অমিতানন্দ দাশের সঙ্গে এক সান্ধ্য কল্প-আড্ডা
লেখক: অনুলিখনঃ অঙ্কিতা
শিল্পী: দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য্য
অনুলিখনঃ অঙ্কিতা
অলংকরণ – দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য্য
বাংলা সাহিত্যে কল্পবিজ্ঞান তখন সবে তার কৈশোর পেরিয়ে সাবালকত্ব অর্জনের পথে পা বাড়িয়েছে। সেই সময়টায় বিদেশী ক্লাসিক্যাল এবং গোল্ডেন এজ সাই ফাই থেকে প্রভাবিত এক ঝাঁক তরুণ তুর্কী আমাদের মাতৃভাষায় এই প্রায় আনকোরা ধারার সাহিত্যে নতুন প্লট এবং ফর্ম বা লেখনশৈলী আনার চেষ্টা করছিলেন। এদের মধ্যে এক অগ্রগণ্য নাম শ্রী অমিতানন্দ দাশ। বর্তমানে সন্দেশ পত্রিকার যুগ্ম সম্পাদক অমিতানন্দ বাবুর কাছে এক সন্ধ্যায় গিয়ে জড়ো হয়েছিল কল্পবিশ্বের তরফে দীপ ঘোষ, সন্দীপন গঙ্গোপাধ্যায় এবং ঋজু গাঙ্গুলী। আমরা জানতে চেয়েছিলাম কল্পবিজ্ঞান নিয়ে ওঁর অভিজ্ঞতা আর ভাবনার সোপান পেরিয়ে এই ধারাকে বাংলা সাহিত্যে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য কি স্বপ্ন উনি আজো দেখেন। আটপৌরে সেই কল্প-আড্ডার অভিজ্ঞতা আমরা ভাগ করে নিলাম বন্ধুদের সাথে।
কল্পবিশ্বঃ সেইসময়, যখন পাঁচের দশকের শেষ আর ছয়ের দশকের শুরু, বাংলা সাহিত্যে কল্পবিজ্ঞান নিয়ে অনেক নতুন ধরণের কাজ হয়েছে। আপনি নিজে তখন কল্পবিজ্ঞান লিখছেন। এছাড়াও অদ্রীশ বর্ধন, সত্যজিৎ রায় এদেরকেও পাশাপাশি দেখছেন … সেই সময়টা নিয়ে যদি কিছু বলেন।
অমিতানন্দঃ সেইসময় আমি নিয়মিত ইংলিশ সায়েন্স ফিকশন পড়তাম। ম্যাগাজিনগুলো পেতাম না রেগুলারলি, মাঝে মাঝে কিছু পেতাম। তাছাড়া অ্যান্থোলজি। প্রচুর অ্যান্থোলজি ওই পুরানো ফ্রিস্কুল স্ট্রীটে সেকেন্ড হ্যান্ড কিনতে পাওয়া যেত। সেই অ্যান্থোলজি পড়তে শুরু করি। মাসির বাড়ীতে একটা বই ছিল, স্কুলে পড়ার সময় সেটা পড়েছিলাম। তারপরে সত্যজিৎ রায়ের বাড়ীতে, সেখানে খুব ছোটবেলায় সন্দীপের কাছে কমিক্স আনতে যেতাম। তারপর আবিষ্কার করলুম ওনার বাড়ীতে সায়েন্স ফিকশন অ্যান্থোলজিগুলো, তখন থেকেই অ্যান্থোলজি পড়া শুরু। ওই জুডিথ ক্লে-র অ্যানুয়াল কালেকশনগুলো। ওইখান থেকে শুরু, তারপর সেকেন্ড হ্যান্ড কিনতে শুরু করি। এখনো বোধহয় শ’খানেক অ্যান্থোলজি রয়েছে আমার কাছে। ইন্টারেস্টটা শুরু হয় এখান থেকেই। এখনকার দিনের সায়েন্স ফিকশনগুলো, বিশেষ করে পশ্চিমি সায়েন্স ফিকশনগুলো, একটু কমপ্লিকেটেড, সাইকোলজিক্যাল, এবং নেগেটিভ অ্যাপ্রোচের হয়ে গেছে। কিন্তু তখনকার দিনে গল্পগুলো সিম্পল পজিটিভ মেন্টালিটির ছিল।
কল্পবিশ্বঃ মানে ওই গোল্ডেন এজ অফ সায়েন্স ফিকশন এর সময়টার কথা বলছেন?
