ইস্কুল
লেখক: বিশ্বজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়
শিল্পী: ধ্রুবজ্যোতি দাস এবং দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য (চিত্রচোর)
রাইজিং স্টার ইন্টারন্যাশনাল ইস্কুলের ফ্রণ্ট ডেস্কের মেয়েটি আমাকে বলল, “আমাদের ইণ্টারভিউ আরও কয়েকদিন চলবে। যাদের আমরা যোগ্যতম মনে করব, তাদের মধ্যে থেকেই আমরা বেছে নেব পরবর্তী ইংরাজি শিক্ষকদের। আপনি যদি সিলেক্টেড হন, আপনাকে ডেকে নেওয়া হবে।”
আমি হতাশ হয়ে বললাম, “তাহলে আজকের মতো কি আসতে পারি?”
মেয়েটি বলল, “হ্যাঁ।”
আমি চারপাশটা একবার তাকিয়ে দেখলাম। প্রায় কুড়ি পঁচিশজন চাকরী প্রার্থী বসে আছে। সবাই ইংরাজি শিক্ষক পদের জন্য আবেদন করেছে। কাল–পরশু আরও লোকজন ইন্টারভিউ দিতে আসবে। এতজনের মধ্যে থেকে আমায় আর কেন নেবে! আমি তো এমনিতেই আগে কোথাও পড়াই নি। সেখানে অন্যান্য অনেকেরই বিভিন্ন ইস্কুলে পড়ানোর পূর্ব অভিজ্ঞতা রয়েছে। চাকরি হলে তাদেরই হবে।
বাইরে এসে স্কুলের বিশাল কম্পাউন্ডটা একবার ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম। স্কুল তো নয়, যেন রাজপ্রাসাদ। এমন স্কুলে পড়া বা পড়ানোর মজাই আলাদা। ব্যাঙ্গালোরের বেশিরভাগ আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন ইস্কুলগুলোর ক্যাম্পাসই এইরকম। ঝাঁ–চকচকে সব বাড়ি ঘরদোর। কবে যে এইরকম ইস্কুলে শিক্ষক হিসেবে সুযোগ পাব কে জানে!
স্কুল থেকে লাল মাটির পথ চলে গেছে বড় রাস্তার দিকে। আমি খরচা বাঁচানোর জন্য আর ক্যাব বুক করলাম না। ভাবলাম এই মাটির পথ দিয়ে পনের মিনিট হাঁটলেই তো শহরতলীর বড়ো রাস্তা পাব। সেখান থেকেই বাস ধরে নেব।
যতক্ষণ এই লাল মাটির পথ ধরে হাঁটছি, ততক্ষণ আপনাদের নিজের সম্পর্কে কিছু বলে দিই। আমার আদি বাড়ি হল দক্ষিণেশ্বরের দিকে। মা ছোটবেলাতেই মারা গিয়েছিল। আমার দাদা ব্যাঙ্গালোরে বড় মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে আছে। বউদিও একই কোম্পানিতে চাকরি করে। আমার বাবার যখন হার্ট–অ্যাটাক হয়, তখন দাদাই বলে যে বাবাকে ব্যাঙ্গালোরে এনে রাখতে। সাথে আমাকেও চলে আসতে বলে। আমি তখন সদ্য ইংরাজিতে এম.এ. পাশ করেছি। দাদা বলল যে ব্যাঙ্গালোরে অনেক ইস্কুল আছে যেখানে স্থায়ী/অস্থায়ী শিক্ষক নেয় ইংরাজি শেখানোর জন্য। এছাড়া অনেক কল সেন্টারেই ভালো ইংরাজি জানা ছেলে–মেয়ে নিয়োগ করে। সুতরাং চাকরি পেতে খুব একটা অসুবিধা হবে না। কিন্তু আসার পরে দেখছি যে চাকরি পাওয়াটা খুব একটা সহজ নয়।
দাদার টু–বি–এইচ–কে ফ্যাটে আমি আর বাবা এসে পড়ায় বউদির বোধহয় খুব অসুবিধা হচ্ছে। সুতরাং মনে–প্রাণে চাইছি একটা ভালো চাকরি যেন পেয়ে যাই। তারপর আমি বাবাকে নিয়ে নিজে একটা আলাদা ফ্ল্যাটে চলে যাব।
সকাল থেকে তেমন কিছুই খাওয়া হয়নি। লাল–মাটির পথে একটা চায়ের দোকান চোখে পড়ল। দোকানে কোনও ভিড় নেই। ভাবলাম একটু চা–বিস্কুট খাই।
চায়ের কাপে সবে চুমুক দিয়েছি, এমন সময় পেছন থেকে কে যেন পরিষ্কার বাংলায় বলে উঠল, “ইংরাজি পড়ানোর জন্য চাকরি খুঁজছেন?”
বিদেশ–বিভুঁইয়ে বাংলা শুনে বেশ ঘাবড়ে গেলাম। পেছন ফিরে তাকালাম। এক ভদ্রলোক হাসি–হাসি মুখে তাকিয়ে আছেন। উচ্চতা মাঝারি, মুখে ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি ও গালে একটা তিল। মাথায় কাঁচা–পাকা চুল। বয়স মনে হল চল্লিশের ওপর হবে। গলার স্বরটা বেশ ভারী। আমি ভদ্রলোককে ভালোভাবে নিরীক্ষণ করে বললাম, “আপনি?”
ভদ্রলোক বেশ উৎসাহী গলায় বললেন, “আমিও ইন্টারভিউ দিতে এসেছিলাম। আমাকেও পরে ডাকবে বলেছে।”
আমি এবার কৌতুহলবশত জিজ্ঞেস করলাম, “আমি যে বাঙালি সেটা জানলেন কী করে?”
