ইন্ডিয়ান স্পেস ফোর্স ~ দেশের রক্ষাকবচ
লেখক: সৌমেন দে
শিল্পী: সুপ্রিয় দাস
ইন্ডিয়ান স্পেস ফোর্সের পঞ্চাশ বছর পূর্তি উপলক্ষে দেশবাসীকে অভিনন্দন জানিয়েছেন কমান্ডার জেনারেল শ্রীমতী কৃষাণী আইয়ার। ডিফেন্স স্পেস এজেন্সির ব্রেনচাইল্ড আইএসএফ আজ অন্যান্য উন্নত দেশগুলির স্পেস ফোর্সের সমকক্ষ হয়ে উঠেছে। আইএসএফ-এর সামরিক শক্তি ও কার্যপ্রণালী সম্পর্কে অবহিত হওয়ার জন্য আপনাদের প্রিয় ওয়েব পত্রিকা সত্যসন্ধানীর কয়েকজন প্রতিনিধি গত কয়েকদিন আইএসএফ-কে খুব কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য অর্জন করেছেন। তাঁদের সেই অভিজ্ঞতা আমরা প্রকাশ করছি এই বিশেষ রিপোর্টে। প্রখ্যাত রিপোর্টার মিস ছায়াপথ সেনগুপ্ত আমাদের প্রতিনিধি দলের নেতৃত্বে ছিলেন। এ ছাড়া ছিলেন ক্যামেরাম্যান এবং সাউন্ড টেকনিসিয়ান। তাঁদের সম্পূর্ণ অভিজ্ঞতা তুলে ধরা হচ্ছে আপনাদের সামনে।
প্রথম দিন:
বেঙ্গালুরুর এপিজে আবদুল কালাম স্পেসপোর্টে সত্যসন্ধানী টিম পৌঁছে গিয়েছিল বিকাল পাঁচটার মধ্যে। পরিচয়পত্র এবং বায়োমেট্রিক পরিচয় যাচাই করার পর স্পেসপোর্টে প্রবেশের অনুমতি মেলে। অত্যাধুনিক এই স্পেসপোর্ট হল যাত্রা শুরুর প্রথম পদক্ষেপ। স্পেসপোর্ট থেকে একটি স্কাই এলিভেটর পৌঁছে দেবে স্পেস স্টেশনে।
স্কাই এলিভেটরটি একটি বেশ বড় আকারের ক্যাপসুলের মতো দেখতে। লম্বায় প্রায় ১০ মিটার এবং ৫ মিটার ব্যাসার্ধের চোঙাকৃতি কামরাটি একটি গ্রাফেন তন্তু দ্বারা নির্মিত কেবলকে নির্ভর করে উপরে উঠতে থাকে তীব্র গতিতে। গ্রাফেন কেবলটি সরাসরি স্পেস স্টেশনের সঙ্গে যুক্ত। স্পেস স্টেশনটি পৃথিবী পৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৩৬০০০ কিলোমিটার দূরে ভূ-সমলয় কক্ষপথ বা জিওস্টেশনারি অরবিটে পৃথিবীর চারদিকে প্রতিদিনে একবার আবর্তিত হচ্ছে। তাই, পৃথিবীর সাপেক্ষে এটি স্থির এবং সেই জন্যই স্কাই এলিভেটর স্থাপন করা সম্ভব হয়েছে।
ক্যাপসুলের ভিতরে ঢুকে টিম সত্যসন্ধানী নির্দিষ্ট আসনে বসে পড়লে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সিটবেল্টগুলি তাঁদের সুরক্ষিত করে। ক্যাপসুলে কোনও জানালা নেই। ভিতরের দেওয়ালে লাগানো বড় ভিউস্ক্রিনে অবশ্য বাইরের দৃশ্য সুন্দরভাবে দেখা যায়। একসময় কাউন্টডাউন শুরু হয়… ১০… ৯… ৮… … ২… ১… ০।
কাউন্টডাউন শেষ হতেই অটোপাইলট সুমিষ্ট যান্ত্রিক কণ্ঠস্বরে বলে ওঠে, “স্কাই এলিভেটরের সমস্ত যাত্রীদের আইএসএফ-এর পক্ষ থেকে অভিনন্দন জানাই। আমাদের যাত্রা শুরু হল। যাত্রার প্রথম অংশে ক্রমাগত ত্বরণ হবে অর্থাৎ ক্যাপসুলের গতি বাড়তে থাকবে, মাঝের অংশে গতি নির্দিষ্ট থাকবে এবং শেষ অংশে মন্দন হবে অর্থাৎ ক্যাপসুলের গতি ক্রমে কমতে থাকবে। প্রথম ও শেষ অংশে আপনাদের কিছু শারীরিক অসুবিধা হতে পারে। এই সময় কোনওভাবেই সিটবেল্ট খোলা যাবে না। আপনাদের যাত্রা শুভ হোক।”
বিজ্ঞানের প্রভূত উন্নতি সত্ত্বেও এখনও মানুষ নিউটনের সূত্র লঙ্ঘন করতে পারেনি। বেশি ত্বরণ বা মন্দন এখনও মানুষের শারীরিক অসুবিধা ঘটাতে পারে। বিশেষভাবে প্রস্তুত এক্সিলারেশন স্যুট পরে থাকলেও সকলেরই অভিকর্ষজ ত্বরণের জন্য কিছুটা অস্বস্তি অনুভব হচ্ছিল। প্রায় পাঁচ ঘণ্টা লেগে গেল স্পেস স্টেশনে পৌঁছাতে।
স্পেস স্টেশনটিকে একটি ভাসমান শহর বলা যেতে পারে। প্রায় ৩০ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের এই স্পেস স্টেশনটিতে স্থায়ী এবং অস্থায়ী পদে রয়েছেন হাজার দশেক মানুষ যার মধ্যে সামরিক পদে রয়েছেন আইএসএফ-এর বিভিন্ন পদাধিকারী সৈনিক এবং অফিসার। অসামরিক পদে রয়েছেন বিভিন্ন টেকনিশিয়ান, বিজ্ঞানী এবং অন্যান্য কিছু কাজের জন্য বেশ কিছু ব্যক্তিবর্গ। স্পেস স্টেশনের মধ্যে প্রবেশের জন্য রয়েছে বেশ কয়েকটি এয়ারলক। এই যাত্রায় স্কাই এলিভেটর ক্যাপসুলটি এসে থামল তিন নম্বর এয়ারলকে।
ক্যাপসুলের দরজা এবং এয়ার লকের দরজার মধ্যের অংশটি সাধারণ অবস্থায় বায়ুশূন্য থাকে। ক্যাপসুলটি চৌম্বকীয় কলারের মাধ্যমে এয়ারলকে সংযুক্ত হওয়ার পর দুটি দরজার মধ্যবর্তী অংশে বায়ু প্রবেশ করানো হচ্ছিল যতক্ষণ না সেখানকার চাপ বায়ুমণ্ডলের চাপের সমান হয়। চাপ সমান হওয়ার পর সবুজ আলো জ্বলে উঠল এবং ক্যাপসুলের দরজা খুলে গেল। সত্যসন্ধানী টিম একটু উৎকণ্ঠা নিয়েই প্রবেশ করলেন এয়ারলকে। এয়ারলকের দরজা খুলে গেল। অপর দিকে অপেক্ষা করছিলেন স্পেস স্টেশনের জনসংযোগ বিভাগের এক কর্মী।
