অস্তিত্ব-বর্ণ
লেখক: সুপ্রিয় দাস
শিল্পী: সুমন দাস
দীর্ঘ দুমাস নিস্তরঙ্গ ভাবে ভেসে আসা বিষ্ণুবাহন-৫ মহাকাশযানটা অবশেষে একটা মৃদুস্পন্দন তুলে হঠাৎ যেন জেগে উঠল। যানের যাত্রী পাঁচজন কিন্তু ইতিমধ্যেই উত্তেজনায় সজাগ। ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এক অভিযানের শরিক এই পাঁচজন। ক্রমশ মহাকাশযানের গতিবেগ কমে এল আর মহাকাশযানের স্বয়ংক্রিয় নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা তার গতিপথ সংশোধন করে তাদের গন্তব্যের দিকে এগিয়ে নিয়ে চলল। তাদের গন্তব্য পৃথিবী থেকে পনেরো কোটি মাইল দূর দিয়ে সূর্যের দিকে ধেয়ে আসা নতুন আবিষ্কৃত ধূমকেতু রুদ্রাণী। ভারতীয় মহাকাশ বিজ্ঞান গবেষণাসংস্থার লাদাখে অবস্থিত গামা-রে টেলিস্কোপে রুদ্রাণীর অস্তিত্ব ধরা পড়েছিল আজ থেকে প্রায় তিন বছর আগে। সূর্যকে প্রদক্ষিণ করা ধূমকেতুদের অস্তিত্ব হঠাৎ ধরা পড়া কোন বিরল ঘটনা নয়। কিন্তু এই ধূমকেতুটা আবিষ্কার হওয়ার পর থেকেই সারা পৃথিবীর বৈজ্ঞানিকদের মধ্যে প্রবল চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছে। রুদ্রাণীর থেকে পৃথিবীতে এসে পৌঁছনো বিকিরণের বিশ্লেষণ করে চমকে উঠেছিল সারা পৃথিবীর বৈজ্ঞানিক মহল। জানা গিয়েছিল যে রুদ্রাণীর শরীরের উপাদান মানুষের বিজ্ঞানের কাছে সম্পূর্ন অজানা। স্পেক্ট্রাল অ্যানালিসিস বলেছিল কম করে দশ রকমের মৌল ও তাদের বিভিন্ন যৌগিক উপাদানের অস্তিত্ব রয়েছে এই ধূমকেতুতে। কিন্তু সেই মৌলগুলো সম্পূর্ন অজানা ধরনের। পৃথিবীর কক্ষপথে অবস্থিত স্পেস ষ্টেশনের যন্ত্র বলেছিল এই মৌলগুলির অনেকগুলোই তেজস্ক্রিয় আর তাদের থেকে যেসব কণার বিকিরণ হয়ে চলেছে, তার অনেকগুলোর অস্তিত্বই মানুষ আজ পর্যন্ত শুধু অনুমানই করে এসেছে; আর এর মধ্যে কিছু কিছু কণার অস্তিত্ব তো একেবারেই মানুষের বিজ্ঞানের ধারনার বাইরে।
পৃথিবী জুড়ে হইচই পড়ে গেল। যে করেই হোক ওই ধূমকেতুর কাছে পৌঁছে তার উপাদানের সম্পূর্ণ বিশ্লেষণ করা একান্তই প্রয়োজন। ভারতীয় মহাকাশ গবেষণাকেন্দ্র আর একধাপ এগিয়ে ভাবল। শুধু বিশ্লেষণ নয়। তারা আজ বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত মহাকাশ গবেষণা সংস্থা। বিভিন্ন মিত্র দেশের সঙ্গে হাত মিলিয়ে তারা পরিকল্পনা করল এক অসাধ্য সাধনের। মহাকাশযান পাঠিয়ে সংগ্রহ করে আনতে হবে রুদ্রাণীর একটা খণ্ড। কে বলতে পারে কি অজানা মহারহস্য লুকিয়ে রয়েছে ওই বিভিন্ন নতুন মৌলের মধ্যে থেকে বিকিরিত কণাগুলির উৎপত্তির আড়ালে? সেই উচ্চাকাঙ্ক্ষী পরিকল্পনার বাস্তবরূপ হল বিষ্ণুবাহন-৫।
আর কিছুক্ষণের অপেক্ষা। বিষ্ণুবাহনের পাঁচজন যাত্রীরই দৃষ্টি এখন কন্ট্রোলরুম-এর ভিউয়ারপ্যানেল-এ। যানের যন্ত্র-মগজ বলছে রুদ্রাণীর থেকে তাদের দূরত্ব আর মাত্র তিনলক্ষ মাইল।
– “কন্ট্রোল-থ্রাস্টার গুলো ট্রিগার হল”।
অস্ফুট স্বরে বলে উঠলেন এই অভিযাত্রী দলের কমান্ডার ত্রিদেব চান্দেল। দলের বাকি চারজন সদস্য হল কমলিকা রায়, অভিজিৎ মালিক, সাগর দ্বিবেদী ও ঋক গুহ। এদের মধ্যে কমলিকা ও ঋক বায়ুসেনার দক্ষ পাইলট যাদের বিশেষ পদ্ধতিতে বাছাই করে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে এই অভিযানের জন্য। অভিজিৎ ও সাগর পদার্থবিজ্ঞানী।
অভিযানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় শুরু হয়ে গেছে। এখন থেকে প্রতিটি পদক্ষেপ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই অভিযান শুরুর আগে ছ’মাসের প্রশিক্ষণ পর্বে প্রত্যেকে নিজের নিজের দায়িত্ব বুঝে নিয়েছে। প্রথম পর্যায়ে সবই স্বয়ংক্রিয়। বিষ্ণুবাহনের যান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা প্রথমে যানটিকে রুদ্রাণীর থেকে দশমাইল দূরত্বে নিয়ে যানের গতিপথকে রুদ্রাণীর গতিপথের সমান্তরাল ও যানের গতিবেগকে তার গতিবেগের সমান করবে; যাতে বিষ্ণুবাহন ও রুদ্রাণীর মধ্যে আপেক্ষিক গতিবেগ এর মান শূন্য হয়ে দাঁড়ায়। তারপরের পর্যায়ে অভিজিৎ ও সাগর কিছু বিশেষ অত্যুন্নত যন্ত্রের সাহায্যে রুদ্রাণীকে বিভিন্ন রকম ভাবে পর্যবেক্ষণ করবে। এই পর্যবেক্ষণ শেষ হলে শুরু হবে এই অভিযানের সবচেয়ে কঠিন ও বিপজ্জনক পর্যায়। বিষ্ণুবাহন থেকে নির্গত একটি ছোট সংগ্রাহক যান পৌঁছে যাবে রুদ্রাণীর একদম কাছে। রুদ্রাণীর পৃষ্ঠদেশে একটা উপযুক্ত অংশকে আঁকড়ে ধরবে সেই যানের একটি রোবটিক আঁকশি। আর অন্য একটি রোবটিক বাহু উচ্চশক্তিসম্পন্ন লেসার এর সাহায্যে ড্রিল করে রুদ্রাণীর শরীর থেকে কেটে বিচ্ছিন্ন করবে সেই আঁকড়ে ধরা অংশ। এইভাবে সংগ্রহ করা হবে মানুষের বিজ্ঞানের পরবর্তী শিখরজয়ের পথের হদিশ। কোন কারণে একটি সংগ্রাহক যান বিফল হলে অন্যটা পাঠানো হবে এই পরিকল্পনা করে বিষ্ণুবাহনে মোট দুটি সংগ্রাহক যানের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।
২
আজ রাতে আবার জ্বর এসেছিল সুমিত্রার। এখন ছেড়েছে মনে হচ্ছে। শান্ত হয়ে ঘুমচ্ছে ও। এই নিয়ে আজ দশদিন হয়ে গেল। কিন্তু পার্থর মন এখনো বিশ্বাস করতে চায় না। তিন বছর হল বিয়ে হয়েছে তার ও সুমিত্রার। এখনো বিয়ের লাল চেলী আর পাটবস্ত্র গিঁটমারা অবস্থায় আলমারির ওপরের তাক থেকে পর্যায়ক্রমে বিতাড়িত হতে হতে নিচের তাকের কোনায় পৌঁছে উঠতে পারেনি। বিয়ের পরের দিন সকালে পার্থর মা সুমিত্রাকে বলেছিলেন
