আইসবার্গ
লেখক: এণাক্ষী চট্টোপাধ্যায়
শিল্পী: মূল প্রচ্ছদ
‘সেই ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল জানিস?’ সাইকেলের স্পিড একটু না কমিয়ে কথা গুলো আমাদের দিকে ছুঁড়ে দিয়ে গেল বুবলাই।
আমরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই সে হাওয়া। লম্বা চক্কর কাটতে পাড়ি দিয়েছে পার্কের ওই প্রান্তে। ঠিক জানি আবার এই পথেই ফিরে আসবে তাই অপেক্ষা করতে লাগলাম সবাই – মানে আমি, অপু আর টোটোন।
কয়েক মিনিটের মধ্যেই আবার তার আগমন। প্যাডেল ঘুরছে বাঁই বাঁই, স্পিড আগের চেয়েও রুদ্ধশ্বাস। আমরা কিছু বলছি না দেখে আর একবার হাঁক ছাড়ল- ‘সেই ভদ্রলোক, বুঝলি কিছু?’
বুঝেছি আমরা ঠিকই কিন্তু না বোঝার ভান করে অন্যদিকে তাকিয়ে রইলাম যেন ওর কথা কানেই ঢোকেনি। জানি বাছাধনকে এখানেই ফিরে আসতে হবে। কোন ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা হল, তিনি কী বললেন এবং তারপরে কী হল বলার জন্য ওর পেট যে ফেটে যাচ্ছে তা আমরা বুঝতে পারিনি?
‘কার কথা বলছে কিছু ধরতে পারলি?’ খুব উদাস মুখ করে নিচু গলায় জিজ্ঞেস করল অপু।
‘আরে ভদ্রলোক তো একজনই’ বলেই আমি চট করে নিজেকে সামলে নিলাম – ‘মানে ভদ্রলোক তো অনেক, তবে সেই ভদ্রলোক বলতে একজনকেই বোঝায়’।
‘মানে সেই রোগা-পটকা, নাক লম্বা’, টোটোনের গলায় কৌতুহল।
‘যিনি ঘনাদার মতো কথা বলা পছন্দ করেন?’ জুড়ে দিল অপু।
‘আর নিজেকে বলেন ঘনাদার পিসতুতো ভাই, মাসতুতো নয় কিন্তু’। বললাম আমি।
ততক্ষনে আর এক চক্কর শেষ করে সিনে উদয় হয়েছেন শ্রীমান বুবলাই। আমাদের এরকম নিরাসক্ত ভাব দেখে আর থাকতে না পেরে শেষে নেমেই পড়ল সাইকেল থেকে।
‘আরে আরে, এ কি করলি! আমরা তো ভাবছিলাম তুই নন-স্টপ সাইকেল চালানোর বিশ্ব রেকর্ড স্থাপন করতে চলেছিস!’
‘বাজে কথা ছাড়। বললাম তো সেই ভদ্রলোকের সঙ্গে হঠাৎ দেখা’।
‘অনেক বার বলেছিস। আমরা কি কালা? তারপরে কি হল বল’।
‘বলছি, বলছি। স্টেট ব্যাঙ্কের গলি থেকে বেরোতে দেখলাম। এদিক ওদিক তাকাচ্ছেন, আমি বললাম, আপনি এখানে? উনি বললেন, একজনকে খুঁজছি। আমি বললাম, সে কে? তার নাম কি? উনি একটু আমতা আমতা করে বললেন, রতন। আমি আবার জিগেস করলাম কোন রতন? আমাদের এদিকে রতন তো অনেকগুলো – কালা রতন, ধলা রতন, ঢ্যাঙা রতন, গ্যাঁড়া রতন আপনি এর মধ্যে কাকে চাইছেন?
‘উনি শুনে খুব চিন্তায় পড়ে গেলেন। মাথা চুলকে বললেন, কালা, ধলা, ঢ্যাঙা, গ্যাঁড়া এরকমভাবে তো ভেবে দেখিনি। ফর্সা মতোন বলা চলে, বেশ গাঁটাগোঁট্টা- বলে অন্যমনস্কভাবে চুপ করে গেলেন’।
‘টোটোন চটে চটে উঠে বলল, ‘বুবলাই তুই বড্ড বেশি নাটক করছিস’।
‘নাটক করছি?’ আরও চটে জবাব দিল বুবলাই। ‘বিশ্বাস হচ্ছে না আমার কথা?’
