এখনও বৃষ্টি হয়!
লেখক: দিগন্ত ভট্টাচার্য
শিল্পী: সুপ্রিয় দাস
কুণাল তাঁর চশমাটা খুললেন। মাঝে মাঝেই ঝাপসা হয়ে আসে কাচ। অনেকসময়ই বিশেষ কোনও কারণ ছাড়াই। অন্যমনস্কভাবে হাত লাগিয়ে ফেলেন, তারপর বিরক্তিকর কাচ পরিষ্কার! চশমা খুলে পরতে গিয়েও ছোঁয়া লেগে যায়, অনবধানতার ফলে। একই কাজ করতে হয় আবার। কখনো কখনো এমনিই ধোঁয়া মত হয়ে যায়, বোধহয় শরীরের নিজস্ব আর্দ্রভাব সেটার জন্য দায়ী। আগে আগে খারাপ লাগত খুব, সময় নষ্ট হচ্ছে বলে। এখন আর হয় না। কুণাল লক্ষ্য করেছেন একই কাজ বারবার, অনেকদিন করলে সেটার মধ্যে একটা যান্ত্রিকতা চলে আসে, অথচ কাজটা করার সময় অন্যান্য চিন্তা কেমন যেন হারিয়ে যায়, ওই কাজটার মধ্যেই যাবতীয় মনোযোগ নিহিত থাকে। অনেকের ক্ষেত্রে সিগারেট ধরাবার সময়, বা গ্লাসে মদ ঢালার সময় এই ব্যাপারটা তিনি খেয়াল করেছেন। না, করেছিলেন। ছিলেন হবে। কুণাল নিজেকে সংশোধন করলেন। এসব কাজ করতে তিনি বহুকাল কাউকে দেখেননি। অনেকদিন হয়ে গেল কি? বছর? মাস, নাকি কয়েকটা সপ্তাহ? তিনি আর বুঝতে পারেন না। ঘড়ির দিকে তাকানো একটা অভ্যাসের ব্যাপার; নিজের কম্যুনিকেটর এ, বিশেষ অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে সাজ–গোজ করলে কব্জির দিকে, পি সি তে খেয়াল হলেই, আর কোনও জায়গায় থাকলে দেওয়ালের দিকে একবার ক্ষণেকের জন্য তাকিয়ে সময় দেখে নেওয়াটা একটা প্রতিবর্তের জায়গায় চলে গিয়েছিল, সকলেরই তাই। কুণাল নিজের জীবনের প্রতিটা মুহূর্ত ঘন্টা–মিনিটের ছকে ফেলে চলতেন। তাঁর বাবা তাঁকে শিখিয়েছিলেন সময় মেনে এবং মেপে চলা জীবনে সাফল্যলাভের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ ও প্রয়োজনীয় শিক্ষা। সাফল্য এসেওছে। না, ছিল। এসেছিল। রাজ্যস্তরে চোখ ধাঁধানো ফল করে আই আই টি থেকে বায়োটেক –এ এম টেক আর তার পর স্ট্যানফোর্ড থেকে এম এস সুদ্ধ পি এইচ ডি আর হার্ভার্ড থেকে পোস্ট–ডক; উন্নতির শ্রমসাধ্য সোপান তাঁর কাছে প্রশস্ত অ্যাশফল্ট –এর রাস্তা হয়ে দাঁড়িয়েছিল যা দিয়ে তিনি নিজের ফেরারি দাবড়াচ্ছিলেন। নোভারটিস আর ফাইজার দুই কোম্পানিই খাবি–খাওয়ার মতো প্যাকেজ অফার করে এবং সাত–পাঁচ ভেবে কুণাল সুইজারল্যান্ডে কিছুকাল কাটানোর সিদ্ধান্ত নেন এবং নোভারটিস-এ জয়েন করেন। অফিসের প্রথমদিনেই একবাক্স সুইস চকোলেট উপহার পেয়েছিলেন তাঁর ফ্লোরের কোলিগ দের তরফ থেকে। নিখুঁত ভাবে প্যাকেট করা বাক্সটা হাতে তুলে দিয়েছিল ক্লারা। ক্লারা ব্লেয়ার, ইনভারনেস, স্কটল্যান্ডের মেয়ে। এই ক্লারা, কতদিন পর, সেন্ট গ্যালেনের একটা লেকের ধারে পা ডুবিয়ে তাঁর কাঁধে মাথা রেখে ওর অদ্ভুত, মাদকতাময় স্কটিশ টানের ইংরিজিতে বুঝিয়েছিল যে তার বাড়ি যেমন ইনভারনেস–এ, যেখানে ম্যাকবেথ এর প্রাসাদ ছিল, তেমনি ব্লেয়ার শব্দটার একটা মানে হল যুদ্ধক্ষেত্র। কুণালের বিস্মিত চোখের দিকে তাকিয়ে ক্লারা খিলখিল করে হেসে উঠেছিল।
না, হাসির শব্দ নয়। জল পড়ছে। মগটা ভর্তি হয়ে গেছে।কুণাল নিজের শরীরটাকে ট্যাপের কাছে টেনে নিয়ে গেলেন। একটা হাসির শব্দের বিনিময়ে এখন তিনি নিজের প্রত্যেকটা কার্যকরী প্রত্যঙ্গ দান করতে পারেন। তবে সেই হাসির আওয়াজ আসতে হবে একটা রক্তমাংসের মুখ থেকে। কোনও রেকর্ডিং থেকে নয়। সিঙ্কের ওপরে জানালার মতো ওপেনিং টার দিকে তাকালেন তিনি। এই ঘরটা মাটির নীচে হলেও ওপরে বাগানে কেউ দাঁড়িয়ে থাকলে ওই জানলাটা ঠিক তার পা–বরাবর পড়বে। বোধহয় সূর্যের আলো কিছুটা আসার জন্য এমনটা করা হয়েছিল। ওপেনিংটা অনেকটাই ওপরে, তবে ঘষা কাচ ভেদ করে বাইরের মরা আলো কিছুটা আসে। অন্তত সকাল কি দুপুর কি রাত সেটা বোঝা যায়। তারও কোনও দরকার নেই অবশ্য। নিজেকে মাঝে–মধ্যেই এটা বোঝান কুণাল। এটাই সবথেকে কঠিন কাজ। হতাশা শব্দটার নতুন নতুন সংজ্ঞার্থ তিনি কতদিন ধরে উপলব্ধি করে চলেছেন, নিজের অস্থি–মজ্জা, প্রতিটা রক্তকণিকা দিয়ে তিনি প্রতি মুহূর্তে বোধ করেছেন টিকে থাকার অর্থহীনতা, সুবিপুল অপরাধবোধের গ্লানি তাঁর অন্তহীন; তিনি আর এমনটা বোধ করেননা যে তিনি এক নির্জন পথ হেঁটে চলেছেন যার শেষে এক বিকট, অনতিক্রম্য গহ্বর অতন্দ্র অপেক্ষায়, তাঁর মনে হয় এখন যে তিনি নিজেই সেই গহ্বরে পরিণত হয়েছেন। সেই কৃষ্ণগহ্বর যা তার চারিদিকের সমস্তকিছু গিলে খাওয়ার পরে নিজের মধ্যে নিজেই আপতিত হবে, দুমড়ে–মুচড়ে বিলীন হয়ে যাবে নিঃসীম শূন্যতায় যেখানে তার আগেকার অস্তিত্বের ছিটেফোঁটা বোঝা যাবে না। পার্থক্য একটাই, কোনও কোনও মহাকাশীয় কৃষ্ণগহ্বর শেষ সময়ে কখনো কখনো বিপুলকায় এক বিস্ফোরণের সম্ভাবনা তৈরী করে যায়, তার অন্তিমকালের মহাবিস্ফোরণের বিকিরিত আলোয় সে একটি সমগ্র তারকাপুঞ্জের সমপরিমাণ ঔজ্জ্বল্য সৃষ্টি করার প্রয়াস করে। কিন্তু এক্ষেত্রে সেটা ঘটবে না। তাঁর অন্তিমসময় হয়ে উঠবে না স্বপ্রভ, কেউ পাশেও থাকবে না, কোনও চেতনা ও বোধশক্তিসম্পন্ন অস্তিত্বের কাছে তিনি শেষ মুহূর্ত টুকুতেও ক্ষমাভিক্ষা করতে পারবেন না। এর থেকে বড় শাস্তি আর কি–ই বা হতে পারত? ভীমকায়, দৈত্যাকৃতি এক লোহার সিন্দুকের মধ্যেকার মৃত্যুর চেয়েও ভয়াবহ নীরবতা তাঁর জীবনের সঙ্গী এখন। জীবন? কুণালের ঠোঁটের কোণে নিজেরই অজান্তে এক বিমর্ষ হাসি আসে। হ্যাঁ, জৈবনিক দিক থেকে তিনি বেঁচে, অবশ্যই। কিন্তু আরও ভয়াবহ শব্দহীনতায় এটাও শেষ হবে। নট উইথ আ ব্যাং, বাট উইথ আ হুইম্পার। সেটা বোধ, জ্ঞান ও সার্বিক প্রাণহীনতার এমনতর এক চূড়ান্ত ও ঘনীভূত রূপ যে এলিয়ট অবধি তা কল্পনা করেননি। শূণ্যদৃষ্টিতে বেশ কিছুক্ষণ সিঙ্কের সামনে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকার পর তিনি নিজের টার্মিনালের সামনে আবার ফিরে এলেন। আরও একটা সিম্যুলেশন। বিগত ছেচল্লিশটার মত এই সিম্যুলেশন টার ব্যর্থতার সম্ভাবনাও পঁচাশি শতাংশের বেশী। কিন্তু আর কি–ই বা তিনি করতে পারেন ক্রমাগত চেষ্টা করে যাওয়া ছাড়া?
