অমানব
লেখক: তানজিরুল ইসলাম
শিল্পী: সুপ্রিয় দাস
অমানব
লেখক – তানজিরুল ইসলাম
অলংকরণ – সুপ্রিয় দাস
(১)
আমার সঙ্গে যে ঘটনাটা ঘটেছে, আমি চাই না সেটা আর কারও সঙ্গে ঘটুক বা আমার জীবনেই আবার দ্বিতীয়বার ঘটুক। মাত্র পাঁচদিন আগে আমি ওখান থেকে বেঁচে ফিরেছি। নেহাত কপালের জোরে, নয়তো আমাকেও মরে পড়ে থাকতে হতো লাশ হয়ে। আর পত্রিকায় উঠে চলে আসতো আমার সেই ক্ষত-বিক্ষত লাশের ছবি।
ব্যাপারটা আপনারাও দেখেছেন পত্রিকায়। তবে আমার মতো করে নয়। আমার মতো করে আপনারা জানেন না সবটা। জানলে বুঝতে পারতেন, আমি এখনও কীভাবে স্বাভাবিক আছি, আপনাদেরকে ঘটনাটা বলতে পারছি, সেটা একটা রহস্য।
তারপরও যে খুব একটা স্বাভাবিক আছি, তাও নয়। মাঝে মাঝেই গাটা শিউরে ওঠে। খেতে গেলে গা গুলিয়ে যায়, রুচি কমে আসে। রাত-বিরেতে ভয়ানক দুঃস্বপ্ন দেখে জেগে উঠি। মনে হয়, এই বুঝি অমানব নামের ওই জন্তুটা আমার ওপর লাফিয়ে পড়বে। ছিঁড়ে-ফুঁঁড়ে ফেলবে চরম আক্রোশে।
যদিও, সেটা ভাবার আসলে আর কোনও কারণ নেই।
আমি এখন আপনাদের সবটাই বলব। যতটুকু জানি লিখে দেব গল্পাকারে। আপনারা পাঠক হয়ে তা পড়বেন। মোটেও ভাববেন না যে, ব্যাপারটা আমার কল্পনাপ্রসূত। এত উন্নত কল্পনাশক্তির মানুষ আমি নই। যা বলব, সত্যিই বলব সবটুকু। তার এক বিন্দুও মিথ্যে নয়।
আর এর পুরো ব্যাপারটা শুরু হয়েছিল মাত্র মাস খানেক আগে…
(২)
অন্ধকার রাত। বারোটা বেজে গেছে হয়তো। দ্রুত পা চালাচ্ছে ছেলেটা। রাতের অন্ধকারের ভরসা করা যায় না। ছেলেটার বয়স বছর তেরো হয়তো হবে, ব্যবহৃত প্লাস্টিক-পলিথিন কুড়ানোর কাজ করে। ভদ্র সমাজ ওর মতো ছেলেদের সাধারণত টোকাই বলেই চেনে। কেউ ঘৃণা করে, কেউবা করুণার চোখে তাকায়। তবে যে যাই করুক, তাতে ওদের কিছু আসে যায় না।
রাত হয়তো বেশি হতো না। কিন্তু মহাজন লোকটা আস্ত একটা শয়তানের বাপ! মাল নিয়ে এমনি এমনিই বসিয়ে রেখেছিল ছেলেটাকে। টাকা চাইলেই বলছিল, আজ নাই, কাল আয়, মেয়ের বিয়ে দিচ্ছি, হাতে টাকা-পয়সার অভাব; আরও কত-শত কথা। তাও ও টাকার জন্য গোঁ ধরে বসে ছিল। টাকা না পেলে খাবে কী? পৃথিবীটা একটা নিষ্ঠুর জায়গা, অল্প বয়সেই ছেলেটা জানে এ সত্য। কেউ তাকে একমুঠো ভাতও দেবে না টাকা ছাড়া। আর ভাত না পেলে পেটের ক্ষুধা মেটারও প্রশ্ন আসে না। তাই ছেলেটা জেদ ধরার পথই অবলম্বন করে। আর মহাজন লোকটাও ছেলেটার জেদ দেখে শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয় টাকাটা দিতে। নয়তো যে ছেলেটাকে পিছুই ছাড়ানো যাচ্ছিলো না।
গা শিরশিরে একটু বাতাস ছুঁয়ে গেলো। রাতটা কেমন যেন গা ছমছমে। আঁধারটুকুও ঘুটঘুটে।
ছেলেটার বুক কিছুক্ষণ থেকে ধুকধুক করছে। গাঢ় অন্ধকারে চোখে পড়ছে না তেমন কাউকে। পড়ার অবশ্য কথাও নয়। কেউ আছে বলে মনে হয় না, শুধুমাত্র কয়েকটা কুকুর ছাড়া। মাঝে মধ্যে সেগুলো ডেকে উঠছে। কান্না করছে কেমন। শুনে ছেলেটার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠছে। গায়ের লোম সব খাড়া হয়ে গেছে। কেমন শিরশির করছে কানে। শুধু মনে হচ্ছে, কিছু একটা … ভয়ংকর কিছু একটা হবে আজ!
সামনেই একটা কবর-স্থান। অনেক গল্প আছে ওটাকে ঘিরে, কোনও এলাকায় কবরস্থান থাকলে সেটাকে কেন্দ্র করে কিছু না কিছু গল্প দাঁড়িয়েই যায়। সেগুলো হঠাৎ ঝড়ের মতো তান্ডব শুরু করলো ছেলেটার মনে।
বাড়ি যেতে হলে ওই কবরস্থানটার সামন দিয়েই যেতে হবে। কিন্তু সঙ্গে কেউ নেই ভেবে ছেলেটার আত্মারাম খাঁচা-ছাড়া হয়ে গেল। গলা শুকিয়ে আসছে, হৃদপিণ্ডটা ধুপধাপ লাফাতে শুরু করেছে বুকের পাঁজরে। ভয়! প্রচণ্ড ভয় … গাঢ় অন্ধকারের সঙ্গে সঙ্গে গ্রাস করে নিচ্ছে তাকে।
সে প্রায় কবরস্থানটার কাছে চলে এলো। বড়জোর মিনিট তিনেক লাগবে ওটা পার হতে। তবে এই তিন মিনিটই যেন ছেলেটির কাছে অনন্তকাল। সে শুধু চাচ্ছে কোনও রকমে কবর স্থানটা পার হয়ে যেতে। হাঁটতে হাঁটতে সে যখন ওটার গেটে চলে এলো, একটা আওয়াজ শুনলো হঠাৎ!
তার আত্মাটা যেন হুস করে উড়ে গেল।
মনে হচ্ছে, কিছু একটা পেছন থেকে এগিয়ে আসছে। থপ থপ শব্দ পাওয়া যাচ্ছে তার পায়ের।
একমুহূর্তের জন্য ছেলেটার মনে হল, প্রাণপণে দৌড় দেবে কিনা? কিন্তু কোথায় যেন সে শুনেছিল, এরকম অবস্থায় ভয় পেলে ভয় আরও পেয়ে বসে। জিনিসটা যদি বুঝতে পারে, ও ভয়ে মরে যাচ্ছে, তবে আর রক্ষে নেই। তাই দৌড়োবার চিন্তাটা আপাতত মাথা থেকে সরিয়ে রাখলো। নিজেকে বোঝাতে লাগলো, সবটাই তার মনের ভুল।
তবে যে ওর পা থেমে গেছে এমনও নয়। স্বাভাবিক কিন্তু দ্রুত গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে পেছনে আসছে সেই থপ থপ আওয়াজ। কিছু একটা নিশ্চিত এগিয়ে আসছে। শব্দটা জোরালো হচ্ছে আস্তে আস্তে।
পালাও!
না, নিজেকে বোঝালো সে। মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে। সব তার মনের ভয়। ভয় কাটাতে সে মনে মনে খোদার নাম জপতে শুরু করল।
জিনিসটা ওর পেছনে এসে দাঁড়ালো। কেমন যেন গন্ধ ভেসে এলো একটা।
পালাও!
এবার আর ছেলেটা স্থির থাকতে পারলো না। দৌড়ানোর একটা তাড়না এলো ভেতর থেকে। সেটাকে আটকানোর সাধ্য ওর নেই।
কিন্তু তার আগেই, হাতের মতো কিছু একটা ওর কাঁধে আঁকড়ে বসলো।
(৩)
স্যারের নাম ড. নাওয়াজ রহমান। তার মতো বড় একজন মানুষ আমাকে কী কারণে ডেকেছেন, সেটা একটা রহস্য। তার রুমের দরজায় দাঁড়িয়ে এমুহূর্তে সেটাই আমার মাথায় খেলে যাচ্ছে। বুক ঢিপ ঢিপ করছে, ভেতরে যাবার সাহস জোগাতে পারছি না।
স্যারের অনার্স প্রাণীবিদ্যায়। মাস্টারস করেছেন সার্জারি রিলেটেড একটা সাবজেক্টে। এরপর জেনেটিক্সে পি-এইচ-ডি। তিনটেতেই তার রেজাল্ট, এক কথায় অসাধারণ। খারাপ করেননি কোনওটাতেই। আমি অবাক হয়ে যাই, কীভাবে একজন মানুষ এতটা মেধাবী হতে পারেন?
এখানেই শেষ নয়।
তিনি একজন বিশ্বনন্দিত বিজ্ঞানী। ইবোলা, ক্যান্সারের মতো জটিল কয়েকটি রোগের প্রতিষেধক উদ্ভাবন করেছেন। খটমটে নামের কয়েকটা সার্জারির পেটেন্টও আছে তার নামে। পৃথিবীর যেকোনও নামি-দামী বিশ্ববিদ্যালয় তার মতো একজন মানুষকে শিক্ষক হিসেবে রাখতে পারলে ধন্য হয়ে যাবে। গবেষণার জন্যেও সাহায্য করবে পাশাপাশি, বিভিন্ন রকম সুযোগ-সুবিধা দেবে। কিন্তু তারপরও যে তিনি বাইরে কোথাও যাননি, দেশে পড়ে আছেন, আমাদের মতো বি-এস-সি পড়া ছাত্রদের পড়িয়ে রিসার্চ করছেন পাশাপাশি, ব্যাপারটা খুব ভালো লাগে আমার। এজন্য তার প্রতি আলাদা একটা শ্রদ্ধাবোধ জাগে।
তবে এখানে দাঁড়িয়ে থাকলে তো আর হবে না। ভেতরে ঢুকে স্যারের সঙ্গে কথা বলতে হবে। দেখতে হবে, উনি কেন ডেকেছেন?
ভদ্রভাবে দরজাটায় নক করলাম। নিজের নার্ভাসনেসটুকু দূরে সরিয়ে ধাক্কা দিলাম আলতো করে। কেমন বিশ্রী একটা ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দ করে খুলে গেলো দরজাটা। ভেতরে তাকিয়ে দেখলাম, স্যার নেই। একটু দ্বিধায় পড়ে গেলাম। ভেতরে ঢুকব কি ঢুকব না? কিন্তু আমাকে দ্বিধা থেকে মুক্তি দিতে স্যার নিজেই যেন এগিয়ে এলেন। ডান পাশের এটাচড বাথরুমটায় ছিলেন তিনি। নিজের বেল্টসহ প্যান্টটাকে টেনে তুলতে তুলতে সেখান থেকে বের হয়ে এলেন। তিনি যখন ওটাকে টেনে ভুড়ির ওপর বসিয়ে নিলেন, আমি দেখলাম, তার জিপারটা খোলা! আর সেটা দিয়ে তার শার্টের কোনাটা বের হয়ে আছে!
স্যার আমাকে দেখে বলে উঠলেন, “আরে শাফায়েত যে। কেমন আছো? চলে এসে অবশ্য ভালো করেছ। কথা আছে তোমার সঙ্গে। এসো, ভেতরে এসো।”
আমি কোনওমতে হাসি আটকে বললাম, “আসসালামু আলাইকুম, স্যার। ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন, স্যার?” বলতে বলতে ভেতরে ঢুকলাম। রুমের এসির বাতাসটা ভালোই ধাক্কা মারলো! শরীরটা জুড়িয়ে দিলো একেবারে।
“এইতো, ভালো আছি। নাও, বসো।” স্যার গিয়ে টেবিলের পেছনে চেয়ারটায় বসলেন। আমিও স্যারের কথা পালন করে টেবিলের সামনের একটা চেয়ারে বসে পড়লাম।
“আচ্ছা, আমার হিসেব যদি ভুল না হয়, তোমার ফাইনাল ইয়ারের পরীক্ষা কয়েকদিন আগে শেষ হয়েছে, তাই না?”
“জি স্যার।” ওঁকে উত্তর দিলাম।
“কিছু ঠিক করেছো? এরপর কী করবে? মানে উচ্চশিক্ষার চেষ্টা চালাবে নাকি জয়েন করবে কোথাও?”
“জানি না, স্যার। এখনও তেমন কিছু ঠিক করা হয়নি।”
“তুমি যদি চাও, আমার ল্যাব অ্যাসিস্ট্যান্ট হতে পারো।”
কথাটা শুনে আমি আকাশ থেকে পড়লাম। স্যারের দিকে হাঁ করে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকলাম কিছুক্ষণ। স্যার মনে হয় আমার চাহনি দেখে বিব্রত হয়ে গেলেন। বললেন, “আমার একজন ভালো সহকারী দরকার। সেজন্যই তোমাকে বলা। থার্ড ইয়ারে আমি তোমাদের অ্যানিম্যাল বায়োটেকনোলজির কোর্সটা নিয়েছিলাম। সে সময় ক্লাসে তোমার রেসপন্স আর প্রশ্নগুলো আমার নজর কাড়ে। তারপর দেখি, ওই কোর্সের ফাইনাল পরীক্ষায় তুমি বেশ ভালো লিখলে। সেজন্যই তোমাকে ডাকা। কাজটা করতে পারো। অনেক কিছু দেখতে পারবে। আর বেতনও পাবে ভালো। টাকার অ্যামাউন্ট নিয়ে ভাবতে হবে না। হাউ অ্যাবাউট ওয়ান ল্যাক পার মান্থ?”
আরও একবার আকাশ থেকে পড়লাম। কি বলবো, বুঝে উঠতে পারছি না। মনে হচ্ছে, একটা অন্ধকার কূপে আটকা পড়ে গেছি।
স্যার বললেন, “কনফিউজড?”
“জি স্যার। একটু।”
স্যার হাসলেন, “হঠাৎ করে অফার করলাম তো, কনফিউজড একটু হবারই কথা। সমস্যা নেই, সময় নাও, চিন্তা-ভাবনা করো। কয়েকদিন পরে জানালেও হবে। তবে বেশি দেরি না করাই ভালো। আমার আগের সহকারী মারা গেছে দিন সাতেক হল। খুব শীঘ্রই নতুন সহকারী প্রয়োজন। তুমি না করলে, দেখি, অন্য কাউকে বলব।”
“মারা গেছে?! কীভাবে স্যার?”
“এ প্রশ্নটার উত্তর পরে এক সময় বলব। চা খাবে?”
আমার কেমন যেন খটকা লাগলো। তারপরও সেটা গোপন করে স্যারকে বললাম, “না স্যার, থাক। চা খাবার ইচ্ছে এখন নেই। আমি বরং আজ আসি। ব্যাপারটা নিয়ে একটু ভাবতে হবে। আমি তাড়াতাড়ি আপনাকে জানানোর চেষ্টা করব।”
“আচ্ছা, এসো তাহলে। আমারও এখন একটা ক্লাস আছে।”
“আচ্ছা স্যার, ভালো থাকবেন।” বলে আমি উঠে পড়লাম। পায়ে পায়ে এগোলাম দরজার দিকে। কেমন যেন অদ্ভুত একটা অনুভূতি হচ্ছে।
আমি দরজা টেনে বাইরে বেরোলাম।
আর যখন বেরোলাম, মনে পড়লো; স্যারের জিপারটা এখনও খোলা। সেটা দিয়ে তার শার্টের কোনাটা বের হয়ে আছে।
(৪)
বাড়িটা অন্ধকারে দাঁড়িয়ে। নিঝুম অন্ধকারে বাতি জ্বালানো মাত্র কয়েকটা। মোটে তিন চারটা হয়তো হবে, তাও বড়জোর বিশ ওয়াটের। ঘন অন্ধকারটুকুর তাতে এমন কিছু ক্ষতিও হয়নি। বরং কেমন যেন একটা আধিভৌতিক আবহের জন্ম হয়েছে। গা-টা ছম ছম করে ওঠে।
একটা চোর কাছেই একটা ঝোপে লুকিয়ে আছে। সতর্ক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে প্রাচীরঘেরা বাড়িটার দিকে। উদ্দেশ্য আর আলাদা করে বলতে হবে না। বাড়িটায় হানা দেয়া যে তার মনোবাসনা, তা যে কেউ সহজেই বুঝতে পারবে।
আশপাশ ফাঁকা দেখে চোরটা পা টিপে টিপে দেয়ালের কাছে এলো। ভেতরে ঢুকতে হলে দেয়াল টপকানো ছাড়া উপায় নেই। গেট লাগানো। নাইট-গার্ড হয়তো ঘুমে ঢুলছে। আর সে যে উদ্দেশ্য নিয়ে এসেছে, তাতে সদর দরজা দিয়ে ঢোকাও সম্ভব নয়। ঢুকতে হবে চুপি চুপি। সকলের অগোচরে।
দেয়ালের কাছটায় সে স্থির হয়ে দাঁড়ালো। কান পাতলো। শুনতে চাইলো, কিছু শোনা যায় কিনা? আশ্চর্যের ব্যাপার, একটা টু শব্দও নেই! সারা পৃথিবীটা যেন অনন্ত নিঃশব্দ হয়ে থেমে আছে! আবছা আলোয় অনড়-স্থির চারপাশ। রাতজাগা পাখিদেরও হুটোপুটি বন্ধ, যেন সারা প্রকৃতি হরতাল ডেকে ফেলেছে দুম করে!
এরকম পরিবেশে ভয় জাগে। মনে হয় এই বুঝি ঝপাৎ করে কিছু একটা চলে আসবে। এসে হয়তো কিছু করবে না, কিন্তু নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে যাবে পেছনে। কানে হালকা সুড়সুড়ি দেবে। তখন চোখ ঘোরালেই যা দেখা যাবে, তাতে ভয়ংকর একটা ধাক্কা খেতে হবে নির্ঘাত। ভাবতেই কেবল মাথা চাড়া দিতে থাকা ভয়টা আরো গাঢ় হয়ে এলো। ভয় কাটাতে বুকে একটু থুঃ দিয়ে নিলো চোরটা।
ধুর! কী ভাবি এইসব?
দেয়ালটা প্রায় দেড় মানুষ সমান। লোকটা লাফ দিয়ে দেয়ালের মাথাটা আঁকড়ে ধরে ঝটপট টেনে তুললো নিজেকে। দেয়ালের ওপর চুপ করে বসে দেখে নিলো, কেউ আশেপাশে আছে কিনা? ভেতরে দেখা যাচ্ছে না কাউকে। গেটের কাছে নাইট-গার্ডটার বসে থাকবার কথা। তাকেও দেখা যাচ্ছে না। হয়তো ঘুমুতে গেছে।
চোরটা বাড়িটার দিকে তাকালো। ভাবতে চেষ্টা করলো, পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে? বাড়িটা মোটে তিন তলার, ডুপ্লেক্স। দোতলার একটা ঘরের বারান্দায় দেখা যাচ্ছে, দরজা খোলা। ঘরে আলো জ্বলছে না কোনও। সেটা দিয়েই ভেতরে ঢোকা যেতে পারে। নিচ থেকে দোতলায় উঠতেও খুব একটা কষ্ট হবে না।
ঠিক আছে। এই সই।
ঝুপ করে নিচে লাফিয়ে নামলো চোরটা। গাছ-গাছালির আড়ালে একটা জায়গায় নেমেছে সে, ঘাসে ছাওয়া। নামতেই মনে হল, একটু ঘন হয়ে এলো অন্ধকারটা। লোকটা সোজা হয়ে দাঁড়ালো। গন্তব্য বারান্দাটার নিচ। সেখান থেকেই বারান্দাটায় ওঠার চেষ্টা করতে হবে। তারপর আল্লাহ-খোদার নাম নিয়ে যা হবার হবে বাকিটা।
চুরি করতে আইসাও আল্লাহ-খোদার নাম?!
মানুষটা কয়েক পা এগোলো। এগোতে এগোতে সে যখন মাঝপথে এসে পড়লো, হঠাৎ কেঁপে উঠল একটা গাছ! ভয়ংকরভাবে। যেন কিছু একটা লাফিয়ে পড়েছে গাছ থেকে।
ভয় পেলো… প্রচণ্ড ভয় পেলো লোকটা!
তারপর… আবার সবকিছু শান্ত। নিস্পন্দ। স্থির। শুধু স্থির নেই লোকটার বুক। দুরু দুরু করছে ভয়ানকভাবে। হৃদপিণ্ডটা বেরিয়ে আসবে যেন। সত্তাটুকু তার নাড়া পেয়েছে প্রবলভাবে। এতটা ভয়… জীবনেও বোধ হয় সে পায়নি। অনুভূতি কেমন যেন অসাড় হয়ে গেছে। একটুও নড়তে পারছে না লোকটা। পা দুটো যেন শক্তভাবে গেড়ে বসেছে মাটিতে।
যে গাছটা নড়ে উঠেছিল, সেদিকে তাকাতেই রক্ত হিম হয়ে গেল লোকটার।
হায় আল্লাহ! কী ওইটা?
প্রায় পাঁচ ফুট উঁচু একটা অবয়ব। অন্ধকারে খুব একটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। আস্তে আস্তে কাছে আসছে জিনিসটা। বাতাসে ভেসে আসছে কেমন হিংস্র একটা গর গর আওয়াজ।
জিনিসটা একটু আলোতে এলো। এবার দেখা গেলো ওটাকে। চার পায়ে হাঁটছে। পুরো দেহ কালো কালো লোমে ঢাকা। কোমর থেকে নিচ পর্যন্ত একটা কুকুরের মতো। আর ওপরটা… এমন কিছু জীবনেও চোখে পড়েনি তার! ইয়া মাবুদ! ওপরটায় দুটো মানুষের দেহ। কালো লোমে ঢাকা থাকলেও বোঝা যাচ্ছে, দুজনেই পুরুষ। কুকুর মতো অংশটুকুর সামনের পা দুটোর ওপর কোমর থেকে দেহ দুটো বসিয়ে দেয়া। মুখমন্ডলও ঢাকা লোমে। মাথা থেকে ঝাকড়া চুল দুলছে বাতাসে।
স্থির হয়ে জমে গেছে চোরটা। একদম নড়তে পারছে না। অনুভূতি অবশ হয়ে গেছে প্রচণ্ড ভয়ে। এরপর সেই জীবটার সঙ্গে চোখাচুখি হয়ে গেলো। দৃষ্টি যেন তীব্রভাবে বিঁধে ফেললো তাকে। আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে একটা গর্জন শোনা গেলো। তবে তার নয়, জিনিসটার!