– “ওই চেলী আর পাটবস্ত্র খুব যত্ন করে রাখবে। তোমরা তো বিদেশে গিয়ে ঘর বাঁধবে। কিন্তু এটা সঙ্গে করে নিয়ে যেও। ওখানে যত্ন করে গুছিয়ে রেখে দিও। অন্তত কোল যতদিন না ভরে ততদিন।”
সুমিত্রার মুখের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে ফেলেছিল পার্থ। সুমিত্রা যথেষ্ট আধুনিক মেয়ে। তবু যেন পার্থর মনে হয়েছিল একঘর লোকের সামনে শাশুড়ীর সেই প্রগলভতায় সুমিত্রার মুখে একটা রক্তিম আভা ফুটে উঠেছিল। পরে ও যদিও তা স্বীকার করেনি। বলেছিল আগের রাতে মেকআপ ঠিকমত তোলা হয়নি। সেটাই নাকি পার্থ দেখেছে। আজ জ্বরে আচ্ছন্ন সুমিত্রার পাশে বসে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে পার্থ মনেমনে সেই রক্তাভ ছায়াটাই খুঁজে চলেছে। সেডেটিভের প্রভাবে একটা পরিযায়ী ঘুম ওর আধবোজা দুচোখে বাসা বেঁধেছে কিছুক্ষণের জন্য। কিন্তু কাগজের মত বিবর্ণ চোখের পাতা আর গালের মধ্যে শুকিয়ে থাকা দুফোঁটা অশ্রু পার্থকে মনে করিয়ে দিচ্ছে যে আজ মেডিক্যাল টেস্টের রিপোর্ট জানিয়েছে যে ওর শরীরে বাসা বাঁধা ক্যান্সারের প্রতিকারে যে কেমোথেরাপি আজ একমাস ধরে চলছে তার প্রভাবে ওর ক্যান্সার এর গতি এখনও রুদ্ধ হয়নি। উলটে তা ছড়িয়ে পড়েছে ওর জরায়ুতে। চিকিৎসায় শেষ পর্যন্ত সুমিত্রা সুস্থ হয়ে উঠলেও তার পক্ষে সন্তানধারণ হয়ত আর কোনদিনই সম্ভব হবে না।
পার্থর চোখে কখন ঘুম এসেছিল তা সে টের পায়নি। হঠাৎ ভোররাতে ঘুমটা ভেঙে গেল। দেয়াল ঘড়ির কাঁটা বলছে রাত প্রায় তিনটে বাজে। প্রথম রাতে বৃষ্টি পড়ছিল ।এখন বৃষ্টি থেমে গিয়ে আকাশে চাঁদের আলোর ঢল নেমেছে। আজ কোন তিথি পার্থ জানত না। তবে আকাশে নিখুঁত গোল চাঁদই জানিয়ে দিচ্ছে যে আজ পূর্নিমা। অন্ধকার ঘরে কাঁচের জানালা দিয়ে আসা চাঁদের আলো দেখতে দেখতে কিরকম একটা ঘোর লেগে গেছিল পার্থর। সে ঘোর ভাঙল সুমিত্রার গলার স্বরে।
– “বাইরে চাঁদ উঠেছে তাই না?”
– “হ্যাঁ সুমি।”
– “জানালাটা খুলে দাও না একটু ভালো করে চাঁদ দেখি।”
বৃষ্টির জন্য জানালা বন্ধ ছিল এতক্ষণ। এখন ঘরটা বেশ গুমোট লাগছে। পার্থ তাই জানালা খুলে দিল। জানালা খুলতেই একরাশ ঠাণ্ডা বাতাস ঘরে ঢুকে সুমির ইন্দ্রিয়গুলোকে যেন আর একটু জাগিয়ে তুলল।
– “আজ পূর্নিমা তাই না?”
– “হ্যাঁ সুমি।”
সুমির মুখের দিকে তাকিয়ে চাঁদের আলোতেও পার্থ দেখতে পেল তার দুগাল বেয়ে দুফোঁটা জলের ধারা নেমে এসেছে। পার্থ এগিয়ে গিয়ে সেই জলের ধারা আলতো হাতে মুছিয়ে দিয়ে বলল
– “সুমি ভরসা রাখো। এখনও তোমার কেমোর অর্ধেকও হয়নি। আজ সবে প্রথম রিপোর্ট। আর পনেরো দিন বাদে পরের ডোজ পরবে আর সেদিন আবার টেস্ট হবে। তুমি দেখো সেদিনের মধ্যে তুমি অনেকটা সেরে উঠবে।”
– “আজ পূর্নিমা।” অস্ফুট স্বরে বলে ওঠে সুমিত্রা। এতক্ষণ পার্থর বলা কথা গুলো যেন সে শুনতেই পায়নি।
– “হ্যাঁ সুমি। চারদিকে চাঁদের আলোর বন্যা। প্রকৃতি আমাদের আশার আলো দেখাচ্ছে।”
– “না পার্থ তুমি বুঝতে পারছ না। আজ থেকেই তো চাঁদের ক্ষয় শুরু। আর পনেরো দিনে সে একেবারে হারিয়ে যাবে। আর হয়ত আমিও! প্রকৃতিও বোঝে। প্রাণের উদ্দেশ্য হল প্রকৃতির প্রবাহকে বজায় রাখা। যে প্রাণ তা পারেনা তার কি মূল্য প্রকৃতির কাছে? তাই সে জানান দিয়ে যাচ্ছে। এই শেষের শুরু; চাঁদের সাথে আমারও।
অঝোরে জল গড়িয়ে পড়তে থাকে সুমিত্রার চোখ বেয়ে। পার্থ বুঝে উঠতে পারে না কি জবাব দেবে। আজকের রিপোর্ট আসার আগে অবধি সুমিত্রা বেশ শক্তইছিল। দুজনে স্থির করে নিয়েছিল যে যাইহোক, এই প্রাণঘাতী রোগের সাথে দুজনে একসাথে শেষ অবধি লড়ে যাবে। কিন্তু আজকে যখন টেস্টরিপোর্ট বলেদিল যে আর যাইহোক, সুমিত্রার পক্ষে সন্তানধারণ করা আর সম্ভব নয়, তখনই মনে হয় সুমিত্রা মনেমনে এই যুদ্ধে অস্ত্রসমর্পণ করে ফেলেছে।
পার্থ আর কিছু বলতে পারে না। নিঃশব্দে সুমিত্রার চোখের জল মুছিয়ে দিতে দিতে ও টের পেল যে ওর জ্বর আবার বেড়েছে।
৩
শেষ বাহাত্তর ঘণ্টা রুদ্ধশ্বাসে কেটেছে বিষ্ণুবাহনের পাঁচমহাকাশচারীর। মানুষের বৈজ্ঞানিক ক্ষমতার চূড়ান্ত চ্যালেঞ্জকে হেলায় হারিয়েছে বিষ্ণুবাহনের অভিযাত্রীরা। ঠিক বাহাত্তর ঘণ্টা আগে মহাকাশযান স্থাপিত হয়েছে রুদ্রাণীর সমান্তরাল গতিপথে। যানের কম্পিউটারের হিসেবে রুদ্রাণীর সাথে বিষ্ণুবাহনের দূরত্ব এখন ঠিক নিরানব্বই মাইল। কন্ট্রোলরুমের ভিউয়ার প্যানেলের প্রায় সবটা জুড়েই এখন ফুটে উঠেছে রুদ্রাণীর ছবি। সেই প্যানেলের দিকে তন্ময় হয়ে চেয়ে আছেন ত্রিদেব।