ভদ্রলোক বললেন, “আপনি যখনই রিসেপশনিস্টকে নিজের নাম বললেন, তখনই বুঝলাম যে আপনি বাঙালি না হয়ে যান না। তাই ভাবলাম যে আপনার সাথে যেচেই আলাপ করি।” এই বলে ভদ্রলোক একটু থামলেন। দোকানীকে চায়ের অর্ডার দিয়ে আবার বলতে শুরু করলেন, “আমি এখানে ইণ্টারভিউ দিতে এসেছিলাম স্রেফ মাইনেটা একটু বাড়াব বলে। আমি ইতিমধ্যেই এক বছর হল ড্রিম এডুকেশন ইস্কুলে চাকরি করছি। সেখানে এখনও আই.সি.এস.ই. বোর্ডের জন্য শিক্ষক নিয়োগ চলছে। ইংরাজির জন্য তিনজন শিক্ষক চাই। আগে পড়ানোর অভিজ্ঞতা না হলেও চলবে। পরশু পর্যন্ত ইণ্টারভিউ চলবে। যদি চান তবে আগামীকাল আমার সাথে বাসে করে যেতে পারেন।
চাকরি যে আমার কতটা দরকার, তা আর বলে দিতে হবে না। একজন পরিচিত ব্যক্তির মাধ্যমে এই ড্রিম এডুকেশন ইস্কুলে যদি কাজে ঢুকে পড়া যায়, তাহলে তো ভালোই হয়। যদিও ইস্কুলটার নামও আজ অব্দি শুনিনি। তাই জিজ্ঞেস করলাম, “ড্রিম এডুকেশন? ইস্কুলটা কোথায় বলুন তো?”
ভদ্রলোক বেশ মোলায়েম হাসি হাসলেন। তারপর বললেন, “অনেকেই শোনেনি। আসলে ইস্কুলটা একদম নতুন তো, তাই। এবং নতুন বলেই আপনার সুবিধে।”
আমি ঠিক বুঝলাম না। জিজ্ঞেস করলাম, “আমার আবার কী সুবিধে?”
ভদ্রলোক বললেন, “ওখানে মোটামুটি যারাই ইণ্টারভিউ দিচ্ছে, সবাই সিলেক্টেড। অবশ্য সিলেক্টেড হওয়ার পরেও আমরা দেখে নেব যে ক্লাসে আপনি কেমন পড়াচ্ছেন।”
এবার কৌতুহলী হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “আর মাইনে–পত্তর?”
ভদ্রলোক বললেন, “সেসব ভালোই। আর সাথে শিক্ষকদের জন্য বিনামূল্যে থাকবার ব্যবস্থা, খাওয়া–দাওয়া ইত্যাদি আছে। আর হ্যাঁ, সাথে জামা–কাপড়, মালপত্র নিয়ে যাবেন। সিলেক্টেড হয়ে গেলে কিন্তু সাথে সাথে জয়েনিং।”
ভদ্রলোক আগামীকাল দুপুর একটার সময় কেম্পেগৌড়া বাস–স্টেশন থেকে বাস ধরবেন। সুতরাং সময় বেশি নেই। তাড়াতাড়ি সব গোছাতে হবে।
দাদা–বাবার কাছ থেকে অনুমতি পেতে বিশেষ অসুবিধে হল না। আর বউদি তো মনে হল বিশেষ খুশি হল যখন শুনল যে এই চাকরিটা পেলে আমায় ইস্কুলের জায়গাতেই থাকতে হবে। যথা সময়ে ভদ্রলোকের সাথে বাসে চেপে বসলাম। ভদ্রলোক যেতে যেতে নিজের সম্পর্কে অল্পই বললেন। ওনার নাম অমর কুমার সাহু। জানতে পারলাম যে উনি প্রবাসী বাঙালি। গত সাত বছর ধরে ব্যাঙ্গালোরেই আছেন। কী একটা কনটেন্ট রাইটারের কাজ করতেন। সেসব ছেড়ে–টেড়ে দিয়ে শেষ তিন বছর ধরে শিক্ষকতা করছেন। এবং মনে হল বর্তমান ইস্কুলে বেশ ভালোই আছেন। কিছুক্ষণ সাধারণ কথা–বার্তার পরে ভদ্রলোক বেশ চোখ বুজে ঘুম দিলেন। আমিও ইয়ারফোন কানে গান শুনতে লাগলাম। গান শুনতে শুনতে বেশ আনমনা হয়ে গেছিলাম। ঘণ্টা–দুয়েক পরে ভদ্রলোক মনে হল আমার কাঁধে টোকা মারছেন। কানের ইয়ারফোন খুলতেই ভদ্রলোক বললেন, “উঠে পড়ুন, এসে গেছি।”
আমি উঠে পড়তেই অমরবাবু কন্ডাক্টরকে বেশ ভাঙা–ভাঙা কান্নাড়া ভাষায় বললেন বাস থামাতে, কারণ আমরা নামব।
তাইতে কন্ডাক্টর চেঁচামেচি করে জানাল যে সেটা সম্ভব নয়। আমি কান্নাড়া ভাষা ভালো জানি না। তবে মনে হল, খুব সম্ভবত সে বোঝাতে চাইছিল যে এই জঙ্গলের মধ্যে কোনও স্টপেজ নেই।
বেশ একচোট ঝগড়ার পরে বাস অবশেষে থামল। মোটামুটি বাসভর্তি লোকের চিৎকার–চেঁচামেচির মাঝে আমরা নামলাম।
আমি চারপাশে তাকিয়ে একটু ঘাবড়ে গেলাম। একপাশে খাদ। আর একপাশে পাহাড়ী জঙ্গল। কিছুটা নিশ্চিন্ত হবার জন্যেই জিজ্ঞেস করলাম, “এখানেই কি ইস্কুল?”
