ইলোভাক
লেখক: অমিতাভ রক্ষিত
শিল্পী: সুপ্রিয় দাস
ইলোভাক
লেখক – অমিতাভ রক্ষিত
অলংকরণ – সুপ্রিয় দাস
১
আমাদের ‘দূরপাল্লার জাহাজ’টা ওয়ার্ম হোল থেকে বেরিয়ে স্পিড কমাল একটু। তারপরে সেটা ডানদিকে সামান্য একটু কাত হয়ে যেতেই ছবিতে হাজার বার দেখা, নীল-সবুজে মেশানো ‘ইলোভাক’-এর গোলাকার অবয়বটা চোখে এল। কী অপূর্ব দৃশ্য! এখানে মহাকাশ আমাদের মতন অত কালো দেখায় না। ‘ইলোভাক’-এর কাছাকাছি অঞ্চলে গ্রহ-নক্ষত্রের ঘনত্ব আমাদের চত্বরের মহাকাশের চেয়ে বহুগুণ বেশি। এত নক্ষত্রের ছিটকে আসা আলোর কল্যাণে, ওয়ার্ম হোল থেকে বেরিয়েই তাই বেশ রুপোলি একটা আভা দেখতে পাচ্ছিলাম চারিদিকে। সেই পটভূমিতে অপার্থিব রহস্যময় ‘ইলোভাক’ আমায় মুগ্ধ করল।
রহস্যময় লাগাটা অবশ্য একেবারে অপ্রত্যাশিত নয়। যতই হোক, আমাদের নিজেদের ম্যাপ অনুযায়ী যেটাকে আমরা বলি ‘আলফা কোয়াড্রেন্ট’, তার প্রথম বাসিন্দা হিসেবে এবং একজন মানুষ হিসেবে ‘ইলোভাক’-এ আমার পদার্পণ, সত্যি বলতে কী নিছক শিক্ষালাভ বা দেশ ভ্রমণের উদ্দেশ্যে নয়। ‘ইলোভাক’ সম্পর্কিত বিশেষ একটি রহস্যের সমাধান করবার চেষ্টা করার জন্য। যদিও আমার পাসপোর্টে লেখা আছে যে, আমি একজন সাংবাদিক আর ভিসায় বলা আছে যে আমি সাংবাদিকতার উচ্চশিক্ষার জন্য আসছি এখানে, আমি কিন্তু আসলে একজন গুপ্তচর। ‘আলফা কোয়াড্রেন্ট সম্মিলিত গ্রহ-উপগ্রহ প্রতিরোধ বাহিনী’-র, অর্থাৎ ‘একিউডি’-এর একজন রীতিমতো বেতনভূক সৈনিক।
‘ইলোভাক’ একটি কৃত্রিম উপগ্রহ। আঞ্চলিক ভাষায় এই শব্দের মানে হল শিক্ষাকেন্দ্র। নামটি যথার্থ। কেন তা একটু পরে বলছি। মহাকাশের এই দিকটায়, যেটাকে আমরা বলি বিটা-গামা কোয়াড্রেন্ট, অনেক ছায়াপথ আর নক্ষত্রমণ্ডলী আছে। আর এত নক্ষত্র আছে বলেই এখানে কোটি কোটি বাসযোগ্য গ্রহ-উপগ্রহও আছে। কাজেই এই অঞ্চলে প্রাণ এবং তা থেকে বিভিন্ন উন্নত প্রযুক্তির সভ্যতারও বিকাশ হয়েছে বহু বছর ধরে। আমাদের আলফা-এপসিলন কোয়াড্রেন্টগুলোয় বাসযোগ্য গ্রহ-উপগ্রহের সংখ্যা অপেক্ষাকৃত কম। তাই উন্নত প্রযুক্তির সভ্যতারও বিকাশ হয়েছে পরে। ফলে মহাকাশের এই দুই ভাগের সভ্যতাগুলোর মধ্যে প্রযুক্তিগত ভাবে বেশ কিছু বৈষম্য আছে।
দূরত্বজনিত বিচ্ছিন্নতার জন্য কিছুদিন আগে পর্যন্তও আমাদের কোয়াড্রেন্টগুলোর কোনও সভ্যতার সঙ্গে বিটা-গামা কোয়াড্রেন্টের কোনও যোগাযোগ কোনওদিন ঘটেনি। সেই ইতিহাস পুনর্লিখিত হয়েছিল আজ থেকে প্রায় একশো বছর আগে। গামা কোয়াড্রেন্টের একটি পরিব্রাজক জাহাজ, একদিন ঘুরতে ঘুরতে এসে নেমেছিল আমাদের অ্যান্ড্রোমিডা ছায়াপথের একটি প্রত্যন্ত উপগ্রহ, ‘নিরাখা’-র মহাকাশ বন্দরে।
‘নিরাখা’ একটি শান্তিপ্রিয় জগৎ। বলা যেতে পারে যে, এটা আলফা কোয়াড্রেন্টের একটি বিশিষ্ট বিলাসভূমি। সেখানে দূর দূর জগৎ থেকে বহুকাল ধরেই লোকেরা আসত হানিমুন করতে, জীবনসঙ্গী বা সঙ্গিনী খুঁজতে কিংবা শুধুই কিছুদিন বিচের ধারে বসে শান্তিতে একটু বিশ্রাম করতে। এত লোক এত বিভিন্ন জায়গা থেকে সেখানে আসতেন বলেই,গামা কোয়াড্রেন্টের পরিব্রাজকেরা যখন প্রথম ‘নিরাখা’য় এসে পৌঁছলেন, তখন তাঁরা খুব সহজেই লোকের কাছে স্বাগত হলেন। ক্রমে বোঝা গেল, বিটা-গামা কোয়াড্রেন্টের বাসিন্দাদের প্রযুক্তি আমাদের প্রযুক্তির তুলনায় অনেক বেশি উন্নত। তা দেখে কিন্তু আমাদের নেতারা, বিশেষ করে সামরিক নেতারা, অত্যন্ত চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলেন। কারণ বিটা-গামার লোকেরা চাইলে যে আমাদের মুহূর্তেই ছারপোকার মতন পিষে ফেলবার ক্ষমতা রাখে, তাতে সন্দেহের কোনও অবকাশ ছিল না। কিন্তু কিংবদন্তিরপ্যান্ডোরার বাক্সের ভোমরাদের মতন, ডালা একবার খোলা হয়ে গেলে তো আর তাদের কোনও মতেই বাক্সে বন্ধ করা যায় না। তাই বিটা-গামার লোকেরাও বেড়াতে আসতে থাকলেন, যোগাযোগও চলল, আমাদের সরকারেরও চিন্তা বাড়তে থাকল।
সৌভাগ্যবশত, মহাকাশের ইতিহাসে যেমন আগে হয়েছে, তেমনই এক্ষেত্রেও প্রমাণ হল যে সভ্যতার যথার্থ অগ্রগতি হলে, কোনও দুর্বল গ্রহ দেখলেই সঙ্গে সঙ্গে সেটাকে আক্রমণ করে আত্মসাৎ করবার প্রবনতাটা কমে যায়। বিটা-গামার লোকেরা শুধুই বন্ধুত্বপূর্ণ যোগাযোগ ও আদানপ্রদানে আগ্রহ দেখাল। ক্রমে আমাদের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক ‘অনাক্রমণ’ ও ‘দ্বিধাহীন বন্ধুত্ব’-র চুক্তি সই হল। সব বাধা ও সন্দেহ নিরসন হলে, তার পরে বিটা-গামা কোয়াড্রেন্ট থেকে আরও জাহাজ ভর্তি ভর্তি ভ্রমণকারীরা বিপুল সংখ্যায় আলফা-ইপসিলন কোয়াড্রান্টের গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে বেড়াতে আসতে লাগলেন। এমনকী, আমাদের পৃথিবীতেও যে দু-একটা জাহাজ ভরা পরিব্রাজকেরা এসে ঘুরে গেলেন না, তা নয়। ক্রমে ওই বিটা-গামা কোয়াড্রেন্টের সভ্যতাগুলোর সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক খুবই হৃদ্যতাপূর্ণ হয়ে গেল।
