অ-আ-ভ
লেখক: রণেন ঘোষ
শিল্পী: দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য (চিত্রচোর)
ক্রিং ক্রিং বা মোবাইলের শব্দ শোনা গেলেই আঁতকে উঠতাম। প্রতিটি ফোনেই মনে হত দীপের ফোন বা কল্পবিশ্বের কোন পাগলের ফোন। না না, আপানারা যা ভাবছেন তা নয় কিন্তু। অর্থনৈতিক কোন কারণ নেই এর পিছনে … সেই সম্পর্ক এখনো ওদের সঙ্গে গড়ে ওঠে নি। টাকা হলে তো ধার–দেনা করে চেয়ে চিন্তে ফেরত দেয়া যায় … ওরা যে লেখা চাইছে। আমার আবার মুখের ওপর না বলার মত শিক্ষা নেই। তাই তো মাস তিনেক পূর্বে বলেই দিলাম … হ্যাঁ হ্যাঁ চিন্তা কোরো না, নিশ্চই লিখে দেব। কেটে গেছে আরো সপ্তাহখানেক। এবার এলো সুপ্রিয় সঙ্গে দুজন। ঢাউস এক যন্ত্র আর এক তরুণ… চোখে মুখে কোন কিছু করতে পারার উত্তেজনা। ঘন্টাখানেক বা দুয়েক ধরে আকাশ সেন, অদ্রীশ বর্ধন আর অধম কলমচির মধ্যে টানাপোড়েনের একগাদা চিঠি, নোট, হাত চিট, পোস্টকার্ড, খসড়া আরো কত কি। দুই তিনশ কাগজ থেকে পোস্টকার্ড আর জেরক্সের সব ছাপা কাগজের খালি পিঠের ওপর সারসার মৌমাছির মত লেখায় ভরা। ‘মৌমাছির মত’ বললাম কেন জানেন? মৌমাছি মানে তো মধুর মিষ্টতা। ঠিক তেমনি চিঠির ভাষা এবং বিষয়বস্তুর মধ্যেও আমি আজও রত্নভান্ডারের সন্ধান পাই। লেখা তো নয়, মৌমাছির মত সারসার লেখাগুলো অভীষ্ট বিষয়ের দিকে ধীর গতিতে এগিয়ে গেছে। চিঠি তো নয়, একটা চকমকির আলো। রাগ, অভিমান, ভালোবাসা, মমত্ববোধ–সম্পন্ন সম্পাদক আমার ভাই যে পরম আশ্লেষে জড়িয়ে আছে বাক্যগুলোর মধ্যে। তবে হ্যাঁ, অদ্রীশদার মতো আমি কিন্তু কাছাখোলা ছিলাম না। আমার কোন চিঠির প্রমাণ নেই কোথাও… সব কাজ সেরেছি সামনা সামনি বসে নয়তো দূরভাষের মাধ্যমে।
আমার কি মনে হয় জানেন… আমার লেখার গুরু অদ্রীশ বর্ধনের বিষয়ে কিছু লেখার চেয়ে চিঠিপত্রের কয়েকখানা প্রকাশ করে দিলেই বুদ্ধিদীপ্ত পাঠককুল সহজেই বুঝে নিতেন চিঠির লেখক আর চিঠির প্রাপকের তৎকালীন দ্বন্দ্ব সমাসের ইতিকথা।
১৯৬৩–১৯৬৪ সালের ঘটনাবহুল সময়ের ছবি আঁকা কি কলমচির অপেশাদারি কলমে ফুটিয়ে তোলা যায়? প্রথম গল্প বেরোয় আশ্চর্য! পত্রিকায় – এস.এস. ফ্লাসওয়ে। আমি তখন বাংলা সরকারের ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের মাসিক ১৩০ টাকা বেতনের করণিক। সকালেই ফোন। নিজের বাড়িতে ফোন ছিল না। একটা বাড়ির পরে দাদার বাড়িতে গিয়ে ফোন ধরে চমকে উঠলাম।
‘… রণেন বাবু, আমি আকাশ সেন বলছি… এমাসের পত্রিকা দেখেছেন? আপনার গল্প এস.এস. ফ্লাসওয়ে বেরিয়েছে।’
আমি তো থ’। এর পূর্বে কোন পত্রিকায় কোনকিছু পাঠানোর সাহস করিনি। আশ্চর্য!’র প্রথম সংখ্যা থেকে প্রতিটা সংখ্যা এক নিঃশ্বাসে শেষ করে ফেলতাম। অফিসে যাবার সময় প্রয়োজনীয় কাগজপত্রের সঙ্গে ‘আশ্চর্য!’ তো থাকতোই। আকাশ সেন তখনও আমার কাছে রাডা গ্রহের কাঙ্খিত মানুষ। সেই আকাশ সেন সাত সকালে আমাকে ফোন করেছেন!
