উপসংহার
লেখক: পার্থ সেন
শিল্পী: ধ্রুবজ্যোতি দাস ও দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য্য (চিত্রচোর)
দুপুর থেকেই বৃষ্টি হচ্ছে আজ। ঠিক পাহাড়ি বৃষ্টি নয়, তবে কেমন যেন আকাশটা ধরে আছে। আজ দ্বাদশী, দুদিন হল আনুষ্ঠানিক ভাবে দুর্গাপূজা শেষ হয়ে গেছে, অবশ্য পশ্চিম বাংলায় বেশীরভাগ জায়গায় পুজোর মরশুমটা লক্ষ্মী পুজো পর্যন্ত থাকে। আর সাধারণত লক্ষ্মী পুজো পর্যন্ত স্কুল কলেজ, অফিস এমনিতেই বন্ধ থাকে, তাই আরো কিছু দিন আনন্দ উপভোগ করা, এই আর কি? দোষ নেই, আসলে আনন্দ জিনিসটা তো মানুষের জীবন থেকে এমন কর্পূরের মতো উবে যাচ্ছে, তাই যতটা পারা যায় আনন্দটাকে আঁকড়ে ধরে থাকা। আমি ডাঃ সুব্রত চক্রবর্তী, আমার অবশ্য ছুটি নেই। আমার নিজের নার্সিংহোম ‘স্পন্দন’, শেষ ছয়দিন ধরে আমি মোটামুটি একাই সেখানে পাহারায় আছি। অবশ্য সেই রকম ক্রিটিক্যাল পেশেন্ট এখন কেউ ভর্তি নেই। তাই আমার প্রায় সব স্টাফই ছুটিতে, দিনের বেলাটা দুজন পালা করে শিফট ডিউটি করছেন। সিস্টার, নার্সরা সবাই ছুটিতে, অবশ্য সে রকম প্রয়োজন হলে তাঁরা আসবেন সে রকম কথাই আছে। তবে সেই প্রয়োজন এখনো হয়নি। কাল অবশ্য চার জন ফিরে আসছেন, দুদিন বাদে বাকিরা সবাই। খালি থাকার মধ্যে আছেন অনিমেষ দা।
অনিমেষ পাকড়াশী, গত এগারো বছর ধরে আমার সব সময়ের সঙ্গী। আজ থেকে বারো বছর আগে যখন মুম্বাই থেকে স্থায়ী ভাবে পশ্চিম বাংলায় ফিরে এলাম আর এই ‘স্পন্দন’ শুরু হল তখন থেকেই অনিমেষদা আমার সঙ্গে। আমাদের বাড়ির কাছেই থাকেন, ছোটবেলা থেকেই চিনতাম তবে সে ভাবে কথা হত না। আমার জন্ম আর বেড়ে ওঠা শিলিগুড়িতে। আমার ডাক্তারী জীবনের শুরু মুম্বাইতে, নর্থ বেঙ্গল মেডিক্যাল কলেজ থেকে পাশ করে উচ্চ শিক্ষার জন্য প্রথমে মুম্বাই যাই। তারপর সেখানে পাঁচ বছর চাকরি করেছি। আসলে বাবার ইচ্ছে ছিল ভিটে ছেড়ে যেন না যাই, তাই বাবা মারা যাবার পর সেই ইচ্ছেটাকে পূরণ করতেই এই নিজের নার্সিংহোম। বাবা শিলিগুড়ি কোর্টের উকিল ছিলেন, জমানো টাকাও ছিল আর আমাদের পূর্বপুরুষের কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া একটা বাড়িও ছিল। সেবক থেকে কালিম্পং যাবার রাস্তায় কালিঝোরার কাছে সেই বাড়ি। মুম্বাইয়ের চাকরিটা ছেড়ে শিলিগুড়িতে ফিরে এলাম। তারপর এই কালিঝোরার বাড়িটাকেই একটু মেরামত আর পরিবর্তন করে আমার নার্সিং হোম শুরু হল। ধীরে ধীরে এটাই হয়ে উঠল আমার জীবনের ‘স্পন্দন’। ২২ জন পেশেন্টকে এখানে এক সঙ্গে রাখতে পারি। শিলিগুড়ি থেকে আঠাশ কিলোমিটার আর মালবাজার থেকে পঁয়ত্রিশ কিলোমিটার দূরে এই জায়গার নাম, ‘রম্বি’, আশে পাশে প্রায় তিরিশ কিলোমিটারের মধ্যে কোন নার্সিং হোম বা ভালো হেলথ সেন্টারও নেই। তাই সাধারন মানুষের কাছে ‘স্পন্দন’এর গুরুত্ব দিনে দিনে বেড়েছে। তবে নিজের প্রফেশনের নামে শপথ করে বলতে পারি, আমি কোনদিন সেটার অপব্যবহার করিনি, আর কোন রোগীকে কখনো ‘না’ বলিনি। সব কাজে নিশ্চয়ই সফল হইনি, তবে নিজের সাধ্যমত চেষ্টা আমি করি। আগে মা আর আমি এই বাড়িতেই দোতলাতে থাকতাম। তারপর এখন মা চলে যাবার পর আমি একাই থাকি। দোতলার দুটো ঘরে অজস্র বই আর গানের ক্যাসেট, সিডি – সেটাই আমার পৃথিবী। সঙ্গী বলতে আমার পেশেন্ট আর অনিমেষদা, আর কিছু পুরোনো বন্ধু। তারা অবশ্য খানিকটা ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেছে। আর উপভোগ করার জন্য আছে এখানকার অসাধারন প্রাকৃতিক সৌন্দর্য । অবিশ্রান্ত তিস্তার জলোচ্ছাস, সদ্য শুরু হওয়া হিমালয়ের হাতছানি, মহানন্দা অভয়ারণ্যের সংস্পর্শ আমি রোজ অনুভব করি। অবশ্য একটা জায়গায় আটকে পড়ায় তেমন কিছু নাম ডাক হলো না আমার। টাকাপয়সা বা পসার সে রকম কিছুও হয়নি, তবে আমার অনুতাপ বা আক্ষেপ কোনটাই নেই। বারো বছরের নিরলস পরিশ্রমে দুটো জিনিস হয়েছে। এক, স্থানীয় প্রায় সব মানুষ আমাকে চেনেন, ভালোও বাসেন। মানুষের ভালোবাসা কাকে বলে সেটা আমি রোজ বুঝতে পারি। সেটা বোধহয় টাকা পয়সা দিয়ে কিনতে পারতাম না। আর দুই, ডাক্তারী শাস্ত্রের মোটামুটি সব প্রাথমিক ব্যাপারগুলো আমি এখন শিখে ফেলেছি। ‘মাস্টার’ কি না বলতে পারবো না, তবে ‘জ্যাক’ তো বটেই!
যাই হোক সেই দুপুর থেকেই একটু বেরোনোর চেষ্টা করছিলাম কিন্তু পারছিলাম না। চারজন পেশেন্ট ভর্তি আছেন, সুতরাং ছোটখাট কাজ তো লেগেই ছিল। অনিমেষদা ফিরলে তবে আমার বিরতি। আসলে নার্সিং হোমের মধ্যে আমি সিগারেট খাইনা, এমনকি নিজের ঘরেও নয়। খেতে হলে বাইরে এসে খাই, তাতে সুবিধে আমারই। একটু কম খাওয়া হয়। আর সত্যি বলতে কি যা দাম হয়েছে এখন সিগারেটের! যত কম হয় তত ভালো! যা হোক বেরোতে সন্ধ্যে সাতটা হয়ে গেল। সামনের চায়ের দোকানের ছেলেটা তখন দোকান বন্ধ করার তোড়জোড় করছে। সূর্য অস্ত গেছে অনেকক্ষণ, আমার এদিকটায় আবার রাস্তায় তেমন আলো নেই, তাছাড়া পাহাড়ি এলাকা তো, সন্ধ্যেটা তাই বড্ড তাড়াতাড়ি নামে। অক্টোবরের শেষ দিকে এদিকটায় কেমন ঠাণ্ডা ভাব এসে যায়, বেশিক্ষণ বাইরে থাকতে ভালো লাগে না, কেমন শীত শীত করে। আজকের দিনটা কাটলে খানিকটা নিশ্চিন্ত হওয়া যায়। যদিও সে রকম এমারজেন্সী কেস কিছু নেই, তবে আসতে কতক্ষণ?
বেশ কাটলো সন্ধ্যেটা। ভারত আর দক্ষিন আফ্রিকার ওয়ান ডে ম্যাচ হচ্ছিলো, শেষ অবধি ভারতই জিতল। এদিকে অবশ্য মাঝে মাঝেই কেবল লাইন চলে যায়, তবে আজ ঠিকঠাক ছিল, কোন সমস্যা করেনি। অনিমেষদা এসে গিয়েছিলেন সুতরাং আমার আর সে রকম কোন কাজ ছিল না। বৃষ্টিটা একটু ধরেছে, তবে আকাশ কেমন যেন এখনো থমথম করছে। রাতের ডিনার শেষ করলাম তখন প্রায় নটা দশ, একা আছি সুতরাং বিছানায় শুয়ে ঘুমোতে পারবো না। আমার এক ভাইপো শরদিন্দুর ঐতিহাসিক কাহিনী সমগ্র পড়তে দিয়েছে, সেটাই পড়ছি গত পাঁচ দিন ধরে। প্ল্যান আছে আজ ‘তুঙ্গভদ্রার তীরে’ টা শুরু করব।
বেশ পড়ছিলাম বইটা। নটা সাঁইত্রিশ, সামনের দুটো ফোন একসঙ্গে বেজে উঠল। দুটো ফোনই একসঙ্গে ধরলাম তবে প্রথম কথা বললাম ল্যান্ড লাইনে, এক শঙ্কিত গলার স্বর বুঝতে অসুবিধা হলো না – “ডাক্তারবাবু, এন এইচ ১০ এর ধারে, সেবক ছাড়িয়ে একটু ওপরে, একটা মারাত্মক অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে, গাড়ি অ্যাকসিডেন্ট, ড্রাইভারের বডি গাড়ীতে আটকে গেছে, সঙ্গে একজন প্যাসেঞ্জার আছেন, ওনার বডিটা বাইরে ছিটকে পড়েছে। তিনি বেঁচে আছেন। তবে খুব বাজে ভাবে জখম ভদ্রলোক, খুব ব্লিডিং হচ্ছে। এক্ষুনি নিয়ে আসতে হবে। আচ্ছা ডাক্তার বাবু আপনার কাছেই আনবো তো?”