মাঝারী উচ্চতার মানুষটির গায়ের রং কৃষ্ণবর্ণ, সম্ভবত দক্ষিণ ভারতীয়। গায়ে বাদামি রঙের স্যুট, কালো নেমপ্লেটে সোনালী অক্ষরে দেবরাজন নামটি জ্বলজ্বল করছে। মৃদু হেসে অভিবাদন জানিয়ে বললেন, “স্পেস স্টেশন আকাশগঙ্গায় আপনাদের স্বাগত জানাই। আপনাদের আগামী দিনগুলি নির্বিঘ্নে কাটুক।”
তাঁর নির্দেশে স্পেস স্টেশনের এক কর্মীর সঙ্গে একটি ছোট হোভারকারে চেপে বিভিন্ন সুড়ঙ্গপথের মধ্য দিয়ে পৌঁছানো গেল বিশ্রামকক্ষে। স্পেস স্টেশনে মাধ্যাকর্ষণ শক্তির প্রভাব খুব কম হওয়ায় টিমের সদস্যদের চৌম্বকীয় জুতো পড়ে চলাফেরা করতে হচ্ছিল। ক্যাপসুলের মধ্যেই খাওয়া দাওয়া সারা হয়ে গেছে। এবার রাতটুকু ঘুমানো যাক। তবে ঘুমানো অভ্যাস করতে একটু সমস্যা হবে। মাধ্যাকর্ষণ অত্যন্ত ক্ষীণ হওয়ার জন্য পৃথিবীর মতো ঘুমানো এখানে চলে না। পোশাকের সঙ্গে আটকানো আছে কয়েকটি স্ট্র্যাপ, সেই স্ট্র্যাপ দেওয়ালের বিভিন্ন হুকে আটকে দিতে হয়। স্বয়ংক্রিয়ভাবে আলোগুলি ক্রমশ স্তিমিত হয়ে আসে। একসময় ঘুম নেমে আসে চোখে।
দ্বিতীয় দিন:
সকাল সাড়ে পাঁচটার সময় মৃদু আলো জ্বলে ওঠে বিশ্রামকক্ষে। ক্রমশ তার ঔজ্জ্বল্য বাড়তে থাকে। ঠিক যেমন ভাবে সকাল হয়, তেমনই ঘটনা কৃত্রিম ভাবে ঘটানো হয়। কিছুক্ষণ সময় দেওয়া হয়েছে প্রাতকৃত্য সারার জন্য। এর ব্যবস্থাও অন্যরকম তবে সে বিবরণ দেওয়াটা রুচিশীল হবে না। এরপর প্রাতরাশ সেরে নেওয়া হল ক্যাফেটেরিয়াতে। আমিষ এবং নিরামিষ দু’রকম খাবারই পাওয়া যায় এখানে। তবে প্রত্যেকটি খাবারই অত্যন্ত স্বাস্থ্যসম্মত, যদিও স্বাদের কিছুটা অভাব লক্ষ করা যায়। এরপর পরবর্তী গন্তব্য জিমন্যাশিয়াম।
মাধ্যাকর্ষণ শক্তির প্রভাব অত্যন্ত কম হওয়ায় এখানে শরীরের হাড় এবং পেশীর ক্ষয় খুব দ্রুত হয়। সেজন্য প্রতিটি মানুষকেই শারীরিক সক্ষমতা বজায় রাখার জন্য প্রতিদিন ন্যূনতম দু-ঘণ্টা বিভিন্ন ব্যায়াম করতে হয়। জিমন্যাশিয়াম থেকে বেরোনোর পর রিপোর্টার টিমের সাক্ষাৎ হবে স্টেশন ডাইরেক্টর স্টেফানি গোমসের সঙ্গে।
গোমস ম্যাডামের অফিসটি স্পেস স্টেশনের কেন্দ্রস্থলে। অফিসের বাইরে সশস্ত্র রক্ষী মোতায়েন। দরজার বাইরে একটি ডেস্কের কর্মচারী অ্যাপয়েন্টমেন্ট এর চিঠিটি দেখে কম্পিউটারে তথ্য পাঠালেন। একটু পরে দরজা খুলে গেল।
একজন মাঝবয়সী ফর্সা ভদ্রলোক এগিয়ে এসে বললেন “নমস্কার, আমি সুতন্দ্র রায়, ডাইরেক্টরের ব্যক্তিগত সহকারী। আপনারা ভিতরের ঘরে আসুন, ম্যাডাম আপনাদের জন্য অপেক্ষা করছেন।”
মূল দরজা থেকে কিছুটা দূরে দ্বিতীয় দরজা। আকাশগঙ্গার প্রতিটি দরজা স্বয়ংক্রিয়ভাবে খোলার সময় দুটি পাল্লা দু-ধারের দেওয়ালের মধ্যে ঢুকে যায়। দরজার পাশে বসানো গোপন ক্যামেরায় আগত ব্যক্তির মুখ, চোখের রেটিনা স্ক্যান হয় নিমেষের মধ্যে, এবং সেই তথ্য কেন্দ্রীয় ডেটাবেসে থাকা অনুমোদিত ব্যক্তিদের তালিকায় থাকলে তবেই দরজা খোলে। ঘরে ঢুকতেই একটি সুসজ্জিত গোল টেবলের একদিকে বসে থাকা ডাইরেক্টর ম্যাডাম উঠে দাঁড়ালেন এবং অভ্যর্থনা জানালেন। তিনি একজন কর্মঠ ব্যক্তি সেটা তাঁর ব্যক্তিত্ব দেখেই বোঝা যায়। স্টেশন ডাইরেক্টর পদটি অসামরিক হলেও এই পদে আসীন হবার যোগ্যতার সঙ্গে শারীরিক সক্ষমতার পরীক্ষাতেও সফল হতে হয়। মিস গোমস যে সেই পরীক্ষাতেও সসম্মানে উত্তীর্ণ হয়েছেন সেটা বোঝা যায়। প্রায় ছয় ফুট উচ্চতার প্রবল ব্যক্তিত্বময়ী এই মানুষটির কিন্তু সৌজন্যবোধে কোনও ত্রুটির অবকাশ নেই। ইন্টারকম মারফৎ কফি এবং স্ন্যাকস আনার নির্দেশ দিলেন। এরপর কথোপকথন শুরু হল।
“আকাশগঙ্গায় এসে আমরা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে গেছি। আইএসএফ সত্যই অসম্ভবকে সম্ভবে রূপান্তরিত করেছে। আমরা আইএসএফ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চাই।”
“আইএসএফ-এর পক্ষ থেকে আপনাদের ধন্যবাদ জানাই। এই প্রথম আইএসএফ-এ কোনও রিপোর্টার প্রবেশ করার অনুমতি পেয়েছেন। আকাশগঙ্গা সম্পর্কে আপনাদের যা যা জিজ্ঞাস্য সেগুলো এক এক করে বলুন, আমি যথাসাধ্য উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করব। তবে কিছু তথ্য দেশের নিরাপত্তার স্বার্থে জানানো যাবে না।”
“দেশের নিরাপত্তার দায়িত্ব তো এখন আইএসএফ-এরই হাতে। আমরা কোনওভাবেই চাই না যে সেই নিরাপত্তা বিঘ্নিত হোক।”
“দায়িত্বশীল রিপোর্টারের ভূমিকা এমনই হওয়া উচিৎ। এবার প্রশ্ন করতে শুরু করুন।”
“প্রথমেই যেটা জানতে চাইব সেটা হল আইএসএফ-এর সূচনা কীভাবে হয়?”
