আত্মীয়
লেখক: সাগরিকা রায়
শিল্পী: চিত্রা মিত্র
পূর্ণিমার রাতে একটু আধটু বাড়ির সামনের খোলা জায়গায় পায়চারি করাটা বহুদিনের অভ্যেস। সেদিনও চাঁদের আলো এসে ঘরের জানালা দিয়ে বেডকভারের ফুল লতাপাতার ওপর পড়তেই আমি পায়ে স্যান্ডেল গলাতে গলাতে থমকে গেলাম। কেউ একজন ছুটে আসছে আমার বাড়ির দিকে। কিছু একটা বলতে বলতে আসছে! কে রে বাবা? এমন চাঁদনী সন্ধ্যেটা মাটি করবে! একেই তো জিনিসপত্রের দাম আকাশ ছুঁয়েছে। ওদিকে অনলাইনে কেনাকাটা ছাড়া দোকানপত্র বলতে কিছুই নেই। আগের দিনে বাজার বসতো গাঁয়ের বাইরে একটা নির্দিষ্ট জায়গায়। এখন সেসব স্বপ্ন। ফসলি জমি শূন্যতে ঠেকেছে। আমি পূর্বপুরুষের খানিকটা জমি অতি কষ্টে বাঁচিয়ে রেখেছি। জানি না কতদিন পারব বাঁচাতে। এর মধ্যেই জনসংখ্যা এমন হারে বেড়েছে, যে পাশাপাশি হাঁটাচলা যায় না! গ্রাম পর্যন্ত ঘিজঘিজ করছে লোকের ভিড়ে। যে প্লাস্টিককে একদিন বর্জ্য বলা হয়েছিল, সেই বর্জ্য দিয়ে খাদ্য বানানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে, তাই খেয়েই বাঁচছে মানুষ। পৃথিবীর ধ্বংসের আর দেরি নেই, মানে ধরা যায় ধ্বংস হয়েই গিয়েছে। মানুষ পঙ্গপালের মত দিকবিদিক ছুটে যাচ্ছে খাদ্যের সন্ধানে। আমার জমিটুকু বাঁচাতে পারলে তবু ধান হবে। ভাত হবে। কিন্তু কতদিন আর? এই গ্রামটার দিকে এখনও সেই অর্থে নজর পড়েনি লোভী মানুষের। একেবারেই প্রত্যন্ত অঞ্চলের একটা ক্ষীণকায়া নদীর পেছনে যেন লুকিয়ে আছে গ্রামটা। আমরা কয়েকজন গ্রামবাসী পাহাড়া দিয়ে লুকিয়ে রেখেছি গ্রামটাকে লোকচক্ষুর আড়াল থেকে। চারপাশে উঁচু পাহাড় আছে বলে পাহারা দেওয়ার কাজটা ওরাই করছে। কিন্তু এখন এক একটা উড়ালপুল বহু উঁচুতে যেন শূন্যে ভাসছে। কবে যে সেখান থেকে আমাদের গ্রামটা ধরা পড়ে যাবে! কার চোখে পড়ে যাবে! গভর্মেন্ট নামক দেশ জোড়া একটি গোষ্ঠী স্পাই ছড়িয়ে রেখেছে বাতাসে। তাদের অ্যান্টেনা কখন আমাদের ধরে ফেলে, সে ভয় কি নেই? সেসব নিয়েও দুশ্চিন্তায় আছি। এরই মধ্যে আবার কার কী হল! বিপদের আশঙ্কা যে সবসময় কেটে খাচ্ছে আমাদের!
-শিবমদা, তোমার ভাই ফিরে এসেছে গো! বাদল চেঁচাচ্ছিল বাজ পড়ার মত আওয়াজ করে।
আমি চমকে উঠেছি। এতবছর পরে রোহন ফিরে এসেছে! মানে? রোহন কোথা থেকে ফিরে এল? আমাদের রোহনই তো? কোনও স্পাই নয় তো? আজকাল নাকি স্পাই ছড়িয়ে পড়েছে লুকনো ফসলি জমি জায়গার খোঁজে। সেরকমই কেউ আসেনি তো?