“ঠিক আছে নিয়ে আসুন, তবে আমার মনে হয় শিলিগুড়িতে একটা খবর করে রাখুন, আসলে পুজোর সময় তো! স্টাফরা সব ছুটিতে! আর তাড়াতাড়ি নিয়ে আসুন, আমি দেখি কি করা যায়, আর ব্লিডিং টা চেষ্টা করুন চেপে রাখার, বুকে সমানে পাম্প করতে থাকুন। হার্ট যেন বন্ধ না হয়ে যায়। আর পুলিশে খবর দিয়েছেন?”
“হ্যাঁ, খবর দেওয়া হয়েছে, ড্রাইভারের বডিটা বেরোচ্ছে না, আর গাড়ী তো পাহাড় থেকে নিচে পড়ে গেছে! আসছি স্যার, আধ ঘন্টার মধ্যে পৌঁছাচ্ছি”, তালে গোলে মোবাইল ফোনটা ধরা হলো না, যখন খেয়াল হল তখন লাইনটা কেটে গেছে।
ওঁদের আসতে প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট লাগল। আহত যে মানুষটি হাসপাতালে ভর্তি হলেন তাঁকে স্থানীয় মানুষ কেউ চেনে না। সেবক ছাড়িয়ে যে জায়গায় দুর্ঘটনাটা হয় সেখানে জনবসতি বেশী নেই। তাই কখন ঘটনাটা ঘটে সেটা ঠিক জানা যায় নি, তবে ভদ্রলোক রাস্তার ধারে ছিটকে পড়েছিলেন, একটি স্থানীয় ছেলে প্রথম তাঁকে দেখতে পায়, সেই কিছু স্থানীয় লোক জোগাড় করে, তারপর আমাকে ফোন করে। একটি মারুতি ভ্যান কোনমতে জোগাড় করে ভদ্রলোককে ওরা এখানে নিয়ে আসে। ভাগ্যিস গাড়ির দরজাটা খুলে যায়, তা নাহলে তাঁকেও পাওয়া যেতো না, গাড়িটার সঙ্গেই খাদে চলে যেতেন। ড্রাইভারের সীট বেল্ট বাঁধা ছিল সেই জন্যে সে হয়তো গাড়িতেই আটকে পড়ে।
ভদ্রলোকের মাথায় ভালো ইনজুরি হয়েছে, মুখটাতো একেবারে রক্তাক্ত, তাই চেনা বেশ কঠিন, তবে দেখে মনে হয় বয়স পঞ্চাশের আশে পাশে। মোবাইল ফোনটা অ্যাক্সিডেন্ট স্পটে ছিটকে পড়েছিল, কেউ তুলে নিয়ে এসেছে। তবে ফোনটা অন হচ্ছে না, কে জানে হয়তো চার্জ শেষ হয়ে গেছে। শুনলাম পথে রক্তক্ষরণ প্রচুর হয়েছে, তাই হয়তো এক বা দুই ইউনিট রক্ত লাগলেও লাগতে পারে। এরকম কেস আমি আগে অনেক দেখেছি, সত্যি বলতে এর থেকে বাজে কেসও দেখেছি, এটা আমার কাছে কিছু নতুন নয়, খালি আমার একটাই চিন্তা ব্লাড গ্রুপ নিয়ে। পুজোর সময়ে সেই রকম আনকমন ব্লাড গ্রুপ হলে পাবো কেমন করে?
অনিমেষদা এই সব দেখে দেখে এই রকম এমারজেন্সী সামলানোর ব্যাপারে ভীষণ পোক্ত হয়ে গেছে, এমারজেন্সী রুম আগে থেকেই সাজানো ছিল। প্রায় এক ঘন্টা প্রাথমিক চিকিৎসা, ফার্স্ট এইডের পর আমি যেটুকু বুঝলাম, ছোট বড় মিলিয়ে বারোটা ফ্র্যাকচার হয়েছে, তার মধ্যে এমন কিছু জায়গাও আছে যেখানে প্লাস্টার হয় না। আরো বেশীও ফ্র্যাকচার থাকতে পারে, সেটা এক্ষুনি বোঝা যাচ্ছে না, সারা শরীরে আমাকে কুড়িটা জায়গায় স্টিচ করতে হবে। এছাড়া মাথায় ইনজুরি আছে, যার জন্য সিটিস্ক্যান করতে হবে। আমার নার্সিং হোমে সে ব্যবস্থা নেই, সে অবশ্য পরে করালেও হবে, তবে ভদ্রলোক সংজ্ঞাহীন। আগের অভিজ্ঞতাতে দেখেছি এই ধরনের ক্রিটিক্যাল কেস সময় সময়ে রাত পেরোয় না। তবে দুটো আশার কথা, এক ওনার ব্লাড গ্রুপ ‘ও পজিটিভ’, আমার এবং অনিমেষ দা দুজনেরই ‘ও পজিটিভ’। শিলিগুড়ি থেকে আনতেও অসুবিধা হবে না আর প্রয়োজনে আমরাও রইলাম। আর দুই, এতোটা রক্তক্ষরণের পরেও ভদ্রলোকের ব্লাড প্রেসার, হার্ট বিট এবং পালস কিন্তু মোটামুটি স্বাভাবিক আছে।
তবে এই সব ব্যাপারে পেশেন্টের বাড়িতে আর থানায় খবর দিতেই হয়। থানাতে একবার ফোন করলাম, ইনস্পেক্টর প্রসেনজিত সরকার আমার খুব পরিচিত, দাদার মত। ওঁর কাছেই শুনলাম, ওঁদের একটা দল ইতিমধ্যে ঘটনাস্থলে পৌঁছে গেছে, সেখান থেকে গাড়িটাও উদ্ধার হয়েছে, তবে ড্রাইভারের বডি এখনো পাওয়া যায় নি। তবে ওই জায়গাটাতে ঘন বন এবং এতো উতরাই যে বডি গাড়ি থেকে ছিটকে অন্য কোথাও চলে গেলে সেটা এক্ষুনি খুঁজে পাওয়া বেশ শক্ত। তার ওপর এখন রাত হয়ে গেছে, এমনিতেই পাহাড়ে আলো থাকে না। আর তাই এই স্বল্প আলোয় উদ্ধার কাজ আরো কঠিন, কাল সকাল পর্যন্ত হয়তো অপেক্ষা করতে হবে। ওঁরা এখন ওখানেই আছেন, খুঁজছেন, আমাকে জানাবেন। আহত মানুষটির প্যান্টের পকেট হাতড়ে পেলাম মানি ব্যাগ, সেখানে সর্ব সাকুল্যে পাঁচশো এগারো টাকা, খুচরো কিছু পয়সা কিছু, দু চারটে হাতে লেখা ছোট নোট। আমি পুলিশ নই সুতরাং সেই সব দেখা বা পড়া আমার কাজ নয়, তাছাড়া এতে আমার কোন ইন্টারেস্টও নেই। তবে একটা উল্লেখযোগ্য জিনিস দেখলাম, সেটা না বললেই নয়। মানি ব্যাগের মধ্যে একটি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আবক্ষ ছবি। শার্টের পকেট হাতড়ে দুটো জিনিস পেলাম, একটা থ্রি টায়ার রেলের টিকিট দুর্গাপুর থেকে নিউ জলপাইগুড়ি, আর একটা আইডেন্টিটি কার্ড। কার্ডের ওপর লেখা সপ্তসিন্ধু সেন, দুর্গাপুরের একটি ঠিকানা। তাতে একটা ফটোও রয়েছে, তবে এত গুলো স্টিচ আর ব্যান্ডেজের পর এখন পেশেন্টের মুখের যা অবস্থা তা দেখে বোঝার উপায় নেই যে মানুষটি আমার সামনে অপারেশন টেবিলে শুয়ে আছেন ইনিই সপ্তসিন্ধু কিনা? একটা এমারজেন্সী ফোন নম্বর ও রয়েছে, ফোন করার চেষ্টা করলাম তবে লাগলো না, অবশ্য পুলিশকে জানিয়ে রাখলাম।
সব কাজ শেষ হল তখন প্রায় বারোটা কুড়ি, এখনো জ্ঞান আসে নি, তবে আমার মন বলছে ইনি হয়তো এ যাত্রায় উতরে যাবেন। কারন সব ব্যাপারেই ইনি মোটামুটি পজিটিভ রেসপন্স করছেন। এখন একটাই ভয়, মনে হচ্ছে ব্রেনে ইন্টারনাল হেমারেজ আছে, তাই মেমারি লসের একটা সম্ভাবনা থেকেই যাচ্ছে! জীবনদায়ী কিছু ইঞ্জেকশন দিলাম আর দু হাতে দুটো স্যালাইন চালিয়ে আমি বাইরে এলাম। বাইরে এসে দেখি তিন জন ভদ্রলোক এমারজেন্সী রুমের বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন আর আমার দিকে উৎসুক চোখে চেয়ে আছেন।
“কি ব্যাপার? কাকে চান?”
ওঁদের মধ্যে একজন বললেন “আপনি কি ডাঃ সুব্রত চক্রবর্তী? আচ্ছা সপ্তসিন্ধুকে এখানে নিয়ে আসা হয়েছে না?”
“হ্যাঁ, ঠিক কিন্তু আপনারা?”
“আমরা আসলে ওর বন্ধু। এক জায়গায় চাকরি করি, চারজনে দুর্গাপুর থেকে এসেছি। লাভা, লোলেগাও বেড়াতে যাচ্ছিলাম, ওর একটা কাজ ছিল শিলিগুড়ি তে, সেই জন্য ওর আলাদা গাড়ীতে করে আসার কথা ছিল! নাহলে সকলের একসঙ্গেই রিশভ যাবার কথা! আমরা তো দুপুরেই বেরিয়ে পড়েছিলাম”
“আপনারা খবর পেলেন কি করে?”