“ডিফেন্স স্পেস এজেন্সির তত্ত্বাবধানে ডিফেন্স স্পেস রিসার্চ অর্গানাইজেশন এই ব্যাপারে প্রাথমিক গবেষণা শুরু করেন। মহাকাশের সামরিকীকরণ যে শুধুই সময়ের অপেক্ষা সেটা বোঝা গিয়েছিল। পরবর্তীকালে ইসরো এবং ডিআরডিও-র গবেষণার ফলাফল এর সঙ্গে যুক্ত হয়। আইএসএফ-এর প্রথম সামরিক মহাকাশযান ছিল পুষ্পক। এটি ছিল একটি ছোট যান, যার দৈর্ঘ্য ৫০ মিটার। টাইটানিয়াম ও আলুমিনিয়ামের একটি সঙ্কর ধাতু এবং উচ্চ তাপমাত্রা সহনশীল সেরামিকের বিভিন্ন স্তর দিয়ে এর নির্মাণ করা হয়েছিল। দেশের প্রথম নিম্নতর তাপমাত্রার ফিউশন ইঞ্জিন এই যানটিতে স্থাপন করা হয়েছিল।”
“স্পেস স্টেশন নির্মাণের কথা আপনারা কেন ভাবলেন? এর নির্মাণ এবং পরিচালনা খরচ তো আকাশছোঁয়া!”
“স্পেস স্টেশন নির্মাণ করার বিপুল খরচ হলেও একে আমরা ভবিষ্যতের জন্য বিনিয়োগ হিসাবেই দেখেছিলাম। এবং আমাদের সেই ভাবনা আজ ফলদায়ক হয়েছে।”
“একটু যদি বুঝিয়ে বলেন।”
“ফিউশন ইঞ্জিন দ্বারা চালিত হলেও যে কোনও মহাকাশযানের বিপুল ভরের জন্য সেটিকে মাধ্যাকর্ষণের বিপরীতে চালনা করতে বিপুল শক্তির প্রয়োজন। স্পেস স্টেশনে অত্যন্ত মৃদু মাধ্যাকর্ষণের জন্য আমরা মহাকাশযান এখান থেকেই উৎক্ষেপণ করতে পারি অনেক কম শক্তি খরচ করে। বিভিন্ন যন্ত্রাংশ স্কাই এলিভেটরের সাহায্যে স্পেস স্টেশনে তুলে এনে এখানেই মহাকাশযানের নির্মাণ সম্পূর্ণ করা হয়।”
“এত বিশাল কর্মকাণ্ডে আপনারা কি কোনও বাধার সম্মুখীন হয়েছিলেন?”
“যে কোনও ভালো কাজ করতে গেলেই বাধা আসে। দেশের অনেক মানুষই এই স্পেস স্টেশনকে জিডিপির ওপর বাড়তি চাপ বলে মনে করেন। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক চাপ তো আছেই। তবে সব চাপ জয় করে আমরা আজ এক সফল মহাকাশ শক্তিতে পরিণত হয়েছি।”
“এবার এই স্পেস স্টেশনের গঠন সম্পর্কে যদি কিছু বলেন।”
“গোপনীয়তার কারণে এই বিষয়ে বিস্তারিত জানানো যাবে না, সংক্ষেপে জানাচ্ছি। আকাশগঙ্গার আকৃতি অনেকটা গোলাকার চাকতির মতো। মাঝের অংশটি অপেক্ষাকৃত পুরু। কেন্দ্র থেকে বাইরের দিকে ক্রমশ পাতলা হয়ে গিয়েছে। এটির ব্যাস প্রায় তিন কিলোমিটার। কেন্দ্রস্থলের বেধ প্রায় ৫০০ মিটার এবং বাইরের অংশের বেধ প্রায় ৩০০ মিটার। বিভিন্ন সঙ্কর ধাতু, সেরামিক, পলিমার ইত্যাদির বিভিন্ন স্তর দিয়ে আকাশগঙ্গার গঠন করা হয়েছে। এর মধ্যবর্তী স্থানকে বিভিন্ন কক্ষে ভাগ করা হয়েছে। কোনও কক্ষ বিশ্রামকক্ষ, কোনওটি ক্যাফেটেরিয়া, জিমন্যাশিয়াম, গবেষণাগার ইত্যাদি।”
“আচ্ছা, এই স্পেস স্টেশনে কি কোনও রকম অস্ত্রসম্ভার রয়েছে?”