‘না হচ্ছে না’। আমরা বলে উঠলাম সমস্বরে।
‘তাহলে ওই দ্যাখ’- সগর্বে ডানহাতটা তুলে কি যেন দেখাতে চাইল বুবলাই।
আরে এ কি কান্ড! ওই তো সেই নাক উঁচু সিড়িঙ্গে পানা ভদ্রলোক যিনি ম্যাজিক করে মাঝে মাঝেই উদয় হন আবার ম্যাজিক করে মিলিয়েও যান। উনি কিন্তু হনহন করে আমাদের দিকেই আসছেন। চেহারার মধ্যে কেমন যেন দিশেহারা ভাব।
উনি যখন আমাদের বেশ কাছে চলে এসেছেন তখন কথা নেই বার্তা নেই অপুটা দুম করে বলে বসল, ‘এই আইসক্রিম খাবি? দ্যাখ না আইসক্রিমওয়ালা যাচ্ছে’।
ঠিকই। তবে মনোযোগ কেড়ে নিয়েছিলেন ঘনাদার পিসতুতো ভাই। তাই আমরা অপুকে খুব একটা পাত্তা না দিয়ে নিবিষ্ট মনে দেখতে লাগলাম ভদ্রলোকের গতিবিধি।
আরও কাছে এলেন ঘনাদার পিসতুতো ভাই বলে যিনি নিজের পরিচয় দেন তিনি। কপাল থেকে দরদর করে ঘাম ঝরছে। পকেট থেকে রুমাল বার করে মুখ মুছলেন, তারপর ফিরলেন আমাদের দিকে।
‘এই যে তোমরা- কেমন আছো বোঁচকা, ঘোঁতন- আরও কি যেন সব নাম তোমাদের?
আমি গম্ভীর মুখে বললাম- ‘এখানে বোঁচকা বলে কেউ নেই, ঘোঁতনও নেই- তবে টোটোন আছে।’
‘সরি, সরি- মনেও থাকে না ছাই, এত রকম জায়গায় ঘুরে বেড়াতে হয় আর এত রকম লোকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে হয় যে সব নাম মনে রাখা অসম্ভব। যাই হোক কে-টোটোন? কার নাম যেন টোটোন?’
টোটোন একটু চালের সঙ্গে এক পা এগিয়ে এল, ‘এই যে আমি, কিছু বললেন আমাকে?’
‘তোমাকে? হ্যাঁ তোমাকে, তোমাদের সবাইকেই বলতে পারো’।
‘বলে ফেলুন, স্বচ্ছন্দে। আমার বন্ধুরা কেউ কিছু মনে করবে না’।
‘বাঁচালে’। ঘনাদার ভাই আর একবার রুমালে মুখ মুছে-বেঞ্চিটায় আরাম করে বসলেন। ‘আইসবার্গ শুনেই বুকটা ধড়ফড় করছিল কিনা তাই একটু বসে পড়তে বাধ্য হলাম’।
বুবলাই আর একবার তার সাইকেল সওয়ার হবার তালে ছিল। বলল, ‘আইসবার্গ, কোথায় শুনলেন? ও তো আইসক্রিমওয়ালা।
আমাদের মনে একটা ক্ষীণ আশা চিড়িক করে দেখা দিয়েই অদৃশ্য হল। সেই সেবার বিষ্টির বিকেলে উনি আমাদের কচুরি খাইয়েছিলেন। এবারে হয়তো আইসক্রিম খাওয়ালেও খাওয়াতে পারেন। বুবলাইয়ের আর সিটে বসা হল না। কাছে এসে হ্যাংলার মতো বলে বসল – ‘ডাকব নাকি আইসক্রিমওয়ালাকে?
