আমার এখন জ্বর এসেছে
লেখক: সঞ্জয় বোস
শিল্পী: দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য (চিত্রচোর)
কেস নং : ১২১
পার্সোনাল আইডেন্টিটি :
প্রত্যক্ষ : ড. রঞ্জন মিত্র।
পরোক্ষ : শ্রী সুধীর গুহ, শ্রী সঞ্জয় বোস।
চিফ কমপ্লেন : অনিশ্চিত মানসিক ব্যবহার, আত্মহত্যা এবং আত্মহত্যার প্রচেষ্টা।
পাস্ট মেডিকেল হিস্ট্রি :
পরোক্ষ : নেই/পাওয়া যায় নি।
প্রত্যক্ষ : মধুমেহ, উচ্চ রক্তচাপ।
ফ্যামিলি হিস্ট্রি :
পরোক্ষ : মানসিক ব্যাধির লক্ষণ পাওয়া যায় নি।
প্রত্যক্ষ : পরিবারে মানসিক ব্যাধি পাওয়া যায় নি।
ফিজিক্যাল হিস্ট্রি : সম্পূর্ণ শারীরিকভাবে সুস্থ।
(রিপোর্টে ফুটনোট হিসেবে উক্তি বন্ধনীতে লেখা রইলো)
রিপোর্ট ::
(১)
ভূমিকা ও ঘটনা পরম্পরাঃ-
২০১৪-র মার্চ মাসে, স্টকহোমে অনুষ্ঠিত মনরোগ বিষয়ক এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে, দক্ষিণ ডেনমার্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এড্রিআনুস স্কভ যে বক্তব্যটি বিশ্বের নামজাদা মনোবিজ্ঞানীদের সামনে তুলে ধরেন, সেটি জুন মাস নাগাদ সাইকিয়াট্রিক টাইমস-এ ফলাও করে প্রকাশিত হয়। বক্তব্যের মূল বিষয়বস্তু ছিল – “মানসিক অস্থিরতা ও অলিক কল্পনা — একটি বিশদ পরিশীলন”।
এই বছরেই বিষয়টি দিল্লীর অখিল ভারতীয় আয়ুর্বিজ্ঞান সংস্থার মনোবিজ্ঞান বিভাগে আলোচনার উপলক্ষ হয়ে দাঁড়ায় একটি বিশেষ কারণে। মনরোগ বিশেষজ্ঞ ডঃ রঞ্জন মিত্র স্কভ সাহেবের প্রাক্তন ছাত্র ছিলেন আর সেই সুবাদে ওনাদের মধ্যে মনোরোগ সংক্রান্ত নানা জটিল বিষয়ে আলাপ আলোচনা চলত। স্কভ সাহেব অগাস্ট মাসের শেষের দিকে, মিত্র-কে একটি মেইল পাঠান। সেটি এখানে তুলে দেওয়া হল। মূল ঘটনাটির সাথে এই বার্তাটির নির্দিষ্ট যোগাযোগ লক্ষণীয়।
“প্রিয় রঞ্জন,
আমাদের পুরনো আলোচনার জের টেনে সোজাসুজি বলছি, এক্ষেত্রে তোমার রোগ নির্ণয়ের পদ্ধতি অচিরেই বদলাতে হবে। অন্যথা ভুল পথে অগ্রসর হয়ে অপ্রয়োজনীয় অর্থ ও সময়ের অপচয় ঘটা অনিবার্য। আগেই তোমাকে লিখেছিলাম আমাদের জ্ঞানের ভিত টিকে আছে গবেষণা ও অনুসন্ধানের ফলাফলের উপরে। মূলত বিজ্ঞানের দর্শন, প্রমাণ এবং যুক্তি দিয়েই বর্ণিত হয়ে এসেছে মানুষের সচেতনতার হাত ধরে। এটাই ছিল আমার এতদিনের শিক্ষা ও অভিজ্ঞতার প্রাণবিন্দু। কিন্তু আমার গত দু’সপ্তাহের শোধের পরিণাম স্বরূপ, এই শাশ্বত ভাব ধারণার মূল সূত্রতে চিড় ধরেছে।
তোমাকে আমি এক ভদ্রলোকের হাতে লেখা ডায়রির বেশ কয়েকটা উল্লেখযোগ্য পাতা স্ক্যান করে পরের মেইলে পাঠাচ্ছি। পুরো লেখাটা পড়লে তোমার বর্তমান “পরিস্থিতি”-র একটা সম্ভাবনাময় ব্যাখ্যা পেতে পার। লেখক একজন ভারতীয় ও তোমারই মতন বাঙালী। যদিও এ জাতীয় আরো দুটি ঘটনা ইদানীং আমি সংগ্রহ করেছি। একটি অস্ট্রিয়া-র টেল্ফস শহরের অন্যটি কলম্বিয়ার প্লেটো অঞ্চলের। তবে যেটা তোমাকে পাঠাচ্ছি সেটি অভিনব এক অভিজ্ঞতা।
