আঁধার আর ঈশ্বর
লেখক: লুৎফুল কায়সার
শিল্পী: সুপ্রিয় দাস
শুরুর আগে
ঘুমিয়ে আছেন তিনি। অদ্ভুত এক মহাজাগতিক শূন্যতা গ্রাস করেছে তাঁকে।
জগৎ-সংসারের সবকিছু বেঁচে আছে উনার ঘুমের মধ্যেই। যদিও এই সংসার নিয়ে বিন্দুমাত্র চিন্তা নেই তাঁর।
তারপরেও এই জগৎ গড়ে উঠেছে।
ঘুমিয়ে চলেছেন তিনি আর দেখে চলেছেন একের পর এক স্বপ্ন। প্রতিটি সৃষ্টিকে নতুন করে পূর্ণতা দিয়ে চলেছে উনার স্বপ্নগুলো। স্বপ্নের মাধ্যমেই প্রতিদিন গড়ে উঠছে নতুন নতুন ছায়াপথ, নক্ষত্র আর গ্রহগুলো।
উনি অসীম ক্ষমতাবান, এই ক্ষমতাই তাঁকে করেছে নিঃসঙ্গ।
উনি কে? এই প্রশ্নের উত্তর সম্ভবত উনি নিজেও জানেন না। শূন্যতার মধ্যে হুট করে একদিন নিজেকে পেয়ে গেছেন তারপর দেখতে শুরু করেছেন স্বপ্ন।
নিজের স্বপ্নকে প্রভাবিত করার ক্ষমতাও উনার আছে, তবে সেই ক্ষমতা প্রয়োগেও চরম উদাসীন তিনি। নিজের সৃষ্টি নিয়ে ভাবতে ভালো লাগে না।
উনার সৃষ্ট প্রাণীগুলোর মধ্যে খুব অল্প সংখ্যকই উনার অস্তিত্বের কথা জানে। তবে এসবের পরোয়া করেন না উনি। কেউ উনাকে ডাকলে খুশি হন না, না ডাকলেও অসন্তুষ্ট হন না। উনি সবকিছুর উর্দ্ধে।
তবে একটা ব্যাপার রয়েছে।
সৃষ্ট প্রাণীগুলোর মধ্যে প্রতি হাজার বছরে একজন অদ্ভুত এক ক্ষমতা নিয়ে জন্মায়।
উনাকে ডেকে আনার ক্ষমতা! কেন তারা এই ক্ষমতা পায়?
উনার স্বপ্নের খেয়ালে হয়তো!
যদিও এইসব নিয়েও ভাবেন না তিনি।
এই প্রাণীগুলো ডাকলে নিজের স্বপ্নের মধ্যে প্রবেশ করেন তিনি আর দেখা দেন নিজের সেই বিশেষভাবে সৃষ্ট প্রাণীটিকে।
গত দশ হাজার বছরে কেউ তাঁকে ডাকেনি!
তবে চিরকাল ঘুমাবেন না তিনি। একদিন জেগে উঠবেন আর সেদিনই হবে এই মহাবিশ্বের শেষ দিন! যাকে ধর্মগুলো বলে ‘মহাপ্রলয়’।
কেউ জেগে ওঠার পরে কি আর তার স্বপ্ন থাকে? উনি জেগে ওঠার পরেও এই মহাবিশ্ব আর থাকবে না!
১. ত্যাগ
“বলছ কী আবিদ! আমাদের একমাত্র মেয়েকে রেখে আসতে হবে? আমাদের সঙ্গে আর থাকবে না ও?” প্রায় আর্তনাদ করে উঠল অনিমা।
“তুমি একটা জিনিস ভুলে গেছ অনি, আমরা এমন কিছু জানি যা এই পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষই জানে না! আমি তোমাকে আগেই বলেছিলাম, আমাদের জয়া অনেক বড় কিছুর জন্য জন্মেছে! আমি ওর ভাগ্য বহু আগেই দেখে ফেলেছিলাম! ও সরাসরি উনাকে ডাকার ক্ষমতা রাখে! উনি… ঈশ্বর,” ঠান্ডা গলায় বলল আবিদ।
“কিন্তু আমাদের জয়াকে রেখে আসব? ও রাস্তায় পড়ে থাকবে?” প্রায় কেঁদে ফেলল অনিমা।
“না! ওর ব্যবস্থা ঠিক হয়ে যাবে, ও এক নতুন বাড়িতে যাবে, যেখানে ওর নাম জয়াই রাখা হবে!”
“এসব তোমাকে কে বলেছে?”
“আমাকে যিনি বলেছেন তিনিও অনেকটা আমাদেরই মতো! উনি এই পৃথিবীতে ঈশ্বরের সবচেয়ে পুরানো সেবকদের একজন। আমাদের মেয়েকে বেশ কয়েকটা বছর খুব বাজে সময় পার করতে হবে, তারপর স্বয়ং ঈশ্বর ওকে দেখা দেবেন আর ওর জীবন বদলে যাবে! বদলে যাবে মহাবিশ্বের অনেক কিছুই!”
“কিন্তু আমাদের মেয়ে ঈশ্বরকে ডাকতে শিখবে কী করে?”
“সময় হলে ঈশ্বরের সেই বর্ষীয়ান সেবক ওকে দেখা দেবেন, উনিই সব শেখাবেন!”
