উৎসব
লেখক: লেখক - এইচ পি লাভক্র্যাফট, বাংলা অনুবাদ - দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য
শিল্পী: সুপ্রিয় দাস
উৎসব
মূল কাহিনি – দ্য ফেস্টিভ্যাল
লেখক – এইচ পি লাভক্র্যাফট
বাংলা অনুবাদ – দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য
অলংকরণ – সুপ্রিয় দাস
শয়তানের কৌশলে, মানুষ অবাস্তবকেও বাস্তব বলে ভুল করে
—লাকট্যানশিয়াস
আমি তখন বাড়ি থেকে অনেক দূরে। পুবের সমুদ্রের জাদু তখন আমাকে ছেয়ে ছিল। সন্ধ্যার আলো-আঁধারিতে আমি পাথরের গায়ে তার ঢেউ ভাঙবার শব্দ পাচ্ছিলাম। টের পাচ্ছিলাম,টিলাটার ঠিক ওপাশে, যেখানে আঁকাবাঁকা উইলোর দল তারা জাগা আকাশের ক্যানভাসে তাদের অন্ধকার ডাল মেলে ধরেছে, সেইখানে সে আছে।
সমুদ্রের পাশ দিয়ে নির্জন পথ পাহাড়ের শরীর বেয়ে চূড়ার দিকে উঠে গেছে। হালকা বরফ জড়ানো সেই পথ ধরে আমি হেঁটে যাই। সামনে, অনেক উঁচুতে অরণ্যের আড়ালে উজ্জ্বল রোহিনী নিঃশব্দে চেয়ে থাকে প্রাচীন এক শহরের দিকে। সে-শহরকে এতকাল আমি স্বপ্নেই দেখেছি কেবল। আজ পিতৃপুরুষরা আমায় সে-শহরের পথে ডাক দিয়েছেন।
সে ছিল ইউলটাইডের তিথি। মানুষ তাকে ক্রিসমাস বলে ডাকে। যদিও চেতনার গভীরে তারা জানে, এ-তিথি বেথলেহেম, মেমফিস বা ব্যাবিলনের চাইতেও পুরোনো। এমনকি মানবসভ্যতার থেকেও অনেক বেশি প্রাচীন।
সে ছিল ইউলটাইডের তিথি। অবশেষে সেইদিন আমি এসে পৌঁছেছিলাম সমুদ্রতীরের প্রাচীন এই শহরে। আমার পূর্বপুরুষের বসতি ছিল এখানে। প্রাচীন যুগে, উৎসব যখন নিষিদ্ধ ছিল, তখনও এ-উৎসব তাঁরা পালন করেছেন। তাঁদের উত্তরসূরীদের আদেশ দিয়েছেন, প্রতি শতাব্দিতে একবার করে সে-উৎসব যেন পালন করা হয়। যেন তাঁদের আদিম, গোপন রহস্যকে ভুলে না যায় পৃথিবী।
খুবই পুরোনো জাতি আমরা। তিনশো বছর আগে এই ভুখণ্ডকে দখল করতে আসা সভ্য দুনিয়াও আমার পূর্বপুরুষদের প্রাচীন জনগোষ্ঠী হিসেবেই চিহ্নিত করেছিল। বিচিত্র মানুষ ছিল তারা। আফিমের ঘোর লাগা দক্ষিণের কোন বুনো এলাকা থেকে সমুদ্র উজিয়ে তাদের এই দেশে আসা। কতকাল আগে, তা কেউ জানে না। স্থানীয় জেলেদের ভাষা শিখে নেবার আগে তাদের ভাষাও কেউ বুঝত না।
আর এখন, এই শহরের গণ্ডী পেরিয়ে তারা ছড়িয়ে গেছে দূর-দূরান্তরে। শেকড় ছড়িয়েছে নতুন নতুন মাটিতে। একেক জায়গায় তাদের একেক ভাষা,একেক চালচলন। কয়েকটা পুরোনো রীতিরেওয়াজ বাদে পুরোনো শেকড়ের আর কোন চিহ্ন বাকি নেই তাদের এই দুনিয়াজোড়া বংশধরদের মধ্যে। তবে সেইসব অবশিষ্ট রীতিরেওয়াজও তারা যন্ত্রের মত মেনে চলে শুধু। তাদের অর্থ সময়ের গভীরে হারিয়ে গেছে।
তাদের মধ্যে একমাত্র আমিই ফিরে এসেছিলাম সে-রাত্রে। এক শতাব্দি বাদে। উপকথার আদেশ মেনে। ইউলটাইডের উৎসব পালনের জন্য। একমাত্র আমিই ভুলিনি। কারণ একাকি দরিদ্র মানুষ তার অতীতকে ভোলে না।
***
দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে অবশেষে পাহাড়চূড়ার অন্যধারে কুয়াশাঘেরা কিংসপোর্ট চোখে পড়ল আমার। তুষারঝরা কিংসপোর্ট! তার প্রাচীন মিনার, দো-চালা ছাদ, চিমনি, তার জেটি, ছোটো ছোটো ব্রিজ, গোরস্থান আর উইলোর দল, তার আঁকাবাঁকা রাস্তাঘাটের অন্তহীন গোলকধাঁধা, আর এদের সবার মাঝখানে টিলার মাথায় একটা অতিকায়, সফেদ মন্দির। সময় সে মন্দিরকে স্পর্শ করে না।
