অপার্থিব মেধার সন্ধানে
লেখক: সনৎ কুমার ব্যানার্জ্জী
শিল্পী: সুপ্রিয় দাস
পর্ব – ৫
আন্তঃনক্ষত্র পরিযান
সবে সূর্যাস্ত হয়েছে। পশ্চিম আকাশে প্রহর শেষের আলোয় রাঙা মেঘ। বারান্দায় বসে চা খাচ্ছি। কলিং বেলের শব্দ শুনে উঠে গিয়ে দরজা খুলে দেখি প্রফেসর মহাকাশ ভট্টের সহকারী ধরণী – আমি অবশ্য ধরণীদা বলি। উনি বললেন –“স্যার আপনাকে সম্ভব হলে আজ রাত আটটা নাগাদ যেতে বলেছেন। উনি বেড়িয়েছেন – সাতটার মধ্যে ফিরে আসবেন। ক’দিন খুব ব্যস্ত থাকবেন। তারপর আবার বাইরে চলে যাবেন”। আমি আটটার একটু আগেই প্রফেসর ভট্টের বাড়ি চলে এলাম। স্যার ওনার স্টাডিতেই ছিলেন। ল্যাপটপে কি কাজ করছিলেন।
আমাকে দেখেই বললেন –“এসো। গত রবিবারই ফিরেছি। এই দু’দিন একটু ব্যস্ত ছিলাম আমার ভিসা আর টিকিটের ব্যাপারে। আমি সামনের শনিবার ফিলাডেলফিয়া যাচ্ছি – মাস দু-তিনেক থাকব। তাই তোমায় আজই ডেকে পাঠালাম। তোমার লাস্ট প্রশ্নটা কি যেন ছিল?”
আমি বললাম –“আমার প্রশ্ন ছিল যে আমরা এ যাবৎ অনেক অ-সৌর গ্রহের সন্ধান পেয়েছি। এমন কি বেশ কিছু পৃথিবী-সদৃশ গ্রহও তো পাওয়া গেল। তাদের কোনটাতেই প্রাণের সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না!এর কারণটা কী? সত্যিই কি তা’হলে আমরা মহাকাশে নিঃসঙ্গ?”
স্যার বললেন –“দেখো কত যে কোটি কোটি গ্রহ আছে তার হিসেব জানা নেই। কেপলার স্পেস মিশনের বিভিন্ন তথ্য থেকে অনুমান করা হচ্ছে যে আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিতে অন্তত চার হাজার কোটি গ্রহ তাদের অভিভাবক তারাদের বাসযোগ্য এলাকার মধ্যে অবস্থান করছে। আর এ পর্য্যন্ত তিন হাজার সাত’শর কিছু বেশী গ্রহের সন্ধান পাওয়া গেছে। আবার তার মধ্যে গোটা পনেরো মাত্র পৃথিবী সদৃশ গ্রহ। তাদের মধ্যে কোন প্রাণের সন্ধান পাই নি বলে ধরে নেব বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে কোথাও প্রাণ নেই এটা চুড়ান্ত অবৈজ্ঞানিক ও অবাস্তব যুক্তি। ব্যাপারটা কি রকম? বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক ও SETI Institute-এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা জিল টার্টারের কথায় বলি, আমরা যদি সমুদ্র থেকে এক গ্লাস জল তুলে নিয়ে তাতে কোন মাছ না পেয়ে সিদ্ধান্ত করি যে সমুদ্রে কোথাও মাছ নেই; এই ব্যাপারটাও অনেকটা তাই। কতটুকুই বা দেখা হয়েছে? আমার ধারণা প্রাণবন্ত গ্রহ অবশ্যই আছে – না থাকার কোন যুক্তি নেই। আবার খুঁজে না পাওয়ার কারণও যথেষ্ট। এমনও হয়তো হতে পারে কোনদিনই খুঁজে পাব না। সে কথাই আজ তোমাকে বলব”।
এমন সময়ে ধরণীদা এসে বললেন যে খাবার দেওয়া হয়েছে। স্যার বললেন –“চল আগে খেয়ে নি। আমার আবার সারাদিন ঠিক মতন খাওয়া হয় নি”। আমরা ডাইনিং রুমে এলাম। আজ শুধু পরোটা, কষা মাংস, স্যালাড আর পুডিং। খেতে খেতে স্যার বলছিলেন যে ইউ এস এ যাওয়াটা হঠাৎই ঠিক হোল। ছেলেরাও বার বার আসতে বলছে। তা ছাড়া ওনার দ্বিতীয় বই ‘ফ্রম সিঙ্গুলারিটি টু ইনফিনিটি’র প্রকাশনার ব্যাপারটাও রয়েছে। খেয়েদেয়ে আমরা আবার স্টাডিতে এসে বসলাম।
স্যার বলতে আরম্ভ করলেন –“আচ্ছা,আমি যে কথা বলছি শুনতে পাচ্ছ?”
আমি একটু অবাক হয়ে বললাম –“হ্যাঁ”!
স্যার –“কিন্তু তুমি যদি আমার থেকে পঞ্চাশ-ষাট ফুট দূরে থাক তা’ হলেও কি এই রকমই শুনতে পাবে?”
