আমাদের ভবিষ্যৎ – নতুন তুষারযুগ নাকি জলমগ্ন পৃথিবী?
লেখক: অঙ্কিতা
শিল্পী: দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য্য (চিত্রচোর)
আমাদের ধারণা পৃথিবীতে তুষারযুগ আসলেও তা আসবে খুব ধীরে ধীরে। কল্পবিজ্ঞান গল্প কিংবা সিনেমায় যেরকম নাটকীয় ভঙ্গিতে দেখান হয়, সেভাবে কখনওই নয়। কিন্তু অনেক বিজ্ঞানীই মনে করেন আবহাওয়ার বিস্ময়কর এবং দ্রুত পরিবর্তন হতে পারে, বিশেষ করে মানুষ যদি পৃথিবীর আবহাওয়া পরিবর্তনে অবৈধভাবে হস্তক্ষেপ করে।
পৃথিবীর প্লাইস্টোসিন যুগ, যা শুরু হয়েছিল আজ থেকে প্রায় পঁচিশ লক্ষ বছর আগে আর শেষ হয়েছে প্রায় দশ হাজার বছর আগে। এই যুগে চারটি তুষারযুগ দেখা গিয়েছিল। তার শেষ তুষারযুগটা হয়তো কল্পবিজ্ঞানের গল্পকাহিনির মতোই কোনও দ্রুত আবহাওয়ার পরিবর্তনের সাক্ষী। ৩৯০০০ বছর আগের সেই তুষারযুগের ফসিল হিসাবেই খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল সাইবেরিয়ান ম্যামথ। মনে করা হয়, কোনও বড় তুষারপাতের ফলে এর মৃত্যু হয়েছে আর সেই তুষার পরে গলে যায়নি। সেই অতিকায় ম্যামথের পেটের ভিতরে পাওয়া গেছে পরিপাক না হওয়া ঘাস। তার মানে তুষারযুগ এত দ্রুত এসেছিল যে খাদ্যহজম করার সুযোগটুকুও পায়নি বেচারি ম্যামথটি।
আর্থার সি ক্লার্কের ছোটগল্প ‘দ্য ফরগটেন এনিমি’-তে দেখা যায় পৃথিবীর শেষ মানুষটি ঘুম থেকে উঠে দেখছ তার বাড়ির দরজায় কড়া নাড়ছে বিশাল একটি হিমবাহ। এক রাত্রিতেই ধুয়ে মুছে গেছে মানব সভ্যতা। আরও বিশ্বাসযোগ্য ঘটনা দেখতে পাই জন ক্রিস্টোফারের লেখা ‘দ্য ওয়ার্ল্ড ইন উইন্টার’ গল্পে যেখানে শীতকাল আসে, চারিদিক তুষারে ঢেকে যায়, কিন্তু আর ঋতু পরিবর্তিত হতে পারে না। সেইভাবেই থেকে যায় পৃথিবীর পরিবেশ।
একবার যদি তুষারযুগ শুরু হয়, তাহলে সেটা ক্রমশ বাড়তে থাকবে পজিটিভ ফিডব্যাক পেয়ে। জলীয় বাষ্প জমে গিয়ে বরফ তৈরি হয়। বরফাবৃত অঞ্চল যত বাড়তে থাকবে, পৃথিবীপৃষ্ঠ থেকে সূর্যরশ্মি তত বেশি মহাশূন্যে প্রতিফলিত হয়ে ফিরে যাবে। ফলে আবহাওয়া আরও শীতল হবে। ফলস্বরূপ আরও তুষারপাত ও বরফ জমা হবে পৃথিবীপৃষ্ঠে। এভাবেই চলতে থাকে চক্রাকারে।
উত্তরমেরুর বরফ ধীরে ধীরে দক্ষিণে বাড়তে থাকে, কারণ আগের মতো ওখানের বরফ গলে যেতে পারে না। ফলে পৃথিবী আরও বরফাবৃত হয়ে পড়ে। এই তুষারযুগ কীভাবে শেষ হবে তাই নিয়েও অনেক মতানৈক্য আছে। একটি মতে উত্তরমেরু সাগর ভালভের মতো কাজ করে, এই সাগর যখন সম্পূর্ণ বরফে পরিণত হয়, তা আর উত্তরের বাতাসে আদ্রতা বেশি দিতে পারে না, ফলে তুষারপাত ধীরে ধীরে কমে যায়।
পৃথিবীর ভারসাম্য নষ্ট করে এই তুষারচক্র শুরু করে দিতে পারে যে সমস্ত অবস্থা তা অনেকভাবেই সম্ভব। হতে পারে বড় কোনও উল্কার আঘাতে সাগর যদি শুকিয়ে যায় কিংবা কোনও সুপারনোভা বিকিরণ। আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাতের ফলে সৃষ্ট ধূলিমেঘও একই চক্র শুরু করে দিতে পারে।
ব্রিটিশ আবহবিদ হুবার্ট ল্যাম্ব দেখিয়েছেন যে সব বছরে অগ্নুৎপাত হয়ে ধূলিমেঘের সৃষ্টি হয়েছিল সেই সব বছরে অত্যধিক ঠাণ্ডা কিংবা অতিবৃষ্টি লক্ষ করা গেছে। এই সূর্যরশ্মি প্রতিফলনের আরও একটি কারণ অত্যধিক ঘরবাড়ি এবং রাস্তাঘাট তৈরি। এর ফলে গ্রামের দিকে যতটা প্রতিফলন হয়, শহরে তার থেকে অনেকগুণ বেশি সূর্যরশ্মি প্রতিফলিত হয়ে থাকে। এছাড়াও মরুভূমির আয়তন যত বাড়বে, তার সূর্যরশ্মি প্রতিফলনের পরিমান তত বেড়ে যাবে। এই সব বিভিন্ন কারণে যদি পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা কয়েক ডিগ্রি বেড়ে যায়, তাহলে ধীরে ধীরে গ্লেসিয়ারের আয়তন বাড়তে থাকবে।