চেতনা হারিয়ে মানুষটা মাটিতে লুটিয়ে পড়লো।
জীবটা ছুটে আসতে শুরু করলো এবারে, গর গর আওয়াজ তুলতে তুলতে ঝড়ের মতো। হাবভাবে মনে হচ্ছে, হামলে পড়বে লোকটার ওপর, ছিঁড়ে-ফুঁড়ে ফেলবে টুকরো টুকরো করে।
তবে জিনিসটা লোকটার কাছাকাছি আসতেই সেটাকে বাধা দিলো একটা কণ্ঠ, অশান্ত জীবটাকে শান্ত করে দিলো যেন। ধমক দিয়ে জোর গলায় বলল, “থাম… দরকার হবে ওই ব্যাটাকে।”
আর সেই কণ্ঠটা নাইট-গার্ড কাম দারোয়ানের।
(৫)
হঠাৎ মেঘ করলো আকাশে। সঙ্গে বাতাস হচ্ছে। ঝড় আসবে বোধহয়। ঝড় আসার মুহূর্তটা আমার অসাধারণ লাগে। বাতাসে অন্যরকম একটা ভাব থাকে তখন। এইতো এখন যেমন আছে। বুকটা শীতল হয়ে যাচ্ছে। সকালে যখন বের হয়েছিলাম, তখনও বাতাস বা মেঘ কোনওটাই ছিল না। এখানে আসতে আসতে জুটে গেছে দুটোই।
স্যারের দেয়া চাকরিটা আমি নিয়েছি। বেকার বসে থাকার চেয়ে তার সঙ্গে কাজ করার সুযোগ হাতছাড়া করার কোনও মানে হয় না। শ্রদ্ধেয় মানুষটার কাছ থেকে আমি অনেক কিছু শিখতে পারব। পাশাপাশি অভিজ্ঞতাও হবে বেশ খানিকটা।
তার বাড়িটা শহরের একটু বাইরের দিকে। আশপাশে ঘর-বাড়ি তেমন নেই। নিরিবিলি পরিবেশ, চারপাশ জুড়ে সবুজ ধানখেত। মেঘলা আকাশ আর ঠান্ডা বাতাসে অপূর্ব লাগছে দেখতে।
আমি বাড়িটার সদর দরজায় নক দিলাম। দারোয়ান লোকটা ভেতর থেকে আওয়াজ দিলো, “কে?”
তাকে যা বলার বললাম। লোকটাকে হয়তো স্যার আগেই বলে রেখেছিলেন। তাই আমার পরিচয় দিতেই বড় গেটটার পাশের ছোট দরজাটা খুলে দিলো আর কেন ঝামেলা না বাড়িয়ে। আমি ভেতরে পা দিয়ে আরও খানিকটা অভিভূত হয়ে গেলাম। বাড়িটাকে বাইরে থেকে যেমন অপূর্ব লাগছিলো, ভেতর থেকেও তেমনই অপূর্ব লাগছে। সাজানো বাগান, বাঁধানো পথ, সারি সারি গাছ-গাছালি। কিছু আমার চেনা, বেশিরভাগই অচেনা। স্যারের রিসার্চ ওয়ার্কে কাজে লাগে হয়তো, কিংবা নিছকই শৌখিনতার বহিঃপ্রকাশ।
লোকটা আমাকে ভেতরে যেতে বলল। আমি পা বাড়ালাম। আড়চোখে দেখলাম, সে ছুটে যাচ্ছে ইন্টারকমে কিছু একটা বলতে। আমারই কথা হবার সম্ভাবনা বেশি। আর সেটাই হবে বোধহয়। কারণ ভেতরে যে চাকরটা ছিলো, সে আমাকে বিনা বাক্য ব্যয়ে সোজা স্যারের ড্রয়িং রুমে এনে বসিয়ে দিলো।
আমি বসে বসে স্যারের জন্য অপেক্ষা করতে শুরু করলাম। আজ ছুটির দিন। স্যার সারাদিন বাড়িতেই আছেন। আমাকে ডাকার সময় তাই বলেছিলেন অবশ্য।
শুধু শুধু অপেক্ষা করা কঠিন। মানুষ চুপচাপ অপেক্ষা করতে পারে না, বিরক্ত হয়ে বসে, অস্থির হয়ে যায়। তাই স্যার আসতে আসতে আমি একটু পত্রিকার শিরোনামে চোখ বুলোতে শুরু করলাম। বিভিন্ন রকম শিরোনাম চোখে পড়লো। হাসপাতালে বসেই রাজনীতি করছেন সাংসদ আমানুর!, ফাইল চলাচলে সময় লাগে আড়াই বছর; অ্যার্টনি জেনারেলকে প্রধান বিচারপতি, খালেদার ফটোগ্রাফার সহ ২৭ জনের যাবজ্জীবন, বস্তি এলাকা থেকে পথশিশু নিখোঁজ, বাবা-তোমার ছেলেটিকে বলো ধর্ষণ কী, আসামীরা নাগালে-ধরছে না পুলিশ …
“কী শাফায়েত, পেপার পড়া হচ্ছে?” কথাটায় ঘোর ভাঙলো আমার। তাকিয়ে দেখি স্যার এসে সামনের একটা সোফায় বসেছেন। লুঙি পরে আছেন একটা। সে লুঙির একটা গিট্টু খোলা, ঝুলছে। যেকোনও মুহূর্তে লুঙিটা খুলে যেতে পারে! স্যারের হয়তো সেদিকে খেয়াল নেই।
“এইতো স্যার, শুধু শুধু বসে থাকতে বোর লাগছিল। তাই একটু পত্রিকাটা দেখছিলাম।” বললাম তাকে। “আপনি কেমন আছেন?”
“ভালোই আছি।” স্যার ছোট্ট করে উত্তর ফেরালেন। “তো কেমন দেখলে? কেমন লাগছে এখানে?”
“কেবল তো এসে পৌঁছেছি। কেমন লাগছে বলতে পারছি না। তবে যেটুকু দেখলাম, দেখেছি বেশ ভালোই।”
“হা হা…” স্যার হাসলেন। “আরও দেখবে, সমস্যা নেই। বাই দ্য ওয়ে, কাজটা নিয়ে তোমার সঙ্গে খুব একটা বিস্তারিত আলাপ হয়নি। এখন হয়ে যাক, কী বলো?”
“জি, স্যার। অবশ্যই।”
স্যার কাজের কথায় চলে এলেন। “তুমি জানো, আমি রিসার্চ ওয়ার্কের সঙ্গে যুক্ত। বেশকিছু জটিল রোগের চিকিৎসা আবিষ্কার করেছি। আমার নামে নতুন ধরণের কিছু সার্জারির পেটেন্টও আছে। আমি এখানে যে কাজগুলো করি, সেগুলো ভয়াবহ রকমের কনফিডেনশিয়াল। তুমি এসব কাজে আমাকে সাহায্য করবে। অনেক কিছু দেখবে, অনেক কিছু জানবে। কিন্তু জীবন গেলেও সেগুলো বাইরে বলতে পারবে না। তারপর … আমি তোমাকে এ সংক্রান্ত যাই করতে বলি না কেন, তাই করতে হবে তোমাকে। তা নিয়ে কোনও প্রশ্ন তোলা যাবে না। তোমার মাইনে তুমি ঠিকঠাক মতোই বুঝে পাবে, সে বিষয়ে সমস্যা নেই। কিন্তু আমি তোমার কাছে যা চাই, তা আমাকে সাধ্যমতো দেয়ার চেষ্টা করতে হবে। বুঝতে পেরেছ?”
যে কোনও রিসার্চ ওয়ার্ক অবশ্যই গোপনীয়। নিজের রিসার্চের তথ্য অন্য কারও সঙ্গে শেয়ার করা ঝুঁকিপূর্ণ। সুতরাং, স্যারের কাজ-কর্মও যে কনফিডেনশিয়াল, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। কিন্তু বাকি যে কথা দুটো স্যার বললেন, তাতে আমার চিপ বেয়ে চিকন ঘাম ছুটলো। যা করতে বলবেন তাই করতে হবে, যা চান তাই দিতে হবে; মানে কী? তবে নিশ্চয় তেমন গুরুতর কিছু নয়। উনি তো আর আমার হৃদপিণ্ড চেয়ে বসতে পারেন না! কিংবা আমার ফুসফুসটাই… আর এমন আবদার না থাকলে, আমার মনে হয় না কোনও সমস্যা হবে।
আমি মাথা নেড়ে স্যারকে বললাম, “জি স্যার, বুঝেছি।”
“তাহলে, আজ সন্ধ্যায় তোমাকে একটা বন্ডে সই করতে হবে। এগুলোই লেখা থাকবে বন্ডে।” স্যার একটু বিরতি টানলেন। “তবে সে অনেক দেরি। কেবল তো এলে, খেয়ে দেয়ে একটু বিশ্রাম করে নাও। বাড়িটা একটু ঘুরে টুরে দেখো। অবশ্য ঝড় হচ্ছে বাইরে। বাইরেটা তো এখন তেমন একটা দেখতে পারবে না। ভেতরটাই দেখো এখন। বেসমেন্টে আমার ল্যাবরেটরি। আপাতত ওখানে না যাওয়াই ভালো।”
“জি স্যার, সমস্যা নেই।” বললাম আমি। “ল্যাবরেটরিটা নাহয় পরেই দেখবো। বলা তো যায় না, কদিন পর হয়তো ওটাই আমার ঘর হয়ে উঠবে।”
আমার কথাটায় স্যার হেসে উঠলেন, “হা হা, ভালোই বলেছো। তবে, আরেকটা কথা তোমাকে বলাই হয়নি।” একটু থামলেন স্যার। “আজ থেকে তুমি এখানেই থাকবে। দোতালার একটা রুমে তোমার শোবার ব্যবস্থা করা হয়েছে। তাছাড়া, তুমি তো হলেই থাকতে, তাই না? এখানে থাকলে বরং তোমার কিছু সময় বাঁচবে।”
তিনি আমার দিকে তাকালেন, জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে। “তোমার কি আপত্তি আছে?”
“না, স্যার। কোনও আপত্তি নেই।” যদিও ভেতরে ভেতরে বেশ খানিকটা অবাক হয়েছি।
“তাহলে আর কোনও প্রশ্ন আছে, শাফায়েত?”
“আপাতত একটা আছে, স্যার। আপনার ফ্যামিলি এখানে থাকে না?” প্রশ্ন করলাম স্যারকে।
পরক্ষণেই গলা নামিয়ে অনুমানটা শোনালাম, “আমার মনে হচ্ছে তারা অন্য কোথাও থাকে।”
“ঠিক ধরেছ।” স্যার সায় দিলেন। “দেশে থাকে না ওরা। আমেরিকার নিউইয়র্কে থাকে। বছরে দু-একবার যাই ওদের সঙ্গে দেখা করতে। তুমি কীভাবে বুঝলে?”
“আমার মনে হল আপনার ফ্যামিলি এ বাড়িতে থাকলে আপনি এত সহজে এখানে আমার থাকার ব্যবস্থা করতেন না। কিংবা করলেও অন্তত বাড়ির দোতালায় না। আমি তো এখন আপনার গেস্ট নই। আপনার এমপ্লোয়ি।”
“তোমার কথায় যুক্তি আছে। মানছি। কিন্তু তারপরও তোমাকে বলছি, তেমনটা হতো না। আর তাছাড়া তুমি আমার ছাত্র। বাকিদের যদি আমি মূল বাড়ির বাইরেও রাখি, তোমাকে অবশ্যই ভেতরে রাখতাম।”
কথাটা শুনে আমি জিবে কামড় দিলাম। স্যার দেখে হেসে ফেললেন।
“যাই হোক,” বললেন স্যার, “আমি সাবেরকে পাঠাচ্ছি। ও তোমাকে রুম দেখিয়ে দেবে। তুমি ফ্রেশ হয়ে খাওয়া দাওয়া করো। খানিক বিশ্রাম নাও। তোমার সঙ্গে আমার পরে আরও কথা হবে।”
স্যার উঠে দাঁড়ালেন। আমার ভয় হল, স্যারের লুঙিটা খুলে যায় কিনা! আরও ভয় হল, ওটা কি তিনি লক্ষ করেছেন? যদি না করেন, তাহলে ভয়ংকর একটা কেলেঙ্কারী ঘটে যেতে পারে যে কোনও মুহূর্তে। যাই হোক, আমার ভয়টা কেটে গেলো। কারণ, স্যার তার লুঙিটা ঠিক করে নিলেন। এরপর চলে গেলেন রুম থেকে।
আমি উঠে ড্রয়িং রুমের বারান্দাটায় গিয়ে দাঁড়ালাম। ঝড় হচ্ছে, সঙ্গে বৃষ্টি। বৃষ্টির ছাঁট গায়ে এসে লাগছে। শিহরিত হচ্ছি। বাইরে পৃথিবীটা অশান্ত। গাছ-পালা উথাল পাথাল করছে বাতাসে। হু হু করে ছুঁয়ে যাচ্ছে বাতাসের ঝাপটা।
আকাশটা অন্ধকার।
আমি ঝড় অনুভব করছি।
ফারিহার কথা মনে পড়ছে। ওর সঙ্গে যেদিন আমার ব্রেক আপ হয় সেদিনও ঝড় হচ্ছিলো এমন। প্রায় এক বছর আগে আমাদের চার বছরের সম্পর্কটার ইতি টেনেছিল ও। বাসা থেকে আমেরিকা পি-এইচ-ডি পাত্রের সঙ্গে বিয়ে ঠিক হয়েছিলো তখন। ও না করেনি তাতে। পাত্রটাকে বিয়ে করে আমেরিকা চলে গিয়েছিলো। তারপর, আর কখনও যোগাযোগ করেনি। আমিও আর ওর সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করিনি। মানিয়ে নিয়েছি। তবুও মাঝে মধ্যে মনে পড়ে একটু। বুকের বাম পাশটায় খানিক ব্যথা হয় তখন। এই এখন যেমন হচ্ছে!
“সাব আসেন, আপনাকে আপনার ঘর দেখাই।” পেছন থেকে কেউ বলল। সাবের হবে হয়তো। আমার ঘুরে তাকাতে ইচ্ছে করছে না। কিন্তু তারপরও ঘুরে তাকালাম। আমাকে যে চাকরটা ড্রয়িং রুমে বসিয়ে গিয়েছিলো, সেই এসেছে। মধ্য বয়স্ক। বয়স আনুমানিক পঞ্চাশ-ষাট। জলদি একটা ডাক ঠিক করতে হবে ওঁর জন্য। চাচা বলেই ডাকবো বলে ঠিক করলাম।
“চাচা, আপনার নাম সাবের?” জিজ্ঞেস করলাম তাকে।
“জি সাব।”
“তাহলে চলুন।”
সে আগাতে শুরু করলো। আমি তাকে অনুসরণ করলাম।
সেদিন সন্ধ্যায় আমি বন্ড সই করলাম। পরদিন রাত নাগাদ আমার সব জিনিসপত্র নিয়ে এসে স্যারের বাড়িতে উঠে গেলাম।
স্যারের সঙ্গে আমার কাজ তখনও শুরু হয়নি।
(৬)
স্যারের সঙ্গে কাজ শুরু হল কয়েকদিন পর। তার আগের কটা দিন শুয়ে বসেই কাটলো।
একটা ব্যাপার লক্ষ করলাম, স্যারের বাড়িতে আসার পর থেকে আমি আর রাত জাগতে পারি না। ঘুম বেড়ে গেছে। আগে বেশ রাত জাগতে পারতাম। একটা-দুইটা আমার কাছে কোনও ব্যাপারই ছিলো না। আর এখন সাড়ে দশ-এগারো বাজতেই কাত হয়ে পড়ি! উঠি সকাল সাড়ে ছটায়, টানা ঘুম।
অবশ্য এর পেছনে একটা কারণ থাকতে পারে। আগে হলে থাকতাম। অনিয়মের হাঁড়ি ছিলাম একটা। খাওয়া-দাওয়া, ঘুম টুমের কোনও বালাই ছিলো না। কখনও দিনে ঘুমোতাম, জেগে থাকতাম সারা রাত। আবার কখনও হতো উল্টোটা। খাওয়া-দাওয়াও নিয়ম মেনে হতো না। হলের খাবার মুখে তুলতে কষ্ট হতো। এখন সবকিছু মোটামুটি নিয়ম মেনেই হয়। স্যারের বাসায় সাবের চাচা রান্না করেন। ওঁর রান্নার হাত অসাধারণ। খেতে বসলেই কীভাবে কীভাবে যেন দু-তিন প্লেট খেয়ে ফেলি! আর তাতেই শরীর ভারী হয়ে ওঠে। মনে হচ্ছে, চর্বিও চড়ছে গায়ে।
একটা কথা আছে। ‘আহার, নিদ্রা, ভয়, যতই বাড়াবে, ততই বাড়িবে।’ আমার ক্ষেত্রেও দেখছি, হচ্ছে সেটাই। খাওয়া-দাওয়া বেড়ে গেছে। রাতের খাবারের পর নিজেকে আর ধরে রাখতে পারি না। চোখ বুঁজে আসে ঘুমে। ধপাস করে বিছানায় পড়ে ঘুমিয়ে যাই!
যাক সে কথা। ওসব তেমন কিছু গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার নয়। স্যারের দেয়া কাজটাই আসল। কারণ, স্যার যদি আবার কাজ থেকে বাদ দিয়ে দেন, তাহলে এই আরাম-আয়েশ সবটাই চলে যাবে!
এরপর স্যার আমাকে প্রথম কাজে ডাকলেন। তবে সেদিন তিনি আমাকে দিয়ে তেমন কিছু করালেন না। টুকটাক কিছু যন্ত্রপাতির সঙ্গে শুধু পরিচয় করিয়ে দিলেন। তার ল্যাবরেটরি ও অপারেশন চেম্বার দেখালেন। ধারণা দিলেন বেশ কিছু কেমিকেল সম্পর্কে। মোট কথা, তার সঙ্গে কাজ করতে যেটুকু প্রাথমিক জ্ঞান দরকার, জানিয়ে দিলেন সেটুকু। তবে এত কিছু দেখালেও একটা জিনিস তিনি আমাকে দেখালেন না, তার ল্যাবরেটরির একপাশে থাকা লাল দরজার আড়ালের অংশটা। অংশটা নিয়ে আমার বেশ কৌতূহল হল, আর হওয়াটাই স্বাভাবিক। সেটার কথা যখন তুললাম, স্যার বললেন, “এখনও সময় আসেনি, মাই বয়। ওয়েট করো।”
স্যারের সঙ্গে কথা বলতে আমার একটু ভয় ভয় হয়। অন্য কিছু নয়, তার অবস্থানের কারণেই আসে ভয়টা। তাই আমি আর বাক্য বাড়ালাম না। কিন্তু সময়টা যাতে তাড়াতাড়ি আসে সেজন্য মনে মনে প্রমাদ গুনলাম।
স্যারের জন্য প্রকৃতভাবে যে কাজটা করতে হল, সেটা এলো আরও কদিন পর। সেদিন স্যার আমাকে একটা কলিজা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে রিপোর্ট লিখতে বললেন। স্যারকে জিজ্ঞেস করলাম, “কীসের কলিজা এটা, স্যার?”
স্যার বললেন, “চিনতে পারনি? এটা একটা প্রাপ্ত বয়স্ক শিম্পাঞ্জির কলিজা।”
আমি খানিকটা অবাক হয়ে গেলাম, “কীহ! কীভাবে? কোথায় পেলেন?”
আমার আচরণে স্যার হেসে ফেললেন, “আমার জন্য এটা এমন কিছু কঠিন নয়, ছেলে। রিসার্চের জন্য আনিয়েছি। আফ্রিকায় আমার পরিচিত একটা সংস্থা আছে। ওদেরকে বলেছিলাম শিম্পাঞ্জির কলিজা পাঠাতে আর ও ব্যাটারা আস্ত একটা শিম্পাঞ্জিই পাঠিয়ে দিয়েছে!”
“ও আচ্ছা।” বললাম আমি। তারপর কলিজাটা নিয়ে চলে গেলাম কাজ করতে। কাজটা করতে আমার কোনও সমস্যাই হল না। কারণ, এর আগে কয়েকদিন স্যারের সঙ্গে কাজ করার সময় দেখেছি। স্যারও আমাকে শিখিয়ে দিয়েছেন একটু। অবশ্য সেবারে ওগুলো ছাগলের কলিজা ছিলো। দুটো।
এরপর এরকম আরও কিছু কাজ করেছি। কখনও কলিজা, কখনও ফুসফুস। কখনও বা অ্যানিম্যাল বায়োটেকনোলোজি সংক্রান্তই কাজ। মাঝে মাঝে ভাইরাস, ব্যাক্টেরিয়ারও কালচার করতে হয়েছে। তবে যেটাই করি, ওই লাল দরজার আড়ালে যাওয়া হয়নি তখনও। আর ওটা দেখার জন্য আমি মরিয়া হয়ে আছি। কৌতূহল হচ্ছে অসম্ভব রকমের। ধৈর্য ধরতে পারছি না। বেশি দেরি হলে হয়তো দেখা যাবে, স্যারের অপেক্ষায় বসে না থেকে আমি নিজেই চলে গেছি ভেতরে, ওটা দেখতে। কারণ ছোটবেলা থেকেই আমি কৌতূহল দমাতে পারি না।
পরদিন বিকেল বেলা। স্যার বাড়িতে নেই, বাইরে গেছেন। আমার এক কাপ চা লাগতো। আমি সাবের চাচাকে খুঁজছি চায়ের কথা বলতে। রান্না ঘর, টিভির ঘর; কোথাও ওঁকে পেলাম না। বাইরে গিয়ে দারোয়ান রহমতকে জিজ্ঞেস করলাম, “সাবের চাচাকে দেখেছেন?”
“না, স্যার।” লোকটা আমাকে স্যার বলেই ডাকে। “উনি তো এদিকে আসেন নাই। বাড়ির ভেতরেই থাকার কথা। বাইর হইতে দেখি নাই।”
আমি বাড়ির ভেতরে গিয়ে জোর গোলায় হাঁক ছাড়লাম, “সাবের চাচা…”
সাবের চাচা হন্ত-দন্ত হয়ে ছুটে এলেন কিছুক্ষণ পর। এসেই বললেন, “সাব, আপনার কিছু লাগবো?”