আমি বিগত এক মাস এই কেসটি নিয়ে দিন-রাত কাজ করে চলেছি। সৌভাগ্যক্রমে অবশেষে নাটকীয় ঘটনাবলীগুলো একে একে আমার সপক্ষে আসতে আরম্ভ করে দিয়েছে। যদিও সেটাও আমার ভ্রান্ত ধারণা হতে পারে।
ঘটনার শেষে আমি একটা ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়েছি; সেটা নিয়ে তোমার স্বতন্ত্র অভিমত জানার ইচ্ছে রাখি।
শুভেচ্ছা,
স্কভ”
(ডঃ মিত্রর কেস ডিটেল সম্বন্ধে মেইলে এর বেশি কোনো উল্লেখ নেই)
পরের মেইলে একটি ডায়েরি জাতীয় দিনলিপির কয়েকটা পাতা স্ক্যান করে পাঠানো হয়েছিল।
(২)
তথ্য
(দিনলিপি পাতা নং:- ১)
“আমি আপনাদের সুধীরের কথা শোনাতে বসেছি এবং আমার নিজেরও। আপনাদের মৌলিক বিশ্লেষণ আমার কাছে বিশেষ গুরুত্ব বহন করবে।”
(কাকে/কাদের উদ্দেশ্য করে লেখা — অপ্রমাণিত)
সামান্য কিছু রং তুলি কেনার মত পয়সা জমিয়েছিল সুধীর। এর বাইরে সঞ্চয় বলতে ব্যাঙ্কে হাজার পঁচিশেক আর বাপের তৈরি বাড়ি। সংসার বলতে সে নিজে এবং তার আলাদা ভাবনা চিন্তার জগৎ।
ওদিকে পয়সা কড়ি নিয়ে ভাববার মত মানুষ সে নয়, তার কিছু প্রয়োজন আছে তবে সেটা কখনো মাত্রা ছাড়িয়ে যায় না। কিছু উদাহরণ দিলে ব্যাপারটা বোঝানো যেত কিন্তু তার কোনো প্রাসঙ্গিকতা এখানে খুঁজে পাচ্ছি না।
দেখুন, যে চরিত্রটি নিয়ে বলতে বসেছি সেটি কি ভীষণ সাধারণ? নির্জীব? জীবনের সমস্ত উচ্ছ্বাস, উদ্যমহীন, স্থূল, মৃত এক সামাজিক শব-এর মতন?
মানুষ ছবি আঁকে বা অন্যরকম ভাবে, এটায় এমন কোনো বৈচিত্র্য নেই। ভারতবর্ষের ঘরে ঘরে এমন “আলাদা মানুষ” ঢের দেখতে পাবেন।
তবে এটাই এক অর্থে প্রকৃত জীবন দর্শন। …যা মধ্যবিত্ত রোজনামচায় রক্ত ও স্বেদ দিয়ে লেখা হয়ে থাকে।
সুধীরেরা তুলিতে রঙের স্বপ্ন মাখিয়ে, ফ্যাকাসে স্থবির ক্যানভাসে যা নেই তার গল্পগাঁথা এঁকে চলে। যেন এক বিচিত্র শহরের রূপকথা। সেই গল্পে রাজা, রানী, পরি, দানব, সবাই থাকে। শুধু তাদের স্থান, কাল, পাত্রগুলো বাস্তব আর অবাস্তবের সীমানা ভুলে যায় —- প্রায়ই।
সে যাই হোক, যা লিখতে বসেছি সময় শেষ হওয়ার আগে লিখে রেখে যাই…
(প্রবাবেল কেস অফ একিউট ডিপ্রেশন)
দিনটার কথা আমার বিশেষভাবে মনে আছে এই কারণে, যে সেদিন সকালে ছাদে উঠে দেখলাম আমার সাধের গোলাপগুলো সব কটা এক সাথে শুকিয়ে মরে পরে আছে। কি অব্যক্ত বেদনা যে অনুভব করেছিলাম লিখে এখন সেটা বোঝানো যাবে না। আমার কোন গাফিলতি হয় নি বলেই মনে করি। জল, খাদ্য, পরিচর্যার ত্রুটি করিনি। আলো, বাতাসের হিসেব রেখেই ওদেরকে বাড়তে সাহায্য করেছিলাম।
বন্ধু সমাজে অহংকারের বিষয়বস্তু ছিল আমার গোলাপগুলো। ওরা অনেকে আসত, দেখে খুশি হয়ে বলত, -“ভাই একটা গোলাপ দেবে?”
আমি হাসি মুখে প্রত্যাখ্যান করে অন্তরে সুখ অনুভব করতাম।
আর সেদিন!
শুধু ফুল নয় গাছগুলোর থেকে কেউ যেন সমস্ত প্রাণ রস শুষে নিয়েছিল। কি ভীষণ শুষ্ক, জরাগ্রস্ত লাগছিল ওদের।
আর পাতাগুলো?
ধুসর কালো রং!
সবুজ, সজীব আমার গোলাপ গাছের পাতা এক রাত্রে কি করে ধুসর হয়ে গেল?
আমি পাগলের মতন দু’হাতে মাটি খামচে তুলে দেখতে লাগলাম। কোথায়! কোথায় সেই পোকার দল!
