড়িয়ে গিয়েছিল। যাইহোক নিজের মনের শান্তির জন্যই আমি বারান্দা ভ্রমণের সময় সাথে একটা মোমবাতি রাখতাম, আর মোমবাতির শিখার দিকে তাকিয়ে চোখকে সান্ত্বনা দিতাম। ও হ্যাঁ, কেল্লার চূড়া বলতে মনে পড়ল একটা বিরাট কালো রঙের ভাঙ্গাচোরা মিনারের মত চূড়ার কথা। সেটা এতই উঁচু ছিল, মনে হত হয়ত আকাশ ছাপিয়ে মিশে গেছে অন্য কোন ভুবনে। ভাঙ্গাচোরা মিনারের গায়ে যে ফাটলগুলো ছিল, সেখানে ধাপে ধাপে পা রেখে কেউ ওই মিনারের শীর্ষে ওঠার স্বপ্ন দেখলেও এর উচ্চতার জন্য তার স্বপ্নভঙ্গ হতে বাধ্য।
আমার মনে হয় জীবনের একটা বিরাট বড় অংশ আমার ওই কেল্লায় কেটেছিল। আমার স্মৃতিতে যদিও আমি আর গুটিকতক ইঁদুর, বাদুড় ও মাকড়সা ছাড়া কোন জীবিত প্রাণীর অস্তিত্ব নেই, কিন্তু আমার ভরণপোষণে কখনই কোন খামতি ছিল না। আর থাকলে আজ আমি এগুলো লিখতে পারতাম না। যেই আমার ভরণপোষণ করে থাকুক, তার এতদিনে থুত্থুড়ে বুড়ো হয়ে যাবার কথা। কেল্লার আনাচেকানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকতো বিভিন্ন হাড়গোড়, মাথার খুলি। কিন্তু সত্যি বলতে কি এগুলো দেখে কখনই আমি ঘাবড়ে যাইনি, বরং রংচঙে ছবির বইয়ের থেকে আমার কাছে এগুলো ছিল অনেক স্বাভাবিক- রোজকার ঘটনা। যদিও এযাবৎ আমি যা যা শিখেছি তার পেছনে ওই সেকেলে রংচঙে ছবির বইগুলোর অবদান ছিল সবথেকে বেশি।
কেল্লায় থাকার সময় আমি কখনও কোন মানুষের গলার শব্দ পাইনি। এমনকি নিজেরও নয়! অবাক লাগলেও এটাই সত্যি। যদিও আমি চাইলেই জোরে জোরে বই পড়তে পারতাম, কিন্তু সত্যি বলতে কি কোন তাগিদই আসেনি সেভাবে। আরও অবাক হবার মত ঘটনা হল, গোটা কেল্লায় কোন আয়না ছিল না, ফলে আমাকে ঠিক কেমন দেখতে সেটাই আমি জানতাম না! যেহেতু আকারে বেঁটেখাটো ছিলাম, ওই ছবির বই দেখেই কোন বাচ্চার ছবির সাথে মিল রেখে নিজের একটা ইচ্ছেমত চেহারা ভেবে নিয়েছিলাম। কেল্লার বাইরে সেই লম্বা লম্বা গাছের সারি আর দুর্গন্ধওলা জলে ভরা পরিখার ধারে বসে বসে আমি নানারকম চিন্তা করতাম। ওই ছবিওলা বইয়ের ছবিগুলোর কথা, কেল্লার ধারের দুর্গম জঙ্গল পেরিয়ে কোন আলো ঝলমলে জগতের কথা- আরও কত কি! একেক সময় ইচ্ছে হত ওই জঙ্গলের ঘেরাটোপ পেরিয়ে ছুটে পালিয়ে যেতে। সেইরকম করেওছিলাম কয়েকবার। কিন্তু জঙ্গলের মধ্যে কিছুদুর এগোবার পরেই যখন দেখতাম আমি কেল্লায় ফিরে যাবার রাস্তা হারিয়ে ফেলেছি, তখনই সব হিসেব যেত গুলিয়ে। আর এগোতে ভরসা পেতাম না! আবার ফিরে আসতাম পুরনো পথে, প্রবাদের সেই মোল্লার মতোই আমারও দৌড় ছিল কেল্লা থেকে ওই জঙ্গলের কিছুদুর অবধিই!