আইফিনিটি–সমন্বিত টার্মিনালের নীলাভ আলো তাঁর মুখে পড়ল। দূরবর্তী আয়নাতে নিজের যে প্রতিবিম্ব পড়ছে তাতে নিজেকে কোনও অপার্থিব ক্ষমতার অধিকারী ভিনগ্রহী অথবা উইজার্ড মনে হচ্ছে তাঁর। বিজ্ঞানী মানেই কি তাই নয়? সেই কিশোরকালে টোলকিয়েনের সাথে প্রথম পরিচয়ে গ্যানড্যাল্ফ তাঁকে যখন বিস্ময়বিমুগ্ধ করে ফেলেছিল এবং বাবার সাথে বিনিময় করেছিলেন সেই মুগ্ধতা, বাবা–ই তখন কল্পনার, বাস্তবতার সীমা অতিক্রম করে বিপুল, বিরাট কিছু তৈরী করে ফেলার সম্ভাব্যতার বীজ প্রথম বপন করেছিলেন। পরবর্তীতে হার্ভার্ডে তাঁর সুপারভাইজার ছিলেন ডঃ ফ্ল্যাহার্টি; এমন এক মানুষ যিনি কোনোদিন নৈরাশ্যবাদ কে ধারে–কাছে ঘেঁষতেও দিতেন না। তিনি বলেছিলেন, এখনও কুণালের মনে আছে, “মেক সায়েন্স আ টুল অফ এক্সপ্রেসিং ইয়োর ইম্যাজিনেশন!” কি সুন্দর কথা! ডঃ ফ্ল্যাহার্টি নিশ্চয়ই বেঁচে নেই আর। মৃত্যুর আগে তিনি কি একবারও ভেবেছিলেন তাঁর প্রিয় অ্যাপ্রেন্টিস কি দুর্দান্তভাবে নিজের ইম্যাজিনেশন কে প্রকাশ করেছে? সার্বিক ধ্বংসের কল্পনা! ইম্যাজিনেশন অফ অ্যাপোক্যালিপস! মানবসভ্যতা সৃষ্টির প্রাথমিকতম মুহূর্তটি থেকে কেউই এই কাজ করে ফেলতে পারেনি এত নিখুঁত ভাবে। তিনি একটা গোটা গ্রহের সভ্যতা ধ্বংস করেছেন! অহো, কি সুমহান অ্যাচিভমেন্ট! দুর্বল আঙ্গুলে নিজের হাঁটু খামচে ধরলেন তিনি, প্যান্টের কাপড়ের ওপর দিয়েও নখ বসে গেল তাঁর। কি রকম নির্লজ্জ তিনি! মনের গভীরতম কোণে এখনও কি একটু অহঙ্কার লুকিয়ে নেই তাঁর? এক কুষ্ঠরোগাক্রান্ত বিকটদর্শন অর্ধগলিত ঠোঁটের কোনে ঝুলে–থাকা হাসির মত নিজের ইগো–কে দেখতে পেলেন তিনি। বাঘ যেমন করে ঘাড় বাঁকিয়ে নিজের ক্ষত চেটে–চেটে পরিষ্কার করে, ঠিক তেমন করে তিনি নিজের আর একটা সত্তা–কে দেখতে পেলেন ঝুপসি আলো–আঁধারিতে, বছরখানেক আগেকার এক আঘাতের যন্ত্রণা প্রশমনের জন্য, এখনও আত্মলেহনে রত। যথেষ্ট প্রতিশোধ কি নেওয়া হয় নি সেই সন্ধ্যার?
খুবই ছোট একটা ঘটনার মধ্যে দিয়ে এ সর্বনাশের শুরু হয়েছিল। যে কোনও বিরাট কিছুর শুরুই বোধহয় হয় অত্যন্ত সামান্য কিছু থেকে, এবং সেখান থেকেই সম্ভবত বাটারফ্লাই এফেক্টের তত্ত্বের অবতারণা। সেদিন সন্ধ্যায় লিওন গ্রিল–এ ক্লারার সাথে ফাইন ডাইনিং এর কথা ছিল, এবং যথাসময়ে তিনি চলেও গেছিলেন এটা জেনেই যে অর্ডার নিয়ে কিছু খিটিমিটি হবে কারণ খাবারে চর্বির পরিমাণ নিয়ে ক্লারার অনেকরকম ঝামেলা–টামেলা আছে। কুণাল মাঝে–মধ্যে ইচ্ছে করে কিছু রাগিয়েও দিতেন; রেগে গেলে ক্লারার অদ্ভুত রকমের ফর্সা–গোলাপী কানের ডগাদুটো লালচে হয়ে যেত, মেয়েটা গুম হয়ে যেত হঠাৎ করে। ঠিক তখন কুণাল জোরে হেসে ফেলতেন, দু’হাত দিয়ে ওর মুখখানি ধরে চোখের দিকে তাকাতেন। ক্লারা ফিক করে হেসে ফেলত, ওর রাগ বেশীক্ষণ থাকত না। সেদিন কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পরেও ক্লারা না আসায় তিনি একবার রিং করলেন। বেশ কিছুক্ষণ এনগেজড টোন পেয়ে কিছুটা দ্বিধান্বিত হয়ে পড়েছিলেন, এমন সময় ক্লারাকে আসতে দেখলেন, কিন্তু একা নয়। কাঁধ পর্যন্ত ছড়ানো সোনালী চুলের, ব্রাউন রং এর একটা ফিনফিনে ফ্রেমের চশমা পরা মডেল–মডেল দেখতে একটা ছেলেও তার সাথে। ক্লারা আলাপ করিয়ে দিল, ম্যাথু প্রিচার্ড, ভাইরোলজি নিয়ে সেন্ট গ্যালেনেই পোস্ট ডক করছে। ওদের আলাপ অনেকটাই দেশোয়ালী, এবং এ পর্যন্ত সবই ঠিক ছিল, কিন্তু আকস্মিক ভাবেই ক্লারা হাসিমুখে বলল, “ইয়ু নো হোয়াট কুণাল? হি ওয়জ মাই ফার্স্ট ক্রাশ!” তিনি রীতিমত অস্বস্তিতে পড়েছিলেন এটা বুঝেও যে তাঁর কাছে এটা সংবাদ হলেও ম্যাথুর কাছে সেটা নিশ্চয়ই নয় কারণ সে হাসছিল। এমনিতেই আকর্ষণীয়, কিন্তু হাসলে ছেলেটাকে প্রচন্ড হ্যান্ডসাম লাগে। ক্লারা কি মুগ্ধ দৃষ্টিতে ওর দিকেই তাকিয়ে আছে? নাকি আড় চোখে বারে বারে চাইছে? কুণাল জীবনে প্রথম বার একটা অসম্ভব শক্তিশালী অনুভূতির স্বাদ পেলেন। ঈর্ষা। কি প্রবলভাবেই তিনি চাইছিলেন সন্ধেটা ক্লারার সাথে কাটাতে, দুজনে, সুন্দর একটা ডিনার করে, একে অপরের কাঁধে মাথা রেখে, শিরশিরে হাওয়ায় লেকের জলে চাঁদের প্রতিবিম্ব দেখতে–দেখতে। কিন্তু সেটা আর হবে না। ম্যাথু বেশ গুছিয়েই বসেছে, তার ব্যাকপ্যাক থেকে ট্যাবলেট বের করে কি সব দেখাচ্ছে, ক্লারা তাঁর দিকে দেখছেও না। ওদের দ্রুতলয়ে বলে–যাওয়া স্কটিশ ইংরাজীর প্রায় কিছুই ধরতে পারছিলেন না কুণাল; তিনি মৃদুস্বরে “এক্সকিজ মি” বলে উঠলেন একবার ওয়াশরুম যাওয়ার জন্য। চোখে–মুখে একটু জল দিয়ে ওয়াশরুমের দরজার কাছে এসে নিজের টেবিলের দিকে তাকালেন তিনি। ক্লারা বোধহয় খেয়ালও করেনি তিনি আর নেই। সে ম্যাথুর চোখের দিকে সরাসরি তাকিয়ে আছে গভীর মনোযোগের সাথে, আর ছেলেটা হাত–টাত নেড়ে কিছু বোঝাচ্ছে। দু’জন সোনালী–চুল আর নীল চোখ ওয়ালা শ্বেতাঙ্গ–শ্বেতাঙ্গিনী বসে গল্প করে যাচ্ছে; এটাই কত সুন্দর একটা ছবি না? এদের মধ্যে বাদামী রং–কালো চুল–কালো চোখের মণির তিনি কেন অনাবশ্যকভাবে ঢুকতে যাবেন? ক্লারা কি এতদিন পর নিজের ভুল বুঝতে পেরেছে তাহলে? তাঁর পেটের মধ্যে একটা