অপার্থিব মেধার সন্ধানে
লেখক: সনৎ কুমার ব্যানার্জ্জী
শিল্পী: ইন্টারনেট
আন্তঃনক্ষত্র পরিভ্রমণ – ১
আজ রবিবার। সকাল থেকেই ঝাঁকে ঝাঁকে বৃষ্টি আসছে। এখন ভরা শ্রাবণ মাস। বারোটা নাগাদ বৃষ্টিটা একটু ধরতে ছাতা মাথায় গুটি গুটি প্রফেসর মহাকাশ ভট্টের বাড়ি এলাম। স্যার স্টাডিতেই ছিলেন। আমাকে দেখে বললেন – “যাক, এসে গেছ। আজ তুমি আসবে বলে আমি বেঁচে গেলাম”।
আমি অবাক হয়ে বললাম – “কেন স্যার?”
স্যার – “আরে বোলো না। আমার এক মামাতো দিদি – শক্তিগড়ে থাকেন। বয়স হয়েছে – একটু অসুস্থ। চিকিৎসার জন্য গতকাল উত্তরপাড়ায় মেয়ের বাড়িতে এসেছেন। ফোন করেছিলেন তাই সকালে একটু দেখা করতে গিয়েছিলাম। তা’ তারা ওখানে কেউ ছাড়বে না। খাওয়া-দাওয়া করে যেতে হবে। দেখো আমি তো ঠিক সেভাবে অত সামাজিক নই – আর ওদের ওই সাংসারিক গালগল্প আমার একদম ভালো লাগে না। তুমি আসবে এই অজুহাতে পালিয়ে এলাম। তবে একটা লাভ হয়েছে – সঙ্গে অনেক ল্যাংচা দিয়ে দিয়েছে – শক্তিগড়ের ল্যাংচা। চল সেগুলোর সদ্ব্যবহার করা যাক। এ কথা সে কথায় প্রায় পৌনে একটা বেজে গেল। ধরণীদা খেতে ডাকলেন। আজ একদম বর্ষার আদর্শ খাবার। খিচুড়ি, বেগুনভাজা, তোপসে মাছ ভাজা, চিংড়ি মাছ দিয়ে পুঁই শাকের পাঁচমিশালি তরকারি। তার ওপর ল্যাংচা। খেয়েদেয়ে আবার স্টাডিতে এলাম। স্যার পাইপ ধরিয়ে তার প্রিয় রিক্লাইনারে গা এলিয়ে দিলেন। আমিও পাশের সোফায় বসে সেন্টার টেবিলে ভয়েস রেকর্ডার নিয়ে প্রস্তুত।
স্যার বললেন – “আজ আমরা যেন কী নিয়ে আলোচনা করব?”
আমি – “স্যাটেলাইটগুলো কীভাবে কক্ষপথে পাঠান হয়”।
স্যার – “ও হ্যাঁ ঠিক। আগের দিন তোমায় রকেটের প্রাথমিক বিষয় নিয়ে বলেছিলাম। যদিও যত সহজে বলেছিলাম বিষয়টা তত সহজ নয় বিশেষত যান্ত্রিক আর কারিগরির দিক থেকে। শুধু স্যাটেলাইটগুলোকে নির্দিষ্ট কক্ষপথে পাঠানই হয় না, পৃথিবী থেকে তাদের নিয়ন্ত্রণও করা হয়। বিশেষ করে স্পেসশিপ বা স্পেসস্টেশনগুলো একশো ভাগই এখান থেকে নিয়ন্ত্রিত হয়। আর সবগুলোই রকেট বা স্পেসশাট্ল দিয়ে উৎক্ষেপ করা হয়”।
আমি – “কিন্তু স্যার এই রকেট আর স্পেসশাট্ল কি আলাদা? আর এই স্যাটেলাইটগুলোরই বা স্পেসশিপ, স্পেসস্টেশন এরকম আলাদা আলাদা নাম কেন?”
স্যার – “তোমার দ্বিতীয় প্রশ্নের জবাবটা আগে দিই। স্পেসক্র্যাফট কথাটা জাতিবাচক – যে-কোনও ধরণের মহাকাশযান।
স্যাটেলাইট মানে উপগ্রহ যা কোনও গ্রহকে কেন্দ্র করে ঘুরছে। মহাকাশে যে সমস্ত স্যাটেলাইট পাঠান হয় সেগুলোকে বলি কৃত্রিম উপগ্রহ – এগুলো ছোটখাটো স্পেসক্র্যাফট – পৃথিবীর চতুর্দিকে ঘুরছে অজস্র ওয়েদার, কমিউনিকেশন স্যাটেলাইট এমন কী স্পাই স্যাটেলাইট পর্যন্ত। এরকম চাঁদ ও মঙ্গলকে কেন্দ্র করে ঘোরা বেশ কিছু স্যাটেলাইট আছে। স্পেসশিপ হল মনুষ্যচালিত ও মনুষ্যবাহী স্পেসক্র্যাফট। আর স্পেসস্টেশন সম্বন্ধে তোমায় আগেই বলেছি – যেখানে বেশ কিছু মানুষ একসঙ্গে দীর্ঘদিন থেকে পরীক্ষানিরীক্ষা করে থাকেন – পৃথিবী থেকে সেখানে যাতায়াত করা যায়।
