ঋকথ
লেখক: অঙ্কিতা
শিল্পী: দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য (চিত্রচোর)
ঋ গোলকের পঞ্চবিংশতি কক্ষে বসে ফাইবার কাঁচের স্বচ্ছ ছাতের মধ্যে দিয়ে রাতের তারা ভরা উজ্জ্বল আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিল। মাথার উপরের এই বিস্তীর্ণ দিগন্তের কোন এক কোনে অদৃশ্য প্রায় ওদের জন্মস্থান। মহাকাশ থেকে যাকে দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়। অপরূপ নীলচে সবুজ রঙ সেই গ্রহের। ঋ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তারা বিজ্ঞানের অগ্রগতি আর নিজেদের ভোগসুখ চরিতার্থ করার জন্য এত বিপুল পরিমাণ উদ্ভিদ ধ্বংস করে ফেলেছে যে এককালের নীলচে সবুজ সমৃদ্ধশালী গ্রহের গায়ে আজ কুষ্ঠের মত দগদগে লাল ঘা। মহাকাশ থেকে দেখেছিল ঋ। নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারেনি। এত ক্ষতি করে ফেলেছে তারা নিজেদের জন্মভূমির গ্রহে। দেড়শ দুশো কোটি বছর ধরে জীব বাস করছে তাদের গ্রহে, কোনদিন প্রকৃতি তাদের হাতে বিপন্ন হয়নি। কিন্তু আজ এই বুদ্ধিমান প্রাণীর জ্বালায় মাত্র কয়েক লক্ষ বছরেই গ্রহের প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হয়ে গেছে। বায়ুস্তরে ফুটো দেখা দিয়েছে। তাই দিয়ে সূর্যের ক্ষতিকর রশ্মিরা ঢুকে আঘাত হানছে গ্রহের বুকে। মরনব্যাধি ধরেছে তাদের গ্রহের। তাই তো বিজ্ঞানীরা এত কোটি কোটি অর্থ ব্যয় করে তাদেরকে পাঠিয়েছে এই গ্রহের বুকে। যদি এখান থেকে সংগ্রহ করা যায় জল। এখান থেকে নিয়ে যাওয়া যায় শ্বাসযোগ্য বাতাস। তাহলে হয়ত এখনো তাদের গ্রহটাকে বাঁচিয়ে তোলা সম্ভব হবে।
“ঋ, গ্রহপ্রধান বার্তা পাঠিয়েছেন।”
“ঠিক আছে আমি দেখে নিচ্ছি।” অসহিষ্ণুতা ফুটে উঠল ঋ-এর কণ্ঠস্বরে।
ঋ শ্রবণ-কথন যন্ত্রটি চালু করল। “আমি গ্রহপ্রধান নিক্স। শূন্যগ্রহের গোলক প্রধান ঋ-এর উদ্দেশ্যে আমার বার্তা।” সামান্য ক্ষণের বিরতির পরে গুরুগম্ভীর কণ্ঠস্বরটি বলে উঠল, “ আমাদের প্রধান যন্ত্র-মস্তিষ্ক জানিয়েছে যে তোমাদের শূন্যলঙ্ঘনসেতুটা সম্পূর্ণ রূপে প্রস্তুত। কিন্তু তোমাদের দিক থেকে আমরা এখন কেন কোন বার্তা পাচ্ছি না সেতু সম্বন্ধে? ঋ অনতিবিলম্বেই আমি সেতু চালু করতে চাই। তুমি আমাকে বার্তা প্রেরণ কর।”
ঋ আজ কয়েকদিন হল খুব চিন্তিত হয়ে পড়েছে। শূন্যলঙ্ঘন সেতু প্রস্তুত হয়ে গেছে গত হপ্তায়। বিজ্ঞানীরা সবাই অধৈর্য হয়ে উঠেছে। তাদের গ্রহ থেকেও ঘন ঘন বার্তা আসছে। কিন্তু ঋ কিছুতেই শুন্যলঙ্ঘনসেতু চালু করার নির্দেশ দিচ্ছিল না। আজ স্বয়ং গ্রহপ্রধান বার্তা পাঠিয়েছে। ঋ ভাবছিল কোনভাবে কি আরো কিছুদিন সেতু বন্ধ রাখা সম্ভব। কিন্তু সমস্ত বিজ্ঞানীরাই স্পষ্টই বলে দিয়েছে যে সেতু উন্মুক্ত করলে কোনরূপ ভয়ের কারণ নেই কারণ এই গ্রহে কিছু নেই। এক বিন্দুও প্রাণের সম্ভাবনা নেই।
ঋ গ্রহপ্রধানকে একটি বার্তা পাঠাল। “ হে নিক্স গ্রহপ্রধান, এখনো সম্পূর্ণ বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা নিরীক্ষা শেষ হয়নি। তার আগেই শূন্যলঙ্ঘন সেতু সক্রিয় করা উচিত নয়। এখানকার বস্তু-সামগ্রীও আমাদের গ্রহে প্রেরণ করাও উচিত নয়।”
মুহূর্তমধ্যে বার্তা এলো গ্রহপ্রধানের কাছ থেকে, “ঋ গোলোক প্রধান, আপনাদের বিগত সমস্ত বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার ফল স্বরূপ প্রধান যন্ত্র মস্তিষ্ক গত মাসেই জানিয়েছে যে ওই গ্রহটি শূন্য। ওখান থেকে কোনরূপ চিন্তাশীল প্রাণীর আক্রমণের কোনরূপ সম্ভাবনা নেই। চিন্তাশীল প্রাণী তো দূরের কথা ঐ গ্রহে কোনরূপ প্রাণের সঞ্চারই ঘটেনি এখনো পর্যন্ত। আপনি অহেতুক দুশ্চিন্তা করছেন। এত গুরুদায়িত্ব হয়ত আপনার প্রাচীন মস্তিষ্ক বহন করতে পারছে না। সেক্ষেত্রে আমি আপনাকে অনুরোধ করব দায়িত্ব পরবর্তী গোলোক প্রধানের হাতে অর্পণ করুন।”