আমি ওঁকে লক্ষ করলাম। গালে পাক ধরা দাঁড়ি, মাথার চুল কেমন উস্কো-খুস্কো। চোখ দুটো ভেজা ভেজা।
আমার খটকা লাগলো। জিজ্ঞেস করলাম, “চাচা, আপনি কাঁদছিলেন?”
উনি সঙ্গে সঙ্গে উদভ্রান্তের মতো চোখ-মুখ মুছতে শুরু করলেন। ধরা পড়ে যাওয়ার মতো করে বললেন, “না, না। নাতো সাব। কাঁনতে যাবো কেন? আমি কাঁনদি নাই।”
বুঝলাম, উনি বলতে চাচ্ছেন না। আমিও তাই আর ঘাটালাম না। বললাম, “আমাকে এক কাপ চা করে দিতে পারবেন?”
“জি সাব। এখনই দিতাছি।”
“আমি বাগানে থাকবো। ওখানে দিয়েন।”
“আচ্ছা সাব।”
এরপর আমি বাগানে গেলাম। হেঁটে হেঁটে ঘুরে ঘুরে দেখছি। বিভিন্ন রকম ফুলের গাছ, ফলের গাছ সব সৌন্দর্য্য বর্ষণ করতে দাঁড়িয়ে। থোকা থোকা ফুল, রং বেরঙের। কয়েকটা বাহারি পাতাবাহার বাগানটার শোভা বাড়িয়েছে যেন আরও। দেখলেই চোখ জুড়িয়ে যায়। শুধু দেখতেই ইচ্ছে করে।
বাগানে বসার জন্য কংক্রীটের কিছু স্থায়ী বেঞ্চও আছে। সেগুলোতে ইচ্ছে করলেই বসা যায়। কিন্তু আমি বসতে চাচ্ছি না। হেঁটে হেঁটেই সময়টুকু উপভোগ করতে চাচ্ছি।
হাঁটতে হাঁটতে আমি যখন বাড়ির পেছন দিকটায় এলাম, কথা খেয়াল হল একটা। এখানে একটা দরজা আছে বড়-সড়ো, লোহার। দরজার পেছনে কোন ঘর নেই। বরং দরজার মাথা থেকে কংক্রীটের একটা দেয়াল স্লোপের মতো মাটিতে নেমে মিশে গেছে। মনে হয় চোরা কুঠরী কোনও। সিড়ির মতো কিছু একটা চলে গেছে মাটির গভীরে। এটা নিয়েও আগ্রহ আছে আমার। কিন্তু কেন যেন স্যারকে জিজ্ঞেস করা হয়ে ওঠেনি।
আমি জিনিসটার দিকে এগিয়ে গেলাম। খুটিয়ে খুটিয়ে দেখতে লাগলাম কাছে গিয়ে। পুরু-মজবুত প্লেন শিটের দরজা। একটা তালা লাগানো। তালাটাও বেশ হোমরা চোমড়া। সাধারণ চেষ্টায় ভাঙবে না নিশ্চিত! আমার তো মনে হয় ওটাকে ভাঙতে হলে একটা রকেট লাঞ্চার এনে উড়িয়ে দিতে হবে। দরজাও গেল, তালাও গেল। যাহ শালা!
কিন্তু কী আছে এর ভেতরে?
“সাব, আপনার চা।”
পেছনে ঘুরে দেখলাম সাবের চাচা দাঁড়িয়ে। তাকে জিজ্ঞেস করলাম। “আচ্ছা চাচা, এই দরজাটার ভেতরে কি?”
তিনি মনে হল একটু চমকে উঠলেন। কেমন অন্যরকম একটা ভাব চলে এলো তার চেহারায়। বললেন, “আমি বলতে পারব না সাব। বড় সাবকে জিজ্ঞাসা কইরেন।”
বুঝতে পারলাম, লোকটা স্যারের কথা বলছেন।
(৭)
গাড়িটা ঠিক দোতালা বাড়িটার সামনে এসে থামলো। মিতসুবিশি, ল্যান্সার, লাল রঙের। হর্ণ বাজলো দুবার। দারোয়ান ভেতর থেকে বেড়িয়ে এলো। গাড়িটার পেছন সিটের জানালাটা খুলতেই সে উঁকি দিলো সেদিক দিয়ে। ভেতরের মানুষটাকে চিনতে পেরে বিগলিত হয়ে পড়লো। ফিরে গিয়ে খুলে দিলো দরজাটা।
গাড়িটাকে ভেতরে নিয়ে জায়গা মতো পার্ক করে রাখা হল। ড্রাইভার নেমে খুলে দিলো ব্যাকসিট-ডোর। ড. নাওয়াজ রহমান বেরিয়ে এলো সেখান থেকে। পরনে ক্যাজুয়াল পোশাক। আশেপাশে না তাকিয়ে সে হাঁটতে শুরু করলো এক তলার প্রবেশ দরজার উদ্দেশ্যে।
প্রবেশ দরজায় দাঁড়িয়ে সে কলিংবেলটায় চাপ দিলো। একটু পর সেটা খুলে দিয়ে লোক দাঁড়ালো একটা, বাড়ির কাজের লোকেদের একজন। ড. নাওয়াজকে সে আগে থেকেই চেনে। এর আগেও নাওয়াজ রহমান বেশ ক’বার এ বাড়িতে এসেছে। তাই কোনও বাক্য ব্যয় না করেই লোকটা তাকে দোতালার একটা গোপন ঘরে নিয়ে গেলো। এরপর ড. নাওয়াজকে একটা কালো আলখাল্লা ও গলায় ঝোলানোর শিকলসহ তামার একটা লকেট দিয়ে চলে এলো।
ঘরটায় কেমন যেন গুমোট একটা পরিবেশ। বেশ কজন কালো আলখাল্লা পরা মানুষ মেঝেতে বসে অপেক্ষা করছে, আগে থেকেই। তামার লকেট ঝুলছে গলায়। সবাই গোল হয়ে বসা, চুপ করে আছে। তাদের মাঝে নারী-পুরুষ উভয়েই আছে, জানে ড. নাওয়াজ। সেও আলখাল্লা আর লকেটটা পরে নিয়ে তাদের সঙ্গে বসলো।
ভাগ্যিস, আলখাল্লাটায় কোনও বোতাম নেই। নাহলে হয়তো দেখা যেতো, ড. নাওয়াজ বোতাম লাগাতে ভুলে গেছে দু-একটা!
মৃদু লাল আলো জ্বলছে ঘরটায়। কেমন অশুভ একটা ভাব। ঘরে কয়েকটা ছবি ছাড়া অন্য কোনও আসবাবও নেই। ছবিগুলো তাদের প্রভূ লুসিফার আর তার চিহ্ন পেন্টাগনের।
শয়তানকে তার পূজারিরা লুসিফার বলেই ডাকে।
তাদের অপেক্ষার অবসান হল কিছুক্ষণ পর। গুরু এসে ঘ্যারঘেরে স্বরে ঘোষণা করলো, “সবাই প্রস্তুত হয়ে নে। রিচুয়্যালের সময় হয়ে গেছে। যারা এখনও আসেনি, তাদেরকে ছাড়াই শুরু করতে হবে। কিছু করার নেই। বেশি দেরি করলে লুসিফার ক্ষুব্ধ হয়ে যাবেন। আর সেটা হলে তার ফল ভয়ংকর কিছু হবে।”
তারা সবাই গুরুর কথায় সম্মতি জানাতে উঠে দাঁড়ালো। গুরু তখন একটা মানুষের মাথার খুলি এনে রাখলো সবার মাঝখানে, যেন বৃত্তটির কেন্দ্র। এদিক ওদিক মানুষের রক্ত ছিটিয়ে দিয়ে আগুন জ্বালালো খুলিটাকে ঘিরে। এবার সে নির্দিষ্ট একটা মিউজিক ছাড়লো। গুরুর জন্য জায়গাটা আগে থেকেই ঠিক করা। সে গিয়ে তার নির্ধারিত জায়গায় দাঁড়ালো। তার ঠিক বিপরীত দিকে দেয়ালে লুসিফারের বড় একটা ছবি।
যথাসময়ে রিচুয়্যাল শুরু হল। আগে থেকে দিয়ে রাখা মাদক নিয়ে নেশাগ্রস্থ হল সবাই। বিভিন্ন রকম অঙ্গভঙ্গি করে সবাই ঘুরে ঘুরে নাচতে লাগলো। সুরের তালে তালে। একটা পর্যায়ে গিয়ে অবৈধ যৌন ক্রিয়ায় লিপ্ত হল তারা। বাতাস জুড়ে পাপ আর শিৎকার ভেসে বেড়াতে লাগলো। জঘন্য একটা পরিবেশ তৈরি হল ঘরটায়।
বর্বরতার যতটা সম্ভব, ততটাই হল ঠিক! মোট কথা, লুসিফারকে সন্তুষ্ট করতে যতটা প্রয়োজন, তার ততটাই করলো তারা।
সারা রাত চললো এই রিচুয়্যাল। ভোরের দিকে শেষ হল।
ড. নাওয়াজ যখন তার চেতনার ওপর জোর পেলেন, বের হয়ে এলেন বাড়িটা থেকে। এসে তার ড্রাইভারকে ফোন দিয়ে বললেন গাড়িটা বের করতে।
বাড়িটার প্রাঙ্গনে দাঁড়িয়ে তিনি দেখলেন, গাড়ি নিয়ে আসছে তার ড্রাইভার। মিতসুবিশি, ল্যান্সার। লাল রঙের।
রঙটা শয়তানের!
(৮)
অবশেষে আমার লাল দরজার রহস্য জানবার দিন এলো।
টানা দুদিন পর বাইরে থেকে ফিরে এলেন স্যার, বিকেলে দিকে। এরপর রাতে এলেন আমার ঘরে। ঘড়িতে তখন এগারোটা বাজে। তবে আশ্চর্যের ব্যাপার, এদিন আমার ঘুম ধরেনি অতটা।
স্যার আমার ঘরে ঢুকে সোফায় বসতে বসতে বললেন, “কী শাফায়েত? বই পড়া হচ্ছে?”
আমি তখন একটা বই পড়ছিলাম বিছানায় শুয়ে। উঠে বসতে বসতে স্যারকে বললাম, “জি স্যার। এইতো, একটু সময় কাটানোর জন্য।”
“বইটা রেখে একটু প্রস্তুত হয়ে নাও তো। আজ তোমাকে লাল দরজার পোর্শনটা দেখাবো।”
আমি স্যারের দিকে তাকালাম। কিছু বললাম না। স্যার উঠতে উঠতে বললেন, “আমি ল্যাবরেটরিতে অপেক্ষা করছি। তুমি রেডি হয়ে চলে এসো।”
আমার প্রস্তুত হবার তেমন কিছু ছিল না। একটা ট্রাউজার আর টিশার্ট পরে ছিলাম। সেগুলো গায়েই দিব্যি যেকোনওখানে যাওয়া যাবে। তাই যে বইটা পড়ছিলাম সেটাকে জায়গামতো রেখে পা বাড়ালাম ল্যাবরেটরির দিকে। যেতে যেতে আরেকটা ব্যাপার ঠিক করলাম। বাড়ির পেছনে দেখা দরজাটার কথাও জিজ্ঞেস করব স্যারকে। তবে লাল দরজার অংশটা দেখা শেষে।
স্যার কী যেন করছিলেন ল্যাবরেটরিটায়। আমার পায়ের শব্দ শুনে চোখ তুলে তাকালেন। আমি তার দিকে এগিয়ে যেতেই আমাকে ইশারা করলেন তার পেছন পেছন যেতে। আমি তার কথামতো তার সঙ্গে এগুলাম।
লাল দরজাটার সামনে দাঁড়িয়ে তিনি আমাকে সতর্ক করে দিলেন। “শাফায়েত, মানসিকভাবে প্রস্তুতি নাও। এখানে যা দেখবে তা তুমি এর আগে দেখোনি। দেখার কথা কখনও হয়তো চিন্তাও করনি। তাই বলে রাখছি, ঘাবড়াবে না।”
কথাটা আমার মস্তিষ্কে ঠকাস করে আঘাত হানলো। স্যারকে দেখলাম, পকেট থেকে চাবি বের করে দরজাটা খুলছেন। কেমন যেন অশুভ অনুভূতি হল। একটা ঢোক গিললাম।
স্যারের কথার মানে কি?!
দরজাটা খোলা হলে দেখলাম ভেতরটা অন্ধকার। কিছু দেখা যাচ্ছে না। স্যার ডানে হাত দিয়ে হাতড়াতে শুরু করলেন। একটু পর কাক্সিক্ষত সুইচটা খুঁজে পেয়ে চাপলেন সেটা। চাপার ফলস্বরূপ হলদে আলো জ্বলে উঠল ঘরটায়। সঙ্গে সঙ্গে কতগুলো চিৎকার ভেসে এলো। অপার্থিব কতগুলো গর্জন। মনে হল, একটা নরকের উদয় হল যেন। অদ্ভুত একটা অনুভূতি এসে ধাক্কা দিলো, বোঝাতে পারব না কী? আসলে, সজ্ঞার সঙ্গে সম্পর্কিত ব্যাপারটা।
পরিস্থিতির ধাক্কায় আমি খানিক নিস্তব্ধ হয়ে রইলাম। কিছু বলতে পারলাম না। স্যার বললেন, “ভয় পেও না। হঠাৎ করে আলো জ্বলেছে তো। প্রাণীগুলো ভয় পেয়েছে। তুমি আমার সঙ্গে এসো।”
আমি স্যারকে অনুসরণ করে ঘরটায় ঢুকলাম। দেখলাম অনেকগুলো খাঁচা রুমটায় সারি সারি সাজানো। হলদে আলোয় সেগুলো দেখে চমকে উঠলাম। ওগুলোয় যে প্রাণীগুলো আটকে রাখা, পৃথিবীর কোনও স্বাভাবিক প্রাণী না সেগুলো। বিভিন্নটা বিভিন্ন রকম। অদ্ভুত সব গড়নের। কেমন যেন। কয়েকটা প্রাণীকে দেখে আমার আঁতকে ওঠার যোগাড় হল। কী দেখছি? একটা ছাগলের দেহে তার চারটে পায়ের বদলে মানুষের চারটা হাত জুড়ে দেয়া। সেগুলো দিয়েই নড়ছে জীবটা, কেমন যেন কিলবিল করে। একটা খাঁচায় দেখলাম, একটা বানরের দুই পায়ের জায়গায় দুটো মানুষের পা লাগানো। তার ওপর ভর করে বানরটা খাঁচার শিক ধরে দাঁড়িয়ে। দেখতেই আমার ভেতরটা কেঁপে উঠল।
কাচ দিয়ে তৈরি বড় একটা চৌবাচ্চা দেখলাম। পানি ভর্তি, হলদে আলোয় ভেতরটা কেমন ঘোলাটে দেখাচ্ছে। তাতে দেখলাম অক্টোপাসের মতো একটা জীব। মাথাটা বোধহয় অক্টোপাসেরই হবে। কিন্তু পায়ের জায়গায় আবার মানুষের হাত, আটটা। সেটা দেখে আমার শরীরটা মাকড়সা হাঁটার সময়ের মতো শিরশির করে উঠল। এরকম অন্যান্য সব খাঁচাতেই অদ্ভুত অদ্ভুত সব প্রাণী। যতই দেখছি, অবাক হচ্ছি ততই, চিন্তা-ভাবনা বিস্ফোরিত হয়ে যাচ্ছে!
এসব কী!
স্যারকে বললাম(শব্দ খুঁজে পেতে বেগ পেতে হল), “এগুলো কী, স্যার?”
“এগুলো আমার সৃষ্টি।” ভরাট গলায় উত্তর দিলেন স্যার। কণ্ঠে খানিকটা গর্বের আভাস ফুটে উঠল, ঠোঁটে কিরকম সন্তুষ্টি হাসি।
“মানে, কী বলছেন আপনি? মানুষের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কেটে পশুর দেহে বসিয়ে দেওয়া আপনার কাজ?”
“ইয়েস মাই বয়। যা কিছু দেখছো, সবই আমার কাজ। এখানকার প্রত্যেকটা জীবকে আমি নিজ হাতে গড়েছি।”
আমার অবাক হবার মাত্রা আরও বাড়লো। মাথাটা ভন ভন করতে শুরু করেছে। “কেন স্যার? কীজন্যে? আপনি কেন এসব করেছেন?”
“কেন মানে? গবেষণা। তোমার কি মনে হয় ইবোলা, ক্যান্সারের মতো জটিল সব রোগের ওষুধ আকাশ থেকে টপকায়? আমার নামে যেকটি সার্জিক্যাল অপারেশনের পেটেন্ট আছে, তা উড়ে উড়ে এসছে? ওগুলোর জন্যেই এসব করতে হয়েছে, বুঝলে? যেমন ধরো ইবোলার ওষুধ তৈরি করার জন্যে একটা মানুষের দেহে শূকরের অঙ্গ বসাতে হয়েছে আমাকে; তুমি তো জানোই, শূকরেরা ইবোলা আক্রান্ত হয় না; এরপর তার দেহে ইবোলা ভাইরাস ইনজেক্ট করে দেই। এতে দিন কয়েকের মধ্যে রোগ প্রতিরোধের জন্যে তার শরীরে যে অ্যান্টিডোটটুকু তৈরি হয়, সেটুকু কালেক্ট করে তা থেকেই ওষুধ বানিয়ে নিয়েছি। তবে এর জন্য আমাকে তিনবার ব্যর্থ হতে হয়েছে। প্রথমে ব্যাপারটা কাজই করছিল না।
“আবার দেখ, জটিল জটিল যে অপারেশনের প্যাটেন্টগুলোও আমার নামে আছে, সেগুলোও কিন্তু এসবের ফসল। ছাগলের দেহে মানুষের হাত, বানরের দেহে মানুষের পা, অক্টোপাসের আটটা পায়ের জায়গায় মানুষের আটটা হাত বা আর যেগুলো দেখছো কিংবা দেখবে, সেগুলোকে কর্মক্ষম করে তোলায় অসাধারণ মাপের সার্জারী দক্ষতা প্রয়োজন। ¯্নায়ু-ট্নায়ু সবকিছুর সমন্বয় করতে হয়। এসব কাজ করে করেই আমি সার্জারীতে দক্ষতা অর্জন করেছি। আর তারপরেই না সেই কাক্সিক্ষত জটিল অপারেশনগুলোর দিকে ঝোঁকার সাহস হয়েছে! ব্যর্থ হয়েছি, আবার চেষ্টা করেছি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সফলতা আমাকে ধরা দিয়েছে। নাহলে সেই সার্জারী পেটেন্টগুলো পেতাম কিনা, কে জানে? ক্যান্সার, ট্যান্সার এরকম বাকি রোগগুলোর চিকিৎসা খুঁজে পেতেও আমাকে অমন বিভিন্ন রকম এক্সপেরিমেন্ট চালাতে হয়েছে। সবকিছু কি আর সহজেই হয়ে যায়? চাইলাম আর পেয়ে গেলাম?”
“কিন্তু স্যার মানুষ দিয়ে কেন? কেন অন্য কিছু দিয়ে নয়?” স্যারকে কী বলব, বুঝতে পারছি না। আগেই বলেছি, স্যারের সঙ্গে কথা বলতে আমার কেমন ভয় ভয় হয়। তবে সে ভয়টা যেখান থেকে আসতো, সেটা বোধহয় আস্তে আস্তে ধসতে শুরু করেছে।
স্যারের সম্মান!
স্যার বললেন, “মানুষের রোগের ওষুধ বের করবো, নতুন নতুন অপারেশনের উপায় বাতলে দেবো, তো মানুষ দিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করবো নাতো কী দিয়ে করবো? আমার আবিষ্কৃত ওষুধগুলো যদি অন্য কিছুর ওপর কাজও করতো, মানুষের ওপর যে কাজ করতো তার নিশ্চয়তা কী? একসময় না একসময় তো মানুষকে লাগতোই। আমি শুধু আগেই মানুষের সাহায্য নিয়েছি।”
“যাদের দিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করেছেন, তাদের কথা আপনার একবারও মনে হয়নি? তাদের জীবনটা যে নষ্ট হয়ে গেলো?”
“বৃহত্তর সার্থে মাঝে মাঝে ক্ষুদ্রতর সার্থ বিসর্জন দেওয়াটা তেমন বড় কিছু নয়। একটা মানুষকে ব্যবহার করে আমি কতগুলো মানুষের উপকার করেছি, ভেবেছো? তোমার কাছে হয়তো খারাপ লাগতে পারে, কিন্তু একটা কথা কি জানো? চিকিৎসা বিজ্ঞানের এত উন্নতির পেছনে হিউম্যান এক্সপেরিমেন্টের একটা গুরুত্বপূর্ণ অবদান আছে। অনেক গবেষকই গোপনে অনেক নিষ্ঠুর নিষ্ঠুর হিউম্যান এক্সপেরিমেন্ট করতেন। নাৎসি ডাক্তার জোসেফ মেঙ্গেল ও সিগমুন্ড র্যাশারের নাম শুনেছো? কনসেন্ট্রেশন সেন্টারের কয়েদীদের ওপর অমানবিক ও নিষ্ঠুর সব এক্সপেরিমেন্ট চালাতেন তারা। তবে তাদের পরীক্ষাগুলো কিন্তু পরবর্তীতে চিকিৎসাবিজ্ঞানের উন্নতিতে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। আবার দেখবে, কিছু কিছু দেশের সরকারও নিজ উদ্যোগে এরকম গোপন এক্সপেরিমেন্ট করে থাকে। কিন্তু প্রকাশ পায় না বলে অনেকেই জানে না।”
স্যার কী মানুষ?!