এবারে তোমার প্রথম প্রশ্নে আসি। রকেট আর স্পেসশাট্ল – দুটোই মহাকাশে স্পেসক্র্যাফট উৎক্ষেপক যান। রকেট কোনও স্পেসক্র্যাফটকে তার নির্দিষ্ট লক্ষ্যস্থলে পৌঁছে দিয়ে নিঃশেষ হয়ে যায়। যেমন ধর তিন পর্যায়ের রকেটের প্রথম পর্যায়ের জ্বালানি শেষ হয়ে গেলে তা’ সিস্টেম থেকে খসে সমুদ্রের জলে পড়ে যায়। সে রকম দ্বিতীয় পর্যায়ের অংশ পৃথিবীর আবহমণ্ডলে পড়ে বেগ ও বায়ুমণ্ডলের সঙ্গে তীব্র ঘর্ষনজনিত কারণে উত্তপ্ত হয়ে জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে যায়। তৃতীয় অংশ স্পেসক্র্যাফটকে তার লক্ষ্যে ছেড়ে দিয়ে মহাকাশেই জঞ্জালরূপে রয়ে যায়। সুতরাং রকেট একবার মাত্র ব্যবহার করা যায় অর্থাৎ একমুখী যান। শাট্ল কথার অর্থ কোনও যান বা বস্তু যা দুই বা ততোধিক স্থানের মধ্যে নিয়মিতভাবে যাতায়াত করে। যেমন তাঁতের মাকু বা ব্যাডমিন্টনের শাট্ল কক বা শাট্ল ট্যাক্সি। ঠিক সেরকম স্পেসশাট্লও স্পেসক্র্যাফট বহনকারী যান যা স্পেসক্র্যাফটকে তার লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছে দিয়ে আবার পৃথিবীতে নিরাপদে ফিরে আসে এবং একই স্পেসশাট্ল বার বার ব্যবহার করা যায়। এই স্পেসশাট্লের তিনটে প্রাথমিক অংশ – একটি জ্বালানির বড় ট্যাঙ্ক, দুটি SRB অর্থাৎ সলিড রকেট বুস্টার ও একটা অরবাইটার। উৎক্ষেপের মিনিট দুয়েক পরেই সলিড রকেট বুস্টার দুটো নিঃশেষ হয়ে সমুদ্রে খসে পড়ে। সেগুলো আবার ব্যবহার করা হয়। বড় জ্বালানির ট্যাঙ্ক নিঃশেষ হলে পৃথিবীর ওপরেই পুড়ে ছাই হয়ে যায়। অরবাইটার কাজ শেষ করে আবার পৃথিবীতে ফিরে আসে”।
এই বলে স্যার ল্যাপটপে ইন্টারনেট থেকে রকেট আর স্পেসশাট্লের ছবি দেখিয়ে বললেন – “এই এরোপ্লেনের মতন দেখতে অংশটাই শাট্ল – একে বলে অরবাইটার যা পৃথিবীর চারদিকে ঘুরতে পারে। এতে এক একবারে সাতজন অ্যাস্ট্রোনট মহাকাশে যেতে পারে। অ্যামেরিকার নাসা এ রকম পাঁচটা কর্মক্ষম স্পেস শাট্ল তৈরি করেছিল – কলোম্বিয়া, চ্যালেঞ্জার, ডিসকভারি, আটলান্টিস আর এন্ডেভার। এর মধ্যে ১৯৮৬-তে চ্যালেঞ্জার আর ২০০৩ সালে কলোম্বিয়া দুর্ঘটনায় ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। এতে মোট চোদ্দজন অ্যাস্ট্রোনট প্রাণ হারান যার মধ্যে রয়েছেন আমাদের প্রথম মহিলা মহাকাশযাত্রী কল্পনা চাওলা।
সলিড রকেট বুস্টার দুটোর কাজ পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণের বিপরীতে শাট্লকে নিয়ে যাওয়া। উৎক্ষেপের সময়ে স্পেস শাট্ল রকেটের সাহায্যে সোজা ওঠে কিন্তু নামার সময়ে ঠিক এরোপ্লেনের মতন গ্লাইড করে রানওয়েতে নেমে আসে। স্পেস শাট্লের উৎক্ষেপনকে নাসা বলে ‘মিশন’। ১৯৮১ থেকে ২০১১ সাল পর্য্যন্ত নাসা ১৩৫টি মিশন করেছে। অর্থাৎ ওই পাঁচটি স্পেস শাট্ল মোট ১৩৫ বার পৃথিবী ও মহাশূন্যের মধ্যে যাতায়াত করে। এর পর থেকে অ্যাস্ট্রোনট ও কসমোনটরা অর্থাৎ নভোচররা যাতায়াত করেছেন সোভিয়েত রাশিয়ার সয়ুজ স্পেসক্র্যাফটে”।
আমি একট ঘাবড়ে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম – “স্যার অ্যাস্ট্রোনট আর কসমোনট কি আলাদা?”