ঋ ভয়ঙ্কর গম্ভীর হয়ে উঠল। নিক্স তাকে ভদ্র ভাষায় হুমকি দিল। সেতু না খুললে তারা জোর করে তাকে সরিয়ে এই কাজ করবে। কিন্তু ঋ যে এখনো বেশ কিছু সম্ভাবনা খুঁটিয়ে না দেখে কিছুতেই সেতু চালু করার নির্দেশ দিতে পারবে না।
ঋ কক্ষ থেকে বেরিয়ে এলো। তার মাথায় একটা চমৎকার পরিকল্পনা এসেছে। কিন্তু কার সাহায্য নেবে সে! কাকে বিশ্বাস করবে? গোলকের বিজ্ঞানীদের মধ্যে ছোটখাটো অসন্তোষের সূত্রপাত দেখা দিয়েছে গতকাল থেকেই। একবার শূন্যলঙ্ঘন সেতু সক্রিয় হয়ে গেলে তারা ফিরে যেতে পারবে নিজদের গ্রহে। এখানকার জল, বাতাস, বিশেষ বিশেষ খনিজ, মূল্যবান লাভা চারটি বিশেষভাবে প্রস্তুত শূন্যলঙ্ঘনসেতুর মাধ্যমে স্রোতের মত পৌঁছতে থাকবে তাদের গ্রহে। চারটি সেতুর মধ্যে দুটি প্রস্তুত হয়ে গেছে। আগে পরীক্ষামূলক ভাবে ওই দুটিকে চালানো হবে। এক সপ্তাহ ওই সেতুগুলি ঠিক ঠাক কাজ করলে তারা এখানকার যন্ত্র-মস্তিষ্ককে সমস্ত নির্দেশ দিয়ে ফিরে যাবে নিজেদের গ্রহে। তখন শুধুমাত্র যন্ত্ররা থাকবে এই শূন্যগ্রহের বুকে। তারাই সমস্ত কাজ সুচারুভাবে করে যাবে। সজীব প্রাণী যাতায়াতের জন্যেও বিশেষ ভাবে একটি শূন্যলঙ্ঘন সেতু তৈরি করা হয়েছে গোলকের মাঝখানে। ওরা চলে গেলে এক মাস বাদে অন্য বিজ্ঞানীরা আসবে। অন্য দুটো সেতু নির্মাণ করার জন্য। সেগুলো অত জটিল কাজ নয়। জটিল কাজ তারা সম্পন্ন করে ফেলেছে।
এখন নিজের গ্রহের ফিরে যাবার আকাঙ্ক্ষায় ব্যাকুল হয়ে উঠেছে সকলে। আরো কিছুদিন সেতু বন্ধ রাখার ক্ষেত্রে ঋ-এর নির্দেশ মানতে রাজি নয় প্রায় কেউই।
হঠাৎ ইকের কথা মনে পড়ল ঋ-এর। এই একজন যে ঋ-কে প্রায় অন্ধের মত বিশ্বাস করে। ইককেই বলতে হবে কথাটা। মনস্থির করে ঋ দ্রুত পায়ে দশম কক্ষের দিকে হাঁটা দিল।
(২)
ঋ কয়েদখানার ভেতর থেকে দুচোখ ভরে বাইরের দৃশ্য দেখছিল। আজ তিনদিন হয়ে গেছে শূন্যলঙ্ঘন সেতু চালু হয়ে গেছে। ঋ বাধা দিতে পারেনি। বিশেষ অধিকারবলের প্রয়োগ করে তাদের গ্রহপ্রধান নিক্স নিজেই কাজটি করিয়েছেন। ঋ-কে নিক্ষেপ করা হয়েছে কয়েদখানায়। ইকের বিরুদ্ধে কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তবে ওয়াম তাকে সন্দেহ করে জেনে দু একজন শুভাকাঙ্ক্ষী ছাড়া গোলকের বাকি বিজ্ঞানীরা ইকের সংস্পর্শ এরকম ত্যাগ করেছে।
প্রতিদিনই বিশাল উজ্জ্বল নক্ষত্রটা দিগন্ত রেখায় উঁকি দেওয়ার সাথেই সাথেই ঋ ঘুম থেকে উঠে পড়ে। এসে বসে ছোট ফাইবার কাঁচের জানালার কাছে। বাইরে দিগন্ত বিস্তৃত জলরাশি। তাতে বাতাসের ঘর্ষণে নিয়মিত ঢেউ উঠছে আর সেই ঢেউ বারে বারে আছড়ে পড়ছে বিস্তীর্ণ রুক্ষ পাথুরে জমিতে। মহাকাশ থেকে ঋ দেখেছিল এই নীলচে গ্রহটির গায়ে অজস্র বিন্দুবৎ লাল ফুটকি। নীল অংশ অবধারিতভাবে জল, আর লাল অংশটি সেই মহাসমুদ্র থেকে জেগে ওঠা ছোট ছোট পাথুরে পাহাড়, শুকনো ডাঙ্গা অঞ্চল। এই শুষ্ক ডাঙ্গা তৈরি হয়েছে কঠিন আগ্নেয়-শিলা দিয়ে। এখনো বিভিন্ন পাহাড়সদৃশ সক্রিয় আগ্নেয়গিরিরা লাভা উদ্গিরন করছে। সেই গরম লাভা সমুদ্রে পরে ক্রমাগত বাষ্প নির্গত হচ্ছে। ধোঁয়ার মেঘের মত বাষ্প গ্রাস করছে গ্রহটাকে। আবার তার থেকে জলকণা ঝরে পড়ছে মাটিতে। সে এক অদ্ভুত সুন্দর দৃশ্য। এই গ্রহের মাটিতে পা দেবার সাথে সাথে ঋ সেটা দেখেছে। দেখছে দূরে ঘন লালচে মেঘের মধ্যে বেগুনী বিদ্যুতের স্ফুরণ। গ্রহটা অদ্ভুতভাবে এখনো যেন শৈশবে অবস্থান করছে। অথচ গ্রহের বয়স কিছু কম নয়। ঋ-দের হিসাবে প্রায় দেড়শ কোটি। এখনো এই গ্রহ জলমগ্ন। ঋ অবাক হয়ে ভাবে যে দুর্লভ বস্তুর জন্য তাদের গ্রহে এত মারামারি যুদ্ধবিগ্রহ, সেই জিনিস ব্যবহারের করার জন্য কেউ নেই এই গ্রহে। এখানে তা অফুরন্ত। ঈশ্বরের এক আশ্চর্য লীলা এই প্রকৃতি। এই জলরাশি পূর্ন গ্রহ আবিষ্কৃত না হলে হয়ত আর কয়েক হাজার বছরের মধ্যেই তারা শেষ হয়ে যেত। অসংখ্য মূল্যবান জিনিসে পূর্ণ হলেও এই গ্রহটার নাম রাখা হয়েছে শূন্য। কারণ এখানে প্রাণের কোন চিহ্ন নেই। সত্যিই কি তাই? সত্যিই কি কোন চিহ্ন নেই প্রাণের?