পাহাড়ের ঢাল জুড়ে গোটা বসতিটা জুড়ে পুরোনোকালের কলোনিয়াল ঘরবাড়ি এলোমেলো ছড়িয়ে আছে। যেন শিশুর খেলাঘরে এলোমেলো ছড়িয়ে থাকা বিল্ডিং ব্লকের দল। তাদের জানালায় তখন একে একে আলো জ্বলে উঠছিল। আকাশে সদ্যফোটা কালপুরুষ আর তার সঙ্গীসাথীদের ভিড়ে মিশে যাচ্ছিল জানালার আলোকবিন্দুগুলো। পুরোনোকালের শহরে সন্ধ্যা নামছে। তার জেটির পচা কাঠামোর গায়ে অবিরত ঘা দিচ্ছিল আলো-আঁধারি অন্ধকার সমুদ্রের ঢেউ।
সমুদ্র! স্মরণাতীত কালের সেই জলরাশির বুক থেকেই দূর অতীতে আমার পূর্বপুরুষরা উঠে এসেছিলেন এই উপকূলের বুকে।
রাস্তাটা যেখানে পাহাড়ের চূড়া ছুঁয়েছে,তার ঠিক পাশেই আর এক পাহাড়ের ঢাল উঠে গেছে আরো উঁচুর দিকে। তার অন্ধকার তুষারের বুকে মৃত দৈত্যের নখের মত জেগে ছিল কালো পাথরের অজস্র সমাধিপাথর। তাদের ফাঁকে ফাঁকে ঝোড়ো হাওয়ার শনশন।
হাওয়ার গোঙানিকে ছাপিয়ে মাঝেমাঝেই কানে আসছিল অদৃশ্য কোন ফাঁসিকাঠের ক্যাঁচকোঁচ আওয়াজ। ১৬৯২তে আমার চারজন আত্মীয়কে ফাঁসি দিয়েছিল ওরা ডাকিনিবিদ্যা চর্চার অভিযোগে। তবে সেই ফাঁসির মঞ্চটা ঠিক কোথায় ছিল আমি জানি না।
পাহাড়ের চুড়া ছুঁয়ে উৎরাইয়ের পথে পা রাখলাম আমি এবার। এখান থেকে পাকদণ্ডি পথ নেমে গেছে সমুদ্রের দিকে। এগিয়ে আসছিল জনবসতি। অথচ প্রাক-ক্রিসমাসের আনন্দস্ফূর্তির কোন গুঞ্জন ভেসে আসছিল না সেই জনবসতি থেকে। আমি নিজের অজান্তেই কখন যেন কান পেতেছিলাম, অভ্যস্ত সেই গুঞ্জন শোনবার আশায়। কিন্তু আশ্চর্য সেই নৈঃশব্দ্যকে ভেঙে দিয়ে তখন একটা হাসির শব্দও উঠে আসছিল না বাড়িগুলো থেকে। তাদের আলোকিত জানালার দল স্থিরহয়েনিঃশব্দে পথের দিকে তাকিয়েছিল।
তাদের মধ্যে দিয়ে হাঁটতে হাঁটতেই ভাবছিলাম, হয়ত এখানকার উৎসব পালনের নিয়মকানুন আলাদা। হয়ত এ-শহরের বাসিন্দারা নিঃশব্দ প্রার্থনায় কাটিয়ে দেয় পবিত্র সময়টা।
শহরে ঢুকে একটা বাজার। সেখানে মানুষজন নেই কোনো। জনহীন দোকানপাটের ভাঙা জানালা-দরজা বেয়ে গোঙানির মত সুর তুলে বয়ে যাচ্ছিল সমুদ্রের বাতাস। তার সরুসরু গলিগুলোর দু-ধারের দেয়ালে পিলারওয়ালা সার সার দরজা আর পর্দাঘেরা ছোটোছোটো জানালা।পর্দা চুঁইয়ে থেকে চুঁইয়ে আসা আলোয় দরজার গায়ের উদ্ভট চেহারার ঘন্টিগুলো একেকবার চিকমিকিয়ে উঠছিল। ভাঙাচোরা রাস্তার বুকেও ইতিউতি সে আলোর ঝলকানি।
শহরটার ম্যাপ আমি আগে দেখেছি। ফলে, আমাদের আদি বসতবাড়িটার ঠিকানা আমার জানাই ছিল। শুনেছিলাম,একবার সেখানে গিয়ে পৌঁছোলে আদরযত্নের অভাব হবে না।
বাজার পেরিয়ে আমি তার পেছনদিকের একটা গলি ধরলাম। বড়োবড়ো পায়ে গলিটা পেরোতেই একটা গোল বাগান। বাগান পেরিয়ে শহরের একমাত্র বাঁধানো রাস্তার পাতলা তুষার ছড়ানো পাথর মাড়িয়ে এগিয়ে গেলাম গ্রিন লেন-এর দিকে।
বুঝতে পারছিলাম যে-ম্যাপটা আমি দেখেছি সেটায় ভুলচুক বিশেষ নেই। ঠিকঠাকই যাচ্ছি আমি। তবে ওরা দু-একখানা খবর ভুল দিয়েছিল বইকি। বলেছিল রাস্তায় ট্রাম চলে। তেমন কোনকিছু চোখে পড়েনি আমার। অবশ্য বরফে ট্রামের লাইন চাপা পড়ে গিয়ে থাকতেই পারে। কিন্তু না। মাথার ওপর কোন তারের দেখাও পাইনি। অবশ্য তাতে আমার কোন আক্ষেপ ছিল না। পাহাড়ের মাথা থেকে জায়গাটাকে ভারী সুন্দর দেখাচ্ছিল খানিক আগে। হাঁটতে খারাপ লাগছিল না আমার।