আমি বললাম –“না”।
স্যার –“কিন্তু আমি যদি খুব জোরে চেঁচিয়ে কথা বলি বা মাইক্রোফোনে বলি তবে নিশ্চয়ই শুনতে পাবে”।
আমি বললাম –“হ্যাঁ। তা তো বটেই”।
স্যার –“আসলে শব্দ বা তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গ যত প্রসারিত হতে থাকে ততই নানান বস্তুর বা মাধ্যমের দ্বারা প্রতিফলিত, প্রতিসরিত এবং ক্রমাগত শোষিত হতে থাকে। এর ফলে তরঙ্গের শক্তি হ্রাস হয় ও তার বিস্তার কমতে থাকে। এ কারণেই দূরের আলো আমরা দেখতে পাই না বা দূরের শব্দ শুনতে পাই না। যে দূরত্ব থেকে আমরা একটা টর্চের আলো দেখতে পাব না – সেই দূরত্ব থেকে একটা জোড়ালো সার্চলাইটের আলো অনায়াসে দেখতে পাব। সুতরাং তরঙ্গের গ্রাহক যন্ত্র যত দূরে থাকবে তত উচ্চ শক্তি সম্পন্ন তরঙ্গ পাঠাতে হবে।
আমরা যে রেডিও শুনি সেখানে কি হয়? কথা বা গান হল শব্দতরঙ্গ – তাকে মাইক্রোফোনের সাহায্যে ইলেক্ট্রিক সিগন্যালে রূপান্তর করা হয়। সেই সিগন্যাল কম কম্পাঙ্ক সমষ্টির ও কম শক্তির – তাকে দূরে পাঠানো জন্য নির্দিষ্ট এক উচ্চ শক্তির বা উচ্চ কম্পাঙ্কের তরঙ্গের সাহায্যে অ্যান্টেনার মাধ্যমে পাঠান হয়। দূরের গ্রাহক যন্ত্র সেই নির্দিষ্ট কম্পাঙ্কের তরঙ্গ থেকে সিগন্যালকে আলাদা করে আবার কথা বা গানের শব্দতরঙ্গে রূপান্তর করে। আমরা যখন স্থানীয় রেডিও স্টেশন ধরি তখন মিডিয়াম ওয়েভে ধরি – সেই রেডিও তরঙ্গের কম্পাঙ্ক ৩০০ কিলোহার্জ থেকে ৩ মেগাহার্জ। কিন্তু এর ক্ষমতা বেশীদূর নয়। দূরের রেডিও স্টেশন আমাদের আরও উচ্চ কম্পাঙ্কের শর্ট ওয়েভে ধরতে হয়। শর্ট রেডিও ওয়েভের কম্পাঙ্ক ৩ থেকে ৩০ মেগাহার্জ। তা হলে দেখো আমাদের সিগন্যালকে যত দূরে পাঠাতে চাইব তত বেশী উচ্চ শক্তির তরঙ্গ ব্যবহার করতে হবে। আন্তঃনক্ষত্র যোগাযোগের ক্ষেত্রেও এই একই সূত্র খাটবে।
এখন আমরা একমাত্র সেইসব অপার্থিব মেধার সন্ধান পেতে পারি যাদের বর্তমান সভ্যতা, বিজ্ঞান ও কারিগরী দক্ষতা আমাদের পৃথিবীর সমতুল্য বা তার চেয়ে বেশী। আমাদের বর্তমান সভ্যতার যুগের থেকে যারা পিছিয়ে আছে তাদের পক্ষে আমাদের সাথে আন্তঃনক্ষত্র যোগাযোগ করা কখনও সম্ভব নয়। আমাদের খুব কাছে পিঠেও যদি কোন গ্রহে এখন ডাইনোসরদের যুগ চলে বা এমন কি আমাদের বিংশ শতকের গোড়ার দিকের মতন সভ্যতাও যদি থাকে তাদেরকেও আমরা যোগাযোগ করতে পারব না। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত সভ্যতার দিক থেকে মানুষ কতটা উন্নত তার মাপকাঠি কি? এ বিষয়ে বিখ্যাত সোভিয়েট জ্যোতির্পদার্থবিদ নিকোলাই কারদাসেভ মানুষ কতখানি শক্তি সঞ্চয় ও ব্যবহার করতে পারে তার ওপর ভিত্তি করে একটি সভ্যতার মাপকাঠির প্রস্তাব করেছিলেন যা ‘কারদাসেভ স্কেল’ নামে পরিচিত।
কারদাসেভ ধাপে ধাপে তিন ধরণের সভ্যতার উল্লেখ করেছেন–
প্রথম – টাইপ ১ সভ্যতা বা গ্রহগত সভ্যতা –একটি গ্রহ তার অভিভাবক তারা থেকে যতটা শক্তি গ্রহণ করে তার সবটাই যদি মানুষ সঞ্চয় ও খরচ করতে পারে। এই শক্তির মান আমাদের পৃথিবী ও সূর্যের পরিপ্রেক্ষিতে প্রায় ৭x১০১৭ ওয়াট এর কাছাকাছি।বর্তমানে আমাদের পৃথিবীতে মানুষের শক্তি খরচের ক্ষমতা তুলনামূলকভাবে অনেক কম – প্রায় ১৫x১০১২ ওয়াট। অর্থাৎ আমরা এখনও টাইপ ১ সভ্যতাতেই উন্নত হতে পারি নি। বর্তমানে আমাদের যা শক্তি উৎপাদনের ক্ষমতা তার এক লক্ষ গুণ বেশী শক্তি উৎপাদন করতে হবে। বিখ্যাত পদার্থবিদ মিচিও কাকু মনে করেন যে টাইপ ১ সভ্যতার মানুষ ভূমিকম্প, আগ্নেয়গিরি, ঘূর্ণিঝড় ও আবহাওয়াকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে আর সমুদ্রে শহর বানাতে সক্ষম হবে। টাইপ ১ পর্যায়ে পৌঁছতে আমাদের আরও একশ থেকে দু’শ বছর লাগবে। বর্তমানে আমরা তার সত্তর ভাগ অব্ধি পৌঁছতে পেরেছি বলা যায়।