এখানে উল্লেখযোগ্য যে, আমি এতক্ষণ শুধু বিটা-গামা থেকে আমাদের কোয়াড্রেন্টে বেড়াতে আসবার কথা লিখেছি, উল্টোটা নয়। সরকারি ও মিলিটারি অফিসাররা ছাড়া, আমাদের এখান থেকে কেউই খুব একটা ওই কোয়াড্রেন্টগুলোয় যাবার সুযোগ এখনও পায়নি। তার একটাই কারণ– প্রযুক্তি। আমাদের চত্বর থেকে বিটা-গামা কোয়াড্রেন্ট-এর সভ্যতাগুলো এত দূরে, যে আমাদের সবচেয়ে দ্রুতগামী মহাকাশযানে করেও সেখানে যেতে একহাজার দু’হাজার বছর লেগে যাবে।
যেদিন থেকে আইনস্টাইন আমাদের প্রথম বুঝিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন যে, যাত্রীবাহী যানের পক্ষে আলোর গতিকে অতিক্রম করা কোনও মতেই সম্ভব নয়, তার পর থেকে লোকে ‘ওয়ার্ম হোল’ বেয়ে দূরে দূরে যাতায়াত করবার স্বপ্ন দেখছিল! আলোর থেকে বেশি গতিমান যানের সৃষ্টি করবার প্রচেষ্টা করা হয়েছিল বটে, কিন্তু আইনস্টাইনের অঙ্ক যে অন্তরায় সৃষ্টি করে, তাকে অতিক্রম করা এখনও পর্যন্ত সম্ভব হয়নি। অন্যদিকে, ওয়ার্ম হোল যা নাকি মহাকাশের দুই বিন্দুর মধ্যবর্তী দূরত্বটাকে প্রায় শূন্যে নামিয়ে আনতে পারে, তার অস্তিত্ব আইনস্টাইনের মৃত্যুর বহু শতাব্দী পরে হলেও, শেষ পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া গিয়েছে। দেখা গেল যে ওয়ার্ম হোল দু’রকম হতে পারে– প্রাকৃতিক ও কৃত্রিম। আমাদের কোয়াড্রেন্টগুলোয় বেশ কিছু প্রাকৃতিক ওয়ার্ম হোল খুঁজে পাওয়া গিয়েছে। সেই ওয়ার্ম হোলগুলোর ওপরে নির্ভর করেই আমরা আজ আলফা-ইপসিলন কোয়াড্রেন্টের মধ্যে বিভিন্ন জায়গায় মাত্র কয়েক ঘণ্টার উড়ানেই পৌঁছে যেতে পারি। ফলে একসময় যেমন জেট ইঞ্জিন আবিষ্কারের পরে পৃথিবীটা হঠাৎ খুব ছোট হয়ে গিয়েছিল, তেমনই প্রাকৃতিক ওয়ার্ম হোলগুলোর কল্যাণে, আমাদের কোয়াড্রেন্টের বিভিন্ন গ্রহ-উপগ্রহগুলো সকলের কাছেই খুব সহজগম্য হয়ে গেছে। ফলে বিভিন্ন সভ্যতার মধ্যে মৈত্রী গড়ে উঠেছে। আর সেই মৈত্রী থেকে আজকের আলফা-ইপসিলন কোয়াড্রেন্টের সম্মিলিত সরকারের উদ্ভব হয়েছে।
কিন্তু প্রাকৃতিক ওয়ার্মহোল না থাকলে? একটা চওড়া নদীর ওপর দিয়ে ব্রিজ বানিয়ে নিলে যেমন সেটাকে সহজেই পার হওয়া যায়, তেমনই মহাকাশের এক বিন্দু থেকে আর এক বিন্দুতে যেতে গিয়ে যদি প্রাকৃতিক ওয়ার্মহোল খুঁজে না পাওয়া যায়, তাহলে কি চট করে একটা পছন্দ মতন কৃত্রিম ওয়ার্মহোল বানিয়ে নেওয়া যায় না? ওয়ার্মহোলগুলো তো আসলে মহাকাশের ওপরে এক ধরনের ব্রিজই, কিংবা টানেল! নিশ্চয়ই যাবে, কিন্তু আমাদের অন্তরায় হল প্রযুক্তি। প্রথম কথা, তার জন্য যতখানি এনার্জি লাগবে, তা তৈরি করবার কোনও উপায় আমাদের জানা নেই। তাছাড়া দুই বিন্দুর মধ্যবর্তী স্পেস-কে কুঁচকে ছোট করে দিয়ে, তবেই কৃত্রিম ওয়র্ম হোলটা তৈরি করতে হবে! কিন্তু সেই প্রযুক্তি আজও আমাদের কাছে স্বপ্নই থেকে গেছে।
এই ব্যাপারে কিন্তু বিটা-গামা কোয়াড্রেন্টের লোকেরা পুরোপুরি পারদর্শী। তাদের মহাকাশযানগুলো চলতে চলতেই ইচ্ছেমতো কৃত্রিম ওয়ার্মহোল তৈরি করে নিতে পারে। কাজেই তাদের প্রযুক্তিতে, দূরত্ব জিনিসটা যেন আর কোনও সমস্যাই নয়! আশার কথা এই যে, মৈত্রী বন্ধনে আবদ্ধ হবার পর থেকে এ নিয়ে তাদের সঙ্গে আমাদের অনেক কথাবার্তা হয়েছে আজ পর্যন্ত। মনে হয় কিছুদিনের মধ্যেই এই প্রযুক্তিটি আমাদের কোয়াড্রেন্টেও এসে যাবে।
বিজ্ঞান বা প্রযুক্তির ব্যাপারে অত্যন্ত অগ্রসর হলেও একটা ব্যাপারে বিটা-গামার লোকেরা আমাদেরই মতন আটকে আছে। তা হল, আয়ু। সাধারণ ভাবে তারা আমাদেরই মতন ১২৫ থেকে ১৫০ বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকেন। অনেক মেরেকেটেও এর থেকে খুব একটা বেশি আয়ু বাড়াতে পারেনি তারা। এমন উন্নত সমাজে এত রকমের সুখ, আরাম, ভ্রমণ ইত্যাদির সম্ভাবনা আছে তাদের জীবনে! কিন্তু তা ভোগ করবার মতন সময় কোথায়? কলেজ থেকে শিক্ষা লাভ করে বেরোতে বেরোতেই তো একশো বছর কেটে যায়। তারপরে কর্মজীবনে প্রবেশ করে সমাজকে তো অন্তত কুড়ি-পঁচিশ বছর সার্ভিস দিতে হবে! তা না হলে আর সমাজ চলবে কী করে? কিন্তু তাহলে রিটায়ারমেন্টের আনন্দ কোথায়? রিটায়ার করতে করতেই তো লোকের জীবন শেষ হয়ে যায়!
স্বভাবতই, পড়াশোনার জন্য প্রয়োজনীয় সময়টাকে অন্তত অর্ধেক করে দিতে পারলে জীবনটা উপভোগ করবার সময় বেড়ে যায়। কিন্তু আজকালকার দিনেও এত উন্নত সমাজে শিক্ষার জন্য এত সময় নষ্ট হয় কেন? আমাদের সমাজেও তো কত সময় লাগে শিক্ষায়। গড়ে পঞ্চাশ থেকে ষাট বছর। প্রথাগত পড়াশোনা না করলে এখন আর কাউকে বিদ্বান বলে মনেই করা হয় না! অথচ একটা সময় ছিল, (অন্তত আমাদের পৃথিবীর ভারতবর্ষ নামক দেশে) যখন বছর দুই ধরে শুভঙ্করের আর্যা শিখলেই গণিতবিজ্ঞানে বেশ পারদর্শিতা অর্জন করা যেত। এবং সেই ব্যক্তি সমাজে বিদ্বান বলেও গণ্য হতেন। কিন্তু আজ জ্ঞানের বিস্তৃতি এত বেড়ে গেছে যে, তার সামান্য ব্যবহারিক অংশটুকুও রপ্ত করা, পঞ্চাশ-ষাট বছরের অধ্যয়নের কমে সম্ভব নয়! বিটা-গামা সভ্যতায় সেই সময়টা হয়ে দাঁড়িয়েছে একশো বছর! কিন্তু শিক্ষায় যতই সময় লাগুক না কেন, যা দরকার তা তো শিখতে হবেই! জ্ঞানের পরিধি তো বাড়াতেই হবে। তা না হলে তো সমাজ বদ্ধকূপের মধ্যে আটকে যাবে আর ধীরে ধীরে অবক্ষয়ের ভারে ধ্বংস হয়ে যাবে!