আমার কী রকম অসুস্থ অসুস্থ লাগছে। আমি আর কিছু বললাম না। তাকে বলতে ইচ্ছে করছে না যে, সে অমানুষ, কাজ গুলো তার সম্পূর্ণ অমানবিক। বুকে বাঁধছে কথাগুলো বলতে।
“এসো, আমার সঙ্গে এসো। তোমাকে কয়েকটা জিনিস দেখাই।”
স্যারের কথা মতো আমি তাকে অনুসরণ করলাম। চিন্তা-ভাবনা কেমন যেন আড়ষ্ট হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে, যা কিছু হয় হোক, তাতে গা ভাসিয়ে দেই।
স্যার আমাকে একটা খাঁচার সামনে নিয়ে গেলেন। বললেন, “তোমাকে প্রাণীটার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেই। এই প্রাণীটা রাতে এই পুরো বাড়িটা পাহারা দেয়।”
আমি খাঁচাটার দিকে তাকালাম। প্রাণীটা অন্যসব প্রাণীর মতোই অদ্ভুত। তারপরও দেখে গাটা শিউরে উঠল। দুটো মানুষের কোমর একসঙ্গে করে একটা এলসেশিয়ান কুকুরের ধরে জুড়ে দেয়া। সারা দেহ কালো কালো লোমে আবৃত। মুখ দুটো দিয়ে ধারালো শ্বদন্ত বের হয়ে আছে।
“প্রাণীটা যা দেখছো, ওটা শুধু তাই নয়। ওর মধ্যে জেনেটিক্যালিও একটু পরিবর্তন করেছি। হায়নার জিন থেকে হিংস্রতা ঢুকিয়ে দিয়েছি একটু। আর মানুষ দুটোর মস্তিষ্কের আবেগ-অনুভূতি, সুস্থ চিন্তার অংশগুলো মানে সেরেব্রাল কর্টেক্সের সিংহভাগ কেটে বাদ দিয়েছি। এখন ওটা আর যাই থাক, অন্তত মানুষ নয়। বেঁচে থাকতে গুন্ডা ছিলো দুটো। এখন আমার বাড়ির পাহারাদার। এই কয়েকদিন আগেও একটা চোরকে জ্যান্ত পাকড়াও করেছে। সেই চোরটারও ব্যবস্থা অবশ্য হবে। সাহস কত! বাড়িতে ঢোকে আমার। যাই হোক, তোমার গন্ধ শুঁকিয়ে দেই প্রাণীটাকে। তাহলে আর রাত-বিরাতে তোমাকে দেখলে আক্রমণ করে বসবে না। দাও, রুমালটা দাও তোমার।”
স্যার আমার রুমালটা নিয়ে প্রাণীটাকে শুঁকিয়ে দিলেন।
“ও, আরেকটা কথা তোমাকে বলা হয়নি।” বললেন স্যার। “এ কদিন তোমার রাতের খাবারে ঘুমের ওষুধ মেশানো হচ্ছিল। এখন থেকে আর হবে না। ভয় ছিল, এসব জানবার জন্য তোমার একটু সময় দরকার ছিল।”
কথাটা শুনে আমি চমকে উঠলাম। এজন্যই রাতের খাওয়া হয়ে গেলে আমি মরে যেতাম ঘুমে?
“কী ব্যাপার? কথা বলছ না যে?” আমি যে তেমন একটা কথা বলছি না, স্যার সেটা লক্ষ্য করেছেন।
“আসলে, স্যার, কী বলবো, বুঝতে পারছি না।” আমার খুব একটা কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। দম বন্ধ হয়ে আসছে।“আমার ভেতরটা হঠাৎ একটা নাড়া পেয়েছে।”
“প্রথম দেখছো তো, এমন হওয়াই স্বাভাবিক। সময় যাক, মানিয়ে নাও। আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে।”
আমি কিছু বললাম না।
“যাইহোক,” বললেন স্যার। রুমটার শেষে একটা সিড়ির দিকে ইঙ্গিত করলেন। সিড়িটা ওপরের দিকে উঠে গেছে। “প্রাণীটাকে ওই ওদিক দিয়ে বাইরে পাঠানো হয়। সিঁড়িটার মাথায় বাড়ির পেছনে একটা দরজা আছে। দেখে থাকবে হয়তো।”
বুঝলাম, কোন দরজাটার কথা বলা হচ্ছে। “জি স্যার।” বললাম ছোট্ট করে।
এরপর স্যার আমাকে একটা বাচ্চাকে দেখালেন, বারো তেরো বছর বয়স। ঘরের এক কোনায় লাইফ সাপোর্ট দিয়ে রাখা। দেখে বুঝতে পারলাম, সম্প্রতি ছেলেটার কোনও অপারেশন হয়েছে। আর সেটা যে স্যারই করেছেন, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই।
একটা বাচ্চাকেও শেষ পর্যন্ত…
“তুমি সেদিন আমাকে যে শিম্পাঞ্জির কলিজাটা পরীক্ষা করে দিয়েছ, সেটা কী করেছি জানো? এই বাচ্চাটার শরীরে বসিয়েছি। তুমি তো জানো, শিম্পাঞ্জির সঙ্গে মানুষের জেনেটিক প্রভেদ খুব একটা নেই। এক-দুই পার্সেন্ট অমিল। এখন যদি বাচ্চাটা বেঁচে যায়, তবে এরপর থেকে কারও কলিজার অসুখে; যেমন, মনে করো লিভার ক্যান্সার হলে; শিম্পাঞ্জির কলিজা দিয়ে বদলে দিলেই হবে।”
“স্যার, আপনার মনে হয় না কেউ বাচ্চাটাকে ব্যবহার করা নিয়ে প্রশ্ন তুলবে?” জিজ্ঞেস করলাম।
“না, সেরকম প্রশ্ন করার তো সুযোগই আসবে না। বাচ্চাটার কথা কেউ জানবে, ভেবেছো? আমি ব্যাপারটা একটা থিওরি হিসেবে পাবলিশ করব। এরপর এটা নিয়ে পরীক্ষা হবে। লিভার ক্যান্সারের কোনও রোগী হয়তো ভলান্টিয়ার হতে চাইবে। আর তখন আমি ব্যাপারটা প্রমাণ করে দেবো। তবে তার আগে যে জিনিসটা কাজ করে, তা তো আমাকে জানতে হবে। সেজন্যই এই পরীক্ষা।”
যতই শুনছি, ততই মাথা ঘুরছে। শ্রদ্ধেয় একজন মানুষের আড়ালে এরকম এক অমানুষ লুকিয়ে আছে, জানলে হয়তো ওঁর প্রতি শ্রদ্ধাবোধটা আসতো না।
“এদিকে আসো, তোমাকে আমার বর্তমানের সবচেয়ে বড় প্রজেক্টটা দেখাই।” বলে তিনি আমাকে একটা কাপড়ে ঢাকা খাঁচার সামনে নিয়ে গেলেন। তারপর একটানে সরালেন কাপড়টা। খাঁচাটায় যা দেখলাম তাতে আমার ভেতরটা নড়ে উঠল। মানুষের মতো একটা অবয়ব। তবে সাধারণ মানুষের চেয়ে আকারে বড়। দেহে চামড়া নেই। নগ্ন মাংস চক চক করছে অদ্ভুতভাবে। মাথায় চুলের বদলে কাটার মতো ছোট ছোট কতগুলো হাড়। চেহারার ঠিক মাঝখানে বড় আকারের একটা চোখ, পাতা নেই। মনিটা গোল হয়ে দৃষ্টি হানছে ভয়ানকভাবে। ঠিকরে বের হয়ে আসতে চাইছে যেন। মুখে আবার কোনও ঠোঁট নেই। ঠোঁটহীন দাতের পাটিগুলো দেখে শিউরে উঠতে হয়। মানুষের হাড় মাংসের ভেতরে থাকলেও জিনিসটার বুকের হাড়গুলো মাংসের বাইরে। নগ্ন চামড়ায় সাদা হয়ে যেন জ্বলছে। আর যেখানে জননাঙ্গ থাকবার কথা, সেখানে কিছুই নেই, ¯্রফে মাংস, নিরেট।
কাপড় সরাবার সঙ্গে সঙ্গে জিনিসটা দৌড়ে এলো খাঁচার শিক বরাবর। এসে ধাক্কা খেলো খাঁচাটার শিকে। খাঁচাটা নড়ে উঠল। আর পশুটা গুঙ্গিয়ে উঠল মেঝেতে পড়ে। বাতাসে জিনিসটার গন্ধ এসে নাকে আঁচড় কাটলো। পচা ডিমের মতো বোটকা একটা গন্ধ। পেট গুলিয়ে উঠল আমার।
“জিনিসটা একটা বায়ো ওয়েপন।” স্যার বলতে শুরু করলেন। “আমি এর নাম দিয়েছি ‘অমানব’। বিগত তিন বছর যাবৎ আমি এটার পেছনে কাজ করছি। জিনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং করে তৈরি করা, সম্পূর্ণ আমার নিজের খুশিমতো। হিং¯্রতা, ক্ষিপ্রতায় অনন্য। মাস প্রডাকশনে গেলে খরচও পড়বে খুব কম। তুমি এ জিনিসটাকে সহজে থামাতেও পারবে না। অস্ত্র-শস্ত্রও কাজ করবে না এর ওপর। যেকোনও ক্ষত; মানে নষ্ট কোষ; রিজেনারেট করে নেবে। কিন্তু সমস্যা একটাই, তা হল পুষ্টি। প্রতি আট ঘন্টায় পুষ্টি দিতে হয় একে। নয়তো আট ঘন্টা হলেই জিনিসটার পুরো দেহ বাষ্প হয়ে উড়ে যাবে। এর পেছনে অবশ্য গাঠনিক কিছু ব্যাপার আছে। সেগুলো তোমাকে বলছি না। তবে এ সমস্যাটা কোনও সমস্যাই না। যেকোনও দেশ এটাকে হাতিয়ার হিসেবে পেতে চাইবে। যুদ্ধক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন হবে এটা পেলে। আবিষ্কারটা কত তাৎপর্যপূর্ণ, বুঝেছো?”
আমি কোনও উত্তর দিলাম না। শুনতে থাকলাম। ইতোমধ্যেই জিনিসটা সোজা হয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে।
“তবে অমানবের কাজ এখনও সম্পূর্ণ হয়নি, বুঝলে? কমপ্লিট করতে হলে আরও একটা কাজ করতে হবে। ইলেক্ট্রিসিটি ব্যবহার করে জিনিসটায় প্রাণ সঞ্চার করেছি বটে, কিন্তু এর চেতনা বলতে কিছু নেই। নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ নেই এর। যাকেই সামনে পাবে তাকেই খুন করে ফেলবে। আল্টিমেট কিলিং মেশিং বলতে পারো। এখন যেটা করা বাকি, তা হচ্ছে আমার চেতনার একটা অংশ এর মাঝে প্রবেশ করানো। তাহলে, অমানবকে আমার খেয়াল খুশিমতো ব্যবহার করতে পারবো। এখন, তোমার কাজ হচ্ছে জিনিসটাকে প্রতি আট ঘন্টায় পুষ্টি দেয়া। ওই যে যন্ত্রটা দেখছো?”
স্যার আঙুল তুলে দেখালেন। আমি তাকিয়ে দেখলাম, খাঁচার উপরটায় সিলিন্ডার আকারের একটা কণ্টেইনার। খাঁচার পাশে একটা ধাতব সিঁড়ি, কন্টেইনার পর্যন্ত পৌঁছানোর জন্য। কন্টেইনারের নিচটা কোণকের মতো সরু। সেখান থেকে একটা পাইপ নেমে গেছে। সেই পাইপ থেকে আবার সূতার মতো সুক্ষ্ম সুক্ষ্ম টিউব বের হয়ে এসেছে নিচে। নিচে এসে পশুটার গায়ে বিভিন্ন জায়গায় সূচ ফোঁড়া হয়ে ঢুকে গেছে। টিউবগুলো খুব সূক্ষ্ম হওয়ায় এতক্ষণ আমার চোখে পড়েনি।
“ওই যন্ত্রটায় পুষ্টি দিতে হবে তোমার। যদিও আমি বেশ পরিমাণে পুষ্টি তৈরি করে রেখেছি, পুষ্টি তৈরির ব্যাপারটা তোমাকেও শিখিয়ে দেব। তাহলে তুমিও ওগুলো তৈরি করতে পারবে। তবে সাবধান, খাঁচাটার কাছে যাবে না। তোমার আগে যে আমার ল্যাব এসিস্ট্যান্ট ছিল, সে বেশি কাছে চলে গিয়েছিল খাঁচাটার। অমানব ওকে বাগে পেয়ে একেবারে ছিঁড়ে-ফুঁড়ে ফেলেছিল। যা একটা সমস্যা হয়েছিল তখন! ও যদি এভাবে মারা না যেত, তাহলে তুমি হয়তো এখানে থাকতে না।”
সবকিছু শুনে শুধু একটা জিনিসই মনে হচ্ছে; এই বাড়িটা শুধু মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলার একটা কারখানা! আর আমি নিজের অজান্তেই তার অংশ হয়ে গেছি। ভালো লাগছে না আমার। একটুও ভালো লাগছে না। সবকিছু অশুভ লাগছে, কেমন অসহ্য লাগছে! চিন চিন করছে মাথাটা। আমি ঘরে ফিরে যাব। গিয়ে ঠান্ডা পানি খাব এক গ্লাস। মনটাকে শান্ত করা দরকার।
এরপর… আমি স্যারকে বললাম কথাটা।
(৯)
রাতটা আমি ঘুমোতে পারলাম না ঠিক মতো। কীভাবে কীভাবে যেন সারাটা রাত কেটে গেল। মাঝে দুয়েকবার চোখ বুঁজে এসেছিল ঘুমে। তখন ভয়ানক সব দুঃস্বপ্ন দেখে দেখে জেগে উঠেছি। বাইরে ইতোমধ্যেই ভোরের আলো ফুটে গেছে। জানালার ফাঁক-ফোকর দিয়ে আবছা আলো ভেতরে এসে জানান দিচ্ছে, শুরু হতে যাচ্ছে নতুন একটা দিনের। বিছানা ছেড়ে আমি বারান্দার দিকে পা বাড়ালাম। ব্যালকনির দরজা খুলতেই হু হু করে সকালের হাওয়া খানিক ছুঁয়ে দিয়ে গেল। কেমন শীত শীত লাগতে শুরু করলো। বারান্দায় গ্রিল নেই, খোলা একটা ব্যালকনি। বাড়ির পেছনটা দেখা যায় এখান থেকে।
নতুন দিনের প্রকৃতি এখনও মনে হয় আড়মোরা ভাঙেনি। সূর্যটা সবে মাত্র উঁকি দিতে শুরু করেছে। গাছগুলো সব জবুথবু হয়ে দাঁড়িয়ে। পাখ-পাখালিরাও এখনও গুটিসুটি মেরে পড়ে আছে নিজেদের নীড়ে।
আমি একটা সিগারেট হাতে নিলাম। এমন নয় যে সিগারেট খাওয়াটা আমার অভ্যাস। তবে যখন দুশ্চিন্তায় থাকি, সিগারেটের দরকার পড়ে আমার। এখনকার ব্যাপারটাও ঠিক তেমনই। আমি সিগারেটের মাথায় আগুন জ্বালিয়ে লম্বা একটা টান দিলাম। ভোরের শীতল বাতাসের সঙ্গে সঙ্গে ধোঁয়াটুকু নিশ্বাসে আরামদায়ক উষ্ণতায় মিশে গেল।
এই বাড়িতে যা হচ্ছে বা স্যার যা যা করেছেন, স্পষ্টত সেগুলো অন্যায়। মানবতাওয়ালা কোনও মানুষ ওগুলো করতে পারে না। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আমি কী করব? স্যার বন্ড সই নিয়েছেন আমার কাছে। মোটা অংকের মাইনে দিচ্ছেন। সুযোগ-সুবিধাও এখানে বেশ ভালোই। তার ওপর, স্যারের সঙ্গে কাজ করলে নিঃসন্দেহে আমি অনেক কিছু জানতে ও শিখতে পারব, যা সাধারণভাবে পারতাম না। এখন কি তাহলে এসবের কাছে আমি আমার মনুষ্যত্বটুকু বিসর্জন দিয়ে দেব, নাকি না?
আমার বাবার কথা মনে পড়ছে। বাবা সবসময় বলতেন, “বুঝলি শাফায়েত, জীবনে অনেক সমস্যাই আসবে। কিন্তু কখনও কোনও অন্যায়ের সঙ্গে আপোষ করবি না।”
তিনি ড্রয়িং রুমের সোফায় বসে বসে পত্রিকা পড়তেন। আমার বয়স তখন চৌদ্দ কী পনেরো। আমি যদি হুট করে তার সামনে চলে যেতাম, তিনি পত্রিকা পড়া থামিয়ে আমার দিকে তাকাতেন। চশমার গোল গোল কাচের মধ্য দিয়ে তার চোখদুটো বড় বড় হয়ে ফুটতো, যেন তিনি বেশ অবাক হয়েছেন আমাকে দেখে! তারপর হুট করেই তার দৃষ্টি স্বাভাবিক হয়ে যেতো। তিনি বলতেন, “বাবা আয়, পাশে বস। দুটো গল্প করি। কাজের চাপে তো তোদের সময়ই দিতে পারি না।”
কথাটা আসলেও সত্যি। বাবা ছিলেন একজন ফরেস্ট অফিসার। বেশিরভাগ সময়ই তাকে বাইরে ডিউটি করতে হতো। বাড়িতে থাকার সুযোগ পেতেন খুব কম।
আমি তখন বাবাকে অজুহাত দেখাতাম, “বাবা, আমার তাড়া আছে। স্যার অনেকগুলো বাড়ির কাজ দিয়েছেন, সেগুলো গোছাতে হবে।”
বাবা তখন ধমক দিতেন খানিকটা। “আরে, বস বেটা! বাপের সঙ্গে বসে বসে দুটো গল্প করলে এমন কিছু দেরি হয়ে যাবে না। নাহলে কিন্তু কান ধরে বসাবো।”
কান ধরার ভয়ে, নাকি বাবার গল্প শোনার লোভে; জানি না কী কারণে আমি তখন বাবার ঠিক পাশে বসে যেতাম। এরপর বাবা তার ঝুলি থেকে চমৎকার চমৎকার সব গল্প ঢেলে দিতেন। বেশিরভাগই তার অভিজ্ঞতার। আমি দুচোখে মুগ্ধতা নিয়ে শুনতাম। মাঝে মাঝে রান্নাঘর থেকে মা এসে আমাদের দেখে যেতেন। বাবা তখন খেঁকিয়ে উঠতেন খানিকটা, “কী দেখছো অত, হুমম? তোমার ছেলেকে মানুষ বানাচ্ছি, মানুষ। জীবন সম্পর্কে তো কিচ্ছু জানে না।”
অবশ্য বাবার কণ্ঠে কোনও রাগ থাকতো না, বরং কেমন যেন একটা আত্মতৃপ্তি। মা তখন মুখ মটকে বলতেন, “এত খেঁকাচ্ছ ক্যান শুনি? তোমার গল্প কি আমি শুনলে দোষ হবে?”
“শুনবে নাকি? তাহলে পাশে এসে বসো। তারপর মন দিয়ে এই বুড়ো খাটাশের গল্প শোনো। শুনে শুনে তুমিও একটু মানুষ হও। কে আটকিয়েছে?”