দিনের শেষে যখন চারদিক আলোআঁধারিতে ভরে যেত, আমি কিসের জন্য ঠিক বলতে পারব না, অপেক্ষা করতাম। হয়ত এই দুনিয়া থেকে মুক্তির! এইসব ভাবতে ভাবতে একদিন একটা ফিকির ঠাওরালাম। কেন জানিনা, আমার মনে হয়েছিল যে বিরাট কালোরঙের ভাঙ্গাচোরা মিনারের মত অন্য কোন জগতে মিশে যাওয়া ওই চূড়াটাই হচ্ছে আমার স্বাধীন দুনিয়ার সিংহদরজা। তাই অনেক ছক কষবার পর একদিন যা হয় হবে ভেবে চড়তে শুরু করলাম কালো রঙের ওই চূড়াটা। অনেক ভাঙাচোরা ধাপে পা ফেলে ফেলে এগোতে এগোতে একসময় থমকে গেলাম। সামনের রাস্তা আর নেই! তার বদলে ভাঙাচোরা পাথরের টুকরো দিয়ে একটা কোনোরকমে হেঁটে যাবার মত রাস্তা তৈরি হয়েছে। দমবন্ধ করা অন্ধকার, বাদুড়ের নিঃশব্দ ডানার শব্দর থেকেও ভয়াবহ ছিল আমার ওপরে ওঠার অগ্রগতি! অনেকখানি উঠে আসার পরও অন্ধকার কিন্তু এক চিলতেও কমেনি। একবার পেছনে ফেলে আসা পথের দিকে তাকালাম, আর বুকটা ছ্যাঁত করে উঠল। আবার পিছু হঠে যাবার কোন প্রশ্নই ওঠে না! যে ভুল বারেবারে ওই জঙ্গল পেরোবার সময় আমি করেছিলাম, সেটা আর করা সম্ভব নয়। এই অন্ধকারের ঘেরাটোপ থেকে আমাকে বেরোতেই হবে। তাই আবার এগোতে শুরু করলাম। হামাগুড়ি দিয়ে কিছুদুর এগোবার পরে হঠাৎ মাথাটা কিসে গিয়ে ঠোক্কর খেল! আমার মনে হল হয় কোন মেঝে বা ছাদ হবে এটা। অন্ধকারের মধ্যেও আমি হাতড়ে হাতড়ে বুঝলাম মাথার ওপর কোন পাথর দিয়ে তৈরি কোন ঢাকনার মত কিছু রয়েছে। হাত দিয়ে সরাবার চেষ্টা করলাম, কিন্তু পারলাম না। অগত্যা মাথা দিয়ে ঠেলে ঠেলে চেষ্টা করতে লাগলাম ওটাকে সরাবার। হাত দিয়ে কোনোরকমে চড়াইয়ের পথে নিজের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখলাম। কিন্তু মাথা দিয়ে বারেবারে সেই বাধা সরাবার চেষ্টা করতে গিয়েই ঘটল বিপত্তি। অনেকবার চেষ্টা চালাবার ফলেই হয়ত ঢাকনাটা কিছুটা আলগা হয়ে গিয়েছিল, এবার সেটা আমাকে কোনকিছু ভাবার সুযোগ না দিয়েই সশব্দে নীচে গিয়ে পড়ল, আর সেই বীভৎস প্রতিধ্বনিতে চারদিক কেঁপে উঠল। আমারও হাত পিছলে গিয়েছিল, তাই আমিও টাল সামলাতে না পেরে গিয়ে পড়লাম নীচের একটা ভাঙাচোরা ধাপে। আমি হয়ত ক্লান্তি কাটাবার জন্য কিছুক্ষণ জিরিয়ে নিতে পারতাম, কিন্তু সেই সময় আমার ছিল না, কারণ আমাকে ছবির বইতে পড়া সেই দুনিয়ায় যেতেই হবে। যেখানে হয়ত আমি ছুঁতে পারব আকাশ, চাঁদ, তারাদের। তাই আবার ওঠা শুরু করলাম বেয়ে বেয়ে। কিন্তু আমার সেই স্বপ্নপূরণের পথে পদে পদে বাধা হয়ে দেখা দিতে লাগলো আমার ওপরে ওঠবার পথে ধাপে ধাপে দাঁড়িয়ে থাকা মার্বেল পাথরের বিরাট বিরাট আলমারি, যার প্রত্যেকটা তাক ঠাসা ছিল অদ্ভুত আকারের বাক্সে। এই কেল্লার ভেতর কত যুগের গোপন ইতিহাস লুকিয়ে রাখা আছে কে জানে? ঠিক এই সময়েই এগোতে এগোতে আমি হাজির হলাম অদ্ভুতভাবে খোদাই করা একটা পাথরের দরজার সামনে। এ যেন মেঘ না চাইতেই জল! খোলবার চেষ্টা করলাম, পারলাম না। দরজাটা ছিল শক্তভাবে আটকানো। কিন্তু হাল না ছেড়ে আমি আমার সমস্ত শক্তি দিয়ে নিজের দিকে টানবার চেষ্টা করতে