অদ্ভুত পাক–খাওয়া অনুভূতি হল। নাহ্, এত সহজে তিনি তাঁর জীবনের একমাত্র প্রেম চলে যেতে দেবেন না! ক্লারা–কে ছাড়া কোনও ভবিষ্যৎ তিনি কল্পনাই করতে পারেন না! তাঁর ভেতরে একটা অদ্ভুত আক্রোশ জমে উঠছিল, এমন একটা অনুভূতি যার অভিজ্ঞতা তাঁর এর আগেকখনো হয় নি। হতাশা, রাগ, ঘৃণা, বিরক্তি, এবং বিরক্তির এক অনাস্বাদিত সংমিশ্রণ। ঈর্ষা? এটাকেই কি ঈর্ষা বলে? তাঁর অ্যাদ্দিন পর্যন্ত সাফল্যের সিঁড়ি অনায়াস দক্ষতায় চড়া দেখে অন্যদের মধ্যেও কি ঠিক এই অনুভূতিটাই এসেছে? তিনি এসমস্ত ভাবছিলেন, এমন সময় ক্লারার নজর তাঁর দিকে পড়ল। তার হাসি তাঁর ভেতরের মালিন্য আপাতত দূর করে দিল, নিজেকে সামান্য তিরস্কার করে তিনি রুমালে হাত–মুখ মুছতে–মুছতে টেবিলে ফিরলেন। ম্যাথু আসলেই বেশ বহুমুখী প্রতিভাসম্পন্ন ছেলে, সে স্কলার হয়েও চেলো বাজাতে পারে, মাউন্টেনিয়ারিং জানে, দুর্দান্ত দাবা খেলে, ভালো রান্না করতে পারে, এবং কাব্যি–টাব্যি লেখে। তার সাথে আলোচনার বিষয় কখনোই কম পড়ার সম্ভাবনা নেই, বিভিন্ন বিষয়েই তার অসীম কৌতূহল এবং প্রচুর প্রশ্ন, যার অধিকাংশের উত্তরই তার নিজের জানা। ভারত এবং কলকাতা নিয়ে প্রশ্ন করে সে কুণালকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলল। তিনি ধীরে ধীরে একটু অধৈর্য্য হয়ে পড়ছিলেন, এমন সময় ক্লারা ম্যাথুকে পরামর্শ দিল নোভারটিস–এ রেসিডেন্ট সায়েন্টিস্ট হিসাবে যোগ দিতে। কুণাল কাষ্ঠ হেসে প্রস্তাব সমর্থন করলেও ভেতরের জ্বালাটা দিব্যি টের পাচ্ছিলেন।
এর পরের কয়েক মাসে কুণাল তাঁর পরিস্থিতি, এবং ওই স্কটিশ ছেলেটাকে ঘৃণা করতে আরম্ভ করলেন। তিক্ত, আমৃত্যু ঘৃণা। ক্লারার সাথে তাঁর একাকী সময়যাপন, তিনি লক্ষ্য করলেন, প্রায় ৯০ শতাংশ কমে গেল আকস্মিকভাবে। ক্লারার ফোনে তিনি অধিকাংশ সময় তিনি বিজি টোন পেতে আরম্ভ করলেন, তাঁদের সান্ধ্য ভ্রমণ এবং খাওয়া–দাওয়া আর তাঁদের দুজনের রইল না যেহেতু ম্যাথু যোগ দিতে আরম্ভ করল, সেক্ষেত্রেও দুজনে টানা কথা বলে যেত; ম্যাথু নাকি ক্র্যাশ কোর্সে এম.বি.এ. করবে, সেখানে ক্লারা তার পথপ্রদর্শক যেহেতু সে–ই এই প্ল্যানটা তাকে দিয়েছে। যেটুকু সময় কুণাল একলা পেতেন, ক্লারা ম্যাথু–কে নিয়ে তখনও কথা বলে যেত। বলেই যেত। কুণাল চেষ্টা করেছেন, ভদ্রলোকের মতোই, মেয়েটার অনুভূতির কোনও পরিবর্তন হয়েছে কি–না সেটা পরিমাপ করতে। ক্লারা যদি মনে করে সে ম্যাথুর সাথেই সুখী, তিনি সরে যাবেন। নিজেকে খলনায়ক হিসেবে ভাবতে তাঁর মোটেই ভালো লাগার কথাও নয়।
একদিন কথাটা তিনি ক্লারাকে বলেই ফেললেন। তিনি এ–ও জানিয়ে দিলেন যে এই সম্পর্ক ভেঙ্গে গেলে তিনি কোম্পানী ছেড়ে দেবেন। ক্লারা আর তার ভবিষ্যৎ প্রেমিকের সাথে একই কনসার্ন–এ কাজ করার কথা তিনি ভাবতেও পারেন না। কিন্তু যতই তিনি ব্যাপারটা নিয়ে উদার হওয়ার চেষ্টা করুন না কেন, তাঁর মনের গভীরে কোনও সুপ্ত আশা নিশ্চয়ই ছিল। তিনি শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত আস্থা রেখেছিলেন তাঁর প্রতি ক্লারার এতদিন পর্যন্ত বারবার স্বীকার করে আসা ভালোবাসার ওপর। নিজের মানসিক দৃঢ়তা নিয়ে এযাবৎ গর্ব করে আসা কুণালের মনে হচ্ছিল তাঁর চারপাশের জগতটা ভেঙ্গে টুকরো–টুকরো হয়ে যাচ্ছে যখন ক্লারা মুখ অন্যদিকে করে শান্ত ভাবেই জানাল যে তাঁদের কয়েকদিন একটু দূরত্ব বজায় রাখাই দরকার কেননা সে নিজের অনুভূতিগুলি আর একবার খুঁজে দেখতে চায়। আত্মানুসন্ধান। অত্যন্ত মানবিক এবং ভদ্রভাবে সম্পর্ক ভেঙ্গে ফেলার এটাই যে প্রতিষ্ঠিত পদ্ধতি, সে বিষয়ে কুণালের কোনোই সন্দেহ ছিল না। মুখে ফ্যাকাসে হাসি ফুটিয়ে ‘অফ কোর্স’ বলে ক্লারার কাঁধে একবার হাত রেখে অ্যাপার্টমেন্টে ফিরে এসে বড় হওয়ার পরে জীবনে প্রথমবার ফুঁপিয়ে–ফুঁপিয়ে কেঁদেছিলেন তিনি। নিজেকে পাগল–পাগল লাগছিল। ল্যাপটপে চাকরি ছাড়ার দরখাস্ত লিখতে বসেও সেটা করে উঠতে পারছিলেন না তিনি। মাথায় কোনও অর্থবহ বাক্যই আসছিল না। পরপর দিন চারেক অফিস গেলেন না তিনি। ফোনে নিজেকে অসুস্থ বলে জানালেন। দ্বিতীয় দিন রাতে ক্লারা একবার ফোন করেছিল। তিনি কলটা নিলেন না। ওর মধ্যে যদি বিন্দুমাত্র আবেগ অবশিষ্ট থাকত তাহলে একটিবার দেখতে অন্তত আসত। পাঁচদিনের মাথায় যেদিন অফিস গেলেন তিনি, তার আগে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন যে দেশে ফিরে যাবেন। চুলোয় যাক ডলার–ইউরোতে পে প্যাকেজ। তিনি এটাও ঠিক করেছিলেন যে যাওয়ার আগে আর একবার ক্লারার সাথে একান্তে কিছু কথা বলে যাবেন। কিন্তু অফিসে পৌঁছে তাঁর একটু অন্যরকম অভিজ্ঞতা হল। সহকর্মীদের মুখে চিন্তার বা সমবেদনার নয়, বরং অন্যের বিড়ম্বনায় যে বেশ উপভোগ্য মজা পাওয়া যায় তার ছাপ, এবং দেশে ফেরার কারণ দেখিয়েও যখন কুণাল রেজিগনেশনের বিষয় তুলতে গেলেন, ডেপুটি ডিরেক্টর তাঁকে বোঝানোর চেষ্টা করলেন যে ‘এইসব ব্যাপারে’ আবেগতাড়িত হয়ে এতটা গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া বুদ্ধিমানের কাজ নয়। এই সমস্ত কিছুর মধ্যে পড়ে কুণাল বেশ বুঝতে পারছিলেন যে তাঁর সযত্ন–লালিত স্বপ্নটা এখন সকলের কাছে মজা করার, পরচর্চার একটা বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কুণালের জ্বালাটা আবার ফিরে আসছিল, আর সেটা একটু একটু করে একটা বন্য রাগে পরিণত হচ্ছিল।