স্যার হেসে বললেন – “আলাদা বলতে নভোচরদের রাশিয়ানরা বলে কসমোনট আর অ্যামেরিকানরা ও অন্যান্য দেশিয়রা বলে অ্যাস্ট্রোনট। রাশিয়ার সয়ুজ আর অ্যামেরিকার স্পেসশাট্ল – দুটোরই কাজ এক অর্থাৎ নভোচরদের পৃথিবী থেকে মহাকাশে পারাপার করা। কিন্তু গঠনের দিক থেকে তারা ভিন্ন। শাট্ল যেমন এরোপ্লেনের মতন দেখতে – অবতরণও করে প্লেনের মতন – সয়ুজ কিন্তু দেখতেও আলাদা আর অবতরণ করে রকেট ইঞ্জিন ও প্যারাস্যুটের সাহায্যে”।
স্যার নেট থেকে সয়ুজের ছবি বার করে বললেন –“এই দেখ সয়ুজের মূল দুটো অংশ – একটা রকেট উৎক্ষেপণের জন্য আর দ্বিতীয়টা রকেটের মাথায় ক্যাপসুল। এই ক্যাপসুলের আবার তিনটি অংশ যাকে বলা হয় মডিয়ুল। প্রথম – অরবাইটাল মডিয়ুল বা হ্যাবিটেবল অর্থাৎ বাসযোগ্য মডিয়ুল যেটা কক্ষপথ পরিভ্রমণকালে নভোচরদের কেবিন বা বাসস্থান বলতে পার। এটা একটা বড় ভ্যান গাড়ির আকারের আর স্পেস স্টেশনের সঙ্গে সংযোগ করা যায়। ফলে নভোচররা অরবাইটাল মডিউল থেকে সরাসরি স্পেসস্টেশনের ভেতর ঢুকে যায় বা আবার ফেরার সময়ে স্পেসস্টেশন থেকে অরবাইটাল মডিউলে চলে আসে। দ্বিতীয় অংশ হল ডিসেন্ট মডিয়ুল বা অবতরণ মডিয়ুল। সয়ুজ উৎক্ষেপণের সময় ও ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশন থেকে পৃথিবীতে ফিরে আসার সময় নভোচররা এই অবতরণ মডিয়ুলটি ব্যবহার করেন। আর তৃতীয় মডিয়ুলটি হল যাবতীয় যন্ত্রপাতি, জ্বালানী, সৌর ব্যাটারির প্যানেল, চালক ইঞ্জিন, অ্যান্টেনা ইত্যাদির।
ফিরে আসার সময়ে নভোচররা হ্যাবিটেবল মডিয়ুল থেকে অবতরণ মডিয়ুলে প্রবেশ করেন। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করার পর আরব পেনিনসুলার কাছাকাছি ভূপৃষ্ঠ থেকে প্রায় একশো চল্লিশ কিলোমিটার ওপরে সয়ুজের তিনটি মডিয়ুল আলাদা হয়ে যায়। রকেট ইঞ্জিন ও প্যারাস্যুটের সাহায্যে অবতরণ মডিয়ুল নভোচরদের নিয়ে নেমে আসে কাজাখিস্থানের ঘাস জমির ওপর আর বাকি দুটো মডিয়ুল বায়ুমণ্ডলেই পুড়ে ছাই হয়ে যায়। স্পেস স্টেশন থেকে নভোচরদের পৃথিবী পৌঁছাতে মোটামুটি সময় লাগে সাড়ে তিন ঘণ্টা।
এবারে আমরা আমাদের মূল বক্তব্যে আসি অর্থাৎ এই স্পেসক্র্যাফটগুলো কীভাবে কক্ষপথে পাঠান হয়। বলা বাহুল্য রকেটই হল একমাত্র বাহক যান। যে-কোনও স্পেসক্র্যাফটকে সাফল্যের সঙ্গে উৎক্ষেপ করতে হলে রকেটকে প্রাথমিক পর্যায়ে উল্লম্ব অবস্থায় রাখতে হবে যাতে করে রকেট পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের ঘনতম স্তর দ্রুত ভেদ করে যেতে পারে আর এতে জ্বালানিরও সাশ্রয় হয়। উৎক্ষেপের পরে রকেটের স্বয়ংক্রিয় নিয়ন্ত্রণ ব্যাবস্থা পূর্বপরিকল্পিত উড়ানপথ অনুসারে রকেটকে সঠিক পথে চালনা করে। অধিকাংশ উড়ান পরিকল্পনা রকেটকে পূর্ব দিকে চালনা করে যেহেতু পৃথিবী পূর্ব থেকে পশ্চিমে ঘুরছে। প্রায় একশো কুড়ি মাইল পথ ওপরে যাবার পর কিছু ছোট ছোট রকেটের সাহায্যে মূল রকেট যানকে অনুভূমিক অবস্থায় নিয়ে আসা হয়। এরপর আরও কিছু ছোট রকেটের সাহায্যে স্পেসক্র্যাফটকে মূল রকেট যান থেকে আলাদা করে দেওয়া হয়।
এ যাবত যত স্পেসক্র্যাফট পাঠান হয়েছে তাদের মূল রকেট বাহক যান কোনটাই এক পর্যায়ের নয় – দুই বা ততোধিক পর্যায়ের – মাল্টি-স্টেজ রকেট সিস্টেম। আমি বরং তোমাকে একটা উদাহরণ দিয়ে ব্যাপারটা বোঝানোর চেষ্টা করি। এতে একটি এ জাতীয় মিশনের ব্যাপকতা ও কার্যপর্যায় বুঝতে সুবিধা হবে।