বিভিন্ন সমাজ তাই বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন ভাবে এই সমস্যার সমাধান করবার চেষ্টা করেছে। এমনকী, খুব হাস্যকর শোনালেও, গর্ভের মধ্যে থাকতে থাকতেই পড়াশোনা শুরু করিয়ে পুরো শিক্ষার সময়টা কমাবার চেষ্টা করা হয়েছে। শিশুরা তো এমনিতেই ভ্রূণের মধ্যে থাকতে থাকতে কত কিছু শিখে ফেলে- শব্দ, ধ্বনি, স্বর, স্বাদ, ঘ্রাণ! তাহলে ঠিক ভাবে চেষ্টা করলে ডিফারেন্সিয়াল ক্যালকুলাস বা ফিজিক্সের স্ট্রিং থিওরিই বা কেন শেখানো যাবে না ভ্রূণকে? কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই ধরনের কোনও চেষ্টাই সফল হয়নি। অন্য চেষ্টার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল রোবটদের শিক্ষিত করবার প্রোজেক্ট। উন্নত আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ব্যবহার করে জগতের সমস্ত জ্ঞানের ভাণ্ডার উপুড় করে ঢেলে দেওয়া হয়েছিল এই বিশেষ ধরনের রোবটদের মাথার মধ্যে। বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, বিভিন্ন মেশিনারি, সমাজ চালানো—ইত্যাদি সবকিছুরই দায়িত্ব দিয়ে দেওয়া হয়েছিল তাদের।
রোবটরা খুবই সফল হয়েছিল সেই দায়িত্ব পালনে। বেশ কয়েকশো বছর ধরে তারা সমাজে সমাজে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, রাসায়নিক, পদার্থবিদ ইত্যাদি হবার দায়িত্ব অত্যন্ত কৃতিত্বের পালন করে সেই সমাজগুলোকে অনেক উন্নত করে ফেলেছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সমস্যা দেখা দিল সমাজের লোকেদের নিজেদের নিয়েই। তারা তো প্রথম কিছুকাল বেশ আনন্দেই কাটাল। কিন্তু বছরের পর বছর সত্যিকারের শক্ত কোনও সমস্যায় মাথা না ঘামিয়ে ঘামিয়ে তাদের মগজের দ্রুত অবনতি ঘটতে শুরু করল। তখন রোবট সমাজবিজ্ঞানীরা নিজেরাই বলতে শুরু করল, ‘‘নাহ! এভাবে চললে তো তোমরা কিছুদিন পরে একেবারে বিলুপ্ত হয়ে যাবে! তোমাদের ধীশক্তি বলে আর কিছুই থাকবে না। সমাজের কাজে তোমাদের আরও বেশি করে অংশগ্রহণ করতে হবে।’’
কিন্তু লোকেরা ততদিনে অলস হয়ে গিয়েছে। শক্ত কাজ করতে তারা আবার সহজে রাজি হবে কেন? স্বাভাবিক ভাবেই এই নিয়ে প্রচণ্ড অসন্তোষের সৃষ্টি হল। পরিণামে, রোবটদের সঙ্গে মানুষের সংঘাত বেঁধে গেল। কিন্তু রোবটদের সঙ্গে অলস মানুষরা পারবে কেন? হেরে গিয়ে অনেকেই সমাজের মূলস্রোত থেকে সরে গিয়ে জঙ্গলে বসবাস করতে শুরু করল। সৌভাগ্যবশত ইতিহাসের মার্টিন লুথারের মতন কিছু কিছু নতুন মনীষীদের নেতৃত্বে, প্রায় একশো বছর সংগ্রামের পরে সমাজের নেতৃত্ব থেকে ধীরে ধীরে রোবটদের উচ্ছেদ করা হল এবং মানুষরা আবার নিজেরাই সমাজ চালাতে শুরু করল। সময় লাগলেও, ধীরে ধীরে লুপ্তপ্রায় জ্ঞানভাণ্ডারের প্রায় পুরোটাই পুনরাবিষ্কৃতহল। তারপর থেকে অন্তত বিটা-গামা সমাজগুলোতে আর মাথার কাজে রোবটদের আধিপত্য দেওয়া হল না। কিন্তু ঠিকমতো করে সমাজ চালাবার দক্ষতা অর্জন করতে লোকেদের আবার সেইএকশো বছর ধরে পড়াশোনা করবার দরকার হল। কাজেই, পুরোনো অসুবিধেটাই ফিরে এল। নতুন উদ্যমে সারা কোয়াড্রেন্টব্যাপী চেষ্টা সত্ত্বেও কিন্তু বহু দিন ধরে সেই সমস্যার কোনও সমাধান হল না।
শেষ পর্যন্ত একদল প্রযুক্তিবিদ ও ব্যবসায়ী মিলে হঠাৎ-ই একদিন সকলকে চমক লাগিয়ে ঘোষণা করলেন যে, তাঁরা নতুন একটা প্রযুক্তি আবিষ্কার করেছেন। তাঁদের প্রযুক্তি ব্যবহার করে শিক্ষার্থীদের পুরো একশো বছরের শিক্ষাসূচি মোতাবেক যাবতীয় বিদ্যা, শুধুমাত্র দু’দিনের মধ্যে শিখিয়ে দেওয়া যাবে। একশো বছরের শিক্ষা মাত্র দু’দিনে? পুরো কোয়াড্রেন্ট জুড়ে প্রচণ্ড হইচই শুরু হল! প্রথমে কেউই বিশ্বাস করতে পারছিলেন না এই দাবিটাকে! কিন্তু একশো বছরের বিদ্যা যদি সত্যিই দু’দিনে অর্জন করা যায়? কত সময় বাঁচবে, আর জীবনটাকে আরও কত বেশীদিন ধরে উপভোগ করা যাবে তাহলে! কাজেই শেষ পর্যন্ত অবিশ্বাসীরা ধোপে টিকলেন না। যথাযথ সরকারি অনুমতি নিয়ে ব্যবসায়ীরা তাঁদের বিদ্যালয়টা বিটা-গামা কোয়াড্রেন্টের রাজধানী গ্রহ ‘মেঙিলিকা’-রএকটি ভাসমান কৃত্রিম উপগ্রহ হিসেবে স্থাপন করলেন। বিদ্যালেয়ের সূচনা থেকেই হাজার হাজার শিক্ষার্থী এসে দরজার সামনে লাইন দিয়ে হাজির হতে থাকল। সেই জনপ্রিয়তা আজও কমেনি। ক্রমে এই স্কুলটাই হয়ে দাঁড়াল বিটা-গামা চত্বরের সর্বাধুনিক (এবং সর্বোচ্চ) শিক্ষাকেন্দ্র – নাম ‘ইলোভাক’!
এই হল ‘ইলোভাক’-এর সৃষ্টির ইতিহাস। তারপর থেকে গত একশো-দেড়শো বছর ধরে বিটা-গামা কোয়াড্রেন্টের হাজার হাজার সভ্যতা তাদের নিজস্ব শিক্ষাসূচি অনুযায়ী কোটি কোটি নাগরিকদের, অতি স্বল্প সময়ে প্রয়োজনীয় শিক্ষা অর্জন করতে পাঠিয়েছে ‘ইলোভাক’-এ। শত শত কোটি মানুষ ‘ইলোভাক’ থেকে ডিগ্রি অর্জন করে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে পেরেছে, নিজেদের সমাজকে সুশৃঙ্খলিত ভাবে গড়ে তুলেছে। তাই ‘ইলোভাক’ এখন একটি কিংবদন্তি! কিন্তু ‘ইলোভাক’-এর সবকিছুই যখন এত ভাল, তখন আমার মতন একজন পেশাদার গুপ্তচরকে এখানে কে ডেকে পাঠাল, আর কেনই বা ডাকল?
আসলে বাইরে চাকচিক্য থাকলেও, ‘ইলোভাক’ সম্বন্ধে ভেতরে ভেতরে অনেক গ্রহের প্রশাসনই কিন্তু কিছুদিন ধরে সন্দিগ্ধ হয়ে উঠছিল। দেখা যাচ্ছিল যে ‘ইলোভাক’-এ শিক্ষিত বহু ছাত্রই খুব অল্প বয়সে মারা যাচ্ছে। সাধারণ নিয়ম অনুযায়ী তো এখানকার লোকেদের ১২৫ থেকে ১৫০ বছর বাঁচবার কথা। কিন্তু দেখা যাচ্ছিল বছর ধরে অনেক প্রাক্তনীই, হঠাৎ হঠাৎ ২৫, ৩০ বছর বয়সে মারা যাচ্ছেন। অথচ শব ব্যবচ্ছেদ করে দেখা যাচ্ছিল যে, তাঁদের শরীরের অভ্যন্তরীণ যন্ত্রপাতির ক্ষয় বয়সের তুলনায় অনেক বেশি। অনেক নারী বন্ধ্যাও হয়ে যাচ্ছিলেন। স্বাভাবিকভাবেই, সকলের সন্দেহ হল যে ‘ইলোভাক’-এর শিক্ষা পদ্ধতিতে নিশ্চয়ই কোথাও কিছু গণ্ডগোল আছে, যার ফলেই ‘ইলোভাক’-এর ছাত্রদের এই অকালমৃত্যু। কিন্তু কী সেই গণ্ডগোল?
যে সভ্যতা তাদের নাগরিকদের ‘ইলোভাক’-এ শিক্ষা অর্জন করতে পাঠায়, তারা সরাসরি ‘ইলোভাক’ কর্তৃপক্ষর কাছে এই বিষয় নিয়ে প্রশ্ন তুলল। কিন্তু বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এই ধরনের মৃত্যুর জন্য কোনও রকম দায়িত্ব স্বীকার করতে চাইল না। তাদের বক্তব্য হল, ‘ইলোভাক’-এর শিক্ষা পদ্ধতি পুরোপুরি বিজ্ঞানসম্মত। তাতে কোথাও কোনও খুঁত নেই। আর ‘ইলোভাক’ উপগ্রহ-র আবহাওয়াও অত্যন্ত উচ্চমানের। কৃত্রিম প্রথায় সৃষ্ট এবং রক্ষিত বলে ‘ইলোভাক’-এর আবহাওয়া এই কোয়াড্রেন্টের মধ্যে সবচেয়ে উৎকৃষ্ট। আর তাছাড়া, একশো-দেড়শো বছর ধরে চলছে এই স্কুল। কোটি কোটি প্রাক্তন ছাত্ররা সফল ভাবে জীবন যাপন করেছেন এবং এখনও করে চলেছেন! তাহলে এত বছর পরে কোন যুক্তিতে ‘ইলোভাক’ কর্তৃপক্ষ কোনও ছাত্রের অকাল মৃত্যুর জন্য দায়ী হতে পারে?
