আরশোলার দুধ
লেখক: অমিতাভ রক্ষিত
শিল্পী: সুপ্রিয় দাস
(১)
বিদগ্ধ পাঠক: এ আবার কী! আরশোলার আবার দুধ হয় নাকি? যত্ত সব চিপ, সেন্সেশনাল জার্নালিজম!
লেখক: হা হা, পাঠক, আপনি আমার আসল উদ্দেশ্যটা ঠিক বুঝেছেন। তবে একটু সেন্সেশনাল করে নাম না দিলে কি আর আমার মতন একজন অজ্ঞাত, অখ্যাত ও অখাদ্য লেখকের লেখা কেউ পড়বে? অন্য কেউ হলে তো আমি নিজেই পড়তাম না! এরকম কত লেখক কলকাতার অলিতে গলিতে ঘুরে বেড়াচ্ছেন! তাই আমাকে যখন প্রথম ডা: বরুণ দেব-এর কর্মজীবনের ইতিহাস সম্বন্ধে কিছু লিখতে বলা হল, তখন আমি যে শুধু অবাকই হয়ে গেলাম তা নয়, ভীষণ চিন্তাতেও পড়ে গেলাম। কী করে আমি তাঁর স্মৃতির প্রতি যথার্থ শ্রদ্ধা জানাব? প্রথমেই তো আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল: “এ কী কথা? আমি কেন? কত বড় বড় পুরস্কার পাওয়া লেখক-সাংবাদিক আছেন, তাঁরাই তো ওঁর কথা লেখবার পক্ষে অনেক বেশি উপযুক্ত”!
বক্র হাসিমুখ থেকে উত্তর এল: “বেশি ন্যাকামি করবেন না মশায়, তাহলে প্রবুদ্ধ মুন্সীকে গিয়েই বলা হবে। নেহাত বরুণবাবু তাঁর সুইসাইড নোটে বিশেষ করে আপনাকেই এই দায়িত্বটা পালন করতে দিতে অনুরোধ করে গিয়েছেন তাই! আমাদের সম্পাদক বললেন, ‘ওকে দিয়েই আগে লিখিয়ে দেখ; বেশি ভালো না উতরালে তখন না হয় আবার অন্য কোনও লেখককে বলা যাবে’। তাড়াতাড়ি আপনার যা লেখার লিখে দিন, অযথা বিনয় করবেন না।”
আমার লেখনীশক্তির এমত অনুমোদন পেলে কি আর তা প্রত্যাখ্যান করা যায় কখনও? তাড়াতাড়ি গেঁটে বাত উপেক্ষা করে আঙুলগুলোকে সম্প্রসারিত করে, কী-বোর্ড নিয়ে কাজে নেমে পড়লাম – আজকাল কি আর কলম দিয়ে কিছু কাজ হয়?
ও হ্যাঁ, আরশোলার কিন্তু সত্যি সত্যি দুধ হয় – সে অনেক গল্প। “ডিপ্লপ্টেরা পাঙ্কটেট্” বলে একধরণের আরশোলা, ডিমের বদলে একসঙ্গে অনেকগুলো জ্যান্ত সন্তান প্রসব করে। প্রসবকালে সবকিছু মিলিয়ে নাকি সেগুলোকে দুধের মতন দেখতে হয়! শুনেছি গোরু-মোষের দুধের তুলনায় সেটা অনেক বেশি পুষ্টিকর। কিছু কিছু বৈজ্ঞানীকেরা আবার স্বপ্নও দেখেন–ওই দুধের চাষ করে পৃথিবীর অনাহারী লোকজনদের জন্য ভালোরকম পুষ্টির ব্যবস্থা করে দেবার! তা, প্রবুদ্ধ মুন্সীই না হয় এই বিষয় নিয়ে বিস্তারিত ভাবে কিছু লিখুন। আমি এক্ষুণি খেয়ে উঠেছি।
কিন্তু ডাঃ বরুণ দেবের মতন একজন লোকের কথা আর নতুন করে কী বলব? আমাদের দেশে যুগে যুগে তো অনেক বৈজ্ঞানিকই জন্মেছেন যাঁদের চিন্তাধারা ও কাজ তাঁদের জীবনকালে তেমন সমাদৃত হয়নি। শেষ পর্যন্ত তাঁদের নিজেদেরই “মরিয়া প্রমাণ করিতে হইয়াছিল” যে তাঁরা সত্যিই অসাধারণ প্রতিভাবান ছিলেন। এই যেমন ধরুন ডাঃ সুভাষ মুখোপাধ্যায়১। বরুণ দেব অবশ্য প্রথমেই সুইসাইড করে বসেননি। আগে তিনি আমেরিকায় পালিয়ে যান। কিছুদিন ভারতে অধ্যাপনার পর যখন তিনি তা ছেড়ে পুরোপুরি গবেষণায় নিযুক্ত হতে চান, তখন ভারতের কোনও নামকরা পরিবেশ-সমস্যা সমাধান প্রযুক্তির গবেষণা কেন্দ্রই তাঁর চাকরীর আবেদনে সাড়া দেয় না। শেষে ছোট এক সংস্থা তবু তাঁকে সুযোগ দিতে রাজি হয়। কিন্তু তাদের মাধ্যমে পেশ করা তাঁর সব গবেষণার প্রস্তাবই বিভিন্ন অর্থ-অনুমোদনকারিরা হয় অস্বাভাবিক, নয় অকার্যকর বলে একের পর এক প্রত্যাখ্যান করে দেয়। তখন রাগের মাথায় তিনি সামান্য একটি দ্বিতীয় শ্রেণীর আমেরিকান কলেজে পরিবেশ বিজ্ঞানের অধ্যাপক হয়ে ভারতবর্ষকে রাতারাতি পৃষ্ঠপ্রদর্শন করেন। সে বহুদিন আগের কথা। কিন্তু তারপরে কী হল সেটা নিয়েই আমার এই আরশোলার দুধের প্রতিবেদন।
(২)
বরুনবাবু সবসময়েই একটু বড় বড় কথা বলতেন। আমেরিকায় গিয়েও তার ব্যাতিক্রম হয়নি। কেবল কফি হাউসের দৈনন্দিন আড্ডার বদলে তাঁর আসর ছিল প্রধানত উইক-এন্ডের অন্যান্য অভিবাসীদের ভোজন পার্টিতে। সকলেই জানেন, মানে এখন তো প্রায় সব ভারতীয় পরিবারেরই কেউ না কেউ প্রথম বিশ্বের কোনও না কোনও দেশের স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে গিয়েছেন, তাই বলছি, বিদেশের অভিবাসী-জীবনের একটা অপরিহার্য অঙ্গ হল সপ্তাহান্তে কারুর না কারুর বাড়িতে জমায়েত হয়ে অন্তত পনেরো-কুড়িটা পরিবার মিলে রন্ধন, চর্বন (খাদ্য এবং যাঁরা উপস্থিত নেই, তাঁদের চরিত্র), আস্ফালন ও ভোজন।