২০০১ সালের ৭ এপ্রিল নাসা মঙ্গলের কক্ষপথে ওডিসি নামে একটা রোবোটিক অরবাইটার স্পেসক্র্যাফট পাঠিয়েছিল। মিশনের নাম ছিল 2001Mars Odyssey। বুঝতেই পারছ আর্থার ক্লার্কের লেখা আর স্ট্যানলি কুব্রিকের পরিচালনায় ১৯৬৮ সালে 2001 A Space Odyssey নামে যে সায়েন্স ফিকশন ভিত্তিক সিনেমাটা হয়েছিল তার স্রষ্টাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এই মিশনের নামকরণ হয়েছিল। গামা রে স্পেক্ট্রোমিটার ও থার্মাল এমিশন ইমেজিং সিস্টেম যন্ত্রের সাহায্যে মঙ্গলে জল বা বরফের অস্তিত্বের অতীত বা বর্তমানের কোনও সন্ধান পাওয়া যায় কি না ও পাশাপাশি গ্রহের ভূতত্ত্বের এবং বিকিরণের পরিবেশ সম্বন্ধে তত্ত্বতালাশ করা ছিল এই মিশনের উদ্দেশ্য। এর গবেষণার সঙ্গে আমিও বেশ কিছুদিন যুক্ত ছিলাম।
ওডিসি মঙ্গলের কক্ষপথে পৌঁছায় ওই বছরের অক্টোবর মাসের ২৪ তারিখ অর্থাৎ সময় লেগেছিল ২০০ দিন বা ছয় মাস সতেরো দিন। ওডিসিকে বহন করে নিয়ে যায় ডেল্টা ২ রকেট সিস্টেম। উৎক্ষেপ করা হয়েছিল ফ্লোরিডায় কেপ ক্যানাভেরাল এয়ার ফোর্স ষ্টেশন থেকে। এই ডেল্টা রকেট তিন পর্যায়ের – অর্থাৎ তিনটে রকেট একটার ওপরে একটা রাখা। সব মিলিয়ে উচ্চতা প্রায় ১২৮ ফুট। মূল রকেটের গায়ে চারদিক ঘিরে বাঁধা আছে নয়টা তেরো মিটার লম্বা আর এক মিটার ব্যাসের ছোট ছোট সলিড-ফুয়েল রকেট মোটর। প্রত্যেকটার মধ্যে আছে ১১৭৬৫ কিলোগ্রাম হাইড্রক্সিল টারমিনেটেড পলিবিউটাডাইন (HTPB) জ্বালানি – মানে প্রায় ১০৬ টনের কাছাকাছি। প্রথম পর্যায়ের রকেটে জ্বালানি থাকে ছিয়ানব্বই টন অত্যন্ত বিশুদ্ধ কেরোসিন আর তরল অক্সিজেন। দ্বিতীয় পর্যায়ের রকেটে জ্বালানি থাকে ছয় টন অ্যারোজাইন ৫০ ও নাইট্রোজেন টেট্রাঅক্সাইড। তৃতীয় পর্যায়ের রকেটের কাজ ওডিসিকে মঙ্গলের কক্ষপথে প্রতিষ্ঠিত করে দেওয়া আর এতে থাকে সলিড ফুয়েল রকেট। আর কিছু বুস্টার রকেট আছে ওডিসির সঙ্গে তাকে প্রয়োজন মতন চালনা করার জন্য। ওডিসির আয়তন প্রায় ৯.৭ বর্গমিটার আর নিজস্ব কিছু জ্বালানি সমেত ওজন ৭২৫ কিলোগ্রাম। তা হলে দেখো একটা ৭২৫ কিলোগ্রাম স্পেসক্র্যাফটকে মহাকাশে পাঠাতে প্রায় ২২০ টনের মতো জ্বালানির প্রয়োজন। অর্থাৎ পুরো ওজনের শতকরা নব্বই ভাগ হচ্ছে জ্বালানির ওজন। এবারে স্বাভাবিকভাবে স্পেসক্র্যাফট যত ভারী হবে জ্বালানিও তত বেশি লাগবে। অ্যাপোলো ১১ স্পেসক্র্যাফট যা নীল আর্মস্টংদের চাঁদে নিয়ে গিয়েছিল তার ওজন ছিল প্রায় ২৮.৮ টন আর তার বাহক যান স্যাটার্ন ৫ রকেটের জ্বালানি লেগেছিল প্রায় ২৮০০ টন। আবার জ্বালানির পরিমাণ নির্ভর করবে স্পেসক্র্যাফট কত দূরে যাবে কারণ সে ক্ষেত্রে উৎক্ষেপ বেগও বেশি হতে হবে অর্থাৎ প্রাথমিক ঘাতও বেশি হতে হবে। একটা পঞ্চাশ ফুট দূরে ছোট ঢিল ছুড়তে যা শক্তি লাগবে একটা শট পুটের বল ছুড়তে অনেক অনেক বেশি শক্তি লাগে। উৎক্ষেপকালে অ্যাপোলো ১১-এর গতি ছিল ঘণ্টায় ১৬৫৬ কিলোমিটার আর যখন চাঁদের কক্ষপথে পৌঁছায় তখন গতিবেগ ২৬৬৪০ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টায়। সে ক্ষেত্রে ওডিসির উৎক্ষেপের ছেষট্টি সেকেন্ড পরে গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ৩৫৯১ কিলোমিটার।
উৎক্ষেপের চার মিনিট চল্লিশ সেকেন্ড পর প্রথম পর্যায়ের মূল রকেট ও সংলগ্ন নয়টি রকেট জ্বালানি শেষ হলে খসে পড়ে সমুদ্রে। স্পেসক্র্যাফট তখন ভূপৃষ্ঠ থেকে ১২৫ কিলোমিটার ওপরে ঘণ্টায় ২১৪৭৫ কিলোমিটার বেগে ছুটছে। এবার শুরু হয় দ্বিতীয় পর্যায়ের রকেটের কাজ যা স্পেসক্র্যাফটকে নিয়ে যায় ১৮৯ কিলোমিটার ওপরে লো-আর্থ কক্ষপথে আর তার গতিবেগ তখন ঘণ্টায় ৩১৩৮২ কিলোমিটার। রকেটের খোল খসে গিয়ে পড়ে সমুদ্রে। এর পর তৃতীয় পর্যায়ের রকেট স্পেসক্র্যাফটকে পৃথিবীর অভিকর্ষ ছাড়িয়ে যাবার জন্য প্রয়োজনীয় মুক্তিবেগ অর্থাৎ ঘণ্টাপ্রতি ৪০০০০ কিলোমিটারের কিছু বেশি দিয়ে মঙ্গলের উদ্দেশ্যে রওনা করিয়ে দেয়। এর পরের দায়িত্ব স্পেসক্র্যাফটের চালনা ও নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার। আর রকেটের স্থান হয় মহাকাশের জঞ্জালের দলে।