“ইক কোথায় তুমি?” একটা রিন রিনে স্বর ইকের ঘুম ভাঙ্গাল।
ঘুম জড়ানো গলায় ইক কোনরকমে উচ্চারণ করল, “কে?”
“আমি সেয়াই বলছি তোমাকে এখুনি দরকার।”
“কোথায় তুমি?”
“আমি পঞ্চম গোলকের যান্ত্রিক কক্ষে আছি। এখানে আবার গোলযোগ দেখা দিয়েছে।”
“তার জন্য আমাকে ডাকছ কেন সেয়াই? আমি তো কোন যন্ত্রবিদ নই।”
অপর প্রান্তে কিছুক্ষণ নিস্তব্ধতার পর দ্বিধাগ্রস্ত স্বরে সেয়াই বলল, “ইক তুমি একবার এলে ভালো হয়।”
ইক পুরোপুরি জেগে উঠল, তিনদিনের মধ্যে এই প্রথম কেউ তার সাহায্য চাইছে তার যাওয়া উচিত।
“হ্যাঁ সেয়াই। আমি আসছি। কি গোলযোগ দেখা দিয়েছে এবারে?”
“সেই একই গোলযোগ। গোলোকের একটি কক্ষের বায়ু পরিশোধন যন্ত্রটা ঠিকঠাক কাজ করছে না।”
ইক একটু চিন্তিত হয়েই যান্ত্রিক কক্ষে ঢুকল। সেয়াই একটি ধাতব পট্টিকায় বসে কক্ষের ছাদের কাছাকাছি ভাসছিল। ইক-কে ঘরে ঢুকতে দেখে উঠে আসতে নির্দেশ দিল। ইক অন্য একটি পট্টিকা নিয়ে সেয়াই-এর কাছে উঠে গেল। সেয়াই তখন যন্ত্রের খারাপ হয়ে যাওয়া অংশটি বদলে দিচ্ছিল।
“এ কি তুমি এই কাজ করছ কেন?” ইক যারপরনাই অবাক হল। “যেকোনো যন্ত্র-দাসকে বললে তারাই তো করে দিত।”
“একই সাথে তাদের দিন-পুস্তিকায় কাজের বিবরণও উঠে যেত। আর তা গোলোকযন্ত্রমস্তিষ্কের মাধ্যমে পৌঁছে যেত আমাদের গ্রহের কাছে।”
সেটাই তো স্বাভাবিক, ইক ভুরু কোঁচকাল। “তাতে কি হয়েছে?”
“ঋ-কে বন্দী করার পরে আমাদের উপরে নির্দেশ দেয়া হয়েছিল যে আমরা যেন সমস্ত খবর ওয়ামের কাছে জমা দি।” সেয়াম যন্ত্রাংশটি লাগানো শেষ করে উপরের ঢাকনাটা বন্ধ করতে করতে ইকের দিকে তাকাল। “কতবার পঞ্চম গোলকের দ্বাবিংশ কক্ষের বায়ু পরিশোধক যন্ত্র খারাপ হয়েছে বলে তুমি জানো?”
“এই নিয়ে তিনবার।”
“না। এইবার নিয়ে পাঁচবার। আগের দুবারই আমি এসে যন্ত্রাংশ পরিবর্তন করেছি। ওয়ামের নির্দেশে।”
ইক ষড়যন্ত্রের আভাস পেল। “ওয়ামের নির্দেশে! ওয়াম এরকম নির্দেশ কেন দিচ্ছে?”
সেয়াই যান্ত্রিক কক্ষের মেঝেতে নামতে নামতে বলল, “কারণ ওয়াম এই তুচ্ছ ঘটনার জন্য সেতু বন্ধ করতে চায় না। তুমি জানো ইক আর মাত্র দুই দিন। প্রথম আর তৃতীয় গোলকের শূন্যলঙ্ঘন সেতু কাজ শুরু করে দিয়েছে। এই গ্রহের জল আর বাতাস প্রতি সেকেন্ডে গ্যালন গ্যালন চলে যাচ্ছে আমাদের গ্রহে। এখন শুধু দ্বিতীয় আর চতুর্থ গোলকের কাজ বাকি। তারপরেই আমরা ফিরতে পারব আমাদের গ্রহে। ওয়াম চাইছে না সেই ফেরাটা আর কোনভাবে পিছিয়ে যায়।”
সেয়াই কখন নেমে গেছে মাটিতে ইক খেয়ালও করেনি। সে তখনও ভাসমান পট্টিকায় বসে ছিল। সেয়াই ইকের হাত ধরে নামিয়ে আনল। “তুমি, তুমি আর কাউকে জানাওনি?”
“না ঠিক সাহস পাইনি। সবাই ওয়ামের নির্দেশে চলছে। তাই গোপনে তোমাকে ডাকলাম।”
“কিসের জন্য যন্ত্রটা বিকল হচ্ছে তা কি তুমি বুঝতে পেরেছ?”