এই রকমই এক ভোজন পার্টিতেই কিন্তু, একদিন শেষ পর্যন্ত বরুনবাবুকে তাঁর স্বেচ্ছা-নির্বাসন ছেড়ে বেরিয়ে আসতে হল। ঘটনাটা ঘটল এইভাবে: একদিন এক প্রথম শ্রেণীর শহরের এক প্রথম শ্রেণীর কলেজের স্নাতকোত্তর ছাত্র, যে তখন পরিবেশ বিজ্ঞান ও আবহপ্রযুক্তিতে (গালভরা নাম!) পিএইচডি করতে ব্যাস্ত, সে তার বাগদত্তা প্রেমিকাকে নিয়ে বরুনবাবুর শহরে তার হবু মাসিশ্বাশুড়ির বাড়িতে বেড়াতে এল। ছেলেটি সম্ভবত তার মাসিশ্বাশুড়িকে সকলের সামনে তার অর্জিত জ্ঞানের গভীরতা জানাতে একটু বেশিরকম ভাবে চেষ্টা করছিল। সে বিশদ ভাবে সকলকে বোঝাতে শুরু করল যে পৃথিবীর সামনে এখন কত রকমের আবহ সম্পর্কিত অস্তিত্ব সংকট। কেবল তার মতন আবহপ্রযুক্তিবিদেরাই শেষ পর্যন্ত জগৎটাকে বাঁচাবে, তা না হলে মনুষ্য সমাজ এখন নিশ্চিত ধ্বংসের পথে! অনেকেই, বিশেষ করে যাঁরা একটু বয়ষ্ক, কিংবা আবহ বিজ্ঞানে যাঁদের তত উৎসাহ নেই, তাঁরা কিছুটা নির্লিপ্ত ভাবেই ছেলেটির আস্ফালন লক্ষ করে যাচ্ছিলেন। বরুনবাবুও চুপচাপ করে সব কিছু শুনে যাচ্ছিলেন। কিন্তু বরুনবাবু নিজে একজন আবহবিদ জানতে পারার পর থেকেই ছেলেটি ক্রমাগত তাঁকে উদ্দেশ্য করেই সোজাসুজি খোঁটা দিতে শুরু করল। “আপনারা তো নামেই আবহবিদ। দূর! পৃথিবীর আবহাওয়ার এই দুরবস্থার জন্য তো আপনাদের জেনারেশনই দায়ি মশাই! যখন প্রথম তাপমাত্রা বাড়তে শুরু করেছিল তখন কি নাকে-কানে সরষের তেল দিয়ে ঘুমোচ্ছিলেন নাকি? অ্যাক্টিভলি একটা কিছু করবার কথা কি ভেবেছিলেন কখনও? এখন তো দিব্যি চোখমুখ গুঁজে এমন একটা জায়গায় পড়ে আছেন যে দশটা-পাঁচটা কলেজ করে আর পঞ্চাশ বছরের পুরানো নোটগুলোকে দিয়ে ক্লাশ পড়িয়েই আরামে জীবনটা কেটে যাচ্ছে! আর এদিকে পরিবেশের অবস্থা তো যা হতে শুরু করেছে তাতে তো পৃথিবীটা আর কতদিন টিকবে তা বলা মুস্কিল!”
বরুনবাবু অবশ্য এই প্ররোচনাতেও বিচলিত হলেন না। এই ধরনের অভিযোগ তো তিনি অনেকই শুনেছেন সারা জীবন। সত্যিই তো, তাঁর জেনারেশনের মধ্যে তো যথাযথ সচেতনার অভাব ছিলই, এখনও আছে। কাজেই এর উত্তর আর কী দেবেন? বিশেষ করে এই সবজান্তা বাচালকে!
কিন্তু ছেলেটির আস্ফালন তাতেও থামানো গেল না। বরঞ্চ বরুনবাবুর কাছ থেকে কোনও রকমের প্রতিক্রিয়া না পেয়ে বোধহয় তার আরও রোখ চেপে গেল। সে একটু গম্ভীর ভাবেই বলতে শুরু করল: “এই দেখুন না কেন, জলের সমস্যা! বরুনদা, পৃথিবীতে ইতিমধ্যেই খুব দ্রুতগতিতে পানীয় জলের ঘাটতি হতে শুরু করেছে। অদূর ভবিষ্যতে দেখবেন শুধুমাত্র পানীয় জলের অভাবেই আমাদের মতন দেশের গরীব লোকেরা পটপট করে মরতে শুরু করছে। সেদিন এক অসাধারণ সামাজিক সমস্যা মাথা চাড়া দিয়ে উঠবে – এক গেলাস জলের জন্যেই লুঠতরাজ, খুন-খারাপি, দাঙ্গা-হাঙ্গামা, কোনও কিছুই আর বাকি থাকবে না।”
পানীয় জলের ব্যাপারটা কিন্তু বরুনবাবুকে একটা অত্যন্ত স্পর্শকাতর জায়গায় গিয়ে আঘাত করল। দীর্ঘ দিনের চেপে রাখা বেদনা যেন মনের গহ্বর থেকে একেবারে ফুটন্ত লাভার মতন তখুনি ফোয়ারা হয়ে বেরিয়ে আসতে চাইল। পানীয় জলের কারণেই যে বরুনবাবুর আত্মনির্বাসন! ঘটনাটা ঘটেছিল আজ থেকে প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে। পরিবেশের ক্রমাগত অবনতি দেখে সেদিনের সেই আদর্শপ্রবন তরুণ, একেবারে ছোটবেলা থেকেই ঠিক করে ফেলেছিলেন যে তিনি জননী পৃথিবীর রক্ষনাবেক্ষনের দায়িত্ব নিয়েই তাঁর জীবনটাকে পরোপুরি উৎসর্গ করে দেবেন। বর্জ পরিশোধনা, তা থেকে শক্তি ও সারের উৎপাদন, প্লাস্টিকের বিকল্পতা ও পুনঃব্যাবহার, কারখানার কার্বন-ডাইঅক্সাইড পরিবেশে না ছড়িয়ে, আগে তাকে রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে পরিবেশ বান্ধব করে ফেলা – কী ছিল না, যা নিয়ে নানা রকমের মৌলিক পরিকল্পনা তাঁর মাথার মধ্যে সবসময়েই ঘুরপাক খাচ্ছিল না! তাই তিনি যখন প্রেসিডেন্সি কলেজ আর যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশুনার সব ক-টা ধাপ, একের পর এক ‘প্রথম-শ্রেনীর-প্রথম’ হয়ে একাধিক স্নাতকোত্তর উপাধি নিয়ে বেরিয়ে এলেন, তখনই সন্ধান করতে শুরু করলেন কোথায় পাওয়া যাবে তাঁর স্বপ্ন সফল করবার সবচেয়ে ভালো সুযোগ। প্রথমে বেশ কিছু বছর ধরে ভারতের বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষক-অধ্যাপক হয়ে কাটালেন কিছুদিন। এমন কি কাশ্মীরের “জম্মু উপত্যকা বিশ্ববিদ্যালয়”-এর সূচনাতেই সেখানে গিয়ে একটি পরিবেশ বান্ধবতার পাঠ্যক্রমের সৃষ্টি করলেন। যদিও সব জায়গাতেই তিনি ছাত্রদের কাছে খুব জনপ্রিয় হতে থাকলেন এবং অনেক-কেই আবহ বিজ্ঞানে উদ্বুদ্ধ করতে সক্ষম হলেন, তবু তাতে তাঁর নিজস্ব মৌলিক এবং যুগান্তকারী কাজ করবার কোনও বাসনা মিটল না, কারণ তাঁর বিভিন্ন পরিকল্পনাগুলোর কোনটাকেই ওপরয়ালারা কেউ তেমন পাত্তা দিল না। আর বিশ্ববিদ্যালয় চত্তরে যদি কারুর রিসার্চ ডিন কোনও অর্থ বরাদ্দ না করেন, কিংবা অন্তত ডিপার্টমেন্টের প্রধান যদি সমর্থন এবং অনুমোদন না করেন, তবে কোনও অধ্যাপকই সফল ভাবে অনুসন্ধান চালাতে পারেন না। অতএব ক্লাশ পড়ানো ছাড়া বরুণবাবুর আর কোনও কিছু করার সুযোগ হল না। মধ্যেখান থেকে ছাত্রদের কাছে তাঁর জনপ্রিয়তা সহকর্মীদের মধ্যে অতিরিক্ত ঈর্ষার সঞ্চার করল এবং কলেজে কলেজে তাঁর জীবন ক্রমাগতই দুর্বিষহ হতে থাকল। কিন্তু নামকরা কোনও রিসার্চ প্রতিষ্ঠানই তাঁকে কলেজ ফেলে শুধু গবেষণা করবার সুযোগ দিতে রাজি হল না। শেষ পর্যন্ত খুব কম মাইনেতে হলেও, যখন কলকাতার কোনও এক বেসরকারি সংস্থা একদিন তাঁকে সেই সুযোগ দিল, তখন তিনি আর দ্বিধা করলেন না। নতুন উদ্যমে ঝাঁপিয়ে পড়লেন তাঁর জীবনের দ্বিতীয় অধ্যায়ে। অধ্যাপকের ক্লাশ নোটের বদলে হাতে দেখা দিল যন্ত্রপাতি – টেস্ট টিউব, মাইক্রোস্কোপ, কোটি টাকার মাস্ স্পেক্টোগ্রাফি, জিন শ্লাইসিং এবং রিসিকোয়েন্সার মেশিনের চাবি এবং মুখে আকর্ণ হাসি।
কিন্তু শুধু দামি মেশিন দিয়ে কী হবে? হাতে কলমে গবেষণা করবার জন্য চাই অর্থ-ও! ধারণা ছিল যে বরুণবাবু নিজেই তাঁর গবেষণার জন্য অর্থ সংগ্রহ করতে পারবেন নানারকম সরকারি অনুদান থেকে। কিন্তু বহু হাঁটাহাঁটি করেও তিনি এক লাখ টাকার বেশি তুলতে সমর্থ হলেন না। এমন কি যে গবেষণা করে তিনি পৃথিবীর পানীয় জলের সব সমস্যার সমাধান করে দিতে পারবেন বলে নিশ্চিত ছিলেন, সেই গবেষণার আবেদনও সরাসরি নাকচ হয়ে গেল। “এসব ছেলেমানুষী রিসার্চের খাতে কোনও টাকা খরচ করা যায় না, বরুনবাবু! এসব জাপানী বা জার্মানদের সাজে। ওরা এসব সমস্যার সমাধান করতে একেবারে এক্সপার্ট…” পান চিবোতে চিবোতে দিব্বি একটা মতামত দিয়ে দিলেন শ্রী ধনঞ্জয় পোদ্দার, সরকারি গবেষণা খাতের খাতা-রাখা খাজাঞ্চি “আপনি বরঞ্চ অন্য কিছু ভালো কাজের জন্য ফান্ডের আবেদন করুন, আমি দেখছি কিছু করতে পারি কিনা তখন।”
সমুদ্রের জল পরিশোধনের যে পরিকল্পনাটা বরুণবাবুর মাথায় ছিল সেটা নিয়ে তাঁর নিজের খুব গর্ব ছিল। কিন্তু সেটাই যখন ওই টাকার বস্তাওয়ালা গবেটটার মাথায় ঢুকল না, তখন তাঁর মনে পড়ে গেল জীবনানন্দ দাশের নৈরাশ্যের একটা কবিতার একটি লাইন “তাহলে তুমিই লেখো নাকো একটি কবিতা…” জীবনানন্দর মতনই বারবার সম্পাদক মহোদয়-মহোদয়াদের কাছ থেকে লেখা প্রত্যাখ্যানের সঙ্গে সঙ্গে লেখার উন্নতি করবার জন্য অযাচিত উপদেশ পাবার পরে, সব লেখকদেরই বোধ হয় বারবার এই লাইনটা লেখবার ইচ্ছে হয়। সে লেখা কবিতাই হোক বা শুভ কাজে অর্থের জন্য আবেদনই হোক!
ধনঞ্জয়ের মনটা না গলাতে পারবার নৈরাশ্য তবু হয়ত বরুণবাবুকে একেবারে ধ্বংস করে দিতে পারত না। কিছুদিন পরে তিনি ঠিকই আবার নতুন উদ্যমে নতুন কোনও ধনঞ্জয়ের কাছে যেতে প্রস্তুত হতেন। কিন্তু তার আগেই হঠাৎ একদিন শ্যামলী বলে উঠল:
“তোমার আইডিয়াগুলো সবই বোগাস, কেউ মানে না! তবু তুমি বড়াই করতে থাক। কেবল ‘মুখেন মারিতং জগৎ’।”
“অ্যাঁ, বলছ কী তুমি শ্যামলী! শেষ পর্যন্ত তুমিও? এই কথাটা মুখ খুলে বলতে পারলে আমাকে? তুমি কি জান না…”
এই বাতানুবাদ আজ প্রায় পঞ্চাশ বছর আগের ঘটনা। এর পরেই শুরু হয়েছিল বরুণবাবুর অজ্ঞাতবাস। কিন্তু আজও যেন ওই ক্ষতটা পুরোপুরি শুকোয়নি!