তোমায় আগেও বলেছি আন্তঃনক্ষত্র ভ্রমণের সবচেয়ে বড় বাধা দূরত্ব। এই দূরত্ব অপেক্ষাকৃত কম সময়ে অতিক্রম করতে গেলে মহাকাশযানের গতি বাড়াতে হবে। এ যাবত রকেট সিস্টেমের যা উন্নতি হয়েছে তাতে ঘণ্টাপ্রতি ৩৯০০০ কিলোমিটার বেগে নভচরেরা আড়াই দিনে পৃথিবী থেকে চাঁদে পৌঁছতে পারছে। বর্তমান প্রযুক্তিতে মঙ্গলে পৌঁছতে গেলে পৃথিবী আর মঙ্গলের অবস্থানের ওপর নির্ভর করে সময় লাগবে ছয় থেকে নয় মাস। অর্থাৎ আসা যাওয়াতেই দেড় বছরের কাছাকাছি। অন্যান্য গ্রহদের কথা বাদ দাও এখনও পর্যন্ত কোনও মানুষ আমরা মঙ্গলেও পাঠাতে পারিনি। অ্যাপোলোর মতন স্পেসক্র্যাফটকে অ্যাস্ট্রোনটসমেত এত দিনের জন্য পাঠাতে গেলে যে ধরণের রকেট সিস্টেম ও জ্বালানি লাগবে তা এখনও গবেষণার পর্যায়ে – তাই নাসা ২০৩৩ সালের আগে মঙ্গলে মানুষ পাঠানোর কথা ভাবতে পারছে না। যাত্রার এই সময়কে কমাতে গেলে আরও উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন ও দক্ষ জ্বালানি ও ইঞ্জিনের প্রয়োজন। তাপ-নিউক্লিয়ার শক্তির অর্থাৎ অ্যাটোমিক রিয়েক্টারে অতি উচ্চতাপে ফিসন বা ফিউসন প্রক্রিয়ায় যে বিপুল শক্তি পাওয়া যায় তার সাহায্যে প্রবল ঘাত সৃষ্টি করে বহুগুণ গতিতে স্পেসক্র্যাফটকে চালান যেতে পারে। অবশ্য এ ক্ষেত্রে প্রাথমিক উৎক্ষেপ রাসায়নিক জ্বালানি দিয়েই করতে হবে আর অনেকটা ওপরে গিয়ে নিউক্লিয়ার শক্তিকে ব্যবহার করতে হবে নতুবা পরিবেশে রেডিও-অ্যাক্টিভ পদার্থ ছড়িয়ে পড়ে জীব-জগতের মহা ক্ষতি করবে। এতে মঙ্গলে যাতায়াতের সময় প্রায় আদ্ধেক হয়ে যাবে। এ নিয়ে গবেষণা অনেক দিন ধরেই চলছে। ছোট খাটো পরীক্ষাও করা হয়েছে।
আমাদের আলোচনা আন্তঃনক্ষত্র পরিভ্রমণ নিয়ে। তাও মনুষ্যচালিত মহাকাশযান নিয়ে। কিন্তু আগেতো সৌরমণ্ডলের সীমা পেরোতে হবে। বিষয়টা বর্তমান রকেট প্রযুক্তিতে সীমাবদ্ধ রাখতে হবে। কারণ কবে অতি উচ্চগতিশীল স্পেসক্র্যাফট বিজ্ঞানীরা তৈরি করতে পারবেন বা আদৌ করা সম্ভব হবে কিনা এখনই বলা যাবে না। ভবিষ্যতের সম্ভাবনার ওপর ভিত্তি করে এ জাতীয় বৈজ্ঞানিক আলোচনা করা নিরর্থক। আন্তঃনক্ষত্র পরিভ্রমণে যেটা প্রায় অলঙ্ঘ্যনীয় বাধা তা হ’ল অকল্পনীয় দূরত্ব। নাসার আন্তঃগ্রহ ফ্লাইবাই স্পেসপ্রোব নিউ হরাইজন ১৯শে জানুয়ারী ২০০৬ সালে উৎক্ষেপ করা হয়েছিল। এর প্রাথমিক গতি ছিল ঘণ্টাপ্রতি ৫৮৫০০ কিলোমিটার। বছরখানেক পর ২৮শে ফেব্রুয়ারী ২০০৭এ বৃহষ্পতির গা ঘেঁষে চলে যায়। যাবার সময়ে বৃহষ্পতির মহাকর্ষের ফলস্বরূপ তার গতি যায় বেড়ে। ১৪ই জুলাই ২০১৫ অর্থাৎ সাড়ে নয় বছর পর সে প্লুটো গ্রহের কাছাকাছি আসে। তখন তার গতি ঘণ্টাপ্রতি ৮৪০০০ কিলোমিটার যা আলোর গতির .০০৮ শতাংশ। এই গতিতে সূর্যের নিকটতম তারা প্রায় চার আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত প্রক্সিমা সেন্টরি পৌঁছতে তার সময় লাগবে ৫৪৪০০ বছরের মতন। বর্তমানে যে স্পেসক্র্যাফট সবচেয়ে দূরে আছে তা ভয়েজার ১। ১৯৭৭ সালের ৫ই সেপ্টেম্বর উৎক্ষেপ করা হয়েছিল। আজ প্রায় একচল্লিশ বছর দশ মাসে সে পাড়ি দিয়েছে ২১৮০ কোটি কিলোমিটার পথ অর্থাৎ .০০২৩ আলোকবর্ষ মাত্র। তা হলে এর গড় গতিবেগ দাঁড়াচ্ছে ঘণ্টাপ্রতি ৫৯৫০০ কিলোমিটার। কাজেই রকেট বিজ্ঞানে শুধুমাত্র রাসায়নিক জ্বালানি ও তার ইঞ্জিনকে ভিত্তি করে আমাদের বর্তমান ব্যবহারিক জ্ঞান ও প্রযুক্তিতে মানুষের আন্তঃনক্ষত্র পরিভ্রমণ ঐ সাইন্স ফিকশনেই সীমাবদ্ধ থাকবে”।
আমি বললাম – “কিন্তু স্যার, স্পেসক্র্যাফট বা রকেটের গতিবৃদ্ধির অন্য কোন কি উপায় নেই? বিজ্ঞানীরা কি এ ব্যাপারে কোন ভাবনা চিন্তা করছেন না?”