সার্থক নামকরণ হয়েছে রুদ্রাণীর। যদিও এই নামকরণ আসলে চিরন্তন প্রথা মেনে এর প্রথম পর্যবেক্ষক লাদাখে কর্মরতা একজন জুনিয়র জ্যোতির্বিজ্ঞানীর নামে। কিন্তু নামের সঙ্গে চেহারার মিলের এরকম অদ্ভুত সমাপতন তার আশাতীত ছিল। রুদ্রাণীর গড় ব্যাস প্রায় সাড়ে সাত মাইল। সূর্যের অভিকর্ষের ও তাপের প্রভাবে অন্য ধূমকেতুর মত একটা হাল্কা ল্যাজের আভাস দেখা দিয়েছে বটে তবে বিশ্লেষণ বলছে যে রুদ্রাণীর উপাদান প্রায় পাথরের মতই শক্ত। জমাট বাঁধা গ্যাসের অংশ কম। কাজেই খুব একটা বড়ল্যাজের বিস্তার রুদ্রাণীর ক্ষেত্রে দেখা যাবে না। কিন্তু ওর আসল বৈশিষ্ট্য হল ওর রঙে ও আলোয়। জ্বলন্ত অঙ্গারের মত উজ্জ্বল লাল রঙের একটা নিজস্ব আলো রয়েছে রুদ্রাণীর। অথচ যন্ত্র বলছে যে ওর পৃষ্ঠের তাপমাত্রা মাইনাস একশ সাতাত্তর ডিগ্রি সেলসিয়াস। অর্থাৎ কোন আগ্নেয় বা আণবিক বিক্রিয়া এই আলোর উৎস নয়। অর্থাৎ এই লাল আলো রুদ্রাণীর একগুচ্ছ অজানা উপাদানের কোন একটার থেকে বিকিরিত হচ্ছে। যেমন রেডিয়াম-এর থেকে হয়ে থাকে। রুদ্রাণীর এরকম রূপ অভিযাত্রীদের কাছে একদমই অপ্রত্যাশিত ছিল। ত্রিদেব বৈজ্ঞানিক নন, সেনাবাহিনীর লোক। তাই এই রূপের বিস্ময়ে আচ্ছন্ন হয়ে রয়েছেন রুদ্রাণীর প্রথম নিকটদর্শন-এর মুহূর্ত থেকেই। এইমুহূর্তে তার কিছু করনীয় নেই। আপাতত অভিযানের প্রধান কাজ দুই বিজ্ঞানী অভিজিৎ ও সাগরের। দ্রুত হাতে রুটিন মেনে সব যন্ত্র চালু করা, যন্ত্রের সংগৃহীত তথ্য সুপার কম্পিউটারে ভরে তার তাৎক্ষনিক বিশ্লেষণ, সমস্ত যন্ত্রের মধ্যে সমন্বয় সাধন করা থেকে শুরু করে সমস্ত তথ্য পৃথিবীর পর্যবেক্ষন কেন্দ্রে পাঠানো – এসবই তারা করে চলেছে দ্রুত ও অভ্যস্ত দক্ষতার সাথে। এখন এই কাজগুলো শেষ পর্যায়ে। শীঘ্রই শুরু হতে চলেছে সেই দুরূহ অন্তিম পর্যায়। কমলিকা ও ঋক-কে প্রায় বারো ঘণ্টা আগেই রিজুভিনেশন চেম্বারে পাঠিয়ে দিয়েছেন ত্রিদেব। এই শেষপর্যায়ের প্রস্তুতির জন্য শারীরিক ও মানসিক বিশ্রামের একান্ত প্রয়োজন এই দুজনের। আর কয়েক ঘণ্টার অপেক্ষা। ইতিমধ্যে তিনি নিজে ছোট যান দুটির সিস্টেম চেক সেরে এসেছেন। সবই এখনও পর্যন্ত পরিকল্পনা মাফিক চলছে তেল খাওয়া নতুন মেশিনের চালে।
রিজুভিনেশন চেম্বারে নিজের বাঙ্কে শুয়ে কমলিকা কানে হেডফোন লাগিয়ে হালকা ধরনের একটা গান চালিয়ে শুনছিল। যদিও কমান্ডার তাকে আর ঋককে বিশ্রামে পাঠানোর সময়ে বলে দিয়েছিলেন যতটা সম্ভব ঘুমিয়ে ও তরল কিছু খাবার খেয়ে নিজেদের প্রস্তুত রাখতে, কিন্তু এই অবস্থায় ঘুমনোর চেষ্টা বৃথা। যদিও যান্ত্রিক উপায়ে ঘুম পাড়ানোর ব্যবস্থা এই যানে রয়েছে। কিন্তু কমলিকার মন চাইল না। সে সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। অত সহজে শারীরিক বা মানসিক কোন রকম ক্লান্তিই তাকে আচ্ছন্ন করে না। উল্টো দিকের বাঙ্কে ঋক কিন্তু অকাতরে ঘুমচ্ছে। কিন্তু কমলিকার মন জুড়ে শুধুই অভিযানের আসন্ন পর্যায়ের প্রতিটি পদক্ষেপের ছবি ফুটে উঠছে। সাথে একটা চিন্তার কাঁটা তাকে দুচোখের পাতা এক করতে দিচ্ছে না।
হঠাৎ কমলিকা দেখল পাশের বাঙ্কে ঋক নড়েচড়ে উঠে বসল। ঘুম ভেঙ্গেছে তার।
-“নাহ, ঘুমটা একটু বেশী হয়ে গেল। মাথাটা একটু হাল্কা করা দরকার। একটু কফি চলবে নাকি ক্যাপ্টেন কমলি?”
একসাথে একবছর প্রশিক্ষণ নেওয়া আর এতদিন একসাথে যাত্রা করার ফলে ঋকের সাথে কমলিকার স্বাভাবিক ভাবেই একটা বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে। আর তারা দুজন প্রায় সমবয়সীও; কাজেই ঋক তার নামটা ছোট করে নিয়ে তাকে কমলি বলেই সম্বোধন করে। কমলিকা কোন কথা না বলে ঘাড় হেলিয়ে সম্মতি জানালো। ঋক লঘুপায়ে প্রভিশন চেম্বারের দিকে চলে গেল কফি আনতে।
ঋক চলে যেতেই কমলিকার মনে আবার সেই চিন্তাটা ফিরে এল। সারা জীবন সে সবক্ষেত্রে বরাবর প্রথম হয়ে এসেছে। কোন ক্ষেত্রেই কোন প্রতিযোগী তার সামনে টিঁকতে পারেনি কোনদিন। অথচ আজ এই কয়েকঘণ্টা পরে তার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মিশনে সে নামতে চলেছে আর এখানেই কিনা ……।
ঋক ফিরছে কফি হাতে। চিন্তাসূত্র ছিন্ন হল কমলিকার। কফির একটা টেট্রাপাউচ কমলিকার হাতে ধরিয়ে দিয়ে অন্যটাতে মুখ লাগিয়ে চুমুক দিতে দিতে কমলিকাকে আড়চোখে লক্ষ্য করল ঋক। কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল এমন সময়ে যানের ইন্টারকম-এ কমান্ডারের গলা ভেসে এল।
-“অফিসারস, তোমাদের মিশনের ব্রিফিংএর জন্য কন্ট্রোলরুমে রিপোর্ট কর।”
৪
“আমাদের জন্য পরিস্থিতিটা কঠিন হয়ে পড়ল মিস্টার রায়। কেমোতে রেসপন্স স্লো মানেই আপনারা আশা ছেড়ে দিচ্ছেন কেন? এখনো ট্রিটমেন্ট এর বেশিরভাগ টাই বাকি রয়েছে। আর এখন মেডিক্যাল সায়েন্স অনেক উন্নত হয়েছে। কেমোতে রেসপন্স না পেলে স্টেমসেল থেরাপি রয়েছে। কিন্তু ইমিডিয়েট আমাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা হল সুমিত্রার মানসিক অবস্থা। হঠাৎ ও কি করে একিউট ডিপ্রেশনে চলে গেল বুঝতে পারছি না। যাই হোক, সিডেটিভের ডোজ বাড়িয়ে দিয়েছি। এই মুহূর্তে আর কিছু করার নেই আমাদের। ওর কাউন্সেলিং দরকার আর সেটা আপনি করলেই বেটার। আপনার চেয়ে বেশি বিশ্বাস ও এইমূহুর্তে …”
সুমিত্রার অঙ্কোলজিস্ট ডঃ মিত্র বলে চলেছে। পার্থ শুনছে, কিন্তু তার দৃষ্টি সুমিত্রার দিকে। সুমিত্রা এখন সিডেটিভের প্রভাবে অচেতন। ওর মুখ এই কদিনে আরও বিবর্ণ হয়ে পড়েছে। চোখের তলায় কালচে ছোপ পড়েছে। সেইরাতে পূর্নিমার চাঁদ দেখার পর থেকেই ওর মনে এই ধারণা বদ্ধমূল যে ওর প্রাণশক্তিও আকাশের চাঁদের মুছে যাওয়ার সাথে এক অদৃশ্য সূত্রে বাঁধা পড়ে গেছে। শেষ কদিন ও রোজ রাতে পাগলের মত চাঁদ দেখার জন্য অপেক্ষা করেছে। আর প্রত্যেকবার চাঁদের ক্ষয় দেখতে দেখতে একমনে প্রলাপ বকে গেছে। অনেক চেষ্টা করেও পার্থ ওকে ঘুমের ওষুধ খাওয়াতে পারেনি।