গ্রিন লেন-এ ঢুকে বাড়ি গুণতে গুণতে এগোচ্ছিলাম আমি। বাঁয়ের দিকে সাত নম্বর বাড়িতে যাব আমি। শুনেছি তার ঢালু ছাদ। দোতলাটা খানিক সামনের দিকে এগোনো। ১৬৫০-এরও আগে তার জন্ম।
খুঁজে খুঁজে খানিক বাদে বাড়িটার সামনে এসে দেখি তার ভেতরে আলো জ্বলছে। জানালা দিয়ে ভেতরে উঁকি দিয়ে বুঝলাম জায়গাটাকে একেবারেই পুরোনোদিনের চেহারায় রেখে দেয়া হয়েছে। বাড়ির সামনে ঘাস-গজানো রাস্তা। তার দোতলার অংশটা সে-রাস্তার ওপর বেশ খানিকটা এগিয়ে এসে উল্টোদিকের বাড়ির দোতলার গায়ে গায়ে ঠেকে আছে প্রায়। তার নীচে দাঁড়িয়ে মনে হচ্ছিল যেন একটা সুড়ঙ্গে ঢুকে পড়েছি আমি। একফোঁটাও বরফ ছিল না সেখানটায় রাস্তার গায়ে।
রাস্তার পাশে কোনো ফুটপাথের চলন নেই এখানে। পথের ধার থেকে রেলিং দেয়া কয়েকধাপ সিঁড়ি সটান উঠে যায় বাড়িগুলোর সদর দরজার সামনে। কায়দাটা আমার কাছে নতুন। আগে দেখিনি কোথাও। একটু অদ্ভুত হলেও, দেখতে ভালোই লাগছিল। তবে রাস্তার বরফে লোকজনের হাঁটাচলার ছাপ থাকলে, কিংবা কয়েকটা জানালার পর্দা তোলা থাকলে বোধ হয় চোখের আরো একটু বেশি আরাম হত।
পুরোনো শহরটার দমচাপা নিস্তব্ধতা, তার অজানা নিয়মকানুন,বরফঝরা একটা ঠাণ্ডা সন্ধে, আমার অজানা অতীত এই সবকিছু মিলিয়ে বুকের ভেতর একটা ঘন অস্বস্তি গড়ে উঠছিল। দরজার উদ্ভট গড়নের ঘন্টিটা বাজাতে গিয়ে মনে হল যেন ভয় পাচ্ছি। আর তারপর, ঘন্টির জবাবে বাড়ির ভেতর থেকে সাড়া জাগতে ভয়টা আরো চেপে বসল মনে। কারণ, দরজা খোলবার শব্দটা হবার আগে আমি কোন পায়ের শব্দ পাইনি তার ভেতর থেকে।
তবে ভয়টা কেটে যেতে দেরি হল না। দরজা খুললেন একজন বয়স্ক মানুষ। গায়ে গাউন। পায়ে স্লিপার। মুখখানা প্রশান্ত। চোখাচোখি হতে তিনি ইশারায় দেখালেন যে তিনি বোবা। তারপর হাতে ধরা একটা মোমের পাটার গায়ে একটা স্টাইলাস দিয়ে লিখলেন, “স্বাগতম”।
তাঁর পিছুপিছু একটা নিচুমত ঘরে এসে ঢুকলাম। ঘরে মোমবাতির আলোয় ছাদের অতিকায় কড়িকাঠগুলোকে ভূতুড়ে দেখাচ্ছিল। সেখানে ইতিউতি সতেরো শতকের কিছু গদিছাড়া শক্তপোক্ত আসবাব ছড়ানো। অতীত সেখানে জীবন্ত হয়ে আছে। ঘরের একপাশে একটা বিরাট ফায়ার প্লেস। তার সামনে, আমার দিকে পেছন করে এক বৃদ্ধা বসে, এই উৎসবের মরসুমেও একমনে চরকায় সুতো কেটে যাচ্ছিলেন। তাঁর গায়ে একটা র্যাপার জড়ানো। মাথার বনেটটার আড়ালে তাঁর মুখ দেখা যায় না।
জায়গাটা কেমন যেন ভেজা ভেজা। স্যাঁতসেঁতে। ফায়ার প্লেসে আগুন ছিল না। বাঁয়ের দিকে একটা উঁচু সোফা।পর্দাঘেরা জানালার দিকে মুখ করে বসানো। মনে হচ্ছিল সেই সোফাতে কেউ বসে আছেন। তবে এ-ধার থেকে তাঁকে দেখা যাচ্ছিল না।
সেখানে দাঁড়িয়ে খানিকক্ষণ আগের ভয়টা আমার ফিরে আসছিল ফের। লোকটার শান্ত মুখটার দিকে যত দেখছিলাম ততই সেটাকে ঠিক শান্ত নয়,যেন হিমশীতল ঠেকছিল আমার। তাঁর চোখদুটো একদম স্থির। মুখের মোমের মত মসৃণ আর ফ্যাকাশে চামড়ায় রক্তের কোন আভা নেই। খানিক বাদে আমার মনে হতে শুরু করল ওটা মুখ নয়,কোন শয়তান কারিগরের সৃষ্টি একটা মুখোশ।
হঠাৎ আমার দিকে ফের ঘুরে দাঁড়ালেন তিনি। থলথলে হাতে মোমের পাটাটায় লিখলেন,উৎসবের জায়গায় যাবার আগে সেখানে একটুক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে আমায়।