আমি ভয় পেলাম- বাদল, সে যে রোহন, কী করে বুঝলি? কুড়ি বছর আগে হারিয়ে যাওয়া দশ বছরের ভাই এতদিন পরে যদি ফিরেও আসে, তাকে চিনলি কী করে?
-আমি কী গো? সকলে চিনবে। হুবহু তোমার চেহারা! যেন যমজ। হ্যাঁ, শিবমদা, রোহন তোমার যমজ ভাই ছিল নাকি? এত মিল! আসছে খুকু আর নির্দল পাহারাদারের সঙ্গে। দেখ, তুমিও অবাক হয়ে যাবে।
আমি আগেই অবাক। খুকু আর নির্দল গ্রামরক্ষা কমিটিতে আছে। চারপাশে নজর রাখা ওদের কাজ। ওরা সহজে ভুল করে না। অতি শক্তিশালী দূরবীনের থেকেও ওদের চোখ তীব্র। তাহলে ওটা রোহন? ছোটবেলায় রোহনের সঙ্গে আমার চেহারার মোটেই সাদৃশ্য ছিল না। বিপরীত মেরুর চেহারা ছিল দুজনের। বড় হয়ে আমরা হুবহু হয়ে গেলাম? এমনকি নিজের ভাইও নয়। দূর সম্পর্কের কাকার ছেলে। চাঁদে জমি দেখতে গিয়েছিল কাকা। সে ফিরেছে। কিন্তু সঙ্গে করে রোহনকে নিয়ে গিয়েছিল। সে আর ফেরেনি।কাকা নাকি চাঁদে গিয়ে ওকে হারিয়ে ফেলেছিল। গ্রামের লোকেরা বলে- চাঁদে কত খোদল, গর্ত, কোথায় পড়েছে, দেখগে! সেই থেকে রোহন নিপাত্তা। সে ছিল ফর্সা, কটা চুল, লম্বা, বাদামি চোখের ছেলে। আমি কালো, বেঁটে, কালো চুল, কালো চোখের ছেলে। হুবহু আমার মত দেখতে হতেই পারবে না রোহন। তাহলে এটা কে এল আমাদের গ্রামে? আর যদি রোহন না হয়, তাহলে এই লোকটি আমাদের গ্রামের রাস্তা চিনল কী করে?
চাঁদনী রাত ঝট করে অমাবস্যা হয়ে গেল। মন আধারে ডুবে গেলে চাঁদ আর কী করতে পারে। সংশয় দানা বাঁধছে। এটা কে এসেছে আমাদের লুকিয়ে থাকা গ্রামে? ছদ্মবেশে অতি চতুর স্পাই?
-তুমি দেখ, এস।
-আগে বল, গ্রামে কি একা এসেছে? নাকি কারও পিছু ধরে?
-পিছু টিছু নয়। অদ্রীশ গিয়েছিল বাজার করতে। এক্স টেন উড়ালপুলের কাছে ভিড় ভাড়াক্কা দেখে উঁকি দিয়ে ব্যাপার বুঝতে গিয়েছিল। গিয়ে অবাক! দেখে তুমি অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছ! ও জল ছিটিয়ে জ্ঞান ফিরিয়ে আনে। তারপর এখানে নিয়ে আসে। তুমি, মানে ওই লোকটা বলছিল-আমি কী করে এখানে এলাম! অদ্রীশ বুঝবে কী করে যে, ওটা আসলেই তুমি নও। ওই দেখ, এসে গিয়েছে।
আমি তাকিয়ে দেখছি। সত্যি, চাঁদের আলোয় দূর থেকে লোকটাকে অনেকটা যেন আমারই মত লাগছে! কিন্তু সামনে আসুক, দেখা যাক।
অদ্রীশের হাত ধরে ধরে লোকটা যখন আসছে, আমার বুকটা ধ্বক করে উঠল। আমি ঠিক ওভাবেই হাঁটি। পাশের জনের সঙ্গে মতে মিলে গেলে হাত ধরে হাঁটি! এটা আমার স্বভাবগত বৈশিষ্ট্য। লোকটাকে অদ্রীশ আমি বলে ভেবে নিশ্চয় সমবেদনার কথা বলেছে, আর তাতেই লোকটা অদ্রীশকে আপন ভেবে হাত ধরেছে!