দ্বিতীয় – টাইপ ২ সভ্যতা বা তারকাগত সভ্যতা – একটি গ্রহের অভিভাবক তারার যতটা শক্তি তার সবটাই যদি মানুষ সঞ্চয় ও খরচ করতে পারে। শক্তির প্রধান উৎস সূর্য। কিন্তু সুর্যের শক্তির অতি সামান্য অংশই পৃথিবীতে আসে। সুর্যের উপর তলে সৌররশ্মির তীব্রতা ৬.৩৩x১০৭ ওয়াট/মিটার2। সূর্যের সেই রশ্মি যখন পৃথিবীপৃষ্ঠে পড়ে তখন তার তীব্রতার বাৎসরিক গড় মান গিয়ে দাঁড়ায় ১৩৬৭ ওয়াট/মিটার2। একটা ১০ ওয়াট শক্তিসম্পন্ন আলোর বাতি এক মিনিট জ্বলার অর্থ ৬০০ জুল শক্তি নির্গত হওয়া। আমাদের প্রাথমিক শক্তির উৎস কয়লা, পেট্রোলিয়াম, বিদ্যুৎ আর স্বল্প পরিমান অপ্রচলিত শক্তি যেমন সৌরশক্তি, বায়ুশক্তি ইত্যাদি। সমগ্র পৃথিবীর বাৎসরিক শক্তি খরচের পরিমান প্রায় ৫x১০২০ জুল। সেখানে সূর্য থেকে নির্গত শক্তির পরিমাণ প্রতি সেকেন্ডে ৩.৮x১০২৬ জুল। এখন কোন তারা থেকে নির্গত এই বিপুল পরিমান শক্তি মানুষ সংগ্রহ করবে কি ভাবে? আমেরিকার তাত্ত্বিক পদার্থবিদ ফ্রীম্যান ডাইসন একটি কল্পিত গবেষণামূলক পরীক্ষার প্রস্তাব করেছিলেন। গোলকের মতন গঠনের অজস্র কৃত্রিম উপগ্রহের ঝাঁক একটি তারাকে কেন্দ্র করে ঘিরে থাকবে আর তারা হতে নির্গত প্রায় সমস্ত শক্তিকে সংগ্রহ করবে যা তারাটির বাসযোগ্য এলাকায় অবস্থিত গ্রহের মানুষের ব্যবহারে লাগবে। এই ধরণের গোলকের নাম দেওয়া হয়েছে ডাইসন স্ফিয়ার বা ডাইসন গোলক। আমাদের সূর্যের চারদিক দিয়ে পৃথিবীর কক্ষপথ বরাবর যদি এরকম একটা কাঠামো তৈরী করতে হয় তাহলে তা’ ভূপৃষ্ঠের আয়তনের ষাট কোটি গুণ যায়গা লাগবে। ডাইসন এও মনে করেন যে এ ধরণের গাঠনিক বস্তু যে পরিমান তাপ মহাকাশে বর্জ্যন করবে তা সহজেই সনাক্ত করা যাবে। সেটি (SETI) গবেষকরা তারার চতুর্দিকে এ জাতীয় তাপ সনাক্ত করারও প্রচেষ্টা করেছেন – যদি কোন উন্নত মানব সভ্যতার সৃষ্ট ডাইসন গোলক পাওয়া যায়। অনুমান করা যায় যে আমাদের বর্তমান মানবিক সভ্যতার এই টাইপ ২ পর্যায়ে পৌঁছতে আরও এক হাজার থেকে দু’হাজার বছর লাগবে।
তৃতীয়– টাইপ ৩ সভ্যতা বা গ্যালাক্সিগত সভ্যতা –একটি গ্যালাক্সির সমস্ত শক্তিকে যদি মানুষ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। এ ক্ষেত্রে শক্তির পরিমাণ প্রতি সেকেণ্ডে ৪x১০৩৭ জুল। আমাদের এই টাইপ ৩ পর্যায়ে যেতে কম করে এক লক্ষ থেকে দশ লক্ষ বছর লাগবে। অবশ্য সবটাই ধারণা। বাস্তবে কি হবে তা একমাত্র ভবিষ্যৎই বলবে।
এখন এই কারদাসেভ স্কেল আবার অনেকে অনেকভাবে ব্যাখ্যা দেবার চেষ্টা করেছে – এমন কি একে এখন টাইপ ০ থেকে টাইপ ৭ অবধি বাড়ান হয়েছে। বর্তমান যুগ তথ্যপ্রযুক্তির যুগ বলে কার্ল সাগান আবার এই স্কেলে শক্তির সাথে তথ্যের পরিমানকেও অন্যতম মাত্রা হিসেবে যুক্ত করেছেন। সাগানের শ্রেণীবিন্যাসে ইংরেজি হরফ A হচ্ছে ১০৬ বিট অর্থাৎ ১২৫ কিলোবাইট তথ্য। এরপর ক্রমান্বয়ে ১০ এর গুণে বাড়তে বাড়তে হরফ Z হ’ল ১.২৫x১০৯ জেটাবাইট (Zettabyte) তথ্য। ১ জেটাবাইট মানে ১০২১ বাইট। ১৯৭৩ সালের হিসেবে পৃথিবীর তথ্যভাণ্ডার ছিল ১২৫০ গিগাবাইট আর সেখানে ২০১৩ সালের হিসেবে তা গিয়ে দাঁড়াচ্ছে ৪ জেটাবাইট। International Data Corporation এর এক সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে ২০২৫ সালে পৃথিবীর তথ্যভান্ডার গিয়ে দাঁড়াবে ১৬৩ জেটাবাইট।