আমি পাশ থেকে বলতাম, “বাবা, তুমি মোটেও বুড়ো খাটাশ না।”
আর মা বলে উঠতেন, “হয়েছে, হয়েছে। আমার অত গল্প শোনার টাইম নাই। রান্না উঠিয়ে আসছি চুলায়। পুড়ে যাবে। আর আমি যথেষ্টই মানুষ হয়েছি, এখন আপনারা বাপ-বেটা মিলে মানুষ হন। হয়ে আমাকে উদ্ধার করেন।”
বলে মা হন হন করে হেঁটে চলে যেতেন। আর বাবা হাসতে থাকতেন আমার কাঁধে হাত জড়িয়ে। আমি তখন বাবাকে দেখতাম। বাবার হাসিটা আমার খুব ভাল্লাগতো। নিষ্পাপ-সরল একটা হাসি, আমার মনে দাগ কাটতো খুব।
কখনও কখনও বাবা গল্প বলার ফাঁকে ফাঁকে বলতেন, “এই দেশের অনেক সমস্যা, বুঝলি, শাফায়েত? একা কারও পক্ষে সেসব দূর করা কখনওই সম্ভব না। কিন্তু সবাই যদি নিজের জায়গা থেকেই অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়, ন্যায় ও সত্যের পথ অবলম্বন করে, তাহলে দেখবি অনেক সমস্যাই দূর হয়ে গেছে। অনেক কিছুই খুব সহজ হয়ে গেছে। সেজন্যই তোকে বলি, অন্যায়ের সঙ্গে কখনও আপোষ করবি না। হোক না সেটা খুব ছোট্ট, কিন্তু তোর মতো আরও মানুষের ছোট্ট ছোট্ট কাজগুলো মিলে দেখবি, বড় কিছু হয়ে গেছে।”
আমি শুনতাম কথাগুলো। মনে প্রাণে সেগুলো বিশ্বাস করতাম, এখনও করি। বাবাকে দেখে তখন অদ্ভুত একটা শ্রদ্ধাবোধ হতো। আমার মনে ইচ্ছে জাগত তার মতো হতে, তার আদর্শগুলোকে নিজের মাঝে লালন করে।
তারপর বাবা মারা গেলেন।
আমি ওইদিন রাতে পড়ার টেবিলে বসে হোমওয়ার্ক গুছাচ্ছিলাম। আমার এখনও মনে আছে। অনুভূতিটা এত জীবন্ত, ধাক্কাটা এত গাঢ়! মনে হলে এখনও আমার বুকটা নাড়া দিয়ে ওঠে। মা তখন রান্নাঘরে রাতের খাবার তৈরি করছিলেন। এমন সময় খবরটা এলো। ফরেস্ট অফিসের একজন লোক ফোন করে জানালেন, বাবা আর নেই।
মাই ধরেছিলেন ফোনটা। সে সময় তার হাতে একটা চালভর্তি স্টিলের গামলা ছিল। যেই তিনি খবরটা শুনলেন, তার হাত থেকে পড়ে গেল গামলাটা। এরপর গামলাটার মেঝেতে আঘাত হানার শব্দ সারা বাড়িতে আঁছড়ে পড়লো। পড়ার টেবিলে আমি একটা অংক মেলাচ্ছিলাম, শব্দটা আমার কানেও আঁচড় কাটলো। সঙ্গে সঙ্গে মনে হল, কিছু একটা ঠিক নেই। আমি ছুটে গেলাম শব্দের উৎসটা লক্ষ্য করে। গিয়ে দেখি, সারা ঘরে চাল ছড়িয়ে ছিটিয়ে একাকার, মা মেঝেতে বসে কান্নায় ভেঙে পড়েছেন। আমাকে দেখতেই জড়ানো গলায় ভাঙা ভাঙা স্বরে বললেন, “তোর বাবা আর নেইরে শাফায়েত…”
কথাটা বুঝতে আমার একটু সময় লাগলো। উপলব্ধিটা ভারী কিছুর মতো আঁছড়ে পড়লো আমার ওপর, আমাকে জমিয়ে দিলো। আমি স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। এটা সত্যি হতে পারে না। অবশ্যই এটা একটা কৌতুক, একটা ইয়ার্কি! হঠাৎ করে আমার সবল-সুস্থ বাবা মারা যেতে পারেন না। হঠাৎ করেই হারিয়ে যেতে পারে না আমাদের পরিবারের ছায়াদায়ী বৃক্ষটা। ভুল হয়ে গেছে…কোথাও নিশ্চয়ই মস্ত বড় একটা ভুল হয়ে গেছে। মাকে বললাম, “মা, তুমি মিথ্যে বলছো।”
মা কোনও উত্তর দিলেন না। আর্তনাদ করে শুধু অশ্রু ঝরাতে লাগলেন। তার চোখে এমন একটা কিছু দেখলাম, যাতে আমি মেনে নিতে বাধ্য হলাম কথাটা-আমার বাবা আর নেই…
আমরা থাকতাম খুলনায়। আর বাবার পোস্টিং ছিল সুন্দরবনে। মৃত্যুটাও তার ওখানে, একটা দুর্ঘটনায়। ফরেস্ট অফিসাররা মাঝে মধ্যেই শিকারে যান। আমার বাবাও গিয়েছিলেন শিকারে। দোনলা একটা বন্দুক সঙ্গে ছিল তার আর একজন পিয়ন। বাবা গিয়েছিলেন হরিণ শিকার করতে, কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে একটা রয়েল বেঙ্গল টাইগারের সামনে পড়ে যান। প্রতক্ষ্যদর্শী কেউ ছিল না। বাবা যখন বাঘটার সামনে পড়েন, সঙ্গের পিয়নটা তখন দূরে। পরে সেই লোকটা বাঘের গর্জন শুনে বন্দুক উঁচিয়ে ফিরে এসে দেখে, বাঘটা ঝুঁকে রয়েছে বাবার লাশের ওপর, কামড়ে ধরেছে গলায় আর বাবার বন্দুকটা পড়ে আছে একটু দূরে। লাশটা ক্ষত-বিক্ষত, নখের আঁচড়ে মাংস কেটে ফালা ফালা হয়ে গেছে। পিয়নটা তখন সঙ্গে সঙ্গে গুলি করে। বাঘটার পেটেও লাগে একটা গুলি। তবে বাঘটা তাতে মরেনি, ছুটে পালিয়েছে। পরে লোকটা ফরেস্ট অফিসের সঙ্গে যোগাযোগ করে বাবার লাশটা বন থেকে নিয়ে আসে।
পরদিন একটা কফিনে করে বাবার লাশটা আমাদের বাড়িতে আনা হল। ওটা দেখাবার জন্য যখন কফিনের ডালাটা খোলা হল, নড়ে উঠল আমার ভেতরটা। কফিনের ভেতর বাবার ক্ষত-বিক্ষত লাশ, মুখটা রক্তাক্ত, লাল, মাংস কেটে ফালা ফালা, ঠিক করে চেনা গেল না। সঙ্গে সঙ্গে আমার পৃথিবীটা দুলে উঠল। মাটি যেন সরে গেল পায়ের নিচ থেকে। বুকের ভেতর অদ্ভুত এক শূন্যতা এসে বাসা বাঁধলো। গাঢ়, গভীর, বিষণ্ন এক শূন্যতা। আমার অস্তিত্বটাকে ভীষণ অসহায় লাগতে শুরু করল। আমি তখন ওখানে, বাবার লাশটার ঠিক সামনেই মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম, বাবার শেখানো আদর্শগুলো আমি রক্ষা করব। কখনও কোনও অন্যায়ের সঙ্গে আপোষ করব না।
সিদ্ধান্তটা এখন স্পষ্ট।
কোনওমতেই আমি আমার মনুষ্যত্ব বিসর্জন দেব না। স্যারের কাজগুলো অন্যায় এবং আমাকে এর প্রতিবাদ করতে হবে। আমি যদি এর প্রতিবাদ না করি, আমার মৃত বাবার সামনে করা প্রতীজ্ঞার বরখেলাপ করা হবে। আর আমি তা কখনওই করব না। নিজের সামর্থে যতটুকু পারি, ততটুকু চেষ্টা অবশ্যই করব। স্যারকে আটকাতে আমার কিছু একটা করতেই হবে।
এরপর হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে আমি আমার ভেজা চোখদুটো মুছে নিলাম।
(১০)
ঠিক করলাম, স্যারের সঙ্গে এ নিয়ে কথা বলব। তাকে বন্ধ করতে বলব সবকিছু। তিনি শুনলে তো ভালোই। আর না শুনলে, কী করা যায়, ভাববো। হয়তো পুলিশের কাছে যাব, কিংবা পত্রিকার কাছে। এখন তা নিয়ে মোটেও ভাবছি না। সেটা বরং পরেই দেখা যাবে।
তবে সকালে স্যারের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ হল না। তিনি বেশ নিয়ম-নিষ্ঠ, ঘড়ি ধরে চলাফেরা করেন। সকালে উঠে প্রয়োজনীয় কাজ-কর্ম সেড়ে খেয়ে-দেয়ে ভার্সিটি চলে গেলেন। তার সঙ্গে কথা বলার জন্য আমাকে বিকেল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হল। বাইরে আকাশে রোদ তখন পড়তে শুরু করেছে। সন্ধ্যা হয়ে যাবে ঘন্টা দুয়েক পর।
স্যার তখন ভার্সিটিতে ক্লাস নিয়ে ফিরে এসেছেন। আমি গিয়ে দেখলাম, উনি একটু রেস্ট নিচ্ছেন বিছানায় আধশোয়া হয়ে। পরনে লুঙ্গি, ঢিলে হয়ে আছে। ঘরের এসিটা চলছে। স্যারের হাতে একটা জার্নাল।
আমাকে দেখার পর স্যার উঠে বসে পাশে রেখে দিলেন জার্নালটা। আমাকে বললেন, “কিছু বলবে?”
একটু দ্বিধা হল, শেষ ধাপে পৌঁছে পূর্ব আশংকার মতো। তবে দ্বিধা ঝেড়ে বলারই সিদ্ধান্ত নিলাম। “জি স্যার, একটা কথা।”
“কী?”
“আমি এসব কাজ করতে পারব না।” মনে মনে প্রমাদ গুনলাম।
“কী বললে? বুঝলাম না।”
“আমি আপনার এসব রিসার্চে সাহায্য করতে পারব না, স্যার। কাজটা আমি ছেড়ে দেবো। আমার দ্বারা এরকম অমানবিক, মনুষ্যত্বহীন ও বিবেক-বর্জিত কাজ করা সম্ভব নয়।”
“তুমি কিন্তু কাজটা নেয়ার আগে বন্ডে সই করেছো।” স্যারের চোখে খানিক বিস্ময়ের আভাস ফুটে উঠল। “আমি তোমাকে যা বলবো, তাই তোমার করার কথা।”
“সরি স্যার, আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, এই কাজ আমি আর করবো না। একজন মানুষ হয়ে অন্য কোনও মানুষের সঙ্গে এমন নিকৃষ্ট কাজ করতে আমার বিবেক আমাকে কোনওভাবেই সায় দেবে না।”
“ঠিক আছে, তুমি যদি এসব করতে না চাও, তাহলে ইস্তফা দিতে পারো। আমার তেমন কোনও আপত্তি নেই। তবে, কথা একটাই, মুখ বন্ধ রাখতে হবে। আমি কোনও ঝামেলায় পড়তে চাই না।”
আমি বেশ অবাক হলাম। স্যার এত সহজে মেনে নিলেন? তবে এখনও একটা কাজ বাকি। “স্যার, আপনার কি মনে হয় না এসব অন্যায়?” সাহস করে তাকে বলেই ফেললাম, “আপনাকেও এসব থেকে সরে আসতে হবে।”
“দেখ, বাজে কথা বলবে না।” স্যার গর্জে উঠলেন। “কী হিসেবে অন্যায় বলছো, হ্যাঁ? এসব কাজ করেছি বলেই হাজার হাজার মানুষের উপকার হয়েছে। দুরারোগ্য ব্যধির হাত থেকে মুক্তি পেয়েছে তারা। আর বড় কিছু অর্জনের জন্য একটু বড় আত্মত্যাগ করতেই হয়। এর কোনও বিকল্প নেই। ইতিহাস খুঁজে দেখ, আমার কথা ভুল কিনা বুঝতে পারবে? আমি ভেবেছিলাম, তুমি শিক্ষিত ছেলে, তোমার এসব বোঝার ক্ষমতা রয়েছে। কিন্তু এখন দেখছি, তুমিও একটা ইমোশনাল ফুল ছাড়া আর কিছুই না। তোমার চিন্তা-ভাবনাও আচ্ছন্ন হয়ে আছে।”
“জি না, স্যার। চিন্তা-ভাবনা আমার মোটেও আচ্ছন্ন হয়ে নেই। আমি ভালো করেই জানি, কাজটা অন্যায়। আপনি আপনার মনুষ্যত্ব হারিয়ে অন্ধ হয়ে আছেন। সাফল্যের নেশায় অন্যায় করতেও আপনার হাত কাঁপছে না। কিন্তু বিজ্ঞানের যে অগ্রগতি অর্জনের জন্য মানুষের ক্ষতি করতে হয়, সে অগ্রগতি আদৌ কাম্য নয়। মানুষের জন্যই বিজ্ঞান, বিজ্ঞানের জন্য মানুষ নয়, স্যার। আপনাকে এসব বন্ধ করতে হবে।”
“তোমার মতো দু’দিনের পুঁচকে ছেলের কথায় আমি এগুলো বন্ধ করবো? নো, নেভার! নিজেকে কী ভাবছো তুমি? আর তাছাড়া যাদেরকে ব্যবহার করেছি ওরা বেঁচে থাকলেও দেশ ও জাতির কোনও উপকার হতো না। নর্দমার কীটগুলো বরং সবার ক্ষতি করে বেড়াত। তার চেয়ে আমার এক্সপেরিমেন্ট এর অংশ হয়ে কাজে লেগেছে।”
“তবুও ওরা মানুষ ছিলো, স্যার।” বললাম আমি। “আপনি যেটা করছেন, সেটা কোনও সুস্থ মানুষের পক্ষে করা সম্ভব না। আপনাকে আমি আগে শ্রদ্ধা করতাম। কিন্তু কাল রাতের পর থেকে সে শ্রদ্ধাটুকু উবে গেছে। আপনি এগুলো বন্ধ করুন, স্যার। নইলে আমাকে অন্য ব্যবস্থা নিতে হবে। একজন বিবেকবান মানুষ হিসেবে আমি এগুলো কখনওই সহ্য করব না।”
“কী বলতে চাচ্ছো তুমি? তুমি কি আমাকে হুমকি দিচ্ছো?” স্যারের কণ্ঠে আগুন ঝড়ছে। “শোনো ছেলে, তুমি আমার কিচ্ছু করতে পারবে না। যাই করো না কেন, তোমার মতো সেদিনের খোকা আমাকে আমার আদর্শ থেকে কখনওই সরাতে পারবে না। তোমার সাহস কী করে হয় এসব বলার? রাগে আমার গা কাঁপছে। তোমাকে যে আমি…”
“তাহলে, স্যার, আমি সবাইকে জানাতে বাধ্য হবো।” পাল্টা বললাম, “আপনি যদি এসব বন্ধ না করেন, আমি পুলিশের কাছে যাব। পত্রিকার লোকজনের কাছে সব ফাঁস করে দেব।”
“দেখ, তুমি কিন্তু বন্ডে সই করেছো।” দাঁত কিড়মিড় করে বললেন স্যার।
“বন্ডের কথা বলে লাভ নেই, স্যার।” আমারও মাথায় যেন রক্ত উঠে গেছে। “আপনিও জানেন, আপনার এই বন্ডের কোনও মূল্য নেই। কাকে দেখাবেন? কাকে বলবেন যে, এই ছেলেটাকে আমি বন্ডে সই করিয়েছি, অথচ, এই ছেলেটা আমার সব অপকর্ম ফাঁস করে দিচ্ছে?”
“তোমার কি আরও টাকা লাগবে?” হঠাৎ স্যারের কণ্ঠ কেমন কোমল হয়ে গেল। “দেখ, আমাদের সবারই টাকার প্রয়োজন। তোমার যদি আরও টাকা লাগে, বলতে পার। আমি মাইন্ড করব না। দরকার হলে মাসে তোমাকে দেড়; দু’লাখও স্যালারি দিতে পারব।”
“জি না স্যার। আমি মোটেও টাকার জন্য এসব করছি না। আমার একটা মূল্যবোধ আছে। আমার মৃত বাবার কাছে আমি একটা প্রতিজ্ঞা করেছি। টাকা দিয়ে আপনি অন্তত আমার মুখ বন্ধ করতে পারবেন না। আপনাকে শেষবারের মতোই বলছি, আপনি এসব বন্ধ করুন, নাহলে আমি উপযুক্ত ব্যবস্থা নেব।”
কথাটা শুনে স্যার খেপে গেলেন। রেগে-মেগে খাটের মাথায় ঘুষি মারলেন একটা। বললেন, “তোমার মতো সেন্টিমেন্টাল মানুষকে কীভাবে শিক্ষা দিতে হয়, আমার জানা আছে। সীমা ছাড়াতে নেই কখনও, বুঝেছো? তোমার সীমা ছাড়ানোর শাস্তি তোমাকে পেতে হবে।”
এরপর তিনি ফোনটা কানে তুললেন। কাকে ডায়াল করেছেন, বুঝতে পারছি না। অপর পাশে যখন কথা বললেন, নামটা শুনে বুঝতে পারলাম তখন। আর স্যারের গলার স্বরটা ভয়াবহ রকমের শীতল। “রহমত, আমার ঘরে এসো। আসার সময় স্টান্ট গানটা নিয়ে আসবে। একটা বেয়াদবকে শায়েস্তা করতে হবে।”
“আপনি কী করবেন?” বললাম আমি, গলা শক্ত রেখে। মেজাজ আমারও ভয়াবহ রকমের খারাপ।
তিনি কিছু বললেন না। জানালা দিয়ে শুধু বাইরে তাকিয়ে রইলেন। তার মুখটা শক্ত হয়ে আছে।
অবশ্য, জানার জন্য বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না। একটু পর আমি বুঝতে পারলাম, তিনি কী করবেন?
স্টান্ট গান দিয়ে আমাকে শায়েস্তা!
(১১)
অন্ধকারে আফসার নামের লোকটা বুকে ফুঁ দিয়ে নিলো। ধরাস ধরাস কাঁপুনি আসছে সেখান থেকে। কবরস্থান জায়গাটা তার ভালো লাগে না। কিন্তু একভাবে ভাবলে দেখা যাবে, এই কবরস্থানের অনেক উপকার করেছে সে, ভবিষ্যতেও করবে। তার হাত হয়ে বেশ কজন মানুষ লাশ হয়ে এখানে এসেছে। অন্তত দশের মতো তো হবেই। কারণ, মানুষ খুন করাই তার কাজ। কখনও বা অপহরণ। আর সেটার একটা নেশা আছে। একবার খুন করলে আবার খুন করতে ইচ্ছা করে। তবে তার এই খুনি পরিচয় খুব বেশি মানুষ জানে না। সে সাবধানে কাজ করে, গা ঢাকা দিয়ে। আর সে রকম বড় কোনও খুনও করেনি বিধায় লাইনের বেশিরভাগ মানুষ তাকে খুচরা আফসার নামেই চেনে। জানে যে, সে টাকার বিনিময়ে খুচরা-খাটি কাজ করে দেয়।
কদিন আগেও তাকে এই কবরস্থানে আসতে হয়েছিলো। একটা জ্যান্ত মানুষ জোগাড় করতে। অবশ্য জ্যান্ত মানুষ যোগাড় করার জন্যই যে সে কবর স্থানে এসেছিলো, তা না। বরং জ্যান্ত মানুষটার পিছু করতে করতে এখানে এসে পড়েছিলো। মানুষটা ছিলো একটা বাচ্চা। তেরো-চৌদ্দ বছর বয়স। রাস্তার টোকাই।
স্যারের কথা মতো সেদিন তাকে একটা জ্যান্ত মানুষ ধরে নিয়ে যেতে হতো। রাত এগারোটায় সে যখন আকণ্ঠ মদ গিলে বেশ্যাপল্লীতে মৌজ-ফূর্তি করছিলো, তখনই আসে ফোনটা। ফোনে উনি জানান একটা জ্যান্ত মানুষ জোগাড় করে দিতে, দ্রুত, বাচ্চা হলে ভালো। লোকটা টাকা-পয়সা ভালোই ঝাড়ে নেহাত। নাহলে কি আর সঙ্গে সঙ্গে তখনই বেরিয়ে পড়ে সে? কিন্তু সমস্যা ছিলো অত রাতে বাচ্চা পাবে কোথায়? শুধু মাত্র একটা চান্স নিতে ভাবে, বস্তি এলাকায় একবার যাওয়া যাক। কাছাকাছিই তো ওটা।
ভাগ্য ভালো বলতে হয়, রাত বারোটার দিকে সে যখন ওদিকে যায়, কবরস্থানের কাছটায় চোখে পড়ে ছেলেটাকে। একা একা হন হন করে হাঁটছিলো। বাড়ি ফিরছিলো মনে হয়। সে তখন ছেলেটার পিছু নেয়। কবরস্থানের সামনে থেকে তুলে নেয় ছেলেটাকে। তার থেকে তখন মদের গন্ধ ছুটছিল, গন্ধে চারপাশ টং। ছেলেটা বোধহয় ভয়ই পেয়েছিল কিনা? শব্দ-গন্ধ পেয়েও পালায়নি।
এরপর লোকটা ছেলেটাকে নিয়ে ওই স্যারের বাড়িতে পৌঁছিয়ে দিয়ে আসে। লোকটা তারপর ওকে নিয়ে কি করলো, জানা নেই। তার কাজ ওই পৌঁছিয়ে দেয়া পর্যন্তই। অবশ্য তার আরও একবার করে ডাক পড়ে। তবে সে কথা এখন থাক। না বলাই ভালো। শুনলে গা গুলিয়ে উঠবে।
আজ আবার কবরস্থানে আসার উদ্দেশ্য হচ্ছে সদ্য সমাহিত কোনও তরুণীর লাশ যোগার করা। আবদারটা তার স্যারেরই, কিন্তু এবারই প্রথম একটা লাশ চাওয়া হল আফসারের কাছে। তাও আবার সদ্য সমাহিত তরুণী। কে জানে, কী করবে তাকে দিয়ে? জ্যান্ত মেয়ে হলে না হয় অনুমান করতে পারতো।
আফসারের কাছে খবর আছে, আজ বিকেলেই কবর দেয়া হয়েছে একজনকে। বিশ বছর বয়সী একটা মেয়ে। আত্মহত্যা করেছিল। কেন করেছিল, অত খবর আফসার জানে না। খবরটা তাকে দিয়েছে তার ইনফর্মার। কবরটা দেখিয়ে দেবার জন্যও ছেলেটার কাছেই কোথাও থাকার কথা।
প্যান্টের পকেট থেকে আফসার ফোনটা বের করে আনলো, চায়না ব্রান্ডের একটা স্মার্টফোন। এরপর কল লাগালো ইনফর্মারকে। আর তাছাড়াও একা একা ও জায়গায় ঢুকতে ভয় লাগবে তার। তার কারবার জীবন নিয়ে। মৃতদের জগত নিয়ে খেলার সাহস তার হয় না। নেহাত টাকার জন্যই…
“হ্যালো, কই তুই?”বলল সে।
…
“হারামির পুত। ফের বিটলামি? এক মিনিটের মইদ্যি কবর-স্থানের গ্যাটে আয়।”
…
“ফের কথা?”
…
“আর শোন, সঙ্গে কোঁদাল নিয়া আসিস একটা।”
…
“আচ্ছা। আছি আমি।” বলে ফোনটা রেখে দিলো।
কিছুক্ষণ পর এলো তার ইনফর্মার। সঙ্গে কোঁদাল, হাতে দুলছে। এক মিনিটের বেশি লেগেছে, সন্দেহ নেই।
“কী? এতক্ষণে আসার টাইম হইলো নবাবের?”
“ওই ওস্তাদ একটু…” সাফাই গাইতে শুরু করছিলো ইনফর্মার।
কিন্তু আফসার তাকে ধমক দিয়ে চুপ করালো। “হইছে… কবরটা দেখা এখন। বেশি ফাল পারিস না।”
“জে ওস্তাদ।”
ওরা কবর-স্থানের ভেতর ঢুকবে। কিন্তু সামনের গেট দিয়ে ঢোকা যাবে না, ঢুকতে হবে পেছনের ঘেরা টপকে। সামনের গেট দিয়ে ঢুকলে চৌকিদারের নজরে পড়ে যেতে হবে। অবশ্য, সে চৌকিদার এখনও জেগে আছে কিনা সন্দেহ।
যাইহোক, ওরা কবরস্থানের পেছন দিকে এলো। বাঁশের ঘেরা দেয়া, তার ওপর দিয়ে তাকানোর চেষ্টা করল; কাউকে দেখা যায় কিনা? কাউকে দেখা গেলো না, চৌকিদার বেটা ঘুমিয়েছে নিশ্চিত। কিন্তু কিছু কবরের ওপর দেখা গেলো আগুন জ্বলছে বিন্দু বিন্দু। আফসারের বুকটা ধ্বক করে উঠল। কি ওগুলো। মাথাটা আচ্ছন্ন হয়ে ছিল, ছোট বেলা থেকেই কবরস্থান নিয়ে বিভিন্ন ভয় প্রচলিত আছে মনে। সেটা যখন পরিষ্কার হয়ে এলো, খুচরা আফসার বুঝতে পারলো ওগুলো আগরবাতি।
তারপর ওরা ঘেরা টপকে কবর স্থানে প্রবেশ করল। আফসারের মনে হল, কিছু একটা বদলে গেলো বোধহয়। গা-টা হালকা শিউরে উঠল। তবে, ইনফর্মার আছে সঙ্গে। দুজন থাকলে আর কিবা ক্ষতি হতে পারে?
“এখন কবরটা দেখা তাড়াতাড়ি।” তাড়া দিলো আফসার।
ইনফর্মার ছেলেটা হাঁটতে শুরু করল, “এইদিকে আসেন।”
আফসার ছেলেটাকে অনুসরণ করতে শুরু করল। ছেলেটার বয়স বেশি নয়, বাইশ পেরিয়েছে সম্ভবত। গড়ন সুঠাম, চুল-দাঁড়ি ছ্যাঁচড় টাইপ। হাসিটা দেখলে পিত্তি জ্বলে। তারপরও ছেলেটাকে সইতে হয়। বিভিন্ন রকম কাজের খবর পাওয়া যায়, এজন্য।
“এই যে। এইটা।” বলল ছেলেটা, আঙুল তোলা কবরের দিকে।
খুচরা আফসার কবরটা দেখলো। অনুভূতি যেন কেমন খচ খচ করছে।
“ওস্তাদ, আমি এখন যাই। আপনে কাম করেন।”
ছেলেটার কথায় আফসার ভয় পেয়ে গেলো। এই কবরস্থানে, একা? “যাবি মানে? কই যাবি?”