“ইক, প্রথম তিনবারের পরে আমি ভেবেছিলাম যে কোন যন্ত্রাংশ খারাপ তা হয়ত যন্ত্র-দাসরা ঠিক ধরতে পারছে না। তাই আমি পুরো দ্বাবিংশ কক্ষের পুরো পরিশোধক যন্ত্রটাকেই বদলে আরেকটা যন্ত্র লাগাবার নির্দেশ দিয়েছিলাম। ওই কক্ষে নতুন পরিশোধক যন্ত্র লাগিয়ে পুরনোটাকে পঞ্চবিংশতি কক্ষে লাগিয়ে দিয়েছি। পঞ্চবিংশ কক্ষটি আকারে বড় হওয়ায় ওখানে পাঁচটি পরিশোধক যন্ত্র কাজ করে। তাই এই পুরনো যন্ত্রটা যদি সত্যি সত্যি খারাপও হয় তাহলে জরুরী অবস্থা তৈরি হবে না। কিন্তু অদ্ভুত ভাবে পঞ্চবিংশ কক্ষে লাগানোর পর থেকে যন্ত্রটা ঠিকঠাক কাজ করছে আর ওদিকে দ্বাবিংশ কক্ষের নতুন যন্ত্রটা আবার খারাপ হয়ে গেছে।”
“সে আবার কি?”
“হ্যাঁ ব্যাপারটা আমারও ভীষণ অদ্ভুত লেগেছিল। তাই আমি এবার যন্ত্রটাকে বাদ দিয়ে অন্যান্য জিনিসগুলো পরীক্ষা করছিলাম। তাতে আরো অদ্ভুত একটা রিপোর্ট পেলাম। আর শুধু অদ্ভুত নয় এই রিপোর্টটা একটা অসম্ভব জিনিস দেখাচ্ছে।
“অসম্ভব!” ইক হতবাক হয়ে তাকাল সেয়াই-এর দিকে।
“হ্যাঁ অসম্ভব। আমি পরশু গত একমাসের হিসাব বের করেছিলাম কম্পিউটার থেকে। প্রথম পনের দিনে পাঁচ থেকে দশজনের হিসাব দেখাচ্ছে যন্ত্রগণক।
“সবাই একসাথে ওই কক্ষে কাজ করতে গেছিল নাকি?”
“তারপরের পনেরো দিন সংখ্যাটা ধীরে ধীরে বাড়তে বাড়তে পঞ্চাশ জন হয়ে গেছে দেখলাম।”
“সে কি? এতো অসম্ভব ব্যাপার! আমাদের গোলকে লোকসংখ্যাই দশজন। এটা কি করে ঘটতে পারে সেয়াই?” উত্তেজনায় ধাতব মেঝেতে শব্দ তুলে পা ঠুকল ইক।
“ইক এই হিসাবটা পেয়ে আমিও হতভম্ব হয়ে গেছি। কক্ষের যন্ত্রগুলো নষ্ট হয়নি ওগুলো প্রতিবারে ভারাক্রান্ত হয়ে কাজ বন্ধ করে দিচ্ছিল।”
“কম্পিউটার হিসাবে কোন গণ্ডগোল হয়নি তো?”
“না। আমি ভালো করে দেখেছি। এছাড়াও আমি খারাপ হয়ে যাওয়া যন্ত্রগুলোকে আবার পরীক্ষা করেছি কালকে রাতে। ওগুলো ওই কক্ষে সত্যি সত্যি ভারাক্রান্ত হয়ে বন্ধ হচ্ছিল। এমনিতে ওগুলো দিব্বি চলছে।”
ইক কপাল কুঁচকে কিছুক্ষণ কি যেন ভাবল। “কি আছে ওই কক্ষে?”
“ওই কক্ষে কিছুই নেই। ওটা আমাদের স্নান কক্ষ। গত মাসে ওখানে একটি জলাধার গঠন করেছিলাম আমরা।”
“জলাধার!”
“হ্যাঁ। সাঁতার কাটব বলে।”
“এই ঘটনা কি তারপর থেকেই শুরু হয়েছে?”
“হ্যাঁ।”
ইক উত্তেজনায় বাতাসে ঘুষি মারল, “ঋ ঠিকই আন্দাজ করেছিল তাহলে। এই গ্রহের জল বাতাস এগুলো কখনই প্রাণহীন নয়।”
“সে কি ইক? এ তুমি কি বলছ?”
“আমাদেরকে এখুনি ওই কক্ষের জলের নমুনা পরীক্ষা করে দেখতে হবে সেয়াই। এই জন্যই ঋ সেতু খুলতে রাজী হচ্ছিল না। সেয়াই তুমি যেকোনভাবেই হোক প্রথম আর দ্বিতীয় সেতু বন্ধ করে দাও। এই মুহূর্তে। কোনমতেই এই গ্রহের জল বাতাসকে আমাদের গ্রহে পাঠানো যাবে না।”
“কিন্তু তা কি করে সম্ভব ইক? ওয়াম কিছুতেই মত দেবেনা।”
“ওয়ামকে জানানোর কোন প্রয়োজন নেই। তুমি কৃত্রিমভাবে ভারাক্রান্ত করে দাও সেতুসক্রিয় যন্ত্রগুলোকে তাহলে ওগুলো আপনা হতেই বন্ধ হয়ে যাবে। আর একবার বন্ধ হলে আবার চালু হতে ওদের কমপক্ষে পাঁচ ছয়দিন লেগে যাবে। তার মধ্যে কোন একটা পথ আমরা ঠিক খুঁজে বার করে ফেলব।”
“কিন্তু ইক…”
সেয়াইকে দ্রুত থামিয়ে দিল ইক, “প্রকৃতির দিব্যি সেয়াই। তুমি কি কিছুই বুঝতে পারছ না? আমরা হয়ত এতক্ষণে আমাদের গ্রহের মৃত্যু পরোয়ানায় সাক্ষর করে ফেলেছি। যে করেই হোক সেতুগুলোকে বন্ধ কর সেয়াই।”
সেয়াইকে যান্ত্রিক কক্ষে রেখে ইক ছুটে গেল দ্বাবিংশ কক্ষের দিকে। কক্ষের দরজার সামনে ওয়াম দুটো যন্ত্র-দাসের সাথে দাঁড়িয়ে আছে। ইক-কে দেখে তারা দরজা আগলে দাঁড়ালো।
ইককে দেখে ওয়াম বিরক্ত মুখে এগিয়ে এলো। “এখানে কি করছ ইক?” ইক বুঝল ওয়াম কিছু একটা সন্দেহ করেছে।
“আমি স্নান করতে যাব।” ইক ভালোমানুষের মত মুখ করল।
“না ইক কিছুক্ষণ আগে স্নান-কক্ষে দুজন অসুস্থ হয়ে পড়েছে। আমি স্নান-কক্ষকে বিশেষ কারণে বন্ধ রেখেছি। সবাইকেই এই মর্মে বার্তা দেয়া হবে। তুমি নিজের ঘরে যাও।”