আর্তনাদ করে উঠলেন ভদ্রলোক। ‘না, না, না। আইস শুনলেই আমার বুকের মধ্যে কাঁপুনি শুরু হয়। উহ, সে কি ভয়াবহ দৃশ্য’।
চোখের সামনে একটা ভোজ ফস্কে যায় দেখে আমি আশ্বাস দিয়ে বললাম, ‘ও কিছু না। ভালো করে দেখুন।
‘ওখানে আইসবার্গ, টাইসবার্গ কিছু নেই- স্রেফ আইসক্রিম’।
বুবলাই ফোড়ন কাটল- ‘মানে যাকে বলে কুলফি বরফ’।
চিঁড়ে ভিজল না। ভদ্রলোক আর একবার ঘাম মুছলেন। কি ভয়ংকর।
আইসবার্গ শুনলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে- ‘টাইটানিক ডোবার দৃশ্য?’ হাত চাটতে চাটতে বলল অপু। আইসক্রিমের আশা দুরাশা দেখে সে অগত্যা প্যান্টের পকেট থেকে বহু পুরোনো একটা চুইংগাম বার করে দেখে সেটা কাদা হয়ে গেছে।
‘টাইটানিক? সে তো ছোটখাট ব্যাপার, আমি যা দেখেছি তা হল বিশ্বজোড়া বিপর্যয়। তখনই বলেছিলাম মোহনটাকে-’
‘কাকে?’
‘মোহন, মোহন মানে লোকে যাকে বলে মনমোহন। বলেছিলাম কি লাভ জি-এইট সন্মেলনে গিয়ে? হবে কোনও কাজের কাজ? নাকি হল? ও সব বড়লোক দেশের ব্যাপার। তাদের নীতি হল নিজের বেলায় আঁটিসাঁটি পরের বেলায় দাঁত কপাটি। নিজেদের স্ট্যান্ডার্ড তো তাই বলে নামানো যাবে না। তার জন্যে হোক পরিবেশ দূষণ, আমরা পেট্রোল পোড়াব যত ইচ্ছে। গ্রীনহাউস এফেক্ট হচ্ছে বলে কি আমরা ইলেকট্রিকের সুইচ নিভিয়ে অন্ধকার যুগে ফিরে যাব? নেহাত চক্ষুলজ্জার খাতিরে বড়লোক নয় এমন চারটি দেশকে নেমন্তন্ন করা হয়েছিল। তাদের গানটান শুনিয়ে ভালোমন্দ খাইয়ে, মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হল’।
‘মনমোহন এসব দেখেশুনেও চুপ করে রইলেন?’ সত্যি অপুটা এমন ঠোঁটকাটা!
‘কি বলবে? তাদের তো দিব্যি করে মগজ ধোলাই হয়ে গেছে। তাদের গায়ে তাপ্পি সেঁটে দেওয়া হয়েছে উন্নয়ণশীল। শুনেই তারা আহ্লাদে আটখানা। অনুন্নত বলেনি তো? তাহলেই হল। উন্নয়নশীল যখন, এখন কোনও না কোনও দিন, অদূর ভবিষ্যতে না হোক সদূর ভবিষ্যতে আমরাও বসতে পারব বড়লোকদের আড্ডায়- জি-এইট সামিট।
‘একটু ভুল হয়ে গেল’। গম্ভীর মুখে বললাম আমি। আইসক্রিমের দুঃখটা মনের মধ্যে খচখচ করছিল।‘তখন জি-এইট আর জি-এইট থাকবে না- জি-নাইন হয়ে যাবে।’
‘টেনও হয়ে যেতে পারে’ ফোড়ন কাওটল অপু।
‘না, উপায় আছে’– বুবলাই বা পিছিয়ে থাকে কেন।
‘একজনকে ধাক্কা মেরে বার করে দেওয়া যায়। জায়গা চাই তো। সবাই যদি ধাক্কা মেরে জি-এইটে ঢুকতে চায় তাহলে তো কুরুক্ষেত্র বেধে যাবে’।
ঘনাদার পিসতুতো ভাই এবার নড়েচড়ে বসলেও। এক গাল হেসে বললেন, ‘সেই কথাই তো বলছিলাম চিদামকে- মানে আমাদের চিদুকে।’
‘চিদাম?’