অমরবাবু বললেন, “হুম। আসুন…”
এই বলে হন–হন করে জঙ্গলের দিকে এগিয়ে গেলেন। আমিও পিছু পিছু চললাম। পাহাড় চিরে উঠে গেছে পুরোনো পাথুরে সিঁড়ি। তারই ধাপে ধাপে আমরা চললাম। আমি জিজ্ঞেস করলাম, “এটাই কি ইস্কুলে যাওয়ার পথ?”
অমরবাবু দ্রুতপায়ে হাঁটতে হাঁটতে বললেন, “না। এটা হল শর্টকাট। আকাশে কেমন মেঘ করেছে দেখেছেন? বৃষ্টি নামার আগে আমাদের পৌঁছতে হবে। তাই এই রাস্তা ধরেছি।”
পাহাড়ী জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে চলেছি। বিভিন্ন রকমের পোকা–মাকড়ের শব্দ কানে আসছে। সাপ–টাপ থাকাও বিচিত্র নয়। প্রায় আধঘণ্টা চলবার পরে একটা ছোটো–খাটো ঝরণা চোখে পড়ল। সেটা পার করে আবার জঙ্গল। সেই জঙ্গলে আরও প্রায় মিনিট–কুড়ি চলবার পরে জঙ্গল শেষ হয়ে এল। আমরা এক পাহাড়ের পাদদেশে পোঁছলাম। চারিদিক সবুজে সবুজ। তার মাঝখানে একটা ছোটখাট প্রাসাদের মতো স্কুলটা দাঁড়িয়ে আছে। দেওয়ালের রঙটা কেমন যেন কালচে।
চারপাশ দেখতে দেখতে কনকনে ঠান্ডা অনুভব করলাম। আমি আমার পিঠের বড় ব্যাগ থেকে টুপি আর একটা জ্যাকেট বের করে গায়ে চাপালাম। অমরবাবু ইস্কুলের গেট ঠেলে আমায় আসতে বললেন। চারপাশটা একটু অদ্ভুত রকমের চুপচাপ। কে জানে, হয়তো নতুন ইস্কুল বলেই এমন চুপচাপ হবে হয়তো।
অমরবাবু আমাকে বসতে বলে কোথায় যেন চলে গেছেন। প্রিন্সিপালের ঘরের সামনে ঠায় বসে আছি। অবশেষে ঘরের ভেতর থেকে ডাক এল, “মিস্টার মিত্র, প্লিজ কাম ইন।”
নিজের সিভিটা হাতে নিয়ে আস্তে আস্তে আমি ঘরের ভেতরে প্রবেশ করলাম। এবং চূড়ান্ত অবাক হলাম। আমি দেখি যে অমরবাবুই প্রিন্সিপালের চেয়ারে বসে আছেন! আমায় অবাক হতে দেখে অমরবাবু হাসলেন। তারপর বললেন, “আরে দাঁড়িয়ে কেন? বসুন?”
অমরবাবু বেশ মোলায়েমভাবে হাসলেন। এই হাসিটা কেমন যেন অস্বস্তিকর ঠেকছে আমার কাছে। যেন এই অতিরিক্ত বিনয়ী হাসির আড়ালে কোথাও একটা ভয়াবহ বা রহস্যময় ব্যাপার লুকিয়ে আছে। অমরবাবু যেন আমার মনের ভাব বুঝতে পেরে বললেন, “কেমন, চমকে দিলাম তো?”
আমি ঢোঁক গিলে শুধু বলতে পারলাম, “আপনি…”
অমরবাবু বললেন, “হ্যাঁ, ইস্কুলের অস্থায়ী প্রধান শিক্ষকের কাজটাও আমাকেই করতে হয়।”
আমি একটু ধাতস্থ হয়ে বললাম, “ওহ।”
অমরবাবু এবার বললেন, “ইন্টারভিউ শুরু করি তাহলে? আর টেবিলে ঠান্ডা জল আছে আপনার জন্য। তেষ্টা পেয়ে থাকলে খেতে পারেন।”
আমি জল খেলে পরে ইণ্টারভিউ শুরু হল। বিভিন্ন বিষয়ে প্রশ্ন করতে লাগলেন ইস্কুলের প্রিন্সিপাল। ভার্বের ফর্ম, উদাহরণসহ অ্যাকটিভ ভয়েস – প্যাসিভ ভয়েসের পার্থক্য, প্রিপোজিশান টেস্ট, ইত্যাদি। এরপর আমায় একটা আরটিকেলের টপিক দিয়ে খানিকটা বলতে বললেন। একটা ছোট কবিতা দিয়ে সেটা ইংরাজিতে ব্যাখ্যা করতে বললেন। আমি সব উত্তরই মোটামুটি ভালোভাবে দেবার চেষ্টা করলাম। ইণ্টারভিউয়ের শেষে অমরবাবু আমায় অবাক করে বললেন, “দেখুন আপনাকে এটা জানাতে পেরে আমার ভালো লাগছে যে আপনি সিলেক্টেড। কাল থেকেই আপনাকে ক্লাস নিতে হবে।”
শুনে প্রথমটা অবিশ্বাস্য মনে হল। ভদ্রলোকের প্রতি কৃতজ্ঞতার সীমা রইল না।
এরপর ভদ্রলোক নিজেই আমাকে বেশ কিছু জায়গা পেরিয়ে একটা সরু প্যাসেজের সামনে নিয়ে এলেন। প্যাসেজের মধ্যে সারি সারি ঘরের দরজা। সবকটাই বন্ধ। অমরবাবু একটা সামনে দিয়ে দাঁড়ালেন। রুম নম্বর নয়–ছয়। ছিয়ানব্বই। আমি বিস্ফারিত চোখে দেখলাম যে দরজা খোলার জন্য ভদ্রলোক কোনও চাবি ব্যবহার করলেন না। বিড়বিড় করে কী যেন বললেন আর দরজা খুলে গেল। আমি থ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম। ভদ্রলোক পেছন ফিরে আমায় একবার দেখলেন। তারপর হাসলেন। সেই অস্বস্তিকর হাসি। তারপর বললেন, “ভাবছেন ম্যাজিক? হ্যাঁ কতকটা তাই। আমরা বেশ কিছু ক্ষেত্রে আসলে মুখে মুখে নির্দেশ দিয়ে থাকি। নির্দেশগুলো অঙ্কের কিছু টার্ম। আর এই প্রযুক্তি আমাদের গোটা ক্যাম্পাস জুড়েই আছে। আপনাকেও শিখিয়ে দিচ্ছি। দরজা খোলবার জন্য এ স্কোয়ার মাইনাস বি স্কোয়ার। বন্ধ করবার জন্য এ স্কোয়ার প্লাস বি স্কোয়ার। এটা আমরা করেছি যাতে ছাত্ররা অঙ্কের সূত্রগুলো বা টার্মগুলো মনে রাখতে পারে। আপনারও আশা করি মনে থাকবে?”