এ পর্যন্তও ঠিক ছিল। কিন্তু একটা ছোট্ট ঘটনা। নাকি ছোট্ট ছোট্ট মুহূর্ত? স্নিপেটস অ্যান্ড কনসিকোয়েন্সেস। বাটারফ্লাই এফেক্টের কথা কতবার ভেবেছেন কুণাল এই ল্যাবের মধ্যে বসে। এতদিন হয়ে গেল। কতবার আত্মহত্যা করতে গিয়েও পারেননি। বুঝেছেন, এইভাবে বেঁচে থাকাটাই তাঁর চূড়ান্ত শাস্তি। বাইরে কি মেঘ করেছে? নাকি সন্ধ্যা নেমে এল? কি যায়–আসে? মোটা, নাইন এম এম এর বুলেট সহ্য করতে পারে এমন ঘষা কাচটার দিকে আবার সতৃষ্ণভাবে তাকালেন তিনি। কতবার চেয়ারের ওপরে চেয়ার চড়িয়ে ওটা দিয়ে বাইরে দেখার চেষ্টা করেছেন তিনি। কিচ্ছু দেখা যায় না। কিচ্ছু না। ল্যাবের এই দিকটা এমনিতেই ফাঁকা। ঘষা কাঁচ না থাকলে বড়জোর দেওয়াল দেখা যেত দূরে। ভেঙ্গে ফেলবেন কাঁচটা? তাও কতবার ভেবেছেন, তারপর নিজেই শিউরে উঠেছেন। বাইরে কি আছে তা তাঁর থেকে ভালো আর কে জানে! ফ্রাঙ্কেন্সটাইনের তৈরী দানব অন্তত সৃষ্টিকর্তাকে চিনত, তার মধ্যে মানবিক বোধ ছিল। কুণালের সৃষ্টি আলাদা। তারা কাউকে চেনে না। তারা চেনে শুধু নিজেদের, নিজেদের বংশবিস্তার আর অভিযোজন। এসব কি ঘটত যদি তিনি রেজিগনেশন জমা দেওয়ার সময় আর একবার ভেবে দেখার অনুরোধ পেয়ে একটু ফাঁকা জায়গায় গিয়ে চোখে–মুখে একটু জল নেবেন বলে ফেসিলিটির একদম পশ্চিমপ্রান্তে না যেতেন, এবং একটা অপেক্ষাকৃত জনহীন করিডোর দিয়ে এগোতে এগোতে খিলখিল হাসির শব্দে চমকে উঠে সেদিকে চোখ না ফেলতেন, এবং একটা বন্ধ–হয়ে–থাকা সেমিনার রুমের সামনে ক্লারা আর ম্যাথু–কে আলিঙ্গনাবদ্ধ অবস্থায় না দেখতেন! সেকেন্ডের ভগ্নাংশেই সেই অভাবিতপূর্ব, ভয়ানক ঘটনাটা ঘটেছিল। তিনি মানুষটা আকস্মিকভাবেই পালটে গিয়েছিলেন। পাশে কোনও মানুষের উপস্থিতি টের পেয়ে দুটো ঠোঁট যখন বিযুক্ত হল এবং ক্লারার কিছুটা অপ্রতিভ চোখ যখন কুণালকে খুঁজে পেল আর তিনি একটা অস্ফুট, লজ্জিত ‘হাই’ শুনতে পেলেন, সেই কুণাল অন্য মানুষ। তাঁর সুতীব্র মানসিক যন্ত্রণা যা খ্যাপাটে রাগ হয়ে যেতে পারত, তা পরিবর্তিত হয়ে গেল অন্য কিছুতে এবং কুণাল নিজেকে একগাল হেসে ‘হাই’ বলতে শুনলেন। সেই অন্য কুণাল নিমেষেই ক্লারা আর ম্যাথুর বিড়ম্বনা হেসে–টেসে উড়িয়ে দিয়ে দুজনের কাঁধে হাত রেখে, তাদের অভিনন্দন জানিয়ে, অত্যন্ত ক্লিশে একটা শেক্সপীরিয় সনেটের লাইন আওড়ে, ফুল–কোর্স লাঞ্চের প্রমিস আদায় করে ধীরে–সুস্থে ডিডি–র অফিসে ফিরলেন, এবং সেখানেও কয়েক ছটাক হেসে নিজেকে সাময়িক বিভ্রান্তির শিকার দাবী করে তাঁর সামনেই পদত্যাগপত্র ছিঁড়ে ফেলে করমর্দন করে নিজের ওয়র্ক–স্টেশনে ফিরে এলেন। তিনি একটা বীভৎস, ভয়ানক, রাক্ষুসে ভাবনাকে নিয়ে খেলছিলেন।
কুণালের বিষয় ছিল রিকম্বিন্যান্ট ডিএনএ টেকনোলজি। এই ফীল্ডে কাটিং–এজ রিসার্চ বিভিন্ন জায়গাতেই চলছিল, এবং বায়োটেকনোলজি, মলিক্যুলার বায়োলজি এবং বায়োকেমিস্ট্রির সবথেকে দুঁদে স্কলাররা এই বিশেষ প্রক্রিয়াটির অনেকরকমের দুর্দান্ত বাস্তব ব্যবহার নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছিলেন। বিংশ শতাব্দী ফিজিক্সের ছিল অবশ্যই, কিন্তু একবিংশ শতক অবশ্যই বায়োলজির। কুণাল সেকথা গভীরভাবে বিশ্বাস করতেন। তিনি অ্যাস্পারজিলাস ফাঙ্গাই নিয়ে কাজ করছিলেন; এই জীনাসের অন্তর্গত অ্যাস্পারজিলাস ফিউমিগ্যাটাস একধরণের দুরারোগ্য ফুসফুসের অসুখ তৈরী করে, সেটাকে নিষ্ক্রিয় করার জন্য একধরণের বায়োকেমিক্যাল কম্পাউন্ড তৈরীর চেষ্টা করছিলেন যা মলিক্যুলার স্তরে গিয়ে ফাঙ্গাসটাকে নির্মূল করতে পারে। বিষয়টাকে তিনি গভীরভাবে ভালোবাসেন বলেই হোক অথবা নিজে ক্ষুরধার বুদ্ধিমান বলেই হোক, অনেকটাই এগিয়েছিলেন এবং মাইকোলজি ও ফাঙ্গাল ইনফেকশনের একজন আন্তর্জাতিক স্তরের কনসালট্যান্ট হিসেবে ধীরে ধীরে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করছিলেন। ক্লারার সাথে পরিচিত হওয়ার আগে পর্যন্ত কুণাল পড়াশোনার বাইরে অন্যকিছু প্রায় করতেনই না এবং ছত্রাক সম্পর্কে বিস্তর স্টাডির সাথে সাথে এই জীবটির টিকে থাকা, বংশবৃদ্ধি করা আর রোগ তৈরী করার কিছু অসম্ভব ক্ষমতা সম্বন্ধে তাঁর ভালো ধারণা তৈরী হয়েছিল। তিনি এটা বিলক্ষণ বুঝেছিলেন যে যেমন ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাসকে ওয়েপনাইজ করার, অর্থাৎ অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করার কথা ভাবা হয় বা করা হয়, ঠিক তেমনই ফাঙ্গাসকেও এইভাবে ওয়েপনাইজ করা যেতে পারে। কিছু ফাঙ্গাস বংশবিস্তার করে স্পোর–এর মাধ্যমে এবং সেটা বাতাসে ছড়ায়। ফলে জৈবনিকঅস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের এর কিছু ভয়ানক সুযোগ–সুবিধা আছে। ফাঙ্গাসের সবথেকে সহজ শিকার হচ্ছে সেইসব ব্যক্তি যাদের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কম, অথবা যারা কোনও রকমের অ্যান্টিবায়োটিক