“আমার মেয়ে…”
“অনি, আর দ্বিধা করো না, আমাদের মেয়ের সঙ্গে এই মহাবিশ্বের ভবিষ্যত জড়িত রয়েছে!”
“মানে?”
“গত কয়েক হাজার বছরে ঈশ্বরকে কেউ সরাসরি ডেকে আনেনি! এতে করে শুধুমাত্র এই ক্লান্তিকর মহাবিশ্বের আয়ুই বৃদ্ধি পাচ্ছে! আর কিছুই না! ঈশ্বরকে ডেকে আনলে উনার ঘুমের মেয়াদ কমে যায়! কাছে আসে উনার জেগে ওঠার সময়! উনি জেগে উঠলেই শেষ হবে এই মহাবিশ্ব! শেষ হবে এইসব ফালতু জিনিসপত্রগুলো! ঈশ্বরের একজন প্রকৃত সেবকের জন্য এর চেয়ে গর্বের আর কিছু নেই যে সে ঈশ্বরকে জাগিয়ে তোলায় ভূমিকা রাখতে পারছে!”
“আমাদের মেয়েকে নিয়ে যেতেই হবে?”
“আমাদের জয়া সম্মানিত হতে যাচ্ছে! ঈশ্বরকে দেখার ভাগ্য সবার হয় না!”
২. বার্তাবাহক
স্থির দৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে লোকটা। গত কয়েকশো বছর ধরে এইভাবে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকেন উনি। উনি আলাদা, অন্য সব মানুষদের থেকে আলাদা।
নিঃসীম অন্ধকার আকাশের গায়ে ফুটে ওঠা তারাগুলো দেখে যুগের পর যুগ অসংখ্য কবি শত-সহস্র প্রেমের কবিতা লিখেছেন। প্রচলিত ধর্মগুলো ওই আকাশকে ঈশ্বরের মহানতা আর বিশালতার প্রতীক হিসাবে দেখেছে।
কিন্তু এরা কেউই জানে না এই মহাবিশ্বের বাস্তবতা।
আর সেটা না জানাই তাদের জন্য ভালো। কারণ সেই সত্য জানতে পারলে পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষই উন্মাদ হয়ে যাবে। তারা হারিয়ে ফেলবে মনুষ্যত্বের প্রতি তাদের তীব্র বিশ্বাস আর আস্থা!
“সময় হয়েছে! এবার আমাকে যেতে হবে, বার্তা নিয়ে,” একা একাই বলে উঠল লোকটা, তার ঠোঁটে ফুটে উঠেছে মুচকি হাসি।
৩. দুঃস্বপ্ন
অদ্ভুত একটা আলো এসে গ্রাস করল জয়ার চোখদুটো। বেশ কিছুক্ষণ পুরোপুরি কিছুই দেখতে পেল না সে।
ধীরে ধীরে সবকিছু পরিষ্কার হল ওর চোখের সামনে।
একটা ফাঁকা প্রান্তরে দাঁড়িয়ে সে। আকাশটা অদ্ভুত রকমের লাল। চারপাশে আর কিছুই নেই।
“ঈশ্বর আসবেন… তোমাকে উনি দেখা দেবেন….” অদৃশ্য কেউ যেন বলে উঠল।
ঘুমটা ভেঙ্গে গেল জয়ার। লোকটা তাকে ধরে অদ্ভুতভাবে ঝাঁকাচ্ছে!
“জয়া, অ্যাই জয়া,” লোকটার কর্কশ কণ্ঠে যেন জয়ার বুকে আঘাত করছিল।
“হুম..” কোনওমতে উত্তর দিল সে।
“ঘুম ভেঙেছে?”
“হ্যাঁ!”
আর কিছু না বলে জয়ার শরীরের ওপর উঠে পড়ল লোকটা।
হঠাৎ করেই কেন যেন চোখ দিয়ে দরদর করে পানি পড়তে লাগল জয়ার।
আজব ব্যাপার না? গত দশটি বছর ধরে প্রায় প্রতি রাতেই এমনটা হয়ে আসছে। এইসবে খুবই অভ্যস্ত সে।
প্রথম দিন কি সে কেঁদেছিল? মনে পড়ে না জয়ার। কেঁদে থাকলেও ব্যথাতেই কেঁদেছিল হয়তো! তখন তো এসবের কিছুই বুঝত না সে!
কিন্তু আজ কেন কান্না পাচ্ছে তার?
উত্তরটা ওর অজানা!
৪. নির্দয়
“এই যে মিস জয়া, তুমি কি আমার কথা শুনতে পাচ্ছ?” বেশ রাগী কণ্ঠে বলে উঠলেন প্রফেসর মাহবুব। ক্লাসে ছাত্র-ছাত্রীদের অমনযোগী থাকাটা একদমই সহ্য করতে পারেন না তিনি।
কোনও উত্তর নেই জয়ার। সে যেন হারিয়ে গেছে কোনও এক কল্পনার জগতে।
“মিস. জয়া!” এবার প্রায় চিৎকার করে উঠলেন প্রফেসর।
“অ্যাই জয়া! তোকে ডাকে!” জয়ার পাশ থেকে বলে উঠল শান্তা।
হুট করেই যেন বাস্তবে ফিরে এল জয়া।
“ইয়েস স্যার!” বলে দাঁড়াল সে।
“আমার ক্লাস থেকে বের হয়ে যাও!” কঠোর কণ্ঠে বললেন প্রফেসর।
“আমি স্যরি স্যার!”