আমার মনে হল যে মনে থাকবে না। আরেকবার জিজ্ঞেস করলাম। অমরবাবু বললেন। আমি সেটাই আওড়াতে আওড়াতে ঘরে ঢুকে পড়লাম। ঘরে ঢুকে পড়ে এ স্কোয়ার প্লাস বি স্কোয়ার বলতেই দরজা দুটো দমাস করে বন্ধ হয়ে গেল। খানিকক্ষণ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রইলাম। না দরজাটা খুলল না।
বাথরুমের দেওয়ালে কোনও জামাকাপড় টাঙাবারই জায়গা নেই। এবার জলের কল খুলতে গিয়ে দেখি যে তা খোলা বা বন্ধ করার জন্য কোনও প্যাঁচই নেই। এই সময় দেওয়ালে চোখ পড়তেই অবাক হয়ে গেলাম। কোথা থেকে একটা সাদা কাগজ দেওয়ালে আটকে আছে আমার মুখের সামনে। অথচ কয়েক সেকেন্ড আগেও দেওয়ালে কিছুই ছিল না! আমি নিজে দেখেছি। যাইহোক, কাগজটার ওপর চোখ বোলালাম। সেখানে ঐ অঙ্কের নির্দেশিকা লেখা আছে। সেটা পড়ে এ প্লাস বি বলতেই, আজব ব্যাপার ঘটল। দেওয়াল ফুঁড়ে জামাকাপড় ঝোলানোর জায়গা বেরিয়ে এল, একটা তাক বেরিয়ে এল যেখানে সাবান ও দাড়ি কাটার সরঞ্জাম রয়েছে। পায়ের পেছনে ধাক্কা খেয়ে দেখি যে একটা বালতি–মগ চলে এসেছে। ব্যাপার–স্যাপার দেখে আমার মাথা বনবন করে ঘুরছিল। একটু ধাতস্থ হয়ে দেওয়ালের কাগজটা আবার দেখলাম। সেটা দেখে এ কিউব প্লাস বি কিউব বলতেই কল থেকে জল পড়তে শুরু করল। বেশ শান্তিতেই চান করলাম। চান করে এ কিউব মাইনাস বি কিউব বলতেই, জল পড়া বন্ধ হয়ে গেল। বাথরুম থেকে বেরোবার আগে তাক, বালতি–মগ ও জামাকাপড় ঝোলাবার জায়গা ভালো করে দেখে নিলাম। এ মাইনাস বি না বললে ওগুলো আর দেওয়ালে ঢুকে যাবে না।
বাথরুম থেকে বেরোতেই দেখি টেবিলে আমার জন্য খাবার ঢাকা দেওয়া। এটাও আবার দেওয়াল থেকে বেরিয়ে এল নাকি? ভেবে আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। কী ভয়ানক ভুতুড়ে যায়গায় এসে পড়লাম রে বাবা! তাও আবার যে সে ভূত নয়, অঙ্কের ভূত। ইংরাজির শিক্ষককে অঙ্ক শিখিয়েই ছাড়বে!