এখন আসল কথা এই অপার্থিব মেধার সন্ধান করতে গেলে যেটা দরকার তা হল তাদের সাথে উপযুক্ত যোগাযোগের ব্যবস্থা করা। আর নিঃসন্দেহে এটা সম্ভব বেতার তরঙ্গের মাধ্যমে কারণ এই তরঙ্গ আন্তঃনক্ষত্র অঞ্চলে আলো বা অন্যান্য তড়িৎ-চুম্বকীয় তরঙ্গের থেকে অনেক নির্বিঘ্নে যেতে পারে।কোন সিগন্যাল বা বার্তা নির্দিষ্ট কম্পাঙ্কের বেতার তরঙ্গের মাধ্যমে অ্যান্টেনার সাহায্যে মহাকাশে পাঠান হয়। যত উচ্চ শক্তি সম্পন্ন বেতার তরঙ্গ পাঠানো যাবে তত দূরের তারার গ্রহে তা’পৌঁছবে যাতে যাত্রাপথে শক্তি কিছু হারিয়েও তার থেকে প্রয়োজনীয় বার্তা উদ্ধার করা যেতে পারে। এই অ্যান্টেনার সিগন্যাল পাঠানোর শক্তি কত তা প্রকাশ করার জন্য একটি পরিমাত্রা আছে যাকে বলে EIRP – Effective Isotropic Radiated Power বা বাংলায় বলতে পার‘কার্যকরী সমসারক বিকিরণ ক্ষমতা’। এই EIRPহল কোন নির্দিষ্ট দিকে অ্যান্টেনার বিকিরণ ক্ষমতা ও আকাশের যতটা অংশে বিকিরণ করতে পারছে তার অনুপাত। অ্যান্টেনার বিকিরণ যদি সর্বতোমুখী হয় তা হলে বিকিরণ ক্ষমতাই EIRP। এই EIRPদিয়েও আবার মানব সভ্যতার শ্রেণীবিন্যাস হয়েছে।এই বিন্যাসে টাইপ ১ সভ্যতায় অ্যান্টেনার বিকিরণ ক্ষমতা ১০১৬ওয়াট, যা সূর্যের যতটা আলো ও তাপেরশক্তি পৃথিবীতে এসে পরে তার সমতুল্য। টাইপ ২ সভ্যতায় এই ক্ষমতা ১০২৭ওয়াট, অর্থাৎ যা সূর্যসম তারার সমস্ত নির্গত শক্তির সমান। আর টাইপ ৩ সভ্যতায় এই ক্ষমতা ১০৩৮ওয়াট,যা একটি গ্যালাক্সির শক্তির তুল্য। ভিনগ্রহীদের সন্ধানের দুটি পন্থা – এক, তাদের পাঠান সংকেত খুঁজে পাওয়া আর দুই আমাদের এখান থেকে সংকেত পাঠানো আর সেই সংকেতের উত্তর পাওয়া। উভয় ক্ষেত্রেই রেডিও তরঙ্গ প্রেরক ও গ্রাহক অ্যান্টেনার উপযুক্ত ক্ষমতা থাকা প্রয়োজন ও সেই অনুসারে তাদের পরিকল্পনা ও নির্মাণ করতে হবে। কতটা দূরত্ব থেকে ভিনগ্রহীদের পাঠান সংকেত আমরা গ্রহণ করতে পারব তা কয়েকটি নির্ণায়কের উপর নির্ভর করবে – যে কোন পাঠান সংকেতের (Signal) সাথে বেশ কিছু অবাঞ্ছিত সংকেত বা ধ্বনি (Noise) আসে যা থেকে প্রয়োজনীয় সংকেতটুকু ছেঁকে নিতে হয়। দেখতে হবে গ্রাহক যন্ত্রের পরিবেশে এই অবাঞ্ছিত ধ্বনি কতটা। গ্রাহকযন্ত্রের সংবেদনশীলতা, প্রেরিত সংকেতের ক্ষমতা, প্রেরক অ্যান্টেনার আয়তন, গ্রাহক অ্যান্টেনার আয়তন। প্রথম কথা এই অবাঞ্ছিত ধ্বনি আমাদের পারস্পরিক যোগাযোগ করার কার্যক্ষমতাকে অনেকটা সীমিত করে দেয়। ধর কোন এক অনুষ্ঠানে তুমি আর আমি কথা বলছি – হঠাৎ কানের কাছে তারস্বরে মাইক বাজতে আরম্ভ করল। আমরা পরস্পরের কথা শুনতে পাচ্ছি না। তখন আমাদের আরও জোরে চেঁচিয়ে কথা বলতে হবে। গণনায় দেখা যায় যে আমাদের যদি মহাকাশের সমস্ত দিকে একশ আলোকবর্ষ দূরে কোন রেডিও সংকেত পাঠাতে হয় যাতে ভিনগ্রহীর গ্রাহক যন্ত্র সকল অবাঞ্ছিত ধ্বনি অবদমিত করে সেই সংকেত যথাযথভাবে গ্রহণ করতে পারে তা হলে আমাদের প্রেরক অ্যান্টেনারবিকিরণ ক্ষমতা হতে হবে ৫.৮x১০১৫ওয়াট, যা সমগ্র আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের তড়িৎশক্তি উৎপাদনের ক্ষমতার সাত হাজার গুণ। আমাদের বর্তমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এখনও এই পরিমাণ বিকিরণ ক্ষমতা সম্পন্ন অ্যান্টেনা তৈরী করতে পারে নি। এ জন্য আমাদেরকে অন্তত টাইপ ১ সভ্যতায় উন্নীত হতে হবে। এখন গ্যালাক্টিক শব্দের অর্থ যে এই একশ আলোকবর্ষ দূরত্ব অতি ক্ষুদ্র। বড় জোর হাজারখানেক তারা এই দূরত্বের মধ্যে রয়েছে। মোটামুটি একটা যুক্তিসঙ্গত অনুসন্ধান চালাতে গেলে আরও অনেক বেশী যায়গা জুড়ে সন্ধান করতে হবে। আর তার জন্য চাই আরও অনেক বেশী শক্তিসম্পন্ন অ্যান্টেনা। আবার যত বেশী দূরত্বে রেডিও তরঙ্গ যেতে থাকবে তত নানাবিধ বাধার সম্মুখীন হয়ে দুর্বল হতে থাকবে, বিপথে যেতে থাকবে –আর তার ফলে ভিনগ্রহীদের গ্রাহক যন্ত্রের পক্ষে সংকেত উদ্ধার করা অসম্ভব হয়ে উঠবে। আমাদের বর্তমান গ্রাহক অ্যান্টেনার যে সংবেদনশীলতা তাতে এখনও আমরা কোন অপার্থিব মেধার সংকেত ধরতে পারি নি– এমন কি টাইপ ২ কি টাইপ ৩ সভ্যতারও নয়, যদি তারা আদৌ থেকে থাকে। হয়তো এই সংবেদনশীলতা অনেক বাড়াতে হবে। হতে পারে তাদের সংকেত আসছে কিন্তু