পার্থকে সমস্ত দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে ডঃ মিত্র বিদায় নিলেন। উনি কয়েকদিন ধরেই সুমিত্রাকে হাসপাতালে শিফট করতে চাইছেন। কিন্তু সুমিত্রা সেটা বুঝতে পারার সাথে সাথে এমন রিএক্ট করেছিল যে শেষ পর্যন্ত সে ভাবনা বাতিল করতে উনি বাধ্য হয়েছেন। তাছাড়া সুমিত্রার মানসিক অবস্থা যা তাতে এইমুহূর্তে পার্থর থেকে দূরে রাখলে ওর অবস্থার আরও অবনতি হওয়ারই সম্ভাবনা বেশি।
সন্ধে হয়ে এল। সুমিত্রা পার্থকে দিয়ে শপথ করিয়ে নিয়েছে যে রাতে চাঁদ উঠলে সে ওকে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখবেনা। ওকে সে চাঁদ দেখতে দেবে। পার্থ প্রথমে ভেবেছিল এতে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠবে কিন্তু শেষপর্যন্ত তার মনে হয়েছে যে এই ব্যাপারটা যে ভুল আর সেটা সুমিত্রার কাছে প্রমাণ করতে হলে এটাই সবচেয়ে ভালো উপায়। অমাবস্যার অন্ধকার রাতটা অব্ধি যদি সে সুমিত্রাকে সামলে নিতে পারে তাহলে তার ভুল আপনিই ভেঙ্গে যাবে। তখন সে নিশ্চয়ই আবার নতুন করে তার অসুখের সাথে লড়াই করবার মনোবল ফিরেপাবে। এই বিশ্বাসে বুক বেঁধে রয়েছে পার্থ। আজ ত্রয়োদশী। আর মাত্র দুটোদিন সামলে নিতে হবে মনের জোর রেখে।
ক্রমে দিনের আলো ক্ষীণ হয়ে অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে। আকাশের কোনায় তারাগুলো একটা একটা করে মুখ দেখাতে শুরু করেছে। পার্থর চোখে পড়ল পূব আকাশে একটা হাল্কা বাঁকা আলোর রেখা দানা বাঁধছে। সে ধীরপায়ে এগিয়ে এসে সুমিত্রার মাথায় হাত রাখল। সুমিত্রার চোখ খোলা ও অভিব্যাক্তিহীন। সে কখন ঘুম থেকে জেগে উঠেছে তা পার্থ এতক্ষণ টেরও পায়নি। পার্থর হাতের স্পর্শ পেয়ে সুমিত্রা হঠাৎ সচকিত হয়ে উঠে বসবার চেষ্টা করল। কিন্তু তার দূর্বল শরীর সহযোগিতা করল না। পার্থ ওর চোখের দিকে তাকিয়ে ওকে শান্ত হতে বলে সন্তর্পনে ওকে উঠিয়ে হুইল চেয়ারে বসিয়ে দিইয়ে হুইল চেয়ারটা ঠেলে বারান্দায় নিয়ে গেল।
আকাশে সেই ক্ষীণ চাঁদের আভা এখন বেশস্পষ্ট। সুমিত্রা বলে উঠল –
“আর কতদিন?”
“আর দুদিন সুমি। আর দুদিন গেলেই তুমি বুঝবে তোমার এই ধারনা সম্পূর্ণ ভুল।”
পার্থর কথাগুলো কোন প্রভাব ফেলল না সুমিত্রার মুখমণ্ডলে। এখন আর অবক্ষীয়মান চাঁদের অবয়ব তার মনে ভয় বা হতাশা জাগায় না। যা ঘটবেই তাকে আর ভয় কিসের। পার্থর অবস্থাও সে দেখছে। তার এই রোগ যে পার্থকেও পরোক্ষে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ওর শ্বাসরোধ করছে তাও সে দেখতে পারছে। আর মাত্র দুদিন। তারপরে তাদের দুজনেরই মুক্তি।
এই আশ্বাসে এখন সুমিত্রা নিশ্চিন্ত। পেছনে দাঁড়ানো পার্থ একটা হাত সুমিত্রার ডান কাঁধে রাখতে সুমিত্রা নিজের বাঁহাতটা তার ওপরে রাখল। পার্থ আবিষ্কার করল গত তেরো দিনে এই প্রথম, সুমিত্রার আজ জ্বর আসেনি।
৫
বিষ্ণুবাহন রওনা দিয়ে দিয়েছে পৃথিবীর পথে। কমলিকার মন থেকে হতাশার মেঘও উধাও। মহাবিশ্ব তাকে গৌরবের আশীর্বাদ থেকে বঞ্চিত করেনি। এই অভিযানের প্রথমদিন থেকেই সে মুখিয়েছিল যাতে রুদ্রাণীর দেহাংশ সংগ্রহ করবার গৌরব তারই হয়। কথা ছিল প্রথমে বিষ্ণুবাহনের কোন একটি সংগ্রাহকযান প্রথম প্রয়াস করবে। একমাত্র সেই প্রয়াস কোন কারণে বিফল হলেই দুনম্বর যান পাঠানো হবে। সেই প্রথম যানে কে থাকবে, কমলিকা না ঋক তার সিদ্ধান্ত কমান্ডারের। কমান্ডারের কাছে ইন্দ্রাণী আর ঋক দুজনেই এই অভিযানে মুখ্য ভূমিকা গ্রহণ করবার ইচ্ছাপ্রকাশ করেছিল। কিন্তু তিনি কোনভাবেই সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি। দক্ষতা, দীর্ঘ মহাকাশযাত্রার শারীরিক ও মানসিক ধকল সামলানোর পরের তুলনামূলক বিশ্লেষণ ইত্যাদির ভিত্তিতে তিনি কোনভাবেই দুজনের মধ্যে থেকে যোগ্যতর হিসেবে একজনকে বেছে নিতে পারেননি। অবশেষে দুজনকে রিজুভিনেশন চেম্বারে পাঠানোর আগে একটা র্যান্ডম লটারির মাধ্যমে ঋক এর নাম উঠে আসে যানের কম্পিউটারে।
এভাবে আশাভঙ্গ হওয়ায় কমলিকা যথেষ্ট মুষড়ে পরেছিল। তাই কমান্ডার ব্রিফিং এ ডাকার পরে কোনোরকমে নিজেকে বয়ে নিয়ে গিয়েছিল সে কন্ট্রোলরুমে। ঋক এর যান যখন বিষ্ণুবাহন থেকে নির্গত হল, সেদিকে তাকাতে অবধি মন সায় দেয়নি তার। দেখতে দেখতে প্রথম যান পৌঁছে গিয়েছিল রুদ্রাণীর কাছে। একটি রোবটিক বাহুযান থেকে প্রসারিত হয়ে আঁকড়ে ধরেছিল তার কম্পিউটারের হিসেবমত পুর্বনির্ধারিত একটা অংশকে। কিন্তু তাতেই ঘটে গেল এক বিপত্তি। সেই বাহুর সাথে ঘর্ষনের ফলে রুদ্রাণীর শরীর থেকে কিছু ছোট ছোট খণ্ড ছিটকে বেরিয়ে এল। প্রায় একটা ফুটবলের আকারের আলগা পাথুরে খণ্ড এসে আঘাত করল ঋকের যানটির গায়ে। আঘাতের তীব্রতায় যানটির বিপদ সংকেত বেজে উঠল। ঘটনার আকস্মিকতা কাটিয়ে বিষ্ণুবাহনের বাকি চারযাত্রী সঙ্গে সঙ্গে যানটির সমস্ত সিস্টেমচেক চালিয়ে দিল। যানের বাকি সব ব্যবস্থাই ঠিক আছে। শুধু দ্বিতীয় রোবটিক বাহুতে অবস্থিত লেসারসিস্টেমে বিদ্যুৎ সরবরাহকারী লাইনটা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। কমলিকা বুঝতে পারল যে এবার দ্বিতীয় যান লঞ্চ করতেই হবে কমান্ডারকে। কিন্তু কমান্ডার বিচক্ষণ ব্যক্তি। উনি নির্দেশ দিলেন যে দ্বিতীয় যান রুদ্রাণীকে স্পর্শ করবে না। বোঝাই যাচ্ছে যে রুদ্রাণীর বাইরের আবরণ বেশ ভঙ্গুর পদার্থে তৈরি। আর তাছাড়া প্রথমযান এখনও সফলভাবে নির্দিষ্ট অংশ আঁকড়ে রয়েছে। কাজেই দ্বিতীয়যান কোনরকম ঝুঁকি নেবে না। তার কাজ হবে প্রথম যানের পাশে পৌঁছে শুধুমাত্র লেসারের সাহায্যে সেই আঁকড়ে ধরা অংশকে কেটে বার করা।
