অমরত্ব
লেখক: সোহম সাহা
শিল্পী: সুপ্রিয় দাস
সন্ধ্যা ছ’টা বেজে পনেরো মিনিট। পশ্চিমমুখী জানালা দিয়ে তাকালেই দেখা যাবে পাহাড়ি উপত্যকার পেছনে সূর্য ডুবে যাচ্ছে। আকাশে লাল রঙের ঘনঘটা। এই সূর্যের দিকে তাকানো চোখের জন্য ভালো নয়, তা সত্ত্বেও দ্যুন মুগ্ধ হয়ে সূর্যের দিকে তাকিয়ে আছেন। হাতে এক কাপ সবুজ চা। চায়ে চুমুক দিয়ে তিনি সিডিসিকে ডাকলেন। সিডিসি সপ্তম প্রজন্মের কম্পিউটার। পৃথিবীতে হাতে গোনা কিছু মানুষের সিডিসির সাথে সরাসরি যোগাযোগ করার ক্ষমতা আছে। দ্যুন তাদের মধ্যে একজন।
“আজ আমার মন খুব ভালো সিডিসি।“
“আমার হিসেব অনুযায়ী মন ভালো থাকারই কথা।“সিডিসির যান্ত্রিক আওয়াজ শোনা গেল।
“কেন?”
“মন ভালো থাকলে আপনি আপনার চায়ে তিন চামচ চিনি খান। তারপর চা হাতে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে সূর্যাস্ত দেখেন। মন খারাপ থাকলে আপনি চায়ে এক চামচ চিনি দেন। তারপর চা অর্ধেক খেয়ে জানালা দিয়ে ফেলে দেন। সাধারণ মানুষের জন্য লিটারিং একটি দশম মাত্রার অপরাধ। তবে আপনার ক্ষেত্রে…”
“থাক, থাক। হয়েছে। তবে বলতে পারো, আজ মন কেন ভালো আমার?”
“মন ভালো থাকার সাতান্ন টি কারণ থাকতে পারে। তার মধ্যে সতেরোটির সম্ভাবনা বেশি। ক্রমানুসারে বলতে গেলে, আপনার আজকের চা টি…”
“আহ থামো। আমার মন ভালো কারণ আমি কে–৩২ জিনের ত্রুটির সমাধান করেছি।“
“আপনাকে অভিনন্দন। আমি এখুনি বিজ্ঞান কাউন্সিলে এই খবরটি জানাচ্ছি। আপনার গবেষণা প্রকাশে সাহায্য লাগলে লেখনী বিশেষজ্ঞ রোবট ‘লেখা–৩’এর সাহায্য নিতে পারেন”।
“তুমি মানুষ হলে আমার কথাটা শুনে হা করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকতে। এই সমাধানের মানে বোঝো? এর মানে মানুষ আর বার্ধক্য জনিত কারণে মারা যাবে না। বয়স কে আমরা ইচ্ছে করলেই থামিয়ে দিতে পারবো।“
“তথ্য অধিকার আইনের প্রধান নীতিমালা অনুযায়ী, যেকোনো বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের কথা বিজ্ঞান কাউন্সিল কে জানানো আমার কর্তব্য। ‘লেখা–৩’ কি আসতে বলব?”
“বলে লাভ হবে না। আমি এই সমাধান প্রকাশ করবো না। বিজ্ঞান কাউন্সিলের সাবেক প্রধান হিসেবে নীতিমালা আমার ওপর খাটে না।“
“বিজ্ঞান কাউন্সিল কে খবর পাঠান হয়ে গেছে। আপনার আদেশ না মানতে পারার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করছি। আপনাকে অন্য কোন ভাবে সাহায্য করতে পারি?”