-আরে শিবম, আমি বুঝতেই পারিনি! গ্রামে নিয়ে আসতে আসতে গ্রামের দু চারজনের সঙ্গে দেখা হল। প্রত্যেকে বলছে-শিবম, অদ্রীশ, বাইরে বেশি ঘোরাঘুরি কর না। যা চলছে! আমি অবশ্য কারও কথার জবাব দেইনি। তা, তুমি দেখ, রোহন হুবহু তোমার মত দেখতে হয়ে গিয়েছে। কী রোহন, চিনতে পারছ?
লোকটা আশ্চর্য চোখে আমাকে দেখছিল। এতটা অবাক করা দৃষ্টিতে আমিও হয়তো ওকে দেখছিলাম! এই লোক রোহন নয়। কিন্তু এর জন্য আমাকে বিপদে পড়তে হবে। মাথায় ঘন্টা বাজছিল। লোকটার দৃষ্টির অর্থ আমি বুঝেছি। ও ভাবছে, ওর বাড়িতে আমি কেন! আমি লোকটা কে! শিবম আদতে শিবম নয়, ও কি সেই তত্ত্ব গ্রামের লোকের মাথায় ছড়িয়ে দেবে? তাহলে ঝামেলা হবে। খুব বড় ঝামেলা।
-আপনি কে? লোকটা আমি প্রশ্ন করার আগে আমাকেই প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল।
-আমি শিবম। এই গ্রামের অধিবাসী। কিন্তু আপনি কে?
-আশ্চর্য! আমিই তো শিবম! এই গ্রামের বাসিন্দা!
লোকটার স্মার্ট জবাব শুনে আক্কেল গুড়ুম আমার। বোঝাই যাচ্ছে যে লোকটা একজন স্পাই। এরা এই গ্রহের, নাকি অন্য গ্রহে আস্তানা গেড়ে বসা কিছু ভ্যাগাবন্ড পৃথিবীবাসী, তা কে বলতে পারে! উদ্দেশ্য মহৎ নয়, সে বুঝতে বাকি নেই। এখন গ্রামের লোকের যদি মাথা ঘুরে যায়, তাহলেই মুশকিল হয়ে যাবে। এই লোকটাকে কিছু প্রশ্ন করার উদ্দেশ্যে আমি মাথা ঠান্ডা করি। অদ্রীশকে বলি লোকটাকে আমার বাড়ির ভেতরে নিয়ে বসাতে। অদ্রীশ অবাক হয়েই ছিল। এবারে আমার কথামত বাড়ির ভেতরে নিয়ে বসাতে যেতেই আমার বউ তৃণা উঁকি দিল-কী হল? চাঁদের আলোয় ঘোরা হয়ে গেল?
-হ্যাঁ, আজ আর হল না। একটা ঝামেলায় পড়েছি। দু নম্বর শিবম ক্লান্ত গলায় বলল তৃণাকে। তৃণা অদ্রীশকে জিজ্ঞাসা করল-কী হল আবার? এই তো হাঁটতে বের হল।
-না না, হাঁটতে আমি বের হইনি। আজ আমি গিয়েছিলাম তোমার কিছু হার্বাল প্রোডাক্ট আনতে। সেসব তো বিশেষ দোকান ছাড়া পাওয়া যায় না। কবে থেকে বলছিলে। তাই আজ বেরিয়েছি। হঠাৎ করে উড়ালপুলে উঠতেই চারপাশ কেমন ধোঁয়াটে হয়ে গেল! মনে হল, অজস্র গাড়ির ব্যাক লাইটগুলো দল বেঁধে আমার দিকে ছুটে আসছে। তারপরেই নদীর স্রোতের মত আলোটা একসঙ্গে জুড়ে বয়ে গেল কোথায় কে জানে! আমার শরীর খারাপ করছিল। ভেবেছি, গার্ড ওয়ালে ঠেস দিয়ে বসি। গাড়ির স্পিড দেখে আমার মাথা ঘুরছে হয়তো। তুমি তো জান, চলন্ত কিছু দেখলে আমার মাথা ঘোরে!