কমান্ডারের নির্দেশমত কমলিকা দ্বিতীয়যান নিয়ে বিষ্ণুবাহন থেকে নির্গত হয়েছিল। কাজটা যথেষ্ট কঠিন, বিশেষত প্রথম যানের সামনে পৌঁছে তাকে লেসার চালাতে চালাতে নিজের যানের গতি রুদ্রাণীর সমান রাখতে হবে যেটা আদৌ সহজ হবে না। একথা ভেবেই তার মনের হতাশার মেঘ কেটে গিয়েছিল। অসামান্য দক্ষতায় সে দ্বিতীয়যান নিয়ে প্রথম যানটির একদম পাশে পৌঁছে গিয়েছিল ও একজন দক্ষ শিল্পীর তুলিচালনার মত নিখুঁতভাবে লেসার চালিয়ে কেটে বের করে এনেছিল রুদ্রাণীর একটা বড়সর পাথরের চাঁই-এর মত অংশ।
বিষ্ণুবাহনের কম্পিউটার এখন আবার অভিযানের পরিচালনার ভার তুলে নিয়েছে। রুদ্রাণীর সংগৃহীত খণ্ডটা এখন বিষ্ণুবাহনের পেটের দিকে একটা শক্তিশালী চৌম্বকক্ষেত্রে ঘেরা মোটা সীসার চাদরে তৈরি কক্ষে সুরক্ষিত রয়েছে। তার ওপর সবরকম প্রাথমিক তথ্যসংগ্রহের কাজ সম্পন্ন হয়েছে। এবার বাকি পরীক্ষা নিরীক্ষা পৃথিবীর গবেষণাগারে হবে। অভিযানের সাফল্যে সকলেই বেশ খুশী।
“আমাদের অবস্থান এখন পৃথিবী থেকে চার লক্ষ মাইল দূরে। আমরা এখন চাঁদের কক্ষপথে। চাঁদকে প্রদক্ষিণ করে তার মাধ্যাকর্ষণকে কাজে লাগিয়ে বিষ্ণুবাহনের গতি হ্রাস করা হয়ছে। এবার আমরা পৃথিবীর পথে রওনা দেব। সব ঠিক চললে আরো প্রায় দশ ঘণ্টা পরে বিষ্ণুবাহন পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করবে।”
কমান্ডার ত্রিদেব ঘোষণা করলেন।
হঠাৎ যানের কন্ট্রোলপ্যানেলে একটা জোরোলো সংকেত বেজে উঠল। অভিজিৎ আর সাগর পালা করে রুদ্রাণীর সংগৃহীত অংশটার ওপর পর্যবেক্ষক যন্ত্রের মাধ্যমে লক্ষ্য রাখছিল। সংকেতটা বেজেছে তাদের পর্যবেক্ষণ স্টেশনেই। সঙ্গে সঙ্গে তারা হুমড়ি খেয়ে পড়ল তাদের সামনের প্যানেলে। বিষ্ণুবাহনের যন্ত্র-মস্তিষ্ক ইতিমধ্যে চরম বিপদসংকেত বাজিয়ে দিয়েছে। রুদ্রানীর খণ্ডিত অংশের তাপমাত্রা অত্যন্ত দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। তার থেকে নির্গত বিকিরনের হারও হঠাৎ বৃদ্ধি পেয়েছে কয়েকগুণ। সব লক্ষণ নির্দেশ করছে যে ধূমকেতুর অংশটিতে একটা আনবিক বিক্রিয়া শুরু হয়েছে। যন্ত্রমস্তিষ্ক অবিলম্বে যান পরিত্যাগ করবার সংকেত দিয়ে দিল।
ঘটনাপ্রবাহের আকস্মিক দিক পরিবর্তনে সবাই হকচকিয়ে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। অভিজিৎ প্রথম মুখ খুলল।
‘ওই অজানা পাথরের খণ্ডে বিস্ফোরণ ঘটতে চলেছে। আর আমাদের হাতে মাত্র মিনিট কুড়ি সময় রয়েছে’।
‘কিন্তু কিভাবে? ও কেন?’ প্রশ্ন করে ঋক।
‘তার উত্তর খোঁজার যথেষ্ট সময় আমাদের হাতে নেই। এখুনি সবাই দু’দলে ভাগ হয়ে সংগ্রাহক যানগুলোতে ওঠ। ঋক আর আমিএকটা যানেও কমলিকা, অভিজিৎ আর সাগর অন্যটায়’।
তীক্ষ্ণ স্বরে নির্দেশ ভেসে এল কমান্ডারের কাছ থেকে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই বিষ্ণুবাহনের থেকে দুটো ছোট যান নির্গত হয়ে দুটি বিপরীত দিকে পূর্ণগতিতে এগিয়ে চলল। প্রতিটামিনিট এখন মূল্যবান। বিষ্ণুবাহণ কিন্তু যন্ত্র-মস্তিষ্কের নিয়ন্ত্রণে পৃথিবীর দিকে এগিয়ে চলেছে।
দেখতে দেখতে কুড়ি মিনিট অতিক্রান্ত হল। কিন্তু এ কি! বিষ্ণুবাহন এখনো অক্ষত! বিস্ফোরণের কোন লক্ষণই দেখা যাচ্ছে না। নিরাপদ দূরত্বে থেকে আরো কিছুক্ষণ রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করল সকলে। কিন্তু না, বিষ্ণুবাহণ নিজের নির্দিষ্ট পথে ছুটে চলেছে। বিষ্ণুবাহনের থেকে ভেসে আসা যন্ত্র-মস্তিষ্কের তথ্য বলছে রুদ্রানীর পাথরের খণ্ডটার বিক্রিয়ার তীব্রতা অনেকটা কমে এসেছে। বিস্ফোরনের সম্ভবনা আর নেই। সকলেই হতবাক।
‘আপাতত বিস্ফোরনের সম্ভবনা আর না থাকলেও এই পাথরটার এরকম আচরনের কারণ কি?’ প্রশ্ন করল ঋক।
‘কারণ আছে’। বলে ওঠে অভিজিৎ।
‘আমি এই পাথরটার সীসার চেম্বারে গত চব্বিশ ঘন্টার পারিপার্শিকতার তারতম্যের তথ্য বিশ্লেষণ করেছি। অন্য সব কিছু স্থির থাকলেও একটা জিনিসের বিশাল তারতম্য ঘটেছে এই সময়ের মধ্যে। সেটা হল মাধ্যাকর্ষণ। চাঁদের কক্ষপথে ঢোকার আগে অবধি এই পাথরটার ওপর মাধ্যাকর্ষণ বল ছিল অত্যন্ত নগন্য। রুদ্রাণীর গতিপথের কাছাকাছি সেরকম বড় কোন মহাজাগতিক বস্তুর অস্তিত্ব নেই নিশ্চই। আমাদের সৌরজগতে প্রবেশ করবার পরেও ওটা অন্য কোন গ্রহ বা উপগ্রহের পাশ দিয়ে আসে নি আর ফলে এই ধুমকেতুর ওপর তাদের মাধ্যাকর্ষণের প্রভাব আমরা জানতে পারি নি। আমরা চাঁদের কক্ষপথে প্রবেশ করার পর প্রথম এই পাথরটার ওপর শক্তিশালী মাধ্যাকর্ষণের প্রভাব পড়েছে। আর তাতেই এই বিপত্তি। এর মধ্যে নিশ্চয়ই এমন কিছু রয়েছে যা শক্তিশালী মাধ্যাকর্ষণের প্রভাবে উদ্দীপ্ত হয়ে পড়ে আনবিক বিক্রিয়ার সূত্রপাত করে। এই জন্যেই আমাদের চেনা গ্রহ বা নক্ষত্রের মধ্যে এই মৌল গুলো অনুপস্থিত’।
সকলে অবাক হয়ে শুনছিল। এবার কমলিকার শঙ্কিত স্বর ভেসে আসে।
‘কিন্তু তার মানে ত আমাদের সামনে আর এক প্রবল বিপদ। এই পাথরটা পৃথিবীর কাছাকাছি পৌছে প্রচণ্ড বিস্ফোরণে ফেটে পড়বে। আর সেটা যদি পৃথিবীর বায়ুমন্ডলের মধ্যে হয়? যদি মাটির যথেষ্ট কাছাকাছি পৌঁছে ঘটে বিস্ফোরণ?’
