একটি উপন্যাসের প্লট – ইলিয়া ভারশাভস্কি
লেখক: ইলিয়া ভারশাভস্কি, বাংলা অনুবাদ - ঋতুপর্ণা চক্রবর্তী
শিল্পী: দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য্য (চিত্রচোর)
আমি খুব খুশি ছিলাম সেদিন। আমার মত এক লম্বা অসুস্থতা যে কাটিয়ে উঠবে সে আমার মানসিক অবস্থা পুরোপুরি বুঝতে পারবে। আমাকে যে আর প্রতিবন্ধী ভাতায় থাকতে হচ্ছে না, আমার অসুস্থতাজনিত ছুটি আরো লম্বা করা হয়েছে, তাতে আমি আমার অসুস্থতার আগে শুরু করা গবেষণাপত্র শেষ করার জন্য অঢেল সময় পাবো। ফলে আমি আমার স্যানেটেরিয়ামে থাকার সময়টা পুরোটাই আরাম করতে পারব, আমায় গবেষণা নিয়ে আর চিন্তা করতে হবে না। এই সব কারণেই আমি বেশ খুশি ছিলাম। তাছাড়া আমি ভারি আরামদায়ক একটা ডবল কোচ পেয়েছিলাম। আর আমার সহযাত্রীটিও খুবই ভদ্র একটি যুবক। আমার ভয় ছিল কোনো খামখেয়ালী মহিলা সহযাত্রী পাওয়ার, আমি নিশ্চিন্ত হলাম।
এক সুন্দরী নারী আমাকে বিদায় জানাতে এসেছিল, এঁকে আমি গভীরভাবে ভালোবাসি। যখন হাজার হাজার যাত্রীর দৃষ্টির সামনে দিয়ে সে আমার হাত ধরে আসছিল, আমি মুগ্ধ হয়ে গেছিলাম। সে আমার হাত ধরে ছিল, যেন সে ছোট্ট একটি মেয়ে, ভীড়ে বাবাকে হারিয়ে ফেলার ভয় পাচ্ছে।
“আপনি কি অনেক দূরে যাচ্ছেন?” আমার সহযাত্রীকে সে জিজ্ঞাসা করল।
“তা যাচ্ছি বটে, সেই কিসলোভস্ক অবধি।”
তাহলে তো খুবই ভালো, সারা রাস্তা আপনারা দুজনে গল্প করতে করতে যেতে পারবেন।“
এত আগ্রহ নিয়ে সে এইকথা বলল, আমি একটু অবাকই হলাম। অবশ্য তারপরই জানালো ” আসলে উনি এখনো সম্পুর্ণ সুস্থ নন, সেরে উঠছেন।”
“চিন্তা করবেন না আমি একজন প্রায় ডাক্তার।” আমার সহযাত্রী মুচকি হাসলেন।
“প্রায় বলতে কি বলতে চাইছেন? আপনি কি একজন ডাক্তারি ছাত্র?”
“একজন চিরন্তন ছাত্র ধরে নিতে পারেন, অবশ্য আমার একটি এম.ডি ডিগ্রি আছে।”
“উনি মনেহয় পি.এইচ.ডি করছেন” বিদায় চুম্বনের সাথে ফিসফিস করল সে, তারপর ট্রেন থেকে নেমে গেলো।
ট্রেন দিনের বেলায় ছাড়লে আমার বেশ ভালো লাগে। ধীরে ধীরে ট্রেনের ছন্দের সাথে মানিয়ে নেওয়া যায়। আমার সহযাত্রীকে নিজের জিনিসপত্র খুলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আরাম করে বসতে দেখতেও ভালো লাগল।
আমি সেদিন সত্যিই খুব খুশি ছিলাম, অন্তত আমার ধারণা তাই। সবকিছু আমার পছন্দমতো হচ্ছিল, তবে কেন জানি না একটা উতকন্ঠা আর অকারণ ছটফটানি আমার মধ্যে তৈরি হচ্ছিল। আমি আমার বসার যায়গা থেকে এক লাফে উঠে একবার করিডোরে যাচ্ছি, আবার পরমুহুর্তেই ফিরে আসছি, জিনিসপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করছি, পত্রিকাটত্রিকা পড়ার চেষ্টা করছি, আবার পরক্ষণেই পত্রিকা ছুঁড়ে ফেলে আবার করিডোরে ফিরে যাচ্ছি।
যাত্রীরা তাঁদের সবথেকে গোপন রহস্যও একদম অচেনা একজন সহযাত্রীকে বলে ফেলে প্রথম আলাপেই। হয়তো এটাই মানুষের স্বভাব। হয়তো প্রাচীনকালে কয়েকজন সহযাত্রী একসাথে কোনো বিপদজনক ঘটনার বিরুদ্ধে লড়েছে, তারপর তারা বন্ধু হয়ে গেছে। সেই থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে মানুষ এই স্বভাব পেয়েছে। তাছাড়া যার সাথে আবার দেখা হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম, গোপন কথা শোনানোর জন্য তার থেকে ভালো আর কে হতে পারে?