“আরে ওস্তাদ, বোঝেন না? নতুন মাল আইছে একটা আইজ। খ্যাপ মারতে যামু। যা ডাগর দেখতে!” বলে পা বাড়ালো ইনফর্মার।
“ওই থাম। আমারে একলা ফেলায় যাবি না।”
“আরে কিচ্ছু হইবো না, ওস্তাদ। আপনের এত ভয়? এই কলিজা নিয়া অতগুলা মানুষ মারছেন ক্যামনে?” যেতে যেতেই বলল ছেলেটা।
খুচরা আফসার কাতর গলায় বলল, “আরে ভাই, বাঁইচা আছিলো হেরা। তোরে নাহয় কিছু বাড়তি টাকা দিমু।”
ছেলেটা গা করলো না। দুনিয়া উল্টে গেলেও খ্যাপটা তাকে মারতেই হবে। এই চান্স মিস করা যাবে না। ভোগটা সবার আগে করবে সেই। এজন্যে মোটা টাকা গুনতে হয়েছে তাকে।
আফসার একা দাঁড়িয়ে ভাবছে, কী করবে? এমন বিপদে পড়ে যাবে, ভাবেনি। কিন্তু না করেও উপায় নেই কাজটা। ঠিকঠাক কাজটা না করলে লোকটার কাছ থেকে কাজ আসা বন্ধ হয়ে যাবে তার।
ধুর! হবে না কিছু।
বাতাসটা কেমন ভারী। গুমোট গন্ধ। চোখ ঘুরিয়ে সে একবার কবরটার দিকে তাকালো। ধ্বক করে উঠল বুকটা। ভয় লাগছে। সে বুকে ফুঁ দিয়ে নিলো। কবরস্থান নিয়ে মাঝে মাঝে অনেক রকম গল্প শোনা যায়, কিন্তু সেগুলো খুব একটা সত্যি হয় না।
হতেও পারে। কে জানে?
আল্লাহ আল্লাহ করতে করতে সে কবরটা খুঁড়তে শুরু করলো। বিশ মিনিট কোঁদাল চালিয়ে সে দেখতে পেলো বাঁশের চাটাই আর বাঁশের টুকরা। আরেকটু খুঁড়ে সে বড়সড়ো একটা গর্ত তৈরি করে ফেললো, তার ঢোকার জন্য। এবারে সে সেখান থেকে বাঁশ, চাটাই সরিয়ে একটু জায়গা করে নিলো। তারপর নেমে পড়লো কবরে।
“কুইউইউইউই…” একটা রাতজাগা পাখি চিৎকার করে উঠল হঠাৎ!
আফসারের চেতনা ধাক্কা খেলো। প্রচণ্ড! বুকে তোলপাড় বয়ে গেল যেন। তার পা লাশটার কাফন জড়ানো পা ছুঁয়েছে। মনে হল, সেটা নড়ে উঠল!
সে যেন জমে গেলো। অসাড় হয়ে গেলো তার চেতনা। বুকের ভেতর লাফানো হৃদপিণ্ডটা জানান দিলো, আজ আর রক্ষে নেই!
তবে তেমন কিছুই হল না। কিছুক্ষণ অসাড় হয়ে থাকার পর সে বুঝতে পারলো, সবটা তার মনের ভুল! সে তখন লাশটা বের করে আনতে মনোযোগ দিলো। বেশ খানিকটা কসরত আর টানা হেঁচড়ার জোরে বের করে আনলো লাশটা! এনে শুইয়ে রাখলো কবরের পাশে। মাটিতে। বুক নাড়া দিচ্ছে ক্রমাগত। আরেকটু হলেই হার্টস্ট্রোক করে মারা পড়তো নির্ঘাত!
খানিক জিরিয়ে লাশটাকে পিঠে করে ছুটলো আফসার। দ্রুত কবরস্থান ত্যাগ করাটাই শ্রেয়। গেটের কাছে রাস্তায় পিকআপটা পার্ক করে রাখা। একবার সেখানে যেতে পারলেই হয়। সমস্যা হবে না আর।
এবার সে কবরস্থানের গেট দিয়েই বের হয়ে এলো। আর বের হতেই; হায় আল্লাহ! কী হইলো এইটা?; আফসার একটা টহলরত পুলিশের ভ্যানের সামনে পড়ে গেলো।
কবরস্থানের সামনে পার্ক করে রাখা পিকআপটা দেখে গাড়ি থামিয়েছিলো তারা।
(১২)
কাল রাতে শেষ কথা হয়েছিলো আফসার নামের লোকটার সঙ্গে। সদ্য সমাহিত তরুণী মেয়ের লাশ নাকি আছে একটা, জানিয়েছিলো সে। অথচ তারপর তার আর কোনও খবর নেই। অপেক্ষা করে করে মেজাজ গরম হয়ে গেছে ড. নাওয়াজ রহমানের। মন-মর্জিও রেগে-মেগে টং। এদিকে আবার শাফায়েতও সমস্যা বাঁধিয়ে দিলো।
হচ্ছে কী এসব?
ড. নাওয়াজ রহমান ফোনটা তুলে আফসারকে কল করলো। সকাল থেকেইে অফ পাওয়া যাচ্ছে সেটা। এবারও তার ব্যতিক্রম হল না। ওপাশ থেকে শোনা গেল, ‘দুঃখিত, এই মুহূর্তে মোবাইল সংযোগ দেয়া…’
তরুণীর লাশ শীঘ্রই চাই ড. নাওয়াজের। দেরি করা চলবে না। আজ বাদে কাল অমাবস্যা। কালকেই শেষ কাজটা করবে সে। অমানবে তার চেতনার একটা অংশ ঢোকাতে লুসিফারের সাহায্য নেবে। তবে এর জন্য তাকে খুশি করতে হবে প্রথমে। আর তাকে খুশি করতে হলে যে কাজটা করতে হবে, তার জন্যই দরকার তরুণী মেয়েটার লাশ। সেই লাশটার সঙ্গে যৌনকর্ম করে একটা রিচুয়্যাল করতে হবে ডক্টরকে। লুসিফার তখন খুশি হবেন, তার চেতনার একটা অংশ প্রবেশ করিয়ে দেবেন অমানবের দেহে।
বিজ্ঞান যতই এগিয়ে যাক, আধ্যাত্মিক কিছুর অস্তিত্ব অস্বীকার করা যায় না কখনওই। চব্বিশ বছর বয়সে এর প্রমাণ পেয়েছিলো ডক্টর। শয়তান পূজারী একটা দলের সঙ্গে বিবাদে জড়িয়ে পড়েছিলো তখন। এর ফলস্বরূপ সে যে ঘটনাগুলো অবলোকন করেছিলো, তা মনে করলে এখনও গা শিউরে ওঠে। তখনই বিশ্বাস আসতে শুরু করে লুসিফারের প্রতি। এরপর যখন দলটার সঙ্গে যোগ দিয়ে লুসিফারের পূজা শুরু করলেন, পাকাপোক্ত হয় বিশ্বাসটা। দলটার সঙ্গে যোগ দিতে চাইলে আর ঝামেলা করেনি তারা। প্রভূর অনুসারী বাড়লে তার শক্তি বাড়বে, তিনি খুশি হবেন তাদের ওপর। সেকথা ভেবেই নাওয়াজ রহমানকে গ্রহণ করে নিয়েছিল ওরা।
এরপর একবার শয়তানের ক্ষমতার প্রমাণও পেয়েছিলো হাতে-নাতে। ঘটনাটা তিন বছর আগের। নাওয়াজ তখন ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েছিলো। জীবন-সংশয়ী অসুখ। কোনওভাবেই সুস্থ হচ্ছিলো না। দুনিয়ার কোনও ডাক্তারই পারছিলো না তাকে সারিয়ে তুলতে। সারিয়ে তুলবে কি! তারা তো বেরই করতে পারছিলো না, রোগটা কী? সবাই ধরেই নিয়েছিল, সে আর বাঁচবে না। আলিঙ্গন করবে মৃত্যুকে।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে মিরাকল ঘটিয়ে সুস্থ হয়ে ওঠে। সবাই তাজ্জব হয়ে যায় তার সুস্থ হওয়ায়। কেউ জানে না, ড. নাওয়াজ রহমান কীভাবে সুস্থ হল? কিন্তু ড. নাওয়াজ জানে। যখন কেউ তাকে সুস্থ করতে পারছিলো না, তখন সে-ই নেয় উদ্যোগটা। বাঁচতেই হতো তাকে। সে প্রভূ লুসিফারের শরণাপন্ন হয়। প্রভূর কাছে প্রার্থণা করে। একদিন প্রভূ তাকে স্বপ্নে দেখা দেন। বলেন যে তিনি তার জীবন ফিরিয়ে দেবেন, কিন্তু বিনিময়ে তাকে সন্তুষ্ট করতে হবে। একটা সদ্য কুমারিত্ব হারানো কিশোরী মেয়ের বলি চান তিনি। ড. নাওয়াজকে কিশোরি মেয়েটার কুমারিত্ব নষ্ট করে তার পায়ে উৎসর্গ করতে হবে।
ড. নাওয়াজ তখন তাই করে।
তার রোগের খবর শুনে ছেলে-মেয়ে-স্ত্রি ছুটে এসেছিলো আমেরিকা থেকে। ড. নাওয়াজ তাদেরকে জোর করে আবার আমেরিকা পাঠিয়ে দেয়। ওরা প্রথমে আপত্তি করেছিল। কিন্তু ড. নাওয়াজ তাদের বলে দেয়, তাকে জীবিত দেখতে চাইলে তারা যেন তখনই আমেরিকা ফিরে যায়, নিজের রোগের প্রতিষেধক সে নিজেই খুঁজবে, কোনও অথর্ব ডাক্তারের আশায় বসে থেকে মরতে পারবে না, তবে এজন্য তাকে সম্পূর্ণ নিমগ্ন হয়ে কাজ করতে হবে, কেউ যেন তাকে ডিস্টার্ব করতে না পারে।
তার কথামতো ছেলে-মেয়ে-স্ত্রি ফিরে যায় বিদেশে। ল্যাব সহকারীটাকেও ছুটিতে পাঠানো হয় বাইরে। বাড়িতে পড়ে থাকে সে বাদে আর দুটি মাত্র মানুষ। তার দেখাশোনার জন্য আফসানা নামের একটা মেয়ে; আগে থেকেই বাড়িতে কাজ করতো মেয়েটা; আর বাড়ি সামলাবার জন্য রহমত নামের দারোয়ান।
আফসানার বয়স তখন সতেরো। কিশোরী মেয়ে হিসেবে ড. নাওয়াজ এই মেয়েটাকেই বেছে নেয়। অসুস্থ ছিলো, গায়ে তার শক্তি ছিল কম, একা তার পক্ষে সব কিছু করা সম্ভব ছিল না। তাই দারোয়ান রহমতকে ডেকে বুঝিয়ে বলে দেয়, কী করবে সে? রহমত এতে সাহায্য করলে অনেক টাকা দেয়া হবে তাকে। সেই সঙ্গে বেতনও বাড়িয়ে দেয়া হবে। রহমত তখন রাজি হয়ে যায় লোকটার প্রস্তাবে।
তারপর এক অমাবস্যায় মেয়েটাকে অজ্ঞান করে দূর্বল শরীরেই তার সঙ্গে সঙ্গমে লিপ্ত হয় ড. নাওয়াজ। রিচুয়্যাল করে মেয়েটাকে উৎসর্গ করে শয়তানের উদ্দেশ্যে। শয়তান এতে খুশি হন। সুস্থ করে দেন ড. নাওয়াজকে। সবকিছু ঠিক হয়ে যায় তখন।
এবার সময় এসেছে শয়তানের কাছে আবারও কিছু চাইবার। ড. নাওয়াজ তা চাইবে। আর সেটা চাইবে অমানবের জন্য। তবে তার জন্য আফসারকে দরকার।
ভাবতে ভাবতে ড. নাওয়াজ মদের গ্লাসটা টেনে নিলো। তাতে ঘূর্ণি তুলতে তুলতে মুখে প্রকট হল দুশ্চিন্তার ভাব। সাফল্যের এত কাছে এসে ঝামেলা তার ভালো লাগে না।
(১৩)
“স্যার, কাল রাতে কবরস্থান থেকে একটা লোককে ধরা হয়েছে।” কথাটা বলা হল ওসি হাসানকে, বলল এসআই কামরুল। “কবর থেকে লাশ তুলে নিয়ে পালাচ্ছিলো লোকটা।”
“খোঁজ খবর কিছু নিয়েছো? আগের কোনও ক্রিমিনাল ব্যাকগ্রাউন্ড আছে, নাকি নেই?” জবাব ফেরালো ওসি হাসান।
কামরুল ঘামছে, লোডশেডিংয়ের কারণে শান্তি মিলছে না একদন্ডও। “আছে স্যার, লাইনে লোকটা খুচরা আফসার নামে পরিচিত। টাকার বিনিময়ে বিভিন্ন ছোট-খাটো কাজ করে দেয়।”
“ইন্টারেস্টিং। তো কি জানতে পারলে ওর কাছে? কবরস্থানে কেন গেছিলো?”
“সেভাবে চার্জ করা হয়নি, স্যার। আপনার পার্মিশনের অপেক্ষায় আছি। কালরাতে ধরার সময় জিজ্ঞেস করেছিলাম। তেমন কিছু বলেনি।”
“ঠিক আছে, পার্মিশন দেওয়া হল।” ব্যাপারটা একটা ফর্মালিটি ছাড়া কিছুই নয়। “মার লাগাও বেধড়ক। সবকিছু বাপ বাপ করে বের হয়ে আসবে।” ‘বাপ বাপ’ শব্দ দুটোর ওপর আলাদা একটা জোর দিলো ওসি হাসান।
“জি, স্যার।” বলল কামরুল। চেয়ার ছেড়ে স্যারকে স্যালুট ঠুকে বেড়িয়ে গেল।
সেলটা বড্ড নোংরা। আলো বাতাসের বালাই নেই। বাইরে দিন থাকা সত্বেও সন্ধ্যার মতো অন্ধকার জড়ানো খোপটা। আফসার এক কোণায় বসে, দেয়ালে পিঠ ঠেকানো। তার চোখগুলো রক্তের মতো লাল। ভয়ানক দুশ্চিন্তা গ্রাস করে আছে তাকে। এর আগে ভাগ্য এতটাও খারাপ হয়নি, যতটা খারাপ হয়েছে এখন। পুলিশের হাতে ধরা পড়া এই তার প্রথম। পলিটিক্যাল ব্যাকআপও নেই কোনও। এবার জেলের ভাত খেতে হবে, রেহাই নেই। সেটুকু বুঝতে পেরেই ধ্বক ধ্বক করছে বুকটা।
হঠাৎ সেলের দরজায় খুট খুট শব্দ পেয়ে খুচরা আফসার চোখ তুলে তাকালো। কনস্টেবল সেলারের দরজা খুলছে, তার পেছনেই অফিসার লোকটা, কালরাতে টহলরত পুলিশের দলটার নেতৃত্ব সে-ই দিচ্ছিলো।
ওদেরকে ঢুকতে দেখে আফসার ভয়ে কেমন সিঁটিয়ে গেলো। এসআই কামরুল এসে এক মণ ওজনের একটা লাথি হাঁকালো আফসারে গায়ে! আফসার এক পাক উল্টে মেঝেতে পড়লো। কনস্টেবল ইতোমধ্যেই কামরুলের হাতে একটা মোটা লাঠি দিয়ে দিয়েছে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই আফসারের পিঠে নেমে এলো সেটা, ঠিক যেন গজবের মতো! প্রতিটা মারের সঙ্গে সঙ্গেই আফসারের গলা চিরে একটা একটা করে আর্তনাদ বেরিয়ে এলো। আর সে আর্তনাদে ফালি ফালি হয়ে গেলো পুরো থানার পরিবেশ। খুচরা আফসারের ওপর ঠিক যেন শনির দশা নেমে গেছে!
আফসারকে বেশিক্ষণ পেটাতে হল না। ঘড়ি দেখে পাক্কা বিশ মিনিট হতে না হতেই সে বলে দিলো সব। এসআই কামরুল যা জানতে পারলো, তাতে ধাক্কা খেলো বড় একটা! দেশের এত বড় মাপের একজন বিজ্ঞানী খুচরা আফসারকে দিয়ে করাচ্ছিলেন এটা। শুধু এটাই নয়। এর আগেও তার হয়ে আফসার বিভিন্ন মানুষকে তুলে নিয়ে গেছে। তাদের দিয়ে কী হয়, আফসারের জানা নেই। তবে মাঝে মাঝে তাকে নাড়ি-ভুঁড়ি, পরিত্যক্ত মানব অঙ্গের ব্যবস্থা করতে হয়েছে। ড. নাওয়াজের বাড়ি থেকে সেগুলো নিয়ে এসে দূরে বিভিন্নখানে জনবিরল জায়গা দেখে পুঁতে ফেলতে হয়েছে।
অসম্ভব!
নিজের কানকে কামরুল বিশ্বাস করতে পারলো না। এসব কী শুনলো সে? তার দেহের লোম দাঁড়িয়ে গেলো।
(১৪)
জায়গাটা অন্ধকার, কালো, দম আটকানো। দুদিন ধরে আমি এখানে বন্দী। লাল দরজার ঘরটায়। অন্যান্য পশুগুলোর মতো একটা খাঁচায়। স্যার আমাকে এখানে আটকে রেখেছেন।
স্যারের কথা মতো দারোয়ান রহমত একটা স্টান্টগান নিয়ে এসেছিলো। সেটা দিয়ে শক দিতেই সমস্ত দেহটা অসাড় হয়ে গিয়েছিলো আমার। এর আগে বেশ কয়েকবার ভুল করে কারেন্টের শক খেয়েছি। কিন্তু এই শকটা সেগুলোর কোনওটার মতোই ছিল না। এটা আরও জোরালো, আরও ধারালো। প্রবল একটা ঝাঁকুনি! আমার শরীরটাকে অবশ করে দিয়েছিলো ভেতর থেকে। তারপর রহমত মিয়া কাঁধে তুলে আমাকে এখানে নিয়ে আসে। স্যার নিজের হাতে খাঁচার দরজায় তালা ঝুলিয়ে দেন।
এই দুদিন আমাকে কোনও খাবারও দেয়া হয়নি। অমানব আর বাকি সব জীবিত প্রাণীকে পুষ্টি মানে খাবার দেবার জন্য সাবের চাচা বেশ কয়েকবার এসেছিলেন। তিনি এসে ওগুলোকে খাবার দিলেও আমাকে কিছু দেননি। এমনকি আমি তাকে ডাকলেও উত্তর দেননি কোনও। হয়তো স্যারই বলে দিয়েছেন এভাবে।
সাবের চাচা আসার সময় অদ্ভুত একটা ব্যাপার লক্ষ্য করেছি। খাবার দেবার সময় বিভিন্ন খাঁচা পার হতে হতে আচরণে অন্যরকম একটা পরিবর্তন আসতো তার, কেমন যেন মনমরা হয়ে যেতেন! চোখ দুটো ছল ছল করত। অযাচিত একটা দুঃখবোধ এসে ভর করত তার মধ্যে। আগেও দেখেছি একবার। সাবের চাচার মনের গহীনে নিশ্চয়ই কোনও গভীর দুঃখবোধ লুকানো, যা তিনি সবার কাছ থেকেই আড়ালে রাখতে চান। দুঃখের নোনা কষ্টগুলো হয়তো আটকে রাখতে চান নিজের মাঝেই। আগে একবার জিজ্ঞেস করায় কিছু বলেননি। এবারও জিজ্ঞেস করলে কিছু বলবেন কিনা, জানি না। তাই আমি আর ওঁকে জিজ্ঞেস করিনি।
সবারই তো ব্যক্তিগত কিছু থাকে!
এখানে বসে বসে আমি আরেকটা জিনিস দেখেছি; আড়ষ্ট চেতনায়। যে বাচ্চাটার শরীরে শিম্পাঞ্জির কলজে বসিয়ে লাইফ সাপোর্ট দিয়ে রাখা হয়েছিল, সে বাচ্চাটা বাঁচেনি। ব্যর্থ হয়েছে স্যারের এক্সমেরিমেন্ট। বাচ্চাটা মারা গেছে কাল সন্ধ্যায়। দারোয়ান রহমত ও সাবের চাচা মিলে লাশটাকে এখান থেকে নিয়ে গেছে। বাচ্চাটার কথা ভাবলে কষ্টই লাগে একটু। এতটুকুন একটা বাচ্চা… দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গে সঙ্গে বুকটা ভারী হয়ে আসে।
জীবনের কিছুই দেখেনি বাচ্চাটা।
আমার নিজের অবস্থাও বেশ খারাপ। জায়গাটা আমার একটুও ভালো লাগছে না। অন্ধকার, দম আটকানো বন্দী অবস্থায় কারই বা ভালো লাগে? এতগুলো প্রাণী; গন্ধ আসছে সেগুলো থেকে। পেটে কিছু থাকলে বমি হয়ে বেরিয়ে আসতো নির্ঘাত। শরীরে জোর পাচ্ছি না। অসাড় হয়ে গেছি। নড়বার শক্তিও মরে গেছে বোধহয়। জানি না, কবে মুক্তি পাব? স্যারের মতলবই বা কী, কে জানে? আমি শুধু অনুভব করছি, আমার চেতনাটা আস্তে আস্তে নিভে আসছে। নিস্তেজ হয়ে পড়ছে ক্রমশ। আমি যেন অন্ধকার, অতল কোনও গহ্বরে হারিয়ে যাচ্ছি!
(১৫)
“ড. নাওয়াজের বিরুদ্ধে আমাদের একটা অ্যারেস্ট ওয়ারেন্ট লাগবে, স্যার।” এসআই কামরুল গলাটা ঠান্ডা রেখে বলল।
খুচরা আফসারকে ওসি হাসানের সামনে বসিয়ে রাখা। তার মুখেই সবটা শুনেছে সে, শুনে হতভম্ব হয়ে আছে। কথাগুলো জানলে যে কেউই ধাক্কা খেতো, নিশ্চিত।
“তুমি জানো, তুমি কি বলছো?” কামরুলকে উত্তর ফেরালো ওসি হাসান। “তার মতো একজন বড় মাপের মানুষের বিরুদ্ধে অ্যারেস্ট ওয়ারেন্ট এত সহজে পাওয়া যাবে ভেবেছো?”
“আমরা কি তাহলে হাত পা গুটিয়ে বসে থাকবো, স্যার?” গলার ঝাঁঝটা দমাতে পারলো না এসআই কামরুল। “কিছু করব না? খুচরা আফসারের কথাগুলো তো আপনিও শুনলেন। পুলিশ হিসেবে কি এখন হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকবেন?”