লাগলাম। অবশেষে সফল হলাম। আমার সামনে খুলে গেছে একটা নতুন রাস্তা। এক অবর্ণনীয় আনন্দে আমার মন ভরে উঠল। রাস্তাটা ঝলমল করছে চাঁদের আলোয়। সত্যি বলতে কি এরকম চাঁদের আলো আমি আগে কোথাও দেখিনি। মাঝে মাঝে কয়েকটা মেঘ এসে ঢেকে দিচ্ছে সেই জ্যোৎস্নাকে। আবার মেঘ সরে গেলে রাস্তাটা জ্যোৎস্নায় ঝলমল করে উঠছে। সেই আলোআঁধারির খেলার মধ্যেই আমি গুটিগুটি এগোতে লাগলাম। এবার মেঘ পুরোপুরি কেটে গেল। কেন জানি না আমার মনে হল আমি কেল্লার চুড়ায় এসে পৌঁছেছি। আর আমি জীবনে প্রথমবার এত আলোয় যা দেখলাম তা আমার মাথা ঘুরিয়ে দেবার পক্ষে যথেষ্ট ছিল। আমি যে মার্বেল পাথরের আলমারি আর অদ্ভুত বাক্সগুলো দেখেছিলাম, সেগুলো কোন বহু পুরনো চার্চের ধ্বংসাবশেষ! আমি আর ভাবতে পারলাম না। এগোতে থাকলাম। এগোতে এগোতে হাজির হলাম একটা জাফরিকাটা দরজার সামনে। কাকতালীয় ভাবে সেটা তালাবন্ধ ছিল না। তাই এক ঝটকায় সেটা খুলে ফেললাম। তারপর দেখলাম সাদা মার্বেল পাথরের রাস্তাটা দু দিকে ভাগ হয়ে গেছে। একটা রাস্তা বেছে নিয়ে এগোতে থাকলাম।
প্রায় ঘণ্টা দুয়েক এগোবার পর আমি এসে পৌঁছলাম একটা বহু পুরনো কেল্লার সামনে। কিন্তু আমি যে কেল্লায় থাকতাম, এটা ঠিক সেটার মত নয়। এতেও গম্বুজ, পরিখা- সবই রয়েছে, কিন্তু অনেকটা অন্যরকম। মনে হল পাতালপুরীর অতল গহ্বর পেরিয়ে আমি হাজির হয়েছি এক নতুন জগতে। যে জগতের সাথে আমার কোন পরিচয় নেই। যে জিনিসটা দেখে আমি সবথেকে অবাক হলাম সেটা হচ্ছে কেল্লার জানলা থেকে আলো ভেসে আসছে। যে মোমবাতির শিখার দিকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা তাকিয়ে আমি নিজের চোখকে সান্ত্বনা দিতাম, তার থেকে অনেক অনেক বেশি উজ্জ্বল আলো। আরও অবাক হলাম আর একটু এগিয়ে। এবার আমার কানে ভেসে এলো অনেক লোকজনের গলার আওয়াজ, হৈ হুল্লোড়, হাসির শব্দ। এরকম শব্দ আমি আগে কখনও শুনি নি। সত্যি বলতে কি, আমার সারাটা জীবন আমার কানে খুব কম শব্দই এসেছে। কিন্তু আমি ওই ছবির বইগুলো পড়ে পড়ে বিভিন্ন আওয়াজ সম্পর্কে বিভিন্ন ধারণা করেছিলাম। এবার এই শব্দগুলো শুনে সেগুলো মেলাবার চেষ্টা করতে লাগলাম। কৌতুহলের বশে জানলার কাছে আরও এগিয়ে গেলাম। দেখলাম বহু পুরুষ ও নারী বিভিন্ন ঝলমলে পোশাকে নিজেদের হেসে হেসে কথা বলছে। দু একজন আবার কেমন ম্যাদামারা ব্যাজার মুখ করে বসে আছে সোফায়। যেহেতু এর আগে কখনও আমি মানুষের কণ্ঠস্বর শুনিনি তাই এদের ভাষা সম্পর্কেও আমার কোন ধারণা ছিল না। এদের ঠোঁটের নড়াচড়া দেখে আন্দাজ করার চেষ্টা করলাম আর বলাই বাহুল্য ব্যর্থ হলাম।