-ওহ, তুমি আজ বাড়িতে ছিলে না? কী বলছ? তৃণা ভীত চোখে দু নম্বর শিবমকে দেখে – একটু আগেই তো বের হলে চাঁদের আলোয় বেরাবে বলে! কখন আবার হার্বাল প্রোডাক্ট আনতে গেলে? আর, আমি তো তোমাকে হার্বাল প্রোডাক্ট আনতে বলিনি! হুম, মনে পড়েছে, সে তো অনেকদিন আগে বলেছিলাম। কিন্তু কখন গেলে? আমি কিছু বুঝতে পারছি না। তৃণা এখনও এক নাম্বার শিবম মানে আমাকে দেখেনি। দেখলে ও হয়তো অজ্ঞান হয়ে যাবে! কিন্তু আমি মনে মনে ভয় পাচ্ছি। চলন্ত গাড়ির সামনে আমার মাথা ঘোরে! এই দুনাম্বারিরও ঘোরে? তৃণাকে এরপর বিশ্বাস করানোটা অসম্ভব হয়ে না যায়! অভ্যেসগুলোও যদি দুজনের একই হয়, তাহলে? ক্রমেই একটা জালে জড়িয়ে পড়ছি কি আমি!
-তৃণা! এই লোকটা একটা প্রতারক। ঠকাতে এসেছে। তুমি জান, আজ আমি বাড়িতে ছিলাম। আমি ঘরে ঢুকছিলাম। তৃণা অবাক হবে, ভয় পাবে, চেঁচাতে পারে… সবটা ভেবেই নিয়েছি। যথারীতি তৃণা সেগুলো পরপর করে গেল। আমি দু নম্বরকে ঠান্ডা মাথায় বসালাম – আপনার খুব বড় ভুল হচ্ছে। আপনি যদি শিবম হন, তাহলে আমি কে? এই বাড়ি, বাচ্চারা, স্ত্রী সব আমার। এখন বলুন, আপনি ঠিক কী উদ্দেশ্যে এসেছেন এখানে?
-আমারও ঠিক একই প্রশ্ন। আপনি এখানে কী করছেন?
-তৃণা, গতকাল আমরা কী করেছি, কী খেয়েছি, সব জিজ্ঞাসা কর এই দু নম্বরিটাকে।
তৃণা হতভম্ব গলায় আমার প্রশ্নের প্রতিধ্বনি করল। দু নম্বরি আশ্চর্জনকভাবে সঠিক জবাব দিয়ে গেল। আর আমি পায়ের নীচে থেকে ক্রমেই মাটি সরে যেতে দেখলাম। মাটি অনেকদিন হল হারিয়ে যাচ্ছিল দেশ থেকে, এখন আমার গুছিয়ে রাখা জমিও হারিয়ে যাবে কি পায়ের তল থেকে!
তৃণা কান্নাকাটি করছে। আমি নিজের ঘরে ঢুকতে পারছি না। তৃণা দুজনের একজনকেও ঘরে ঢুকতে দেয়নি। ছেলেদুটো বোকার মত খাটের এক ধারে গুটিসুটি হয়ে আছে। দু নম্বর শিবম বাচ্চাদের ডাকল – সোনারা আমার। এস আমার কাছে। তোমাদের কী চাই বল?