খেয়ে দেয়ে নিয়ে দেখি টেবিলের পাশে দেওয়ালে সেই বাথরুমের নির্দেশিকাটা উদয় হয়েছে। নির্দেশিকাটায় লাল কালিতে লেখা আছে, এ স্কোয়ার প্লাস বি স্কোয়ার মাইনাস টু এ বি। সেটা দেখে একবার পড়লাম। সঙ্গে সঙ্গেই খাবার টেবিলটা দেওয়ালের ভেতরে ঢুকে গেল। একপ্রকার মিলিয়েই গেল বলা চলে। নির্দেশিকাটা অবশ্য দেওয়ালে তখনও রয়েছে। দেখে মনে হচ্ছে কেউ যেন একটা কাগজ আঠা দিয়ে সেঁটে দিয়েছে দেওয়ালে। কিন্তু আমি জানি যে ব্যাপারটা তেমন নয়! একেবারেই নয়।
কী ঘটছে বোঝার জন্য আমি কাগজটাকে দেওয়াল থেকে তুলতে গেলাম। কাগজের একটা প্রান্তকে ধরতেই মনে হল যেন একটা মুখে ভেজা বাবলগামকে দুই আঙুলে ধরেছি। কেমন ঘেন্না লাগল। আঙুল থেকে ছেড়ে দিতেই পলকের মধ্যে সেই নির্দেশিকাটা দেওয়ালে ঢুকে গেল।
এই দেওয়ালের মধ্যে কী আছে? আমি উত্তেজনার বশে নির্দেশিকার অদৃশ্য হয়ে যাওয়া জায়গাটায় একটা ঘুঁষি মারলাম। মারতেই আমার হাতের মুঠোটা দেওয়ালের মধ্যে খানিকটা ঢুকে গেল। এই অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করা খুব মুশকিল। তবু বলি নদীর বয়ে যাওয়া জলে মনে হল যেন আমি হাত ডুবিয়েছি আর অসংখ্য ছোট ছোট মাছ যেন খাবার খাওয়ার জন্য আমার হাতে আলতো কামড় দিচ্ছে। আমি শিউড়ে উঠলাম। দেওয়াল থেকে হাত বের করে নিলাম। জেলির মতো লাল–লাল কিছু হাতে লেগে আছে। সেই লালচে পদার্থ থেকে যেন এক অপার্থিব আলো বেরোচ্ছে। তাড়াতাড়ি বাথরুমে গিয়ে হাত ধুলাম। ফিরে এসে দেওয়ালের দিকে তাকালাম। মনে হল পুরো দেওয়ালটাই যেন একটা সজীব প্রাণীর মতো।
আমার রীতিমতো ভয় হল। বাড়িতে একটা ফোন করলাম। ফোনে টাওয়ারের সিগনাল দেখাচ্ছে না। ভাবলাম এই সময় অমরবাবুকে পেলে ভালো হত। দরজার কাছে গিয়ে বললাম, “এ স্কোয়ার মাইনাস বি স্কোয়ার।”
দরজাটা খুলে গেল। আমার প্যাসেজ থেকে বেরিয়ে সামনে গেলেই সরু প্যাসেজটা দুভাগে ভাগ হয়ে গেছে। আমি ডানদিক ধরে এগোলাম। অথচ সেদিকের মুখ মনে হল বন্ধ। তবু এগিয়ে গেলাম। একটা দরজার দিকে চোখ পড়তেই চমকে গেলাম। দরজার নম্বর ছিয়ানব্বই। তখন চারপাশে তাকিয়ে মনে হল যেন আমি আমার দরজার সামনেই দাঁড়িয়ে আছি। আমি এবার উল্টোদিকে ঘুরে প্যাসেজ ধরে এগিয়ে বামদিকের রাস্তাটা ধরলাম। সেখানে এগোতে গিয়েও অদ্ভুত ব্যাপার দেখলাম। চারপাশের দেওয়াল যেন অদ্ভুতভাবে বদলে গিয়ে আমার ঘরের সামনের প্যাসেজ হয়ে যাচ্ছে! এবং হ্যাঁ সেদিকেও আর কয়েক পা এগিয়ে ছিয়ানব্বই নব্বর রুম আবিষ্কার করলাম। আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়েই দাঁড়িয়ে ছিলাম। হঠাৎ চমকে উঠলাম অমরবাবুর গলা শুনে।
উনি ওনার সেই গম্ভীর গলায় মোলায়েম করে হেসে বললেন, “কী ব্যাপার? রাত্রিবেলা নিজের ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে কী ভাবছেন?”
আমি আমতা–আমতা করে বললাম, “কিন্তু এটা আমার ঘর হবে কিভাবে? আমি তো হেঁটে এলাম… ঐ যে… ঐ দিকের প্যাসেজটা ধরে!”
অমরবাবু কোনও কারণে বিশেষ মজা পেয়েছেন বলে মনে হল। তিনি কথা না বাড়িয়ে বললেন, “এ স্কোয়ার মাইনাস বি স্কোয়ার”। আমার সামনে দরজা খুলে গেল। অদ্ভুত ব্যাপার। আমি দেখি যে নতুন ঘরেই আমার জামা–কাপড় সবকিছু রাখা। ইস্কুলের প্রিন্সিপাল এবার গম্ভীর গলায় বললেন, “আশা করি আপনি নেশা–টেশা করে ভুল বকছেন না! অনেক রাত হয়েছে। যান শুয়ে পড়ুন। কাল থেকে ক্লাস নিতে হবে। আর হ্যাঁ, শোবার সময় বলবেন ফ্যাকটোরিয়াল জিরো। তাহলেই ঘর অন্ধকার হয়ে যাবে।”
আমি যেন একটা ঘোরের মধ্যে থেকে বললাম, “এ স্কোয়ার প্লাস বি স্কোয়ার”। ঘরের দরজা বন্ধ হয়ে গেল। আমার মনে হল চারদিকের দেওয়াল যেন আমাকে গিলে খেতে চায়। আমার মনে হচ্ছিল সবই যেন জীবন্ত। এই খাট, বিছানার চাদর এগুলোও! এইসব ভাবতে ভাবতে কখন যেন আমার দুচোখের পাতা বন্ধ হয়ে এল। অজানা আতঙ্কের কারণে আমি আর ফ্যাকটোরিয়াল জিরো বলতে সাহস পাই নি। ঘরের আলো জ্বলতে লাগল।