দ্যুন সাবধানে একটা নিঃশ্বাস ফেললেন।
“হ্যাঁ পারো। বাজার থেকে চাল, ডাল, লবণ, তেল, আর কিছু মশলা ডেলিভারি দিতে বল। প্রাচীনকালে বাংলাদেশের মানুষরা খিচুড়ি বলে এক রকম খাবার খেত। সেটা বানানোর চেষ্টা করবো।“
“ব্যবস্থা করা হয়েছে।“
চা শেষ হলে তিনি নিজের ব্যাক্তিগত কম্পিউটার থেকে কিছু ফাইল মুছে ফেললেন। এরপর নিজের শোবার ঘরে গিয়ে একটা বই হাতে নিলেন। বইয়ের নাম “বাংলার রান্না”। বিছানায় বসার আগে তিনি আবার সিডিসিকে ডাকলেন।
“সিডিসি, খিচুড়ি রান্না করতে ঘি বলে একটা জিনিস লাগে। ঘি জিনিসটা কি?”
“ঘি হচ্ছে এক ধরনের তেল, যা গরুর দুধ থেকে তৈরি করা হতো।“
“দুধ থেকে তেল? এটার ব্যবস্থা করা যায়না? নয়ত খিচুড়ি তৈরি হবে না।“ দ্যুনকে অনেক চিন্তিত দেখাচ্ছে।
“আমি চিড়িয়াখানায় খবর দিতে পারি। গরুর দুধ হলে আপনাকে এক লিটার পাঠিয়ে দেবে। কিন্তু সেটা অক্টোবরের আগে সম্ভব নয়। আপনার খিচুড়ির অন্যান্য সরঞ্জাম এসে গেছে।“
তিনি রান্নাঘরে গিয়ে হিটারে জল বসালেন। চালের প্যাকেট খুলে এক কাপ চাল জলে ঢাললেন। পরিমাণমত ডাল দিয়ে ঢেকে দিলেন। কিন্তু আগের মত উৎসাহ পাচ্ছেন না। মনে হচ্ছে ঘি ছাড়া খিচুড়ি রান্না করা অর্থহীন।
ফোন বেজে উঠলো। তিনি কেটে দেবার আগেই রান্নাঘরের মাঝখানে হলোগ্রাফিক ছবি ভেসে উঠলো। ক্রিতিন – বিজ্ঞান কাউন্সিলের বর্তমান সভাপতি।
“শুভ সন্ধ্যা, মহামান্য দ্যুন।“
“শুভই তো ছিল একটু আগে পর্যন্ত। কি চাও বল।“
ক্রিতিনের মুখের হাসিটা একটু ছোট হয়ে এলো।
“সিডিসি বলল আপনি নাকি কে–৩২ জিনের ত্রুটি সমাধান করেছেন। করেছেন নাকি?”
“করেছি। আজ বিকেলেই হঠাৎ মাথায় চলে এলো।“
“সমাধানটা কি আমরা পেতে পারি?”
“না।“
“না পারার কারণ?”
“এই সমাধানটা পাওয়া মানবজাতির জন্য এই মুহূর্তে খুব জরুরি মনে করছি না আমি।“
“এই সমাধান ক্যান্সার চিকিৎসায় আমাদের কয়েক যুগ এগিয়ে দিতে পারে। মানুষের মৃত্যুহার কমিয়ে শুন্যের কাছাকাছি এনে দিতে পারে। তাও আপনি বলছেন এর প্রয়োজন নেই?”
“না নেই। কারণ এই মুহূর্তে মানবজাতির প্রধান সমস্যা ক্ষুধা। আফ্রিকার কিছু জায়গায় গতকালও সাতশ মানুষ খরায় মারা গেছে। বিজ্ঞান কাউন্সিল এ বিষয়ে কি করেছে?”
“ওদেরকে জাহাজের মাধ্যমে রশদ পাঠানো হয়েছে। ত্রাণ দেওয়া হচ্ছে।“
“ত্রাণ? হাসালে। দুর্ভিক্ষের কারণ নিবারণে কিছু করা হয়েছে?”