ইতিমধ্যে রাতের খাবারের সময় হয়ে এসেছে, আমার সহযাত্রী নিজেই আমাকে প্রস্তাব দিলেন ডাইনিং কারে যাওয়ার। খাওয়ার সময় আমি অন্তহীন বকবক শুরু করলাম। খাওয়া শেষ হয়ে গেলো কিন্তু আমার বকবক কমল না। এমনকি একবার ওয়েটার এসে টেবিলক্লথ বদলে দিয়ে গেল, মানে মোলায়েমভাবে বলতে চাইলো, এবার উঠে পড়ুন, অন্যরাও খাবে। তাতেও আমি বকবক করা থামালাম না। আমার সহযাত্রীটি একজন আদর্শ শ্রোতা। কমবয়সীদের মত কৌণিক চেহারা তার। সবুজ চোখ, রোদেপোড়া চোখের পাতা, এমনকি তার হাতের লম্বা লম্বা আঙ্গুলগুলি তার মনোযোগী শ্রোতা হওয়ার প্রমাণ ছিলো যেন। বিনাপ্রশ্নে সে আমার কথা সব শুনছিলো।
ঘুম না আসা রাতে আমার মাথায় যা যা এসেছিল সব আমি তাঁকে বলছিলাম। এই পঁয়ত্রিশ বছর বয়সে আমার চাকরিটি আমার আর পছন্দ হচ্ছে না, লেখালিখিই আমার আসল পছন্দ। লেখালিখির জন্য আমার বিভিন্ন চেষ্টা আর বারবার হেরে যাওয়ার গল্পও আমি তাঁকে করলাম। আমার মতে আগামী তিন মাসের এই স্যানেটেরিয়াম বাস যে আমাকে একটা সিদ্ধান্তে পৌছতে সাহায্য করবে সেটাও বললাম। আমার নতুন ধারণার কথাও বললাম, হয় আমি একটি দারুণ উপন্যাস লিখে চারদিকে সাড়া ফেলে দেবো, না হলে আমি আর কিছু লেখার চেষ্টাই করব না। এমনকি আমার মাথায় থাকা উপন্যাসের প্লটও তাঁকে বলে ফেললাম। বলেই আমার কেমন যেন একটা অনুশোচনা হল। এতো গোপন একটি প্লট যে আমি আমার প্রিয়তমাকেও বিশ্বাস করে বলিনি, সেই প্লট আমি একজন অপরিচিতকে উগরে দিলাম। তবে আমার মনে হয়, আমার অত্যধিক সংশয়ের কারণেই আমি আমার প্রেয়সীকে আমার পরিকল্পনা জানাইনি। তবে এটাও সত্যি যে সেটাই সম্পূর্ন আসল কারণ না। আসল কারণ হল, আমি নিজেই জানি না আমার উপন্যাস লেখার মত প্রতিভা আছে কিনা। আমি তার চোখে একজন ব্যর্থ মানুষ হয়ে থাকতে চাই না। যদি ব্যর্থ হওয়াই আমার ভবিতব্য হয় তাহলে আমার একাই সেই ব্যর্থতার যন্ত্রনা ভোগ করা উচিত। সেই কথাও আমি ওঁকে জানালাম।
যখন আমার কথা বলা শেষ হল তখন আমরা আবার আমাদের কোচে ফিরে এসেছি। আর তাঁর থেকে একটি প্রতিক্রিয়াও আশা করছিলাম। নিজের প্রগলভতায় আমি একটু লজ্জিতই হয়েছিলাম। যে চিন্তাগুলো আমার মনে সঠিকভাবে রূপ নিতেও পারেনি এখনো সেইসব তথ্যও আমি ওঁকে বলে ফেলেছিলাম। নিজেকে একটু বোকাবোকাই লাগছিলো, মনে হচ্ছিলো একটু বাজে বকে ফেলেছি।
তিনি আমার বদলে যাওয়া মানসিকতা লক্ষ্য করে বললেন, “আমার মত একজন অপরিচিতকে এতোকিছু বলে ফেলেছেন, এমনকি কিছু গোপন কথাও, এর জন্যে আপনি পস্তাচ্ছেন মনে হচ্ছে, না?”
আমি একটু তেতোভাবেই বললাম, “একশোবার। আমি স্কুলে পড়া বাচ্চার মতো বকবক করছি। একজন বিখ্যাত ব্যক্তি বলেছেন যিনি শব্দের অভাবে ভোগেন, অথবা অতিরিক্ত বকবক করেন, সে কখনোই ভালো লেখক হতে পারবেন না। এই অতিরিক্ত বকবকই আমার দুর্বলতা। আমার মাথায় অনেক প্লট আসে কিন্তু আমি লিখতে বসলেই এতো অপ্রয়োজনীয় তথ্য দিয়ে ফেলি যে নিজের জালে নিজেই জড়িয়ে যাই। এখনকার মতই।”
তিনি নিজের পকেট থেকে একটি ছোট বাক্স বার করলেন। “আমি আপনার স্ত্রীর কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ – দয়া করে নিজের ওষুধ খেয়ে নিন। এই মুহুর্তে ওটাই আপনার দরকার বলে মনে হচ্ছে।”
আমার ধৈর্যের কফিনে ওটাই শেষ পেরেক ছিলো। উনি সম্ভবত আমার মুখ দেখে কিছু আন্দাজ করেছিলেন।
বাক্সটা আবার নিজের পকেটে ঢোকাতে ঢোকাতে তিনি বললেন, “আপনি ঠিকই ভাবছেন। এই ওষুধগুলো এক একটা শাঁখের করাতের মত। বিশেষ করে ঘুমের ওষুধ, অবশ্য আমিও মাঝে মাঝে খাই। তবে আমার মতে এইসব ক্ষেত্রে টোটকা বেশী কার্যকারী। একটা তো এখনই পরীক্ষা করা যেতে পারে। তিনি তাঁর সুটকেস থেকে একটি কনিয়াকের বোতল বের করলেন। একদম খাঁটি আর্মেনিয়ান, এখন এটাই সবথেকে ভালো। আপনি একটু অপেক্ষা করুন, আমি কন্ডাক্টারের থেকে দুটো গ্লাস নিয়ে আসি।
এতোক্ষণ তাঁকে অল্পবিস্তর ডাক্তার বলে মনে হচ্ছিল, এখন তো আরোই মনে হচ্ছে না। একটু পরে তিনি দুটো গ্লাস নিয়ে বিজয়ীর মত ফিরে এলেন।
আমার জন্য কয়েক ফোঁটা ঢাললেও নিজের জন্য গ্লাসের এক তৃতীয়াংশ ভর্তি করলেন। “খাওয়ার আগে হাতের তালু দিয়ে গ্লাসটা একটু গরম করে নিন, মদ্যপানের শৌখিনরা বলেছেন এতে নাকি মজা আরো বাড়ে।”
আমি একফোঁটা পান করলাম। একটা আরামদায়ক উত্তাপ আমার গলা বেযে যেন পেটের দিকে চলে গেলো। আমার মনে পড়ল, কত্তদিন আমি কনিয়াকের একটুও স্বাদ পাইনি।
“আশ্চর্য ব্যাপার, আমাকে সব ডাক্তার পইপই করে মানা করেছেন একফোঁটাও মদ্যপান করতে। আমি যখন হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাই…”
“ধুর ধুর এসবের কোনো মানেই হয় না” হাত নেড়ে তিনি বললেন। আসলে ডাক্তারিতে এরকম বোকাবোকা ধারণা অনেক রয়েছে। তাঁরা মনে করেন মদ একটি সামাজিক বিষ। আর এটার অনেকে দুর্ব্যবহারও করেছে, ফলে নিষিদ্ধ করারও অজুহাত সহজেই পাওয়া গেছে। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে এর কোনো তুলনাই নেই। এই দেখুন, আপনি একঢোঁক খেয়েছেন, আর ইতিমধ্যেই অস্থিরতা ভুলে গেছেন, ঠিক কিনা?”