খাচ্ছে। কানাঘুষোয় কুণাল শুনেছিলেন একটা ইয়ুরোপীয় দেশ এমন ফাঙ্গাস ডেভেলপ করার কাজ হাতে নিয়েছে যা প্রথমে টার্গেট সাবজেক্ট এর শরীরে ইমিউনোডেফিশিয়েন্সি তৈরি করবে, এবং তার পর তার কোনও গুরুত্বপূর্ণ ইন্টারনাল সিস্টেমকে আক্রমণ করে অকেজো করে দেবে ব্যাপক বংশবিস্তারের মাধ্যমে। এই সূত্রে তিনি একটা অফার পেয়েছিলেন যেটা সঙ্গত কারণেই ফিরিয়ে দেন, কিন্তু বিপজ্জনক ফাঙ্গাল প্যাথোজেন–এর ওপরে তাঁর আগ্রহ এই সময় থেকেই বাড়তে থাকে এবং তিনি নিজস্বভাবে অ্যাস্পারজিলাস ফিউমিগ্যাটাস বা মিউকরমাইকোসিস–এর মতো আতঙ্কজনক ফাঙ্গাল এলিমেন্টস এর একটা ডেটাবেস তৈরী করতে আরম্ভ করেন। এই সবের মধ্যেই তাঁর ‘হাতে’ আসে করডাইসেপ্স জীনাসের কিছু নারকীয়, বীভৎস ফাঙ্গাল এন্টোমোপ্যাথোজেন। এন্টোমোপ্যাথোজেনিক ফাঙ্গাই হল এমন ফাঙ্গাই যা কীটপতঙ্গের পক্ষে মারাত্মক এবংএই শ্রেণীভুক্ত অনেক রকমের ফাঙ্গাইবহু বছর ধরেই কীটনাশক হিসেবে সফলভাবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে বিভিন্ন দেশে।এদের মধ্যে করডাইসেপস ইউনিল্যাটারালিস নামে একটি ফাঙ্গাস কুণালকে বিশেষভাবে আকৃষ্ট করেছিল। তার কারণ এই ফাঙ্গাসটির হোস্টকে, অর্থাৎ যাকে আক্রমণ করছে তাকে নিপুণ অথচ হিংস্রভাবে মেরে ফেলে নিজের বংশবিস্তার করার অনায়াস ক্ষমতা। ফাঙ্গাসটি প্রথমে কোনও একটি আরথ্রোপড এর সাথে নিজেকে সংযুক্ত করে। ধরা যাক একটি পিঁপড়ে। বেচারা পিঁপড়ের অজ্ঞাতসারেই তার মৃত্যু পরোয়ানা লেখা হয়ে যায় যখন তার বহিঃখোলক বা এক্সোস্কেলিটন–এর বিভিন্ন আণুবীক্ষণিক ফাটল দিয়ে ফাঙ্গাসের স্পোর ঢুকে পড়ে এবং হোস্টের মস্তিষ্ক এবং শ্বাসযন্ত্র আক্রমণ করে। হোস্টের খাদ্য চুরি করে ফাঙ্গাস তার শরীরের মধ্যেই মাইসেলিয়া বিস্তার করতে থাকে বা ‘বড়’ হতে থাকে যতক্ষণ না পর্যন্ত তার স্পোরুলেশন বা বংশবিস্তারের সময় না হয়।তারপর একটা নির্দিষ্ট সময়ে পিঁপড়েটিকে গাছে উঠতে দেখা যায়, যখন তার আচরণ সম্পূর্ণভাবে তার মস্তিষ্কের মধ্যে পূর্ণরূপে বিকশিত ফাঙ্গাসের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। সেই গাছে ওঠাই পিঁপড়েটির শেষ কাজ, কারণ তার ঠিক পরেই মস্তিষ্কের ভেতরে বেড়ে–ওঠা ফাঙ্গাস সেটিকে সম্পূর্ণ আত্মসাৎ করে এবং হোস্টকে হত্যা করে, আর তারপর দুর্ভাগা পিঁপড়েটির এক্সোস্কেলিটন ফাটিয়ে সেটি বেরিয়ে এসে বাতাসে স্পোর ছড়িয়ে দেয়, যার ফলে আশে–পাশের অন্যান্য পিঁপড়েও ওই ফাঙ্গাসের দ্বারা সংক্রামিত হয়। করডাইসেপস ইউনিল্যাটারালিসের এই ভয়ঙ্কর অথচ মোক্ষম পদ্ধতি কুণালকে বিস্মিত, আবিষ্ট করেছিল। রিকম্বিন্যান্ট ডিএনএ টেকনোলজির মাধ্যমে এই ফাঙ্গাসের ‘টার্গেট হোস্ট’ আরথ্রোপড–এর বাইরে, উন্নততর ফাইলাম–কে করে তোলা যায়–কি–না, তা নিয়ে কুণাল গভীর ভাবনাচিন্তা আরম্ভ করেছিলেন। কর্ডেট–ভারটিব্রেট হয়ে ম্যাম্যালিয়া পর্যন্ত আসা ভয়ানক কঠিন ব্যাপার কারণ ডিএনএ স্ট্রাকচার আর অ্যানাটমি তাৎপর্যপূর্ণভাবে পালটে যায়। তাঁর চিন্তাটা কোনও ভয়ানক, বিপজ্জনক দিকে বাঁক নিচ্ছিল সে সম্পর্কে তাঁর ধারণা একেবারে ছিলনা তা নয়, কিন্তু কৌতূহল আর নিজের ক্ষমতার সীমা পরখ করার খিদে বড়ই আগ্রাসী। কাজটাতে মূল সমস্যা ছিল দুটো। ম্যাম্যালিয়ান অর্থাৎ স্তন্যপায়ী গোষ্ঠীভুক্ত জীবদেহের ইমিউনোলজি অনেকটাই উন্নত। তারা বাইরের থেকে এসে–পড়া কোনও সংক্রমণ অনেক বেশী সাফল্যের সাথে মোকাবিলা করতে পারে। অর্থাৎ প্যাথোজেন–এর স্ট্রেইন কে অনেক বেশী শক্তিশালী করতে হবে। আর একটি বড় সমস্যা হল এমন একটা ভেক্টর প্রোক্যারিওটিক কোষ নির্বাচন করা, যা জেনেটিক্যালি এঞ্জিনিয়ারড ওই প্যাথোজেনটিকে বহন করে ব্যাপক সংক্রমণের জায়গায় নিয়ে যেতে পারে। দুটো সমস্যার মধ্যে আবার অনেক ক্ষুদ্রতর, কিন্তু সমধিক গোলমেলে সমস্যা আছে। কুণাল সমস্যাগুলোর সূক্ষ্মতর দিক নিয়ে নেহাত বৌদ্ধিক চ্যালেঞ্জ হিসেবেই মাথা ঘামাচ্ছিলেন যখন তিনি এই চাকরিটা পেয়েছিলেন আর ক্লারাকে নিয়ে এক মিথ্যা স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিলেন।
কুণাল একটু ঘুমিয়ে পড়েছিলেন বোধহয়। বিপ–বিপ আওয়াজে তাঁর সম্বিৎ ফিরে এল। আর একটা সিম্যুলেশন শেষ হল। প্রতিটা সিম্যুলেশন শেষ হতে প্রায় সাড়ে চার ঘন্টা লাগে। ঘোলাটে চোখে স্ক্রিনের দিকে তাকালেন তিনি। নেগেটিভ। এই নিয়ে সাতচল্লিশটা। প্রায় আড়াই মাস হয়ে গেল। এসব করে আর কোনও লাভ আছে আদৌ? যেভাবে এগোচ্ছে, যদি কোনও সিকোয়েন্স কাজ করেও যায়, তিনি যদি অমানুষিক পরিশ্রমও করেন, তাঁর একার পক্ষে সেটার অ্যানালিসিস করতে, সিন্থেসিস করতে এবং কয়েকটা ব্যবহারোপযোগী এয়ারবোর্ন অথবা ওয়াটারবোর্ন অ্যান্টি–ফাঙ্গাল কম্পাউন্ডের ভায়াল তৈরী করতে আরও অন্তত মাসখানেক লেগে যাবে। ততদিনে কিছুই কি থাকবে? কিছুই কি আর আছে? টিভিতে শেষ সম্প্রচার শুনেছিলেন প্রায় বারো দিন হয়ে গেল। রেডিও তারও আগে। এই মাটির তলার হারমেটিক্যালি সীলড পরীক্ষাগারে ক্ষীণতর এবং দূরবর্তী রেডিও সম্প্রচার শুনতে পাওয়া এমনিতেই অসম্ভব। তিনিই বা কি করছেন এখানে একা একা? যাবেন