“স্পেস স্টেশনের ভিতরে অস্ত্রের ব্যবহার নিষিদ্ধ, তবে রক্ষীদের প্রাণঘাতী নয় এমন অস্ত্র ব্যবহারের অনুমতি রয়েছে। স্পেস স্টেশনের অস্ত্রভাণ্ডারে রয়েছে মূলত তিন ধরণের অস্ত্র– গতিশক্তি নির্ভর বা কাইনেটিক, ক্ষেপণাস্ত্র বা মিসাইল এবং রশ্মিনির্ভর বা বিম। কাইনেটিক অস্ত্র মূলত অত্যন্ত দ্রুতগতির ধাতব বস্তু যা তার গতিশক্তির প্রভাবে মারাত্মক ধ্বংসাত্মক। একবিংশ শতাব্দীর প্রথমদিকে যে রেলগান ব্যবহৃত হত তারই প্রভূত উন্নতির মাধ্যমে কাইনেটিক অস্ত্রের জন্ম। উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন তড়িৎচুম্বকীয় ক্ষেত্রের প্রভাবে একটি ধাতুর টুকরোকে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার প্রতি সেকেন্ড গতিতে নিক্ষেপ করা হয়। মিসাইলগুলি বিভিন্ন ধরণের, কোনওটি পৃথিবীতে আঘাত হানতে সক্ষম কোনওটি মহাকাশের কোনও বস্তুকে ধ্বংস করতে পারে। বিম হল উচ্চ শক্তিসম্পন্ন লেজার রশ্মি, যা বেশ কিছু মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন। এই অস্ত্রগুলির প্রয়োগ আক্রমণাত্মক বা আত্মরক্ষামূলক দুইভাবেই হয়ে থাকে।”
“স্পেস স্টেশনে কী কী মহাকাশযান তৈরি করা হয়ে থাকে?”
“এখানে বিভিন্ন ধরণের যান তৈরি করা হয়। বিভিন্ন গ্রহাণু থেকে খনিজ আহরণ করার জন্য বিভিন্ন মাপের যান, ফাইটার ও বম্বার বহনকারী ক্যারিয়ার যান, বিভিন্ন মাপের যুদ্ধজাহাজ ইত্যাদি নির্মাণ করা হয়।”
“এবার আমাদের শেষ প্রশ্ন। ভবিষ্যতে আইএসএফ নিয়ে আপনারা কী ভাবছেন?”
“আইএসএফ-কে এখনও অনেকটা পথ যেতে হবে। আমরা আকাশগঙ্গাকে আরও বড় এবং উন্নত করতে চাই। বিভিন্ন মহাকাশযানকে আরও দ্রুতগতিতে চালনা করা এবং অত্যাধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত করা আমাদের উদ্দেশ্য। যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিয়েই কিন্তু আমরা শান্তি বজায় রাখতে পারি। এ প্রসঙ্গে বলে রাখা ভালো যে কিছু কিছু অসামরিক কাজও আইএসএফ করে থাকে যেমন, কোনও বড় গ্রহাণু পৃথিবীর কাছাকাছি আসছে কিনা তা পর্যবেক্ষণ করা, দেশের বিভিন্ন অংশের আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ করা ইত্যাদি।”
“অনেক ধন্যবাদ ম্যাডাম। আপনার ব্যস্ত সময়সারণীর মধ্যে আমাদের এতটা সময় দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ।”
“আকাশগঙ্গায় আপনাদের বাকি দিনগুলি শুভ হোক, নমস্কার।”
এই কথোপকথন শেষ হওয়ার পর লাঞ্চ সেরে নেওয়া হল রেস্তোরাঁয়। লাঞ্চের পর স্পেস গ্যালারিতে কিছু সময় অতিবাহিত করে রিপোর্টার টিম বিশ্রামকক্ষে ফিরে গেলেন।
সন্ধ্যায় যাওয়া হল সিমুলেশন সেন্টারে। সিমুলেশন সেন্টারে পাইলটদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় ভার্চুয়াল জগতে। এখানে একসঙ্গে পঞ্চাশ জনকে প্রশিক্ষণ দেওয়া যেতে পারে। পঞ্চাশটি চেয়ার রয়েছে যেগুলি দেখতে অনেকটা আরামকেদারার মতো। বিভিন্ন যন্ত্রপাতি লাগানো রয়েছে প্রতিটি চেয়ারে। একজন প্রবীণ পাইলট প্রশিক্ষণের দায়িত্বে রয়েছেন। তাঁর ছোট একটা ইন্টারভিউ নেওয়া হল।
“নমস্কার, আমি সিমুলেশন ট্রেনার আয়েশা। আপনাদের আসার খবর আগেই পেয়েছি। বলুন, কী জানতে চান। তবে প্রশ্নগুলো সংক্ষেপে করবেন। অত্যন্ত ব্যস্ততার মধ্য দিয়ে আমাকে প্রশিক্ষণ দিতে হচ্ছে।”
“আমরা আপনার বেশি সময় নেব না। আচ্ছা, আপনিই কি একমাত্র প্রশিক্ষক?”
“আছেন আরও দুজন। তবে একজন অন্য একটি সিমুলেটর নির্মাণের পর্যবেক্ষণ করতে ব্যস্ত এবং আরেকজন শারীরিক কিছু অসুস্থতার কারণে কয়েকদিনের ছুটিতে আছেন।”
“আপনারা একজন পাইলটকে কীভাবে নির্বাচন করেন? পুরুষ এবং মহিলা যে কেউ কি পাইলট হতে পারেন?”
“পুরুষ বা মহিলা নির্বিশেষে পাইলট হতে পারেন যে কোনও মানুষ যদি তাঁর কিছু গুণ থাকে। ফাইটার বা বম্বার পাইলটের ক্ষেত্রে ৫ ফুট ৬ ইঞ্চির কম এবং ৫ ফুট ১০ ইঞ্চির বেশি উচ্চতার কেউ পাইলট হতে পারেন না। তবে ক্যারিয়ার বা অন্য যুদ্ধজাহাজ চালনার জন্য এই উচ্চতার বাধ্যবাধকতা নেই। পাইলটদের যে গুণগুলি থাকতেই হবে সেগুলি হল তাৎক্ষণিক ডিসিশন নেওয়ার ক্ষমতা, বরফের মতো ঠান্ডা মস্তিষ্ক এবং নিস্পৃহ থাকার ক্ষমতা।”
“পাইলটদের সঙ্গে কি কথা বলা যেতে পারে?”
“হ্যাঁ, বলতে পারেন। তবে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে। সিমুলেশন শেষ হলে আপনারা আপনাদের জিজ্ঞাস্য পাইলটদের কাছে বলতে পারেন।”
কিছুক্ষণ পর…
“নমস্কার, আমি রিপোর্টার মিস ছায়াপথ সেনগুপ্ত। আপনার সঙ্গে কিছু কথা বলতে চাই।”
“নমস্কার, আমি ট্রেনি পাইলট দানিয়েল চন্দ্র। বলুন কী জানতে চান।”
“আপনি কতদিন এই সিমুলেটরে প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন এবং কীভাবে এই ট্রেনিং হয়?”