‘আরে ওই নামেই তো ডেকে এসেছি বরাবর। তবে হ্যাঁ লম্বা চওড়া ভালো নাম আছে বৈকি একটা- যেমন সবার থাকে। সেটা হল চিদাম্বরম’।
আমরা সবাই ভ্যাবলার মতো, এ-ওর মুখের দিকে তাকালাম।
‘বলছিলাম খুব তো কেষ্টবিষ্টু হয়ে দেশ উদ্ধার করছ। অর্থনীতি গুলে খেয়েছ শুনতে পাই। দেশ সুদ্ধ লোকের গলায় ঝুলবে মোবাইল কানে, গোঁজা থাকবে আইপড, হাতে থাকবে স্টিয়ারিং।’ আরে ছোঃ ছোঃ একে বলে উন্নতি? এ তো দূষণের চূড়ান্ত- শব্দ দূষণ, ব্রেন দূষণ, পরিবেশ দূষণ। বাকিটা আর কি থাকল তবে?’
‘আপনি কি অর্থমন্ত্রীর কথা বলছেন? অপু আর না জিজ্ঞেস করে পারল না’।
‘আরে হ্যাঁ, বাবা হ্যাঁ। কেউ-কেটা হয়েছে এখন। আমি তো দুগ্ধপোষ্য বয়স থেকে চিনি ওকে – এখন অবশ্য বলা যাবে না দুগ্ধপোষ্য, বলতে হবে কফিপোষ্য’। এই বলে নিজের রসিকতায় নিজেই হো হো করে হেসে উঠলেন ভদ্রলোক।
আমরা চারজনের কেউই কিন্তু হাসলাম না।
অপুটা নাছোড়বান্দা। বলে বস- ‘তা আপনার কথার উত্তরে কি জবাব দিলেন অর্থমন্ত্রী, মানে আপনার চিদাম?’
‘চিদামের এখন সময় কোথায় আমার মতো ছেঁদো লোকের সঙ্গে কথা বলার? এই পকেটে মোবাইল বাজছে প্যাঁ, ওই পকেটে মোবাইল বাজছে পোঁ। এদিকে একজন বলছে সার, ওদিকে একজন বলছে হুজুর। চামচাগুলো মিলে একবারে ছিনিমিনি খেলছে’।
‘তার মানে আপনার সঙ্গে ওঁর আর কথাই হল না?’
নিরাশ মুখে বললেন ভদ্রলোক– ‘হল আর কই। তাই দুঃখের কথা তোমাদের কাছে বলেই মনটা হালকা করি। যদি তোমাদের সঙ্গে কোনদিন চিদামের দেখা হয়ে যায়- বলা তো যায় না-তোমরাও একদিন কেউকেটা হয়ে উঠতে পারো-’
‘তাহলে আমরা কি বলব?’
‘বোলো যে গ্রীন পিসের ছোকরাগুলো এসে ওই কথাই বলে গেছে। সুন্দরবন ঘুরে এসে ওরা বলেছে সুন্দরী গাছ কেটে ফেলার ফলে ওখানকার আবহাওয়া গরম হয়ে উঠেছে। ইতিমধ্যে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে কিছু কিছু দ্বীপ জলের তলায় তলিয়ে গেছে। ওখানে যেন কোনমতেই প্রাকৃতিক ভারসাম্য বিনষ্ট হতে না দেওয়া হয়।’
‘একটা কথা মেসোমশাই, যদি কিছু মনে না করেন’- বলে উঠল টোটোন।
‘না, না, আমি কিছু মনে করব না সে তুমি মেসোই বল আর পিসেই বল। শুধু ওই আজকালকার ছেলেপুলে যা বলে- আংক্ল কেমন শিরশির করে’।
‘আমি সে কথা বলছিলাম না,’ বাধা দিয়ে বলল টোটোন’। ‘আসলে আমি একটা কথা জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিলাম- ভাবছি তাতে যদি আপনি কিছু না মনে করেন।’
‘ও তাই বল। আরে বলে ফেল, বলে ফেল। মনে যদি প্রশ্নেরা ভিড় করে তাহলে বলে ফেললেই হালকা হওয়া যায়। একটা কেন একশোটা প্রশ্ন করলেও আমি কিছু মাত্র রাগ করব না’।
‘আপনি বললেন প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট না হতে দেওয়ার কথা, তাহলে কল-কারখানা কি আর হবে না। শুনি যে উন্নতির জন্যে কল-কারখানা ছাড়া গতি নেই। গাছ তো তাহলে কাটতেই হবে, কারখানা থেকে দূষিত গ্যাস বাতাসে মিশবে, বর্জ্য পদার্থ মাটি আর জলে ঢুকে যাবে- মানে সব দিক দিয়ে, পরিবেশ নষ্ট, প্রকৃতির ভারসাম্যে গোলমাল-
পিঠ চাপড়াবার ভঙ্গীতে টোটোনের দিকে তাকালেন ঘনাদার পিসতুতো ভাই। ‘বেড়ে বলেছ ভাই। তুমি আমাকে মেসোই বল আর পিসেই বল, আমি কিন্তু তোমাকে ভাই বললাম, আশা করি তুমি তাতে কিছু মনে করলে না?’