লেখা শেষ করে ঘরের একপাশে একটা বইভর্তি টেবিল আর তার সামনে রাখা একটা চেয়ারের দিকে ইশারা করে দেখিয়ে মানুষটা চলে গেলেন। চেয়ারে গিয়ে বসে বইগুলো নেড়েচেড়ে দেখতে গিয়ে একটু চমকে উঠেছিলাম আমি। পুরোনোকালের বই সেগুলো। ছাতাধরা।স্যাঁতসেঁতে। মরিস্টারের “বিজ্ঞানের আদিম বিস্ময়”, ১৬৮১তে প্রকাশিত জোসেফ গ্ল্যানভিলের ভয়জাগানো “সাদুসিসমাস ট্রায়ামফেটাস”,১৫৯৫ সালে লিওঁ-তে ছাপানো রেমিজিয়াসের “ডেমনোলাট্রিয়া” আরঅলাস ওরমিনাসের নিষিদ্ধ লাতিন অনুবাদে উন্মাদ আরব আল হাজরাদ-এর অস্পৃশ্য বই “নেক্রোনমিকন”। এই শেষের বইটা আমি আগে কখনো চোখে দেখিনি,তবে তার ব্যাপারে অনেক ভয়ানক কথা শুনেছি চোরাগোপ্তা আলোচনায়।
কেউ কোন কথা বলছিল না আমার সঙ্গে। কানে আসছিল শুধু বাইরে ছুটন্ত হাওয়া শোঁ শোঁ শব্দ, আর বুড়ির চরকার মৃদু,অনিঃশেষ ঘরঘর। হয়ত এটাই এখানকার স্বাভাবিক পরিবেশ, এই ভেবে নিজেকে সান্ত্বনা দিলাম আমি। তারপর বইগুলোতে একটু আধটু চোখ বুলিয়ে সময় কাটাবার দিকে মন দিলাম।
নেক্রোনমিকন বইটার একটা উদ্ভট অধ্যায়ে একরকম মজেই গিয়েছিলাম আমি। ভয়াল একটা কল্পনা, কিন্তু চুম্বকের মত তা টেনে রাখে তা পাঠককে। পড়তে পড়তেই খেয়াল হয়েছিল,সোফার সামনের একটা জানালা প্রায় নিঃশব্দে বন্ধ হয়ে গেল। যেন কেউ তা একটুক্ষণের জন্য খুলেছিল আমার অলক্ষ্যে। প্রায় তার সঙ্গেসঙ্গেই একটা মৃদু ঘরঘর শব্দও উঠেছিল। কেমন যেন মনে হয়েছিল শব্দটা বুড়ির চরকা থেকে আসেনি। এসেছে জানালাটার কাছ থেকেই। তবে সন্দেহটা বিশেষ দানা বাঁধেনি আমার মনে,কারণ বুড়ির চরকা তখন ঘরঘর করে ঘুরেই চলেছে। আর সেইসঙ্গে যোগ দিয়েছে একটা পুরোনো ঘড়ির ঘন্টার আওয়াজ।
ওর পর শুধু মনে হয়েছিল,সোফাটায় আর কেউ বসে নেই। সেদিকে মনোযোগ না দিয়ে আমি তখন নেক্রোনমিকনের সেই অধ্যায়টায় ডুবে গেছি একেবারে।
খানিক বাদে বুড়োমানুষটা ফের ফিরে এল। পোশাক বদলে গেছে তখন তার। পুরোনো দিনের একটা ঢিলে জোব্বা গায়ে। পায়ে বুটজুতো। ঘরে এসেই সে সোফাটায় গিয়ে বসে পড়ল। আমার চেয়ার থেকে তাকে দেখা যাচ্ছিল না।
খানিক বাদে এগারোটার ঘন্টা পড়তে লোকটা সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। তারপর ঘরের একধারে রাখা একটা বিরাট আলমারি খুলে দুটো হুডওয়ালা আলখাল্লা বের করে নিয়ে এল। বৃদ্ধার চরকা তখন থেমে এসেছে। আলখাল্লার একটা নিজের গায়ে পরে অন্যটা সে জড়িয়ে দিল বৃদ্ধার শরীরে।
বৃদ্ধা একটু খোঁড়াচ্ছিলেন। তাঁকে দাঁড় করিয়ে রেখে মানুষটা আমার দিকে এগিয়ে এল। তারপর টেবিল থেকে নেক্রোনমিকন বইটাকে হাতে তুলে নিয়ে আমায় হাতের ইশারায় ডাক দিয়ে বাইরের দরজাটার দিকে এগিয়ে গেল।
আকাশে চাঁদ ছিল না। বরফঝরা অন্ধকার রাতে শহরের অলিগলি বেয়ে আমরা এগিয়ে যাচ্ছিলাম। আস্তে আস্তে শহরের বাড়িগুলোর জানালার আলো একটা একটা করে নিভে আসছিল। চারপাশের অন্ধকার দরজাগুলো থেকে বের হয়ে আসা, আলখাল্লায় ঢাকা মানুষের ঢল নামছিল রাস্তায়। তাদের মাথার ওপরে লুব্ধক তাকিয়েছিল পলকহীন চোখে।
আস্তে আস্তে মানুষের ঢলটা একসঙ্গে মিশে গিয়ে নিঃশব্দ,অন্ধকার জলস্রোতের মত এগিয়ে চলল খোলা মাঠঘাট,গির্জাঘর পেরিয়ে। তাদের হাতে ধরা লন্ঠনের আলোকবিন্দুগুলো যেন সেই অন্ধকার স্রোতের গায়ে জোনাকির মত দুলছিল। উঠছে,নামছে, এগিয়ে চলেছে যেন তারা কোন অদৃশ্য স্রোত বেয়ে। যেন কোন নেশাগ্রস্ত তারকামণ্ডল। মহাকাশ বেয়ে ছুটে চলেছে অনির্দেশ্য কোন মৃত্যুক্ষেত্রের দিকে।