স্যার –“উপায় বেশ কিছু ভাবা হয়েছে। বলতে গেলে গত শতাব্দীর সত্তরের দশক থেকেই এই সব নিয়ে নানা তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক গবেষণা, নানাবিধ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হচ্ছে। ছোটখাট সাফল্যও পাওয়া গেছে। কয়েকটা বিকল্প পদ্ধতির কথা সংক্ষেপে বলছি।
তুমি জানো প্লাসমা হচ্ছে অতি উত্তপ্ত আয়নিত গ্যাস যাকে আমরা বলি পদার্থের চতুর্থ অবস্থা। এই প্লাসমা-ভিত্তিক রকেট ইঞ্জিন বানানোর একটি প্রকল্প নাসা নিয়েছে যার নাম VASIMR (Variable-Specific-Impulse Magnetoplasma Rocket)। এতে তড়িৎচুম্বকীয় শক্তির সাহায্যে হাইড্রোজেন প্লাসমাকে কোন প্রণালীর মধ্য দিয়ে উচ্চ বেগে ত্বরাণ্বিত করলে যে ঘাত সৃষ্টি হবে তাতে রকেট বা স্পেসক্র্যাফট চলবে। নাসার মতে এ ভাবে কোন স্পেসক্র্যাফটকে মাস তিনেক সময়ে মঙ্গলে পাঠান সম্ভব হবে। অবশ্য এ জাতীয় প্লাসমা রকেট ১৯৭০ সালের দিকে রাশিয়া স্যাটেলাইটে ব্যবহার করেছিল। দক্ষ হলেও এর ঘাত এত কম ছিল যে শুধুমাত্র স্যাটেলাইটকে তার কক্ষপথে পরিচালনা করার জন্য ব্যবহৃত হয়েছিল।
এ রকমই আর একটা হ’ল আয়ন-ড্রাইভ। এতে কোন নিষ্ক্রিয় গ্যাস যেমন ক্সেননকে আয়নিত করে ইলেক্ট্রিক ফিল্ড দিয়ে ত্বরাণ্বিত করে প্রয়োজনীয় ঘাত সৃষ্টি করা হয়। মঙ্গল ও বৃহষ্পতির মাঝে যে গ্রহানুপুঞ্জের বন্ধনী আছে – সেখানে সব থেকে বড় গ্রহানু সিরিস। একে গ্রহানু না বলে বলা হয় বামন গ্রহ। ২০০৭ সালের সেপ্টেম্বরে ‘ডন’ স্পেসপ্রোব সিরিস আর ভেস্টা নামের একটা দৈত্যাকার গ্রহানু পর্যবেক্ষণের জন্য পাঠান হয় আর তাতে এই আয়ন-ড্রাইভ রকেট ব্যবহার করা হয়েছিল।
আরও এক ধরণের স্পেসক্র্যাফট চালনার পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে – তার নাম সোলার সেইল – বা বলতে পার সৌর-পাল। নৌকার পাল দেখেছতো বা আগেকার দিনের পালের জাহাজের ছবি। অনেকটা সে রকম ব্যাপার। পাল তোলা নৌকা চলে বাতাসের শক্তিতে। আর পালতোলা স্পেসক্র্যাফট চলবে আলোর শক্তিতে। আলো মূলত তড়িৎ-চুম্বকীয় তরঙ্গ হলেও এর দ্বৈত সত্ত্বা – কখনও তরঙ্গ কখনও কণার মতন আচরণ করে। আলোর কণাকে বলে ফোটন। ফোটনের ভর নেই বটে কিন্তু ভরবেগ আছে তার গতির জন্য। কোন বস্তু অপর কোন বস্তুকে কত জোরে এসে আঘাত হানবে তা নির্ভর করে বস্তুর ভরবেগের ওপর। ভরবেগ যত বেশি হবে আঘাতের জোরও তত বেশি হবে। আঘাতের ঠেলায় দ্বিতীয় বস্তু গতি লাভ করে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে পারে।
পলিয়েস্টার ফিল্মের ওপর রূপোর প্রলেপ দেওয়া যেমন পাতলা পাত হয় সেরকম খুব বড় আয়নার মতন প্রতিফলনশীল পাতলা পাতের মতন পাল সোলের সেইল স্পেসক্র্যাফটে থাকে। এবার সূর্যের আলো যখন পালে এসে পড়ে প্রতিফলিত হয় – তখন ফোটনদের ভরবেগ পালে হস্তান্তর হয় ও তার ফলে পাল কিছুটা ধাক্কা খেয়ে আলোর গতির দিকে এগিয়ে যায় – ঠিক যেমন পালে হাওয়া লেগে নৌকা এগিয়ে যায়। মহাকাশে শূন্যস্থানে কোন রকম বাধা না পাওয়ার জন্য ফোটনের অবিরাম ধাক্কায় স্পেসক্র্যাফটের গতিবৃদ্ধি হতে থাকে। মহাকাশে স্পেসক্র্যাফটের গতি নিয়ন্ত্রণ, দিক পরিবর্তন ইত্যাদির জন্য যে সমস্ত বুস্টার রকেট থাকে তার সন্মিলিত ওজনতো কম নয় বিশেষতঃ দূর পাল্লার যাত্রায়। তার জন্য প্রাথমিক গতিও কমে যায়। এ ক্ষেত্রে বুস্টার রকেটের বদলে সৌর পাল ব্যবহার করলে স্পেসক্র্যাফটের ওজনও অনেক কমে যাবে আর অনেক দ্রুত গতিতে সে চলতে পারবে। এই প্রযুক্তি একবার ভাল মতন দাঁড়িয়ে গেলে খরচও অনেক কম হবে।