(৩)
অর্বাচীন ছাত্রটির পানীয় জল নিয়ে খোঁটা দেওয়ার ব্যাপারটা বরুনবাবুর কাছে মড়ার ওপরে খাঁড়ার ঘা বলেই মনে হল। বিশেষ করে যখন তিনি জানতেন যে সামান্য ক-টি টাকার অনুদান পেলেই তিনি পঞ্চাশ বছর আগেই পানীয় জলের সমস্যা চিরতরের জন্য সমাধা করে দিতে পারতেন। অথচ সে সুযোগটুকুও তিনি পাননি। আর এখন কি না…
শেষ পর্যন্ত তিনি আর থাকতে পারলেন না। বলে উঠলেন:
“পৃথিবীর তো সাত ভাগ জল আর তিন ভাগ মাত্র স্থল। চারিপাশে এত জল থাকতে আমাদের পানীয় জলের অভাব হবে, তা কি হতে পারে নাকি? কখনই হতে পারে না! অভাব শুধু যথাযথ প্রযুক্তির…”
“বাঃ, আপনি তো দেখছি বেশ কনফিডেন্ট লোক,” উদ্ধত ছাত্রটি মুচকি হেসে উত্তর দিল “যদি আপনার সত্যি সত্যি কোনও আইডিয়া থাকে তো হাতেকলমে করে দেখান না কেন! মুখে বলে কী লাভ? পৃথিবীর কত বড় বড় বৈজ্ঞানিকেরা মিলে এই সমস্যার সমাধান করবার চেষ্টা করে যাচ্ছেন বহুদিন ধরে, আর আপনি কিনা বলে দিচ্ছেন, ‘অভাব শুধু প্রযুক্তির!’ বোঝ ঠেলা!”
“ঠিকমতন সুযোগ পেলে তো হাতেকলমেই করে দেখাতে পারতাম, এখনও পারি। কিন্তু তার জন্য টাকা পয়সা দেবে কে? বিনা পয়সায় তো আর সে কাজ হবে না!”
“ও, তাই নাকি! তা আপনি বলছেন যে শুধুমাত্র টাকার অভাবেই আপনি এই আন্তর্জাতিক সমস্যাটার সমাধান করতে পারছেন না, তাই তো?”
“তা একরকম বলতে পার বটে!”
“তার মানে আপনাকে যদি যথেষ্ট টাকা দেওয়া হয়, তবে আপনি সব কিছু করে দেখিয়ে দিতে পারবেন, এই বলছেন তো?”
“অ্যাবসোলিউটলি!”
“বেশ তো, তাহলে আর বেশি কথা বলে সময় নষ্ট করে লাভ কী আছে? একটা প্রোপোজাল দিন তো দেখি!
“একসময় অনেক প্রোপোজাল লিখেছি ভাই। তোমাকে আবার প্রোপোজাল দিয়ে কী করব? তুমি কি খরচ দেবে? এসব কাজ দশ-বিশ টাকায় হয় না ভাই!”
“ও, আপনি ভাবছেন যে আমি মস্করা করছি! শুনুন, আমার মামাবাড়ির ব্যাবসাই হল জল-পরিশোধন। ‘নীরবিন্দু’ ব্র্যান্ডের নাম শুনেছেন তো। ওটা আমার ছোটমামা তিরিশ বছর আগে দীঘার পশ্চিমে একটা গ্রামে গিয়ে শুরু করেছিলেন।”
“শুনেছি তো, কিন্তু তা দিয়ে আমি কী করব? পুকুরের জল তুলে বোতলে পোরা আর সমুদ্রের জল পরিশোধন করার মধ্যে অনেক তফাৎ আছে।”
“সত্যি নাকি? আমার তো কোনও ধারণাই ছিল না, হাঃ হাঃ! শুনুন, নীরবিন্দু এখন আমার দাদা চালায় – ইন্দ্রজিৎ। তার এই বছরের প্ল্যান সমুদ্রের জল ফিল্টার করতে শুরু করবার।”
“তাই নাকি! তা বেশ বেশ, কিন্তু বেল পাকলে কাকের কী?”
“সে বেল তো পাকছেই, বরুণদা। কিন্তু সত্যিই যদি আপনার কোনও আইডিয়া থাকে, কাগজে কলমে অন্তত দেখিয়ে দিন না কেন, কেমন করে লাভজনকভাবে সমুদ্রের জল ফিল্টার করা যায়! মুখে তো অনেক কথাই বলছেন দেখছি।”
“মুখের কথা শুধু নয় ভাই। আমার পরিকল্পনা খুবই ব্যাবহারিক। কিন্তু তা বোঝবার মতন ক্ষমতা আর কড়ি ফেলে তেল মাখবার মতন বুকের পাটা আছে, তেমন তো কাউকে দেখিনি এখনও।”
“তাই নাকি! তা ইন্দ্রদার পকেটে কড়ি আছে অনেকই, আর বুদ্ধিশুদ্ধিও আছে প্রচুর! কিন্তু যথেষ্ট আত্মবিশ্বাস আছে কি আপনার? তার সামনে গিয়ে দাঁড়াবার?”
“এতে আর আত্মবিশ্বাসের সমস্যা কী? কিন্তু আমি গিয়ে কী করব, আমার পরিকল্পনার কী মূল্য দেবেন তিনি?”
“ও, প্রথমেই মূল্য! আপনার পরিকল্পনা কী অমূল্য?”
“ভাই, আমার কাছে তো অমূল্যই। কিন্তু তা বুঝবে শুধু সে, যার সত্যিকারের দূরদৃষ্টি আছে। তোমার ভাই যে তেমন লোক, তা কী করে নিশ্চিত হব?”
“ইতিমধ্যেই ভয় পেয়ে যাচ্ছেন? সাহস করে ইন্দ্রদার কাছে একবার গিয়ে দেখানই না কেন, আপনার ওই অমূল্য পরিকল্পনাটা। সে হয় আপনার ধুতি খুলে দেবে, নয়ত আপনাকে বাহবা দেবে। আর যদি সত্যিই কাজের হয় তাহলে কে জানে, হয়তো বা ফান্ডিং-ও দিয়ে দেবে।”
“ভালো কথা। যোগাযোগ করিয়ে দাও তাহলে, গিয়ে দেখব কতখানি সমঝদার তিনি। আর কিছু না হোক সমুদ্রের জল ফিল্টার করার কী পরিকল্পনা তাঁর, তা তো জানতে পারব, ভালো-মন্দ পরের কথা।”
“ঠিক আছে! আপনি আবার দেশে যাচ্ছেন কবে?