সেই নিঃশব্দ জনস্রোতের মধ্যে আমিও আমার সঙ্গীর পেছনপেছন চলেছিলাম। মাঝেমাঝেই আমার গায়ে কোন তলতলে কনুইয়ের ছোঁয়া লাগছিল।কখনো শরীরে এসে ঠেকে যাচ্ছিল থকথকে কোন শরীর। কিন্তু তাদের কারো মুখে কোন কথা ছিল না। এমনকি নিঃশ্বাসের শব্দও ছিল না কোন। আস্তে আস্তে গোটা দলটা কোন প্রাচীন সরীসৃপের মতই উঁচু থেকে আরো উঁচুতে উঠে যাচ্ছিল পাহাড়ের গা বেয়ে। বুঝতে পারছিলাম,শহরের একেবারে মাঝখানে টিলার মাথায় দাঁড়ানো বিশাল সাদা মন্দিরটার দিকে চলেছি আমরা।
মন্দিরটার চারপাশে একটা পাথরবাঁধানো বড়োসড়ো চাতাল। ঝোড়ো বাতাস তার বুকে ক্রমাগত ঝরে পড়া তুষারকণাদের উড়িয়ে নিয়ে চলেছে কুয়াশার মত। তার চারপাশ ঘিরে ঢালু ছাদওয়ালা কয়েকটা বাড়ি। তার চত্বরের কবরগুলোর ওপরে আলেয়ার আলো দুলছিল। সে আলোয় কোনো ছায়া পড়ে না। মন্দিরচত্বর ছাড়িয়ে আর কোন লোকবসতি নেই। তার এপাশে শহরটা অন্ধকারে হারিয়ে গেছে। অন্যপাশে বহুদূরে পরিত্যক্ত বন্দরের ওপরে তারার আলো মিটমিট করে জ্বলছিল। মাঝেমাঝে একএকটা লন্ঠনের আলো শহরের গলিগুলো পার হয়ে দ্রুত এগিয়ে এসে আমাদের মিছিলটাকে ছাড়িয়ে এগিয়ে গিয়ে হারিয়ে যাচ্ছিল মন্দিরের ভেতরে।
সম্পূর্ণ মিছিলটা এগিয়ে এসে মন্দিরের ভেতরে ঢুকে যাওয়া অবধি আমি তার বাইরেই দাঁড়িয়ে রইলাম। বুড়ো মাঝেমাঝেই আমার হাত ধরে টানছিল, কিন্তু আমি ঠিকই করে নিয়েছিলাম যে মন্দিরের ভেতর আমি ঢুকব একেবারে সবার শেষে।
সবাই ঢুকে গেলে অবশেষে মোমের মত মুখওয়ালা বুড়ো আর চরকা বোনা বুড়ির পেছনপেছন আমি গিয়ে মন্দিরের ভেতরে ঢুকলাম। তার অন্ধকার গহ্বরে দুলন্ত লন্ঠনের আলোকবিন্দু ধরে রাখা মানুষের দল ভিড় করে আছে।
সেই ভিড়ে মিশে যেতে যেতে শেষবারের মত একবার বাইরের দিকে ফিরে তাকিয়েছিলাম আমি। সেখানে তারাদের মৃদু আলোয় চাতালের গায়ে লেগে থাকা তুষারের প্রলেপের ওপর কোন পায়ের ছাপ নেই। এমনকি আমার পায়ের ছাপও পড়েনি সেখানে।
লন্ঠনগুলোর আলো মন্দিরের ভেতরটাকে আলোকিত করতে পারেনি বিশেষ। কারণ তার ভেতরে ঢুকে আসা মানুষজনের বেশির ভাগই কোথাও অদৃশ্য হয়ে গেছে। দেবতার বেদির ঠিক সামনে একটা সমাধিকক্ষের অন্ধকার দরজা হাঁ করে ছিল। মানুষগুলো লন্ঠন হাতে নিঃশব্দে এগিয়ে গিয়ে একে একে হারিয়ে যাচ্ছিল সেই অতিকায় দরজার ভেতরে। সেখান থেকে একটা পুরোনো সিঁড়ি এঁকেবেঁকে নেমে গেছে আলোহীন, স্যাঁৎসেঁতে সমাধিকক্ষের মেঝেতে। আমিও তাদের সঙ্গে নিঃশব্দে এগিয়ে গিয়ে সেই সিঁড়িতে পা রাখলাম।
মেঝের মাঝখানটায় গিয়ে মানুষের সারিটা ভারী অদ্ভুতভাবে হারিয়ে যাচ্ছিল। কাছে এসে নজরে পড়ল সেখানে একটা চওড়া ফাটল। তার মুখ থেকে সটান পাতালের দিকে নেমে গেছে পাক খাওয়া একটা সিঁড়ি।তার সারা শরীরে একটা ভেজা দুর্গন্ধ জড়ানো। মানুষের দীর্ঘ সারিটা সেই সিঁড়ি ধরে কোন প্রাচীন মহাসর্পের মতই নেমে যাচ্ছিল পাহাড়ের গভীরে। তাদের সঙ্গে চলতেচলতে নজরে আসছিল,আমায় ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে শ্যাওলাধরা পাথরের বড়ো বড়ো টুকরোর প্রাচীন,খসে পড়া গাঁথুনি।