এই কথাগুলি তিনি এতো গম্ভীরভাবে বললেন যে আমি হাসি চাপতে পারলাম না।
“আপনার কথা অক্ষরে অক্ষরে ঠিক, তবে আমার মত একজন রোগীর মদ খাওয়ার পরিণাম নিয়ে কি বলবেন?”
“আমি আপনাকে আর দেবো না, তাহলেই আর পরিণাম খারাপ হওয়ার সম্ভাবনা নেই। এই কয়েক ফোঁটায় কোনো ক্ষতি হবে না। “
এই বলে তিনি মহানন্দে আরেক চুমুক দিলেন গ্লাসে।
“আবার একথাও ঠিক যে মদ্যপান করলে সবার আলাদা প্রতিক্রিয়া হয়। নিজের গ্লাসটা আলোর সামনে তুলে আপনমনেই বলে চললেন। যেমন কফি খেলে কেউ কেউ ঘুমোতে পারেন না, আবার কেউ ঘুমোনোর জন্যেই কফি খান। মানুষের মস্তিষ্ক আসলে এক জটিল পদ্ধাতি নিয়ে চলে। সারা জীবন ধরে সে উত্তেজনা আর সেই উত্তেজনার বিধিনিষেধ নিয়েই লড়ে যায়। তাই প্রতি আলাদা আলাদা ক্ষেত্রে জানতে হবে কোনো মানুষ কিসে কিভাবে উত্তেজিত হন। আপনার ক্ষেত্রেই দেখুন, সামান্য মদ্যপানের ফলে আপনি আরাম পেয়েছেন, ঠিক কিনা?”
“একদম ঠিক। তবে আমি বুঝতে পারছি না আমার একফোঁটা খাওয়ার আগেই আপনি কি করে বুঝলেন যে মদ্যপানে আমি আরাম পাবো?”
“এটুকুও না পারলে আমি নিজেকে খুব খারাপ মনোবিদ বলে মনে করতাম।”
“আপনি একজন মনোবিদ?”
“খানিকটা।”
এই আরেক রহস্য শুরু হল। আমি অনেকদিন মদ্যপান করিনি, তাই মাথা সামান্য টলমল করছিল, তার সাথে ট্রেনের দোলানি মিলেমিশে আমার বেশ অবসন্ন লাগছিলো। আমি বললাম, “খানিকটা মনোবিদ বলতে আপনি কি বোঝাতে চাইছেন? একটু আগেই বললেন আপনি প্রায় একজন ডাক্তার, এখন বললেন আপনি খানিকটা মনোবিদ। আসলে আপনি ঠিক কি একটু বলবেন?”
“আমি একজন সাইকোফিজিওলজিস্ট।”
“সেটা আসলে কি?”
“আমি আপনাকে স্বল্পকথায় বোঝাতে পারব না, আর এই বিষয়ে বিস্তারিত বলেও লাভ নেই। আমি বরং একটা সোজা উদাহরণ দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করছি। যেমন ধরুন আপনি কনিয়াক আপনাআর মানসিক অবস্থার কিছু পরিবর্তন করেছে, ঠিক?”
“একদম”
“বাইরে থেকে প্রযুক্ত বস্তুর সাথে তৈরি করা এক কৃত্রিম মানসিক পরিবর্তন। তেমনিই, মানুষের শারীরিক পরিবর্তন তাঁর মানসিক পরিবর্তনের জন্যেও দায়ী, যেমন বিভিন্ন হরমোন। মানব মস্তিষ্ক এবং অন্যান্য অঙ্গের মধ্যে পারস্পরিক বহু ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার যোগাযোগ আছে। এই সব মিলেই মানুষকে সম্পূর্নতা দিয়েছে। আর এটি একমাত্র সম্পুর্ণ মানুষের ক্ষেত্রেই পরীক্ষা করা সম্ভব। ছোট করে বলতে গেলে সাইকোফিজিওলজি এমন এক বিজ্ঞান যা মানুষের শরীরের প্রভাব তার মস্তিষ্কের উপর এবং মস্তিষ্কের প্রভাব তার শরীরের উপর নিয়ে চর্চা করে।”
“ বুঝেছি, তাহলে উদাহরণস্বরূপ বলতে পারি, যে খিটখিটে স্বভাবের কারণ হল পিত্তরসের ক্ষরণ…”
“একদম ঠিক, যদিও বিষয়টা ওর থেকে অনেক জটিল। অনেক সময়ই কার্যকারণ থেকে ফলাফলকে আলাদা করা যায় না। অনেক সময় আমরা ফলাফল ভেবে যাকে ধরে নিয়েছি, সেটাই কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আবার অনেক সময়ই উল্টোটা হয়। এই নিয়ে অবশ্য অনেক কাজ বাকি। অবশ্য কাজগুলো খুবই আকর্ষণীয়।”
এই বলে তিনি আরেক ঢোঁক পান করে একটু গম্ভীর হয়ে গেলেন।
আমি জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম, আমরা দক্ষিণের দিকে চলেছি। বরফে ঢাকা টুকরো টুকরো জমির বদলে সবুজ মাঠ চোখে পড়ছে এখন। আকাশ, সুর্য আর ভুমি যেন একদম আলাদা এক চালচিত্র রচনা করছে।
“আমি আপনাকে সাহায্য করতে পারি,” হঠাৎ আমার সহযাত্রী বলে উঠলেন। “আমার কাছে এক দুর্দান্ত প্লট আছে, তাই থেকে এক অসামান্য উপন্যাস তৈরি হতে পারে। মূল ঘটনাগুলি সত্যি সত্যিই ঘটেছে। যদিও শুনতে অনেকটাই অবিশ্বাস্য কিন্তু একটি শব্দও বানানো নয়। আপনি কি শুনতে চান?”