“আপনি জানেন, মধ্য আফ্রিকায় খরা জিনিসটা নতুন কিছু নয়। যুগ যুগ ধরে এরকম চলে আসছে। তাই …”
“হাসিও না। গত ত্রিশ বছরে ওখানে কোন খরা হয়নি।“ দ্যুন হাত তুলে ক্রিতিনকে থামিয়ে দিলেন। “এই খরার কারণ তোমার কোম্পানির নতুন “ইকো–সার”– যা নাকি ফসলের ফলন চারগুণ বেশি দেয় বলে তুমি দাবি করেছো। এই সার আমার নেতৃত্বকালীন সময়ে কখনো অ্যাপ্রুভাল পায়নি। কত লাভ করলে তুমি এর বিনিময়ে?”
ক্রিতিন গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন, “এই সার ব্যাবহারের কিছু নিয়মাবলী আছে, যা না মানলে এমন বিপর্যয় আসা সম্ভব। কিছু লোভী মানুষ তা জেনেও মাত্রাতিরিক্ত পরিমাণে এর ব্যাবহার করেছে। এই দুর্ভিক্ষ তাদের লোভেরই ফসল।“
“বিজ্ঞান একাডেমীতে যোগ দেবার আগে আমরা একটা শপথ নিয়েছিলাম মনে আছে? মানুষকে রক্ষা করা। তাদেরকে নিজের লোভ থেকেও রক্ষা করাটা তোমার দায়িত্ব ছিল। মানুষের একথা বুঝতে কতদিন লাগবে ভেবেছ? পত্রিকায় এ নিয়ে এ পর্যন্ত বেশ কিছু লেখা আমি পড়েছি।“
“আপনি কথা ঘোরাচ্ছেন। আপনার আবিষ্কার বিজ্ঞান একাডেমীর প্রয়োজন। সমাধানে কোন ভুলও তো থাকতে পারে। আমরা তা খতিয়ে দেখতে চাই।“
“আমার আগের সমাধানগুলোর মতই এটাতেও কোন ভুল নেই। থাকলেও তোমাদের তা নিয়ে মাথাব্যথা করতে হবে না।“
“আপনাকে বিজ্ঞান কাউন্সিলের সর্বোচ্চ সম্মাননা দেওয়া হবে এই আবিষ্কারের জন্য।“
“তুমি ভালো ভাবেই জানো, এর আগে চারবার আমাকে এই সম্মাননা দেবার চেষ্টা করা হয়েছে। আমি গ্রহণ করিনি। এ নিয়ে পাঁচবার হবে। আমার জীবনে শুধু একটা জিনিসের জন্য আমি লোভ করেছি। কিসের জন্য, তা বোঝার ক্ষমতা তোমার নেই।“
“তা হলে আপনি আমাদের সমাধান দেবেন না?”
“না।“
“তাহলে আমার আর কিছু বলার নেই। বিজ্ঞান কাউন্সিল নিজে থেকেই এর সমাধান করবে। আপনি বসে বসে খিচুড়ি বানান। শুভরাত্রি।“
হলোগ্রাফিক ছবিটি মিলিয়ে গেলো।
“সিডিসি?”
“বলুন।“
“কাউন্সিলের পরবর্তী নির্বাচন তো আগামীকাল, না?”
“হ্যাঁ।“
“ক্রিতিনের জেতার সম্ভাবনা কতটুকু?”
“তার পাঁচ বছরের শাসনকালে খুব কম যুগান্তকারী আবিষ্কার হয়েছে। একাডেমীর ভোটাধিকারী বিজ্ঞানীরা এতে খুশি নন। এই দুর্ভিক্ষ মানুষের কাছে তার আপিল আরও কমিয়ে দিয়েছে। সাধারণ মানুষের কাছেও তিনি অপাংতেয়। তাও তার ষাট ভাগ সম্ভাবনা জেতার। একাডেমীর বিজ্ঞানীদের বড় একটা অংশ তার ফান্ডিং–এ চলে। খুব সম্ভবত এদের সব ভোট তার পকেটে।বাকিদের ভোট ৫০–৫০।“
দ্যুন চোখ বন্ধ করে চিন্তা করতে শুরু করলেন। পোড়া খিচুড়ির গন্ধে রান্নাঘর ম ম করতে লাগল।
রাত আটটা পঁয়ত্রিশ। মনিটরে খবরের প্রথম লাইন পড়ে দ্যুনের ভ্রু কুঁচকে গেলো।
“অমরত্বের জনক?