যখন ঘুম ভাঙল তখন দিনের কোন সময় তা বুঝতে পারলাম না। মনে হল সকাল হয়েছে। সামনের দেওয়াল থেকে একটা জোর শব্দ আসছে। দেখি যে দেওয়ালে কখন যেন একটা ঘড়ি উদয় হয়েছে। তার অ্যালার্ম বাজছে। এমন বিচিত্র ঘড়ি আমি জীবনে দেখিনি। যেখানে বারো সংখ্যা লেখা থাকে সেখানে লেখা চারশো। আর একের জায়গায় লেখা মাইনাস পঞ্চাশ! ঘণ্টা–মিনিটের কাঁটা আন্দাজ করে বুঝলাম যে এখন বাজে তেত্রিশটা আটাত্তর! কোন পাগলের বানানো ঘড়ি কে জানে! তাড়াতাড়ি উঠে দেখি যে দেওয়াল থেকে আমার জন্য প্রাতঃরাশ বেরিয়ে এসেছে। মুখ ধুয়ে, জল–খাবার খেয়ে, চান করে সবে চুল আঁচড়াচ্ছি, এমন সময় আমার ঘরের দরজা খুলে গেল। অমরবাবু ঘরে এলেন। জিজ্ঞেস করলেন রাতে ভালো ঘুম হয়েছে কিনা। মাথা নাড়লাম। উনি এবার বললেন, “চলুন, ক্লাস সেভেনের ছাত্ররা আপনার জন্য অপেক্ষা করছে।”
আমি চুপচাপ ওনাকে অনুসরণ করলাম। গতকাল রাতের মতো সব প্যাসেজ একই রকম দেখাচ্ছে না। বেশ অন্যরকম। দেওয়ালের রঙও কোথাও নীল, কোথাও সাদা বা ক্রিম কালার। এবার ইস্কুলের প্রিন্সিপাল একটা দরজার সামনে এসে দাঁড়ালেন। তারপর তাঁর সেই গাণিতিক মন্ত্র উচ্চারণ, “এ স্কোয়ার মাইনাস বি স্কোয়ার”। দরজা খুলে গেল। আমরা ঘরে ঢুকলাম। এরপর অমরবাবু দরজা বন্ধের সংকেত বললেন।
ভেতরের দেওয়ালের রঙ একদম কালো। ঘরের ওপরের দেওয়ালে একটা প্রকান্ড আলো জ্বলছে। সেই আলোর তেজ কখনও বাড়ছে আবার কখনও কমছে। সেই আবছা আলোয় আমি ছাত্রদের মুখ দেখলাম। স্পষ্ট দেখতে পেলাম না, কিন্তু আমার মনে হল ওদের সবার মুখই একই রকম। চিনের শিশুদের মতো দেখতে প্রতিটা মুখ। প্রত্যেকের হাতে গ্লাভস পরা।
অমরবাবু বললেন, “এবারে আপনি পড়ানো শুরু করতে পারেন। ঐ টেবিলে প্রোজ এর বই আছে। সেটা খুলে যেকোন একটা গল্প দিয়ে শুরু করুন। একটু করে প্যাসেজ পড়ুন আর মানে বুঝিয়ে দিন।”
আমি বললাম, “ইয়ে, এত অন্ধকারে বইয়ের পাতাও তো দেখতে পারব না।”
আমার কথা শেষ না হতেই দেওয়ালের একটা অংশ চিরে যেন এক ফালি তীব্র আলো এসে পড়ল আমার ওপর। আমি পড়াতে শুরু করলাম বই দেখে। ভুতুড়ে ক্লাসরুমে আমি একা পড়িয়ে চলেছি। অমরবাবু একেবারে ছাত্রদের পেছনে বসে আমার পড়া শুনে চলেছেন। খানিকটা পড়িয়ে আমি অভ্যেস মতো জিজ্ঞেস করলাম, “বাচ্চারা পড়া বুঝতে কোনও অসুবিধা হচ্ছে? কারুর কোনও প্রশ্ন আছে?”
কেউ কোনও কথা বলল না। আমি আস্তে আস্তে একজন বাচ্চা কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “বল, কোনও প্রশ্ন আছে?”
সে একবার আমার দিকে তাকিয়ে বিদঘুটে ভাবে শব্দ করে উঠল, “কিঁচ–কিঁচ।”
তার পাশের জনও শব্দ করে উঠল, “কিঁচ–কিঁচ”, তারপর তার পাশের জনও। এবার সবাই মিলে শব্দ করতে শুরু করল, “কিঁচ–কিঁচ–কিঁচ–কিঁচ।”
তারপর সব ছাত্ররা ডেস্ক ছেড়ে আমার দিকে উঠে আসতে লাগল। আমি পিছু হঠতে লাগলাম। আমার মাথায় একটাই কথাই এল, “পালাও এখান থেকে।”
এ স্কোয়ার মাইনাস বি স্কোয়ার বলতেই দরজা খুলে গেল। আমি দৌড়তে লাগলাম। কোনদিকে যাচ্ছি তা জানি না। পেছনে পায়ের শব্দ শুনে বুঝলাম যে বাচ্চারা ও অমরবাবুও দৌড়ে আসছে। খানিক দৌড়নোর পরেই বুঝলাম যে আবার সেই প্যাসেজের মরীচিকা শুরু হয়েছে। একই প্যাসেজ দিয়ে দৌড়ে যাচ্ছি। এবং সেই ভয়ঙ্কর বাচ্চাগুলো এবার আমার কাছে এসে পড়েছে। তাদের পেছনে সেই ক্রুর হাসি নিয়ে অমরবাবু। আমার মাথায় একটা বুদ্ধি এল। আমি বললাম, “ফ্যাকটোরিয়াল জিরো”। সঙ্গে সঙ্গে প্যাসেজের সব আলো নিভে গেল। ভাবলাম অন্ধকারে কেউ আমায় সহজে দেখতে পাবে না। কিন্তু কয়েক মিনিট পরেই কে যেন কানের কাছে বাংলায় ফিসফিস করল, “এখানকার ছাত্ররা কিন্তু অন্ধকারেও দেখতে পায়।” সাথে সেই নিষ্ঠুর মোলায়েম হাসির শব্দ।
জ্ঞান এলে বুঝলাম যে আমাকে বেঁধে রাখা হয়েছে। আমাকে ঘিরে আছে সেই ক্লাসরুমের ছাত্ররা যাদের আর যাই হোক মানুষ বলা চলে না। ওদের ছদ্ম মুখের অবয়ব বদলে আসল মুখ এবার দেখতে পাচ্ছি। প্রত্যেকের চারটে চোখ, চারটে নাসারন্ধ্র ও একটা মুখ। আর প্রতি হাতে চারটে করে লিকলিকে আঙুল।
অমরবাবু দেখলাম কাছেই দাঁড়িয়ে আছেন। একমাত্র তাঁকেই মানুষের মতো দেখতে লাগছে। আমি রীতিমতো চিৎকার করে বললাম, “অমরবাবু আপনি আসলে কে? এরা সব কারা? আর… আর… আমায় নিয়ে কী করতে চান?”