“আমাদের প্রশিক্ষণের সময়কাল দু-বছর। এর মধ্যে প্রথম বছর সিমুলেটরে এবং শেষ বছর আসল যানে প্রশিক্ষণ।”
“আচ্ছা কে কোন যানের পাইলট হবেন তা কি প্রথম থেকেই ঠিক করা থাকে?”
“না, ঠিক করা থাকে না। দু’বছরের প্রশিক্ষণ শেষে যাঁদের দক্ষতা সর্বাধিক হয় তাঁরা হন ফাইটার পাইলট, অপেক্ষাকৃত কম দক্ষতার পাইলট চালান বম্বার। আর যাঁদের দক্ষতা সাধারণ মানের তাঁরা চালান চিকিৎসার উপকরণ এবং চিকিৎসকদল সমন্বিত মেডিকেল শিপ বা খনিজ আহরণকারী মাইনিং শিপ ইত্যাদি।”
“আর ক্যারিয়ার বা যুদ্ধজাহাজের ক্ষেত্রে?”
“ফাইটার বা বম্বার পাইলটরা বেশ কয়েকবছর পর পদোন্নতির সুযোগ পান তাঁদের দক্ষতা এবং অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে।”
“নারী এবং পুরুষের মধ্যে পাইলট হিসাবে কে বেশি দক্ষ?”
“এই ধরণের প্রশ্ন না করাই ভালো। আমাদের একটাই বিবেচ্য বিষয় তা হল ব্যক্তিগত দক্ষতা। এখানে নারী পুরুষ ভেদাভেদ নেই।”
“আচ্ছা, এতদিন ধরে পরিবার থেকে দূরে থাকলে আপনাদের অসুবিধা হয় না?”
“অসুবিধা প্রথম প্রথম হয়, তারপর ব্যাপারটা গা সওয়া হয়ে যায়। আর একই স্কোয়াড্রনের পাইলটদের মধ্যে বন্ধুত্ব খুবই গভীর হয়।”
“অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। আশা করি আপনি ভবিষ্যতে অনেক উঁচু পদে উন্নীত হবেন।”
“নমস্কার।”
দুপুরের খাওয়াদাওয়া সারার পর এবার কিছু বিনোদনের পালা। ত্রিমাত্রিক হলোগ্রাফিক প্রজেক্টরে একটি সিনেমা দেখার পর বিকেলে দেখতে যাওয়া হল মহাকাশযান নির্মাণস্থল। উপযুক্ত প্রশিক্ষণ না থাকায় রিপোর্টার টিম এই স্থানে প্রবেশের অনুমতি পেলেন না। অনেক মানুষ এবং স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র করে চলেছে মহাকাশযান নির্মাণের কাজ। অনভ্যস্ত রিপোর্টার টিম প্রবেশ করলে কাজে বিঘ্ন ঘটার এবং অসাবধানতাবশত দুর্ঘটনায় পড়ার সম্ভাবনা থাকতো। তবে পুরোপুরি হতাশ হতে হয়নি টিমকে। একটি প্লেক্সিগ্লাস নির্মিত বড় জানালা দিয়ে পুরো জায়গাটা দেখতে পাওয়া যাচ্ছিল।
স্পেসইয়ার্ড সুপারভাইজার কাজরিকা জানালেন, “বর্তমানে একটি সুবিশাল যুদ্ধজাহাজ প্রস্তুতির কাজ চলছে। সুপার ড্রেডনট শ্রেণীর এই স্পেসশিপটি লম্বায় প্রায় এক কিলোমিটার। এই স্পেসশিপ তৈরি হতে এক বছর সময় লাগবে।”
“এই স্পেসশিপের ব্যাপারে সংক্ষেপে কিছু বলতে পারেন?”
“দেখুন, এই স্পেসশিপটির তথ্যাবলী বেশিরভাগই ক্লাসিফায়েড। সামান্য কিছু বলতে পারব। এটি একটি চ্যাপ্টা শঙ্কু আকৃতির যান। এর ধারণক্ষমতা প্রায় ২০০০ জন। এর সর্বোচ্চ গতিবেগ হবে প্রতি ঘণ্টায় এক মিলিয়ন মাইলেরও বেশি। একটি ওয়ারহেড বিশিষ্ট ক্ষেপণাস্ত্রের পাশাপাশি বহু ওয়ারহেড বিশিষ্ট ক্ষেপণাস্ত্র থাকবে এর অস্ত্রভাণ্ডারে। এগুলির ন্যূনতম রেঞ্জ ৫০০০০ কিলোমিটার। এ ছাড়াও থাকবে বেশ কয়েকটি ১০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন লেজার বিম। এক গিগাওয়াট ক্ষমতার খুব স্বল্প সময়ের জন্য কার্যক্ষম একটি পরীক্ষামূলক লেজার বিমও এতে থাকবে। আরও কিছু পরীক্ষামূলক নতুন প্রযুক্তির অস্ত্র থাকতে পারে। কোনও গ্রহ বা উপগ্রহে নামার জন্য প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সৈন্যদল এবং তাদের বহন করার জন্য শাটলও আছে।”
“দেশের এই অভূতপূর্ব উন্নতিতে দেশবাসী গর্বিত। ভবিষ্যতে আইএসএফ আরও উন্নতি করবে এই আশা রাখি।”
“ধন্যবাদ আপনাদের যে আমাদের এই উদ্যোগের কথা আপনারা দেশবাসীর কাছে পৌঁছে দিতে উদ্যোগী হয়েছেন।”
“আইএসএফ নিয়ে দেশবাসীর মনে অনেক ভুল ধারণা আছে। সেই ধারণাগুলিকে নির্মূল করাই আমাদের লক্ষ্য।”
পরস্পরের প্রতি অভিবাদন জানিয়ে কথোপকথন শেষ হল। আজ এক বিশেষ নৈশভোজে রিপোর্টার টিমকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন স্টেশন ডাইরেক্টর। উচ্চপদস্থ বিভিন্ন ব্যক্তিও উপস্থিত থাকবেন এই বিশেষ নৈশভোজে। এই ব্যাপারটির বর্ণনা এখানে অপ্রাসঙ্গিক। নৈশভোজের পর আবার বিশ্রামকক্ষে ফেরা। আগামীকাল অপেক্ষা করছে নতুন কিছু।