দু নম্বর শিবমের গলা শুনে বাচ্চারা চকচকে চোখে তাকাল – বাবা, ওরা কাকে নিয়ে এসেছে? তোমার মত দেখতে।
-জানি না সোনারা। এই লোকটা আমার বাড়িতে এসে ঢুকে বলছে এটা ওর বাড়ি। আমার খুব টায়ার্ড লাগছে। সারাদিন বাইরে ঘুরেছি। এখন আর শরীরে দিচ্ছে না। আমি শোব। ঘুম চাই। ওহো, আমার গরম জল দাও তৃণা।
তৃণা দ্রুত এগিয়ে আসে – দাঁড়াও, দিচ্ছি।
আমি ভয় পেয়ে চিৎকার করে উঠেছি – তৃণা! ভুল কর না। এটা আমি নই। প্লীজ তৃণা।
দু নম্বর বিরক্তির চোখে তাকাল – যাও, যেখান থেকে এসেছ, সেখানে ফিরে যাও। আর ভালো লাগছে না।
আমি সারারাত বাড়ির বাইরে পায়চারি করে চল্লাম। গ্রামবাসীদের কেউ কেউ আমার পাশে আছে। কেউ কেউ সন্দেহের মধ্যে আছে।
অদ্রীশ মাঝরাতে আমার কাছে এল – কী হচ্ছে বলতো? আমিও কিছু বুঝতে পারছি না।
আমি কথা বলতে পারছিলাম না। তৃণা যেখানে বিশ্বাস করল না, সেখানে আর কে আমাকে হেল্প করবে!
সকাল হল যথানিয়মে। বাচ্চারা স্কুলে যায় না এখন। পড়াশোনা সব এখন অনলাইনে। নিজের পছন্দমত পড়াশোনার সুযোগ আছে। ওদের বাগানে দেখে ডাকলাম-সোনারা, এস আমার কাছে এস। শোন, আমাদের বাড়িতে যে লোকটা এসেছে, সে আমার মত দেখতে হলেও সে কিন্তু তোমাদের বাবা নয়।
-এই বাচ্চারা, তোমরা এদিকে চলে এস। তৃণা প্রচন্ড রাগ আর দ্বিধা নিয়ে ছুটে এল। বাচ্চাদের বাড়ির ভেতরে টেনে নিয়ে যাচ্ছে তৃণা – আপনি যে-ই হোন, ডিস্তার্ব করবেন না।
আমি পাহাড়ের নীচে নিজের লুকনো জমির কাছে গে্লাম। এই জমি আমাকে চেনে! এই মাটির ফসল জানে আমি কে! নীচু হয়ে মাটি তুলে নিজের গায়ে লেপে দিতে যাচ্ছি, পেছন থেকে দু নম্বর শিবম চেঁচিয়ে ধমক দিল – এই কে ওখানে? কে? কে ঢুকেছে আমার জমিতে?
আমি চমকে গে্লাম। এই জমি, স্ত্রী, সন্তান সব নিয়ে নিচ্ছে লোকটা? কত কষ্ট করে এই মাটিটুকু লুকিয়ে রেখেছি, সেটা কোনওভাবে কি কেউ জেনে ফেলেছে? চারপাশে যে ভাবে স্পাই ঘুরছে, নিশ্চয় তেমন কিছু হয়েছে। আমার জন্য কোথাও কি কোনও জায়গা নেই?
অদ্রীশের কাছে গিয়েছিলাম। অদ্রীশ আমাকে বিশ্বাস করছে খানিকটা। ওর কাছেই হয়তো যাওয়া যায়। অদ্রীশ আমাকে দেখে আজ থতমত খেল। পরে সামলে নিল – বল।
-কী বলব? আমি বুঝতে পারছি না এসব কেন হচ্ছে!
-আমিও বুঝতে পারছি না। একটা কথা বল, যখন উড়ালপুলের কাছে গিয়েছিলি…
-না, না অদ্রীশ! সে আমি নই ভাই। আমি এখানেই ছিলাম কাল। পুলের কাছ থেকে ওই দু নম্বরিকে নিয়ে এসেছিলি তুই!