‘একদম ঠিক ক্যাপ্টেন রায়। এই পাথরটাকে কোন অবস্থাতেই পৃথিবীতে পৌঁছতে দেওয়া চলবে না’।
৬
গভীর ঘুমের মধ্যে চোখে স্বপ্ন এলে অনেক সময় চোখের পাতা ঘুমের মধ্যেও সামান্য খুলে যায়। সেই অবস্থায় চোখের মণি দ্রুত সঞ্চালিত হয়ে স্বপ্নের পিছু পিছু ছুটে বেড়ায়। সুমিত্রা ঘুমোচ্ছে। তার চোখও আধবোজা। কিন্তু তার চোখের মণি পাথরের মত স্থির। পার্থ একমনে সুমিত্রার ঘুমন্ত চোখে সেই স্বপ্নচারণের আশ্বাস খুঁজে চলেছে।
আজ সকালেও ডঃ মিত্র এসেছিলেন। সুমিত্রার মানসিক অবস্থার কথা জানতে পেরে উনি আগামী কয়েকদিন রোজ একবার করে এসে ওকে দেখে যাবেন বলেছিলেন। জ্বর আসা বন্ধ হওয়াটা উনি ভালো লক্ষণ বলেই মনে করছেন। কিন্তু আপাতত সুমিত্রার মন থেকে জীবনবিমুখতাকে দূর করাটাই প্রধান লক্ষ্য।
সিডেটিভের প্রভাবে সুমিত্রা এখনো ঘুমে অচেতন। সন্ধ্যে প্রায় পার হয়ে এলো। আর কিছুক্ষণ বাদেই সুমিত্রাকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে তাকে ঘুম থেকে জাগিয়ে দিতে হবে পার্থকে। তবে আজ পার্থ আশাবাদী। আজ রাতে আকাশের চাঁদ অস্ত যাবে না। মাঝ আকাশেই একটু একটু করে পৃথিবীর ছায়ায় মুখ লুকিয়ে মুছে যাবে আবার নতুন আলোয় আত্মপ্রকাশ করতে। পার্থ আশায় বুক বেঁধেছে যে হয়ত সেই নতুন চাঁদের আলো সুমিত্রার মনে বদ্ধমূল এই নৈরাশ্যকেও মুছে ফেলবে।
এইসব ভাবনায় ক্ষনিকের জন্য অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল পার্থ, আবার সুমিত্রার দিকে চাইতেই সচকিত হয়ে উঠল সে। সুমিত্রার চোখ খোলা আর তা সটান খোলা জানলার বাইরের আকাশের দিকে স্থির। কখন সে ঘুম থেকে জেগেছে পার্থ টেরও পায় নি। পার্থ গিয়ে ওর মাথায় হাত রাখল ও আশ্বস্ত হল।
‘আমাকে আজ একটু ব্যালকনীতে বসতে দেবে?’ বলে ওঠে সুমিত্রা।
আজ পার্থ ঠিক করে রেখেছে যে সুমিত্রার সব ইচ্ছে পূরন করবে। আর আজ বাইরে বেশ ভাল আবহাওয়া। বাতাসে শীত বিদায়ে বসন্তের আভাষ। তাই সে রাজী হয়ে গেল। সুমিত্রাকে হুইলচেয়ারে বসিয়ে সেটা ঠেলে ব্যালকনিতে নিয়ে এলো আর নিজেও তার পাশে একটা চেয়ারে গিয়ে বসল। সুমিত্রার দৃষ্টি একটানা আকাশের দিকে। পার্থ যেন অস্তিত্ববিহীন; কারণ আকাশে সে সরু ধনুকের মত একটা শীর্ণকায়া চাঁদের দেখা পেয়ে গিয়েছে।
আজ খুব অল্প সময়ের জন্যই চাঁদ উঠেছে। আর ইতিমধ্যেই সেটা ম্লান হতে শুরু করেছে। আকাশের আবছা বাঁকা সাদা দাগটা আরো আবছা, আরো ছোট হয়ে আসছে। সুমিত্রার দৃষ্টি সেইদিকে স্থির। তার মনে দুঃখের চেয়ে স্বস্তি বেশি। কিছুক্ষনের মধ্যে আকাশের বুক থেকে সাদা আলোর শেষ দাগটুকুও মুছে গেল। সুমিত্রা তার কয়েক মুহূর্ত আগেই চোখ বুজে ফেলেছে।
পার্থ এই মুহূর্তটার জন্যই অপেক্ষা করে ছিল। সে সুমিত্রার হাত নিজের হাতে নিয়ে বলে ওঠে।
‘চোখ খোল সুমি। চেয়ে দেখ। আকাশে আর চাঁদ নেই। অথচ তুমি এখনো বেঁচে আছ। এবার ত এই ভুল ধারণা মন থেকে দূর কর! আকাশের চাঁদ প্রকৃতির নিয়মে বিদায় নিয়েছে আপাতত। কয়েকদিন পরে সে ফিরেও আসবে। কোন মানুষের জীবন-মৃত্যুর সঙ্গে তার কোন সম্পর্ক থাকতে পারে না! এই নিয়মের কোন ব্যতিক্রম নেই।’
‘কিন্তু প্রকৃতির নিয়ম ত বলে মানুষ তার ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্ম দেবে। সেই নিয়মটা আমার ক্ষেত্রে কেন ভাঙল পার্থ? আমি ইঙ্গিত পেয়ে গেছি। আজ আমাকে মরতেই হবে। এটাও প্রকৃতির ইচ্ছে। আমি এখন প্রকৃতির কাছে মূল্যহীন, বর্জনীয়!’