২০০৫ সালে অ্যামেরিকার প্ল্যানেটরি সোসাইটি কসমস-১ নামে একটি পরীক্ষামূলক সোলার সেইল পাঠিয়েছিল – কিন্তু রকেট ঠিকমতন কাজ না করায় মিশনটি অকৃতকার্য হয়। এরপর জাপান অ্যারোস্পেস এক্সপ্লোরেসন এজেন্সি (JAXA) ২০১০ সালে শুক্রগ্রহে IKAROS (Interplanetary Kite-craft Accelerated by Radiation Of the Sun) নামে একটি সোলার সেইল স্পেসপ্রোব পাঠাতে সফল হয়। এ ছাড়াও নাসার ন্যানোসেইল ডি, প্ল্যানেটরি সোসাইটির লাইটসেইল মিশনগুলিতেও সোলার সেইল দিয়ে স্পেসক্র্যাফট চালাতে সফল হয়েছে। তবে এগুলো খুব ছোট হালকা স্পেসক্র্যাফট – মানে .০০৩ ঘনমিটার আয়তনের আর ওজন ৪ কিলোগ্রাম। এর পালের আয়তন ১১০ বর্গফুট। তবে জাপান যে সোলার সেইল পাঠিয়েছিল তার পালের আয়তন ২১১০ বর্গফুট আর প্রোবের ওজন ছিল ৩১৫ কিলোগ্রাম। গত ২৫ জুন প্ল্যানাটরি সোসাইটির লাইট সেল ২ নামে একটা পাউরুটির আকারের ১০ সেন্টিমিটার কিউবের মতন ক্ষুদে স্পেসক্র্যাফট পৃথিবীর লো আর্থ কক্ষপথে পাঠান হয়েছে। এটা চলবে সোলার সেইল দিয়ে সূর্যের আলোর সাহায্যে। এর গোটান পালও খুলে গেছে যার আয়তন প্রায় ৩৪৪ বর্গফুট। এই পাল নিয়ন্ত্রণ করেই একে কক্ষপথে চালান হবে।
এই প্রসঙ্গে তোমায় রাশিয়ান পদার্থবিদ্ ও বিনিয়োগকারী ইউরি মিলনার ও স্টিফান হকিন্সের উদ্যোগে একটি গবেষণা প্রকল্পের কথা বলি যার নাম ব্রেকথ্রু স্টারশট। এই প্রকল্পের উদ্দেশ্য অতি উচ্চ বেগসম্পন্ন লাইট সেইল চালিত ক্ষুদ্র স্পেসক্র্যাফট গড়ে তোলা। এ ক্ষেত্রে লাইট সেইল মানে যা সূর্যের আলো নয় লেসার রশ্মিতে চলবে। বিজ্ঞানীরা সম্ভাবনা দেখছেন যে এ জাতীয় ফ্লাইবাই ন্যানোস্পেসপ্রোব বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক তথ্য সংগ্রহের জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে যা শুধু আমাদের সৌরমণ্ডলের মধ্যেই নয় আন্তঃনক্ষত্র জগতেরও তত্ত্বতালাশ করবে। স্টারচিপ প্রকল্পে একটা মূল স্পেসক্র্যাফটে করে প্রায় হাজারখানেক খুব ছোট ছোট সেন্টিমিটার আকৃতির ও গ্রাম ওজনের আন্তঃনক্ষত্র স্পেসক্র্যাফট পাঠানোর পরিকল্পনা আছে। এই ক্ষুদে বা ন্যানোস্পেসক্র্যাফটগুলোতে মিনি ক্যামেরা, সংযোগকারী সিস্টেম, ব্যাটারি, যান নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা সব থাকবে আর এদের চালাবে লাইট সেল। লক্ষ্য হল সৌরমণ্ডলের নিকটতম তারা আলফা সেন্টরির প্রক্সিমা সেন্টরি বি নামের অসৌরগ্রহ যা তারার বাসযোগ্য এলাকায় অবস্থিত। বিজ্ঞানীদের আশা এই ন্যানোস্পেসক্র্যাফটগুলো আলোর গতির শতকরা পনেরো থেকে কুড়ি ভাগ গতিতে যেতে সক্ষম হবে আর কুড়ি থেকে তিরিশ বছরেই সে আমাদের নিকটতম তারাজগতে প্রবেশ করতে পারবে।
অ্যান্টিম্যাটার বা প্রতিবস্তুর শক্তিতে অতি দ্রুত গতিতে স্পেসক্র্যাফট চালানোর কথাও বিজ্ঞানীরা ভেবেছেন তবে সেটা বাস্তবে আদৌ সম্ভব হবে কি না এ রকম কোন আশার আলো এখনও দেখা যাচ্ছে না। ইলেকট্রন, প্রোটন, নিউট্রন বা যে কোনও মৌলিক কণার প্রতিকণা আছে। কণা আর প্রতিকণাদের ভর এক কিন্তু তড়িৎ আধান বিপরীত। এ ভাবে প্রতিটি বস্তুর প্রতিবস্তু আছে যেমন ইলেকট্রনের প্রতিকণা পোসিট্রন, প্রোটনের অ্যান্টিপ্রোটন বা হাইড্রোজেন পরমাণুর অ্যান্টিহাইডোজেন। যদি কোনও বস্তুর তার প্রতিবস্তুর সঙ্গে সংঘাত হয়, তারা উভয়ে বিলুপ্ত হয়ে শক্তিতে রূপান্তরিত হয়। আবার শক্তি থেকে বস্তুর ও প্রতিবস্তুর জোড়ায় জোড়ায় উদ্ভব হয়। মজার কথা কি জান – বিশ্বসৃষ্টির যে তত্ত্ব বর্তমানে প্রতিষ্ঠিত তাতে বলছে যে সৃষ্টির মুহূর্ত বিগ ব্যাং-এর পরে শক্তি থেকে যখন বস্তুর উদ্ভব হল তখন সমপরিমাণ বস্তু ও প্রতিবস্তুর উদ্ভব হওয়ার কথা অথচ আমরা মহাবিশ্বে শুধু বস্তুকেই পাই – কদাচিৎ পসিট্রন বা অ্যান্টিপ্রোটনের সাক্ষাৎ মেলে। তা হলে এত প্রতিবস্তু গেল কোথায়। এর কোনও উত্তর এখনও পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। উচ্চ শক্তির কণা-ত্বরণ যন্ত্রে প্রতিবস্তু সৃষ্টি করা সম্ভব হয়েছে।