-কী যে বলি! এত মিল দুজনের! কিছুই বোঝা যায় না! লোকটা এল কোথা থেকে? তোদের দুজনেরই সব কিছুই একই রকম। এতটা সাদৃশ্য দেখা যায় না। আচ্ছা, ভেবে বল, এই লোকটির সঙ্গে তোর কোনওরকম আত্মীয়তা নেই?
-পাগল! তাহলে তোরা জানতিস! এত বছর একই সঙ্গে আছি আমরা! গ্রামের সকলেই সকলের খুঁটিনাটি জানে। তাহলে আমার এই আত্মীয়কে একবার হলেও দেখতিস!
-আমি কী করে বলব! অন্য গ্রহ থেকে কেউ আসতে পারে! নাসা থেকে বলছে শুনেছি, এমন হতে পারে। আবার বছর দুই আগে কে চলে গিয়েছিল সমান্তরাল দুনিয়ায়! অন্য কোনও বিশ্বে! ফিরে এসে হাবাগোবার মত হয়ে গিয়েছিল! কী সব বলত সারাক্ষণ! হুবহু ওর মত দেখতে একজনের সঙ্গে নাকি ওর দেখা হয়েছে, এক বালি ভর্তি জায়গায় নাকি গিয়ে পড়েছিল ও! ভারি নিঝুম সে জায়গা! কেমন হাবিজাবি কথা বলত! তেমন করে কেউ চলে আসতে কি পারে না?
আমি ভেতরে ভেতরে চমকে উঠেছি। সমান্তরাল দুনিয়ার কথাটা আমার মাথায় আসেনি। সত্যি কথাটা মাথায় কেন এল না? হুবহু একই রকম মানুষ একমাত্র অন্য বিশ্বে থাকতে পারে এই তত্ব নিয়ে পড়েওছি আমি। ভুলে গিয়েছিও অনেক কিছু। কিন্তু, অদ্রীশ কেন একথা বলল?
-বলেছি, কারণ গতকাল তোদের বাড়ির অবস্থা দেখে বাড়িতে গিয়ে শান্তি পাচ্ছিলাম না! একটু খোঁজ খবর করব ভেবে বসলাম। বিজ্ঞান চর্চার যে নতুন একটি সেন্টার হয়েছে, সেখানে আমার ভাই ধৃতিমান আছে। ওকে তোর ঘটনাটা বললাম। তো, ও আমাকে এই সমান্তরাল বিশ্বের কথা বলেছে। ওর মনে হচ্ছে, এই দ্বিতীয় লোকটা অন্য কোনও দুনিয়া থেকে এসেছে। এই অন্য দুনিয়ার কথা আমরা জানি। অসংখ্য বিশ্ব সৃষ্টি হয়েছে। যা আমাদের ধারণার বাইরে। অদ্রীশ দম ফেলে।
-তুই স্ট্রিং তত্বের কথা বলছিস। ক্লান্ত গলায় বললাম।
-স্ট্রিং তত্বকে বিশ্লেষণ করেই বিজ্ঞানের একটা শাখা বলছে, আমাদের মহাবিশ্বের সৃষ্টিটাই হয়েছিল দুটো ব্রেনের সংঘর্ষের কারণে। এই সংঘর্ষের জন্যই ইনফ্লেশনের সৃষ্টি হয়। এইরকম সংঘর্ষ একই জায়গায় তো হয় না।
-না, সে হয় না। মহাবিশ্বে অনন্ত শূন্যে এমন সঙ্ঘর্ষ হয়ে চলছে,সে আমরা জানি। এই যুগে এসে এসব আর অজানা নেই। আর এই সংঘর্ষের ফলে তৈরি হয়ে চলেছে অসংখ্য মহাবিশ্ব।
-আমার ভাই, মানে ধৃতিমান বুঝিয়ে দিল ব্যাপারটা। বলল, যদি এই সঙ্ঘর্ষের ফলে মহাবিশ্ব সৃষ্টির তত্বটা সঠিক হলে আমাদের মহাবিশ্বের মত দেখতে আরও অনেক মহাবিশ্ব থাকা অবশ্যই উচিত। এমন মহাবিশ্বকে লেভেল-২ প্যারালাল ইউনিভার্স বলে। তো যদি সেটা মেনে নিই, তাহলে সেই মহাবিশ্বে আমার তোর মত মানুষ থাকতেই পারে। সময়ের ফাঁক গলে সে এই বিশ্বে যদি চলে আসে, হঠাৎ করে বুঝতে পারবে না। কোন ভাবেই পারবে না। কারণ, হুবহু তারই আপনজনদের মতই হুবহু আপনজনরা এই বিশ্বেও আছে। বুঝতে পেরেছিস?