আতস কাঁচের তলায় নিগুঢ়ভাবে নিরীক্ষণ করলাম প্রতিটি ডাল, পাতাকে।
নেই ! নেই, কোনো অজানা পোকার সারি। যদি দল বেঁধে তারা ধেয়ে চলত ডাল পাতার ফাঁকে ফাঁকে; আমি তাহলে হয়ত খুশি হতাম, ভাবতাম কারণ খুঁজে পেয়েছি।
তবে কি হাওয়া বা আলো নিয়ে এসেছিল মৃত্যুর বীজ? কিছুই বুঝে উঠতে পারিনি।
সেদিন বিকেলের দিকে সুধীর এসে বলল, “আজকাল অসময়ে জ্বর আসে রে সঞ্জয়।”
আমার মন তখন এমনিতেই অস্থির; বিব্রত কণ্ঠে বলি, “অসময়ে?”
“ওই যেমন সকালে ঘুম থেকে উঠে, বা অফিস ফেরত বাসে। এগুলো তো অসময়-ই হল! নাকি?”
“ডাক্তার দেখিয়েছিস?” বলেই মনে হল গোলাপ গাছগুলোর কোনো ডাক্তার পাওয়া যায় না? এক মনে ভাবতে লাগলাম পরশু নতুন কুঁড়িগুলো সন্ধ্যের হালকা বাতাসে দুলছিল। আমি এক একবার আদরে হাত বুলিয়ে দিয়েছিলাম ওদের উপরে। ভেবেছিলাম এরা আরো বড় ফুলের রূপ নেবে কোনো একদিন আর সেদিন আবার সমস্ত বন্ধুদের ডেকে এই ছাদে বসাব এক অভিনব গানের আসর।
সেই কুঁড়িগুলো আজ আগুনে পোড়া, ভঙ্গুর বিকট রূপে একইভাবে হাওয়ায় দুলছে। সামান্য আঙ্গুলের চাপে গুঁড়ো হয়ে ভেসে যাবে অদৃশ্য কোনো জগতে।
হায়! আমার সাধের গোলাপ বাগান।
সম্বিত ফিরতে দেখি সুধীর এক দৃষ্টে চেয়ে আছে আমার দিকে।
“আচ্ছা সঞ্জয়, চোখের সামনে হঠাৎ এমন কিছু যদি এসে যায় যা তোর কল্পনার বাইরে। কল্পনা কেন? ধর, চিন্তা ভাবনার বাইরে। তোর মনে তার কিরকম প্রতিক্রিয়া হবে?”
আমি চমকে উঠি। ওকি জানে আমার গোলাপদের কথা?
কিছুটা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “কি দেখার কথা বলছিস?”
সেদিন এর বেশি কিছু বলেনি সুধীর… সামনের একটা চেয়ার টেনে বসে পরে। কিছুক্ষণ পরে দেখি অঘোরে ঘুমিয়ে পড়েছে।
আমি ধীরে ধীরে ছাদে চলে আসি।
গোধূলি লগ্নে আকাশে পাখির মেলা, গাছে গাছে অন্ধকার বাসা বাঁধছে। আমি অনেকক্ষণ তাকিয়ে ছিলাম সেদিকে। চোখের কোণ দিয়ে দেখা মৃত গাছেদের অবয়ব কেন জানি না মনে অজানা এক ভয়ের সঞ্চার ঘটিয়েছিল।
জীবন বড় বিচিত্র। আর মানুষ জন্ম তার সাথে নিয়ে আসে জটিলতা। যারা জীবিত অবস্থায় ভালবাসার প্রতিমূর্তি ছিল; তারা মৃত হয়ে ত্রাস নিয়ে এলো।
এ এক অদ্ভূত কবিতা।
নিচে ফিরে এসে দেখি সুধীর চলে গেছে।
সেদিন ছিল শনিবার…
এরপরের কয়েকটা দিন আমার ব্যস্ততায় কেটে যায়।
অফিস একটা আছে, মাঝেসাঝে যাই। আমার কোনো কালেই উচ্চাশা নামের জিনিসটা নেই। কোনো কোনো মাসে বেতন কেটে দেয় অনিয়মিত হওয়ার জন্য। আমি তেমন পাত্তা দিই না। ভাবছেন এমন চাকরি টিকে আছে কি করে?
টিকে আছে বোধহয় আমার ভাগ্যের জোরে, বা যার সুবাদে চাকরিটি পেয়েছিলাম তার আশীর্বাদের ফলে। সেটা অন্য কাহিনী এখানে বলে কাজ নেই।
এই কটা দিন প্রচুর লোকেদের সাথে দেখা করেছি, বন্ধুরা এসেছে। বিস্তর সান্ত্বনা পেয়েছি। অকৃতদার মানুষের জীবনে সান্ত্বনা দেবার লোকের সংখ্যা বেড়েই চলে। তারপর একদিন হঠাৎ সহানুভূতির কলসি শুকিয়ে গেলে আমাদের মতন জীবেরা বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যায়। এটাই হয়ত নিয়ম।
কয়েকজন মালী ডেকে এনেছিলাম। ওরা মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে চলে গেল। এরপর জোগাড় করি কয়েকটা বাগান শিল্পের উপরে লেখা বই। অনেক খুঁজেও এই দুরারোগ্য গোলাপ ব্যাধির হদিস পেলাম না। এতেও থামিনি, দু একজন বিশেষজ্ঞ খুঁজে দেখা করলাম। একজন তো আমার ছাদে এসে নিরীক্ষণ করেও গেলেন। কোথাও কোনো সুরাহা হল না। ভদ্রলোকটি গাছগুলোর দিকে অপলক চোখে তাকিয়ে রইলেন প্রায় পনের মিনিট। তারপরে এক অবর্ণনীয় ক্রোধে ফেটে পড়লেন! আমি তটস্থ হয়ে শুনে গেলাম ওনার কথাগুলি। বোঝাবার চেষ্টা করলাম, আমার কোনো হাত নেই এই পরিণতিতে। আমি তো এদের নিজের সন্তানের মত ভালোবেসে এসেছি।
এ যে আমার রঙ্গিন জীবনের মাঝে দুর্বোধ্য ধুসর এক অংশ!