অমিতানন্দঃ এটা গোল্ডেন এজের কিছু পরে। তবে কন্টিন্যুয়েশন অফ গোল্ডেন এজ বলাই যায়। ১৯৩০ এর দশকটাকে অ্যাসিমভ বলে গেছেন বিফোর দ্য গোল্ডেন এজ। ৪০-৫০-এর দশকটাকে, ঐ যখন ফাউন্ডেশন সিরিজ হয়েছিল, সেই সময়টাকে গোল্ডেন এজ বলা যেতে পারে। তো সেই সময়, অ্যাসিমভ, ক্লার্ক, ব্র্যাডবেরি … কিন্তু একেক জনের স্টাইল আলাদা।
কল্পবিশ্বঃ একটা প্রশ্ন ছিল। স্টার্জন, হাইনলাইন প্রভৃতি লেখকের লেখায় আমরা এক ধরণের মানসিকতা দেখেছি যেটাকে অনেকাংশেই রক্ষণশীল মানসিকতা বলা যায়। বর্তমান সময় তাদের বা তাদের মানসিকতাকে প্রায় উপেক্ষা করার মতো করেই দেখা হয়। সেই জিনিসটা কিন্তু কখনো বাংলা কল্পবিজ্ঞানে আসেনি। মানে সেই ধরণের মানসিকতা। এর কারণটা কি? যেমন ধরা যাক ‘স্টারশিপ ট্রুপারস’-এ মিলিটারি সায়েন্স ফিকশনের সঙ্গে একটা কট্টর দক্ষিণপন্থী মানসিকতা বা স্টার্জনের ‘সাম অফ ইয়োর ব্লাড’-এ যে ধরণের ভাবনা চিন্তা এসেছে। বা হাইনলাইনের ক্ষেত্রেই আমি বলব, প্রিডেস্টিনেশন প্যারাডক্সের মধ্যেই একটু অন্যরকম চিন্তাভাবনা। আমরা কিন্তু সেই ধরণের জটিল ব্যাপারটা কখনোই বাংলাতে পাইনি।
অমিতানন্দঃ বাংলাতে আসলে রিয়েল সায়েন্স ফিকশন বলতে কিন্তু খুব বেশী কিছু লেখা হয়নি।
কল্পবিশ্বঃ অনেকক্ষেত্রেই ফ্যান্টাসি ঢুকে গেছে।
অমিতানন্দঃ ফ্যান্টাসি ঢুকে গেছে অথবা খুব সিমপ্লিফায়েড। প্লটগুলো খুব সিমপ্লিফায়েড। পশ্চিমী সায়েন্স-ফিকশনে যে স্ট্যান্ডার্ড হয়, এখানে ঠিক সেরকম হয়নি। এখানে লিখতে গেলেও একটা প্রবলেম আছে। একটু কমপ্লেক্স প্লট দিতে গেলে পাঠকরা নিতে পারবে না। সত্যজিৎ রায়ের ক্ষেত্রে ধরতে গেলেই, শঙ্কুর প্রথম গল্পটা তিনি নিজেই বলেছিলেন ফাজলামি উপন্যাস। পরের শঙ্কুগুলো খানিক সিরিয়াস। তাও সেই বাচ্চাদের জন্য সিম্পলভাবেই লেখা।
কল্পবিশ্বঃ আচ্ছা সেই সময় অদ্রীশ বাবুর সঙ্গে আপনার আলাপ কিভাবে হল? আপনি আশ্চর্যের সঙ্গে কিভাবে যুক্ত হলেন?