(৪)
বরুনবাবু ইন্দ্রজিৎ বর্মনকে যতটা তরুণ হবেন বলে মনে করেছিলেন, দেখলেন আসলে তা কিন্তু নয়। আর তাঁর মধ্যে ওঁর পিসতুতো ভাইয়ের ঔদ্ধত্যর কোনও চিহ্ন দেখলেন না। ইন্দ্রজিৎবাবু মোটামুটি মধ্যবয়স্ক, ধনী ও বিনয়ী; সত্যি সত্যিই সাগর থেকে জল তুলে পরিশোধন করে দেশে ও বিদেশে পানীয় জলের চাহিদা মেটাতে তিনি বদ্ধপরিকর।
“দেখুন, সারা পৃথিবীতে যেমন একদিকে পানীয় জলের চাহিদা বাড়ছে, তেমনি আবার নানা কারণে তার প্রাকৃতিক সরবরাহও কমে যাচ্ছে ক্রমাগত। কাজেই একজন ব্যাবসায়ী হিসেবে আমি চাই খুব সস্তায় সমুদ্রের জল পরিশোধন করে তা ব্যবহার করা। তাহলে অপর্যাপ্ত পানীয় জল আমরা প্রস্তুত করতে পারি।”
“তা তো বটেই, তাহলেই তো কেল্লা ফতে।”
“কিন্তু সেটা করতে গিয়ে যে কতরকমের সমস্যা দেখা দিচ্ছে তা আর বলে শেষ করা যায় না!”
বরুণবাবু একটু মুচকি হেসে বললেন:, “কী কী সমস্যা ফেস্ করছেন? কী পদ্ধতিতে ফিল্টার করবার চেষ্টা করছেন আপনারা?”
ইন্দ্রজিৎ একটু ইতস্তত করে বললেন, “দেখুন মাত্র তিন রকমেরই তো পদ্ধতি আছে জল পরিশোধন করবার। এক তো হচ্ছে সেই জল ফোটানো। হাজার বছর ধরে মানুষ জল ফুটিয়ে বাষ্প ধরে ঠান্ডা করে খাচ্ছে। জল তাতে খুবই বিশুদ্ধ হয়। কিন্তু দেখুন এটা তো আর কমার্সিয়াল স্কেলে করা যায় না, তাই ওটা বাদ…”
“ঠিক। আর কমার্সিয়াল স্কেলে জল ফোটাতে গেলে যা এনার্জি লাগবে তার কোনও ইয়ত্তা নেই!”
“ঠিক, ঠিক, ও কথা আমরা ভাবছিই না। যদিও আমরা ভ্যাকুয়াম দিয়ে প্রেসার কমিয়ে জল ফোটানোর তাপমাত্রাটা নামিয়ে ফেলেছি যাতে করে ফোটানোর খরচটা কমে যায়।”
“কিন্তু তা কমলে কী হবে, ভ্যাকুয়াম করতে এনার্জি লাগছে না? হরে দরে তো একই হল!”
“তা তো লাগছেই। ওই শালগ্রাম শিলা-র ওঠাবসা আর কি! কাজেই আমাদের হয় করতে হবে ইলেক্ট্রোলিসিস, কিংবা রিভার্স অসমোসিস, মানে ‘আর-ও’।”
“দুটোই ভালো, কিন্তু ‘আর-ও’ই তো মনে হয় বেশি লোকে ব্যবহার করছে।”
“তা করছে বটে বরুনবাবু, কিন্তু আপনার কী মত? আপনি তো একসময় রাইজিং স্টার ছিলেন মশাই। আপনি আসার আগে আমি একটু গুগল করে দেখছিলাম আপনাকে। ব্রিলিয়ান্ট ছাত্র, ব্রিলিয়ান্ট প্রফেসর, আর আবহ বিজ্ঞানের ওপরে কত যুগান্তকারী পেপার আছে আপনার – শেষে আপনি বোধহয় একটা রিসার্চ ল্যাবেও জয়েন করেছিলেন, তাই না?”
“হ্যাঁ, তা করেছিলাম বটে।”
“কিন্তু তারপরে কী হল? গত পঁচিশ তিরিশ বছরে ধরে তো আর আপনাকে কোথাও দেখাই যায়নি। এখন বোধহয় আমেরিকার একটা কলেজে পড়ান, তাই না?”
“হ্যাঁ, ছোট কলেজে পড়াই তো, তাই সেখানে রিসার্চের তেমন কোনও অবকাশ নেই, পেপারও লিখিনি আর।”
“কিন্তু শুধু রিসার্চ নয়, আমি দেখছিলাম যে আপনার চিন্তা ধারাটাও খুব ব্যবহারিক। এই এনভায়রনমেন্টাল সমস্যাগুলো নিয়ে আপনি এমন ভাবে অনেক কিছু লিখেছিলেন যে তাতে বোঝা যায় যে আপনি ব্যবহারিক সমস্যা সমাধানের দিকেই বেশি জোর দিতে ভালোবাসেন। আমাদের ফার্মে জয়েন করবেন নাকি? আমাদের প্রচুর সমস্যা!”
“হাঃ হাঃ, অনেক ধন্যবাদ আমাকে টিম মেম্বার করতে চাওয়ায়। কিন্তু আমি তো পুরানো হয়ে গেছি; এখন তো আপনার ভাইয়ের মতন অনেক নবীন এবং তুখোর লোক উঠছে। তারাই এসব সমস্যার সমাধান করে দেবে।”
“কে, প্যালারাম? সরি, ডাকনামে ডেকে ফেলেছি অর্ণবকে; ও ছোটবেলায় খালি জ্বরে পড়ত আর শুয়ে শুয়ে টেনিদার গল্প পড়ত। তাই আমি নাম দিয়েছিলাম প্যালারাম। ও হয়তো সময়ে জয়েন করবে আমাদের ফার্মে, কিন্তু এখন তো বড়ই আনকোরা। আপনার অভিজ্ঞতার সঙ্গে কি আর তুলনা হয় তার?”
“না না, সে তো ভারী ব্রাইট ছেলে। তা আপনারা কোন দিকে হেলছেন তবে, ঠিক করেছেন কি?”
“দেখুন, আমার তো মনে হয় জাপানী প্রথাটাই সবচেয়ে ভালো। বহু বছর ধরে খুব নির্ভরশীলভাবে কাজ করছে সৌদি আরেবিয়ার ডিস্যালিনেশন প্ল্যান্ট হিসেবে। এই দেখুন না, আমার কোম্পানি একটা পোর্টফোলিও তৈরি করেছে, দীঘার সমুদ্রতীরে আমাদের নতুন ফ্যাক্টরিটার জন্য কিছু মূলধন তোলার কাজে।” এই বলে বরুণবাবুর হাতে একটা রংচং-এ পুস্তিকা ধরিয়ে দিতে দিতে ইন্দ্রজিৎবাবু বলে চললেন, “একটু পড়ে দেখুন তো, লিখতে গিয়ে কেউ কোথাও ভুলটুল করেছে কি না – মার্কেটিং-এর লোক তো সব, কোনও বিশ্বাস নেই!”