এই উত্তরে অবশ্য কোনও প্রশাসনই খুশী হল না। তারা ‘ইলোভাক’ কর্তৃপক্ষকে অবিলম্বে তাদের শিক্ষাদান পদ্ধতির সম্পূর্ণ বর্ণনা লিখে জানাতে দাবি জানাল। কিন্তু ‘ইলোভাক’-এর শিক্ষা পদ্ধতি আইনি প্রথায় ‘ট্রেড সিক্রেট’। কেউই জোর করে সেটাকে প্রকাশ করে দিতে বলতে পারে না– একমাত্র আদালত ছাড়া। বিটা-গামা অঞ্চলে ব্যাবসায়িক স্বার্থকেই সবচেয়ে বেশি মর্যাদা দেওয়া হয়। যে কোনও ‘ট্রেড সিক্রেট’ এই কোয়াড্রেন্টে অত্যন্ত মজবুত ভাবে সুরক্ষিত। ভাল সুরক্ষা থাকলে তবেই তো সম্পূর্ণ স্বাধীনতার সঙ্গে ব্যবসায়ীরা ঝুঁকি নিয়ে ব্যবসা আরও বাড়াতে চাইবেন! তা না হলে তো সব মূলধন ব্যাঙ্কের সেভিংস অ্যাকাউন্টের মধ্যেই তালাবন্দি হয়ে পড়ে থাকবে। অথচ ব্যবসা থেকেই তো সমাজের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি। ‘ইলোভাক’ কর্তৃপক্ষ এই সব কথা জানে বলেই, ওই দাবিতে কোনও কান দিল না। শেষে ‘ইলোভাক’ কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে বিটা-গামা কোয়াড্রেন্টের সর্বোচ্চ আদালতে মামলা করা হল। কিন্তু তাতেও কোনও লাভ হল না। অনেক হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের পরেও ‘ইলোভাক’ কর্তৃপক্ষ অজেয় এবং অনড় হয়ে থেকে গেলে। কোনও ভাবেই ‘ইলোভাক’-এর ট্রেড সিক্রেটকে ভাঙা গেল না।
তখন অন্য পরিকল্পনার দিকে ঝুঁকতেই হল বিভিন্ন সভ্যতাকে। সামরিক অভিযান তো আর করা যায় না, তাই গুপ্তচর দিয়েই রহস্যটা ভেদ করবার চেষ্টা শুরু হল। কিন্তু তা করেও খুব একটা লাভ হল না। বহু কষ্টে এটুকুই শুধু জানা গেল যে, পরিকল্পিত শিক্ষার শেষে ছাত্রদের বাধ্যতামূলক ভাবে একটি স্নানঘরে গিয়ে, কোনও এক বিশেষ ধরণের স্নায়ুতরঙ্গের মধ্যে কিছুক্ষণ ধরে অবগাহন করতে হয়। সেই অবগাহনের পরে, একমাত্র যা শিক্ষা তাঁরা পেয়েছেন, তাছাড়া আর কোনও কিছুই তাঁদের মনে থাকে না।
বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত হলেন যে, ওই স্নায়ুতরঙ্গের মধ্যেই কিছু রহস্য লুকিয়ে আছে। কিন্তু কী করে সেই রহস্যের জট ছাড়ানো যায়?ইতিহাসের ঠিক এই রকম সময়ে, আলফা-এপসিলন কোয়াড্রেন্টের গভর্নমেন্ট-এর সঙ্গে বিটা-গামা কোয়াড্রেন্টের গভর্নমেন্টগুলোর মৈত্রী চুক্তি সম্পন্ন হল। এর পর বিটা-গামা কোয়াড্রেন্টের গভর্নমেন্টগুলি সঙ্গে সঙ্গে একটা সাহায্য চেয়ে বসল। সাহায্য চাইল একজন দক্ষ গুপ্তচরের।
২
“আমি?” এক ঝটকায় চেয়ার ছেড়ে লাফিয়ে উঠলাম! “কী বলছেন সান্যালদা ? আমিই হব সেই গুপ্তচর? আমার আবার কী দক্ষতা? সবে তো জয়েন করলাম! কোয়াড্রেন্ট ভর্তি এত হাজার হাজার অভিজ্ঞ সামরিক গুপ্তচর আছেন, তাঁদের সবাইকে বাদ দিয়ে তাঁরা কেবল আমাকেই চাইছেন কেন?’’
“তুমি মানুষ বলে।”
“সে আবার কী স্যার?”
“আমি অতশত জানি না বাপু। আমি কি তোমার মতো বায়োলজি পড়েছি? আমি তো নিরীহ ইতিহাসের ছাত্র ছিলাম একজন। বাবা-মা জোর করে মিলিটারিতে ঢুকিয়ে দিলেন। বললেন, ‘ইতিহাস পড়ে খাবি কী?’ বলো তো কী গেরো…”
“জানি স্যার। আমি জানি।” খুব নরম করে উত্তর দিলাম। সান্যালদার আসল মনোকষ্টের কথা কে না জানে! “আমার তো মনে হয় আপনি একজন নামকরা ঐতিহাসিক হতে পারতেন দাদা…”
সান্যালবাবু আমার কথায় বেশি আমল না দিয়ে টেবিল থেকে একটা রিপোর্ট তুলে চোখ বুলোতে বুলোতে বললেন—
“হ্যাঁ, এই যে। ওরা রিপোর্টে বলেছে যে ‘ইলোভাক’-এর কসাইরা যে স্নায়ুতরঙ্গ দিয়ে পুরোনো স্মৃতি সব মুছে ফেলে দেয়, তা আদিম সরীসৃপ জাতীয় প্রাণী থেকে উদ্ভূত লোকজনদের স্নায়ুমণ্ডলের ওপরে কাজ করবার জন্যই তৈরি। যেহেতু ওদের কোয়াড্রেন্টে প্রায় সবাই সরীসৃপ থেকেই উদ্ভূত, আর আমাদের মতন বানর থেকে উদ্ভূত কোনও প্রানীই সেখানে নেই, সেহেতু সম্ভবত ‘মানুষ’ গুপ্তচর ব্যবহার করলে হয়তো তারা সব স্মৃতি ঠিকমতন মুছে নাও ফেলতে পারে। অন্তত সেরকম একটা সম্ভাবনা আছে। আর মানুষ গুপ্তচর-ই যদি চায়, তবে মানুষ গুপ্তচর তো আমাদের কোয়াড্রেন্টেও বেশি নেই –সিংহভাগ রিক্রুট-ই সরীসৃপ অথবা অন্যান্য জিনোম থেকে উদ্ভূত। তাই ওরা তোমাকেই নির্বাচন করেছে। যাও, গিয়ে বেশ একটু অ্যাডভেঞ্চার করে এসো ভায়া।’’
৩
সন্ধের আগেই মহাকাশযানটা ‘ইলোভাক’-এর চকচকে স্পেস পোর্টে আমাকে নামিয়ে দিল। বহু লোক এসেছিলেন আমাকে স্বাগত জানাতে। ‘ইলোভাক’ কর্তৃপক্ষের সবাই এসেছিলেন! প্রথমত, আমি বহু দূরদেশবাসী– আমাদের জগৎ থেকে এর আগে আর কেউ কোনওদিন এখানে আসেনি। কাজেই একটা কৌতূহল তো ছিলই। তারপরে আমি আবার সদ্য চুক্তিবদ্ধ দুই সরকারের প্রথম প্রতিনিধি হিসেবে পড়তে আসছি ইলোভাকে। আমি বিভিন্ন সংবাদপত্র ও ম্যাগাজিন-ওয়েবজিনে বিজ্ঞান নিয়ে কলাম লিখে জীবিকা নির্বাহ করি। খাতায়-কলমে আমার এখানে আসার উদ্দেশ্য হচ্ছে, নিজে কিছু কোর্স করে নিয়ে, বিদ্যার্জনের অভিজ্ঞতাটা ফলাও করে মৈত্রীরসে ভরপুর কলাম লেখবার। সেই কলাম পড়ে হয়তো বা শিগগিরই লক্ষ-কোটি শিক্ষার্থী আমাদের জগৎ থেকে এখানে আসতে শুরু করবে। ফলে আমি এখানে একজন অতি সম্মানিত ব্যক্তি। চারিদিক স্বাগত জানানো ফেস্টুনে ভর্তি। আর আমাদের জগৎ-এর প্রথা মেনে, গলায় মালা দিতেও এগিয়ে এল কতজন! প্রথম যে যুবতী মালা দিতে এল, তার অপরূপ সৌন্দর্য দেখে তো আমার একেবারে ভিরমি খাবার যোগাড়! মনে হল,