কে–৩২ জিনের ত্রুটির সমাধান। মহামান্য ক্রিতিনের আবিষ্কারে অমরত্ব আমাদের হাতের মুঠোয়। আজ রাত বারোটায় অমরত্বের জনক মহামান্য ক্রিতিন তার গবেষণা প্রকাশ করবেন। লাইভ দেখার জন্য টিভিতে চোখ রাখুন।“
তিনি দুবার ক্রিতিনকে ফোন করার চেষ্টা করলেন। এনগেজ্ড। কড়াইটা পরিষ্কার করে তিনি আরেকবার খিচুড়ি বসালেন।
মিনিট পনের বাদে হলোগ্রাফিক স্ক্রিনে একটি ছবি ভেশে উঠল। দ্যুন মানুষটিকে দেখে একটু অবাক হলেন। তার প্রাক্তন ছাত্রী লায়ানা। বয়স পঁয়ত্রিশ হলেও মুখে ছেলেমানুষি সরলতার ছাপ। প্রথম দৃষ্টিতে দেখতে অতি সাধারণ চেহারার হলেও তুখোড় প্রতিভার এই নারী বিজ্ঞান একাডেমীর চেয়ারম্যানের পদপ্রার্থী। জেতার সম্ভাবনা ৩৫ ভাগ। বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন লায়ানা পড়তে আসে তখন তার বয়স পনের, আর দ্যুনের ষাট। প্রথম দিন থেকেই মেয়েটির প্রতি দ্যুন পিতৃ–সুলভ এক ধরনের টান অনুভব করেছিলেন।অভাবী মেয়েটির জন্য সব ধরনের গবেষণার সুযোগ করে দিয়েছিলেন তিনি। মেয়েটি তার মান রেখেছে।বুদ্ধি ও একাগ্রতার জোরে তরতর করে বিজ্ঞান কাউন্সিলের সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেছে।
“স্যার ভালো আছেন?”
“লায়ানা। অনেকদিন পরে তোমার খবর পেলাম। তোমার ছোট ছেলেটির কথা আমি শুনেছি। সে ভালো আছে তো ?”
“আমার ছেলের কথা বলতে আমি আসিনি।“ লায়ানার মুখটা একটু কেঁপে উঠল।“আমি শুনেছি আপনি কে–৩২ জিনের ত্রুটির সমাধান খুঁজে পেয়েছেন। কিন্তু চেপে রেখেছেন। এর মানে কি?”
“এ নিয়ে তোমার সাথে আমি কথা বলতে চাই না।“
“বলতে আপনাকে হবে। আপনি জানেন, ক্রিতিন এর মধ্যেই সমাধান প্রকাশ করার সব ব্যবস্থা করে ফেলেছে?”
“জানি।“
“আপনি জানেন, এই সমাধান হাতে পেলে সাধারণ মানুষ কে ক্যান্সার নামক ব্যাধি থেকে আমরা চিরতরে মুক্তি দিতে পারব?”
“জানি।“
“এও নিশ্চয়ই জানেন, ক্যান্সারের চিকিৎসার সব ওষুধের সরবরাহ এখন ক্রিতিনের মালিকানাধীন কোম্পানির হাতে। সাধারণ মানুষ শুধু প্রাচীন কেমোথেরাপির ওপর নির্ভর করে আছে। শুধু কিছু পয়সাওয়ালা লোক ক্যান্সারের আধুনিক চিকিৎসার সুবিধা পাচ্ছে।“
“তুমি বলতে চাইছ, যে এই সমস্যার সমাধান ক্রিতিন করলে সাধারণ মানুষ এর সুযোগ সুবিধা থেকে সম্পূর্ণ ভাবে বঞ্চিত হবে। তাই তো?”
