এক কল্প দুনিয়ার গ্রিনরুম
লেখক: সন্দীপন গঙ্গোপাধ্যায়
শিল্পী: সুপ্রিয় দাস
‘সেই বিষাক্ত জঙ্গলে তখন নতুন একটা নির্বিষ অঙ্কুর জেগে উঠছে ঠিক নউসকা’র হারানো গগলসের পাশে। ভয়ংকর ওহমেরাও জেনে গেছে যে তাদের এক নতুন বন্ধু হয়েছে যে তাদের এই অভিশাপ থেকে মুক্তি দেবে’। এভাবেই শেষ হয় অ্যানিমে (জাপানী ভাষায় অ্যানিমেশন) ছায়াছবি ‘নউসকা অফ্ দ্য ভ্যালি অফ্ দ্য উইন্ড’। এই শেষ কিন্তু আসলে একটা স্বপ্ন গড়ার কারখানার সূত্রপাত। বৃহত্তর টোকিও শহরতলির পশ্চিমদিকে কোগানেই (বা কোগানেইশি) অঞ্চল। ১৯৮৫ সালে যখন ‘নউসকা’ ছবিটা বিরাট সাফল্য লাভ করে তখন সেই সাফল্যকে আরো নতুন দিগন্তে ছড়িয়ে দেয়ার জন্য তিন বন্ধু এই কোগানেইতেই খুলে বসলেন একটা অ্যানিমেশন স্টুডিও যার নাম ‘স্টুডিও ঝিবড়ি’।
‘নউসকা অফ্ দ্য ভ্যালি অফ্ দ্য উইন্ড’ ছবি একটা দৃশ্য
হায়াও মিয়াজাকি, ইসাও তাকাহাতা আর তোসিও সুজুকি। ঝিবড়ির এই তিনজন আদি প্রতিষ্ঠাতার মধ্যে প্রথম দুজন পরিচালক আর সুজুকি ছিলেন আদতে প্রযোজক। ‘ঝিবড়ি’ শব্দটা আসলে মূল ইটালিয়ান শব্দ ‘ঘিবলি’ থেকে নেয়া যা আসলে লিবিয়া অঞ্চলের এক ধরণের মরু হাওয়াকে বোঝায়। অ্যানিমের জগতে একটা নতুন খোলা হাওয়া আনার জন্য এই শব্দটাকে বেছে নিয়েছিলেন ওরা তিনজন। এই স্টুডিও থেকে বেরোনো আশ্চর্য অ্যানিমে ছবিগুলো গত প্রায় তিরিশ বছর ধরে সিনেমা-প্রেমী দর্শক আর সমালোচকদের প্রশংসা বয়ে নিয়ে চলেছে। এই ধারাবাহিক সাফল্যের মূল স্থপতি বলতে যদিও মিয়াজাকির নামই সবার আগে আসে। রূপকথা, ইতিহাস আশ্রয়ী কল্পকাহিনী, কল্পবিজ্ঞান এই সব ধারাতেই সমান সফল স্টুডিও ঝিবড়ি। ১৯৮৬ সালে হায়াও মিয়াজাকির ‘লাপুতা – ক্যাসল ইন দ্য স্কাই’ ছায়াছবি দিয়ে শুরু হয় এই জয়যাত্রার। লাপুতা এই শব্দটা আসলে জোনাথন সুইফট্ এর গালিভারস্ ট্রাভেলস্ এর সেই ভাসমান দ্বীপের নাম থেকে নেয়া। এই ছবিতে দেখানো ভাসমান দুর্গের গল্পে কল্পবিজ্ঞানের মোড়কে নানা ধর্মীয় অনুষঙ্গ আর কিংবদন্তীর বেশ কিছু চিহ্ন যে মুনশিয়ানার সঙ্গে ব্যাবহার করা হয়েছিল তা দর্শকদের প্রশংসা কুড়োয়। সাথে ছিল মিয়াজাকির তুলির আশ্চর্য টান যা অনেক স্বপ্নের মতো ফ্রেম তৈরি করেছিল এই ছবিতে। এই বিশেষ কৃতিত্বের জন্য সে বছর বিখ্যাত অ্যানিমেজ পত্রিকা আয়োজিত অ্যানিমে গ্র্যান্ড প্রাইজ দিয়ে সম্মানিত করা হয় এই ছবিকে। এর পর থেকে অসংখ্য পুরস্কার আর সম্মান এসেছে স্টুডিও ঝিবড়ির ঝুলিতে। কল্পনার ছবিকে প্রকাশের ক্ষেত্রে এক অন্যতম শৈল্পিক মাত্রা এনেছেন এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট গুণী শিল্পীরা। পাঁচবার অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ড এর মনোনীত হয়েছিল এই স্টুডিও থেকে রিলিজ হওয়া ছায়াছবি।