“ও, তা আপনার ডিস্যালিনেশন প্ল্যান্টটা কি দীঘা বীচে হবে?”
“হ্যাঁ, মানে একেবারে বীচে তো হবে না, শহর থেকে একটু দূরে, এই দু-তিন কিলোমিটার পশ্চিমে।”
“আচ্ছা।” এবারে একটু থেমে, পুস্তিকাটায় চোখ বুলোতে বুলোতে বরুণবাবু বললেন, “না ঠিকই লিখেছে তো, যা দেখছি। আপনারা প্রমাণিত প্রযুক্তি ব্যবহার করছেন। সমুদ্রের জলকে সেমি-পার্মিয়েবল, মানে আধা-ভেদ্য পর্দার একধার থেকে চাপ নিয়ে অন্য ধারে নিয়ে যাচ্ছেন। যাবার পথে জলের মধ্যে মেশান লবণ ও অন্যান্য বর্জ্য পদার্থ ছেকে বেরিয়ে আসছে, অন্যধারে জলটা হয়ে যাচ্ছে সম্পূর্ণ পরিশোধিত। ঠিকই তো, বেশ সহজ করে লিখেছে। কিন্তু এটা ঠিক লিখলেও, পরিশোধনের পর যে লবণটা পড়ে থাকে, তাকে কী করে সরাচ্ছেন? তা নিয়ে তো কিছু বলা হয়নি!”
“আর বলবেন না দাদা। আমার কাছে তো এটা একটা বিরাট মাথা ব্যাথার কারণ হয়ে গেছে। যদি লবণটা বীচে কিংবা কোনও মাঠে ফেলে রাখি তবে তো হৈ হৈ কাণ্ড হয়ে যাবে। পরিবেশ বান্ধবেরা এসে দু-দিনে আমাদের কারখানা বন্ধ করে দেবে।”
“তা হলে কী করবেন?”
“কী আর করব! আপাতত অন্যেরা যা করে তাই করব। পাইপে করে লবণগোলা জল বানিয়ে তাকে সমুদ্রের মধ্যে আবার ফেলে দেব।”
“কিন্তু তাতে করে তো কৃত্রিমভাবে একটা ছোট অঞ্চলে লবণের ঘনতা অনেক বেড়ে যাবে আর সেই অঞ্চলের সামুদ্রিক প্রাণীদের প্রাণহানি হবার আশঙ্কা বেড়ে যাবে!”
“মানলাম। কিন্তু আপাতত তো আমার কাছে আর কোনও রাস্তা খোলা নেই! তাই এখন এটাই করব। কিন্তু আমি এখন নতুন প্রযুক্তি খুঁজছি যাতে করে এই সমস্যার ভালো সমাধান করা যায়। আপনার মাথায় কোনও আইডিয়া আছে নাকি?”
“একসময় হয়তো ছিল। কিন্তু তার আগে একটা প্রশ্ন করি। আপনার পরিশোধনের হার কীরকম হবে? মানে কী রেটে জল পরিশোধিত হবে – দিনে কত শো লিটার?”
“এই তো আর একটা সমস্যার কথা তুলে দিলেন আপনি! আমরা লোনা জলের ওপর যত একদিক থেকে চাপ বাড়াব তত বেশি দ্রুতগতিতে জল পরিশোধিত হয়ে পৌঁছবে অন্যদিকে। কিন্তু তাতে দুটো সমস্যা। এক, চাপ বাড়াবার জন্য অনেক এনার্জি চাই। অত শক্তি কিনতে কিনতে তো দেউলিয়া হয়ে যাব মশাই! তা ছাড়া, বেশি চাপ দিলে তো শেষ পর্যন্ত মেমব্রেনগুলো তো ছিঁড়ে যায়! কাজেই পরিশোধনের হার বাড়াবার জন্য একটা রাস্তাই খোলা আছে – তা হচ্ছে আরও অনেক, অনেক ‘আর-ও’ ইউনিট যোগ করা। এনার্জির খরচ বাড়বে, কিন্তু তবু কিছু সাশ্রয় হবে।”
“এই ব্যাপারে আমার কিছু পরিকল্পনা ছিল। তাতে এক ঢিলে অনেকগুলো পাখি মারা যেত হয়তো। কিন্তু তখন কোনও আর্থিক অনুদান পেলাম না। আপনাদের যদি বাজেটে কিছু টাকা বরাদ্দ থাকে তবে হয়তো সেই আইডিয়াগুলোকে ব্যবহারিক করে দেখা যায়।”
“নিশ্চয়ই। কিন্তু তার আগে অল্প কথায় একটুখানি আমায় পরিকল্পনাটা বলবেন আমাকে, তাহলে সহজে বিবেচনা করতে পারি।”
“দেখুন, সমস্যা তো তিনটে। এক, জলের চাপ বাড়াতে আপনাকে এনার্জি খরচ করতে হচ্ছে, তা না হলে পরিশোধনের হার খুব কম থেকে যাচ্ছে, লাভজনক কিছু হবে না তেমন। দ্বিতীয়, বেশি চাপ দিলে পরিশোধনের হার হয়তো বাড়বে, কিন্তু মেমব্রেন ছিঁড়ে যাবার ভয় আছে। তৃতীয়, আপনি যত জল পরিশোধন করবেন, তত পড়ে থাকা লবণকে যথাযথভাবে অপসারণের সমস্যা বেড়ে যাবে।”
“তা এখানে আপনার ঢিলটা কী হবে, বরুনবাবু?”
বরুণবাবু তখন পকেট থেকে দু-কপি কাগজ বার করে বললেন, “কিছু মনে করবেন না, কিন্তু আমি একটু তৈরি হয়েই এসেছিলাম। এই কাগজে আমার পদ্ধতিটা একটু আইনি ভাষায় লেখা আছে। যদি আপনি এটা সই করে দেন, তবে এই পদ্ধতির স্বত্বটা যে আমারই থেকে যাচ্ছে সেটা আপনি মেনে নিচ্ছেন। আপনি সই করতে রাজি হলে আপনি দলিলের এক কপি রাখবেন। আমার কাছে অন্য কপি থাকবে। কি, সই করতে রাজি আপনি?”