বেশ কিছুক্ষণ এইভাবে নেমে চলবার পর খেয়াল করলাম,দেয়ালের চরিত্র হঠাৎ করেই বদলে গেছে। পাথরের টুকরোর গাঁথুনি দেখা যাচ্ছে না আর। তার বদলে পথ নেমে গেছে সরাসরি কঠিন পাথরের বুক ফুঁড়ে। আমায় ঘিরে নিঃশব্দে দাঁড়িয়েছিল পাহাড়েরসেই কঠিন পাথুরে শরীর। খেয়াল করছিলাম, এতগুলো মানুষের চলাচল তার শরীরে সামান্যতম শব্দও জাগিয়ে তুলছে না। উঠছে না কোন প্রতিধ্বনি।
আরো কিছুক্ষণ নামবার পর নজরে পড়ল, সিঁড়ির পাশে পাশে দেয়ালের গায়ে কিছু অন্ধকার গলিপথ এসে মিশেছে, হয়ত বা পাহাড়ের বুকে লুকোনো অজানা কোনো গুহাশ্রেণী থেকে উঠে এসে। আস্তে আস্তে আমাদের ঘিরে তাদের সংখ্যা বেড়ে উঠছিল। আর সেইসঙ্গে বেড়ে উঠছিল একটা অসহনীয় দুর্গন্ধ। বুঝতে পারছিলাম পাহাড়ের বুকের ভেতর দিয়ে পথ চলে আমরা কিংসপোর্টের তলা দিয়ে চলেছি।
অবশেষে একসময় পথচলা শেষ হয়ে এল আমাদের। সামনে কিছুদূরে,মৃদু আলোয় আবছা কোন জলরাশি ছলছল করছিল। সে জলাশয় কখনো সূর্যের মুখ দেখেনি। একটা অজানা আশঙ্কায় ছটফট করছিলাম আমি। বারবার আক্ষেপ হচ্ছিল, কেন এসেছি আমি এ-উৎসবে যোগ দিতে? কী প্রয়োজন ছিল পূর্বপুরুষের ডাকে সাড়া দিয়ে এই শহরের বুকে পা দেবার?
সিঁড়ির ধাপগুলো এইবার খানিক চওড়া হয়ে উঠছিল। কানে আসছিল কোন দুর্বল বাঁশির শিসের মত শব্দ। আর তারপর,একেবারে হঠাৎ করেই শেষ হয়ে গেল সিঁড়ির ধাপ। আমার সামনে ছড়িয়ে গেল ভূগর্ভের একটা বিরাট তটভূমি। তার পচে ওঠা কাদায় ছত্রাকের অরণ্য। সে অরণ্যের এখানে সেখানে মাঝেমাঝেই লাফ দিয়ে উঠছে সবজেটে আগুনের ঝলক। আর সেই আলোয় চোখে পড়ছিল, পাহাড়ের কোন অজানা কন্দর থেকে বয়ে এসে অন্ধকার একটা জলস্রোত ঝাঁপ দিয়ে পড়ছে ভূগর্ভের সেই অন্ধকার, আদিম সমুদ্রে।
আমার সঙ্গীর দল ততক্ষণে এগিয়ে গিয়ে সবজেটে আগুনের একটা স্তম্ভকে ঘিরে একটা অর্ধবৃত্ত বানিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে। ইউলটাইডের অনুষ্ঠান! শীতার্ত দিনগুলোর পরে বসন্তের প্রাগৈতিহাসিক আরাধনা! আলো, উষ্ণতা,চিরসবুজ আর সুরময় বসন্তের প্রার্থনা উৎসব! সবজেটে আলোর স্তম্ভটাকে পুজো করছিল তারা। একটা আলোহীন, বিশাল গর্তের মধ্যে দাঁড়িয়ে সমুদ্রের অন্ধকার জলে ছড়িয়ে দিচ্ছিল দুর্গন্ধ ছত্রাকের অঞ্জলি।
তাদের হাতে ধরা লন্ঠনের আলোকবৃত্তের বাইরে,অন্ধকারের মধ্যে গাঢ়তর অন্ধকারের স্তূপের মত অবয়বহীন কিছু একটা বসে ছিল। বাঁশির শব্দটা উঠে আসছিল সেই স্তূপটার কাছে থেকে। তার সুরের তালে তালে অন্ধকারের মধ্যে থেকে বারবারই জেগে উঠছিল কিছু ডানা ঝাপটাবার আওয়াজ। আর,সেই সবকিছুর মধ্যেই যেন নরক থেকে উঠে আসা সবুজাভ আলোর স্তম্ভটা বারবার ফুঁসে উঠছিল। তার শিখা মাথার ওপরের পাথরের স্তরের গায়ে জমিয়ে তুলছিল সবুজাভ অঙ্গারের আস্তরণ। সে-শিখায় কোন উত্তাপ ছিল না। ছিল মৃত্যুর শীতলতা।
আমায় সঙ্গে করে নিয়ে আসা বুড়ো এইবার আলোর স্তম্ভটার পাশের একটা জায়গার দিকে এগিয়ে গিয়ে মাথার ওপর তুলে ধরল সঙ্গে আনা নেক্রোনমিকন পুঁথিটাকে। প্রায় সঙ্গেসঙ্গেই গোটা দলটা হাঁটু গেড়ে বসে কপাল ঠেকাল পায়ের তলার কাদামাখা দুর্গন্ধ জমিতে। আমি নিজেও হাঁটু গেড়ে বসেছিলাম তাদের সঙ্গে। পিতৃপিতামহের এই উৎসবে অংশ নেবার জন্যই তো আমার এখানে আসা!