কয়েক সেকেন্ডের নীরবতা ভেঙে বলে উঠলাম… ‘তাই নাকি, আমি তো ভাবতেই পারিনি’… তার পরে উন্মাদের মতো কি বলেছিলাম জানি না। কিন্তু আনন্দোচ্ছ্বাসকে থামিয়ে দিয়ে ওপার থেকে ভেসে এল, ‘… রণেনবাবু, সময় করে আশ্চর্যের দপ্তরে চলে আসুন…বিকেলে ছুটির পর… গল্পটাকে নিয়ে আমার ভাবনা আছে।’
তর সইল না। কলেজস্ট্রীট থেকে পাতিরামের সামনের ভেন্ডারের কাছ থেকে ‘আশ্চর্য!’ কিনে ফেললাম অফিস যাবার আগে। তারপরে, সেইদিন সন্ধেবেলায় উত্তেজনায় দুরু দুরু বুকে হাজির হলাম পত্রিকার দপ্তরে। চেয়ারে বসে সুপুরুষ এক বাঙালি – চোখে চশমা… সামনের চেয়ারে আরও কয়েকজন।
আমার পরিচয় দিতেই উঠে দাঁড়িয়ে আমার হাত ধরে সামনের চেয়ারে বসালেন। যারা জাঁকিয়ে বসেছিল তাদের উদ্বাস্তু করে দিতে কয়েক সেকেন্ডও দেরী করলেন না আশ্চর্য!-র সম্পাদক। আশ্চর্য! কুমার… আমার রাডাগ্রহের বাসিন্দা আকাশ সেন… আমার কাছে রাডাগ্রহের বিক্রমজিৎ। আমার আড়ষ্টতা কয়েক সেকেন্ডে উধাও হয়ে গেল। আশ্চর্য! এগিয়ে দিতেই বললাম… না না… আমি তো কিনে নিয়েছি।
… বাপস এর মধ্যে কিনে নিয়েছেন? তবুও রাখুন আপনার কমপ্লিমেন্টারী সংখ্যা।
তারপর শুরু হল গল্পটার উপন্যাস রূপ দেবার ভাবনা চিন্তার বহিঃপ্রকাশ। বার বার করে জিজ্ঞাসা করলেন, এত ভাল উপন্যাসের প্লটটা কেন ছোটগল্পের আকারে দিলাম। উপন্যাস তো তখন আমার কাছে সম্পূর্ণ ভিনগ্রহী।
কোন এক আনকোরা লেখকের কাঁচা গল্প নিয়ে কোন সম্পাদক, বিশেষ করে একমাত্র সায়েন্স ফিকশন পত্রিকার সম্পাদক, আকাশ সেনের মত আন্তরিক সাহস জোগানো কজন সম্পাদক করেন বা করেছেন আমার জানা নেই। হ্যাঁ, তখনও সম্পাদক অদ্রীশ বর্ধন হননি– আকাশ সেনই ছিলেন আমার কাছে। আজ তাই আমি ভাবি যখনকার কথা বলছি তখন অদ্রীশদা ক্যালকাটা কেমিক্যালে দায়িত্বপূর্ণ পদে কাজ করছেন… সদ্যোজাত পত্রিকা মায়ের মত আগলে রাখছেন… পাতা ভরাবার জন্য লিখছেন দু হাতে। তাবড় তাবড় লেখকের কাছে ধর্না মারছেন লেখার জন্য। সেই সঙ্গে করছেন পত্রিকা বিক্রি করার আপ্রাণ চেষ্টা। সঙ্গে তো পত্রিকার অক্সিজেন অর্থের সংস্থানের কথা ভেবে দোরে দোরে মাধুকরী বৃত্তি চালিয়ে যাওয়া।
একটা গল্প ছেপে বেরোনোর সঙ্গে সঙ্গে আমার কাছে আমি তো কেউকেটা বনে গেছি… লেখার সঙ্গে আর যোগাযোগ নেই, বেশ কয়েকদিন নির্বিঘ্নে কেটে গেলেও দিন পনেরোর মধ্যে অফিস ঘরে ডাক পড়ল। আমার নাকি ফোন এসেছে।
রিসিভার কানে তুলতেই ভেসে এল,
… রণেনবাবু, আমি আকাশ সেন বলছি… আকাশ সেন… আসছেন না কেন? লেখা কোথায়? চিন্তায় আছি!