ভালো ছেলের মতোন ঘাড় নাড়ল টোটোন। আমরা সবাই উৎসাহিত হয়ে উঠলাম, তাহলে শেষ অবধি আইসক্রিমটা কপালে নাচছে বলেই মনে হচ্ছে। ভদ্রলোকের মেজাজটা যেন বেশ খুশি খুশি।
‘দাও ফিরে সে অরন্য, লও এ নগর। কে বলেছিলেন?’ উত্তরের অপেক্ষা না করে উনি নিজেই বলে গেলেন – হ্যাঁ, রবীন্দ্রনাথ। কবি বলেছিলেন আমাদের হল অরন্যভিত্তিক সভ্যতা আর ওদের হল নগরভিত্তিক। লাখ কথা এক কথা। কিন্তু দুঃখের বিষয় তাঁর কথা আজ কে শুনছে।আমরা পড়ি কি মরি করে ছুটছি ওই তথাকথিত উন্নত দেশগুলোকে নকল করতে। তাই গলায় মোবাইল, কানে আইপড, আঙুলে কি বোর্ড, কিছুদিনের মধ্যেই হাতে হাতে স্টিয়ারিং। এদিকে কিয়োটো প্রটোকলের কি ঠিক হল ভুলে মেরে দিল সবাই এরই মধ্যে?’
কিয়োটো প্রটোকলটা কি জিনিস? আমতা আমতা করে জিজ্ঞেস করল বুবলাই।
ভদ্রলোক উৎসাহিত হয়ে উঠলেন, ‘আরে ইতস্তত করছ কেন? না জানলে প্রশ্ন করে জেনে নেবে। মনের মধ্যে অকারণ ধোঁয়াশা তৈরি হতে দেবে না। তাহলে শোনো বলি। কিয়োটো কোথায় জানা আছে আশা করি?’
আমরা সমস্বরে বলে উঠলাম, ‘জাপানে-জাপানে।’
‘একদম কারেক্ট। সেখানে উনিশশো সাতানব্বই সালে একটা আন্তর্জাতিক সন্মেলন হয় পৃথিবীর আবহাওয়া নিয়ে। যে রেটে আবহাওয়া বদলে যাচ্ছে তাতে সকলেই চিন্তিত। আবার তাঁরা আরও বেশি চিন্তিত এই নিয়ে যে কারও তোয়াক্কা না করে ধনী দেশগুলো মনের আনন্দে জ্বালানি পুড়িয়েই চলেছে। ফলে কি হচ্ছে? হচ্ছে পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি আর পরিবেশ দূষণ, দু-চারটে দেশের জন্যে শাস্তি পাচ্ছে সবাই। আরে আবহাওয়া তো আর দেশের সীমান্ত মেনে চলে না!’
অপু ক্রমেই অধৈর্য হয়ে উঠছিল, আইসক্রিম থেকে অনেক দূরে চলে যাচ্চি যে।সে আর থাকতে না পেরে ভদ্রলোককে মনে করিয়ে দিল, ‘দেখুন পিশেমশাই, আপনি তখন আইসবার্গের নাম শুনে ওরকম ঘাবড়ে গিয়েছিলেন কেন? বললেন ভয়ংকর দৃশ্য। সেটা কি?’
এদিকে আইসক্রিমওয়ালা হাঁক দিতে দিতে ক্রমেই দূরে চলে যাচ্ছে। বুবলাই চেঁচিয়ে উঠল-‘এই আইসক্রিম, এদিকে’।
ভদ্রলোক অন্যমনস্ক ভাবে মানিব্যাগ বার করলেন। ‘খাবে নাকি? এই যে ভাই চারটে- কি নেবে কাঠি না কাপ?’