“আসলে আসতে দেরী হচ্ছে দেখে আমরা ফোন করছিলাম, তার পর কোন সাড়া নেই, ফোন তো সুইচড অফ। তারপর এদিক ওদিক খোঁজখবর নিলাম, শেষ পর্যন্ত হোটেল থেকেই পুলিশে খবর নিয়ে জানতে পারলো অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে, তাই সঙ্গে সঙ্গে এলাম”
আমার কিছু বলার আগে আর একজন বললেন “স্যার ওকি বেঁচে আছে?”
“হ্যাঁ, এখনো অবধি তো রেসপন্স করছেন ঠিকঠাক! তবে এই সব কেসে খারাপ হতে কতক্ষন?”
আগের ভদ্রলোক এবারে বললেন “স্যার কিছু মনে করবেন না, মানে যদি সিচুয়েশনটা একটু ঠিক হয়, মানে একটু কন্ট্রোলে থাকে আর কি, ওকে কি আমরা শিলিগুড়িতে বড় হাসপাতালে নিয়ে যেতে পারি?”
“না না, মনে করার কিছু নেই। আপনি ঠিক বলেছেন। নিশ্চয়ই নিয়ে যাবেন। আমার এখানে তো একটা প্রাথমিক ট্রিটমেন্ট হয়, বড় হাসপাতালে তো নিয়ে যেতেই হবে। তবে আমি বলব একটু অপেক্ষা করুন, জ্ঞান এসে গেলে আর চিন্তা নেই। কারণ এখান থেকে শিলিগুড়ি যেতে দেড় ঘন্টা তো লাগবেই! মাঝ রাস্তায় শরীর খারাপ হলে আপনারা সমস্যায় পড়ে যাবেন! কিন্তু আপনারা শিলিগুড়ি জেনারেল হাসপাতালে কাউকে চেনেন?”
“না স্যার”
“ঠিক আছে, আমি দেখছি। তবে পুলিশকে একটা খবর দিতে হবে। আশা করি বুঝতে পারছেন!”
“হ্যাঁ, সে তো বটেই।”
“আসুন ভেতরে আসুন”, এমারজেন্সীর পাশের ঘরটায় নিয়ে এলাম। যদিও এটা পেশেন্টদের থাকার ঘর, তবে এমারজেন্সী চলছে তো, এখানে থাকাই ভালো। দরকারে তাড়াতাড়ি পৌঁছতে পারবো। আর এখন তো এমনিতে ঘরটা খালি আছে। “আপনাদের নাম গুলো?”
এখনো পর্যন্ত যিনি মূলত কথা বলছিলেন তিনিই জবাব দিলেন “আমি জয়ন্ত ঘোষ, ও অতনু সান্যাল আর ও অরুপ মিত্র, আমরা সবাই দুর্গাপুরে থাকি। আমরা একটা রিসার্চ ল্যাবে কাজ করি। বায়োকেমিক্যাল ল্যাব, ওষুধের রিসার্চ হয়! এই আমার কার্ড, যদি আপনার কোন প্রয়োজন হয়, আমার ফোন নম্বরটা ও দেওয়া আছে”
“ধন্যবাদ, তা লোলেগাও কি বেড়াতে?”
“হ্যাঁ, সে রকম প্ল্যান ছিল। কিন্তু এখন তো সব পালটে গেল”
“এনার বাড়ীতে খবর দিয়েছেন?”
“আসলে ওর কেউ নেই। খবর করার মতো কেউ নেই। ও একা, অবিবাহিত, তবে অফিসে খবর দেওয়া হয়েছে”
“দেখুন আশা করি সব ঠিকঠাক থাকবে, আপনাদের একটা ফর্ম ফিল আপ করতে হবে। আর একটা অ্যাম্বুলেন্স লাগবে, সেটা ছাড়া এতোটা রাস্তা যেতে পারবেন না। অবশ্য রাস্তা বেশী নয়, তিরিশ কিলোমিটার মতো, তবে সেবকের কাছে জ্যাম থাকলে আপনাদের আরো সময় লাগবে। আমি কথা বলে নিচ্ছি, তবে অ্যাম্বুলেন্সের পেমেন্টটা কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে করতে হবে”
“ঠিক আছে স্যার, আমরা করে দেবো। আর স্যার, আপনার পেমেন্টটা?”
“সেটা এখন থাক, মিঃ সেন সুস্থ হলে ওনাকে বলবেন আমাকে ফোন করতে, আমি নিয়ে নেব, এখন ওনার লাইফ অনেক ইম্পপরট্যান্ট আমার পেমেন্টের থেকে। আর দোতলায় একটা রুম আছে গেস্ট রুম লেখা, আপনারা ওখানে একটু রেস্ট নিন। আমি এখানেই আছি, সিচুয়েশন যে রকম হবে জানাবো আপনাদের।”
দরকারী কাজ গুলো সেরে তিন ভদ্রলোক ওপরের ঘরে চলে গেলেন। আমি নীচের এই ঘরটাতেই রইলাম, যদি হঠাৎ করে কোন দরকার হয়? অবশ্য অনিমেষদা কে কিছু বলতে হয় না, উনি সব জানেন কখন কি করতে হয়। এমারজেন্সী রুমেই রইলেন। আমার ঘুম পায়নি, ‘তুঙ্গভদ্রার তীরে’ গল্পটা বসে পড়ছিলাম। মাঝখানে খালি একবার দশ মিনিটের জন্য ধূমপানের বিরতি নিয়েছিলাম।
প্রায় আড়াই ঘন্টা বাদে সপ্তসিন্ধুর সংজ্ঞা ফিরল। অনিমেষ দার আগমন আর ওনার মুখের ভাষা দুটোর কোনটাই আমার বুঝতে অসুবিধা হয়নি। তাড়াতাড়ি ফিরলাম এমারজেন্সী রুমে। সদ্য জ্ঞান ফিরে আসা রুগী কে সাধারণত আমি তিনটে প্রশ্ন করি। ওনার কথা বলা বারন, তাই একটা সাদা কাগজ হার্ড বোর্ডে লাগিয়ে এগিয়ে দিলাম ওনার দিকে, সঙ্গে একটা পেনসিল। সামনের বড় দেওয়াল ঘড়িটায় সময় দেখাচ্ছে – ২-৪৭। সময় জানতে চাইলে আমার পেশেন্ট কোন ভুল করলেন না। এবারে হাতের চারটে আঙ্গুল এক জায়গায় করে জানতে চাইলাম “বলুন তো কটা আঙ্গুল?” এবারেও উত্তর ঠিক এল। নাম জানতে চাওয়াতে কাঁপা কাঁপা হাতে সাদা কাগজে যে নাম টা ফুটে উঠল – সেটা আমি ভালো ভাবেই পড়তে পারলাম – ‘সপ্তসিন্ধু সেন’। যাক আমার টেনশন টা কাটল! মনে হচ্ছে স্মৃতি শক্তি ঠিক আছে। নিশ্চিন্ত মনে এমারজেন্সী ঘর থেকে বেরিয়ে আসছিলাম তবে একটা জিনিস চোখে পড়তেই কি রকম সেখানে আটকে যেতে হল, বাঁ হাতের কনুইয়ের ওপরে একটা গভীর ক্ষত ছিল যেখানে আমি তিনটে স্টিচ করেছিলাম সেই তিনটে স্টিচই কি রকম যেন আলগা হয়ে খুলে এসেছে। অবশ্য কোন রক্ত বেরোচ্ছে না, তবে ক্ষত টা দেখা যাচ্ছে, কিন্তু এই রকম কেন হল? সাধারণত স্টিচ জিনিস টা আমরা ডাক্তাররা কলেজেই শিখি, তারপর আঠেরো বছরে এতো স্টিচ করেছি এই রকম তো কখনো হয়নি আগে? হতে পারে এতো গুলো স্টিচ করতে করতে এটা হয়তো ঠিক হয়নি। অনিমেষ দাকে দেখাতে ওর মুখের ভাবভঙ্গি দেখে যা বুঝলাম উনি কিছু বোঝেন নি। নিজের খুব খারাপ লাগল, আমার কি চোখের দৃষ্টি কমে আসছে নাকি হাতের কাজ খারাপ হয়ে যাচ্ছে? তবে নতুন করে আর স্টিচ করলাম না, রক্ত যখন বন্ধ হয়ে গেছে তখন আর খোঁচাখুঁচি না করাই ভালো। আর এমনিতে স্টিচ জিনিসটা খুব আরামদায়ক তো নয়! আসলে টানা ছয়দিন ধরে যা যাচ্ছে, হয়তো তারই এফেক্ট! বেরোতে গিয়ে আবার আটকে গেলাম এবার আমার পেশেন্টের কেমন একটা গোঙানি শুনলাম, কিছু বলার চেষ্টা করছেন কি? কাছে গিয়ে ভালো করে শোনার চেষ্টা ও করলাম। মিনিট দুই তিন সেটাকে শোনার পরও ভালো করে বুঝতে পারলাম না তবে কেমন যেন আমার সারা গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। মনে হচ্ছে একটা কথা, আমার কানে এসেছে – “আমাকে বাঁচালেন কেন?” ভালো লাগলো না, বেরিয়ে এলাম, আঠারো বছর ধরে কাজ করছি, এমন কথা তো আমি আগে কখনো কোন রুগীর মুখে শুনিনি! ঠিক শুনেছি তো?