আমি উত্তর দিলাম “নিশ্চয়ই, আমি শুনতে খুবই আগ্রহী। কিন্তু সবচেয়ে ভালো প্লট ব্যবহার করে আমি ভালো উপন্যাস লিখতে পারব কি না নিশ্চিত নই…”
কথার মাঝেই বাধা দিয়ে বললেন “সে লিখবেন কিনা আপনার ব্যাপার। কিন্তু গল্প শুরু করার আগে আমার আপনাকে বলে রাখা উচিত, এই ডাক্তারী পেশায় রোগীর নাম প্রকাশের ক্ষেত্রে কিছু নৈতিক বাধা থাকে। এগুলি আপনাকে নিজেকে বানিয়ে নিতে হবে। আর বাকি… আচ্ছা শুনুন।”
“কাহিনী শুরু হয় একজন বিখ্যাত বৈজ্ঞানিকের ক্লিনিকে। আমরা তাঁকে প্রফেসর বলেই ডাকব। আমি আপনাকে কিছু তথ্য দিচ্ছি যাতে তাঁর চরিত্রচিত্রণে আপনার সুবিধা হয়। কিন্তু তাঁকে খুব ভালো মানুষ বা পাগল কুটিল মানুষ বানাবেন না দয়া করে। এই ব্যক্তি একধারে যেমন জটিল তেমনই একজন উদারচেতা বিদ্বান। অসামান্য শল্য চিকিৎসক, একরোখা কিন্তু রোগীদের প্রতি অত্যন্ত মনোযোগী ও সহানুভুতিশীল। আবার তাঁর অধীনস্থ ব্যক্তিদের সঙ্গে খুবই দুর্ব্যবহার করতেন। এছাড়াও আপনি যদি চান আরো কিছু দোষ বা গুণ তাঁর চরিত্রে যোগ করতে পারেন। তবে তা খুব একটা প্রয়োজনীয় হবে না বলেই মনে হয়।”
“তাঁর কাজ চিকিৎসাশাস্ত্রকে এক নতুন দিশা দেখিয়েছিল। এই তথ্য আপনি আপনার উপন্যাসে ব্যবহার করতেই পারেন। তাঁর পুরো কাজটাই ছিল বিভিন্ন অঙ্গ প্রতিস্থাপন নিয়ে। কিভাবে এই ক্লিনিকে অঙ্গ প্রতিস্থাপনের কাজ হত সেটা আপনাকে একটু অনুমান করে নিতে হবে। কোনো বিশেষ জ্ঞান এর দরকার নেই, সেখানকার পরিবেশ সম্পর্কে একটা ধারণা থাকলেই হবে। একটা উদ্বিগ্ন আবহাওয়া যেন সবসময় এই ক্লিনিককে ঘিরে থাকত। একটি বড় বিশেষজ্ঞ দল সবসময় তৈরি থাকত অঙ্গ প্রতিস্থাপনের জন্য কিন্তু কেউ জানত না কোন সময়ে এই কাজটি হবে। একঘন্টাও হতে পারে আবার একমাসও লাগতে পারে রুগী পেতে। তাই বলে যে তাঁরা অনির্দিষ্ট কালের জন্য হাত পা গুটিয়ে বসেছিলেন তা নয়। এই সময়ে পরীক্ষাগারে প্রতিস্থাপন নিয়ে বিভিন্ন প্রয়োজনীয় পরীক্ষানিরীক্ষা চলছিল। বিভিন্ন জীবজন্তুর উপরে পরীক্ষা চলছিল। সব পরীক্ষার ফলাফলই নতুন নতুন আশার সৃষ্টি করছিলো, নতুন পরিকল্পনা আর নতুন হতাশার সৃষ্টিও হচ্ছিল।”
“প্রফেসর অক্লান্তভাবে নিজের লক্ষ্যের দিকে ছুটে চলছিলেন – তাঁর মূল লক্ষ ছিল মানব মস্তিষ্কের প্রতিস্থাপন করা। ইঁদুর আর কুকুরের উপর অগুনতি পরীক্ষা করা হয়েছিল। তবে তাড়াতাড়ি কিছুই হয়নি। বছরের পর বছর এইসব পরীক্ষার পিছনে কেটে গেছে। শেষে একটি মস্তিষ্ক প্রতিস্থাপন হওয়া বাঁদর একদম সুস্থভাবেই বেঁচে উঠেছিলো। নতুন প্রশ্ন জন্মালো এই পরীক্ষার ফল থেকে। পরবর্তী পদক্ষেপ কি হবে? মানুষের উপরেও কি এরকম পরীক্ষা করা যাবে? যেকোনো প্রতিস্থাপনকে এখনও খুবই সন্দেহজনক ভাবে লক্ষ্য করা হয়। আর এখানে তো এমন একটি বিষয়ের কথা হচ্ছে, সেখানে অনেক নীতিগত সমস্যাও প্রচুর। প্রফেসর তাঁর কাজ উচ্চতর আধিকারিকদের কাছে পেশ করলেন, কিন্তু তাঁরা সবাই সিদ্ধান্ত নিয়ে গড়িমসি করলেন। সিদ্ধান্তকে পিছোনর জন্য যতরকম অজুহাত হয়, সবই তাঁরা ব্যবহার করে নিলেন। ফলে মানব মস্তিষ্ক প্রতিস্থাপনের প্রস্তাবনাকে গ্রহণ বা বর্জন কিছুই করা হল না।”
“ইতিমধ্যে ক্লিনিকে সফলভাবে হৃদপিন্ড, কিডনি সাফল্যের সাথে প্রতিস্থাপিত করা গেছে। তবে এইসব সাফল্য হয়তো আসল কাজের ভুমিকামাত্র। একদিন প্রায় হঠাত করেই সুযোগ এসে গেলো। প্রায় একসাথেই এম্বুলেন্স দুইজন মানুষকে ক্লিনিকে নিয়ে এলো। দুজনই অজ্ঞান, দুজনকেই রাস্তায় পড়ে থাকা অবস্থায় পাওয়া গেছে। প্রথমজন অজ্ঞাতপরিচয়, তাঁর নাম, ঠিকানা, বয়স এবং জীবিকা অজানা। তাঁর ফুসফুস থেকে প্রচুর রক্তপাত হয়েছে, ফলে অবস্থা হাতের বাইরে। দ্বিতীয়জন একজন শিক্ষক, অবিবাহিত, তিরিশ বছর বয়সী- একটি পথদুর্ঘটনার শিকার। তাঁর মাথার খুলি প্রায় দুভাগ হয়ে গেছে, মস্তিষ্কে গভীর আঘাত লেগেছে। যদিও দ্বিতীয় জন মৃতপ্রায়, প্রথমজনকে বাঁচানোর খুব চেষ্টা করা হচ্ছিলো। প্রথম ব্যক্তিকে দ্বিতীয় ব্যক্তির ফুসফুস প্রতিস্থাপন করার চেষ্টা করা হচ্ছিলো। তবে সবকিছু প্রস্তুত করেও কিছুতেই অপারেশন শুরু করা যাচ্ছিলো না। প্রথমত, দাতা বা তাঁর কোনো পরিজনের