-গ্রামের বাকি লোকেরা কি পারবে বুঝতে? তারা অন্য বিশ্বের অস্তিত্ব সম্পর্কে জানে। কিন্তু, আমিই যে সত্যি এই বিশ্বের শিবম, সেটা মানবে? কেমন করে বোঝাব?
অদ্রীশ চুপ হয়ে গেল। আমিও। আমার বউ, ছেলেরা, ওর বাড়িঘর, জমি, ফসল সব ও নিয়ে নিল? আর আমি? আমার অস্তিত্ব কোথায়?
তৃণা চিৎকার করে একটা প্লেট ছুঁড়ে মারল আমাকে। আমি কিছু করিনি। কিচেনে তৃণার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে ওর পিঠে হাত রেখে বোঝাতে গিয়েছি যে, ও যেন মানুষ চিনতে ভুল না করে। তৃণা এমন ফেরোসাস হয়ে যাবে, যেতে পারে, ভাবতেই পারিনি! আমার স্পর্শ পর্যন্ত বুঝতে পারেনি তৃণা! অথচ, তৃণা বলেছিল – অন্ধকারেও তোমার স্পর্শ আমি অনুভব করতে পারি। আজ কিনা…! স্থির হয়ে দাঁড়াতে পারছি না। মাথা টলছিল। কারা এসে পড়েছে চিৎকার শুনে। তারাই আমাকে ধরে বাইরে নিয়ে আসে। জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছি। খানিক পরে জ্ঞান ফিরে এল যখন, পাড়ার লোকেরা সমবেদনা জানাল – এভাবে কি কিছু হয়? এটা শিবমের বাড়ি। ওর ঘর সংসারে আপনি কী বলে ঢুকবেন? শুধুমাত্র একই রকম দেখতে বলে বাকি ব্যাপারগুলো শিবমের মতই হবে? আসলে, আপনার মধ্যে একটা লোভ জেগেছে। শিবমের সংসার, ফসলভরা জমি… এসব দেখে আপনি ভাবতে শুরু করেছেন, এসব আপনার। মাথা ঘুরে গিয়েছে। নিজেকে সামলান।
আমি কথা বলতে পারছি না। হাঁটু গেড়ে বসে গ্রামের লোকদের কাছে আবেদন জানা্লাম, ’আমাকে চিনতে ভুল করবেন না, প্লীজ। আমি আপনাদের সেই শিবম!’ কিন্তু কেউ বুঝতে পারল না। একটা সময় আবিষ্কার করলাম আমি একা পড়ে আছি। আশেপাশে কেউ নেই। আমাকে একা ফেলে সব চলে গিয়েছে নিজের নিজের কাজে। আমি নিজের বাড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম, তৃণা দরজা বন্ধ করে দিচ্ছে!
অদ্রীশ এসেছিল। রাগত গলায় ও একটু ধমকই দিল – আপনি কেমন লোক? আমার বন্ধু শিবম। ও আজ নিজের বাড়িতে ঢুকেছে। কাল সারাদিন বাইরে বাইরে ঘুরে মরেছে। আমরা সারাক্ষণ আপনার ব্যাপারে কথা বলেছি। এখন ওর বউ যখন ওকে চিনতে পেরেছে, আর কোন কথা হবে না! আপনি কী বলে অন্যের বউএর পিঠে হাত রাখতে গিয়েছিলেন?