আমরা তা উদ্ধার করতে পারছি না। আর ধরা যাক একশ থেকে দু’শ আলোকবর্ষ দূরে কোন অতি উন্নত সভ্যতা আমাদের পাঠান সংকেত উদ্ধার করে উত্তর পাঠাল – কিন্তু তাতে সময়ও লাগবে দু’শ থেকে চারশ বছর মানে এই এত বছর ধরে – প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে এই অনুসন্ধান চালিয়ে যেতে হবে উত্তরের আশায়। তাই দেখা যাচ্ছে যে মহাকাশে বিশাল এলাকা জুড়ে বিপুল সংখ্যক তারার মধ্যে অপার্থিব মেধার অনুসন্ধান চালানোর মত শক্তির উৎস, প্রযুক্তি ও অর্থ হয়তো আমাদের ক্ষমতার বাইরে। এ জাতীয় বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের জন্য অনেক অর্থের প্রয়োজন হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ইউনিভারসিটি বা গবেষণা সংস্থার বৈজ্ঞানিকরা অত্যন্ত সীমিত আর্থিক অনুদানের ওপর নির্ভর করে গবেষণা চালান। যে সব রেডিও টেলিস্কোপে তাঁরা অনুসন্ধান করেন তার সময়সীমা বাঁধা থাকে আর তা বছরে কয়েক ঘন্টা থেকে হয়তো কয়েকদিন। তার জন্য অনেক আগে থেকে টাকাপয়সা দিয়ে সংরক্ষণ করতে হয়। সেই অল্প সময়ের মধ্যেই ভিনগ্রহীদের সংকেত ধরা যাবে তার সম্ভাবনা কতটা বলা খুব মুশকিল। তবুও এই সীমিত ক্ষমতার মধ্যে যতদূর সম্ভব অনুসন্ধান চালিয়ে যেতে হবে। সাফল্য যে আসবেই না কে বলতে পারে?
অপার্থিব মেধার অনুসন্ধানে অতি সাম্প্রতিককালে দুটো বড় প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। একটা হ’ল আমেরিকার বার্কলেতে ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাস্ট্রোনমি ডিপার্টমেন্টের সেটি (SETI) রিসার্চ সেন্টারের ‘ব্রেকথ্রু লিসন প্রকল্প’। রাশিয়ান বিনিয়োগকারী ইউরি মিলনার এর জন্য দশ কোটি ডলার বরাদ্দ করেছেন। উত্তর গোলার্ধে পশ্চিম ভার্জ্জিনিয়ার গ্রীন ব্যাঙ্ক রেডিও টেলিস্কোপের কুড়িভাগ সময় ও দক্ষিণ গোলার্ধে অস্ট্রেলিয়ার নিউ সাউথ ওয়েলসের পার্কস অবসারভেটরির রেডিও রেলিস্কোপের পঁচিশ ভাগ সময় এই প্রকল্পের জন্য নির্দিষ্ট করা হয়েছে। দ্বিতীয়টির নাম ফাস্ট (FAST – Five hundred meter Aperture Spherical Telescope)। এটা দক্ষিণ পশ্চিম চীনের গাইজো প্রদেশে স্থাপিত একটি রেডিও টেলিস্কোপ যাতে আছে ১৬০০ ফুট ব্যাসের ডিস অ্যান্টেনা। এর বর্তমান বিকিরণ ক্ষমতা ১০১২ওয়াট। এর সাহায্যে আঠাশ আলোকবর্ষের মধ্যে অবস্থিত প্রায় ১৪০০ তারার মধ্যে অনুসন্ধান চালানো হবে।
আমি বললাম, “এবার বুঝলাম কেন আমরা এতদিনেও ভিনগ্রহীদের কোন সন্ধান পেলাম না। অর্থাৎ আমাদের এ বিষয়ে আরও অনেক বেশী প্রযুক্তিগত উন্নতি দরকার। আচ্ছা অনেক সময়ে বলা হচ্ছে যে বর্তমানে জনসংখ্যা বৃদ্ধি, খাদ্যাভাব, পরিবেশ দূষণ, বিশ্বের উষ্ণায়ন, অপ্রচলিত শক্তির উৎসের ক্রমান্বয় হ্রাসপ্রাপ্তি প্রভৃতি নানা কারনে আগামি দিনে পৃথিবীতে মানুষের অস্তিত্ব টিকে থাকবে কি না সন্দেহ। অনেকেই বলেছেন এমন কি মহামান্য স্টিফেন হকিং ও বলেছেন যে মানবজাতিকে টিকিয়ে রাখতে হলে আমাদের এখন থেকেই অন্য কোন বাসযোগ্য গ্রহে উপনিবেশ গড়ে তুলতে হবে। তাই যদি হয় সেটাতো সভ্য ভিনগ্রহীদের ক্ষেত্রেও হতে পারে। তা হলে অন্তত টাইপ ২ বা টাইপ ৩ সভ্যতার মানুষ এতদিনে অনেক গ্রহেই হয়তো উপনিবেশ গড়ে তুলেছে। সেই প্রস্তর যুগ থেকে মানুষ যখনই প্রয়োজন হয়েছে এক বাসস্থান ছেড়ে অন্যত্র পরিযান করেছে। আবার নতুন করে বসতি স্থাপন করেছে। ঠিক সে রকম কোন আন্তঃনক্ষত্র পরিযান কি হয় না? তাদের মধ্যে কেউ কি কখনও আমাদের পৃথিবীতে অনুসন্ধান করতে আসত না? এইসব উড়ন্ত চাকি বা প্রাচীন যুগের কিছু কিছু অদ্ভূত প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন দেখিয়ে অনেকেই ভিনগ্রহীদের পৃথিবীতে আসার তত্ত্ব খাড়া করে থাকেন এগুলো কতটা সত্যি?