আর পায় কে? আমার পাখা গজাল… সম্পাদকের তাগাদার মানেটা সহকর্মীদের ঠারে ঠারে বোঝাতে শুরু করলাম…. কলার উল্টে চলার মত…
তারপরের ঘটনা তো সহজেই অনুমেয়। হাজার কাজের মধ্যে একজন সম্পাদক লেখক তৈরি করার দুঃসাধ্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। সেইযুগের সেদিনের কথা মনে এলে আজও আমার শরীরে রোমাঞ্চ জাগে। মোস্ট মিডিওকার তরুণ কেরানীর মধ্যে যে সাময়িক ভাবে উন্মাদনা জাগিয়ে দিতে, দু চোখে ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখাতে পারে, সেই স্বপ্নের ম্যাডনেস এর রেশে আপ্লুত আমি ৮২ বছর বয়সেও দেখে চলেছি তার নাম অদ্রীশ বর্ধন ছাড়া আর কেউ হতে পারে না……।। হ্যাঁ, সত্যি হতে পারে না, অন্তত আমার কাছে।
ডোবার বর্ণনা করতে সময় লাগেনা। কিন্তু সাগরের বর্ণনা করব কেমন করে… কোথা থেকে শুরু করব তাই তো ভেবে ঠিক করতে পারি না। অদ্রীশদা সম্পর্কে বলতে হলে কোথায় শুরু করব আর কোথায় শেষ করব বুঝতে পারি না।
… নানা অদ্রীশ বর্ধনকে আমি দেবতার স্তরে উন্নীত করছি না।
… অদ্রীশদা মানুষ……মানুষের প্রবৃত্তির বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে বারেবারে। ……… হিংসা, দ্বেষ, লোভ, লালসা কি নেই সেখানে… তার বড় পরিচয় আমি ছাড়া আর কেউ বোঝেনি। কিন্তু সেইসব ক্ষুদ্রতা, সঙ্কীর্ণতার মাঝেও তার মধ্যে সৃষ্টির উন্মাদনা, সৃজনীশক্তির বিকাশ, সহকর্মী সহমর্মীদের উৎসাহ দিয়ে গড়ে তোলার প্রচেষ্টা, সব মানবিক প্রবৃত্তিকে ছাপিয়ে যায়।
কত স্পটলাইট দেখলাম… পাতার পর পাতা লেখা যায়। বলে শেষ করা যাবেনা।
একদিন বিকালে ঝড়ের বেগে অদ্রীশদা এল ১৫ নম্বর লিন্টন ষ্ট্রীটে। ফ্যান্টাসটিক পত্রিকা প্রকাশলগ্নের মাসখানেক আগে আমরা দুজন বসে নতুন পত্রিকার নামকরণ থেকে বিস্তারিত ভাবে আলোচনা করেছি।
কৃষ্ণা… কৃষ্ণা, শোন, আমার জন্যে এক কাপ চা কর… কড়া হয় যেন। রণেনকে ঘরে আটকে রেখেছি, আজই আমি একটা গল্প লেখাব।
পাক্কা দু–আড়াই ঘন্টা ধরে পাশের ঘরে কৃষ্ণার সঙ্গে গল্প করল… মাঝে মাঝে হাঁক পাড়ছে… কলম চলছে তো… জমিয়ে লিখে যাও।
বেশ কয়েকঘন্টা পরে লেখা হল… ক্যাকটাস। একের মগজ অন্যদেহে প্রতিস্থাপন, সময় সেটা ১৯৭৫। অদ্রীশদার মন্তব্য শুনে আপনারা যেন ভাববেন না আমি নিজের ঢাক নিজেই পেটাচ্ছি। বিশ্বাস করুন সেদিনের কথাগুলো এখনো কানে বাজছে। সেইখানে বসে পুরো গল্পটা পড়ল। চোখমুখে জ্বলজ্বলে ভাব।
“…আমার তো নিজেকেই সাবাস বলতে ইচ্ছা করছে। দেখ তো, এমন একটা গল্প, যেটা আমি এখনো ভাবতে পারছি না। বুঝতে পারছি তোমার মত আরও কয়েকজনকে চাই, তৈরি করে নিতে হবে।“