বাধ্যের মত ইক নিজের কক্ষের দিকে হাঁটাতে শুরু করল।
(৩)
গোটা একটা দিন তদন্তের পরে ইক কিছু অদ্ভুত জিনিস আবিষ্কার করল। স্নান-কক্ষের হাওয়ায় দূষিত বাতাসের মাত্রা বেড়ে যাওয়ার একমাত্র কারণ স্নান-কক্ষের মধ্যেই এমন কিছু একটা আছে যা ওই ঘরের শ্বাসযোগ্য হাওয়াকে নষ্ট করে দিচ্ছে। কিন্তু প্রথমে বাতাসে সেরকম কিছুর সন্ধান পেল না ইক। কক্ষে আর কি আছে সেটা খুঁজতে গিয়ে ইক দেখল জলাধারে জলের রংটা অদ্ভুত রকমে। ইক এর আগেও স্নান-কক্ষে এসেছে কিন্তু জলাধারের জলের রং এমন দেখেনি। ইক সেয়াইকে জিজ্ঞেস করতে সেও বলল কিছুদিন আগেও জলের এরকম রং ছিল না। তারপর বেশ কিছুদিন কেউ আর বিশেষভাবে খেয়াল করেনি। এখন ইক দেখছে জলের রং ফ্যাকাসে নীলচে সবুজ। সেই জলের স্যাম্পল পরীক্ষা করে দেখতেই ইক এক অদ্ভুত জৈবের সন্ধান পেল। একটা এককোষী প্রাণী। যেটা শ্বাসযোগ্য বাতাসকে ক্রমশ দূষিত বাতাসে পরিবর্তন করে দিচ্ছে।
সেদিন ওয়াম ইকের সাথে কথোপকথনের কিছু পরেই খবর পান যে শূন্যলঙ্ঘন সেতুগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। সেটা ঋ-এরই কোন চাল ভেবে ওয়াম প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। সবাইকে ডেকে পাঠানো হয় সভাকক্ষে। সবাই সভাকক্ষে গেলে ইক বাইরে থেকে কক্ষের দরজা সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করে দেয়। তারপর প্রধান যন্ত্র-মস্তিষ্কটিকে ভাইরাস পাঠিয়ে ভারাক্রান্ত করে তোলে। যন্ত্র-মস্তিষ্কটি কাজ করা বন্ধ করে দেয়। এর ফলে গোলকের কোন অংশেই আর যন্ত্র-মস্তিষ্কের নির্দেশে কাজ করানো সম্ভব হবে না। খুলবে না নিয়ন্ত্রণ কক্ষের দরজা। কাজ করবে না কোন যন্ত্র-দাস। অন্তত: একঘণ্টা লাগবে যন্ত্র-মস্তিষ্কের পুনরায় চালু হতে। ততক্ষণে গোলকের উপর কব্জা করে ফেলবে ইকেরা।
সেয়াই ইকের কথামত সেতু বন্ধের পরেই ঋ-কে কয়েদ থেকে উদ্ধার করে তারপর নিয়ন্ত্রণ কক্ষে নিয়ে আসে। যন্ত্র-মস্তিষ্ক ঠিক হতেই ঋ প্রথম বার্তা পাঠিয়েছিল গ্রহপ্রধান নিস্কের কাছে। বার্তার সাথে বারবার স্নান-কক্ষের বায়ু-পরিশোধন যন্ত্রের খারাপ হবার বিবরণও দিয়েছিল। নিষেধ করেছিল এই গ্রহ থেকে পাঠানো জল এবং বাতাস যেন ব্যাবহার না করা হয়। আজ একদিন হয়ে গেছে সেই বার্তার কোন উত্তর আসেনি।
ইকের কাছ থেকে সমস্ত কিছু জানার পরে ঋ সভা কক্ষের দরজা খুলে দিল। কক্ষে ছিল মোট পাঁচজন বিজ্ঞানী। ঋ আর ইক যখন সভা কক্ষে ঢুকল তখন ওয়াম ছাড়া বাকি সহ-বিজ্ঞানীদের দৃষ্টিতে ঘৃণা ঝরে পড়ছিল। আর ওয়ামের চোখে ছিল খুনের আকাঙ্ক্ষা। ঋ জানত এদেরকে বোঝাতে তার সময় লাগবে। তবু মানুষের শুভবুদ্ধির উপরে ভরসা করা ছাড়া উপায়ই বা কি থাকতে পারে মানুষের কাছে।
ঋ ঘরে ঢুকে সামান্য উঁচু ডায়াসটার উপরে দাঁড়াল, “আমার সহ-বিজ্ঞানীরা।” সবাই মুখ ফিরিয়ে বসে থাকল ছোট ঘরটায় ছন্নছাড়ার মত। কোনদিকে দৃকপাত না করে ঋ বলে চলল, “আমি গতকাল যা করেছি তার কোন ক্ষমা হয়না তা আমি জানি। কিন্তু আমি যা করেছি তা বৃহত্তর ভালোর জন্যে। আমি জানি দীর্ঘদিন এই প্রাণহীন শূন্যগ্রহে আটকে থাকতে থাকতে আপনারা সবাই উদগ্রীব হয়ে উঠেছিলেন আমাদের জন্মগ্রহে ফিরে যাবার জন্য। সেই আকুলতা থেকেই আমরা এমন একটা ভুল করে বসেছি যার জন্য হয়ত মহাকাল আমাদেরকে ক্ষমা করবে না।” কয়েকজন বিজ্ঞানী ভুরু কুঁচকে ফিরে তাকাল ঋ-এর দিকে। “আমরা সম্পূর্ণ গ্রহকে বিস্তারিত ভাবে পরীক্ষা না করেই এখানকার জল আর বাতাস আমাদের গ্রহে পাঠিয়ে দিয়েছি।”
“কিন্তু এখানকার জল কিংবা বায়ুমণ্ডলে কোন প্রাণের চিহ্ন তো নেই। আমাদের কোষ-পরীক্ষক যন্ত্র তা পরীক্ষা করে দেখেছে।”
“আপনি ঠিকই বলেছেন বিজ্ঞানী ফেয়া। আমাদের কোষ-পরীক্ষক যন্ত্র এই গ্রহে কোনরকম প্রাণের চিহ্ন পায়নি। কারণ এই যন্ত্র যে ধরনের কোষের পরীক্ষা করে থাকে সেই ধরনের কোষবিশিষ্ট কোন প্রাণী এই গ্রহে নেই।”
“আপনি ঠিক কি বলতে চাইছেন বিজ্ঞানী ঋ?”