“বের হও!”
জয়ার নিজেরও কেন যেন আর ক্লাসে থাকতে ইচ্ছা করছিল না। তাই প্রায় ছুটেই বাইরে বেরিয়ে এল সে।
ক্যাফেটেরিয়ার দিকে এগোতে লাগল জয়া। এখন প্রায় সব ডিপার্টমেন্টেরই ক্লাস চলছে তবে তারপরেও ক্যাফেতে ঝলককে পাওয়া যাবে এটা নিশ্চিত। একটা ক্লাসও করে না ছেলেটা। সারাদিন ক্যাফেতে বসে সিগারেট খায় আর ইন্টারনেটে উদ্ভট সব ভিডিয়ো দেখে।
“এক বেলা খাওয়াও আমাকে,” ক্যাফেতে ঢোকার ডানপাশ থেকে কার যেন কণ্ঠস্বর শুনতে পেল জয়া।
সেদিকে তাকিয়ে বেশ অবাক হল সে। লুঙ্গি পরে একটা মধ্যবয়স্ক লোক বসে আছে, লোকটার চুলে জটা আর শরীরের বাকি কাপড়-চোপরও বেশ ময়লা। লোকটার গায়ের রং এককালে ফর্সা ছিল বোঝাই যায়, তবে এখন তা প্রায় কালোই হয়ে গেছে।
“ক্ষুধা লেগেছে অনেক,” আবার বলে উঠল লোকটা।
লোকটার মুখের দিকে তাকাল জয়া। আসলেই মনে হয় লোকটা অনেকদিন খায়নি।
ব্যাগ থেকে একটা একশো টাকার নোট বের করে লোকটার হাতে দিল সে।
“হা হা হা! তোমার দেখি মনটা অনেক বড়!” বেশ কুৎসিত ভাবে হাসল লোকটা।
“আপনি খেয়ে নেবেন, আমি যাচ্ছি!” এই বলে ক্যাফেতে ঢুকতে গেল জয়া।
“আমি জানি তুমি অনেক কষ্টে আছ, ঈশ্বরকে ডাকো! ঈশ্বরকে ডেকে আনার ক্ষমতা তোমার মধ্যে আছে! এই পৃথিবীতে কয়েকশো শতাব্দী পর পর এমন মানুষ জন্মে যারা ঈশ্বরকে ডেকে আনতে পারে!”
ঈশ্বরকে ডেকে আনা! এমন কথা আগে কখনওই শোনেনি জয়া। অবাক হয়ে পিছে তাকাল সে, যেখানে লোকটা বসে ছিল।
আশ্চর্য! ওখানে কেউ নেই!
৫. আহবান
“এতো সিগারেট খাস কেন তুই?” বিরক্ত হয়ে ঝলককে প্রশ্ন করল জয়া।
“তুই মন দিলি না, সেই কষ্টে সিগারেট খাই!” ক্যাফেটেরিয়ার ছাদের দিকে তাকিয়ে বলল ঝলক।
বেশ বিব্রত লাগতে লাগল জয়ার। ফার্স্ট ইয়ার থেকে ওকে পছন্দ করে ঝলক।
জয়ার নিজেরও ভালো লাগে ঝলককে। কিন্তু ঝলককে ও কী করে বোঝাবে ওর অবস্থা?
“জানি, তুই কেন আমাকে এভাবে ইগনোর করিস,” একটা নতুন সিগারেট ধরিয়ে বলল ঝলক।
“কেন?”
“তোর বাবা!”
“আমার বাবা কী?” কান খাড়া হয়ে উঠল জয়ার! তবে কি ঝলক জানে? কিন্তু এই কথা তো…
“তোর বাবার পালক মেয়ে তুই, তুই হয়তো ভাবিস এটা আমার পরিবার মেনে নেবে না।”
“না না এমন কিছু না,” স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল জয়া।
“দেখ জয়া, তোর বাবা, হক সাহেব দেশের সেরা ধনীদের একজন। তিনি যতই তোর পালকপিতা হন না কেন, তোকে বিয়ে করার জন্য কিন্তু লাইন লেগে যাবে কিছুদিন পর!”
“ধুর!”
“ক্যাম্পাসের সবচেয়ে সুন্দরী মেয়ে তুই! তোর জন্য অনেক ছেলেই পাগল। কেন তুই কাউকে পাত্তা দিস না? তোর বাবার ভয়ে, তাই না? উনি তোকে নিজের ইচ্ছামতো বিয়ে দেবেন?”
“দেখ! এই বিষয়ে আমি কথা বলতে চাচ্ছি না!”
“তোর নিজের কোনও ইচ্ছা নেই? ওই লোকের ইচ্ছাই সব?”
“ডাস্টবিনে পড়েছিলাম আমি দশ বছর বয়সে! উনি আমাকে তুলে এনেছিলেন দয়া করে! উনার ইচ্ছাই আমার ইচ্ছা!”
“তাই বলে উনার ইচ্ছার বাইরে তুই বিয়েও করতে পারবি না?”
চুপ করে বসে রইল জয়া। সে যদি ঝলককে বোঝাতে পারত!
কিন্তু ব্যাপারটা সম্ভবত পৃথিবীর কাউকেই সে বোঝাতে পারবে না!