“কামরুল, ব্যাপারটা আসলে অত সহজ নয়। অনেক ব্যাপার আছে এখানে। ড. নাওয়াজের মতো একজন হাই প্রোফাইল মানুষের গায়ে হাত দিতে হলে অনেক ভেবে চিন্তে দিতে হবে। একটু ভুল হলেই সব শেষ। টানাটানি পড়ে যাবে তোমার আমার চাকরি নিয়ে। কোথায় ট্রান্সফার করে দেবে, কে জানে? উনি একজন ইন্টারন্যাশনাল ব্যাক্তিত্ব। ভেবে দেখেছো? সারা পৃথিবী তোলপাড় হয়ে যাবে। সব দেশের মিডিয়া ছুটে আসবে। ব্যাপারটা একটা ইন্টার ন্যাশনাল ইস্যু হয়ে দাঁড়াবে। তাই, যেটাই করা হোক, অত্যন্ত ভেবে চিন্তে করতে হবে, বুঝলে? একটুও ভুল করা যাবে না।” এরপর তিনি আফসারের দিকে তাকালেন, “ওই ব্যাটা, কোনও হুজুগে গল্প ফাঁদিস নাই তো?”
“না স্যার, বিশ্বাস করেন। আমি সত্যি কইতাছি।” মার খেয়ে আফসারের মনের জোর, গলার জোর দুটোই কমে গেছে।
“স্যার, এটা মিথ্যা গল্প নয়।” বলল কামরুল। “ভেবে দেখুন, আফসার যদি মিথ্যা বলতেও চাইতো তবে ড. নাওয়াজের মতো একজন বিজ্ঞানী লোককে টেনে আনবে কেন? খুচরা আফসারের মতো লোকের তো তাকে চেনারই কথা নয়।”
“তোমার কথায় যুক্তি আছে অবশ্য। দেখি, ম্যাজিস্ট্রেট অফিসে কথা বলে কিছু করতে পারি কিনা? ওয়ারেন্ট না পেলে তো কোনও পদক্ষেপই নিতে পারব না। বসে বসে আঙুল চুষতে হবে।”
“আচ্ছা, স্যার। আমি এই ব্যাটাকে সেলে ভরছি। ম্যাজিস্ট্রেট অফিস থেকে কী সিদ্ধান্ত আসে, তার ওপর বিবেচনা করে পরে কোর্টে চালান করে দেব।”
“আচ্ছা, নিয়ে যাও।” বলল ওসি, এতক্ষণ ধরে আটকে রাখা একটা শ্বাস ছেড়ে দিয়ে।
তার মাথায় একটা দুশ্চিন্তা চেপে গেছে।
বুকটা ভেঙে যায়। খুব কষ্ট লাগে সাবেরের। গলা ভেঙে কান্না আসতে চায়। বছর তিন আগের দুঃখটা তীব্র হয়ে বুকে বিঁধে, এখনও। ব্যাপারটা এখনও মনে পড়ে তার। একেবারে স্পষ্ট। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সে সেটা ভুলতে পারবে না। কষ্টটা জ্বল জ্বল করে অম্লান হয়ে থাকবে তার মস্তিষ্কে। সারাক্ষণ পোড়াবে তাকে।
একটা মাত্র মেয়ে ছিল তার। আফসানা। মা-মরা মেয়েটাকে কোলে পিঠে করে মানুষ করেছিলো সে। সংসারের অবস্থা ভালো ছিল না। বাড়তি কিছু আয়ের জন্য এ বাড়িতে কাজ করত মেয়েটা। কিন্তু বছর তিন আগে সেই মেয়েটাকে তার বুক থেকে কেড়ে নেওয়া হয়। অসহায়, দুস্থ বাবাটাকে বানানো হয় সম্পূর্ণ একা।
মেয়েটা মারা যাবার পর লাশটাও তাকে দেয়া হয়নি। সে এ বাড়িতে এসে এত কেঁদেছে, হাত-পা ছুঁড়ে মাটিতে গড়াগড়ি করেছে, তারপরও কেউ তার প্রতি দয়া করেনি। তাকে বলা হয়েছিল, সেদিন নাকি মেয়েটা এ বাড়িতে আসেইনি। অথচ বিকেল বেলা মেয়েটা তাকে বলে এসেছিলো, ‘আব্বা, আমি কামে গেলাম স্যারগো বাড়ি। আইজ নাও আসবার পারি। স্যারের তো অসুখ করসে।’ মেয়েটার সেই শেষ কথাগুলো এখনও তার কানে বাজে।
সাবের চোখ বন্ধ করে ফেললো। বুকটা কাঁপছে। চাপা কষ্টটা বেড়িয়ে আসবে যেন।
তাকে আশ্বাস দিয়ে স্যার মিথ্যা একটা জিডি করেছিলেন থানায়। আর ফল আসেনি সেটার, স্যার অসুস্থ থাকায় সাবের তখন বেশি চাপাচাপিও করতে পারেনি। তবে সেটাই যে ফল না আসার একমাত্র কারণ নয়, তা সে বুঝেছিলো আরও পরে। তার সঙ্গে যত নাটকই করা হোক, তার কেন যেন মনে হয়েছিলো সত্যিটা এই বাড়িতেই লুকিয়ে। তা না হলে তার মেয়ে হঠাৎ করে গায়েব হয়ে যাবে কেন? সম্পর্ক করে কোনও ছেলের সঙ্গে পালিয়ে যাবার মতো তো ছিলো না তার মেয়ে।
এরপর সে এই বাড়িতে কাজ নেয়। তাকে কাজ দিতে কার্পণ্য করেননি স্যার। ঠিকই কাজ দিয়েছিলেন তাকে। তখন থেকে এই বাড়িতে কাজ করতে শুরু করে সে। আর শুরু করে সত্যিটার খোঁজ করতে। এক বছর কাজ করার পর স্যারের বিশ্বাসভাজন হয়ে ওঠে সাবের। আস্তে আস্তে স্যারের ল্যাবরেটরি, লাল দরজা, বাগানের পেছনের অদ্ভুত দরজা; সবকিছুরই রহস্য জানা হয় তার। জেনে তার ভেতরটা গুলিয়ে উঠলেও সে টু শব্দটি করে না।
আগে সে রাতে এ বাড়িতে থাকতো না। সবকিছু জানার পর সে রাতেও থাকতে শুরু করে এ বাড়িতে। এ বাড়িতে কাজ করার সময় সে তার মেয়ের স্পর্শ খুঁজে পেতো। ভেবে ভালো লাগতো সেটা। এত খারাপের মাঝেও একটা ভালো লাগার রেশ বয়ে যেতো।
আস্তে আস্তে তার রহমতের সঙ্গে ভাব হয়। বন্ধুর মতো আড্ডা হতে শুরু করে তার সঙ্গে। একদিন সে আর রহমত মিলে ঠিক করে রাত-ভর মদ গিলবে, আড্ডা হাঁকাবে। আর ওই রাতেই সে জানতে পারে সত্যিটা, আকণ্ঠ মদ গিলে দারোয়ান রহমত যখন বেশুমার মাতাল… নেশার ঘোরেই সে বলে দেয় কথাগুলো। সে সত্যের প্রতিটা শব্দই হৃদয়ের রক্তক্ষরণ করে সাবেরের বুকে একটা একটা করে সূচের মতো বিঁধেছে সেদিন। একটা মাত্র মেয়ে ছিল তার, মা-মরা। ছোটবেলা থেকেই তাকে এত আদর-সোহাগ দিয়ে মানুষ করেছিলো কোলেপিঠে। আর সেই মেয়েটাকেই এই পশুগুলো কেড়ে নিয়েছে তার বুক থেকে। একটুও মায়া করেনি।
সে তখনই ঠিক করে, প্রতিশোধ নেবে। জানোয়ারগুলোকে বাঁচতে দেবে না। উচিত শাস্তি দেবে দুজনকে।
দুই দুইটা বছর ধরে সে সুযোগের অপেক্ষায় ছিল। এমন একটা সুযোগ যাতে করে জানোয়ারগুলোকে কষ্ট দিয়ে মারতে পারে। ইচ্ছে করলেই সে খাবারে বিষ মিশিয়ে শয়তান দুটোকে মারতে পারতো। কিন্তু ফুলের মতো আদুরে মেয়েটাকে তার কাছ থেকে যেভাবে কেড়ে নেওয়া হয়েছে, তার তুলনায় কি উপযুক্ত শাস্তি হতো ওটা? হতো না। সাবেরের আরও ভয়ংকর একটা উপায় লাগতো। আরও কষ্টকর একটা উপায়। তাই সাবের অপেক্ষা করে, আরও ভয়ংকর কিছুর জন্য অপেক্ষা। কিন্তু কিছুতেই মন মতো কিছু পাচ্ছিলো না। তবে এবার পেয়েছে। পরম করুণাময় উপর ওয়ালার ইচ্ছায়। সব কিছু তো তারই ইশারা। তিনিই যেন নিজ হাতে চোখে আঙুল তুলে আফসারকে দেখিয়ে দিয়েছেন উপায়টা, সিদ্ধাহীনতার গোলকধাঁধা থেকে বের হবার পথ দেখিয়ে বের করে এনেছেন।
একটা মাস আগে তার সামনে আসে উপায়টা। ঘটনাটা না ঘটলে তার মাথায় কোনওভাবেই সেটা আসার কথা ছিল না। অজানার গন্ডিতেই পড়ে রইতো সেটা। কিন্তু সেটা সামনে আসে স্যারের আগেকার ল্যাব অ্যাসিস্ট্যান্টের মৃত্যুতে। অমানব নামের বদখত প্রাণীটা যখন তাকে ছিড়ে-ফুঁড়ে মেরে ফেলে, তখনই সাবের পারিষ্কার দেখতে পায়, এতদিন থেকে সে যা খুঁজছিলো, তা পড়ে রয়েছে ওই অন্ধকার বেজমেন্টে, ঠিক লাল দরজাটার আড়ালে।
শয়তান দুটোর মৃত্যু!
সে যেভাবে চেয়েছিলো, ঠিক সেভাবেই। ভয়ংভাবে… ভয়ংকর রকমের নিষ্ঠুরভাবে। আর সে নিজ হাতে নিশ্চিত করবে সেটা।
(১৬)
গাঢ়-নিকষ অন্ধকারে খাঁচায় বসে ধুকছি। জানি না, আর কতদিন আমাকে না খাইয়ে রাখবে। আমাকে নিয়ে করবেই বা কী, কে জানে?
যে চোরটাকে ধরা হয়েছিল, দেখেছি, তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কেটে বিশেষ প্রক্রিয়ায় সংরক্ষণ করা হয়েছে। আমাকে নিয়েও তাই করা হবে কিনা, জানি না। আসলে আমি আর কিছুই জানি না। কিছু ভাবতেও ইচ্ছে করে না এ নিয়ে। মানুষ লক্ষ্যহীন অপেক্ষা করতে পারে না। ভেঙে পড়ে, ভেতরে ভেতরে অস্থির হয়ে ওঠে। আমারও তাই হচ্ছে। ভেতরটায় ঝড়ের সমুদ্রের মতো তোলপাড় বয়ে চলছে।
বাতাসটা গুমোট, দম আটকানো, কেমন যেন মরা মরা। নিশ্বাস নিতে পারছি না। শরীর দূর্বল হয়ে পড়েছে। পেটে কিছু পড়েনি। খিদেয় চোঁ চোঁ করছে। গুড় গুড় করে উঠছে একটু পর পর। পিপাসাও পেয়েছে প্রচন্ড। গলা শুকিয়ে একেবারে কাঠ হয়ে আছে। মনে হচ্ছে কত যুগ ধরে যেন পানি খাই না।
আমি আর পারছি না। মনে হচ্ছে এখানেই মরে যাবো। সহ্য সীমার শেষ বিন্দুতে পৌঁছে গেছি। একটু পানি বা একটু খাবার; দুটোর জন্যই আমি যেকোনও কিছু করতে পারব।
খাঁচাটার লোহার শিক দুহাতে ভালো করে ধরলাম। স্নায়ুগুলো মনে হয় মরে গেছে। শীতল ধাতব স্পর্শ উপলব্ধি করতে পারলাম না। আমি দুহাতে শক্ত করে ধরে জোর খাটিয়ে শিকটা বাঁকানোর চেষ্টা করলাম। আমার সর্বশক্তি দিয়ে, যতটা সম্ভব। কিন্তু কিছুই হল না। একচুলও বাঁকলো না শিকটা। আমার সমস্ত চেষ্টা বৃথা প্রতিপন্ন হল।
সহসা আমার সমস্ত শক্তি যেন মরে গেল হুট করে। আমি চাপা একটা ধপ শব্দ করে মেঝেতে বসে পড়লাম। নড়বার শক্তিটুকুও হারিয়ে ফেলেছি, একটুও নড়তে পারব না।
আর তখনই ঘরের হলুদ আলোটা জ্বলে উঠল। তারস্বরে চিৎকার করে উঠল প্রাণীগুলো। আমি চমকে উঠলাম। সমস্ত সত্তা নাড়া খেলো আমার। দুরু দুরু বুকে অনুভব করলাম, আমি ভয় পেয়েছি। নিঃশব্দ নীরবতায় হঠাৎ খেলে যাওয়া শব্দগুলো আমাকে ভয় পাইয়ে দিয়েছে।
প্রাণীগুলো আবার শান্ত হল। ঘরের দরজা দিয়ে যাকে আশা করছিলাম সেই এসেছে, মধ্যবয়স্ক সাবের চাচা। কিন্তু অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম, আজ তার হাতে কোনও খাবারের পাত্র নেই। আমি দূর্বল গলায় তাকে ডাক দিলাম, “সাবের চাচা, আমাকে একটু পানি দেবেন?”
তিনি চমকে তাকালেন। আমার দিকে ঠায় তাকিয়ে থাকলেন কিছুক্ষণ। তারপর ঠোঁট দুটো ঈষৎ ফাঁক করলেন, মনে হল কিছু বলবেন, কিন্তু কিছুই বললেন না শেষ পর্যন্ত। মুখ ঘুরিয়ে একটা খাঁচার দিকে এগিয়ে গেলেন।
খাঁচাটা আমার চেনা। ওটা অমানবের।
অমানব খাঁচাটায় ঝিম মেরে বসে ছিল। তিনি কাছে যেতেই নড়ে চড়ে উঠল। স্থির দেহটায় প্রাণ পেলো যেন। চাঞ্চল্য দেখা দিলো। আমি তখন বাতাসে কেমন যেন একটা অশুভ গন্ধ পেলাম। চাপে থাকলে মানুষের সজ্ঞা প্রবল হয়ে ওঠে। আমারও তাই হয়েছে মনে হয়। তবে বুঝলাম না, অশুভ গন্ধটা কিসের?
প্রাণীটার খাঁচার সামনে দাঁড়িয়ে সাবের চাচা কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন। আমি তার পাশটা দেখতে পাচ্ছি। তার গাল শুকনো নয়, ভেজা। চোখ বেয়ে পানি পড়ছে গড়িয়ে। আর কী যেন বিড়বিড় করছেন আপন মনে। খানিক পর তিনি মনে হয় সম্বিত ফিরে পেলেন। আস্তে করে খাঁচার দরজার দিকে এগিয়ে গিয়ে খুললেন তালাটা।
আমি হঠাৎ বুঝতে পারলাম, তিনি কী করছেন?
উনি কী পাগল হয়ে গেছেন?
তালাটা খুলে ফেলে দরজাটা হাট করে খুললেন তিনি। আর খুলতেই অমানব ছুটে এলো। হিংস্র একটা চিতাবাঘের মতো ঝাঁপিয়ে পড়লো তার ওপর। তিনি ছিটকে একটা ছুঁড়ে দেয়া ধানগাছের আঁটির মতো মেঝেতে পড়ে গেলেন। তার হাতে থাকা চাবিটা ছিটকে চলে এলো আমার খাঁচাটার কাছে। হাত বাড়ালে এখন হয়তো আমি ওটাকে টেনে আনতে পারব।
অমানবকে দেখলাম সাবের চাচার গলায় কামড়ে ধরেছে। সেখান থেকে রক্ত ছুটছে ফিনকি দিয়ে। পেট গুলিয়ে উঠল আমার। এই প্রথম জিনিসটাকে আমি মানুষ মারতে দেখছি। কিছুক্ষণের মধ্যেই সাবের চাচাকে জিনিসটা ছিঁড়ে-ফুঁড়ে ফেললো।
এদিকে আমি হাত বাড়িয়েছি চাবিটাকে ধরতে। কিন্তু একটুর জন্য সেটা আমার হাতে আসছে না। আমি হাত বাড়িয়ে প্রাণপণে চেষ্টা করছি। হাতটাকে ঠেলে আরও লম্বা করতে চাইছি। খাঁচার শিকগুলো আমার মাংস কেটে বসতে চাইছে। ব্যথা করছে রীতিমতো। আমার কাঁধ জ্বলতে শুরু করেছে চিন চিন করে।
আর তখনই আমার নাকে ধাক্কা দিলো গন্ধটা। পচা ডিমের মতো বোটকা একটা গন্ধ। চকিতে সজাগ হয়ে উঠলাম। গন্ধটা আমার চেনা, অমানবের গা থেকে আসা। আমার দিকে ছুটে আসছে জিনিসটা।
আশপাশ, কোনও কিছু না ভেবে নিজেকে আবার খাঁচার ভেতরে ঢুকিয়ে নিলাম। আর সঙ্গে সঙ্গে অমানব ঝাঁপিয়ে পড়লো আমার ঠিক সামনে। অল্পের জন্য বেঁচে গেছি। নাহলে জিনিসটার হাতে আমাকে এখানেই মরতে হতো।
অমানব আমার খাঁচাটার শিক ধরে হুটোপুটি শুরু করলো। অনুভব করলাম আমার ভেতরে এক চিলতে ভয় হামাগুড়ি দিয়ে আসছে। ক্রমশ গাঢ়, ক্রমশ গভীর হচ্ছে সেটা, আমার সবটুকু অনুভূতি গ্রাস করে নিতে চাইছে। হৃদপিণ্ডটা ধ্বক ধ্বক করছে। আমার বুকটা কেঁপে উঠছে তার দমকে। আমি নিজেকে খাঁচাটার মাঝখানে গুটিয়ে-শুটিয়ে রাখলাম। চ্যাপ্টা করে নিজেকে সেঁটিয়ে রাখলাম একেবারে মেঝেতে। যে ভয়টা এখন অনুভব করছি, তার চেয়েও বড় একটা ভয় আছে মনে, অমানবের হুটোপুটিতে চাবিটা ছিটকে দূরে না চলে যাক!
হঠাৎ অমানব লাফ দিয়ে আমার খাঁচাটার ওপরে উঠল। চলে এলো মাঝখানে, আমার ঠিক ওপর বরাবর। শিকের ফাঁক দিয়ে হাত ঢুকিয়ে দিলো। ক্রমাগত হাত নাড়িয়ে খামচে ধরতে চাইলো আমাকে। বৃথা চেষ্টায় আমি নিজেকে মেঝেটার সঙ্গে আরো চ্যাপ্টা করে বসাতে চাইলাম, পারলে যেন ওর সঙ্গে মিশে যাই। আমার ভেতরটা প্রচণ্ড ভয়ে কুঁকড়ে গেছে। এই বুঝি অমানব আমাকে ধরে ফেলবে, কিংবা ওর আঙুলের ডগার নখ আমার শরীরটাকে ফালা ফালা করে দেবে। ঠিক আমার বাবার মতো হবে আমার ক্ষত-বিক্ষত লাশ।
আমি চাই না… আমি চাই না ওই প্রাণীটার হাতে মরতে!
আমাকে ছুঁতে না পেরে হয়তো অমানব আগ্রহ হারিয়ে ফেললো। হুটোপুটি কমিয়ে স্থির হয়ে দাঁড়ালো খাঁচাটার ওপর। কান খাড়া করে মনে হয় কিছু শুনলো। এরপর হুট করে দরজার দিকে দৌঁড়ে গেলো। খোলা দরজা দিয়ে নিজের শরীরটাকে বের করে সেটা চলে গেলো বাইরে। আমি নিজের বুক থেকে চাপা একটা ভয় মেশানো নিশ্বাস বের করে দিলাম। মনে হল, কেউ আমার বুক থেকে দশ মণ ওজনের একটা পাথর সরিয়ে নিয়েছে।
হাঁচড়ে পাঁচড়ে কোনওমতে উঠে বসলাম। বাতাসটা কেমন ভারি, নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। আমি এবার মনোযোগ দিলাম চাবিটার দিকে। তবে আর হাত দিয়ে নয়, চেষ্টা করলাম পা বাড়িয়ে। শিকের ফাঁক দিয়ে পা বাড়াতে কষ্ট হল, কিন্তু আমার পায়ের নাগালে এলো চাবিটা। আঙুল দিয়ে আঁকড়ে ধরে সেটাকে টেনে আনলাম।
তালা খুলে বের হলাম এরপর। হাঁটতে শুরু করলাম দরজার দিকে। পা ঠেলে ঠেলে এগোতে কষ্ট হচ্ছে। শরীরে জোর পাচ্ছি না। স্বাভাবিক, শরীরটা ঠিক মতো পুষ্টি পায়নি এ কদিন।
আমি লাল দরজাটার কাছে এলাম। স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে শোনার চেষ্টা করলাম, বাইরে থেকে কিছু শোনা যায় কিনা? এবার যদি অমানবের হাতে পড়ে যাই, মরতে হবে নির্ঘাত। বাঁচার মতো কিছুই নেই এখানে।
বাইরে থেকে কোনও শব্দ পেলাম না। তার মানে অমানব চলে গেছে।
কিন্তু কোথায়?
হয়তো ওপরে, বাইরের দিকে।
নিশ্চিত হতে আমি একবার উঁকি দিলাম। বিপজ্জনক কিছু চোখে পড়লো না। জন্তুটা নেই, চলে গেছে। আমি এবার হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। ভয়ানক তেষ্টা পেয়েছে। আমার একটু পানি খেতে হবে। না খেলে হবে না।
আমি ল্যাবরেটরিটার বেসিনের দিকে এগিয়ে গেলাম।
পানি খাবার পর আমি যখন বেজমেন্ট থেকে উঠে আসছি, একটা আর্তনাদ ভেসে এলো কানে। কোন ঘর থেকে এলো জানি না, তবে কণ্ঠটা আমার চেনা। ওটা স্যার, ডক্টর নাওয়াজ রহমানের।
যা শুনলাম, বিশ্বাস করতে পারছি না। জন্তুটা স্যারকেই আক্রমণ করে বসেছে। সৃষ্টি হয়ে বধ করতে বসেছে ¯্রষ্টাকে।
অসম্ভব!