নাকি বেরিয়ে? একবার দেখবেন কেউ আছে কিনা? লাফ দিয়ে উঠে পড়লেন তিনি। অস্থির পায়ে স্টীলের মোটা দরজার গায়ে মাল্টিপল রেকগনিশন বোর্ডের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। এটা কি হচ্ছে! তিনি কি উন্মাদ হয়ে যাচ্ছেন? তিনি তো জানেন বাইরে কি আছে! সজোরে মাথা ঝাঁকিয়ে দু’হাতে মাথার চুল আঁকড়ে ধরে ট্যাপ খুলে তিনি জলের তলায় মাথা পেতে দিলেন। ঠান্ডা, ক্লোরিনেটেড জল তাঁর মাথায় পড়ছিল আওয়াজ করে আর তিনি কাঁদছিলেন, হাঁপাচ্ছিলেন। জিনিসপত্রে ঠাসা মাঝারি ঘরটাতে কোনও প্রতিধ্বনি হয়না বলে নিজের বিকৃত বিলাপ তাঁর নিজেরই কানে অদ্ভুত রকমের ফাঁপা ঠেকল। ধীর, কাঁপা আঙ্গুলে, বার বার এন্ট্রি ভুল করতে–করতে তিনি আটচল্লিশ নম্বর সিম্যুলেশন সেট করে ঘরের ডানপ্রান্তে রাখা একটা স্টীলের টেবল, যার ওপর থেকে অন্যান্য জিনিসপত্র সরিয়ে একটা বালিশ রেখে শোয়ার বন্দোবস্ত করা হয়েছে, তার ওপরে কুঁকড়ে শুয়ে পড়লেন দু’হাতে নিজের মাথাটা আঁকড়ে ধরে।
প্রায় সাত থেকে আট মাস মনের মধ্যে শয়তান লালন করেছিলেন তিনি। সর্পিল, পঙ্গিল কোনও দুর্গন্ধযুক্ত কদাকার সরীসৃপ জাতীয় কিছু যা তাঁর মনের মধ্যে, গভীরতম কোনও কোণে বাসা বেঁধে ছিল। তিনি ল্যাব কে ঘর মানিয়ে নিয়েছিলেন যেখানে টানা চোদ্দ–পনেরো ঘন্টা কাজ করতেন, আর নিজে কারো সাথে বিশেষ কথা বলতেন না বলে অন্যরাও এড়িয়েই চলেছিল। কুণাল তাঁর সময়–জায়গা এমনভাবে বেছে নিয়েছিলেন যে ক্লারা আর ম্যাথুর মুখোমুখি যেন না হতে হয়। পরিচিত কেউ সামনে এসে গেলে তিনি খুব হেসেই, অতি ভদ্রভাবে তার সাথে কথা বলতেন এবং কয়েক মিনিটের বেশী বাক্যব্যয় করতেননা। একদিক থেকে, তিনি একটা দ্বৈত ব্যক্তিত্বের মানুষ হয়ে উঠেছিলেন। শুধু ক্লারা বা ম্যাথু নয়, বিশ্বসংসারের প্রতি একটা তীব্র ঘৃণার বীজ তিনি রোপণ করেছিলেন যা ক্রমশই ডালপালা মেলে বিস্তৃত হয়ে চলেছিল। ভেতরের সুতীব্র প্রতিশোধস্পৃহা এবং জিঘাংসা কাউকেই বুঝতে দেননি তিনি। কি ঘটতে চলেছে সে সম্পর্কে তাঁর সম্যক ধারণা ছিল বলে নিজের ল্যাবটাতে ধীরে ধীরে, একটু একটু করে খাবার–দাবার জড়ো করছিলেন। অফিশিয়ালি তিনি অ্যাস্পারজিলোসিস এর অ্যান্টিফাঙ্গাল ট্রিটমেন্ট তৈরী করছিলেন একটা অসম্ভব ডেডলাইন নিয়ে, কাজেই ডিডি এসবের মধ্যে কোনোই সমস্যাও খুঁজে পাননি। কিন্তু আসলে তিনি করছিলেন অন্যকিছু।
করডাইসেপস ইউনিল্যাটারালিসের ডিএনএ স্ট্র্যান্ড কেটে, তিনি সেটাকে সংযুক্ত করেছিলেন স্ট্যাফাইলোকক্কাস অরিয়াস–এর সাথে, যা নিরক্ষীয় অঞ্চলে স্বাস্থ্যবান মানুষের দেহে পায়োমায়োসাইটিস নামে একটি পেশীস্ফীতি ঘটায়। তাছাড়া স্ট্যাফাইলোকক্কাস অরিয়াস এমন একটি ব্যাকটেরিয়া যা মানুষের দেহে ব্যাকটেরেমিয়া ঘটাতে সক্ষম। ব্যাকটেরেমিয়া হল রক্তে ব্যাকটেরিয়াল কলোনি ছড়ানোর শারীরবৃত্তীয় পরিঘটনা। এর সাথে তিনি টাইপ টু হিউম্যান ইমিউনোডেফিসিয়েন্সি ভাইরাসের ডিএনএ স্ট্র্যান্ড আর একটি কম্পোনেন্ট হিসেবে যুক্ত করেন। তারপর সেই গোলমেলে, দীর্ঘ ডিএনএ–টিকে স্টেবল করার জন্য অপেক্ষাকৃত বৃহৎ প্লাসমিড যুক্ত একটি ব্যাকটেরিয়ার সাহায্য নেন। এটাই ছিল দ্বিতীয় কঠিনতম নির্বাচন। ভেক্টর ব্যাকটেরিয়াটিকে স্বাভাবিক পরিবেশে টিকে থাকার উপযোগী হতে হত, এবং জল ও বায়ু, যেকোনো মাধ্যমে ছড়িয়ে যাওয়ার উপযুক্ত হতে হত। সার্বিক সর্বনাশের কোনও প্রেত যেন তাঁর ওপরে ভর করেছিল; উন্মাদের মত কাজ করে গিয়েছিলেন তিনি। যে কাজ একটা গোটা টীম–এর পক্ষেও সাত–আট মাসে করে ফেলা যথেষ্ট চ্যালেঞ্জিং, সেই কাজ তিনি একা, ওই সময়ের মধ্যে করে ফেলেছিলেন। সাড়ে চার মাসের মধ্যেই ক্লারা ম্যাথুকে বিয়ে করেছিল; তাঁর মনেও নেই তিনি কি বলেছিলেন নিমন্ত্রণ গ্রহণ করার সময়। শুধু এটা মনে আছে, নিমন্ত্রণ হোক অথবা প্লাম্বিং–এর কাজ করতে আসা প্রফেশন্যাল, কুণালের মনে হতে আরম্ভ করেছিল, আসলে তিনি গভীরভাবে বিশ্বাস করতেন যে সব্বাই তাঁর কেচ্ছাটা জানে, আর জিভে–জল–আনা কেচ্ছাটা হল একটা বাদামী চামড়ার কুদর্শন ভারতীয়ের শ্বেতাঙ্গিনী সুন্দরীকে জীবনসঙ্গিনী করার অসম্ভব হাস্যকর ফ্যান্টাসি এবং সেটার ততোধিক মজার ভেঙ্গে–পড়া। কুণাল বিলক্ষণ বুঝতেন সকলেই এটা নিয়ে মনে মনে হাসছে, তাঁকে নিয়ে কাফেটেরিয়াতে টিটকিরির হররা উঠছে, তিনি আসলে সবাইয়ের কাছে একটা মানসিক রোগগ্রস্ত ভাঁড়, আর সকলে স্বাভাবিক ব্যবহার করে দেখতে চাইছে লোকটা কেমন করে রিঅ্যাক্ট করে! কিন্তু তিনি সমস্ত বুঝেও না বোঝার ভান করে চলতেন। কাজেই সক্কলের সামনেই তিনি একটা মুখ–এঁঠো করা হাসি ঝুলিয়ে রাখতেন। না, নেমন্তন্নে যাননি তিনি। সবাই যখন নবদম্পতির পার্টিতে শুভেচ্ছা বিতরণে ব্যস্ত, তিনি তখন ক্ষুভিত প্রেতাত্মার মতো একা ঘুরে ঘুরে বেরিয়েছেন ফাঁকা, সুনসান করিডোরে, বিড়বিড় করে অভিসম্পাত দিয়েছেন সক্কলকে, তাঁর লক্ষ্য আর কেবল প্রাক্তন প্রেমিকা এবং ম্যাথু ছিল না; তিনি সর্বনাশ চেয়েছিলেন সবাইয়ের, মানুষ নির্বিশেষে। এখন তাঁর মনে হয়, এত প্রকান্ড, সর্বগ্রাসী ঘৃণা তাঁর ছোট্ট শরীরে তিনি সংহত করেছিলেন কি করে!