৬. মুখোশ
বাগানে বসে চা খাচ্ছিলেন হক সাহেব। এমন সময়ে ভার্সিটি থেকে ফিরল জয়া।
হক সাহেবকে এড়িয়েই বাড়িতে ঢুকে যাচ্ছিল সে।
“জয়া,” ঠিক তখনই পেছন থেকে ডেকে উঠলেন হক সাহেব।
“হ্যাঁ?” পেছন ঘুরল জয়া।
“তোমার সঙ্গে আমার একটু কথা আছে, ঘরেই থেকো!” গম্ভীর কণ্ঠে বললেন হক সাহেব।
***
জানালার কাছে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রয়েছেন হক সাহেব। উনার পরনে কোনও কাপড় নেই।
বিছানার ওপর অর্ধনগ্ন অবস্থায় শুয়ে রয়েছে জয়া। কেমন যেন একটা ঘোরের মধ্যে চলে গেছে সে। গত কয়েকমাস ধরে হচ্ছে এই ব্যাপারটা। ওর পালক পিতা শরীরের ওপর থেকে উঠে যাওয়ার পর কেমন যেন একটা ঘোরের মধ্যে চলে যায় ও।
“জয়া, আমি বের হচ্ছি, ফিরতে রাত হবে, তুমি গোসল করে খেয়ে নিও,” এই বলে পায়জামাটা পরে বের হয়ে গেলেন হক সাহেব।
***
নিজের আসল মা-বাবার কথা কিছুই মনে পড়ে না জয়ার।
ওর শুধু একটুকুই মনে পড়ে যে একটা ডাস্টবিনে প্রচন্ড ক্ষুধার্ত অবস্থায় বসেছিল সে আর ঠিক তখনই ওর পাশে এসে দাঁড়ায় একটা দামী গাড়ি।
সেই গাড়ি থেকে ধীরে সুস্থে নেমে এসেছিলেন দেশের বিশিষ্ট শিল্পপতি আহসানুল হক সাহেব। অবাক চোখে জয়ার মুখের দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রয়েছিলেন তিনি। তারপর আর কোন কথা না বলে ওকে বাড়িতে নিয়ে এসেছিলেন।
ওকে বাড়িতে আনার পর খুব একটা সমস্যা হয়নি। হক সাহেব অকৃতদার মানুষ, উনার তেমন কোনও আত্মীয়-স্বজনও নেই। তাই ‘ডাস্টবিন থেকে একটা বাচ্চাকে কেন তুলে আনা হল?’ এই প্রশ্ন তাকে কেউ করেনি!
তখন জয়ার বয়স ছিল দশ বছর।
সুস্থ হওয়ার পর একা একাই খেলে বেড়াত জয়া। বাড়ির চাকর-বাকরেরা ওকে সঙ্গ দিত মাঝে মাঝে। কোনও কিছুরই অভাব ছিল না তার। যা চাইত সেটারই ব্যবস্থা হয়ে যেত।
তবে হক সাহেব কেন যেন একটা অদ্ভুত দূরত্ব রাখতেন ওর সঙ্গে। বাইরের কেউ আসলে অবশ্য সবার সামনে জয়াকে নিজের পালক মেয়ে হিসাবেই পরিচয় দিতেন তিনি। জয়ার নামটাও উনি রেখেছিলেন। জয়ার নিজেরও মনে ছিল না যে আগে ওকে কী বলে ডাকা হত, তাই সেও সাদরেই নামটা গ্রহণ করেছিল।
জয়া মাঝে মাঝে ভাবত, “এই লোকটা কেমন?”
জয়ার বয়স তখন বারো বছর যখন হক সাহেব ওর ঘরে প্রথম আসেন! ওই রাতের কথা জয়া কখনও ভুলবে না…
***
তারপর ব্যাপারটা চলতেই থাকে!
ষোল বছর বয়সে একদিন জয়া বুঝতে পারে যে হক সাহেব তার নাম কেন ‘জয়া’ রেখেছিলেন।
গভীর রাতে একদিন জয়াকে নিজের ঘরে ডাকেন হক সাহেব। সাধারণত উনি ডাকার পাঁচ-সাত মিনিট পরেই যায় জয়া। কিন্তু সেদিন সঙ্গে সঙ্গেই প্রায় চলে গেছিল।
হক সাহেবের ঘরের দরজাটা আধখোলাই ছিল। উনি এমনই রাখেন। চাকর-বাকরদের সাহসই নেই যে ওরা দরজার কাছে আসবে। নিজেই বের হয়ে ওদের আদেশ দেন হক সাহেব।
জয়া সোজাসুজি ঢুকে পড়েছিল ঘরে আর দেখেছিল বেশ বড় সাইজের একটা ছবি দেখে হস্তমৈথুন করছেন হক সাহেব!
জয়াকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে ছবিটা পড়ে যায় ভদ্রলোকের হাত থেকে।
এগিয়ে গিয়ে ছবিটা দেখে জয়া।
ছবিটা একজন ভদ্রমহিলার! তার সঙ্গে জয়ার চেহারার অস্বাভাবিক মিল! ভদ্রমহিলা মধ্যবয়স্ক, জয়ার বয়স যখন অমন হবে ঠিক ওকেও তখন এমন দেখাবে। ছবিটার এখানে সেখানে বীর্য লেগে রয়েছে!