‘‘ধনি কানড় ছান্দে বান্ধে কবরী।
নবমালতী মাল তাহে উপরী।।
দলিতাঞ্জন গঞ্জ কলা কবরী।
থেনে উঠত বৈঠে তাহে ভ্রমরী।।’’
নেহাত বাড়িতে যে সদ্য বিবাহিতা যুবতীটিকে ফেলে এসেছি, সেও কিছু কম যায় না, তাই রক্ষে।
যাই হোক, এইসব ‘মৈত্রী মৈত্রী’ হইচই ছাড়িয়েও আমি স্পষ্ট অনুভব করতে পারছিলাম যে, বেশ কয়েকজোড়া অনুসন্ধিৎসু চোখ আড়াল থেকে আমার প্রতিটি পদক্ষেপের ওপরে বেশ কড়া নজর রাখছে।
ডিনারের সময় ‘ইলোভাক’-এর পক্ষ থেকে আমার অ্যাকাডেমিক উপদেষ্টা অধ্যাপক পি. ঢ়ংষাঝ পাশে এসে বসলেন। অন্য দিকে বসলেন বিটা-গামা সরকারের শিক্ষা বিভাগের প্রধান, ড. ঙাবাসনি। এই সফরে আমার আতিথ্যের পুরোপুরি দায়িত্ব তাঁরই। ড. ঙাবাসনি আসলে আমারই মতন সরকারি চর বিভাগের বেতনভোগী কর্মচারী। তিনি ফলাও করে একটা অনুষ্ঠানে সকলের সামনে আমাকে স্বাগত জানিয়ে, গলায় একটা চকচকে ধাতব মেডেল পরিয়ে দিলেন। এই ধাতুটি আমাদের ওখানে পাওয়া যায় না। এখানেও বিরল। তাই খুব দামি। সমাজের সর্বোচ্চ সম্মান জানানোর জন্য ক্কচিৎ কখনও এই মেডেল দিয়ে কাউকে কাউকে পুরস্কৃত করা হয়। কাজেই সেই হিসেবে দেখলে কারও কোনও সন্দেহের উদ্রেক হবার কথা নয়। কিন্তু এটা আসলে বিটা-গামা জগতের সবচেয়ে আধুনিক প্রযুক্তিতে তৈরি একটি রেকর্ডার বা ট্রান্সমিটার। পরিকল্পনা অনুযায়ী আমি এখানে সাংবাদিকতায় মাস্টার্স ডিগ্রি করব। এমনিতে দু’বছর লাগে সেই কোর্সটা শেষ করতে। কিন্তু ‘ইলোভাক’ পদ্ধতিতে চার ঘণ্টারও কম সময় লাগবে। কাল সকাল থেকে ক্লাস শুরু হবে। লাঞ্চের মধ্যেই কোর্স শেষ। সন্ধ্যাবেলায় নৈশভোজনের পরে হবে সমাবর্তন। অনুষ্ঠানটা হবে এই হলেই।
ড. ঙাবাসনি জানালেন যে, তিনি এখানকার গেস্ট হাউসে থেকে যাবেন দিনটা। সন্ধ্যায় সমাবর্তনের পরে আমায় নিয়ে নিজস্ব জাহাজে করে সোজা রাজধানীতে ফিরবেন। ইঙ্গিতটা আর কেউ বুঝল কিনা জানি না, তবে আমার কাছে সেটা সুস্পষ্ট ছিল। উনি বুঝিয়ে দিলেন, আমাকে বাঘের মুখে ঠেলে দিয়ে নিজে সরে যাচ্ছেন না। কোনওরকম বিপদে মেডেলটায় একটু বিশেষ রকম ভাবে চাপ দিলে, যেভাবেই হোক আমার কাছে সাহায্য পৌঁছে যাবে। রেকর্ডারটা ঠিক মতন কাজ করবে কি না তা কেউই জানে না ঠিক করে। তবে তার জন্য গুপ্তচর নিয়োগ করা আছে চারিদিকে। প্রয়োজনে সাহায্য সবসময় পাওয়া যেতে পারে।
৪
ভোর হতে না হতেই অধ্যাপক পি. ঢ়ংষাঝ-এর ব্যক্তিগত সহকারী শ্রী ক্রুয়ালাঝা, যিনি আমার দোভাষীও বটে, তিনি এসে দরজায় নক করে ঘুমটা ভাঙিয়ে দিলেন। এরা নিজেরা সরীসৃপ জাতীয় বলে ডিম খাওয়াটাকে অভব্যতা মনে করে। তবে এক বিশেষ ধরনের পাখির বাসা দিয়ে রান্না করা স্যুপটা খেতে সুস্বাদু ছিল। কিন্তু তাও বেশীক্ষণ আমেজ করে খাওয়া গেল না। তাড়াহুড়ো করে আমাদের সংবর্ধনা হলের সামনে একটা স্টেশনে নিয়ে যাওয়া হল। কত হাজার ছাত্র যে ইতিমধ্যেই স্টেশনে জড়ো হয়েছিল তা বলবার নয়! আমি তো দেখেই হতভম্ব। শুনলাম, এটা নাকি ‘ইলোভাক’-এর নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার। মাঝে মাঝে একসঙ্গে এর দ্বিগুণেরও বেশি ছাত্র পড়তে আসে। স্টেশনে ভিন্ন ভিন্ন কোর্সের জন্য ভিন্ন ভিন্ন ট্রেন। বড় বড় সাইনবোর্ড দিয়ে তির দেখানো আছে। সবাই ছোটাছুটি করছে এদিক ওদিক।
আমি অবশ্য কিছুই পড়তে পারছিলাম না। তবে সেই জন্যেই তো শ্রী ক্রুয়ালাঝা আমার সঙ্গে ছিলেন। তিনি আমাকে নিয়ে নির্দিষ্ট ট্রেনের প্রথম সারির একটা কামরায় গিয়ে উঠলেন। বললেন, ‘‘ক্লাসরুম পর্যন্ত ঠিক পৌঁছে দেব, কিচ্ছু চিন্তা করবেন না।’’ একটু পরে ট্রেনগুলো ছাড়ল– একেবারে ঘড়ির কাঁটা মেনে। খুবই মসৃণ ভাবে চলতে শুরু করল প্রথমে। তারপরেই বিভিন্ন ট্রেনগুলো, সাপের মতন এঁকেবেঁকে বিভিন্ন দিকে চলে গেল। আমাদের ট্রেনটা যে কখন যে গতি বাড়াল তা ঠিক বুঝতে পারলাম না। ক্রুয়ালাঝা বললেন, আমরা নাকি ঘণ্টায় ২০০০ কিলোমিটারেরও বেশি বেগে চলছি। কথাটা শুনে আমার রক্ত হিম হয়ে গেল। কোন এক অজানা আশঙ্কায় বুকটা ধড়ফড় করে উঠল। মাত্র চার ঘন্টার ক্লাস। তার জন্য কতদূর যাচ্ছি আমরা যে ট্রেনটাকে ২০০০ কিলোমিটার বেগে যেতে হচ্ছে! কিন্তু বেশি কিছু ভাববার আগেই, ট্রেনটা হঠাৎ রোলার-কোস্টারের মতন তিরবেগে নীচের দিকে একটা প্রচণ্ড ডাইভ দিল।