“এই গ্রহে প্রাণ আছে। আর সে এমনই এক ধরনের প্রাণ যার কোষবৈশিষ্ট আমাদের প্রায় বিপরীত।”
“আপনি যে এইসব কথা বলছেন তার কি কোন প্রমাণ আছে বিজ্ঞানী?” ফেয়া উত্তেজিত কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করলেন।
“আছে বৈ কি। ইক তুমি ওনাদেরকে আমাদের গবেষণার ফলাফল দেখাও।”
ইক ফলাফলের বিবরণ দেখাতে লাগল, দেখা শেষ হলে ঋ গলা খাঁকারি দিয়ে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করল। “খুব প্রাথমিকভাবে বলি, আমাদের যে কোষের গঠন তাতে একটা খোলস আছে তারমধ্যে আছে একটা তরল আর তারমধ্যে আছে নিউক্লেই। আমরা মনে করি যেকোনো চরিত্রের সমস্ত বৈশিষ্ট্য লুকিয়ে আছে ঐ নিউক্লেইতেই। বিবর্তনের সাথে সাথে আমাদেরকে উন্নত করে তুলতে সাহায্য করেছে ঐ নিউক্লেই-এর মধ্যে থাকা ক্রোমোজোম আর ডিএনএ বন্ডিং আর জিন। এক সময় প্রায় দেড়শ দুশো কোটি বছর আগে আমাদের গ্রহে যখন প্রথম প্রাণ এসেছিল তখন হয়ত অনেকটা এই গ্রহের এখানকার এককোষীগুলোর মত দেখতে ছিল। কিন্তু আমাদের গ্রহের এককোষীদের গঠন দ্রুত পরিবর্তিত হয় আর খুব দ্রুতই তারা বিবর্তিত হয়। মাত্র দেড়শ কোটি বছরের মধ্যেই আজ আমরা উন্নত মস্তিষ্কের প্রাণীতে পরিণত হয়েছি। কিন্তু এই গ্রহের কোষগুলো একদমই উন্নত হতে পারেনি। এমনকি এদের কোন নিউক্লেই বলেও কিছু নেই। কোন ক্রোমোজোম বন্ডিং নেই। শুধু বলতে পারো তরলের মধ্যে একটা ডিএনএ সুতো ভাসছে। তাই আরো কোটি বছর ধরে বিবর্তিত হলেও এরা কখনোই হয়ত উন্নত জীব হতে পারবে না।”
“তাহলে এদেরকে নিয়ে চিন্তার কি আছে বিজ্ঞানী?” একজন ব্যাঙ্গাত্মক প্রশ্ন করল, যদিও উদ্বেগে তার গলা কেঁপে যেতে ব্যাঙ্গটা ঠিক বোঝা গেল না।
ঋ দৃঢ় স্বরে বলল, “চিন্তা আছে। কারণ এরা গত দেড়শ কোটি বছর ধরে এমন অদ্ভুত ভাবে বির্বতিত হয়েছে যা আমরা কখনো আমাদের গ্রহে দেখিনি। এই এককোষী প্রাণী এমন ধরনের যে তুমি তাদেরকে না জীব না জড় বলতে পারো। কিছু কিছু বিশেষ বিশেষ অবস্থায় এদের মধ্যে প্রাণের উন্মেষ ঘটে নয়ত অন্য সময় এরা জড় বস্তু। আর সবচেয়ে খারাপ ব্যাপার হল এরা আমাদের কোষের গঠনকে নষ্ট করে দিতে সক্ষম। তার মানে ঠিকঠাক আবহাওয়ায় এরা আমাদেরকে মেরে ফেলতে সক্ষম।”
ঘরের হাওয়ায় অস্বাভাবিক নিস্তব্ধতা নেমে এলো। কিছুক্ষণ পরে একজন বিজ্ঞানী মুখ খুললেন।
“আমরা আজ প্রায় ছয় মাসের উপরে এই গ্রহে আছি এতদিনে তো কিছু ঘটেনি আমাদের। কোন রোগ অসুখ বা অন্য কিছু।”
“আমিও এদের প্রকৃতি সম্পর্কে সম্পূর্ণভাবে জ্ঞাত নই। কিন্তু এই জীবগুলোর মধ্যেই একজাতের জীব স্নান-কক্ষের বাতাসকে দূষিত করে দিয়ে আমাদের দুজন বিজ্ঞানীকে মেরে ফেলার উপক্রম করেছিল।”
দীর্ঘ আলোচনা চলতে থাকল বিজ্ঞানীদের মধ্যে গবেষণার ফলাফলের উপরে। শেষ পর্যন্ত সবাই ঋ-এর কথায় রাজী হল যে কোনভাবেই এই গ্রহের জল বা বাতাস তাদের গ্রহে নিয়ে যাওয়া যাবে না। আলোচনার শেষ পর্বে ইক হঠাৎ লক্ষ্য করল ওয়াম কখন যেন সবার অগোচরে কক্ষ ত্যাগ করেছে। ইক ঋ-কে বলতেই ঋ শশব্যস্ত হয়ে ছুটে গেল দরজার দিকে। কিন্তু ওয়াম তাদেরকে সভা কক্ষে বন্দী করে ফেলেছে ততক্ষণে।
ঋ দ্রুত কথন যন্ত্রের মাধ্যমে সেয়াইকে খবর দেওয়ার চেষ্টা করল। সে আছে এখনো নিয়ন্ত্রণ কক্ষে। কিন্তু অনেক চেষ্টাতেও তার কোন উত্তর পাওয়া গেল না। ভাগ্যক্রমে ইকের কাছে একটা লেসার ছুরি ছিল। প্রায় এক ঘণ্টার চেষ্টায় সেটা দিয়ে দরজার খানিকটা অংশ কেটে তারা বাইরে বেড়িয়ে এলো।
সেয়াই-এর মৃতদেহটি নিয়ন্ত্রণ কক্ষেই পাওয়া গেল। ওয়ামকে ওরা পেল গোলকের মাঝখানের শূন্যলঙ্ঘন সেতুর কাছে। ঋ-দের দেখতে পেয়েই ওয়াম দ্রুত সেতুর মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল। ঋ-রা দেখল ওয়াম চলে যাওয়ার পরে সেতুটা আস্তে আস্তে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।