সম্মতির প্রয়োজন ছিলো, যা পাওয়া যাচ্ছিলো না। দ্বিতীয়ত, একজন মৃত ব্যক্তির অঙ্গ প্রতিস্থাপন করা যায়, কিন্তু ওই রোগীর মধ্যে সামান্য হলেও প্রাণ অবশিষ্ট ছিলো এবং সেই প্রাণটুকু রক্ষা করতে চিকিৎসকরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিলেন। একজনকে তো আর মেরে ফেলা যায় না ইচ্ছেমত। শেষরক্ষা হল না, প্রথম ব্যক্তির বাঁচার সব রাস্তা বন্ধ হয়ে গেলো্ যখন জানা গেলো, দ্বিতীয় ব্যক্তির টিবি আছে।
প্রচুর মানুষ এমন আছেন, যাদের টিবি আছে, কিন্তু তাঁরা জানেনও না। শরীর নিজেই এমনভাবে প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরী করে যাতে রোগটা আর না ছড়ায়। কিন্তু কোনো চিকিৎসক একটি টিবি রোগাক্রান্ত ফুসফুস প্রতিস্থাপন করতে রাজি হলেন না। । তার বদলে দুটি মৃত্যুর দায় নিতেও তাঁদের অসুবিধা নেই। এই সময় একজনকে সম্পুর্ণ দায়িত্ব নিতেই হয়। প্রফেসর সেটাই করলেন। প্রথম ব্যক্তিত মস্তিষ্ক দ্বিতীয় জনকে প্রতিস্থাপন করার পরিকল্পনা নিলেন। তাঁর বোধহয় মনে হয়েছিল দুইজন মারা যাওয়ার থেকে একজন মারা যাওয়া একটু বেশি ভালো। ব্যক্তিগতভাবে অবশ্য আমার মনে হয়েছে এটি হঠকারিতায় নেওয়া একটি সিদ্ধান্ত, ভেবেচিন্তে করা পরিকল্পনা নয়। তবে ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময়ই কোথায় ছিল রোগীদের কাছে?”
“এই সূক্ষ্ম অপারেশনের বিস্তৃত বিবরণ নাও দিতে পারেন। পাঠকরা এত বিস্তারিত বিবরণ পড়লে একটু নিরুৎসাহিত হতে পারে। অপারেশন হয়ে গেলো। পরের দিন দাতার স্ত্রী তাঁকে খুঁজে বার করলেন এবং মর্গে সনাক্তও করলেন। তাঁকে বলা হয়েছিলো যে তাঁর স্বামী ফুসফুসের রক্তপাতে মারা গেছেন। সত্যি কথাই বলা হয়েছিলো, তবে বাকি কোনো তথ্যই তাঁকে দেওয়া হল না। কারণ হয়তো তাঁর পক্ষে সেই তথ্য হজম করা কঠিন হত। বছর পঁচিশেকের ওই ভদ্রলোক একজন সাংবাদিক ছিলেন। মাত্র একবছর হলো ওঁদের বিয়ে হয়েছিলো এবং ওঁরা একে অপরের প্রেমে ডুবে ছিলেন। মৃতরোগীর একজন নিকটাত্মীয়ের সসাথে কথা বলা একজন ডাক্তারের পক্ষে সবথেকে কঠিন কাজ। রোগীকে বাঁচাবার সবরকম চেষ্টা করলেও তাঁর সবসময় মনে হয়, তিনি নিশ্চয়ই কিছু একটা ভুল করেছেন তাই রোগী মারা গেছেন। সম্ভবত সেই কারণেই প্রোফেসর নিজে কথা না বলে, নিজের এক সহকারীকে পাঠালেন ভদ্রমহিলার সাথে কথা বলতে। এটুকুর জন্য আমরা ওকে ক্ষমা করে দিতেই পারি কারণ আরেকজন রোগীও সেখানে ছিলেন, আর প্রফেসর শুধু সমাজের কাছে না, তাঁকে নিয়ে নিজের বিবেকের কাছেও কিছুটা দায়ী ছিলেন।”
“আগের অন্যান্য জীবের উপর করা মস্তিষ্ক প্রতিস্থাপনের পরীক্ষাগুলি থেকে কী জানা গেছিলো? জানা গেছিলো যে অন্যান্য প্রানীরা তাদের অঙ্গসঞ্চালন ক্ষমতা আর ভারসাম্যবোধ তাড়াতাড়ি ফিরে পায়। প্রতিস্থাপনের সঙ্গে সঙ্গে দাতার সাধারণ প্রতিবর্ত ক্রিয়াগুলি চলে যায়, তবে আবার তাড়াতাড়ি ফিরেও আসে। কিন্তু এই তথ্যের উপর ভিত্তি করে বোঝা পায় অসম্ভব একজন মানুষের উপর এই মস্তিষ্ক প্রতিস্থাপনের কী রকম প্রতিক্রিয়া হবে? মস্তিষ্কের কী কী ক্ষমতা রয়ে যাবে? স্মৃতি কি থাকবে না পুরো নষ্ট হয়ে যাবে? দাতার স্মৃতিগুলি কি অবচেতনে থেকে যাবে? কথা বলা আর ব্যক্তিত্বে কী কী পরিবর্তন আসবে? এই সকল প্রশ্নের উত্তরই অজানা। একজন মানুষের ব্যক্তিত্ব অন্য মানুষের মধ্যে প্রতিস্থাপিত হয়ে নতুন ব্যক্তিত্বের সৃষ্টি বয়ে কি? এই রকম বহু প্রশ্নেরই উত্তর পাওয়া যায়নি তখনো। জানার থেকে অজানার পরিমান অনেক বেশি।”
“অপারেশনের পরে দেখা গেল একজন শয্যাশায়ী মানুষকে যিনি শ্বাস নিতে পারছেন, আলোতে সাড়া দিচ্ছেন এবং তরল খাদ্য গ্রহণ করছেন। তাঁর পরিপাকক্রিয়া এবং রেচনপ্রক্রিয়া কাজ করছে- ব্যাস এটুকুই। এভাবেই সপ্তাহের পর সপ্তাহ, মাসের পর মাস কেটে গেলো। ধীরে ধীরে তিনি উঠে বসলেন, তাঁকে হাঁটা শেখানো হল। কিছুকিছু শব্দও তিনি শিখলেন। আরো কিছুদিন পরে তিনি কষ্ট করে কিছু কিছু শব্দও উচ্চারণ করতে পারতেন। তাঁকে এরপর পড়তে শেখানো হল। একবছর এইসবেই কেটে গেলো। এরপর তিনি কথা বলতে, পড়তে এবং লিখতে পারতেন কোনও বাধা ছাড়াই। তাঁর স্মৃতি ছাড়া সবই ফিরে এসেছিলো। তাঁকে বলা হয়েছিলো তিনি মস্তিষ্কের আঘাতের শিকার। যা তাঁর স্মৃতিকে পুরোপুরি নষ্ট করে দিয়েছে। তিনি এই সমস্যা বুঝতেও পেরেছিলেন,