স্যার – “হ্যাঁ, এটা নিয়েও বেশ কিছু বিতর্ক হয়েছে। এটা ঠিকই পৃথিবীতে মানুষ আদিম যুগ থেকেই এক যায়গা থেকে আরেক জায়গায় নানা কারণে পরিযান করেছে। বিশেষতঃ বেঁচে থাকার রসদের অভাব ঘটলে বা বহিঃশত্রু আক্রমণ করলে বা কোন মহামারী, প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিপর্যস্ত হলে। ঠিক একই তত্ত্ব অপার্থিব পরিযানের ক্ষেত্রেও প্রয়োগ হতেই পারে। কিন্ত সত্যিই এই অপার্থিব পরিযাণ হয় কি না বা হয়েছে কি না তার বোঝার কোন উপায় এখনও আমরা পাই নি। তবে এই নিয়ে কিছু বৌদ্ধিক চর্চা করা হয়ে থাকে। এই অপার্থিব পরিযাণ নিয়ে প্রথম আলোচনা শুরু করেন ১৯৭৫ সালে ফের্মি প্যারাডক্সকে প্রতিষ্ঠা করার মূল হোতা মাইকেল হার্ট, ডেভিড ভিউইং ও পরবর্ত্তীকালে ফ্রাংক টিপলার, রোনাল্ড ব্রেসওয়েল। এদের কথা তোমাকে প্রথম দিন ফের্মি প্যারাডক্স নিয়ে আলোচনার সময়ে বলেছিলাম। তাঁদের আলোচনার প্রথম কথাই ছিল যে পৃথিবীতে ভিনগ্রহীদের আসার কোনও স্পষ্ট প্রত্যক্ষ প্রমাণ নেই। উড়ন্ত চাকি নিয়ে বা প্রাচীন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন নিয়ে যে যাই বলুক সবই মিথ্যে, জল্পনা– কোন বিজ্ঞানসম্মত প্রমাণ নেই বরঞ্চ অনেক ক্ষেত্রে জাল বা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। যদি অতীতে পৃথিবীতে ভিনগ্রহীরা এসেই থাকত তাহলে আমাদের এই সায়ানোব্যাক্টিরিয়া থেকে হোমোস্যাপিয়েনস হওয়ার বিবর্তন আর হত না – অনেক আগেই আমরা শেষ হয়ে যেতাম।
একদিকে অপার্থিব উন্নত সভ্যতার পর্যাপ্ত উপস্থিতি আর অপরদিকে পৃথিবীতে উন্নত ভিনগ্রহীদের অনুপস্থিতি – এই দুই আপাতবিরোধী ধারণার মধ্যে সামঞ্জস্যের জন্য চারটে ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে –
- হয়তো প্রযুক্তিগত কারণে বা জৈবিক কারণে মহাকাশযানে আন্তঃনক্ষত্রভ্রমণ সম্ভবপর নয় – তাই ভিনগ্রহীদের পৃথিবীতে আসার ইচ্ছে থাকলেও কখনো আসতে পারে নি।
- হয়তো কোন উন্নত সভ্যতার ভিনগ্রহীরা অন্য ভিনগ্রহীদের অন্বেষণ করছে কিন্তু এখনও আমাদের খুঁজে পায় নি বা অথবা পেলেও আমাদের ব্যাপারে তাদের কোন আগ্রহ জন্মায় নি বা নীতিগত কারণে হস্তক্ষেপ করা প্রয়োজন মনে করে নি।
- অথবা হয়তো ভিনগ্রহীরা অতীতে আমাদের পৃথিবীতে বা আশেপাশে সক্রিয় ছিল বা এখনও আছে, অথচ আমরা তাদের উপস্থিতি টের পাচ্ছি না।
- হয়তো আন্তঃনক্ষত্র ভ্রমণ সম্ভবপর এবং উন্নত সভ্যতা তাতে হয়তো বেশীদিন সফল হয় নি আর যার জন্য ভিনগ্রহীরা আমাদের এখানে এখনও এসে পৌঁছতে পারে নি।
এখন আমরা যদি এই চারটে ধারনাকেই বাতিল করে দিই তাহলে একটাই সম্ভাবনা থাকে যে আমরাই এই গ্যালাক্সিতে একমাত্র উন্নততম ধরণের জীবন।
প্রথম ধারণাটা নিয়ে বলি। ফের্মিও কিন্তু এই সন্দেহ করেছিলেন যে এ পর্য্যন্ত কোন ভিনগ্রহীর পৃথিবীতে না আসার কারণ, আন্তঃনক্ষত্র মহাকাশ ভ্রমণ হয়তো সম্ভবপর নয়। দেখো বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির কোন তত্ত্ব বা সুত্র কিন্তু বলবে না যে আন্তঃনক্ষত্র মহাকাশ ভ্রমণ সম্ভব নয়। তবে এ নিয়ে আমি পরে আলোচনা করছি। পরের ধারণাগুলোকে সামাজিক দৃষ্টিতে বিচার করতে হবে। এদের কোন নির্দিষ্ট বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব গড়ে তোলা যায় না। মাইকেল হার্ট এ নিয়ে বিশদ আলোচনা করেছেন। তাঁদের মতে এ সব অপার্থিব মেধার অনুসন্ধান করা মানে সময় নষ্ট আর সরকারি অর্থের অপচয় করা। তাঁদের এই আলোচনা অনেক জ্যোতির্বিজ্ঞানী, সমাজতত্ত্ববিদ, রাজনীতিবিদদের বেশ প্রভাবিত করেছিল। অনেক গবেষণামুলক বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল। যার ফলে একসময়ে মার্কিন সরকার নাসার অপার্থিব মেধার গবেষণার সব প্রকল্পের আর্থিক অনুদান বন্ধ করে দিয়েছিল।