“শুধু তাই না, কিছু ক্ষমতাবান লোক হবে অমরত্বের অধিকারী। তাই আমি চাইছি, আপনি ক্রিতিনের আগেই সমাধানটি প্রকাশ করুন।“
“আমি প্রকাশ করলেও ক্রিতিনের হাতে এই সমাধানটি হাতিয়ে নেবার সবরকম ক্ষমতা আছে। আর তুমি নিশ্চিন্তে থাকতে পারো, ক্রিতিন সমস্যাটির সমাধান করতে পারে নি।“
“আমি আপনার কথা মেনে নিতে পারছি না। ক্রিতিন নিশ্চয়ই এত বড় মূর্খ নয় যে নির্বাচনের আগে এত বড় একটা বাপারে সে ভুল করবে ? এই কনফারেন্সে যদি সে কোন ভুল জিনিস উপস্থাপনা করে, সে একজন হাস্যাস্পদ ব্যাক্তিতে পরিণত হবে।“
“আমার মনে হচ্ছে সে কিছুক্ষণ পরেই অনুষ্ঠানটি বাতিল করবে।“
লায়ানাকে অস্থির মনে হল। সে কিছুক্ষণ চিন্তা করে বলল, “ক্রিতিন যাই করুক, আপকি কি সমাধানটি ভবিষ্যতে কখনো প্রকাশ করবেন?”
“মনে হচ্ছে না।“
লায়ানাকে খুব চিন্তিত মনে হোলো।
“কিন্তু কেন? আমার এই নির্বাচনে জেতার একটা সম্ভাবনা আছে। আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি, আপনার আবিষ্কারের পুরো ফল যাতে জনগণের হাতে যায় আমি তা নিশ্চিত করবো।“
“আমি জানি তোমার এই আগ্রহের কারণ।“ দ্যুন কঠোর স্বরে বললেন,“তোমার ছোট ছেলে ক্যান্সারের সাথে লড়ছে। একাডেমীর সহ সভাপতি হিসেবে চিকিৎসার সর্বোচ্চ সুযোগ তোমাকে দেওয়া হয়েছে। তোমার ছেলে অনায়াসে আরও বেশ কিছুদিন বাঁচবে। কিন্তু ক্যান্সারের বিষ সে তার শরীরে বহন করুক তুমি তা চাও না। এই তো? আমি দুঃখিত, তোমার অনুরোধ আমার কাছে খুব স্বার্থপর মনে হচ্ছে।“
লায়ানাকে খুব ক্লান্ত – বিধ্বস্ত মনে হোল। কিন্তু তার কণ্ঠস্বর এখন স্পষ্ট।
“অমরত্বের ওষুধের কোন প্রয়োজন নেই আপনার। আপনি মহাপুরুষ। মানুষের ইতিহাসে আপনার আবিষ্কার, আপনার কীর্তির জন্য আপনি অমর হয়ে থাকবেন। কিন্তু মহাপুরুষ দেখেই হয়তো আপনি মানুষের অনেক সাধারণ অনুভূতি থেকে বঞ্চিত। তাই হয়তো ছেলের যন্ত্রণা দেখে মায়ের কষ্ট বোঝার ক্ষমতা আপনার নেই। আপনার জন্য কেন যেন আমার দুঃখ হচ্ছে।“
লাইন কেটে গেলো।
“সিডিসি? লায়ানাকে আমি আমার যোগ্য উত্তরসূরি মনে করেছিলাম। ওর এই স্বার্থপরতার দিকটি আমি খেয়াল করিনি আগে। নিজের ছেলের স্বার্থের জন্য মানবজাতির কল্যাণের কথা একবার ভেবে দেখল না?”
“আপনার সাথে দ্বিমত পোষণ করতে বাধ্য হচ্ছি আমি।“ সিডিসির যান্ত্রিক গলায় উত্তরটা অদ্ভুত শোনাল।
“কেন?”