তৃতীয় দিন:
সকালে প্রাতরাশ সারার পর রিপোর্টাররা গিয়ে উপস্থিত হলেন পাঁচ নম্বর এয়ারলকে। এয়ারলকের বাইরে অপেক্ষা করছে একটি স্পেস শাটল। এই যানটি অনেকটা ঘনকাকৃতি বাক্সের মতো দেখতে। এটি শুধুমাত্র মহাকাশেই চলতে পারে। বায়ুমণ্ডলে ওড়ার ক্ষমতা এর নেই। স্পেস শাটলে অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই পৌঁছে যাওয়া হল একটি স্পেস ক্যারিয়ারে। ক্যারিয়ারটির নাম বিনাশক। এয়ারলক দিয়ে ক্যারিয়ারে প্রবেশ করার পর কয়েকজন রক্ষী আমাদের পরিচয় যাচাই করার পর স্বাগত জানালেন। ক্যারিয়ারটির কেন্দ্রীয় অক্ষরেখা বরাবর একটি চওড়া সুড়ঙ্গপথ। এখানেও হোভারকারে যাতায়াত করার ব্যবস্থা রয়েছে। সুড়ঙ্গপথ থেকে বিভিন্ন শাখা সুড়ঙ্গ নির্গত হয়েছে। সত্যসন্ধানী টিমের জন্য একাধিক বিশ্রামকক্ষের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
কিছুক্ষণ বিশ্রামের পর টিম পৌঁছে গেলেন ক্যারিয়ারের ক্যাপ্টেন রমনীষ থাকরালের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে। রমনীষ দেশের প্রথম ট্রান্সজেন্ডার স্পেসশিপ ক্যাপ্টেন। স্বাগতম জানানোর পর তিনি বললেন, “স্পেস ক্যারিয়ার সম্পর্কে আপনাদের নিশ্চিতভাবেই অনেক কিছু জিজ্ঞাস্য থাকবে। আপনারা স্পেস স্টেশনটি যেমন পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে পর্যবেক্ষণ করেছেন তা বেশ প্রশংসনীয়। এখানেও আমরা আপনাদের সমস্ত ক্যারিয়ারটি ঘুরিয়ে দেখাব। তবে স্পেস স্টেশনের মতো সুযোগ সুবিধা হয়তো পাবেন না। যুদ্ধযানকে বেশি আরামদায়ক রূপে নির্মাণ করলে সৈন্যরা আরামপ্রিয় হয়ে উঠবে। আর তা ছাড়া আরামের উপকরণের বদলে যদি বেশি অস্ত্র রাখা যায় তাহলে সেটাই তো কাম্য।”
“আমাদের অনেক কিছুই জিজ্ঞাস্য আছে, তবে তার আগে একটি ব্যক্তিগত প্রশ্ন করতে চাই যদি কিছু মনে না করেন।”
“মনে হয় আপনাদের প্রশ্নটা আন্দাজ করতে পারছি। তবু বলুন কি প্রশ্ন।”
“একজন ট্রান্সজেন্ডার মানুষ হিসাবে আপনাকে…?”
কথা শেষ করতে না দিয়ে ক্যাপ্টেন বলে উঠলেন, “কোনও প্রতিকূলতার সম্মুখীন হতে হয়েছে কি না এই তো? প্রতিকূলতা তো থাকবেই। বেশ কিছু মানুষ আজও যাদের অস্বাভাবিক মনে করে, তাদের পক্ষে উচ্চপদে আসীন হওয়াটা অসম্ভব না হলেও বেশ কঠিন। তবে ব্যক্তিগত দক্ষতা এবং বেশ কিছু প্রগতিশীল মানুষের সাহায্য পেয়ে আমি আজ এই জায়গায় পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছি।”
“আপনি এক নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। আশা করি আগামী দিনে আপনাকে আরও উচ্চপদে দেখতে পাব। এবার এই স্পেস ক্যারিয়ারের সম্পর্কে কিছু বলুন।”
“স্পেস ক্যারিয়ারটি অনেকটা আয়তাকার বাক্সের ন্যায় আকৃতির। এর দৈর্ঘ্য ৭০০ মিটার এবং প্রস্থ ৫০০ মিটার। কেন্দ্রীয় অক্ষের দুই পাশে রয়েছে পাঁচটি করে লঞ্চ বে। একটি লঞ্চ বে থেকে একটি করে ফাইটার এবং বম্বার প্রেরণ করা যায়। ক্যারিয়ারের মূল কাজ হল ফাইটার ও বম্বারগুলিকে যুদ্ধক্ষেত্রে পৌঁছান। একবিংশ শতাব্দীর এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারের সঙ্গে এর কার্যপ্রণালীর মিল আছে। ক্যারিয়ারের আক্রমণাত্মক অস্ত্র তেমন না থাকায় এটি একটি সহজ নিশানা হয়ে পড়ে। এজন্য বেশ কিছু আত্মরক্ষামূলক অস্ত্রের ব্যবস্থা আছে এখানে। অপেক্ষাকৃত কম শক্তিশালী লেজার বিম, কিছু স্বয়ংক্রিয় চালকবিহীন ড্রোন এবং কিছু স্পেস মাইন এই অস্ত্রগুলির মধ্যে প্রধান। পরবর্তীকালে কিছু আক্রমণাত্মক অস্ত্র এই ক্যারিয়ারে যোগ করা হতে পারে।”
“এবার আমরা কি ফাইটার ও বম্বারগুলি দেখতে পারি?”
“এখন সেটা সম্ভব নয়। এই মুহূর্তে একটি যুদ্ধের মহড়া চলছে। সেটি শেষ হলে তার কিছু সময় পর আপনারা যেতে পারবেন।”
“যুদ্ধের মহড়া কীভাবে হয়?”