ছবিটার নিচে লেখা রয়েছে
“মোসাঃ জয়া খাতুন”
“এটা আমার দাদীর ছবি, আমার জন্মের প্রায় ষোল বছর আগেই উনি মারা যান,” গম্ভীরকণ্ঠে বলেছিলেন হক সাহেব।
৭. একাকীত্ব
আয়নায় নিজের মুখ দেখছে জয়া। একদম নিখুঁত সুন্দরী সে। গায়ের রং ফর্সা, চোখদুটোতে কেমন যেন একটা ভাসাভাসা ভাব আছে, সেই সঙ্গে ওর সৌন্দর্যে একটা অন্য মাত্রা এনে দিয়েছে ওর দীঘল কালো চুল!
নিজের জগতে বড়ই একা জয়া।
গোটা দেশের মানুষ ওর পালকপিতা হক সাহেবকে চেনে দেশের সেরা ধনী এবং একজন অতি উদার মনের মানুষ হিসাবে। যিনি রাস্তা থেকে একটা মেয়েকে তুলে এনে নতুন জীবন দিয়েছেন।
মাঝেই মাঝেই এই নিয়ে টকশোগুলোতে ডাকা হয় উনাকে। কিন্তু হক সাহেব সেগুলো এড়িয়ে যান।
লোকটার এই ব্যাপারটা খুব ভালো লাগে জয়ার। উনি কখনওই এমন কিছু বলেন না যেটা উনি নন। তাই সম্ভবত টকশোতে নিজের তথাকথিত ‘মহত্ত্ব’ জাহির করতে যেতে চান না।
অনেকবার কিছু টিভি চ্যানেল থেকে জয়াকেও ফোন করা হয়েছিল। কিন্তু জয়াও সেসব এড়িয়ে গেছে।
একা থাকতেই ভালো লাগে ওর।
সেজন্যই ভার্সিটির সেরা সুন্দরী মেয়েটা হবার পরেও তার বন্ধুবৃত্ত খুবই ছোট। হাতে গোনা কয়েকটা ছেলে-মেয়ের সঙ্গে ওর নিয়মিত কথা হয়।
ঝলক ছাড়া আর কোন ছেলের সঙ্গেই তেমন কথা হয় না বলতে গেলে। তারপরেও ফেসবুকে বা ফোনে ঝলকের কথারও ঠিকঠাক জবাব দেয় না ও মাঝে মাঝে।
ধর্মীয় ব্যাপারে খুবই সন্দিহান একটা পর্যায়ে আছে জয়া। হক সাহেব ওর শিক্ষা নিয়ে কখনোই তেমন মাথা ঘামাননি। তিনি নিজেও খুব একটা ধার্মিক মানুষ নন।
ধর্ম বা ঈশ্বর নিয়ে সেজন্য খুব একটা মাথা ঘামায়নি জয়া। ঈশ্বরকে কখনও মন থেকে ডাকেওনি।
ঝলক ছেলেটা নানান ব্যাপারে জ্ঞান রাখে। ওর কাছে পৃথিবীর অন্তত দশটা অদ্ভুত ধর্ম সম্পর্কে জানতে পেরেছে জয়া।
তবে ঝলক ছেলেটাও খুব একটা ধার্মিক নয়।
একটা কথা প্রচলিত আছে, “ধর্ম নিয়ে আপনি যদি অনেক বেশি জানেন তবে হয় আপনি খুব বেশি ধার্মিক হবেন অথবা হবেন নাস্তিক!”
এই দুটোর কোনওটাই নয় ছেলেটা। সে যে কী সেটা সম্ভবত সে নিজেও জানে না।
জয়ার মনে অবস্থাও অনেকটা ঝলকেরই মতো কিন্তু ঝলকের মতো নানান ধর্ম সম্পর্কে অত জ্ঞান তার নেই।
***
আড়চোখে লোকটাকে দেখে ক্যাফেটেরিয়ার বাইরে চলে যাচ্ছিল জয়া।
“এই শোন,” পেছন থেকে ডাকল লোকটা।
“বলুন,” বেশ কড়া কণ্ঠে বলল জয়া।
“আজ রাতের বেলা ছাদে উঠে আকাশের দিকে তাকিয়ে ঈশ্বরকে ডাকবে! উনি আসবেন!”
“মানে?”
“মানে আর কিছু না। তোমার সঙ্গে আমার আজকের পর আর দেখা হবে না।”
“ঈশ্বর আসেন কি? উনার পক্ষে কি আসা সম্ভব?”
“সম্ভব! তবে সবার ডাকে উনি আসেন না! সবার সে ক্ষমতা নেই! তোমার মধ্যে আছে!”
“আপনিও তো ধর্মীয় পন্ডিতদের মতোই কথা বলছেন!”
“ধর্মগুলো ঈশ্বরকে ব্যাখ্যা করতে পারে না! উনি অমন নন! যেমনটা ওরা ভাবে!”
“আপনি কে?”
“আমি কে? আমি এই পৃথিবীর বুকে ঈশ্বরের বার্তাবাহক! এই বার্তা শুধু বিশেষ মানুষদের জন্য! যারা এটাকে নেওয়ার ক্ষমতা রাখে। সাধারণ মানুষেরা এই সত্য জানার পরেই মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলবে!”
পিছন ফিরে হাঁটতে শুরু করল জয়া।
“আজই তোমার দুঃখের অবসান ঘটাবেন ঈশ্বর!” পিছন থেকে বলে উঠল লোকটি।
ঘুরে তাকাল জয়া।
কেউ নেই ওখানে! কয়েক মুহূর্ত আগেও তো লোকটা ওখানে ছিল!