“মহামান্যা লায়ানার কনিষ্ঠ সন্তানটি গত মাসে মারা গেছে।“
আশি বছরের সুদীর্ঘ জীবনে তিনি নিজেকে কখন এত ক্ষুদ্র মনে হয়নি তার। চেয়ারের হাতল ধরে তিনি স্থির হন। এখন দুর্বল হলে চলবে না। খেলা অনেকদূর এগিয়ে গেছে। এর পরের চালগুলো খুব ঠাণ্ডা মাথায় দিতে হবে।
খিচুড়ির পোড়া গন্ধে তার সংবিৎ ফিরে এলো।
রাত সাড়ে এগারটা।
হলোগ্রাফিক স্ক্রিনে ক্রিতিনের ছবি ভেসে উঠেছে। সে একই সাথে উত্তেজিত এবং আনন্দিত।
“একই দিনে আমি আর তুমি একই সমস্যার সমাধান করলাম। কি অদ্ভুত কাকতালীয় ব্যাপার, না?” দ্যুন ঠাণ্ডা স্বরে বললেন।
“কি বলতে চান ভালো করে বলুন।“
“কিছুই বলতে চাইছি না। ভাবছি, সমাধানটা সম্বন্ধে কিছু বলবে নাকি আমাকে। মিলিয়ে দেখতাম। যদি কোথাও ভুল হয়ে থাকে? অধিবেশনে যদি কোথাও গিয়ে আটকে যাও, তাহলে তো সমস্যা হবে।“
“আটকানোর প্রশ্নই ওঠে না। আমার ল্যাবের রোবটেরা ইতিমধ্যেই আমার ফরমুলার ফাইল তৈরি করে ফেলেছে, যা দেয়া হবে অধিবেশনের বিজ্ঞানীদের। তবে শুধু আমাকে ভোট দিলেই। অমরত্বের লোভের চেয়ে বড় তো আর কিছু নেই, তাই না?”
“তুমি কি একটু তাড়াহুড়ো করে কাজ করছ না?”
“তাড়াহুড়ো?” ক্রিতিনের মুখে একটি বাঁকা হাসি ধীরে ধীরে ফুটে উঠল।
“আমার তো মনে হচ্ছে তুমি ভাওতা দিচ্ছ।“ দ্যুন বললেন।
ক্রিতিন হঠাত জোরে জোরে হেসে উঠলেন।
“হ্যাঁ ভাওতা দিচ্ছি।“
“মানে?”
“সমাধানটা আমি আবিষ্কার করিনি। করেছেন আপনি। আপনার সমাধানই আমি ব্যবহার করছি। বলতে পারেন আপনাকে দিয়ে সমাধানটা তৈরিও করিয়েছি আমি।“
“একটু বুঝিয়ে বলবে?” দ্যুন জিগ্যেস করলেন।
“আমার বিজ্ঞান কাউন্সিলে গত পাঁচ বছরে কোন আবিষ্কার হয়নি। বিজ্ঞানীদের কেউ কেউ সেজন্য আমার ওপর খেপে আছে। আর আফ্রিকার এই খরাটাও এমন সময়ে এলো, যে আমার জনপ্রিয়তা এখন… যাক, কথা হোল, যে আমার জেতার সম্ভাবনা এখন শতকরা পঞ্চাশ ভাগের কম। আপনার ছাত্রী আমাকে ধীরে ধীরে কোণঠাসা করে ফেলছিল। তবে আমজনতার একটা ভালো জিনিস হল, তারা কোন কিছু বেশিদিন মনে রাখেনা। খরাটা ওদের মনোযোগ আকৃষ্ট করে রেখেছে। কিন্তু হঠাৎ অন্য কোন দিকে ওদের মনোযোগ ঘুরিয়ে দিলেই ওরা তাই নিয়ে অনেকদিন ব্যস্ত থাকবে। আর মনোযোগ ঘোরানোর জন্য কোন যুগান্তকারী আবিষ্কারের চেয়ে আর কিই বা বেশী কার্যকর হবে?”