ইন্দ্রজিৎ কিছুক্ষণ চিন্তা করে বললেন, “ঠিক আছে, আমি সই করছি। শুধু শর্ত হবে যে আপনি আমাদের কোম্পানিতে জয়েন করে নিজেই এই পরিকল্পনাটার বাস্তবায়ন করবেন, আর তাতে আমাদের লাভ হলে, স্বত্ব হিসেবে আপনি কিছু রয়ালটি পাবেন।”
(৫)
দু-জন সাক্ষী ডেকে, দু-কাপ চায়ের সঙ্গে মহাসমারোহে দলিলটা শেষ পর্যন্ত সই হল। তারপরে বরুণবাবু আবার বলতে শুরু করলেন, “আমার পদ্ধতিতে আপনার শক্তির খরচ খুব কম হবে, কারণ আমাদের পুরো পরিশোধনাগারকে জলে নিমগ্ন করে রাখতে হবে।”
“বলেন কি?”
“হ্যাঁ। দেখুন, আপনার পরিশোধনের হার বাড়াতে গেলে দুটো সমস্যা। যথেষ্ট চাপ সৃষ্টি করার জন্য এনার্জি ব্যবহার, আর মেমব্রেন ছিঁড়ে যাবার সমস্যা। তা চাপ সৃষ্টি করার জন্য আমরা প্রকৃতিকেই ব্যবহার করি না কেন? জলে ভর্তি সমুদ্র তো বসেই রয়েছে। তার যত গভীরে নামবেন, তত জলের ওজনে আপনা থেকেই চাপ বাড়তে থাকবে, কোনও কৃত্রিমভাবে আলাদা শক্তি খরচ করে চাপ বাড়াতে হবে না। কেবল যে ক্যাপসুলের মধ্যে পরিশোধনাগারটা তৈরি করা হবে, সেটাকে জলরোধী, মানে ওয়াটার টাইট করতে হবে।”
“আচ্ছা! ইন্টারেস্টিং! কিন্তু মেমব্রেন?”
“হ্যাঁ হ্যাঁ, বলছি। জিনপদ্ধতি দিয়ে আমাদের একটা কৃত্রিম ঝিল্লি, মানে আর্টিফিসিয়াল মেমব্রেন বানাতে হবে, যা ছাঁকনি হিসেবে একই রকম থাকবে, অর্থাৎ জলের মলিকিউলদের যেতে দেবে, কিন্তু সোডিয়াম বা ক্লোরিনের আয়নকে প্রতিরোধ করে রাখবে। কিন্তু তাকে খুব শক্ত হতে হবে। আমি একসময় এই নিয়ে কিছু পরীক্ষানিরীক্ষা করেছিলাম। আজকাল এই ধরনের সেমি পার্মিয়েব্ল, বা অর্ধ-প্রতিরোধী ঝিল্লী, জৈবিকভাবে তৈরি করা হয়, যাতে করে ছাঁকনীর ফুটোগুলোর ব্যাস ইচ্ছেমতো বাড়ানো-কমানো যায়। তা সেই জিন পদ্ধতি মেনেই, সামুদ্রিক জৈব পদার্থের সঙ্গে গণ্ডারের চামড়ার জিন মিশিয়ে একটা নতুন ধরণের ঝিল্লী বানিয়েছিলাম যাকে ইচ্ছে মতন যত শক্ত চাই, তত শক্ত করে ফেলা যায়।”
“অসাধারণ! আর লবণের বর্জন?”
“বর্জনের সমস্যাও হবে না, কারণ আমাদের সমুদ্রের বেশ গভীরে যেতে হবে, পরিশোধনের হার অনেক গুণ বাড়াবার জন্য। তখন আমরা ক্যাপসুলের বাইরে থেকে মেমব্রেনের ওপরে বাইরের জলকে এসে পড়তে দেব। ঝিল্লীর অন্যপাশে চাপে পড়ে পরিশোধিত জল, পাইপের মধ্যে দিয়ে ফোয়ারার মতন করে ভূপৃষ্ঠে কারখানার ওপর তলায় গিয়ে উঠবে। কিন্তু যে লবণটা ঝিল্লি পেরতে পারবে না, সে আবার আশপাশের জলের সঙ্গে মিশে যাবে। যেহেতু চারিপাশে জলের পরিমান প্রায় ইনফিনিটি, তাই এই আলাদা হওয়া লবণটা ওই অঞ্চলের জলের লবণাক্ততাকে কোনওভাবেই বদলাতে পারবে না, আর আপনার উৎপাদনের বাই প্রোডাক্টটা, মানে লবণটা, একেবারেই পরিবেশ বিরোধি হবে না।
বরুণবাবুর ব্যখ্যা শুনতে শুনতে ইন্দ্রজিৎ খুব উত্তেজিত হয়ে যাচ্ছিলেন। এবারে তিনি উঠে দাঁড়িয়ে দু-হাত দিয়ে তাঁকে জড়িয়ে ধরে বললেন, “সাধু, সাধু, বরুণদা! আমি আপনাকে দেখেই বুঝেছি যে আপনি আমাদের অনেক সমস্যার সমাধান করতে পারবেন। যা বললেন তা তো অসাধারণ! কিন্তু সামনে যে অনেক কাজ!!! কবে থেকে শুরু করবেন, মানে জয়েন করবেন?”
(৬)
এর পরের ইতিহাস হল যে পরবর্তী দু-বছর ধরে ক্যাপসুল বানানো, ঝিল্লী বানানো এইসব খুব জোর কদমে চলল। বরুণবাবুকে এর আগে কেউ কখনও এত খুশি থাকতে দেখেনি। বছর তিনেক পরে বেশ কিছু পরীক্ষানিরীক্ষার পর সমুদ্রের নীচে একটা গোপন গভীরতায় গিয়ে প্রথম ক্যাপসুলটাকে প্রস্থাপন করা হল। খুঁটিনাটি সবকিছু ঠিকঠাক করে নেবার পরে কারখানার ওপর তলায় গিয়ে ভাল্ভ খুলে দিতেই একটা মোটা জলস্তম্ভের মতন করে পরিশোধিত জল প্রায় দুশো ফুট ওপরে ছিটকে গিয়ে, একটা ফোয়ারা হয়ে ঝরে পড়তে থাকল। সেদিন আর সকলের আনন্দ কে দেখে!