অ্যাম্বুলেন্স এসে গেছিল, প্রসেনজিতদা কে একবার ফোন করে জানিয়ে রাখলাম, জয়ন্ত ঘোষের সঙ্গে ওঁর কথাও হয়ে গেল। শিলিগুড়ি জেনারেল হসপিটালে কথা বলে রাখলাম, রুগীকে শিফট করে সব কিছু শেষ করতে প্রায় এক ঘন্টা লেগে গেল। তবে সপ্তসিন্ধুর জিনিস গুলো আমার কাছেই রয়ে গেল, আসলে সেগুলোর কথা বলতেই ভুলে গেছিলাম। মনে মনে ঠিক করলাম সব ঠিকঠাক থাকলে আমি দু-তিন বাদে একবার শিলিগুড়ি যাবো। তখন হয়তো মানুষটাকে অনেক সুস্থ দেখবো। আর শিলিগুড়িতে আমাকে মাঝে মাঝেই যেতে হয়।
[২]
সকালে আমার অ্যালার্ম ঘড়ি লাগে না, এমনিতেই ছটার মধ্যে ঘুম ভাঙ্গে, সে রাতে যখনই শুই। কাল অবশ্য নিজের অফিস ঘরে চেয়ারে বসেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ঘুম ভাঙল কলিং বেলের শব্দে, ঘড়িতে দেখাচ্ছে পাঁচটা বিয়াল্লিশ। তখনো ভালো করে আলো ফোটে নি। তাড়াতাড়ি এসে দরজা খুললাম – দেখি প্রসেনজিতদা।
“কি ব্যাপার তুমি এতো সকালে? এসো ভেতরে এসো”
“না ভেতরে এখন যাবো না, একটু বাদে। তোর ভেতরে তো সিগারেট খাওয়া যায় না, বাইরে আয় কথা আছে”
দরজাটা ভেজিয়ে বাইরে এলাম “হ্যাঁ বলো”
প্রসেনজিতদা সিগারেট ধরালো, “কি কেস হয়েছে, খবর শুনেছিস?”
“কিসের কেস?”
“তোর এখান থেকে কাল সপ্তসিন্ধু কে নিয়ে তিন বন্ধু বেরিয়ে আর শিলিগুড়ি পৌছয় নি”
“মানে? ভ্যানিশ?”
“মাঝরাস্তায় তিনজনেই মার্ডারড, খুন! সঙ্গে আম্বুলেন্সের ছেলে টাও। ইংলিশবাজারের কাছে গাড়ি রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে, পাহাড়ের দিকে মুখ করে। আর সপ্তসিন্ধুর বডি গাড়িতে নেই। বাকি চারটে লাশ পড়ে আছে, দুটো গাড়িতে দুটো বাইরে রাস্তার ওপর “
“কি বলছ কি?” বুঝতে পারছি না, স্বপ্ন দেখছি না তো? “চারটে খুন, একসঙ্গে! কি করে খুন করেছে?”
“মার্ডার উইপেন এখনো পাওয়া যায় নি, তবে দেখে মনে হচ্ছে খুব শক্ত কিছু জিনিস দিয়ে খুব জোরে মোক্ষম জায়গায় একটা করে মেরেছে, তাতেই কাজ শেষ। চারটে কেই একভাবে খুন করেছে! অবশ্য পোস্ট মরটেম হলে ডিটেলে জানা যাবে”
“তুমি কি করে খবর পেলে?”
“আমি ওদিকে ব্যস্ত ছিলাম, একে লোক নেই তারপর পরপর এই রকম ঘটনা। আমাকে সাড়ে চারটে তে শিলিগুড়ি হাসপাতাল থেকে ফোন করে বলছে পেশেন্ট এখনো আসে নি, খবর পাঠালাম এদিক ওদিক। তারপর একটা পেট্রোলিং ভ্যান যাচ্ছিলো, ওরাই প্রথম দেখতে পায়, তারপর আমাকে জানায়। তারপর এই স্পটে এলাম সেখান থেকে সোজা তোর কাছে। এখানেই ফার্স্ট এলাম কারন লোক গুলো কে তুই লাস্ট দেখেছিস, যদি কিছু ইনফরমেশন পাওয়া যায়”
“তোমার ওদিকে কি খবর? ড্রাইভারের বডি পেলে?”
“হ্যাঁ মালবাজারের ট্র্যাভেল কোম্পানির গাড়ি, ট্র্যাভেরা ছিল, পাহাড় থেকে নেমে গেছে, নিচে আটকে আছে। ড্রাইভার নাকি লোকাল, বডি আটকে আছে ভেতরে, বেরোয় নি এখনো, জানাবে আমাকে”
“কি হচ্ছে বলোতো? পাঁচজন মারা গেল এক রাতে? তার ওপর আবার ওই রকম আহত একটা বডি লোপাট? পাহাড়ে এই রকম কখনো হয়েছে আগে?”
“বোঝা যাচ্ছে না! কার কাজ? আচ্ছা সপ্তসিন্ধুর অবস্থা কি রকম ছিলো যখন তুই রিলিজ করলি?”
“পনের ষোল টা ফ্র্যাকচার, আরো বেশী হবে, প্রায় চল্লিশটা স্টিচ, ব্রেনে ইনজুরি, কুড়ি দিনের আগে তার দাঁড়ানোর কথা নয়, তবে জ্ঞান ফিরেছিল। পালস, হার্টবিট ঠিকঠাক ছিল। আচ্ছা আমাকে একটা কথা বলো, এই যে বডিটা লোপাট করেছে বেডশুদ্ধু লোপাট হয়েছে?”
“না না বেড যে রকম ছিল সে রকম আছে, আর তুই বোধহয় স্যালাইন লাগিয়ে পাঠিয়েছিলিস না? সে স্যালাইনের বোতল গাড়িতে পড়ে রয়েছে।”
“তোমার কি মনে হচ্ছে বডি নিয়ে পালিয়ে গেছে কেউ?”
“তাছাড়া কোন অপশন আছে কি? আমরা চেক লাগিয়েছি, কিন্তু তার আগেই যদি পাহাড় থেকে নেমে গিয়ে থাকে? তাহলে তো আর ধরা যাবে না! আমি একটা জিনিস বুঝতে পারছি না, এই লোকটা কে এমন ইম্পপরট্যান্ট লোক বলতো? যার জন্য এতো গুলো খুন হল?”
“কিন্তু এর জন্যই যে হয়েছে বুঝছো কি করে? আগের টা তো গাড়ী অ্যাকসিডেন্ট ছিল”
“হ্যাঁ ওকে নিয়েই তো সব কিছু হচ্ছে, তাই না! অ্যাকসিডেন্টটা প্ল্যান্ড হতে পারে। আচ্ছা কিছু মালপত্তর পেয়েছিস লোকটার? কি করত লোক টা? কিছু জানিস”
“এসো ভেতরে এসো, সব বলছি”
প্রসেনজিতদা কে ভেতরে নিয়ে এলাম, চুয়ান্ন তে পা দিয়েছে এই সেপ্টেম্বরে, আমাদের মধ্যে যারা পুলিশদের উঠতে বসতে গালাগাল দেয়, আমার খুব ইচ্ছে করে তাঁদের কে একবার প্রসেনজিতদা কে দেখাই। সিন্সিয়রিটি, সততা, আর সাহস – এই তিনের এক অসামান্য সংমিশ্রণ হলো প্রসেনজিতদা। যা হোক অনিমেষ দা চা বানালেন, আমি সপ্তসিন্ধুর মানি ব্যাগ, মোবাইল ফোন, পড়ে থাকা কাগজ, ট্রেনের টিকিট সব কিছু দিয়ে দিলাম, সঙ্গে জয়ন্ত ঘোষের কার্ড টাও। আমার সঙ্গে ওঁদের যতটা কথা হয়েছিল তার প্রায় পুরোটাই বললাম প্রসেনজিতদা কে। কাগজ গুলো উলটে পালটে দেখছিল প্রসেনজিতদা, প্রায় মিনিট দুয়েক চুপ করেই ছিল তারপর বলল – “দুর্গাপুর যেতে হবে মনে হচ্ছে, আর একটা কথা। আমাদের স্কেচ করার লোকটাকে তোর কাছে পাঠিয়ে দেবো, যতটা মনে আছে তার বেসিসে এই সপ্তসিন্ধুর একটা স্কেচ করে দিসতো!”
“কিন্তু সপ্তসিন্ধু কে তো আমি ভালো করে দেখিনি, অত রক্ত, অত গুলো স্টিচ, কি করে করি বলতো?”
“যা পারিস তাই করিস, বাকিটা ওই আই কার্ডে ছবি আছে, দেখি এই দুটো দিয়ে যতটা করা যায়”
“আচ্ছা তুমি এই গুলো দেখে কিছু পেলে?”
“সে রকম কিছু নয়, তবে একটা খটকা লাগছে জানিস?”
“কি রকম?”
“ওর বন্ধুরা তোকে বলেছিল ওরা বেড়াতে এসেছে। তারপর সপ্তসিন্ধু র কোন কাজ ছিল শিলিগুড়িতে। সেই জন্য সে কয়েক ঘন্টা বাদে স্টার্ট করলো। তাই তো? তাহলে এই লোকটা একা একা একটা থ্রী টায়ার ট্রেনে চেপে দুর্গাপুর থেকে নিউজলপাইগুড়ি এলো কেন? সবাইকার এক সঙ্গে আসা উচিত ছিল। তাই না? আচ্ছা তোকে এটা বলেছিল রিশভে কোন হোটেলে উঠেছে?”
হোটেলের নাম আমাকে বলেনি, তাই ‘না’ বলতে হল। কিন্তু প্রসেনজিতদার এই যুক্তিটার সঙ্গে আমি এক মত হতে পারলাম না “কিন্তু দেখো, একটা ব্যাপার। ধরো বন্ধুরা আগে প্ল্যান করেছে, তারপর পরে ওকে রাজী করিয়ে এক ট্রেনে নিয়ে এসেছে। আর তারপর ধরো সীটের অ্যাডজাস্টমেন্ট ট্রেনে করাটা কি খুব শক্ত কাজ? একটা রাতের তো ব্যাপার!”
“হ্যাঁ সেটা করা শক্ত নয়। তবে সীটের অ্যাডজাস্টমেন্ট করতে গেলে টিটি কে তো রিসারভেশনের টাকা দিতে হবে। তাহলে তার স্লিপ কোথায় গেল? হ্যাঁ, সে সেটা ফেলে ও দিতে পারে, কিন্তু আরো একটা বড় খটকা আছে! এই লোকটা ১০ তারিখে মানে পরশু জলপাইগুড়ি পৌঁছল সকাল আটটায়। এরা যাচ্ছে লোলেগাও, তাহলে একটা দিন জলপাইগুড়ি তে কি করল? যদি তুই লাভা লোলেগাও যাস তাহলে একটা দিন শুধু শুধু তুই জলপাইগুড়িতে টাইম ওয়েস্ট করবি কেন?”