‘কাপই ভালো’, বলল বুলাই।
‘ঠিক আছে। তাহলে চারটে কাপ। কি আছে– চকোলেট, ভ্যানিলা, বাটারস্কচ? শুধু চকোলেট? আচ্ছা তাই দাও। হ্যাঁ কি যেন বলছিলাম? আইসবার্গ। বিশ্বের উত্তাপ বৃদ্ধি। তাতে কি হচ্ছে? দুই মেরুর বরফ গলছে। গলছে, মানে গলতে শুরু করেছে। ইতিমধ্যেই গলতে শুরু করেছে কারণ কিয়োটো প্রোটোকলের তোয়াক্কা না করে দূষণ সৃষ্টিকারী দেশগুলো কয়লা আর পেট্রোলিয়ামের ব্যাবহার বাড়িয়েই চলেছে। সৃষ্টি হচ্ছে গ্রীন হাউস এফেক্ট – ওজোন স্তরের ছিদ্র বাড়ছে তো বাড়ছেই’।
‘তাহলে তো মুশকিল।’ কাপের ভেতরটা জিভ দিয়ে চেটে উত্তর দিল অপু।
অবশ্য তার মুখ দেখে মোটেই মনে হচ্ছিল না তার কোনও ভাবনা চিন্তা আছে।
‘মুশকিল বলে মুশকিল।’ ঘনাদার পিসতুতো ভাই উত্তেজিত হয়ে একটা থাপ্পড় কষালেন বেঞ্চির হাতলে। আইসবার্গ ভেঙে চলতে শুরু করেছে। এরপর যখন তারা গলে জল হবে তখন কি হবে অনুমান করতে পারছ?’
ভুরু কুঁচকে খুব চিন্তাশীল হবার ভান করল টোটোন। ‘সমুদ্রের লেভেল উঁচু হয়ে যাবে। আশেপাশের জায়গা ডুবিয়ে দেবে’।
‘ঠিক তাই। কলকাতার হালটা তাহলে কি দাঁড়াচ্ছে? শ্যামবাজার থেকে বরানগর যেতে লাগবে নৌকা। নয় কি?’
আমরা কয়েক মুহূর্ত চামচ চাটা থামিয়ে চুপ করে গেলাম।
‘বুঝলে তাহলে কেন আমি এত ব্যস্ত হয়ে রতনকে খুঁজে বেড়াচ্ছি?’
‘ও হ্যাঁ, হ্যাঁ, তাইতো’। এতক্ষণে হুঁশ ফিরল বুবলাইয়ের সেইতো আমাদের প্রথম আমাদের রতনের খবরটা দেয়। এসে বলে যায় সেই সেই ভদ্রলোক হন্তদন্ত হয়ে কে এক রতনকে খুঁজে বেড়াচ্ছেন।
‘হদিশ পেলেন আপনার রতনের?’ জিজ্ঞেস করল সে।
‘সময় তো আর নেই। আমাকে আবার একটা কনফারেন্সে দৌড়তে হবে জাকার্তা। তোমাদের বলা রইল রতনকে যদি এ তল্লাটে দেখতে পাও বোলো অত গাড়ি গাড়ি করে নেচে লাভ নেই। বানাতে যদি হয় বানাও নৌকা-স্রেফ ডিঙি নৌকা। তাতে হয়ত আখেরে উপকার হতে পারে।’
চোখ গোল গোল করে অপু জানতে চাইল, ‘আর যদি উত্তর মেরু আর দক্ষিণ মেরুর সবই বরফ গলে যায়?’
কিন্তু উত্তর যিনি দেবেন তিনি ততক্ষণে হাওয়া। বিদ্যুৎগতিতে চলে গেছেন জাকার্তার প্লেন ধরতে।
আমরা হাঁ করে দাঁড়িয়ে রইলাম। চকোলেট আইসক্রিমকেও যেন মনে হল নিমপাতার চাটনি।
Tags: এণাক্ষী চট্টোপাধ্যায়, কল্পবিজ্ঞান গল্প, চতুর্থ বর্ষ প্রথম সংখ্যা, মূল প্রচ্ছদ
thanos ke sottyi e dorkar