তারপর থেকে আমার জীবনে আর যা যা ঘটেছিল, ঘটে চলেছে আজ পর্যন্ত, তার সবকিছু এখন আর স্পষ্ট করে মনে নেই আমার। কিছু কিছু ঘটনা মনে রয়ে গেছে, আর কিছুকিছু জিনিস খানিক চেষ্টা করলে তবু বা একটু আধটু মনে করতে পারি। কিন্তু তাতে করে মাথায় বেশ যন্ত্রণা শুরু হয়ে যায়। তাই এই কাহিনির বাকি যা কিছু লিখতে পারব নীচে, তা বেশীর ভাগই রেকর্ডিং, সাইকিয়াট্রিস্টদের করা রিগ্রেশন অ্যানালিসিস, বা আরও অন্যান্য উপায়ে উদ্ধার করা স্মৃতি।
৫
প্রথম যে ঘটনাটা স্পষ্ট মনে আছে, তা হল যে অল্প কিছুক্ষণ ডাইভ দেবার পর, ট্রেনটা একটা বিশাল বড় স্টেশনে এসে থামল। সবাই নামতে শুরু করল। ক্রুয়ালাঝা বললেন, ‘‘চলুন,আমরাও নামব এখানে।’’ ষ্টেশনে নেমে দেখি, চারিদিকে সারি সারি সিকিওরিটি অফিস। ক্রুয়ালাঝা আমাকে নিয়ে তার একটার মধ্যে ঢুকে পড়লেন। দেখলাম আমাদের সামনে বহু ছাত্র লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। আর একে একে উলঙ্গ হয়ে তাদের সমস্ত জামাকাপড় ও ব্যক্তিগত জিনিসপত্র সিকিওরিটির হাতে তুলে দিচ্ছেন। পরিবর্তে তাঁদের হাতে নতুন ইউনিফর্ম ও বই-খাতা-কলম ইত্যাদি তুলে দেওয়া হচ্ছে। আমি অবাক হয়ে ক্রুয়ালাঝার দিকে তাকালাম। তিনি বললেন, “ফেরবার সময় সব কিছু ঠিকঠাক ফিরে পাবেন, চিন্তার কিছু নেই।” আমি রেগে গিয়ে বললাম, “এটা কি জেলখানা নাকি, যে কয়েদিদের মতন ব্যক্তিগত জিনিসপত্র সব বাজেয়াপ্ত করে জেলের দেওয়া কাপড়চোপড় পরতে হবে?’’ ক্রুয়ালাঝা কোনও উত্তর দিলেন না। ক্রমে আমারও বিবস্ত্র হয়ে সব কিছু জমা দেওয়ার পালা এল। দূরপাল্লার ইঞ্জিনের মতন রাগে ফোঁস ফোঁস করতে করতে জামাকাপড়গুলো খুলে দিয়ে দিলাম। খাতাপত্র, জার্নাল, কলম – সবই নিয়ে নেওয়া হল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত যখন আমার গলায় ঝোলানো মেডেলটাকেও খুলে দিতে বলল, তখন আমি আর থাকতে পারলাম না। প্রতিবাদ করে বললাম, “না, এটা আমি দেব না।” তখন মুহূর্তের মধ্যে কোথা থেকে দৌড়ে এসে আমাকে চারপাশ দিয়ে চেপে ধরল গোটাকয়েক লোক। একজন হ্যাঁচকা টান মেরে গলা থেকে ছিঁড়ে নিল মেডেলটা। আমি রেগে মত্ত হাতির মতন লাফালাফি শুরু করলাম। বাড়ি থেকে এই কোটি কোটি আলোকবর্ষ দূরে, অজানা, অচেনা জগতে, এটাই ছিল আমার একমাত্র রক্ষাকবচ। সেটাকে আমি কী করে হাতছাড়া করি! ধ্বস্তাধ্বস্তি, গুঁতোগুঁতির মধ্যে চেয়ে দেখি ক্রুয়ালাঝা সবাইকে ধাক্কা দিতে দিতে আমার দিকে এগিয়ে আসছেন। কাছে এসে পকেট থেকে একটা হুইসিল বার করে, তাতে খুব জোরে একবার ফুঁ দিলেন তিনি। সঙ্গে সঙ্গে মন্ত্রের মতন কাজ হল। সবাই আমাকে ছেড়ে দিয়ে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। তিনি পকেট থেকে পরিচয়পত্রের মতন কিছু একটা বার করে সেটাকে ওপরে তুলে সকলকে দেখাতে দেখাতে উত্তেজিত হয়ে অনেক কিছু বলতে থাকলেন। শেষপর্যন্ত একজন লোক এগিয়ে এসে আমার হাতে মেডেলটা তুলে দিলেন আর ইঙ্গিত করে সেটা গলায় পরে নিতে বললেন।
এর পরের যে ঘটনা একটু একটু মনে আছে, তা হল আমাকে জোর করে একটা ঘরে ঢোকানো। সবাইকে ছেড়ে আমাকে আলাদা করে একটা বিশেষ ঘরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। পরে শুনেছি সেটাই ছিল ওই কুখ্যাত স্নায়ুতরঙ্গের ঘর। সেখানে সবাই মিলে আমাকে ঠেলে ঢুকিয়ে দিতেই আমার প্রচণ্ড মাথাব্যথা করতে শুরু করল। একটু পরে আমি সংজ্ঞাহীন হয়ে গেলাম।
তারপরের স্মৃতি– আমার চারিপাশ ঘিরে খুব উদ্বিগ্ন ভাবে দাঁড়িয়ে, নানারকম ভাবে চিকিৎসা করে চলেছেন ডাক্তার জাতীয় কয়েক জন। আমার দমবন্ধ হয়ে যাচ্ছে, হাত-পা নাড়াতে পারছি না, আর নিশ্বাসও নিতে পারছিনা। কেবলই মুখ দিয়ে গ্যাঁজলা বেরোচ্ছে। আরও মনে আছে, যে একটু পরে আমাকে ধরে ধরে সংবর্ধনা হলের সামনে সকালের সেই স্টেশনটায় নামানো হচ্ছে। সেখানে ডজন ডজন পুলিশ, মিলিটারি অফিসার, বন্দুক, অ্যাম্বুলেন্স আর আমার বিদেশ বিভুঁইয়ের একমাত্র ভরসার বন্ধু – ড. ঙাবাসনি!
এরপরে সারা শরীরে প্রচণ্ড যন্ত্রণা-সহ যখন সংজ্ঞা ফিরে এল, তখন অনুভব করলাম যে দু’টি অত্যন্ত কোমল হাত, আমার ডান হাতটাকে খুব আলতো করে ধরে বসে আছে। চেনা গন্ধ পেয়ে চোখ খুলে দেখি, সেই কোমল হাত দুটির মালিক আর কেউ নয়, বাড়িতে ফেলে আসা আমার সেই সদ্যবিবাহিতা স্ত্রী রজনী। আমি অবাক হয়ে বলি, “এতদিন কোথায় ছিলেন?” পরে অবশ্য রজনী বলেছিল, আমার মুখ দিয়ে শুধু বেরিয়েছিল, ‘‘তুমি? এখানে কী করে? আমি কোথায়?’’ উত্তরে রজনী শুধু তার একটা আঙুল আমার ঠোঁটে আলতো করে ঠেকিয়েছিল। কিন্তু পাশ থেকে শুনতে পেলাম সান্যালদার ভারী গলা – ‘‘ওহ! দেখো, জ্ঞান ফিরেছে! কী যে ভাবিয়ে তুলেছিলে ভায়া!’’
আমি চমকে উঠে শুধু একটুখানি ক্ষীণ স্বরে বলতে পারলাম, ‘‘ইলোভাক?’’
সান্যালদা আশ্বাস দিয়ে বললেন, ‘‘ইলোভাক’? সে তো প্রায় ছমাস আগেই বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে ভায়া– তোমার কৃতিত্বেই তো সব হল!’’