আমার মনে হয় উনিও আমারই মতন একজন প্রকৃত গোলাপপ্রেমী মানুষ ছিলেন।
(দিনলিপি পাতা নং:- ২)
সুধীরের ফোন আসে আরো কয়েকদিন পর।
জড়ানো গলায় বলে ওর নাকি জ্বরটা বার বার আসছে …
আমি ওকে আমার বাড়িতে আসতে বলাতে চুপ করে থাকলো বেশ কিছুক্ষণ। শেষে বলল চেষ্টা করবে।
সেদিন ও আসেনি। এসেছিল আরো দু’দিন পর।
আবার শনিবার।
সকালবেলাটা যেন কোন মতে শীত ভুলতে শুরু করতেই, দেওয়ালে ছড়ানো সূর্যের আলোগুলো সবুজ পাতাদের সাথে সজীব নকশা কেটে আমার মনের মধ্যে জ্বর বিকারগ্রস্ত বন্ধুর প্রলাপগুলোকে আরো প্রাঞ্জল করে তুলেছিল।
এ এক অদ্ভুত অনুভূতি! একটি নিঃস্পৃহ মনে “হোক না যা চলছে” ভাব ধারণার সাথে, ভালো লাগার উৎকট মেলবন্ধন গড়ে উঠেছে।
আমার আজ কোনো কাজ নেই, কাজ করার তেমন ইচ্ছেও নেই, অথচ আজ আমাদের অফিসে সবাই কাজ করছে। আমি যাই নি এর কোনো কারণও নেই। পরশু যখন বসের বিকৃত মুখ দেখব, তখন ভ্যান গঘের কথা ভাবব — “যারা আলু চষেছিল”।
(সেল্ফ ইনফ্লিকটেড এগনি)
কাজের একটা লোক আছে। খেয়াল খুশি মত আসে। ওকে বলা থাকে যদিও যে সকালে আমি অফিসে যাই, তবুও মাঝে সাঝে ও চলে আসে। এই যেমন আজ এসেই বলল, “ঘর জুড়ে আপনার এত ধুলো, থাকেন কি করে?”
অথচ কোথাও তেমন ধুলো নেই। সন্ধ্যেবেলায় ফিরে আমি ঘরদোর পরিষ্কারই রাখি।
“আমাকে একটু ঘুমাতে দাও, তুমি যা করার কর”
আমি পাশ ফিরে শুয়ে পড়ি।
এই যে মানুষের একটা প্রবৃত্তি একই কথা নিয়ে দিন রাত অকারণে ঘ্যানঘ্যান করা। এটা আমার ভালো লাগে না। পরিচ্ছন্নতা আমার রুচির সাথে ওতপ্রোতভাবে এক হয়ে আছে। মনে পড়ে ছোটবেলায় এই পরিষ্কারের বাতিক নিয়ে কত লোক কথা শুনিয়ে যেত। তবুও কোনো জিনিষ তার নিজস্ব জায়গা থেকে সরে গেলে আমার আজও বিরক্ত লাগে। ধুলোর পরত, এলোমেলো বিছানা বা ছড়িয়ে রাখা জামাকাপড় কোনদিনও মন মেনে নিতে পারে নি।
তাই “চারদিকে ধুলো!” আমার কাছে বাজে কথা ছাড়া আর কিছু নয়।
বরং সুধীরের কথাগুলো নিয়ে ভাবা দরকার। দুপুর নাগাদ ও আসলো। আমি বুঝতেই পারিনি কাজের লোকটা কখন চলে গেছে। দরজা খোলা।
চোখ মেলে দেখি সামনের চেয়ারে ও বসে আছে।
আপনাদের সত্যি কথা বলব। কখনো আমার মনে হয় ও যেন রক্তমাংসের কেউ নয়। ওর আসা, যাওয়া, কথাবার্তার ধরন সব কেমন বিজাতীয়। আমি আজ ভাবি সুধীরকে আমি কবে থেকে চিনতাম? ওদের বাড়িতে আমি কতবার গিয়েছি? ওর মা, বাবা, ভাই, বোন কে কে আছে? আমি কি এসব ঠিক মতো জানি?