লাপুতা ছবির ভাসমান আকাশ দুর্গ
পূর্ণদৈর্ঘ্যের অ্যানিমে চলচ্চিত্র ছাড়াও শর্ট-ফিল্ম, টেলি কমার্শিয়াল সিরিজ এবং টেলি ফিল্ম নির্মাণের ক্ষেত্রেও রীতিমতো কৃতিত্বের দাবিদার এই স্টুডিও। জাপানী ভাষার বাণিজ্যিকভাবে সফল প্রথম ১৫টা অ্যানিমে ছবির তালিকায় স্টুডিও ঝিবড়ির আটটা পূর্ণ দৈর্ঘ্যের ছবি আছে। যার মধ্যে এক নম্বর স্থানে থাকা হায়াও মিয়াজাকির ছবি ‘স্পিরিটেড অ্যাওয়ে (২০০১)’ শুধুমাত্র জাপানেই নয় বরং সারা পৃথিবীতে এক বিরাট জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। এই ছবিকে তার উৎকর্ষতার জন্য বার্লিন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের সেরা পুরস্কার ‘গোল্ডেন বিয়ার’ দিয়ে সম্মানিত করা হয়। এছাড়াও অস্কার এবং অন্যান্য অনেক দেশের চলচ্চিত্র উৎসব থেকে শ্রেষ্ঠত্বের শিরোপা গ্রহণ করেছে এই ছবি। ওই প্রথম পনেরো ছবির তালিকায় থাকা আরেকটা ছবি ‘মাই নেইবার তোতোরো (১৯৯৮)’ র অন্যতম চরিত্র তোতোরো নামের সেই কাল্পনিক জন্তুর ছবি এতটাই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে যে স্টুডিও কর্তারা তাকেই পরে স্টুডিওর ম্যাসকট মনোনীত করেন। সেই সময় থেকেই আমাদের ভেতরে থাকা চির-শিশুদের কল্পনার রাজ্যে ঘুরে বেড়ানোর অন্যতম ঠিকানা তোতোরোর ওই মুখটা।
স্টুডিও ঝিবড়ির ম্যাসকটে তোতোরোর মুখ
শুধুমাত্র কল্পনার জাল বোনাই নয়, মানবিক সম্পর্কের গল্প যাতে সাধারণ মানুষের বাঁচা মরা উঠে আসে সেই ধরণের ছবির ক্ষেত্রেও সফল ঝিবড়ির সৃষ্টি সম্ভার। মনে পড়ে যায় ইসাও তাকাহাতার ‘গ্রেভ অফ্ দ্য ফায়ারফ্লাইস (১৯৮৮)’। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে এক অনাথ কিশোর আর তার বোনের জীবনের ছবি এক গভীর মানবিক টেস্টামেন্টে উঠে এসেছে এই ছবির গল্প বয়ানে। আগুন, ধোঁয়া আর মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে যেন জীবনের জয়গান গাওয়া হয়েছে ছবিটাতে। ছোট্ট বোন সেইতা যে দৃশ্যে তার দাদা সেটসুকোকে জিজ্ঞাসা করে যে জোনাকিরা এত তাড়াতাড়ি মরে যায় কেন সেই ফ্রেমটা যেন ওই ছবির গণ্ডি পেরিয়ে মহাকালের বিচার-শালায় গিয়ে ইতিহাসের পাতার সব যুদ্ধবাজ শাসকের সামনে ওই প্রশ্নটা রাখে।