ক্রিতিন নিঃশ্বাস নিয়ে আবার শুরু করলেন।
“এমন সময়, গত বছর মার্চে আপনি হঠাৎ কে–৩২ নিয়ে পড়াশোনা করতে চান। সিডিসি ব্যাপারটা আমাকে জানায়। সেই থেকে আপনার ওপর আমি কড়া নজর রেখেছি। আপনি কিছু প্রাচীন ভারতীয় পুথি থেকে আপনার গবেষণা শুরু করেন। কিছু গল্প আমার নিজেরও জানা আছে। তারপর আপনি প্রাচীন গাছপালা নিয়ে পড়াশোনা করতে চান। আপনার ডায়রিতে আপনি সেদিন লিখেছিলেন – “অমরত্ব কোন নতুন আবিষ্কার নয়। প্রাচীন মানুষ এর রহস্য অনুধাবন করতে পেরেছিল।“ তখনই আমার ধারনা হয়, প্রাচীন কোন ফরমুলা থেকে আপনি সমস্যার সমাধানে পৌছাতে চাচ্ছেন। আমি আন্তর্জাতিক ইতিহাসের গ্রন্থাগার আপনার জন্য উন্মুক্ত করে দিলাম। আমার আশা ছিল, আপনার আবিষ্কার হলে আপনি আমাদের জানাবেন। কিন্তু তা যখন হলো না, তখন আমাকে আঙ্গুল বাঁকা করতেই হোল। আমি আপনার যাবতীয় তথ্য আপনার কম্পিউটার থেকে তুলে নিয়েছি। কিন্তু সেগুলো এনক্রিপটেড। বেশিরভাগই মনে হলো প্রাচীন কিছু গাছপালার জেনেটিক কোড –যা খুলতে সিডিসিরও বছর খানেক লাগবে। তাই আমি লক্ষ্য করলাম, আপনি ইতিমধ্যে কোন ফাইলগুলো মুছে ফেলেছেন। সেগুলোকে ডিক্রিপ্ট করতে বেশিক্ষণ লাগবে না। কিছু চুম্বক শব্দ প্রথমেই চলে এলো, “অমৃত, সূর্যালোক, সংরক্ষণ।“ আর কি লাগে বুঝতে? বাকিটা সিডিসিকে দিয়ে দিলাম। সিডিসি এখন সবাইকে সেই ফাইলের কপি পাঠাচ্ছে। তবে বলতেই হচ্ছে, এই সমস্যা সমাধানের কিছুটা হলেও কৃতিত্ব আমার।“
“সমাধানের কৃতিত্ব পুরোটাই তোমার। ফাইলগুলো কি বিজ্ঞানীদের পাঠিয়ে দিয়েছ?” দ্যুন বললেন।
“হ্যাঁ।“ ক্রিতিনের মুখে বিজয়ীর হাসি।
“তাহলে তোমাকে অভিনন্দন। হাজার মানুষের মৃত্যুর জন্য দায়ী তোমার মত একজন দানব যে ধরণের অমরত্ব পেতে পারে, সে ধরনের অমরত্বই তুমি পাবে।“
অপমানে ক্রিতিনের মুখ থমথম করে উঠল। “আপনি কি বলতে চাইছেন?”
“অমরত্ব দু ধরনের হয়। প্রথমটা জৈবিক – যেটা ঈশ্বর ছাড়া কেউ আয়ত্ত করতে পারে নি। আরেকটা হয় মানুষের মনে। মানুষের ভালোবাসায়। অবশ্য তোমার অমরত্ব হবে তৃতীয় ধরনের। লোকে তোমাকে ঘৃণার সাথে মনে করবে তোমার ব্যর্থতার জন্য, আর মনে রাখবে তোমার মূর্খতার জন্য।“
“আপনি সীমা লঙ্ঘন করছেন।“ গর্জে উঠল ক্রিতিন। “মানুষ আমাকে মনে রাখবে অমরত্বের জনক হিসেবে।“
“একটু ভুল বললে। কথাটা হবে, আমসত্ত্বের জনক।“
“মানে?”