এই বলে পার্থর হাত ছাড়িয়ে হুইলচেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াতে গেল সুমিত্রা। কিন্তু দূর্বল শরীর তার সাথে সহযোগিতা করল না। আবার চেয়ারে ঢলে পড়ল সে। তার দুচোখ বেয়ে অঝোরে জলের ধারা নেমে এলো।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে পার্থ হুইলচেয়ারটা ঠেলে সুমিত্রাকে ঘরের দিকে নিয়ে চলে। কিন্তু সুমিত্রা আপত্তি জানায়।
‘আর একটু থাকতে দাও আমাকে ব্যালকনিতে, প্লিজ। আকাশের তারা গুলো বেশ লাগছে আজ’।
সুমিত্রার এই কথাটা পার্থর মনে অবশেষে একটু শান্তি এনে দিল। অনেকদিন বাদে সুমিত্রার মুখ থেকে একটা আশাব্যঞ্জক বাক্য শুনতে পেল সে।
‘আমাকে একটু জল খাওয়াবে?’
‘হ্যাঁ সুমি নিশ্চই’। জল আনতে ঘরের ভেতরে চলে গেল পার্থ।
৭
কম্যান্ডার চান্দেলের কপালে চিন্তার রেখা ফুটে উঠেছে। যানের বাকি যাত্রীরাও চিন্তিত। সাময়িক ভাবে বিস্ফোরণের সম্ভবনা কমে যাওয়ায় সকলে আবার বিষ্ণুবাহণ-৫ এ ফিরে এসেছে ঠিকই কিন্তু যানের যন্ত্রমগজে শেষ কয়েক ঘণ্টার সমস্ত তথ্য ফিড করার পর জানা গেছে যে আর মাত্র তিন ঘণ্টা সময় রয়েছে। তার পরেই পৃথিবীর আকর্ষণ বল আবার ওই পাথরটার অণু পরমাণুগুলোকে চঞ্চল করে তুলবে আর তার পরে যে কোনো মুহূর্তে বিস্ফোরণ ঘটে যেতে পারে। বিষ্ণুবাহনকে ধ্বংস হতে দিলে তাদের পক্ষে পৃথিবীতে ফেরা সম্ভব হবে না। সংগ্রাহকযান গুলোর পাতলা আবরণ পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করার জন্য প্রস্তুত করা হয়নি। বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করা মাত্র বাতাসের সঙ্গে ঘর্ষনে উৎপন্ন তাপে সেগুলো পুড়ে ছাই হয়ে যাবে। আবার পাথরটাকে মহাশূন্যে ভাসিয়ে দিলে তা পৃথিবীর আকর্ষণে সোজা গিয়ে আঘাত হানবে তার বায়ুমণ্ডলে। তার ফলে ধ্বংস নেমে আসতে পারে সারা পৃথিবীতে। বিষ্ণুবাহনে যথেষ্ট জ্বালানী নেই যার সাহায্যে এই পাথর নিয়ে সে পৃথিবীর আকর্ষণের আওতার বাইরে গিয়ে পাথরটা ফেলে আবার পৃথিবীতে ফিরে আসতে পারে।
একমাত্র উপায় হল একটি সংগ্রাহকযানের সাহায্যে পাথরটাকে অন্য পথে চালনা করা। কিন্তু সেই যানের চালকের পক্ষে আর পৃথিবীতে ফিরে আসা সম্ভব হবে না। দলনেতা হিসেবে এই আত্মবলিদান কম্যান্ডারেরই কর্তব্য। তাই কম্যান্ডার চান্দেল এই প্রস্তাব সবার সামনে রাখলেন।
‘আমি এই যানের কম্যান্ডার হিসেবে বিশেষ ক্ষমতাবলে এই সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছি। আমার অবর্তমানে যানের কম্যান্ডার হবে ক্যাপ্তেন ঋক গুহ। পৃথিবীর মিশন কন্ট্রোলের অধিকর্তা ও আমার কম্যান্ডিং অফিসারকে এই সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়েছে এবং ওঁরা এই সিদ্ধান্ত সমর্থন করেছেন। রুদ্রানীর অংশটা ইতিমধ্যে বিষ্ণুবাহনের রোবটিক লিফটারের সাহায্যে সংগ্রাহকযানে তোলা হয়ে গেছে’।
ত্রিদেব চান্দেল নিজের বক্তব্য শেষ করতে সবে সকলে তাদের প্রতিক্রিয়া জানাতে যাবে, ঠিক এমন সময় হঠাৎ যানের সতর্কতা সংকেত বেজে উঠল। সকলে সচকিত হয়ে লক্ষ্য করল যে একটা সংগ্রাহকযান বিষ্ণুবাহন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে মহাশূন্যে ছুটে চলেছে। আর সাথে সাথে ঋকের গলা শোনা গেল,
‘কমলিকা! কমলিকা কোথায়?’
সকলে আবিষ্কার করল যে কমলিকা যানের কন্ট্রোলরুমে নেই। হুমড়ি খেয়ে কম্যান্ডার চান্দেল বিষ্ণুবাহনের কমিউনিকেটর প্যানেলের ওপর পড়ে তীক্ষ্ণকন্ঠে চিৎকার করে উঠলেন
‘ক্যাপ্টেন রায়! এটা কি পাগলামি হচ্ছে!’
‘পাগলামি নয় কম্যান্ডার। এটা ন্যায়বিচার’। কমিউনিকাটরে কমলিকার গলা ভেসে আসে।
‘এই মুহূর্তে আপনি মূল-যানে ফিরে আসবেন! এ আমার আদেশ!’ গর্জে উঠলেন ত্রিদেব চান্দেল।
‘আমি আপনার আদেশের ঊর্ধ্বে চলে গেছি ক্যাপ্টেন। এ আমার অন্যায়ের প্রায়শ্চিত্ত। আমাকে বাধা দেবেন না। আর বাধা দিতেও পারবেন না। বিষ্ণুবাহনের স্বয়ংক্রিয় ন্যাভিগেশন আপনারা যাতে বন্ধ না করতে পারেন তার ব্যবস্থা আমি করে এসেছি। আপনাকে এই পাথরটা সংগ্রাহকযানে তুলতে দেখেই আমি আপনার প্ল্যানটা আন্দাজ করতে পেরেছিলাম। তখনই এই সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছি। আর আমাকে আপনারা ফেরাতে পারবেন না। অন্য সংগ্রাহকযানটিরও সিস্টেম রিস্টার্ট করে এসেছি। ওটা এখন কয়েকঘণ্টার মধ্যে আর ওড়ার অবস্থায় পৌঁছবেনা’।
‘কিন্তু কেন? কমলি কেন?’ ঋকের ক্ষোভ আর বিস্ময় মেশানো কণ্ঠস্বর কমিউনিকেটর হয়ে আছড়ে পড়ল মহাশূন্যে ধেয়ে চলা কমলিকার সংগ্রাহক যানটার ওপর।
কিছুক্ষণ কোন উত্তর নেই; তার পরে ভারী গলায় কমলিকা বলে উঠল।
‘কারণ আছে ঋক। এটা আমার ভবিতব্য। আমার ঈর্ষার, আমার অন্যায়ের উপযুক্ত বিচার’।
‘কি বলছ কমলিকা!’
‘হ্যা ঋক। মনে পড়ে এই অভিযানের প্রস্তুতির সময়ে প্রশিক্ষণকেন্দ্রে আমাদের শেখানো হয়েছিল যে অভিযানে জীবন বিপন্ন করেও একে অপরকে রক্ষা করা আমাদের কর্তব্য। সেই কর্তব্য আমি পালন করতে পারিনি ঋক! জানো তোমার সংগ্রাহক যানের লেজার রশ্মি তুমি রওনা হওয়ার আগের মুহূর্তে আমিই বিগড়ে দিয়েছিলাম। রুদ্রাণীর সঙ্গে সংঘর্ষে তা বিকল হয় নি!’
‘কিন্তু কেন!’