“ফাইটার ও বম্বারদের সমানভাবে দুটি ভাগে বিভক্ত করা হয়। ট্রেনিং মোড চালু করা হয়। আসল অস্ত্র এইসময় কাজ করে না। ফাইটার বা বম্বার থেকে নির্গত আলোকরশ্মির বিভিন্ন তীব্রতা, কম্পাঙ্ক এবং সময়ের ব্যবধান দিয়ে বিভিন্ন অস্ত্রের সিমুলেশন করা হয়। একপক্ষের আলোকরশ্মি অপরপক্ষের উপর পড়লে কম্পিউটার কতটা ক্ষতি হল তা নির্ণয় করে। নির্দিষ্ট সময়ের শেষে যাদের ক্ষতির পরিমাণ কম, তারাই বিজয়ী হয়।”
এরপর ক্যাপ্টেনের কক্ষের একপাশে লাগানো বিশাল ভিউস্ক্রিনে এই মহড়া দেখলেন সকলেই। কিছুক্ষণ পর মহড়া শেষ হল। ক্যাপ্টেন বললেন, “আপনারা লাঞ্চ সেরে বিশ্রাম নিন কিছুক্ষণ। বিশ্রামের পর আপনাদের নিয়ে যাওয়া হবে লঞ্চ বে দেখাতে।”
লঞ্চ বে একটি আয়তাকার কক্ষ যেগুলি কেন্দ্রীয় সুড়ঙ্গের সঙ্গে শাখা সুড়ঙ্গ দ্বারা যুক্ত। এই সুড়ঙ্গের মুখে একটি এয়ারলক রয়েছে। অপরদিকে রয়েছে একটি বিশালাকার দরজা যা কক্ষটির সম্পূর্ণ দৈর্ঘ্য জুড়ে রয়েছে। একটি ফাইটার এবং বম্বার স্থির অবস্থায় রয়েছে। আশপাশে অনেক টেকনিশিয়ান সেগুলিকে পরীক্ষানিরীক্ষা করছেন। ফাইটারগুলি অনেকটা এয়ারফোর্স ফাইটারের মতোই দেখতে কিন্তু ডানাগুলি গুটানো অবস্থায় রয়েছে।
ক্যাপ্টেন আবার কথা শুরু করলেন, “বম্বারগুলি ফাইটারের থেকে প্রস্থে বেশি হলেও, সামগ্রিক গঠন প্রায় একই রকম। ফাইটারগুলিতে অস্ত্র হিসাবে অটো রেলগান, স্বল্প পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র আছে। বম্বারের একমাত্র অস্ত্র উচ্চগতিসম্পন্ন গাইডেড বোমা। অত্যধিক শক্তির প্রয়োজন বলে ফাইটার বা বম্বারে লেজার বিম স্থাপন করা হয়নি। একবার জ্বালানি ভরা হলে এগুলি প্রায় ১০ হাজার কিলোমিটার যেতে পারে। ফাইটারের ক্ষেত্রে আর একটি বিশেষ ব্যাপার আছে। সেটির ব্যাপারে আপনি কোনও পাইলটের সঙ্গে কথা বললে বিশদে জানতে পারবেন।”
এরপর তিনি ডেকে পাঠালেন সিনিয়র ফাইটার পাইলট নীহারিকা চট্টরাজকে।
“নিহা, এরা সত্যসন্ধানী ওয়েব ম্যাগাজিনের পক্ষ থেকে আইএসএফ-এর উপর একটি ফিচার লিখবেন। এদের সাহায্য করো।”
“অবশ্যই সাহায্য করব, ক্যাপ্টেন। বলুন কী জিজ্ঞাস্য আছে?”
“ফাইটার বা বম্বার পাইলটরা কি প্রত্যেকে নিজেই সিদ্ধান্ত নেন নাকি কোনও পূর্বনির্ধারিত নিয়ম অনুযায়ী তাঁদের চলতে হয়?”
“দু’টির কোনওটিই নয়। ফাইটার এবং বম্বারগুলি স্কোয়াড্রন হিসাবে ওড়ে। প্রতি স্কোয়াড্রনে সর্বাধিক ১০ জন পাইলট থাকেন। এর মধ্যে একজন থাকেন স্কোয়াড্রন লিডার। তাঁর নির্দেশ অনুযায়ী বাকিরা চলেন।”
“আচ্ছা, ক্যাপ্টেন বলছিলেন যে ফাইটারের ক্ষেত্রে কোনও এক বিশেষ ব্যাপার আছে। সেটা কি ব্যাপার বলতে পারবেন?”
“বিশেষ ব্যাপার বলতে এই ফাইটারগুলিতে এনএফইউ ব্যবহার করা হয়েছে। এনএফইউ বা নিউরাল ফিডব্যাক ইউনিট এমন একটি যন্ত্র যার মাধ্যমে ফাইটার পাইলটের যে কোনও প্রতিক্রিয়া হয় তাৎক্ষণিক। কোনও তথ্য ফাইটারের কম্পিউটার থেকে সরাসরি পাইলটের মস্তিষ্কে প্রবেশ করে মাথার পিছনে স্থাপিত নিউরাল লিঙ্কের মাধ্যমে। মস্তিষ্কের বিশেষ কিছু অঞ্চলে স্থাপিত নিউরাল চিপ এই নিউরাল লিঙ্কের সঙ্গে যুক্ত থাকে। মস্তিষ্কের নির্দেশ নিউরাল লিঙ্কের মাধ্যমে সরাসরি চলে যায় কম্পিউটারে। এই সম্পূর্ণ ব্যাপারটির নাম হল নিউরাল ফিডব্যাক ইউনিট।”
“এই পদ্ধতি নিশ্চয়ই খুব ব্যয় এবং ঝুঁকিপূর্ণ?”
“পদ্ধতিটি ব্যয়বহুল তো অবশ্যই, কিন্তু ঝুঁকির ব্যাপারটা খুবই কম। মস্তিষ্কে নিউরাল চিপ এবং লিঙ্ক স্থাপনের পুরো পদ্ধতিটি রোবোটিক সার্জেন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় এবং অভিজ্ঞ চিকিৎসকরা পর্যবেক্ষণ করতে থাকেন সম্পূর্ণ পদ্ধতিটি।”
“কেউ যদি তাঁর মস্তিষ্কে চিপ বসাতে সম্মত না হন?”