অমরবাবু বললেন, “এইসবের উত্তর জানতে গেলে আপনাকে আগে নার্ডিসদের সম্পর্কে জানতে হবে। এই যে আমাদের ইউনিভার্স কিম্বা মাল্টিভার্স, এর সাথে সমান্তরালভাবে রয়েছে বহু ইউনিভার্স বা মাল্টিভার্স। কিন্তু সেসব রয়েছে অন্য ডাইমেনশনে। সেইরকমই এক ভিন্ন ডাইমেনশনে রয়েছে নার্ডিসদের গ্রহ রেটোরাস। পৃথিবী ও রেটোরাসের অবস্থান প্রায় একই, কেবল ডাইমেনশন আলাদা। দুটি গ্রহের মাঝে আছে ইণ্টার ডাইমেনশানাল ওয়াল। কিছুদিন আগে এক ব্ল্যাক হোলের আগ্রাসী প্রভাবে ইণ্টার ডাইমেনশন ওয়ালের কিছু অংশ খুলে ব্ল্যাক হোলের দিকে চলে যায়। ফলে ইণ্টার ডাইমেনশন ওয়ালে ফাটল ধরে। এইভাবে নার্ডিসদের পৃথিবীতে আসবার রাস্তা খুলে যায়। পৃথিবীতে এসে নার্ডিসরা বোঝে যে মানুষের থেকে তাদের অনেক কিছু শেখার আছে, এই গ্রহটা থেকেও তাদের অনেক কিছু পাওয়ার আছে। পৃথিবীর জল, খনিজ সম্পদ, মানুষের জ্ঞান–বিজ্ঞান নার্ডিসদের সভ্যতাকে উন্নত করবে। সেটা করতে গিয়ে মানুষের সাথে নার্ডিসরা মিশতে চায়। কিন্তু আপনি দেখেছেন যে মানুষের মতো ওরা কথা বলতে পারে না। ওরা কিঁচ–কিঁচ শব্দ ছাড়া কিছুই করতে পারে না। যদিও আমাদের কথা ওরা বুঝতে পারে, মনেও রাখতে পারে। ওদের বিজ্ঞানীরা চেষ্টা চালাচ্ছে যাতে অপারেশন করে ওদের মধ্যে মানুষের মতো স্বরক্ষেপণ গঠন বসানো যায়। সেটা যতদিন না হয়, ততদিন ওদের প্রয়োজন কিছু মানুষ যাদের মাধ্যমে ওরা পৃথিবীর সম্পর্কে আরও জ্ঞান অর্জন করবে। আর সেই মানুষগুলো হলাম আপনি–আমি।”
আমার গলা দিয়ে আওয়াজ প্রায় বেরোচ্ছে না। তবু চিঁ–চিঁ গলায় প্রশ্ন করলাম, “আমায় নিয়ে কী করতে চান?”
অমরবাবু বললেন, “বিশেষ কিছুই করতে চাই না। আপনার একটা ছোট্ট অপারেশন হবে। চিন্তার কিছু নেই। হাত–পা সব অক্ষত থাকবে। কেবল আপনার মাথার ভেতরে আমরা ছোট্ট একটা জৈব চিপ বসিয়ে দেব। এটা থাকলে নার্ডিসদের এই ইস্কুল ছেড়ে আপনি বেশিদিন দূরে থাকতে পারবেন না। এক সপ্তাহ হয়ে গেলেই আপনার মাথায় ভয়ানক যন্ত্রণা শুরু হবে, যার ফলে আপনি মরেও যেতে পারেন। সুতরাং আপনাকে এখানে ফিরে আসতে হবে। আর এসে এই নার্ডিসগুলোকে পড়াতে হবে।”
আমি খানিকক্ষণ চুপ করে রইলাম। তারপর জিজ্ঞেস করলাম, “আমার আগে কেউ ওদের পড়িয়েছে?”
অমরবাবু উত্তর দিলেন, “হ্যাঁ। এক অঙ্কের শিক্ষক। তিনি দু’মাস পড়িয়েছিলেন। তাঁর মাথায় অপারেশন করে আমরা জৈব চিপ বসাই। তিনি আমাদের ছেড়ে চিরতরে পালাতে চেয়েছিলেন। তাই সাতদিনের পরে আর ফিরে আসেন নি। আমি মনে করি তাঁর মৃত্যু হয়েছে। তবে তাঁর অবদান আমরা ভুলি নি। তাই তো এখানকার সবকিছুর মধ্যেই অঙ্কের কিছু টার্ম জুড়ে দিয়েছি। আর আমি অবশ্য কিছু পড়াই না। আমি অ্যাডমিনিস্ট্রেশন দেখি। আর শিক্ষক নিয়োগ করি। আমারও মাথায় জৈব চিপ বসানো আছে।”
আমি আর কথা বলতে পারছিলাম না। আমার খুব খিদে পেয়েছিল। সেকথা বললাম অমরবাবুকে। অমরবাবু হাতে একটা একটা ইনজেকশান দিয়ে বললেন, “এতে আপনার খিদে–ঘুম দুয়েরই কাজ হবে।”
আমি বিছানায় শুয়ে আছি। মাথায় অপারেশন হয়েছে। শরীর খুব দুর্বল। তবু সামনে অমরবাবুকে দেখে প্রশ্ন করবার লোভ সামলাতে পারলাম না। ইস্কুলের প্রধান শিক্ষককে জিজ্ঞেস করলাম, “আমি কতদিনে সুস্থ হয়ে উঠব?”