৮. কৃপা
স্বপ্ন দেখেই চলেছেন তিনি। তাঁর স্বপ্নগুলোও তাঁর মতোই উদাস। সেগুলোর নেই কোনও শুরু বা শেষ। অন্তহীন এক শূন্যতার সাগরে ভেসে চলেছে তাঁর স্বপ্নগুলো।
তিনি অনেক নিঃসঙ্গ!
কিন্তু একী!
হুট করেই কেঁপে উঠলেন তিনি!
স্বপ্ন দেখার সময়ে বাস্তবতার আঘাত পেলে আমরা যেমন কেঁপে উঠি, ঠিক সেইভাবে!
কেউ তাঁকে ডাকতে যাচ্ছে! শত-সহস্র বছর পর তাঁর কোন বিশেষ সৃষ্টি তাঁকে ডাকতে যাচ্ছে!
নিজের স্বপ্নের সব সৃষ্টির প্রতিই দারুনভাবে উদাসীন তিনি, এই বিশেষ সৃষ্টিগুলোও তাঁর মনের অজান্তেই হয়ে গেছে!
স্বপ্নের মধ্যে কী হয় না হয়, তার কি কোন ঠিক আছে?
হাজার বছর পর নিজের স্বপ্নের মধ্যে প্রবেশ করতে হবে তাঁকে! দেখা দিতে হবে স্বরূপে।
নিদ্রা, উদাসীনতা আর শূন্যতার সাগরে হাবুডুবু খেতে খেতে হাফিয়ে উঠেছেন তিনি! এবার হয়তো সেটা কিছুটা হলেও কেটে যাবে।
৯. যুক্তি
“দেশে এতোই ধর্ষণ হচ্ছে আজকাল! আর আজব ব্যাপার হল এই জানোয়ারের বাচ্চাগুলোকে ডিফেন্ড করারও মানুষ আছে!” ঝটকা মেরে খবরের কাগজটা ফেলে দিল ঝলক।
কিছু বলল না জয়া। আজকেও ক্লাসে যায়নি সে।
সকাল থেকেই চুপচাপ ক্যাফেতে ঝলকের সামনের বসে আছে।
“তোর কি কোনও কারণে মন খারাপ?” জিজ্ঞাসা করল ঝলক।
“আচ্ছা বাইরে যে লোকটা বসে থাকে, মানে ক্যাফের সিঁড়িতে, উনি কবে থেকে এখানে বসছেন?” একটু বিব্রত হয়ে প্রশ্নটা করল জয়া।
“ওহ, ওই লোক? ওকে গত একমাস ধরে দেখা যাচ্ছে। কারও সঙ্গে কোন কথা বলে না, কেউ কথা বললে উত্তরও দেয় না।”
“আমার সঙ্গে তো কথা বলেছেন!”
“তাই? আজব!”
“হুম, একশো টাকাও দিয়েছি আমি উনাকে, লোকটা সম্ভবত অনেকদিন না খেয়ে ছিল!”
“এর আগেও জানিস উনাকে অনেকেই টাকা দিতে গেছে! কিন্তু উনি টাকা নেননি! তোর টাকা নিলেন কেন? উনি তোকে আর কিছু বলেছেন?”
“হুম… বলেছেন ঈশ্বরকে ডাকতে! আমার ডাকে নাকি ঈশ্বর আসবেন!”
“হাহাহাহাহা.. ঈশ্বর বলে কিছু আছে কি? এই যে ধর্ষণগুলো হচ্ছে, ধর্ষিতা মেয়েগুলো কি ধর্ষিত হতে হতে ঈশ্বরকে ডাকছে না? ওদের ডাক শুনে উনি আসেন না কেন?”
“লোকটা অদ্ভুত একটা কথা বলেছে!”
“কী?”
“উনি বলেছেন সবার মধ্যে ঈশ্বরকে ডেকে আনার ক্ষমতা নেই! আমার মধ্যে নাকি আছে!”
“হাহা… যে ঈশ্বর ধর্ষিতার চিৎকার শুনে চুপচাপ বসে থাকেন, যদি তিনি থেকে থাকেন আরকি, তবে তাকে ঈশ্বর বলে না! বলে পিশাচ!”
“তুই ঈশ্বরে বিশ্বাস করিস না, তাই না?”
“হুম.. তুই ‘অমনি পটেন্ট প্যারাডক্সে’র ব্যাপারে শুনেছিস?”
“নাহ।”
“আচ্ছা এই প্যারাডক্সটা এমন.. ‘ঈশ্বর মানেই তো সর্বশক্তিমান এক সত্তা, তাই না? তো এই সর্বশক্তিমান সত্তা কি এমন একটা পাথর সৃষ্টি করতে পারবেন যা তিনি নিজেই তুলতে পারবেন না?’ প্যারাডক্সটা বুঝতে পেরেছিস?”
“হ্যাঁ, যদি তিনি এমন পাথর সৃষ্টি করতে নাই পারেন তবে তিনি কেমন সর্বশক্তিমান? আর যদি সৃষ্টি করে তুলতে না পারেন তবেও তিনি কেমন সর্বশক্তিমান!”
“হ্যাঁ.. কিন্তু একটা জিনিস ভুলে যাচ্ছিস!”