“সেক্ষেত্রে তিনি ফাইটার পাইলট হতে পারবেন না। ফাইটার পাইলটদের ক্ষেত্রে প্রতিটি মিলিসেকেন্ড গুরুত্বপূর্ণ। জীবন ও মৃত্যুর বলিদান এখানে কয়েক মিলিসেকেন্ড মাত্র। পরীক্ষায় প্রমাণিত হয়েছে যে, এনএফইউ-এর মাধ্যমে পাইলটদের প্রতিক্রিয়ার সময় গড়ে ২৫০ মিলিসেকেন্ড কম হয়েছে। এই কারণেই এনএফইউ ফাইটারের ক্ষেত্রে এক যুগান্তকারী আবিষ্কার।”
“আপনাকে অনেক ধন্যবাদ নীহারিকা ম্যাডাম।”
“আইএসএফ-এ আপনাদের আগামী দিনগুলি শুভ হোক। নমস্কার।”
ইন্টারভিউ নেওয়ার পর আজ আর কোনও কাজ নেই। শুধুই বিশ্রামের পালা। ইচ্ছা করলে অবশ্য ত্রিমাত্রিক সিনেমা দেখা বা ভার্চুয়াল গেমস খেলা যেতে পারে। রিপোর্টার টিম অবশ্য এসব কিছুই করলেন না। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে নৈশভোজে অংশগ্রহণ করলেন ক্যাপ্টেনের আমন্ত্রণে। কাল যাওয়া হবে ব্যাটলশিপ শ্রেণীর একটি যুদ্ধজাহাজ পরিদর্শন করতে। এরপর রিপোর্টার টিম ফিরে যাবেন পৃথিবীর বুকে।
চতুর্থ দিন:
রোজকার মতো সকালের প্রাতরাশ সেরে টিম সত্যসন্ধানী রওনা হলেন ব্যাটলশিপের উদ্দেশে। শাটল চেপে অল্প সময় পরেই পৌঁছে গেলেন ব্যাটলশিপে। এই যুদ্ধজাহাজটির নাম প্রলয়। প্রলয়ের ক্যাপ্টেন শ্রীমতী পরমিনদর কৌর দ্বিতীয় কমান্ডিং অফিসারকে পাঠিয়েছিলেন অভ্যর্থনা জানানোর জন্য। তিনি নিয়ে গেলেন ক্যাপ্টেনের কাছে।
ক্যাপ্টেন কৌর জাহাজের নিয়ন্ত্রণ কক্ষে ছিলেন। তিনি বললেন, “আসুন, আপনাদের জন্যই অপেক্ষা করছিলাম। এই হচ্ছে আমাদের নিয়ন্ত্রণ কক্ষ। এখানে ২৪ ঘণ্টাই কেউ না কেউ ক্যাপ্টেনের ভূমিকা পালন করেন। আট ঘণ্টা করে তিনটি শিফটে তিনজন এই ভূমিকা পালন করেন। আমি ছাড়া কমান্ডিং অফিসার শ্রী নোরবু ভুটিয়া এবং দ্বিতীয় কমান্ডিং অফিসার বিনায়ক পাণ্ডে এই দায়িত্ব পালন করেন। তবে যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে আমাকেই নিয়ন্ত্রণ কক্ষে থাকতে হয়।”
“এখানে অনেকগুলি ডেস্ক দেখতে পাচ্ছি। এগুলির কাজ কী যদি বলেন।”
“যে ডেস্কটি মধ্যখানে সেটি হল ক্যাপ্টেনের। ক্যাপ্টেনের বামদিকের ডেস্কে বসেন নেভিগেশন অফিসার যিনি মহাকাশের সাপেক্ষে মহাকাশযানের অবস্থান, গতিবেগ এবং যাত্রাপথ নির্ধারণ করেন। ট্যাক্টিক্যাল অফিসার বসেন ডানদিকে। তিনি যুদ্ধকালে যুদ্ধনীতি ঠিক করেন। ওয়েপন অফিসারের ডেস্ক পিছনে বামদিকে, যুদ্ধের সময় সমস্ত অস্ত্রের প্রয়োগের ক্ষমতা থাকে এঁর হাতে। আর পিছনের ডানদিকে সেন্সর অফিসার বিভিন্ন সেন্সর থেকে আসা সমস্ত তথ্যের সন্ধান রাখেন।”
“এই যুদ্ধজাহাজটি কি বর্তমানে সবথেকে বড় এবং শক্তিশালী যুদ্ধজাহাজ?”
“এটি দ্বিতীয় বৃহত্তম। বর্তমানে সবথেকে বড় এবং শক্তিশালী হল ড্রেডনট শ্রেণীর যুদ্ধজাহাজ। তবে সেই খেতাব খুব শীঘ্রই চলে যাবে সুপার ড্রেডনট শ্রেণীর কাছে।”
“ব্যাটলশিপ শ্রেণী সম্পর্কে আর একটু বিশদে জানতে চাই, যেমন এর আকার, এবং ক্ষমতা সম্পর্কে।”
“আপনারা কি স্পেস স্টেশনে সুপার ড্রেডনট শ্রেণীর যুদ্ধজাহাজ তৈরি হওয়া দেখেছেন?”
“হ্যাঁ, আমরা দূর থেকে হলেও দেখেছি। অভূতপূর্ব প্রযুক্তিগত উন্নতির একটি নিদর্শন।”
“ওই শ্রেণীর যুদ্ধজাহাজের তুলনায় বেশ কিছুটা ছোট ব্যাটলশিপ শ্রেণী। দৈর্ঘ্য প্রায় ৬৫০ মিটার, সর্বাধিক প্রস্থ ৩০০ মিটার। অস্ত্রশস্ত্রের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম হলেও সেগুলির ক্ষমতা এবং পাল্লা একই। শুধুমাত্র পরীক্ষামূলক কিছু অস্ত্র এবং গিগাওয়াট লেজার এক্ষেত্রে অনুপস্থিত।”
“আচ্ছা এই যুদ্ধজাহাজ প্রস্তুতির বিপুল পরিমাণ উপাদান আপনারা কোথা থেকে পান?”
“উপাদানগুলি বিভিন্ন গ্রহাণু, উল্কাপিণ্ড ইত্যাদি থেকে সংগ্ৰহ করা হয়।”
“আপাতত আমাদের আর কোনও প্রশ্ন নেই। আমরা চারিদিক একটু ঘুরে দেখতে পারি?”
“অবশ্যই পারেন। আমাদের কর্মচারীরা আপনাদের সঙ্গে থাকবেন। শুধু একটা ব্যাপার মেনে চলতে হবে, কোনও এলাকায় প্রবেশের নিষেধাজ্ঞা থাকলে সেটা কঠোরভাবে মেনে চলতে হবে। কোনওরকম অনুরোধ এই ক্ষেত্রে গৃহীত হবে না। আপনাদের দিন শুভ হোক।”
এরপর, টিম সত্যসন্ধানী বেশ কিছুক্ষণ প্রলয়ে কাটানোর পর দুপুরের খাওয়ার সময় হয়ে এল। বিশ্রামের পর এবার জিনিসপত্র গোছানোর পালা। এবারের মতো আইএসএফ সফর শেষ। এরপর শাটলে চড়ে আকাশগঙ্গায় ফেরা এবং সেখান থেকে স্কাই এলিভেটরে আবার পৃথিবীতে ফিরে যাওয়া। রিপোর্টার ছায়াপথ ফেরার পথে ভাবছিলেন, আইএসএফ-এর জীবনযাত্রা যতই উন্নত হোক; আমাদের মতো সাধারণ মানুষরা পৃথিবীতেই আছি ভালো। ওখানকার অত কড়া নিয়মকানুন মানতে পারাটা সত্যই কঠিন। আর এই যে খোলা আকাশের নীচে মুক্ত বাতাসে শ্বাস নেওয়া, এর তুলনায় স্পেস স্টেশনের পরিশ্রুত কৃত্রিম আবহাওয়া অনেকখানি পিছিয়ে।
Tags: কল্পবিজ্ঞান জার্নাল, চতুর্থ বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা, পূজাবার্ষিকী, সুপ্রিয় দাস, সৌমেন দে
দারুণ লেখা! আর্থার সি ক্লার্কের মহাকাশ-ভাবনা আর দেশজ স্বপ্নকল্পনা ভারি সুন্দরভাবে মিশেছে এই লেখায়।