মেনেও নিয়েছিলেন। তবে তিনি যত সুস্থ হয়ে উঠছিলেন, তত তাঁর আর হসপিটালের পরিবেশে থাকতে আর ভালো লাগছিলো না। প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছিলো যে এবার তাঁকে নিয়ে কি করা হবে? তাঁর কাগজপত্র অনুযায়ী তিনি একজন শিক্ষক। তবে এই পরিস্থিতিতে সেই জীবিকায় ফিরে যাওয়া এখন প্রশ্নাতীত। সাংবাদিকতারও কিছু তাঁর মধ্যে আর অবশিষ্ট নেই। নতুন কিছু শিখতে পারবেন কিনা এই প্রশ্ন করারও সময় আসেনি এখনো। তাঁকে কি প্রতিবন্ধীভাতায় রাখা হবে? হয়তো তাঁর এতে খারাপ লাগবে। তাছাড়া এতদূর এসে এই সময়ে এই পরীক্ষা ছেড়ে দেওয়ার কোনো মানেই হয় না। তাঁকে লোকজনের সাথে মেলামেশার সুযোগ করে দেওয়া উচিত, সিনেমা থিয়েটার যাওয়া উচিত, তবে সবটাই বিশেষজ্ঞদের নজরদারীতে।”
“আমি আগে বলতে ভুলে গেছি, এই শিক্ষকের একজন প্রেয়সী ছিলেন। তিনি এই দুর্ঘটনা আর অপারেশনের ব্যাপারে কিছুই জানতেন না প্রথমে। তারপর যখন জেনেছিলেন তিনি ওঁর সাথে দেখা করার অনুমতি চাইতেন প্রায়ই। এমনকি তিনি বোর্ড অফ হেলথে আর্জি পেশ করেছিলেন। কিন্তু প্রফেসর সেই সময়ে রোগীর সাথে কাউকেই দেখা করতে দিতেন না। তাঁর ভয় ছিলো, তাতে রোগীর উপর কোনো ক্ষতিকর প্রভাব পড়তে পারে। কিন্তু এখন পরিস্থিতির অনেক পরিবর্তন হয়েছে, তাই এবার তাঁকে দেখা করার অনুমতি দেওয়া হয়। রোগী যথারীতি তাঁকে চিনতে পারলেন না, তবে ক্লিনিকের বাইরের একটি নতুন মুখ দেখে তিনি আন্তরিক ভাবে খুশি হলেন। এছাড়া ভদ্রমহিলা খুবই সুন্দরী এবং স্মার্ট হওয়ায় তাঁর ওঁকে খুব পছন্দ হল।”
“ভদ্রমহিলা প্রতিদিন ওঁকে দেখতে আসতেন, ঘন্টার পর ঘন্টা তাঁরা কথা বলতেন। ভদ্রমহিলা ওঁর অতীত সম্পর্কে গল্প করতেন, বেচারা এমন ভাবতেও শুরু করলেন তাঁর কিছু কিছু স্মৃতি ফিরে আসছে। অবশেষে একদিন ভদ্রমহিলা ওঁকে নিজের বাড়ি নিয়ে যাওয়ার অনুমতি চাইলেন। প্রফেসর রাজীও হয়ে গেলেন।”
“প্রথমদিকে সবকিছু ঠিকঠাকই ছিলো। ভদ্রমহিলা ভাবতেন, তিনি তাঁর কোনো দুর্ভাগা একজন প্রিয়জনকে বাড়ি নিয়ে এসেছেন। আর্থিক সমস্যাও ছিলো না, কারণ শিক্ষকের কিছু সঞ্চয় ছিলো এবং ক্লিনিক থেকেও তাঁকে প্রতিবন্ধীভাতায় রাখা হয়েছিল অনির্দ্দিষ্টকালের জন্য। এই পরিবেশের পরিবর্তনটি তাঁর জন্য খুবই দরকারী ছিলো। তাঁরা দুজনে পরস্পরের সাথে খুবই খুশি ছিলেন। এইরকম পরিস্থিতিই বজায় থাকে কিনা, সেটা জানার জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিলো না।”
“দুঃখের বিষয়, সবকিছু আগের মতো ভালো আর চলছিলো না। হয় ওঁর স্মৃতি ফিরে আসছিলো অল্প অল্প করে, না হলে তাঁর সাংবাদিকতার অতীতের কিছু ঘটনা তাঁর অবচেতনে ভেসে উঠেছিলো। তিনি প্রায়ই বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতেন, আর সাংবাদিকের বাড়ির বাইরের সিঁড়িতে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতেন ঘন্টার পর ঘন্টা। স্বাভাবিক ভাবেই তাঁর প্রেয়সী এই ঘটনায় একটু উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লেন। তিনি প্রফেসরের কাছে পরামর্শ চাইতে গেলেন, কিন্তু প্রফেসরই বা এই বিষয়ে কী বলতে পারেন? বোঝাই যাচ্ছিলো এমন একটি বিষয় এই গল্পে প্রবেশ করতে চলেছে যা এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয়।”
” সেই ঘটনা ঘটানো গেলো না কোনোমতেই। অবশেষে সাংবাদিকের স্ত্রীর সাথে ওঁর দেখা হল।”
“ভালোবাসা কি অদ্ভুত ! হাজার হাজার বই লেখা হলেও এ নিয়ে আমরা কত কম জানি। আমি আগেই আপনাকে বলেছি যে সাংবাদিক ও তাঁর স্ত্রী পরস্পরের প্রেমে ডুবে ছিলেন। এতটা বলে তিনি একটু বিরতি নিলেন।”
“ডাক্তারের নজরের সামনে আরেকটু পান করলে আপনার কোনও ক্ষতি হবে না। শুধু শুধু চিন্তা করার দরকার নেই।” এই বলে তিনি বোতলটি আরেকবার খুললেন।
আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “আপনি কোথা থেকে এই গল্প জেনেছেন?”