এখন আমরা যেমন অপার্থিব মেধার অনুসন্ধান করছি, ভিনগ্রহীদের নিয়ে আমাদের এত উৎসাহ, মহাকাশ ভ্রমণের নিত্য নতুন গবেষণা করছি এবং প্রাথমিকভাবে বেশ কিছুটা সফলও হয়েছি– আর সব উন্নত সভ্যতার ভিনগ্রহীরাও তাই করছে এমন ভাবার কোন কারণ নেই। হয়তো তারা আদৌ এসব ব্যাপারে আগ্রহী নয় – তারা হয়তো আধ্যাত্মিক চিন্তা নিয়ে বেশী ব্যস্ত– উচ্চতর মনোজগতের অনুসন্ধানে ব্যপৃত। একে বলা হয়েছে The Contemplation Hypothesis।
এমনও হতে পারে যে এই সব ভিনগ্রহীরা নিউক্লিয়ার যুদ্ধবিগ্রহে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। একে বলে The Self-destruction Hypothesis।
অথবা এও হতে পারে যে তারা আমাদের ভালোভাবেই জানে আর আমরা যাতে বিনষ্ট না হই তার জন্য জাতীয় বন বা বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের মতন আমাদের ঘাঁটাচ্ছে না। এর নাম The Zoo Hypothesis।
তোমার মনে আছে বোধ হয় আমি প্রথম দিন ফের্মি প্যারাডক্স নিয়ে আলোচনার সময়ে বলেছিলাম যে অনুমান করা যেতে পারে আমাদের গ্যালাক্সিতে আমাদের মতন বা আমাদের থেকেও উন্নত সভ্যতা অন্তত এক লক্ষ আছে। নাহয় তর্কের খাতিরে আরও রক্ষণশীল অনুমান করলাম যে এর সংখ্যা দশ হাজার। তা হ’লে এই দশ হাজার উন্নত সভ্যতার অপার্থিব মেধার মানুষ সবাই আমাদের প্রাচীন বৈদিক ঋষিগণের মতন আধ্যাত্মিক উন্নতির প্রয়াস করছে বা সকলেই নিউক্লিয়ার যুদ্ধবিগ্রহ করে নিজেরা ধ্বংস হয়ে গেছে বা সবাই আমাদের সংরক্ষণের জন্য বিরক্ত করছে না অথবা কিছু আধ্যাত্মিক চর্চায় ব্যস্ত, কিছু ধ্বংস হয়ে গেছে আর বাকিরা আমাদের ঘাঁটাচ্ছে না – এ সব অদ্ভূত ভাবনা ভাবার বা ধরে নেবার কোন যুক্তি আছে কি? দেখো প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ পরীক্ষার দ্বারা প্রমাণ বা কোন গাণিতিক গণনার দ্বারা সমর্থিত সর্বজনস্বীকৃত মডেল ছাড়া বিজ্ঞান কোন তত্ত্ব স্বীকার করে না। এ সব মনগড়া অনুমানের ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা তত্ত্বের কোন মূল্য বিজ্ঞানের কাছে নেই। সুতরাং ভিনগ্রহীদের পৃথিবীতে না আসার কারণ হিসাবে কল্পিত এই দ্বিতীয় ও তৃতীয় ধারণা দুটিকে অনায়াসে নাকচ করা যেতে পারে।
এবার চতুর্থ ধারণাটি বিশ্লেষণ করা যাক। একটা গ্রহের উন্নত প্রাণী সফলভাবে দ্রুত মহাকাশ ভ্রমণের পন্থা আবিষ্কারের পর থেকে কতদিনে মহাকাশে গ্যালাক্সির সকল বাসযোগ্য ঘরে ছড়িয়ে পড়ে উপনিবেশ গড়ে তুলতে পারে তার একটা আন্দাজ মাইকেল হার্ট থেকে শুরু করে অনেকেই করেছেন। সাম্প্রতিককালে ফ্লোরিডা গালফ-কোস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের টমাস হেয়ার ও অ্যান্ড্রু হেডম্যান ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অফ অ্যাস্ট্রোবায়োলজিতে এই নিয়ে আলোচনা করেছেন সম্পূর্ণ গাণিতিক মডেলের ভিত্তিতে। কথা হচ্ছে যে এনারা দুজনেই গণিতজ্ঞ – কেউই অ্যাস্ট্রোনমার বা অ্যাস্ট্রোবায়োলজিস্ট নন।