“জলপাইগুড়িতে এক রাত থাকতেই পারে! কাছে পিঠে বেড়ানোর জায়গার কি অভাব আছে?”
“হতে পারে! কিন্তু বন্ধু গুলো তো তোকে বলেই ছিল, যে ওরা লাভা লোলেগাও বেড়াতে যাচ্ছে। তাহলে এই জলপাইগুড়ির হল্টটা কেন? একটা গ্যাপ কিন্তু থেকে যাচ্ছে! আচ্ছা শোন আমি এখন উঠি, সামনে অনেক কাজ”
“বাড়ী যাবে না?”
“একটু বাদে। এখন একবার ইংলিশবাজার স্পটে গিয়ে দেখি কিছু পাওয়া যায় কিনা? কিছু তো একটা থাকবেই। তবে আসল রহস্যটা কিন্তু এই সপ্তসিন্ধুই। দেখা যাক! আর তুই তাহলে ওই টা একটু করে দিস, আমি জানাবো তোকে কি হল?”
ঠিক সময়ে মনে পড়ল, তাই প্রসেনজিতদাকে বলে রাখলাম কালকে জ্ঞান ফেরার ঠিক পর আমি সপ্তসিন্ধুর গোঙ্গানির মধ্যেও কি শুনেছিলাম।
সকাল টা খানিক টা অলস ভাবেই কাটল। অনিমেষদা পুরো ব্যাপারটা জানতেন, প্রসেনজিতদার সঙ্গে কথা বলার সময় উনি ও ছিলেন, আর তাছাড়া এখানে গোপনীয়তার কিছু ছিলও না। এই রকম একটা ঘটনায় আমার মতো উনিও কেমন মানসিক ভাবে আহত হয়ে পড়েছেন। আমার দুজন স্টাফ আর দুজন নার্স আজ কাজে জয়েন করলেন, তাঁরাও দেখলাম সব জানেন। আসলে ছোট জায়গা তো খবর তাড়াতাড়ি ছড়িয়ে পড়ে। সকাল নটা, আমার ব্রেকফাস্ট হয়ে গেছে ঠিক এই সময়ে দীপকবাবু, যিনি আমাদের অ্যাকাউন্টস দেখেন আমার ঘরে এলেন, “স্যার একটি ছেলে এসেছে নাম বলছে রোহন কুমার, আপনার সঙ্গে দেখা করতে চায়”
নিচে গেলাম, একটি বছর তিরিশের ছেলে মুখটা চেনা চেনা, আগে দেখেছি, তবে ঠিক কবে সেটা মনে পড়ছে না, আমাকে দেখে সে হাত জোড় করে নমস্কার করলো,
“ডাক্তার বাবু আপনি হয়তো মনে করতে পারবেন না, তবে আমি আপনাকে কিন্তু ভুলিনি, আমার বাবাকে আপনি চিকিৎসা করে সুস্থ করেছিলেন। রোড অ্যাকসিডেন্ট হয়েছিল ২০১৪ নভেম্বরে, আপনি হয়তো ভুলে গেছেন। আমার নাম রোহন কুমার, আমরা কালিম্পঙ্গে থাকি। আপনার সঙ্গে একটু দেখা করতে চাই”
“কি ব্যাপারে?”
“একটু পারসোনাল কথা আছে”
পেশেন্টের কথা সবসময়ে ব্যক্তিগত হয়, কাজেই সময় নষ্ট না করে ওপরে নিজের অফিস ঘরে নিয়ে এলাম, “বলো কি ব্যাপার?”
“স্যার কাল রাতের গাড়ী আক্সিডেন্টের ব্যাপারে কিছু বলার ছিলো”
“বলো, কি বলতে চাও?”
“স্যার, ডামডিম ছাড়িয়ে উদলাবাড়ির দিকে একটু এগোলে আমার একটা রোড সাইড খাবারের দোকান আছে, রেস্টুরেন্ট বলতে পারেন। কাল সন্ধ্যে আটটা নাগাদ একটা ট্র্যাভেরা আমার হোটেলে আসে, সেখান থেকে প্যাসেঞ্জার আর ড্রাইভার দুজনেই আমার কাছে খাওয়া দাওয়া করে। তারপর আধ ঘন্টা বাদে ওরা বেরিয়ে পড়ে, শুনলাম সেই ট্র্যাভেরা টা নাকি পাহাড় থেকে পড়ে গিয়ে অ্যাকসিডেন্ট করেছে। ড্রাইভার লোকাল ছেলে, আমার চেনা, কালিম্পঙ্গে থাকে। তেজবাহাদুর নাম, আর শুনলাম ওই ভদ্রলোককে জখম অবস্থায় কাল রাতে এখানে নিয়ে আসা হয়। স্যার আরো একটা জিনিস বলার ছিল”
মন দিয়ে শুনছি, সুতরাং মাথা নেড়ে ওকে এগোতে বললাম।
“স্যার আরো একজন ভদ্রলোক কিন্তু ওঁদের সঙ্গে টেবিলে বসে ছিলেন। উনি আগে এসেছিলেন অন্য টেবিলে বসেছিলেন, চা খেয়েছিলেন খালি। আর তিনি কিন্তু লোকাল নন, তাঁকে আগে কিন্তু এখানে দেখিনি। তারপর দেখলাম এই ভদ্রলোক ওনাকে চিনতেন, সেই জন্য দুজনে একসঙ্গে বসলেন”
“ওই ভদ্রলোকের মুখটা মনে আছে তোমার?”
রোহন মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো, আবার বলল, “স্যার পুলিশে গেলাম না আপনার কাছেই এলাম, তবে পুলিশের যদি কিছু লাগে আমার ফোন নম্বর টা রেখে যাচ্ছি আপনার কাছে”
“আচ্ছা তেজবাহাদুর কি নতুন ড্রাইভার?”
“না স্যার, তুখোড় হাত, বছর দশেক হল গাড়ি চালাচ্ছে, সেই বাচ্ছা বয়স থেকে। ওর হাত থেকে এই রকম ভাবে গাড়ি বেড়িয়ে যাওয়া স্যার ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না ”
“তুমি সত্যি খুব উপকার করলে, তোমার আর একটু হেল্প লাগবে, আসলে পুলিশের একজন লোক আসছেন আমার কাছে। উনি চেহারা বর্ণনা শুনে উনি স্কেচ করেন। তা এই ভদ্রলোকের একটা ছবি আঁকাও, দেখা যাক এনাকে আমরা কেউ চিনি কিনা? তারপর আমরা বরং পুলিশের সঙ্গে কথা বলব”
রোহন আবার মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো, ঘর থেকে বেরোনোর সময় এও বলল সে নিচে অপেক্ষা করছে। রোহন কে ছেড়ে আমি ঘর থেকে বেড়িয়েছি আর ঠিক এই সময়ে অনিমেষ দাকে দেখলাম আমার ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে। দরজা ভেজানো ছিল তাই নক করেননি, “কি ব্যাপার অনিমেষ দা?” কালকে অপারেশনের সময় আমরা সপ্তসিন্ধুর একটা ব্লাড স্যাম্পল নিয়েছিলাম যেটা ফ্রিজে রাখা ছিল আর আমি সেটার কথা বেমালুম ভুলেই গেছিলাম। অনিমেষদা সেটাকে টেস্ট করে ফেলেছেন এবং তাতে অ্যামফেটামাইন্স এবং কেটামাইন খুব বেশী মাত্রায় পাওয়া গেছে। আমি যতটা জানি তার ভিত্তিতে বলতে পারি সাধারনত কোন খাবার থেকে এই জিনিস তো আসবে না, মিডল ইউরোপ বা দক্ষিন আমেরিকা থেকে আসা ড্রাগসে এই সব রাসায়নিক পদার্থ যথেষ্ট বেশী মাত্রায় থাকে! এটার আবার একটা বাজে ঘুমপাড়ানো প্রভাব আছে। তাহলে? এর ব্যবহার কেন হয়েছে? সপ্তসিন্ধুকে দেখে একেবারেই আমার ড্রাগ আসক্ত লাগেনি, ব্যাপারটা সত্যি স্বাভাবিক লাগছে না এবারে! প্রসেনজিতদা ঠিকই বলেছে, একটা গভীর রহস্য লুকিয়ে আছে।
মাঝের দুটো দিন কেটে গেল, অনেক খবর বেরোল, অনেক আলোচনাও শুনলাম। আজকে থানায় এসেছিলাম, রাত প্রায় সাড়ে নটা হয়ে গেল থানা থেকে বেরোতে। থানার ঠিক পেছনে একটা ছোট খোলা জায়গা আছে, সেখানে চেয়ার লাগিয়ে বসে প্রসেনজিতদার সঙ্গে কথা বলছিলাম। এখন অনেকগুলো রহস্য আমাদের সামনে। এক, রোহনের মুখের বর্ণনা শুনে পুলিশ যাকে স্কেচ করল – তিনি আর কেউ নন তিনি অরুপ মিত্র, সপ্তসিন্ধুর তিন বন্ধুর এক জন, যারা কাল রাতে ওঁকে ‘স্পন্দন’ থেকে শিলিগুড়িতে হাসপাতালে নিয়ে গেলেন। আমাকে বলেছিলেন খবর পেয়ে ওঁরা রিশভ থেকে এসেছেন তাহলে ব্যাপারটা ঠিক নয়। কারন রোহন ওঁকে রাত সাড়ে আটটায় সপ্তসিন্ধুর সঙ্গে মালবাজারে হোটেলে খেতে দেখেছে। তাহলে আমাকে মিথ্যে কথা বলা হলো কেন? দুই, ইংলিশ বাজারে অ্যাকসিডেন্ট স্পটে পাওয়া চার জনের ডেডবডি পরীক্ষা করে এটা দেখা গেছে প্রসেনজিতদার অনুমান অনেকটাই সঠিক। তিনজন কে একটা করে আঘাত করা হয়েছে এবং সেই আঘাত করা হয় শরীরের একেবারে মোক্ষম জায়গায়। অতনু সান্যাল কে গলার কাছে যাতে ভোক্যাল কর্ড ভেঙ্গে তৎক্ষণাৎ মৃত্যু, অরুপ মিত্র কে মাথার বাঁদিকে, জয়ন্ত ঘোষকে বুকের বাঁদিকে তাতে লাংস পাঙ্কচার হয়ে মৃত্যু, আর আম্বুলেন্সের ছেলেটিকে গলা টিপে হত্যা। সবচেয়ে বড় রহস্য এখানে কোন অস্ত্রের ব্যবহার হয়নি। কারন কোন অস্ত্রের ব্যবহার হলে আঘাত স্থানে ফরেন পার্টিকিলস পাওয়া যায়, এখানে সে রকম কিছু নেই। তাহলে আঘাত করা হলো কি দিয়ে? হ্যাঁ, হাত দিয়েও এই খুন গুলো করা যায়। তবে তাতে আততায়ীকে অমানুষিক শক্তির অধিকারী হতে হবে অথবা বিশেষ মিলিটারি স্কিল থাকতে হবে। বিশেষত অরুপ মিত্র কে যে আঘাত করা হয়েছে, যেখানে ওনার মাথার খুলি ফেটে গেছে আমার মনে হয় না সেটা কোন মানুষ শুধু হাত দিয়ে করতে পারে। এটা বোঝা যাচ্ছে, আততায়ী চারজনকে খুন করে আহত সপ্তসিন্ধুকে নিয়ে চলে গেছে। কিন্তু খটকাটা হলো এই যে, পুলিশ কিন্তু এই ষষ্ঠ ব্যক্তির হাতের ছাপ পায়নি। তাহলে আততায়ী সতর্ক হয়ে হাতের ছাপ লুকিয়েছে। রহস্যের কিন্তু এখানেই শেষ নয়। মালবাজারে ওরিয়েন্টাল ট্র্যাভেল কোম্পানি থেকে ট্র্যাভেরা নিয়ে সপ্তসিন্ধু যাচ্ছিলেন দার্জিলিং, সুতরাং সেখানেও গন্ডগোল। আমাকে বলা হয়েছিল রিশভ, এতো গোলমাল কেন? কিন্তু তেজবাহাদুর যে কিনা এই চত্বরে এক অত্যন্ত বিশ্বস্ত ড্রাইভার তার মৃতদেহ পরীক্ষা করে পুলিশ প্রচুর মাত্রায় অ্যামফেটামাইন্স এবং কেটামাইন পেয়েছে। তেজবাহাদুরের খুব সুনাম এই এলাকায় এবং খুবই সুদক্ষ ড্রাইভার। এখন সবচেয়ে রহস্য টা হল ড্রাইভার এবং আরোহী দুজনে এতো বেশী মাত্রায় ড্রাগস নিলো কেন?