ওর আঁকা ছবিগুলোর কথাই ধরুন। ওসব কি সাধারণ কোনো মানুষের কাজ? যেমন একটার নাম দিয়েছিল “দুই পৃথিবী”। ক্যানভাসে তুলে ধরা দুটো ভিন্ন জগত। যথার্থ অর্থ বহন করে। ছবিটার একটা মজা হল, যেদিক দিয়েই দেখবেন মনে হবে দুটো পৃথিবী বা জগত একে অপরের সাথে জুড়ে আছে অথচ তারা যেন ভিন্ন মাত্রায় বিরাজ করছে।
দুদিকেই গাছ, মাটি, পাখি, নদী, তুষারশৃঙ্গ মাথা তুলে আছে নীল আর কমলা আকাশের দিকে। তবে তাদের ভালো করে দেখলে বৈচিত্র্যগুলো বোঝা যায়।
ছবির সূক্ষ্ম ব্যতিক্রমগুলো শিল্পীর মুনশিয়ানায় অপূর্ব রূপ নিয়েছে। যদি এই পৃথিবীর নদী দক্ষিণমুখী, আর এক জগতে সে উত্তরে ধেয়ে চলেছে। পাখিরা একদিকে ফুলের মধু আহরণে ব্যস্ত, অন্য দিকে তারা শুধুই পতঙ্গভুক। এমন আরো কত কি। এক জায়গায় একটা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে সামনের নদীটির দিকে চেয়ে। অন্যদিকে আর একজন উল্টো দিকে পাহাড় দেখছে। শিল্পী কিছু জায়গায় মাত্রাগুলো পর্যন্ত বদলে দিয়েছে। একদিকে যদি মানুষের উচ্চতা, তার চারিধারের প্রাকৃতিক বিষয়বস্তুর সাথে অপেক্ষিক, অন্যদিকে সেরকম নয়। কোথাও ফুলের আকার ভ্রমরের সাথে মানানসই, আবার অন্যদিকে ভ্রমর যেন ফুলের অস্তিত্বের থেকে বেশি মাত্রায় প্রকট।
জিজ্ঞেস করলাম “তুই কতক্ষণ?”
“তুই কি জেগে আছিস?”
আমি ধীরেসুস্থে উঠে বসি।
বললাম, “ঘুমিয়ে ছিলাম, এখন জেগে আছি।”
সুধীর একটা কাগজ আমার দিকে এগিয়ে দিল।
(দিনলিপি পাতা নং:- ৩)
কেটে গেছে বেশ কয়েকটা মাস। বর্ষার জল এসে ধুয়ে দিয়ে গেছে আমার সাধের বাগান। শূন্য টবগুলোয় আর নতুন কিছুর জন্ম দেবার ইচ্ছা হয় নি। তবুও এখনো আমি ওদের সামনে গিয়ে বসি, মাটিগুলো নেড়েচেড়ে দেখি। কোনো রাতে তীব্র শিষের আওয়াজে ঘুম ভেঙ্গে গেলে, রাতজাগা পাখিদের ডানায় লাল গোলাপের রঙ স্বপ্নের ঘোরে কল্পনা করে চলি। এক রাত্রে ঘুম বা জেগে থাকার মাঝামাঝি এক স্তরে সুধীরকে দেখলাম। আমার জানালার বাইরে হাওয়ায় ভাসছে। বিমূর্ত কোনো শিল্পীর ছবির মতন। “দুই পৃথিবী” -র মাঝখানে আমি একলা মূক, বধির কোন সত্ত্বা। নিজের অজ্ঞাতে তার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়েছি আর সে অপার্থিব এক কুয়াশায় একটু একটু করে গলে মিশে গেছে আমার চোখের সামনে। নাকি আমার স্বপ্নের অন্য দিকে? আমি বুঝতে পারি না।
এই ক’মাস অফিসে প্রায় যাইনি বললেই চলে। ছুটি সব শেষ। এখন বেতন কাটা যাচ্ছে। কাটছে তো কাটুক। আরো কয়েকমাস চালাবার মতন রসদ এখনো আমার আছে।
আপনারা ভাবতে পারেন, এসব লিখে রাখার অর্থ কি? আমি তো আর বই ছাপাবো না? বা এ দিয়ে কোন মানুষের কোন উপকারের সম্ভাবনাও নেই। তাও লিখে রাখছি এই ভেবে যে, কোনদিন যদি কেউ পড়েন তবে বুঝবেন আমার জীবন কত বিচিত্র পথে বয়ে গেছে বল্গাহীন নদীর মতন। আমি নিজের মধ্যে সজ্ঞানে রচনা করেছি আরো ব্যাপ্ত এক জগতের; যা সংখ্যা, সময়, শূন্যতার মত অসীম… কোন শুরু নেই, কোন শেষ নেই।
(দিনলিপি পাতা নং:- ৪; চিঠি)
“সঞ্জয়,
দেখ যা বলব তা মনের বিকার নয়। আমার দেহ অসুস্থ হয়ত হতে পারে, তবে মনের ভেতরে যে বাস করে সে এখনো পূর্ণমাত্রায় সুস্থ। তোকে মনের ভেতরের কথা বললাম কারণ আজকাল আমি জীবন, সমাজ, জ্ঞান ও চেতনার ভেতরের রূপ দেখতে পাচ্ছি। শুধু আমার জ্বরটা অতিমাত্রায় বিরক্ত করছে।
শুরু থেকে শুরু করি যাতে তুই বুঝতে পারিস, না হলে তোর বার বার ডাক্তারি উপদেশ আমার কাছে অসহ্য হয়ে পড়েছে। ঘটনাটা শুরু হয় কবে সময়টা আমার মনে নেই। তুই জানিস আমার সন-তারিখ, ডান-বাম ইত্যাদি মনে থাকে না। এটা রোজ অল্প অল্প করে বাড়ছে।
এক সন্ধ্যাবেলায় প্রথম বুঝি তীব্র জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে। কোনমতে উঠে এক গ্লাস জল নিয়ে এলাম পাশের ঘর থেকে। সারা মাথা জুড়ে কি ভীষণ যন্ত্রণা। চোখ দুটো যেন সেই যন্ত্রণার চাপে ছিটকে বেরিয়ে আসবে কোটর থেকে।
দু’হাতে মাথা চেপে ধরে পায়ের আঙ্গুল পিষে চলেছি। হঠাৎ দেখি সামনে একজন বসে আছে! ভাবতে পারিস কি রকম অবস্থা আমার হয়ে গেছিল সেদিন? একদিকে অসহ্য মাথার ব্যাথা অন্যদিকে এক চূড়ান্ত অসম্ভব ঘটনা!