নিজের সৃষ্টির প্রতি এই যে আত্মবিশ্বাস ….অহংকার নয়… সায়েন্স ফিকশন সৃষ্টির নেশায় সঠিক মাটিতে সঠিক বীজ পোঁতার অঙ্গীকার। সেদিন আমি দেখেছিলাম অদ্রীশদার চোখে, সেদিনের যারা সায়-ফি কলম নিয়ে শোরগোল তুলেছিল বা পরবর্তী কালে যে মুষ্টিমেয় কয়েকজন সায়–ফি কলম বাঁচিয়ে রেখেছে, তাদের মধ্যে সকলের না হলেও অধিকাংশের মনেই সায়-ফির প্রতি আন্তরিক ভালোবাসা জন্মানোর পিছনের ওই ম্যাডনেস কাজ করেছিল।
….অদ্রীশদার ম্যাডনেস …।
ভবিষ্যতের রঙিন স্বপ্ন জাগিয়ে তোলার ক্ষমতা। না, বলতে গেলে টাকার দুটো পিঠের কথাই বলা উচিত। সঠিক মূল্যায়নের জন্য। কিন্তু সেই মূল্যায়নের সত্য কথনের সাহসটুকু আমার নেই। মাঝে মাঝে ভাবি নির্মম সত্য কেন বলতে পারব না…। না আমি পারব না।
আবার অদ্রীশ বর্ধনকে দেখেছি এক প্রতিষ্ঠান বাঁচানোর আপ্রাণ প্রয়াসে।
সেটা কোনদিন আমি ভুলতে পারব না।
— রণেন তুমি ত দায়িত্ব নিতে পিছ পা হও না। একটা সাহিত্য প্রতিষ্ঠানকে বাঁচাতে পারবে?
আমি তো আকাশ থেকে পড়লাম। আমি তখন শ্রীরামপুরে কাজে যাবার জন্য তৈরি হচ্ছি। তখনও আমি ১৫ নম্বরে। অদ্রীশদা তখন ইত্যাদি প্রকাশনীর ‘কিশোর মন’ পত্রিকার সম্পাদক। ১৯৮৩–৮৪ ‘র কথা। ইত্যাদিতে তখন চরম বিশৃঙ্খলা চলছে। ‘পরিবর্তন’, ‘সুকন্যা’ আর ‘কিশোর মন’ খ্যাত বিশাল কোম্পানির ‘সুপ্রভাত’ নামে দৈনিক কাগজ বার করার প্রচেষ্টা– প্রবাদপ্রতিম চৌধুরী সাহেবের স্বপ্ন– প্রতিদ্বন্দ্বী কর্পোরেট জগতের টর্পেডোর আঘাতে ডুবতে বসেছে। আমিও তখন সারাভাই গ্রুপের স্টান্ডার্ড ফার্মাসিউটিক্যালস–এ ম্যানেজারি পদ থেকে স্বেচ্ছাবসর নেব বলে ঠিক করেছি। অদ্রীশদার কথা শিরোধার্য করে ইত্যাদির দায়িত্ব নিলাম ১৯৮৫ তে। আশ্চর্যের ব্যাপার হল যে অদ্রীশদার কথায় একশো–দেড়শো জন কর্মীর দায়িত্ব নিলাম, তার ম্যানেজার ডাইরেক্টর পদে… কিন্তু মাস খানেকের মধ্যে অদ্রীশদা চাকরী ছেড়ে দিল আমাকে না জানিয়ে। শুধু তাই নয় আমাকে সরে আসার জন্য বারবার উপদেশ দিয়েছিল। সেও এক কথায় সায়–ফির মত রোমাঞ্চকর ঘটনা।
অদ্রীশদার চরিত্রে মিলেমিশে রয়েছে গুরুচণ্ডালী ব্যাপার স্যাপার। নিজের ঘরের লোক হয়েও আজও সেকথা জানতে পারিনি হাজার চেষ্টা করেও। শুধু একটি দৃষ্টান্ত নয়… আরও আছে। আশ্চর্য!-র মত ইতিহাস সৃষ্টিকারি পত্রিকা থাকতে আবার কেন নতুন পত্রিকা ফ্যান্টাস্টিকের জন্ম দিলাম! দিলাম বললাম এইজন্য যে সেই নতুন পত্রিকাকে পৃথিবীর আলো দেখানোর প্রসব বেদনায় আমিও যে অন্যতম অংশীদার ছিলাম। আবার বিস্ময়! সাই-ফি পত্রিকায় যুক্ত হবার জন্য বেশ কয়েকবার অদ্রীশদা কে বলেছি… লেখা দিতে অনুরোধ করেছি… কিন্তু সব বিফলে গেছে। নতুন লেখা পাইনি বিস্ময়!-এ।