‘ঈর্ষা আমাকে উন্মাদ করে দিয়েছিল। রুদ্রাণীর সংগ্রাহক হিসেবে তোমার নাম ইতিহাসের পাতায় লেখা থাকবে আর আমি পার্শচরিত্র হয়ে সেই পাতার এক কোনায় পড়ে থাকব, এটা আমি মেনে নিতে পারিনি ঋক। ঈর্ষা আমাকে এতটাই অন্ধ করে তুলেছিল যে আমি আমার ভালোবাসার মানুষকে অবধি সম্ভাব্য বিপদের মুখে ঠেলে দিতে দ্বিধা করিনি। হ্যাঁ ঋক। আজ অবশেষে তোমাকে আমার মনের কথা জানিয়ে যেতে চাই। ট্রেনিং বা অভিযানের আইন আমাদের সহকর্মীদের সাথে সম্পর্ক গড়ার অনুমতি দেয় না। কিন্তু সেই আইন আমি ভঙ্গ করেছি। তোমাকে কোনদিন বুঝতে দিইনি কিন্তু মনে মনে তোমাকে আমি ভালোবেসেছি। ভেবেছিলাম পৃথিবীতে ফিরে তোমাকে মনের কথা জানাবো। কিন্তু আমার ঈর্ষা আমার ভালোবাসাকে পরাজিত করল’।
কমলিকার রুদ্ধ কন্ঠে প্রথমবার একটা ভেজা ভাব লক্ষ্য করল ঋক আর তার পরেই তার কমিউনিকেটরের সংকেতস্তব্ধ হল। কমলিকা তার কমিউনিকেটর বন্ধ করে দিয়েছে।
‘কমলিকা রুদ্রানীর পাথরটা নিয়ে সোজা চাঁদের দিকে ছুটে চলেছে’।
নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে বিষণ্ণ কন্ঠে ঘোষনা করল অভিজিৎ।
৮
জলের গেলাস হাতে ব্যালকনির দরজায় দাঁড়াতেই পার্থ আবিষ্কার করল যে ব্যালকনির দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। তীব্র আশঙ্কায় রুদ্ধশ্বাসে দরজাতে ধাক্কা দিল সে।
‘সুমি! দরজা খোল! দরজা বন্ধ করেছ কেন? দরজা খোল বলছি!’
‘না, পার্থ! না। প্রকৃতির নির্দেশ আমি পেয়েছি। তার প্রতি আমার অন্য কোন কর্তব্য যখন আমি পালন করতে পারলাম না তখন এই শেষ নির্দেশটা আমাকে পালন করতেই হবে। আমাকে বাধা দিও না।
একটা ঠান্ডা আশঙ্কার স্রোত বয়ে যায় পার্থর শিরদাঁড়া বেয়ে। পাগলের মত দরজা ধাক্কা দিতে থাকে সে।
‘প্লিজ সুমি, প্লিজ! এভাবে হার মেনে নিও না! আজ ডঃ মিত্র বলে গেলেন যে তোমার অবস্থার উন্নতির লক্ষণ দেখা যাচ্ছে’।
‘কি লাভ ? আমি সেরে উঠলেও এই নিষ্ফলা জীবন নিয়ে আমি কি করব? আর আমার এই রোগ যে দিনে দিনে তোমাকেও ক্ষয় করে চলেছে তা ত আমি নিজেই দেখতে পাচ্ছি। আজ তাই তোমাকেও এই যন্ত্রণা থেকে মুক্ত করতে চাই আমি’।
চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল সুমিত্রা। দরজাটা বন্ধ করতে তার দূর্বল শরীর অনেকটা শক্তি ব্যয় করে ফেলেছিল। কোনরকমে দরজা বন্ধ করেই সে ব্যালকনির চেয়ারে ঢলে পড়েছিল। শ্বাস-প্রশ্বাস দ্রুত হয়ে তাকে বাধ্য করেছিল কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে শক্তি সঞ্চয় করতে। কিন্তু আর দেরী নয়। পার্থ পাগলের মত দরজা ভাঙার চেষ্টা করছে। তাই আর অপেক্ষা করা যাবে না। টলতে টলতে সে এগিয়ে চলল ব্যালকনির রেলিঙের দিকে।
রেলিঙের অনেক নিচে মাঝরাতের জনহীন রাজপথ তাকে মুক্তির পথে নিয়ে যাবে বলেই অপেক্ষা করে রয়েছে। কালো অন্ধকার আকাশে ক্ষীণ আলোর তারা গুলো শহরের নিয়ন ও ভেপার ল্যাম্পের আলোর প্রকোপে আরো ক্ষীন হয়ে নিরর্থক শ্বাস-প্রশ্বাস নিয়ে চলেছে ঠিক যেন তারই মত। শরীরের শেষ শক্তি প্রয়োগ করে একটা চেয়ার টেনে রেলিঙের সামনে এনে তার ওপরে উঠে দাঁড়ালো সুমিত্রা।
নিচের দিকে পা বাড়ানোর আগে শেষ বারের মত দুচোখ মেলে আকাশের দিকে তাকালো সে।
দরজার পাশে পড়ে থাকা একটা ফুলের টব দেখতে পেয়ে হঠাৎ খানিকটা সম্বিত ফিরে পেল পার্থ। দুহাতে টবটা মাথার ওপরে তুলে ধরে ছুটে এসে সর্বশক্তিতে আঘাত হানলো দরজার ল্যাচলক -এর অংশে। আঘাতের তীব্রতায় থরথরিয়ে কেঁপে উঠে ভেঙে পড়ল দরজার প্রতিরোধ।
দরজা পেরিয়ে ব্যালকনিতে এসে পাথরের মত স্থির হয়ে গেল পার্থ। রেলিঙের ধারে সুমিত্রার ক্ষীন আবয়বের ছায়া। হতবাক সুমিত্রা বিস্ফারিত নিষ্পলক চোখে চেয়ে রয়েছে আকাশের দিকে।
আর আকাশ! এ আকাশ ত কালো অমাবস্যার আকাশ নয়! প্রকৃতির সব নিয়ম উল্লঙ্ঘন করে এই আকাশে জ্বলে উঠেছে পূর্ণচন্দ্রের অলৌকিক এক রূপ। এই চাঁদ আর ফ্যাকাশে সাদা রক্তশূন্য নয়। এই চাঁদের রঙ ঘোর রক্তবর্ণ ও উজ্জ্বল। যেন প্রকৃতি এই মাত্র সিঁদুর পরিয়ে নববধূ রূপে গ্রহণ করেছে তাকে।
প্রাথমিক বিস্ময় কাটিয়ে উঠে এগিয়ে গিয়ে সুমিত্রাকে জড়িয়ে ধরে রেলিঙের থেকে সরিয়ে আনল পার্থ। সর্বশক্তিতে পার্থকে আলিঙ্গন করে পার্থর বুকে মাথা রেখে ভেজা গলায় বলে উঠল সুমিত্রা,
‘আমাকে আকাশ আবার তোমার কাছে ফিরিয়ে দিল। আমাকে বাঁচার লড়াই করতেই হবে। পারবে আমাকে জিতিয়ে দিতে?’
সুমিত্রার মাথায় হাত রেখে তার রুক্ষ ক’খানি চুলে হাত বোলাতে বোলাতে রুদ্ধ কণ্ঠেপার্থ বলে উঠল,
‘নিশ্চই পারব সুমি’।
সুমিত্রার উষ্ণ নিঃশ্বাস বুক পেতে অনুভব করতে করতে তার মুখের দিকে তাকিয়ে পার্থ দেখল তার রক্তশূন্য ফ্যাকাশে গালের ওপরে আজ আবার পড়েছে অনেকদিনের হারিয়ে যাওয়া সেই রক্তিম আভা।
——-
লেখকের কৈফিয়তঃ এই গল্পের প্লট মৌলিক হলেও বিশ্বসাহিত্যের একটি বিখ্যাত গল্পের কিছুটা প্রচ্ছন্ন অনুপ্রেরণা এই গল্প লিখতে আমাকে উদ্বুদ্ধ করেছে। গল্পের নাম উল্লেখ করছি না। পাঠক যদি গল্পটিকে চিনতে পারেন তাহলে গল্পের নিচে কমেন্ট বক্সে মন্তব্য করে জানাবেন।
Tags: কল্পবিজ্ঞান গল্প, দ্বিতীয় বর্ষ প্রথম সংখ্যা, সুপ্রিয় দাস, সুমন দাস
“The Last Leaf” by O. Henry