কিন্তু বরুণবাবু তখন আবার কী কারণে আত্মহত্যা করলেন তাহলে? আসলে তিনি তখন মোটেও আত্মহত্যা করেননি। করেছিলেন আরও বেশ কিছুদিন পরে। ইতিমধ্যে তিনি প্রথমে জলপ্রপাতের ধারা অনেক বাড়িয়ে দিলেন। তখন দীঘার কুলে যেন আর একটা নদীর সৃষ্টি হয়ে গেল! মানুষ কত পরিশোধিত জল বোতলে ভরবে? কিন্তু সেই নদীকে কী করে সংযত করা যাবে? তা না হলে তো সে তার তোড়ে পুরো দীঘা শহরটাকে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে? তাই সেখানেও বরুণবাবু এলেন সমাধানকারী হয়ে। তিনি শুধু তাকে সংযতই করলেন না, তিনি একটি প্রাচীন পদ্ধতিতে, পাম্প না ব্যবহার করেই, সেই পরিশোধিত জলের নদীকে সোজা দার্জিলিং-এর পাহাড়ের ওপরে সেঞ্চল লেকে পৌঁছে দেবার ব্যবস্থা করলেন। আর তার যাত্রাপথের মধ্যেই তিনটে বিভিন্ন জায়গায় জলবিদ্যুৎ উৎপাদনেরও ব্যবস্থা করে দিলেন, যা থেকে উত্তর ও মধ্য বঙ্গে বিদ্যুৎ সরবরাহ অনেক বেড়ে গেল। সে অনেক গল্প। না হয় তা আর একদিন বলা যাবে।
কিন্তু আত্মহত্যা? সে গল্প তাহলে প্রবুদ্ধ মুন্সী-ই লিখুন না হয়; আমি কেন দুঃখের কথা লিখতে যাব?
ও, আচ্ছা, পাঠক, আপনি যেন কী বললেন? ‘শেষের প্যারাগ্রাফটা একেবারে গাঁজাখুরী’ – না, না, তা মোটেই নয়! একেবারেই নয়! বিদগ্ধ পাঠক, দেখুন, আপনাকে কেন ঠকাতে যাব? “কী বললেন? আজ্ঞে ঠিক বুঝতে পারলাম না, আর একবার বলবেন দয়া করে? অ্যাঁ, ‘@##&*(& %ঁঁ?’ ও, ছি ছি ছি, প্লীজ এরকম কথা বলবেন না; এ রকম কথা তো আমি ছাপাতেই পারব না! এবারে কী বললেন – ও, আমার রিপোর্টটা ফিজিক্স-এর “ল” ভায়োলেট করছে? না, একেবারেই নয়। আমি যে বৈজ্ঞানিকের কথা লিখছি, তিনি যা করেছেন জীবনে, তাতে পদার্থবিজ্ঞানের কোনও একটা নিয়মও কখনও ভঙ্গ হয়নি। তিনি সারাজীবন প্রকৃতিকে শুধু কী করে ‘অ-প্রথাসিদ্ধ’ ভাবে কাজে লাগানো, যায় তাই নিয়েই ভেবে গিয়েছেন। তিনি পাম্প দিয়ে বাহ্য শক্তি খরচ করে নদীকে কখনই পাহাড়ের ওপরে পাঠাননি, তিনি প্রকৃতির অন্তর্নিহিত শক্তি দিয়েই এই কাজ সম্পন্ন করেছিলেন। আপনাদের মধ্যে যাঁরা প্রত্ন-ইতিহাস নিয়ে ঘাঁটাঘাটি করতে ভালোবাসেন তাঁদের হয়তো মনে পড়বে যে পুরানো দিনের অন্তত একটি সভ্যতা, ঠিক এই পদ্ধতিতেই মাধ্যাকর্ষণের বিরুদ্ধে জলকে ওপরে তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন। বরুণবাবু শুধু তাদের সফলতার প্রমাণ পেয়েই, এই অভিনব প্রথার আধুনিকিকরণ করেছিলেন। তবেই তো ভারত সরকার তাঁকে নাগরিকদের পাবার সর্বোচ্চ পুরস্কার প্রদান করে ‘ভারত রত্ন’ বলে ঘোষণা করেছিলেন! অথচ সেই সূত্রেই তাঁকে আত্মহত্যা করতে হল শেষ পর্যন্ত। সেই গল্প আমার ভবিষ্যতে বলবার ইচ্ছে রইল, অবশ্য যদি সেটা সম্পাদকমশাই আমাকে দিয়ে বলাতে চান। প্রবুদ্ধ মুন্সি তো চারিদিক থেকে ছোঁক ছোঁক করছেন!
১ আজ এত বছর পরে আর ডাঃ সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কথা কে মনে রাখে জানি না! তবে আমার পূর্ব পুরুষদের কাছে শুনেছি যে ১৯৭৮ সালে তামাম দুনিয়ার দ্বিতীয় “টেস্ট টিউব বেবি” হিসেবে আমাদের এই পোড়া দেশের পোড়া শহর কলকাতাতেই এক অতুলনীয়া রক্ত-মাংসের দুর্গাকে জন্ম দিয়েছিলেন ডাঃ মুখোপাধ্যায়। না, তিনি কোনও বড় ডিগ্রীধারি পটুয়া ছিলেন না। আজ হাজার বছর ধরে কুমোরটুলীর শিল্পীরা লক্ষ লক্ষ অনন্য সুন্দর দুর্গা প্রতিমার জন্ম দিয়ে এসেছেন বটে, কিন্তু ডাঃ মুখোপাধ্যায় রীতিমতন একজন ‘ডাক্তারবাবু’ ছিলেন। তিনি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে শুধুমাত্র টেস্ট টিউবে কৃত্রিমভাবে পিতা-মাতার জন্মপ্রদায়ক কোষযুগলের মিলন ঘটিয়ে এক অসামান্যা শিশুকন্যার জন্ম দিয়েছিলেন। কিন্তু তখন পশ্চিমবঙ্গে গাধাপার্টির রাজত্ব। গাধামোড়ল, গাধাপার্টির মেম্বার নয় এমন কারুর খ্যাতি হোক, তা কখনও হতে দিতে চায়নি। কাজেই গাধাগুলো সবাই মিলে ডাঃ মুখোপাধ্যায়কে জোর করে আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দেয়। ডাঃ বরুণ দেবের জীবন কাহিনিও মনে হয় সেইরকমই।
Tags: অমিতাভ রক্ষিত, কল্পবিজ্ঞান গল্প, গল্প, চতুর্থ বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা, পূজাবার্ষিকী, বিজ্ঞানভিত্তিক গল্প, সুপ্রিয় দাস
besh laglo,chaliye jaan
prosenjit
Peosenjit babu – onek dhonybad
চমৎকার লাগলো!! কিন্তু গল্পের নামের সঙ্গে খুব বেশি সাযুজ্য পেলাম না।
Thank you Agniv babu. Namta bodhhoy ektu beshi chotokdar hoye geche, kintu lekhbar somoy kichutei namtake mon theke bar korte parlam na. Golpota porar jonyo dhnyobad.
Fantastic
Thank You
অমিতাভদা, আপনার গল্পটি উপভোগ করলাম| বিজ্ঞান ও হাস্যরস দুইই বর্তমান| পরবর্তী অধ্যায়গুলোর জন্য অপেক্ষা করছি, হয়তো সেখানে আরশোলার দুধের প্রসঙ্গ আরো আসবে| ভাল থাকুন, লিখে যান|
দীপেন ভট্টাচার্য
অনেক ধন্যবাদ, দীপেন।