এত কেনর উত্তর আজও রহস্যে ঢাকা। ইদানিং বেশ কয়েক বছর আগেও সময় অসময়ে অদ্রীশদার বাড়ি গেছি। ভাইপো জয়ের রণেন কাকু হয়েও থেকে গেছি। আমার নতুন বই সব নিয়ে গিয়ে গুরুপ্রণাম করেছি। অপার স্নেহে বুকে জড়িয়ে ধরেছেন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা বইয়ের বিষয়বস্তু নিয়ে আর সাই–ফি নিয়ে কথা হয়েছে। কিন্তু সদুত্তর মেলেনি।
আজ অদ্রীশদা বয়সের ভারে অসুস্থ। বিস্মরণের শিকার…শোনার আসুবিধাও আছে। তবু অদ্রীশদা ‘অদ্রীশ বর্ধন’ বাংলার। এই আমিই ১৯৮৫ সালের ফ্যান্টাসটিকের প্রথম বইমেলা করলাম একদম গায়ের জোরে। অদ্রীশদার সম্পূর্ণ ইচ্ছার বিরুদ্ধে। সে আর এক ইতিহাস। আরও এক লম্বাকাহিনী ।
বাংলায় সায়–ফি পত্রিকা সেই ১৯৬৩ সালে প্রকাশ করে যে দুঃসাহস দেখিয়েছিল… তারুণ্যের বিজয়ধব্জা উড়িয়েছিল তাকে অস্বীকার করার ক্ষমতা কোন ভবিষ্যতের নেই।
১৯৬০ এর দশকের সাহিত্যের প্রেক্ষাপটের দিকে আরও একবার ফিরে তাকাই, ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ছোটদের বেশ কিছু পত্রিকার সায়–ফি ধরনের গল্পলেখা হয়েছে। কিন্তু পাঁচমেশালি সাহিত্য পত্রিকা ছেড়ে শুধু সায়–ফি পত্রিকার প্রকাশ– বাস্তবের কথা ছেড়ে দিলেও– কল্পনাও কেউ করতে পারেননি।
আনন্দবাজার, যুগান্তর, বর্তমান সহ বড় বড় প্রকাশনার প্রতিষ্ঠান রমরম করে চলছিল। তাদের অনেকেরই পত্রিকা ছিল। কিন্তু তারা কেউ বাংলা ভাষায় কল্পবিজ্ঞান নিয়ে মাসিক পত্রিকা বার করার প্রয়োজন বোধ করেননি। শুধু সেদিন কেন আজও কোন প্রতিষ্ঠিত প্রকাশনাও কল্পবিজ্ঞান নিয়ে পত্রিকা প্রকাশ করার দুঃসাহস দেখান নি। এই প্রেক্ষাপটের সামনে দাঁড়িয়ে অদ্রীশদা মাসিক কল্পবিজ্ঞান পত্রিকার শুধু স্বপ্নই দেখেন নি, পত্রিকা বার করে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন ম্যাডনেস না থাকলে নতুন কিছু করা যায় না। বেরিয়েছিল আশ্চর্য… ১৯৬৩ সাল। তারপরের কথা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। তাইতো অদ্রীশ বর্ধন বাংলা সাহিত্যে বিশেষ করে বাংলা পত্রিকার জগতে অনেক উঁচুতে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছেন। অথচ তার কপালে সরকারী বেসরকারি কোন খেতাব বা পুরস্কারই জোটেনি; আজও। অবশ্য খেতাব বা পুরস্কারের মধ্যে অধিকাংশই গা শোঁকাশুঁকি দলের লোক হওয়ার প্রয়োজন পড়ে। তবে তিনি পাঠকদের পুরস্কার থেকে বঞ্চিত হননি। সায়-ফি পিপাসুদের মনে অদ্রীশ বর্ধন এর আসন চিরস্থায়ী হবে।