উল্লেখযোগ্য আরো কয়েকটা তথ্য পাওয়া গেছে। দুর্গাপুর থেকে খবর এসেছে গত শুক্রবার মানে পঞ্চমী র দিন হয়ে অফিসে পুজোর ছুটি শুরু হয়। অতনু সান্যাল, অরুপ মিত্র আর জয়ন্ত ঘোষের বাড়িতে কথা বলে জানা গেছে এঁরা অষ্টমীর দিন একসঙ্গে তিস্তা তোরসায় চেপে জলপাইগুড়ির উদ্দেশ্যে বেরোন। আগে থেকে কিছু প্ল্যান ছিলো না, হঠাৎ করে বেড়িয়ে পড়েন। অবশ্য এইরকম বিনা প্ল্যানে তাঁরা আগেও বেড়িয়ে পড়েছেন। সুতরাং প্রসেনজিতদার প্রশ্নের উত্তর এখনো পাওয়া যায়নি। সপ্তসিন্ধু একা একা একটা থ্রী টায়ারে চেপে দুর্গাপুর থেকে নিউ জলপাইগুড়ি এলো কেন? তাকে কি কেউ ডেকে পাঠিয়েছিল? যাই হোক, এই সপ্তসিন্ধু কিন্তু একা, অবিবাহিত। তাঁর এক ভাই আছেন কলকাতায় থাকেন, তাঁকে পুলিশ খবর দেবার চেষ্টা করছে, তবে মোবাইল নাকি সমানে সুইচ অফ আসছে। এও শুনলাম স্থানীয় পুলিশ তার বাড়ি হয়তো তল্লাশি করবে এক দুদিনের মধ্যে এবং কোন দরকারী তথ্য পেলে আমাদের জানাবে। এটা ঠিক, এঁরা চারজনে বন্ধু ছিলেন। একটা বায়োকেমিক্যাল ল্যাবরেটরিতে কাজ করতেন এবং অফিসের রেকর্ড অনুযায়ী চারজনেরই পঞ্চাশের আশে পাশে বয়স। তবে এঁদের মধ্যে সপ্তসিন্ধু একটু একা একাই থাকতেন, খুব একটা লোকজনের সঙ্গে মিশতেন না। এঁদের সবার বাড়ির লোকজন হয়তো এক দুদিনের মধ্যে এখানে আসবেন মৃতদেহ শনাক্ত করতে। তবে সপ্তসিন্ধুর কোন খবর এখনো পাওয়া যায় নি।
[৩]
স্পন্দনে ফিরলাম তখন প্রায় সাড়ে দশটা হয়ে গেছে, আজকের রাতটা আবার একা। কারন আজ লক্ষ্মী পুজো আর মোটামুটি সবার বাড়িতেই এই পুজোটা হয়। আসলে আমি কাউকে ‘না’ বলতে পারি না। আমার স্টাফ দের তো একেবারেই নয়। যা হোক আমি আর অনিমেষদা সামলে দেবো। আসলে ক্লান্ত ছিলাম তাই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, হঠাৎ ঘুম ভাঙ্গল মোবাইলের একটা কর্কশ শব্দে। ঘড়িতে দেখলাম তিনটে সাতাশ, অচেনা নম্বর, তবে মোবাইল থেকে নয়, ল্যান্ড ফোন থেকে। ফোন বাজলেই এখন ভয় লাগে, যা যাচ্ছে। কিন্তু আমরা পেশায় ডাক্তার, আমাদের ধরতেই হয়, ধরলাম
“ডাঃ চক্রবর্তী?”
“হ্যাঁ বলুন”
“আমি সুধাময় সেন বলছি, সপ্তসিন্ধুর ভাই, আমি এখন এখানে নর্থ বেঙ্গলেই রয়েছি। সপ্তকে পাওয়া গেছে আজ কয়েক ঘন্টা আগে, খুব সিরিয়াস ভাবে জখম, হয়তো আর বেশীক্ষন সে নেই। বড়জোর দুই তিন ঘন্টা, কালিম্পঙ্গে চার্চের পেছনে একটা হেলথ সেন্টারে আমরা আছি। একবার দেখা করা যেতে পারে কি?”
“পুলিশে খবর দিয়েছেন?”
“এই আপনাকে দিয়ে তারপর দেবো”
“কোন ডাক্তার দেখছেন?”
“নাম তো জানি না স্যার, তবে উনি একটু বাড়ি গেলেন, আবার আসবেন বললেন। এলে আপনার সঙ্গে কথা বলিয়ে দেবো”
“ঠিক আছে আমরা আসছি”
সপ্তসিন্ধুর কেসটা নিয়ে আসলে মানসিক ভাবে এমন বিধ্বস্ত হয়ে আছি আমাকে রাজী হতেই হল। মাঝরাত হলেও প্রসেনজিতদা কে ফোন করলাম, তিন বার রিং হতেই তুলল। সব বললাম, জানলাম সেখানেও ফোন গেছে আর আমার সঙ্গে যে কথা হয়েছে সেটাও উল্লেখ করা হয়েছে। প্রসেনজিতদা জীপ নিয়ে আসছে আমাকে নিয়ে যাবে সেই রকম ঠিক হল। আমি ভেবেছিলাম একটু সকাল হলে বেরোব, কিন্তু প্রসেনজিতদা রিস্ক নিতে চাইল না। যদি দেরী হয়ে যায়?