মাসখানেক পরে শরীরে একটু বল পেয়ে উঠে বসতে পারলাম। খবর পেয়ে ড. ঙাবাসনি একদিন দেখা করতে এলেন। সঙ্গে তাঁর স্ত্রী মেঞায়সি এবং দ্বিভাষী ক্রুয়ালাঝা। প্রাথমিক সম্ভাষণ আর কুশল সংবাদ বিনিময়ের পরে অনেক অনুরোধ করায়, তাঁরা সকলে মিলে ধীরে ধীরে পুরো ঘটনাটা আমাকে খুলে বললেন। দেখা গেল, সকলে বাইরে থেকে ‘ইলোভাক’ সম্বন্ধে যা যা অনুমান করছিলেন, আমার প্রচেষ্টায় তার অনেক কিছুই ঠিকঠাক প্রমাণিত হয়েছে। যদিও আমি নিজের স্মৃতি থেকে বেশি কিছু বলতে পারিনি, তবু আমার গলায় পরা চকচকে মেডেলটাই বাজিমাত করে দিয়েছে। ইলোভাকের গহ্বরের গভীরে নেমে যা যা অভিজ্ঞতা করেছি আমি, তার সব কিছুই নিখুঁত ভাবে রেকর্ড করে রেখেছে ওই বস্তু। তার জন্য অনেকটা কৃতিত্ব অবশ্য শ্রী ক্রুয়ালাঝারও পাওনা। তিনি আসলে এ অঞ্চলের সরকারী গুপ্তচর বিভাগের প্রধান, যদিও আগে আমি তা জানতাম না।
ড. ঙাবাসনি আমাকে বুঝিয়ে বললেন, ‘‘‘ইলোভাক’ আসলে বিশাল বড় একটা ফুটবলের মতন ফাঁপা গোলোক।আমাদের বিটা-গামা কোয়াড্রেন্টের রাজধানী গ্রহ হল এই ‘মেঙিলিকা’। এটাই এই অঞ্চলের সবচেয়ে বড় গ্রহ। তার মধ্যে আমার অফিস, আমার বাড়ি আর তোমার এই হাসপাতালও। বিদ্যালাভের আদর্শ জায়গা বলে মেঙিলিকার একটা কৃত্রিম উপগ্রহ হিসেবে ‘ইলোভাক’-কে উপস্থাপন করা হয়েছিল এখানেই। কাছাকাছি যে সব ‘স্বাভাবিক’ গ্রহ-উপগ্রহ আছে, তাদের সকলের সঙ্গে খাপ খাইয়ে, কাঁটায় কাঁটায় সময় ধরে মেঙিলিকাকে প্রদক্ষিণ করত বলে ‘ইলোভাক’-এর সময়, এ জগতের গৃহীত ‘আদর্শ সময়’-এর সঙ্গে মিলে যেত। অর্থাৎ আমি যদি তোমাকে দেখে বাড়ি ফেরবার পরে মেঞায়সিকে নিয়ে ‘ইলোভাক’-এ দুদিন ছুটি কাটিয়ে আসি, তবে ফিরে এসে দেখব যে আমাদের জীবন থেকে শুধুমাত্র দু’দিন সময়ই খরচ হয়ে গেছে, তার বেশি বা কম কিছুই নয়। একই গ্রহে, অল্প সময়ের মধ্যে অনেকগুলো ‘সময় বাউন্ডারি’ পেরিয়ে গেলে যেমন ‘জেট ল্যাগ’ হয়, তেমনই চট করে এক গ্রহ থেকে অন্য গ্রহে গেলে অনেক ক্ষেত্রে কম-বেশি কিছু ‘সময় ল্যাগ’-এর অসুবিধে অনুভূত হয়। কিন্তু ‘ইলোভাক’-এ যাওয়া-আসা করলে সেই ‘সময় ল্যাগ’টা অনুভব করতে হত না। ‘ইলোভাক’-এর ফাঁপা ফুটবলটার মধ্যে অবশ্য আরও অনেকগুলো অপেক্ষাকৃত ছোট ছোট গোলোক লুকোনো ছিল। তারা ‘ইলোভাক’-এর গর্ভের ভেতরের একটা অত্যুজ্জ্বল গোলোককে ‘রেফারেন্স নক্ষত্র’ হিসেবে মান্য করে,নিজেদের নির্ধারিত অক্ষ ধরে ধরে প্রচণ্ড জোরে লাট্টুর মতন করে নক্ষত্রটাকে প্রদক্ষিণ করত। বলতে পারো যে ‘ইলোভাক’-এর গর্ভের মধ্যে কৃত্রিম সৌরমণ্ডল তৈরি করা হয়েছিল। বিভিন্ন গোলোকের ওপরে, বিভিন্ন শিক্ষাসূচি অনুযায়ী স্কুল, ল্যাবরেটরি এবং বসতবাড়ি ইত্যাদি তৈরি করা হত। কোন্ গোলোকটা কত জোরে কৃত্রিম নক্ষত্রটাকে প্রদক্ষিণ করবে, তা ‘ইলোভাক’-এর ওপরের স্তরের একটি ইঞ্জিন ঘর থেকে প্রোগ্রাম করা হত। যে গোলোক যত বেশি জোরে প্রদক্ষিণ করত, সে গোলোকের মধ্যে সময় তত তাড়াতাড়ি কাটত। সেই গোলোকটার মধ্যে বাস করলে কিন্তু, বাসিন্দাদের কাছে সময়টা ঠিক ‘আদর্শ সময়-এর মতনই মনে হত। অর্থাৎ গোলোকটা যতবার নক্ষত্র-টাকে প্রদক্ষিণ করত ততবারই তার বাসিন্দাদের মনে হত যেন পুরো একটা বছর কেটে গেছে। তাদের শরীরের যাবতীয় বায়োলজিক্যাল ফাংশনও আনুপাতিক ভাবে দ্রুতবেগে চলতে শুরু করত। অথচ ওপরের স্তরে ততক্ষণে হয়তো আসল সময়ের হিসেবে, মাত্র আধ সেকেন্ড কাটত। এটাকে বলা হয় ‘টাইম ডায়ালেশন’।
‘ইলোভাক’ কর্তৃপক্ষ এই টাইম ডায়ালেশনটাকেই বাণিজ্যিক স্বার্থে ব্যবহার করতেন। ছাত্রদের কোর্স অনুসারে বিভিন্ন গোলোকে পাঠানো হত এবং সেখানে তাঁদের হোস্টেলে রাখা হত। তারপরে রোবটিক অধ্যাপকদের সাহায্য নিয়ে ছাত্রদের ক্লাশরুমে বসিয়ে শিক্ষা দেওয়া হত। শিক্ষা উচ্চস্তরের-ই হত, এবং পাঁচ বছরের কোর্স পাঁচ বছরেই শেখানো হত। কিন্তু সেই পাঁচ বছর সত্যি সত্যি আদর্শ সময়ের পাঁচ বছর নয়, টাইম ডায়ালেশনের আপেক্ষিক হিসেবেপাঁচ বছর! হয়তো বা আদর্শ সময়ে সেটা হত পাঁচ মিনিট। সমস্যা হল,যাঁরা ছাত্র ছিলেন তাঁদের কিন্তু মনে হত যেন পুরোপুরি পাঁচবছর ধরেই তাঁরা অধ্যয়ন করছেন। সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের শরীরটাও পুরো পাঁচ বছরের মতনই ক্ষয় হয়ে যেত। শিক্ষার ফল অবশ্য সাধারণ ভাবে শিক্ষা লাভ করলে যেমন ভাল বা খারাপ ফল হয়, ঠিক তেমনই হত। অথচ আদর্শ সময়ের হিসেবে খুবই কম সময় খরচ হয়েছে বলে মনে হত! দারুন স্মার্ট আইডিয়া,তাই না?
কিন্তু প্রশ্ন হল যে, এই নিদারণ অভিজ্ঞতার কথা কারও মনে থাকত না কেন? তার কারণ স্কুল-গ্রহ ছেড়ে ওপরের স্তরে ফিরে যাবার আগে, জোর করে তাঁদের স্নায়ু তরঙ্গে স্নান করিয়ে, অর্জিত বিদ্যা ছাড়া বাকি সব কিছু অভিজ্ঞতার স্মৃতি পুরোপুরি মুছে ফেলা হত। তাই আসল জগতে ফিরে এসে শুধু তাঁরা বিদ্যা ছাড়া আর কিছুই মনে করতে পারতেন না। জীবনে ফিরে আসার পরে ধরে নেওয়া হত যে পড়াশোনা করবার জন্য জীবন থেকে শুধুমাত্র তিন-চার বা পাঁচ দিন খরচ করেছেন তাঁরা, প্রায় আরও ১৫০ বছর আয়ু বাকি আছে তাঁদের। কিন্তু বায়োলজির দিক থেকে ভেবে দেখলে তো তাঁরা ইতিমধ্যেই পঞ্চাশ, ষাট, একশো ইত্যাদি বছর খরচ করে ফেলেছেন। তাই ইলোভাকের শিক্ষা লাভের পরে আর তিরিশ, চল্লিশ, পঞ্চাশ বছরের বেশি কেউ বেঁচে থাকতেন না।
আর কিছু নয়, সাধারণ ভাবে শিক্ষালাভ করতে গেলেও তো শিক্ষার শেষে লোকে ওই তিরিশ-চল্লিশ বা পঞ্চাশ বছরই বাঁচতেন! কিন্তু ‘ইলোভাক’ কর্তৃপক্ষ দাবি করতে শুরু করেছিল যে, তারা তিনদিনের মধ্যেই সবকিছু শিখিয়ে দেবে। আর শিক্ষার শেষে প্রায় পুরো ১৫০ বছর ধরেই লোকে জীবনটা উপভোগ করতে পারবেন। কিন্তু সেটা তো প্রতারণা করা হল! নির্মম প্রতারণা! যখন দেখা গেল যে শিক্ষার পরে লোকে আসলে স্ট্যাটিস্টিকালি ১৫০ বছর বাঁচছে না, তখনই অসন্তোষ শুরু হল। তাছাড়া মাঝে মাঝে সাইকিয়াট্রিস্টদের কাছ থেকে পেশেন্টদের স্মৃতি রিগ্রেশন বার করা কিছু কিছু অত্যন্ত ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথাও শোনা যেতে লাগল। তখন চাপে পড়ে আমাদের সরকার নানা ভাবে এই রহস্যের সমাধান করবার চেষ্টা শুরু করল। কোর্ট কেসে হেরে যাবার পরেও তারা নানা রকম ভাবে গুপ্তচর লাগিয়ে খবর বার করবার চেষ্টা করে চলল। অনেক গুপ্তচরই তো তোমার মতন বিদ্যালয়ের গর্ভে গিয়ে পৌঁছতে পেরেছিলেন। কিন্তু ‘ইলোভাক’-এর স্নায়ুতরঙ্গের কোপ আমাদের জগতের লোকেদের ওপরে এতই কার্যকর ছিল যে, বহু চেষ্টা করেও কেউ কিছু মনে করে খবর বার করে আনতে পারলেন না। অনেক চেষ্টা সত্ত্বেও কোনও ভাবেই কিছু রেকর্ডিং করা গেল না। শেষ পর্যন্ত যখন তোমাদের সঙ্গে আমাদের পরিচয় ও নানা রকম সহযোগিতা চুক্তি হল, তখন আমরা ভাবলাম, একজন মানুষ গুপ্তচর দিয়ে চেষ্টা করে দেখলে কেমন হয়? তারপরের বাকি ঘটনা তো তুমি সবই জান।”
আমি প্রতিবাদ করে বললাম, ‘‘কোথায় সব জানি? তাহলে আমার এ অবস্থা হল কী করে?’’