(৪)
দীর্ঘ একবছর বাদে গোলকে নয়জন বিজ্ঞানীর মধ্যে মাত্র দুইজন বিজ্ঞানী বেঁচে। ঋ আর ইক। ওয়াম গোলকের মাঝখানের শুন্যলঙ্ঘন সেতুটি বন্ধ করে দেওয়ার পরে ইক প্রথম আর দ্বিতীয় সেতু দুটির সমস্ত যন্ত্রকেই নষ্ট করে দিয়েছিল। যাতে করে এই গ্রহের বিষাক্ত জল আর বাতাস কোনভাবেই ওদের গ্রহে যেতে না পারে। কিন্তু তাতেও ভবিতব্যকে আটকাতে পারেনি কেউই। ওদের গ্রহ থেকে ক্রমান্বয়ে বার্তা আসতে থাকল বিভিন্ন অদ্ভুত রকমের মহামারীর। একে একে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছিল গ্রহের উদ্ভিদকুল। বিশাল বিশাল বনরাজি ধ্বংস হয়ে যাচ্ছিল কয়েকদিনের মধ্যেই। অনতিবিলম্বেই খাদ্যবস্তুর অভাবে শেষ হয়ে যেতে লাগল জনপদগুলি।
গত একবছর ধরে ইকেরা কয়েকজন গবেষণা করছে এই গ্রহের এককোষী প্রায়-প্রাণগুলোর উপরে। ঋ-এর নির্দেশ এই প্রায়-প্রাণদের দুর্বল কোষের গঠন পরিবর্তন করতে হবে। কোষগুলির মধ্যে নিজেদের কোষের নিউক্লেইটিকে ক্রোমোজোমের সুতোর গুলি সমেত স্থাপন করার চেষ্টা করে চলেছে তারা। শূন্যগ্রহের বুকে গোলকের বিজ্ঞানীরাও বিভিন্ন প্রকার রোগ অসুখের শিকার হচ্ছিলেন ধীরে ধীরে। তার মধ্যেও শেষ কাজ তারা চালিয়ে যাচ্ছিল। ঋ কখনোই তাদেরকে বলেনি কেন সে এই কাজটা করতে চাইছে। বিজ্ঞানীরা তার কাছে জানতে চাইলে সে শুধু একটা কথাই বলেছে মৃত্যু আশঙ্কায় মুহূর্ত গুনে গুনে একটি করে দিন কাটানোর চেয়ে ভালো নয় কি একটা কাজের মধ্যে নিজেকে ব্যস্ত রাখা। আমরা বিজ্ঞানী জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত আমরা বিজ্ঞানেরই সেবা করে যাব। কিছুক্ষণ থেমে প্রায় অস্ফুট স্বরে যোগ করেছিলেন, “আর প্রায়শ্চিত্তও তো করতে হবে আমাদেরকেই।”
সপ্তম বিজ্ঞানী ফেয়া মারা যাবার পরের দিনই তারা গবেষণায় কৃতকার্য হয়। কিন্তু তা দেখার জন্য ইক আর ঋ ছাড়া কেউই বেঁচে ছিল না। ঋ-এর পাগলামো দেখে ইকের মনে হয়েছিল দীর্ঘদিনের চিন্তাভাবনা আর মৃত্যু আশঙ্কায় সত্যিই বোধহয় ঋ-এর মাথা খারাপ হয়ে গেছে। নতুন এককোষী প্রাণীটাকে তারা গবেষণা কক্ষে একটি বাটি ভর্তি জলের মধ্যে রেখেছে। প্রাণীটা বেশ দ্রুতই তার বংশ বিস্তার করছে। ঋ তার উপরে আরো কিসব জটিল গবেষণা করছে ইক তা জানেনা। একটি পরিপূর্ণ কোষ সম্বলিত প্রাণীটা জন্ম নেবার পরেই ইক গবেষণা কক্ষ ত্যাগ করে নিয়ন্ত্রণ কক্ষে এসে আশ্রয় নিয়েছে।
এক সপ্তাহ হল ইক নিয়ন্ত্রণ কক্ষের মধ্যে একলা বসে আছে। এক সপ্তাহ আগে নিয়ন্ত্রণ কক্ষ আর গবেষণা কক্ষকে ঋ গোলকের বাইরে একটা রুক্ষ ভূখণ্ডের উপর স্থাপন করেছে। তারপর শূন্যলঙ্ঘন সেতু, যন্ত্র-দাস, যন্ত্র-মস্তিষ্ক, যন্ত্রগণক আর সাতজন বিজ্ঞানীর দেহ সমেত পরিপূর্ণ গোলকটাই ঋ বিস্ফোরণে নষ্ট করে রেণু রেণু করে ছড়িয়ে দিয়েছে। ইক বলেছিল, ওগুলো থেকে গেলেই কিই বা আসে যায়। কিন্তু ঋ তা মানেনি, অস্ফুট কণ্ঠস্বরে বলে উঠেছিল যদি প্রমাণ থেকে যায়। আজকাল ঋ-এর অনেক কথার মাথা মুণ্ডুই ইক বুঝতে পারেনা।
এই গ্রহের রোগজীবাণুরা যে ইককেও আক্রমণ করেছে তা ইক স্পষ্টই বুঝতে পারছে। ক্রমে ক্রমে সে নির্জীব হয়ে যাচ্ছে। আজকাল নিয়ন্ত্রণ কক্ষের বিশাল দূরবীনটায় চোখ রেখে নিজের গ্রহটাকেই দেখতে ভালো লাগে ইকের। তার গ্রহের গাঢ় সবুজ রং ফ্যাকাসে হয়ে এসেছে এই একবছরের মধ্যেই। এই জীবাণুগুলো খুব তাড়াতাড়িই শেষ করে দিল মহাবিশ্বের একমাত্র উন্নত মস্তিষ্কের প্রাণীদের। আরো হয়ত কয়েক শো বছর টিকে যেত তারা। তারমধ্যে হয়ত কোন একটা উপায়ও বার করে ফেলত কিন্তু এই অনুন্নত এককোষী প্রায়-প্রাণগুলো সমস্ত সম্ভাবনাকেই আমূল মুছে দিল। আক্রোশে মুঠো পাকাল ইক।
ঋ এসে দাঁড়াল ইকের পাশে। মৃদু স্বরে বলল, “কষ্ট হচ্ছে?”