-অদ্রীশ!
-আমি জানি না আপনি অতি চতুর, নাকি বোকা! আপনাকে একটু ডাক্তার দেখাতে হবে।
আমাকে মানসিক হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল গ্রামেরই লোক। কাউকে বোঝাতে পারিনি আমার কথাগুলো। নিশ্চুপ হয়ে গিয়েছি একটা সময়। রাত আসে নীরবে। বালিশে মাথা রেখে আমি আস্তে আস্তে নীরবে গিয়ে তৃণার পাশে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ি। বাচ্চাদুটোর গায়ে আদরের হাত বুলিয়ে দিই। সকাল হলে আয়ারা আমাকে ডেকে তোলে। ডাক্তার আসেন। আমার কথা বলতে ইচ্ছে করেনা। কথা বলি না। অপেক্ষা চলে। বাইরে বের হতে হবে। কিন্তু তারপরে কী হবে? ফের সেই একঘেয়ে নাটক? কী লাভ আর এসবের জন্য মাথা ঘামিয়ে?
মাস দুই পরে ঘোর অন্ধকার জীবন থেকে, ওষুধের গন্ধ থেকে আমার ছুটির নোটিশ এল। আমি নাকি সুস্থ। ডাক্তারের সার্টিফিকেট নিয়ে বেরিয়ে আসি হাসপাতাল থেকে। খোলা আকাশের নীচে দাঁড়িয়ে অনেকটা সময় কাটাই। একসময় কোথায় একটা পাখি ডেকে উঠেছে। উঠে পাখিটাকে খুঁজলাম। কোথায় সেই পাখি! নেই নেই!
একসময় উঠে দাঁড়াই। হাঁটতে শুরু করেছি। হেঁটে হেঁটে অনেকটা এগিয়ে মেইন রোডে এসে পৌঁছলাম। একটা গাড়িতে উঠে বসি। নিজেই ড্রাইভ করে চলে যাওয়া গেলাম একটা বিশেষ জায়গায়। ভাড়াটা আমার আকাউন্ট থেকে কেটে নেওয়া হবে। গাড়ি থেকে নেমে হেঁটে গিয়ে সেই জায়গায় দাঁড়ালাম। আজ, এখন রাত নামছে এই এক্স টেন উড়ালপুলেও। গাড়িগুলোর ব্যাক লাইটগুলো স্রোত তৈরি করছে। গার্ড ওয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়ালাম। আমার মত হুবহু সেই আত্মীয় এখান থেকেই আমাদের গ্রামে গিয়েছিল!… তাহলে সমান্তরাল সেই বিশ্বে দু নাম্বারির হুবহু আমার সংসারের মতই একটি সংসার আছে! ওর বউ ওর জন্য অপেক্ষা করছে। হার্বাল প্রোডাক্ট আনতে গিয়েছে বর। আসবে এখনই!
দু নাম্বারের সংসার, আপনজনেরা অপেক্ষমান ওর জন্য। হোক সেটা অন্য মহাবিশ্বে। কী এল গেল তাতে! আমার সংসারে আমার জায়গা দখল হয়ে গিয়েছে! এবারে আমার পালা দখলদারির।
পিঠের নীচে দেওয়াল ঝুলে অন্ধকার কূপের মধ্যে ফেলে দিচ্ছে আমাকে! সব ধোঁয়া… আমি অন্য কোথাও ডুবে যাচ্ছি…। হার্বাল প্রোডাক্ট… হার্বাল প্রোডাক্ট…!
Tags: কল্পবিজ্ঞান গল্প, চতুর্থ বর্ষ প্রথম সংখ্যা, চিত্রা মিত্র, সাগরিকা রায়
Sundor laglo