“তুমি যেই রেসিপি নিয়ে ঘাটাঘাটি করছ, সেটা আমসত্ত্বের রেসিপি। প্রাচীনকালে মানুষ আম বলে এক ফল কে রোদে শুকিয়ে আমসত্ত্ব তৈরি করতো। আমের আরেক নাম অমৃতফল। অমৃত, সূর্যালোক, সংরক্ষণ… কোত্থেকে এসেছে বুঝলে? বিজ্ঞানী হলে একবার তাকিয়েই বুঝে ফেলতে ব্যাপারটা। কিন্তু তুমি অনেকদিন থেকেই আর বিজ্ঞানী নেই। তুমি পুরোপুরি একজন রাজনীতিবিদ হয়ে গেছো।”
ক্রিতিন কোন কথা বলতে পারলেন না। হাঁটু গেড়ে বসে পরলেন। দ্যুন তখনো বলে চলেছেন।
“গত বছর যখন আমি বুঝলাম এই মনুষ্য–সৃষ্ট খরা থেকে মানুষকে রক্ষার কোন চেষ্টাই তুমি করবে না, তখনই তোমার নজরে আশার জন্য আমি কে–৩২ র কথা বলি সিডিসিকে। তুমি লোভী। আমি জানতাম এই সমস্যার কথা তোমার চোখ এড়াবে না। বাকিটা তো তুমিই বললে।“
“আমি আপনার কি ক্ষতি করেছি?” ক্রিতিনের গলার স্বরে হতাশার সুর। সে হেরে গেছে। চারদিক থেকে ফোন বাজতে সুরু করেছে।
“আমার কোন ক্ষতি করোনি তুমি। তবে একটা কথা, মানুষ যখন রাজনীতিবিদদের হাত থেকে বিজ্ঞানীদের হাতে তাদের ভাগ্য তুলে দিয়েছিল, তখন থেকেই তাদেরকে সব ভুল থেকে রক্ষা করা আমাদের দায়িত্ব। এই দায়িত্ব আমি আমৃত্যু পালন করে যাব।“
ভোর সাড়ে পাঁচটা।
খবরের কাগজের হেডলাইনঃ
“‘আমসত্ত্বের জনক’ ক্রিতিনের পদত্যাগ। বিজ্ঞান কাউন্সিলের নতুন সভাপতি লায়ানা।“
খবর পেয়ে দ্যুন আশ্চর্য হননি। তার খেলার ফলাফল তিনি আগে থেকেই জানতেন।
তবে কিছুক্ষণ আগে আরেকটা ঘটনা ঘটেছে যাতে তিনি যার পর নাই আশ্চর্য হয়েছেন। তার এক ভক্ত কোত্থেকে এক বয়াম ঘি পার্সেল করে পাঠিয়ে দিয়েছে। মানুষের এই ভালো বাসার প্রতিদান কি তিনি কখনো পুরোপুরি দিতে পারবেন?
রাত দুটোর সময় ফোন বেজে উঠল। লায়ানা।
“লায়ানা। আমার বয়স হয়েছে। এই আশি বছরের জীবনে আমি কারও কাছে ক্ষমা চাইনি। আজ চাইছি।“
লায়ানা মাথা নাড়ল। “কে–৩২ এর সমাধান আপনি করেন নি তাহলে?” তার গলার স্বর ভাঙাভাঙা।
“করেছি।“
“আপনি সেটা প্রকাশ করবেন না?”
“সেটা চল আমরা আজ খিচুড়ি খেতে খেতে চিন্তা করি।“
“কিন্তু আমার প্রেস ব্রিফিং?”
“রিপোর্টারদের এখানে আসতে বল। ওরাও খাবে। চালের আন্দাজ ঠিক হয়নি। পুরো এক গামলা হবে। তারা রাজি হবেনা?“
লায়ানা মাথা নিচু করে চোখ মুছে নিলো।
“আপনি বলেছেন, আর কেউ না বলবে, তা হয়? তাই হবে।“
পূর্বদিকের জানালা দিয়ে আলো আসছে। নতুন সূর্য উঠছে। দ্যুন তাকিয়ে আছেন দিগন্তরেখার দিকে। সূর্য প্রতিদিনই ওঠে। কিন্তু কিছু দৃশ্য কখনো পুরোনো হয়না।
খুব ভালো লেগেছে গল্পটা।
হুমায়ুন আহমেদের সুযোগ্য উত্তরসূরী। সিডিসি অবধি হাজির। অসাধারণ হয়েছে।
সুন্দর লেখা।