অমিতানন্দঃ আমি অদ্রীশবাবুর ঠিকানা খুঁজে খুঁজে গিয়ে লেখা জমা দিয়েছিলাম। দুটো লেখা ছাপা হয়েছিল আশ্চর্যতে। তারপরে ধীরে ধীরে আলাপ পরিচয় বাড়ে। যখন ফ্যান্টাস্টিক শুরু হল তখন আমি ওনাদের সঙ্গে কাজ করছি। সুজিত ধর নামে একজন ছিলেন। যাঁর কম্পোজ মেশিন ছিল। তাঁর সঙ্গেই মিলিতভাবে কাজ করা হত। সেই সময় শিয়ালদায় টাইপ এত কম ছিল যে ওই ষোল পাতা ছাপা হচ্ছে, সেটা ছেপে আবার টাইপগুলো ফেরত আসছে। আবার ষোল পাতা কম্পোজ হচ্ছে। আবার ছাপতে পাঠানো হচ্ছে।
একটা বড় গল্পে আমি এক চরিত্রের নাম রেখেছিলাম সুরঞ্জন। সুজিতবাবু বললেন, না ওটা বিনয় করে দাও। কেন? কারণ, অত যুক্তাক্ষরের টাইপ কোথায়! অবশ্য নিজেদের মধ্যে সেই আন্ডারস্ট্যান্ডিংটা ছিল। আমার আগেই দলে যোগ দিয়েছিলেন রণেন ঘোষ। উনি সুজিতবাবুকে ফাইন্যান্সও করতেন। সেইসময় আমাদের একটা দল তৈরি হয়। তৎকালীন লেখকদের নিয়ে। নিরঞ্জন সিংহ, রাজকুমার রায়চৌধুরী … অনীশ দেবও ছিলেন।
কল্পবিশ্বঃ আপনারা এই যে পত্রিকাগুলো করতেন। তখন তো এই পুরো ব্যাপারটাই অত্যন্ত কষ্টকর ছিল। ডিটেলিং থেকে শুরু করে ছাপানো সবকিছুই। পত্রিকাগুলো অর্থনৈতিকভাবে দাঁড়াতে পারত?
অমিতানন্দঃ খুব একটা নয়। আশ্চর্যটা আমি ঠিক জানি না। তবে পরে ফ্যান্টাস্টিকে উনি যে ফরমুলাটা করেছিলেন। মানে বই বার করা। একটা দেড়শো পৃষ্ঠার ম্যাগাজিন। তার মধ্যে ৯৬ পেজ কি ১২০ পেজের একটা বই বেরিয়ে গেল। একই সঙ্গে বই আর ম্যাগাজিন ছাপা হল। বইটা এত কপি, আর ম্যাগাজিন এত কপি। বইটা বাঁধিয়ে বিক্রি হয়ে গেল। ম্যাগাজিনটা বিক্রি হল। এই করে উনি দাঁড় করিয়ে ছিলেন।
কল্পবিশ্বঃ আমার মনে হয় নীলগ্রহের মানুষ এইভাবেই বই হিসাবে বেরিয়েছিল। এছাড়াও ১৯৮২ কি ৮৩-র বইমেলাতে উনি একটা ব্যাপার করেছিলেন। পাঁচটা গল্পের একটা সংকলন বার করেছিলেন। তাতে বইমেলায় বসে উনি সইও করেছিলেন। তাতে সমুদ্র মানুষ ছিল, বন মানুষের হাড় ছিল। এই সংকলন করে বই হিসাবে বের করার জন্য আমার মনে হয় ফ্যান্টাস্টিক কিছু দিন ভায়াবল হতে পেরেছিল।
অমিতানন্দঃ আমাদের বিস্ময় যখন চলছিল, তখন লেখকদের আড্ডা টাড্ডা সবই জমল। কিন্তু সুজিত ধর যেটা ভেবে শুরু করেছিলেন যে নিজের একটা প্রফিটেবল ইনকাম হবে, সেটা আর হল না। সেই জন্যে আলটিমেটলি ওটা বন্ধ হয়ে গেল। ওই কারণেই।
কল্পবিশ্বঃ আগেকার দিনে যে ধরণের অনুবাদ ছিল, মানে ধরুন গাবলু সিংকে নিয়ে আপনি নিজেই যেটা লিখেছিলেন। অচেনা শহরে গল্পটা। একদমই মনে হয়নি অনুবাদ বা আরোপিত। কিন্তু পরে সেইভাবে আর বিদেশী গল্পকে আত্তীকরণ করে বাংলায় অনুবাদ করাটা চলল না কেন?