এবার আমি ওই আলো ঝলমলে ঘরের সবথেকে নীচের জানলার দিকে এগিয়ে গেলাম। কারণ এই বিস্ময়কর দুনিয়ায় কি কি রহস্য লুকিয়ে রয়েছে তা আমাকে জানতেই হবে। নীচের জানলা দিয়ে আমি ধীরগতিতে ঢুকলাম ঘরের মধ্যে। আর মুহূর্তের মধ্যেই ঘরের পুরো ছবিটা গেল পাল্টে। হাসিখুশি, ম্যাদামারা, ব্যাজার, উদাসীন সবগুলো মুখেই একটা ভয়ের অভিব্যক্তি খেলে গেল। হাসি, কথা সবকিছু পাল্টে গেল আর্তনাদে। সবাই ভয়ার্ত গলায় চিৎকার করতে করতে ঘরের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত ছোটাছুটি করতে লাগলো। দৌড়োদৌড়ির ঠেলায় কিছু চেয়ার, কুর্সিও গেল উল্টে। অনেকে তো আবার ভয়ের চোটে হাত দিয়ে দু চোখ ঢেকে ফেলল। আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না, ঠিক কি জন্য এরা আমাকে দেখে এত ভয় পেয়েছে। নাকি অন্য কিছু দেখে! যা কি না আমার পিছনেই আছে! ঘরের সবার গন্তব্যই ছিল বিভিন্ন দরজা। আমিও তাই দ্রুতবেগে একটা দরজা দিয়ে হাজির হলাম একটা বারান্দায়।
আমার পিছনে যেন নামহীন কোন দানব বসেছিল। আমার ঘাড়ের ওপর যেন তার তপ্ত নিঃশ্বাস টের পাচ্ছিলাম। এক ঝটকায় পিছনে ফিরতেই, হঠাৎ আমি নিজের সামনে দেখতে পেলাম সেই দানবকে। আমার স্নায়ুগুলো কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছিল পুরোপুরি। আমার হাত যেন আর আমার নিয়ন্ত্রণে ছিল না। আমার গোটা শরীরকে যেন অন্য কেউ চালনা করছিল। হঠাৎ টের পেলাম সেই দানবের নখওলা থাবা। কিন্তু আমি যেন সেই সময় পুরো পাথর হয়ে গেছি। আমার মাথাও পুরোপুরি কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে।
ঠিক এই সময়েই আমার গলা দিয়ে বেরিয়ে এলো জীবনের প্রথম ও শেষবারের মত একটা শব্দ। নিজের গলার শব্দ শুনে আমার নিজের গায়েই কাঁটা দিয়ে উঠল! গর্জন, আর্তনাদ নাকি হুঙ্কার কি বলা যায় এটাকে? কোন চেনা পরিচিত শব্দের সাথে এটাকে মেলাতে পারলাম না। একটা অপার্থিব উলুধ্বনির মত এই শব্দটা। শুনে দুর্ভাগ্য বা সৌভাগ্য যাইহোক না কেন, সাহসে ভর করে আমি যখন ছুঁয়ে দেখতে গিয়েছিলাম সেই দানবকে, দেখেছিলাম সেও একইভাবে আমাকে ছুঁয়ে দেখতে চায়। আর তখনই আমি জীবনে প্রথমবার দেখেছিলাম পার্থিব দুনিয়ার এক সৃষ্টিকে। যা কখনও দেখিনি আমার আশৈশব কাটিয়ে দেওয়া সেই কেল্লায়।
বুঝতে পারলাম এই আলো, খুশির দুনিয়া আমার জন্য নয়। শুধু একটা জিনিসই মনে হল, কোন সংযত কারণেই হয়ত এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টিকর্তা দুই দুনিয়ার বাসিন্দাদের কখনও মিলিত হতে দেননি। তাদের মঙ্গলের জন্যই হয়ত বা। কেউ কেউ হয়ত সৃষ্টিই হয়েছে আজীবন ধুসর গোধূলিতে ঢাকা বিবর্ণ সেই অন্য দুনিয়ায় বসবাস করার জন্য। আমিও হয়ত পিরামিডের দেশের সেই অভিশপ্ত ফারাও নেফ্রেন-কার মতোই অশুভ অভিশাপের প্রতিমূর্তি। সেই ফারাও যাকে চিরকালের মত গোপন এক পিরামিডের মধ্যে বন্দী করে রাখা হয়েছিল। যে পিরামিডে এই পার্থিব দুনিয়ার কোন রকম অনুপ্রবেশ ছিল এক চরম অমঙ্গলের সূচক। আমিও সেই নেফ্রেন-কারই এক প্রতিমূর্তি। এক অমঙ্গলের প্রতীক। পরিচিত এই জগতের কাছে সত্যিকারের একজন অনাহূত।
হ্যাঁ, আমার সামনে ছিল ফ্রেমে বাঁধানো একটা বিরাট বড় আয়না। আর সেই আয়নার সামনে দাঁড়িয়েই আমি আমাকে ছুঁয়ে দেখতে চেয়েছিলাম।
Tags: অনুবাদ গল্প, এইচ পি লাভক্র্যাফট, দ্বিতীয় বর্ষ চতুর্থ সংখ্যা, সুপ্রিয় দাস, সৌমেন চ্যাটার্জী
কাহিনীর দিক দিয়ে খুব একটা জুতসই না ঠেকলেও অনুবাদ দারুণ।
Dhonnonad