ক্লারা তার বারো দিনের মধুচন্দ্রিমা কাটিয়ে আসারও প্রায় চার মাস পরে তিনি প্রথম একটা স্টেবল ভেক্টর ব্যাকটেরিয়া পেলেন যা স্বাভাবিক পরিবেশেও দিব্যি টিকে থাকতে পারে এবং তার ভয়াবহ ‘পেলোড’ টার্গেট হোস্টের ইমিউন সিস্টেমে ঢুকিয়ে দিতে পারে। এর থেকে রক্ষা পাওয়া, বিশেষত আক্রমণ হতে চলেছে সেটা না জানা থাকলে, অসম্ভব। কুণাল ব্যাপারটাকে এমনভাবে প্রোগ্রাম করেছিলেন যে ব্যাকটেরিয়া শ্বাসের সাথে ফুসফুসে সংক্রমণ ঘটাবে, কিন্তু প্যাথোজেন–এর ফাঙ্গাল আক্রমণ ততক্ষণ পর্যন্ত ঘটবে না যতক্ষণ পর্যন্ত হোস্টের শরীরে ব্যাকটেরেমিয়া না ঘটে যায়। তারপর কাজ করতে আরম্ভ করবে হোস্টের শরীরে ইমিউনোডেফিশিয়েন্সি ঘটানোর এলিমেন্টটি। এই দুটো ঘটনা যাওয়ার পর, হোস্ট যখন বুঝতে পারবে সে অসুস্থ এবং অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়া আরম্ভ করবে, তখন করডাইসেপস ইউনিল্যাটারালিসের খেলা আরম্ভ হয়ে গেছে। স্ট্যাফাইলোকক্কাস অরিয়াসের ব্যাকটেরেমিয়া আর টাইপ টু এইচআইভি–র তৈরী ব্যাপক এবং আকস্মিক ইমিউনোডেফিশিয়েন্সি কাজে লাগিয়ে সে সুষুম্নাকান্ডকে আক্রমণ করবে আর ঠিক সেই ঘটনাগুলি পরপর ঘটতে থাকবে যেগুলি আক্রান্ত পিঁপড়ের ক্ষেত্রে ঘটেছিল। কুণাল এই স্বহস্তকৃত মহাবিষের সাতটা ভায়াল শহরের কয়েকটা উঁচু জায়গা থেকে দূরে ছুঁড়ে দিলেন এবং বিশেষভাবে কাস্টোমাইজড একধরনের ল্যাবরেটরি মাস্ক পরে নিলেন। তিনি জানতেন সঙ্গে–সঙ্গেই ইনফেকশন আরম্ভ না হলেও খুব বেশী দেরীও হবে না, ঘন্টাখানেক সময় লাগবে ভেক্টর ব্যাকটেরিয়ার অ্যাক্লিমাটাইজেশন প্রসেস শেষ হতে, যদিও হোস্টের মধ্যে লক্ষণ প্রকটিত হতে সময় লাগবে ছিয়ানব্বই ঘন্টারও কিছু বেশী। এ সমস্ত হিসেবই প্রোজেকশন মাত্র, আসলে ঠিক কি হবে সেটা জানার তো কোনও উপায়ই ছিল না যেহেতুএটা একটা সম্পূর্ণ নতুন ধরনের প্যাথোজেন, আর কুণাল নিজেই তখনও কোনও অ্যান্টিডোটের কাজ আরম্ভ করেননি। এখন তাঁর বারবার মনে হয়, তিনি কি আদৌ বুঝতে পেরেছিলেন যে ঠিক কি মারণযজ্ঞ তিনি আরম্ভ করলেন, বা এর শেষ ঠিক কোথায়? জিনিসটা তৈরী করার সময়ও তো কোনও লাইভ হোস্ট তিনি পাননি, পুরোটাই সিম্যুলেশন যার প্যারামিটারস তাঁর নিজেরই সেট করা! পরপর তিনদিন ‘নেজাল ইনফেকশন’ কারণ দেখিয়ে ছুটি নিয়ে তিনি চার দিনের মাথায় ওই মাস্ক পরেই অফিসে গেলেন। তাঁর বিচারবুদ্ধিতে, এই বাহাত্তর ঘন্টায় কেবল এই অফিস নয়, প্রায় আড়াইশো বর্গকিলোমিটারের মধ্যে প্রত্যেকেই এর মধ্যে কোনও না কোনও ভাবে ভেক্টর ব্যাকটেরিয়ার সংস্পর্শে এসেছে। তাঁর উদ্ভট মুখোশ অনেকেই দেখছিল আর নিজেদের মধ্যে কিসব বলাবলি করছিল। রিসেপশনের ফ্রিডা একবার ঠোঁট টিপে হাসল না? মরণশীল মানুষগুলোর দিকে তাকিয়ে, তাদের অনুসন্ধিৎসু চোখগুলোকে অগ্রাহ্য করে, একগলা ঘৃণা ভেতরে নিয়ে কুণাল ধীর পায়ে নিজের ল্যাবে গিয়ে দরজা ভেতর থেকে লক করে দিলেন। পরিকল্পনামাফিক ধীরে–ধীরে জড়ো করা প্রায় বছর খানেকের মতো খাবার আর সীলড মিনারেল ওয়াটার ল্যাবের ভেতরে জমা করা ছিল। কুণাল জানতেন প্রায় সর্বক্ষণ তিনি ল্যাবেই থাকেন বলে প্রথম চব্বিশ ঘন্টা কারো কোনও সন্দেহই হবে না। তিনি ইচ্ছে করেই বিগত এতগুলো মাস ধরে ল্যাবে আসা আর সেখান থেকে বেরোবার সময় উল্টোপাল্টা করে দিয়েছিলেন যাতে করে তাঁর গতিবিধি নিয়ে কোনও নির্দিষ্ট ধারণা না করা যায়। যখন থেকে এই ভেতর–থেকে–বন্ধ ল্যাব নিয়ে কৌতূহল আরম্ভ হবে, তখন ব্যস্ত হয়ে পড়ার মতো আরও অনেক কিছুই আরম্ভও হয়ে যাবে। কুণাল যেমন ভেবেছিলেন, ব্যাপারগুলো ঠিক তেমনই ঘটতে লাগল। তিনি ল্যাবের ভেতরে ছিলেন বলে বিশেষ কিছুই বুঝতেও পারছিলেন না। প্রায় চব্বিশ ঘন্টা নিজের সেলফোন তিনি বন্ধ রেখেছিলেন। যখন খুললেন তখন থেকেই টানা ফোন আসা আরম্ভ হল। তার মধ্যে ক্লারার, ডিডি–র, কাফেটেরিয়ার যে ছেলেটিকে ভালো টিপস দিতেন এবং যে তাঁকে এক্সট্রা চিজ দিত বিনে পয়সায় তার, এমনকি দেশ থেকেও অনেক ফোন আছে। স্থিরদৃষ্টিতে ফোনের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে সেটাকে সাইলেন্ট করলেন তিনি। তারপর টিভিটা খুললেন। এবং পাথর হয়ে গেলেন।
তিনি এক মহামারী সৃষ্টি করেছেন। বিউবোনিক প্লেগ এর কাছে দুগ্ধপোষ্য শিশু মাত্র। যা ভেবেছিলেন, তার থেকেও অনেক বেশী দ্রুতগতিতে ইনফেকশন ছড়াচ্ছে। সেন্ট গ্যালেনের ১০০% মানুষ ইনফেক্টেড। যুবক, বৃদ্ধ, নারী, শিশু, কেউ বাদ নেই। ইনফেকশন দাবানলের মত সুইজারল্যান্ড এবং মধ্য ইয়ুরোপ জুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে। আন্তর্মহাদেশীয় সড়ক, বিমান ও রেল পরিষেবা বন্ধ করে দেওয়া হলেও কুণাল জানেন, বিগত বাহাত্তর ঘন্টায় যা হওয়ার হয়ে গিয়েছে। কারণ প্যাথোজেনের ইনফেকশন রেট একশো শতাংশ, যেহেতু মানুষের নিজস্ব ইমিউন সিস্টেম এইরকম মারাত্মক অণুজীবের মোকাবিলা করার জন্যে আদৌ প্রস্তুত নয়। ফলে ওই সময়ে যারা যারা বাইরে গেছে তারা নিজেরাও সংক্রমণ ছড়িয়েছে এবং তাদের দ্বারা সংক্রামিত ১০০% মানুষই সেটাকে আবার ছড়িয়েছে। নিজের তৈরী সিম্যুলেশন দেখে