আমি হয়ত কয়েক মুহূর্তের জন্য সমস্ত ব্যথা বেদনা ভুলে গেছিলাম। চেয়ে রয়েছিলাম লোকটার দিকে। আমি কিন্তু অবাক হয়েছিলাম বললে সত্য বলা হবে না, বরং বলা উচিত ভয় পেয়েছিলাম। বন্ধ ঘরের ভেতরে সামনের চেয়ারের বসে একজন মানুষ আমাকে দেখছে। তোর কি মনে হয়? এই রকম পরিস্থিতি, তুই কিভাবে মেনে নিবি?
যাই হোক, আমি কোন মতে উঠে বসে জিজ্ঞেস করলাম সে কি করে ঘরে এলো। পরিবর্তে কি করলো জানিস? চেয়ার ছেড়ে উঠে দরজা খুলে বেরিয়ে গেল। কোন কথা নয়, কোন অভিব্যক্তি নেই, নিষ্প্রাণ দুই চোখ মেলে ধীর, স্থির পদক্ষেপে উঠে চলে গেল। ও বেরিয়ে যেতেই মাথার যন্ত্রণা ভোজবাজির মত উড়ে গেল। দেখি জ্বরটাও আর নেই।
ওই শুরু। প্রতিবার আমার জ্বরের মুহূর্তে ও এসেছে। দেখেছে। তারপরে মৃত মানুষের শরীরে যেন অলৌকিক প্রাণের ছোঁয়া লাগে, সে উঠে বেরিয়ে যায়।
আমাদের মতন আর কতজন মানুষ আছে বলতে পারিস? মানে একই ছাঁচে বানানো। শুধু দেখতে এক নয়; হাবভাব, দৃষ্টি, আচরণ, শরীরের ভাষা অবধি এক।
কে সৃষ্টি করে এদের? এই বিশাল পৃথিবীতে এরকম খেলা খেলে কার কি সুখ? নাকি সবই কাকতালীয়? কোথাও কোনো একটা ছক আছে নিশ্চয়। এসবের কোনো কারণ থাকবেই, যা আমার মতন সাধারণ মানুষের চিন্তা ভাবনার বাইরে।
সকালে ফুল ফোটে, রাত্রে সবুজ ঘাসের উপরে শিশিরের প্রলেপ, হাওয়ায় বয়ে আনে অজানা সুবাস, কোনো নাম না জানা শব্দ ইত্যাদি কি সবই অকারণে? আমি তোকে লিখে যা বোঝাবার চেষ্টা করছি, সেটা তোর সামনে বসে হয়ত বলে বোঝাতে পারতাম না। এও এক বিচিত্র রহস্য, মানুষের ইচ্ছা তার গতিপথ অনেক সময় নিজের পছন্দমত বেছে নেয়। আবার সেই মানুষই ভাবে, কেবলমাত্র তার সত্ত্বাই অবিনশ্বর। বাকি সব ভ্রম মাত্র।
আমি এই জ্বরজারির পরে নিজের অনেকগুলো রূপ হাটেবাজারে বার বার দেখে এসেছি। চায়ের দোকানে, সবুজ বাগানে, কর্মব্যস্ত রাস্তার সংযোগস্থলে, আমার বাড়ির সামনের গলিতে। সর্বত্র! সব চেয়ে অবাক হয়েছি যখন বুঝলাম, ওরা কেউ আমাকে পাত্তা দিচ্ছে না। ওদের দেখে বিচলিত কেবল আমি !