১৯৭৯ সালের বিখ্যাত সিনেমা ‘কুইনটেট’-এর পটভূমিতে দেখা যায় চারিদিকে বরফাবৃত শহর। আরও অনেক কল্পবিজ্ঞান উপন্যাসেই দেখা যায় এইরকম প্লট। উল্লেখ করা যেতে পারে ডগলাস ওরগ্রিল এবং জন গ্রিবিনের লেখা ‘দ্য সিক্সথ উইন্টার’ (১৯৭৯)। বাংলায় শেখর বসুর লেখা ‘কলকাতায় তুষারপাত’ উল্লেখযোগ্য যেখানে দেখা যায় কলকাতা শহর তুষারাবৃত হয়ে গেছে।
তবে আবহাওয়া পরিবর্তনের ফলে তুষারযুগ ফিরে আশার সম্ভবনা যতটা তার থেকে অনেক বেশি সম্ভবনা পৃথিবী জলমগ্ন হয়ে যাবার। পৃথিবীর জলভাগের উচ্চতা এখনই ধীরে ধীরে বাড়তে শুরু করেছে। আবহাওয়ার পরিবর্তনের ফলে বরফ গলছে। ১৯৯২ সাল থেকে আন্টার্টিকায় ৩ ট্রিলিয়ন টন বরফ গলে গেছে। সমুদ্রতলের উচ্চতা বাড়িয়ে দিয়েছে ৭.৬ মিমি। এর অর্ধেক ওজনের বরফটাই গলেছে গত পাঁচ বছরে। ডুবতে শুরু করেছে ব্রিটেনের বিখ্যাত কোস্টাল ওয়েটল্যান্ড। বিজ্ঞানীরা আশংকা করছেন ২০৪৫ সালের মধ্যেই আমেরিকার সমুদ্র তীরবর্তী বড় বড় শহরগুলোতে ক্রমোচ্চ সাগরের ঢেউ প্রভূত সমস্যার সৃষ্টি করবে।
জলভাগ বেড়ে গেলে পৃথিবীপৃষ্ঠ থেকে সূর্যরশ্মি কম প্রতিফলিত হবে মহাশূন্যে। ফলে আরও বরফ গলতে থাকবে আর ধীরে ধীরে পৃথিবীর তাপমাত্রা বাড়তে থাকবে। যদি গ্রিনল্যান্ড আর আন্টার্কটিকার সব বরফ গলে যায়, তাহলে সমুদ্রতল ৬০ মিটার বেড়ে যাবে। পৃথিবীর সমস্ত বড় শহর, উপকূলবর্তী অঞ্চল জলের তলায় চলে যাবে।
জে জি বার্নাডের লেখা ‘দ্য ড্রাউন্ড ওয়ার্ল্ড’ উপন্যাসে দেখা যায় সমগ্র পৃথিবী গ্রীষ্মপ্রধান অঞ্চলে পরিণত হয়েছে আর আমাদের বেশিরভাগ সভ্যতাই বাস করছে জলের তলায়।
মানবজাতি প্রচুর কয়লা এবং খনিজ তেল ব্যবহার করে, ফলে প্রচুর পরিমাণে কার্বন-ডাই অক্সাইড এর মতো গ্রীন হাউস গ্যাস তৈরি হয়। এই গ্যাসের সূর্যের ইনফ্রারেড রেডিয়েশন শোষণ করে আরও বেশি উষ্ণ হয়ে ওঠে। গাছপালা এই সমস্ত গ্রীন হাউস গ্যাস শোষণ করে থাকে। কিন্তু মানবজাতি যে পরিমাণে অরণ্যছেদন করছে, তার ফলে বাতাসে গ্রীন হাউস গ্যাসের পরিমাণ আরও বেড়ে যাচ্ছে। এই গ্রীন হাউস এফেক্টের ফলে পৃথিবীর উষ্ণতা দ্রুত বেড়ে চলেছে।
আমাদের অতি পরিচিত কথা ‘গ্লোবাল ওয়ার্মিং’ মানবজাতিকে ক্রমাগত ওয়ার্নিং দিচ্ছে আগামী তুষারযুগ বা জলমগ্ন পৃথিবীর। পৃথিবীর উষ্ণায়ন আমাদের ভবিষ্যতকে ঠেলে দিতে পারে এই দুই প্রলয়ের মুখেই।
তথ্যসূত্রঃ
১) দ্য সায়েন্স ইন সায়েন্স ফিকশন, পিটার নিকলস
২) সায়েন্স ফিকশন এনসাইক্লোপিডিয়া
চিত্রঋণঃ ইন্টারনেট
Tags: অঙ্কিতা, আমাদের ভবিষ্যৎ - নতুন তুষারযুগ নাকি জলমগ্ন পৃথিবী?, তৃতীয় বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা, দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য্য, প্রচ্ছদ কাহিনি
darun lekha…Gloabl warming satyi warming issue…….aamra sachetan na hole sesher sedin khub dure noy!
tabe myamoth er pet e hajam na haoa ghas ki druto aasa mrityu (aaghat peye) ingit kore na druto aasa tushar jug ingit kore?