ইক ঝটিতি ঘুরল ঋ-এর দিকে, “আপনার বুঝি আনন্দ হচ্ছে?”
“না ইক। আনন্দ নয় শান্তি পেয়েছি আমি।”
“শান্তি? আমাদের গ্রহ ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে ঋ। দেখুন আমাদের গ্রহের সবুজ অংশ ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। এরপরে নীলের ভাগ দ্রুত কমে যাবে।” ইকের গলা ধরে এলো।
“তারপরে লাল ধুলোয় ঢেকে যাবে সম্পূর্ণ গ্রহ। বায়ুমণ্ডল উধাও হয়ে যাবে দ্রুত। একসময় ভেঙে পড়বে সবচেয়ে কাছের উপগ্রহটি। নষ্ট হয়ে যাবে সম্পূর্ণ জীবকুল। মুঝে যাবে শেষ নীলের আভা। লাল গ্রহ হয়ে পড়ে থাকবে মহাকাশের কোলে আমাদের বাসস্থান।” শান্তস্বরে ঋ বলল।
ইক দুহাতে মুখ ঢেকে ফোঁপাতে থাকল, “এরপরেও আপনি শান্ত থাকেন কি করে ঋ? আমরা… এই মহাবিশ্বের একমাত্র উন্নত মস্তিষ্ক। আমরা শেষ হয়ে যাচ্ছি। আর কোন চিহ্ন থাকবে না আমাদের ঋ।”
“শান্ত হও ইক। গত একবছর ধরে তাহলে কি গবেষণা করলাম আমরা?”
ইক অবাক হয়ে তাকাল ঋ-এর দিকে, “কিসের গবেষণা?”
“ঐ যে এককোষী প্রাণী।”
“তাতে কি?”
“ইক আমি পরীক্ষা করে দেখেছি ওই প্রাণী দ্রুত বিবর্তনে সক্ষম। এই গ্রহের আবহাওয়া, জলবায়ু, ভূপ্রকৃতি যেভাবেই পরিবর্তিত হোক না কেন এই প্রাণী বিবর্তিত হতে থাকবে।”
“কিন্তু তাতে আমাদের কি আসে যায় ঋ?” অসহিষ্ণু হয়ে উঠল ইক।
“ওটা যে আমরাই ইক।” শান্ত স্বরে বলল ঋ।
“আমরা মানে?”
“আমাদের ডিএনএ আছে ওই কোষের মধ্যে। ওই ডিএনএ-এর মধ্যেই আছে জিন। আর এই জিনের মধ্যেই লুকিয়ে থাকে সব কিছু; আমাদের দুশো কোটি বছরের প্রাণের ইতিহাস, আমাদের স্বপ্ন , আমাদের চিন্তা ভাবনা। এই সবকিছুই লুকিয়ে থাকবে এই কোষের মধ্যে। একদিন বিবর্তনের ফলে ওই কোষ থেকে উৎপন্ন হবে উন্নত মস্তিষ্কের প্রাণী। আমাদেরই মত। আমাদের জানার আকাঙ্ক্ষার বীজ বপন করে দিয়েছি তাদের মধ্যে। তারাও এক এক করে আবিষ্কার করতে পারবে। যেতে পারবে গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে।”
ইক অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকল ঋ–এর দিকে, এই জন্যেই কি ঋ মরতে মরতেও এই গবেষণা চালাচ্ছিল। তারা নিজেদের বীজ বপন করে দিয়েছে এই প্রায়-প্রাণদের মধ্যে একটা পূর্ণ প্রাণী হিসাবে।
“ঋ বিবর্তন কতদিন সময় নেবে?”
ঋ হাসল, “সঠিক জানি না ইক। আমাদের এককোষ থেকে উন্নত মস্তিষ্কে বিবর্তিত হতে সময় লেগেছিল দেড়শ কোটি বছর। এদেরও হয়ত তাই লাগবে। দেড়শ দুশো কোটি বছর বাদে এই রুক্ষ গ্রহটা কত পরিবর্তিত হয়ে যাবে ভাবো তো! এই রুক্ষ আগ্নেয়শিলা ঢেকে যাবে উর্বর মাটি আর উদ্ভিদে। ঘুরে বেড়াবে উন্নত প্রাণীরা। তবে তখন আমরা আর থাকব না। আমাদের গ্রহ থেকে যাবে। লাল গ্রহ হিসাবে। শুধুমাত্র সৌরজগতে চতুর্থ গ্রহ হয়ে।”
Tags: অঙ্কিতা, ঋকথ, গল্প, দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য (চিত্রচোর), প্রথম বর্ষ প্রথম সংখ্যা