কুণালের চোয়াল ঝুলে গিয়েছিল যখন তিনি দেখেছিলেন যে এটার আর–নট (R0) ফ্যাক্টর পঁয়ত্রিশের ওপরে! এটা এতাবৎ পর্যন্ত জানা সবথেকে ছোঁয়াচে রোগের আর–নট ফ্যাক্টরের দ্বিগুণ! মানুষজন কাশতে কাশতে হামাগুড়ি দিয়েও হাসপাতালে যাওয়ার চেষ্টা করছে প্রথম স্তরে, প্রবল জ্বর এবং অস্বাভাবিক পেশীস্ফীতি ঘটছে দ্বিতীয় স্তরে, এবং রোগের কেবল এই দুটি পর্যায়ের দৃশ্যই মানুষকে আতঙ্কে উন্মাদ করে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। কিন্তু আসল বীভৎসতার ঘটনা ঘটছে তৃতীয় স্তরে যেখানে ফাঙ্গাস ধবংস–হয়ে–যাওয়া ইমিউন সিস্টেমের শরীরের দখল নিচ্ছে এবং সেই মৃতপ্রায় শরীরগুলির মস্তিষ্ক ‘খেয়ে’ ফেলে তাদের অঙ্গ–প্রত্যঙ্গকে নিয়ন্ত্রণ করছে। হেলিকপ্টার থেকে জুম–করা ক্যামেরা দেখাচ্ছে কেমন করে ভেজিটেটিভ স্টেটে চলে যাওয়া মানুষের শরীরগুলো কেবল ইতস্তত ঘুরে বেড়াচ্ছে কোনও শক্ত জায়গায় বারবার মাথা ঠুকে সেটাকে ফাটিয়ে মাটিতে পড়ে যাওয়ার আগে, এবং ফেটে–যাওয়া মাথা থেকে বেরিয়ে আসছে হলদেটে, রক্তমাখা ছোট্ট ছোট্ট স্পোর। সেগুলো সংক্রমণ আরও দ্রুতহারে ছড়াচ্ছে যা থেকে এমনকি গোরু, বেড়াল বা কুকুরের মতো অন্যান্য স্তন্যপায়ী প্রাণীও বাদ যাচ্ছে না। ল্যাবের দরজায় বেশ কয়েকবার জোরে–জোরে আঘাত শুনতে পেয়েছেন তিনি, কিন্তু তার বেশী কিছু নয়। আসলে কেউই কিচ্ছুটি বুঝতে পারেনি। পারলে, কুণাল নিশ্চিত, তাঁকে টেনে বাইরে বের করে মেরে ফেলা হত। অবশ্য বাইরে একবার বেরোলে আর আলাদা করে মারার কোনও প্রয়োজনই থাকে না।
ক্যামেরা বেশী চলেনি। মাত্র দুই সপ্তাহের মাথায় আর কোনও নিউজ চ্যানেলই কিছুই ব্রডকাস্ট করছিল না স্ট্যাটিক ছাড়া। তার মধ্যে কুণাল অনেক কিছুই দেখেছেন। উন্মাদের মত কাশতে থাকা মা’কে মস্তিষ্ক বিলুপ্ত হয়ে–যাওয়া সন্তানকে আঁকড়ে ধরে হাঁপাতে–হাঁপাতে চিৎকার করতে দেখেছেন, ব্যক্তিত্ব লুপ্ত–হয়ে যাওয়া দুটো মানুষের শরীরকে পরস্পরকে কামড়ে খেতে দেখেছেন, ফাঙ্গাসের নিয়ন্ত্রণে থাকা মানুষ ও পোষ্যদের বহুতলের জানলা দিয়ে কাঁচ ভেঙ্গে ভাবলেশহীন মুখে, নীরবে লাফিয়ে পড়তে দেখেছেন, ভাবলেশহীন ড্রাইভারকে রাস্তায় শুয়ে কাতরাতে–থাকা শয়ে–শয়ে মানুষের ওপর দিয়ে গাড়ি সজোরে চালিয়ে নিয়ে গিয়ে কোনও বাড়ির দেওয়ালের মধ্যে ঢুকিয়ে দিতে দেখেছেন, বড় বড় হাইরাইজকে দাউদাউ আগুনে জ্বলে যেতে দেখেছেন – তালিকা শেষ হবে না। শেষের দিকে নিজেকে যন্ত্র মনে হত। নিজেকে ঘেন্না করতেও আর ইচ্ছে হত না। কি হবে? তার থেকে যতক্ষণ আছেন, একটা কাজ অন্তত করে যাওয়া যাক! শেষ মহাগুরুত্বপূর্ণ কাজ। এমনটা কি হতে পারে, কেউ কোত্থাও নেই? অ্যামাজনের অরণ্যে, কুমেরুর কাছে, তিব্বতের কোনও দুর্গম মনাস্ট্রিতে, সাইবেরিয়ার মাঝখানে, জাইর নদীর অববাহিকার কোনও কুঁড়েঘরে অথবা সেন্ট্রাল প্যাসিফিকের কোনও বিন্দুবৎ দ্বীপে; সব্বাই মরে গেছে এমনটা কি করে হতে পারে! সেই আশাতেই বুক বেঁধে কুণাল একটা অ্যান্টিডোটের একের পর এক সিম্যুলেশন করে চলেছেন। এখনো পর্যন্ত কোনোটাই স্টেবল এবং কার্যকরী বলে প্রমাণিত হয়নি। এই যন্ত্র আর তিনি। এভাবেই আছেন। এক নিদারুণ নৈঃশব্দের ঘেরাটোপে। নিজের টার্মিনাল আর সেলফোনে তিনি এভি ফাইল চালিয়ে দেন যখন মানুষ দেখা বা শোনার দরকার হয়। কিন্তু এভাবে আর বেশীদিন চলতে পারে না। তিনি আর পারছেন না। একটা মানুষ দরকার যার হাত ধরে তিনি দুটো কথা বলতে চান। কারো দেখভাল ছাড়া ইলেক্ট্রিক্যাল সিস্টেমও ক’দিন ঠিক থাকবে, জল কতদিন পাবেন, এয়ার কন্ডিশনিং কতদিন আর কাজ করবে, তা তিনি জানেন না। অ্যান্টিবডি তৈরী করার ওপরে তাঁর বাঁচা–মরা নির্ভর করছে, কিন্তু সেটা অতি সামান্য বিষয়। আসল কথা হল, যদি ধরে নেওয়াও হয় কয়েকজন এখনও বেঁচে আছে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে, হয়তো বা তাঁরই মতো মাটির তলায় কিংবা কোনও কন্ট্রোলড এনভায়রনমেন্ট–এ, তারা আর বেশীদিন বাঁচতে পারবে না এভাবে। কোনও সিস্টেমই সেল্ফ সাস্টেনেবল নয়। বেরোতে তাদের হবেই। তখন এই অ্যান্টিডোট ছাড়া তারাও সঙ্গে সঙ্গেই ইনফেক্টেড হবে এবং…
কুণাল এই ক’দিনে অজস্র দাগ ধরে–যাওয়া চশমাটা খুলে আবার মুছে পরলেন। সিম্যুলেশন পুরো রান করার দরকার নেই, তিনি বুঝতেই পারছেন এটাও কাজ করবে না। আসলে প্যাথোজেনটা নিজেকে পাল্টাচ্ছে। নিয়মিতভাবে। তাঁর সন্দেহ হল জিনিসটা বুদ্ধিমান হয়ে পড়েছে কি–না। তিনি আবারও বেশ বুঝতে পারলেন,এটাই আসল শাস্তি। একলা, একদম একলা, গোটা পৃথিবীর মানুষের মৃত্যুর দায়ভার কাঁধে নিয়ে সজ্ঞানে তাঁকে মরতে হবে। বেশ ওপরের মোটা কাঁচের জানলাটার বাইরের ফ্যাকাসে আলো আর কাঁচের ওপারে জলের ফোঁটার দিকে তাঁর চোখ গেল। বৃষ্টিই হচ্ছে তাহলে কাল থেকে! কুণালের দুচোখ দিয়ে উষ্ম জল গড়িয়ে পড়ল। এখনও বৃষ্টি হয়!
Tags: এখনও বৃষ্টি হয়!, কল্পবিজ্ঞান গল্প, কল্পবিজ্ঞান গল্প, দিগন্ত ভট্টাচার্য, দ্বিতীয় বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা, পূজাবার্ষিকী, সুপ্রিয় দাস
সুন্দর গল্প। বেশ ভালো।