দাদা সেইতার পিঠে চেপে ছোট্ট বোন সেতসুকো – গ্রেভ অফ দ্য ফায়ারফ্লাইস ছায়াছবি থেকে
মিয়াজাকি আর তাকাহাতা ছাড়াও ছাড়াও আর যে কজন গুণী শিল্পী স্টুডিও ঝিবড়ির সৃষ্টি সম্ভারকে সমৃদ্ধ করেছেন তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন ইয়োসিফুমি কোন্ডো, হিরোয়ুকি মোরিতা এবং হিরোমাশা য়োনেবায়াসি। এদের পরিচালিত ছবির মধ্যে বিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে কোন্ডোর ‘হুইস্পার অফ্ দ্য হার্ট’, মোরিতার ‘দ্য ক্যাট রিটার্ণস্’ এবং য়োনেবায়াসির ‘দ্য সিক্রেট ওয়র্ল্ড অফ্ অ্যারিয়েটি’। শুধু পরিচালনা নয় বিভিন্ন ছবিতে অ্যানিমেটর হিসেবেও তাদের অবদান কৃতিত্বের। পরে হায়াও মিয়াজাকির ছেলে গোরো মিয়াজাকিও তার বাবার মতোই প্রতিভার সাক্ষর রেখেছে ‘টেলস্ ফ্রম আর্থ সী’, ‘ফ্রম আপ অন পপি হিল’ ছায়াছবিরগুলোর মধ্যে দিয়ে। এই অ্যানিমেগুলোতে হলিউড এবং সমগ্র পশ্চিমের প্রভাব ছাপিয়ে ভীষণভাবে এক প্রাচ্য দর্শনের রূপটান দেখা যায়। গল্প বয়ানের ক্ষেত্রে অনেক সময় অধিবাস্তববাদের প্রভাব স্পষ্ট যেখানে এই চেনা পৃথিবীর মধ্যেই এক অচেনা জগতের ছবি ভেসে ওঠে। তবে সেই ছবির মধ্যেও জাপানী কিংবদন্তী এবং তাদের সংস্কৃতির ছাপটা স্পষ্ট। মিয়াজাকি নিজেই তার অনুপ্রেরণা হিসেবে হলিউডের বদলে সোভিয়েত অ্যানিমেশন বিশেষ করে ১৯৫৭ সালের ছবি ‘স্নো কুইন’ এর উল্লেখ করেছেন। ওঁর প্রথম কাজের ক্ষেত্র মাঙ্গা’তে আর্টিস্ট হিসেবে তিনি পাশ্চাত্যের ছায়া সম্পূর্ণভাবে কাটিয়ে পুরোপুরি দেশীয় রীতিতে চরিত্রদের আঁকা বিশেষত: তাদের মুখের ভঙ্গীতে আবেগের প্রকাশ করেছেন। মাঙ্গা আকার এই পদ্ধতিকে ‘গেকিগা’ বলা হয়। নওসিকা ছায়াছবিটাও আসলে মিয়াজাকির একই নামের মাঙ্গার ওপর ভিত্তি করে তৈরি হয়। চরিত্রের মুখভঙ্গিতে আবেগের এই সূক্ষ্ম প্রকাশ ঝিবড়ির অন্যতম বৈশিষ্ট্য। যার সঙ্গে পাশ্চাত্য অ্যানিমেশনের জাঁকজমক প্রকাশের অনেকটাই পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। ওয়েস্টার্ন অ্যানিমেশনের একমাত্রিক কালো সাদার দ্বন্দ্বের বদলে এই অ্যানিমেগুলোতে যে চরিত্ররা বারবার আসে তারা আমাদেরই চারিপাশের মানুষ। তাই যেন স্বাভাবিক মানবিক গুন আর খামতি নিয়ে গড়া। অ্যানিমে ছায়াছবিতে মানবিক এই আবহটাকে প্রকাশ করার জন্য আর যে মানুষটার অবদান অনস্বীকার্য তিনি হলেন সুরকার জো হিসাইশি (আসল নাম মামোরু ফুজিসাওয়া)। স্টুডিও ঝিবড়ির ছবির একটা অন্যতম উপাদান তার আবহ সংগীতে বারবার এই মানবিক আবেদন সাংগীতিক অভিঘাতে প্রকাশ করেছে হিসাইশির অসামান্য সুরগুলো।