হেয়ার আর হেডম্যান তাঁদের তত্ত্বের প্রথমেই ধরে নিয়েছেন যে গ্যালাক্সিতে পাঁচ আলোকবর্ষের তফাতে একটা করে আমাদের মতন সৌরজগৎ আছে। কোন উন্নত সভ্যতা যার মহাকাশ ভ্রমণের উপযুক্ত প্রযুক্তি করায়ত্ত করতে এবং ঔপনিবেশিকতায় উৎসুক এক গ্রহ থেকে নিকটস্থ গ্রহে উপনিবেশ স্থাপন করতে সময় নেবে এক হাজার বছর। তার মধ্যে পাঁচশ বছর ভ্রমণকাল – মানে আলোর গতির শতকরা এক ভাগ গতিতে গেলে আর পাঁচশ বছর পরবর্ত্তী গ্রহে যাবার প্রস্তুতি। অবশ্যই তাঁদের তত্ত্বের এই প্রাথমিক ধারণাটাই যথেষ্ট বিতর্কমূলক। তাঁদের পরবর্ত্তী বিশ্লেষণ গণিতে প্রচলিত পারকোলেসন তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে। পরিশেষে তাঁরা মহাকাশযানের আরও বাস্তবসম্মত গতি অর্থাৎ আলোর গতির শতকরা ০.২৫ ভাগ ধরেও সিদ্ধান্ত করেছেন যে এই হারে উন্নত সভ্যতার ঔপনিবেশিকতা পাঁচ কোটি বছরের মধ্যে ১৩০,০০০ আলোকবর্ষ যায়গা জুড়ে ছড়িয়ে পরতে সক্ষম। আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির ব্যাপ্তি ১০০,০০০ থেকে ১২০,০০০ আলোকবর্ষ। সুতরাং আমাদের পৃথিবী যা গ্যালাক্সির প্রান্তিক অঞ্চলে অবস্থিত – সেখানে এতদিনে উন্নত সভ্যতার ভিনগ্রহীদের পদার্পণ ঘটা নিশ্চিত ছিল। আমাদের গ্যালাক্সির বয়স প্রায় এক হাজার কোটি বছর আর পৃথিবীর বয়স অন্তত সাড়ে চারশ কোটি বছর। কাজেই দেখো মহাজাগতিক সময়ের স্কেলে এই পাঁচ কোটি বছর খুবই কম সময়। পাঁচ কোটি বছর আগে বিবর্তনের পর্যায়ে সব পাখির দল তখন পৃথিবীর আকাশে উড়ে বেড়াচ্ছে। পৃথিবীতে যখন প্রাণের উদ্ভব হয়েছে তখন অন্য কোন প্রাচীন তারার গ্রহে উন্নত সভ্যতা গড়ে না ওঠার কোন কারণ নেই। তাই ভিনগ্রহীরা সাম্প্রতিকালে পরিযান শুরু করেছে আর সে কারণে আমাদের পৃথিবীতে এসে এখনও পৌঁছতে পারে নি, এই ধারণা ধোপে টেঁকে না।
এখন এও হতে পারে যে আমাদের পৃথিবী কোনো ফাঁকে পড়ে গেছে যে ভিনগ্রহীরা লক্ষ্য করেনি। এ বিষয়ে তাঁরা বলেছেন যে তাঁদের মডেল নানানভাবে পরীক্ষা করে দেখেছেন যে এই ফাঁক সর্বাধিক তিরিশ আলোকবর্ষ হতে পারে। পৃথিবীর মানুষ বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিক থেকেই রেডিও সম্প্রচার করা আরম্ভ করেছে। গত প্রায় ষাট বছর ধরে মানুষ মহাকাশে ভিনগ্রহীদের উদ্দেশ্যে সিগন্যাল পাঠাচ্ছে – তাদের কোন বার্তা পাওয়া যায় কি না তার অনুসন্ধান চালাচ্ছে। এই রেডিও সিগন্যাল ধরেই যে কোন উন্নত ভিনগ্রহী আমাদের পৃথিবীর সন্ধান অনায়াসেই পেতে পারে।এ ছাড়াও যদি একাধিক উন্নত সভ্যতা থেকে থাকে তবে তাদের মধ্যে উপনিবেশ স্থাপনের প্রতিযোগিতা হওয়াটাও স্বাভাবিক। হেয়ার আর হেডম্যানের মতে এর জন্য আরও জটিল মডেল তৈরী করা সম্ভব।
তা হলে দেখা যাচ্ছে পৃথিবীতে এখনও পর্য্যন্ত ভিনগ্রহীদের অনুপস্থিতির চারটি ধারণার তিনটিই নাকচ করা যাচ্ছে। বাকি থাকছে প্রথম ধারণা অর্থাৎ মহাকাশযানে আন্তঃনক্ষত্র ভ্রমণ সম্ভবপর নয় – এ নিয়ে আমি পরে ফিরে এসে বিশদভাবে আলোচনা করব”।
************
[ক্রমশঃ]
Tags: অপার্থিব মেধার সন্ধানে, তৃতীয় বর্ষ চতুর্থ সংখ্যা, প্রবন্ধ, বিজ্ঞানভিত্তিক প্রবন্ধ, সনৎ কুমার ব্যানার্জ্জী, সুপ্রিয় দাস