অমিতানন্দঃ সব গল্প তো অনুবাদ করা যায় না। অনেক গল্প যায়। যেমন আর্থার সি ক্লার্কের আদিবাসীদের আদিখ্যেতা। গল্পটা বেশ অ্যাপ্রিসিয়েটেড হয়েছিল। বা সেপাই শিহরণ। এখানে অরজিনাল গল্পটা ছিল ইউরোপিয়ান হিস্ট্রি নিয়ে। ইউরোপিয়ান হিস্ট্রিকে ইন্ডিয়ান হিস্ট্রিতে চেঞ্জ করে প্লটটা খাড়া করা হয়েছিল। তখন গল্পগুলো লোকে নিয়েছিল।
কল্পবিশ্বঃ এখন যারা লিখছেন তারা আর সেরকম অনুবাদ করেন না। অন্ততঃ পত্রিকাগুলোতে তো আর অনুবাদ সেইভাবে দেখাই যায় না। আসলে এখন তো পত্রিকাগুলোতে কল্পবিজ্ঞানের জন্য স্লটই খুব কম। তার উপরে আবার অনুবাদ … তার ওপর আরও একটা সমস্যা। এখনকার ইংলিশ গল্পগুলো টেকনিক্যালি বা অন্যান্য দিক থেকে এত বেশী জটিল। সেই সমস্ত গল্পগুলো পড়ে পরিষ্কার বোঝা যায় যে ওই গল্প আমরা বাংলায় লিখতে পারব না।
অমিতানন্দঃ লেখা কেন যাবে না? কিন্তু পাঠকের কাছে পৌঁছান যাবে না।
কল্পবিশ্বঃ হ্যাঁ। এই পৌঁছানটা একটা বড় ব্যাপার। গত বছর দেবজ্যোতি বাবু একটা সুন্দর অনুবাদ করেছিলেন।ল্যুইস প্যাজেট মানে হেনরি কুটনার আর সি এল ম্যুরের ‘মিমসি ওয়্যার দ্য বোরোগোভস’ থেকে। গল্পটা কিছুতেই পাঠকের কাছে পৌঁছতে পারল না। আমার প্রশ্নটা হচ্ছে এতদিনেও বাংলা কল্পবিজ্ঞান আপনাদের জায়গাটা পেরিয়ে এগোতে পারল না কেন?