ছবির আবহ সংগীত গ্রহণের মুহূর্তে জো হিসাইশি এবং বাদ্যযন্ত্রীরা
স্টুডিও ঝিবড়ির কর্তারা পাশ্চাত্যে এবং বিশেষ করে হলিউডে তাদের ছবির মুক্তি এবং বিপণনের ক্ষেত্রে ‘নো এডিট’ পলিসিতে বিশ্বাসী। আসলে ‘নওসিকা’ ছবির ক্ষেত্রে যেভাবে হলিউডের মুনাফা-লোভী স্টুডিও সিস্টেম ছবিটাকে কেটে ছোট করে তার ভেতরের জাপানী কৃষ্টির নির্যাসকে প্রায় ছেঁটে ফেলেছিল সেখান থেকেই এই শিক্ষা নেয়া। এই নিয়ে একটা মজার গল্প আছে। মিরাম্যাক্সের এক কর্তা হার্ভে ওয়েনস্টাইন এক সময় স্টুডিও ঝিবড়ির অন্যতম শ্রেষ্ঠ কাজ ‘প্রিন্সেস মনোনোকে’ ছায়াছবিকে কিছুটা সম্পাদনার করে হলিউডে রিলিজের প্রস্তাব রাখেন। আসলে ছবিটা বিপণনের ক্ষেত্রে আমেরিকান দর্শকদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা বাড়াবার জন্য তার এই প্রস্তাব ছিল। যাহোক এর উত্তরে নাকি ঝিবড়ির এক প্রযোজক তাকে একটা লেখা নোট পাঠিয়েছিলেন যাতে উদ্যত তরোয়াল হাতে এক সামুরাই’এর ছবি ছিল যার নিচে লেখা ‘নো কাট’।
তাঁর গড়া চরিত্রদের সাথে এক ফ্রেমে স্বপ্ন গড়ার প্রধান কারিগর – হায়াও মিয়াজাকি
এইভাবে বারবার অ্যানিমের মধ্যে দিয়ে অনবদ্য ভঙ্গিতে মানবিক সম্পর্কের গল্প বলার চেষ্টা করে গেছে স্টুডিও ঝিবড়ির থেকে বেরোনো ছায়াছবিগুলো। এই প্রবন্ধের সীমিত পরিসরে প্রবন্ধকারের ব্যক্তিগত পছন্দের বারোটা ছবির উল্লেখ করে এই আলোচনা শেষ করব আপাতত।
১) লাপুতা – ক্যাসল ইন দ্য স্কাই (১৯৮৬),
২) গ্রেভ অফ্ দ্য ফায়ারফ্লাইস (১৯৮৮),
৩) মাই নেইবর তোতোরো (১৯৮৮),
8) কিকিস্ ডেলিভারি সার্ভিস (১৯৮৯),
৫) হুইস্পার অফ্ দ্য হার্ট (১৯৯৫),
৬) প্রিন্সেস মনোনোকে (১৯৯৭),
৭) স্পিরিটেড অ্যাওয়ে (২০০১),
৮) মিলেনিয়াম অ্যাকট্রেস (২০০১),
৯) টেলস্ ফ্রম আর্থ সী (২০০৬),
১০) পোনিও (২০০৮),
১১) দ্য সিক্রেট ওয়র্ল্ড অফ্ অ্যারিয়েটি (২০১১) এবং
১২) দ্য টেল অফ্ দ্য প্রিন্সেস কাগুইয়া (২০১৩)
স্টুডিও ঝিবড়ি’র মিউজিয়াম
Tags: এক কল্প দুনিয়ার গ্রিনরুম, দ্বিতীয় বর্ষ প্রথম সংখ্যা, প্রচ্ছদ কাহিনি, সন্দীপন গঙ্গোপাধ্যায়, সুপ্রিয় দাস