তবে অদ্রীশ বর্ধন এর মানসিকতার উত্তরসূরি হিসাবে বর্তমান পাঠক সমাজের গভীরভাবে ভেবে দেখবার সময় হয়েছে যে আজও কেন সায়-ফি কল্পবিজ্ঞান সাহিত্যের মূল স্রোতে ঠাই পায় নি? আজও সায়-ফি ব্রাত্য হয়ে সীমিত প্রয়াসের মধ্যে আটকে রয়েছে। অবশ্য খেয়াল খুশিতে প্রতিষ্ঠিত সাহিত্যিকেরা সায়-ফি লেখার চেষ্টা করেছেন… কয়েকটি উতরে গেলেও অধিকাংশই সায়-ফি পদমর্যাদাযুক্ত না খেয়ালখুশির ফসল, সেটাও ভেবে দেখা দরকার।
যতই মনে করি এবার থামব… ততই কলম বিদ্রোহ করে… আর কয়েকটি কথা না বললে হয়ত সত্য কথনের অমর্যাদা করা হবে। যাইহোক আমার কেবল একজনের কথা বার বার মনে পড়ে। সে কবেকার লোক সে কথা পুরাণ লোকসাহিত্য বলতে পারবে। সে হচ্ছে ভগীরথ … ভগীরথের মাথায় ম্যাডনেসের ভূতে ধরেছিল। মহাদেবের জটা জাল ছিন্ন করে গঙ্গাকে মর্ত্যে নামিয়ে এনে পরম জনকল্যাণের কাজ করেছিলেন। স্বয়ং ভগীরথ কোন প্রযুক্তির সাহায্য নিয়েছিলেন জানিনা, তবে অদ্রীশদার পাগলামি ভগীরথের সমতুল্য… বার বার কুর্নিশের দাবীদার। মাঝে মাঝে মনে হয় আসুন না, আমরা সবাই বেঁচে থাকা অদ্রীশ বর্ধনকে কল্পবিজ্ঞানের ভগীরথ উপাধিতে ভূষিত করি।
বাংলা সাহিত্যে সায়–ফি নিয়ে নয়া ঘরানা সৃষ্টি করেছে নয়া ভগীরথ। বাংলা সাহিত্যে ব্রাত্য অপাংতেয় বিষয়কে সাহিত্যের মূলধারায় নিয়ে আসার স্পর্ধা দেখিয়েছে… তারই জন্য আমরা পেয়েছি আশ্চর্য!, বিস্ময়!, ফ্যান্টাসটিক আর বর্তমানের কল্পবিশ্ব।
কল্পবিজ্ঞানের ভগীরথের দেহে নিশ্চয় সায়-ফির জিন আছে, সেই জিনের প্রবল সংক্রমণ ঘটুক আমাদের তরুণ তরুণীদের মধ্যে।
ভগীরথ দীর্ঘজীবী হোন।
(সম্পাদকের কথা – পাঠকের মত আমরাও কৌতূহলী ছিলাম, ‘অ–আ–ভ‘ কেন লেখার নাম ? রনেন বাবুকে প্রশ্নটা করতে উনি স্মিত হেসে উত্তর দিলেন – ‘ওটাও তোমাদের কুইজ হোক না ?’ হে পাঠক, পারবেন কি আপনি এই রহস্য ভেদ করতে?)
এই সংখ্যার প্রথম লেখা এটাই পড়লাম। বাকরুদ্ধ ! পুরো দৃশ্যাবলী চোখের সামনে ভেসে উঠল। অসাধারণ লেখা। সুপ্রিয় ও তার ঢাউস স্ক্যানার যন্ত্রের সাথে বোধহয় আমিই গিয়েছিলাম। অ আ ভ ধাঁধার সমাধানের চেষ্টা করলাম আমার স্থুল মস্তিষ্ক দিয়ে , অতীত আর ভবিষ্যৎ ।
it means three names: Adrish ,Akash and Bhagirath ….
ekdom thik dhorechen 🙂
“আশ্চর্য!”-র মতো একটা পত্রিকার স্রষ্টা হয়েই অদ্রীশ বর্ধন বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে অক্ষয় স্থান অধিকার করে আছেন। অনুবাদক এবং লেখক অদ্রীশ বর্ধনের কথা ছেড়ে দিয়েও বলা যায়, শুধু এই একটি ভূমিকায় তিনি সত্যিই আকাশের মতো বিশাল, এবং ভগীরথের মতো পরিশ্রমী ও সাহসী। কিন্তু ক্যাম্পবেল যেভাবে ইংরেজি ভাষায় কল্পবিজ্ঞান চর্চাকে একটা সুসংহত আকার দিয়েছিলেন, বাংলায় সেটা করা যায়নি, এটাই আমাদের দুর্ভাগ্য।