স্যার আমার সঙ্গে অন্যায় করেছেন বটে, অনেকের সঙ্গেই করেছেন। কিন্তু সেজন্যে তো আমি তার সঙ্গে অন্যায় করতে পারি না। তাকে বাঁচানো আমার কর্তব্য। ভাবার চেষ্টা করলাম, কী করতে পারি? আমার সাধ্য নেই অমানবের সঙ্গে লড়াই করে তাকে বাঁচাবো। শরীরের এই অবস্থাতে তো কোনওভাবেই নয়। অন্য কোনওভাবে তাকে বাঁচানো যায় কিনা, ভাবছি। কালবৈশাখীর মতো ঝড় চালাচ্ছি মস্তিষ্কে। আর তখনই বুদ্ধিটা এলো। প্রাণীর কথা মনে পড়লো একটা, বাড়ি পাহারা দেবার ওই জন্তুটা।
দুটো মানুষ একসঙ্গে, কোমর থেকে একটা এলসেশিয়ান কুকুর জুড়ে দেয়া।
আমি সঙ্গে সঙ্গে আবার ল্যাবরেটরিতে দৌড়ে গেলাম। দৌড়ানো বললেও ব্যাপারটা ঠিক দৌড়ানো নয়। দৌড়ানোর শক্তি আমার মোটেও নেই। হাঁচড় পাঁচড় করে কোনওমতে নিজেকে টেনে নিয়ে গেলাম আরকি। সিঁড়ি বেয়ে নামার সময় হোঁচট খেলাম। শরীরটার ওপর ঝড় চালিয়ে গড়িয়ে পড়লাম একেবারে নিচে। শরীরটা এমনিতেই দূর্বল হয়ে ছিল। এখন অবস্থা হল আরও খারাপ। মনে হল যেন ডান কাঁধটা ভেঙে গেছে। নাড়াতে পারছি না। ওটা অসাড় হয়ে পড়েছে ব্যথায়। ডান কাঁধের জায়গায় অনুভব করলাম, শুধু ব্যথা নয়, প্রচণ্ড ওজনও জাপটে ধরেছে খুব করে।
তারপরও আমি থামলাম না, নিজেকে টেনে টুনে লাল দরজার ওপাশে নিয়ে গেলাম। একেবারে গিয়ে থামলাম জন্তুটার কাছে। জন্তুটা আমাকে দেখে অপরিচিতের মতো আচরণ করলো না। মোটামুটি ঠান্ডা হয়েই রইলো। আমি দ্রুত সেটার শিকলটা খুলে দিলাম। তারপর বললাম, “তোর মনিব বিপদে। যা, সাহায্য কর।”
জন্তুটা কিছু বুঝলো কিনা বুঝতে পারলাম না। সঙ্গে সঙ্গে ছুটে গেলো ওপরের দিকে। আমিও ওখানে না দাঁড়িয়ে আবার ফিরতে শুরু করলাম। তবে জন্তুটার মতো দৌড়ে নয়, হেঁটে। হাঁটতে হাঁটতেই কানে এলো আরেকটা আর্তনাদ।
তবে এবারেরটা স্যারের নয়। অন্যকারও…
(১৭)
অ্যারেস্ট ওয়ারেন্টটা পেতে ওসি হাসানকে বেশ ঝক্কি পোহাতে হয়েছে। ম্যাজিস্ট্রেটকে বোঝাতে বোঝাতে কালো ঘাম ছুটে গেছে একেবারে। আজ সকালে সে যখন এসআই কামরুলকে ওয়ারেন্টটা হস্তান্তর করে, তখনই তার কথা বার্তায় প্রকাশ পায় কথাগুলো।
ওয়ারেন্টটা পাওয়ার পর এসআই কামরুল আর এক মুহূর্তও দেরি করেনি। ফোর্স নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে সঙ্গে সঙ্গে। ছাদ বিহীন একটা জিপ, সঙ্গে মোট পাঁচজন কনস্টেবল, আর চালকের আসনে এক ড্রাইভার। এসআই কামরুল বসেছে ড্রাইভারের পাশের সিটে। কনস্টেবলগুলো পেছনে। ফাঁকা রাস্তা ধরে ছুটে যাচ্ছে জিপটা। একটু পর পর বিপরীত পাশে থেকে কয়েকটা ভ্যান, রিকশা, লেগুনা, সিএনজি বা বাস ছুটে আসছে। সেগুলোকে পাশ কাটিয়ে বেশ আরামসেই পার হয়ে যাচ্ছে ওরা। শহরের ভেতর হলে তো জ্যাম সামলাতেই খবর হয়ে যেতো। ডক্টরের বাড়িটা শহরের বাইরে বলে জ্যাম বাবাজির কবলে পড়তে হয়নি। আর একটু সামনে এগোলেই মেটে রাস্তা। সেটা ধরে কিছুক্ষণ গেলে ডক্টরের বাড়ি। সেখানেই পাওয়া যাবে ডক্টরকে। ইনফরমেশন সব আগে থেকেই নেওয়া। তিনি আজ বাড়িতে থাকবেন। ছুটির দিন, ক্লাসে যাননি। গত দু-তিন মাস ধরে বিদেশেও যাননি লোকটা। কে জানে, দেশে বসে কী করছেন? মানুষই বা খুন করছেন কেন, কে জানে?
সমস্যা নেই, গ্রেফতার করে থানায় নিয়ে চার্জ করলে নিশ্চয়ই জানা যাবে। তবে তার মতো লোককে চার্জ করার ব্যাপারে মনটা একটু খুঁত খুঁত করে। আর করাটাই স্বাভাবিক।
গাড়িটা মেটে রাস্তায় বাঁক নিলো। একটু সামনে এগোতেই মহাসড়কের আর টিকিটাও দেখা গেলো না। ডানে-বাঁয়ে যেদিকেই চোখ যায়, অবারিত ধানখেত। এগোনোর মেটে পথটাও গিয়ে মিশেছে দিগন্তে। দূরে দূরে খানিক পর পর বাড়ি দেখা যাচ্ছে একেকটা। আকাশটা মেঘলা, রোদ নেই। তাতে যেন এই দৃশ্যের সৌন্দর্য্যটুকু আরও খানিক প্রকট হয়ে ফুটে উঠেছে।
চলতে চলতেই প্রাইমারি স্কুলটাকে পাশ কাটালো ওরা। কামরুল তখন ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করলো, “ফজলু, কতক্ষণ লাগবে আর?”
ড্রাইভার ফজলু জবাব দিলো, “আইসা পড়ছি স্যার, আর পাঁচ মিনিট।”
“আচ্ছা, ঠিক আছে।”
কামরুলের জিজ্ঞেস করাতেই হয়তো ড্রাইভার গতি আরও একটু বাড়িয়ে দিলো। বাতাসটা সুন্দর-সতেজ। এসে আরামদায়ক শীতলতায় ধাক্কা দিচ্ছে। কামরুলের মনে হল, পাঁচ মিনিটের একটু বেশি লাগলেও সমস্যা কী? ডক্টর তো আর পালিয়ে যাচ্ছে না। বরং মেঘলা দিনে এমন বাতাসের তুলনা হয় না।
তবে পৌঁছাতে আর পাঁচ মিনিট লাগলো না। তার ইচ্ছেটাকে কাঁচকলা দেখাতেই হয়তো গাড়িটা মিনিট তিন, সাড়ে-তিনের মধ্যেই ডক্টরের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে গেলো।
আর তখনই পুরু প্রাচীর ভেদ করে ভেসে এলো একটা গর্জন। আকাশ বাতাশ কাঁপিয়ে আঁছড়ে পড়লো ওদের কানে।
নিখাদ বিস্ময়ে উপস্থিত সবাই চমকে উঠল। তাদের সত্তায় যেন বারোশো ভোল্টের ঝটকা দেওয়া হয়েছে একটা! উত্তেজনার আতিশয্যে দুজন কনস্টেবল সঙ্গে সঙ্গে গেটে বাড়ি মেরে বসলো; দ্রুম দ্রুম। গেটটা একটুও নড়লো না, ভেতর থেকে লাগানো আছে ওটা। দরজা নাড়ানোর প্রত্যুত্তরে সাড়াও এলো না কোনও। এসআই কামরুল তখন নির্দেশ দিলো, “এখনি প্রাচীর বেয়ে ভেতরে ঢুকে গেটটা খোলো।”
“ইয়েস স্যার,” বলে স্যালুট ঠুকে একজন কনস্টেবল তর তর করে প্রাচীর বেয়ে উপরে উঠল। ভেতরে তাকিয়ে দেখলো না কাউকে। দারোয়ান নেই, জায়গাটা ফাঁকা। এরপর সে ভেতরে ঢুকে খুলে দিলো গেটটা।
এসআই কামরুল তার দলবল নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলো।
(১৮)
আর্তনাদটা শোনার পর হিসেব কষে বুঝতে পারলাম, ওটা কার? সাবের চাচা আগেই মারা গেছেন। গলার স্বরটা স্যারেরও নয়। বাকি থাকলো আর একজন। তার মানে চিৎকারটা দারোয়ান রহমতের।
যতটা দ্রুত সম্ভব আমি ওপরে যেতে লাগলাম। নিজেকে টেনে নিয়ে যেতে লাগলাম হাঁচড়ে পাঁচড়ে। শরীরে শক্তি নেই। বেশি জোরে নড়তে পারছি না। কাঁধটাও ব্যথা হয়ে আছে। নিজেকে যতই চাপ দিচ্ছি, মনে হচ্ছে আমার দেহটা, আমার পুরো চেতনা ভেঙে পড়ে যাবে এখানেই। আর সেটা হলে আমি জানি না, কী হবে আমার? ওপরে অমানব নামক জন্তুটা পুরোপুরি মুক্ত হয়ে আছে! কোনওভাবে আমাকে পেলে টুকরো টুকরো করে ফেলবে নির্ঘাৎ। জেগে থাকলে আমি অন্তত নিজেকে বাঁচাবার চেষ্টা করতে পারব, কিন্তু অজ্ঞান হয়ে পড়লে আর সুযোগ থাকবে না একটুও।
এক পা, এক পা করে আমি সিঁড়ি বেয়ে উঠতে শুরু করলাম। মনে হল যেন দশ কেজি ওজনের একেকটা বোঝা টেনে তুলছি। থপ থপ করে পা ফেলে যখন উপরে উঠলাম, গর্জন শুনলাম একটা। গর্জনটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে আমার বুকটা ধ্বক করে উঠল। আমি জানি ওটা কার। কার না বলে কীসের বলাই ভালো। কারণ, ডাকটা অমানবের।
নিজেকে বাড়িটার ভেতরে টানতে গিয়ে আবিষ্কার করলাম, ডুপ্লেক্স বাড়িটার দোতালায় যাবার সিঁড়ির কাছে রক্তাক্ত একটা লাশ। লাশটার চেহারা স্পষ্ট হয়ে উঠল একটু কাছে এগোতেই। ওটা দারোয়ান রহমতের। প্রাণহীন নিথর দেহটা পড়ে আছে কাত হয়ে। একটা চোখ খুবলে নেয়া, আরেকটা চোখ ড্যাব ড্যাব করে চেয়ে আছে আমার দিকে। বুকটা কেমন খচ করে উঠল। হয়তো স্যারের চিৎকার শুনে বাড়িতে দৌড়ে এসেছিলো লোকটা, আর এসে অমানবের হাতে বেঘোরে মরেছে।
ড্রয়িং রুম থেকে হুটোপুটির শব্দ ভেসে আসছে। জোরালো গরগর আওয়াজও ভেসে আসছে তার সঙ্গে। পশুটা আর এলসেশিয়ানটা লড়ছে ওখানে। এখানে থাকাটা মোটেও নিরাপদ নয়। যেকোনও মুহূর্তে এ ঘরে চলে আসতে পারে ওগুলো। তখন জানি না, কী বিপদ তেড়ে আসবে আবার?
এ মুহূর্তে বোধহয় আমার চেয়ে অসহায় কেউ নেই পৃথিবীতে। কী করবো জানি না, ভাবতেও পারছি না। তবে আচমকাই মনে হল; আমার সত্তার ভেতর থেকে যেন এলো কথাটা-একবার স্যারকে দেখে আসি।
দোতালার সিঁড়ি ধরে উঠতে শুরু করলাম। আমার যে খুব কষ্ট হচ্ছে, সেটা নিশ্চয়ই বলতে হবে না। তীব্র… ভয়ানক রকম তীব্র ব্যথার সঙ্গে লড়াই করে আমি নিজেকে টানতে থাকলাম। প্রতিটা পদক্ষেপের সঙ্গে সঙ্গে পেছনে হুটোপুটির শব্দটা কমে এলো। এরপর যখন আমি স্যারের ঘরে পা রাখলাম, একেবারে মিলিয়ে গেলো শব্দটা। ওদের লড়াই এখনও চলছে কিনা জানি না। তবে চললেও তার শব্দ দেয়ালের স্তর ভেদ করে উপরে আসছে না।
একটা দীর্ঘশ্বাস টেনে ঘরের ভেতরটায় তাকালাম। পুরো ঘরটা লণ্ডভণ্ড, কেয়ামত বয়ে গেছে যেন। সবকিছু ছড়িয়ে ছিটিয়ে, বিছানার চাদর ফালা ফালা, দেয়ালে নখের আঁচড় আর মেঝেতে রক্ত। স্যারের দেহটা পড়ে আছে ঠিক রক্তের মাঝখানে।
কাঁচা রক্তের গন্ধ নাকে লাগলো। গাটা শিউরে উঠল আমার। নখের আঁচড়ে স্যারের দেহটা ফালা ফালা, জায়গায় জায়গায় মাংস নেই, খুবলে নেয়া। দেখতে আমার মৃত বাবার লাশটার মতো লাগছে।
স্যারের দেহটা নড়ছে তারপরও, খুব ক্ষীণভাবে। স্যার দূর্বল স্বরে গোঙাচ্ছেন কী যেন। আমি কাছে যেতেই বুঝতে পারলাম, গুঙিয়ে গুঙিয়ে পানি চাচ্ছেন তিনি। হঠাৎ কেন যেন মায়া হল আমার। জানি না, তার প্রতি মায়া হওয়া উচিত কিনা? তারপরও দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো একটা। আমি এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখলাম একটা কাচের জগ ভেঙে পড়ে আছে মেঝেতে। এখনও একটু পানি রয়ে গেছে সেটার তলায়। আমি স্যারের মাথাটা যত্নের সঙ্গে কোলে নিলাম। তারপর সাবধানে পানিটুকু তুলে দিলাম তার মুখে। কিন্তু ভাগ্য করুণ বলতে হয়, আর পারলেন না তিনি। পানিটুকু গলায় পড়ার আগেই শেষ নিশ্বাসটা ত্যাগ করলেন। জীবনের শেষ পানিটুকুও খাওয়া হল না তার। স্যার মারা গেলেন নিজেরই সৃষ্টির হাতে!
অজান্তেই আমার বুক চিরে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। কেন জানি লাশটাকে ধরে রেখে মনে হল, আমার মৃত বাবার লাশ ধরে আছি। আমার বাবারও কি শেষ মুহূর্তে পানির তেষ্টা পেয়েছিল? তিনিও কি মারা গিয়েছেন পানি না খেতে পেয়ে? জানি না। আমি তার মাথাটা কোলে চেপে হা করে তাকিয়ে থাকলাম।
এভাবে কতক্ষণ বসে ছিলাম জানি না। সম্বিত ফিরে পেলাম একটু পর, যখন আমার ঠিক পেছনে খস খস একটা আওয়াজ হল, পঁচা ডিমের মতো বোটকা গন্ধটা ধাক্কা দিলো নাকে। সঙ্গে সঙ্গে শিউরে উঠলাম। কাছে… একেবারে কাছে চলে এসেছে ওটা। ঠিক আমার পেছনে।
এবারে কী মরতে হবে আমাকে?
আমার সাহস হচ্ছে না পেছনে তাকানোর। কাঁপা কাঁপা বুকে তবুও একবার পেছনে তাকালাম। তাকাতেই চোখে চোখ পড়লো জিনিসটার, পাতাবিহীন, গোল বড় একটা চোখ। আমার ঠিক ইঞ্চি দুয়েক দূরে। ঠোঁট বিহীন ধারালো দাঁত, ঈষৎ ফাঁক করা, লালা পড়ছে গড়িয়ে।
কিছুক্ষণ আগের হালকা হয়ে আসা ভয়টা আবার জেগে উঠল আমার ভেতর। অজান্তেই হাত দুটো তুলে মুখটা ঢাকলাম। অনুভব করলাম, আমার অনুভূতি যেন অসাড় হয়ে আসছে। মাথা ঝিম ঝিম করছে। নিভে আসছে সমস্ত চেতনা।
ভয়ানকভাবে জন্তুটা গর্জে উঠল; আমার পুরো সত্তাটুকু নাড়া দিয়ে। মুখ থেকে ছুটে আসা গরম বাতাসের ছাঁট পেলাম। যেকোনও মুহূর্তে আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে পশুটা।
ঠিক তখনই আমি যে আওয়াজটা শুনলাম, সেটা পুরোপুরিই আমার আশার বাইরে। ঘরের গুমোট বাতাস বেয়ে ভেসে এলো শব্দটা।
একটা গুলির আওয়াজ!
তার ঠিক সঙ্গে সঙ্গেই গুঙিয়ে উঠল জন্তুটা, কেমন একটা ব্যথাকাতর গর্জন। ঝট করে তাকিয়ে দেখলাম, দরজায় দুজন পুলিশ দাঁড়িয়ে, বন্দুক ওঁচানো একজনের, গুলি করেছে অমানবকে। শেষ গর্জনটা সেই গুলির আঘাতের প্রেক্ষিতেই।
আবার গুলি করলো পুলিশটা। এবারে হিঁসিয়ে উঠল অমানব। পুলিশ দুটোর দিকে ছুটে গেলো। পশুটার থামার কোনও লক্ষণ নেই দেখে অনবরত গুলি চালিয়ে গেলো পুলিশটা। তার আরেক সঙ্গীও বন্দুক উঁচিয়ে গুলি করতে শুরু করেছে এতক্ষণে। তবুও থামলো না অমানব। স্যারের বলা একটা কথা মনে পড়লো আমার, কোনও অস্ত্রই জিনিসটার কোনও ক্ষতি পারবে না, যেকোনও ক্ষত নিমেষেই রিজেনারেট করে নেবে।
মুহূর্ত কয়েকের মধ্যেই পুলিশ দুটো অমানবের শিকার হল। প্রাণীটা ছিঁড়ে-ফুঁড়ে ফেললো ওদের। আবার নিচ থেকে গুলির আওয়াজ ভেসে এলো। আবার এসে আঘাত করলো ওটাকে। ওটা আবারও ছুটে গেলো। আমি ঠায় বসে রইলাম। হতবাক হয়ে গেছি যেন। এভাবে কিছুক্ষণ গুলির শব্দ শোনা গেলো। তারপর আর নেই।
আমি আরও কিছুক্ষণ বসে রইলাম। স্থির হয়ে যেন জমে গেছি। তারপর উঠে দাঁড়ালাম।
পালাতে হবে।
ঝাড়া দিয়ে সজাগ করে নিলাম সত্তাটা। স্যারের ঘর থেকে বেড়িয়ে এসে সিঁড়ি ধরে নামতে শুরু করলাম। নামতে নামতে দেখলাম সিঁড়িতে একটা পুলিশের লাশ। আরেকটু এগোলাম। সিঁড়ি গোড়ায় একজন। রহমত বাদেও আরেকজন পুলিশ।
বাসার দরজাটা হাট করে খোলা। দরজার সামনে এলসেশিয়ানটার ক্ষত-বিক্ষত দেহ। শক্তিতে পেরে ওঠেনি অমানবের সঙ্গে। আরেকটু এগোলাম। বাসা থেকে বের হয়ে দরজার সামনে আরেকটা ক্ষত-বিক্ষত লাশ, পুলিশের।
আমি ধুকে ধুকে এগোচ্ছি। আমার জানা নেই, কেন এসেছে পুলিশগুলো? এরপর লনে আরও দুটো লাশ দেখলাম। এ দুটোও পুলিশ। আরও খানিক সামনে বাড়ির সদর দরজাটাও হা করে খোলা। আমি সেটার দিকে এগিয়ে গেলাম।
আকাশে মেঘ করেছে। কালো হয়ে গেছে, ডাকছে গুড় গুড়। বাতাসে অদ্ভুত একটা শীতলতা। হঠাৎ জোরালো একটা গর্জন করে ঝরতে শুরু করলো আকাশটা। পুরো পৃথিবীটাকে ভিজিয়ে দিতে নিচে নেমে এলো বৃষ্টি। গায়ের রক্তমাখা শার্টটা আস্তে আস্তে ভিজে যাচ্ছে সেই বৃষ্টিতে।
আমি গেটটা দিয়ে বের হলাম। একটা পুলিশের জিপ সামনে দাঁড়িয়ে। তার ডানপাশে মাটিতে পড়ে আছে আরেকটা ক্ষত-বিক্ষত লাশ, সাদা পোশাকে। আমার জানা নেই, কে? হতে পারে গাড়ির ড্রাইভার… কেমন যেন কেঁপে উঠল বুকটা। কষ্ট লাগছে লোকগুলোর জন্য।
গাড়িটার ড্রাইভিং সিটে উঁকি দিলাম। কী-হোলে এখনও চাবি লাগানো। কিছু না ভেবে আমি উঠে বসলাম। তারপর চাবিটা ঘুরিয়ে স্টার্ট দিলাম গাড়িটা। গিয়ার সেট করে পিক আপে চাপ দিলাম। গাড়িটা চলতে শুরু করলো। আমি মুক্তি পেয়েছি নরক থেকে। মৃত্যুর কাছ থেকে ফিরে এসেছি। এখন যত তাড়াতাড়ি পারি, সরে যেতে হবে এখান থেকে।
সামন থেকে হঠাৎ চোখ পড়লো ডানে। দূরে দেখলাম, ধানখেতের মাঝ দিয়ে ছুটে যাচ্ছে অমানব। যাওয়ার সময় সবুজ ধানখেতের ধানগাছগুলো শুইয়ে চিহ্ন রেখে যাচ্ছে নিজের। আমি চোখ ফেরালাম। ওটাকে নিয়ে আর ভাবতে হবে না। স্যার বলেছিলেন, পুষ্টি সমস্যা আছে ওটার। আট ঘন্টার মধ্যে পুষ্টি না পেলে ওটার দেহ বাষ্প হয়ে উড়ে যাবে। আমি আশা করছি, আট ঘণ্টা পর ঠিক তাই হবে ওটার।
কারণ, পশুটাকে পুষ্টি দেবার কেউ নেই এখন।
অমানবকে সৃষ্টি করা অমানবের মতোই পৃথিবী থেকে বিদায় নেবে ওটা।
Tags: কল্পবিজ্ঞান উপন্যাস, তানজিরুল ইসলাম, তৃতীয় বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা, পূজাবার্ষিকী, সায়েন্স-ফ্যান্টাসি উপন্যাস, সুপ্রিয় দাস
এক কথায় অনবদ্য
ধন্যবাদ। ❤