অমরবাবু ওনার ট্রেডমার্ক হাসিটা হাসলেন। এই হাসিটা আমার আর এখন ততটা খারাপ লাগছে না। বেশ গা–সওয়া হয়ে গেছে। তিনি বললেন, “খুব শিগগিরই। হয়তো আর চার–পাঁচদিন।”
আমি দুর্বল গলায় বললাম, “আমি এখানে আসবার পরে অনেক ভুতুড়ে ঘটনার সম্মুখীন হয়েছি। সেগুলোর কোনও ব্যাখ্যা নেই আমার কাছে। সেগুলো আপনি ব্যাখ্যা করতে পারবেন?”
অমরবাবু এই কথা শুনে আর হাসলেন না। বরং বেশ গম্ভীর মুখে বোঝাতে আরম্ভ করলেন। বললেন, “দেখুন, প্রথমদিন থেকেই আপনার পালানোর পথ বন্ধ করতে চেয়েছিলাম। তাই আপনাকে রাখা হয়েছিল একটা ভার্চুয়াল রিয়ালিটির ঘরে। আপনি যে পথেই যাচ্ছিলেন, আমরা আপনার ঘরের রেপ্লিকা ও তার সংলগ্ন প্যাসেজ তৈরী করে দিচ্ছিলাম। এতে শেষ পর্যন্ত আপনি আপনার ঘরেই ফিরে আসতে বাধ্য হবেন।”
আমি জিজ্ঞেস করলাম, “আর এই ইস্কুলের রহস্যময় দেওয়াল আর ঘড়ির অদ্ভুত সময়?”
অমরবাবু বোঝালেন, “আসলে এই ইস্কুলটাতো ঠিক ইস্কুল নয়। এটা একটা ছদ্মবেশী মহাকাশযান। নার্ডিসরা একটা ব্যাপারে অনেক এগিয়ে আছে মানুষের থেকে। ওরা জড় বস্তুর মধ্যে প্রাণ সঞ্চার করতে পেরেছে। যেমন ধরুন এই মহাকাশযানটাকেই। এর প্রত্যেকটা অংশ, দেওয়াল, প্যাসেজ – সবকিছু সজীব। আপনি ছুটছেন, কথা বলছেন, চান করছেন, ঘুমোচ্ছেন – এই সবই সে পর্যবেক্ষণ করছে। আপনার মনের সাথে মহাকাশযান যোগাযোগ করতে পারছে। এবং আপনার প্রয়োজন অনুযায়ী সাহায্য করছে। যেহেতু মহাকাশযানে থ্রিডি অবজেক্ট সৃষ্টির প্রযুক্তি আছে, তাই আপনি চাইলেই অনেক কিছু সাথে সাথে তৈরী হয়ে দেওয়াল থেকে বেরিয়ে আসছে। আর ঘড়ির সময় নিয়ে আপনি যা দেখেছেন সেটা আসলে নার্ডিসদের গ্রহের সময়।”
সবকিছুর ব্যাখ্যা পেয়ে ভালো লাগল। কিঁচ–কিঁচ শব্দ শুনে চেয়ে দেখি এক নার্ডিস ছাত্র কাঁপা–কাঁপা হাতে একটা জলের গ্লাস ধরে আছে। দেওয়াল থেকে জল না পেয়ে যে ভিনগ্রহী এক প্রাণীর হাতেই জলটুকু পেলাম, সেটা ভেবে মনে খুব শান্তি হল।
আমি বেশ খুশি হয়ে চোখ বুজে আরাম করতে লাগলাম।
কয়েকবছর পরের কথা। দুই যুবক শিক্ষক নিয়োগের পরীক্ষা দিয়ে বেরোচ্ছে এক বেসরকারী ইস্কুল থেকে। প্রথমজন বলল, “আমাদেরকে স্যোশাল সায়েন্সের জন্য আর কেন শিক্ষক হিসেবে নেবে? এইসব ইস্কুলে আগেই ভেতর–ভেতর সব নিয়োগ হয়ে যায়।”
দ্বিতীয়জন হতাশ হয়ে বলল, “একদম ঠিক বলেছিস। এইভাবে চললে আমাদের আর চাকরি হবে না।”
তাদের পেছন থেকে হঠাৎ কে যেন বলে উঠল, “আপনারা কি চাকরি খুঁজছেন? আমার জানাশোনা একটা বেসরকারী ইস্কুলে স্যোশাল সায়েন্সের শিক্ষক নিচ্ছে। ইন্টারভিউ দিলেই সাথে সাথে নিয়োগ। যুবকেরা পেছনে ফিরে তাকাল। আর তারা কাকে দেখল জানেন? আমাকে।
নতুন শিক্ষক নিয়োগের দায়িত্বটা আমাকেই দেখতে হচ্ছে। অমরবাবুর পরে এখন আমিই ইস্কুলের সর্বেসর্বা কিনা
Tags: ইস্কুল, গল্প, দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য (চিত্রচোর), দ্বিতীয় বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা, ধ্রুবজ্যোতি দাস, পূজাবার্ষিকী, বিশ্বজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়