মেঞায়সি নিজে ডাক্তার এবং আমার একজন চিকিৎসকও। তিনি এগিয়ে এসে মাথা নেড়ে বললেন, ‘‘তা ঠিক। আমরা বলতে ভুলে গেছি! তোমাকে তো প্রায় মেরেই ফেলছিল ওরা। আসলে কিন্তু সত্যিই মেরে ফেলেছিল তোমাকে, যদিও সেটা তাদের আসল উদ্দেশ্য ছিল না। গত ন’মাসে তুমি অনেকবারই মরে গিয়েছিলে, জানো? আমাদের ডাক্তারেরা অনেক কষ্ট করে তোমাকে বাঁচিয়ে তুলেছেন বারেবারে।”
আমি খুবই কৃতজ্ঞ ভাবে বললাম, ‘‘তোমাদের ডাক্তার আর নার্সদের সত্যিই অনেক ধন্যবাদ জানাই। কিন্তু কী করে মরতে বসেছিলাম সেটাও আমাকে খুলে বলো।’’
মেঞায়সি হেসে বললেন, “বলছি, বলছি। তুমি যে আসলে গুপ্তচর, শুধু কেবল পড়তে আসবার ভান করে আসছ, সেটা ভেতরে ভেতরে ‘ইলোভাক’ কর্তৃপক্ষ ঠিকই বুঝতে পেরেছিল। তাই প্রস্তুতি হিসেবে, তাদের যেটুকু জ্ঞান ছিল মানুষদের স্নায়ুমণ্ডলী সম্বন্ধে, সেটাই কাজে লাগিয়ে তড়িঘড়ি একটা সিমুলেশন করে ফেলল। তার ভিত্তিতে তোমার জন্য আলাদা করে একটা নতুন স্নায়ুতরঙ্গের ঘরও তৈরি করে নিল তারা। মোটামুটি তো ঠিকই কাজ করেছে সেটা– দেখতেই পাচ্ছ যে তুমি নিজে থেকে কিছুই মনে করতে পারছ না।”
আমি সায় দিয়ে বললাম,“ঠিক”।
ক্রুয়ালাঝা এতক্ষণ চুপ করে বসে ছিলেন। এবারে তিনি বলে উঠলেন, ‘‘মুশকিল কী হল জানো তো, কোনও মেশিনই কখনও প্রথম বারে নিখুঁত হয় না। দুর্ভাগ্যবশত তোমার জন্য তৈরি স্নায়ু তরঙ্গটা শুধু তোমার স্মৃতি নয়, তোমার স্নায়ুর কিছু কিছু মোটর ফাংশানকেও নষ্ট করে দিচ্ছিল। তাই হঠাৎ হঠাৎ তোমার হার্ট কাজ করা বন্ধ করে দিচ্ছিল আর তুমি ভাল করে নিশ্বাসও নিতে পারছিলে না। ভাগ্যিস আমরা বুদ্ধি করে আগে থেকে ওদের স্টাফেদের মধ্যে আমাদের অনেক চর ঢুকিয়ে রাখতে পেরেছিলাম। তারা তোমার যে কোনও এমার্জেন্সির জন্য প্রস্তুত ছিল– তা না হলে তুমি কখনই বেঁচে ফিরতে পারতে না গর্ভগৃহ থেকে। ডাক্তারদের তো প্রায় তোমার অর্ধেক মোটর ফাংশনকেই নতুন করে তৈরি করে দিতে হয়েছে।”
ক্রুয়ালাঝা-র কথা শেষ হতে হতে সান্যালদা এসে ঘরে ঢুকলেন। ক’দিন তিনি আমায় দেখতে আসেননি। শুনেছিলাম বেড়াতে গিয়েছেন। ঘরে ঢুকে অতিথিদের দেখে তিনি খুবই উচ্ছ্বসিত হয়ে ঙাবাসনি, মেঞায়সি আর ক্রুয়ালাঝাকে নিকট ভাবে আলিঙ্গন করলেন। বোঝা গেল যে এঁদের সকলের মধ্যে বেশ একটা হৃদ্যতার সৃষ্টি হয়েছে ইতিমধ্যেই।
আনন্দ-উচ্ছ্বাস শেষ হওয়ার পরে আমার দিকে তাকিয়ে সান্যালদা খুব হাসি হাসি মুখ করে বললেন, “বউমার কাছে শুনলাম যে, তোমায় আজকালের মধ্যেই হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেবে! কী আনন্দের কথা ভায়া! কবে পৃথিবীতে ফিরে যাচ্ছ তোমরা?”
আমার কিন্তু কথাটা শুনে মোটেও ভাল লাগল না। বললাম, “আমরা মানে? আপনি কি আলাদা ফিরবেন নাকি?”
সান্যালদা একগাল হেসে বললেন, “আমি তো আর ফিরছিই না ভায়া। চাকরিটা ছেড়ে দিয়েছি।”
“বলেন কী!”
“একদম।” তারপরে ঙাবাসনি-কে দেখিয়ে বললেন, “এই যে, এই ঙাবাসনি ভায়াই সব ব্যবস্থা করে দিয়েছেন! তোমাদের বউদি তো কবেই গত হয়েছেন। আমার আর পৃথিবীতে বাকি আছে কে বল? কার জন্য ফিরব? এই গ্রহটা খুব ভাল লেগে গিয়েছে আমার, বুঝলে না! কত ইতিহাস এখানে। বাঁধা রাস্তা ছেড়ে এক পা ফেললেই ভয় হয়, এই বুঝি মাটির তলায় লুকনো কোনও হাজার বছরের প্রত্নবস্তুর ওপরে পা দিয়ে ফেলছি। অসাধারণ! তা আমার ইতিহাসে এত আগ্রহ দেখেই বোধহয়, ঙাবাসনি একদিন নিজে থেকে আমাকে ডেকে বললেন,‘সান্যাল,তোমার তো দেখছি মেঙিলিকা আর তার ইতিহাসকে খুব ভালো লেগে গেছে। জান তো, ‘ইলোভাক’-কে আমরা এবারে একটা মিউজিয়াম বানিয়ে ফেলব। কাজেই আমাদের একজন কিউরেটারের দরকার। কাজটা নেবে নাকি? তুমি এখানে থেকে গেলে কিন্তু আমাদের খুবই ভালো লাগবে। কি, রাজি? মেঙিলিকাতে থেকে যেতে রাজি? তাও চাকরিশুদ্ধু! বলে কী! এ তো সোনায় সোহাগা! একেবারে রাজকন্যা আর অর্ধেক রাজত্ব! এমন প্রস্তাবে আবার রাজি হবার কথা জিজ্ঞেসও করতে হয় নাকি? আমি তো এক মুহূর্তেই প্রস্তুত! তারপরে চুক্তিপত্রে সই হওয়া মাত্র,দৌড়ে গিয়ে তোমাদের ওই সাধের পচা মিলিটারিটাকে, মনের সাধে গুড বাই বলে দিলাম। তিনবার করে বলে তবে মনের ঝাল মিটল।”
পেছন থেকে রজনী আস্তে করে বলল, “দাদার সঙ্গে আবার এই হাসপাতেলের একজন বিধবা নার্সের বেশ ভালো আলাপ হয়ে গিয়েছে। ভারী সুন্দর দেখতে ভদ্রমহিলাকে।”
Tags: অমিতাভ রক্ষিত, ইলোভাক, কল্পবিজ্ঞান গল্প, তৃতীয় বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা, পূজাবার্ষিকী
পড়লাম। বিজ্ঞানের বহু বিষয়ই ঠেসে দেওয়া হয়েছে। প্রস্তাবনা ও পরিস্থিতি বোঝাতে। শেষে যবনিকাপাত। তাই আমার ধারণা একটা বড়সড় সায়েন্স ফিকশনের উপাদান গল্পের মধ্যে রয়ে গেছে — তাই একটা উপন্যাস বা বড় গল্প হওয়া উচিৎ ছিল। একটু তাড়াহুড়ো করা হয়েছে। যাই হোক, নতুন ভাবনার গল্পটি আমার ভালো লেগেছে।
ধন্যবাদ
Great Ideas . The quadrant concepts from Star Trek ? The time difference suffered by students of Elovac appeared a bit elusive . If you are at high relative speed compared to earth your time moves slower than earth in “real time “. doesn’t it ? ie . your clock moves slower , including your biological clock , so will the organs age by earth years nevertheless , as was experienced by students in Elovac? ( Such tragedies are reported in cloning only , if the cell which has been taken for cloning has already aged .)
Nice plot nevertheless and well written . I enjoyed reading it ,
– Alok Basu . Kolkata . India . alok.kumar.basu@gmail.com
শেষের অংশটুকু বেশ রসালো হয়েছে। তার আগে বড্ড বেশি গ্যাজর-গ্যাজর আর ইনফোডাম্পিং হয়ে গেছে।
Besh valo hoyeche. Aro onek barano jeto…online eo ki page limit ?