কালিম্পঙ্গে চার্চ আমি খুব চিনি, মানে আমাদের এখানকার সবাই চেনে। তবে পেছনের হেলথ সেন্টার ব্যাপারটা ঠিক বুঝিনি, অবশ্য প্রসেনজিতদা বলল – ও চেনে। বছর দুয়েক শুরু হয়েছে স্থানীয় মিউনিসিপ্যালিটির উদ্যোগে। পুরোনো বাড়ি, ব্রিটিশ আমলের, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নাকি এসেছিলেন, অবশ্য শোনা কথা। ওই চত্বরে কয়েকটা পুরোনো বাড়ি আছে, ঠিক কোনটা বুঝতে পারিনি, তবে এলাকাটা বুঝতে পারছিলাম। যা হোক শেষ অবধি চিনতে অসুবিধা হয়নি। হেলথ সেন্টারে যখন ঢুকছি তখন প্রায় সকাল পাঁচটা। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে যাবো এই সময় এক ভদ্রলোক কে দেখলাম আমাদের দেখে হাত তুলে নমস্কার করলেন, পরিচয় দিলেন – “আমি সুধাময়, সপ্তর ভাই, আসুন ওপরে”
একটা জিনিস দেখে অদ্ভুত লাগলো সপ্ত সিন্ধু এক পাঁচ ফুট সাত – আট ইঞ্চির খুব সাধারন চেহারার মানুষ, কিন্তু সেখানে তাঁর ভাই কিন্তু খুবই বলিষ্ঠ, অনেকটা বডি বিল্ডারদের মতো, উচ্চতায় তো ছয় ফুট দুই তিন তো হবেনই। প্রসেনজিতদা আগে ছিল আমি পেছনে, বাঁদিকের একটা ঘর আমাদের দেখালেন। ঘরে আলো জ্বলছে তবে তেমন উজ্জ্বল নয়। প্রথমে প্রসেনজিতদা, তারপর আমি, পিছুপিছু সুধাময়। সেখানে ঢোকার ঠিক পরেই অদ্ভুত ঘটনা ঘটল। আমি ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই মাথার পেছনে একটা আঘাত, দুচোখ অন্ধকার, আর আমার মনে নেই।
জ্ঞান যখন ফিরল দেখলাম সামনের দেওয়াল ঘড়িটা দেখাচ্ছে পাঁচটা তিরিশ, যদি এই ঘড়িটা ঠিক হয়ে থাকে তার মানে প্রায় মিনিট পনের আমি সেন্সলেস ছিলাম। খেয়াল হতে বুঝলাম আমার হাত টা পেছনে বাঁধা আর আমাকে চেয়ার বন্দী করে বেঁধে রাখা হয়েছে। এবারে বাঁদিকের চেয়ারে চোখ পড়ল প্রসেনজিতদার ও এক অবস্থা। তবে আমার জ্ঞান ফিরেছে, ওর কিন্তু এখনো আসেনি। ঘরটা বেশ অন্ধকার, একটা আলো আছে তবে সেটা খুব কম। এবারে ডান দিকে চোখ পড়ল, একটা চেয়ারে এক ভদ্রলোক বসে আছেন। সঙ্গে একটা জ্বলন্ত সিগারেট, মুখটা আমি দেখতে পারছি না, তবে বুঝতে পারছি তিনি আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। আমার এই রকম অভিজ্ঞতা আগে কখনো হয়নি। এবারে একটা গলার আওয়াজ শুনতে পেলাম, চিনতেও পারলাম। যিনি কথা বলছেন তিনি সুধাময়, যার সঙ্গে একটু আগে ফোনে কথা হয়েছে – “আমাকে ক্ষমা করবেন ডাঃ চক্রবর্তী, আসলে এই ইন্সপেক্টর ভদ্রলোক কে আমি এখানে চাইছিলাম না। কিন্তু আসতে বারন করি কি করে? তাই এটা করতে হল, ওনাকে একটা ঘুমের ডোজ দেওয়া আছে, সকাল আটটার আগে ওনার ঘুম ভাঙবে না। আর আপনি ভাববেন না। কিচ্ছু করবো না আপনাদের সঙ্গে, খালি একটা গল্প শোনাবো আপনাকে! আসলে এটা একটা ভয়ের গল্প! আপনার কি রিঅ্যাকশন হবে ঠিক জানি না তো? তাই একটু নিরাপত্তা নেওয়া আর কি।”
আমি মুখে কিছু বলি নি, তখনো ভয়টা কাটেনি, চুপ করেই ছিলাম, “সপ্ত আর এক ঘন্টা, ডাক্তার কথা দিয়ে গেছেন। জানেন ছোট থেকেই ও খুব ব্রিলিয়ান্ট ছিলো, মাধ্যমিকে তেত্রিশ, উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় সাতাশ, তারপর ইঞ্জিনিয়ারিং, যে রকম সব ভালো ছেলেরা করে আর কি। তারপর শুধু পড়াশোনা নয়, রবীন্দ্রনাথের এত বড় অনুরাগী কিন্তু আপনি দেখবেন না। পাঁচশোর বেশী রবীন্দ্রসঙ্গীত গীত বিতানের সাহায্য ছাড়াই ও গাইতে পারে, লিরিক্স পুরো মুখস্থ। কিন্তু কি জানেন চাকরিটা জমাতে পারলো না। প্রথমে তো একটা পাবলিক সেকটারে, তারপর সে ছেড়ে রিসার্চ ইনস্টিটিউট ব্যাঙ্গালোরে ছিল অনেক দিন, কিন্তু সেখানে গণ্ডগোল করল, সেটা ছেড়ে কলকাতায় এলো, তারপর সেখানেও রিসার্চ করছিল, কিন্তু কিছুই জমেনি ঠিকঠাক, নানা প্রবলেম, তারপর চাকরিটাও খোয়ালো। তারপর শেষ পাঁচ বছর ধরে দুর্গাপুরে এই চাকরিটা করছিল, কিন্তু ওই মরে মরে বেঁচে থাকা আর কি। আসলে বেশী ট্যালেন্ট থাকলে বোধহয় মানুষ এই রকম হয়”
কয়েক সেকেন্ডের বিরতি তারপর আবার নিজে থেকেই বললেন, “ওর সব ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের বন্ধুরাই এখন সমাজে প্রতিষ্ঠিত কিন্তু ওকে দেখুন? না আমি নতুন জিনিস আবিষ্কার করবো, পেটেন্ট বানাবো, ইনভেন্ট করবো, সেই নিয়ে লড়াই, ঝগড়া, কি হলো শেষ পর্যন্ত? নিজের চাকরী টাও গেল। যা হোক, কোন রকমে চলছিল, স্বপ্ন গুলো আসতে আসতে নিভে যাচ্ছিল। সব গোলমাল হয়ে গেল আগের ডিসেম্বরে। একটা রাশিয়ান জার্নালে পড়ল – নিজের চেহারা বদলানোর রিসার্চ চলছে ব্যাস অমনি শুরু হয়ে গেল। একটা কেমিক্যাল সলিউশন বানিয়েও ফেলল, যেটা ব্যবহার করলে স্কিন পিগমেন্ট এবং বডি স্ট্রাকচার দুটোই পরিবর্তন হয়ে যায়, আসলে ডিএনএর মিউটেশন হয়ে যায়। মানে ধরুন একটা ছোট কালো খরগোস কে ওটা খাওয়ালেন আর তাতে সেটা বেশ বড়সড় সাদা খরগোসে পরিবর্তন হয়ে যাবে। ওর ওয়েট চেঞ্জ হবে, আকৃতি পরিবর্তন হবে। আরো একটা কথা, এই যে পরিবর্তন টা হতো সেটা সাময়িক ভাবে হতো, স্থায়ী নয়। কিন্তু সে রিসার্চ করার খরচ কে দেবে? চেষ্টা চলল কিন্তু কিছু হলো না। তো এই সব থেকে মানসিক অবসাদ গ্রাস করল ওকে। আর সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডী যে সে নিজেকেই গিনিপিগ বানালো। অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট আর কার্বন টেট্রা মিথাইল দিয়ে বানানো সেই সলিউশন নিজের ওপর প্রয়োগ করল সে। ধীরে ধীরে এটা হয়ে উঠল তার একটা নেশা। তবে কারোর ক্ষতি করার জন্য নয়। নিজের থেকে নিজেকে ভুলে থাকার জন্য। আর রিসার্চটাও অসম্পূর্ণ থেকে গেলে তো।”
আমি চুপ করেই আছি, এখনো বুঝতে পারছি না এই সব গল্প আমাকে কেন শোনানো হচ্ছে? আকাশ বেশ পরিষ্কার হয়ে এসেছে। এখন ঘরটাতে আর আগের মতো অন্ধকার নেই। তবে সুধাময় সেনের মুখটা এখনো আমি পরিষ্কার ভাবে দেখতে পাচ্ছি না। তবে ওনার মুখের দিকে তাকিয়ে আছি কারন গল্পের পরের অংশটাও আমি শুনতে চাই। কয়েক সেকেন্ডের বিরতির পর তিনি আবার বলা শুরু করলেন, “তারপর জানেন সব ঠিকঠাক চলছিল, নেশা অ্যাডিকশন এই সব নিয়ে নিজেকে ভুলেই ছিল সে। কিন্তু মাঝে মাঝে ভগবান এমন মনের মধ্যে ভালো করার ইচ্ছে ধরিয়ে দেন না! আন্দ্রে মিখাইলচেঙ্কো রাশিয়ান বিজ্ঞানী, ডুয়াল আইডেন্টিটি নিয়ে রিসার্চ করেন, তাঁরই পেপার পড়ে সপ্তর এই পাগলামো র শুরু হয়, তিনি ভারতে আসছেন জানতে পারলো। দেখা করতে চাইল, আবার রিসার্চ নিয়ে মেতে উঠল। সময় ও পাওয়া গেল, ডাঃ আন্দ্রে দার্জিলিং এ আসবেন দেখা করবেন ওর সঙ্গে। কিন্তু পথে কাঁটা হয়ে দেখা দিল তিন জন, সেই তিন জন, যাদের কে সে বিশ্বাস করতো, অথচ তারা মিথ্যে হাসি, মিথ্যে প্রতিশ্রুতি, মিথ্যে কথা দিয়ে বন্ধু সেজেছিল তার। আসলে নিজের সাফল্যের কথা তো সবাই বলতে চায়, সেও বলল। কোন এক দুর্বল মুহূর্তে সে বলে ফেলল। আর তারা ষড়যন্ত্র করল। কারন? ওই পেটেন্টটা তাদের চাই, আসলে পরিশ্রম না করে শুধু অসামাজিক কাজ করে তো প্রচুর পয়সা পাওয়া যায়। আর সেটা অনেক সহজ। ব্যাস, গাড়ী অ্যাকসিডেন্ট প্ল্যান করে ফেলা হল! মাঝ রাস্তায় সিগারেটের নামে ড্রাগস দিয়ে দেওয়া হল, যাতে ড্রাইভারের গাড়ির ওপর থেকে কন্ট্রোল চলে যায়। মিথ্যে একটা প্রাণ গেল, আর একটা আজকে যাবে।”
এবারে প্রথম আমার যেন প্রথম কথা বলার শক্তি এলো, “আর ইংলিশবাজারের রাস্তায় সেই তিন বন্ধুকে খুন করা সেটা কার কাজ?”