অমিতানন্দঃ আমরাও তো জায়গাটাকে কোনমতেই ধরে রাখতে পারলাম না। ফ্যান্টাস্টিককে ফাইনান্সিয়ালি ভায়াবল করতে গিয়ে, অবশ্যই সেটারও প্রয়োজন ছিল, কিন্তু তাতে করে লেখকগোষ্ঠী চাপে পড়ে গেল। তার পরবর্তীকালেও সেইভাবে মেইনস্ট্রিমে আর কাজ হল না।
কল্পবিশ্বঃ রিসেন্টিলি কয়েকজনের লেখায় ফ্যান্টাসির চেয়ে বিজ্ঞান খানিকটা হলেও ফিরে আসছে। তবে সেই পাঠকের পছন্দের ডাইকোটমিটা এখনও আছে। যেমন ধরুন অভিজ্ঞান রায়চৌধুরী হলেন আমাদের প্রজন্মের একজন সাহিত্যিক, যিনি ডেডিকেটেডলি কল্পবিজ্ঞানটা লিখেছেন। তবু রিসেন্টলি উনি ফেসবুকে একটা পোস্ট দিয়েছিলেন। পুজোসংখ্যায় একটা রহস্য উপন্যাস লেখার সময় উনি ন্যানো টেকনোলজির কিছু জিনিস ব্যাবহার করবেন ভেবেও পিছিয়ে আসেন। কারণ ওটা করলে ওনাকে একটা বড় সংখ্যক পাঠক হারাতে হত। পাঠক নিত না অত টেকনিক্যাল জটিলতা।
অমিতানন্দঃ এটা তো একটা বড় সমস্যা বটেই। এর জন্যেই সন্দেশের রিসেন্ট অনুবাদ ইস্যুটাতে গল্প খুঁজতে খুঁজতে আমি পিছিয়ে গিয়ে সেই একশো বছর আগেকার এইচ জি ওয়েলস-এর গল্প বাছালাম। সহজ গল্প। কোন বিশেষ টেকনিক্যাল জটিলতা নেই।
কল্পবিশ্বঃ সেটাই সবথেকে বড় সমস্যা। এই সময়ের পশ্চিমের যে কল্পবিজ্ঞান সেগুলোকে অনুবাদে ধরা … সেটার একটা বড় কারণ, ওটা আমাদের সমাজের সঙ্গে খাপ খায়না। লাস্ট কুড়ি বছর ধরে ওয়েস্টার্ন দেশগুলোতে এখন যেধরণের কল্পবিজ্ঞান চর্চা চলছে সেগুলো খুব স্পষ্টভাবেই বামপন্থী মানসিকতা ঘেঁষা। হুগো, নেবুলা এরা তো পরিষ্কারভাবে লিবারাল ডেমোক্র্যাটিক এক একটা লবি। এতটাই বামপন্থী যে নতুন সংকলনগুলোতে হাইনলাইন নেই, স্টার্জন নেই। তার একমাত্র কারণ কি? না, বর্তমান পলিটিক্যাল কারেক্টনেসের মধ্যে ওরা ব্রাত্য। এক ধরণের উল্টো ম্যাকার্থিজম … সেইজন্যে মনে হয় আজকের বাঙালী মানসিকতায় এখনকার পাশ্চাত্য কল্পবিজ্ঞান নেওয়া সম্ভব না। বেশ কিছু হুগো নেবুলা পাওয়া গল্পকে আমরা অনুবাদ করব ভেবেছিলাম। কিন্তু পড়ে বুঝলাম প্রায় অসম্ভব। আচ্ছা আমরা আবার দেশে ফিরে আসি।
অমিতানন্দঃ সেই ভালো।
কল্পবিশ্বঃ আপনি এতদিন ধরে সন্দেশের সঙ্গে যুক্ত। সন্দেশ কল্পবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে কি ধরণের কাজ করেছে? বা এর মাধ্যমে কি নতুন কল্পবিজ্ঞান লেখককে তুলে আনার কোনরকম সহায়তা …
অমিতানন্দঃ স্পেসিফিক্যালি নয়। তবে সাধারণভাবে সেরকম গল্প এলে আমরা অবশ্যই এনকারেজ করতাম।
কল্পবিশ্বঃ পুরোনো সন্দেশের মধ্যে আমি একজন লেখককে পেয়েছিলাম। অভিজিৎ চৌধুরী নামে। তিনি দুটো মাস্টারপিস লিখেছিলেন। একটা আনন্দমেলায়। কর্ভাস। আরেকটা জলাতঙ্ক। পরে কিন্তু সেই লেখককে আর পেলাম না।
অমিতানন্দঃ হ্যাঁ ওই লেখককে আমরা পরে যোগাযোগ করেছিলাম। লেখাও চেয়ে পাঠিয়েছিলাম। উনি দু একটা লেখা দিয়েওছিলেন। কিন্তু সেই ধার ছিল না আর লেখায়। এমনকি পাঁচ ছয় বছর আগেও লেখা চেয়ে নিয়ে এসেছিলাম। কিন্তু সেইটা যেন মিসিং।
কল্পবিশ্বঃ আপনার কি মনে হয়? এখন যারা কল্পবিজ্ঞান সবে লিখতে শুরু করেছে এদেরকে নারচার করতে পারলে আবার সেই বিস্ময়, ফ্যান্টাস্টিকের সময়ের জিনিস ফিরে পাওয়া যেতে পারে?