“কী?”
“একজন সর্বশক্তিমান সত্তার তো নিজের শক্তিকে কমানো এবং বাড়ানোরও ক্ষমতা থাকা উচিত, তাই না?”
“হ্যাঁ!”
“তো ঈশ্বর এমন একটা পাথর সৃষ্টি করলেন যা উনি নিজেই তুলতে পারবেন না, তারপর তিনি নিজের শক্তিকে বৃদ্ধি করে ফেললেন এবং এমন এক পর্যায়ে চলে গেলেন তাতে করে তিনি পাথরটা তুলতে পারবেন! আজব না?”
“আরে তাই তো!”
“আমার মনে হয় ঈশ্বর আমাদের পরোয়া করেন না!”
“কেমন?”
“আমরা সম্ভবত তার ইচ্ছাকৃত সৃষ্টিই নই। শুধুই একটা দুর্ঘটনা!”
“মানে?”
“ঈশ্বরকে ধর্মগুলো কী করে ব্যাখ্যা করে? এক অতিশয় দয়ালু সত্তা, তাই না?”
“হুম।”
“কিন্তু তিনি যদি তেমন না হন? তিনি যদি এক দয়া-মায়াহীন মহাজাগতিক সত্তা হন, তবে?”
“কী বলছিস?”
“ভাব ব্যাপারটা, ভেবে দেখ!”
***
জয়া যখন বের হল তখন আবার সেই লোকটাকে সে ক্যাফেটেরিয়ার সামনে দেখতে পেল।
আড়চোখে লোকটাকে দেখতে দেখতে ক্যাফেটেরিয়ার বারান্দা দিয়ে হেঁটে বাইরে আসছিল জয়া।
“শোন মেয়ে! আজ রাতে ঈশ্বরকে ডেক!” পিছন থেকে বলে উঠল লোকটা।
“মানে?” অবাক হয়ে ঘুরে তাকাল জয়া।
“আজ তোমাকে মুক্তি দেবেন ঈশ্বর!”
“বুঝলাম না!”
“আজ রাতের বেলা ছাদে উঠে ঈশ্বরকে ডাকবে, উনি আসবেন! তোমার মধ্যেই ক্ষমতা আছে উনাকে ডেকে আনার।”
পিছন ঘুরে হাঁটতে শুরু করল জয়া। লোকটার ফালতু কথা শুনতে একদমই ইচ্ছা করছে না তার।
“তোমার সঙ্গে আমার কোনওদিনই আর দেখা হবে না, আমি নিজের দায়িত্ব পালন করেছি। ভালো থেকো মেয়ে!” পিছন থেকে বলে উঠল লোকটা।
ঘুরে তাকাল জয়া। ওখানে কেউ নেই! কয়েক মুহূর্ত আগেও না লোকটা ওখানেই ছিল!
১০. ঈশ্বর
ছাদের ওপর একা দাঁড়িয়ে আছে জয়া। আকাশ দেখতে তার কেন যেন অদ্ভুত লাগছে। ওই অদ্ভুত লোকটার কথা মনে পড়ছে হুট করে।
লোকটা অমন করে উধাও হয়ে যায় কী করে? সে কি তবে মানুষ না?
বেশিক্ষণ ভাবার সময় পেল না জয়া। তার আগেই পিছন থেকে হক সাহেবের কণ্ঠ শুনতে পেল সে।
“জয়া, এদিকে এস,” বললেন তিনি।
উনার দিকে তাকাল জয়া। ছাদের ওপর বিশেষ ধরনের একটা বিছানা রাখা থাকে সবসময়। বাড়ির কাজের লোকেরা জানে যে বিশেষ বিশেষ দিনে ছাদের বসে আকাশ দেখেন হক সাহেব, তাই এই ব্যবস্থা।
শুধু জয়া জানে এই বিছানার আসল কাজ কী!
জামা-কাপড় খুলে ফেলে শুয়ে পড়ল জয়া।
কিছুক্ষণের মধ্যেই ওর শরীরের ওপর চেপে বসলেন হক সাহেব।
লোকটার শরীরের স্পর্শ পেতেই সবকিছু কেমন যেন ঘিনঘিনে লাগতে লাগল জয়ার আর সেই অনুভূতি থেকেই সে যেন মনে মনে বলে উঠল “হে ঈশ্বর, রক্ষা করুন আমাকে!”
হঠাৎ করে গোটা আকাশ জুড়ে যেন বিদ্যু চমকে উঠল! অদ্ভুত একটা শব্দে ছেয়ে গেল চারদিক। তারপরেই আকাশের বুকে উদয় হলেন উনি!
ভীত চোখে ওটাকে দেখছে জয়া! কালো রঙের একটা অবয়ব। গোটা আকাশ জুড়েই রয়েছে সেই অদ্ভুত সত্তা! তাঁর কোন শুরু বা শেষ নেই! গোটা শরীর জুড়ে অজস্ত্র চোখ সেই বিশাল প্রাণীটার!
তবে কি এটাই ঈশ্বর?
অদ্ভুত সেই শব্দটা শুনতে আকাশের দিকে ঘুরলেন হক সাহেব!
তারপর আর্তনাদ করার সময়টুকুও পেলেন না তিনি।
মুহূর্তের মধ্যেই উনার গোটা শরীর পরিণত হল একটা ছোট্ট মাংসপিন্ডে! তারপর হাওয়ায় মিলিয়ে গেল সেই মাংসপিন্ড!