“আমি…” তিনি একটু থমকে গিয়ে বললেন, “আমাকে এই কেসটাতে বেশ কয়েকবার পরামর্শ দেওয়ার জন্য ডাকা হয়েছিল। আবার শুরু করি গল্পটা?”
“নিশ্চয়ই!”
“তাঁদের দেখা হল। শিক্ষক তাঁকে দেখে আপ্লুত হয়ে পড়লেন। সাংবাদিকের স্ত্রীর কোনো স্মৃতি তাঁর মস্তিষ্কের কোনো কোণে রয়ে গিয়েছিলো। আর সেই অবচেতন স্মৃতিকেই তিনি ভেবে নিলেন যে তিনি ওঁকে প্রথম দর্শনেই ভালবেসে ফেলেছেন।”
আর সেই ভদ্রমহিলা? তাঁর কি প্রতিক্রিয়া হল?”
“তাঁর? এঁকে দেখে এক অপরিচিত ব্যক্তি ছাড়া তাঁর আর কিছুই মনে হয়নি। আর তাছাড়া স্বামীর মৃত্যু নিয়ে তিনি তখনো শোকাচ্ছন্ন। তাই তিনি এঁকে একেবারেই মনোযোগ দিলেন না। কিন্তু ভদ্রলোক ওঁর ফ্ল্যাটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতেন। রাস্তাঘাটে কথাবার্তা শুরু করতে চাইতেন। ক্রমাগত চেষ্টা করলে কিছুদিনের মধ্যে সফলতা এসেই যায়। না না, এর জন্য ওই ভদ্রমহিলাকে খারাপ ভাবার কিছুই নেই। তিনি অত্যন্ত অল্পবয়সী এবং একদম একা এই পৃথিবীতে। এছাড়াও এই মানুষটির ছোট ছোট অনেক বৈশিষ্ট্য তাঁর মৃত স্বামীর সাথে মিলে যাচ্ছিলো।”
“কিন্তু সেই ভদ্রমহিলার কি হলো যিনি ওঁকে ক্লিনিক থেকে বাড়ি নিয়ে এসেছিলেন? আমি জানতে চাইলাম। ওঁকে কি ছেড়ে দিলেন ভদ্রলোক?”
“সেটাই তো আসল কথা, তিনি পারলেন না। তিনি ওঁকেও ভালোবাসতেন। আপনি যখন এই সম্পর্কগুলি নিয়ে লিখবেন তখন কিন্তু আপনাকে খুব কৌশল করে লিখতে হবে। কারণ সাধারণ ত্রিকোণ প্রেমের গল্প নয় এটা। বোঝানো খুব মুশকিল। আসলে তিনি একাধারে দুইজন পুরুষ ছিলেন, তাই দুইজন নারী…. না, ঠিক এভাবে বোঝানো যাবে না! দুই নারী মিলে তাঁর সামনে একটিই ছবি তৈরি করছিল। আর সেটি তিনি আলাদা করতে পারছিলেন না। হয়তো একজন বিশেষজ্ঞ এখানে একটু মানসিক রোগের ছায়াও পাবেন। তবে কোনো গল্পের নায়কই মানসিক ভাবে সম্পুর্ণ সুস্থ নয়। এটাই যা ভরসা।”
পকেট থেকে অন্য একটি ছোট বাক্স বার করে তিনি একটি ওষুধ খেলেন। তাঁর কপাল ঘামে ভিজে গেছিলো, চোখ ঠিকরে বেরিয়ে আসছিল, প্রচন্ড উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলেন। মনে হচ্ছিলো আমাকেই হয়তো এবার মনোবিদের ভুমিকা নিতে হবে ওঁকে শান্ত করতে। আমি নিজেও এই কাহিনীতে খুবই উৎসাহিত হয়ে পড়ছিলাম। কিছু কিছু বিষয়ে সন্দেহও হতে শুরু করেছিলো। আমি ওঁকে জিজ্ঞাসা করলাম, “এই যে শিক্ষকের কথা বলছেন, ইনি কোন বিষয়ের শিক্ষকতা করতেন?”
“তাতে আর কি যায় আসে? হয়তো শারীরবিদ্যাই পড়াতেন। আপনি আপনার ইচ্ছেমত কিছু একটা লিখে দেবেন। আমি তো শুধু আপনাকে প্লটটাই বলছি…”
“বাকিটাও বলুন, সত্যিই অসাধারণ প্লট এটা।”
“দুজন ভদ্রমহিলার কেউই এই পরিস্থিতি মেনে নিতে রাজি নন। দুজনেই কমবয়সী, সুন্দরী এবং উচ্চাভিলাষী। দুজনেই এঁকে নিজের বলে মনে করেন। আমি আগে আপনাকে ইচ্ছে করেই মানসিক অসুস্থতার কথা বলেছিলাম। মানব মস্তিষ্কের নিজস্ব কিছু প্রতিরোধ কৌশল থাকে। যখনই কোনো পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যায়, তখন প্রায়ই মানুষ কাল্পনিক জগতের আশ্রয় নিতে চায়। এটি স্বাভাবিক নয়, একে কিছুটা পাগলামিও বলা যায়। তাই, যদি আপনি চান, আপনার উপন্যাসের শেষে একটি পাগলা গারদের কথাও লিখতে পারেন।”
“ধুর, শেষটা খুবই দুঃখের। সত্যি বলতে কি, আমি পাগলাগারদে যাবজ্জীবন কারাবাসের থেকে ভালো কিছু আশা করেছিলাম।” আমি বলে ফেললাম।
“সারা জীবন কেন হবে?” তিনি আপত্তি জানালেন। “এখন চিকিৎসাবিজ্ঞান আগের থেকে অনেক বেশি উন্নত হয়ে গেছে। রোগের কারনকে রোগীর থেকে বিচ্ছিন্ন করলেই এইরকম অসুস্থতা সারানো সম্ভব। তবে সেটাই সবথেকে কঠিন কাজ। এই পরিস্থিতি থেকে রোগীকে সাময়িক ভাবে সরিয়ে নেওয়া চিকিৎসার প্রথম ধাপ। তবে আপনাকে এটাও বুঝতে হবে বিশেষত এই কেসটির ক্ষেত্রে পুরো ব্যাপারটাই সম্পুর্ণ আপেক্ষিক। কারণ হয়তো কালক্রমে তাঁদের আবার দেখা হবে এবং আবার সবকিছু শুরু হবে। আমার মতে সবথেকে উচিৎ পদক্ষেপ হল রোগীকে সব সত্যিকথা বলে দেওয়া। এতে তিনি তাঁর রোগের কারনও বুঝতে পারবেন এবং এত সমস্যার উৎপত্তি কোথা থেকে হচ্ছে সেটাও নিজেই পরীক্ষা করে দেখতে পারবেন। হয়তো কিছুদিন পরে তিনি নিজেই এই ঘটনা কাউকে গল্প করবেন।……… আমি আর কথা বলতে পারছি না, এখানে বড্ড দম আটকাচ্ছে, আমি একটু করিডোরে যেতে চাই।” বলে তিনি বাইরে চলে গেলেন।