এবার বুড়োর ইশারায় অন্ধকার থেকে বাঁশির আওয়াজের জোর বেড়ে উঠল কিছুটা। বদলে গেল তার সুর। সে সুর এই পৃথিবীর নয়। অন্ধকার মহাকাশে জেগে থাকা কোন নক্ষত্রমণ্ডলের শীতল স্পর্শ ছিল তাতে। আমার ইচ্ছের বিরুদ্ধে, যেন জোর করে আমাদের মাথাগুলোকে শ্যাওলাজমা সেই মাটির বুকে আরো নামিয়ে ধরছিল সেই সুরের বাণীহীন আদেশ।
সেই অবস্থায় স্থির থেকেই খেয়াল করছিলাম অন্ধকারের ভেতর থেকে আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে কিছু ডানার শব্দ। তাদের স্পষ্টভাবে দেখা যায় না।স্পষ্টভাবে স্মৃতিতে ধরেও রাখা যায় না। কোন পরিচিত পাখি বা অন্য কোন প্রাণীর সঙ্গে কোন মিল নেই তাদের গড়ণের। পরিচিত জ্যামিতির কোন সংজ্ঞাতেই বাঁধা যায় না তাদের ভয়াল শরীরকে।
আস্তে আস্তে, হেলেদুলে এগিয়ে আসছিল তারা। কিছুটা তাদের হাঁসের মত পায়ে ভর দিয়ে,কিছুটা বাদুরের মত ডানার ধাক্কায়। আমাদের কাছে এগিয়ে আসতে আলখাল্লায় জড়ানো মানুষগুলো একে একে তাদের পিঠে সওয়ার হল। তারপর আস্তে আস্তে এগিয়ে গেল অন্ধকার সেই নদীর ধারে ধারে খুলে থাকা অজস্র গহ্বরের ভেতরে।
চরকা কাটা বুড়িও তাদের সঙ্গে উধাও হয়েছিল। মোমের মুখোশ পরা বুড়ো শুধু রয়ে গিয়েছিল আমার সঙ্গে। তার শত নির্দেশেও আমি ওই নরকের জীবগুলোর একটার পিঠে সওয়ার হতে রাজি হইনি।
খানিক বাদে উঠে দাঁড়িয়ে আমি খেয়াল করলাম বাঁশিওয়ালা অন্ধকার স্তূপটা কোথায় হারিয়ে গেছে। তার জায়গায় দুটো জন্তু শান্তভাবে দাঁড়িয়ে অপেক্ষায় রয়েছে আমাদের দিকে চোখ মেলে। বুড়োর হাতে তখন ফের উঠে এসেছে তার মোমের পাটা। তার গায়ে ধীরে ধীরে সে লিখে চলেছিল,এ উৎসবের প্রতিষ্ঠাতা আমারই পুর্বজরা। তাঁদের নির্দেশ ছিল, একদিন আমি ফিরে আসব এ-উৎসবের প্রাঙ্গনে,আর সেদিন উৎসবের গোপনতম অনুষ্ঠানগুলো উদযাপন করা হবে।
কথাগুলো লিখে একটুক্ষণ থেমে রইল সে। তারপর ফের একবার সচল হল তার কলম। মোমের পাটায় ফুটে উঠল একটা দাবিঃ উৎসবের সূচনার দিনটিতেও সে তাঁদের সহকারী ছিল।
লেখা শেষ করে সে নিজের পোশাকের ভেতর থেকে প্রমাণ হিসেবে বের করে আনল একটা প্রাচীন শিলমোহরের আংটি আর একটা ঘড়ি। ঘড়িটা দেখে আমি শিউরে উঠেছিলা। কারণ ওর ছবি আমি দেখেছি আমাদের বংশের প্রাচীন নথিতে। বহু পুরুষ আগে, ১৬৯৮ সালে ও ঘড়িকে কবর দেয়া হয়েছিল আমারই পূর্বপুরুষের মৃতদেহের সঙ্গে।
তারপর মানুষটা আস্তে আস্তে তার মাথার ঢাকনা সরিয়ে ফেলল। নিজের মোমের মত মুখের দিকে ইশারা করে দেখাল আমার বংশের চেহারার সঙ্গে তার গভীর মিল। সেদিকে চোখ ফেলে ফের একবার শিউরে উঠলাম আমি। কারণ মুখটা যে মোমের মুখোশ তা এইবার একেবারে পরিষ্কার বুঝতে পারছিলাম আমি।
ওদিকে অপেক্ষায় থাকা প্রাণীগুলো তখন অধৈর্য হয়ে উঠেছে। অধৈর্য হয়ে উঠেছে বুড়ো মানুষটাও। প্রাণীদুটোর একটা এইবার অন্ধকারের মধ্যে এগিয়ে যাবার চেষ্টা করতে বুড়ো এগিয়ে গিয়ে তাকে আটকাতে ছুটে গেল। আর সেই ঝাঁকুনিতে হঠাৎ তার মুখোশটা একটু সরে যেতে আমার চোখে পড়ল সেই মুখোশের আড়ালে কোন মাথা নেই।
আমি পাগলের মত এদিকওদিক তাকাচ্ছিলাম। দুঃস্বপ্নের সেই মুণ্ডহীন ধড়টা ওপরে ফিরে যাবার সিঁড়িটার সামনে আগলে দাঁড়িয়ে। তখন,নিরুপায় হয়ে একটা আতঙ্কের চিৎকার করে আমি ঝাঁপ দিলাম অন্ধকার নদীটার বুকে। প্রায় সঙ্গেসঙ্গেই পৃথিবীর গহ্বরের সেই পুতিগন্ধময় থকথকে রস আমাকে ভাসিয়ে নিয়ে গেল কোনো অজানা অন্ধকার তলদেশে,যেখানে আলোর প্রবেশ নিষেধ,যেখানে জীবনের অস্তিত্ব অর্থহীন।