কয়েক সেকেন্ডের বিরতি তারপর বেশ কাটাকাটা গলায় আমার প্রশ্নের উত্তরটা পেলাম, “আমি সুধাময় সেন, আমি চারটে খুনের দায়িত্ব নিচ্ছি, ওদের খুন না করলে সপ্তকে আমি নিয়ে আসতে পারতাম না। আর ওরা তো সপ্তকে মেরেই দিতো, ওরা ওকে চিকিৎসা করাতে চায়নি, মারতেই চেয়েছিল। যদিও আমার কোন রিগ্রেট নেই তবুও অ্যাম্বুলেন্সের ড্রাইভার নারায়নকে আমি কিন্তু মারতে চাইনি। ভালো ছেলে, আসলে এই সব দেখে ভয় পেয়ে এমন করছিল ও, আমাকে মারতেই হল”
আমার দীর্ঘ ডাক্তারী জীবনে এই রকম আগে কখনো হয়নি, খুনী আমার সামনে বসে আছে আর খুনের দায়ীত্ব স্বীকার করছে। আমি কিন্তু এখনো বুঝতে পারছি না এই সব কথা আমাকে কেন বলা হচ্ছে। এবারে বাধ্য হয়ে প্রশ্নটা করেই ফেললাম, “কিন্তু এই সব আমাকে বলছেন কেন? আমি তো আপনার দাদা কে চিনতামই না, মাত্র তিন ঘন্টার চিকিৎসা করেছি মাত্র। আর সেতো আমার দায়ীত্ব ছিল”
সুধাময় আমার কথার সোজা উত্তর দিলেন না, তাঁর দৃষ্টি অন্যদিকে, আমি তাঁর মুখে একটা কবিতা শুনলাম, আগে শুনেছি তবে কবে মনে নেই,
এ জন্মের গোধুলি ধুসর প্রহরে, বিশ্ব রস সরোবরে
শেষ বার ভরিব হৃদয় মন দেহ
দূর করি সব কর্ম, সব তর্ক, সকল সন্দেহ, সব খ্যাতি, সকল দুরাশা
বলে যাব, “আমি যাই, রেখে যাই, মোর ভালোবাসা”
“১৯৩৯ সালে নিজের লেখা ‘জন্মদিন’ কবিতা এই বাড়ীতে বসে পাঠ করেছিলেন কবিগুরু, আর আকাশবানীতে সেই কবিতা শোনানো হয়েছিল, লক্ষ বাঙ্গালী শুনেছিল সেই কবিতা, সেই পাঠ। আর আজ যে সপ্তসিন্ধুর উপসংহার লেখা হবে, আপনি ছাড়া সে কাহিনী শোনার আর কে আছে?”
“আপনার ভায়ের সঙ্গে একবার দেখা করা যাবে?”
“নিশ্চয়ই যাবে তবে গল্প টা শেষ হলে, কিন্তু এখনো তো গল্পটা শেষ হয়নি।”
“আমার একটা প্রশ্ন আছে, করতে পারি কি?”
“নিশ্চয়ই পারেন”
“আপনার ভাই কে তিন দিন আগে যে অবস্থায় দেখেছিলাম তাতে তাঁর তো কোন কথা বলার শক্তি ছিলো না, তাহলে আপনি কলকাতায় থেকে এতো কিছু জানলেন কি করে? আপনাকে এতো ডিটেলে সব কিছু বলল কে?”
“স্যার আপনি এখনো বুঝতে পারেন নি সেটা? খুনের স্থানে ষষ্ঠ ব্যক্তির হাতের ছাপ আপনারা পেয়েছিলেন? পান নি, পেতেন ও না। কারন সপ্তর আর একটা আইডেন্টিটি তো এই সুধাময়”
“মানে?”
“১৮৮৬ সালে লুইস স্টিভেনসন যেটা কল্পনা করে বই তে লিখেছিলেন সপ্ত সেটাকে বৈজ্ঞানিক ভাবে সত্যি প্রমান করেছিল। রাত তিনটের পর রোজ মিঃ হাইড আসেন সুধাময় রুপে, তবে কারোর ক্ষতি করার জন্য নয়। সপ্তকে কয়েক ঘণ্টা তার নিজের জীবনের দুঃখ থেকে ভোলানোর জন্য। পাঁচ ফুট আট ইঞ্চির বাহাত্তর কেজির সপ্ত হয়ে যায় এক বলিষ্ঠ ছয় ফুট চার ইঞ্চির অমানুষিক শক্তিশালী সুধাময়। যার একটা হাতের আঘাতে মানুষের ভাটিব্রা গুঁড়িয়ে যেতে পারে বা একটা ঘুষিতে মাথার খুলি ফেটে যায়। সে রোজ আসে, রাতের বেলা, যখন ওই ডিএনএ গুলোর মিউটেশন হয়ে যায়। ওই যে বললাম নেশা বা অ্যাডিকশন, সেই একটাই নেশা সপ্তর। কিন্তু রিসার্চটা অসমাপ্ত থেকে গিয়েছিল। সূর্যের আলট্রা ভায়োলেট রে-টা সহ্য হত না, ডিএনএ গুলোর আবার মিউটেশন হয়ে যেত, আর ডাঃ জেকিল রোজ ফিরে আসতেন দিনের বেলা। আর সপ্ত থেকে যায় সেই অসফল, সেই ব্যর্থ, একা একটা মানুষ। কিন্তু সপ্ত ছাড়া সুধাময়ের কোন অস্তিত্ব ই নেই, যাকে আপনি এখন দেখছেন সেও সপ্তসিন্ধু, ওই যে বললাম ‘ডুয়াল আইডেন্টিটি’। একমেবদ্বিতীয়ম”
আমি এখনো একটা ঘোরের মধ্যে রয়েছি, সব কটা কথা কানে ঢুকেছে, তবে কেমন যেন শরীরের ভেতর টা খালি হয়ে আসছে। কি করে সম্ভব? ইনিই সপ্তসিন্ধু, আবার ওষুধের নেশায় ইনিই হয়ে যান সুধাময়? আমি আবার শুনতে পেলাম ওনার গলা,
“এতো গুলো খুনের দায় নিয়ে সপ্ত আর বাঁচতে চায় না, অনেক গুলো স্লিপিং পিলস নেওয়া হয়ে গেছে। ওই যে বললাম আর বেশীক্ষন ও আর নেই। ডাক্তার টাক্তার বাজে কথা, আশা করি আপনি বুঝতে পেরেছেন এতোক্ষনে। এদিকে সূর্য উঠে গেছে, সূর্যের আলো ঘরে আসতে শুরু করেছে, সুধাময়েরও ডাক এসে গেছে, এবারে তাকে যেতে হবে। সুধাময় থেকে সপ্ত হবার সময় চেহারার পরিবর্তন টা দেখবেন না, সহ্য করতে পারবেন না, সে এক ভয়ংকর দৃশ্য। এখানে একটা খাম রাখা রইল, এতে কিছু টাকা রইল। জানতে চাইবেন না প্লিজ, কি করে এলো টাকা গুলো। আপনাকে টাকা সেদিন দেওয়া হয়নি, আপনার প্রয়োজন মত যেটা নেবার নিয়ে বাকিটা তেজবাহাদুর আর নারায়নের পরিবার কে দিয়ে দেবেন। খুব ভালো ছেলে ওরা, আমাদের এই মিথ্যে আর অসৎ মানুষে ভরা পৃথিবী যাদের বাঁচতে দিলো না। তবে জানেন একটাই সান্ত্বনা, চলে যাবার আগে আপনার মতো একজন ভালো মানুষের সঙ্গে পরিচয় হল। আগে পরিচয় হলে এতো তাড়াতাড়ি বোধহয় উপসংহার টা লিখতে হতো না। যাক একজন কে তো পেলাম গল্পটা শোনানোর, আপনাকেই শোনালাম। আপনার হাত টা খুলে দিচ্ছি, বাকী বাঁধন টা আপনি নিজেই খুলতে পারবেন। আর একটা অনুরোধ, শেষ অনুরোধ বলতে পারেন, কাউকে কোনদিন বলবেন না এই সব কথা, কেউ বিশ্বাস করবে না, আর তারা ভাববে আপনি ও সপ্তসিন্ধু সেনের মতো একটা পাগল!”
সুধাময় আমার হাতের বাঁধন খুলে দিয়ে ভেতরের ঘরে চলে গেলেন। দরজাটা ভেজিয়ে দেওয়া হল। নিজেকে চেয়ার থেকে মুক্ত করতে আমার খানিক টা সময় লাগল, একে তো ভয় এবং বিস্ময় আমাকে কেমন যেন অথর্ব করে ফেলেছিল, তাছাড়া আমাকে বাঁধাও হয়েছিল বেশ কায়দা করে। তাও যতটা তাড়াতাড়ি করা সম্ভব ততটাই করে ভেজানো দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলাম। এই ঘরটায় বেশ আলো, একটা বড় খাট, আর তার ওপর একজন শুয়ে আছেন – চিনতে অসুবিধা হচ্ছে না তিন দিন আগে গুরুতর জখম অবস্থায় যাকে আমার কাছে নিয়ে আসা হয়েছিল। আমার করা সব কটা স্টিচ শরীর থেকে খুলে গেছে, তবে ক্ষত গুলো এখনো সারে নি। ঠিক যেমন টা দেখেছিলাম সেই অ্যাকসিডেন্টের রাতে। প্রশান্ত মুখে, প্রাণহীন শরীরে শুয়ে আছে সপ্তসিন্ধু সেন। এবারে চোখে পড়ল খাটের মাথার কাছে সাদা দেওয়ালে কালো কালিতে মোটা হরফে লেখা চারটে লাইন –
যে শাখায় ফুল ফোটে না, ফল ধরে না একেবারে,
তোমার ওই বাদল-বায়ে দিক জাগায়ে সেই শাখারে।
যা-কিছু জীর্ণ আমার, দীর্ণ আমার, জীবনহারা,
তাহারি স্তরে স্তরে পড়ুক ঝরে সুরের ধারা ।
পাশের ঘরে একটা আওয়াজ পেলাম, মনে হচ্ছে প্রসেনজিতদার জ্ঞান ফিরে এসেছে।
(পাঠকদের কাছে আমার একটাই অনুরোধ আপনাদের বিশ্বাস করানোর জন্য এই কাহিনি নয়, তবে আমার আঠারো বছরের কেরিয়ারে এই রকম ঘটনা কখনো হয়নি। )
Tags: উপসংহার, গল্প, তৃতীয় বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা, পার্থ সেন
দারুণ লাগল। Dual personality র ব্যাপার টা এত সুন্দর ভাবে সামনে এসে মুগ্ধ করলো। লেখককে আন্তরিক অভিনন্দন এত সুন্দর গল্প উপহার দেওয়ার জন্য।