এই প্রতিবস্তুর অমিত শক্তি। তাই একে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করে রকেট ও স্পেসক্র্যাফট চালান যায় কি না নাসার উদ্যোগে বিজ্ঞানীরা গবেষণা করছেন। তাঁদের অনুমান এক গ্রামের দশ হাজার ভাগের এক ভাগ প্রতিবস্তুই যথেষ্ট একটা স্পেসক্র্যাফটের মাত্র পয়ঁতাল্লিশ দিনে মঙ্গলে পৌঁছতে। তবে সমস্যা হল যথেষ্ট পরিমান প্রতিবস্তু পাওয়া। এ যাবৎ কৃত্রিম ভাবে কণা-ত্বরণ যন্ত্র থেকে যত প্রতিবস্তু পাওয়া গেছে তাতে যা শক্তি পাওয়া যাবে – তা দিয়ে এক কাপ চায়ের জলও গরম হবে না। যা হোক এই প্রতিবস্তু চালিত স্পেসক্র্যাফট এখনও সায়েন্স ফিকশনের গণ্ডি পেরোনোর সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। বিখ্যাত তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্ ও ভবিষ্যৎবাদী মিশিও কাকুর মতে এই প্রযুক্তির জন্য আমাদের টাইপ ২ সভ্যতায় উন্নীত হতে হবে।
আমি বললাম –“স্যার, তা হলে দেখা যাচ্ছে আন্তঃনক্ষত্র পরিভ্রমণে সবথেকে বড় বাধা দূরত্ব। বর্তমানে আমাদের স্পেসক্র্যাফটের যা সর্ব্বোচ্চ গতি তা আলোর গতিবেগের এক শতাংশেরও কম। এতে আমাদের সৌরমণ্ডল পেরোতেই তো একশো বছরের বেশি লেগে যাবে। অর্থাৎ একজন মানুষ তার জীবদ্দশায় কখনই তা পারবে না। আর প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে একটা স্পেসক্র্যাফটে মানুষ পরিভ্রমণ করবে এটা সম্পূর্ণ অবাস্তব ভাবনা। তারাদের মধ্যে দূরত্ব তো আর কমবে না, সুতরাং একমাত্র আলোর গতির কাছাকাছি যেতে পারলে পৃথিবীর দশ আলোকবর্ষের মধ্যে যে গোটা কুড়ি তারা আছে – সেখানে হয়তো মানুষ যেতে পারে। কিন্তু আলোর কাছাকাছি কেন দশ শতাংশ যাওয়াও কি কোনওদিন সম্ভব হবে? হয়তো এটা অন্য ভীনগ্রহীদের ক্ষেত্রেও সত্যি আর এই কারণেই আজ পর্যন্ত তারাও আমাদের অতিথি হয়ে আসতে পারে নি”।
স্যার বললেন –“এটা একটা সম্ভাব্য কারণ তো বটেই। দেখ তাত্ত্বিক বা গাণিতিক দিক থেকে অনেক কিছু সম্ভব হলেও তার ব্যবহারিক প্রয়োগ বা উপযুক্ত প্রযুক্তিতে পরিণত করা বহুক্ষেত্রে অসাধ্য হয়ে ওঠে। এর জন্য যে পরিমাণ অর্থ ও অন্যান্য সংস্থানের প্রয়োজন তার জোগানের অভাবও অন্যতম কারণ। আমাদের যা কিছুই করতে হবে সীমিত ক্ষমতার মধ্যে করতে হবে। সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নত না করে বহির্বিশ্বের বুনো হাঁসের পেছনে ধাওয়া করার জন্য অকাতরে অর্থব্যয় করতে কোনও দেশের সরকারই রাজি হবে না। ঠিক এ কারণেই নাসা এক সময়ে এই সব প্রকল্পের জন্য অর্থ সাহায্য বন্ধ করেছিল।
এ ছাড়া আরও একটি বড় সমস্যা আছে। সেটা যান্ত্রিক নয়, মানবিক – অর্থাৎ নভোচরদের শরীর ও মনের ওপর দীর্ঘ মহাকাশ যাত্রার প্রভাব যা বিজ্ঞানীদের কাছে স্পেসক্র্যাফটের গতিবৃদ্ধির থেকেও বড় চ্যালেঞ্জ। এ চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা না করে কোনও মানুষকে দীর্ঘ মহাকাশ যাত্রায় পাঠান যাবে না। কারণ শুধু পাঠালেই তো হবে না – তাকে সুস্থ শরীরে ফিরিয়েও আনতে হবে। তা না হয় সামনের রবিবার আলোচনা করা যাবে”।
[ক্রমশঃ]
Tags: চতুর্থ বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা, পূজাবার্ষিকী, প্রবন্ধ, সনৎ কুমার ব্যানার্জ্জী