***
হাসপাতালে আমায় বলা হয়েছিল, ভোরবেলা আমাকে অজ্ঞান অবস্থায় কিংসপোর্টের বন্দরের পাশে পাওয়া গিয়েছিল। তখন আমি বরফে জমে গিয়েছি প্রায়। তারা বলেছিল,আগের দিন রাতে অন্ধকারে শহরের দিকে না গিয়ে তার উল্টোদিকের ভুল পথ ধরেছিলাম আমি। ফলে আছড়ে পড়েছিলাম পাহাড়ের ওপর থেকে বন্দরের পাশের অগভীর জলে। সে-খবর তারা পেয়েছে বরফের ওপর আমার পায়ের ছাপ অনুসরণ করে।
আমি তাদের কিছু বলিনি। কারণ হাসপাতালের চওড়া জানালায় শহরটার অসংখ্য বাড়ির ছাদ দিনের আলোয় হাসছিল। তাদের সবই হালফ্যাশানের। তাদের মধ্যে সাকুল্যে গোটাপাঁচেক পুরোনো গড়নের ছাদ চোখে পড়ে। তাদের ফাঁকে ফাঁকে ছড়িয়ে যাওয়া বাঁধানো রাস্তায় ট্রাম আর মোটরগাড়ির শব্দ।
তারপর, যখন শুনলাম শহরের মাঝখানের পাহাড়ের মাথায় দাঁড়ানো প্রাচীন মন্দিরটার গা ঘেঁষে এই হাসপাতালটা দাঁড়িয়ে,তখন হঠাৎ ভয়ে উন্মাদ হয়ে উঠেছিলাম আমি। আর একটাও রাত সে হাসপাতালে না কাটাবার জন্য জেদ ধরেছিলাম।
তখন তারা আমায় চিকিৎসার জন্য আরখামের সেন্ট মেরির হাসপাতালে পাঠিয়ে দেয়। এখানে এসে আমার উপকারই হল অবশ্য। এখানকার ডাক্তারবাবুদের চিন্তাভাবনা অনেক উদার। আমার কথা শুনে তাঁরা খুব বেশি অবাক হলেন না। বরং মিসকাটনিক ইউনিভার্সিটির লাইব্রেরি থেকে আলহাজরাদ-এর নেক্রোনমিকনের একটা সংরক্ষিত কপি আমাকে আনিয়ে দেবার ব্যবস্থা করলেন। সাইকোসিস বা ওইরকম কিছু একটা কথা বারবারই বলছিলেন তাঁরা আমার বিষয়ে। নাকি কোনো দুঃস্বপ্ন দেখে আমার মনে গড়ে ওঠা এই ম্যানিয়াটা একেবারে ঝেরে পরিষ্কার করে দেবার জন্যই বইটা আমার হাতে তুলে দিয়েছেন তাঁরা।
বইটার সেই অধ্যায়টা ফের একবার বের করে পড়েছিলাম আমি। শিউরে উঠে দেখেছিলাম, তার প্রত্যেকটা কথা আমার আগে পড়া। আমার জানা। বরফে আমার পায়ের ছাপ যতই ভুল পথের দিকে দেখাক, আমি এ-বইকে এ-শহরের এক প্রাচীন বাড়িতে দেখেছি। সে-বাড়ির কথা আমি ভুলে যেতে চাই।
কী লেখা ছিল সেই অধ্যায়ে তা আমি লেখবার সাহস করব না। শুধু তার একটা অনুচ্ছেদের অনুবাদ এইখানে তুলে দিচ্ছি।
উন্মাদ আরব লিখছেন, “গভীরতম সেই গুহাদেশ সাধারণ মানুষের দেখবার জন্য নয়। তার অভিশপ্ত জমিতে এখনও মৃত অস্তিত্ত্বের দল বিচিত্র শরীর ধরে জেগে থাকে। মুণ্ডহীন এক শরীরের আশ্রয়ে সেখানে জেগে থাকে এক অশুভ চেতনা। ইবন স্কাকাবাও তাই বলে গেছেন, যে সমাধিক্ষেত্রে কোন ডাইনির দেহ নেই, কেবল সেই সমাধিক্ষেত্রই পবিত্র। যে শহরের সমস্ত ডাইনির শরীর ছাই হয়ে গেছে, একমাত্র সেখানেই কোন অশুভের অস্তিত্ব থাকে না। শয়তানের কাছে বিক্রি হয়ে যাওয়া আত্মা তার সমাধির মাটি ছেড়ে কখনো বিদায় নেয় না। তার শবের মেদমজ্জায় বেড়ে ওঠা কৃমিকীট ও শকুনদের আশ্রয় করে তারা টিঁকে থাকে চিরকাল।
তবু, সেই পচনের মধ্যে থেকে জীবন ফের ফনা তোলে। ডাইনির শবে পুষ্ট,তাদের আত্মার বাহন শকুন ও কৃমিকীটের দল ফের অতিকায় রূপ ধরে জেগে ওঠে। মাটির গভীরে সুড়ঙ্গসাম্রাজ্য গড়ে তোলে তারা, তারপর একসময় দু’পায়ে ভর করে বের হয়ে আসে—–“
Tags: অনুবাদ গল্প, উৎসব, এইচ পি লাভক্র্যাফট, তৃতীয় বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা, দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য, দ্য ফেস্টিভ্যাল, পূজাবার্ষিকী, সুপ্রিয় দাস
অসাধারন অনুবাদ