একদিন দেখি বাসস্ট্যান্ডের সামনের চায়ের দোকানে একজনকে। একই ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে অলস ভাবে চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছে। ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলাম। আসেপাশে সেদিন লোকজন কম ছিল। আর একটু এগোতেই সামনের চলন্ত একটা বাসে উঠে পড়লো। আমি নিজেকে পেলাম ঠিক সেখানে, যেখানে সে দাঁড়িয়েছিল একটু আগেই।
জানি এসব তোর বিশ্বাস হচ্ছে না। তবুও জেনে রাখ এর এক বর্ণও মিথ্যে নয়। নিজেকে বার বার নিজের সামনে দেখার যে অব্যক্ত যন্ত্রণা সেটা শুধু আমি নিজের ভেতরে বয়ে বেড়াচ্ছি উন্মাদের মতন, অথচ আমার মনের মধ্যে কোনো বিকার নেই।
এর মাঝে মাঝে নিয়মিত জ্বরটা এসেছে। এসেছে সেই লোকটাও। এসব ঘটনার কোনো অর্থ বা যুক্তি আমি খুঁজে পাইনি। একবার ভেবেছিলাম হয়ত নিজের অজান্তে পাগল হয়ে যাচ্ছি। তাই শহরের নামজাদা মনো-বৈজ্ঞানিকের কাছে গিয়েছিলাম মনে আশা নিয়ে। উনি সব কিছু শুনে এমন কিছু ওষুধ লিখে দিলেন যা আমাকে সম্পূর্ণ নিস্তেজ করে দিল। না পারি ভাবতে, না পারি বুঝতে। জড় বস্তুর মতন দুদিন বিছানায় শুয়ে কাটালাম। খেতে ইচ্ছে করত না ,বাইরে বেড়াতে মন চাইতো না। ওহ ! সে কি বিরক্তিকর অবস্থা। জানালা দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিলাম অপদার্থ ওষুধগুলোকে।
এরপর শুরু করলাম পড়াশুনো। নানা জায়গার থেকে মনরোগ বিষয়ক বই নিয়ে আসলাম। ছোট বড় প্রচুর বই পড়তে পড়তে বুঝলাম আমার মনের কল্পনা (আমি তখনও আশাবাদী) বা যাকে আমি ভাবছি বাস্তব, সেই ব্যাপারটির কোনো যুক্তিযুক্ত বিশ্লেষণ আমি খুঁজে পাচ্ছি না। এক রনসন সাহেবের মনোরোগ বিষয়ক বইয়ের কিছুটা পড়ে বুঝলাম, এ ভাবে চললে হয়ত বা পাগলামির থেকে আরো এক ধাপ উপরে উঠে কোনো গর্হিত কাজে লিপ্ত হয়ে যাব। একপ্রকার ভয় পেয়েই এই পড়াশুনার কাজেও ইস্তফা দিলাম।
আমার এইসব কথাবার্তায় তোর মনে কি রকম প্রভাব সৃষ্টি করছে জানতে ইচ্ছে করে।
তখন আমার এই জটিল অবস্থা। দুরারোগ্য ব্যাধির মতন দেহমনকে আক্রান্ত করে ভেতর থেকে আনন্দ, উত্সাহ বা এই জাতীয় সাবলীল সুখ চিন্তাগুলোকে ধ্বংস করতে সুরু করে দিয়েছিল। কিছুই ভালো লাগত না। বাইরে বেরোলে নিজেকে দেখি। ঘরে থাকলে জ্বরে ভুগি। দৈবের প্রতি তো কোনদিন ভক্তি শ্রদ্ধা ছিল না। থাকলে একটা ভরসা বোধহয় পেতাম। তাও একদিন দেখি নিজের অজান্তে ভগবানকে স্মরণ করছি।
এভাবেই চলত, যদি না এক রাতে জ্বরের ঘোরে প্রথমবার শুনি কেউ বলছে, “ওকে ছুঁয়ে দেখো, ওকে দিয়ে দাও।”
ভ্রমরের গুঞ্জনের মত গুন গুন অনুরণন মাথার ভেতরে বার বার ঘুরতে থাকে।
“ওকে ছুঁয়ে দেখো, ওকে দিয়ে দাও।”
আমার আর কিছু করার ছিল না।”
(দিনলিপি পাতা নং:- ৫)
এখন আমার প্রচণ্ড জ্বর।
(দিনলিপি পাতা নং:- ৬; শেষ পাতা)
আমি হাটেবাজারে প্রায়ই নিজেকে দেখতে পাই। ওদের ধরতে গেলে বুঝি, ধরা সম্ভব নয়। আসলে ওরা আমার অস্তিত্বের হাজার ছায়া। আমার শরীরের থেকে ওদের জন্ম, ওদের মৃত্যু আমারই শরীরের ভেতরে। আর জ্বরের প্রকোপে যাকে দেখি, আমার দিকে নিশ্চল চোখে চেয়ে আছে। সে সৃষ্টি করে আমার আসল ‘আমি’-কে। এক নতুন ‘আমি’ জন্ম দেয় আমার অন্য সত্ত্বাদের।
(৩)
ড.স্কভের রিপোর্ট (বিশ্লেষণ)
দ্বিতীয় মেইলের শেষে পাওয়া ড. স্কভের বিশ্লেষণ :