তাঁর বেরোনো অবধি আমি অপেক্ষা করলাম, তারপর আধগ্লাস কনিয়াক ঢাললাম এবং এক চুমুকে পান করলাম কারন …
আমি কি করে এই চেহারা ভুলে যেতে পারি? সেই দুই সবুজ চোখ, কৌণিক চেহারা, রোদে পোড়া চোখের পাতা। আমার বিছানার উপর ঝুঁকে পড়ে আমাকে কথা বলা শেখাচ্ছিলেন। কাল্পনিক জগতে বিচরণের সময়ও এই ভীষণ চেনা মুখটি আসা যাওয়া করেছে বহুবার…
আমার কাছে এখন অনেক বিষয়ই একেবারে পরিষ্কার হয়ে গেছে। আমি আবার নতুন করে সব কিছু শুরু করতে পারি। সবথেকে দরকারী বিষয় হল যে সেই নারী অবশেষে আমাকে নিজের স্বামী বলে ডেকেছে।
আর কোনোকিছুতেই কিছু যায় আসে না। এমনকি টিবি স্যানেটেরিয়ামে আমার আগামী তিনমাস থাকাও।
অনুবাদ প্রসঙ্গেঃ
ইলিয়া ভারসাভস্কি (Илья Иосифович Варшавский) (Ilya Iosifovich Varshavsky)১৯০৮ সালের ১৪ই ডিসেম্বরে জন্মগ্রহন করেন কিয়েভ শহরে। তখন এই শহর অখন্ড রাশিয়ার অন্তর্ভুক্ত হলেও এখন ইউক্রেনের অন্তর্ভুক্ত। প্রথমে জাহাজের মেকানিক ও পরে রাশিয়ান ডিজেল প্লান্টের ইঞ্জিনিয়ার ডিজাইনার পদে ছিলেন। ১৯২৯ সালে তাঁর প্রথম বই প্রকাশিত হয়। তারপর ১৯৬০ অবধি কোনো লেখাই প্রকাশিত হয়নি। ১৯৬২ তে প্রথম কল্পবিজ্ঞান রচনা, তাও ছেলের চ্যালেঞ্জের জবাব দিতে গিয়ে এবং ১৯৬৪ সালে এঁর সবথেকে বেশি জনপ্রিয় গ্রন্থ ‘নো এলার্মিং সিম্পটম’ প্রকাশিত হয়। ইনি রাশিয়ার বিখ্যাত সায়েন্স ফিকশন লেখকদের একজন। এঁর লেখনীর সাথে প্রায়ই বিখ্যাত ছোটগল্প লেখক ও হেনরীর তুলনা করা হত। ১৯৭৪ সালের ৪র্থ জুলাই এঁর মৃত্যু হয়। বিখ্যাত কল্পবিজ্ঞান লেখক বরিস স্ট্রুগাটস্কি স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে মনে করেছেন, ভারসাভস্কি কে তাঁরা দাদু ডাকতেন, মনে করেছেন অজাতশত্রু মানুষটির উজ্জ্বল সদাহাস্যময় উপস্থিতি, তাঁর মজা করা, দু-তিন পাতার ছোটো ছোটো গল্পের মধ্যে দিয়ে সারা বিশ্বের কল্পবিজ্ঞানের স্বাদ এনে দেওয়া, যখন তারা ব্রাডবেরি, অ্যাসিমভ বা Shackley সম্বন্ধে কিছুই জানতেন না। মাত্র দশ বছরের সাহিত্য জীবনে এত বিবিধ বিষয়ে এত মনোজ্ঞ গল্প তিনি লিখে গেছেন যা বিস্ময়কর।
মূল গল্পটির রচনাকাল ১৯৭১। ১৯৭৯ সালে Helen Saltz Jacobson এটি ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ করেন, ছাপা হয় ম্যাকমিলান প্রকাশিত Roger DeGaris সম্পাদিত ‘নিউ সোভিয়েত সায়েন্স ফিকশন’ বইতে। এই বইতে লেখক ইলিয়া ভারসাভস্কির চারটি গল্প ছাপা হয়েছিল, এটি তৃতীয়। বর্তমান অনুবাদটি এখান থেকেই করা হয়েছে। পরের বছর Collier Books বইই রিপ্রিন্ট করে।
অনুবাদক ঋতুপর্ণার জন্ম ১৯৮৫ সাল। বহুমুখী রাষ্ট্রীয় বালিকা বিদ্যালয়, আলিপুর থেকে মাধ্যমিক ২০০১। স্কুল কলেজের পড়াশুনো সাঙ্গ করে তথ্য প্রযুক্তি কর্মী হিসাবে কাজ করেছেন বেশ কিছুদিন। আপাতত একটি দেড় বছরের খোকার জননী। খোকার জন্য এবং দীর্ঘ নার্ভঘটিত অসুখে ভোগার কারণে বর্তমানে অচাকুরে। ছোটবেলা থেকেই ভালোবাসেন বই পড়তে আর লিখতে।
কৃতজ্ঞতা: ইলিয়া ভারসাভস্কি, হেলেন সালট্জ জ্যাকবসন, রজার ডি-গ্যারিস, ম্যাকমিলান, কলিয়ার বুকস।
Tags: ইলিয়া ভারশাভস্কি, ঋতুপর্ণা চক্রবর্তী, একটি উপন্যাসের প্লট, দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য্য, দ্বিতীয় বর্ষ চতুর্থ সংখ্যা, রাশিয়ান অনুবাদ গল্প
জানি না কী বলব। এতো ওস্তাদি একটা সাইন্স ফিকশানে থাকতে পারে ভাবা যায় না। শুধু দু:খ রয়ে গেল, গল্প এতো ছোট কেন?
ভালো লাগলো