অমিতানন্দঃ লেখকদের এক জায়গায় বসে আড্ডা মারাটা খুব জরুরী। আড্ডা এবং গল্পের মাধ্যমেই অনেক কিছু উঠে আসে। সেরকম করতে পারলে হয়ত…
কল্পবিশ্বঃ আমরা কল্পবিশ্বের তরফ থেকে কয়েকবার এমন আড্ডার পরিসর করেছি। সেখানে এই চিন্তার আদানপ্রদানের ব্যাপারটা বেশ উপভোগ্য হয়েছিল আর কে কি পড়ছে বা ভাবছে সেটা থেকে নতুন বেশ কিছু দিকও উঠে এসেছিল। কিন্তু নিয়মিত ভাবে ব্যাপারটা বজায় রাখা সম্ভব হয় না।
অমিতানন্দঃ যেহেতু এটা একটা স্পেসিফিক ব্যাপার। সাধারণ গল্পের মত নয়। সেগুলো প্রায় সবাই পড়ছে সবাই আলোচনা করছে। এটার ক্ষেত্রে সমমনস্ক মানুষ নিয়ে গ্রুপ ইন্টার্যাকশন করতে পারলে খুব ভালো হয়। এবং সেটা প্রয়োজনও।
কল্পবিশ্বঃ সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে কল্পবিজ্ঞান নিয়ে আপনার কখনো আলোচনা হয়েছে?
অমিতানন্দঃ খুব বেশী নয়। খুব সিম্পল দু একটা জিনিস নিয়ে একটু আধটু কথা হয়েছে, এই আর কি।
কল্পবিশ্বঃ ময়ূরকন্ঠী জেলি ছাড়া সত্যজিৎ রায়ের আর কোনও গল্পকে কি কল্পবিজ্ঞান বলা যেতে পারে?
অমিতানন্দঃ ময়ূরকন্ঠী জেলি ফ্যান্টাসি।
কল্পবিশ্বঃ অনুকূল।
অমিতানন্দঃ হ্যাঁ অনুকূল। ওই গল্পটা কল্পবিজ্ঞান। আরেকটা গল্প আছে, প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য, কিন্তু তাকেও ফ্যান্টাসিই বলা যেতে পারে। ফ্রিৎজ। আর শঙ্কুর কিছু গল্পে সামান্য সায়েন্স … আসলে উনি তো হার্ডকোর সায়েন্স ফিকশন রাইটার নন। ওনার বেশীরভাগ লেখাতেই ফ্যান্টাসি মিস্ট্রি এইধরনের টেম্পারামেন্ট।
কল্পবিশ্বঃ সায়েন্স ফিকশন সিনে ক্লাবের সম্পর্কে স্মৃতির কথা যদি কিছু বলেন।
অমিতানন্দঃ আমি সায়েন্স ফিকশন সিনে ক্লাবের সিনেমাগুলো দেখেছি। সেগুলো তখন বেশ লাগত। অদ্রীশ বাবু আর সত্যজিৎ বাবু বেশ ডেডিকেটেডলি ব্যাপারটা পরিচালনা করতেন সেটা দেখেছি। প্রেমেন্দ্র মিত্রও ছিলেন। কিন্তু আমি নিজে তখন ওই ক্লাবের সঙ্গে সেইভাবে অ্যাক্টিভ ছিলাম না। আমি সিনে সেন্ট্রালের মেম্বার ছিলাম। তবে আলাদা করে সায়েন্স ফিকশন সিনে ক্লাবের মেম্বার ছিলাম না।
কল্পবিশ্বঃ তখন সায়েন্স ফিকশন সিনে ক্লাব কোন ধরণের সিনেমা আনার চেষ্টা করত?