“সর্বপ্রথম জানিয়ে রাখি, আমি সাবজেক্টকে সামনে বসিয়ে নিরীক্ষণ করেছি। কোথায় ও কিভাবে তার বিবরণ এখানে অপ্রয়োজনীয়। সাবজেক্ট অর্থাৎ, সঞ্জয় বোস বর্তমানে আমার চিকিৎসাধীন। মেডিকেশন প্রণালী ও ওষুধ বিশ্লেষণের নিচে লিখে দিলাম কেস স্টাডি হিসেবে তোমার যদি কাজে লাগে।
আমার প্রাথমিক বিশ্লেষণ : সঞ্জয় বোস এবং সুধীর গুহ , এক এবং অভিন্ন ব্যক্তি।
প্রমাণ : ১) চিন্তা ভাবনার সামঞ্জস্য।
২) সঞ্জয় বোস নিজে একজন চিত্রশিল্পী।
৩) সাবজেক্ট কোনোদিন চাকরি করেননি। (তথ্যে প্রমাণিত)
৪) সুধীর গুহ এবং সঞ্জয় বোসকে একসাথে কোনো দ্বিতীয় ব্যক্তি দেখেনি। (আত্মীয় ও বাড়িওয়ালার থেকে প্রমাণিত, আত্মীয় বলতে এক কাকার ছেলে)
৫) ডায়েরিতে বারবার জিজ্ঞেস করা “তোর মনে কিরকম প্রতিক্রিয়া হবে”, এতে অবচেতন মনের সীমাবদ্ধতা পরিস্ফুটিত হয়েছে। যা ভঙ্গুর চিন্তাভাবনার পরিচায়ক।
৬) ছাদের উপরের গোলাপবাগান বাড়ির মালিকের নিরীক্ষণে থাকে। তাতে কোনো বড় মাপের বিপর্যয়ের প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
৭) গোলাপবাগানটি শিল্পীর “দুই পৃথিবী” ছবির পরিপূরক। একদিকে সৌন্দর্য, অন্যদিকে ধর্মী মনোভাবের প্রতীক।
কারণ :
১) বর্তমান যুগের পরিস্থিতি ও পরিবর্তনের ফল স্বরূপ চিত্র শিল্পীর ছবির কদর বাজারে পরে গেছিল।
২) সৃষ্টির সুখ মানুষকে উত্সাহ দেয়। সেখানে সৃষ্টি যদি গৃহবন্দী হয়ে থাকে ও মানুষের কদর না পায়, তাহলে শিল্পীর সংবেদনশীল মনে তার শক্তিশালী প্রভাব পড়তে পারে।
৩) সুধীর নামের চরিত্রের অবতরণ, নিজের না পাওয়ার যন্ত্রণাকে হয়ত ভুলতে সাহায্য করেছিল। তবে সেটাও সাবজেক্টের হতাশ মনোভাবের সাথে পরের দিকে ওতপ্রোতভাবে জুড়ে যায়।
৪) নিজের হাজার রূপ দেখা ও তার পেছনে দৌড়ানো, স্বপ্নভঙ্গের লক্ষন বিশেষ। সাথে শোনা গেছে বাজারে ওনার ধারদেনাও বেড়ে উঠেছিল।
৫) জ্বরের ঘোরে অন্য অবয়ব দেখা ও যন্ত্রণার নিদান পাওয়া, নিজেকে নতুন করে গড়ে তোলার ইচ্ছে হতে পারে।
সঞ্জয় বোস দুদিন আগে ভারতবর্ষে ফিরে গেছেন। তুমি চাইলে তার সাথে দেখা করতে পার। একইরকম মানসিক রোগী আমি অস্ট্রিয়া ও কলম্বিয়াতেও পেয়েছি। তবে তাদের জ্বরের সমস্যা হয়নি। সেদিক দিয়ে এই কেসটি আলাদা।
আমার কিছু পুরনো ভাবাদর্শে যে ধাক্কা পৌঁছেছে, সেটা তোমার যুক্তিবিদ মন কিভাবে মেনে নেবে তা আমার ধারণার বাইরে। তাই আমি চাইব তুমি ভদ্রলোকের সাথে একবার দেখা করো। উনি এখন ওনার ভাইয়ের তত্ত্বাবধানে আছেন।
উপরের বিশ্লেষণ শুধু আমার বিজ্ঞান-মনস্ক চিন্তাভাবনার পরিচায়ক। তবে এখনো অনেক কিছু বিজ্ঞানের বাইরে বর্তমান। সেসব নিয়ে শিক্ষিত সমাজে আলোচনা বাতুলতা মাত্র।
ওষুধের বিবরণী :…”
(৪)
উপসংহার ও পরিণাম :
উপরোক্ত রিপোর্টে শ্রী সঞ্জয় বোস এবং ড. রঞ্জন মিত্রের শোচনীয় পরিণতির প্রতি আলোকপাত করা হয়েছে ।
২১/০১/২০১৫ : শ্রী সঞ্জয় বোস আত্মহত্যা করেন।
কারণ – মানসিক ব্যাধি ও সম্ভবত পরীক্ষামূলক ওষুধের পার্শ-প্রতিক্রিয়া।
০২/০২/২০১৫ : ড. রঞ্জন মিত্রের আত্মহত্যার প্রচেষ্টা।
কারণ : মানসিক বিকার (পুনরায় একই কথা বলা -“আমি নিজেকে নানা জায়গায় দেখতে পাই” ও “আমার এখন জ্বর এসেছে”)
রিপোর্ট সমাপ্ত
Tags: আমার এখন জ্বর এসেছে, দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য (চিত্রচোর), প্রথম বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা, সঞ্জয় বোস