ঈশ্বরকে দেখার ক্ষমতা সবার থাকে না। আর যাদের থাকে না তারা যদি তাঁকে দেখে ফেলে তবে এই অবস্থাই হয়!
আকাশের দিকে তাকাল জয়া!
অন্ধকার একটা আকাশ! ওখানে আর কেউ নেই! ঈশ্বর চলে গেছেন!
১১. সমাপ্তি
জরুরী মিটিং চলছে ‘হক গ্রুপ অফ ইন্ডাস্ট্রিজ’র বোর্ড অফ ডিরেক্টরসদের। দেশের সবচেয়ে বড় কোম্পানি তারা। তাই মিটিংগুলোও অনেক বেশি দীর্ঘ হয়।
পুরো মিটিংই প্রায় চুপচাপ আছে চেয়ারম্যান জয়া ফারজানা হক। আজ থেকে ঠিক পাঁচ বছর আগে চেয়ারম্যান হিসাবে এই কোম্পানিতে জয়েন করেছে সে।
দশ বছর আগে হক সাহেব নিরুদ্দেশ হওয়ার পর তার উত্তরাধীকারি হিসাবে তার পালককন্যা জয়ারই চেয়ারম্যান হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তখন জয়ার লেখাপড়া শেষ না হওয়ার কারণে পাঁচ বছর এমডি মনসুর সাহেবই চেয়ারম্যানের দায়িত্ব সামলেছেন।
এখানকার পড়াশোনা শেষ করে বিদেশ থেকে ডিগ্রী নিয়ে পাঁচ বছর আগে ফেরে জয়া তারপর নেয় এই কোম্পানির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব।
***
মিটিং শেষে চুপচাপ নিজের গাড়িতে চড়ে বসল জয়া। গাড়ি নিজেই চালাতে ভালোবাসে সে, কোনও ড্রাইভার সে রাখেনি।
সেই রাতে হক সাহেব নিরুদ্দেশ হওয়ার পর শুরুর দিকে তাকেই সন্দেহ করেছিল পুলিশ, কারণ বাড়ির চাকরেরা সবাই বলেছিল যে ওইদিন হক সাহেবকে বাড়ি থেকে বাইরে বের হতে তারা কেউই দেখেনি।
কিন্তু কোনও প্রকার ফিঙ্গারপ্রিন্ট বা ডিএনএ স্যাম্পল না পাওয়ার কারণে জয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগ ধোপে টেকেনি।
হক সাহেবের বিরাট বড় সম্পত্তির মালিক হয়ে যায় জয়া।
এরপরে আর কখনওই কেন জানি ঝলক ওর সামনে আসেনি। হয়তো ছেলেটা ভেবেছে যে এত ধনী একটা মেয়ে ওকে কেন বিয়ে করবে?
অবশ্য ঝলক আসলেও জয়া তাকে বিয়ে করত না।
সেদিন সেই অদ্ভুত লোকটা জয়াকে একটা কথা বলেনি। ব্যাপারটা হল, ঈশ্বরকে দেখার ক্ষমতা নিয়ে জন্মা নেওয়া কেউ যদি ঈশ্বরকে ডেকে আনে তার বিনিময়ে ঈশ্বর ওই মানুষটার প্রজনন ক্ষমতা কেড়ে নেন!
জয়া আর কোনদিন সন্তানের মা হতে পারবে না। সেজন্য বিয়েও করেনি সে।
যদিও আজকাল ওকে বিয়ে করার জন্য অনেকেই পাগল। কেউ ওর রূপের পাগল আর কেউ পাগল ওর সম্পত্তির জন্য! জয়া সন্তানের মা হতে পারবে না এটা শোনার পরেও সম্ভবত এদের মধ্যে বেশির ভাগই ওকে বিয়ে করতে চাইবে।
কিন্তু যে হৃদয় জয়া ঝলককে উৎসর্গ করেছিল সেটা আর কাউকে দিতে চায়নি সে। তাই একাই থেকে গেছে।
গাড়ির জানালা দিয়ে আকাশ দেখছে জয়া! ওই আকাশেই আবির্ভূত হয়েছিলেন ঈশ্বর!
ঘুমের মেয়াদ কমে গেছে উনার! খুব শীঘ্রই জেগে উঠবেন উনি!
Tags: ইসলামিক ম্যাজিক রিয়ালিসম, কল্পবিজ্ঞান গল্প, গল্প, চতুর্থ বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা, পূজাবার্ষিকী, লুৎফুল কায়সার, সুপ্রিয় দাস
চমৎকার গল্প। আনকমন কনসেপ্ট। সাবলীলভাবে গল্প এগিয়ে গেছে, একটানে পড়ে ফেলার মত। তবে ব্যক্তিগত অভিমত, ফিনিশিংটা মন মতো হয়নি। লেখকের জন্যে শুভকামনা রইল।
বেশ অন্যরকম লেখা আর সেই কারণেই গল্পটা উতরে গেছে। চিন্তা ভাবনায় যে একটা অপার নতুনত্ব আছে, সেটাই গড়গড়িয়ে এগিয়ে নিয়ে গেছে লেখাটিকে। তবে লেখককে অনুরোধ, এই থিমটাকে আরও একটু বিস্তৃত করে লিখলে, আরো চমৎকার একটি বড় গল্প হতে পারে।