অমিতানন্দঃ মাঝে মাঝে চেষ্টা করত বিভিন্ন দেশের ছবি আনার জন্য। চয়েসটা মূলতঃ সত্যজিৎ বাবুরই ছিল। তবে তখন ছবিগুলো জোগাড় করাও চাপের ছিল।
কল্পবিশ্বঃ বাংলায় আগামী দিনের কল্পবিজ্ঞান নিয়ে আপনার ভাবনা কি?
অমিতানন্দঃ আমি আশা ছেড়ে দিইনি। তোমরা যেমন একটা প্ল্যাটফর্ম করেছ। মনে হয় কিছু নতুন লেখকও উঠে আসছে … তবে পড়াশুনো করতে হবে অনেক কারণ এটা একটা নিস ধারা। আর শেষমেশ ভালো গল্প বলার জন্য কল্পনা শক্তির দরকার। সেটা কারো এমনিতেই আসে বা নিরন্তর চর্চার মধ্যে দিয়ে কিছুটা আনা সম্ভব। আশা করব আগামীতে যারা লিখতে আসবেন তারা আগে ভালো পাঠক হবেন।
Tags: অঙ্কিতা, অমিতানন্দ দাশ, ইন্টারভিউ, তৃতীয় বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা, দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য্য, পূজাবার্ষিকী
কল্পবিশ্বের এই ব্যাপারটা আমার খুব ভালো লাগে। প্রথিতযশা পাকামাথাদের ইন্টারভিউ বের করা। এই কথোপকথনটাও বেশ লাগলো। উপরোক্ত কথোপকথনে স্মৃতিচর্চাই বেশী হয়েছে, উপদেশ দিয়েছেন কম। সেটা অবশ্য জ্ঞানী মানুষদের কাছ থেকে আদায় করাও মুশকিল।
সবকথাই যে মনে ধরলো তা নয়, যেমন বাঙালি পাঠকের উপর ওঁর আস্থা বেশ কম। তবে এঁদের কথোপকথন থেকে বিশেষত নবীন লেখকরা খুবই উপকৃত হবেন। একটা কথা খুব দামী বলেছেন যে, লেখকদের এক জায়গায় হয়ে আড্ডা দেওয়াটা খুব জরুরী। যেটা সাগরময় ঘোষও খুব এনকারেজ করতেন। কল্পবিশ্ব টিম এটা নিয়ে একটু ভাবতে পারে।
অবিশ্যি আগেকার দিনের মত সেই আড্ডাঘরে জমায়েত হয়ে চা ও সিঙারা সহযোগে অনন্ত আড্ডা দেওয়া, সেইদিন আর নেই। প্রধান অসুবিধে লেখকরা সবাই একজায়গায় থাকেনও না। কেউ কলকাতা তো কেউ বেঙ্গালুরু। ভারতবর্ষের বাইরেও বহু বাঙালি আছেন। আজকের আড্ডা দেওয়ার প্রধান মাধ্যম হল ফেসবুক। তবু যে আড্ডা হয় না তার কারণ লেখকরা কেউ পরস্পরকে চেনেন না। মুখোমুখি আলাপ না থাকলে ভরসা করে মন খোলা যায় না। ফেসবুকের আলাপেও আজকাল অনেকে বিয়ে করতে ছুটছে বটে কিন্তু একটা বয়সের পর আর সেটা হয় না। এই আলাপ করিয়ে দেওয়ার কাজটা কল্পবিশ্ব নিতে পারে। মাঝেমধ্যে এক একটা মিট করে, এই ধরুন পুজোর সময়, কি পয়লা বৈশাখে। একবার আলাপ পরিচয় হয়ে গেলে এঁরা কল্পবিশ্ব গ্রুপেই দেদার আড্ডা দিতে পারবেন বলে আমার বিশ্বাস। এই যেমন ধরুন দেখা হলে সুদীপদার কি সন্তুদার কাছে দুচার-ঘা খেতে পারি এই ভরসা না থাকলে কি আর মন খুলে ওঁদের লেখার বিরূপ সমালোচনা করতে আমিই পারব?